মৃত্যুর মুশায়রা

মৃত্যুর মুশায়রা 

কাগজের ওপর কাটাকুটি করতে করতে গালিব একটি ঘোরের মধ্যে ঢুকলেন। বারবার লিখলেন, আমি যে শহরে বাস করি তার নাম দিল্লি। যে মহল্লায় আমার ঘর তার নাম বিল্লিমোরাও। দুটো বাক্য যতবারই লিখলেন ততবারই কাটলেন। কাটতে কাটতে কাগজের পৃষ্ঠা ভরে গেলো। কালি লেপ্টে গিয়ে হিজিবিজি রেখায় গোলকধাঁধার মতো দেখতে হলো পৃষ্ঠা। তিনি ভাবলেন, এই শহরে ঢুকলে আর বের হওয়া যায় না। অলিগলি, পথঘাট, খোলা মাঠ, গাছপালা, ঘরবাড়ি ঘরবাড়ি, ঘরবাড়ি— ঘরবাড়ির ঠিকানা হয়ে যায় বিল্লিমাঁরাও। তার আশেপাশে লালকেল্লা থাকে। লালকেল্লায় মুঘল সম্রাটরা থাকে। মুঘল সাম্রাজ্যের ঠিকানা হয় সে কেল্লা। সাম্রাজ্যের সম্রাট একজন কবি। কবি! এই শহরে গালিবইতো একা কবি— আকাশ সমান উঁচু মাথা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। গালিবইতো এই শহরের মুশায়রার সবচেয়ে বড় কণ্ঠ— তাঁর মতো আর কে আছে? 

তাঁর ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। তিনি কলমের নিবটা দোয়াতে চুবিয়ে রেখে উঠে পড়েন। শুরু করেন পায়চারি। দিল্লি এখন মৃত নগরী। সিপাহীরা পরাজিত হয়েছে। দিল্লি দখল করেছে ব্রিটিশরা। ওই ব্রিটিশ, ব্রিটিশরাজ— গালিবের কণ্ঠে দ্বিধা। কদিন ধরে শহরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ধ্বংসযজ্ঞ। গালিব থমকে দাঁড়ান। যেন পা জোড়া আটকে গেছে মেঝেতে। তিনি আর নড়তে পারছেন না। চারদিক থেকে ভেসে আসছে মানুষের আর্তনাদ। তিনি আবার ফিরে আসেন টেবিলে। আঁকিবুকি কাটা কাগজটা দুমড়ে মুচড়ে টেবিলের এক কোণে রেখে দেন। নতুন একটি কাগজ টেনে বের করে দোয়াতে চুবানো কলমটা দ্রুত হাতে উঠিয়ে নিয়ে লিখতে থাকেন : 

‘দুঃখের রাগরাগিনীর মূল্যও বুঝতে শেখো, হৃদয় আমার; 
অস্তিত্বের এই বিচিত্রবীণাটি একদিন নিঃশব্দ হয়ে যাবে।’ 

গজলটি লিখে গালে হাত দিয়ে বসে রইলেন। খুব কষ্ট হচ্ছে। বারবারই মনে হয় বুকের ধুকপুক শব্দটি যে কোনো মুহূর্তে থেমে যেতে পারে। হয়তো তখন গালিব নামের এই কবিকে চিনবে না দিল্লিবাসী। হয়তো বাতাসের মর্মর ধ্বনিতে উড়ে যাবে মুশায়রায় উচ্চারিত গালিবের কণ্ঠ। আর কি হবে? আর কি হতে পারে? গালিবের হাতে ধরা কলমটি নেমে আসে কাগজের উপরে। লিখতে শুরু করেন আরেকটি গজল : 

‘আমার এ গানের তিক্ততা ক্ষমার চোখে দেখো, গালিব, 
হৃদয়ের ব্যথা আজ পূর্বের সকল মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।’ 

আবার কলমের মাথা বন্ধ হয়ে যায়। কলমটাকে রেখে দেন দোয়াতের পাশে। এক মুহূর্ত তাকিয়ে দেখে ভাবেন, নিবের গায়ে লেগে থাকা কালিটুকু শুকিয়ে যেতে কতক্ষণ লাগবে? হয়তো বেশি সময় না, হয়তো বেশি— কে জানে। গ্রীষ্ম শেষ হয়ে গেলে এখনও বাতাস উষ্ণ এবং শুষ্ক। শরীরে তার স্পর্শ তেমনভাবে আরামদায়ক নয়। 

তখন উমরাও বেগম দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকে স্বামীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেন, সব কি শেষ হয়ে গেল? 

গালিব তাঁর দিকে তাকালেন না এবং কোনো উত্তরও দিলেন না। মুখ ঘুরিয়ে নিবিষ্ট মনে নিজের লেখা গজলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ভাবলেন, কোনো কিছু যেন মাথায় এসে যাচ্ছে। কলমটা কি হাতে নেবেন? 

উমরাও বেগম কণ্ঠস্বর খানিকটা উঁচু করে বলেন, কথা বলছেন না যে?

স্ত্রীর দিকে মুখ না ফিরিয়েই গালিব বলেন, ইচ্ছে হয় না কথা বলতে। কথা আমি লিখতেই জানি। 

উমরাও বেগম কণ্ঠস্বর ঝাঁঝিয়ে বলেন, আপনি কথা বলতেও জানেন। আপনার মুখে রসিকতার ফুলকি ছোটে। বন্ধুদের সঙ্গে আপনি তা বলতেই থাকেন। আপনি এখন আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছেন কিন্তু। 

গালিব এবার মুখ ফেরান। মৃদু হেসে বলেন, বেগমতো রাগবেই। খোদাতালা তাঁকে রাগের শক্তি দিয়েছেন। 

হ্যাঁ, রাগের শক্তিতো দেবেনই। কারণ আপনি আমাকে রাগিয়ে দেয়ার মতো রসিকতা করতেও ভালোবাসেন। 

কোনটা বলতো? আমিতো মনে করতে পারছি না। 

ঠিক, ঠিক ভুলে গেছেন? 

বিলকুল ভুলে গেছি বেগম। 

এটাও রসিকতা। 

খোদার কসম, এটা রসিকতা না। তুমি বল বেগম? তাড়াতাড়ি বল। আমাদের ঘরের বাইরে দিল্লির মহল্লা, রাস্তাগুলো পুড়ছে। 

ওহ, খোদা। 

উমরাও বেগম দোপাট্টা দিয়ে মুখ ঢাকেন। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ান। গালিব পেছন থেকে তাঁর হাত ধরে বলেন, বললে না আমার রসিকতার কথা। 

উমরাও বেগম দু’চোখে আগুন ঝরান। তারপর তপ্ত কণ্ঠে বলেন, দিল্লির মতো আমার কলজেটাও পুড়ছে। 

ওহ, বেগম। আসল কথাটা বলো। 

আপনি একবার ওমরাও সিংয়ের কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলেন।

গালিব মাথা নাড়িয়ে বলেন, আমার শিষ্য ওমরাও সিং? 

হ্যাঁ, হ্যাঁ তিনি। উমরাও বেগমের কণ্ঠে ঈষৎ ব্যঙ্গ। 

ওর দ্বিতীয় পত্নীর মৃত্যুর পরে আমি একটি চিঠি পেয়েছিলাম। 

মনে আছে, ও চিঠিতে কি লিখেছিল? 

তা আছে বৈকি। ও লিখেছিল, আমাকে এখন তৃতীয় পত্নী গ্রহণ করতে হবে। নইলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কে দেখাশোনা করবে। 

মনে আছে আপনি কি লিখেছিলেন? 

গালিব গড়গড়িয়ে বলেন, লিখেছিলাম, ওমরাও সিং তোমার জন্য আমার মায়া হচ্ছে, আর নিজের জন্য হিংসে হচ্ছে। তুমি দুবার বেড়িকাটার সুযোগ পেলে, আর আমি একান্ন বছর ধরে ফাঁসির দড়ি পরে আছি। দড়িটা ছেঁড়েও না, আমার প্রাণও বের হয় না। আমিতো গলায় ফাঁস আটকানো মানুষ। 

আমি আপনার গলায় ফাঁস? 

তা, নয়তো কি? আমিতো সত্যি স্বীকার করতে ভালোবাসি। বিবি তুমিতো চেনো আমাকে। 

তারপরও আপনি আমার সঙ্গে ঘর করলেন? আপনি কবি। শের লেখেন। কিন্তু স্ত্রীর কলজের আগুন দেখতে পান না। আপনি কেমন কবি? নিষ্ঠুর রসিকতা করে মজা পান। 

উমরাও বেগম শব্দ করে কেঁদে ওঠেন। তারপর দ্রুতপায়ে চলে যান। গালিব নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন। জোরে জোরে আওড়াতে থাকেন নিজের লেখা প্রিয় শের- 

‘এ যে মানুষের হৃদয়, ইটপাথর নয়, ব্যথায় ভরে যাবে না কেন? 
আমি হাজারবার কাঁদবো, কেউ আমাকে কাঁদায় কেন?’ 

দু’বার শের আউড়ে তিনি জানালার ঘুলঘুলি দিয়ে রাস্তা দেখার চেষ্টা করেন। দরজা বন্ধ। এই দুঃসময়ে দরজা খুলে রাখার সাহস নেই। ব্রিটিশ সৈন্যরা উন্মাদের মতো আচরণ করছে। জানালার ঘুলঘুলি দিয়ে খানিকটুকু বাতাস আসছে। তাতে গরমের উষ্ণ প্রবাহ কমছে না। ঘরও ঠাণ্ডা হচ্ছে না। তিনি হাঁ করে বাতাস টানলেন। সঙ্গে সঙ্গে বুঝলেন, এ বাতাস দিল্লি শহরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া স্বাভাবিক বাতাস নয়। এ বাতাসে মানুষের আর্তনাদ মিশে আছে। দীর্ঘশ্বাস ও রক্তের গন্ধ নিয়ে বইছে। হঠাৎ বুকের ভেতরে প্রবল কাঁপুনি অনুভব করেন। ভয় আর আতঙ্কে তিনি দিশেহারা বোধ করলে চিৎকার করে স্ত্রীকে ডাকেন। উমরাও বেগম ততক্ষণে কিছুটা শান্ত হয়েছেন। মানুষটি এমনই— সেই বালিকা বয়স থেকে তাঁকে দেখছেন। দেখে শেষ করাতো হয়েইছে, তবে আর নতুন করে দুঃখ কি। তিনি হৃদয়ের জ্বালা প্রশমিত করার চেষ্টা করেন। এমন সময় শুনতে পান স্বামীর ডাক। বুঝতে পারেন যে তাঁর নিজের ভেতরে কোনো প্রশ্ন জেগেছে। তিনি সেই প্রশ্নের উত্তর তাঁকে জিজ্ঞেস করবেন। উমরাও বেগম ধীর পায়ে স্বামীর ঘরে আসেন। বলেন, কি হয়েছে? আমাকে কেন দরকার হয়েছে আপনার? 

বিবি আমি বেঁচে আছি কেন? বলতে পারো আমার বেঁচে থাকার কি দরকার? 

উমরাও বেগম এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে বলেন, কারণ আপনি ‘দস্তাম্বু’ লেখা শেষ করেন নি।

গালিব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলেন, হ্যাঁ, আমার একটি বড় কাজ বাকি আছে। এটা আমি লিখে শেষ করবো। কিন্তু বিবি তারপরও বলো, আমি বেঁচে আছি কেন? 

উমরাও বেগম চুপ করেই থাকেন। কারণ এরপর আর কোনো উত্তর তাঁর জানা নেই। মানুষ কেন বেঁচে থাকে একথার উত্তর তিনি নিজের মতো করে কিছু বলতে পারেন। কিন্তু তাঁর স্বামী কেন বেঁচে আছে এ উত্তর তিনি নিজের মতো করেও বলতে পারবেন না। জোর গলায় বলতে পারবেন না যে তুমি আমার জন্য বেঁচে আছো। আমাদের ভালোবাসার সংসার আছে। ভালোবাসার সংসার রেখে কেউ মরে যেতে চায় না। গালিব বিরক্তির সঙ্গে বলেন, বেগম তুমি কথা বলছো না কেন? 

আমার মনে হয় আপনি ‘দস্তাম্বু’ লিখতে বসলে আপনার মন থেকে খারাপ চিন্তা চলে যাবে। 

গালিব উম্মার সঙ্গে বলেন, এটা মোটেই খারাপ চিন্তা নয়। এটা দার্শনিক চিন্তা। একজন কবির চিন্তা। এত বছর ধরে ঘর করে একজন কবিকে তুমি বুঝতেই পারলে না। 

আপনার জন্য আমি মিসতার শরবত পাঠাচ্ছি। খেয়ে মাথা ঠাণ্ডা করুন। এমন মরণের শহরে ঘরে বন্দী হয়ে থাকলে কবিতো পাগল হয়েই যাবে। কবির কি দোষ! 

মরণের শহর! দিল্লি, আমার প্রিয় দিল্লি এখন মরণের শহর! 

গালিব বিড়বিড় করেন। উমরাও বেগম তাঁর সামনে থেকে চলে গেছেন। নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ ঘর। কোথাও একটি টিকটিকির শব্দও নেই। আরশোলা দেখা যাচ্ছে না। পিঁপড়েও না। মানুষের মতো কি ওরাও শহর থেকে পালিয়েছে? কই কাকের ডাকও তো ভেসে আসছে না? তিনি টেবিলে এসে বসেন। ‘দস্তাম্বু’ যে খাতায় লিখছিলেন সেটা টেনে নিয়ে বসেন। সাদা পৃষ্ঠার ওপর কালির আঁচড় পড়তে থাকে; মহররম মাসের ২৬ তারিখ। ১৮ই সেপ্টেম্বর। শুক্রবার। মধ্যাহ্ন বিজয়ীরা লালকেল্লাসহ পুরো শহরটি দখল করে ফেলে। সিপাহী বিদ্রোহের অবসান ঘটে গেল। দিল্লির পথে পথে মানুষেরা আতঙ্কে ছুটোছুটি করছে। গ্রেফতারি ও হত্যার আতঙ্ক চারদিকে। চাঁদনি চকের সীমানার পরেই খুনজখমের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। রাস্তাগুলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে দখল হয়ে আছে। ভয়াবহতার পরিমাণ বলে শেষ করা যায় না। ব্রিটিশদের মতো ক্রুদ্ধ সিংহ শহরে ঢুকেছে। অসহায় মানুষদের নির্বিচারে মেরে ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। প্রতিটি বিজয়ের পরে এ ধরনের নৃশংসতার প্রকাশ বুঝি এভাবেই ঘটে থাকে। তারপরও বলতে হয় এই ঘটনায় শহরে বাসকারী অসহায় মানুষদের বুক দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে গেল এবং গণহত্যা দেখে তারা সন্ত্রস্ত হয়ে থাকল। বিজয়ীরা যাকেই সামনে পেয়েছে তাকেই কচুকাটা করেছে। অভিজাত মানুষেরা নিজেদের সম্মান বাঁচানোর জন্য ঘরের দরজা আটকে বসে আছে। অন্যভাবে বলতে হয় তাঁরা নিজেরাই নিজেদেরকে বন্দি করে রেখেছে। অভিজাতরাতো রাস্তায় হাঁটতে পারে না। তাঁরা পালকিতে চড়ে। এসব ভাবনা ভাবতেও বিরক্ত লাগছে। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন। কিন্তু ভাবনা তাঁকে পেয়ে বসে। তিনি প্রসঙ্গক্রমে নিজের কথাই ভাবেন। কারণ তাঁকে ভাবতে হয়। সিপাহী বিদ্রোহ এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে নিজের অবস্থানের কথা চিন্তা করে আবার টেবিলে বসেন। কাগজ টেনে লিখতে থাকেন, দরিদ্র, কিন্তু সমাজের অন্য সবার থেকে আলাদা, যারা নিজেদের রুটি রুজির জন্য ব্রিটিশদের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তারা বিভিন্ন মহল্লায় বাস করতো। কখনো এক সঙ্গে এক জায়গায় বাস করেনি। তারা এক একজন দ্বীপের মতো মানুষ। অস্ত্র সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। এমনকি কুঠার বা তীরধনুক সম্পর্কেও। তাই বিদ্রোহের সময় তারা সিপাহীদের পায়ের শব্দ পেলেও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়তো। যুদ্ধ করতে পারার মতো মানুষই তারা ছিল না। কি যে দুঃসময় বয়ে গেছে তাদের জীবনের উপর দিয়ে। ভাবাই যায় না। তারা জানতো সব ধরনের কষ্ট সহ্য করে ঘরে বসে থাকতে। বন্দি জীবনযাপন করতেই তারা বুঝেছিল। এটাতো সত্যি ছুটে আসা পানির তোড়কে শুধু ঘাসের আঁটি দিয়ে আটকানো যায় না। এদের সবার মতো আমিও একজন অসহায় এবং আঘাত-জর্জর মানুষ। 

এটুকু লিখে কলমটা দোয়াতে চুবিয়ে রাখলেন। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। জীবন-জগতের নানা চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। বেশি করে মনে পড়ছে নিজের কবিতার বই ‘দীওয়ান’ প্রকাশের সময়ের কথা। মানুষ অসহায় হয়ে পড়লে কি স্মৃতি তাঁকে বেশি করে তাড়িত করে? নিজের প্রশ্নের উত্তর তাঁর নিজের কাছেই নেই। তিনি আবার স্ত্রীকে ডাকেন। প্রবল বিরক্তি নিয়ে কাছে এসে দাঁড়ান উমরাও বেগম। 

বলেন, কি হয়েছে? 

আমার একটি শের তোমাকে শোনাতে চাই বিবি।

উমরাও বেগম মুখ ঝামটা দিয়ে চলে যেতে চাইলে তিনি তাঁর হাত টেনে ধরে বলতে থাকেন- 

‘জীবনের ঘোড়া ছুটে চলেছে, দেখো কোথায় থামে; 
না হাতে আছে লাগাম, না পা আছে রেকাবে।’ 

আপনার এই শের আমি অনেকবার শুনেছি। বারবার শুনতে বিরক্ত লাগে।

বিবি, তুমি এভাবে বললে? 

হ্যাঁ, বললাম। বলবোই। আপনার সঙ্গে ছুটতে ছুটতে আমার জীবনও শেষ। আমিতো মুখ থুবড়ে পড়েই গেছি। আপনি ঠিকই লিখেছেন শের-এ। আপনি লাগাম ধরতে জানেন না। রেকাবেও পা রাখতে জানেন না। 

তুমি আজ নিষ্ঠুরের মতো কথা বলছো। বুঝতে পারছি ব্রিটিশদের রোষ তোমাকে ভর করেছে। দিল্লির বাতাসে তোমার নিঃশ্বাস পূর্ণ হয়ে গেছে। 

আজ আমাকে এইসব কথা বলে লাভ নেই। আমার শরীর ভালো নেই। আমাকে আর এভাবে ডাকাডাকি করবেন না। আপনার জন্য শামী কাবাব বানিয়ে রেখে আমি শুয়ে পড়বো। 

তোমার অশেষ মেরেহবানী বিবি। 

উমরাও বেগম যেতে চাইলে গালিব আবার তাঁর হাত টেনে ধরেন। উমরাও বেগম ভুরু কুঁচকে বলেন, আবার কি? 

গালিব গভীর স্বরে বুকের ভেতর থেকে উঠিয়ে আনা শব্দরাজি ছড়িয়ে দিতে থাকেন— 

‘এদিকে তাকাও, আয়না হাতে অতো তন্ময় কেন? 
দেখো, কি গভীর তৃষ্ণা চোখে নিয়ে আমি তোমাকে দেখছি।’ 

আপনার এই শের বারবণিতাদের জন্য, ঘরের বিবির জন্য নয়। 

দিল্লি শহরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নিষ্ঠুরতা আমি তোমার ভেতরে দেখতে পাচ্ছি। বিবি, তুমি যাও। হায় খোদা, এত যন্ত্রণা কেন আমাকে ভোগ করতে হয়! 

গালিব উল্টো দিকে মুখ ঘোরান। উমরাও বেগমের চলে যাওয়া দেখতে চান না। তীব্র বিবমিষায় তাঁর শরীরী কম্পন তাঁকে বিপর্যস্ত করলে তিনি বিছানায় আশ্রয় নেন এবং পরমুহূর্তে সোজা হয়ে বসে বলেন, উমরাও বেগম ঠিক কথাই বলেছে। একবিন্দু মিথ্যে নেই। তিনি আবার শুয়ে পড়েন এবং অল্পক্ষণে তাঁর ঘুম আসে। 

বেশ কিছুক্ষণ পরে ঘুম ভাঙে কাল্লু মিয়ার চেঁচামেচিতে। 

হুজুর! হুজুর! হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে কাল্লু মিয়া। 

তিনি ধড়মড়িয়ে উঠে বসেন। ক্রন্দনরত কাল্লু মিয়াকে দেখেন। কান্নার দমকে তাঁর শরীর কতখানি নড়ছে সেটা বুঝে বিষয়টি অনুমান করার চেষ্টা করেন। তারপরও চুপ করে বসে থাকেন। ঘুমের আমেজ কাটেনি তা নয়, কিন্তু কোলাহলহীন শহরের নিস্তব্ধতা বুকের মধ্যে অনুভব করেন। কাল্লু মিয়ার কান্নায় হেঁচকি উঠছে। এক সময় থামলে তিনি আস্তে করে বলেন, তুমি এক গ্লাস পানি খেয়ে এসো কাল্লু মিয়া। তোমার কলজে শুকিয়ে গেছে। 

ঠিক বলেছেন, হুজুর। আমি পানি খেয়ে আসছি 

ও চলে গেলে গালিব চুপচাপ বিছানায় বসে থাকেন। মাথার মধ্যে নানা কিছু চিন্তা। নিজেকেই বলেন, ঘরের কোণায় খুব অসহায় হয়ে পড়ে থাকছি। এখন কলম আমার বন্ধু। যখন দিনলিপি লিখি তখন দুঃখের শব্দ ঝরে কাগজের ওপর। আর নিজের চোখের পানি ঝরে বুকের ওপরে। কি করবো আমি? ব্রিটিশদের অত্যাচার নৃশংসতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ এই ব্রিটিশদের দেয়া পেনশনে আমিতো আমার পরিবার লালন-পালন করছি। পরিবারটি ছোট নয়। কাল্লুর মতো কয়েকজন আছে। দুই নাতি আছে। আমার স্ত্রী তাদেরকে খুব ভালোবাসে। আমিও ওদেরকে খুব ভালোবাসি। আমার নিজের সন্তানেরা কেউ বেঁচে নেই। মাঝে মাঝে ভাবি, ভালোই হয়েছে যে খোদাতালা ওদেরকে নিয়ে গেছেন। নইলে অভাবের মাঝে ক্ষুধার্ত শিশুদের দিকে তো আমি তাকাতেই পারতাম না। আফসোস করি না। আমার স্ত্রী বলে, আমার কলজে এজন্য কোনো আফসোস নেই। আফসোস থাকবে কেন? আমিতো মনে করি আমার জন্য এটা খোদাতালার মেহেরবানী। 

এক মুহূর্তে হুড়োহুড়ি করে ঢুকে পড়ে দুই ভাই 

নানা, মিঠাই খাবো। 

মিঠাই? গালিব বিমূঢ় হয়ে যায়। 

নানা, মিঠাই, মিঠাই। দুই ভাই লাফাতে লাফাতে বলে, কতদিন মিঠাই খাইনি। 

গালিব ওদের কাছে ডেকে আদর করে বলেন, এখনতো মিঠাই পাওয়া যাবে না। দোকানপাট সব বন্ধ। 

কেন বন্ধ নানা? চারদিকে এত তুফান কেন? আমাদের গলিটাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। 

হ্যাঁ, সে জন্যইতো মিঠাইয়ের জন্য কাউকে পাঠানো যাচ্ছে না। 

আচ্ছা নানা, ওরা লোকজনদের মেরে ফেলছে কেন? ওই লালমুখো সাহেবগুলো খুব খারাপ। খুব শয়তান। আজকে যাই। কালকে কিন্তু মিঠাই খাবো। মিঠাই আমাদেরকে দিতেই হবে। কয়েকদিন ধরে নানি আমাদেরকে দুধও দিচ্ছে না। 

আর একজন গালিবের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে, আখরোট, নাশপাতিও না।

শহরের অবস্থা ঠিক হোক তোমাদেরকে সবকিছু দেয়া হবে। 

দেয়া হবে, দেয়া হবে— বলতে বলতে ওরা ঘরের মধ্যে ঘুরপাক খায়। তারপর একদৌড়ে ঘর ছাড়ে। আনন্দে গালিবের চোখ বুজে আসে। দু’চার ফোঁটা পানিও গড়ায় গালের ওপর। মনে পড়ে আগ্রায় তাঁর একটি চমৎকার শৈশব ছিল। ঘুড়ি ওড়ানোর বন্ধু ছিল বংশীধর। ওহ্, কতদিন বংশীধরের সাথে দেখা নেই। বংশীধর দিল্লিতে এলে ওর জন্য লাউ-কুমড়ো, ফলমূল নিয়ে আসতো। ঝুড়ি বোঝাই করে আনতো। দুজনে মিলে শৈশবের স্মৃতিচারণ করে মেতে উঠতো— কি আনন্দ ছিল! কতটুকুই বা সময়ের জন্য ওরা ফিরে যেতো শৈশবে, কিন্তু মনে হতো দিনগুলো হারিয়ে যায়নি। এই এখন যেমন এই বাচ্চাদের শৈশবে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ওদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাবে না। 

গালিব বিছানা থেকে নামার জন্য পা ঝুলিয়ে দিলে ফোঁসফোঁস করতে করতে কাল্লু মিয়া ঢোকে। 

হুজুর, হুজুর আমার প্রাণের দোস্ত বশির মিয়া নাই। 

বশির মিয়া? কোন বশির মিয়া? গালিব ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন। 

গোস্তের দোকানদার। কসাই বশির মিয়া। গোস্তের সবচেয়ে বড় টুকরোটা ও আপনার জন্য রেখে দিত। ওটা দিয়েইতো শামী কাবাব বানানো হতো। আপনি খেয়ে খুব আনন্দ পান। 

গলির রাস্তাতো বন্ধ। তুমি খবর পেলে কি করে? 

ও কেমন আছে খোঁজ নেয়ার জন্য আমি লুকিয়ে বের হয়েছিলাম। হুজুর, ও একা নয় ওর সঙ্গে আরও অনেকে রাস্তার ওপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে। হায় আল্লাহ, এ কেমন দিন এলো আমাদের জীবনে! ওই গোরা সৈনিকেরা দিল্লি শহরের একজন মুসলমানকেও বাঁচতে দেবে না। 

কাল্লু মিয়ার কান্না থামে না। ঘরের মেঝেতে বসে কাঁদতে থাকে। গালিব অন্যমনস্ক চিন্তায় ওর কান্নার শব্দ শোনেন। যেন শব্দ যমুনা নদীর ওপর দিয়ে অনেকদূরে চলে যাচ্ছে। পৌঁছে যাচ্ছে ওর শৈশবের আগ্রা শহরে- ওখানে উড়ছে ওর শৈশবের ঘুড়ি। সেই ঘুড়ি শব্দ নিয়ে উড়ে যাচ্ছে আকাশে কিংবা অন্য কোথাও। গালিব বিড়বিড় করে বলেন, অন্য কোথাও। অন্য কোথাও। অন্য কোথাও। দেখতে পান কাল্লু মিয়া চোখ মুছতে মুছতে চলে যাচ্ছে। তখন তিনি উঁচু কণ্ঠে ওকে ডাকেন। কাল্লু মিয়া ফিরে এসে দাঁড়ায়। তিনি অন্যমনস্ক হয়ে যান। কি যেন বলতে চেয়েছিলেন ওকে। 

 হুজুর, আমাকে ডাকলেন কেন? 

তুমি কি আমার ভাই ইউসুফ মীর্জার খবর আনতে পারো? 

আমার রাস্তায় বের হতে ভয় করে। 

ভয়? 

হ্যাঁ, হুজুর, ভয়। ভয়। সৈনিকগুলো আমাকেও মেরে ফেলতে পারে, এই ভয়।

আমার ভাইয়ের বাড়ি তো এখান থেকে বেশি দূরে নয়। তাছাড়া আমার ভাই গোস্ত বিক্রি করে না। ও একটা পাগল। ত্রিশ বছর বয়সে ওর পাগলামি ধরা পড়ে। সেই থেকে, কাল্লু মিয়া সেই থেকে এখন পর্যন্ত ও আর ভালো হয়নি 

আমি এসব জানি হুজুর। 

হ্যাঁ, হ্যাঁ। তুমিতো সবই জানো। তুমিতো আমার পরিবারেরই একজন। কাল্লু মিয়া আমি তোমাদের সবাইকে খুব ভালোবাসি। এতবড় পরিবার টানতে আমার খুব কষ্ট হয়। তারপরও—তারপরও আমি চাই তোমরা সবাই আমার সঙ্গে থাকবে। আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। 

কাল্লু মিয়া অকস্মাৎ গালিবের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলে, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি হুজুর যেভাবে হোক আমি ইউসুফ হুজুরের খবর আপনাকে জানাবো। 

সাবধানে যেও। 

হ্যাঁ, আমাকেতো সাবধানেই যেতে হবে এবং ফিরে আসতে হবে। নইলে আমি কেমন করে আপনাকে খবর জানাবো। সেলাম, হুজুর। 

কাল্লু মিয়া দ্রুতপায়ে বেরিয়ে যায়। গালিবের মনে হয় তাঁর শরীর কাঁপছে। তিনি বেশি কিছু ভাবতে পারছেন না। তাঁর ভাই সারাদিনে কি খেলো, রাত্রে ঘুমুতে পারছে কিনা কে জানে, কোনো খবরই পাচ্ছেন না। একজন মানুষ উন্মাদদশা নিয়ে ষাট বছরের বেশি সময় ধরে বেঁচে আছেন। এই যন্ত্রণার কথা কাকে বলবেন? স্ত্রী আর মেয়েরাই বুঝতে পারে তাঁকে? না, একদমই না। তিনি কাউকে বিরক্ত করেন না, চেঁচামেচি করেন না, নিজের মনে থাকেন। হায় খোদা, কাল্লু মিয়া কি খবর আনবে কে জানে। আমি যদি জাদু জানতাম তাহলে কারো পিঠে পাখা লাগিয়ে উড়িয়ে দিতাম। না জাদু জানলেও কাজ হতো না। ওদেরকে আমি এখানে নিয়ে আসতে পারতাম না। কোনো খাবারও পাঠাতে পারতাম না। ইউসুফ মির্জার কি খাবার পছন্দ তাও আমার জানা নেই। এই শহরে আমরা দু’ভাই বাস করি, কিন্তু একে অপরকে ঠিকভাবে জানি না। আমার কি দুর্ভাগ্য! আমার কষ্ট আমি কাউকে ভাগ করে নিতে পারি না। আমার স্ত্রীর সঙ্গেও আমার দূর দূর ব্যবধান। 

গালিব ধীর পায়ে বারান্দায় আসেন। বালতি থেকে চোখে মুখে পানি দিয়ে নিজেকে শীতল করেন। পানির স্পর্শ তাঁকে স্নিগ্ধই করে। তিনি স্বস্তি বোধ করেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে হয় ‘দস্তাম্বু’র পৃষ্ঠা ভরাবেন হিন্দুস্থানবাসী এবং ব্রিটিশদের ভূমিকার কথা লিখে। যারা ন্যায় বিচারের কথা বলে এবং অত্যাচারের নিন্দা করে তাদের জানা উচিত যে গদরের সময় হিন্দুস্থানের সিপাহীরা নির্বিচারে হত্যা করেছে। হত্যা করেছে অসহায় নারীদের, এমনকি দোলনায় খেলতে থাকা শিশুদেরও। সে সঙ্গে ইংরেজদের আচরণও খতিয়ে দেখা যায়। যখন তারা জিতলো, তারাও বদলা নেয়ার লড়াই শুরু করলো, বিরোধিতাকারীদের শাস্তি দিতে শুরু করলো। শহরবাসীরাতো গদরকে সমর্থন করেছিল। তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করতে পারতো ইংরেজরা। কিন্তু করেনি। তারা নারী ও শিশুদের রেহাই দিয়েছে। তারা এটা করেছে এজন্য যে অপরাধী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য বোঝাতে। ওরা যদি উন্মত্ত হতো তাহলে এই শহরের কুকুর-বেড়ালকেও বেঁচে থাকতে দিতো না। এখন আমাকে রাণী ভিক্টোরিয়ার নামে কসীদা লিখতে হবে। তাঁর কাছে আমার তিনটি প্রার্থনা আছে। আমরাতো সবাই জানি গ্রিস, ইরান এবং অন্যান্য অনেক দেশে কবি- সাহিত্যিকদের কতভাবে সম্মানিত করা হয়- তাদের দু’হাত মুক্তো দিয়ে ভরে দেওয়া হয়, কখনো কখনো বখশিশ দেওয়া হয়, ইনাম দেওয়া হয়। রাণীর কাছে আমার প্রার্থনা এই যে তিনি নিজে আমাকে একটি খেতাব প্রদান করবেন। তিনি আমাকে দরবারি পোশাক-খিলঅত উপহার দিবেন এবং সামান্য কয়েক টুকরো রুটির ব্যবস্থা করবেন। যদিও আমি জানি আমি তাদের পেনশনভোগী। তারপরও বারবার আমাকে রুটির জন্য আবেদন করতে হয়। এসবই কপালের লিখন। সব মানুষেরই ভাগ্যতো নির্ধারিত থাকে। আর এই বেঁচে থাকার জন্য সামগ্রী দিয়ে দেয়া হয়। এই যে জীবন চলছে, এর মধ্যেই থাকে বিপদ এবং বিপদ থেকে রক্ষা। কারো সাধ্য নেই এর থেকে বাইরে যাওয়া। ছোট বাচ্চারা যেমন সব তামাশাতে মজা পায়, আনন্দ করে, এই বুড়ো বয়সে আমারও উচিত সময়ে যা কিছু ঘটছে সেটাকে খুশি মনে মেনে নেয়া। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এই একমাত্র উপায় সম্বল করে আমার শেষ দিনগুলো কেটে যাক, নিজের জন্য এই আমার প্রার্থনা। 

গালিব বারান্দা থেকে ঘরে আসেন। পানি দিয়ে ধোয়া মুখ গামছায় মোছা হয়নি। পানির স্পর্শ লেগে আছে ত্বকে। তিনি দাড়িতে হাত বোলান। তারপর চুল এলোমেলো করেন। মনে মনে ভাবেন, এক পেয়ালা সুরা পেলে সময়টা খুব আনন্দে কাটাতে পারবেন। এই দুঃসময়কে মনোরম করার আর কিইবা উপায় আছে। তিনি নিজের শের আওড়াতে থাকেন— 

‘নাদা হো যো কহতে হো কে কিয়োঁ জিতে হ্যায় গালিব 
কিস্মৎ সে হ্যায় মরণে কী তামান্না কোঈ দিন অন্তর। 
অবুঝ লোকেরা বলে গালিব কেন বেঁচে 
ভাগ্যে রয়েছে বাঁচার ইচ্ছে কিছুদিন আরও!’ 

সত্যিতো তাঁকে বাঁচতে হবে আরও। কেন মারা যাবেন? ইংরেজরা দিল্লি দখল করার পরে বাদশাহ কেমন আছে খোঁজ পাননি। পাবেনই বা কি করে ঘরে তো বন্দি তিনি। মহম্মদ ইব্রাহিম জওকের মৃত্যুর পরে বাদশাহ তাঁকে দরবারের কবির পদে বরণ করেছিলেন। আসলে জওকের মৃত্যুর পরে এই পদের দাবিদার আর কবি ছিলেন না। তিনি খুব খুশি মনে পদটি গ্রহণ করেননি। কারণ তিনি জানতেন তিনি যেমন বাদশাহর কবিতার তেমন প্রশংসা করেন না, বাদশাহও তাঁর কবিতার দারুণ সমজদার নন। তিনি ‘শায়র-উল-মূলক’ হলেন বটে কিন্তু জওকের মতো ‘মালিক-উল-শুয়ারা’ অর্থাৎ কবিদের রাজা উপাধি তাঁর পাওয়া হবে না। তাছাড়া পারিশ্রমিকও বাড়েনি। বাদশাহর ওস্তাদ হওয়ায় বাদশাহর কবিতা তাঁকে সংশোধন করতে হতো। মাঝে মাঝে ভাবতেন কাজটি কখনো খুব কঠিন। কারণে অকারণে প্রশংসা করা সহজ কাজ নয়। সে তিনি বাদশাহই হোন বা অন্য কোনো কবিই হোন না কেন। তাতে কিছু এসে যায় না। তাঁর বোঝাটাই সত্য। 

তিনি ঘরের মাঝে এসে দাঁড়ান। এখন একজন বন্ধু থাকলে বেশ হতো। এই দারুণ সময়কে তিনি গজলের মধ্যে বেঁধে ফেলতে পারতেন। তাঁর দীর্ঘশ্বাস উড়িয়ে দিতে পারতেন। তিনি ঘরে পায়চারি করতে করতে আবারও ভাবেন, কেমন আছে বাদশাহ? একবার ঈদ উপলক্ষে বাদশাহর সামনে একটি কসীদা পাঠ করেন তিনি। বাদশাহ তাঁর কবিতার প্রশংসা করতেন না। কসীদা শুনে বললেন, ‘মির্জা তুম পড়তে বহোৎ খুব হো।’ তাঁর আবৃত্তির প্রশংসা করলেন। গালিবতো জানেন মুশায়রায় তিনি যখন পাঠ করেন তখন উপস্থিত সবাই তাঁর পাঠে উচ্ছ্বসিত থাকেন। এ ব্যাপারে তাঁর সুনামের কমতি নেই। কিন্তু বাদশাহ যখন বলেন, তখন বাদশাহ কসীদার প্রশংসা এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই করেন, এটা তিনি বুঝতে পারেন। পরস্পরকে বোঝার মধ্য দিয়ে সম্পর্কের সূত্র তৈরি হয়। কবিইতো বুঝবেন অন্তরের কথা। কবিইতো জানেন কোনটা নকল রঙ, কোনটা তামাশা, কোনটা বুকের ভেতরের খাঁটি রঙ। সেদিন তাঁর খুব মন খারাপ হয়েছিল। ফেরার পথে বন্ধু সইফতার বাড়ি গিয়েছিলেন। ওর সঙ্গে কথা বলে স্বস্তি পেয়েছিলেন। মনের দুঃখ লাঘব হয়েছিলো। সেদিন দু’জনেই একমত হয়েছিলেন যে, খাঁটি পৃষ্ঠপোষক পাওয়া কঠিন। এই মুহূর্তে বন্ধু সইফতা, তুতা এবং আরও অনেকের কথা মনে হয়। গদরের শুরু থেকেই কারো সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নেই। 

দোস্ত, তোমরা কেমন আছ? 

তিনি চেয়ারে বসেন। টেবিলের ওপর কনুই রেখে হাতের তালুতে মুখ রেখে মাথা কাৎ করেন। এটি তাঁর একটি প্রিয় ভঙ্গি। স্মৃতি রোমন্থন কিংবা নানা কিছু ভাবনার সময় এই ভঙ্গিতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। গদরের প্রসঙ্গ মনে হতেই ভাবলেন, গদরের ঘটনাটি তো একদিনের নয়। থাক, এ প্রসঙ্গ। তিনি নিজের মাথা ঠাণ্ডা রাখতে চাইলেন। পরে বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। 

ঘরে এলেন উমরাও বেগম। 

গালিব ভুরু উঁচিয়ে এক মুহূর্ত তাঁকে দেখলেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন, কি হয়েছে বিবি? 

ইংরেজরা শহরের লোকজনকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। 

কে জানালো খবরটা? 

খাদিমা। ওরা চলে যাচ্ছে। 

কোথায় যাচ্ছে? 

শহরের বাইরে কোনো খোলা জায়গায় ওদের পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। 

ওরা কোথায় থাকবে? 

খোলা আকাশের নিচে নিশ্চয় না। খাদিমা বলেছে ওরা কোনো ব্যবস্থা করবে। তাঁবু চাইতে পারে কারো কাছে কিংবা মাথার ওপরে অন্য কোনো ছাউনির চিন্তা ওদের আছে। খাদিমা বলেছে ওরা শুধু ভয়ে আতঙ্কে শহর ছেড়ে যাচ্ছে না। ওরা কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছে। 

গালিব গভীর শ্বাস টেনে বললেন, তবু ওরা বেঁচে আছে। ওরা হয়তো একদিন আবার ফিরে আসবে শহরে। 

উমরাও বেগম দোপাট্টায় চোখ মোছেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ওরাতো শত শত মানুষকে মেরেও ফেলেছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়েপুড়িয়ে দিয়েছে। 

ওহ, বিবি তোমার কষ্ট কলজের মধ্যে গেঁথে রাখো। আমাকে আমার পরিবারের কথা ভাবতে দাও। তুমিতো জানো বিবি এপ্রিল মাস পর্যন্ত আমি দিল্লির কালেক্টরি থেকে পেনশন পেয়েছি। গদরের মাস থেকে পেনশন বন্ধ হয়ে আছে। আমি এখন খুবই দুশ্চিন্তায় আছি। আগে তুমি আর আমি ছিলাম। এখন দুটি এতিম শিশু আমাদের সঙ্গে আছে। 

উমরাও বেগম মাথা নেড়ে বলেন, এখন ওদেরকে দুধ মিঠাই কাবাব রুটি ঠিকমতো খাওয়াতে পারছি না। 

ভেবে দেখো। আমরা কত দুঃখে আছি। এছাড়া আমাদের সংসারে কতজন আশ্রিত আছেন। পেনশন না পেলে ওদের দেখাশোনাই বা কীভাবে চলবে। 

উমরাও বেগম চোখ উজ্জ্বল করে বলেন, ইংরেজরা ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। এবার আপনার পেনশন আবার চালু হবে। ঠিক বলেছি? 

গালিব দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলেন, ঠিক কিনা এখনও জানি না। আমিতো বাদশাহর সভাকবি ছিলাম। ওরা আমাকে বিশ্বাস করবে তো? 

তিনি তাঁর দু’হাত চুলের ভেতর ঢুকিয়ে মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিয়ে বলেন, বিবি আমার ক্ষিদে পেয়েছে। 

যাই, দু’টুকরো শুকনো রুটি নিয়ে আসি। 

শুধু শুকনো রুটি? 

আরতো কিছু নেই। কোথায় থেকে আসবে? 

বলতে বলতে উমরাও বেগম চলে যান। গালিব নিজেকে শক্ত করে ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি তো খবর পেয়েছেন, শহরের যে কোনো যুবক এবং সমর্থ মুসলমানকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওদেরকে হত্যা করা হয়েছে। তা সে অপরাধী বা নিরাপরাধী কেন। 

যেই হোক না 

তিনি দু’পা হেঁটে আবার ভাবলেন, আমার প্রতি যারা শত্রুতার মনোভাব লালন করে, যারা ব্রিটিশদের বিশেষ বন্ধু তারা আমার বিরুদ্ধে এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে। এটা তারা করতেই পারে আমাকে বিপদে ফেলার জন্য। 

তিনি ঘরে পায়চারী করলেন। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই বললেন, আমিতো সেই মধ্য দুপুরের কথা ভুলে যাইনি, যেদিন ঘোড়ার খুরের শব্দে কেল্লার দেয়াল ও দরজাগুলো কেঁপে উঠেছিল। মীরাটের উন্মত্ত সিপাইরা ছিল নেমকহারাম এবং ইংরেজদের রক্তের জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল। ওরা রক্তলোলুপ দুর্বৃত্ত। শহরের প্রবেশদ্বারের রক্ষীরা ওদের সঙ্গে জুটে গিয়েছিল। ওরা শহর রক্ষা করার দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়েছিল। প্রভুর প্রতি নিজেদের বিশ্বস্ততার কথা ভুলে গিয়েছিল। আর শহরবাসীর অনেকে তাদের অভ্যর্থনা জানালো। সিপাহীদের সঙ্গে এক হয়ে লুটতরাজ আর হত্যায় লিপ্ত হয়ে গেলো। এখন তার পরিণাম ভোগ করতে হচ্ছে। 

দু’টুকরো রুটি নিয়ে ঘরে আসেন উমরাও বেগম। সঙ্গে এক গ্লাস পানি। স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলেন, আপনার ভুরু কুঁচকে আছে কেন? আপনি কি কিছু ভাবছেন? 

ভাবছিলাম গদরের কথা। সেদিন সিপাহীরা যে ইংরেজকে সামনে পেয়েছিল তাকে হত্যা করেছিল। বাড়িঘর পুড়ে ছাই হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ওরা থামতে পারেনি। 

এসব কথা থাক এখন। আপনি রুটির টুকরো দুটো খেয়ে ফেলুন। 

গালিব রুটির টুকরোটা হাতে নিতে নিতে বলেন, যাদেরকে শহরের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে ওদের মধ্যে আমার কোনো বন্ধু থাকলে কি হবে? কেমন করে যোগাযোগ করবো? আমরা যারা শহরের ভেতরে রয়ে গেলাম তারা যদি ওদের খবরাখবর নিতে পারতাম তাহলে খানিকটা দুশ্চিন্তা থেকে দূরে থাকতে পারতাম। 

তা ঠিক। উমরাও বেগম দোপাট্টা দিয়ে মুখের ঘাম মোছেন। 

এখন আমরা হৃদয় যন্ত্রণায় কাতর। 

তারচেয়েও বড় শহরের মানুষেরা ইংরেজদের হত্যাকাণ্ডে আতঙ্কিত। 

হ্যাঁ, শহরটা এখন একটা মৃত্যুজমিন। বসন্তের ফুল ফোটা বন্ধ থাকবে, শীতের উত্তরের বাতাস বইবে না। বর্ষার বৃষ্টি ধারা যমুনায় পড়বে না। মৃত্যুজমিন মানুষের শোণিতে— 

উমরাও বেগম রুদ্ধকণ্ঠে স্বামীকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, আপনি এভাবে বলবেন না। আমি সহ্য করতে পারছি না। 

দ্রুতপায়ে চলে যান। গালিব শুকনো রুটি শেষ করে গ্লাসের পানি খান। মনে হয় বুকটা পুড়ে যাচ্ছে। প্রবল জ্বালা ছড়িয়ে যাচ্ছে মৃত্যুজমিনে বসবাসকারী একজন কবির হৃদয়ে। 

.

পরদিন কাল্লু মিয়া মির্জা ইউসুফের খবর নিয়ে আসে। গালিবের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকে, হুজুর 

গালিব ওর দিকে ঘুরে তাকালে কাল্লু মিয়া দেখতে পায় তাঁর দুচোখ লাল। শরীর বোধহয় জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। কিংবা মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। কাল্লু মিয়া বুঝতে পারে না যে এ সময় কি তাঁকে মির্জা ইউসুফের খবর দেয়া ঠিক হবে কিনা? গালিব ইশারায় কাল্লু মিয়াকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, আমার ভাইয়ের বাড়িতে যেতে পেরেছিলে? 

পেরেছিলাম। সেখান থেকেই আমি এই মাত্র এসেছি। 

গালিব উদ্গ্রীব কণ্ঠে বলেন, কেমন আছে আমার ভাই? তুমিতো জানো না যে ও আমার চেয়ে মাত্র দু’বছরের ছোট। আমার খুব আদরের ভাই। বলো ও কেমন আছে? 

ভালো আছে হুজুর। তবে— 

তবে— তবে কি? থামলে কেন? 

তাঁর বিবি ও মেয়েরা অন্যদের সঙ্গে দু’দিন হলো শহর ছেড়ে চলে গেছে।

কে আছে ওর সাথে। মানে ওর দেখাশোনা— 

বুড়ো দারোয়ান আছেন। 

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আকরামা খুব ভালো লোক, খুব বিশ্বস্ত। 

তাঁর পরিচারিকাও আছে। 

আহা, বুড়ো নেকজানের মা। ওরা দুজন ছাড়াতো ওর সংসার অচল। বুঝলে কাল্লু মিয়া আমার ভাই দু’জন ভালো লোকের দেখাশোনাতেই আছে। তুমি ওকে সুস্থ দেখেছ তো? 

হ্যাঁ, তিনি সুস্থই আছেন। দারোয়ান ভাইয়া বললো খাওয়া-দাওয়ার একটু অসুবিধে হচ্ছে। 

সেতো হবেই। সবই নসীব। আমরা এখন দুর্যোগের মধ্যে বাস করছি। তুমি যাও কাল্লু মিয়া। তোমাকে শুকরিয়া যে তুমি জানের ঝুঁকি নিয়ে আমার ভাইয়ের খবর এনেছো। জানোতো ইংরেজরা এই শহরের মুসলমানদের বাঁচিয়ে রাখবে না। ওরা রক্তের বদলা নিচ্ছে। 

যত কিছু হোক না কেন আমি আপনার ভাইয়ের খবর আপনাকে এনে দেবো। আমি সময়-সুযোগ বুঝে ওই বাড়িতে যাবো হুজুর। 

সাবধানে যাবে। 

আপনি ঘাবড়াবেন না হুজুর। 

কাল্লু মিয়া চলে গেলে গালিব লিখতে বসলেন। কলমটা দোয়াতে চুবিয়ে লিখলেন, 

‘এখন অস্ত্রধারী ইংরেজ সেনা স্বেচ্ছাচারী ও স্বাধীন। 
আতঙ্কহিম নিশ্চল মানুষ, পথ জনহীন।’ 

ভাইয়ের স্ত্রী ও মেয়েদের শহর ছেড়ে চলে যাওয়া তাঁকে খুব মর্মাহত করে। তারা তাঁর ভাইকে রেখে চলে গেছে। হায় খোদা! তিনি গভীর আক্ষেপের সঙ্গে আবার লিখলেন : 

‘নিরানন্দ বাসভূমি আজ কারাগার 
চক পরাজিতের রক্তে রঙিন।’ 

চাঁদনি চক তাঁর প্রিয় জায়গা। সেই জমিন আজ রক্তে ডুবে যাচ্ছে! না, ভাইয়ের স্ত্রী ও মেয়েদের প্রতি তাঁর কোনো ক্ষোভ নেই। ক্ষোভ পুষবেন কেন? তাঁদেরওতো জীবনের ভয় আছে। মানুষতো বাঁচতে চায়। তিনি নিজেও ষাট বছরের বেশি সময় ধরে বেঁচে আছেন। আরও বেঁচে থাকতে চান। তাঁর বেঁচে থাকার তৃষ্ণায় অনন্ত ধারায় পানি সিঞ্চিত হোক। সতেজ থাকবে বয়সের নবীন চারা। পরক্ষণে আবার মন খারাপ হয়ে যায়। দিল্লির বর্তমান সময় তাঁকে তাড়িত করে ফিরছে। নিজেকে সামলে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আবার লিখলেন : 

‘নগর মুসলমানের শোণিত-ভূষিত
প্রতিটি ধুলিকণা তৃপ্তিবিহীন।’ 

শের তিনটি একটি আলাদা কাগজে লিখলেন। শের তিনটি ‘দস্তাম্বু’তে রাখবেন না। দিনলিপির অংশ হবে না এগুলো। কারণ ‘দস্তাম্বু’ বই হয়ে বের হলে ওটা ব্রিটিশদের হাতে পড়তে পারে। তারা তাঁর ক্ষতি করতে পারে। কে জানে। কাগজটি ভাঁজ করে আলাদা রাখলেন। বন্ধুদের চিঠিতে শেরগুলো জুড়ে দিলে যারা লক্ষ্ণৌ বা আগ্রায় বাস করছে তারা বুঝতে পারবে যে দিল্লির অবস্থা কেমন যাচ্ছে। গালিব দু’হাতে চোখের জল মোছেন। বাসগৃহ কারাগার হয়ে গেলে একজন মানুষের বেঁচে থাকা কতটা অর্থহীন হয়ে যায় এটা তারচেয়ে বেশি কে আর বুঝবে! তিনি চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে শূন্য ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। 

এক পেয়ালা শরবত নিয়ে ঘরে আসে বাকির 

নানা আপনার জন্য শরবত এনেছি। 

বাহ, বহুৎ আচ্ছা। আমার মনে হচ্ছে আমি মনে মনে শরবত খেতে চেয়েছিলাম। 

সত্যি! 

হ্যাঁ, সত্যি। তুমি এখন যাও বাকির। 

আপনি কি করবেন? 

আমি লিখবো। 

আপনি কি লিখবেন? 

আমি একটা দিনলিপি লিখছি। 

আপনিতো সব সময় লিখেন নানা। আমার জন্য একটা গজল লিখবেন? তোমার জন্য গজল? উঁহু, পারবো না। তোমার জন্য লেখা খুব কঠিন 1 আমি লিখতে পারবো না। 

থাক, না পারলে লিখতে হবে না। আপনার দিনলিপির নাম কি নানা?

‘দস্তাম্বু’। 

দস্তাম্বু, দস্তাম্বু! সুন্দর নাম। আচ্ছা আমি যাই। 

দৌড়ে চলে যায় বাকির। এই ছোট বাচ্চা ‘দস্তাম্বু’ মানে কি বুঝলো কিনা কে জানে। ওর বোঝার বয়সই বা কি। গালিব চুমুকে চুমুকে শরবত শেষ করেন। ভাবেন, বিবির মেজাজ ভালো আছে। নইলে নাতিকে দিয়ে শরবত পাঠাতো না। ভালো লাগে তাঁর। তিনি ‘দস্তাম্বুর’ পৃষ্ঠা খুলে বসেন। লিখতে শুরু করেন : 

১৮ সেপ্টেম্বর 

শুক্রবার জুম্মার দিন। ২৬ মহরম। যেসব সিপাহী বিপদগামী হয়েছিল, উন্মত্ত হয়ে এই শহরে প্রবেশ করেছিল, ঝড়ের মতো তাণ্ডবে ঘোড়ার খুরের শব্দে ভরিয়ে দিয়েছিল শহর, তারা এখন পালাতে শুরু করেছে। যেদিন ইংরেজ সেনানায়ক পাহাড়ি এলাকা থেকে নেমে বিজয়ীর বেশে শহরের প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করল সেদিনই শহর ও কেল্লা দখল করে নিল। হত্যা আর গ্রেফতারের খবর এই গলিতে এসে পৌছালো। আতঙ্কে শীতল হয়ে গেল সকলের কলজে। 

এটুকু লিখে তিনি আবার কাটলেন। কেটে পৃষ্ঠাটা টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। ভাবলেন, আবার নতুন করে লিখবেন। আসলে যা লিখতে চাইছেন তা হচ্ছে না। এই আতঙ্কিত শহর আমার বুকটা ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। শরীরের চেয়ে আমার বুক অনেক বেশি আহত এবং যন্ত্রণাদগ্ধ। অনেক বেশি পীড়িত কত বেশি যে পীড়িত তা আমি কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা করতে পারবো না। 

তিনি একটা কিছু লিখবেন তা ভাবার আগেই দুই নাতি এসে হাজির হয়।

নানা, আপনার লেখা কি শেষ হয়েছে? 

নাতো? কেন? 

আমরা চাই আপনি আমাদের সঙ্গে গলিতে মার্বেল খেলবেন।

আমার শৈশবে আমি ঘুড়ি উড়াতাম। মার্বেল খেলতাম। 

এখন আবার খেলবেন। আপনি তো তেমন বুড়ো হননি নানা। 

কে বলেছে বুড়ো হইনি? অনেক বুড়ো হয়েছি। আমি এখন বাদশাহর সভাকবি। 

সভাকবি! দুই বাচ্চা পরস্পরের দিকে তাকায়। তারপর বলে, আমরাই খেলবো। আপনার যেতে হবে না। আমরাতো গলিতে খেলতে পারি নানা? 

না, না গলিতে খেলতে যেও না। 

গলির মুখতো পাথর দিয়ে বন্ধ। কেউ খুলতে পারবে না। 

ও হ্যাঁ, তাইতো। গালিব অন্যমনস্ক হয়ে মাথা নাড়েন। 

দুই ভাই দৌড়ে বেরিয়ে যায়। 

তিনি তাঁর ‘দস্তাম্বু’র পৃষ্ঠায় লেখেন : 

গলির দরজা বন্ধ 

এই গলিতে দশ/বারোটি বাড়ি আছে। গলিটির মুখ একটিই। কানাগলি বলতে হবে। গলির বেশিরভাগ বাড়ির লোকেরা চলে গেছে। নারীরা বাচ্চাদের বুকে আগলে নিয়ে বেরিয়ে গেছে। তাদের হাতে দু’একটা পটুলিও ছিল। পুরুষরা যা বহন করা যায় তেমন জিনিসপত্রের গাঁটরি নিয়ে চলে গেছে। ওহ, এমন দৃশ্য আমাকে দেখতে হয়েছে। কদিন ধরে এমন দৃশ্য দেখলাম। আমরা যারা রয়ে গেলাম তারা ঠিক করলাম গলির মুখটা বন্ধ করে দেবো। আমরা সবাই মিলে একটি পাথর দিয়ে গলির মুখ আটকে দিলাম। এই গলিতে কোনো কুয়ো নেই। তারপরও এমন করতে হয়েছে। গলিটির আগে একটি চোখ ছিল, এখন দুটোই গেছে। পুরোই অন্ধ হয়ে গেছে বিল্লিমাঁরোওর এই গলি। 

এটুকু লিখে তিনি কলমটা দোয়াতে ঢোকালেন। আরও কিছু লিখবেন বলে ভাবলেন। শহরের চিত্র ভেসে ওঠে। ১৫ সেপ্টেম্বরের পর থেকে শহরের বাড়ির দরজাগুলো বন্ধ। যে যেভাবে পেরেছে পালিয়ে গেছে। নইলে খুন হয়েছে। দোকানগুলো বন্ধ। গম আটা ইত্যাদি কেনার জন্য দোকানদার নাই। কাপড় ধোয়ানোর জন্য ধোপা নাই। চুল কাটানোর জন্য নাপিত নাই। ময়লা সাফ করার জন্য মেথরও নাই। গলির লোকেরা পানির জন্য বাইরেও যেতে পারছে না। গলিটাকে পাথর দিয়ে বন্ধ করে যে অন্ধকার তৈরি করা হয়েছে, সে অন্ধকারে আমার হৃদয়ও পূর্ণ হয়ে আছে। 

তখন উমরাও বেগম ঢোকেন। খানিকটুকু উত্তেজিত। 

এই অবস্থা আর কতদিন চলবে? যেটুকু দানাপানি মজুদ ছিল তা শেষ হয়ে এসেছে। আর দু’একদিন চলতে পারে। 

গালিব নিস্পৃহ কণ্ঠে বলেন, আমার কি করার আছে? 

বাইরে বের হয়েতো দেখতে পারেন। কিছু করা যায় কিনা তার চেষ্টাতো করতে পারেন। 

বিবি বসো। আমাকে ভাবতে দাও। 

পাতিয়ালার মহারাজা গলি রক্ষার জন্য যাদের দাঁড় করিয়েছেন, ওদের সঙ্গে কথা বলুন। 

ঠিক আছে, আমি সেটাই করে দেখছি। 

উমরাও বেগম ফোঁস করে বললেন, আশ্রিতদের সবাইকে ঠিক মতো খাবার দিতে পারছি না। একটু একটু করে ভাগ করে দিয়েও কুলাচ্ছে না। গত রাত থেকে তিন-চারজন না খেয়ে আছে। দু’চার গ্লাস পানি খেয়ে কাটাবে সে অবস্থাও নাই। আগেতো গলির লোকেরা পানি আনতে পারতো, আটাও পাওয়া যেতো। 

জানি, বিবি এসব আমি জানি। 

তাহলে এমন বসে আছেন কেন? কেন নড়াচড়া করছেন না? 

যাচ্ছি, এখুনি যাচ্ছি। 

গালিব চপ্পল পায়ে গলিতে নামেন। পাহারায় যে রক্ষী ছিল তাকে বললেন, আমি বাইরে যেতে চাই। ভীষণ জরুরি দরকার। 

হুজুর, আপনার কি দরকার আমাকে বলবেন?

এই কিছু সওদা করা দরকার। 

রক্ষী দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলে, চকের বাজার পর্যন্ত যেতে পারবেন হুজুর।

সেটুকু যেতে পারলেই হবে। 

বোধহয় হবে না হুজুর। 

কেন? 

হত্যা-খুনে বাজারও খুব গরম। আমি আপনাকে না যেতেই বলি হুজুর। রাস্তাও খুব খারাপ। নানা ধরনের বিপদ আছে রাস্তায়। যাবেন না হুজুর। 

আচ্ছা থাক। নাইবা গেলাম। কিন্তু পানি ছাড়া তো চলছে না। 

আমরা ঠিক করেছি পানি আনার জন্য দরজা খুলে দেবো। যার যার বাড়ি থেকে কোনো পুরুষ মানুষ গিয়ে পানি আনবে। এখনতো শহরে ভিস্তিওয়ালারা নেই যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পানি দিয়ে আসবে। 

যার ঘরে যেটুকু পানি মজুত ছিল তাই দিয়ে কদিন চললো। আরতো চলছে না। 

হুজুর আপনি বাড়ি যান। আজাদ বা কাল্লু মিয়াকে মটকি বা ঘড়া দিয়ে পাঠিয়ে দিন। 

গালিব খানিকটুকু আশ্বস্ত হয়ে ধীরেসুস্থে বাড়ি আসেন। দূর থেকেই দেখতে পান যে উমরাও বেগম দুই নাতির হাত ধরে দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। উদগ্রীব চোখের দৃষ্টি। কাছে যেতেই বলেন, কিছু হলো? 

পানির সুরাহা হয়েছে। ভৃত্যদের পাঠাও। রক্ষী দরজা খুলে দেবে।

মিঠা পানি পাওয়া যাবেতো? 

সেতো আর আমি বলতে পারবো না। 

উমরাও বেগম ঝংকার দিয়ে বলে, তাতো পারবেন না। পারবেন কি? পারবেন শুধু— 

আহা থামো বিবি। দেখো নাতিরা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। 

উমরাও বেগম মুখ ঘুরিয়ে নাতিদের হাত টেনে চলে যান। একটু পরে দুজন কাজের ছেলে ঘড়া নিয়ে ছুটতে থাকে। গালিব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, আমাদেরকে যিনি প্রতিপালন করেন তিনি আমাদেরকে ভুলবেন না। খোদার প্রতি সে কৃতজ্ঞ থাকে না—শয়তান যাকে ভর করে। 

পানি পাওয়ার সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত গালিব অস্থির হয়ে রইলেন। ঘরে- বারান্দায় পায়চারি করতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে দুই নাতি হাতে দুটো গ্লাস নিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইল। দু’একবার শুধু বললো, পানির জন্য মরে যাচ্ছি। বুক ফেটে যাচ্ছে নানা। 

সবুর করো তোমরা। সবুরে মেওয়া ফলে। 

‘ওরা কাতর চোখে নানার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল। 

শেষ পর্যন্ত মটকি ভরা পানি নিয়ে ফিরে এলো দুজনে। আজাদ দরজার সামনে মটকি নামিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বললো, হুজুর আমাদেরকে দূরে যেতে দেয়া হয়নি। মিঠা পানি পাইনি। নোনা পানি নিয়ে আমাদেরকে ফিরে আসতে হয়েছে। 

শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। তবুতো পাওয়া গিয়েছে। তোমরা পানি পান করো বাচ্চারা। 

দু’ভাই এক চুমুক পানি পান করে মুখ কুঁচকায়। 

নানা খেতে পারছি না। 

উমরাও বেগম পেছনে দাঁড়িয়ে বলে, একটু একটু করে খাও বাচ্চারা। গালিব চারদিকে তাকিয়ে বলেন, আমাদের তৃষ্ণার আগুন এভাবেই নেভাতে হবে। 

তিনি নিজেও একটু একটু করে এক গ্লাস পানি পান করলেন। তাঁর মনে হলো মাথার ওপর থেকে খররোদ সরে গেছে। চারদিকে ছায়া নেমেছে। আজ তিনি দেয়ালের ওপর একটি চড়ই পাখি বসে থাকতে দেখেন। মাথার ভেতরে একটি শের তৈরি হয়- 

‘গোলাপের কলিগুলি পাপড়ি মেলেছে বিদায় জানাবার জন্য; 
হে বুলবুল, চলো এবার, চলে যাচ্ছে বসন্তের দিন।’ 

শেরটি তখুনি লিখতে বসলেন না। মাথায় রাখলেন। ভাবলেন, ঘুম পাচ্ছে। জাগরণে স্বপ্নে শেরটি ধরে রাখার জন্যই শুয়ে পড়লেন। অল্পক্ষণে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। 

.

কয়েক দিন পরে সুবেদার সীতারাম রাতের অন্ধকারে গালিবের কুঠুরিতে আসে। শতরঞ্জির উপর লুটিয়ে পড়ে বুকভাঙা কান্নায় ফোঁপাতে থাকে। গালিব তাঁর হাত ধরেন মাত্র। বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত, ভাঙা গাল-চোয়াল, কোটরগত চোখ সর্বস্ব সীতারামকে চিনতে তাঁর কষ্ট হয়েছিল। 

কেঁদেকেটে অনেকক্ষণ পরে স্থির হয়ে উঠে বসে সীতারাম। তারপরও বারবার ঘাড় কাত হয়ে যায়। গালিব তাঁকে সময় দেন। এক সময় সীতারাম কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলে, আমার পুত্র নাই। 

তোমার পুত্র অনন্তি? অনন্তি রামের কথা বলছো? 

হ্যাঁ হজরত। ফায়ারিং স্কোয়াডে ওরা আমার অনন্তির মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করেছে। 

তুমি পানি খাবে সীতারাম? 

না, লাগবে না। এখন আমার আর কিছুই লাগে না। তারপর নিজেই বলে, সেদিন ওরা আমাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের ডিউটিতে রেখেছিল। আমার ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে ওদের পায়ে ধরেছিলাম আমি। 

আমি জানি তুমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেঙ্গল নেটিভ ইনফেনট্রির সুবেদার। সীতারাম তারপরও মাফ পাওনি? 

হ্যাঁ, হজরত, তারপরও। তবে একটা জায়গায় মাফ পাই। ফায়ারিং স্কোয়াডের ডিউটি থেকে আমি রেহাই চেয়েছিলাম। অনেক অনুনয়-বিনয়ের পরে মেজর সাহেব আমাকে সেই ডিউটি থেকে বাদ দেন। আমি কীভাবে আমার পুত্রের বুকে গুলি চালাতে পারি হজরত, আপনি বলুন? 

গালিব মাথা নিচু করে থাকেন, যেন সীতারামকে কোনো কথা বলার সাধ্য তার নেই। আসলেই তো নেই। তাঁর এখন বোবা হয়ে থাকার সময়। মাঝে মাঝে এমন সময়ই তাঁর জীবনে আসে। আবার ধ্বনিত হয় সীতারামের কণ্ঠ, পরদিন আমার ছেলেসহ অনেক সিপাহীকে ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে যাওয়া হয়। শুধুমাত্র সন্দেহের বসে তারা এই কাজটি করেছিল। হজরত, আমি ব্রাহ্মণ। সকালে আমার তাঁবুতে বসে মন্ত্র জপ করছিলাম। শুনলাম গুলির শব্দ। ঝাঁকবাঁধা গুলির শব্দ। 

সীতারাম দু’হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়ে। আবার থামে। বলে, সেই শব্দ আমাকে জানিয়ে দিয়ে গেল যে আমার ছেলে নেই। আমি একবার শুধু ভাবতে পেরেছিলাম যে আমার চল্লিশ বছরের চাকরির এই পুরস্কার। কেউ নেই তো আমাকে দয়া দেখানোর জন্য। হজরত, ওদের কাছে মৃত্যু এখন একটা উৎসব। 

গালিব মাথা তুলে তাকান। পূর্ণ দৃষ্টিতে সীতারামকে দেখেন। সীতারাম বলে, আমাদের সিপাহীরা বিদ্রোহ করেছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে হিন্দুস্থানের পক্ষে লড়াই করেছে। ওরা ইংরেজদের মেরেছে প্রতিশোধের আগুন থেকে। আমি আমার চাকরি জীবন থেকে এটা বুঝেছি। ওদের নুন আমি খেয়েছি। তবে এটা বুঝেছি ওরা পশু, পশুর মতো। সেদিন ওরা সিপাহীদের মেরে ফেলে রেখেছিল। চিল, শকুন, শিয়ালের খাবার বানিয়েছিল। মেজর আমাকে আবার একটু দয়া দেখিয়েছিল। আমি আমার পুত্রের মৃতদেহ সৎকারের সুযোগ পেয়েছিলাম। ভগবান আমার এই প্রার্থনা পূরণ করেছেন 

হজরত। 

গালিব তাঁর মুখোমুখি বসে হাত জড়িয়ে ধরে রাখেন শুধু। এবারও তিনি কথা বলতে পারেন না। সীতারাম দু’হাতে চোখের জল মুছে বলে, আপনি কি বাদশাহর খবর জানেন হজরত? 

না, আমি তো ঘরে বন্দী? কোথা থেকে খবর পাব! 

সীতারাম সোজা হয়ে বসে বলে, ইংরেজরা শহরে প্রবেশ করার কয়েকদিন পরেই বাদশাহ বেগম ও যুবরাজদের নিয়ে লালকেল্লা ছেড়ে সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিতে আশ্রয় নেন। সঙ্গে অনেক সিপাহি ছিল। 

গালিব উদগ্রীব কণ্ঠে বলেন, তারপর? 

মেজর হডসনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বাদশাহকে গ্রেফতার করার জন্য। তবে কাজটি সহজ ছিল না। হডসন নানা কৌশল করে বাদশাহকে আত্মসমর্পণ করার জন্য বাধ্য করেন। এখন তাঁকে লালকেল্লায় বন্দী করে রাখা হয়েছে। তাঁর বিচার করা হচ্ছে। 

যুবরাজরা কেমন আছেন? তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। 

সীতারাম ভগ্ন কণ্ঠে বলে, বিভিন্ন জনের মুখে মুখে শুনেছি পাষণ্ড হডসন সবাইকে হত্যা করেছে। শুনেছি মুঘলদের শেষ সম্রাটকে ইঁদুরের মতো গর্ত থেকে বের করবার জন্য এবং তাঁর পুত্রদের শেষ করে দেবার জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন জেনারেল মন্টগোমারী। হজরত, খবর এখন বাতাসের বেগে উড়ে বেড়ায়। 

সীতারাম একটুক্ষণ থেমে আবার বলে, হডসন তিনজন যুবরাজকে গ্রেফতার করে গরুর গাড়িতে তুলে দেন। এক সময় তাঁদেরকে জামাকাপড় খুলে ফেলার হুকুম দেন। তারপর নিজে গুলি চালিয়ে তাঁদেরকে হত্যা করেন। 

গালিব এবারও মাথা নিচু করে বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে থাকেন। তাঁর বুক ফেটে যাচ্ছে। চোখের পানিতে ভেসে যাচ্ছে মুখমণ্ডল। হাত তুলে মোছারও শক্তি তাঁর নেই। সীতারাম তাঁর এই অবস্থা না দেখেই বলতে থাকে, কয়েকজন যুবরাজের লাশ কোতোয়ালীর সামনে একদিন এক রাত ঝুলিয়ে রাখা হয়। আরও কুড়িজন যুবরাজকে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। 

সীতারাম এক মুহূর্ত থেমে বলে, আরও শুনেছি যে দু’জন যুবরাজের ছিন্ন 

মুণ্ডু বাদশাহকে হডসনের উপহার হিসেবে পাঠানো হয়েছে। 

সীতারাম, আমি আর কিছুই শুনতে চাই না। সীতারাম তুমি থামো।

আমি চলে যাই। 

পারবে যেতে? 

চেষ্টা করে দেখি। 

সীতারাম চলে গেলে গালিব শতরঞ্জির উপর পড়ে থাকলেন। বিভিন্ন জনের ডাকাডাকিতে তিনি সাড়া দিলেন না। 

.

দু’দিন পরে বৃষ্টি নামলো। বর্ষা মৌসুম শুরু হয়েছে। আকাশ কালো করে চারদিক কাঁপানো বৃষ্টি। বাড়ির সবাই বৃষ্টির পানি ধরার জন্য মেতে উঠলো। উঠোনে একটি চাদর টানিয়ে তার নিচে ঘড়া-মটকি রেখে দেয়া হলো। টানা বৃষ্টিতে ভরে গেল পাত্রগুলো। পানি দেখে খুশি সবাই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন উমরাও বেগম। দোপাট্টা দিয়ে ভিজে যাওয়া মুখ মুছতে মুছতে বললেন, বেশ কিছুদিনের জন্য নিশ্চিত হওয়া গেলো। 

গালিব মৃদু হেসে বললেন, বেশ অনেকদিন পরে তোমার হাসিমুখ দেখতে পেলাম বিবি। 

উমরাও বেগম ভুরু কোঁচকালেন। মুখে কিচ্ছু বললেন না। মাথার ওপর থেকে দোপাট্টা সরিয়ে হাত খোঁপা করে রাখা চুল ছড়িয়ে দিলেন পিঠের ওপর। দীঘল কেশরাশির দিকে তাকিয়ে গালিব বললেন, আমাদের একদিন কৈশোর ছিল। 

থাকবেইতো। আমরাতো জন্মেই বুড়িয়ে যাইনি। তার জন্য আপনার দুঃখ হচ্ছে? 

হয়ইতো। সৌন্দর্য নষ্ট হলে মানুষের দুঃখ হওয়াই স্বাভাবিক। 

বয়সেরও সৌন্দর্য আছে। মানুষের বয়স এক জায়গায় থেমে থাকলে আপনারা কবি হতে পারতেন না। 

বাব্বা, বিবি তুমিতো বেশ কথা বলেছো। 

যাই, পানি মজুত রাখার ব্যবস্থা করি। আপনি কি আর এক গ্লাস বৃষ্টির পানি খাবেন? 

বৃষ্টির পানিতো খোদার মেহেরবানী। আমাকে আরও দু’চার গ্লাস পানি দিও দুপুরের খাবার সময় 

আচ্ছা দেবো। আপনি কি এখন আপনার কৈশোর নিয়ে কসীদা লিখবেন?

ভেবে দেখি। তারপর উমরাও বেগমের হাত টেনে ধরে বলেন :

‘কোঈ দিন গর জিন্দাগানী অওর, হ্যায় 
আপনে দিল মে হমনে ঠানী অওর হ্যায়। 
জীবন যদি আরও কিছুদিন থাকে, 
মনে মনে আমি ঠিক করেছি, কিছু অন্যরকম।’ 

উমরাও বেগম মৃদু হেসে বলেন, তা আমি জানি। আমাকে বিয়ে করে আপনি খুশি নন। আপনি সব সময় অন্য রকমই ভেবেছেন এতগুলো বছর। 

গালিব একদৃষ্টে উমরাও বেগমের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ভেবেছিলেন বৃষ্টিস্নাত বর্ষার স্নিগ্ধতায় তাঁর বিবি জীবনের দুঃখ ধুয়ে ফেলবেন। দেখলেন উমরাও বেগমের জীবনে বৃষ্টি শুধুই খাওয়ার পানি। 

উমরাও বেগম ভুরু কুঁচকে বলেন, দেখছেন কি? আপনি আমাকে কয়েকদিন পর পর বলেছেন, যখন আমার আব্বাজান মৃত্যুর গভীর নিদ্ৰায় চলে গেলেন, সেই সঙ্গে আমার ভাগ্যও নিদ্রায় ডুবে গেলো। 

হ্যাঁ আমিতো আমার ভাগ্যের কথা বলেছি। 

কিন্তু আপনার আব্বাজানের মৃত্যুর পরে আপনার চাচাজানের কোলে ঠাঁই পেয়েছিলেন। সেটাওতো ভাগ্যবানের লক্ষণ। 

ঠিকই বলেছো বিবি। 

তাহলে স্বীকার করেন যে আপনার ভাগ্য নিদ্রায় তলিয়ে যায়নি। 

গালিব এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন। তারপর প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলতে শুরু করলেন, আমার চাচাজান জেনারেল লর্ড লেক বাহাদুরের খুব বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলেন। তিনি চারশো ঘোড়সওয়ারের সর্দার ছিলেন। আগ্রার কাছে দুটি পরগণার মালিক হয়েছিলেন। 

তারপরও আপনি কেন বলেন যে, আপনার ভাগ্য- 

আহ বিবি, থামো থামো। তুমিতো জানো আমার চাচাজানের মৃত্যুর পরে ইংরেজ সরকার পরগণা দুটি ফিরিয়ে নিয়েছিল। 

উমরাও বেগম এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে বলেন, পরগণার বদলে আপনাকে এবং আপনার ভাইকে পেনশন মঞ্জুর করেছিল ইংরেজ সরকার। 

হ্যাঁ, তা করেছিল। আমরা বেশ আরামেই ছিলাম। 

আমাদের বিয়ের পরে আমার আব্বাজান আপনাকে দিল্লি নিয়ে এসেছিলেন। আপনি আসাদ নামে কবিতা লিখবেন না গালিব নামে লিখবেন তা আমার আব্বাজান ঠিক করে দিয়েছিলেন। এখন আপনি একজন বড় কবি। বাদশাহর সভাকবি। 

বিবি, তুমি একজন বেশ আলেমদার মহিলা। তোমার অনেক বুদ্ধি। 

এই বুদ্ধি দিয়ে এখন পানি মজুদ করার ব্যবস্থা করবো। নসীব আপনা আপনা। আপনার চেয়ে আমার নসীবই নিদ্রায় তলিয়ে গেছে। আমার চেয়ে এটা আর কে বেশি জানে। 

গালিবকে আর কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উমরাও বেগম দ্রুতপায়ে ঘর ছাড়েন। গালিব বড় করে শ্বাস টানেন। উমরাও বেগম তাঁকে অনেক কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেলেন। তিনি ‘দস্তাম্বু’র খাতা খুলে লিখলেন, ‘আমার পাঁচ বছর বয়সে পিতা আবদুল্লাহ বেগ ইন্তেকাল করলেন। আমার নয় বছর বয়সে আমার চাচা নসরুল্লাহ বেগ ইন্তেকাল করলেন। মৃত্যু আমার ভাগ্যকে অন্ধকারে নিয়ে গেলো। নইলে আমার আরও অন্য কিছু হতে পারতো। আমি জানি না তা কি।’ 

সেদিন সন্ধ্যেবেলা একুশ বার তোপধ্বনি শুনতে পেল শহরের অধিবাসী। গালিব কান খাড়া করে শুনলেন। ভাবলেন কি হলো? একুশ বার কেন? তিনি তো জানেন লেফটেনান্ট গভর্নর এলে সতেরোবার তোপধ্বনি হয়। গভর্নর জেনারেল এলে হয় ঊনিশ বার। কি হয়েছে তার কোনো খবর পাওয়ার উপায় নেই। তবে কি ওরা বিদ্রোহীদের সঙ্গে আর একটি লড়াইয়ে জিতেছে? সে জন্যই হবে হয়তো। এখনো বিদ্রোহীরা কয়েক জায়গায় লড়াই করছে। বেরিলী, ফররুখাবাদ, লক্ষ্ণৌ— জিততে পারবে না জেনেও লড়াই। মানুষতো এমনই। সহজে পরাজয় স্বীকার করতে চায় না। আস্তে আস্তে সব যুদ্ধেই জিতবে ইংরেজরা। আস্তে আস্তে ওরা- তিনি থামলেন। ভাবলেন, এখনো অবরুদ্ধ এই শহর। আর কতদিন লাগবে তাদের মুক্ত হতে? সে রাতে ঠিকমতো ঘুমুতে পারলেন না তিনি। উঠলেন, পানি খেলেন। শেষ রাতে ঘুম এলো। ঘুম যখন ভাঙলো তখন বেলা বেশ গড়িয়েছে। 

বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে উমরাও বেগম ডাকাডাকি করছেন তাঁকে। তাঁর পেছনে কাল্লু মিয়াসহ আরও কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। 

তিনি ধড়মড়িয়ে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে বিবি? 

সর্বনাশ হয়েছে। ইউসুফ ভাই সাহেবের বাড়ি লুট হয়ে গেছে। কাল্লু মিয়া তার খবর জানতে গিয়েছিল। 

জ্বী হুজুর। আমি নিজে দেখে এসেছি। গলির আরও অনেকের বাড়ির সঙ্গে তার বাড়িও লুট হয়েছে। 

আমার ভাই কেমন আছে? 

তিনি ভালো আছেন। তাঁর বুড়ো দারোয়ান আর বুড়িকে কিছু বলেনি লুটেরারা। 

যাক, বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। 

গালিব হিসেব করে বললেন, ইংরেজরা শহর দখলের সতেরো দিন পরে এমন ঘটনা ঘটলো। যাক, আমরা ভাগ্যবান যে আমার ভাইয়ের গায়ে ওরা হাত দেয়নি। কাল্লু মিয়া, ওই বাড়িতে দানাপানি আছে তো? 

আছে হুজুর। বুড়ো দারোয়ান দুজন হিন্দুকে আশ্রয় দিয়েছেন। ওই দুজন থাকাতে খানিকটা সুবিধা হয়েছে। ওরা দানাপানি যোগাড়ের চেষ্টা করে। বুড়োর তেমন কষ্ট হয় না। বুড়ো বরং হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। 

যাক, এটা একটা সুখবর। কি বলো বিবি? 

হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। 

গালিব পায়ে চপ্পল গলিয়ে খাট থেকে নামেন। বারান্দার দিকে যেতে যেতে বলেন, বুকটা বেশ হালকা লাগছে। খোদা মেহেরবান। 

বালতি থেকে পানি নিয়ে মুখে ছিটানোর সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, লুটপাট করলো কে? সিপাহীরা বিদ্রোহ করলে শহরের ঘরবাড়ি লুটপাট হয়, ইংরেজরা বিজয়ী হলেও লুটপাট হয়। তাহলে লুটপাটের হোতা দিল্লিবাসীরা। হাঃ! নিজেদের লোকই নিজেদের শত্রু। দুঃসময়ে তারা নিজেরা বন্ধুর আচরণ করে না। সে জন্যই চারদিকে এত জ্বালা-যন্ত্রণা। তিনি আবার ঘরে ফিরে আসেন। মুখ জুড়ে, হাতে, গলায় ফোঁটা ফোঁটা পানি লেগে থাকে। কপাল থেকে একটি সরু ধারা গালের ওপর গড়িয়ে আসে। তিনি হাত দিয়ে পানি মুছতে মুছতে বলেন, বেশ আরাম লাগছে। ভালোই তো আছি। 

.

পরদিন দুপুরবেলা। আকাশে মেঘ আছে, তবে বৃষ্টি নেই। ভ্যাপসা গরম অস্বস্তিকর। গালিব নিজেই হাতপাখা নিয়ে নিজেকে বাতাস দিচ্ছেন। কিছু লিখবেন বলে ভাবছেন, অন্তত ‘দস্তাম্বু’র পৃষ্ঠা ভরাবেন বলে চিন্তা করছেন। তখুনি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে আসে আজাদ। 

হুজুর। হুজুর। 

হাঁফাচ্ছো কেন? কি হয়েছে? 

কয়েকজন গোরা সৈন্য দেয়ালের ওপর উঠে পড়েছে। মনে হয় ওরা আমাদের বাড়ির দিকে আসছে। 

গোরা সৈন্য গলিতে? গালিব উৎকণ্ঠিত হন। দ্রুতকণ্ঠ বলেন, এই গলি পাহারা দেয় মহারাজা নরেন্দ্র সিংয়ের রক্ষীরা। তারা কি করছে? তারা ওদেরকে বাধা দিতে পারছে না? 

না, হুজুর পারেনি। অন্য বাড়িতেও ওরা ঢোকেনি। এতক্ষণে বোধহয় আমাদের দরজায় এসে পড়েছে। যাই দেখি। 

গালিব কলম হাতে নিয়ে কাগজের ওপর মাথা নুইয়ে বসে রইলেন। বুকটা ভয়ে কাঁপছে। ওরা তো জানে যে তিনি বাদশাহর সভাকবি। বাদশাহর কবিতা পরিমার্জনা করে দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো। তবে কি? 

তখন দরজায় বুটের শব্দ হয়। অর্থাৎ ওরা পৌঁছে গেছে। বাড়ির মালামাল কি লুট হয়ে যাবে? তিনি দ্রুত নানাকিছু ভাবলেন। তাঁর টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালো একজন। বাকিরা দরজার কাছে কিংবা ঘরের অন্য জায়গায় দাঁড়ালো। কেউ কোনো জিনিসপত্রে হাত দিলো না। টেবিলের সামনে যে দাঁড়িয়েছিল সে ভদ্র ভাষাতেই বললো, আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। 

তিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন, কোথায়? 

কর্নেল ব্রাউনের অফিসে। 

আমিতো পালকি ছাড়া কোথাও যাই না। পালকির বেহারারা শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। 

কর্নেল ব্রাউনের অফিস আপনার গলি থেকে খুবই কাছে। হেঁটে যেতে কোনো অসুবিধা হবে না। আপনি উঠুন। 

আমি কয়েকজনকে সঙ্গে নিতে চাই।

যাকে খুশি নিতে পারেন। 

আমাকে পোশাক বদলাতে হবে। 

আমরা বাইরে দাঁড়াচ্ছি। আপনি তাড়াতাড়ি পোশাক বদল করে আসুন। 

গালিব বুঝলেন যে ওরা তাঁকে নিয়েই যাবে। তাঁকে যেতেই হবে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝলেন যে, ওরা তাঁর মর্যাদা রেখেছে। আদব-কায়দার সঙ্গে ব্যবহার করছে। তিনি কাপড় বদলানোর জন্য নিজের ঘরে যেতে যেতে উমরাও বেগমকে বললেন, বাচ্চাদের কাপড় বদলে দাও। ওরা আমার সঙ্গে যাবে। কাল্লু, আজাদ, হাফিজ, তৌফিক যাবে। 

অল্প সময়ের মধ্যে তারা বাইরে এলে দেখতে পান কয়েকজন প্রতিবেশী উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একজন জিজ্ঞাসা করলেন, ওস্তাদ, এরা আপনাকে কোথায় নিয়ে যাবে? 

কর্নেল ব্রাউনের অফিসে। 

তাঁর অফিস কাছেই। আমরা চিনি। দাঁড়িয়ে থাকা চারজন এক সঙ্গে বললেন, আমরাও আপনার সঙ্গে যাব। 

আমার সঙ্গে যাবেন? 

বাহ্, আমাদেরতো দেখতে হবে যে ওরা আপনাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।

গোরা সৈন্যরা তাগাদা দিলে সবাই মিলে হাঁটতে শুরু করে। প্রতিবেশী তৌফিক নেওয়াজ বলে, চাঁদনি চকেই সাহেবের অফিস। ব্যবসায়ী কুতুব-উদ- দিনের বাড়ি সেটা। 

আপনাদের শুকরিয়া জানাই যে আপনারা আমার সঙ্গে যাচ্ছেন। 

মাশহুদ বয়সী ভদ্রলোক। চকে তার ব্যবসা আছে। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ওস্তাদ আপনি আমাদের মাথার তাজ। আমরা বেঁচে থাকতে আপনাকে গোরা সৈন্যরা নিয়ে যাবে তা কি হয়? দরকার হলে দিল্লি শহরবাসী আপনার কাছে এসে দাঁড়াবে। 

গালিব প্রতিবেশীদের আন্তরিকতায় খুবই মুগ্ধ হন। তাঁর বুকটা বড় হয়ে যায় এই ভেবে যে ওরা তাঁকে খুব ভালোবাসে। তাঁর নাতিরা লাফাতে লাফাতে হাঁটছে। কখনও দৌড় দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। যেন ওরা এতদিন বন্দি পাখি ছিল। আজ ছাড়া পেয়েছে। ডানা মেলতে পারছে। ওরা উড়ে গিয়ে ছুঁয়ে আসবে আসমানের নীল। কিন্তু তাঁর চিন্তা বাচ্চাদের মধ্যে থেমে থাকে না। মনে হয় কয়কজন প্রতিবেশীর ভালোবাসাই সামান্য কথা নয়। তাঁর শত্রুরও শেষ নেই। তখন মনে মনে আওড়ালেন নিজের শের : 

‘আমি আছি গালিব, আর অবসাদের প্রত্যাশা আছে। 
দুনিয়ার লোকের ভালোবাসার রকম দেখে হৃদয় পুড়ে গেছে।’ 

তাঁরা পৌঁছে গেলেন চকে। যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গে তাঁকে কর্নেল ব্রাউনের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রতিবেশীরাও তাঁর সঙ্গে ব্রাউনের কক্ষে ঢুকলেন। ব্রাউন ভাঙা ভাঙা উর্দু এবং ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন।

আমি শুনেছি আপনি কবি। আপনার পুরো নামটা বলবেন কি?

মির্জা মহম্মদ আসাদুল্লাহ খান গালিব। আমি গালিব নামে- 

প্রতিবেশী নেওয়াজ খান আগ বাড়িয়ে বলেন, তিনি এই নামে কবিতা লিখে খ্যাত। সবাই তাঁকে চেনে। 

আপনি? 

আমি তাঁর প্রতিবেশী। ব্যবসা করি। 

বহুৎ আচ্ছা। একটু জোরের সঙ্গেই বললেন ব্রাউন। গালিবের মনে হলো মেকী কণ্ঠস্বরে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে গেলো। তারপরও ব্রাউন যথেষ্ট সৌজন্য দেখাচ্ছেন। গালিব তাঁর প্রথামাফিক পোশাক পরেছেন। যেসব পোশাক তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কোথাও যেতে হলে পরেন। মাথায় পরেছেন বিশেষ ধরনের টুপি কুল্লাহ পপাখ। গায়ে আলখাল্লা। কোমরে রঙিন বন্ধনী। ব্রাউন তাঁর দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, আপনি মুসলমান? 

গালিব নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, আধা। 

ব্রাউন বিস্মিত হয়ে বললেন, এর মানে কি? 

গালিব মৃদু হেসে বলেন, মদ খাই। কিন্তু শুয়োর খাই না। 

কথা শুনে ব্রাউন হাসেন। 

গালিব তাঁকে রানী ভিক্টোরিয়ার কাছ থেকে পাওয়া উত্তরপত্র দেখান। ব্রাউন বলেন, ইংরেজদের বিজয়ের পরে আপনি পাহাড়ে এলেন না কেন? 

গালিব মৃদু হেসে বলেন, অসুবিধায় ছিলাম। আমি চারজন বেহারার অফিসার ছিলাম। ওরা আমাকে রেখে পালিয়ে গেছে। আমি তো পালকি ছাড়া চলতে পারি না। কি করে যেতাম বলেন? 

ব্রাউন মাথা নাড়েন। বলেন, আপনাদের সঙ্গে কথা বলে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমরাতো শান্তি চাই। শান্তি ছাড়া জীবন ঠিক মতো চলে না। 

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা সত্যি, তা সত্যি। আমি আপনাকে শান্তির শের শোনাতে পারি? 

অবশ্যই পারেন, অবশ্যই পারেন। বলুন। 

গালিব কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করেন। তারপর দাড়িতে হাত বুলিয়ে আবৃত্তি করেন : 

‘আজাদহ্ রু হু অওর মেরা মসলক হ্যায় সলহ-এ-কুল। 
হরগিজ কভি কিসীসে অদাবত নহী মুঝে। 
উদার মনে শান্তি চাই সবার সাথে 
বন্ধুতা চাই, শত্রুতায় কাজ নেই আমার।’ 

উপস্থিত সবাই প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। ব্রাউন হ্যান্ডশেক করে বললেন, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমার খুব ভালো লাগছে। থ্যাঙ্কু মি. গালিব। 

গালিব সবাইকে নিয়ে খুশি মনে বেরিয়ে এলেন। বাইরে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, যাক বাঁচা গেলো। ভেবেছিলাম না জানি কি হয়। 

নেওয়াজ খানও একই কথা বললেন, আমরাও ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আপনি বাদশাহর সভাকবি ছিলেন, না জানি ওরা আপনাকে কি করে! 

খোদা মেহেরবান! গালিব স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ছাড়েন। 

সবাই মিলে বাড়ির পথে এগোতে থাকে। এখন আর সঙ্গে গোরা সৈন্যরা নেই। প্রতিবেশীদের একজন নিচু স্বরে বলে, ব্রিটিশরা লোকজনকে হত্যা করে, তাড়িয়ে দিয়ে খুনের দরিয়া বইয়ে দিয়েছে। 

আহ্ থামুন। 

আমার জীবনে আমি শহরে খুনের দরিয়া বইতে দেখিনি। 

আহ্ থামুন। আপনার কথা শুনলে বাচ্চারা ভয় পাবে। আগে বাড়ি চলুন। কাসিম গলিতে ঢোকার পরে বিল্লিমাঁরোতে পৌঁছালে বুঝবো যে বাড়িতে এসেছি। তার আগে পর্যন্ত নয়। 

গালিবের ক্ষুব্ধ কণ্ঠ বাতাসে ভেসে যায়। কেউ আর কথা বলে না। 

কয়েক কদম এগোনোর পরেই চাঁদনি চকের দিক থেকে হৈ-হল্লা ভেসে আসে। গালিব দলবল নিয়ে মসজিদ চকের কাছে থমকে দাঁড়ান। একজন প্রতিবেশী তাঁর হাত টেনে ধরে বলে, দাঁড়াবেন না। বাড়ি চলুন। নিশ্চয় কোথাও কেউ খুন হয়েছে। আমাদের এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না। 

গালিবের মনে হয় পায়ের পাতা ভারি হয়ে গেছে। পা টেনে ওঠানো যাচ্ছে না। কাল্লু এসে হাত ধরে, হুজুর আমার ঘাড়ে হাত দেন। 

গালিব ওর ঘাড়ে হাত রেখে দম নেন। ওর ঘাড়ে ভর দিয়ে খানিকটুকু হেঁটে আসেন। চাঁদনি চক এলাকা ছাড়ার কয়েক কদম পরেই সবাই দেখতে পায় যে একজন ছুটতে ছুটতে আসছে। গালিবের সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রবলভাবে দম ফেলে বলে, আদাব মির্জা সাহেব। আপনার জন্য একটি দুঃসংবাদ এনেছি। 

দুঃসংবাদ? কি হয়েছে? 

সবাই তাকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। লোকটি ঘড়ঘড়ে গলায় বলে, মীর সাহেব খবরটা আপনাকে জানাতে বলেছেন। 

কি হয়েছে বলুন? গালিবের কণ্ঠে উদ্বেগ। 

আজ খুব ভোরে কাশ্মিরী গেটের কাছে নওয়াব শামসুদ্দীনকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। 

ইন্নালিল্লাহ- 

গালিব এটুকু বলতেই লোকটি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলে, খোদার দোহাই লাগে আপনি বাড়ি যান। ঘর থেকে বের হবেন না। চারদিকে মৃত্যু আর মৃত্যু যাই। খোদা হাফেজ। 

লোকটি দৌড়ে চলে যায়। গালিব উদ্‌ভ্রান্ত দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকান। স্খলিত কণ্ঠে বলেন, মৃত্যু, মৃত্যুর মুশায়রা চলছে শহর জুড়ে। কান পাত, কান পাত সবাই। শোন মুশায়রার বিলাপ। 

কাল্লু অনুভব করে হুজুর তার শরীরের ভার ওর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি খুব ধীরে ধীরে পা ফেলে বাড়ির দিকে এগুচ্ছেন। পেছনে বাকিরা। শুধু বাচ্চা দুটো দৌড়ে চলে যাচ্ছে আগে আগে। গালিব চারদিকে তাকান। দেখতে পান শহরের হতশ্রী অবস্থা। প্রায় জনমানব শূন্য এলাকা। কাশ্মিরী গেট থেকে চাঁদনিচকের মাঝের এলাকাটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা। যাকে পেয়েছে তাকেই খুন করেছে তারা। বুকের ভেতরে বিলাপের ধ্বনি ওঠে। তিনি এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করেন। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলেন, এখন আমি নিজেই হেঁটে যেতে পারবো। তোমার সাহায্য আর দরকার হবে না কাল্লু মিয়া। 

ওর হাত ছেড়ে দিয়ে তিনি প্রতিবেশীদের দিকে তাকান। বলেন, ব্রাউন আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছেন, না? 

হ্যাঁ, তা করেছেন। তবে ওদেরকে বিশ্বাস নেই। 

কেনইবা আপনাকে ওর অফিসে ডেকে নিয়ে গেলো তা বুঝতে পারলাম না।

তাইতো, তেমন কিছু জিজ্ঞেস করেনি ওস্তাদকে। 

গালিব মাথা নেড়ে বলেন, ঠিক বলেছেন আপনারা। তবে আমি ওদের পেনসন খাই সে জন্যও ডাকতে পারে। 

হতে পারে। 

বিদ্রোহের সময় থেকে পেনসন পাওয়া বন্ধ হয়ে আছে। সেটা আবার কবে পাবো কে জানে। 

সবাই গলি বিল্লিমাঁরোতে পৌঁছে যায়। তখন সূর্য মধ্য গগন ছেড়ে খানিকটুকু পশ্চিমে সরেছে। তিনি দেখতে পান উমরাও বেগম তাঁর জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা একজন নারীর মতো মনে হচ্ছে, যে নারীকে কখনো দেখা হয়নি, অথচ এমন একজন অপেক্ষমান নারীর তৃষ্ণা আছে বুকের মধ্যে। তিনি ঘরে ঢুকে উমরাও বেগমের হাত থেকে পানির গ্লাসটা গ্রহণ করেন। চুমুক দিয়ে বলেন, শুকরিয়া বিবি। 

আপনি এখন কি করবেন? 

গোসলের পানি দিতে বলো। 

আপনি কি খুব ক্লান্ত? 

হ্যাঁ, খুব ক্লান্ত। 

আপনাকে কেমন জানি লাগছে। 

কেমন? 

মনে হচ্ছে এই শহরে আপনি বুঝি নতুন এসেছেন। শহরটা আপনি চেনেন না।

ঠিকই বলেছো বিবি। শহরটা আমি চিনতে পারছি না। এত নষ্ট—এত রক্ত-মৃত্যু, মৃত্যু বিবি, মৃত্যুর মুশায়রা চলছে। 

কি বলছেন মৃত্যুর মুশায়রা? পাগল হয়ে গেলেন নাকি? আমি পানি দিতে বলছি। আপনি গোসল করুন। মাথা ঠাণ্ডা হবে। 

উমরাও বেগম চলে গেলেও গালিব দাঁড়িয়ে থাকেন। মনে হয় যে মহিলা তাঁর সামনে থেকে চলে গেলেন তাঁকে তিনি চেনেন না। কোনোদিন দেখেননি। আশ্চর্য, কতকাল হলো যে তিনি এই বাড়িতে আছেন? হাজার বছর? নাকি তারও বেশি? দিল্লি শহর কবে গড়ে উঠেছিল? কীভাবে? যমুনা নদীর গর্ভ থেকে কি দিল্লির জন্ম হয়েছিল? আহ্, যমুনা নদী! যমুনা নদীর পাড়ে তাঁর জন্ম, শৈশব কেটেছে সেখানে, কত ঘুড়ি উড়িয়েছেন। নদী, শৈশব-ভাবনা, আকাশ জুড়ে ঘুড়ি এবং ঘুড়ির সুতো তাঁর মন ভালো করে দেয়। তিনি স্বস্তি বোধ করেন। 

কাল্লু মিয়া এসে দাঁড়ায়। বলে, হুজুর গোসলের পানি দিয়েছি।

ওই নোনা পানি? 

এছাড়া আর তো পানি নেই হুজুর। অনেক খুঁজে একটু খাবার পানি জোগাড় করতে পেরেছি আমরা তিন জনে মিলে। 

গালিব চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। কাল্লু মিয়ার চলে যাওয়া দেখেন। কিন্তু খানিকটুকু যেতেই তিনি ওকে ডাকেন। কাল্লু মিয়া কাছে এসে দাঁড়ালে বলেন, আমরা কত কাল এই বাড়িতে আছি কাল্লু মিয়া? 

কতকাল? ও আঙুলে গুণে সময় হিসেব করতে থাকে। তারপর মাথা চুলকে বলে, আমি মনে করতে পারছি না হুজুর। 

গালিব ওর দিকে তাকিয়ে বলেন, বোধহয় এক হাজার বছরের বেশি হয়ে গেছে। 

কাল্লুর চোখ কপালে ওঠে। চোখ বন্ধ করে বলে, এক হাজার বছর!

হ্যাঁ, শোন কাল্লু তুমি কি ছোটবেলায় ঘুড়ি ওড়াতে? 

না, হুজুর। আমি কখনো ঘুড়ি উড়াইনি। মার্বেলও খেলিনি। কারণ ওগুলো কেনার টাকা আমাদের ছিল না। বাবা-মায়ের কাছে আবদার করে লাভ হতো না। 

তাহলে তোমরা- 

আমরা হুজুর লুকোচুরি খেলতাম। দৌড়াদৌড়ি করতাম। পুকুরে সাঁতার কাটতাম। পাখির ডিম খুঁজতাম। গরিব মানুষের যেটুকু খেলাধুলা বরাদ্দ ছিল আমরা তাই খেলতাম। 

আফসোস! মানুষের যদি শৈশবে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন না থাকে তাহলে মানুষের অনেক কিছু হারিয়ে যায়। মানুষ সেসব জিনিস খুঁজতে থাকে জীবনভর। কিন্তু বুঝতে পারে না যে সে কি খুঁজছে। 

ঠিক হুজুর। আমার মাঝে মাঝে এমনই লাগে। তখন আমি কাঁদি। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যাই। ঘুমে খুব সুন্দর স্বপ্ন দেখি। 

কি স্বপ্ন দেখো কাল্লু মিয়া? 

এই তো দু’দিন আগে দেখেছি আমি খুব ছোট। বাবা-মায়ের সঙ্গে যমুনা নদীতে বড় একটা বজরায় চড়ে কোথাও যাচ্ছি। খুব সুন্দর বজরা। আমার নিজেকে বাদশাহর মতো মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমি হাওয়ায় ভেসে যেতে পারি। 

বাহ্, কাল্লু মিয়া বাহ্। তোমার স্বপ্নে তুমি তোমার শৈশব ফিরে পাও। খোদাতালা মানুষকে এভাবে তার হারানো জিনিস ফিরিয়ে দেন। 

কাল্লু মিয়া গদগ স্বরে কিছু একটা বলে গালিব তা বুঝতে পারেন না। বুঝতে চানও না। বুকের ভেতর যমুনা নদী বইতে শুরু করেছে। তিনি দ্রুত হেঁটে পানির কাছে আসেন। পানিতে মাথা ভেজান। তারপর পুরো শরীর। যেন তাঁর শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে যমুনা, গড়াচ্ছে যমুনার জল, আর তিনি এক আশ্চর্য বালক- জল এবং নদীর অনুভব নিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছেন। 

.

পরদিন তাঁর ঘুম ভাঙার কিছুক্ষণের মধ্যেই মির্জা ইউসুফের দারোয়ান তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুর খবর নিয়ে এলো। তাঁর ঘরের মেঝেতে বসে লোকটি কিছুক্ষণ কাঁদলো। তাঁর বয়সী শরীর অনেকক্ষণ ধরে আন্দোলিত হলো। তিনি ওকে দেখে নিজেকে সামলাচ্ছিলেন। তাঁর চেয়ে মাত্র দু’বছরের ছোট ইউসুফ। কত স্মৃতি আছে ওকে নিয়ে। তাঁর বুক ভেঙে যাচ্ছে। কেঁদেকেটে স্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছিল ইউসুফের? 

পাঁচ দিন ধরে জ্বরে বেঁহুশ ছিল। তারপর মাঝরাতে শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন। এই পাঁচ দিনে আমি আপনাকে খবর দিতে আসতে পারিনি। কেমন করে আসবো? তাঁকে ছেড়েতো কোথাও যাইনি। পানি আনতেও না। একফোঁটা ওষুধও দিতে পারিনি। 

বুড়ো দারোয়ান আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। তিনি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, এখন আমরা কি করবো? পানি, রুমাল, মুর্দা ফরাস, কবর খোঁড়ার লোক, ইট, চুন কোথা থেকে পাবো কে জানে। পালকির ব্যবস্থা নেই। আমিই বা তার বাড়িতে কি করে যাবো? কোন কবরস্থানে নিয়ে যাবো যেখানে লোক পাওয়া যাবে? বাজার বন্ধ। ভালো বা খারাপ যাই হোক না কেন কাফনের কাপড়ইতো পাওয়া যাবে না। কবর খোঁড়ার জন্য লোকই বা কোথায়? হিন্দু হলে নদীর ধারে নিয়ে দাহ করা যেতো। তাছাড়া শহরের যা অবস্থা, দু-তিনজন মুসলমানকে এক সঙ্গে হাঁটতে দেয়া হয় না। মুর্দার কফিন নিয়েই কি যেতে দেয়া হবে? একমাত্র উপায় শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া। 

আজাদ এসে বুড়োকে নাস্তা খাওয়াতে ডেকে নিয়ে যায়। মির্জার ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে শুনে একে দুয়ে প্রতিবেশীরা আসতে থাকে। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন গালিব। চোখের পানিতে ভেসে যায় গাল, দাড়ি। একজন বলে, আপনার দুঃখে আমরাও কাতর। এখনতো একটা কিছু আপনাকেই করতে হবে। আর তো কেউ নেই। আমরা ঠিক করেছি আপনার সাহায্যে কিছু করবো। 

গালিব গলা পরিষ্কার করে বলেন, কি করা যায়? 

পাতিয়ালার সেপাইরা তো গলিতে রয়েছে। মহারাজাকে বলে ওদের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। 

হ্যাঁ, সেটা হতে পারে। 

গালিব মাথা নাড়েন। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। 

তাহলে আমরা কথা বলার জন্য তার কাছে যাই? 

যান। অপেক্ষা করা চলবে না। যা কিছু করার তাড়াতাড়ি করতে হবে।

প্রতিবেশীরা চলে গেলে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে আসেন উমরাও বেগম। বলেন, ইউসুফ ভাইয়ের বিবি-বাচ্চাদেরকে কি খবর দেয়া হবে? 

ওরা কোথায় আছে আমি তো জানি না। 

দারোয়ান জানতে পারে। উমরাও বেগম দ্বিধার সঙ্গে বলেন। 

গালিব চুপ করে থেকে বলেন, দারোয়ানকে এখন পাঠানো ঠিক হবে না। আগে দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। 

কাফনের কাপড়—উমরাও বেগম কথা শেষ করেন না। 

কাফনের কাপড় কেনার জন্য দোকান খোলা নাই। তোমার ঘরের পরিষ্কার দু’তিনটি বিছানার চাদর বের করো। 

বিছানার চাদর দিয়ে- 

উমরাও বেগম ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। 

গালিব মাথা নিচু করে চোখের পানি মোছেন। উমরাও বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে যান। নিজের ঘরের সিন্দুক থেকে দুই তিনটি চাদর বের করেন। 

প্রতিবেশীরা সিপাহীদের নিয়ে ফিরে আসে। গালিব তৈরি হয়ে নেন। বাড়ির কাজের লোকেরাও সঙ্গে যায়। ওদের হাতে দাফনের কাপড় বিছানার চাদর। কোথাও আতর-লোবান নাই। সিপাহীদের সামনে রেখে তারা কয়েকজন মানুষ হেঁটে ইউসুফ মির্জার বাড়িতে আসেন। মুর্দাকে গোসল করানো হয়। চাদর জড়িয়ে বাড়ির কাছের মসজিদে নিয়ে এসে সেখানে কবর দেয়া হয়। অবসন্ন গালিব ফিরে আসেন বাড়িতে। মনে হয় কান্নার শক্তিও ফুরিয়ে গেছে। 

উমরাও বেগম এক গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে আসেন। তিনি শূন্য দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকান। গ্লাস হাতে নেন না। 

খান। শরবত খেলে শরীর ঠাণ্ডা লাগবে। 

তিনি মাথা নেড়ে বলেন, শরবত খাবো না। গোসল করবো। 

গোসল! উমরাও বেগম বিব্রত বোধ করেন। গালিব বুঝতে পারেন যে বোধহয় পানি নেই। 

গোসল করব শুনে অবাক হয়েছো বিবি। বুঝতে পারছি যে বোধহয় পানি নেই। আমার সৌভাগ্য যে আমি আমার ভাইকে শেষ গোসল দিতে পেরেছি। ওই বাড়িতে একজন মুর্দার গোসলের পানি ছিল। 

চোখের জল মুছে গালিব নিজের শের বলতে থাকেন জোরে জোরে :

‘তুম কৌনসে যে অ্যায়সে খরে দাদ ব সিতদ কে 
করতা মূলক অলমওত তকাজা কোঈ দিন অওর। 
এত তাড়া ছিল মৃত্যুর? 
না হয় যেতে কিছুদিন পরে আরও।’ 

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বিছানায় শুয়ে পড়েন। উমরাও বেগমকে বলেন, বিবি আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে দাও। কেউ যেন না আসে। 

উমরাও বেগম টেবিলের ওপর শরবতের গ্লাস রেখে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে যান। শুনতে পান খাঁচায় আটকে রাখা তোতা পাখিটা ঠোঁট দিয়ে টুক টুক শব্দ করছে। ওটার জন্যও দানাপানি ঠিকমতো জোটে না। তিনি খাঁচাটার সামনে এসে দাঁড়ান। আঙুল ঢুকিয়ে ডানার পালকে মৃদু পরশ দেন। তোতা বিরক্ত হয়। আঙুলে ঠোকর দেয়ার চেষ্টা করে। তিনি আঙুল বের করে নেন। আবার ঢোকান। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে খেলা করতে করতে তাঁর মনে পড়ে তাঁর স্বামীর একটি কৌতুকের কথা। তখন তাঁরা বল্লিমারোতে আসেননি। লালকুয়ায় কালে সাহেবের বাড়িতে থাকতেন। সেবার খুব শীত পড়েছিল। তোতা পাখিটি ঠাণ্ডা সইতে পারতো না। বেশিরভাগ সময় ঘাড় কাত করে নিজের পালকে ঠোঁট গুঁজে রাখতো। যেন নিজের পালক থেকে ঠোঁটে গরম ছড়িয়ে দিতে চাইতো। উমরাও বেগমের মনে হতো পাখিও নিজের শরীরকে উষ্ণ রাখার কৌশল বের করে। সব প্রাণীরই নিজস্ব কৌশল আছে। তিনি একদিন স্বামীকে বলেছিলেন, দেখেন আমাদের তোতা পাখির কাণ্ড। শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কেমন ঠোঁট গুঁজে বসে আছে। 

গালিব হাসতে হাসতে পাখির খাঁচা নাড়া দিয়ে বলেন, ওহ মিয়া তোমারতো বউ-বাচ্চা নাই। তাহলে এমন ঘাড় গুঁজে বসে আছ কেন? তোমার কিসের এত চিন্তা? 

উমরাও বেগম হাঁ করে তাঁর দিকে তাকিয়েছিলেন। তিনি মুখ ফিরিয়ে বলেছিলেন, হাঁ করে দেখছো কি বিবি? 

আপনিতো তোতাকে নিয়ে নয়, আমাকে নিয়ে কৌতুক করলেন। আপনি আমাকে নিয়ে এমন শক্ত কৌতুক করতে পছন্দ করেন। 

আমিতো এমনই। তুমিতো আমাকে অনেককাল ধরে চেনো বিবি।

উমরাও বেগম গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, হ্যাঁ চিনি। মনে আছে একবার আপনি আমাকে ভূত বলেছিলেন। 

গালিব চোখ কপালে তুলে বলেন, বলেছিলাম নাকি? মনে করতে পারছি না তো। 

মনে করিয়ে দেবো? 

দাও। গালিব ঘাড় নেড়ে বলেন। 

মনে আছে একবার আপনি বাড়ি বদল করার জন্য বাড়ি দেখছিলেন।

গালিব কথা না বলে মাথা ঝাঁকান। 

উমরাও বেগম বলতে থাকেন, আপনি আগে নিজে একটি বাড়ি দেখে আসেন। বৈঠকখানাটি আপনার পছন্দ হয়নি। কিন্তু বাড়ির ভেতরের ঘর আপনাকে দেখতে দেওয়া হয়নি। তাই আপনি আমাকে পাঠিয়েছিলেন। মনে আছে? 

গালিব মুখ বুজে ঘাড় নাড়েন। 

আমি বাড়ি দেখতে গেলাম। লোকে আমাকে নানা কথা বললো। আমি পছন্দ-অপছন্দ কোনোটাই করতে পারলাম না। আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার পছন্দ হয়েছে বিবি? আমি বলেছিলাম, লোকে বলছে ওই বাড়িতে নাকি ভূত থাকে। আপনি কি বলেছিলেন মনে আছে? 

গালিব চুপ করে থাকেন। হাঁ বা না সূচক ঘাড়ও নাড়ান না। 

উমরাও বেগম গম্ভীর হয়ে বলেন, আপনি বলেছিলেন দুনিয়াতে তোমার চেয়েও বড় ভূত আছে নাকি? মনে আছে? 

গালিব এবারও চুপ করে থাকেন। 

উমরাও বেগম ঝাঁঝালো গলায় বলেন, আমার কথা শেষ হয়েছে। আপনি এবার আপনার কথা বলতে পারেন। 

এতক্ষণ জোর করে নিজের দম আটকে রাখা গালিব আচমকা হাসিতে ভেঙে পড়েন। নিজের লেখা কতআ আউড়ে বলেন, লোকে প্রেমের ব্যাপারে ভয় পায়। কিন্তু আমি তো জানি খাওয়া-পরার খোঁজ করার চেয়ে বড় বিপদ আর কিছু নাই। একইভাবে বলতে হয় যে মহাজনের তাগাদার চেয়েও বড় চিন্তা আর কিছু নাই। 

উমরাও বেগমের চোখে পানি আসে। মানুষটা পেনসন উড়িয়ে দিয়ে দিন চালালো। মনের সুখে মদ খেলো। আর দেনা করে মদ খেয়ে কতআ লিখলো হায় কবি, মহাজনের চিন্তায় অস্থির। 

এখন এই দুর্যোগের সময় একমাত্র ভাইটি মরে গেলো। কে থাকলো আর। নিজের সাতটি সন্তানের জন্ম হলো। একটিও বাঁচলো না। উমরাও বেগমের চোখ দিয়ে পানি গড়ালো। দোপাট্টা দিয়ে পানি মুছে গালিবের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। সামান্য ফাঁক করে তাকিয়ে দেখলেন মানুষটি নিঃসাড় ঘুমাচ্ছে। 

দিন গেলো, রাত গেলো। 

গালিবের ঘুম ভাঙলো পরদিন সকালে। 

মনে হলো চারদিকে নতুন দিন। নতুন সূর্য। 

দুপুরের খাবার খেয়ে লিখতে বসলেন। ইউসুফ ছাড়া কার কথাই বা এখন তাঁর মনে আছে। লিখেন- খুবই আপসোসের কথা যে ষাট বছরের মধ্যে মাত্র ত্রিশ বছর ও মানসিকভাবে সুস্থ ছিল। শৈশব থেকে ত্রিশ বছর। দুনিয়াটা চিনে বড় হতে হতেই ও আবার চেনা দুনিয়াটাকে ভুলে গেলো। কবরে ওর জন্য কোনো বালিশ নাই। ওখানে ও মাটি ছাড়া আর কিছুই পায়নি। মাটিইতো সবার জন্য শেষ বিছানা। খোদাতালা ওকে যেন দয়া করেন। জীবিত অবস্থায় ওর অনেক কষ্ট ছিল। আরাম কি তা জানতো না। আজ, এখন যেন কোনো ফেরেশতা ওকে বেহেশতে নিয়ে যায়। ওর জন্য আর কোনো প্রার্থনার ভাষা আমি জানি না। 

এটুকু লিখে কলমটা দোয়াতে চুবিয়ে রাখলেন। ভাবলেন, আর কি লিখবেন? মাথায় তো কিছু আসছে না? তারপর কলমটা নিয়ে আবার কাগজের টুকরোয় লিখলেন, ১৯ অক্টোবর। অনেকক্ষণ ধরে তারিখটা লিখলেন আর কাটলেন। কালো কালিতে কাগজের পৃষ্ঠা ভরে গেলো। বড় বড় করে লিখলেন এই দিনটিকে সপ্তাহের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেয়া উচিত। ওহ, এই সপ্তাহে একটি দিন না থাকলে কি এসে যায়। কার কি ক্ষতি হয়। পুরো মাস থেকে একটি দিন বাদ গেলে কি খুব গরমিল হয়ে যাবে? তিনি কলমটা রেখে দিয়ে দোয়াতের মুখ বন্ধ করলেন। তারপর মৃদু হেসে নিজেকে বললেন, এত কাটাকুটির পরেও ওই তারিখটি কালো কালিতে তাঁর স্মৃতির খাতায় লেখা থাকবে। তার আগে তার ছোট ভাইটির চলে যাওয়া তো নিষ্ঠুর সত্য। তিনি চেয়ারের উপর পা উঠিয়ে মাথা হেলিয়ে দিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকেন। বুকের ভেতর কেমন একটা ধুকপুক ধ্বনি হচ্ছে। বেশ লাগছে সেই শব্দ উপভোগ করতে। কতক্ষণ যে একইভাবে বসে থাকেন নিজেও জানেন না। নিজেই বলেন, তোমার হৃদয়কে যদি দূরে রাখো তাহলে শোক করো কেন? তোমার হৃদয়কে যদি হারিয়ে ফেলো তাহলে বেদনার অনুভব থাকবে কেন? তোমার হৃদয় যদি তোমার সঙ্গে না থাকে তাহলে শুধু জিহ্বা দিয়ে বিলাপ করার দরকার কি? গালিব তুমি তোমার শরীরের সবটুকু সন্ধান করো। দেখো সব জায়গা ঠিক আছে কিনা। গালিব হৃদয়কে কঠিন করতে নেই। কঠিন হৃদয় মানুষকে দেয়। যে বুকভরে কাঁদতে পারে সে হৃদয়ই প্রকৃত হৃদয়। তার অনুভবে প্রেম থাকে, দরদ থাকে। তাঁর চোখ দিয়ে পানি গড়ায়। তিনি সে পানি মুছতে চান না। ভিজে থাকে মুখের সবটুকু। তাহলে যমুনা নদীর অনুভব তাঁর শরীরে কম্পন তুলবে। তিনি নিজের লেখা শের নিজেকেই শোনান : 

‘নেশা করে সুখ পেতে চায় কোন মুখপোড়া, 
আমি চাই কেবল রাতদিন নিজেকে একটুখানি ভুলে থাকতে।’ 

পিপাসা, বুকের ভেতর সহস্র ধারার পিপাসা। কতদিন তিনি সুরা পান করেননি। আহ্, বুকের চৌচির প্রান্তর সুরার বৃষ্টি চায়। সুরা, সুরা। কতবারতো প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে দেনা করে মদ পান করবেন না। কিন্তু প্রতিজ্ঞা রাখতে পারলেন কৈ? প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা খুবই কঠিন। আবারও নিজেকে শোনালেন নিজের শের : 

‘মদ স্পর্শ করবে না বলে শপথ করেছো, গালিব; 
তোমার শপথের উপর কিন্তু একটুও ভরসা করা যায় না।’ 

সোজা হয়ে বসে দুহাতে চোখের পানি মোছেন। ভিজে যাওয়া দাড়িতে হাত বোলান। তারপরে উঠে পায়চারি করেন। ফিরে এসে আবার টেবিলে বসেন। তুতার কথা মনে হয়। গদরের পরে তুফতার সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। ওকে একটি চিঠি লেখা দরকার। গদরের পরে তুফতা শহর ছেড়ে চলে গেছে। তিনি কাগজ টেনে নিলেন। দোয়াতের ছিপি খুলে কলমটা ডোবালেন কালো কালিতে। ভাবলেন চিঠির সম্বোধন, ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসা পরে করবেন, আগে শহরের অবস্থাটা লিখে ফেলা দরকার। শুরু করলেন এভাবে, আমি তোমাকে একটি শব্দও বাড়িয়ে লিখছি না– জেনে রাখো যে শহরের ধনী-গরিব নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ শহর ছেড়ে চলে গেছে। অভিজাত পরিবারের সঙ্গে তাদের অনুগ্রহে বেঁচে থাকা মানুষেরাসহ দোকানি-কারিগর এমন কেউই বাদ নেই। তোমাকে কতটা লিখব বুঝতে পারছি না। কারণ খুঁটিনাটি সব লিখতে ভয় পাচ্ছি। লালকেল্লার কর্মচারীদের অবস্থা খুব খারাপ। তাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করা হচ্ছে। ওরা সারাক্ষণ কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে আছে। অনেককে কারাবাসে পাঠানো হয়েছে। তুফতা, তুমিতো জানো আমি এক গরিব কবি। গত দশ-বারো বছর ধরে দরবারে ‘তারিখি’ লেখা ও বাদশাহর কবিতার পরিমার্জনা করা ছিল আমার কাজ। তুমি এ কাজকে দু’ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারো। বলা যায় এটা দরবারি কাজ, আর নয়তো বলা যায় এটা দিনমজুরের পেনশন। তুমি যেভাবে বুঝতে চাও বুঝে নিতে পারো। তুমি ভালো করেই জানো যে সিপাহীদের বিদ্রোহে আমার কোনো ভূমিকা ছিল না। আমি আমার কাজকে কবিতার মধ্যেই আটকে রেখেছিলাম। অন্য কোনো কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করিনি। আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে আমি নির্দোষ। তাই আমি শহর ছেড়ে পালাইনি। বলো, আমার শহর থেকে বিনাদোষে আমি পালাবো কেন? ব্রিটিশ শাসকরা দরবারের কাগজে কিংবা নিজেদের গুপ্তচরদের কাছে আমার বিরুদ্ধে কিছুই পায়নি। পেলে আমাকে হেস্তনেস্ত করে ছাড়তো। জিজ্ঞাসাবাদ করে নাজেহাল করতো। আমি তো জানি ওরা শহরের অনেক সম্মানিত ব্যক্তিদের ছাড়ে নি। আমিতো ওদের কাছে কেউকেটা কেউ না। বেশির ভাগ সময় আমি বাড়িতেই থাকি। বাইরে কমই বের হই। তাছাড়া আমার কাছে দেখা করতে কে আসবে? শহরে আছেই বা কে? কতদিন তোমাদের মতো বন্ধুদের মুখ দেখি না। যারা লুকিয়ে ছাপিয়ে আছে তারা রাস্তায় বের হতে ভয় পায়। ঘরের পরে ঘর মানুষহীন। একটুও বিস্মিত হবে না একথা জেনে যে প্রতিদিন অপরাধীদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে। প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে মৃত্যু ঘটছে। এই শহরে মৃত্যু এখন রুটি আর আচার খাওয়ার মতো সাধারণ ঘটনা। ১১ মে সামরিক শাসন চালু হয়েছিল। এখন পর্যন্ত তা বহাল আছে। কতদিন এই অবস্থা চলবে কেউ জানে না। কি হয় তা দেখার জন্য আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে। ব্যবস্থাটা এমন যে পারমিট ছাড়া কেউ শহরে আসতে বা বের হতে পারছে না। তুমি শহর ছেড়ে বাইরে চলে গেছো, ভালোই করেছো। কোনো অবস্থাতেই ফিরে আসার কথা ভেবো না। মুসলমানদের শহরে ফিরে আসার অনুমতি দেয়া হয় কিনা তা দেখার জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। 

এটুকু লিখে তাঁর আর লিখতে ইচ্ছে হলো না। কাগজটা একটা ছোট পাথরের টুকরো দিয়ে চাপা দিয়ে রাখলেন। উঠে পায়চারি করলেন। কাল্লু মিয়া কয়েকটা আখরোট নিয়ে এলো। তিনি খুশি হয়ে রেকাবিটা হাতে নিয়ে শতরঞ্জির ওপর বসলেন। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পা ছড়িয়ে দিলেন। 

হুজুর! কাল্লু মিয়ার বিনীত কণ্ঠ 

কি বলবে, বলো। 

তিনি মনোযোগ দিয়ে আখরোট খাচ্ছেন। বেশ লাগছে ফলটা চিবুতে। বেশ অনেকদিন পরে বাড়িতে আখরোট এসেছে। কোথা থেকে জোগাড় হয়েছে তিনি তা জানতে চাইলেন না। ভাবলেন, জিজ্ঞেস করে লাভ কি, ফল জুটেছে এটাই বড় কথা। বেশি কিছু জানার দরকার নেই। 

হুজুর। কাল্লু মিয়ার অনুচ্চ কণ্ঠ। 

তুমি আমাকে কিছু বলছো না কেন কাল্লু মিয়া? 

সাহেবের অফিসে আপনাকে তলব করতে পারে? 

তলব করবে? কে বলেছে? 

মহারাজার রক্ষীরা। গোরা সেপাইরা ওদের কাছে জেনে গেছে যে আপনি বাড়িতে আছেন কিনা। 

কেন তলব করবে বলেছে কিছু? 

না, সেসব কিছু বলেনি। না, মানে আমি ঠিক জানি না। রক্ষীদের কাছে বললে বলতেও পারে। 

যাও, ওদের কাছ থেকে জেনে আসো। 

কাল্লু মিয়া চলে গেলে তিনি চোখ বুজে ভাবেন, কি হতে পারে? নতুন ফন্দি কি আঁটা হচ্ছে তাঁর বিরুদ্ধে? তবে এটাও ঠিক যে এখন পর্যন্ত ব্রিটিশরা তাঁর গায়ে হাত দেয়নি। নানা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা কোনো খারাপ দিকে মোড় নেয়নি। তাঁকে শহর ছাড়তে হয়নি, নির্বাসন দণ্ড পেতে হয়নি, তাঁকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয়নি। খোদাতালার অশেষ মেহেরবানী। গালিব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভাবেন যে, ওদের মৃত্যুর মুশায়রাতো এখনো চলছে। কবে এই আসর ভাঙবে কে জানে। তাঁর আখরোট খাওয়া শেষ হয়েছে। এক গ্লাস পানি পেলে ভালো লাগতো। কাউকে ডাকাডাকি না করে তিনি কাল্লুর ফেরার অপেক্ষা করেন। 

অল্পক্ষণে কাল্লু ফিরে আসে। চোখমুখ শুকনো। গালিব ওর চেহারা দেখে বুঝলেন যে কোনো ভালো খবর নেই। বরং খবর শুনে ও ভয় পেয়ে গেছে। 

হুজুর। কাল্লুর ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর। 

গালিব পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলেন, খবরটা কতটা খারাপ তা আমাকে বুঝতে দাও কাল্লু মিয়া। 

ওরা একটু পরেই আসবে। 

কেন জানতে পেরেছ? 

বাদশাহর সিক্কায় আপনার কবিতা— 

বুঝেছি আর বলতে হবে না। তুমি আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো। 

কাল্লু মিয়া পানি আনলে তিনি খেয়ে শেষ করতে পারেননি, তখন দু’জন গোরা সৈন্য এসে বাড়ির উঠোনে ঢোকে। তিনি কাপড় বদলে বের হয়ে যান। উমরাও বেগম নিজের ঘরে ছিলেন। তিনি কিছুই জানতে পারেন না। কাল্লু মিয়া সঙ্গে যায়। 

সাহেব তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, বিদ্রোহের সময় বাদশাহর নামে যে শীলমোহর খোদাই করা হয়েছিল সে কথাগুলো কি আপনি লিখেছিলেন? 

তিনি এক মুহূর্ত ভাবেন, চিন্তার ভান করেন। তারপর বলেন, বাদশাহ নিজে কবি। দরবারে অনেক কবি আসতেন। শাহজাদাদের কয়েকজন কবি। এতজনের মধ্যে একজন কবিকে সন্দেহ করা কি যুক্তিযুক্ত? 

আপনি কি বলতে চাইছেন? 

এই অর্থে আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। 

সাহেব তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। তিনি নির্ভয়ে বলেন, আহসানউল্লাহ খানের মতো দরবারের কর্মকর্তাও এই কথাই বলবেন। কারণ এত কবির মধ্যে একজনের কবিতা বোঝা কঠিন।

সাহেব বুঝতে পারেন যে চট করে এই কবির যুক্তি খণ্ডন করা যাবে না। কারণ তার কাছে তেমন কোনো প্রমাণও নেই। এটি প্রমাণ করার জন্য দরবারে তেমন কোনো নথি খুঁজেও পাওয়া যায়নি। 

গালিব তখন বিগলিত হেসে বলেন, আমি যদি ওই কথাগুলো লিখেই থাকি তবে নিরূপায় হয়ে লিখেছি। এই বিচারে আমি নির্দোষ। 

সাহেব মাথা ঝাঁকালেন। কি কারণে ঝাঁকালেন তা বোঝা গেলো না। তিনি আরও গদগদ কণ্ঠে বললেন, বিদ্রোহের পরে ব্রিটিশরা তো অনেক সিপাহীকে ক্ষমা করেছে। এটি যদি তারা করতে পারে তবে দুটো লাইন লেখার জন্য একজন কবিকে কি ক্ষমা করা যায় না? 

সাহেব একটুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নেড়ে বললেন, আচ্ছা আপনি আসুন।

ফেরার পথে তাঁর বারবারই মনে হলো কাগজে-পত্রে কোনো প্রমাণ না থাকলেও বিষয়টিতো সত্য। বিদ্রোহের পরে বাদশাহ আবার পূর্ণ ক্ষমতায় ফিরে এসেছিলেন। উৎসব পালন করা হয়েছিল। উৎসব উপলক্ষে সিক্কাটি চালু করা হয়েছিল। সিক্কার ওপর খোদিত লেখাগুলো তাঁরই রচনা। তিনি সাহেবের সামনে নানা কিছু বলে পার হয়ে এলেন। এই কৌশল গ্রহণ করার দরকার ছিল। কিন্তু বিষয়টি জানে অনেকে। মুন্সি জীবনলাল তাঁকে বলেছিলেন যে তিনি যে রোজনামচা লিখছেন সেখানে এই ঘটনাটির উল্লেখ করবেন। যদিও বিষয়টি এখনো ব্রিটিশরা জানে না। এটাতো মিথ্যে নয় যে রাজদরবারের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তিনি আরও ভাবলেন, নথিপত্রে এর প্রমাণ না থাকার কথা নয়। তবে এমন হতে পারে ব্রিটিশরা শহরের পুরো দখল নেয়ার আগে দরবারের নথিপত্র নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। সবই খোদাতালার মেহেরবানী, কাল্লু মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ফেরার সময় তিনি এভাবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ইংরেজদের পরাজিত করায় তিনি বাদশাহর স্তুতি করে কাসিদা পাঠ করেছিলেন। বাদশাহ তাঁকে ‘খিল্লাত’ দিয়েছিলেন, সম্মানিত করেছিলেন। মাত্র মাস দুই আগের কথা, তখনো তিনি একটি কাসিদা লিখে বাদশাহকে সম্মান জানিয়েছিলেন। যাহোক, যা করেছেন তা তিনি ঠিকই করেছেন, একথা ভেবেই তিনি নিজের ভেতরে শক্তি অনুভব করলেন। তাঁর হাঁটার গতি বেড়ে গেলো। তিনি জোরে জোরেই বললেন, 

‘বার্জারি আফতাব ও নুকরা-ই-মাহ 
সিক্কা জড়দার-জাঁহা-বাহাদুর-শাহ
সূর্যের সোনা ও চন্দ্রের রূপোর মতোই 
বাহাদুর শাহ ও এই মুদ্রায় তাঁর চিহ্নটি রেখেছেন।’

কাল্লু মিয়া তাঁর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে, হুজুর! 

কাল্লু মিয়া দু’হাজার ইংরেজ সৈন্যের বিশাল বাহিনী একদিন দিল্লি শহরে ঢুকে পড়লো। কেঁপে উঠলো শহরটা। তুমি আমার কাছে আসো কাল্লু মিয়া আমি তোমার ঘাড়ে হাত রাখি। 

হুজুর।

কাল্লু মিয়া। 

হুজুর। 

বাদশাহর এখন বিচার চলছে। 

ওরা কি বাদশাকে মেরে ফেলবে হুজুর? 

আমাকে হাঁটতে দাও। আমি এই পথে বসে পড়তে চাই না। 

হুজুর। 

কাল্লু মিয়া বাদশাহর নামে প্রচলিত মুদ্রায় আমিতো লিখেছিলাম যে সূর্যের সোনা এবং চাঁদের রূপোর মতো বাদশাহ 

হুজুর আপনিতো ঠিকই লিখেছিলেন। 

গালিব আর কথা বাড়ান না। তিনি খানিকটা জোরে হাঁটার চেষ্টা করেন। কাল্লু মিয়ার ঘাড়ে হাত রেখেই হাঁটেন। 

হুজুর। 

বলো কি বলবে? 

বিচারে কি বাদশাহর ফাঁসি হবে? 

খামোশ! চুপ করে থাকো। 

গালিব চিৎকার করে কথা বললে তাঁর শরীর কেঁপে ওঠে। 

কাল্লু মিয়া দ্রুতকণ্ঠে বলেন, আমাকে মাফ করবেন হুজুর।

তিনি পরিশ্রান্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন। 

দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন উমরাও বেগম। 

কোথায় গিয়েছিলেন? 

গালিব পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢোকেন। অবসন্ন কণ্ঠে বলেন, পানি। 

কাল্লু মিয়া ছুটে যায় পানি আনার জন্য। তিনি চেয়ারে বসে পড়েন।

উমরাও বেগম আবারো জিজ্ঞেস করেন, নতুন কোনো বিপদ হয়েছে কি?

না, বিপদ হয়নি। কৌশলে বিপদ কাটাতে পেরেছি। খোদা মেহেরবান।

কাল্লু মিয়া পানি নিয়ে এলে তিনি ঢকঢক করে পানি খান। তারপর দম নিয়ে উমরাও বেগমকে ঘটনাটি খুলে বলেন। উমরাও বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজের কাজে চলে যান। গালিব ভাবলেন একটু বিশ্রাম নিয়ে তুফতাকে চিঠি লিখবেন। লিখবেন কি, তুমি কি আঁচ করতে পারো বন্ধু যে এখানে কি ঘটছে? এখনকার সঙ্গে তুলনা করলে আমার মনে হয় আমাদের একটি আগের জন্ম ছিল। বন্ধুদের সঙ্গে যে ধরনের ঘটনা ঘটে আমরাও সেভাবে দিন কাটিয়েছিলাম। আমরা কবিতা লিখতাম, দীওয়ান সম্পাদনা করতাম। আমাদের বন্ধু ছিলেন মুনশী নবী বখশ। একদিন দেখলাম ও আমাদের পাশে নেই। কোথায় যেন চলে গেছে। বন্ধুত্বের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলে খুব কষ্ট লাগে বন্ধু। কিন্তু কিছুকাল পরে আমাদের আবার যোগাযোগ হলো। আমি কয়দিন আগে মুনশী নবী বখশকে চিঠি লিখেছি। ওর উত্তর পেয়েছি। তোমার চিঠিও পেয়েছি তুফতা। তবে দেখো অবস্থাটা কি তোমার নাম এখনও মুনসী হরগোপাল, তোমার তখলুস তুফতা, যে শহরে আমি এখনও বাস করছি তার নাম দিল্লি, মহল্লার নাম বল্লিমারো, কিন্তু কষ্টের কথা এই যে পুরনো বন্ধুদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কতদিন যে কারো সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। এমন কথা বলতেই হয় যে এই শহরে মুসলমানদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। শহর এখন এমনই পরিত্যক্ত। তুমিতো জানো আমার বন্ধুর সংখ্যা কত বেশি ছিল। বন্ধুদের মৃত্যুকে আমি কেমন করে সহ্য করি। আমার বন্ধুদের মধ্যে ছিল ব্রিটিশ, হিন্দু, ব্রিটিশদের যেসব মুসলমান সমর্থন দিতো তারা, যারা বিদ্রোহীদের দলে যোগ দিয়েছিল সেই মুসলমানরাও। সব ধরনের মানুষের বন্ধুত্ব পেয়ে আমি আনন্দে ছিলাম। আমার কবিতাই ছিল তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের যোগসূত্র। আমার বন্ধুরা অনেকে প্রাণ হারিয়েছে, তারচেয়েও বেশি জনেরা ফতুর হয়ে গেছে। হায় আল্লাহ, এসব মেনে নেওয়াও কঠিন।

তাঁর চোখ দিয়ে পানি গড়াতে থাকে। তিনি চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিলে মনে করেন তাঁর ঘুম পাচ্ছে। পরক্ষণে মনে হয় ঘুম নয়, তিনি একটি দৃশ্যের মধ্যে ঢুকে গেছেন। বন্ধুদের মুখগুলো দিল্লির গাছ-পাখি-নদী-আকাশ-ঘরবাড়ির মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। তিনি কারো সঙ্গে কথা বলতে পারছেন না। তাঁর মাথা কেমন করে। তিনি শুয়ে পড়েন এবং তাঁর ঘুম পায়। 

পরদিন ঘুম ভাঙলে শুনতে পান প্রতিবেশীর কারো বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। তিনি বিছানা ছাড়তে পারেন না। বুঝতে পারেন কোথাও কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তিনি বালিশে মাথা গুঁজে রাখেন। একবার ভাবেন কাউকে ডেকে খবর নেবেন, আবার ভাবেন থাক। কি হবে কষ্টের মধ্যে ঢুকে। সকালটা অন্য রকম হবে, শান্তিতে থাকতে পারবেন, সে শহরতো এখন দিল্লি নয়। 

ছুটতে ছুটতে আসে কাল্লু মিয়া। হুজুর, হুজুর। 

তিনি মাথা তুলে সোজা হয়ে বসেন। তিনি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই কাল্লু মিয়া জোরে জোরে বলে, হুজুর ফাঁসি, ফাঁসি। 

ফাঁসি? 

একসঙ্গে পাঁচজনের হুজুর। 

কাঁদছে কে? 

মোহাম্মদ আলির পরিবার। ওই পরিবারের পাঁচজনকে একসঙ্গে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। জীবন্ত ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে গাছে। 

আহ্, চুপ করো কাল্লু মিয়া। 

কাল্লু মিয়া মেঝেতে বসে পড়ে। হাঁটুতে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। গালিব ওকে কাঁদতে দেন। নিজে বিছানা ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ান। ভাবেন খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নিলে তাঁর দম আটকে যাবে না। কিন্তু টের পেলেন যে দম আটকে আছে, ওখানে নিঃশ্বাসের প্রবাহ আছে কি নেই, তা বুঝতে পারছেন না। তিনি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে শোকার্ত পরিবারের কান্নার শব্দ শোনেন। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি নিজেও মনে রাখতে পারেন না। বাড়ির বাচ্চা দুটো এসে তাঁর হাত ধরে। 

নানা, ঘরে চলেন। 

নানা আজকে আমরা আপনার সঙ্গে নাস্তা খাবো। 

শিশুদের হাত ধরে তিনি ঘরে ঢোকেন। ঘরে ঢুকে শিশুদের মাথায় হাত রাখেন। নিজেকেই বলেন, একদিন ওদেরকে আগ্রায় নিয়ে যাবো। যমুনা নদী দেখাবো। এই বয়সে আমি যমুনা নদীর পাড়ে বড় হয়েছি। আমি এই বুড়ো বয়স পর্যন্ত যমুনা নদীর পাড়েইতো আছি। আগ্রা থেকে দিল্লি। আমার বন্ধু ছিল বংশীধর। আহা, এই শিশুদের তেমন কোনো বন্ধুই হলো না, যাকে ওরা জীবনভর মনে রাখবে। 

নানা, নানি আজকে ভালো নাস্তা বানিয়েছেন। নিসতার হালুয়া, তন্দুরি রুটি, কাবাব- 

এত কিছু? 

হ্যাঁ, নানা, কে যেন অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। সে জন্যইতো নানি-

আপনি যে ভালো খাবার খেতে ভালোবাসেন আপনার বন্ধুরা সবাই তা জানে। 

হয়েছে, হয়েছে থামো তোমরা। 

গালিব ওদের থামিয়ে দিয়ে মেঝেতে বিছানো দস্তরখানার কাছে দাঁড়ান। পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে খাবার এবং প্লেট। বেশ সুগন্ধ আসছে। গালিব বারান্দার বালতিতে রাখা পানি দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নেন। ঘরে এসে এক মুহূর্ত ভাবেন, তাঁর ঘুম ছুটেছে ফাঁসির খবর শুনে। একটু আগে কাল্লু মিয়া এখানে বসে কাঁদছিল। একটু আগে তিনি দম ফেলার চেষ্টা করছিলেন। এখন ঘরে পাক খাচ্ছে সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ। জীবনতো এমনই। ততক্ষণে উমরাও বেগম এসে গেছেন। নাতিদের প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন। গালিব জিজ্ঞেস করেন, কে পাঠিয়েছে? 

আমিনউদ্দিন ভাই।

আর কিছু পাঠায়নি? 

সুরার কথা বলছেন? 

হ্যাঁ, তাই। আমার জীবন শুকিয়ে যাচ্ছে। দিনগুলো তো মরুভূমি হয়ে গেছে কবেই। যে এসেছিল সে কিছু বলেনি? 

বলেছে। 

বলেছে? তাহলে এতক্ষণ ধরে তা বলছো না কেন? 

গালিবের কণ্ঠস্বরে অসহিষ্ণুতার আঁচ। চোখও বড় হয়ে গেছে। 

এটা বলার মতো কোনো খবর নয় বলে বলছি না। 

গালিব খাওয়া বন্ধ করে স্ত্রীর দিকে তাকান। চোখে আগুন। উমরাও বেগম অন্যদিকে তাকিয়ে বলেন, বলেছে দু’একদিনের মধ্যে একটি বোতল পাঠাবে। তবে বিদেশি বোতল না, দেশী। 

হোক দেশী, তবুওতো সুরা। 

গালিব উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন। বলেন, শুকরিয়া, শুকরিয়া। প্রকৃত বন্ধুত্বই জীবনের আসল সম্পদ। 

গালিব খেয়াল করেন না যে তার উচ্ছ্বাস উমরাও বেগমকে কতটা বিমর্ষ করে ফেলেছে। যদিও তিনি জানেন তাঁর স্বামীকে, জানেন তিনি কতটা সুরাসক্ত, তারপরও এমন অনেক আনন্দ মেনে নেয়া কঠিন। তাঁর একটাই অভিযোগ যে তিনি মদ খেয়ে জীবনকে উড়িয়ে দিয়েছেন। যেটুকু মুঠিতে আছে তা খুবই সামান্য। উমরাও বেগম উচ্ছ্বাসের আরও কিছু না দেখার জন্য নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যান। বাচ্চারা খাওয়া শেষ করে উঠে পড়েছে। গালিব তখন তন্দুরি আর গোস্তের টুকরো চিবুতে চিবুতে বলছেন : 

‘সুরাপাত্রের গায়ে নানা বর্ণের চিত্র ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাও তুমি; 
বিস্ময়ে উদভ্রান্ত চোখের আয়নায় আমি তা ধরে রাখি।’ 

দস্তরখানা ছেড়ে উঠে পড়েন তিনি। চিলুমচিতে পানি ঢেলে হাত ধুয়েছেন। বুকের ভেতর আনন্দের থইথই। একটি বোতল আসবে আগামী এক দুই দিনে কি? নাকি আরও পরে? বুকের পিপাসায় তিনি ব্যাকুলতা বোধ করেন। নিজেকে আশ্বস্ত করতে নিজেকে বলেন, 

‘গালিব, মদ তো ছেড়েছি, তবু এখনো ক্বচিৎ কখনো, পান করি মেঘলা দিনে আর জ্যোৎস্না রাতে।’ 

তিনি মনের আনন্দ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ‘দস্তাম্বু’ লিখতে বসেন। কিন্তু লেখা হয় না। মনোযোগ দিয়ে সুস্থির হয়ে বসার আগেই রাস্তায় ড্রামের শব্দের সঙ্গে কিছু একটা ঘোষণার কথা শুনতে পান। চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজায় দাঁড়ান। দেখতে পান বাড়ির ছেলেরাসহ প্রতিবেশী বাড়ির ছেলেরা গলির মাথায় যাচ্ছে। তিনিও লাঠিটা টেনে নিয়ে ধীরে সুস্থে এগুতে থাকেন। 

শুনুন শুনুন, আপনারা শুনুন। ঘোষণাকারীর কণ্ঠ এতক্ষণে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর কাছে। তিনি গলির মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে পড়েন। ও কি বলছে তা ঠিকমতো শোনার জন্যই দাঁড়ানো প্রয়োজন। হাঁটলে মনোযোগ হারিয়ে ফেলতে পারেন। শুনতে পান ঘোষণা : আপনারা শুনুন, যে যেখানে আছেন শুনুন, গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং প্রত্যেক নাগরিককে নিজ নিজ বাড়িতে আজ সন্ধ্যা থেকে প্রদীপ জ্বালাতে নির্দেশ দিয়েছেন। সবাইকে বাড়ির বাইরের অংশ, দোকান, বাজারেও আলোকসজ্জা করার নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি কমিশনার বাহাদুরের বাড়িতেও প্রদীপ জ্বালাতে হবে। 

ঘোষণাটি শুনে গালিব গলির মাথায় এসে দেখতে পান টাঙ্গায় বসে থাকা দলটি ড্রাম পেটাতে পেটাতে চলে যাচ্ছে। গলির মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর তিক্ত কণ্ঠ গর্জে ওঠে— 

কোথায় আলো জ্বলবে? 

একজন চিৎকার করে বলে, কবরে। 

ওহ, খোদা। শেষ পর্যন্ত শহরে কি প্রাণ ফিরবে? 

না। ঘরবাড়িতো খালি। মানুষ কোথায়? কে আলো জ্বালাবে? 

আমরা যারা আছি তারা জ্বালাবো। 

যে কয়জন আছি সেই কয়জনকে জ্বালাতে হবে। 

শুনলে না, আলো জ্বালানো হয়েছে কিনা তা দেখার জন্য সৈন্যরা সারা রাত টহল দেবে। 

যে বাড়িতে আলো দেখবে না সে বাড়ির সবাইকে ধরে নিয়ে যাবে। আমি আমার বন্ধুর কবরে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে আসবো। 

আমিও। 

আমিও। 

আমি আমার ভাইয়ের কবরে- 

তোমরা থামো। একজন বয়সী ওদেরকে থামিয়ে দিয়ে বলে, তোমরা কবরে আলো জ্বালাতে যেও না। এই শহরে আমরা আর মৃত্যু দেখতে চাই না। 

গালিব আবার বাড়ি ফিরতে থাকেন। তিনি ঘোষণাটি শুনেছেন মাত্র। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। যেতে যেতে ভাবলেন, শুধু আলো কি পারবে এই মৃতপ্রায় শহরের প্রাণ ফিরিয়ে আনতে? আকাশে হাজার হাজার তারা জ্বলে শহর তো আলোকিত হয় না। মানুষের মুখে হাসি নেই। মৃত্যুভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ। হায় খোদা, আলো জ্বালানোর নির্দেশ দিয়ে গভর্নর জেনারেল একটা কৌশল নিয়েছেন। এই শহরে প্রদীপ জ্বালাবে বাসিন্দারা। কোথাও উজ্জ্বল আলো জ্বলবে। কোথাও ক্ষীণ আলো। এই শহরে মুঘল বাদশাহ বিচারাধীন আছে। তিনি এখন জেলে বাস করছেন। 

গালিব গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বললেন, বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর একজন কবি। কবিকে বিচার করার সাহস হয় ওদের। শুনেছি বাদশাহ এখন কাঠকয়লা দিয়ে দেয়ালের গায়ে কবিতা লিখছেন। আসলে, কবিতা লেখাই তো কবির নিয়তি। 

তিনি হাঁফাতে হাঁফাতে নিজের বাড়ির দরজায় এসে থামেন। দূর থেকেই দেখতে পেয়েছিলেন উমরাও বেগমকে। তখন বিরক্তি নিয়ে বলেছিলেন, আবার বিবি! কতগুলো বছর যে তাঁর সঙ্গে কাটাতে হলো। 

কোথায় গিয়েছিলেন? আমি আপনাকে নিয়ে খুব ভয়ে থাকি। পানি খাবেন? 

গালিব মৃদু কণ্ঠে বলেন, ভয় কেন? 

গোরা সৈন্যরা যদি আপনাকে ধরে নিয়ে যায়। যদি- 

যদি বলে থেমে যান উমরাও বেগম। 

গালিব তাঁর হাত নাড়িয়ে দিয়ে বলেন, থামলে কেন বিবি? বলতে পারলে না, যদি আমাকে মেরে ফেলে? হয় গুলি করে, না হয় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে? হাঃ হাঃ, এটাই এখন এই শহরের নিয়ম। 

উমরাও বেগম শুকনো কণ্ঠে বলেন, ওরা ঘোষণায় কি বললো? 

বাড়িতে দোকানে বাজারে প্রদীপ জ্বালাতে বলেছে। 

প্রদীপ জ্বালাতে হবে? 

হ্যাঁ, ওরা দেখাবে যে শহর সচল হয়ে উঠেছে। বিদ্রোহ দমন হয়েছে। দেশ এখন ইংরেজ শাসনের অধীনে 

ওরা আপনার পেনশন ঠিকমতো দেবে তো? যদি দেয় তাহলে আপনি যে কয়টা প্রদীপ জ্বালাতে বলবেন তারচেয়ে একটি বেশি আমি জ্বালাবো। 

প্রদীপ বেশি না জ্বালালেও আমি পেনশন পাবো বিবি 

রানীর নামে কসীদা লিখেছিলেন? এখন কি গভর্নরের নামে লিখবেন?

হ্যাঁ, লিখতেতো হবেই। তুমিসহ এই সংসারে আশ্রিতের সংখ্যাতো অনেক। সবার জন্য রুটি তো আমাকেই যোগাতে হয়। 

আপনি রুটির খোঁটা দিলেন? আমার দুই নাতিও আপনার আশ্রিত। 

গালিব হেসে বললেন, দরজা ছাড়ো। ঘরে ঢুকতে দাও। 

উমরাও বেগম দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে থাকলেন। বাকি পথে ঘরে ঢুকলেন গালিব। উমরাও বেগম ভাবতে পারলেন না যে কতদিন এই মানুষটির সঙ্গে তিনি সুখের দিন কাটিয়েছেন। হিসেব মেলে না। তিনি আকাশের দিকে তাকান। ঝকঝক করছে আকাশ। নীল আলো প্রদীপের শিখার মতো। তিনি দোপাট্টায় চোখের জল মুছলেন। সে জল দেখলেন না গালিব  

সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বললো শহরে। 

গালিবের বাড়িতেও দুটি মাটির প্রদীপ জ্বালানো হলো। সামান্য তেলে প্ৰায় নিভু নিভু সলতে জ্বললো কতক্ষণ কে জানে! 

গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে শুনতে পেলেন গোরা সেনাদের টহলের শব্দ। ওরা শহরে দাপিয়ে বেড়িয়ে দেখছে প্রত্যেক বাড়িতে আলো জ্বালানো হয়েছে কিনা। কাউকে পেলে সঙ্গে সঙ্গে ধরবে। ওদের শরীরে এখন খুনের নেশা। ওরা কারো কবরে আলো জ্বলতে দেখলেও ধরবে। তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। মাটির প্রদীপ নিভে যায়নিতো? জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন আজাদ শিশি থেকে প্রদীপে তেল ঢালছে। উস্কে দিয়েছে সলতে। 

তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ভাবলেন, এ যাত্রায় রক্ষা পাওয়া তাঁর জন্য খুব দরকার ছিল। অল্পক্ষণে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। জানতেও পারলেন না যে কত লোককে ধরেছে ওরা। কতজনকে গাছে ঝুলিয়ে মেরেছে। 

এরপর তাঁর কাছে খবর আসতে লাগলো একের পরে এক। খবর এলো রাজপরিবারের একুশ যুবরাজকে একদিনের মধ্যে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। তাঁদের লাশ গরুর গাড়িতে করে শহরের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। খবর পেলেন যে বাদশাহর পরিচিত অসংখ্য জনকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। তারপরে তাদেরকে নেংটি পরিয়ে চাঁদনি চকে ফেলে রাখা হয়েছে। সবশেষে খবর পেলেন বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরকে রেঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। 

টেবিলে বসলে নিচু হয়ে যায় মাথা। কলম চুবিয়ে দেন দোয়াতের কালিতে। সাদা পৃষ্ঠায় ফুটে ওঠে কালির আঁচড়। বেদনার তীব্র দহনে রচিত হয় পঙ্ক্তিমালা : 

‘রক্তের এক সমুদ্র চারপাশে উত্তাল হয়ে উঠেছে 
হায়রে! তারা সব কোথায় গেল? 
ভবিষ্যতই বলবে 
আর কী কী আমাকে এরপরও দেখে যেতে হবে?’ 

লেখা শেষ হলে মাথা ঠেকে যায় টেবিলে। তিনি ভাবেন, অনন্ত বিশ্রামের সময় বুঝি এখনই। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *