ঘোড়ার খুরের শব্দ

ঘোড়ার খুরের শব্দ 

গ্রীষ্মের যে কোনো একটি দিনের মতোই দিনটি শুরু হয়। ঝকঝকে আলো চারদিকে ছড়িয়ে আছে। যেন আলোর পানীয় শুষে নিয়ে শান্ত-স্নিগ্ধতায় শুয়ে আছে শহর। বাতাসে গ্রীষ্মের উত্তাপ। সবে দিনের শুরু বলে গ্রীষ্মের আগুনে- পোড়া গরম তখনও সহনীয়। কাকেরা কর্কশ ধ্বনি ছড়িয়ে শব্দের তরঙ্গ তোলেনি। প্রকৃতি জানে মানুষের এখনই ঘুম ভাঙবে। 

তাই আড়িমুড়ি ভেঙে জাগছে শহর। কিন্তু রোদ যত বাড়তে থাকে দিনটি আর প্রতিদিনের গ্রীষ্মের দিন থাকে না। ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই লোকেরা শুনতে পায় শহরজুড়ে প্রবল ঘোড়ার খুরের ধ্বনি। 

গালিব বিছানায় বসেই কান খাড়া করে কেন ঘোড়ার খুরের ধ্বনির এত মাতম তা বুঝতে চেষ্টা করেন। শব্দ চারদিক প্রকম্পিত করছে। তাঁকে দরবারে যেতে হবে। কালেক্টর তো দরবারে বসবে। তাঁর জরুরি কাজ আছে। গালিব বালতিতে রাখা পানি দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নেন। তারপর চিৎকার করে ডাকেন, বিবি, বিবি 

উমরাও বেগম সাড়া দেন না। গালিব রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলেন, তাকে কি মরণ ঘুমে পেয়েছে! নাকি অন্য কোথাও চলে গেছে? এই সংসারের পাট চুকিয়ে দিয়েছে? হায় আল্লাহ, মানুষের দিলে রহম দাও। স্ত্রীকে বুঝতে দাও যে একজন কবিকে যত্ন করা ঈশ্বর সাধনার মতো : কবিই তো মানুষের বুকের ভেতর প্রবেশ করতে পারে। তার উপলব্ধিকে অভিভূত করে। কবিই পারে মানুষকে ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যেতে। 

গালিব দেয়ালে ঝোলানো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের ভেতর হাত ঢুকিয়ে চুল বিন্যস্ত করতে থাকেন। চিরুনির পরিবর্তে নিজের আঙুলগুলোকে তাঁর চুলের জন্য অনেক বেশি উপযোগী মনে করেন, তবে যতক্ষণ ঘরে থাকেন ততক্ষণ। বাইরে গেলে পরিপাটি করে চুল আঁচড়াতে হয়। তিনি দেখতে পান তাঁর মুখমণ্ডলে পানির ফোঁটা এখানে-ওখানে বিন্দুর মতো ফুটে আছে—ভুরুর কাছে, কিংবা চোখের পাতায়, নয়তো গালে, চিবুকে বা নাকের ডগায়। তিনি উৎফুল্ল হয়ে ভাবেন, তাঁকে বেশ সুদর্শন লাগছে। আজকের দিনটি তাঁর জন্য নিশ্চয়ই আনন্দদায়ক হবে। তিনি আবার বিবি, বিবি বলে ডাকেন, বুঝতে পারেন তাঁর ভীষণ খিদে পেয়েছে। কিন্তু এবারও উমরাও বেগমের সাড়াশব্দ নেই। 

শুনতে পান দরজায় করাঘাত। বেশ জোরে। তিনি নিজেই দরজা খোলেন। সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর বন্ধু হাকিম আহসানউল্লা। তিনি গালিবের বন্ধু এবং বাদশাহর চিকিৎসক ও বিশ্বস্ত অনুচর। 

গালিব বিস্ময়ে অস্ফুট ধ্বনি করেন, আপনি? 

আহসানউল্লা আতঙ্কিত। উদ্ভ্রান্তের মতো ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বলেন, বাদশাহ পাঠিয়েছেন আপনাকে খবর জানাতে। 

খবর? কী খবর? 

খবর খুব খারাপ। বাদশাহ একজন কবিকে নিয়ে শঙ্কিত। বাদশাহর কাছে একজন কবির জীবন অনেক মূল্যবান। 

আহ, খবরটা কী, তা আমাকে বলেন। 

ঘোড়ার পিঠে চড়ে মিরাটের সৈন্যরা দিল্লিতে ঢুকে পড়েছে।

সৈনিকরা যমুনা নদী পার হলো কীভাবে? 

ওরা নৌকা জোড়া লাগিয়ে সেতু বানিয়েছে। সেই সেতুর ওপর দিয়ে 

প্রবেশ করেছে শহরে। 

নৌকা দিয়ে সেতু বানিয়েছে? 

হ্যাঁ, দোস্ত। বাদশাহ তাঁর যে নিভৃত কক্ষে বসে যমুনা নদীর ওপর দিয়ে দৃষ্টি ছড়িয়ে তাকিয়ে থাকেন, যে নদী তার খুব প্রিয়, যে নদীর তরঙ্গ বাদশাহর কবিতায় কুলকুল ধ্বনি তোলে সেই— 

আহ্ কী হয়েছে বলেন? 

সৈনিকরা দিল্লি শহরে ঝড় তুলেছে। যাকে পাচ্ছে তাকে নিধন করছে। আমি যাই। 

গালিব আহসানউল্লার হাত ধরে বলেন, এখন বের হবেন না। আপনি আমার বাড়িতে থাকেন। 

না, থাকতে পারব না। বাদশাহকে জানাতে হবে যে কবির কাছে খবর পৌঁছে দিয়েছি। কবি সাবধানে থাকবেন। আপনি যে তার কত প্রিয় কবি আপনি তা জানেন না। 

আমি জানি। আমি জানি বাহাদুর শাহ জাফর আমাকে কত ভালোবাসেন। তিনিও আমার একজন প্রিয় কবি। আমরা যখন কবিতার কথা বলি, তখন আমরা একাত্ম হয়ে যাই। কবিই পারে কবির সঙ্গে এভাবে একাত্ম হতে। হাকিম, বাদশাহ সুস্থ আছেন তো? 

আছেন। এখন পর্যন্ত তিনি সুস্থই আছেন। 

দ্রুতপায়ে বেরিয়ে যান হাকিম আহসানউল্লা। দরজার সামনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন গালিব। শহরের হট্টগোল, প্রবল উল্লাস, হত্যাযজ্ঞের তীব্রভেদী আর্তনাদ দু’কান ভরে বাজে। গালিব দরজা বন্ধ করে দেন। ফিরে আসেন নিজের লেখার টেবিলে। দু’কনুই টেবিলের ওপর রেখে মাথা চেপে ধরে বসে থাকেন চেয়ারে। 

প্রবল উত্তেজনা নিয়ে ঘরে ঢোকেন উমরাও বেগম। আতঙ্কে চোখ বড় হয়ে গেছে। চিৎকার করে বলেন, শহরে এসব কী হচ্ছে? 

গালিব ধীরেসুস্থে মাথা তোলেন। স্ত্রীর দিকে তাকান। দেখেন একজন মহিলা কতটা আতঙ্কিত হলে তিনি মুহূর্তে অচেনা হয়ে যান। তাঁর দৃষ্টি বদলে যায়, কণ্ঠস্বর একরকম থাকে না। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো থরথর করে কাঁপে, যেন ওগুলোর জোড়া খুলে যাওয়ার সময় হয়েছে। উমরাও বেগম আবার চিৎকার করে বলেন, শহরে এসব কী হচ্ছে? এমন হত্যা-আগুন- 

সেপাইরা বিদ্রোহ করেছে বিবি। 

বিদ্রোহ? 

হ্যাঁ, মহাবিদ্রোহ। 

কে ওদের নিরস্ত্র করবে? 

ব্রিটিশ প্রভুরা। 

উমরাও বেগম দু’হাত ওপরে তুলে বলেন, আল্লাহ মেহেরবান। 

গালিব বলেন, আমি তো মদ পান করি, কিন্তু শূকরের মাংস খাই না।

এটা আমার চেয়ে বেশি আর কে জানে। কিন্তু তাহলে আপনি কেমন মুসলমান? 

অর্ধেক। অর্ধেক মুসলমান। 

হায় আল্লাহ, এমন কথা একজন খাঁটি মুসলমান বলতে পারে না। 

আমি তো নিজেকে খাঁটি মুসলমান দাবি করি না বিবি। আমার পাপ আমার কবিতা। 

উমরাও বেগম মুখ ঝামটা দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই গালিব তাঁর হাত চেপে ধরে বলতে থাকেন— 

‘হৃদয়ের আগুন দিয়ে 
আমি কবিতার আলো জ্বালিয়েছি 
সেই শব্দ চয়নে কেউ একটি আঙুলও 
ছোঁয়াতে পারবে না।’ 

খুব সুন্দর। উমরাও বেগম মৃদু কণ্ঠে বলেন। 

তোমার ভালো লেগেছে? 

উমরাও বেগম ঘাড় নাড়িয়ে বলেন, হ্যাঁ খুব ভালো লেগেছে। কবিতা নিয়ে আপনার খুব গর্ব, না? 

হ্যাঁ, খুব গর্ব, খুব। এই গালিব, এই মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব একজনই জন্মায় বিবি। 

উমরাও বেগম মৃদু ধমক দিয়ে বলেন, এভাবে বলতে হয় না। আল্লাহ নাখোশ হবেন। 

গালিব বলেন, শহরের রাস্তায় যখন হত্যাযজ্ঞ তখন আমি গলা ফাটিয়ে কবিতা পড়তে পারি। আমিই কবি। কবিতার মানুষ। তুমি আমাকে আজ সকালে কী খেতে দিবে বিবি? মোগলাই পরোটা তো? 

আপনি খেতে চাইলে তাই দেবো। যাচ্ছি তৈরি করতে। কিন্তু দরজা খুলে বের হবেন না। প্রয়োজনে কালুকে ডাকবেন। 

পাগল। আমি কবিকে মরতে দিতে পারি না। কবি হত্যা আর আগুনের অপব্যবহার পছন্দ করে না। 

উমরাও বেগম বেরিয়ে যান। 

গালিব জানালা দিয়ে তাকান। সেপাইরা যাকে পাচ্ছে তাকেই নিধন করছে। বাড়ি বাড়ি আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। নৌকার বানানো সেতু পার হয়ে অশ্বারোহী দল দরিয়াগঞ্জের কাছে রাজঘাটের পথে শহরে ঢুকেছে। সেপাইদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে দিল্লিবাসীর অনেকে এবং বাদশাহর সেপাইদের একটি দল। 

দেয়াল টপকে গালিবের বাড়িতে ঢোকে শাহজাদা চিশতী। দরবারে চাকরি করে। কোথা থেকে দৌড়ে এসেছে কে জানে। হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, চমন লালু ডাক্তার খুন হয়েছেন। পানি খাব ওস্তাদ। 

গালিব চিশতীকে পানি দেন। ও পরপর দু’গ্লাস পানি খায়। পানি খেয়ে দম নিয়ে বলে, ডাক্তার চমন লালু যে খ্রিস্টান হয়েছিল সেজন্য তিনিই প্রথম হত্যার বলি হলেন। সেপাইরা ফিরিঙ্গি ও ব্রিটিশ নিধনে মেতেছে। 

বাদশাহ কেমন আছেন চিশতী? 

সুস্থ আছেন। 

গালিব গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, ঘোড়ায় চড়ে আসা সেপাইরা লালকেল্লার কাছে যায়নি? 

চিশতী অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলেন, গিয়েছিল, গিয়েছিল। কেল্লায় প্রবেশ করার জন্য ওরা বাদশাহর কাছে অনুমতি চেয়েছিল। 

তারপর? বাদশাহ কী করলেন? 

আমাকে দম ফেলতে দিন ওস্তাদ। আমি আবার পানি খাব। আমার ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। 

গালিব ঘরের কোনায় রাখা সোরাই থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে চিশতীকে দেন। কিছুক্ষণ পায়চারি করেন। তারপর চিশতীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেন, বাদশাহ কী করেছেন আমি তা জানি।

চিশতী পানির গ্লাসটা টেবিলে রাখে। জোরে জোরে শ্বাস টেনে দম নেয়। তারপর মৃদুস্বরে বলে, বাদশাহকে আপনার চাইতে বেশি আর কে চেনে ওস্তাদ? আপনি তাঁর চিন্তার নক্ষত্র চেনেন। আপনি তার বুকের জমিন চেনেন। 

হ্যাঁ, চিনি চিনি। তাঁর সবটুকু আমি চিনি। ব্রিটিশরা কীভাবে তাঁর ক্ষমতা হরণ করেছে এটাও আমি দিব্য চোখে দেখতে পাই। আমি জানি বাদশাহ ওদেরকে লালকেল্লায় ঢোকার অনুমতি দেননি। আমি জানি, সেপাইদের বিদ্রোহে বাদশাহ বিভ্রান্ত হবেন না। আমি ধরে নিতে পারি যে তিনি প্রাসাদ রক্ষীবাহিনীর ব্রিটিশ সেনাপতিকে ডেকে পাঠিয়েছেন। ওই সেনাপতি ডগলাস ঠিকই ছুটে গেছে তার কাছে। 

চিশতী গালিবের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাথা নাড়ে। মুখে কিছু বলে না। ভয়ে-আতঙ্কে ওর শরীরের কাঁপুনি তখনও থামেনি। গালিব ওকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে বলেন, তুমি কি আর পানি খাবে? 

চিশতী মাথা নেড়ে বলেন, খাব। আমার মনে হচ্ছে যমুনা নদী পুরোটাই এখন আমি খেতে পারব। 

ও দু’হাতে মুখ ঢাকতে ঢাকতে বলে, উহ্ কী বীভৎস দৃশ্য! আমি আর বেঁচে থাকতে চাই না। মৃত্যুই আমার কাম্য। 

আহ্, চুপ কর। তোমার কথা শুনতে আমার একটুও ভালো লাগছে না। তুমি তো জান আমি কবি। কবির চোখের সামনে এখন জেগে উঠছে জামা মসজিদের অসাধারণ সুন্দর মিনারগুলো। তুমি তো জান উত্তর ভারতের মসজিদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর দিল্লির জামা মসজিদ। জ্যোৎস্নার আলোয় ওই মসজিদের মিনারের দিকে তাকালে আমার মনে হাজার হাজার গজলের পভুক্তি অনবরত পাখা মেলে উড়ে আসত। আমার জীবন ধন্য হয়ে যেত চিশতী। দিল্লি শহরের সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। এই শহরকে ঘিরে গেঁথে তোলা লাল প্রাচীরটি কী চমৎকার! আহা, এই শহরে বাস করে আমার কবিজীবন সার্থক। অসাধারণ সুন্দর লাল প্রাচীরের গায়ে জ্যোৎস্নার আলোছায়া অপরূপ দৃশ্য ফুটিয়ে তুলত। এমন দৃশ্য দেখলে আমার মনে হয় আমি বুঝি শরাব পান করছি। জ্যোৎস্নার শরাব, কবিরাই শুধু এমন শরাব পান করতে পারে। আর কেউ না, আর কেউ না। যমুনা নদীর অপর পাড়ে দাঁড়িয়ে আমি অনেক দিন দেখেছি আকাশের দিকে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে থাকা মিনারগুলোর ছায়াচিত্র। নদীর সঙ্গে ছায়া মিশে শহরকে অন্য দৃশ্য এনে দেয়। কবি সেই দৃশ্যের দিকে দু’চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। আহ্, এই শহরের আমিই সেই কবি! 

ওস্তাদ, বাইরে এখন হত্যার তাণ্ডব উৎসব চলছে। আপনার প্রিয় শহর, আর জ্যোৎস্না রাতের শহর নেই। 

খামোশ, বাজে কথা বলবে না। আমি চোখ বুজলেই আমার প্রিয় শহরের সৌন্দর্য দেখতে পাই। যমুনায় নৌকার ওপর ভেসে থেকে আমি শহরকে দেখি। কত বৈচিত্র্য, কত মায়া, কত রূপ! 

কথা বলতে বলতে গালিবের দৃষ্টি উদাস হয়ে যায়। ছোট কুঠুরিতে পায়চারি করতে করতে হাত ওঠান, হাত নামান। হাতের আঙুলগুলো চুলে ঢোকান। এলোমেলো করে ফেলেন পুরো মাথা। চুলের গুচ্ছ লুটিয়ে পড়ে কপালে। স্নিগ্ধ হাসি লেগে থাকে ঠোঁটে। যেন কোনো দেবদূত, এইমাত্ৰ স্বৰ্গ থেকে নেমে এসেছে। চিশতী মুগ্ধস্বরে বলে, আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে ওস্তাদ। 

শরাব পান করার সময় আমাকে আরও অনেক বেশি সুন্দর লাগে। তখন আমি ঈশ্বরের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান হই। 

ওস্তাদ, বাইরে হত্যাকারীদের হাস্য উল্লাস শোনা যাচ্ছে। ওস্তাদ–

চুপ কর। খারাপ কথা বলবে না। আমি জানি, এই মুহূর্তে বাহাদুর শাহ জাফরও কবিতা লিখছেন। যদিও এখন তিনি খুব খারাপ অবস্থায় আছেন। ব্রিটিশরা তাকে জব্দ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আমার প্রিয় শহরের অদূরে কাশ্মীরি গেটের কাছে ইংরেজ রেসিডেন্টের বিশাল আবাস। 

এটুকু বলেই থেমে যান গালিব। চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েন। ঘুরতে ঘুরতে আবৃত্তি করেন নিজের কবিতা- 

‘হে ঈশ্বর 
আর কতদিনের এই অপেক্ষা 
আর কতদিন 
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এইসব আকাঙ্ক্ষা! 
প্রার্থনার সময় 
আমার বাহু দুটিকে আরও উচ্চতা দাও।’ 

মগ্নতার ভেতরে উচ্চারিত তাঁর কণ্ঠস্বরের মাধুর্য ছড়িয়ে যায় ঘরের ভেতরে। চিশতী মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থেকে বলে, ওস্তাদ আপনি কি নগরবাসীর কান্না শুনতে পাচ্ছেন? 

পাচ্ছি। পাচ্ছি। আর্তনাদ ওঠে গালিবের কণ্ঠে। বলেন, কান্না তো আমার বুকের ভেতরে— আমি আমার কবিতায় কান্নার ধ্বনির বিস্তার দেখছি। চিশতী তুমি আমার সঙ্গে বলো : 

‘শ্রদ্ধেয় মানুষের ক্রোধোন্মত্ততা নয়
আবার দ্বিচারী বন্ধুদের মতোও নয়—
আত্মকেন্দ্রিকতাও নয়- 
কিন্তু সকলের সঙ্গেই নেচে ওঠো ॥ 
হতাশ হয়ো না 
জ্বলন্ত আগুনে হতাশা খুঁজো না
বা ফুটন্ত ফুলেও খুঁজো না আনন্দ
সিমুনের পাড়ে দাঁড়িয়ে
বা মৃদুমন্দ বাতাসে 
উন্মাদের মতো শুধু নেচে ॥’

চিশতী কবিতা বলতে বলতে বেরিয়ে যেতে চায়। দরজার কাছে যেতেই গালিব ওর হাত টেনে ধরে বলেন, যেও না। এই উন্মত্ত শহর এখন বিপজ্জনক। 

না, আমি যাব। গালিবের কবিতা বলতে বলতে চলে যাব। 

যদি তুমি সন্ত্রাসের মুখোমুখি হও? 

হতেই পারি। এই আতঙ্কের শহরে এখন আমি আমার নিজের কথাই কেবল ভাবতে পারছি না। 

আহ্, চিশতী পরিস্থিতি বুঝতে হবে। 

যারা বিদ্রোহ করেছে সেই সেপাইরা তো পরিস্থিতি বুঝেই শহরের রাস্তায় নেমেছে। আমরা জানি না, ওরা ব্রিটিশ সেনাদের সঙ্গে টিকে থাকতে পারবে কি-না। 

গালিব রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলেন, তাতে কিছু এসে যায় না। ওদের বিদ্রোহই সত্য। ওদের বিদ্রোহ আমাদেরকে বুঝতে হবে। 

আমি যাই। চিশতী দ্রুতপায়ে চলে যেতে থাকে বিল্লিমাঁরো গলির বাড়ি থেকে। ভগ্নহৃদয় নিয়ে গালিব ফিরে আসেন নিজের টেবিলে। চেয়ার টেনে বসলে কলম, কাগজ, কালির দোয়াত, ছড়িয়ে থাকা কয়েকটি বই তাঁর মনোযোগ কাড়তে পারে না। বিমর্ষ হয়ে বসেই থাকেন। টের পান কাবাবের ঘ্রাণ। খিদে চনমনিয়ে ওঠে। সকালের নাশতা খেতে অনেক দেরি হয়ে গেল। বুঝতে পারেন আজ তাঁর বিবির মন ভালো নেই। 

কাল্লু মিয়া দস্তরখানায় নাশতার রেকাবি রাখে। তিনি কাবাবের টুকরো মুখে পোরেন, সঙ্গে রুটির টুকরোও। মুখভর্তি খাবার নিয়ে বলেন, এত দেরি করে খাবার দিলে যে? 

শহরের পরিস্থিতি ভালো না তো হুজুর। 

শহরের পরিস্থিতির সাথে তোমরা আমার পেটের সুতো বেঁধে দিয়েছো? তাই তো করতে হবে। এমন অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে তো খাওয়াই জুটবে না। আমাদের যে কী হবে আল্লাহই জানেন। আপনি রাস্তায় বের হবেন না হুজুর। 

হুম, গালিব চোখ বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে শব্দ করেন। তারপর মনোযোগ দিয়ে খেতে থাকেন। বুঝতে পারেন চিশতীর সঙ্গে কথা বলার সময় খিদের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। এখন খিদে শুধু পেটে নেই, মাথায়ও উঠেছে কাল্লু সোরাই থেকে পানি ঢেলে গ্লাসটি গালিবের হাতের কাছে রাখে। 

বাড়ির কেউ তো আজকে রাস্তায় নামেনি? 

না, হুজুর। সবাই আতঙ্কে জড়সড় হয়ে বসে আছে। বাড়ির বিড়ালটা পর্যন্ত। কবুতরগুলোও। 

ও আচ্ছা। তোমার মাইজি কী করছেন? 

আপনার জন্য নাশতা বানিয়ে আবার গিয়ে শুয়ে পড়েছেন। আমাদের ভাগ্য ভালো যে আমাদের বিল্লিমাঁরো গলিতে সেপাইরা ঢোকেনি। 

তুমি এখন যাও। 

কাল্লু চলে যায়। তিনি ধীরেসুস্থে কাবাব-রুটি শেষ করেন। নাশপাতির শরবত খান। হালুয়া যা দিয়েছে সেটিও শেষ করে ফেলেন। সবাই জানে তিনি খেতে ভালোবাসেন। তিনি মনে করেন, কবিতা লেখার পর খাওয়াটাই সবচেয়ে আনন্দদায়ক কাজ। এই আনন্দ অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে ভাগাভাগি করা যায় না। 

খাওয়া শেষ করে চুপ করে বসে থাকেন। চেয়ারে হেলিয়ে দেন মাথা। ঘুলঘুলি দিয়ে আলো আসছে, সঙ্গে রোদের ছায়া। বাইরে কাক ডাকছে তীব্র শব্দে। তিনি কাকের ডাক উপভোগ করেন। ভাবেন, কর্কশ ধ্বনিও কখনও প্রবল মধুর। কানের ভেতর দিয়ে বুক পর্যন্ত পৌছায়। তখন তিনি ভাবতে থাকেন এই সময়কে নিয়ে একটি বই লিখবেন— পদ্যে নয়, গদ্যে লিখবেন। ভাবতে গিয়ে উত্তেজিত হন। স্মৃতিকথা তিনি লিখেননি। এখনই লেখার সময়। এখনই একটি বিশেষ সময় বয়ে যাচ্ছে তাঁর জীবনে। ষাট বছর বয়স তো হয়ে গেল আর কতদিনইবা বাঁচবেন? মানুষের দিন ফুরিয়ে যেতে খুব সময় লাগে না। গালিব উঁচু গলায় কাল্লুকে ডাকেন। ও এসে রেকাবি-গ্লাস নিয়ে চলে গেলে তাঁর বুকের ভেতরে জীবিকার বিষয়টি খামচে থাকে। ভাবেন, এই বিদ্রোহে তিনি কাকে সমর্থন করবেন? তবে তাঁর ভাতা পাওয়ার প্রসঙ্গে তাঁকে ভেবেচিন্তে এগোতে হবে। তিনি তো ইচ্ছে করলে যা খুশি তা করতে পারেন না। তাহলে রুটি খাবেন কী করে? 

নানান কিছু ভাবনায় তিনি উদভ্রান্ত বোধ করেন। আবার পায়চারি করতে থাকেন। কখনও বিছানায় শুয়ে থাকেন। কখনও জানালার কাছে দাঁড়িয়ে কান পেতে থাকেন। বিল্লিমাঁরো ছাড়িয়ে কতদূর থেকে ভেসে আসছে শব্দ? নাকি শব্দ নিজের বুকের ভেতর গুড়গুড় করছে? তাঁর অস্থিরতা তাঁকে ম্রিয়মাণ করে ফেলে। ভাবেন, বিদ্রোহের মেয়াদ কতদিন হবে? কোন পক্ষ জিতবে? কোন পক্ষ ক্ষমতায় এলে তাঁর প্রশস্তি গাইতে হবে? তিনি নিজেকে স্থির করেন। শান্ত হওয়ার চেষ্টা করেন। বাদশাহর কথা ভাবেন এবং বুঝে নেন যতদিন বিদ্রোহ না থামবে, ততদিন বাদশাহকে বন্দিজীবন কাটাতে হবে। 

একদিন গেল। দু’দিন গেল। 

গালিব ঠিক করলেন এই রাস্তার ধারে যারা থাকেন তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। বিদ্রোহীদের গতিবিধির খবর নিতে পারেন। তাঁর রাস্তায় থাকেন তাঁরই প্রতিবেশী মেহমুদ খান, মুর্তুজা খান, গোলামুল্লা খান। তাঁরা সবাই পাতিয়ালার দরবারের সঙ্গে যুক্ত। পাতিয়ালার রাজার বৃত্তি ভোগ করেন। বেশ স্বচ্ছন্দেই জীবন কাটান তারা। গালিব নিজ বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবলেন, সৌভাগ্যক্রমে তিনি এই রাস্তার অধিবাসী। মহল্লাটি পাতিয়ালার মহারাজার অধীন। মহারাজা প্রথম থেকেই নিজেকে ব্রিটিশদের সমতুল্য মনে করতেন। তাঁর দাপটই অন্যরকম। সবসময় বলেন, আমার দেশ। আমিই রাজা। আমিই সিদ্ধান্ত নেব। আমার দেশের বিখ্যাত হাকিমদের গায়ে ব্রিটিশরা হাত দিতে পারবে না। পাতিয়ালার দরবার একটি অবস্থান নিয়েছে, এ কথা ভেবেই গালিব নিজের বাড়ির দরজা বন্ধ করে রাস্তায় নামেন। গা ছমছম করে। রক্তের বোটকা গন্ধ আসছে চারদিক থেকে। গালিব চারদিকে তাকান। বাড়িগুলোর দরজা-জানালা বন্ধ। গলিটি নিস্তব্ধ। প্রাণহীন ধ্বংসস্তূপ ম্রিয়মাণ করে রেখেছে শহরকে। হায় আমার দিল্লি, আমার প্রাণ, আমার কবিতা! 

মুখোমুখি হন ফাইয়াজের। ও হন্তদন্ত হয়ে ফিরছিল অন্য কোথাও থেকে। গালিবকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। 

চাচা কোথায় যাচ্ছেন? 

এই তো বাবা মেহমুদ খানের বাড়িতে। যাচ্ছি শহরের খোঁজ নিতে।

শহর তো শহর নেই চাচা। শহরটা দোজখ হয়ে গেছে। আপনি কিন্তু বেশিদূর যাবেন না। 

না, বেশিদূরে যাব না। তুমি কোথায় গিয়েছিলে? 

ফুপুআম্মার বাড়িতে। 

কথা বলে শেষ করার আগেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে ফাইয়াজ। গালিব ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, বুঝেছি কিছু একটা ঘটেছে তোমার ফুপুর বাড়িতে। 

নেই নেই, কেউ বেঁচে নেই। ফুফাতো বোনটার লাশ দেখিনি। ওকে বোধহয় ধরে নিয়ে গেছে। ওহ্ আল্লাহ- 

ফাইয়াজ দ্রুত পায়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়। গালিব কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ওর চলে যাওয়া দেখেন। কেমন অদ্ভুত লাগে ওর চলে যাওয়া দেখতে। তারপর নিজে হাঁটতে শুরু করেন। মেহমুদ খানের বাড়িতে টুকটুক কড়া নাড়েন। ভেতর থেকে ভীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, কে? 

গালিব সপ্রতিভ কণ্ঠে বলেন, মির্জা আসাদুল্লাহ খান। 

ওহ কবি এসেছেন, আসুন। 

গালিব ঘরে ঢুকলে ভেতরের ঘর থেকে মেহমুদ খান মুখ বাড়ান। দু’পা এগিয়ে এসে বলেন, ভয়ে আতঙ্কে মুষড়ে থাকি বুঝলেন। দরজা খুলতেও ভয় পাই। 

আপনি কি বাদশাহর কিছু জানেন? বাদশাহর খবর জানতে পারিনি কিছু। সিপাহিরা তাঁর সঙ্গে কেমন আচরণ করছে জানি না। 

আমি খানিকটা শুনেছি। 

গালিব উদ্গ্রীব কণ্ঠে বলেন, কী শুনেছেন? খারাপ কিছু? বাদশাহ বেঁচে আছেন তো? 

মেহমুদ খান ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে বলেন, সিপাহিরা ঘোড়ায় চাবুক দাবড়ে লালকেল্লার ভেতরে ঢুকে পড়ে। দেওয়ানি খাসের পাশে যে বাগানটি আছে সেখানে উত্তেজিত যুবকরা জমায়েত হয়। তারা বাদশাহকে বলে, বাদশাহ যেন তাদের দোয়া করেন। যেন তারা এই বিদ্রোহে সফলকাম হতে পারে। 

মেহমুদ খান থামলে গালিব আবার উদগ্রীব কণ্ঠে বলেন, বাদশাহ কী বললেন? আমি ধৈর্য রাখতে পারছি না, আমাকে সব বলুন। 

বাদশাহ সিপাহিদের বিদ্রোহের ব্যাপারে একদম আগ্রহী ছিলেন না। বুঝেছি, তারা তাঁর ওপর খড়গ উঁচিয়ে কথা বলেছে। বাদশাহ তাদের আচরণে দুঃখ পেয়েছেন। 

কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত নিজের সিদ্ধান্তে স্থির থাকেননি। কারণ তাঁর সামনে আর কোনো রাস্তা খোলা ছিল না। 

ঠিকই ধরেছেন। তিনি বিদ্রোহীদের সমর্থন জানিয়েছেন। আর তাই দিল্লিতে বিদ্রোহের পতাকা উড়ল। বাদশাহ সিপাহিদের হাতের পুতুল মাত্র। সিপাহিদের ঘোড়াগুলো বাগানের ঘাস, গাছপাতা চিবিয়ে ছিঁড়েছে। আমি আমার দিব্যচোখে এর সবকিছুই দেখতে পাচ্ছি। যেন বুকের ভেতরের দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে আমার ভেতরটা। আর কোনোদিন বুঝি বাদশাহর দরবারে মুশায়রার আসর বসবে না। 

গালিব দু’হাতে নিজের চুল টেনে ধরলে মেহমুদ খান মৃদুকণ্ঠে বলেন, শান্ত হন মির্জা। 

শান্ত যে হতে পারছি না। লালকেল্লার যে দরবার ছিল আমাদের প্রাণের জায়গা, জ্যোৎস্নালোকে উদ্ভাসিত সংস্কৃতির আকাশ, সে দরবারে এখন অনবরত ধ্বনিত হবে ঘোড়ার খুরের শব্দ আর সিপাহিদের কর্কশ কণ্ঠ। আমি দেখতে পাচ্ছি সামনে মুশায়রার জন্য অন্ধকার। অন্ধকারে কবিতার জন্য রাস্তা খুঁজতে হবে মির্জা গালিবকে। 

আহ্, আপনি শান্ত হন মির্জা। 

হ্যাঁ, আমাকে তো শান্ত হতেই হবে। আমি এবং আমাদের মতো অভিজাত শ্রেণীর মানুষ এতদিন দু’পক্ষের প্রতি অনুগত থেকে জীবন কাটিয়েছি। আমরা জানতাম ব্রিটিশরা ছিল শাসক আর মোগল সম্রাট ছিলেন ভক্তি-বন্দনার মূর্তি। কিন্তু এই মহাবিদ্রোহ ঘোড়ার পায়ে দলে ফেলেছে সব আবছা ছায়া। এখন আমাদের সামনে আর কোনো অস্পষ্টতা নেই মেহমুদ খান। 

ঠিকই বলেছেন, আমাদের এখন পক্ষ নিতে হবে। 

গালিব দ্রুত কণ্ঠে বলেন, এখন আমাদের হয় ব্রিটিশদের সমর্থন দিতে হবে, নয় তো বাদশাহকে। এখন দু’পক্ষে তাল মেলানো যাবে না। 

আপনাকে শরবত দিতে বলি মির্জা? 

হ্যাঁ, আমি এক গ্লাস শরবত খাব। খুব পিপাসা পেয়েছে। আর এবারের গ্রীষ্ম একদম অন্যরকম। কী ভীষণ গরম পড়েছে। 

মেহমুদ খান ভেতরে গেলে গালিব দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে শরীর ছেড়ে দেন। যেন কতকাল ধরে হাঁটতে হাঁটতে তিনি ভীষণ ক্লান্ত। সামনের দিনগুলোতে তিনি কতটা পথ হাঁটতে পারবেন চিন্তা করার জন্য চোখ বুজে আসে তাঁর। দিল্লিতে বিদ্রোহীদের পতাকা উড়েছে, গালিব মাথা ঝাঁকিয়ে সোজা হয়ে বসেন। বাদশাহর মুখ স্মরণ করেন। কবি বাদশাহ তাঁকে ওস্তাদ বলে মানতেন। কয়েক দশক ধরে গড়ে উঠেছে এই সম্পর্ক। কখনও সম্পর্কে টানাপোড়েন চলেছে। আবার সেটা কেটে গেছে। কিন্তু কখনও সম্পর্কের সূত্র ছিন্ন হয়নি। বাদশাহর ছেলেও ছিল তাঁর সাগরেদ। বাদশাহর মুশায়রার আসরে যোগ দিতে প্রায় প্রতিদিনই তিনি হাজির হতেন সেখানে। তাঁর কাছে লালকেল্লা ছিল কবিতার কেন্দ্রবিন্দু। এই কেল্লা কিলাই-মোলাই নামে খ্যাত ছিল। কী ভীষণ প্রাণের টানের জায়গা। যদিও তিনি জানতেন ক্ষয়ে যাচ্ছে মোগল সাম্রাজ্য– ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে মোগল শাসন। সামনে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে ব্রিটিশরা। কত বছর ধরে দরবারে যাতায়াত — সাক্ষী হয়ে গেছেন ক্ষয়ে যাওয়া মোগল শাসনের নিয়তির। বুক চেপে আসে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তিনি আবার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেন। কিলাই-মোলাই তো তাঁর জীবনের সবটুকু জুড়ে আছে! কখনও মুশায়রায় অংশগ্রহণ, কখনও ভাতার টাকা নিতে আসা। একটি মনের ক্ষুধা মিটিয়েছে, অন্যটি শরীরের। দুটোই তার বেঁচে থাকার জন্য সমান। দুটোকেই এক পাল্লায় সমানভাবে মাপা যায়। 

গালিবের জন্য শরবত আর হালুয়া আসে। নিয়ে আসে মেহমুদ খানের পরিচারক। প্রথমেই তৃষ্ণার্ত বুক ঠাণ্ডা করার জন্য এক চুমুকে শরবত শেষ করেন। তারপর হালুয়ার বাটি টেনে নিয়ে বলেন, তোমার প্রভু কোথায়? আমার বন্ধু মেহমুদ খান? 

তিনি একটি কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছেন। 

ও, তাহলে আমাকে একাই হালুয়ার বাটি শেষ করতে হবে? জী হ্যাঁ, জনাব। 

হালুয়া খেয়ে আমাকে চলে যেতে হবে? 

জ্বী হ্যাঁ, জনাব। আমার মুনিব আমাকে তেমনই বলেছেন। 

তিনি আর কী বলেছেন? 

বলেছেন যে, আপনার সঙ্গে যেটুকু কথা বলার দরকার তিনি তা বলে শেষ করেছেন। 

আবার আসতে বলেছেন কি? 

সে আপনার মেহেরবানি। আপনার যখন খুশি তখনই আসতে বলেছেন।

গালিব সানন্দে হালুয়া খেয়ে শেষ করেন। ছেলেটির দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করেন, তোমার নাম কী? 

জায়েদ। পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ জায়েদ। 

তুমি গজল শুনতে ভালোবাস? 

হ্যাঁ, খুব ভালোবাসি। আপনি আমাকে একদিন কিলাই-মোলাইয়ে নিয়ে যাবেন? 

ওরে বাব্বা, বাদশাহর দরবারে! তোমার তো সাধের সীমানা নেই।

আমি বাদশাহকে দেখতে চাই। 

বাদশাহর সামনে কেউ অকারণে বসে থাকলে তিনি খুব রেগে যান।

আমি তো বসে থাকব না। আমি দেখেই চলে আসব। শুধু এক নজর।

কেন তাঁকে দেখতে চাও? 

শুনেছি সিপাহিরা বাদশাহকে হিন্দুস্তানের সম্রাট বানিয়েছেন। 

হ্যাঁ, তা ঠিক। আচ্ছা যাই।

আপনি যে আমাকে কিছু বললেন না? 

আরেকদিন বলব। সময় ভালো হোক। এখন তো খুব খারাপ সময় যাচ্ছে। 

এখন তো আমাদের সময়। আমাদের মানুষই সম্রাট। ওই লালমুখো ইংরেজ কুত্তাগুলোকে আমি দেখতে পারি না। 

আহ্, চুপ কর। এভাবে কথা বলতে হয় না। 

সিপাহিরা ওদের কেটে টুকরো করছে খুব ভালো করছে। আমি খুব খুশি। 

গালিব ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দ্রুতপায়ে বাড়ি ছাড়েন। রাস্তায় নেমে ভাবেন, ছেলেটির বয়স কত হবে? আঠারো কি উনিশ? তাই হবে। তিনি খানিকটা ভীত হয়ে পড়েন। নিজের বৃত্তির কথা ভেবে চুপসে যান। বৃত্তির টাকা কোনো কারণে বন্ধ হলে তাঁকে ভীষণ কঠিন জীবনযাপন করতে হবে। বউ, নাতিসহ কয়েকজন কাজের লোক-বড় একটা সংসার চালাতে হয় তাঁকে। দ্রুতপায়ে হাঁটতে থাকেন তিনি। বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েন। বাড়িটা পুরনো হয়ে গেছে। সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কার! শব্দটা মনে হতেই বুকে তোলপাড় করে ওঠে। মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস তো তাঁর জন্মের পর থেকেই অন্যরকম হতে থাকে। কমে যায় সীমানার আকার, অর্থ, বিত্ত, প্রতিপত্তি, জৌলুশের চেহারায় ক্ষয় ধরে। এ ইতিহাস তো কতভাবেই জানা হয়েছে তাঁর তিনি দরজায় কড়া নাড়েন। অবসন্নের মতো ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়েন। মনে হয় কত পথ হেঁটে এসে তিনি এখন ভীষণ ক্লান্ত। খুদাবক্স এক গ্লাস পানি দিয়ে বলে, হুজুর খান। আপনার মুখ শুকিয়ে গেছে। তিনি উঠে গ্লাসের পানি শেষ করে আবার শুয়ে পড়েন। অবসাদ তাঁকে পেয়ে বসেছে; কিন্তু মানসিক বোধ খুব সক্রিয়। 

হায় খোদা, বলে তিনি বিছানায় উঠে বসেন। চারদিকে তাকালে দেখতে পান খুদাবক্স ঘরের কোণে চুপচাপ বসে আছে। তাঁকে উঠতে দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, কিছু লাগবে হুজুর? 

হ্যাঁ, লাগবে। 

পানি দেব? শরবত? না- 

আস্তে আস্তে। কবির সঙ্গে এত তড়বড়িয়ে কথা বলতে হয় না। আচ্ছা খুদাবক্স, তোমার কি বাদশাহকে দেখতে ইচ্ছে হয়? 

না হুজুর না, একদম দেখতে ইচ্ছে হয় না।

গালিব বিস্মিত কণ্ঠে বলেন, ইচ্ছে হয় না কেন? 

গরিবের আবার বাদশাহ্ কী, শাহানশাহ কী? গরিব তো গরিবই। 

গালিব ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসেন। ভাবেন, খুদাবক্স তো ঠিকই বলেছে। নাকি ভুল? 

হুজুর আর একটা কথা। খুদাবক্স ইতস্তত করে বলে। 

বলো, কী কথা। 

গরিবের ওপর জুলুম করেই তো বাদশাহর খানদানি গড়ে ওঠে হুজুর। বাদশাহর এত জৌলুশ কোথা থেকে আসে? সব এই গরিব, এই গরিবরা দেয়। 

খামোশ খুদাবক্স। তুমি যাও এখান থেকে। 

ঘরের কোণায় বসি? 

না, এখানেও বসবে না। বের হয়ে যাও। 

ছেলেটি চলে যেতেই তাঁর মাথা দপদপ করে। বাদশাহর জৌলুশ থেকেই তো তাঁর বৃত্তির টাকা আসে। এত ধন-দৌলত-বিত্ত না থাকলে দরবারের রাজকবির পেনশন কীভাবে হতো? এ টাকা দিয়েই তো ওই গরিব খুদাবক্সও দিন গুজরান করে। তাহলে তো গরিবের টাকা গরিবের কাছেও ফিরে আসে। ওহ গালিব, গালিব- 

গালিব খাটের ওপর বসে জোরে জোরে পা দোলাতে থাকেন। বাদশাহ এখন লালকেল্লার অলিন্দে বসে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া যমুনা নদীর পানিতে জামা মসজিদের মিনারের ছবি দেখবেন। আর কাঠ-কয়লা দিয়ে দেয়ালের গায়ে লিখবেন কবিতা। তাঁর কবিতার পঙক্তি দেয়ালের গায়ে চিত্রকলার মতো ফুটে থাকবে। গালিব, আপনাকে ভালোবাসে সম্রাট। গালিব বিশ্বের তাবৎ কবিকে ভালোবাসে। 

বিছানা থেকে নেমে তিনি টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ান। অস্থিরতা পেয়ে বসে তাঁকে। দিল্লির মতো বুকের ভেতরটা ভীষণ অশান্ত। শৈশব থেকে এ অশান্ত হৃদয় নিয়ে বড় হয়েছেন। খুঁজেছেন কত কিছু, পাননি কত কিছু, পেয়েছেন যেটুকু সেটুকু দিয়ে মন ভরেনি। আনন্দ করার জায়গা ক্রমাগত সংকুচিত হয়েছে। ব্রিটিশরা শাসন ক্ষমতা দখল করার পর মুঘল সম্রাট এক ধরনের বন্দিত্ববরণ করেন। তাঁর জন্য বরাদ্দ হয় বছরে সাড়ে এগারো লাখ টাকার তহবিল। কত কৌশল অবলম্বন করে তাঁরা। সম্রাটের উপর নজরদারি করার প্রয়োজন দেখা দেয়। প্রভুত্ব বজায় রাখার খবরদারি তো ছিলই। তাই তাঁরা বসতি গেড়েছিল কাশ্মীরি গেটের কাছে। ব্রিটিশরা মুঘল সম্রাটের নামে নিজেদের রাজ্যশাসন চালাত। গালিব জানালা দিয়ে বাইরে তাকান। যদি বিদ্রোহীরা পরাজিত হয় তবে ব্রিটিশরা পুরো ক্ষমতায় আসবে। তখন তাঁর নিজের বৃত্তির টাকা আসবে ব্রিটিশদের কাছ থেকে। তখন কি ব্রিটিশরা দেখতে চাইবে মুঘল সম্রাটের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ কতটা ছিল? তার চেয়েও বেশি আনুগত্য কতটা ছিল? গালিবের বুকের ভেতর গুড়গুড় ধ্বনি হয়। ভাবেন, এর একটি উপায় বের করতে হবে। একটি ডায়েরি লিখলে কেমন হয়? প্রতিদিনের ঘটনার বর্ণনা থাকবে তাতে। বর্ণনা করবেন ব্রিটিশরা সিপাহিদের হাতে কতটা নির্যাতিত হয়েছে তাঁর কথা। ভাবতেই তাঁর ষাট বছরের দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি কাগজ টেনে বসেন। কিন্তু দিনলিপিটি লেখা শুরু করতে পারেন না। লিখেন একটি কবিতা–

‘ওই যে অসীম অনন্ত 
যার কোনো শুরু নেই আমার স্বীকৃতিস্বরূপ নক্ষত্র 
সেই আকাশই ছুঁয়েছে 
কিন্তু এ পৃথিবীতে আমার কবিতার 
খ্যাতি আসবে 
মৃত্যুর পরে।’ 

কবিতাটি লিখে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকেন। বিমর্ষ এবং চিন্তিত দেখায় তাঁকে। কিছুই ভালো লাগে না তাঁর। তিনি বিবি-বিবি বলে চেঁচিয়ে ওঠেন। অল্পক্ষণে উমেরা বেগম তাঁর ঘরে ঢোকেন। 

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন তাঁর দিকে। গালিব কিছু বলার আগেই উমরাও বেগম বলেন, এমন চেঁচামেচি করে ডাকাডাকি করছেন কেন? তোমাকে অনেকক্ষণ ধরে বাড়িতে দেখছিলাম না! তুমি কোথায় গিয়েছিলে? 

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উমরাও বেগম বলেন, শহরে মেয়েদের গয়নাগাটি কেড়ে নিচ্ছে সিপাহিরা। বাড়িতে বাড়িতে লুটপাট হচ্ছে। আপনি কি জানেন কিছু? 

গালিব চোখ বুজে বলেন, হ্যাঁ শুনেছি। কিন্তু কোনো মেয়ের শরীর থেকে গয়না খুলে নিয়েছে এমন কোনো ঘটনার সাক্ষী আমি হইনি। 

এটা মোটেই রসিকতা করার সময় নয়। 

আমার কাছে রসিকতা ফুসফুসে বাতাস চলাচলের মতো। 

সারাজীবন আপনি তা-ই করলেন। এসব করে জীবনটা উড়িয়ে দিলেন।

মোটেই উড়িয়ে দিইনি। আমার অনেক সঞ্চয়ও আছে। 

সঞ্চয়! ফুঃ! মদ-রুটির পরে তো একটি মোহরও থাকে না। 

মোহর তো হাতের ময়লা। আমার সঞ্চয় আমার কবিতা। আমার মৃত্যুর পরে লোকে গালিবের নামে জান কোরবানি করবে। 

দোপাট্টায় মুখ ঢেকে উমরাও বেগম খুকখুক করে কাশেন। কাশি থামিয়ে একসময় বলেন, আমাকে খুঁজছিলেন কেন? 

আমি গয়না লুটপাটের খবর জেনে তোমাকে খোঁজ করেছি এ জন্য যে, তোমার গয়নাগুলো কোথায় রেখেছ? 

আপনি যখন আমার গয়নার চিন্তায় ছিলেন তখন আমি সেগুলো নিরাপদ জায়গায় রাখার জন্য পাঠিয়েছি। ইনশাল্লাহ আমার অলঙ্কারের ছোট বাক্সটি নিরাপদেই থাকবে। 

কোথায় পাঠিয়েছ শুনি? 

পরে জানতে পারবেন। কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে তা ফেরতই পাব। এসব ভেবে দুশ্চিন্তার ধাপ বাড়িয়ে লাভ কি? 

কথার ঝাপটা দিয়ে উমরাও বেগম ফিরে দাঁড়ান। দু’পা এগিয়ে আবার ফিরে এসে বলেন, কবিতার সঞ্চয়ের কথা বললেন। তো এই সঞ্চয়ের পরিমাণ কী? 

শতাব্দীর পর শতাব্দী সঞ্চিত থাকবে। 

তাতে কী হবে? 

কবিতায় বেঁচে থাকবে গালিব। আর গালিবের কবিতা মানুষের আত্মার ক্ষুধা মেটাবে। 

সিপাহিরা যদি আপনাকে বাঁচিয়ে রাখে তবে তো? নাকি বেঁচে না থাকলেও সঞ্চয় থাকবে? 

ষাট বছর বয়স পর্যন্ত যা করেছি সেটাই অনেক। মানুষ এই সঞ্চয় খরচ করে শেষ করতে পারবে না। 

ফুঃ! কবিতা! মানুষের আবার আত্মার ক্ষুধা। সিপাহিরা জিততে না পারলে ব্রিটিশরা আসবে। দিল্লি শহর দখল করবে। তখন ওরা আপনাকে মারবে। কারণ আপনি বাদশাহর দরবারে আত্মার খাদ্য বিলি করতে যান। আপনার তো আবার সিন্দুকবোঝাই সে সম্পদ আছে। 

হ্যাঁ বিবি, তা ঠিক। ঠিক বলেছ। এই একটি জায়গায় আমি বাদশাহরও বাদশাহ। 

উমরাও একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে স্বামীকে দেখেন। কত অল্প বয়স থেকে তিনি এই মানুষটিকে দেখছেন। তাঁর দেখা ফুরালই না। একসময় মনে হয় তিনি এই রকম, অন্য সময় মনে হয় না এ রকম না, তিনি অন্যরকম। তাহলে একজন মানুষ কি কবি হলে স্ত্রীর কাছে অচেনা মানুষ হয়ে থাকে? 

কী দেখছ বিবি? 

আপনাকে। 

আমাকে, আমাকে কেন? আমরা তো চল্লিশ বছর ধরে একসঙ্গে আছি।

আপনি তো চল্লিশ বছর ধরে একরকম মানুষ থাকেন নি। আপনার রঙ বদলায়। 

গালিব হাসতে হাসতে বলেন, কবি রঙ ভালোবাসেন। বসন্ত, শীত, নদী- গাছ ভালোবাসেন। কবির রঙ তো বদলাবেই। কবিরা এক রঙের হয় না। 

হয় না? কবি কি মানুষ না? 

প্রাণখোলা বুক ফাটানো হাসি হাসেন তিনি। তারপর হাসি থামিয়ে চোখ বড় করে বলেন, কবি মানুষের চেয়েও বড় অন্যকিছু। 

উমরাও বেগম হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন। আশ্চর্য হয়ে অনুভব করেন কবির দু’চোখ আকাশ হয়ে গেছে। মানুষটা তো ভালোই ছিল, শুধু সুরাসক্ত হয়ে সংসারটাকে ছারখার করেছে। সে জন্য উমরাও বেগমের মন বিষিয়ে গেছে। দুই নাতি হুসেন আর বাকির এই নিয়ে তাঁকে নানা প্রশ্ন করে। সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে তাঁর ভালো লাগে না। মন খারাপ করে স্বামীর সামনে থেকে সরে আসেন উমরাও বেগম। 

গালিব আবার কাগজ টেনে ঝুঁকে পড়েন টেবিলের ওপর। ডায়েরি লিখবেন ভেবে কয়েকটি বাক্য লেখা শুরু করেন, পুলিশের বড় কর্তাদের মেয়ে ও বউদের বাদ রেখে আর কারও অলঙ্কার লুণ্ঠন করতে দুর্বৃত্ত সিপাহিদের বাঁধছে না। এসব সিপাহি কাপুরুষ ডাকাতের দলে পরিণত হয়েছে। মেয়েদের অলঙ্কার হরণ করে, ঘরবাড়ি লুটপাট করে ওরা ধনী হয়ে উঠছে। আমি আমার বিবিকে যে কথা বলিনি তাহলো ওরা মেয়েদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ধর্ষণ করছে। এসব উন্মত্ত মানুষের কাছে নতিস্বীকার করা ছাড়া মেয়েদের আর কিছু করার নেই। হায় আল্লাহ, এই কি আমার প্রিয় দিল্লি? এই কি পূর্ণিমা রাতের শহর? জামা মসজিদ, লালকেল্লার ইজ্জতইবা কোথায় থাকছে? গালিব নিজে খুব বিপন্ন বোধ করছেন। বিপন্ন বোধ তাঁকে মরমে মারছে। গতকালই গুল মহম্মদ তাঁকে এসব কথা বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, অল্পবয়সী যে মেয়েরা আমাদের স্নেহ ও শ্রদ্ধা দিয়ে ভরিয়ে রাখত, এই নতুন ধনীদের শয়তানি ও ষড়যন্ত্রের কাছে আমরা মাথা হেঁট করে ফেলেছি। না, আমরা মাথা হেঁট করে ফেলতে বাধ্য হয়েছি। হায় আল্লাহ! গালিব মাথা ঝাঁকিয়ে আবার চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দেন। উঠে পায়চারি করেন, আবার এসে চেয়ারে বসেন। লিখতে থাকেন কয়েকটি পক্তি : ‘এদের স্বভাব এমন বিষময় যে অহঙ্কারের ঘূর্ণিঝড় মাত্র। কীভাবে গুরুত্বের কেন্দ্রে আসা যায়, শুধু সেই চিন্তাতেই মশগুল থাকত এই নিম্নজাতীয় মানুষগুলো। তারা যেন বুনো জলস্রোতের মধ্যেও ঘাসের পাতার মতো তাদের অহঙ্কারী মাথাটি জাগিয়ে রাখত। পণ্ডিত এবং অভিজাতরা ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত হলেন। অথচ এই নিচুমানের মানুষগুলো, যারা কখনও সম্পদ বা সম্মান কিছুই দেখেনি তারাও সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়ে সীমাহীন পর্যায়ে বড়লোক হয়ে গেল। এককালে যার বাপ রাস্তা ঝাঁট দিত সেও নিজেকে এখন এই নব্য বাতাসের শাসক বলে দাবি করছে। যার মাকে একদিন রান্নাঘরে আগুন জ্বালাতেও প্রতিবেশীদের দ্বারস্থ হতে হতো সেও এখন নিজেকে আগুন রাখার সার্বভৌম অধিকারী বলে ঘোষণা করেছে। এসব মানুষ আশা করছে, ভবিষ্যতে এরাই আগুন ও বাতাসকে পরিচালনা করবে।’ 

গালিব এটুকু লিখে থামলেন। ভাবলেন, যারা এমন একটি বিদ্রোহ ঘটাল তারা কীভাবে এতসব কুকাজে লিপ্ত হলো? অভিজাত শ্রেণীর সঙ্গে এখানেই নিম্ন শ্রেণীর মানুষের পার্থক্য। অভিজাতরা নিমক খেয়ে নিমকহারামি করে না, কিন্তু ছোট জাতের মানুষ সব কাজই করতে পারে। ওদের কোনো কিছুতে বাধে না। গালিবের শরীর রাগে চড়বড় করে। বুক ফুঁসে ওঠে। পরক্ষণে মনে হয় তাঁর বন্ধু হুসেন আলীর পাঁচটি চমৎকার সুন্দরী মেয়ে আছে। কেমন আছে ওরা? চিন্তা করতে গিয়ে ভয়ে কুঁকড়ে যায় গালিবের বুক। তারপর দ্রুত হাতে জামা টেনে গায়ে দিয়ে বেরিয়ে আসেন রাস্তায়। দ্রুতপায়ে মহল্লা পেরিয়ে আসেন। হুসেন আলীর বাড়ি বেশি দূরে নয়। কিন্তু পথে নেমে তাঁর চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়। রাস্তায় যত্রতত্র মানুষের লাশ পড়ে আছে। বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়েছে অনেক ব্রিটিশ নারী। চাঁদনিচকের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে তাঁর ক্রোধ বাড়তে থাকে। যেন দু’হাতে টুকরো করে ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে নিজেকে, নাকি অন্যদের? নাকি ভেঙে চুরমার করতে ইচ্ছে হচ্ছে লালকেল্লা? ওখানে কি আর কোনোদিন মুশায়রার আসর বসবে? না, কোনোদিন না বোধহয়। কে জানে ভবিষ্যৎ কোন সুতোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। গালিব নিজের বুকে ফুঁ দেন। যা হওয়ার হবে। ভবিষ্যৎ তো পূর্ণিমা রাত নয় যে, তাকে নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ আছে কিংবা একটি দারুণ প্রেমের কবিতা হবে? গালিব দ্রুতপায়ে হুসেন আলীর বাড়িতে এসে পৌঁছেন। 

দরজা হাঁ করে খোলা। ঘরের মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়ে আছে হুসেন আলী। চোখ খোলা, মুখ হাঁ করা। মুখের চারপাশে মাছি ভন ভন করছে। আশপাশে কোথাও কেউ নেই। হুসেন আলীর মৃতদেহের চারপাশে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। পুরো বাড়িতে আর কোনো লাশ নেই। গালিব দাঁড়াতে পারেন না। দ্রুতপায়ে বেরিয়ে আসেন। বুঝতে পারেন মেয়েগুলোকে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। কোথায়? যমুনার অপর পাড়ে কি? নাকি এই শহরের কোথাও? 

গালিব দ্রুতবেগে ছুটতে থাকেন। তাঁকে পালাতে হবে। কারও হাতে ধরা পড়া চলবে না। গালিব পালাচ্ছেন। গালিব, তোমার প্রিয় শহরে তুমি পালিয়ে বাঁচতে চাইছ। প্রিয় শহরে তুমি এখন আগন্তুক মাত্র, নাকি এই শহরে তুমি একজন অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষ? গালিব ছুটছে। তছনছ হয়ে যাওয়া শহরের অলিগলি পার হয়ে গালিব নিজের বাড়িতে আসেন। চারদিকে শব্দ তুলে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়েন, যেন ঘোড়ার খুরের প্রবল শব্দ ছড়িয়ে দিচ্ছেন চারদিকে। জানালা ফাঁক করে কেউ একজন দেখে নেয় যে দরজায় কে কড়া নাড়ছে। তারপর দ্রুত এসে দরজা খোলে। গালিব ধমক দিয়ে বলেন, এত দেরি হলো কেন দরজা খুলতে? 

কড়া নাড়ার শব্দ এত জোরে হয়েছে যে আমরা ভেবেছি বুঝি সিপাহিরা এসেছে বাড়িতে হামলা করতে। 

গালিব থমকে দাঁড়িয়ে বলেন, সিপাহিরা? 

দেখছেন তো হুজুর, ওরা কেমন লণ্ডভণ্ড করেছে শহর। এই শহরে আমি আর থাকব না। ঠিক করেছি চলে যাব। 

চলে যাবে? গালিব বিস্মিত হন। 

খুদাবক্স ডুকরে কেঁদে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমি শহরের রাস্তায় এত লাশ আর দেখতে পারছি না। হুজুর, রাস্তায় যে কোনো শব্দ হলেই আমার বুকের মধ্যে আজরাইল ঢুকে যায় বলে মনে হয়। শহরটায় থাকতে আমার ভূতের ভয়ও করে। মনে হয় এক্ষুণি এসে গলা চেপে ধরবে। নিজের পায়ের শব্দ শোনার পরও শহরে মানুষ আছে বলে আমার মনে হয় না। উহ্ আল্লাহ, মৃতদেহ নিয়ে কুকুরগুলো কামড়াকামড়ি করছে। শকুনগুলোকে দেখেছি মৃতের গোশত খেয়ে আর উড়তে পারছে না। আমাদের দেখলে দু’এক পা হেঁটে সরে যায় মাত্র। ডানা ঝাপটায় কোনোরকমে। ওদের গলা পর্যন্ত ভরে আছে পচা গোশতের স্তূপ। 

আহ্ খুদাবক্স চুপ কর! আর বলবে না। 

খুদাবক্স দু’হাতে চোখ মুছে গ্লাসে পানি ঢেলে গালিবের দিকে এগিয়ে দেয়। গালিব ঢক ঢক করে একটানে পানি খেয়ে গ্লাসটা টেবিলের ওপর রাখতে না রাখতেই উমরাও বেগম এসে ঘরে ঢোকেন। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? 

 গালিব উমরাও বেগমের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেন না।

কী হলো কথা বলছেন না যে? 

আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। 

উমরাও বেগম তাঁর কথায় কান না দিয়ে নিজের মতো ঝঙ্কার দিয়ে বলেন, এই খুনখারাবির শহরে কেউ রাস্তায় বের হয়? 

আমি হুসেন আলীর মেয়েদের খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। 

ফুঃ! মেয়ে! এই শহরের মেয়েরা আর মেয়ে নেই। ওরা লুটের মাল হয়েছে। 

গালিব দু’হাত উপরে তুলে পায়চারি করে বলেন, আমার দিল্লির এই চেহারা আমি দেখতে চাইনি। 

আপনার দেখতে চাওয়া-না চাওয়ায় কার কী এসে যায়? আপনার কাছে অস্ত্র নেই। অস্ত্র না থাকলে কি দুর্বৃত্তরা ভয় পায়? 

বিবি, তুমি আমাকে আর এসব কথা বলো না। আমি সহ্য করতে পারছি না। আহা, হুসেন আলীর ফুলের মতো মেয়েরা। এই শহরে ওরা হারিয়ে গেছে। ফুলের মতো পাঁচটি মেয়ে। একগুচ্ছ কুসুম। কুসুমগুচ্ছ ছিল ওরা। ওহ্ হো- 

উমরাও বেগম দোপাট্টায় চোখ মোছেন। গালিব নিজেও দু’হাতে চোখের পানি মোছেন। তাঁর শরীর কাঁপে থরথর করে। উমরাও বেগম তাঁকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেন। বলেন, লেবু দিয়ে এক গ্লাস শরবত আনব? 

হ্যাঁ, আন। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। এত পিয়াস যে মনে হয় যমুনা নদী পুরো খেলেও পিয়াস মিটবে না। 

উমরাও বেগম স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে যান। গালিব চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে শরীরের ভার ছেড়ে দেন। নিজেকে শুনিয়ে বলেন, দিল্লি শহর যদি খালি হয়ে যায়, যদি একজন মানুষও না থাকে তাহলে আমি আনন্দ করব। এই শহর ছেড়ে শহরবাসীরা চলে গেলে শহর নিয়ে আর কিসের চিন্তা। বাহ, তখন আমি দু’কান ভরে জান্তব উল্লাস শুনব। ভাবব, এসবই শোনার জন্য খোদা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই উল্লাস ধ্বনিই শ্রেষ্ঠ গজলের সুর! 

উমরাও বেগম ফিরে আসেন লেবুর শরবত নিয়ে। গ্লাসটা তাঁর সামনে ধরে বলেন, আপনি নিজের সঙ্গে কথা বলছিলেন? 

হ্যাঁ বিবি। নিজের সঙ্গেই কথা আমার। যখন বন্ধুরা একে একে দূরে চলে যায় তখন কার সঙ্গে আর কথা বলার থাকে? 

ঠিক, তাই তো। কে আর আছে আপনজন। আপনার ভাইয়ের খবর তো নিতে হয়। 

কাল্লু মিয়াকে পাঠিয়ে দেব আমার ভাইয়ের বাসায়। 

কালু রাস্তায় বের হতে চায় না। ও ভয় পায়। কালকে আমি ময়দা আনতে পাঠাতে চেয়েছিলাম, ও বের হতে চায়নি। ও আমাকে বলেছে, খরলকাবাজার ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। 

থাক, এসব কথা এখন থাক। 

আপনি একটু বিশ্রাম করুন। আমি আপনার বিছানা ঠিক করে রেখেছি। যান শুয়ে পড়েন। 

গালিব চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন। নিজেও মনে করেন যে তাঁর বিশ্রাম দরকার। তিনি শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আভিজাত্যের অহংবোধ ফুঁসে ওঠে। বারবারই মনে হয় ছোটলোকদের হাতে ব্রিটিশ নারীদের নিধন খুবই মর্মান্তিক। সহনীয় নয়। তাঁর বুকের ক্রোধ পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। শুয়ে থাকতে ভালো লাগে না। উঠে পড়েন। টেবিলে এসে বসেন। আঁকিবুকি আঁকেন কাগজে—হিজিবিজি রেখায় ভরে ওঠে কাগজ। তারপর নিহত ব্রিটিশ নারীদের মুখ স্মরণ করে লেখেন, সুন্দর মুখশ্রী, তন্বী নারী, তাদের মুখগুলো ছিল চাঁদের মতো উজ্জ্বল আর শরীরের বাঁকগুলো ছিল রুপোর মতো ঝকমকে। একটু লিখে তিনি আবার সোজা হয়ে বসেন। নিহত নারীদের কথা মনে করে তাঁর মাথা ভার হয়ে আসে। মনে হয় ঘাড় ব্যথা করছে। ঘাড়টা সোজা করে রাখাই কঠিন লাগছে। নিজেকেই বলেন, রাস্তায় পড়ে থাকা নারীদের পরনের স্কার্ট ও নেটকে রক্ষা করার বাধা দেওয়া কি তুমি দেখনি গালিব? দেখনি কি ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে বাধ দেওয়া কোনো সাফল্য? ব্রিটিশ প্রশাসন ছাড়া অন্য কোনো প্রশাসনে ন্যায় রক্ষার দায় কি তুমি দেখতে পেয়েছ গালিব? আমি তো ব্রিটিশদের কথা দিয়েই শুরু করব আমার ‘দস্তাম্বু’ লেখা। প্রতিদিনের ঘটনা দিয়ে শুরু হবে ‘দস্তাম্বু’–ওহ্ দস্তাম্বু, দস্তাম্বু—গালিব বিড়বিড় করতে করতে কাগজের পাতা উল্টে যান। দস্তাম্বু তাঁর প্রিয় শব্দ, মানে কুসুমগুচ্ছ। গালিব কুসুমগুচ্ছ নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে করেন একটি একটি করে উড়ে যাচ্ছে পাপড়ি, একটি একটি করে ঝরছে পাপড়ি। কুসুমের মতো দেখতে হারিয়ে যাওয়া মেয়েগুলো আর কোনোদিন ফিরে আসবে না এই শহরে। 

তখন তিনি কাগজ টেনে লিখতে থাকেন। ডায়েরির সূচনাটা হয় এভাবে : ‘এই বইয়ের পাঠকদের জানা উচিত যে, আমি ব্রিটিশদের নুন ও রুটি খেয়েছি। এবং আমার শৈশবের শুরুতেও পৃথিবী বিজয়ী বীর ব্রিটিশদের টেবিল থেকেই খাদ্য গ্রহণ করেছি। 

বছর সাত-আট আগে তাঁর দরবারে ডেকে পাঠিয়ে মুঘল বাদশাহ আমাকে তৈমুরি রাজবংশের ইতিহাস লিখতে বলেন এবং এ বাবদ বাৎসরিক ছয়শত টাকা পারিশ্রমিক দেবেন, এমন প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হয়ে আমি কাজ শুরু করি। ঘটনাচক্রে এ সময়ে বাদশাহর ওস্তাদের মৃত্যু হয়। বাদশাহর রচিত কবিতাগুলো সংশোধন করে দেওয়ার জন্য সেই স্থানে আমাকে নিয়োগ করা হয়। 

আমার বয়স হয়েছে, দুর্বল হয়ে পড়েছি, ক্রমেই আমি আমার নিজস্ব কোণের শান্তি ও নিঃসঙ্গতার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছিলাম। তাছাড়া কানে ক্রমেই কম শোনায় তা আমার বন্ধুদের পক্ষে অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। তাদের ভাষা বোঝার চেষ্টা করতাম শুধু ঠোঁট নাড়া দেখে। সপ্তাহে দু’বার বাদশাহর দরবারে উপস্থিত হয়ে বাদশাহর ইচ্ছানুসারে তাঁর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতাম। যদি তিনি তাঁর কক্ষ ছেড়ে উঠে না আসতেন তো বাড়ি ফিরে আসার আগে, অল্প সময় একটি প্রশস্ত কক্ষে নির্বাচিত শ্রোতৃমণ্ডলীর সামনে কিছুক্ষণ বসে অপেক্ষা করতাম। এ সময় আমার সদ্য শেষ করা লেখাগুলো নিয়ে যেতাম বাদশাহকে পড়ে শোনানোর জন্য। কখনও আবার পাঠিয়ে দিতাম পত্রবাহকদের হাতেও। এই ছিল আমার কাজকারবারের ধরন এবং বাদশাহর সঙ্গে সম্পর্কের ছবিটি। যদিও এই সামান্য সংযোজনটুকুই আমাকে কিছুটা শান্তি ও বিশ্রাম দিয়েছিল, দিয়েছিল দরবারের নানা বিতর্ক থেকে সরে থাকার অবকাশ। তবুও তা কোনোভাবেই আমাকে আর্থিক নিরাপত্তা বা বর্ধিষ্ণুতার আনন্দ কিছুই দিতে পারেনি।’ 

এটুকু লিখে তিনি থামলেন। বুকের ভেতর ক্ষোভ অনুভব করলেন। এভাবে জীবনের কত বছর কেটে গেল। কতকিছুই তো করতে হলো বেঁচে থাকার তাড়নায়। এখন আর বাকি কী? এখন অপেক্ষা করতে হবে নতুন করে দেখার জন্য। বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। কবিতার পক্তি মনে আসে। কাগজে লেখার আগে নিজে নিজে আওড়াতে থাকেন—আমি আমার ক্ষুধার অধীন, তাই রুটির জন্যই তো লেখা। 

মাথা সোজা করে আবার উঠে বসেন। সেই রাত্রির কতদিন হয়ে গেল, ভাবলেন চোখ বুজে। হিসাব করে দেখলেন, বাইশ দিন। দিনের আয়ু দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, ফুরিয়ে যাচ্ছে আরও কী যেন, কী— তা ভাবতে গিয়েও ভাবতে পারলেন না। কাগজের পৃষ্ঠায় ঝুঁকে পড়ল মাথা। লিখতে শুরু করেন, ‘সোমবার এক মধ্যাহ্নে অর্থাৎ ১৬তম রমজানের দিন, ১২৭৩ হিজরি পরবর্তী অর্থাৎ ১১ মে, ১৮৫৭ সালে লালকেল্লার দেওয়ালগুলো এমন এক শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয়ে কেঁপে উঠল যে শহরের আশপাশেও সেই কম্পন প্রতিধ্বনিত হলো। দিল্লির খোলা প্রবেশদ্বার দিয়ে মিরাট থেকে আসা অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী মাছির মতো ভন ভন করে উড়ে এসে উন্মাদের মতো তছনছ করে দিল দিল্লি শহর। যেখানেই তারা ইংরেজদের হাতে পেল, তা সে অফিসার বা অধঃস্তন যাই হোক না কেন, তাদের খুন না করে তারা থামল না। ইংরেজদের ঘরবাড়িগুলোও ধ্বংস করে দিল এই সিপাহিরা। আমার বাড়ির দরজা-জানালা সব ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েও ঘরের মধ্যে থেকে আমি তাদের চিৎকার ও চেঁচামেচির শব্দ শুনেছি। শুনেছি, লালকেল্লার অভিভাবক সেই ব্রিটিশ এজেন্টও খুন হয়েছেন। চারদিকে তখন পদাতিক সৈন্যদের দৌড়ানোর আওয়াজ আর অশ্বারোহীদের ঘোড়ার খুরের খটখট শব্দ। 

ওহ্ কী নৃশংসতা। ওহ্ কী বর্বরতা। 

বিড়বিড় করতে গিয়ে তাঁর কলম থেমে যায়। বলেন, নিয়মমতো ব্রিটিশরাই হিন্দুস্থানের একমাত্র শাসক। বিদ্রোহীকারীরা অকৃতজ্ঞ। ব্রিটিশরা যদি বিদ্রোহীকারীদের পরাস্ত করতে পারে তবে সেটাই হবে ন্যায় ও মঙ্গল প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আমি তো এমনই চাই। এখন আমার ঘরে সুরা নেই। সুরার তৃষ্ণায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। দিনগুলো যে কেমন কাটছে তা আমি আর কাকে বোঝাব। বোঝার জন্য কেইবা আছে এই শহরে। এমন আতঙ্ক নিয়ে, এমন বর্বরতা সহ্য করে শহরের দিনগুলো দোজখ হয়ে গেছে। দোজখ, দোজখ। দোজখ চারদিকে। আর কে না জানে, সিপাহিরা ঘোড়ায় চড়ে মোগল সম্রাটের প্রাসাদে গিয়েছিল। তাদের মাথায় পাগড়ি তো ছিলই না, পোশাকও নিয়মমাফিক ছিল না। যেনতেন পোশাকে যে রাজদরবারে যাওয়া যায় না, এটা তারা জানত না। অথচ ব্রিটিশ আধিকারিকদের আদব- কায়দাই ছিল ভিন্নরকম। তারা যথাযথ পোশাকে সজ্জিত হয়ে সবসময় রাজদরবারে গিয়েছে। এমনকি তারা দেওয়ানি প্রবেশ দ্বারে ঘোড়া থেকে নেমে হেঁটে প্রাসাদে ঢুকেছে। অভিজাতদের সম্মান জানাতে তারা কখনও কুণ্ঠিত ছিল না। কিন্তু বর্বরদের আচরণই ভিন্ন। তিনি শুনেছেন বাদশাহ ব্রিটিশ আধিকারিকদের কাছে সিপাহিদের আচরণের বিরুদ্ধে নালিশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সিপাহিদের তাচ্ছিল্যপূর্ণ ব্যবহার অসহনীয়। তার উপস্থিতিতে তারা যে অশালীন আচরণ করেছেন তা খুবই নিন্দনীয়। 

আসলে সিপাহিরা তাদের নতুন পাওয়া ক্ষমতা আর দিল্লি জয়ের খুশিতে এমন সব ভাবভঙ্গি করতে থাকে যে, তার দ্বারা বোঝা যায় তারা অভিজাতদের ন্যায্য সম্মান দেখাতে একদমই ইচ্ছুক নয়। ভাবটা এমন, তারা অভিজাতদের তোয়াক্কাই করে না। ওরা আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করার একদল মানুষ, যারা শহরটাকে পায়ের নিচে রেখে বিজয়ের আনন্দে গর্বিত। হায় আল্লাহ, এই জীবনে এসব আমাকে দেখতে হচ্ছে। আমি তো আমার কবিতার কাছে নতজানু। আমি আর কারও কাছে নতজানু নই। আমি তো জানি, আমি কোথায় আছি। কী আমার পরিচয়। কবি ও পণ্ডিত ছাড়াও আমার আরও পরিচয় আছে। 

জন্মসূত্রে আমি একজন নামী অভিজাত পরিবারের সন্তান। হিন্দুস্তানের অভিজাত সমাজ ছাড়াও সাধারণ মানুষ আমাকে চেনে। রাজা-মহারাজারা আমাকে এক নামে চেনে। আর হাতেগোনা যে ক’জন মানুষকে ব্রিটিশরা অভিজাত বলে স্বীকার করেন, গালিব তাদের একজন। অন্যতমই বলা উচিত। এসব ভাবনাকে আমি বাড়াবাড়ি বলে মনে করি না। সিপাহিরা যে আচরণ করছে তা অভিজাতদের অপমান করার চেয়েও বেশি। 

তিনি ফিরে এলেন টেবিলে। লিখলেন, ‘এই বিচারহীন-বিবেকহীন পরিস্থিতির কীভাবেইবা বর্ণনা করব। যেসব শ্রমজীবী মানুষ সারাদিন ধরে মাটি কোপাত এখন সেখানেই তারা সোনার টুকরা খুঁজে পেয়েছে। আর বাদবাকি যারা অর্থাৎ যাদের জমায়েতে ফুল ফুটত তারাই ডুবে গেছে হতাশায়।’ 

কোনোকিছুই ভালো লাগছে না ভেবে চেয়ার থেকে উঠে পড়েন তিনি। বালতির পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে মাথা ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করেন। তারপর বিছানায় এসে শুয়ে পড়েন। মনে হয় অসহ্য গরম তাঁর শরীরের সবটুকু শুষে নিচ্ছে। এ বছরটি তিনি হয়তো পার করতে পারবেন না, এমন একটা ভাবনা তাঁকে মনমরা করে ফেলে। তিনি চিৎ হয়ে শুয়ে বড় বড় শ্বাস টানেন। 

.

কয়েকদিন পরে খবর পান যে, হিন্দন নদীর ধারে ব্রিটিশ সৈন্যদের সঙ্গে সিপাহিদের লড়াই বেধেছে। বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে ব্রিটিশরা। উৎকণ্ঠিত হয়ে থাকেন গালিব। কয়েকদিন ঘর থেকে বের হন না। শরাব নেই বলে মেজাজ খিঁচড়ে থাকে। খিটিমিটি বাধে স্ত্রীর সঙ্গেও। এমনিতে তো পানাসক্ত-নেশাখোর স্বামীর সঙ্গে মাঝে মধ্যে বিরূপ আচরণ করেন, তাঁকে সহ্যই করতে চান না। কখনও ভালো ব্যবহার করেন, মনেই হয় না যে তাঁর সঙ্গে তিনি কখনও দুর্ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু ইদানীং মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। 

একদিন সকাল বেলা উমরাও বেগম হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে বললেন, শুনেছেন খবর? 

গালিব চোখ বড় করে তাকিয়ে বললেন, কোন খবর? 

হিন্দন নদীর ধারে সিপাহিদের সঙ্গে ইংরেজদের যে লড়াই হচ্ছিল সেখানে ইংরেজরা জিতেছে। 

জিতেছে? তিনি উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েন। উমরাও বেগম নিজেও উজ্জ্বল মুখে জোরেজোরে বলেন, হ্যাঁ, ইংরেজরা জিতেছে। আমাদের সুদিন বোধহয় আসবে। 

ঠিকই বলেছ বিবি। মানির মান রক্ষা হবে। ওই সিপাহিরা তো অভিজাতের মর্যাদা দিতে জানে না। বাদশাহকেও ওরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। একদিন এই মুঘলরাই তো ইসলামের ধ্বজা উড়িয়ে হিন্দুস্তানে প্রবেশ করেছে। বীরের বেশে প্রবেশ করেছে। ওহ্ খোদা মেহেরবান। বিবি তুমি কি আমাকে কিছু খাওয়াবে? 

আপনার জন্য পেস্তাজল আর মিছরি দিয়ে শরবত বানিয়ে আনব?

তুমি কি আমাকে রোজকার মতো সাতটি পেস্তাজল দেবে?

ওই কয়টাই তো আপনার সকালের নাশতার জন্য বরাদ্দ। 

আজ এই খুশির দিনে তুমি আমাকে দুটি পেস্তাজল বেশি দিও। 

উমরাও বেগম মৃদু হেসে বলেন, আচ্ছা। তবে শহরের যা অবস্থা তাতে আর কতদিন আমরা এসব জিনিস খেতে পারব তা আল্লাহপাকই জানেন। 

গালিব চুপ করে থাকেন। তাঁর বুকের ভেতর আনন্দের ঢেউ গড়ায়। সামনে ভালো দিন আসবে। শরাব পিয়ে বুঁদ হয়ে থেকে চাঁদনি রাতে হেঁটে যাবেন যমুনার ধারে। দেখবেন নদীর পানিতে মিনারের ছায়া, দেখবেন অলৌকিক দৃশ্যে পূর্ণ দিল্লির সৌন্দর্য। ওহ দিল্লি, দিল্লি! আমার জীবন। 

উমরাও বেগম পেস্তাজল আর শরবত নিয়ে আসেন। গালিব রেকাবি থেকে পেস্তাজল তুলে মুখে দেন। আজ মুখে অরুচি নেই। খেতে ভালোই লাগছে। হাসতে হাসতে বিবিকে জিজ্ঞেস করেন, দুপুরে কী খাব? 

গোস্তের সুরুয়া আর তন্দুরি। 

ঠিক আছে, তাই হবে। তারপর জোরে জোরে নিজেরই কবিতা বলতে থাকেন : 

‘রাত-দিন গর্দিশ মেঁ সাত আসমান 
হো রহেগা কুছ কুছ ঘাবড়ায়ে ক্যা? 
‘সাতটি আকাশ রাত-দিন টালমাটাল হয়ে আছে 
কিছু না কিছু হবেই। ঘাবড়ানোর কী আছে?’ 

উমরাও বেগম হাঁ করে স্বামীকে দেখেন। মানুষটা এভাবে জীবন কাটিয়ে দিল। বলা যায়, তাঁর দিনগুলো আকাশের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। সেগুলো কোথায় কোথায় গিয়ে পড়ল তার আর খোঁজ রাখল না। হায়, মানুষটা এমনই! তাঁকে নিয়ে তিনি সুখও পেলেন না, দুঃখও বুঝলেন না। তাঁকে এসব কথা বলা যায় না। বললে তিনি কোনো কবিতার লাইন বলে হাসবেন। 

‘জীবনের ছুটন্ত ঘোড়া জানি না কোথায় থামবে। হাতে লাগাম নেই, রেকাবেও পা নেই।’— উমরাও বেগম নিজের মনে শেরটি আউড়ে ভাবলেন, এমন মানুষকে বোঝার সাধ্য তাঁর নেই। তাঁর বন্ধুদের কাছে শুনতে পান যে তিনি খুব বড় কবি। থমকে যায় উমরাও বেগমের চিন্তা। বড় কবিই যদি হবেন, তবে এমন জ্বালাপোড়ার জীবন কেন? 

তখন গালিব রেকাবির পেস্তাজল শেষ করেন। এক চুমুকে শেষ করেন মিছরির শরবত। স্ত্রীর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেন, বিবি তোমার কি মনে আছে আমি কবে শায়ের লিখতে শুরু করলাম? 

হ্যাঁ, বিলকুল মনে আছে। 

মনে আছে? বলতো তখন আমার বয়স কত ছিল? 

গালিব এক মুহূর্ত থমকে থেকে বিমর্ষ কণ্ঠে বলেন, এই শহরটা এখন আমার কৈশোর-যৌবনের সময় না। এখন কবিতার কথা বলার সময় না। 

উমরাও বেগম মৃদু কণ্ঠে বলেন, তারপরও আপনি কবিতার কথা বললেন। ঠিকই বলেছ। বিয়ের পরে আমি যখন দিল্লিতে আসি তখন আম্মা আমাকে বলেছিলেন, ‘বেটা শায়েরই সব নয়। মানুষ হতে হবে।’ আমি আমার আম্মাজানের কথা ধরেই মনে করেছিলাম যে, মানুষ তো আমি হবো। তবে শায়েরের হাত ধরে। শায়েরকে আমি ছাড়ব না। শায়ের লেখা বাদ দিলে সেটা . হবে আমার মৃত্যুর সমান। আমার কাছে এমন মৃত্যু কাম্য হতে পারে না। 

উমরাও বেগম কিছু বলার আগেই তিনি দু’হাতের মুঠিতে তাঁর ডান হাত নিয়ে বলেন, তুমি অনুমতি দিলে বাবুর্চি আমার জন্য ঘরে একটু সুরা বানাতে পারে। দেবে অনুমতি? 

উমরাও বেগম এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। গালিব বিষণ্ণ মনে বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে। গলি ফাঁকা। আশপাশের বাড়ির জানালাগুলোও খোলা নেই। কেউ হয়তো উঁকি দিয়ে বাইরে তাকায়, আবার বন্ধ করে দেয়। তিনি গলির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকেন। পাশের বাড়ি থেকে মোস্তফা জং বেরিয়ে এসে বলেন, আপনাকে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখে বের হয়ে এলাম। ভয়ে আতঙ্কে এই বন্দিজীবন কাটাতে আর পারছি না। কবে এর শেষ হবে কে জানে! 

গালিব নিস্পৃহ কণ্ঠে বলেন, আপনি ভালো আছেন তো? বাল-বাচ্চারা? বিবি? 

আমার পরিবারের কেউই ভালো নেই। অসহ্য গরম। গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েছে বাল-বাচ্চারা। এদিকে হেকিম নেই, ওষুধ নেই। কী করব, কোথায় যাব বুঝতে পারি না। 

আর একটি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন আলতফ। অন্যান্য বাড়ি থেকে আরও দু’একজন। ছোটখাটো জটলা তৈরি হয়। কিন্তু কেউই প্রাণখুলে কথা বলতে পারেন না। ভয়ে চুপসে আছেন সবাই। তারপরও কেউ কেউ মুখ খুলেন। কুশল বিনিময় করেন। 

আপনাকে দেখে এই প্রথম ঘর থেকে বের হয়েছি মির্জা সাহেব। 

ভালো আছেন তো? 

ভালো? এই শহরে কেইবা ভালো থাকবে! 

গালিব তিক্ত কণ্ঠে বলেন, সিপাহিরা দেশপ্রেমিক ঠিকই, কিন্তু লুট করার মতো লোভের উপরে উঠতে পারেনি। 

এই আচরণ আমাদের খুব কষ্ট দিচ্ছে। 

গালিবের কথায় সায় দেয় আলতফ। ওরা ইংরেজ খোঁজার অছিলায় ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে, তারপর লুটপাট করে বেরিয়ে যায়। অথচ ভাবটা করে যেন যে ঘরে ঢুকেছে, সে ঘরে লুকিয়ে থাকা একজন ইংরেজকে ঠিকই খুঁজে পাবে। আসলে ওরা নির্লজ্জের মতো তালা ভাঙে, জানালা-দরজা খুলে নেয়, ঘরের জিনিসপত্র তছনছ করে, যা ইচ্ছা তা কেড়ে নিয়ে চলে যায়। আমরা তো এ দেশেরই মানুষ। আমরা তো ওদের শত্রু নই। 

এটুকু বলে আলতফ থামেন। এর-ওর মুখের দিকে তাকান। দেখতে পান গালিব ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। পরক্ষণে মুখ ফিরিয়ে বলেন, আমার মতো অভিজাত পরিবারের মানুষের পক্ষে এসব মেনে নেওয়া কঠিন। আমি ক্ষুব্ধ, মর্মাহত। সিপাহিরা ভীষণ ক্রুদ্ধ এবং স্বৈরাচারী। ওরা নিজেরা বুঝতে পারছে না যে ওরা কী করছে। 

ঠিক বলেছেন। আমাদের মহল্লা পাতিয়ালের নবাবের অধীন বলে আমরা এই বর্বরতার মধ্যে পড়িনি। 

আর একজন দু’হাত উপরে তুলে আড়িমুড়ি ভাঙার ভঙ্গিতে বলেন, তাও ভালো যে আমরা এখানে দাঁড়িয়ে দু’দণ্ড কথা বলতে পারছি। 

খোদা মেহেরবান। যাই, বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। ওরা দেখতে পেলে বন্দুক উঁচিয়ে ছুটে আসবে। 

একে-দুয়ে যে যার বাড়িতে ঢুকে পড়েন। গালিব একা দাঁড়িয়ে থাকেন। চারদিকে তাকান। ভাবেন, এ মুহূর্তে তাঁর আত্মা মহেশ দাশকে খুঁজছে। সেই হৃদয়বান অসাধারণ মানুষটি যে তাঁকে শরাব দিয়ে তার বেঁচে থাকার সাধ পূর্ণ করেছিল। তার কথা লিখতে হবে দিনলিপি ‘দস্তাম্বু’তে। নিজেকে শুনিয়ে তিনি বললেন, সত্য কথা লুকিয়ে রাখা কোনো স্বাধীনচেতা ব্যক্তির কাজ নয়। যে এটা করে সে ভীরু কাপুরুষ। আমি অবশ্যই এই গোত্রের মানুষ নই। বুক টানটান করে সবকিছু অকপটে স্বীকার করতে পারি। আমি স্বভাবের কাছে নতিস্বীকার করা মানুষ। স্বীকার করবইবা না কেন? যা ভালো লাগবে তাকে কাছে টানব। আত্মার ক্ষুধা মেটাব। আমি ধর্ম থেকে মূক্ত মানুষ। এজন্য লোকে আমার বদনাম করে। তাতে কিছু এসে যায় না। যার যা খুশি বলুক। বলে যদি ওরা শান্তি পায় তো পাক। শান্তি আমারও খুব প্রিয় শব্দ। তারপরও আমি দুর্নামের ভয় থেকে মুক্ত। আমাকে স্পর্শ করে কার সাধ্য! পরক্ষণে আবার বিষাদাক্রান্ত হন তিনি। ঘুরে-ফিরে মহেশের কথা মনে হচ্ছে। এখন ও কোথায় আছে তিনি তা জানেন না। মহেশের দুটি ফুলের মতো মেয়ে আছে। আহ্, ওরা এখন কোথায়? তাঁর মনে হয় রাস্তার ওপর বসে চিৎকার করে কাঁদতে। তাঁর তো অনেক বছরের অভ্যাস রাতে ঘুমানোর আগে ফরাসি মদ পান করা। নইলে তাঁর ঘুম আসত না। কিন্তু ফরাসি মদ সবসময় কোথায় পাওয়া যাবে! অত অর্থই বা কই? মহেশ দাশ দিলদরিয়া যুবক। ফরাসি মদের মতো দেখতে হিন্দুস্তানি শরাব তাঁর জন্য নিয়ে এসেছিল। সেই শরাবের গন্ধও ভালো ছিল। তখন সেটা মহেশ তাঁকে না দিলে কী যে কষ্ট হতো ভাবতেই এখন বুক কেঁপে ওঠে। তখন তিনি গলির মধ্যে পায়চারি করতে করতে তাঁর নিজের লেখা প্রিয় রুবাইটি আওড়াতে থাকেন— 

‘বহুদিন থেকে আমার ইচ্ছা ছিল যে আসল শরাব পাই 
দু’এক পেয়ালা আমার ঠোঁট পর্যন্ত পৌঁছে যেন যায় 
জ্ঞানী মহেশ দাশ আমাকে এই অমৃত জুগিয়ে যায় 
যাকে আপন তরে খুঁজতে সিকান্দর বেরিয়েছিল হায়।’ 

ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ফজলে, হুজুর ঘরে চলুন। আপনার খানা তৈরি হয়েছে। 

খানা? খকখক করে কাশেন তিনি। 

ফজলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ভাবে, হুজুরের এমন কাশি আগে ছিল না। এখন তো শীতকাল নয় যে তাঁর ঠাণ্ডা লেগেছে। এই ঘোর গ্রীষ্মে হুজুর এমন করে কাশছেন কেন? ফজলে চিন্তিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কাশি থামলে ফজলে জিজ্ঞেস করে, হুজুরের শরীর ঠিক আছে তো? 

শরীর? শরীরের ভেতরে পচা মাংসের গন্ধ ঢুকে যমুনা নদী হয়েছে। ওখানে এখন শেয়াল-শকুনের আস্তানা তৈরি হয়েছে। আমি তো জানি না আমার বন্ধুরা কেমন আছে? 

হুজুর ঘরে চলুন। 

এই শহরে এখন আমার আত্মার জন্য কোনো পানীয় নেই। আমি পাগলের মতো আমার যুবক বন্ধু মহেশ দাশের জন্য অপেক্ষা করছি। ও কি একদিন আমার দরজায় দাঁড়িয়ে ঠুকঠুক শব্দ করবে? দরজা খুললে বলবে, কবি আমি এসেছি। আর আমি দেখতে পাব ওর হাতে আছে হিন্দুস্তানি শরাবের বোতল। হুজুর, খোদার ইচ্ছায় এমন ঘটনা ঘটতেও পারে। সেটা আজ রাতেও হতে পারে। 

আজ রাতে? গালিবের দু’চোখ বড় হয়ে যায়। 

খোদা মেহেরবান হুজুর। 

কিন্তু আমি তো খোদার বিশ্বাসী বান্দা নই। আমি তো নিজের কথা শুধু ভেবেছি, তাকে দিনে পাঁচবার স্মরণ করিনি। তিনি কেন আমাকে দয়া করবেন? আমি তো পাপী গুনাহগার। 

বলতে বলতে ঘরে ঢুকে যান গালিব। দেখতে পান দস্তরখানার ওপর খানা দেওয়া আছে। ফজলেকে বলেন, তেল- গামছা নিয়ে আস। গোসল করব। পানি চাই, অনেক পানি। শরীর যেন জুড়িয়ে যায়। 

একটু আগে আপনি কাশছিলেন হুজুর। 

ওটা কাশি নয়। ওটা ছিল যন্ত্রণা আর মৃত্যুর শব্দ। কাশির বার্তা হয়ে এসেছে। যা বলেছি তা কর। বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? 

ফজলে সরে পড়ে। তেল- গামছা নিয়ে ও আসার আগেই উমরাও বেগম ঢোকেন। 

আপনার নাকি তবিয়ত আচ্ছা নেই? 

বিলকুল ঠিক আছে। চাকর-বাকরের কথা শুনতে হয় না। ওরা কবিকে কীভাবে বুঝবে? ওদের সাধ্যইবা কি? 

উমরাও বেগম আর কী বলবেন বুঝতে পারেন না। বিষণ্ণ বোধ করেন। ফজলে তেল-গামছা নিয়ে এলে গালিব নিজেকে জাজিমের ওপর ছেড়ে দেন। ফজলে পুরো শরীরে তেল মাখিয়ে দিলে তিনি স্নানঘরে ঢোকেন। ফজলে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। ও শুনতে পায় পানি পড়ার শব্দ। তিনি ইচ্ছেমতো ভিজছেন। আর চিৎকার করে গজল গাইছেন। মানুষটার জন্য ভীষণ মায়া হয় ফজলের। ও ভেবেছিল, এই শহর থেকে চলে যাবে, কিন্তু এখন ভাবে এই মানুষটাকে রেখে ও কোথাও যাবে না। মানুষটাকে আরও বেশি করে যত্ন করবে। তাঁর জন্য শরাব খুঁজতে বের হবে। নিজের জান হাতে নিয়েই ও কাজটি করবে। ও নিজে নিজে কসম কাটে। 

সেই বিকেলেই দরজায় টুকটুক শব্দ হয়। শব্দ শুনে কান খাড়া করেন গালিব। মহেশ দাশ কি? ও এলেই এমন শব্দ করে। খোদা মেহেরবান, গুনাহগার বান্দাকে দয়া করেছেন। নিশ্চয় মহেশ দাশই হবে। কেউ একজন এসে দরজা খোলে। 

দরজায় দাঁড়িয়ে মহেশ দাশ মৃদুকণ্ঠে বলে, হজরত! 

গালিব দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরেন মহেশকে। বলেন, তুমি কি আমাকে বাঁচাতে এসেছ বন্ধু! 

কবিকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবেই। কবিই তো পৃথিবীর মানুষের আত্মার ক্ষুধা মেটায়। 

মহেশ জামার ভেতর থেকে হিন্দুস্তানি শরাবের বোতল বের করে। গালিব বোতল দু’হাতে ধরে চুমু খান। তারপর কাছে দাঁড়িয়ে থাকা কাল্লুকে বলেন, জলদি পেয়ালা আনো। দু’জনে শতরঞ্জির ওপর বসেন। বোতলটাকে দু’হাতে ধরে রেখেই বলেন, এই গদর, গদর শুরু হওয়ার পর থেকেই আমি দরজা বন্ধ করি। মাঝে মাঝে হাঁফ ছাড়ার জন্য একটু-আধটু বের হই। কিন্তু এই বিদ্রোহের ঝামেলা আমার সহ্য হয় না। বাইরে বের হতে ইচ্ছে করে না। পাতিয়ালার মহারাজা হাকিম মহম্মদ খাঁয়ের নিরাপত্তার জন্য পাহারা বসিয়েছিলেন। তাঁর প্রতিবেশী হওয়ার ফলে আমরাও, এই গলির মানুষেরা, নিরাপত্তা পাই। তাই বিজয়ী সিপাহিদের লুটপাটের হাত থেকে রেহাই পাই আমরা। বুঝলে বন্ধু, নেক বান্দাদের খোদাতালা এমন কিছু দয়া দেখান, গুনাহগাররা তা অনেক সময় বুঝতে পারে না। 

মহেশ দাশ মৃদু হেসে বলে, হজরত, নির্জন ঘরে বসে গদরের ঘটনা লিখতে শুরু করেছেন কি? এখন তো আপনার বন্ধুদের আড্ডা নেই। 

হ্যাঁ, আমি লিখছি। আমাকে তো লিখতেই হবে। তবে কথা কি জানো, লেখায় সবসময় মন বসে না। আমার বাড়ি থেকে অল্প দূরে আমার ভাই থাকে। তুমি তো জানো সে পাগল মানুষ। একজন বয়স্ক দাসী, আর একজন দারোয়ান তার সঙ্গী। এখন পর্যন্ত তার খবর ঠিকমতো পাইনি। বন্ধু, তুমি তো জানো আমার ভাইটি আমার ছোট। আমি তাকে খুব ভালোবাসি। আমি যখন দিল্লিতে বাস করতে আসি তখন তাকেও নিয়ে আসি। আমরা দু’ভাই ছাড়া আমাদের আর কোনো ভাই নেই। ত্রিশ বছর বয়সে ভাইটি পাগল হয়ে যায়। 

এই সময় পেয়ালা নিয়ে আসে কাল্লু মিয়া। তিনি খুব যত্ন করে শরাব ঢালেন। খুশিতে চকচকে দৃষ্টি নিয়ে মহেশের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলেন, শুকরিয়া বন্ধু 

শুকরিয়া জানাতে হবে না হজরত। আমি তো জানি আমার মতো আপনার অগণিত বন্ধু শুধু দিল্লিতে নয়, সারা হিন্দুস্তানে আছে। আপনার বন্ধুরা আপনাকে খুব ভালোবাসে। 

গালিব মৃদু হেসে বলেন, আমার নিন্দুকও অনেক। তারা আমাকে কাফের বলে, মাতাল বলে, ধর্মভ্রষ্ট বলে। 

তাতে আপনার কিছু এসে যায় না। আপনি মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব। আপনি হিন্দুস্তানের রত্ন। উর্দু ভাষায় আপনার মতো কবি কমই আছে। 

গালিব দ্রুত মদপান করেন। মহেশের কথার উত্তর দেন না। 

তারপর পেয়ালা নামিয়ে রেখে বলেন, বুঝলে বন্ধু, শরাব ছাড়া আমার হাতের কলম চলে না। শরাব হলো ধোঁয়াহীন আগুন। আমি ওই আগুনকে বলি, কোথায় তুমি? গদরের পর থেকে আমার এমনই মনে হচ্ছে। আমি আগুন খুঁজছি, ওই তরল গলায় ঢাললে তা আমার শরীরের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে যায়। আগুনের হলকা ছোটে। মন নেচে ওঠে। মাথা বিলকুল সাফ হয়ে যায়। আমার শের আগুনের ফুলকি হয়ে ওঠে। তাই শরাব ছাড়া আমি কিছু বুঝতে পারি না। আমি মাতাল হতেই তো ভালোবাসি বন্ধু। তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ। তুমি শরাব পান কর না। আমি তোমাকে শরাব পান করতে বলিনি। 

হজরত, আমি এখন যাব। 

হ্যাঁ, যাও। দেশপ্রেমিক সিপাহিদের হাতে তুমি নাজেহাল হবে না আমি এই আশা কি করতে পারি? 

করতে পারেন। কারণ আমি ওদের লোক। ওদেরকে সমর্থন করি। 

সাবাস, সাবাস বন্ধু। মনে রেখো এই অধমের কথা। 

আমি নিজে আসতে না পারলে আপনাকে বোতল পাঠিয়ে দেব। 

শুকরিয়া, শুকরিয়া বন্ধু। 

তিনি নিমগ্নচিত্তে শরাব পান করেন। বাড়ির ভেতর থেকে কয়েকটি শামি কাবাব আসে। রাতের জন্য এই তাঁর বরাদ্দ। তিনি খুশিমনে রেকাবি টেনে নেন। আজকের রাত যমুনায় পূর্ণিমা দেখার মতো রাত। গদর শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি তো একটি রাতও ঠিকমতো ঘুমুতে পারেননি। আজ ঘুমুবেন। এক ঘুমে রাত পার হয়ে যাবে। 

.

কিছুদিন পর থেকেই নানা ঘটনা ঘটতে থাকল। বদলির যুদ্ধে জিতল ব্রিটিশরা। এই বিজয় সিপাহিদের হতোদ্যম করতে পারেনি। তাদের মনের জোরে প্রভাব ফেলেনি। দিল্লিতে তারা বিজয়ের আনন্দে নানা কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করে যাচ্ছিল। ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবেনি যে, দুটি যুদ্ধে ব্রিটিশরা জিতলেও শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশরা ওদের সামনে টিকে থাকতে পারবে। ওরা ঠিকই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এ দেশ থেকে ওদের পাততাড়ি গুটাতেই হবে। 

অন্যদিকে আরাবল্লী পর্বতের পাদদেশে ব্রিটিশদের অবস্থা খুব শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। সংখ্যায় তারা কমে গিয়েছিল। রসদের জোগানও কমে গিয়েছিল। অতিরিক্ত সৈনিকের যে দরকার ছিল তারও ব্যবস্থা ছিল না। নানা কারণে সিপাহিদের বিজয়ের উৎসব ধরে রাখার অবস্থা ছিল বলে মনে করা হচ্ছিল। দিল্লির অধিবাসীরা অনেকে একত্র হয়ে নানা পরিকল্পনায় মেতে উঠেছিল। সেই প্রাণবন্ত সময়টি অনেককে আশাবাদী হয়ে ওঠার জায়গা তৈরি করে দিয়েছিল। 

গ্রীষ্মের দাবদাহ মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে পেটের অসুখ ও ম্যালেরিয়া জ্বর। একে-দুয়ে অনেকে মারা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে উমরাও বেগম সামনে এসে দাঁড়ান। গালিব লেখার খাতা থেকে চোখ তুলে বলেন, কিছু বলবে বিবি? 

চারদিকে মানুষের খুব অসুখ হচ্ছে। 

মানুষ বেঁচে থাকলে তার তো অসুখ হবেই। অসুখ হওয়া শরীরের স্বাভাবিক নিয়ম। কেউ এই নিয়মের বাইরে থাকতে পারবে না। 

আপনি বিষয়টিকে খুব সোজা করে দেখছেন। 

গালিব হেসে উঠে বলেন, শুধু সোজা নয়, বিষয়টি আমার শরাবের মতো তরলও। 

ব্রিটিশরা আরেকটি যুদ্ধে জিতেছে। 

তাতে সিপাহিদের প্রাণশক্তির দেয়ালে আঘাত লাগেনি। অনেক নতুন নেতা হয়েছে। আমাদের আরও অনেক কিছু দেখতে হবে। 

আমার মনে হচ্ছে আপনার তবিয়ত ঠিক নেই। 

বিলকুল ঠিক আছে। হুসেন ও বাকির কী করছে? জানি না। ওরা ভালোই আছে। জ্বর হয়নি। 

তোমার মন খারাপ বিবি? 

খারাপ তো হবেই। সাতটি সন্তানের জন্ম দিয়েছি। একটিও বেঁচে নেই। যিনি তাদের দিয়েছিলেন, তিনিই আবার নিয়ে গেছেন। বান্দার কী করার আছে। আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি না, সুরা পান করি বলে তুমি আমাকে দোষারোপ করো। কিন্তু তুমি পাঁচবার নামাজ পড়েও খোদাতায়ালার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছ। আমি কখনও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করি না। আমি আমার মতো করে খোদার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। 

উমরাও বেগম মুখ ঝামটা দিয়ে বের হয়ে যান। গালিব মৃদু হাসেন। এভাবেই তো জীবন কাটিয়ে দিলেন। এভাবেই তো জীবনের আনন্দ-বেদনার দিন গুনে চলেছেন। এমন কে আছে যে, দিনযাপনের খতিয়ানে অনবরত ফুল ফোটাবে, গন্ধ ছড়াবে? আরিফের দুই সন্তান নিয়ে তাঁর খুব ভালো দিন কাটছে। শিশুরাই জগতের শ্রেষ্ঠ ধন। তাই বলে নিজের সন্তান না থাকার কারণে খোদাতালার কাছে তাঁর কোনো অভিযোগ নেই। জগৎপিতা দিয়েছিলেন, আবার নিয়ে গেছেন, সবই তাঁর ইচ্ছা। 

ক’দিন পর তাঁর সাগরেদ হালি আসেন। ছোট্ট কুঠুরির দরজা দিয়ে মাথা নিচু করে ঢুকে শতরঞ্জির ওপরে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়েন। গালিব নিজে একা একা দাবার ঘুঁটি চালছিলেন। এটি তাঁর প্রিয় খেলা। হালির দিকে না তাকিয়েই বললেন, কী খবর হালি? সিপাহিদের খবর কী? 

হালি গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, ব্রিটিশদের সঙ্গে দুটি যুদ্ধে হারলেও সিপাহিদের মনোবল অটুট আছে। তারা নিজেদের দারুণভাবে সংগঠিত করেছে। আরাবল্লী পর্বত বরাবর আক্রমণ চালিয়েছে। 

গালিব মুখ না তুলেই বলেন, সাবাস। বাদশাহর খবর কী? 

বাদশাহ ঠিকই আছেন। সিপাহিরা এমনই অনুমান করেছিল যে, বাদশাহ তাদের নেতৃত্ব দিতে ভুল করবেন না। বাদশাহর বড় ছেলে মির্জা মোগলকে প্রধান সেনাপতি করা হয়েছে। মন্ত্রী করা হয়েছে তার ছোট ছেলে জোয়ান বখতকে। কোতোয়ালকে বলা হয়েছে তার নিজের যে কাজ তা দেখাশোনা করতে। 

বাহ, তুমি তো বেশ অনেক খবর রাখ দেখি। 

গালিব চোখ তুলে তাকান। সকৌতুকে হালিকে দেখেন। 

হালি গালিবের দৃষ্টি উপেক্ষা করে বলেন, সব খবরই রাখতে হবে। পিছিয়ে থাকার মানে নেই। আমি বুঝতে পারছি বিদ্রোহের পরে প্রশাসন সামলাতে না পারলে, যদি ব্রিটিশরা সিপাহিদের দমন করতে পারে, তাহলে মুসলমানদের কেটে শেষ করবে। এখন যেমন ইংরেজদের খতম করা হয়েছে, ঠিক তেমন। 

তোমার কথা শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে হালি। আমি আতঙ্ক বোধ করছি। 

এ শহরে আমরা যদি বেঁচে থাকি তাহলে আমাদের এই নিয়তির শিকার হতে হবে। হয় মৃত্যু, না হয় বেঁচে থাকা। 

তার জন্য আমাদের কি কিছু করার আছে? 

যে দেশপ্রেমিক সে সিপাহিদের সমর্থন করবে, যে নয় সে ব্রিটিশদের। 

গালিব ভ্রূ কুঁচকে হালিকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, আমি তোমার কথা বুঝেছি। তুমি আমাকে প্রশাসনের পরিকল্পনার কথা বলো। 

বাদশাহ প্রশাসনের মূল কাঠামোকে ঠিক রেখেছেন। পদের নামগুলো ফারসিতে বদলানো হয়েছে। আবার কিছু কিছু পুরনো প্রতিষ্ঠান, যেমন ধরুন সদর-উল-সদর, অর্থাৎ মুসলিম আইনের প্রধান ব্যাখ্যাকর্তাকে নতুন করে সাজানো হয়েছে। আর যেটা নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা হলো, তা হলো সামরিক দরবার। 

সামরিক দরবার! গালিব চমকে তাকান। চোখ বড় করে বলেন, বিষয়টি আমাকে বুঝিয়ে বলো। 

এর প্রধান কাজ পৌর ও সামরিক বিষয়গুলো দেখাশোনা করা। মোট দশজন সভ্য আছে। 

বুঝেছি। গালিব গম্ভীর কণ্ঠে বলেন। আরও বলেন, ক্ষমতার বদল হচ্ছে। তাই সাংগঠনিক স্তরে সামরিক প্রশাসনের আদল আনা হয়েছে। 

হালি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, বাহবা, বাহবা। আপনি তো বুঝবেনই ওস্তাদ। আপনি বাদশাহর ওস্তাদ। দরবারে প্রতিদিন যাতায়াত করতেন। আপনার পক্ষে এসব বোঝা সহজ। 

তুমি কি আমার সঙ্গে দাবা খেলবে? 

না, আমি এখন যাব। আপনি যে মহীশূরের শাহজাদাকে নিজের বই পাঠালেন তার কোনো জবাব পেয়েছন? 

ও হ্যাঁ, তোমাকে বলতে ভুলেই গিয়েছি। তিনি প্রাপ্তি সংবাদ জানিয়েছেন এবং বইয়ের দাম জিজ্ঞেস করেছেন। 

হালি ঔৎসুক্য নিয়ে বলে, তাহলে তো ভালোই। আপনি যে বই পাঠিয়েছেন তিনি তাঁর মূল্য পরিশোধ করবেন বলে দামের কথা জিজ্ঞেস করেছেন। 

আমারও তাই মনে হয়েছে। সেজন্য আমি একটি জবাব লিখেছি। তুমি শুনবে? চিঠিটা পড়ব? 

হ্যাঁ, শুনব। তাহলে আমি আরেকটুক্ষণ বসি। 

গালিব চিঠিটা বের করে পড়তে শুরু করেন : আমি বুঝতে পারছি না যে আপনি বইয়ের মূল্য কেন জানতে চেয়েছেন। মনে রাখবেন, আমি গরিব ঠিকই, কিন্তু ক্ষুদ্র আত্মার লোক নই। আমি কবি। কিন্তু ব্যবসায়ী নই। আমি বইয়ের ব্যবসা করি না। আমি পুরস্কার চাই, কিন্তু দাম চাই না। স্বাধীনচেতারা শাহজাদার নিকট যা পাঠায় তা নজরানা, আর শাহজাদা স্বাধীনচেতাদের যা পাঠান তা প্রসাদ। এটা ব্যবসা নয়, এতে হুজ্জতি বা ঝগড়ার কোনো অবকাশ নেই। আমি যে বই পাঠিয়েছি সেটা উপহার, পরে যা কিছুই পাঠাব তা নজরানা হিসেবে গণ্য করবেন। 

পড়া শেষ হলে হালি বলে, ঠিক আছে, খুব ভালো। এটা স্বাধীনচেতা কবিরই চিঠি। আপনি চিঠিটা পাঠাতে পারবেন না। আমি আরেকদিন আসব। সেদিন আমাকে দেবেন। আমি ডাকঘরে নিয়ে যাব। 

বহুত শুকরিয়া হালি। তুমি আমার যোগ্য সাগরেদ। 

হালি ছোট কুঠুরি থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যান। গালিব দাবার ছক নিয়ে আবার বসেন। শুনতে পান সিঁড়িতে দুপদাপ শব্দ। বুঝতে পারেন দুই নাতি উঠে আসছে। তাঁর মনে হয় ওদের চোখ জোড়া যেন ঝকঝকে বিশাল আকাশ। হুসেন ও বাকির দরজায় দাঁড়িয়ে একসঙ্গে ডাকে, নানাজান। 

আসো, আসো। 

দু’জনে দৌড়ে এসে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। 

তোমরা কী করছ মানিক আমার? 

আমরা আপনার জন্য বাদাম শীরা নিয়ে এসেছি। খাবেন? 

এখন খাব না। তোমরা খাও। 

আমরা একটু রাস্তায় যাব? 

রাস্তায়? কেন? 

আমরা মার্বেল খেলব। 

তোমরা বাড়ির পেছনে খেল। 

নানাজান, ওখানে তো কয়দিন ধরে খেলছি। আমাদের এক জায়গায় খেলতে আর ভালো লাগছে না। 

ও আচ্ছা, তাই তো। তোমাদের একটি নতুন জায়গা দরকার। ঠিক আছে, চলো আমার সঙ্গে। তোমরা দু’জনে খেলবে আর আমি দাঁড়িয়ে থাকব তোমাদের জন্য। 

চলেন, চলেন। দুই শিশু আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। 

নানাজান আপনিও আমাদের সঙ্গে খেলবেন কিন্তু। 

ওরা গালিবের দুই হাত ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামে। দরজা খুলে ওদেরকে নিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়ান তিনি। 

আপনি কখনও মার্বেল খেলেছেন নানাজান? 

তোমাদের বয়সে তো অনেক খেলেছি। মার্বেল খেলতে আমার খুব ভালো লাগত। 

আপনার মার্বেল ছিল? 

হ্যাঁ, অনেক মার্বেল ছিল। অনেক রঙ-বেরঙের মার্বেল ছিল। 

আপনার বন্ধু ছিল? 

অনেক বন্ধু ছিল। বন্ধুরা ছাড়া কি খেলা চলে। যাও যাও, খেলতে যাও তোমরা। 

দুজনে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন গালিব। অল্পক্ষণে তিনি বুঝতে পারেন, ওরা খেলায় মগ্ন হয়ে গেছে, ওদের আর নানার কথা মনে নেই। গালিব নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন। বুকের ভেতর প্রবল শূন্যতা হা-হা করে। যেন পুরো শহরটা বুকের ভেতর লুটিয়ে পড়েছে। একটু পর তার কানে আসে কান্নার ধ্বনি। তিনি কান খাড়া করেন। কে কাঁদে? উমরাও বেগমের মতো মনে হচ্ছে যেন! তিনি ঘাড় ঘোরাতেই দেখতে পান ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে আছেন উমরাও বেগম। তিনি দু’পা পিছন ফিরে এসে জিজ্ঞেস করেন, কী হয়েছে? কাঁদছ কেন? 

উমরাও বেগম চোখ মুছে বলেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে। 

সর্বনাশ, সর্বনাশ হবে কেন? আমাদের বাড়ি তো কেউ লুট করেনি। তাছাড়া তোমার অলঙ্কারগুলো তো নিরাপদ জায়গায় রাখা হয়েছে। মিয়াকালে বাদশাহর ধর্মগুরু এবং ফকির হিসেবে সম্মানিত ব্যক্তি। 

আপনি তো আপনার মতো কথা বলে যাচ্ছেন। সর্বনাশের কি কোনো চেহারা আছে? 

আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না। 

গহনাগুলো লুট হয়ে গেছে। 

লুট হয়ে গেছে? 

গালিব স্তম্ভিত হয়ে যান। বলেন, মনে আছে তোমার যে, আমি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তাঁর বাড়িতে অনেকদিন ছিলাম 

আমি তো ভেবেছিলাম, আমার দামি গহনাগুলো একজন ধার্মিক মানুষের জিম্মায় থাকলেই নিরাপদ থাকবে। কালে সাহেব সৎ। তিনি বাদশাহর নেক নজরে আছেন। তার গায়ে কেউ হাত দেবে না। তাছাড়া তিনি গহনাগুলো গোপন কুঠুরিতে রেখেছিলেন। মাটির দেয়াল দিয়ে কুঠুরির দরজা বন্ধ করা ছিল। কথা বলতে বলতে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন উমরাও বেগম। 

কেঁদো না বিবি, কেঁদো না। যা আমাদের ভাগ্যে ছিল না তা নিয়ে বিলাপ করে লাভ কী? মনে করো যেন গহনাগুলো নিজেদের বাড়ি থেকেই লুট হয়ে গেছে। 

উমরাও বেগম চোখ মুছে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নাতিদের ডাকেন। ঘরে আসতে বলেন। ওরা নানিজান বলে দৌড়ে আসে। 

নানিজান আপনি আমাদের ডাকছেন কেন? আমরা আর কিছুক্ষণ খেলব। নানিজান আপনিও আসেন। আমাদের সঙ্গে খেলবেন। 

না, মানিকরা আর খেলতে হবে না। তোমাদের গায়ে ধুলাবালি লেগেছে। তোমরা আসো, আমি তোমাদের গোসল করিয়ে দেব। দেখবে শরীর ঠাণ্ডা হবে। তখন তোমাদের খিদে পাবে। 

ওদের মুখ শুকিয়ে যায়। খেলার আনন্দ শেষ হয়ে যাওয়ার কষ্টে ওরা কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির ভেতরে ঢোকে। গালিব বিড়বিড় করে বলেন, শিশুদের চোখের পানি দেখা গুনাহর কাজ। আমিতো তেমন গুনাহগার হতে চাই না। 

হুসেন আর বাকিরের বাবা ছিল তার খুবই ঘনিষ্ঠ। একদিকে তিনি ছিলেন আত্মীয়, অন্যদিকে ছিলেন মধুরভাষী, চিন্তাশীল। গুছিয়ে কথা বলতেন। তাঁর সঙ্গে কথা বললে হৃদয় জুড়িয়ে যেত। কতদিন তাঁর সঙ্গে কেটেছে। কত সময় ধরে যে দু’জনে কথা বলে কাটিয়েছেন। যে সময়টুকু তাঁর সঙ্গে কাটাতেন সে সময়টুকু তাঁর মৃত্যুর পর ধুধু মরুভূমি হয়ে গেল— যেন পানিহীন, বৃক্ষহীন সময়। মেঘহীন, বসন্তের বাতাসহীন সময়। কখনও কোনো বন্ধুর মৃত্যু হলে তিনি দেখেছেন খানিকটুকু সময় এমন বেদনায় তলিয়ে গেছে শূন্যতার গর্ভে। হায় গালিব, তোমার অজস্র গজল তোমার ক্রন্দন মুছিয়ে দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত নয়। 

তিনি নিজের লেখার জায়গায় এসে বসেন। দোয়াতে কলম ডুবিয়ে চুপ করে বসে থাকেন। জাইনুল আবেদীনের মৃত্যুর পর তিনি শোকগাথার আকারে একটি গজল লিখেছিলেন। কেমন করে দিন চলে গেল। তার দুই সন্তান এখন তাঁর ঘরে দৌড়ে বেড়ায়, খেলা করে। জীবনের কী বিচিত্র রহস্য। খোদাতালা সন্তানহীন মানুষকে সন্তান থেকে প্রাপ্ত সুখে ভরে দেন। তারা আছে বলেই তো তিনি জীবনের অন্য সুখ অনুভব করেন। বসন্তের বাতাস বুকে টেনে নিয়ে বলতে পারেন : 

‘মিহরবাঁ হো কে বুলা লো মুঝে চাহো জিস বক্ত হো 
মৈঁ গরা বক্ত নহি হুঁ সির আ না সকুঁ। 
দয়া করে যখন খুশি আমাকে ডেকে নাও। 
আমি বিগত সময় নই যে, আবার আসতে পারব না।’ 

লিখতে লিখতে মাথা ঝুঁকে যায় কাগজের ওপর। লেখা শেষ হলে ঘরের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে বলতে থাকেন নিজের রচিত শের। যখন খুশি তখন আমাকে ডাকলে আমি ঠিকই হাজির হব। গালিব কখনও অতীতকাল হবে না। কখনও না। গালিব বর্তমানের। গালিব মুছে দেবে অতীতকে। গালিব, তোমার শেরই তো বর্তমানের সাক্ষী। কার সাধ্যি আছে তোমাকে অতীতের গর্ভে ছুঁড়ে ফেলবে? গালিব তোমার শরীরে ভরে আছে বসন্তের বাতাস। তোমার জীবন থেকে বসন্তের বাতাস কখনও দূরে যাবে না। 

দু’হাতে দরজা-জানালা খুলে দেন তিনি। নিজেকেই বলেন, গালিবের কোনো বন্দি জীবন নেই। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *