শেষ হয়ে যায় বসন্তের দিন

শেষ হয়ে যায় বসন্তের দিন 

নিজের ছোট কুঠুরিতে একা একা বসে থাকেন গালিব। চেষ্টা করেন কিছু লিখতে। হয়ে ওঠে না ঠিকমতো। 

এখনও শহরের অবস্থা ঠিক হয়নি। পুরো শহরই তছনছ হয়ে আছে। মানুষেরা কলের পুতুলের মতো দিন কাটাচ্ছে। মাঝে মাঝে শহর কেঁপে ওঠে সৈনিকের বুটের শব্দে। সেই শব্দ তাকেও যে চমকে দেয় না, তা নয়। 

স্বস্তি এটুকুই যে জীবন আবার একটা ছকে এসেছে। রামপুরের নওয়াবের দেয়া বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্রিটিশ সরকারের পেনসন। ধারের বোঝা কমে এসেছে, এটাও স্বস্তির কারণ। ভাবেন, যেটুকু বাকি আছে তা আস্তে আস্তে শোধ হয়ে যাবে। যাবে কি? ভয়তো নিজেকে। বন্ধুদেরতো অনরবত লিখেন যে, মরতে ভয় পাই না, কিন্তু আরামের অভাব শঙ্কিত করে। আরাম ছাড়া বাঁচতে চাই না। আর প্রতি রাতে চাই শরাব। শরাবের ব্যবস্থা হয়েছে এ জন্য হাজার শোকর। 

কষ্ট একটা যে বন্ধুদের সঙ্গে আগের আড্ডা আর বসে না। আড্ডা ছাড়া তাঁর জীবনতো পানিবিহীন মাছের মতো। ডাঙায় পড়ে তড়পাতে হয় শুধু। বসে বসে কাগজে আঁকিবুকি কাটলেন আর বন্ধুকে লিখলেন, গভর্নর জেনারেল দিল্লি আসবেন শুনেছি। আগের বারের দরবারের সময় ছয়জন জায়গীরদার নিজের নিজের দরবার বসিয়েছিলেন। তারা হলেন ঝর্ঝর, বল্লভগড়, ফারুকনগর, দোজানা, পাতৌদি ও লোহারু। প্রথম চারটি রাজ্যইতো সিপাহী বিদ্রোহের সময় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। দোজানা আর লোহারু হানসি-হিসার পরগণার প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। যে রাজ্যটি রক্ষা পেয়েছে সেটি হলো পাতৌদি। বন্ধু তোমাকে এটা বুঝতে হবে যে হিসার-পাতৌদি ও লোহারু কমিশনার যদি দুজন নওয়াবকে সঙ্গে করে নিয়ে যান তাহলে মনে করতে হবে যে তারা হলেন আসলে তিনজন। মুসলিম অভিজাতদের মধ্যে মাত্র তিনজন জীবিত আছেন। একজন দিল্লিতে মোস্তফা খান, আর একজন সুলতানজীতে মৌলভী সদরুদ্দিন। অন্যজন বল্লিমাঁরো মহল্লার এই অধম, যাকে হিন্দুস্থানের মানুষ আসাদ বলেই চেনে। এঁরা সকলেই ছিল অভিযুক্ত, অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত এবং আঘাতে আঘাতে জর্জরিত 

এটুকু লিখে নিজেকে মৃদু ধমক দিলেন তিনি। 

তুমিতো এখন ভালো আছো মির্জা নওশা। কেন অতীত খোঁড়। 

আহ, আমি এই ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত হৃদয় কার কাছে জিম্মি রাখব? কে এর দায় নেবে? 

কেউ না। ভার বইতে হবে তোমাকেই। 

আমি আমার বন্ধুদের দেখতে চাই। আড্ডা চাই। কবিতার মুশায়রা চাই।

হাঃ হাঃ হাঃ…। হাসছো কেন? 

ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় শব্দ। গালিব নিঃশব্দ বসে থাকেন। বাজুক, দু’কান ভরে বাজুক দিল্লির যাবতীয় শব্দরাজি। 

ছুটে আসে কাল্লু মিয়া।

হুজুর। 

গালিব নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকান। 

ব্রিটিশ সৈন্যরা জামা মসজিদ ছেড়ে চলে গেছে হুজুর। 

গালিবের ভুরু কুঁচকে যায়। তিনি চোখ বড় করে তাকান। 

নামাজের জন্য জামা মসজিদ খুলে দিয়েছে হুজুর! 

কাল্লু মিয়ার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। 

আমরা আজকে জামা মসজিদে নামাজ পড়তে যাবো। বাকির, হুসেনও যাবে।

ওদের কি টুপি আছে কাল্লু মিয়া? 

আমি এখন ওদের জন্য টুপি কিনতে যাবো। বেগম সাহেবা রুপিয়া দিয়েছেন হুজুর। 

আচ্ছা যাও। 

কাল্লু মিয়া দু’পা এগোলে তিনি পেছন থেকে ডাকেন। 

কাল্লু শোন। 

জ্বী হুজুর। 

আমার শরাব কয় বোতল আছে? 

সতের বোতল হুজুর। 

গোলাপ জল? 

কালু ঘাড় নেড়ে বলে, মজুদ আছে। বহুত আচ্ছা। যাও। 

গালিবের মনে হলো তাঁর নিঃসঙ্গতা মুছে যাচ্ছে। তিনি আশ্রয় খুঁজে পেয়েছেন। নিজেকে এখন আর পরিত্যক্ত আঘাত-জর্জরিত মানুষ মনে হচ্ছে না। অনেক কাল আগে এমন একটি সময় ছিল তাঁর জীবনে, এখন সেই সময়টা অন্ধকারে ডুবে গেছে। তিনি আলোর দেখা পাচ্ছেন। দিনের প্রথম আলোয় ভরে গেছে তাঁর ঘর। 

সেদিন বিকেলে আলতফ এলেন। 

কি খবর হালি? 

খবর? খবরতো এখন প্রতিদিনই জন্ম নেয়। খবরের কি শুরু বা শেষ আছে। 

বোস। 

কি করছেন? দিন গুনছি। 

কবিতা লেখা? 

হয় না। দিনগুলো বুকের ওপর বোঝা হয়ে আছে যে! 

চিঠি লিখছেন না? 

লিখছি। কিন্তু তেমন জবাব পাচ্ছি না। আমার চিঠি ঠিকমতো প্রাপকের কাছে পৌঁছাচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ লাগছে। মনে হচ্ছে ডাক বিভাগের পরিষেবা এখনো ঠিক মতো দাঁড়ায় নি। বন্ধই হয়ে আছে কিনা কে জানে। ডাকহরকরাদের যাতায়াত করাইতো কঠিন হয়ে গেছে। নাকি? তুমি কি চিঠি পাও হালি? 

পাচ্ছিতো কিছু কিছু। 

তাহলে আমি যাদের লিখছি তারা আমাকে লিখছে না। হয়তো নানা ঝামেলায় আছে। 

সেটাই হবে। আপনি লিখতে থাকুন। তুফতা আর আরামতো আপনার উর্দু চিঠির সংকলন ছাপতে চেয়েছিল। 

আমি রাজী হইনি। উর্দুতে লেখা চিঠিগুলোতে ফারসির মতো সাহিত্য গুণ নেই। 

আপনার এখন ঘুম হয়তো? যদিও বিদেশী মদ এখনও পাওয়া যায় না।

তাতে অসুবিধা হচ্ছে না। যা পাচ্ছি তাই যথেষ্ট। বহুকালের অভ্যেসতো। আর ছাড়তে পারবো না। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এভাবেই চলবে। 

আলতফ কিছু বললো না। 

গালিব ছটফটিয়ে উঠে বললেন, আড্ডা হারিয়ে আমি খুবই মুষড়ে পড়েছি। তোমার সঙ্গে কথা বলছি ঠিকই কিন্তু জমছে না। আশৈশব যাদের সঙ্গে কাটিয়েছি তারা সব কে যে কোথায় ছিটকে পড়লো, হায় খোদা। 

তাঁর বেদনার্ত কণ্ঠস্বর ছুঁয়ে যায় আলতফকে। বুঝতে পারেন একজন কবি অন্য কবিদের সাহচর্যের অভাব খুব বোধ করছেন। যাদের সঙ্গে তিনি দীর্ঘ বছর ধরে সাহিত্য আলোচনা করেছেন, কবিতা পরিমার্জনা করেছেন, আবেগ এবং বুদ্ধির জায়গা থেকে খোশগল্প করেছেন, তাঁরা আজ নেই। এই একাকীত্ব তাই তাঁকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। আলতফ মৃদুস্বরে ডাকে, ওস্তাদজী 

গালিব চোখ মুছে তাকান। 

যাঁরা নেই ওরা আমার হৃদয়ের সাথী ছিল হালি। 

আমি বুঝতে পারছি ওস্তাদ। 

আরও একটা জিনিস আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। 

গালিব দু’হাতে চোখ মুছে স্থিত হন। 

কিসের কষ্ট? 

কষ্টতো অনেক। ইংরেজদের বিজয়ের পর থেকে এই শহরটাকে খালি করার কাজ শুরু হয়ে গেছে। এখন যেটুকু অবশিষ্ট আছে তা দিয়ে দশ বছর আগের সময়কে খুঁজে পাওয়া যাবে না। 

গালিব কুঁজো থেকে পানি ঢেলে নিজে এক গ্লাস খান। আলতফকে এক গ্লাস দেন। আলতফ কথা বলতে পারছিলেন না। গালিবের ভাবনার সঙ্গে নিজের ভাবনা মিলিয়ে দেখেন। বোঝেন, কথাগুলো খুবই সত্যি। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যাবে না। 

গালিব আরও বলেন, আর একটি কঠিন সত্য আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। আস্তে আস্তে ঘটবে। তবে ঘটবেই। সেটা দেখার জন্য আমি বাঁচবো না, তুমিও হয়তো থাকবে না। কিন্তু দেখবে আমাদের পরের বংশধররা। 

খুলে বলুন ওস্তাদজী। আমার ভয় করছে। 

ভয়তো করবে। কারণ যে সংকট তৈরি হচ্ছে সেই সংকট মোকাবেলা করার সাধ্য অভিজাতদের নাই। দিল্লি শহর থেকে তাদের ছিটকে ফেলে দেয়া হচ্ছে। দিল্লি শহর চলে যাচ্ছে বণিক শ্রেণীর দখলে। 

কীভাবে? আলতফের কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে যায়। 

ভেবে দেখো যে জায়গীরদাররা বিদ্রোহের পক্ষে ছিল তাদের মেরে ধ্বংস করা হয়েছে। যারা ভূ-সম্পত্তির মালিক, বিদ্রোহীদের সহযোগিতা করেছে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে ব্রিটিশরা। এরা এসব আর ফিরে পাবে না। তাহলে বোঝ অভিজাতরা সর্বস্বান্ত হয়েছে। 

আলতফ স্তব্ধ হয়ে কথা শোনেন। চুপ করে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন গালিবের দিকে। 

গালিব আবার পানি খেয়ে বলেন, যেসব বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে ব্রিটিশরা তাদের ক্ষতিপূরণ দেবে ঠিক করেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের পরিমাণও স্থির করেছে। যারা ক্ষতিপূরণ পাবে তাদের টিকিট দেয়া হয়েছে। 

আমিতো জানি। আমার পরিচিত অনেকে টিকিট পেয়েছে। এই টিকিট দেখালে ওরা বাজেয়াপ্ত করা জমিতে বাড়ি বানাতে পারবে। 

গালিব তীক্ষ্ণ চোখে তাকান আলতফের দিকে। বলেন, বাড়ি বানানো কি এতো সোজা? যেটুকু টাকা পেয়েছে ওই দিয়ে কি বাড়ি হবে? 

তা হবে না। ওদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। সবাই মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। ক্ষতিপূরণের টাকায় নতুন বাড়ি হবে না। 

গালিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, যারা ঘরবাড়ির মালিক ছিল তারা হয়ে গেল ফকির। আর কিছু সংখ্যক মানুষ খুবই কম দামে বিশাল জমির মালিক হয়ে যাচ্ছে। আর ব্রিটিশরা বাকি যে জমির নিলাম ডাকল সেগুলোও কিনে নিল বণিকশ্রেণীর মানুষেরা। এখন বল কি দাঁড়াল এই শহরে? 

আলতফ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, সাবেক অভিজাত শ্রেণীর মানুষের বদলে লুটতরাজেরা জায়গা করে নিল ব্রিটিশ বেনিয়াদের ছত্রচ্ছায়ায়। 

হাউমাউ করে কেঁদে উঠল আলতফ হুসেন হালি। গালিব চুপ থেকে বললেন, এখন আমাদের চোখের জল ফেলার ইতিহাস তৈরি হচ্ছে হালি। সত্যকে মেনে নিয়ে চোখের জল মোছ। 

চোখের জল মুছতে আলতফের সময়ই লাগল। দু’হাতে মুখ ঢেকে মাথা চেপে বসে রইলেন। 

গালিব বলতে থাকেন, একদিন আমার পূর্বপুরুষেরা সম্পদে ও সম্মানে অভিজাত মানুষ ছিলেন। আমি নিজেও ছিলাম তাঁদের মধ্যে একজন। সেই অবস্থানের স্বীকৃতি অনুযায়ী সম্মানসূচক রাজন্য ভাতা পেতাম। যে পরিমাণ সম্পত্তিতে আমার মালিকানা স্বীকৃত ছিল তার পরিমাণ ছিল অনেক। আমার ঐশ্বর্যভরা অতীতের কথা আমি এখন নিজেই 

ভুলে যাই আলতফ আবার শব্দ করে কেঁদে ওঠেন।

তুমি কি আমার কথা শুনে কাঁদছো? 

এ অবস্থা আপনার একার না। আমি সবার জন্য কাঁদছি। 

আর আমি কেঁদেছি সইফতা আর ফজল হকের জন্য। ওহ আমার প্রিয় দুজন মানুষ। ওহ্ আমার সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী। আমার চারপাশে আর কেউ থাকল না। আমি কার কাছে গিয়ে মনের কথা বলব। 

আলতফ চোখ মুছে সোজা হয়ে বসেন। যে দুটো নাম গালিব উচ্চারণ করেছেন তাঁদের জন্যও তাঁর বুকের ভেতরে হাহাকার আছে। দু’জনে কবি, বিদ্বান মানুষ। সজ্জন মানুষ। তাঁদের আচার-ব্যবহারের তুলনা হয় না। আলতফের মনে হয় ওর বুকের ভেতরে গুড়গুড় করছে। ওর দম ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। 

গালিব আলতফের হাত ধরে বলেন, তুমি বলো আলতফ নওয়াব মুস্তাফা খাঁ, যাঁকে আমরা সইফতা ডাকি, তাঁকে সাত বছর কারাদণ্ড দেয়া হলো। আর কোনো দিন কি তাঁর সঙ্গে দেখা হবে? আমি আর কয়দিনই বা বাঁচবো! 

আলতফ জোর দিয়ে বলেন, সাত বছর বেশি সময় নয় ওস্তাদ। আপনি বাঁচবেন। আমাদের সবার প্রার্থনা আছে আপনার আয়ুর জন্য। 

আহ থাম হালি। মনে হয় সইফতার সঙ্গে আমার দেখা হলেও হতে পারে, কিন্তু ফজল হকের সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে না। 

হ্যাঁ, তাঁকে তো দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়েছে। আজীবনের নির্বাসন! ওহ!

আলতফের কণ্ঠে আবার অস্ফুট ধ্বনি। গালিব সে ধ্বনির অনুরণন নিজের ভেতর অনুভব করেন। 

একদিন সইফতার বাড়িতে যাই তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য। বাড়ির সামনের কার্নিশের নিকট বেশ অন্ধকার ছিল। আমি কার্নিশের নিচে দিয়ে তাঁর বৈঠকখানার দিকে এগিয়ে দেখলাম তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন আমাকে স্বাগত জানানোর জন্য। আমি তাঁকে দেখে বললাম, বেহেশতের অমৃত ঝরণাতো অন্ধকার ফাঁক করে বের হয়। তিনি মৃদু হেসে আমার হাত ধরে বললেন, শুকরিয়া হজরত। 

বৈঠকখানার বারান্দাটা ছিল পূর্বমুখী। ঘরে ঢুকে বারান্দার দিকে চোখ পড়তেই মন ভরে যায়। রোদের আলোয় ভেসে আছে বারান্দা। উৎফুল্ল হয়ে বললাম, ‘ঈ খানাতমাম আফতাব অস্ত’-সারা ঘরে শুধু সূর্য আর সূর্য।’ দেখলাম তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বিনয়ের হাসিতে ভরিয়ে দিল আমাকে। আমি যে তাঁকে প্রশংসা করেছি তা বুঝতে তাঁর একটুও সময় লাগেনি। খুবই বিদগ্ধজন। তাঁকে কারাগারের অন্ধকারে রেখে আমাদের আত্মাকে দমিয়ে দেয়া হয়েছে। 

দুঃখ পাবেন না ওস্তাদজী। 

দুঃখ! দুঃখতো পাবোই। না পেয়ে উপায় কি? উপায় নেই। একদিন দরবারে বাদশাহ আমার শেরের প্রশংসা না করে আমার আবৃত্তির প্রশংসা করেছিলেন। আমি বুঝলাম বাদশাহ ইচ্ছে করেই আমার গজলের প্রশংসা করেননি। 

সেদিন কেল্লা থেকে বাড়ি ফেরার পথে আমি সইফতার বাড়িতে গিয়েছিলাম। তুমি তো জানো আমি আমার সব পরিচিতজনদের বাড়িতে যাই না। যাঁরা আমার বাড়িতে আসেন আমি শুধু তাঁদের বাড়িতে যাই। সইফতা আমার খুব কাছের মানুষ। আমার মানসিক সংকটে সব সময় তাঁর সাহায্য পেয়েছি। 

গালিবের গলা ধরে এলে তিনি থামলেন। 

কেল্লা থেকে কষ্টভরা মন নিয়ে তাঁর কাছে গেলাম। সইফতাকে বললাম কেল্লার ঘটনা। বাদশাহর কথা। তিনি আমাকে বললেন, বাদশাহ আপনার গজলটি বোঝেননি মির্জা সাহেব। দুঃখ পাবেন না। 

আমি তাঁর সান্ত্বনার ভাষায় মুগ্ধ হই। কত শান্ত স্বরে তিনি আমাকে দুঃখ ভোলার কথা বলেছিলেন। তাঁর সুন্দর কথায় আমার তাপিত হৃদয় শীতল হয়েছিল। 

সেদিন তাঁর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হলো কবিতা নিয়ে। কবিতার সমঝদারি নিয়ে। যে কতক্ষণ সময় সেখানে থাকলাম বুঝলাম তিনি কবিতার কত বড় সমঝদার। তিনি শুধু বিত্ত বৈভবের মালিক না। তাঁর আছে ঐশ্বর্যভরা মস্তিষ্ক, সম্পদ ভরা হৃদয়। এমন মানুষ কমই হয়। 

গালিব থামলেন। আলতফ বুঝলেন যে কবি আসাদুল্লাহ খান গালিব দিল্লি শহরে কবিতার সমঝদারের অভাবে কত কাতর, এমন আর অন্য কিছুতে নয়। কাতর হওয়ার অনেক জায়গা থাকা সত্ত্বেও এই একটি জায়গাই তাঁকে মরমে মারছে। এই মুহূর্তে এর থেকে পরিত্রাণের আর কোনা পথ খোলা নেই। 

গালিব ধীরে ধীরে বললেন, সেদিন আমি সইফতাকে একটি শের শুনিয়েছিলাম। তুমিও শোন : 

‘দিল হি তো হ্যায় না সঙ্গ র খিশত, দর্দ সে ভর না আয়ে কিয়ো?
রোয়েঙ্গে হম্ জার বার, কোই, হঁমে সতায়ে কিয়োঁ? 
এতো হৃদয়ই, ইট-কাঠ-পাথর নয়, দুঃখে কাতর হবে না কেন
কাঁদবো আমি হাজার বার, কেউ দুঃখ দেবে কেন?” 

আলতফের বুকের ভেতর শব্দ গুড়গুড় ধ্বনি তোলে। কেউ দুঃখ দেবে কেন? কেউ দুঃখ দেবে কেন…। দুঃখতো মানুষই দেবে। দুঃখ দেয়ায় আনন্দ আছে। স্বার্থ আছে। দুঃখতো মানুষের কাছ থেকে আসতেই থাকবে। একজন কবিকে এই সত্য বুঝিয়ে দেয়ার সাধ্য কি কারো আছে? কবির দুঃখের কথা কবিকেই বুঝতে হবে। 

কদিন ধরে ফজল হকের চিন্তা গালিবকে খুবই পীড়িত করছে। এমন এক ঘনিষ্ঠজনকে হারিয়ে তিনি তাঁর শোকের মুহূর্ত কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। যাবজ্জীবন দীপান্তর। এমন শাস্তি মানুষ যেন কখনো পায় না! মানুষকে বাঁচতে দিয়ে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দেয়া। এটা শুধু নিষ্ঠুরতা নয়, বর্বরতা। গালিব পায়চারি করেন, পানি খান, লেখার টেবিলে বসেন, চিৎকার করে নিজের শের আবৃত্তি করেন— নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা তাঁর জন্য খুব কষ্ট হয়ে যায়। 

তাঁর উচ্চকণ্ঠ শুনে উমরাও বেগম আসেন। 

কি হয়েছে? 

তিনি থমকে থাকেন। চোখ বড় করে তাকান। উমরাও বেগমের মনে হয় তাঁর বড় চোখের পাতায় গাঢ় অন্ধকার। একফোঁটা আলো নেই। মরে গেছে কি তাঁর স্বামী? এমন মৃত্যুতো তিনি কখনো দেখেননি। তাহলে? 

আবারও বলেন, কি হয়েছে? 

গালিব নিমগ্ন কণ্ঠে বলেন, কিছু না। 

তাহলে চিৎকার করছিলেন যে? 

অভিশাপ দিচ্ছিলাম। 

কাকে? 

বর্বর মানুষদের। 

বর্বর মানুষ? কারা? 

অভিজাত মানুষ হয়ে যাদের কাছ থেকে সরকারি পেনসন নেই। 

ওহ! উমরাও বেগম দু’হাতে মুখ ঢাকেন। 

বিবি আমাদের অনেক কষ্ট। 

হ্যাঁ, কষ্টই তো। লোহারু বংশ শেষ হয়ে গেলো। যেটুকু বাকি আছে তার আয়ু বেশি দিন নেই। 

আমার কষ্ট অন্য রকম। 

গজলের কষ্ট। মুশায়রা না থাকার কষ্ট। 

এই মুহূর্তে একজন বড় মানুষের জন্য কষ্ট। 

ফজল হকের জন্য? 

তুমি কি করে বুঝলে? 

আমার মনে হয়েছে আপনার আশেপাশে যত কবি আছে তার মধ্যে ফজল হকের সঙ্গেই আপনার ভালোবাসা গভীর। তাঁর শাস্তি যাবজ্জীবন দীপান্তর হওয়ায় আমিও খুব কষ্ট পেয়েছি। তার জন্য আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি। 

তাঁর পরামর্শে আমি আমার উর্দু দীওয়ান আবার সম্পাদনা করেছিলাম।

আপনিতো আপনার নিজের গজলের ব্যাপারে কারো কথা শুনেন না।

আমি তাঁকে মান্য করি। তাঁর জ্ঞানকে শ্রদ্ধা করি। তিনি আমাকে বলেছিলেন ব্রিটিশের অধীনে কাজ করার সময় তাঁকে বেশ অপমান করা হয়েছিল। আমি জানি তিনি চেয়েছিলেন মুঘল শাসনের অধীনে পুরনো হিন্দুস্থান আবার ফিরে আসুক। 

উমরাও বেগম বিষয়টি না বুঝে অন্য প্রসঙ্গে যান। বলেন, শহরের মুসলমানরাতো ফিরে আসার অনুমতি পায়নি। 

জানি। পারমিট নিয়ে ওরা শহরে আসা-যাওয়া করে। কিন্তু থাকতে পারে না। 

কবে ওদের অনুমতি দেয়া হবে? 

জানি না। 

উমরাও বেগম যাবার জন্য উঠে দাঁড়ান। বলেন, আপনি কি মিছরির শরবত খাবেন? 

হ্যাঁ, পাঠিয়ে দিও। কাল্লু গোশত আনতে পেরেছে? 

এখনতো আপনি রোজই শামী কাবাব, গোশতের সুরুয়া সবই খাচ্ছেন।

গোশতের অভাবে আমি অর্ধেক মরা হয়ে গিয়েছিলাম। 

আমি তা জানি। আপনার খাবার তো ওই একটাই। গোশত না খেলে— 

গালিব হেসে বলেন, থাক আমাকে আর বাঘের কথা বোল না। আমি বাঘ নই যে গোশত ছাড়া অন্য কিছু খাই না। এই তিন বছর বেঁচে থাকলাম কি করে? বিবি মানুষই পারে মানুষ থাকতে। 

উমরাও বেগম কোনো কথা না বলে বেরিয়ে আসেন। ভাবেন, এই মানুষটির সঙ্গে ঘর করতে করতেই তাঁর দিন ফুরিয়ে গেল। সাতটি সন্তান মরে গেছে। কোনো একজনের জন্মের সময় তিনিও তো মরে যেতে পারতেন, কিন্তু মারা যাননি। মানুষটির সঙ্গে শেষ দিন পর্যন্ত কাটানোর আয়ু খোদাতালা তাঁকে দিয়েছেন। তিনি আর কোথায় যাবেন? না বেহেশতে, না দুনিয়ায় — বাকিটুকু তিনি আর ভাবতে পারলেন না। মন খারাপ হয়ে যায় তাঁর। কেবলই মনে হয় বড় বেশি দুর্ভাগ্যের জীবন কাটিয়েছেন। সুখ তাঁর জীবনে অলীক পাখি। তিনি ঘরের দরজার সামনে এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন। বুক ভরে বাতাস নিলেন। আগ্রার কথা মনে এলো। যমুনা নদী ছবির মতো তাঁর স্মৃতিপটে আটকে আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, শৈশবই সুন্দর ছিল। সুন্দরের দিন বেশি দিনের হয় না। সুন্দর খুব তাড়াতাড়ি মরে যায়। 

তিনি রান্নাঘরে গেলেন। শামী কাবাব তৈরি হচ্ছে। সুন্দর গন্ধ আসছে। তাঁর স্বামী খাবেন সন্ধেবেলা। তারপর মদ। মদ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন। তিনি চুলোর কাছে এসে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকলেন। 

কি হয়েছে মাইজী? 

তিনি চমকে তাকালেন। তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। 

কি হয়েছে মাইজী? 

আজ শুকনো কাঠে এত ধোঁয়া হচ্ছে কেন? 

আজ তো ধোঁয়া কমই হচ্ছে মাইজী। অন্যদিন আরও বেশি হয়। 

ও আচ্ছা। 

আপনি আপনার ঘরে যান মাইজী। আমি বালতিতে পানি দিয়ে আসবো। 

চোখ ধুয়ে ফেলেন। চোখ লাল হয়ে গেছে। 

উমরাও বেগম নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে ভাবলেন, চোখ কি ধোঁয়াতে লাল হয়েছে? ধোঁয়াতো তাঁর চোখ পর্যন্ত আসতেই পারেনি। নিজের জন্য তাঁর খুব মায়া হলো। একটি সন্তানও বেঁচে নেই। তিনি একজন সন্তানহীন নারী। স্বামীর সঙ্গে যে ঘর, এটাও ঠিক ঘর না। জোড়াতালির ঘর। ভালোবাসা কি বুঝলেনই না। বোঝার বয়স কোনোকালে যে ছিল এটাও তিনি ভুলে গেছেন। 

নিজের ঘরের সামনে বারান্দায় দাঁড়ালেন তিনি। নিজের কবি স্বামীর একটি শের মনে করার চেষ্টা করলেন। অনেক শেরই তাঁর মুখস্থ আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছুই মনে আসছে না। তাঁর বুক ফেটে যাচ্ছে। প্রাণপণ চেষ্টা করছেন দুটো পঙ্ক্তি মনে করার। পারছেন না। পারছেন…. 

আম্মা আপনার জন্য পানি। 

রাখো। 

এক আঁজলা পানি মুখে ছিটানোর সঙ্গে সঙ্গে বুক চিরে বেরিয়ে আসে একটি শের : 

‘আমার ঘন নৈরাশ্যের মধ্যে কালের গতি রুদ্ধ; 
যে দিন মিশকালো তার প্রভাতই বা কী, সন্ধ্যাই বা কী।’

উমরাও বেগম পানিভরা বালতির সামনে বসে পড়েন। দু’হাতে ছড়াতে থাকেন পানি। ভিজে যায় শরীর। তারপরও মনে হয় কোথাও জলের স্নিগ্ধ স্পর্শ নেই। সবটাই শুকনো কাঠের উত্তাপ এবং ধোঁয়া। তিনি পাগলের মতো বালতির পানিতে আলোড়ন তোলেন। 

.

কিছুদিন পরে গালিবের কাছে খবর এলো যে ফজল হকের ছেলে ও বন্ধুরা যে তাঁর শাস্তির বিরুদ্ধে আপীল করেছিলেন আদালত তা নাকচ করে দিয়েছে। বরং ফল হয়েছে উল্টো। বলা হয়েছে দীপান্তরের আদেশ দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর করতে। গালিব বিমর্ষ হয়ে গেলেন। শুনলেন, তাঁরা ইংল্যান্ডের আদালতেও আপীল করেছেন। নিজেকেই বললেন, এর দ্বারাও কিছু হবে না। কোনো লাভ নেই। তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি এই শিক্ষা পেয়েছেন। পেনসনের মামলায় হেরে গিয়ে তিনি কলকাতা থেকে ফিরে এসে ইংল্যান্ডের আদালতে আপীল করেছিলেন। কোনো বিচারই পাননি। গদরের পরেতো অবস্থা আরও অনেক বেশি খারাপ। বিদ্রোহে যাঁরা সমর্থন দিয়েছিলেন তাদেরতো হত্যা করা হয়েছে। যাঁরা আয়ুর জোরে বেঁচে আছেন তাঁদের নানাভাবে দমন করা হচ্ছে। এই অরাজকতার শহরে তাঁদের জন্য কোনো আইন নেই। 

ওহ, ফজল হক। কেমন করে আন্দামানে কাটাবেন তিনি। যেখানে ভয়ঙ্কর আসামিদের পাঠানো হয় সেখানে একজন পণ্ডিত মানুষ কি করে দিন কাটাবেন!

দু’হাতে চোখের জল মুছতে মুছতে তিনি বিড়বিড় করে বলতে থাকেন, ওহ্ ফজল হক! আপনার ঋণ যদি আমার জীবন দিয়ে শোধ করতে পারতাম তাহলে আমি তাই করতাম। 

.

কয়দিন পরে বন্ধু সরুরের চিঠি পেলেন। সরুর তাঁর চিঠির সংকলন করার চিন্তা করছে। চিঠি সংগ্রহের কাজও শুরু করেছে। 

সরুর লিখেছে : পেনসনের বকেয়া দিয়েতো আপনার ধার শোধ হবে না। হায়দ্রাবাদের নিজামকে কসীদা লিখে পাঠান। তিনি আপনাকে সাহায্য করতে পারেন। কিছু আর্থিক সাহায্য পেলে দুর্ভোগ মোকাবেলা সহজ হবে। 

চিঠিটা দু’তিনবার পড়লেন। পড়ে ব্যথিত হলেন। সরুরকে ব্যথিত মনের প্রকাশ ঘটিয়ে একটি চিঠি লিখতে বসলেন। এখন আর আগের মতো লেখা হয় না। বসলেই কোনো কাজ করা হয়ে ওঠে না। ভাবতে ভাবতে সময় গড়িয়ে যায়। ভাবলেন, বয়স তাঁকে কাবু করে ফেলছে। তিনি নিজেকে সুস্থির করে দোয়াতে কলম ডোবালেন। লিখতে শুরু করলেন : লেখাটি শুরু করছি এভাবে যে তুমি ভাববে এসব কথার কি দরকার ছিল। কিন্তু আমার মনে হয়েছে কথাগুলো তোমাকে জানাতে হবে। না জানালে কেন লিখছি সেই লেখাটা তোমার কাছে অন্যরকম অর্থ নিয়ে হাজির হবে, বন্ধু। আমি তোমার বোঝায় অস্পষ্টতা রাখতে চাই না। 

আমাকে যারা চেনে তারা সবাই জানে যে আমার পাঁচ বছর বয়সে আমার আব্বা মারা যান। তেমন করে কিছুই বুঝিনি। কেঁদেছিলাম কিনা তাও মনে নাই। বন্ধু, স্মৃতিতে জমেছে অনেক সঞ্চয়। 

আমার নয় বছর বয়সে মারা যান আমার চাচা। চাচার ভূ-সম্পত্তির বদলে আমার ও আমার আত্মীয়দের পাওয়ার কথা ছিল দশ হাজার। হিসেব সে রকমই করা হয়েছিল। কিন্তু লোহারুর নওয়াব আহমদ বখশ এই পরিমাণ টাকা দিতে রাজি হলেন না। তিনি বলে দিলেন, তিন হাজার টাকার বেশি দিবেন না। ফলে আমার ভাগে পড়লো মাত্র সাড়ে সাতশো টাকা। 

এই অসঙ্গতি দেখে আমি ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। আমি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম। দিল্লির রেসিডেন্ট কোলব্রুক সাহেবের কাছে গেলাম। 

কলকাতায় গেলাম। কলকাতার সরকারি সচিব আমাকে বলেছিলেন যে, আমি যা দাবি করেছি তা ন্যায়সঙ্গত। আমার দুর্ভাগ্য এমনই যে এর পর পরই দিল্লির রেসিডেন্ট পদচ্যুত হলেন। আর সচিব অকালে মৃত্যুবরণ করলেন। 

কয়েক বছর পরে দিল্লির বাদশাহ আমার জন্য পঞ্চাশ টাকা মাসিক বৃত্তি মঞ্জুর করলেন। তাঁর উত্তরাধিকারী ধার্য করলেন বছরে চারশো টাকা। দুর্ভাগ্য এমন যে দুই বছর পরে সেই উত্তরাধিকারী মারা যান। অযোধ্যার নওয়াব ওয়াজিদ আলি শাহ বছরে পাঁচশো টাকা ভাতা দেয়ার কথা বললেন। দু’বছরের মধ্যে তাঁর রাজত্ব আর থাকলো না। ধ্বংস হয়ে গেলো। তাঁর ধ্বংসের আগে আমি সাত বছর তাঁর রুটি খেয়েছি। দুর্ভাগ্য আমার পায়ে পায়ে চলে। যারা আমার পৃষ্ঠপোষক ও শুভাকাঙ্ক্ষী তারাই একের পরে এক ধ্বংস হচ্ছে। এখন যদি আমি দক্ষিণের শাসকদের দিকে হাত বাড়াই তাহলে সেটা আমার জন্য ভালো হবে না। প্রচেষ্টা সফল হবে বলে মনে হয় না। শুধু শুধু কসীদা লিখব, কিন্তু ভাতা মঞ্জুর হবে না। 

হায়দ্রাবাদের নিজামকে কসীদা লেখার বিপক্ষে তাঁর মনোভাবের কথা এভাবে জানিয়ে দেন। চিঠি লেখা শেষ করে প্রতিদিনের কাজ নিয়ে বসেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে, বিভিন্ন জনের কাছ থেকে আসা গদ্য-পদ্য সংশোধনের কাজ। যথেষ্ট পরিশ্রম হয়, তারপর কাজটি তিনি রোজ করেন। লেখাগুলো শুধু দিল্লি থেকে আসে না, আসে বেরিলি, লক্ষ্ণৌ, কলকাতা, বোম্বে এবং সুরাট থেকে। 

বাকির ইদানিং এসব ব্যাপারে নানা প্রশ্ন করে। ও বেশ বড় হয়েছে। ওর চাঞ্চল্য কমেছে। ধীরস্থির স্বভাবের বাকির নানাজানের বিভিন্ন কাজে সহায়তা করে। মাঝে মাঝে অনুযোগ করে বলে, নানাজান আপনি খুব খাটুনি করছেন। আপনার চোখ বসে গেছে। 

একটা চোখে তো প্রায় কিছুই দেখতে পাই না। আর একটা চোখেই যা কিছু দেখা। 

তাহলে এসব কাজ থাক নানাজান। চোখ নষ্ট হয়ে গেলে তখনতো আরও বিপদ হবে। 

দুনিয়া দেখা হবে না। তুমি যে দিনে দিনে বড় হয়ে যাচ্ছ এটাও দেখা আমার হবে না। 

তাহলে এইসব কাজ আর করবেন না। থাক এসব। 

ও কাগজগুলো গুছিয়ে সরিয়ে রাখতে চায়। 

গালিব বাধা দেন। বলেন, এটুকু করতে দাও আমাকে। আর মাত্র অল্প বাকি। 

অল্প কোথায়? এটাকে আমি কাগজের পাহাড় বলবো। 

বাকির দু’হাত রাখে কাগজের ওপর 

গালিব মৃদু হেসে বলেন, আমি এরপর থেকে তোমার কথামতো কাজ করবো। 

আপনার চোখ আমাদেরকে বাঁচাতে হবে নানাজান। যেটুকু দৃষ্টি বাকি আছে সেটুকু শুধু গজল লেখার জন্য থাকবে, আর কোনো কাজের জন্য না। 

গালিব খুশি হয়ে বলেন, আচ্ছা ঠিক আছে। কেউ তাঁর যত্ন নিচ্ছে ভাবতেই তাঁর বুকের ভেতর আনন্দের ঢেউ ওঠে। অনুভব করেন তাঁর চারদিকে সুবাতাস। আহ্, কি আনন্দ! এমন আনন্দের সঙ্গে এতদিন তাঁর কোনো যোগ ছিল না। খোদা মেহেরবান। 

বাকির দ্রুত হাতে টেবিলটা গুছিয়ে দেয়। বলে, নানাজান আপনার শুনতে অসুবিধা হয়। এখন কেমন আছে আপনার কানের মেজাজ? 

দু’কানেরই মেজাজ ভালো নেই। আমার চেয়ে আমার কান বেশি বুড়ো হয়ে গেছে। যত তাড়াতাড়ি পারছে তত তাড়াতাড়ি কবরের দিকে চলে যাচ্ছে আমার শোনার শক্তি। 

আহারে, আমার নানাজান। বাকির দু’হাতে গলা জড়িয়ে ধরে। 

এতদিন আপনি আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। এখন আমাদের করা উচিত। আমি আর একটু বড় হলে আপনাকে কিচ্ছু করতে দেবো না। 

তাহলে আমি কি করবো? 

খাবেন আর ঘুমুবেন। 

নেশা করবো না? 

করবেন। 

করবো? বাহ তুমিতো দারুণ নাতি আমার। কত অনায়াসে পারমিশন দিয়ে দিলে। তোমার নানিজান তো একদম সহ্যই করতে পারে না। 

নানিজানের বয়স হয়েছে না। নানিজানের কত কষ্ট! একটি বাচ্চাও বাঁচেনি। আপনারওতো কষ্ট আছে নানাজান! 

গালিব চুপ করে থাকেন। এই ছেলেটি বুঝি হঠাৎ করে তাঁর সামনে বড় হয়ে গেলো। এই সেদিন নাচতে নাচতে জামা মসজিদে নামাজ পড়তে গেলো! এই সেদিন বুঝি কিছু একটার বায়না করেছিল— অবুঝ বালকের মতো। আসলে ও একটু একটু করে বড় হয়ে গেছে। ওর বড় হওয়া তিনি খেয়ালই করেননি। হায় বাচ্চা, তুমি এখন আমার অভিভাবক হয়ে গেছ! গালিব ওর দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকেন। 

হাসছেন যে নানাজান? 

এখন থেকে তুমি আমার গার্জিয়ান। 

বাকির হঠাৎ লজ্জা পেয়ে দ্রুতপায়ে ঘর ছাড়ে। যেতে যেতে বলে, আমি আবার আসব। 

গালিব আনন্দ-মুগ্ধতায় বিগলিত বোধ করেন। জীবনের এই গভীর রহস্য তাঁর অনুভবে ছিল না। হঠাৎ করে একটি বিশাল দরজা খুলে গেছে তাঁর সামনে। তিনি অবাক হয়ে সেই বিস্ময়কে অবলোকন করে। এই নতুন ভালোলাগা তাঁর এতকালের জীবনযাপনকে উল্টে দিয়েছে। নিজের এই প্রাপ্তি তাঁর কাছে বিশাল হয়ে ওঠে। তিনি ভাবতে থাকেন কোনো একটি গজল দিয়ে তিনি তাঁর মনের ভাব প্রকাশ করবেন। প্রতিদিনের সাহচর্য পাওয়া দুটি বালকের একজন কিশোর হয়ে উঠেছে। চারপাশ বুঝে ওঠার অভিজ্ঞতা হয়েছে। তিনি এতকাল নিজেকে নিয়েই মগ্ন ছিলেন। এখন সেই কিশোর নিজেই সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলছে, দেখো আমাকে। গালিব নিজের শের আবৃত্তি করলেন : 

‘এদিকে আমি—শত সহস্র আর্তনাদ; 
ওদিকে তুমি—এক পরমাশ্চর্য না শোনা।।’

পরক্ষণে আরও একটি শের মনে করে তিনি আপ্লুত হলেন : 

‘শত শোভা রয়েছে চোখের পাতা তোলার অপেক্ষায়,
চোখের দানে ধন্য হবার সামর্থ্য কি আছে তোমার?’ 

.

কিছুদিনের মধ্যে দুই বালককে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ হলো তাঁর। বাকির বড় বলে ও নানা কিছু বুঝে উঠতে শুরু করেছে। হুসেন এখনও অবুঝ বালক। গালিব বুঝতে শুরু করেছেন যে দুই বালকের কাছ থেকে তিনি দুই ধরনের আনন্দ পাচ্ছেন। এখন তিনি একটি নতুন ভুবনে ঢুকেছেন। এই ভুবনের আলো-অন্ধকার তাঁর আগামী দিন। 

চরম দারিদ্র্য থেকে রেহাই পেয়েছেন। আনন্দের নতুন জমিন পেয়েছেন। ত্রিশ বছর পরে দিল্লি থেকে বাইরে যাওয়ার সুযোগ এসেছে। 

নওয়াব ইউসুফ খাঁর পরগণা রামপুরা যাবেন। নওয়াব তাঁকে একশ টাকা করে মাসিক ভাতা দিচ্ছেন। ওস্তাদের সম্মানদক্ষিণা। প্রয়োজনে মাঝে মাঝে বাড়তি টাকাও পাঠান। এই যোগাযোগ কাজটি করে দিয়েছিলেন ফজল হক। তাঁরই পরামর্শে গালিব নওয়াবের নামে কাসীদা লিখে পাঠিয়েছিলেন। এতে কাজ হয়েছিল। নওয়াব রাজী হলেন। প্রবল দুঃসময়ে ফারসিতে একটি কাতা লিখে পাঠিয়েছিলেন বছর দুয়েক আগে। সে সময় নওয়াব কোনো জবাব দেননি। এবার গালিব নওয়াবের শিক্ষক নিযুক্ত হলেন। নওয়াবের লেখা কবিতা অনবরত সংশোধন করে পাঠিয়েছেন। ওস্তাদ হিসেবে সম্মান পেয়েছেন। নওয়াব তাঁকে নানা উপহার পাঠিয়েছেন। নওয়াবের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এখন তিনিই নওয়াবের আমন্ত্রণে রামপুরা যাচ্ছেন। সঙ্গে বাকির আর হুসেন। তাঁদেরকে দেখাশোনার জন্য আছেন দু’জন অনুচর 

বাকির আর হুসেনের খুশির সীমা নেই। 

নানাজান আমরা কয়দিনে রামপুরা পেঁছাবো? 

ছয়দিন লাগবে। 

বাকির বিজ্ঞের মতো বলে, আমাদেরকে অনেকগুলো জায়গা পার হয়ে যেতে হবে বলে শুনেছি নানাজান। 

হ্যাঁ, বেশ কয়েকটা। গালিব আঙুল গুনে বললেন, যেমন ধরো মুরাদনগর, মীরাট, শাহজাহাপুর, গড়মুক্তেশ্বর ও মুরারাদাদ। 

বাকিরও আঙুলে গুণছিল। গালিব চেঁচিয়ে বললেন, পাঁচটা জায়গা দেখতে দেখতে যাওয়া হবে। 

আমার মনে হচ্ছে পুরো দুনিয়াটা আমার দেখা হয়ে যাবে নানাজান।

গালিব মৃদু হেসে ওর মাথায় হাত রাখেন। 

.

একদিন তাঁরা পৌঁছে গেলেন রামপুরা। 

নওয়াব তাঁর ওস্তাদের যত্নের ত্রুটি করলেন না। নিজে তাঁকে সাদরে বরণ করলেন। থাকার জন্য বড় একটি বাড়ি দিলেন। প্রতিদিন সময় মতো যেন খাবার পৌঁছে যায় সে ব্যবস্থাও করলেন। খাবারের আয়োজনে গালিব প্রীত হয়ে গেলেন। 

রাতের বেলা দু’ভাই বলে, আমরা এখান থেকে যাবো না নানাজান। আমরাতো মেহমান। 

মেহমানতো কি হয়েছে? আপনিতো নওয়াবের ওস্তাদ। যতদিন ইচ্ছা ততদিন থাকবেন। 

তা কি হয়? এতো ভালো দেখায় না। লোকে বলবে আমরা নওয়াবের ঘাড়ে উঠেছি 

হুসেন গাঁইগুই করে বলে, দিল্লি গেলেতো আমরা এত খাবার খেতে পারবো না। 

এখনতো দিল্লিতে আমাদের আর কষ্ট নেই। তোমরা রোজ রোজ গোশত- রুটি খাচ্ছ, ফল-মিঠাই-দুধ খাচ্ছ। 

সে খাবারগুলো এ রকম না–হুসেন গোঁ গোঁ করে বলে। 

বাকির ওকে হাত ধরে বাইরে টেনে নিয়ে যায়। যেতে যেতে বলে, পরের খাবারে লোভ করতে হয় না ভাইয়া। 

হুসেন জেদের সঙ্গে বলে, আমি এখানেই থাকবো। 

ওরা থাকতে না দিলে? ওরা যদি বাড়ি থেকে বের করে দেয়? যদি খাবার না দেয়? 

ভাইয়ের কথা শুনে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে হুসেন। 

বাকির বলে, চলো নদীর ধারে যাই। 

বাচ্চাদের মুখে নদীর কথা শুনে গালিব নিজেও ভাবেন, নদীর কাছে যাবেন। কাছেই কোশী নদী। কিন্তু অতটা পথ হাঁটতে পারবেন না ভেবে দমে গেলেন। কি সুন্দর নদী, যেমন স্বচ্ছ পানি, তেমনি ঠাণ্ডা। হাত ছোঁয়ালে শরীর সজীব লাগে। খেতেও ভালো। মিষ্টি স্বাদ আছে। মাঝে মাঝে কাজের লোকদের ডেকে, কুঁজো ভরে নদীর পানি আনতে বলেন। 

বাকির নদীর পানি খুব পছন্দ করে। বলে, দিল্লিতে আমরা নদীর পানি খাইনি নানাজান। 

হ্যাঁ, ওখানে আমাদেরকে কুয়োর পানি খেতে হয়। 

কুয়োর পানির চেয়ে নদীর পানি অনেক ভালো। 

এই পানি খেয়ে আমার কলিকের ব্যথা ভালো হয়েছে। খাবার হজমও হয়। 

কোশী নদীকে আমরা দিল্লি নিয়ে যেতে পারি না? 

নদী কি মালামাল যে ঘাড়ে তুলে নিয়ে যাবে? 

গালিবের মৃদু হাসিতে লজ্জা পায় বাকির। বলে, এখানকার বাড়িগুলো মাটির তৈরি। বেশ ঠাণ্ডা। বাস করতে ভালো লাগছে। 

রামপুরে পাথর পাওয়া যায় না। সেজন্য বেশির ভাগ বাড়ি মাটি দিয়ে তৈরি হয়। দেখছো না, মাত্র কয়েকটি ইটের ইমারত। 

আজ যখন নানিজানকে চিঠি লিখব তখন এসব কথাই লিখব। 

কি লিখবে? 

লিখব যে এখানে আমরা কেমন ভালো আছি। নদীর কথা, মাটির বাড়ির কথা লিখব। 

খাবার দাবারের কথা লিখবে না? 

খাবারের কথাতো আগেই লিখেছি। এমন খাবার আমরা দিল্লিতে খাইনি সেকথা লিখেছি। 

তোমার নানিজান মন খারাপ করবে। ভাববে, নাতিরা তার দেয়া খাবারের কদর করছে না। 

বাকির চুপ করে যায়। এ বিষয়টি ও ভেবে দেখেনি। ওর বুদ্ধিই বা কি! ওকে আরও অনেক কিছু শিখতে হবে। ও একটু লজ্জা পায়। নানিজানের কথা ভেবে মন খারাপ করে। তারপরে দু’ভাইয়ে নানিজানকে চিঠি লিখতে বসে। 

গালিব নিজেও চিঠি লিখতে বসেন। বিভিন্ন জায়গায় সব সময় চিঠি না লিখলে তার দিন কাটতে চায় না, এটাতো দীর্ঘকালের অভ্যেস। তার ওপর দিল্লির বাইরে আছেন। কোথাও থেকে তাঁর জন্য কোনো খবর থাকলে সেটা পেতেও তাঁর দেরি হবে। 

চিঠি লেখা শেষ করে দু’ভাই নানার সামনে এসে বলে, নানাজান আমরাতো নানিজানকে চিঠি লিখছি, কিন্তু নানিজান কীভাবে চিঠি পড়বেন? তিনি তো চিঠি পড়তে পারেন না। 

তোমরা কি ভুলে গেছ যে আমি গুলাম নজফ খানকে বলে এসেছি যে আমাদের চিঠি তাঁকে পড়ে শোনাতে? 

হ্যাঁ, হ্যাঁ আমাদের মনে পড়েছে। 

হুসেন দু’তিন লাফ দিয়ে কথাটা বলে। তারপর গালিবের সামনে এসে দু’হাত ধরে বলে, আমি আর এখানে থাকবো না। আমি নানিজানের কাছে যাবো। 

ঠিক আছে যাবো। 

না, আমি কালকেই যাবো। ও জেদ করে। 

কালকেতো আমি যেতে পারবো না। আমি এখানে নওয়াবের মেহমান। তিনি যেদিন আমাকে ছাড়বেন আমি সেদিন যাবো। 

তাহলে আমাকে পাঠিয়ে দিন। 

তুমি কেমন করে যাবে? একা? 

একাতো আমি যেতে পারবো না। আমাকে কারো সঙ্গে পাঠিয়ে দিন। 

আগে তোমার চিঠি পাঠিয়ে দেই। তোমার নানিজানের কাছে আমি লিখবো যে তোমরা ফিরে যেতে চাও। তিনি যদি বলেন, তোমাকে পাঠিয়ে দিতে, তাহলে আমি পাঠিয়ে দেব। ঠিক আছে? 

আচ্ছা। হুসেন ঘাড় কাত করে। 

দু’ভাই হাত ধরে ছুটে যায় মাঠে। 

গালিব বারান্দায় বসে ওদের খেলতে দেখেন। এ কয়দিনে ওদের জন্য জমা হয়েছে দু’তিনটে বকরী, বেশ অনেকগুলো পায়রা, কয়েকটি তিতির, নানা আকারের একগাদা ঘুড়ি। বাকির ঘুড়ি ওড়াতে ভালোবাসে। মাঝে মাঝে আর একজনের হাতে নাটাই দিয়ে দৌড়ে এসে তাঁকে বলে, ঘুড়ি যখন আকাশের দিকে যেতে থাকে তা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। ইচ্ছে হয় ঘুড়ির মতো উড়ে আকাশ ছুঁয়ে আসি। সে জন্য যখন নাটাইয়ের সুতো ছাড়ি তখন সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই। মাঝে মাঝে ঘুড়িটা আপনার ছবি হয়ে যায়। 

বাহ, তুমিতো বেশ ভাবতে পারো। তোমার আব্বার মতো কবি হবে নাকি? 

না, আব্বার মতো না। হলে আপনার মতো হবো। আপনার মতো কবিতার আকাশ হবো। সবাই আমাকে আপনার মতো ভালোবাসবে। 

গালিব ওর ভাবনায় মুগ্ধ হয়ে যান। মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওকে দেখেন। মাথায় হাত দিয়ে বলেন, বড় হও। 

বাকির আবার এক দৌড়ে মাঠে চলে যায়। 

গালিব বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করেন। এখানে আসার পরে শরীর ভালো লাগছে। এই শান্ত-স্নিগ্ধ এলাকা তাঁর দুঃখের ওপর পরশ বুলিয়ে দেয়। অবসাদ ঘুচিয়ে দেয়। মন সতেজ রাখে। এক ঘুমে রাতটা বেশ পার হয়ে যায়। 

নওয়াবের সঙ্গে তিন দিন দেখা হয়েছে তাঁর দরবারে। আপ্যায়নের ত্রুটি নেই। দেখতে দেখতে মাস দুয়েক পার হয়ে গেছে। একদিন একটি চিঠি পেলেন দিল্লি থেকে। গুলাম নফজ খান পাঠিয়ে দিয়েছেন। লিখেছেন পাঞ্জাবের লেফটেন্যান্ট গভর্নর রবার্ট মন্টগোমারীও। তিনি তাঁকে লিখেছেন, খান সাহেব আপনার পাঠানো বই ‘দস্তাম্বু’ পেয়েছি। কসীদাটিও পেয়েছি। খুব সুন্দর কাসীদা। 

গালিব চিঠি পড়ে খুব খুশি হলেন। তিনি শুনেছেন তাঁর সম্মান পুনরুদ্ধারের জন্য নওয়াব ইউসুফ চেষ্টা করছেন। নওয়াবের দরবারের কেউ কেউ বলছেন, শিগগির গভর্নর জেনারেল দরবারে তাঁর নির্দিষ্ট সম্মানসূচক আসন এবং তাঁর পোশাক পুনর্বহাল করবেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁর এই সম্মান ফিরিয়ে দিলে তিনি চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হবেন। এটা হবে কবিতার জয়। অহংকারের জয়। কোনো দয়া বা করুণা নয়। কদিন ধরে সরকারের এমন মনোভাবের কথা ভেবে তিনি আত্মগরিমায় রুখে দাঁড়ান। নিজের ভেতরে শক্তি অনুভব করেন। নিজেকে বলেন : 

‘দেখো তার বাক্যের চমৎকারিতা, সে যা বলে- 
আমার মনে হয় এ-ও যেন, আমার হৃদয়ের মধ্যেই ছিল।’ 

.

সেদিন হুসেন এসে গালিবের কাছে টাকা ধার চাইলো। গালিব দু’ভাইকে দু’টাকা করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তোমাদের মাসের হাতখরচ। 

দুজনে দশদিনের মধ্যে টাকা খরচ করে ফেলে। মহাফুর্তিতে আছে তারা। খরচের হিসাব-নিকাশও তাদের নেই। 

হুসেন এসে সরাসরি বললো, নানাজান একটা টাকা কর্জ দিন।

কর্জ? গালিব কৌতুকের চোখে তাকান। 

হ্যাঁ, কর্জ। শোধ দিয়ে দেব। 

কবে শোধ দেবে? 

হুসেন মাথা চুলকিয়ে ভাবে। আঙুল গুণে কিছু হিসেব করে। তারপর মাথা নেড়ে বলে, তা জানি না। 

তাহলে তো শোধের কোনো সময় থাকলো না। 

ও বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলে, তাই তো মনে হয়। 

গালিব হাসতে হাসতে ওকে কয়েকটি পয়সা দিয়ে বলেন, শোধ দিতে হবে না। তোমাকে কর্জ না, উপহার দিলাম। 

উপহার? ছোট্ট উপহার। আচ্ছা ঠিক আছে। তবে আমি চাইলে আমাকে কর্জও দিতে হবে। 

ও চলে যায়। গালিব নাতির কর্জের ব্যাপারে কৌতুক বোধ করেন। মনে মনে বলেন, নাতি নানাজানের স্বভাব পেয়েছে। নানাজানের মতো দেনাজর্জরিত জীবন না পেলেই রক্ষা 

দু’চার দিনের মধ্যেই ছেলেরা দিল্লি ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হুসেন বলে, নানিজান বোধহয় আমাদের জন্য কান্নাকাটি করছে। নানিজানতো আমাকে চোখের আড়ালই করতে চায় না। একটু না দেখলে বলে, কোথায় গেলি হুসেন। 

বাকিরও গম্ভীর হয়ে বলে, এখানে অনেক আনন্দে আছি। কিন্তু আমার আর থাকতে ভালো লাগছে না। আমরা কালই চলে যাবো নানাজান। 

কাল? কালতো নওয়াব আমাকে যেতে দেবে না। 

আপনি তাহলে থাকেন। আমরা চলে যাবো। আমরা আর থাকবো না।

কালকের দিনটা আমাকে সময় দাও। আমি ভেবে দেখি। 

ওরা যেতে যেতে বলে, বেশি ভাবতে দেবো না কিন্তু। মাত্র একদিন সময়।

সেদিনই দিল্লি ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন গালিব। অনুচরদের উপর নির্ভর করে এত লম্বা রাস্তা তিনি ওদের ছাড়তে চাইলেন না। 

.

দিল্লিতে নিজের বাড়ির ছোট ঘরটিতে এখন তাঁর দিন কাটছে। 

প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে চিঠি লিখছেন। মজরুহকে লিখলেন, বাচ্চারা ফিরে আসার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ছেলেদেরকে শুধু লোক দিয়ে দিল্লিতে পাঠাতে সাহস করিনি। যদি পথে কোনো বিপদ ঘটে যেত তাহলে কীভাবে নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম, বলো বন্ধু। নিজেকে আমি ক্ষমা করতেও পারতাম না। সেজন্য আমাকে ফিরে আসতে হলো। আমি মনে করি ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তা না হলে আমার গ্রীষ্ম ও বর্ষা রামপুরা কাটাবার কথা ছিল। বন্ধু, জীবনের অনেক আনন্দ আমি একা উপভোগ করেছি। এই ছেলে দুটো আমাকে জীবনের ভিন্ন ভুবনে নিয়ে গেছে। ওরা না থাকলে এই আনন্দ আমার পাওয়া হতো না। 

চিঠিটা খামে ভরতে ভরতে তিনি চেঁচিয়ে কাল্লুকে ডাকেন। 

ঘরে আসেন উমরাও বেগম। 

কাল্লু মিয়াকে গোশত কিনতে পাঠিয়েছি। 

গোশত! গালিব হাসি ছড়িয়ে বলেন, গোশত না হলে খেয়ে আরাম পাই না। 

একথা আমার চেয়ে আর বেশি কে জানে। 

তুমি তো জানবে। আমার কি অন্য কোনো বিবি আছে। 

উমরাও বেগম সে প্রসঙ্গে না গিয়ে বলেন, রামপুরায় থাকায় আপনার স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। 

ওরা আমাকে খুব যত্ন করেছে। প্রত্যেক বেলায় ভালো ভালো খাবার দিয়েছে। বাচ্চারা আসতে না চাইলে আরও কিছুদিন থেকে আসতাম। 

বাচ্চাদেরকে চাকরদের সঙ্গে না পাঠিয়ে ভালো করেছেন। ওরা আমাদের চোখের মণি।

ওদের আব্বাজান কবি আরিফ আমার চোখের মনি ছিল। ওর মৃত্যু আমাকে সবচেয়ে বেশি কাঁদিয়েছে। কত অল্প বয়সে ও ঝরে গেলো। হায়, কবিতার ফুল হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখতো। 

উমরাও বেগম ওড়নায় চোখ মুছলেন। আরিফ ছিল তার ভাইয়ের ছেলে। তিনিও ওকে নিজ সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। তাঁর দুই শিশু পুত্রকে দত্তক নিলেন দু’জনে। 

উমরাও বেগম বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন, আপনি আরিফকে নিয়ে যে শের লিখেছেন তা আমার মনে আছে। 

বলো, বিবি বল, আমরা দুজনে আরিফকে স্মরণ করি। 

উমরাও বেগম গালিবের চোখে চোখ রেখে বলেন : 

‘হে আকাশের পীর, আরিফ যুবক ছিল, 
ক্ষতি কি হতো, যদি রইতো কিছুদিন আরও?’ 

গালিব নিজে পরের অংশ বললেন : 

‘তুমি ছিলে গৃহের জ্যোতি আমার 
কেন রইল না সে শোভা কিছুদিন আরও।’ 

বাকিটা আমি বলি। উমরাও বেগম জলভরা চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন : 

‘আমাকে ঘৃণা, সূর্যের সাথে লড়াই 
শিশুদের তামাশা দেখতে কিছুদিন আরও?
গুজরি না বহর হাল য়ে মুদ্দত খুশ বা না খুশ 
কারণা যা জওয়া মর্গ! গুজারা কোঈ দিন অন্তর।
আনন্দে-নিরানন্দে কাটলো না দিন 
কাটানো যেতো না কিছুদিন আরও।’ 

থামলেন গালিব। তাঁর কণ্ঠস্বর ভেসে বেড়ায় ঘরজুড়ে। কাটানো যেতো না কিছুদিন আরও? কার কাছে জানতে চাইবেন এই প্রশ্নের উত্তর? আরিফের মৃত্যু শুধু একজনের চলে যাওয়া নয়। দুটি বালকের ছায়ার মধ্যে বেঁচে আছে সে-আছে স্মৃতি, আছে কবিতা, আছে বেদনা—আছে দুঃখ ভোলার দিন। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা উমরাও বেগমের দিকে তাকিয়ে গালিব অন্যমনস্ক স্বরে বলেন, রামপুরায় আমি একটি নদী পেয়েছিলাম বিবি। আমার গজলের মতো নদী। শরীর শীতল করে দিয়েছিল। 

নদী। উমরাও বেগম অস্ফুট কণ্ঠে বলেন, নদীর নাম কি? 

কোশী। ভারী সুন্দর পানি। একদম মিঠা পানির মতো। 

আমি একটাই নদীর নাম জানি। 

যমুনা। যমুনা তোমার আমার নদী। 

এতক্ষণে উমরাও বেগম মৃদু হাসেন। শৈশব প্রসঙ্গ তাঁকে সব সময় আনন্দ দেয়।

ছেলে দুটো নদী দেখে খুব খুশি হয়েছে। 

ওরা নদীর অনেক গল্প করেছে আমার কাছে। 

যাক, আমি খুশি যে রামপুরা ওদের ভালো লেগেছে। 

আপনার ভালো লাগেনি? 

নওয়াবের ওস্তাদ হিসেবে ওরা আমার খুব সম্মান করেছে। এত সম্মান আমার ভাগ্যে ছিল আমি তা ভাবতে পারিনি। 

আল্লাহর কাছে হাজার শোকর যে আপনি সম্মান পেয়েছেন। দিল্লিতেতো আপনার চারদিকে আছে পাওনাদার আর হিংসা করা লোকেরা। 

এখানে আমার বন্ধুরাও ছিল বিবি। 

এখন নাই। 

গদরের পরে প্রিয় মানুষের সংখ্যা নব্বই ভাগই কমে গেছে। 

উমরাও বেগম আর কথা বাড়ান না। এই প্রসঙ্গ ধরে বলার মতো কথা আর তার নাই। গালিব নিজেই বলতে থাকেন, রামপুরা থেকে আসার পরে কত ধরনের কথা যে শুনতে হলো। 

কে আবার আপনাকে কথা শোনালো? 

মহল্লায় কি কথা শোনানোর লোক কম আছে? মানুষের হিংসের শেষ নেই বিবি। লোকে বলাবলি করেছে যে, নওয়াব কম করে হলেও গালিবকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছে। আবার কেউ বলেছে আসাদুল্লাহ নওয়াবের কাছে গিয়েছিল চাকরির খোঁজে। কিন্তু তার আশা পূরণ হয়নি। 

গালিব শতরঞ্জির উপর পা ছড়িয়ে দিয়ে হাসলেন। তাঁর হাসি থামলে উমরাও বেগম বললেন, আপনি হাসছেন? আমারতো শুনে রাগ হচ্ছে। 

আরও কি বলেছে শুনলেতো তোমার আরও রাগ হবে। শুনবে?

হ্যাঁ শুনবো। শুনলে মানুষের মনোভাব জানতে পারবো। 

লোকেরা একধাপ বাড়িয়ে বলেছে যে, নওয়াব আমাকে চাকরি দিয়েছিল। দু’শো টাকা বেতন ঠিক হয়েছিল। কিন্তু লেফটেন্যান্ট গভর্নর আমাকে দেখে ভীষণ রেগে গেলেন। বললেন, গালিবকে এখনই এখান থেকে বিদায় করেন। নইলে আমাদের সঙ্গে আপনি ভালো সম্পর্ক রাখতে পারবেন না। 

উমরাও বেগম ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকেন। বলেন, তারপর?

ওদের কথামত তারপর নওয়াব আমাকে তাড়িয়ে দিলেন।

আপনি ওদেরকে কিছু বললেন না? 

না। কিছুই বলিনি। কেন বলবো? ওরা যা বলে বলুক। আমার আর মন খারাপ হয় না। আমি বিচলিত বোধও করি না। 

কিন্তু আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে মহল্লার লোকদের ঘরে ঘরে গিয়ে বলি— 

মাথা ঠাণ্ডা রাখ বিবি। উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই। 

কিন্তু এসব কথা কি শুনতে ভালো লাগে? 

সেটা করাই সঙ্গত। ওদের সঙ্গে ঘাস খেতে ময়দানে নামলে আমিও একটা বকরি হয়ে যাবো। আমি বকরি হতে চাই না বিবি। 

ঠিক আছে আমি যাই। 

কোথায় যাবে? কি করবে? 

মাথায় তেল আর পানি দেবো। 

দু’ভাই কাছাকাছি কোথাও ছিল। ছুটে এসে উমরাও বেগমের হাত ধরে। 

ওরা চলে যেতেই গালিবের মনে হয় সুযোগ পেলে তিনি আবার রামপুরে যাবেন। ইউসুফ নওয়াবের দরবারে যে সম্মান তিনি পেয়েছেন লালকেল্লায় সে সম্মান পাননি। রামপুরের নওয়াবের দরবারে তাঁর সবচেয়ে ভালো সময় কেটেছে। মানুষের জীবনে এমন সৌভাগ্য কমই হয়। রামপুরে আবার যাওয়ার যে ইচ্ছা তার হয়েছে তা কি পূরণ হবে? দেখা যাক উপরওয়ালা কি করেন! তিনিই তো জগতের মালিক! নিজেকে বললেন : 

‘যদি আকাশের রথচক্র থেমে যেত গালিব 
যে যুগ ধ্বংস হলো, কেনই বা হলো?’ 

.

কয়েকদিন পরে আলতফ এসে জানাল খবরটি। 

উৎফুল্ল আলতফ বললো, ওস্তাদজী আপনার জন্য খবর আছে। 

খবর? 

সইফতার সাত বছর দণ্ড মওকুফ হয়েছে। 

সইফতা এখন কোথায়? 

মীরাটে। 

মীরাটে? মীরাটেতো ওর কেউ নেই। 

এক বন্ধুর সঙ্গে আছে। 

বন্ধুর সঙ্গে। গালিব আফসোস করে বললেন, এক সময়ের অভিজাত সইফতা এখন সর্বস্বান্ত। আমি কারাগারে বন্দী ছিলাম তখন বন্ধুদের মধ্যে সইফতা আমার সঙ্গে দেখা করতে যেত। আমরা দুজনে কিছুক্ষণ গল্প করতাম। তখন শ‍ইফতাকে আমার পরম আত্মীয় মনে হতো। অল্প কিছুক্ষণ সময় আমরা এক সঙ্গে কাটাতাম। মনে হতো অনন্ত সময়। আমি কখনো সেই সময়ের কথা ভুলি না। 

গালিব থামলেন। 

আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে যাব আলতফ। 

মীরাটে? 

হ্যাঁ মীরাটেই। মেল ট্রেনে যাবো। 

পারবেন যেতে? 

পারতেই হবে। বন্ধু আমার তুমি ভালো থাকো। 

একজন অনুচর নিয়ে যাবেন কিন্তু। 

দেখি কি ব্যবস্থা করতে পারি 

কবে যাবেন?

কালই। 

আলতফ এই সিদ্ধান্তে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। মুখে কিছু বলেন না। 

গালিব বলেন, বছর কয়েক আগে মেল ট্রেনে করে হাকিরকে দেখতে যেতে চেয়েছিলাম। হাকির তখন আলীগড়ে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার যাওয়া হয়নি। হাকিরকে কথা দিয়েও আমি যেতে পারিনি। কিন্তু এবার আমার কথার নড়চড় হবে না। আমি যাবই। 

আলতফ বুঝলেন যে গালিবের বুকের ভেতরে টান পড়েছে। না গিয়ে তিনি থাকতে পারবেন না। 

আমি কি আপনার জন্য টিকিট কেটে আনবো? হ্যাঁ, দুটো টিকিট কাটবে 

কে যাবে আপনার সঙ্গে? 

একজন অনুচর তো যাবেই। ভেবো না বন্ধু। 

তিনি আলতফকে টিকিট কাটার জন্য টাকা দিলেন। জামাকাপড় গুছিয়ে দিল কাল্লু। গম্মন তাঁর সফরসঙ্গী হলো। 

ট্রেনে উঠে তিনি ভাবলেন, কখনো সময়ের গতি এমন তীব্র হয়। তখন কোনো দিকে তাকানোর ফুরসত থাকে না। এখন তিনি সময়ের তীব্র গতি নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন। শ‍ইফতা সেই গতির উৎস। কখনো মানুষ এভাবে নিজেকে উৎসের কাছে নিয়ে গিয়ে নিজের বন্ধ কুঠুরির দরজা খোলে। সে কুঠুরির অন্ধকার-আলো-বাতাস অনুভব করে। মানুষের জীবনে অনেক কুঠুরি থাকে। অনেক সময় সেগুলোর দরজা খোলাই হয় না। 

ট্রেনের ঝাঁকুনিতে তাঁর ঝিমুনি এলো। তিনি কামরার দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজলেন। করোটিতে ঘুরপাক খায় নিজের শের : 

‘হেমন্ত কী, বসন্তই বা কাকে বলবো- যে ঋতুই আসুক, 
সেই আমি, সেই খাঁচা আর সেই কেটে ফেলা পালকের জন্য বিলাপ।’

মাথার ঘূর্ণিতে আবর্তিত হয় ঋতুচক্র – ফুল-পাখি-গাছ-সবুজমাঠ-প্রান্তর- দিগন্ত। গালিব ঘুমিয়ে পড়েন। বুঝতে পারেন যে কত হাজার বছরের ক্লান্তি তাঁকে ছেয়ে আছে। তিনি বুঝি আর এই ঘুম থেকে জেগে উঠতে পারবেন না। 

রেল স্টেশনে এসে থামে। 

মানুষের হৈচৈয়ে ঘুমের আমেজ কেটে যায়। মাথা বেশ ঝরঝরে লাগছে। 

হুজুর। 

এসে গেছি আমরা? 

হ্যাঁ হুজুর। 

পোটলা-পুঁটলি নিয়েছো? 

সব গুছিয়ে নিয়েছি। আমরা নেমে যেতে পারি। 

গালিব স্টেশনে নেমে চারদিকে তাকালেন। কি সুন্দর লাগছে চারদিক মৃদু বাতাস এসে ছুঁয়ে যায় শরীর। অপূর্ব লাগছে শ্বাস নিতে 

একজন এসে জিজ্ঞেস করলো, তিনি দিল্লি থেকে আসা অতিথি কিনা?

আমি মুশরফির অতিথি। 

তিনি আপনার জন্য পালকি পাঠিয়েছেন। আসুন! 

ষোল বেহারার পালকি। পালকি দেখেই তিনি খুশি হয়ে গেলেন অনেকদিন এত বড় পালকিতে চড়া হয়নি। পালকির হুম হুম ধ্বনি শুনে কাওয়ালির মতো মনে হচ্ছিল, যেন চারদিক থেকে কাওয়ালির ধ্বনি উঠে আসছে। খানিকটুকু আনন্দের সুখ মনের মধ্যে অনুরণিত হতে থাকলেও বাড়িতে এসে স্তব্ধ হয়ে গেলেন গালিব। 

সইফতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারলেন না। হাতটা বাড়িয়ে তাঁকে ধরতেও পারলেন না। 

দুই বন্ধু অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকেন। 

কতক্ষণ? 

তাঁরা জানেন না। 

কতক্ষণ? 

তাঁদের কোনো সময়ের হিসেব নেই। 

কতক্ষণ? 

তাঁরা হিসেব রাখতে শেখেন নি। 

মুশরফি এসে বলেন, আপনাদের কি হয়েছে? 

দুই বন্ধু চমকে তার দিকে তাকান। 

আপনারা আসুন আমার সঙ্গে। এখানে বসুন। কতদিন পরে দু’বন্ধুর দেখা হলো? 

কেউ কোনো কথা বলে না। এক সময় দু’জনে দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। 

গালিব রুদ্ধকণ্ঠে বলে, কত শুকিয়ে গেছ তুমি। 

জেলে বসে তোমাদের কথা খুব মনে হতো। 

আবার দুজনে চুপ হয়ে যান। দুজনেরই মনে হয়েছিল তাদের অনেক কথা জমে আছে। বুকভরা কথা গলগল করে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু ফল হলো উল্টো। দু’জনের কেউই কথা বলতে পারছেন না। যেন দুজনের কেউ কখনো কবিতা লেখেনি। শব্দ ব্যবহার করতে জানে না। নিজেকে প্রকাশ করতেও তাঁরা ভুলে গেছেন। দুজনেই ছটফট করেন। অস্বস্তি কাটাতে চান। 

সন্ধ্যার আগে মুশরফি বলে, চলুন আমরা মাঠে হেঁটে আসি। 

গালিব বিভ্রান্ত বোধ করেন। 

মাঠে হাঁটতে যাবো? 

হ্যাঁ, মাঠে হাঁটবেন। একটু পরে সূর্য ডুববে। আপনারা সূর্য ডোবা দেখবেন। 

সইফতা গালিবের হাত ধরে বলেন, চলো বন্ধু। আমরা সূর্য ডুবে যাওয়া দেখতে শিখবো। আমরাতো কত কিছুই ভুলে গেছি 

তাঁরা বেশ কিছুক্ষণ মাঠে হাঁটাহাঁটি করেন। তাঁরা সূর্য ডোবা দেখেন। শেষ আলোর বিকিরণ দেখেন। তাঁরা সন্ধ্যা নামতে দেখেন। পাখিদের ঘরে ফিরতে দেখেন। সূর্যাস্তের সোনালি আলোর পরে অন্ধকার গাঢ় হয়। তাঁরা দুজনে হাত ধরেন। 

বাতাস বেশ ভালো লাগছে। 

মনে আছে আমি যখন জেলে ছিলাম তুমি আমাকে দেখতে যেতে।

খুব মনে আছে। মনে থাকবে না কেন? আমি তোমার দুঃখের সময় ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। 

তুমি তা পেরেছিলে। কারাগারে তোমাকে দেখলেই আমার মনে হতো পৃথিবীতে আমার কেউ আছে। 

তখনকার সময় এবং এখনকার সময় একদম ভিন্ন। 

আমি তোমাকে দেখতে এসেছি দুঃখ ভোলার জন্য। 

আমরা আর দুঃখ ভোলা হবে না। 

কেন? 

কারণ আমাদের সিপাহীদের বিদ্রোহ সফল হয়নি। আমরা হেরে গেছি। তুমি কি বাদশাহর খবর জানো বন্ধু? 

রেঙ্গুনে তিনি কেমন আছেন তা আর জানি না। 

নির্বাসিত মানুষের থাকা আর না থাকা। 

সইফতার কথার পরে গালিব আবার নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। বাদশাহর দরবার, মুশায়রা–না তিনি আর ভাববেন না। কবিতা লেখার দিনতো বুঝি তার ফুরিয়েছে। এখনতো আর মাথায় কিছু আসে না। 

বিশাল অন্ধকারের পটভূমিতে সইফতার কণ্ঠস্বর ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। 

বলেন, বাদশাহর কোনো খবর পেলে আমাকে একটা চিঠি লিখে দিও।

খবর? 

তুমি দিল্লিতে থাকবে। খবরতো তোমার কাছে আগে আসবে।

গালিব রূঢ়কণ্ঠে বলেন, কি খবর পেতে চাও তুমি? 

যে কোনো খবর। 

তাও বলতে পারছো না যে মৃত্যুর খবর। 

হ্যাঁ, মৃত্যুর খবরই শুনতে চাই। তাঁর জীবনে আর কোনো খবর অবশিষ্ট নেই। 

অন্ধকার ভেঙে চৌচির হতে থাকে। মুশরফি বলে, আপনারা বাড়িতে চলুন। 

.

সইফতার কাছে চারদিন থাকলেন গালিব। প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে ওঠার পরে দু’জনে বেশ ভালো সময় কাটালেন। সইফতার জাহাঙ্গিরাবাদের জমিদারি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সরকার বাজেয়াপ্ত করে রেখেছে। সইফতার পেনসনের ব্যাপারেও ফয়সালা হয়নি। সংকট এবং দুশ্চিন্তা তাঁকে কাবু করে রেখেছে। গালিবের সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটিয়ে তিনি আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। 

বলেন, দণ্ড মওকুফ হওয়াতেই আমি বেশি স্বস্তি পেয়েছি। কারণ আমি কারাগারে মরতে চাইনি। 

সরকার তোমার জমিদারি ছেড়ে দেবে। এ প্রক্রিয়ায় কাজ শুরু হয়েছে।

কবে কি হবে কে জানে! 

পেনসনও হয়ে যাবে। 

এটাই বা কি করে ধরে নেব যে হবে। 

অভিজাত মুসলমানরাতো সরকারের দু’চোখের বিষ। আমার চেয়ে এটা আর কে বেশি ভালো বুঝবে। 

ধৈর্য ধরো বন্ধু। 

এখন প্রাণটা বেরিয়ে গেলেই রক্ষা পাই। 

এই চারদিনে মন ভালো হয়েছে তোমার। মনটাকে আর খারাপ হতে দিও না। স্বাস্থ্যের দিকে নজর দাও। ভালো থাকার চেষ্টা করো। 

সইফতা মৃদু হেসে বললেন, আর ভালো থাকা। আমরা তো একই সাগরের ঝড়ে পড়েছি। ঝড়ে কারো জাহাজ পুরোই ডুবে গেছে। কেউ নিখোঁজ হয়ে গেছে। কেউ খড়কুটো ধরে ভাসছে। আমি এই শেষের দলে। ভাসতে পারবো কিনা জানি না। কোনো একদিন হাত থেকে খড়কুটো ছুটে যাবে, আর– 

গালিব দু’হাত উপরে তুলে বলেন, থাক, আর কি তা আমাদের জানার দরকার নেই। 

হো হো করে হেসে ওঠেন সইফতা। প্রাণখোলা হাসি। অন্যরাও হাসিমুখে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন। বেশ কিছুক্ষণ হাসলেন সইফতা। হাসি থামলে বললেন, অনেকদিন পরে হাসতে পারলাম। বুক ফাটানো হাসি। 

গালিব হাসিমুখেই বললেন, মৃত্যু আমাদের কাছে এখন একটি বড় রসিকতা। মৃত্যুর কথা মনে করে আমরা হাসতে পারি। 

পারিইতো। দিল্লির অভিজাত মুসলমানদের মৃত্যু চিনিয়েছে ইংরেজরা। সিপাহী বিদ্রোহে আমরা জয়ী হলে আমরা ইংরেজদের মৃত্যু চেনাতাম। বন্ধু আমাদের সামনে এমন দিন আসবে। আমরা প্রতিশোধ নেব। 

কতদিনে? গালিব ভুরু কোঁচকান। আবার বলেন, দেখে যেতে পারবো কি? 

সইফতা ঘাড় নাড়িয়ে হাত উঁচিয়ে বলেন, দিনের হিসাব করতে পারবোনা। সময়টা লম্বাও হতে পারে। ওরা বিজয়ী হয়েছে। নিজেদের মতো করে গোছাচ্ছে। এটাই ভাবনার বিষয় এখন যে আমাদের কত বছর লাগবে ওদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য। তুমি কি বলো বন্ধু? 

আমি ভাবতে পারি না। বয়স হয়ে গেছে ভাবার সাধ্যও নাই। একশ বছরও লেগে যেতে পারে কে জানে! 

সইফতা উচ্চ কণ্ঠে বলেন, তার কমও লাগতে পারে। তবে সময়টা লম্বা হবে এটুকু মনে হয়। আমরা দেখে যেতে পারবো না। 

আর কথা হয় না। নিস্তব্ধ হয়ে থাকে সময়। এবং কবিদের চিন্তাও। দুজন কবি নিজেদের অনাগত দিনগুলো নিয়ে আর কিছু ভাবতে পারেন না। বর্তমানকে অতিক্রম করার চিন্তা করেন। 

.

চারদিন বন্ধুর সঙ্গে কাটিয়ে দিল্লিতে ফিরে আসেন গালিব। 

ছুটে আসে বাকির ও হুসেন। 

তোমাদের জন্য দেখো কি এনেছি? ফল আর মিঠাই। 

দু’ভাই হাত বাড়িয়ে ফল আর মিঠাই নিয়ে যেতে যেতে বাকির ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, নানাজান ওখানে নদী আছে? 

নদী? নিশ্চয়ই নদী আছে। কিন্তু আমি যে বাড়িতে ছিলাম সে বাড়ির কাছে নদী ছিল না। 

আপনি ঘুড়ি উড়িয়েছিলেন?

না তো। ঘুড়ি উড়াইনি। 

তাহলে তেমন ভালো মজা হয়নি। 

গালিব হাসতে থাকেন। 

এবার আমরা কোথাও গেলে নানিজানকে নিয়ে যাবো। নেবেনতো নানাজান? 

তোমাদের নানিজান কি যেতে চাইবে? এখন জিজ্ঞেস করো? 

না, আমরা পরে জিজ্ঞেস করবো। এখন ফল-মিঠাই খেতে যাই।

গালিব উমরাও বেগমের দিকে তাকিয়ে বলেন, তোমার শরীর খারাপ?

না। ভালোই আছি। 

খারাপ খবর আছে কিছু? 

বাড়িওয়ালা বাড়ি ছাড়তে বলেছে। 

তাই নাকি? কবে? 

এইতো আপনি যাওয়ার পরে। 

একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। গত বর্ষায় অতি বৃষ্টিতে আমাদের খুব কষ্ট হয়েছে। বাড়ির যা অবস্থা। 

গালিব খানিকটা স্বস্তি পাওয়ার চেষ্টা করেন। যদিও জানেন এই সময়ে বাড়ি পাওয়া বেশ কঠিন কাজ। 

আমাদের একটা নতুন বাড়ি খুঁজতে হবে। 

উমরাও বেগম বাড়ি বদলের চিন্তায় ম্রিয়মান। তবুও স্বামীকে কথাটা স্মরণ করান তাগাদা জানানোর ভঙ্গিতে। বাড়ি বদলের কথা ভাবতেও তাঁর খারাপ লাগছে। ঝক্কি-ঝামেলা সহ্য করাও কঠিন। 

কিন্তু গালিবের চিন্তা অন্যত্র। বাড়ি কোথায় পাবেন? দিল্লির শত শত বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। রাস্তা চওড়া করা হচ্ছে। ভিক্টোরিয়ান সৌধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। মহল্লার পর মহল্লা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এত কিছুতে তিনি ক্লান্ত। গালিব বাড়ি ছাড়ার কথায় নিজেও ক্লান্তি বোধ করেন। চাঁদনি চক আর খারি বাওলি পর্যন্ত রাস্তাটুকু শুধু ছাড় পেয়েছে। এক সময়ের ঘনবসতি আর দোকানপাটে ভরা এলাকাগুলো বিলীন হয়ে গেছে। খসবাজার নাই। উর্দুবাজার নাই। খানমকা বাজার নাই। এমনভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এসব এলাকা যে কারো সাধ্য নেই খুঁজে বের করার যে তার বাড়িটি কোথায় ছিল। 

উমরাও বেগম উঠতে উঠতে বলেন, গত দশ-বারো বছর ধরে আমরা এই বাড়িটিতে থাকলাম। এখন ছেড়ে যেতে মায়াও লাগবে। 

মায়া! পরের বাড়িতে মায়া কেন বিবি? 

পরের বাড়ি হলে কি হবে নিজের বাড়ির মতোই তো থেকেছি। তাছাড়া বাড়ির মালিক হাসান খান আমাদের ভালোই দেখাশোনা করতেন। 

বাড়ির যা হাল হয়েছে, ভাবতে আমার ভয় করে। বৃষ্টি হলে জিনিসপত্র একবার এদিকে টানতে হয় আর একবার অন্যদিকে। চার ঘণ্টা বৃষ্টি হলে ছাদ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পানি ঝরে। 

থাক, এসব বলে আর কি হবে! বাড়ির মালিকও তো বদল হয়ে গেছে। নতুন মালিক যখন ছাড়তে বলেছে ছেড়ে দেয়াই ভালো। এখনকার মালিকের নাম গুলাম উল্লাহ খান। আপনি তার সঙ্গে কথা বলেন। 

আচ্ছা বিবি আজই কথা বলবো। 

গুলাম বলেছে বাড়ি মেরামত করবে। 

আচ্ছা, দেখি কি করি। 

লোকটা বেশ বদরাগী। বাড়ির মালিক হয়ে দেমাগ বেড়েছে বলে মনে হয়।

অর্থ মানুষকে দেমাগী করে। 

গালিব লেখার কাগজপত্র গোছাবেন বলে উঠলেন। 

উমরাও বেগম যেতে যেতে বলেন, আপনার মতো লোকেরা টাকা পয়সা হাতে রাখতে পারে না। নেশা করে উড়িয়ে দেয়। সে জন্য দিল্লি শহরে একটা বাড়ি করতে পারলেন না। 

কথাগুলো বলে উমরাও বেগম গালিবের উত্তর শোনার অপেক্ষা করেন না। দ্রুতপায়ে চলে যান। গালিব এক মুহূর্ত ভাবলেন, বিবির কি বাড়ি না থাকার জন্য আক্ষেপ আছে? পরক্ষণে হাত ওলটালেন। থাকতেই পারে। লোহারু পরিবারের মেয়েতো। তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দিলেন এই বলে যে, আমার আক্ষেপ নাই। যার সন্তান নাই, তার আবার নিজের বাড়ির চিন্তা কি! থাকা, না থাকা সমান। 

তিনি নিজের লেখার সরঞ্জাম গোছালেন। কিছুক্ষণ পরে এলেন গুলাম উল্লাহ খান। 

আপনি? গালিব জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। 

আমি এই বাড়ির মালিক গুলাম উল্লাহ খান। বাড়িটি হাকিম মুহম্মদ হাসান খানের কাছ থেকে কিনেছি। 

কার থেকে কিনেছেন সেটা আমি জানতে চাইনে। গালিবের কণ্ঠ রূঢ়। 

গুলাম উল্লাহ এক মুহূর্ত থমকে গিয়ে বললেন, আপনাকে জানাতে চেয়েছি। 

আমি প্রায় বারো বছর এই বাড়িতে আছি। আমি মালিকের নাম জানি। তিনি অত্যন্ত সজ্জন মানুষ। 

গুলাম উল্লাহ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আমি আগামীকাল থেকে বাড়ির মেরারত কাজ শুরু করবো। 

 আমাকে তো কয়েকদিন সময় দেবেন নতুন একটি বাড়ি খুঁজে বের করার জন্য।

আমি তো সময় দিয়েছি। আজ আমি আবার বলছি আমি কাল থেকে বাড়ি মেরামতের কাজ শুরু করবো। 

আমার বাড়ি খুঁজতে সময় লাগবে না? 

সেটা আমি জানি না। আপনি কি করবেন তা আমি জানি না। 

গুলাম উল্লাহ খান আর দাঁড়ায় না। হনহনিয়ে চলে যায়। গালিব ওর যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন। অবাক হন না। শহরটা এখন এমনই হয়ে গেছে। এটা আর কবিতার শহর নেই, এটা এখন বাণিজ্যের শহর। বাদশাহর শাসনের সময় যমুনা নদীর সেতুর ওপর ফুলের বেসাতি হতো। এখন এই শহরে আর ফুল বিক্রি হয় না। লোকে এখন মালিক-ভাড়াটিয়ার সম্পর্কতো এভাবে দেখবে। একজন অভিজাত মানুষের মূল্য তার কাছেই বা কি! 

.

যেই কথা সেই কাজ। 

পরদিন থেকে বাড়ি ঠিকঠাক করার কাজ শুরু হয়ে যায়। 

বাকির এসে বলে, নানাজান আমি কি দুজন লোকের পিঠে ঘুষি লাগাবো?

গালিব মৃদু হেসে ওর দিকে তাকান। 

হাসছেন যে? 

ওরা শাবল-হাতুড়ি দিয়ে কাজ করছে। ঘুষি খেয়ে ওরা কি চুপ করে থাকবে? 

তা হয়তো থাকবে না। হাতুড়ি দিয়ে আমার মাথা ফাটিয়ে ফেলবে। 

তাহলে? 

বাকির অস্থির হয়ে ঘরে ঘুরপাক খায়। 

এই শব্দ আমার অসহ্য লাগছে। 

চলো তুমি আর আমি বাড়ি খুঁজে দেখবো। 

কোথায় খুঁজবো? 

এই মহল্লাতেই। বল্লিমাঁরোতে।

ঠিক আছে চলেন। 

দুজনে বাড়ির বাইরে বের হন। 

প্রথমে দেখা হয় নুজ্জাত হুসেনের সঙ্গে। সে সালাম দিয়ে বলে, হজরত কোথায় যাচ্ছেন? 

বাড়ি খুঁজতে। 

আপনি বাড়ি খুঁজবেন কেন? আমরা খুঁজে দেবো। আমরা শুনেছি গুলাম উল্লাহ আপনাকে বাড়ি ছাড়তে বলেছে। 

ওর বাড়ি ও ছাড়তে বলতে পারে। কিন্তু সময় তো দেবে! 

হ্যাঁ, তা তো দেবেই। আপনি ঘরে থাকুন। আমরা এই মহল্লায় কোনো বাড়ি খালি থাকলে আপনাকে জানাবো? 

কয়দিন লাগবে? 

আজ আর কাল। 

ঠিকতো? 

এখনতো আমার এটাই কাজ। আর কোনো কাজ নাই। 

আচ্ছা যাও। 

নুজ্জাত হুসেন চলে যায়। বাকির নানার হাত ছাড়িয়ে নুজ্জাতের সঙ্গ ধরে।

আমিও আপনার সঙ্গে বাড়ি খুঁজবো। 

চলো। তুমিতো এখন ভালোই বড় হয়েছো। আর এক দুয়েক বছরের মধ্যে চাকরি করবে। তারপর বিয়ে… 

হা হা হাসিতে ভেঙে পড়ে নুজ্জাত। বাকির লজ্জায় কথা বলে না। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকেন গালিব। বাকিরের চলে যাওয়া দেখেন। এই প্রথম ও একটি কাজের দায়িত্ব নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। ও এখন থেকে কাজের দায়িত্ব নেবে। ওকে আর কেউ ফেরাতে পারবে না। গালিব গভীর আনন্দে ডুবে যান। ভীষণ ভালো লাগে না। বাড়ি মেরামতের কাজ তাঁকে আর কাবু করে না। তিনি বলতে থাকেন : 

‘হো চুকেঁ গালিব বলায়েঁ সব তমাম্‌ 
এক মর্গ-এ নাগহানী অওর হ্যায়। 
গালিব, সব দুঃখ ঘুচে গেছে 
শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু রয়ে গেছে।’ 

তিনি ঘরে ফিরতে ফিরতে শেরটি আরও দুবার আওড়ালেন। মাঝে তিনি নিজেই মৃত্যু বিষয়ে জ্যোতিষ গণনা করেছিলেন। বন্ধু-বান্ধবদের বলেছিলেন, তিনি ১২৭৭ শকাব্দে মারা যাবেন। নিজের মৃত্যু গণনার তারিখ ঠিক করেছিলেন ইসলামী সাল অনুযায়ী। বন্ধুরা অনেকে বিশ্বাসই করেনি। তাঁর ধারণা ছিল যে তিনি যা বলেছেন সেটা ঠিক হবে, কিন্তু হয়নি। সময় নিজের নিয়মে পার হয়ে গেছে। পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা গালিবের শরীর ছুঁয়ে দেখেনি। ভেবেছে বুঝি ওই শরীরে হাত বাড়ানোর সময় হয়নি। কিন্তু গালিব নিজে লজ্জা পেয়েছেন। তাঁর ভবিষ্যৎ বাণী যাঁরা বিশ্বাস করেনি তাঁরা নানা প্রশ্ন করে তাঁকে নাজেহাল করেছে। হাসি-ঠাট্টা করেছে। 

বেশতো কাটাচ্ছিলেন দিন, তবে কেন মৃত্যুর সাল ঘোষণা করেছিলেন?

এমনইতো ইঙ্গিত পেয়েছিলাম আমার আয়ুরেখায়। করতল মেলে দেখেছি। 

ভুল দেখেছেন। 

হয়তো তাই হবে। 

ভুল কথা প্রচার করা ঠিক হয়নি। দিল্লি শহরে গালির থাকবে না এটা কেইবা ভাবতে পারে। যমুনা নদী বলে গালিব, গালিব। 

আমাকে আর লজ্জা দেবেন না। 

এই মুহূর্তে হাতুড়ি আর শাবলের শব্দ শুনতে শুনতে সবকিছু তাঁর কাছে মৃত্যুর মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনির মতো মনে হয়। তারপরও তিনি আবার সেই শেরই বলতে থাকেন :  

‘গালিব সব দুঃখ ঘুচে গেছে 
শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু রয়ে গেছে।’ 

পরক্ষণে নিজেকে প্রশ্ন করলেন, তাই কি? সব দুঃখ কি ঘুচে যায়? মানুষের সব দুঃখ ঘুচে গেলে মানুষতো ফেরেশতা হয়ে যাবে। যে কবির দুঃখ থাকে না সে কবির কবিতা লেখা হবে না। 

ঘরে ফিরে এলেন। দিনভর দেখলেন তাঁর বাড়ির উঠোনে আবর্জনার স্তূপ জমা করছে বাড়ির মালিকের মিস্ত্রিরা। তিনি দরজা বন্ধ করে রাখলেন। উমরাও বেগম অভিযোগ করতে এলেন। 

এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা সম্ভব না। 

নুজ্জাত হুসেন বলেছে, কালকের মধ্যে একটা বাড়ি ঠিক হতে পারে। বিবি তুমি জিনিসপত্র গোছগাছ করো। 

আমার চাকর-নফররা সবই গুছিয়ে ফেলেছে প্রায়। বাকিটা বাড়ি ঠিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করে ফেলবো। 

গালিব হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠে বলেন, আমাদের বাকির কাজের ছেলে হয়েছে। সংসারের অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। বিবি ও নিজেও বাড়ি খুঁজতে গেছে। 

উমরাও বেগম উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, খোদা মেহেরবান, ও এতবড় হয়েছে! ও আমাদের কথা ভাবতে শিখেছে। 

দোয়া করতে করতে উমরাও বেগম বেরিয়ে যান। গালিব মনে মনে বলেন, একটা ফাঁড়া কাটলো। নইলে উমরাও বেগমের বিরক্তি দেখতে হতো। 

সেদিনও বাড়ি পাওয়ার কোনো খবর হলো না। 

পরদিন আলীগড় থেকে বন্ধুর চিঠি পেলেন। তিনি জানিয়েছেন মুনশী নবী বকশ হাকির ইন্তেকাল করেছেন। স্তব্ধ হয়ে রইলেন চিঠি পড়ে। তারপর মৃদুকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাহি রাজেউন- আল্লাহর জন্যই আমরা এবং তাঁর কাছেই আমরা ফিরে যাবো। চিঠিটা বুকে চেপে ধরলেন। নিজেকেই বললেন, একজন কবির মৃত্যু সহ্য করা কঠিন। হাকির আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু ছিল। কবিতার একজন খাঁটি সমঝদার ছিল। আলীগড় থেকে দিল্লিতে এলেই দুজনের আড্ডা হতো। কবিতার আলোচনায় মেতে থাকতেন তাঁরা। কখনো সারাদিন চলে গেছে নিজেদের আবেগ-অনুভব প্রকাশে। নিজেদের অভিজ্ঞতার ভাগাভাগি করতেন তাঁরা। আহা, কি মধুর ছিল সে দিনগুলো। গালিবের চোখ দিয়ে জল গড়ায়। তিনি মুছলেন না। জল গড়াতে দিলেন। বললেন, হে বন্ধু বিদায়। চলে গেছে বসন্তের দিন। 

তিনি চিঠিটা বুকে চেপে রাখলেন। 

বয়সে তুমি আমার ছোট বন্ধু, অসুস্থও ছিলে না, তারপরও তুমি আমার আগে চলে গেছো। হায় আল্লাহ। 

তিনি পানি খেলেন। গ্লাস হাতে নিয়ে পায়চারি করলেন। কালুকে ডেকে বললেন, পেয়ালা এনে মদ আর গোলাপ জল মেশাতে। বড় অস্থির লাগছে। 

কাল্লু এলে বললেন, মিস্ত্রিদের আজ যেতে বলো। ওরা যেন কাল আবার আসে। আমার ভীষণ মাথা ধরেছে। 

কাল্লু গিয়ে ওদের কাজ থামাতে বললে, তারা বলে, না আমরা তা পারবো না। এটুকু শেষ না করে চলে গেলে সারাদিনের মজুরি দেবে কে? তোমার সাহেব? যাও, এখন সরো। পারলে বাড়ি ছাড়ো। 

গালিব ঘরে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনলেন। তারপর চিঠিটা আবার পড়লেন। হাতুড়ির শব্দ এসে মাথায় লাগছে। চিঠিটা আবার পড়লেন। আবার। কাল্লু মদের পেয়ালা রেখে চলে গেছে। তিনি পেয়ালা হাতে নিয়ে বললেন : 

“ভালোবাসা চায় ধৈর্য, বাসনা অধীর। 
আঘাতে আঘাতে হৃদয় আরও কঠিন হবে; 
ততোদিন কি দিয়ে ভোলাবো তাকে?’ 

সেদিন ঘুমুনোর আগে পর্যন্ত মদ পান করলেন। সন্ধ্যায় অন্যদিনের চেয়ে অনেক বেশি শামী কাবাব খেলেন। যেন রাক্ষুসে ক্ষুধা তাঁকে পেয়ে বসেছে। গোশতের সুরুয়ায় রুটি ভেজাতে ভেজাতে বললেন, এগুলো রেখে দিও আগামী বর্ষার জন্য। যখন ছাদ চুঁইয়ে বৃষ্টির পানি পড়বে তখন ঘরের কোণে বসে এগুলো খাবো। আর আমার বন্ধু হাকিরকে বলবো- কি যেন বলবো ভাবলাম–এখন আর মনে করতে পারছি না। 

কাল্লু মিয়া দ্রুত পিরিচ-রেকাবি সরিয়ে নিতে থাকে। ও বুঝলো, হুজুর মাতাল হয়ে গেছে। এখুনি হয়তো শতরঞ্জির ওপর গড়িয়ে পড়বে। তাকে ধরে বিছানায় তোলা যাবে না। তিনি লাথি মারবেন। 

কাল্লু মিয়া একপ্রস্ত রেখে এসে আর এক প্রস্ত তোলার জন্য ঢুকতেই দেখলো তিনি চিৎপাত হয়ে শুয়ে আছেন। পা ফাঁক করা। হাত ছড়ানো। মাথা কাত হয়ে আছে। কাল্লু মিয়া হ্যাজাক বাতিটা কমিয়ে রেখে বেরিয়ে যায়। আজ রাতে ওর আর কিছু করার নাই। 

.

বিল্লিমাঁরো মহল্লাতে একটি বাড়ি পাওয়া যাবে বলে আশ্বাস দিয়েছে নুজ্জাত হোসেন। এদিকে ভাঙাচোরা আবর্জনায় ভরে উঠছে বাড়ির উঠোন। ওরা কোনো অনুরোধ শুনছে না। মিস্ত্রিদের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। ওরা হুকুমের দাস। জানপ্রাণ দিয়ে প্রভুর হুকুম পালন করছে। 

উমরাও বেগম বলে, মরার আগে দোজখ দেখা হয়ে গেলো। এখন শান্তিতে মরতে পারলে বেঁচে যাই। আপনি কি করে সহ্য করছেন? 

সহ্যতো করছি না। 

সহ্য না করলে আছেন কি করে? 

দাঁতে দাঁত চেপে। 

ছেলেরা থাকলে আপনার এই কথা শুনে হাসতো। আমি হাসতে পারছি না। শুধু ভাবছি আপনার দাঁত কত শক্ত! 

আল্লাহ জানে কত শক্ত! আমি বান্দা কি করে জানবো! জানলেতো ওই হাতুড়ি-শাবল দাঁত দিয়ে কামড়ে ভেঙে দিতাম। 

উমরাও বেগম কোনো কথা না বলে দু’হাতে কান চেপে ধরে ঘর ত্যাগ করেন। 

তিনদিন দোজখে কাটানোর পরে মুক্তি লাভ হয়। বল্লিমারো মহল্লাতেই বাড়ি পাওয়া যায়। তিনি যেমন চেয়েছিলেন তেমন পাওয়া যায়নি। তবে আগের বাড়ি থেকে বেশ ভালো বলা যায়। ছেলেরা খুশি। 

বাকির নিজেই দেখেশুনে পছন্দ করেছে। আশ্রিতদেরও পছন্দ হয়েছে। উমরাও বেগম বললেন, আর যে কয়দিন বাঁচবো এখানে কাটাতে পারলেই হবে। অতিবৃষ্টিতে ঘরের ছাদ বেয়ে পানি পড়বে না। দেয়ালগুলোও মজবুত। ভালোই হয়েছে। 

গালিব নিজেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কাল্লু তাঁর লেখার সরঞ্জাম ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে দিল। তিনি এখন সইয়া, জুনুন, তুফতার কবিতা সংশোধন করেন। তারা নিয়মিত তাঁদের লেখা পাঠান।

কিন্তু নিজের লেখা হচ্ছে না। আগের মতো কবিতা আর মাথায় আসে না। মাঝে মাঝে নিজের ওপর বিরক্ত হন। তাহলে কি তিনি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন? নাকি নতুন কিছু শুরু করার জন্য তাঁর ভিতরটা তৈরি হচ্ছে? তিনি তা জানতে পারছেন না? এমন যদি হয় তাহলেতো ভালোই হয়। দেখা যাক, অপেক্ষার পরে দেখা যাবে গালিব আবার নতুন করে জ্বলে উঠেছে। 

মাঝে মাঝে কারও স্মরণে কিছু লিখে দেন। সেগুলো কবিতা নয় বলে তিনি মনে করেন। মাঝে মাঝে কারো অনুরোধে দু’একটি তারিখি লিখে দেন। এগুলোও কবিতা নয়। তারিখি তো হলো কবিতা দ্বারা তারিখ প্রকাশ করার পদ্ধতি। এটাকে কি কবিতা বলা যাবে? না, কখনো না। তাছাড়া সংখ্যার হিসেব করে লেখা এক রকম ঝকমারি। আনন্দের চেয়ে বিরক্তিই বেশি। 

.

শহরে কলেরার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। 

প্রায়ই মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। খুব সতর্কতার সঙ্গে দিন কাটাচ্ছে পুরো পরিবার। এখন পর্যন্ত সকাল ভালোই আছে। উমরাও বেগম সকলের সুস্থতার প্রার্থনায় বেশির ভাগ সময় জায়নামাজের ওপরে থাকেন। কয়েকদিনের মধ্যে কলেরার প্রকোপ কমে যায়। সপ্তাহখানেক পরে মজরুহর চিঠি আসে। শহরে কলেরার মহামারীর খবর শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে চিঠি লিখেছেন। গালিব ও তাঁর পরিবারের খবরাখবর জানতে চেয়েছেন। 

গালিব কৌতুক করে চিঠি লিখলেন : বন্ধু তুমি মহামারীর খবর জানতে চেয়েছ। আমার পরিবারের সবাই সুস্থ আছে। এই বাড়িতে কলেরা ঢোকেনি। কিন্তু ঢোকার সুযোগ ছিল। আর কারো জন্য না হোক আমার জন্যতো বটেই। আমার ভাগ্যের মালিক যিনি তাঁর জন্য এই একটি তীর বাকি ছিল। তিনিতো তেমন তীরন্দাজ যার লক্ষ্য কখনো বিপথে যায় না। এই শহরে নির্বিচারে হত্যা হয়েছে, অবাধে লুণ্ঠন হয়েছে, দুর্ভিক্ষ হয়েছে, জ্বরের মহামারীতে মারা গেছে অনেকে—তখনতো কিছু হয়নি। এখন এই মহামারী আর কি করবে? তোমার চিঠি পেয়ে ভেবে দেখলাম একটি সাধারণ মহামারীতে মৃত্যু হওয়া আমার জন্য মোটেও সম্মানজনক নয়। এমন ঘটনা ঘটলে তা আমার জন্য খুবই অসম্মানের হতো। ভেবে দেখো আমি ঠিক বলেছি কিনা? আমি একটি সম্মানজনক মৃত্যু চাই বন্ধু। আমার জন্য প্রার্থনা করো। 

বেশ অনেকদিন পরে আলতফ এলো দেখা করতে। ওকে থেকে গালিব খুব খুশি হলেন, আবার অভিমানও করলেন। 

তুমি কি আমাকে ভুলে গেছো হালি? 

ওস্তাদজী, আপনাকে ভোলার সাধ্য আমার নাই। আমি অসুস্থ ছিলাম। পারিবারিক ঝামেলাও ছিল। এখনও শরীর আগের মতো ঠিক হয়নি। একটা খবর আপনাকে দেয়ার জন্য না এসে পারলাম না। 

খবর? ভালো না খারাপ? 

গালিব উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন। 

রেঙ্গুনে বাহাদুর শাহ জাফরের মৃত্যু হয়েছে। 

তিনি স্খলিত কণ্ঠে বললেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজেউন। দুজনে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। দু’জনেই চোখ মুছলেন। দু’জনেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। 

গালিব মৃদুকণ্ঠে বললেন, রামপুরা থাকার সময় সইফতা আমাকে বলেছিল এই খবরটি পেলে আমি যেন ওকে জানাই। 

চিঠি লিখবেন? 

আজই লিখবো। আজই— 

শহরটায় যে কতকিছু ঘটে যাচ্ছে, ভাবলে কষ্ট হয়। মেনে নিতেও পারি না। 

নতুন কি হয়েছে? 

মিউনিসিপ্যালিটি ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয়েছে। 

ও আচ্ছা। তারা কারা? 

অভিজাত কেউ নয়। সবাই সদ্য গজিয়ে উঠেছে 

বুঝেছি। ওরা ব্রিটিশদের প্রতি বিশ্বস্ত। 

ওরা শুধু বিশ্বস্ত না। ওরা অতি ধনী একটি শ্রেণী। সেই পাঁচটি পরিবার যারা ক্ষমতার উৎসে এসেছে। 

বলতো তারা কে কোথাকার? 

তাঁরা হলেন শালগ্রাম গিরিধার লালের দুটি জৈন পরিবার, চুন্নালাল গুরুওয়ালা ও নাহেরওয়ালা পরিবার। এরা সবাই ক্ষাত্রী সম্প্রদায়ভুক্ত। হিন্দু মিউনিসিপ্যাল কমিশনের সভাগুলো নতুন বানানো টাউন হলে বেশ ঘটা করে পালন করা হচ্ছে। 

গালিব চেঁচিয়ে বলেন, হোক গিয়ে। আমার এসব শুনতে আর ভালো লাগছে না। 

হঠাৎ করে চেঁচিয়ে ওঠায় তাঁর মাথা ঝিমঝিম করে। তিনি দু’হাতে মাথা চেপে নিজেকে সামলান। 

ওস্তাদজী, আপনার কি খারাপ লাগছে? 

হ্যাঁ, লাগছে, লাগছে। মনে হচ্ছে শহরটাকে ভেঙেচুরে শেষ করি।

আমি এখন যাই? 

যাও। 

আলতফ চলে গেলে তিনি শোকাহত হয়ে বসে থাকেন। বাদশাহ নির্বাসিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন এটাই বড় কথা এখন। দিল্লিতে আর কি হলোই বা না হলো তাতে তাঁর কি এসে যায়। তিনি আর এই শহর নিয়ে ভাববেন না বলে ঠিক করেন। তারপরও ভাবনা এড়ানো যায় না। মনে হতে থাকে, বাদশাহর দাফনের জন্য তাঁর নিজ দেশে তিন হাত জমি পাওয়া গেল না। 

মন শান্ত হলে সইফতাকে চিঠি লিখতে বসেন। প্রথমে বেশ আবেগ দিয়ে খানিকটুকু লিখলেন, তারপর আবার কাটলেন। আবার লিখলেন। না, হচ্ছে না। শেষে সংক্ষেপে লিখলেন : ৭ নভেম্বর, শুক্রবার আবদুল জাফর সিরাজুদ্দিন বাহাদুর শাহ রেঙ্গুনে একই সঙ্গে কারাগার এবং তাঁর নশ্বর দেহের কাঠগড়া থেকে মুক্তি লাভ করেছেন। 

তারপরে আরও দু-একটি বাক্য লিখবেন ভাবলেন। কিন্তু পারলেন না। কোথায় যে কি আটকে আছে। শোকের পাথর সরছে না। আটকে দিচ্ছে চোখের জল এবং অনুভবের আবেগ। নিজের সঙ্গে রাগ করতেও পারলেন না। শেষ পর্যন্ত থিতিয়ে গেলেন। খামের ওপর ঠিকানা লেখার সময় বুঝতে পারলেন শরীরের তাপ বাড়ছে! 

.

দু’দিনের জ্বরে কাবু হলেন গালিব। 

জ্বর ছাড়ছে না। অসহ্য ব্যথা। গায়ে-মাথায়। মাথা তোলার সাধ্যি নেই। দু’দিন পরে ডান পায়ে এবং দুই হাতে বেশ বড় আকারের ফোঁড়া দেখা দিল। আস্তে আস্তে ফোঁড়া লাল হয়ে পুঁজে ভর্তি হয়ে গেলো। দু’দিন পরে দেখা দিল ঘা। 

উমরাও বেগমের মুখ শুকিয়ে গেলো। বাড়ির অন্যরা থমথমে চেহারা নিয়ে কাজকর্ম করে। সবাই উদ্বিগ্ন। এমনকি ছোট হুসেনও নানাজানের বিছানার পাশে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে চুপি চুপি কাঁদে বাকির। 

ফোঁড়ার ক্ষত শুকোয় না। বরং ক্ষত গভীর হয়। হাকিম-বৈদ্যের চিকিৎসায় কাজ হয় না। তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকেন। যন্ত্রণায় গোঙান। ক্ষত শুকোয় না। শেষ পর্যন্ত একজন সার্জন ডাকা হয়। তিনি ভারতীয়, কিন্তু বাইরে থেকে লেখাপড়া করে এসেছেন। দেখেই বললেন, এই ক্ষততো কখনোই শুকোবে না। মাংস পচতে শুরু করেছে। ক্ষতের চারপাশের পচা মাংস কেটে ফেলতে হবে। 

বাড়িতে কান্নার রোল ওঠে। 

ডাক্তার সান্ত্বনা দিয়ে বলে, আপনারা কাঁদবেন না। ওনার এখন এই একটাই চিকিৎসা আছে। এই চিকিৎসা হলে তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন। 

গালিব ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলেন, ডাক্তার সাহেব আমাকে সুস্থ করেন… আমি ঘুমুতে চাই… আমার ঘুম নাই… যন্ত্রণা… যন্ত্রণা… 

আধো আধো উচ্চারণে, জড়িয়ে যাওয়া শব্দে তিনি যা বলেন তা ডাক্তার ঠিক মতো না বুঝলেও তাঁর কষ্টের কথা বোঝেন। তাঁকে মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দেন। 

আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন মির্জা সাহেব। আমি কালকে এসে আপনার পা ঠিক করে দেবো। আপনার ব্যথা কমে যাবে। আপনি ঘুমাতে পারবেন। 

গালিব তার কথা শুনে স্বস্তি বোধ করেন। ঘাড় নেড়ে সাড়া দেয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু পারেন না। হাসতে চেষ্টা করেন। হাসতেও পারেন না। তিনি শুধু তাকিয়ে থেকে দেখেন যে ডাক্তার চলে গেলো। তার সঙ্গে গেলো ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা কেউ কেউ। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা উমরাও বেগম ঘরে ঢুকলেন। বিছানার পাশে বসলেন। মাথায় হাত রাখলেন। দাসী গোশতের সুরুয়া নিয়ে এলে তিনি চামচ দিয়ে একটু একটু করে খাওয়ালেন। 

পরদিন ডাক্তার আসেন। সঙ্গে দুজন সহকারী প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে আসে। ডাক্তার অনেকক্ষণ ধরে ক্ষতের চারপাশের পচা মাংস কেটে ফেলে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়। 

কাজ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে যায়। 

চেতনে-অবচেতনে আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন গালিব। মনে হয় কষ্ট কি তা তিনি জানেন না। শরীরের কোথাও কিছু ঘটে গেছে তা তিনি টেরই পাচ্ছেন না। শুধু মনে হয় ঘরজুড়ে প্রবল অন্ধকার। আকাশ সামিয়ানা হয়ে বিছানার ওপর নেমে এসেছে। তিনি গায়ে জড়িয়ে ধরেছেন পুরো আকাশ। 

.

দিন যায়। আস্তে আস্তে ব্যথা কমে। 

দু-চার দিন পর পর ডাক্তার এসে দেখে যান। সহকারীরা এসে ক্ষতের পরিচর্যা করে। কিন্তু শুকোতে সময় লাগছে। 

এদিকে পা ফুলে গেছে। পায়ে জুতো ডোকে না। হাঁটতে কষ্ট হয়। জুতো না পরতে পারার কারণে বাইরে যাওয়া একদম বন্ধ। মাঝে মাঝে অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করলে শব্দ ছুটে যায় ঘরের দেয়াল ফুটো করে। তখন তিনি গোঙানির শব্দে আউড়ে যেতে থাকেন নিজের শের : 

‘প্রত্যেকের জীবনেই 
একটি দিন আছে 
যা মৃত্যুর জন্য নির্ধারিত 
তাই রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে 
মৃত্যুভয়ে কাটানো কেন?’ 

তিনি একটু থামলে কাল্লু মিয়া নরম কণ্ঠে ডাকে, হুজুর। 

তিনি গোঙানির শব্দ থামাতে পারেন না। সে শব্দ দিয়েতো কোনো প্রিয়জনের ডাকের উত্তর দেয়া যায় না। তিনি গোঙাতেই থাকেন। 

কাল্লু মিয়া চোখে জল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরে ঢোকে উমরাও বেগম।

কাল্লু কি হয়েছে? 

নতুনতো কিছু না। আমি আর সহ্য করতে পারি না। নতুন করে মলম লাগিয়ে দেবো? 

দাও। 

কাল্লু ব্যান্ডেজ করা পায়ের ওপর হাত রাখে। ক্ষত থেকে এখনো পচা গন্ধ আসছে। যদিও গন্ধের তীব্রতা কমেছে। কাল্লু মিয়া আস্তে আস্তে ব্যান্ডেজ খুলতে থাকে। আস্তে আস্তে পুরনো মলম মুছে ফেলে। তিনি পা নাড়াতে চান। পারেন না। পা ভারি হয়ে আছে। 

কাল্লু মিয়া—তিনি গোঙানির স্বরে ডাকেন। 

হুজুর। 

পানি খাবো। 

তুমি তোমার কাজ করো কাল্লু। আমি পানি নিয়ে আসছি। উমরাও বেগম বেরিয়ে যান। ফিরে আসেন পানি নিয়ে। মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বলেন, হাঁ করেন। 

গালিব হাঁ করলে পানি দেন উমরাও বেগম। পরপর কয়েক চামচ খেয়ে মুখ ফেরান। 

আর খাবেন না? 

না। 

তিনি হাত উঠিয়ে মুখ মোছেন। তারপর নিজের ডান হাত দিয়ে উমরাও বেগমের বাম হাত ধরেন। 

একটু দাঁড়াও বিবি। 

ব্যথা কমেছে? 

না। মৃত্যুর আগে কমবে না। 

ধৈর্য ধরেন। 

ধৈর্য ধৈর্য। ধৈর্য আর বুঝি না। ব্যথা আমাকে বন্দি করেছে। বিবি আর কতদিন লাগবে এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে? আমি মুক্তি চাই, মুক্তি। 

গালিব সজোরে মাথা নাড়েন। 

গম্মন তাঁর হাত ধরে বলে, হুজুর শান্ত হন। কাল্লু মলম লাগাচ্ছে। নড়াচড়া করলে মলম ঠিক জায়গায় লাগানো যাবে না। 

তিনি মাথা নাড়ানো বন্ধ করে বলতে থাকেন, ‘প্রত্যেকের জীবনেই একটি দিন আছে, যা মৃত্যুর জন্য নির্ধারিত…. 

আহ, চুপ করুন, থামুন। উমরাও বেগমের কন্ঠ কঁকিয়ে ওঠে। 

তিনি চোখ বড় করে তাকান। উমরাও বেগমের বুক ধক করে ওঠে। আহ, কি বড় এই চোখ। এই চোখ একদিন অদ্ভুত সুন্দর ছিল। এখন এই চোখে ভাষা নেই। নিষ্প্রাণ চোখ। উমরাও বেগম দু’চোখ বন্ধ করে আল্লাহর কাছে হাত ওঠান। তারপর বেরিয়ে যান। 

বাকির এসে বিছানার পাশে দাঁড়ায়। 

আমি আপনার জন্য কি করবো নানাজান? বাড়ির ছাদে উঠে ঘুড়ি উড়াবো?

তোমার বয়সে আমি অনেক ঘুড়ি উড়াতাম। নানা রঙের ঘুড়ি।

আমি ঘুড়ি উড়ালে আপনার কষ্ট কমে যাবে? 

আমি মনে করবো আমি তোমার বয়সে ফিরে গিয়েছি। আমার মনে আনন্দ ফিরে আসবে। আমি কষ্টের কথা ভুলে যাবো। 

তাহলে আমি ঘুড়ি উড়াতে গেলাম। ঘুড়ি যখন অনেক দূরে উড়ে যাবে আমি খোদাকে বলবো, খোদা মেহেরবান, আমার নানাজানের কষ্ট কমিয়ে দিন। 

গালিবের মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। বাকির চলে গেলে সন্তানের আনন্দে তিনি বিহ্বল হন। মুহূর্তের জন্য মনে হয় শরীরের কোথাও বুঝি ব্যথা নাই। আহ, এভাবেই যদি পুরো জীবনটা কেটে যেতো। 

কাল্লু মিয়া ব্যান্ডেজ শেষ করলে তিনি চোখ বোঝেন। এখন খানিকটুকু আরাম লাগছে। কিন্তু আরাম বেশিক্ষণ থাকে না। শুরু হয় যন্ত্রণা। যন্ত্রণায় রাতে ঘুমুতে পারেন না। 

রাতের পর রাত নির্ঘুম কেটে যায়। দিন গড়ায়। মাস গড়ায়। বছরও শেষ হতে চলেছে। 

শারীরিক দুর্বলতা এমন যে নিজেকে দাঁড় করাতে সময় লাগে। একদিন বাকির হাত ধরে টেনে ওঠাবার সময় বলে, নানাজান আপনি এত দুর্বল হয়েছেন। উঠতে এত সময় লাগে! 

গালিব হাঁফ ছেড়ে বলেন, অনেক সময় না? যে সময় ধরে আমাকে উঠতে হয় এই সময়ে মানুষ সমান একটা পাঁচিল তুলে ফেলা যায়। 

বাকির হাসতে গিয়ে থমকে যায়। মুহূর্তে ভাবে, নানাজান তো কষ্টের কথা বলেছেন, এটা মোটেই হাসির কথা নয়। তারপরও নানাজান কৌতুক করেই বললেন। পারেনও বলতে। 

বাকির তাঁকে বসিয়ে দেয় মাত্র। তারপর পা সোজা করেন। আস্তে আস্তে পা ঝুলিয়ে দেন। একটু একটু করে তিনি দাঁড়ান। তারপর লাঠি দিয়ে ঘরের মধ্যে কয়েক পা হাঁটেন। 

এর মধ্যে বছর ফুরিয়ে গেলো। 

একটি বছর বিছানায় পড়ে থেকে অভ্যেস এমন হয়েছে যে এখন বেশির ভাগ শুয়েই কাটান। কাল্লুকে মাঝে মাঝে বলেন, এটাই এখন আমার বিলাস কাল্লু মিয়া। 

বুঝেছি হুজুর। পানি দেবো? 

গোলাপ জল মিশিয়ে দিবে। 

হাকিমতো দেশী মদ খেতে মানা করেছে। 

বেশি কথা বলবে না কাল্লু। যা বলেছি তা করো। জীবন এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। এখন দিন কাটে যৌবনের কথা স্মরণ করে। 

কাল্লু চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে পেয়ালা ভর্তি করে নিয়ে আসে। মৃদু স্বরে ডাকে, হুজুর 

তিনি শুনতে পান না। ও আবার ডাকে, হুজুর। এবারও তিনি শুনতে পান না। কাল্লু মিয়া তাঁর হাতে পেয়ালা ধরিয়ে দেয়। তিনি ওর দিকে ফিরে তাকান। বুঝতে পারেন অনেক দিন আগে থেকেই ঠিক মতো শুনতে পাচ্ছেন না, সেটা দ্রুত খারাপের দিকেই যাচ্ছে। এখন শুনতে পান না বলা যায়। চোখেও ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছেন না। বেশির ভাগ সময় কাল্লুর সাহায্য নিতে হয়। এখনও পেয়ালা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি আমাকে ডাক দিয়েছিলে? 

দিয়েছিলাম। 

আমি শুনতে পাইনি, না? 

কাল্লু চুপ করে থাকে। তিনি এক চুমুকে পান করে বলেন, আর কয়দিন পর আমি তোমাকে দেখতে পাবো না। আর কিছুদিন পর হয়তো আমার কিছুই মনে থাকবে না। তখন আমি কি করব? কীভাবে দিন কাটবে আমার? 

তিনি দু’হাতে পেয়ালা আঁকড়ে ধরে ঘন ঘন চুমুক দেন। দেখতে পান তাঁর সামনে কাল্লু নেই। ঘরে কারো ছায়া নেই। তিনি ভীষণ একা। এক সময় জীবনকে কতভাবে উপভোগ করেছেন। সেই সব স্মৃতি এখন দুঃখের অনুভব দেয়। বুকের ভেতরে হাহাকারের রব ধ্বণিত হয়। তিনি এক চুমক পান করেন, আর নিজের গজল আবৃত্তি করতে থাকেন : 

‘সেই সব দিন পার হয়ে গেছে 
যখন শেষবারের মতো 
প্রিয়াকে কাছে পেয়েছিলাম 
এবং পাত্রভর্তি সুরা সমবেত সুধীমণ্ডলীকে 
আলোকিত করেছে।’

তিনি থামলেন। মনে হচ্ছে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তিনি আবার চুমুক দিলেন পেয়ালায়। আবার বলেন : 

‘আবার নিজেকে শ্বাসরুদ্ধ মনে হচ্ছে 
এইসব নিয়মের 
বাঁধাবাঁধিতে, 
সেসব দিন পার হয়ে গেছে 
শেষ যখন সমস্ত বাঁধা ঝেড়ে ফেলেছিলাম।’ 

আবার থামলেন তিনি। দম নিলেন। এখন নিঃশ্বাসও তাঁকে সহযোগিতা করে না। এই বিরূপ আচরণ করছে শরীর। মনের জন্য শরীরের ভালোবাসা উবে গেছে। কবিতা লেখার জন্যও শরীর আর কোনো সহযোগিতা করতে রাজি নয়। হায় খোদা, এমনই কঠিন দিন দিলে আমাকে! আবার নিজের মগ্নতায় ঢুকে বলতে থাকেন : 

‘রাত পানীয়ের চুমুকে কোথায় গেল 
সেইসব মাদকতা 
এসো উঠে পড় 
ভোরবেলা ঘুমোবার 
আনন্দই তো চলে গেছে।’ 

যৌবনের স্মৃতি তাঁকে দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে। তিনি বারবার মনে করছেন শরীরকে অভিশাপ দেয়ার সময় কি এখন? শরীরতো বিছানা থেকে নামতে চায় না? দিনের আলো দেখতে চায়না। মনে করে এখন অন্ধকারই দিন। 

তিনি পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে বলেন : 

‘সময়ের পরিবর্তনে 
গালিব, 
অনেক মূল্য দিতে হয়েছে 
যৌবনের সেইসব আশা 
কোথায় উঠে গেল।’ 

তিনি আর কিছু ভাবতে পারলেন না। নিজের নিঃস্ব অবস্থা তাঁকে উদ্‌ভ্রান্ত করে। অনেকক্ষণ পরে কালু ফিরে এসে দেখে তাঁর হাতের পেয়ালাটি টুকরো টুকরো হয়ে মেঝেয় পড়ে আছে। 

তাঁর মাথা হাঁটুতে গোঁজা। শরীর থর থর করে কাঁপছে। তিনি কাঁদছেন। 

কাল্লু মিয়া কাছে গিয়ে দাঁড়ায় না। নরম স্বরে ডাকেও না। নিঃশব্দে শতরঞ্জির উপর বসে পেয়ালার ভাঙা টুকরোগুলো কুড়িয়ে তোলে। কান খাড়া করে কান্নার ধ্বনি শোনে। মুখ তুলতেই দেখতে পায় উমরাও বেগম দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি ভুরু উঁচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করেন, কি হয়েছে? 

কাল্লু মিয়া মাথা নেড়ে বলে, জানি না। 

দু’জনেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। দুজনেই ভাবে, মানুষটা কেঁদেকেটে শান্ত হোক। উমরাও বেগম আরও ভাবলেন, মানুষটার কাঁদার ইচ্ছা হয়েছে। মানুষটা কাঁদুক। তাঁর কাঁদাই উচিত। যত পাপ করেছে তারতো কিছু প্ৰায়শ্চিত্য লাগে। পাপ, পাপ, পাপের শাস্তি হচ্ছে এখন তাঁর। 

এসব ভাবনার মাঝে নিজের ঘরে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন উমরাও বেগম। ভীষণ বিরক্তির সঙ্গে ভাবলেন, টাকার ব্যবস্থা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রাতের শরাব আবার চালু হয়ে গেছে। এখন শরাব পান না করে তিনি ঘুমাতে যান না। এ জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছেন। হায় আল্লাহ। উমরাও বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই মানুষের সঙ্গে, সংসারটা এভাবেই কাটলো। 

.

কয়েকদিন পরে গালিব খবর পেলেন যে আজুরদা ছাড়া পেয়েছেন। তাঁর বিচার শেষ হয়েছে। গত চার বছর ধরে তিনি জেলে আটকে ছিলেন। গালিব দু’হাত তুলে শোকর আদায় করে বললেন, খোদার মেহেরবানী যে তিনি প্রাণে বেঁচে গেছেন। কিন্তু তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। 

এই খবরে আনন্দ এবং কষ্ট পেলেন গালিব। শরীরের এই অবস্থায় আজুরদার সঙ্গে দেখা হবে না। দেখা করতে যেতে পারবেন না। আজুরদা তাঁর খুব প্রিয় মানুষ। 

মাসখানেক পরে শুনতে পেলেন আজুরদা লাহোর চলে গেছেন। ওখানে তাঁর বাড়ি আছে। ওখানে কমিশনার ও লেফটেন্যান্ট গভর্নর তাঁর সম্পত্তির একটা অংশ তাঁকে ফেরত দিয়েছে। এইসব থেকে যা পান তাই দিয়ে সংসার চলে। সবচেয়ে দুঃখের কথা এই যে প্রিয় শহর দিল্লি ছেড়ে তাঁকে চলে যেতে হয়েছে। মুশায়রার আসর তাঁর সামনে নেই। পরিচিত যে মানুষগুলোকে ঘিরে তাঁর একটি জায়গা গড়ে উঠেছিল সে জায়গাটি থেকে আলাদা হয়ে তিনি এখন একটি নির্জন কুঠুরির বাসিন্দা। 

উমরাও বেগম একদিন বলেছিলেন, আপনি বন্ধুর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন কেন? 

উনিতো অনেক কষ্ট পেয়েছেন। দুঃখের ভাগ আমি নেবো না কেন?

আপনি নিজের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। 

বিবি, যখন আমি প্রতি রাতে শরাব পান করতে পারতাম না। তখন আমি নিজের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতাম। ভেবে দেখো তখনকার অবস্থা। ভাতা পেতাম একশো বাষট্টি টাকা। দিতে হতো পাওনাদারদের টাকা, আয়কর শোধ করতে হতো, দারোয়ানের বেতন দিতে হতো, পরিচারকদের বাবদ খরচ হতো, আর তোমার-আমার নাতিদের খাওয়া পরার খরচতো ছিলই। যে টাকা পেতাম তাতে তো কিছু হতো না। তখন কুড়ি টাকা বাঁচানোর জন্য আমি রাতের শরাব পান ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমি কি ঠিক কাজটি করিনি বিবি? বন্ধুরা আমাকে জিজ্ঞেস করতো, সকাল-সন্ধ্যার শরাব ছাড়া তোমার দিন কাটছে কীভাবে? আমি বলতাম, সবই উপরের ইচ্ছা। 

উমরাও বেগম তিক্ত কণ্ঠে বলেন, এখনতো আপনার আর সেই দিন নেই। এখনতো আবার রোজ শরাব খেতে শুরু করেছেন। 

গালিব খানিকটা রূঢ় কণ্ঠে বলেন, এখনতো সংসারের কেনাকাটা করতে পারছি আমি। 

উমরাও বেগম কথা না বাড়িয়ে খানিকটা রোষের সঙ্গে উঠে পড়েন। 

গালিব চিৎ হয়ে শুয়ে থাকেন। কয়েকদিন আগে আলাইয়ের ছোটবেলার এক শিক্ষক মৌলভী হামজা খানের কথা লিখে আলাই তাঁকে চিঠি পাঠিয়েছেন। হামজা খান তাঁকে মদপান ছেড়ে দিতে বলেছেন। গালিব আলাইয়ের উপরে প্রথমে রাগলেন। কোন কালে একজন তাঁকে পড়িয়েছে সেই শিক্ষকের কথা আবার এভাবে লিখে পাঠাতে হবে নাকি? হামজা নাকি ওকে আরও লিখতে বলেছে যে, গালিবের উচিত হাফিজ যেমন লিখেছেন তেমনভাবে চলা। 

ফুঃ! গালিব ক্রোধে ক্ষিপ্ত হন। হাফিজের শের তারচেয়ে বেশি আর কে মনে রাখে। হাফিজ লিখেছিলেন- 

‘হাফিজ, বয়স তো অনেক হলো, 
এখন আবার মধুশালায় কেন? 
নারীসঙ্গ ও মদ্যপান কম বয়সের ধর্ম।’ 

ফুঃ! হাফিজ কি ভুলে গিয়েছিলেন যে কবিদের বয়স নেই। কবিদের বয়সের হিসেব করার দরকার নেই। কোনটা কম বয়সের ধর্ম, কোনটা বেশি বয়সের ধর্ম এটা কবিদের বেলায় খাটে না। ফুঃ। 

তিনি এভাবে ক্রোধ প্রকাশ করতে থাকেন। 

দুপুরের খাবারটি পছন্দমাফিক হওয়ার পরও তিনি ক্রোধ সামলাতে পারেন না। তাঁর ঘুম আসে না। বিশ্রাম হয় না। তিনি আইলাকে চিঠি লিখতে বসেন। বেশ কড়া করেই লিখেন : হামজা খানকে আমার সালাম জানিও। আর তাঁকে বলো যে আমি বলেছি, ‘যে তুমি শরাবের মর্ম বোঝ না, তোমায় বলছি/আমরা পান করি অবিরাম।’ আমি ঠিকই ভালো করে জানি যে কীভাবে খোদাতালা আমাকে শরাব পানের অনুমতি দিয়েছেন। মৌলভী হয়ে বেনিয়াদের আর পানওলার ছেলেদের পাঠদান করা এক বিষয়। ধর্মীয় নিয়ম অনুসারে ঋতুচক্র আর প্রসব পরবর্তী রক্তপাতের সমস্যা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করাও ওই একই বিষয়। আর বড় কথা হলো এই পৃথিবী নিয়ে ভাবা এবং খোদার অস্তিত্ব তার প্রকাশকে বুকের ভেতরে গভীরভাবে অনুভব করা অন্য বিষয়। 

চিঠিটি লিখে খামে ভরলেন। খামের উপরে ঠিকানা লিখতে লিখতে নিজেকেই বললেন, 

‘পেরে উঠতেই হবে, গালিব, 
অবস্থা সঙ্গীন এবং প্রাণ প্রিয়।’ 

কাল্লুকে ডেকে চিঠিটা পাঠাতে বলেন। হঠাৎ অবাক হয়ে কাল্লুর দিকে তাকান। ভাবেন, কত বছর ধরে ছেলেটি তাঁর কাছে আছে। কোনোদিন বাড়তি কিছু চায়নি, কখনো বলেনি কষ্ট হচ্ছে। কত অনুগত, যেন পরিবারের খুবই আপন কেউ। ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে ও খানিকটা বিব্রত হয়ে বলে, হুজুর। 

গালিব মৃদু হেসে ওকে পয়সা দিয়ে বলেন, যাও চিঠিটা পাঠাও। কালু চলে যায়। 

তিনি বিছানায় ফিরতে ফিরতে বলেন, 

“না চাইতেই যদি দেন তিনি তো তার স্বাদই আলাদা; 
সেই ভিখারী শ্রেষ্ঠ, হাত পাতার অভ্যেস হয় নি যার।’ 

এখন নিজের শেরের ভেতরে নিজেকেই ফিরে ফিরে দেখতে হয়। নিজের সঙ্গে এক দারুণ খেলা। শুধু কবিই পারে এমন খেলা খেলতে। আর কেউ না। খোদাতালা কবিকেইতো এমন শক্তি দিয়েছেন। হা হা হা – কবিই খোদাতালার প্রিয় বান্দা। 

তিনি খানিকটুকু পায়চারি করার চেষ্টা করলে অনুভব করেন তাঁর পায়ে শক্তি ফিরে এসেছে। তিনি হাঁটতে পারছেন। খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তাঁর ম্রিয়মান হয়ে থাকা চেহারা। 

ছুটে আসে বাকির। 

নানাাজান আপনি হাঁটতে পারছেন? 

পারছিতো। হাঁটতে ভালোই লাগছে। 

উহ কি বিপদ থেকে যে আপনি রক্ষা পেয়েছেন নানাজান। আমি জামা মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে আপনার জন্য অনেক দোয়া করেছি। 

গালিব ওর হাত ধরে বিছানায় বসেন। বালিশে বা দেয়ালে হেলান না দিয়ে তিনি বসতে পারেন না। বাকির ঠিকমতো বসতে সাহায্য করে। হুসেনও কাছে এসে দাঁড়ায়। গালিব আদর করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। 

হুসেন বলে, আপনার অসুখের সময় আমি অনেক কেঁদেছি। কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহর কাছে আপনার প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছি। 

ওহ, রে আমার ভাইয়া। গালিব চোখ মোছেন। 

তখন আপনাকে দেখতে আমার ভয় লাগতো। 

ভয় লাগতো? গালিব ভুরু কুঁচকে ওদের দিকে তাকান। 

আপনার সারা শরীরে কয়টি ফোঁড়া হয়েছিল আপনি তা জানেন নানাজান?

কুড়িটার মতো হবে 

বাকির মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, উঁহু হলো না। আমি একটা একটা করে গুণেছিলাম। পা থেকে মাথা পর্যন্ত মোট বারোটি ফোঁড়া ছিল। ফোঁড়াগুলো বড় বড় গর্তের মতো হয়ে গিয়েছিল। সে জন্য হুসেন ভয় পেতো। ও কাঁদতে কাঁদতে মাঝে মাঝে বলতো, ওই গর্তে পড়ে গেলে আমি ডুবে যাবো। 

হ্যাঁরে হুসেন, তাই? তোমার এত ভয় করতো? 

গর্ত দেখে ভয় করতো না নানাজান। আপনার কষ্ট দেখে ভয় করতো। মনে হতো আপনি যদি মরে যান তাহলে আমি কাকে নানাজান ডাকবো। কে আমাকে আদর করবে। আমারতো আব্বাও নাই আম্মাও নাই। 

আহ, ভাইয়ারা থামো। তোমরা এভাবে কথা বলো না। আমিতো ভালোই হয়ে গেছি। 

ভালোতো হবেনই। প্রতিদিন কত মলম যে দেয়া হয়েছে তার হিসেব আপনাকে আমি বলতে পারবো না। আমি শুধু দেখেছি। 

এখনতো তোমরা খুব খুশি? 

হ্যাঁ খুব খুশি। আমরা অনেক দোয়া পড়েছি। খোদাতালা আমাদের কথা শুনেছেন। 

গালিব পকেট থেকে একটি টাকা বের করে বাকিরের হাতে দিয়ে বলেন, যাও দুজনে মিলে কিছু খেয়ে এসো। 

দু’ভাই টাকা নিয়ে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে যায়। গালিব চোখ বুজে বলেন, আহ শান্তি! ভাগ্যিস ওরা দুজনে তাঁর জীবনে আছে। 

কয়েকদিন পরে বাকির আর হুসেন এসে বায়না ধরে। বলে, নানাজান আমরা ফুলওয়ালোঁ-কা মেলা দেখতে যাবো। 

ফুলের মেলা? 

হ্যাঁ নানাজান। আপনি আমাদেরকে এই মেলার অনেক গল্প করেছেন।

কিন্তু মেলা তো গদরের পর থেকে বন্ধ হয়ে গেছে। 

কাল্লু বলেছে এ বছর থেকে ফুলের মেলা আবার হবে। নানাজান আমরা কিন্তু মেলায় যাবো। 

মেলা? বুকটা তোলপাড় করে ওঠে গালিবের। বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের সময়ে ধুমধামের সঙ্গে মেলা বসতো। ওহ, কি আনন্দে কাটতো সে কটা দিন। দ্বিতীয় আকবর শাহের আমলে মেলার সূচনা হয়েছিল। জাফর শাহের বাবা তিনি। বাবা যে উৎসবের সূচনা করেছিলেন সম্রাট তা কত যত্নের সঙ্গে পালন করতেন। যা কিছু সুন্দর, যা কিছু আনন্দের তার দিকেই মানুষটির খেয়াল ছিল খুব। স্মৃতি স্মরণ করে গালিব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নাতিদের বলেন, ঠিক আছে তোমরা ফুলের মেলায় যাবে। 

পয়সা দেবেনতো? ফুল কিনবো। 

হুসেন দু’হাত জড়িয়ে ধরে বলে, আপনার জন্য লাল রঙের গোলাপ কিনবো নানাজান। 

বাকির মুখ উজ্জ্বল করে বলে, আপনি কবি। আপনার এত সুনাম চারদিকে। আমাদের এখন সুযোগ হয়েছে একটা বড় লাল গোলাপ আপনাকে উপহার দেয়ার। 

গালিব হা-হা করে হাসেন। বাচ্চারা খুশিতে তালি বাজায়। তারপর ছুটে বেরিয়ে যায়। গালিব উচ্ছ্বসিত হয়ে শের আওড়ান : 

‘মঞ্জুর হবে যদি নিশ্চিত জানো তবে প্রার্থনা করো না, 
অর্থাৎ এক প্রার্থনাহীন হৃদয় ছাড়া আর কিছু চেয়ো না।’ 

কিন্তু পরক্ষণে আবার মন খারাপ হয়। সেই ফুলের মেলাই আবার জমবে, কিন্তু সম্রাট নেই। এই জগতেই নেই। গালিব দু’হাতে চোখের জল মুছলেন। 

একবার তিনিওতো একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে গিয়েছিলেন সম্রাটের সামনে। বলেছিলেন, বাদশাহ হুজুর, হযরত শাহেনশাহ, এই ফুল আপনার জন্য। এই ফুলের সুবাস আপনার কবি খ্যাতি বয়ে নিয়ে যাক হিন্দুস্থানের সব মানুষের কাছে। 

ভাবতে গিয়ে উত্তেজনায় তিনি উঠে বসেন। বালিশে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে দেন বিছানার উপর। ইতিহাস স্মরণ করেন। আকবর শাহের মেজ ছেলে, মির্জা জাহাঙ্গীর একগুঁয়ে বদমেজাজী লোক ছিলেন। যখন তখন যে কারো সামনে দিল্লির ইংরেজ রেসিডেন্টকে উপহাস করতেন। ‘কুলু’ বলে ব্যঙ্গ করতেন। একবার রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর তুমুল বেঁধে যায়। এর কারণে রেসিডেন্ট তাঁকে শাস্তি দিলেন। পাঠিয়ে দিলেন এলাহাবাদে। তাঁর মা ছেলের এই শাস্তিতে খুব আঘাত পেলেন। ছেলে দূরে থাকাতে কষ্ট পেলেন। মানত করলেন ছেলে দিল্লিতে ফিরে এলে হজরত খাজা কুতুবদ্দীনের মাজারে চাদর ও ফুল বিছিয়ে দেবেন। একদিন মায়ের মানত পূর্ণ হয়। বন্দি অবস্থা কাটিয়ে ফিরে আসে ছেলে। মা মাজারে চাদর ও ফুলের তোড়া অর্পণ করেন। মানত পূরণ করেন। সেখানে একটি ফুলের মেলা বসে। 

আহ্ কি আনন্দ! গালিবের মনে হয় তিনি যেন ইতিহাস থেকে ফুলের সৌরভ পাচ্ছেন। লোকমুখে শোনা গল্প কোনোদিন ভোলেননি আরও একটি কারণে। এই ফুলের মেলা হিন্দু-মুসলমানের মিলন মেলায় রূপ নিয়েছিল। সেদিন ফুলবিক্রেতারা কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকীর মাজারে ও যোগমায়া মন্দিরে ফুলের স্তবক অর্পণ করেছিল। কয়েকদিন ধরে হযরত কুতুবের মাজারে মেলা চালু ছিল। শহরের হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে এই মেলায় অংশ নিয়েছিল। ফুলের উৎসবে মানুষের প্রাণে যমুনা নদীর জোয়ার উঠেছিল। 

বাদশাহ এই দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়েছিলেন। বাদশাহ বছরে একবার এই অনুষ্ঠান পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন মুসলমানরা হযরত কুতুবের মাজারে আর হিন্দুরা যোগমায়া মন্দিরে ফুল অর্পণ করবে। শামসি পুকুর থেকে মিছিল শুরু হয়ে মেহের ওলির বাজার পার হয়ে জঙ্গলি মহলে গিয়ে শেষ হবে। সেখানে অভিবাদন জানানো হবে সম্রাটকে। 

ফুল দেয়া হতো একদিন যোগমায়া মন্দিরে, অন্যদিন হজরত কুতুবের মাজারে। উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানরা যেন হিন্দুদের সঙ্গে যোগ দিতে পারে, হিন্দুরা মুসলমানদের সঙ্গে। মেলা চলতো বুধবার থেকে শুক্রবার — তিন দিন। 

গালিব চোখ বুজে স্মৃতির সুখ অনুভব করেন। বাদশা দসহারী আর দিওয়ালি উৎসব উদ্‌যাপন করতেন। সেসব উৎসব গালিবের স্মৃতির দিন। কখনোই ভুলবার নয়। ভুলবেন কবরে যাওয়ার পরে। 

উমরাও বেগম এসে ঘরে ঢোকেন। সরাসরি জিজ্ঞেস করেন, আপনি নাকি বাকির আর হুসেনকে মেলায় যেতে দেবেন? 

হ্যাঁ, দেবো। বাচ্চারা ফুলের মেলায় না গেলে ওদের সুন্দর স্মৃতি থাকবে না। এই আমি যেমন এখন মারা যাওয়ার আগে সুন্দর স্মৃতি নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। 

আমি বারান্দায় পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ফুলের মেলার মিছিল দেখতাম। বাচ্চাদেরকে তো কিছু পয়সা দিতে হবে? 

দেবো। ফুল কেনার আনন্দ ওদেরতো পেতে হবে। 

কার সঙ্গে যাবে ওরা? 

ভাবছি, গলির কেউ যদি যায়। শাহ সুজা ওর ছেলেকে নিয়ে যেতে পারে। তার সঙ্গে দেবো। কাল্লুতো থাকবেই। 

উমরাও বেগম স্বস্তির সঙ্গে মাথা নাড়েন। নির্ভরযোগ্য কারো সঙ্গে না দিতে পারলে তিনি নাতিদের যেতে দিবেন না। তাঁর এই মনোভাব গালিব বুঝতে পারেন। 

ভালোই হলো, বাচ্চারা এই প্রথম একটি উৎসবে যাবে। 

ওরা আর একদম বাচ্চা নেই বিবি। 

আমার কাছে ওরা বাচ্চাই। ওদের আব্বাজানও আমার কাছে বাচ্চাই ছিল। 

ওহ, আরিফ, কবি আরিফ। ও বেঁচে থাকলে একজন বড় কবি হতে পারতো। আমিও ওর মুখ ভুলতে পারি না। ছবির মতো আমার বুকের ভেতর আটকে আছে ওর সুন্দর চেহারা। কত ভদ্র আর বিনয়ী ছিল ও। 

উমরাও বেগম ওড়নায় চোখ মোছেন। 

থাক, এসব কথা। বলতো বিবি, বাদশাহ যেসব উৎসব আয়োজন করতো তার মধ্যে কোনটা তোমার বেশি ভালো লাগতো? 

উমরাও বেগম এক মুহূর্ত ভেবে বললেন, হোলি। 

হ্যাঁ, হোলি আমারও ভালো লাগতো। লালকেল্লায় ধুমধামের সঙ্গে হোলি পালন করা হতো। 

কি যে আনন্দ হতো! কত ধরনের বাদ্য বাজতো শহরের রাস্তায়। আমি বারান্দার চিকের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতাম। খুব ইচ্ছে হতো ছুটে বেরিয়ে যেতে। মনে হতো আপনার হাত ধরে বেরিয়ে যেতে। 

কোনো দিন তো একথা বলোনি আমাকে। 

লজ্জা পেতাম। তাছাড়া বেপর্দা হয়ে বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না সেটাও ভাবতাম। 

তবে আমি হোলি উৎসবে খুব মজা করতাম। দেখতাম গলিতে, বাজারে বাড়িতে বাড়িতে রঙের খেলা চলছে। নানা জায়গায় রঙিন পোশাক পরে বাইজিরা নাচছে। যারা রঙ ছড়াচ্ছে তারা লাইন করে লালকেল্লায় আসছে। প্রাসাদের বারান্দায় বসে বাদশাহ সেসব দৃশ্য দেখছেন। একদিকে বাদশাহ আমীর ওমরাদের নিয়ে বসে আছেন। অন্যদিকে শাহজাদীরা এবং আমিরদের মেয়েরা বসে আছে। রঙ-ছড়ানো লোকেরা একে একে এসে বাদশাহর কাছ থেকে পুরস্কার নিচ্ছে। 

এটুকু শোনার পরে উমরাও বেগম উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, যাই।

কেন? 

আপনার এসব কথা আমার শুনতে ভালো লাগছে না।

তাহলে দসহারা দিনের কথা বলি? একটু বসো বিবি? 

সব উৎসবই আপনার আনন্দ। আমার না। 

তাহলেও একটু বসো। 

উমরাও বেগম অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসলেন। 

গালিব বলেন, দসহারার দিন বাদশাহ সকালে দরবার বসাতেন। সবার বসা হলে শুরু হতো উৎসবের আয়োজন। বাদশাহ প্রথমে একটি নীলকণ্ঠ পাখি ছেড়ে দিতেন। তারপর দুটি বাজপাখি নিয়ে বাদশাহর পাশে দুজন দাঁড়াতো। বাদশাহ বাজপাখি দুটো দু’হাতে ধরতেন। এর অর্থ হলো যে বাদশাহর সামনে শত্রুমিত্র একঘাটে পানি খায়। তারপরে হিন্দু আমির-ওমরাওরা বাদশাহকে নজরানা দিতেন। নয় দিন পর্যন্ত রাসলীলার শোভাযাত্রা চলতো। দশম দিনে ভরতের পুনর্মিলনের পরে উৎসবটি শেষ হতো। 

এটুকু শোনার পরে উমরাও বেগম আবার উঠে দাঁড়ান। বলেন, যাই। 

গালিব মাথা নাড়লেন। বুঝলেন দ্বিতীয়বার বসতে বললে উমরাও বেগম আর বসবেন না। কোনো কারণে তাঁর মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। হতেই পারে, হোক। যেতেই যখন চাইছে, চলে যাক। 

তিনি আবার নীরব হয়ে গেলেন। চিৎপাত শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। 

.

কয়েকদিন পরে আলতফ এলেন। মাঝে কয়েক মাস তাঁর দেখা মেলেনি। এক ঠোঙা আঙুর নিয়ে এসেছেন। 

গালিব মৃদু হেসে বললেন, কেমন করে এতদিন ভুলে থাকলে আমাকে?

আমি তো দিল্লিতে ছিলাম না। 

চিঠি তো লিখতে পারতে? 

আলতফ সে প্রসঙ্গে না গিয়ে বলে, আঙুর খান। আপনার শরীর বেশ ভালো হয়েছে। 

ভালো হয়েছে বুঝতে পারি। কারণ আমার নাতিরা আমাকে দেখে ভয় পেতো। তুমিও ভয় পেয়েছিলে আলতফ। 

কি যে বলেন ওস্তাদ। 

গালিব হাসতে হাসতে নিজের শের আবৃত্তি করেন, 

‘প্রেমের আবেগ বিনয়ীকে মহিমান্বিত করে, 
একটি বালুকণাকে মরুভূমি ধরে রাখে, 
সমুদ্র একটি জলকণাকে।’ 

এক সময় থেমে গিয়ে বলেন, আমি আলোয়ারে যাবো ঠিক করেছি। 

এ সময়ে আলোয়ারে যাওয়ার চিন্তা করা কি ঠিক হবে? 

কেন নয়? 

মাত্র অসুস্থতা কাটিয়ে উঠলেন। 

কিন্তু আলোয়ারের জন্য মন খুব টানছে। আমার পাঁচ বছর বয়সে আমার আব্বা বখতাওর সিং বাহাদুরের জন্য লড়াই করতে গিয়ে মারা গেলেন। সরকার 

থেকে আব্বার তনখাহ আমার নামে ঘোষণা করা হলো। তালরা নামের গ্রামও দান করা হলো। ভাবতে পারো হালি যে দুধ খাওয়া বন্ধ হওয়ার পরে আমি আলোয়ারের রুটি খেতে শুরু করেছিলাম। 

আলতফ তাঁকে রেকাবি ভরে আঙুর এগিয়ে দিয়ে বলেন, খান। 

তিনি একটি আঙুর আলতফকে দেন, একটি নিজের মুখে পুরেন। একটি খেয়ে আর একটি। এভাবে বেশ কয়েকটি খেয়ে বলেন, দিল্লির জৌলুস আর নেই। উৎসব নেই। মুশায়রা নেই। বন্ধু যারা ছিল তারাও বেশির ভাগ নাই। শুধু চিঠি লিখেই যোগাযোগ করছি। চিঠিই এখন আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তারপর হেসে নিজের শের বলেন : 

‘আমি এখনো ভেঙে পড়িনি, অপেক্ষা করছি 
আরো কি ঘটে তা দেখার জন্য।’ 

আলতফ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করেন আপনার কাছে এখন কি বই আছে?

সেই পুরনো বইটি যেটা নিয়ে আমার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চলছে। মৌলভী মোহাম্মদ হুসেন তাববিজীর লেখা ফারসি শব্দকোষ বুরহান-ই-কাতে। আমি বইটি আবার নতুন করে দেখছি। 

কিন্তু যে কারণে আপনার বিরুদ্ধে এত প্রচারণা সেটাতো আপনি আর ফেরাতে পারছেন না। তাহলে বইটি নিয়ে আবার ঘাঁটাঘাটি কেন করছেন? 

যারা আমার বিরুদ্ধে লিখছে তারা বাড়াবাড়ি করছে বলে আমার মনে হচ্ছে। 

আপনি লিখেছেন কাতে-ই-বুরহান আর এর বিপরীতে বই বেরিয়েছে মুহরিকে কাতে, কাতে কাতে, মোওয়য়দে বুরহান, সাতে বুরহান ইত্যাদি কত রকম পুস্তিকা। 

আমি জানি। সবই দেখেছি। আমি এটাও মনে করি যে আমি যেসব ভুল ধরেছি তা যথার্থ। 

ওস্তাদজী আমার মনে হয় যে বই দুশো বছর আগে লেখা হয়েছে তার ভুল ধরাটা বুরহানের অনুরাগীরা মানতে পারছে না। তারা এ কাজকে যথার্থ মনে করছে না। 

গালিব উত্তেজিত হয়ে বলেন, ভুল ধরে আমি ঠিক কাজ করেছি। আমি আমার ফারসি ভাষার জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছি। আর ওরা আমার সমালোচনার জন্য আমাকে গালাগালি করে চিঠি লিখছে। অশ্লীল ভাষায় নিন্দা করছে। 

আপনিতো এতদিন এসব হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, গাধা লাথি মারলে কি গাধাকে লাথি মারতে হবে? 

তুমিতো জানো হালি যে পাতিয়ালের মিয়া আমিনউদ্দিন ‘কাতে-কাতে’ নামে বই লিখে আমাকে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করেছে। আমি ভেবেছি এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। আমি ব্রিটিশ অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের কোর্টে আমিনউদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবো। 

গালিব টেবিলের ওপর থেকে কয়েকটি কাগজের টুকরো এনে হালিকে দেখান। 

হালি ইশতেহারগুলোর দিকে একনজর তাকিয়ে বলেন, এগুলোর বিষয়ে আমি জানি। আপনাকে বাজে ভাষায় আক্রমণ করে লিখেছে। 

তুমি কি এদের সঙ্গে একমত? 

হালি মাথা নিচু করেন। 

গালিব হালির উত্তরের অপেক্ষা না করে বলেন, আমিতো তোমাকে আগেই বলেছি, ‘বুরহান-ই-কাতে’ যারা পড়বে তাদের শব্দকোষ বিষয়ে বিদ্যা থাকতে হবে, ফারসি ভাষা শুদ্ধভাবে জানতে হবে, ভাষার জন্য ভালোবাসা থাকতে হবে। এমন মানুষই আমার মতামতের মূল্য দিতে পারবে। অন্যরাতো মুর্খের মতো আচরণ করবে। কিন্তু যে ভাষায় আমিনউদ্দিন আমাকে আক্রমণ করেছে, তার কোনো মাত্রাজ্ঞান নেই। যাঁরা এসব কুৎসা রটনা করছে তাদের মনে রাখা উচিত যে আমি একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। সম্রাট আমাকে ‘সাম্রাজ্যের নক্ষত্র’ উপাধি দিয়েছিলেন। 

গালিব থামলে আলতফ বলেন, আপনি যা বলছেন তা ঠিক। 

তাহলে কি আমিনউদ্দিন ঠিক কাজ করেছে? 

তা আমি বলতে পারবো না। তবে ওস্তাদ আপনার পক্ষে-বিপক্ষে যাঁরা আছেন তাঁরা দিল্লির সাহিত্য জগতের নামজাদা ব্যক্তি। এঁদের সঙ্গে লড়াইটা কঠিন হবে। 

কঠিন হবে? আমি কাউকে ভয় পাই না। 

গালিব ক্ষুব্ধস্বরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। বলেন, আমি দেখতে পাচ্ছি শব্দকোষ নিয়ে জ্ঞানের আলোচনার চেয়ে আমাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করছে বেশি। ওরা কবি গালিবকে সহ্য করতে পারছে না। আমি সবই বুঝি। ওই বইয়ের সমালোচনা যা করেছি তা আমি ঠিকই করেছি। 

ওস্তাদজী শান্ত হন। 

শান্ততো হয়েই আছি। তবে মামলা আমি করবোই। 

আলতফ মৃদুভাবে বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ওস্তাদ আমি বলি কি আপনি এখন থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। শারীরিক কারণে যদি দাঁড়িয়ে পড়তে না পারেন তবে বসে পড়েন। প্রতীকীভাবে পড়েন। যেভাবে আপনার সুবিধা হয় সেভাবে পড়েন। পানি দিয়ে ওজু করা সব সময় সম্ভব না হলে বালি দিয়ে ওজুর কাজ সারতে পারেন। কোনোভাবে নামাজ পড়া বাদ দেয়া চলবে না। 

তুমি আমাকে উপদেশ দিচ্ছ হালি? 

গালিব স্থির চোখে হালির দিকে তাকিয়ে থাকেন। চোখের পলক পড়ে না।

হালি মাথা নিচু করে থাকেন। 

গালিব আবার ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলেন, আমার বয়স হয়েছে। মৃত্যু আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আমার পুরো জীবন কাটিয়েছি পাপ কাজ করে। তোমাদের ভাষায় পাপ। তার জন্য আমি অনুতাপ করি না। আমি নামাজ পড়িনি, রোজা রাখিনি, ভালো কোনো কাজও করিনি। বাকি যে কয়দিন বাঁচবো সে কয়দিন নামাজ পড়লে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা হবে? তুমি কি তাই ভাবো হালি? 

হালি উত্তর দেন না। চুপ করেই থাকেন। মাথা তুলে গালিবের দিকে তাকান না। 

তবে ভালো হয় একটি কাজ করলে। 

গালিবের কণ্ঠ বিদ্রূপের ধ্বনিতে হালির কানে এসে বাজে। হালি তারপরও মাথা তুলে তাকাতে পারেন না। 

গালিব হালির অবস্থান উপেক্ষা করে বলতে থাকেন, সবচেয়ে ভালো হবে আমার মৃত্যুর পরে আমার বন্ধু এবং আত্মীয়-স্বজনরা যদি আমার দাফনের ব্যবস্থা না করে যদি মুখে কালি লাগিয়ে, পায়ে দড়ি বেঁধে দিল্লি শহরের রাস্তায়, গলিতে, বাজারে ঘোরায়। তারপর যদি কুকুর, চিল ও কাকের খাদ্য হবার জন্য ফেলে দেয় শহরের বাইরে। অবশ্য সেইসব প্রাণী যদি আমার শরীরের মতো জিনিস খেতে রাজী থাকে। কি বলো হালি? 

হালি এবারও নিশ্চুপ থাকেন। 

গালিবের বিদ্রূপের কণ্ঠ চারদিক ছড়িয়ে যায়। কণ্ঠস্বর উঁচুও হয়। বলতে থাকেন, আমার মনে হয় আমার পাপের পরিমাণ এত বেশি যে শুধু এইটুকু শাস্তিতে তার ভার লাঘব হবে না। এর চেয়েও বড় শাস্তি আমার পাওনা হয়। আমি হলফ করে বলবো যে আমি এক এবং অদ্বিতীয় আল্লায় বিশ্বাস করি। আমি যখন একা থাকি তখন সারাক্ষণ বলি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’—আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ঈশ্বর নাই—সবকিছুর মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্ব বিরাজমান। 

হঠাৎ করে আকস্মিকভাবে রেগেমেগে বলেন, বুঝলে বুঝলে হালি, এরপরও তুমি বলবে না যে আমি নামাজ না পড়ে পাপ করছি। 

ওস্তাদজী, আমি আজকে যাই। 

যাও, যাও। সরো চোখের সামনে থেকে। 

হালি নিঃশব্দে বেরিয়ে যান। গালিব আরও উত্তেজিত হোক এটা তিনি চাননি। দেখতে পান গালিব নিজের উত্তেজনা সামলাচ্ছেন। বালিশে হেলান দিয়ে পা সোজা করে দেন। 

রাস্তায় বেরিয়ে হালি ভাবলেন, আমিতো ওস্তাদের ভক্ত। তারপরও স্বীকার না করে পারছি না যে ওস্তাদের কিছু ভুল আছে। বোধহয় তিনি লেখাটি লিখেছিলেন স্মৃতি থেকে। মূল বইগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারেননি বোধহয়। দেখলে ভুল কম হতো। তাছাড়া তিনি যে কটু মন্তব্য লিখেছিলেন সেগুলো সম্পর্কে আর একটু সতর্ক হলে বিরোধী পক্ষ এমন আক্রমণের সুযোগ পেতো না। ওস্তাদ যে মন্তব্য করেছিলেন তার বিরুদ্ধে কত যে প্রচারপত্র ছাপা হয়েছে। এখন চারদিকে তাকালে মনে হয় পুরো শহরটি বুঝি গালিবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তিনি নিজে শহরের রাস্তায় বের হলে বুঝতেন অবস্থা কত খারাপ! যেতে যেতে থমকে দাঁড়ালেন হালি। ভাবলেন, আসলে এতকিছু ঘটছে এ কারণে যে ওস্তাদ শহরের নামকরা এক লেখক গোষ্ঠীর মূলে আঘাত করেছেন। সে জন্য ওরা ক্ষেপেছে। এই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠার মাত্রা রাখেনি তাঁরা। সব শালীনতা পার হয়ে গেছে। ওরা এত বাড়াবাড়ি না করলেই পারতো। হালি নিজে নিজে ভাবলেন এবং বুড়ো কবির অসুস্থাবস্থার পরে এমন নাজেহাল হওয়ার বিষয়টি ভেবে মন খারাপ করলেন। 

কয়েকদিন পর ব্রিটিশ অ্যাসিসটেন্ট কমিশনারের কোর্টে মামলা দায়ের করলেন গালিব। বিবাদী আমিনউদ্দীন। মামলার মূল বিষয় আমিনউদ্দীন তাঁর প্রচার পুস্তিকায় গালিব সম্পর্কে যা লিখেছেন তা আসলেই অশ্লীল কিনা। গালিবের পক্ষে দাঁড়ালেন অনেকে। বিপক্ষে গেলেন দিল্লি কলেজের অধ্যাপক রিয়াজউদ্দিনসহ আরও অনেকে। সবাই সাহিত্য জগতের নামকরা ব্যক্তি। যত দিন গড়াচ্ছে গালিব বুঝতে পারছেন যে তাঁর ন্যায়বিচার পাওয়া সহজ হবে না। উপরন্তু ব্রিটিশ কমিশনার বিতর্কের বিষয়টি ঠিকমতো বুঝতে পারছে না। একজন বিদেশির পক্ষে বাদ-বিচারের পরিপ্রেক্ষিত বোঝা কঠিন। গালিব বিধ্বস্ত, শরীর ঠিক মতো চলে না, তারপরও বুঝতে পারছেন মামলাটি খুব বাজে অবস্থার দিকে যাচ্ছে। জ্ঞানীগুণীরাও একজন লেখকের অশালীনতাকে সমর্থন দিচ্ছে। সাহিত্যকে বারবণিতার পর্যায়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই বয়সে এতকিছু মেনে নেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। 

আমি তো বিনা দ্বিধায় শরাবের প্রতি আমার ভালোলাগা জানিয়েছি। লুকিয়ে ছাপিয়ে শরাব পান করিনি। আমিতো আল্লাহর অস্তিত্বের বিশ্বাসী। কিন্তু ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা আমি মেনে চলি না। এটিও সবাই জানে। তারপরও ওরা আমার জীবনযাপন নিয়ে অশ্লীল কথা বলে। আমার সৎ নিষ্ঠাকে ওরা সাধুবাদ জানাতে পারে না। তাহলে এ মামলা চালিয়ে আর লাভ কি। আয়ুতো শেষ হয়েই এসেছে। আরও দ্রুত শেষ হবে মাত্ৰ। 

নিজের সঙ্গে তিনি বোঝাপাড়া করলেন। 

একদিন মৌলভী জিয়াউদ্দিন আদালতে দাঁড়িয়ে সবার সামনে বললেন, আমিনউদ্দিনের বইতে গালিবকে আগ্রার শুঁড়ি বলা হয়েছে। এটি কোনো দোষের কথা নয়। কারণ গালিব একজন মাতাল, পাঁড় মাতাল। মদ ছাড়া তাঁর দিন চলে না। এছাড়া ‘কাতে কাতে’ গ্রন্থে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে তিনি তার উপযুক্তই লোক। এতে সত্যের অপলাপ হয় না। 

এসব শুনে গালিব বুঝলেন, যারা তাঁকে বুঝতে পারলো না তাদের বিরুদ্ধে মামলা চালানো বৃথা 

তিনি আবেদন করে অভিযোগ প্রত্যাহার করলেন। ভাবলেন যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাবেন। যে হৃদয় পুড়ে যাচ্ছে সেটাতো রোধ হবে। 

কিন্তু হলো না। বিরোধী পক্ষ তাঁকে ছাড় দিতে রাজী নয়। বেনামী চিঠি আসা শুরু হলো। চিঠিতে নাম নেই, ঠিকানা নেই। তাই ভাষা আরো অশ্লীল। কুৎসিত। 

এত আক্রমণ নিয়েও তিনি সোজা হয়ে রইলেন। কোনো অনুশোচনায় ভেঙে পড়লেন না। কিন্তু শারীরিক জোর ভেঙে পড়েছে, প্রবল শক্তি নিয়ে প্রতি আক্রমণ করতে পারছেন না। তারপরও দুর্বিনীত হয়ে থাকতেই পছন্দ করলেন। কোনো সমঝোতা নয়। কারো কাছে নতিস্বীকারও নয়। 

মাঝে মাঝে বাকিরের কথা খুব মনে হয়। এই সময় ও কাছে থাকলে খানিকটা জোর পেতেন। সাহসও পেতেন। বাকির মাসোহারার ভিত্তিতে চাকরি নিয়ে আলোয়ারে গিয়েছে। ওখানেই থাকে। যা সামান্য আয় তা দিয়ে নিজের সংসার চালাতেই কষ্ট হয় ওর। 

সেদিন দুপুরবেলায় মাংসের সুরুয়া আর রুটি খেতে বসেছেন। হাল এসেছেন। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই খাবারের সময় হয়ে যায়। কাল্লু খাবার নিয়ে আসে। 

তখন পিয়ন চিঠি নিয়ে আসে। সুরুয়া মাখানো এক টুকরো রুটি মুখে দিতেই মনে হয় বমি পাচ্ছে। তিনি বাম হাত দিয়ে চিঠিটা হালির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন, খুলে পড়ো। আমিতো জানি ওই চিঠিতে কি থাকতে পারে। 

হালী চিঠিটি পড়ে বিব্রতবোধ করলেন। এত কুৎসিত ভাষা যে চিঠিটি জোরে পড়া যাবে না। তিনি চুপ করে রইলেন। 

গালিব বললেন, বুঝেছি। পড়তে পারছো না। দাও, আমাকেই দাও।

তিনি টেনে নিয়ে চিঠিটা পড়েন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্তই পড়েন। চিঠিতে এক জায়গায় মা তুলে গালাগাল দিয়েছে। 

পড়া শেষ করে হালির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, গালাগালি করার জন্য চিঠিটা লিখেছে। কিন্তু গালাগালি করতেও শেখেনি। শোনো, বুড়ো বা মাঝবয়সীদের লজ্জা দেয়ার জন্য মেয়ে তুলে গাল দেয়া হয়। তরুণদেরকে বৌ তুলে গাল দেয়া হয়। কারণ বৌয়ের প্রতি তার টান বেশি হয়। আর ছোট বালকদের মা তুলে গাল দেয়া হয়। কারণ তখন পর্যন্ত মা ছাড়া সে কিছু বোঝে না। আর এই বদমাশটি একজন বাহাত্তর বয়সী লোককে তার মাকে নিয়ে গালি দিয়েছে। এর চেয়ে বেকুব আর কে আছে বলো হালি? আমারতো মনে হয় এ তোমারই কোনো আসল শিষ্য? নাকি? 

হালি লজ্জায় মুখ ফেরালেন। আর তিনি খাবারে মনোনিবেশ করলেন। খাওয়া শেষ করার আগে আর কোনো কথা বললেন না। 

হালি বুঝলেন যে তাঁকে এই খোঁচাটি দিলেন তিনি। কারণ তিনি একদিন তাঁকে নামাজ পড়ার জন্য উপদেশ দিয়েছিলেন। কাল্লু যখন তাঁকে হাত ধোয়াচ্ছিলো তখন হালি উঠে পড়লেন। গালিব গামছায় হাত মুছতে মুছতে নিজে নিজে বললেন, আমার কোনো অনুশোচনা নেই। আমি যা করেছি তা আমার জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে করেছি। জেনেশুনেই করেছি। আমার শব্দকোষে ভুল নেই। ভুল করে তো কিছু করিনি তাহলে অনুশোচনাই বা কিসের! 

হুসেন এসে ঢোকে। 

নানাজান খাওয়া হয়েছে?

হ্যাঁ, শেষ করেছি।

তুমি খেয়েছো?

খেয়েছি। 

গালিব স্নেহের দৃষ্টিতে হুসেনের দিকে তাকালেন। বাকির আলোয়ারে যাওয়ার পরে ও একা হয়ে পড়েছে। কোনো মাসোহারা ওর নেই। ওর খরচ গালিবকেই টানতে হচ্ছে। বয়সও হয়েছে। দেখতে সুন্দর। স্বাস্থ্য ভালো। ওর বিয়ে দেয়া দরকার। উমরাও বেগম বিয়ের কনে ঠিক করেছেন। কিন্তু আর্থিক কারণে কোনো কিছু হচ্ছে না। কিছু টাকা দেনা আছে। সেটাও শোধ করতে পারছেন না। 

হুসেন তাঁর ঘরের এ মাথা ও মাথা ঘুরে ফিরে তাঁর কাছে এসে বসে। ওকে দেখেই গালিব বিষণ্ণ হয়ে যান। ওর বিয়ের জন্য দু’বার তারিখ ঠিক হয়েছিল, কিন্তু অর্থের কারণে হয়নি। কবে হবে সেটাও জানা নেই। গালিব ওর মাথায় হাত রাখেন। 

হুসেন বলে, আমিও আলোয়ারে যাই নানাজান? ওখানে গিয়ে কিছু হয় কিনা দেখি। বেকার বসে থাকতে আমার ভালো লাগছে না। 

তোমাকে ছাড়া আমি কেমন করে থাকবো ভাইয়া? তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। 

নানিজানও এই কথাই বলেন। কিন্তু আপনারতো অনেক কষ্ট হচ্ছে।

তুমি বলো যে আমাকে ছেড়ে যাবে না? 

হুসেন এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে, আচ্ছা যাবো না। 

গালিব পকেট থেকে দুটো টাকা বের করে ওকে দেন। 

হুসেন হেসে বলে, এখন লাগবে না। টাকা আপনার কাছে থাকুক। পাওনাদাররা খুব জ্বালাচ্ছে আপনাকে। 

মৃত্যুর আগে ওদের টাকাটা শোধ করতে চাই। এক হাজারের চেয়ে সামান্য বেশি কিছু টাকা শোধ করতে হবে। কি করে শোধ করবো ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। দেনা শোধ না করে মরে যাওয়াতো মুসলমানের ধর্ম নয় হুসেন। 

নানাজান আপনি চিন্তা করবেন না। একটা কিছু হবে। নিশ্চয় আপনার দেনা শোধ হবে। আমি আর ভাইয়া মিলে দেনা শোধ করে দেবো। 

দেনার কথা মনে হলে আমার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। আমি শরমে মরে যাই। পাওনাদাররা বাড়িতে এলে মান-মর্যাদা কিছু থাকে না হুসেন। 

আপনি শান্ত হন। 

আমিতো জানি আমার মৃত্যুর পরে দেনা কেউ শোধ করতে পারবে না। তোমার নানিজানকেই বা কে দেখাশোনা করবে। 

হুসেন চুপ করে থাকে। কি বলবে ও? এখন পর্যন্ত ও বেকার। ভবিষ্যতের কথা ও এখনই বা কি বলবে? গালিব আর্তনাদের কণ্ঠে বলেন, এখন আমি দেনা নিয়ে চিন্তা করছি। ভবিষ্যতের কথা ভাবছি। অথচ জীবনভর টাকা পয়সাকে তুচ্ছ করেছি। সাধ্যের বাইরে টাকা পয়সা উড়িয়েছি। আর এসব করতে গিয়ে ডান-বামে না তাকিয়ে ধার করেছি। 

গালিব দু’হাতে মুখ ঢাকেন। হুসেন নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। 

কয়েকদিন পরে টাকা পয়সার আশায় তাঁর শেষ ভরসাস্থল রামপুরার দরবারে আবেদন করলেন। সময়টা ছিল জুলাই মাস। বর্ষাকাল। সংসারের আর্থিক টানাটানিতে মনে হচ্ছিল দিন যেন আর কাটছে না। চিঠিতে প্রথমে বকেয়া দেনাটুকু শোধ করার জন্য আবেদন জানালেন। দ্বিতীয়ত হুসেনের বিয়ের জন্য আর্থিক অনুদান চাইলেন। তৃতীয়ত তাঁকে যে একশত টাকা বৃত্তি দেয়া হয় সে বৃত্তি তাঁর মৃত্যুর পরে হুসেন ও বাকিরকে পঞ্চাশ টাকা করে দেয়ার অনুরোধ করলেন। 

কিন্তু কোনো জবাব পেলেন না। কোনো অর্থ সাহায্যও এলো না। গালিবের দু’চোখে অন্ধকার নামলো। শরীর ভেঙে পড়লো। 

শরীরে যেসব রোগ আগে থেকেই ছিল তার মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো। সেই বৃষ্টিমুখর শীতার্ত রাতের কথা মনে পড়ছে বারবার। এইতো কিছুদিন আগে বছর দুয়েক হবে রামপুরা থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। রামপুরার নতুন নওয়াবের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে মুরাদাবাদের ঠিক আগে নদী পার হওয়ার সময় সেতু ভেঙে পড়ে। তিনি অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন। যে পাল্কিতে ছিলেন তিনি তাঁর মাথা ছুঁয়ে সেতুটি পড়ে। সেদিন আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানিয়েছিলেন। গরুর গাড়িতে ছিল জিনিসপত্র আর পরিচারকরা। সবাই মিলে রাস্তায় আটকে পড়েছিলেন। একটি পান্থশালা জোগাড় করে রাত কাটিয়েছিলেন। পান্থশালার খাবার ভালো ছিল না বলে রাতে না খেয়ে থাকলেন। ভয়াবহ শীত। তার সঙ্গে ঝড়বৃষ্টি। 

নানা দুর্ভোগ পার হয়ে বাড়ি ফেরার পরে সেই যে স্বাস্থ্য ভাঙলো আর ঠিক হতে পারলেন না। ঠিকমতো দেখতে পান না, কানেও শোনেন না—এতো বেশ কয়েক বছরের অসুস্থতা। এখন স্মৃতিও লোপ পেয়েছে। কলম ধরতে পারছেন না। হাত কাঁপে। 

এখন হাঁটতেও পারছেন না। পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছেন। উমরাও বেগম 

আর তেমন দেখাশোনা করতে পারেন না। বাগানে শুয়ে থাকেন। দুজন লোক পাঁজকোলা করে তুলে বাগানের পাশের একটি কুঠুরিতে রেখে যায়। ঠিকমতো জানালা নেই। প্রায় অন্ধকার কুঠুরি। 

সারাদিন সেখানে পড়ে থাকেন। 

সমস্ত দিন পার হয়ে যায়। দুপুরে মাংসের সুরুয়া খান। খাটিয়ায় পড়ে থাকেন। ঘুম আসে না। নিজের কোনো শের মনে পড়ে না। দরজা দিয়ে বাইরে তাকান। দিন না রাত বুঝতে পারেন না। সন্ধ্যায় দুজন লোক আবার একইভাবে পাঁজকোলা করে ঘরে নিয়ে আসে। শুইয়ে দেয় খাটে। 

রাতের খাবার দু-তিনটে ভাজা কাবাব। আর ঘুমানোর আগে পান করেন বাড়িতে তৈরি পাঁচতোলা সুরা। তারপর রাত কীভাবে কাটে তা ভাবা তাঁর জন্য এক মর্মান্তিক যন্ত্রণা। দিনরাত এখন সমান। মানতে পারেন না কিছুই। চিৎকার করতে ইচ্ছা করে। সবকিছু ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। 

লেখালেখি পুরো বন্ধ। কিন্তু মস্তিষ্ক সচল। ভাবতে পারেন। বহুদিনের অভ্যেস চিঠি লেখা। প্রিয় একটি কাজ। কাউকে মুখে মুখে বলে দেন। সে চিঠিটি লেখে। এর মধ্যে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে কবিতা আসে সংশোধনের জন্য। জমে থাকে সেসব লেখা। গত বছর এসব কবিতা না পাঠানোর জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে খুব কাজ হয়নি। যারা তাঁর সাগরেদ তারা পাঠাতেই থাকে। গালিব নিজেকে বলেন, যারা আমার বিরুদ্ধে লেগেছিল, আমাকে আদালতে যেতে বাধ্য করেছিল তারা দেখো গালিব কত সম্মানিত, এখনো কত প্রিয় মানুষের কাছে। তোমরা ওদেরকে ঠেকিয়ে রাখতে পারনি। তোমাদের বাঁধ ভেঙে ওরা জলের স্রোতের মতো আমার কাছে পৌছে যায়। এই গালিব, এই গালিবের সামনে কোনো বাঁধ কাজ করে না। 

হুসেন তাঁর বিছানার কাছে বসে থাকে। ও জানে রামপুরার নওয়াবের কাছে অর্থের জন্য আবেদন করেছেন তাঁর নানাজান। তাঁকে যে একশ টাকার বৃত্তি দেয়া হয় সে রশিদটি পাঠানো হয়নি বলে জানিয়েছে রামপুরার দরবার থেকে। 

গালিব মাঝে মাঝে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরলে স্বাভাবিক কথা বলেন। তাঁর মন খুব সজাগ। সক্রিয়। কথাবার্তা স্বাভাবিক, তা প্রলাপের মতো নয়। জ্ঞান ফিরলে হুসেনকে জিজ্ঞেস করলেন, রশিদটি কি নওয়াবের দরবারে পৌঁছেছে? 

আমি তা জানি না নানা। 

নওয়াব কলব আলী খান আমার উপর বিরক্ত হয়েছেন। 

কেন নানা? 

আমি তাঁর লেখার সমালোচনা করেছিলাম। একটু থেমে বলেন, সমালোচনাতো করবোই। ভুলকে আমি ভুলই বলি। কারো মুখের দিকে চেয়ে তাকে আমি ঠিক বলতে পারি না। সেই থেকে তিনি আমার ওপর নাখোশ। তবে আমার বৃত্তিটি বন্ধ করেননি। 

হুসেন তাঁর হাত চেপে ধরে বলে, আমিতো জানি আপনি মাসে মাসে বৃত্তির একশ টাকা পেয়ে যাচ্ছেন। 

গালিব মৃদু হেসে চুপ করে থাকেন। তারপরে বলেন, তোমার দাদীকে ডাকো। 

হুসেন ছুটে যায়। অল্পক্ষণে উমরাও বেগম আসেন। 

ডেকেছেন কেন? খারাপ লাগছে? 

না, বিবি তবিয়ত ঠিক আছে। না, ঠিক বললাম না। ওটা ঠিক নেই। তবিয়ত যেমন ছিল তেমনই আছে। 

উমরাও বেগম বিছানার কাছে বসেন। দোয়া পড়েন। 

গালিব বলেন, আমিতো আর বেশিদিন নাই। যে কোনো সময়ই চলে যেতে পারি। 

এভাবে বলবেন না। আল্লাহকে ডাকুন। 

আমি ভাবছি আমার মৃত্যুর পরে তুমি কীভাবে চলবে বিবি।

আমারও তবিয়ত ভালো নেই। আমিও বেশিদিন বাঁচবো না। 

তারপরও ধরো তুমি যদি দুই মাস বেশি বাঁচো। 

আমার জন্য বাকির আছে, হুসেন আছে। আমার ভাই আমিনউদ্দিন, জিয়াউদ্দিন আছে। আমার দিন কেটে যাবে। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আপনার জন্য পেস্তাজল নিয়ে আসছি। 

উমরাও বেগম চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে যান। 

.

কয়েকদিন পরে গালিবকে দেখতে আলতফ আসেন। গালিবের জন্য তাঁর টান প্রবল। বিভিন্ন সময়ে না এলে নিজেই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। সময়ের তিনিই সেই মানুষ যিনি গালিবকে স্বচ্ছভাবে বুঝতে পারেন। বিছানার কাছে বসে হাত ধরতেই গালিব চোখ খুলে তাকান। 

আমি হালি। 

চিনেছি। তোমার চেহারা ভুলে যাইনি। তুমি আমার সাগরেদদের মধ্যে সবচেয়ে কাছের। 

আপনি কেমন আছেন? 

গালিব উত্তর না দিয়ে চোখ বন্ধ করেই রাখেন। কিন্তু হালির হাত ছাড়েন না। হালি তাঁর নিমীলিত চোখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ভাবেন, এই মানুষটি জীবনের শেষবেলায় কত ভয়াবহভাবে নিঃসঙ্গ — তাঁর সামনে দিল্লির শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর নেই। যিনি নিজে গোঁড়া মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও গালিবের সব ধরনের আচরণকে সহজভাবে দেখতেন। সম্রাট বেঁচে থাকলে তাঁকে এমন দুঃসহ জীবনযাপন করতে হয়তো হতো না। কে জানে! হালি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। 

অভিজাত গোষ্ঠীর মুসলমানরা গালিবকে পছন্দ করতেন। তাঁকে সব ধরনের সহযোগিতা দিতেন। গদরের পরে তাঁরা একদম বসে গেছে। কারো আর সেই অবস্থা নেই যাঁরা তাঁর পাশে এসে দাঁড়াবেন। কয়েক দিন আগে আজুরদা মারা গেছেন। এই খবর কি কবিকে দেয়া দরকার? না থাক। কী হবে মৃত্যুর খবর জানিয়ে তাঁকে কষ্ট দেয়ার! শহরে আজুরদা থাকলে এই নিঃসঙ্গ কবির এত কষ্ট হতো না! 

এই সময়ে ব্রিটিশরা যে নতুন বণিকশ্রেণী গড়ে তুলেছে তারা সাহিত্য বুঝে না। বাণিজ্য বুঝে। তাদের কাছে একজন বড় কবির কোনো মূল্য নেই। তাই কবিকে নিঃসঙ্গ থাকতেই হবে। তিনি এখন অসুস্থ বৃদ্ধ এবং দেনাগ্রস্ত 

তখন গালিব মৃদুকণ্ঠে ডাকেন, হালি। আমি একটি লিখিত বিবৃতি দিয়েছি।

বিবৃতি? কি ধরনের বিবৃতি? 

আমি আলাইকে আমার উর্দু কবিতা ও গদ্যের উত্তরাধিকারী করেছি। আমার মৃত্যুর পরে যারা আমাকে মানে, আমার অধিকার স্বীকার করে তারা আলাইকেও একই অধিকার নিয়ে স্বীকার করবে। এটা আমি সীলমোহরের উপর লিখে রেখেছি। তুমিও জানলে হালি। 

ঠিক আছে। আমি জানলাম। 

আমার বালিশের নিচে আলাইয়ের একটি চিঠি আছে। বের করে পড়ো।

হালি বালিশের নিচ থেকে চিঠি বের করে পড়েন। 

গালিব আলতফকে বলেন, চিঠিটা আবার পড়ো। 

হালি বলেন, চিঠি পড়ে কি হবে। লোহারুর নওয়াব আলাউদ্দিন খান আপনার স্বাস্থ্য বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। 

তুমিতো জানো হালি এই আলাইকে আমি খুব বেশি ভালোবাসি । 

আমি জানি। লোহারু পরিবারের মধ্যে তিনিই আপনার সবচেয়ে বেশি স্নেহধন্য। 

ও আমাকে দেখতে আসেনি। 

অভিযোগ করে গালিব আবার চোখ বুজলেন। একটু পরে চোখ খুলে বললেন, তুমি আমার একটি জওয়াব লিখে দাও। 

হালি কাগজ কলম নিয়ে এলেন। গালিব বলতে থাকেন, কেমন আছি জানতে চেয়েছো। কি হবে জেনে? কেন জানতে চেয়েছো? দু-একদিন পরে প্রতিবেশী, বন্ধু বা আত্মীয়দের কাছে খোঁজ নিও যে আমি কেমন আছি। 

এটুকু বলে তিনি থামলেন। হালি বুঝলেন যে চিঠি এখানেই শেষ। তিনি চিঠি ভাঁজ করে খামে ঢোকালেন। ঠিকানা লিখলেন। তখন শুনতে পেলেন আকস্মিকভাবে গালিব বলে যাচ্ছেন : 

‘বিপদ বিধ্বস্ত গালিবের 
অভাবে
কোনো কাজই কি 
থেমে থেকেছে? 
এত কান্নাকাটির প্রয়োজন নেই 
প্রয়োজন নেই 
উচ্চস্বরে বিলাপ করবার।’ 

কয়েকবার বিড়বিড় করে খানিকটুকু বলে থেমে গেলেন। হালি বুঝলেন জ্ঞান হারিয়েছেন। হালি অপেক্ষা করলেন। কিন্তু আর চোখ খুললেন না। হুসেন বললো, নানাজানের তো এমন অবস্থাই চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসবে। 

হালি ওর কাছ থেকে বিদায় নিলেন। হুসেনকে বোধহয় কিছু বলা উচিত ছিল, ভাবলেন। কিন্তু কি বলবেন তা ভেবে পেলেন না। বল্লিমারো মহল্লায় তিনি স্তব্ধ হয়ে সামান্যক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর হাঁটতে শুরু করলেন। মনে হলো কাসিম জান গলি পার হতে বুঝি পারবেন না। বুঝি এই গলিটুকু পার হতে দু’দিন দু’রাত চলে যাবে। তিনি শোকার্ত চিত্তে ঘোরের ভেতর পথ হাঁটতে শুরু করলেন। গলির মাথায় কাল্লু মিয়া তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, হুজুর আপনি চলে যাচ্ছেন? 

কাল আবার আসবো। 

হালির চোখ থেকে জল ঝরলো। কাল্লু মিয়ারও। 

রাত কেটে গেলো। বিছানার চারপাশে অচেতন গালিবকে ঘিরে বসে রইলো কেউ কেউ। পরদিন ভোর। জ্ঞান ফিরলো না। সারাদিন কেটে গেলো। সন্ধ্যা হবো হবো করছে। বল্লিমারো মহল্লার বাড়িগুলোর মাথায় সূর্যের শেষ স্পর্শ লেগেছে। কাসিম জান গলির মানুষেরা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে ভাবে, কোথায় কি যেন ভেঙে পড়ছে। তখন মাগরিবের আযান ভেসে আসে। মুয়াজ্জিনের কণ্ঠস্বর প্লাবিত হয় মহল্লায়। 

উমরাও বেগম হুসেনকে বললেন, তিনিতো এতটা সময় অচেতন থাকেন না হুসেন। 

হুসেন তাঁর দিকে না তাকিয়ে বলে, নানিজান আযান শেষ হয়ে গেছে।

তাহলে আমি নামাজ পড়ে আসি। 

উমরাও বেগম বেরিয়ে যান।

মাগরিবের নামাজের সময় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মীর্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব। 

তখন বসন্তকাল। দিল্লির বাতাস স্নিগ্ধ। শহরের উপর রাতের অন্ধকার নামছে। গ্যাস বাতি জ্বলে উঠেছে রাস্তায়। 

সেদিন ১৮৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। বছরের প্রথম মাসটি পার হয়েছে মাত্র। কলরব করছে শহর। যে শহরকে তিনি কারাগার ভেবেছিলেন যৌবনে, যে শহরে বাস করে নিজেকে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন—সে শহরের বুকে স্নিগ্ধ বাতাসে উড়ে যায় তাঁর কবিতার চরণ- 

‘বন্ধু, তোমাদের পুষ্পোদ্যানে আমি 
এক আগাছা 
যদি চলে যাই 
দুঃখ পেয়ো না। 
সাইপ্রাস ও সুগন্ধী ফুল
তোমরা, আমি নই। 
যদি ভালোবাসা নাও থাকে
তবু বাহবা দিও উচ্চকণ্ঠে,
যে কবিতা তোমাদের দিলাম
তার শেষ পারিশ্রমিক 
দিতে ভুলো না। 
জানি ভুলে যাবে 
বন্ধুজন আনন্দ সমাবেশে 
হয়তো পড়বে মনে কোনওদিন 
কোনও কবিতার মজলিসে।’ 

পরদিন দুপুরবেলা। গনগনে দুপুর মাথার ওপর রোদ ছড়িয়েছে। 

দাফন করার জন্য কবির মরদেহ আনা হয়েছে ফকির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার কবরের কাছে। এখানে আছে লোহারু বংশের পারিবারিক গোরস্থান। লোহারু বংশের যে প্রিয় মানুষটি তাঁর কবিতা সংরক্ষণ করতেন তিনি মরদেহের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন—নওয়াব জিয়াউদ্দিন খান। আরও আছেন হাকিম আহসানউল্লাহ খান, নওয়াব মুস্তাফা খান সইফতা। 

তখনো বসন্তের বাতাসে স্নিগ্ধতা। কিন্তু শোকার্ত মানুষের হৃদয়ে সে স্নিগ্ধতার স্পর্শ নেই। অগণিত মানুষ এসেছে জানাজায় যোগ দিতে। শিয়া সম্প্রদায়ের একজন বললেন, মির্জা সাহেব শিয়া ছিলেন। তাই শিয়া প্রথা অনুযায়ী তাঁর দাফন করতে চাই। 

নওয়াব জিয়াউদ্দিন খান দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, আমার চেয়ে বেশি আর তাঁকে কে চেনে? আমার কিশোর বয়স থেকে আমি তাঁকে চিনি। তিনি সুন্নী মুসলমান ছিলেন। তাঁর শেষ কাজ সুন্নী মতে হবে। 

সম্পন্ন হলো শেষ কাজ। চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন মির্জা গালিব। 

একে একে চলে যাচ্ছে সবাই। তখনো দাঁড়িয়ে আছেন নওয়াব জিয়াউদ্দিন। সূর্য হেলেছে পশ্চিমে। চারদিকে রোদের ছায়ায় ঝিম ধরানো দুপুর। জিয়াউদ্দিন ভাবছেন বাড়ি ফিরবেন, কিন্তু নড়তে পারছেন না। কেউ যেন জিজ্ঞেস করলো, যাবেন না? 

তিনি মুখের দিকে না তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বললেন, যাবো। 

তারপরও দাঁড়িয়ে আছেন। বুকের ভেতরে গালিবের কণ্ঠস্বর গমগম করছে। বুকের ভেতরে বয়ে যাচ্ছে যমুনা নদী। যমুনা নদীর পাড়ে দিল্লি শহর। এ শহরে একদিন গালিব থাকতেন। এখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। আর ঘুম ভাঙবে না। 

কিন্তু যমুনা নদীতে বসেছে মুশায়রার আসর। কলকল স্রোতে ভাসছে গালিবের কণ্ঠস্বর : 

‘এখন চলো, এমন একটা জায়গায় গিয়ে থাকি,
যেখানে কেউ, কেউ নেই 
সেখানে কথা বলার এমন কোনো জন নেই 
যে তোমার ভাষায় কথা কয়। 
… …
অসুখ বিসুখে পড়লে এমন কেউ নেই সেখানে 
যে তোমায় যত্নআত্তি করে, 
আর যদি মরেও যাও, 
এমন কেউ নেই সেখানে অঝোরে কাঁদবার।’ 

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জিয়াউদ্দিন নিজেকে সামলালেন। 

তারপর দু’হাতে চোখের জল মুছলেন। দেখলেন জল বাঁধ মানছে না। তিনি প্রায় নীরব হয়ে যাওয়া গোরস্থানে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদলেন। 

.

তথ্যসূত্র 

১. গালিবের গজল থেকে, আবু সয়ীদ আইয়ুব ॥ দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা ৭০০ ০৭৩, প্রথম প্রকাশ ১ জানুয়ারি ১৯৭৬। 

২. গালিব : নির্বাচিত কবিতা, সম্পাদনা : জ্যোতিভূষণ চাকী, শঙ্খ ঘোষ ॥ সাহিত্য অকাদেমী, রবীন্দ্র ভবন, ৩৫ ফিরোজ শাহ রোড, নতুন দিল্লি, প্রথম প্ৰকাশ ২০০৪। 

৩. Ghalib : The Man The Times, Pavan K. Varma ।। Penguin Books, New Delhi, First Published 1989. 

৪. গালিব, এম মুজিব ॥ অনুবাদ : মণিভূষণ ভট্টাচার্য। সাহিত্য অকাদেমী, নতুন দিল্লি, প্রথম প্রকাশ ১৯৭৯। 

৫. গালিবের স্মৃতি, মৌলানা আলতফ হুসেন হালি ॥ অনুবাদ : পুষ্পিত মুখোপাধ্যায় ॥ সাহিত্য অকাদেমী, প্রথম প্রকাশ ২০০১। 

৬. মির্জা গালিব ও তার সময়, পবনকুমার ভার্মা ॥ অনুবাদ : মন্দার মুখোপাধ্যায় ॥ সাহিত্য অকাদেমী, নতুন দিল্লি, প্রথম প্রকাশ ২০০৬ 

৭. Mirza Ghalib, A Biographical Scenario, Gulzar 1 Rapa & Co 7116 Ansary Road, Daryaganj, New Delhi, First Published: 2006. 

৮. ধ্বংসস্তূপে কবি ও নগর, সৈয়দ শামসুল হক ॥ ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ৩৮/৩ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০, প্রথম প্রকাশ ২০০৯। 

৯. কত জনপদ কত ইতিহাস, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব) ॥ পালক পাবলিশার্স, ১৭৯/৩ ফকিরেরপুল, ঢাকা, প্ৰথম প্ৰকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১০। 

১০. বাহাদুর শাহ জাফর : শেষ মুঘল সম্রাট, জাফর আলম ॥ অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ২২ সেগুনবাগিচা, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ 

১১. মির্জা গালিব, সঞ্চারী সেন ॥ উর্বী প্রকাশন, ২৮/৫ কনভেন্ট রোড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ বইমেলা ২০০৭। 

১২. Empire of the Moghul : Brothers at War, Alex Rutherford Publisher : Headline Review, 338 Euston Road, London, First Published 2010. 

১৩. মহাবিদ্রোহ ১৮৫৭, সম্পাদক : পি.সি যোশী। অনুবাদ : প্রিয়দর্শী চক্রবর্তী ॥ ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া, প্রথম প্রকাশ ২০১০। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *