তবুও অসীম আকাশ
বয়স বাড়ছে। শরীর ভেঙে যাচ্ছে।
‘দস্তাম্বু’ লেখা শেষ হয়ে গেছে। এখন ছাপার কাজ শেষ করতে হবে। শহরের অবস্থা এখন পর্যন্ত খুবই খারাপ। কবে ঠিক হবে কে জানে!
তিনি গভীর নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে বললেন, এখন তাঁর প্রিয় দিল্লি শহরে মৃত্যু খুব সস্তা। আর শস্য সবচেয়ে দামী।
মানুষের বেঁচে থাকার সঙ্কট এখন চরমে। এক টাকায় বিক্রি হচ্ছে বত্রিশ পাউন্ড যব। আর এক পাউন্ড ডালের দাম হয়েছে ষোল টাকা। উমরাও বেগম সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছেন। তারপরও তাঁরা দুজনেই ঠিক করেছেন যে, একজন আশ্রিতকেও চলে যেতে বলবেন না। সবাই মিলে কষ্ট ভাগাভাগি করে নেবেন। দেনা হচ্ছে হোক। পেনসনের ছাড় হলে সব ঠিক করে ফেলবেন। জীবনভর দেনাতো কতই করলেন। শোধও করেছেন। বাকি যে কটা বছর বাঁচবেন, এভাবেই যাক।
গালিব আবারও নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন, গত বছরের দুটো ঘটনায় তিনি খুব মুষড়ে পড়েছেন। সিপাহীদের বিদ্রোহ তাঁকে এক ধরনের কষ্ট দিয়েছে। ইংরেজদের ক্ষমতা দখল আর এক ধরনের মানসিক সঙ্কট তৈরি করেছে। ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে পেনশন গ্রহণ করেন ঠিকই, এর দ্বারা বেঁচে আছেন। বড় সংসারের আশ্রিতদের বাঁচিয়ে রেখেছেন।
তারপরও? তারপরও ওদের নিষ্ঠুরতার কোনো ব্যাখ্যা তিনি খুঁজে পান না। বুক ভেঙে গেলে আবার নিঃশ্বাস পড়ে। ভাবেন, একজন কবির নিয়তি তো এমন হতে পারে না। গত কয়েক বছরে এই শহরের কত কিছু দেখতে হয়েছে তাঁকে। বিগত পাঁচ বছরে শহর বারবার আক্রান্ত হলো। একবার হলো সিপাহী বিদ্রোহের দ্বারা, একবার শহর পুনর্দখলকারী ব্রিটিশদের দ্বারা, মহামারী ও দুর্ভিক্ষের দ্বারা, কলেরার আক্রমণে এবং মহামারীর মতো জ্বরের ফলে। কতভাবে যে এলোমেলো হয়ে গেছে শহরবাসীর জীবন।
তিনি নিজের ঘরে একাকী চুপচাপ বসে থেকে ভাবেন, ‘গালিব তোমার বাড়ির মেঝে-দেওয়াল সব ছেয়ে যাচ্ছে জংলা লতায়—আমি কী এতই নিঃসঙ্গ এবং হতভাগ্য যে, আজ আমার বাড়িতে এইভাবে অবহেলায় বসন্তের সমাগম ঘটছে।’
তিনি সোজা হয়ে বসেন।
বসন্ত! ওহ, বসন্ত!
তারপর খুব নিঃসঙ্গ কণ্ঠে বলেন:
‘কোনো আশাই পূর্ণ হয় না,
কোনো পথই দেখা যায় না কোথাও।’
উমরাও বেগম এক গ্লাস গরম পানি নিয়ে ঘরে এলেন। এগিয়ে দিয়ে বললেন, খান।
শুধু পানি?
আর কি?
কোনো ব্যবস্থাই কি হয় না?
উমরাও বেগম কথা না বলে অন্যদিকে মুখ ঘোরান।
ঠিক আছে বিবি, দাও। তুমি আমাকে গরম পানি পান করতে বলছো-
কারণ আপনার বুকে কফ জমেছে। এ বছর ঠাণ্ডা খুব বেশি পড়েছে।
গালিব গরম পানিতে চুমুক দিয়ে বলেন, হ্যাঁ ঠাণ্ডা খুব বেশি পড়েছে। ঠাণ্ডায় কাবু হয়ে পড়েছি আমি।
কড়াইতে কয়লা জ্বালিয়ে দিতে বলবো?
না, দরকার নাই। বাড়তি খরচ করার সাধ্য কি আর আছে।
উমরাও বেগম খালি গ্লাস হাতে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। গালিব দেখতে পান বুড়িয়ে গেছে উমরাও বেগম। চেহারায় বলিরেখা। চুল অর্ধেকই সাদা হয়ে গেছে। আগের মতো শারীরিক শক্তি আছে বলেও মনে হয় না। তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনে হয় উমরাও বেগমও খুবই একা। সন্তানহীন এই নারীর লড়াইয়ের সময় শেষ হয়ে গেছে। শুরু হয়েছে তাঁর দিন গোণার পালা।
উমরাও বেগম ক্লান্ত স্বরে নিচু কণ্ঠে বলেন, আপনি কি ভাবছেন?
তাদের কথা ভাবছি যারা ব্রিটিশদের তাড়া খেয়ে সব কিছু ফেলে শহরের বাইরে চলে গেছে।
উমরাও বেগম বিষণ্ণ কণ্ঠে বলেন, এই শীতে তাদের না জানি কত কষ্ট হচ্ছে।
ওরা নিজের ইচ্ছায় যায় নি। ওদেরকে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। আহ, বিশাল প্রান্তর-শীতের রাত—হিমঝরা রাতের কনকনে ঠাণ্ডা—কুয়াশা- আমি আর ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারছি না বিবি। ওদের জন্য আমার বুক পাথরের মতো ভারী হয়ে আছে।
ওদের মধ্যে অনেকজন আপনার বন্ধু।
আমার প্রিয় বন্ধু বিবি। ওরা চলে গেছে পরিবার পরিজনসহ। ওরা কবি ওদের কবিতা দিল্লি শহরে রয়ে গেছে। সইফতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওর সাগরেদ ছিল অনেকে। যেসব ব্রিটিশকে সেপাইরা মেরে ফেলেছে তাদের অনেকে সইফতার সাগরেদ ছিল। ওরা না থাকলেও গালিব তো রয়ে গেছে। দুঃখ বয়ে বেড়ানোর জন্যই গালিবের বেঁচে থাকা। হায় গালিব, তোমার মতো দুর্ভাগা আর কে!
দুঃখ করবেন না। উমরাও বেগমের শান্ত কণ্ঠ।
গালিব চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দেন। মনে হয় চারদিক থেকে ঘোড়ার খুরের শব্দ ভেসে আসছে। তিনি ওই শব্দ করোটিতে পুরে নিয়ে চলে যাচ্ছেন কোথাও। কোনো এক অলৌকিক যাত্রায়। তিনি কাঁধে কবিতার পুটলি নিয়ে পথে নেমেছেন। কতদূর যেতে পারবেন কে জানে? দেখা হলো বাদশাহর সঙ্গে। দু’হাত বাড়িয়ে গালিবকে আলিঙ্গন করলেন। গালিব তাঁর মানসিক উষ্ণতা উপভোগ করে ভাবলেন, কয়েক বছর আগে বাদশাহ একবার মক্কা শরীফে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন। তখন গালিব তাঁর গজলে এই শেরটি লিখেছিলেন :
‘যিনি যান মক্কায়, তিনি সঙ্গে নেন আমায়
খুশিমনে আমার পুণ্য অর্পণ করি তায়।’
গালিবের মনে হলো তিনি যেন বাদশাহকে জিজ্ঞেস করছেন, কেমন আছেন কবি? বাদশাহ এখন আর বাদশাহ নন। নির্বাসিত একজন। কবিতা ছাড়া আর কোনো সঙ্গী নেই তাঁর। তিনি ব্রিটিশদের অন্যায় কাজগুলো বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছিলেন। না মেনে তাঁর কোনো উপায় ছিল না। রাজ্য শাসন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে কবিতা লেখায় মনোযোগী হয়েছিলেন। কিন্তু এসব করেও শেষ রক্ষা হয়নি। লালকেল্লায় নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে এক ধূসর বিষণ্ণ দিনে তাঁকে চলে যেতে হয়েছে। গালিব ভাবলেন যাওয়ার সময় তিনি কি নিজের লেখা শেরটি মনে মনে উচ্চারণ করে দিল্লি শহরের চৌহদ্দী অতিক্রম করেছিলেন? গালিব নিজেই বাদশাহর লেখা শেরটি আবৃত্তি করলেন :
‘দরজা আর দেওয়ালগুলোর দিকে অতৃপ্ত নয়নে দেখছি
বিদায় হে দেশবাসী, আমি যে পথ চলছি।’
হায় বাদশাহ, রেঙ্গুনের নির্বাসিত জীবনে ঘরের দেয়াল আপনার কবিতার খাতা। কাঠকয়লা আপনার কলম। কিন্তু বাদশাহ আপনার কোনো দোয়াত নেই। দোয়াতভরা কালি নেই। আপনার কবিতা আর আমাদের পড়া হবে না। আপনি এখন গজলের কোন শেরে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছেন প্রিয় বাদশাহ? আপনার কি মনে পড়ে একবার দরবারে এমন একটি শের পড়েছিলাম
‘রহস্যময় তোমার কাব্য, অতুলনীয় ভাষা গালিব,
তোমায় দেবদূত ভাবতাম, যদি মদ্যপ না হতে।’
গালিবের শেরটি শুনে বাদশাহ বলেছিলেন, ‘না কবি, মদ্যপ না হলেও তোমাকে আমি দেবদূত ভাবতাম।’ সেদিন গালিব হাসতে হাসতে বলেছিলেন, বাদশাহ হুজুর, আমি জানি আপনি আমাকে এখনও তেমনটিই ভাবেন, কিন্তু আপনি আমার গজলের প্রশংসা করতে চান না।
ক্লান্ত গালিব বাদশাহর স্মৃতিচারণ করে নিজের মধ্যে শক্তি ফিরে পান। মনে হয় স্মৃতি বুকের দেয়ালে আটকে থেকে মানসিক সঙ্কট কাটানোর জন্য ঔষধি হিসেবে কাজ করে। তিনি ভাবতে থাকেন সেই সময়ের কথা যখন বাদশাহর ওস্তাদ হওয়ার পরে তাঁকে প্রায়ই লালকেল্লায় যেতে হতো। কখনো যেতেন বাদশাহর কবিতার পরিমার্জনা করে। কখনো নিজের লেখা গজল নিয়ে যেতেন। সবসময় দরবারে বসে থাকতে হতো না। তখন কেল্লায় গিয়ে দীওয়ান-এ-আম-এ বসে থাকতেন। বাদশাহ ডেকে পাঠালে তাঁর সঙ্গে দেখা হতো। নইলে দুপুরের দিকে চলে আসতেন। মাঝে মাঝে বাদশাহর অন্য রকম ইচ্ছে হতো। সকাল বেলা দরবার বসতো। বিকেল হলে নদীর ধারে গিয়ে ঘুড়ি ওড়ানো হতো। বাদশাহ গালিবকেও এসব অনুষ্ঠানে থাকার জন্য হুকুম দিতেন। অন্য সভাসদদের মতো তিনিও উপস্থিত থাকতেন। কেটে যেতো সারাদিন। সব সময় এভাবে সারাদিন কাটাতে তাঁর ভালো লাগতো না। তাঁর শরীরের জন্য সেটা শাস্তিস্বরূপ ছিল। এখন দুঃখ হচ্ছে এই ভেবে যে এমন শাস্তি দেওয়ার লোকটি এখন এই শহরে নেই। মাঝে মাঝে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছেন। বুক তোলপাড় করে ওঠে। তোলপাড় করে ওঠে শহর—তাঁর চিরচেনা জায়গাগুলো—লালকেল্লা, জামা মসজিদ, চাঁদনি চক, কাশ্মিরী গেট, যমুনা নদী ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
মনে পড়ছে শাহজাদাদের কথা। মনে পড়ছে বাদশাহর উত্তরাধিকারী ফখর-উদ-দিনের কথা। হঠাৎ করে তাঁর মৃত্যু হলে ব্রিটিশরা একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারা ঠিক করেছিল যে বাদশাহর পরে যিনি তখতে বসবেন তাঁকে আর বাদশাহ বলা হবে না। তিনি শাহজাদা নামে অভিহিত হবেন। সেই ঘোষণায় গালিব নিজেও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছিলেন। ভবিষ্যতে ভাগ্যে কি আছে তা ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। ব্রিটিশ সরকার আরও বলেছিল যে, বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের মৃত্যু হলে তাঁরা আর কেল্লায় থাকতে পারবেন না। তাদেরকে শহরের বাইরে গিয়ে বাস করতে হবে। তাদেরকে কুতুব এলাকায় থাকার নির্দেশ দেয়া হবে। দুঃখ গভীর হয়ে চেপে থাকে এটা ভেবে যে ফখর-উদ-দিনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্ণৌর নওয়াবী আমল শেষ হয়ে গেছে। লক্ষ্ণৌ তাঁর পছন্দের শহর। যখনই ওই শহরে গিয়েছেন প্রবল টান অনুভব করেছেন।
ঘুরে ফিরে তাঁর স্মৃতি আবার শাহী পরিবারে এসে দাঁড়ালো। ব্রিটিশ সরকার শাহজাদাদের কাউকে বাদশা বলতে চায়নি। ওদের চোখে তারা শুধুই প্রিন্স ছিল। তাঁদের অনেককে গুলি করে মারা হয়েছে। অনেককে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। জল্লাদের ফাঁসির দড়িতে তাঁদের আত্মা হিমশীতল হয়ে জমে গিয়েছিল। কেউ কেউ এখনো বন্দিশিবিরে আটকে আছে। কেউ নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। শাহী পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে গেছে সাধারণ মানুষের বেশে। কোথায় তারা কেউ জানে না। ঘুমিয়ে আছে হয়তো গাছতলায়, নয়তো কোনো জীর্ণ কুটিরে বসে শুকনো রুটি চিবুচ্ছে। পানি পেয়েছে কি পায়নি কে জানে! বৃদ্ধ, দুর্বল, অসহায় বাদশাহ কেমন ছিলেন তাঁর প্রাসাদে? কেমন কেটেছিল তাঁর শেষ দিনগুলো?
পরক্ষণে নিজেকে শান্ত করার জন্য বলেন, না, আমি আর বাদশাহর কথা ভাববো না। তিনি দূরে আছেন দূরেই থাকুন। কিন্তু বাদশাহকে ছাড়তে পারলেন না। তাঁর প্রায়ই মনে হতো তিনি যত না বাদশাহর ওস্তাদ, তারচেয়ে বেশি সভাসদ। বাদশাহর নিজের এবং তাঁর দরবারের মনোরঞ্জন করাই ছিল বুঝি প্রধান কাজ। তিনিতো অনায়াসে ওদের মনের ইচ্ছা পূরণ করেছেন। কিন্তু মাঝে মাঝে বুক ভেঙে যেতো। কষ্ট পেতেন। ভাবতেন, এটাতো কবির কাজ নয়। একবার বাদশাহ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মির্জা তুমি কয়টি রোজা রেখেছো? তিনি বলেছিলেন, ‘এক নহী রক্খা।’ তিনি ভাবলেন সেদিন তিনি কৌশলে বাদশাহর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। এর অর্থ তো দুই রকমই হতে পারে। ধরা যেতে পারে যে একটাও রাখিনি। কিংবা সবগুলো রেখেছি, শুধু একদিন রাখা হয়নি। সেদিন এটাকে রসিকতা ভেবে সবাই হেসেছিলেন। দ্বিতীয় প্রশ্ন কেউ করেনি। কত যে মজার কত কিছু ঘটে যায়। কত সামাল দিতে হয়। ভেবে নিজে হাসলেন। একবার রমজান মাসে একজন সুন্নী মৌলভী দেখা করতে এসেছিলেন। সূর্য তখনো ডোবেনি। সন্ধ্যার কাছাকাছি সময় ছিল। তিনি আজাদকে বলেছিলেন, তার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আসতে। মৌলভী অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল, আপনি রোজা রাখেননি জনাব? তিনি তাকে বলেছিলেন, আমি তো ভাই সুন্নী মুসলমান। দিনের চার প্রহর বাকি থাকতেই রোজা খুলে ফেলি।
মৌলভী সাহেব হাঁ করে তাকিয়েছিলেন। এখন এই স্মৃতিচারণের সময় তাঁর বেশ আমোদ লাগছে। মানুষকে হাসিয়ে তিনি মজা পেয়েছেন। আবার যারা তাঁর কৌতুক শুনেছেন তারা সেগুলো মনে রেখেছেন। মুখে মুখে প্রচার হয়ে গেছে কৌতুকগুলো। চেয়ার থেকে মাথা তুলে ভাবলেন ‘দস্তাম্বু’র পৃষ্ঠায় চোখ বোলাবেন। দিনলিপির পাতা ভরে আছে তাঁর অনুভবে, কষ্টের কথায়—শহরের ঘটনায়। এটি ছাপা হলে বোঝা যাবে পাঠকেরা কীভাবে এর মর্যাদা করছে।
তিনি সোজা হয়ে বসে ‘দস্তাম্বু’ লেখা খাতাটি টেনে পাতা উল্টাতে না উল্টাতে আলতফ আসে। হাতে দেশীয় মদের বোতল।
গালিব কয়েক কদম এগিয়ে আলতফকে জড়িয়ে ধরে বলেন, সাগরেদ তুমি! তুমি দেবদূত হয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছ।
আলতফ হাসিমুখে বলেন, ছাড়েন, ছাড়েন। আগে বোতলটা আপনার হাতে উঠিয়ে দেই। তবেই আমার আত্মা শান্তি পাবে ওস্তাদজী। আমিতো জানি আপনি কত নিরানন্দেই আপনার দিনগুলো কাটাচ্ছেন।
আমার অবস্থা তোমার চেয়ে বেশি আর কে জানে! সাগরেদইতো ওস্তাদকে বোঝে।
গালিব বোতলটা হাতে নিয়ে কাল্লু মিয়াকে হাঁক দিয়ে ডাকেন। পেয়ালা আনতে বলেন। আলতফ শতরঞ্জির ওপর বসেন। সঙ্গে গালিবও। বোতলের ছিপিটা খুলতে খুলতে গালিব বলেন, তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশি ছোট। কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার জমে ভালো।
আমি তো আপনার সাগরেদ ওস্তাদজী। যাঁর কবিতার জন্য শিষ্যত্ব হয়, তিনি আমার মাথার উপরের মানুষ। আমার বুকের ভিতরের মানুষ।
গালিব আলতফের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকেন। ভাবেন, শিষ্যের ভালোবাসা পাওয়া বিরল ভাগ্যের ব্যাপার। তারপর হাসতে হাসতে বলেন, মনে আছে একদিন তোমাকে আমি শামী কাবাব খেতে বলিনি?
আলতফ হেসে বলেন, পরেরটুকু আমি বলি?
তিনি মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, বলো। তোমার কাছ থেকে শুনতে আমার এখন ভালোই লাগবে। কারণ তোমার আনা সুরা পানের সঙ্গেই তোমার কথা শুনবো।
আলতফ হেসে বলেন, বহুৎ শুকরিয়া। একদিন আমি সন্ধ্যা হওয়ার আগেই আপনার বাড়িতে এসেছিলাম। তখনো সূর্য ডোবেনি। আপনি রাতের খাবার খাচ্ছিলেন।
খাবার বলতে তেমন কিছু ছিল না। শুধু শামী কাবাব। গালিব কৌতুকের স্বরে বলেন।
আমি আপনার সামনে বসে আমার রুমাল দিয়ে মাছি তাড়াচ্ছিলাম।
গালিব এক চুমুক মদপান করে হাত তুলে বলেন, থামো, থামো।
থামবো কেন? আলতফ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলে, আপনি বলেছিলেন, তুমি শুধু শুধু কষ্ট করছো। এই কাবাব থেকে এক টুকরোও তোমাকে দেবো না।
সেদিন তুমি আমাকে কিছু বলনি আলতফ।
আমিতো জানতাম যে কাবাব আপনার খুব প্রিয় খাবার। আর সেদিন কাবাব পরিমাণে খুব বেশিও ছিল না।
আমিতো জানি এ জন্যই তুমি আমার খুব প্রিয় সাগরেদ।
আপনি আমাকে সেদিন আর একটি গল্প বলেছিলেন।
কেন বলেছিলাম জানো?
আপনি নিজে আমাকে শামী কাবাবের টুকরো যে দেননি –
গালিব তাঁকে কথা শেষ করতে না দিয়ে তাড়াতাড়ি বলেন, হ্যাঁ ঠিকই ধরেছো যে আমি নিজের না দেয়ার সাফাই গেয়েছিলাম।
আলতফ হা হা করে হেসে ওঠেন।
গালিব তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, তুমি এখন মনের আনন্দে ঘটনাটি স্মরণ করে বলতে পারো। আমরা দুজনেই না হয় হাসি
আলতফ কিছু বলার আগেই কাল্লু মিয়া তাঁর জন্য আখরোট আর শরবত নিয়ে আসে। আলতফ শরবতের গ্লাসটি হাতে নিয়ে এক চুমুক পান করে বলেন, আপনি সেদিন নওয়াব আবদুল অহদ খাঁর কথা বলছিলেন। বলেছিলেন তিনি খেতে বসলে তাঁর দস্তরখানায় তাঁর কাছের মানুষ ও দোস্তদের জন্য নানা রকম খাবার রাখা হতো। যেটা অন্যদের দেয়ার জন্য থাকতো। শুধুমাত্র তাঁর জন্য যা রান্না হতো তিনি ওটা ছাড়া অন্য কিছু খেতেন না। শুধু সেই খাবারটিই তাঁর সামনে রাখা হতো। একদিন তাঁর জন্য জাফরান দেয়া পোলাও রান্না হয়েছিল। সেদিন সে সময়ে তাঁর একজন পর্ষদ সেখানে গিয়ে হাজির হলেন। সেদিন মেহমানদের জন্য অন্য খাবার রাখা ছিল না। পর্ষদও তাঁর সামনে আকস্মিকভাবে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাই তিনি কাজের ছেলেটিকে একটি রেকাবি আনার জন্য ডাক দিলেন। ছেলেটির আসতে দেরি হচ্ছিল। এদিকে নবাব খেয়েই যাচ্ছেন, আর ছেলেটিকে ডাকছেন। তখন উপস্থিত পর্ষদ নওয়াবের সামনে রুমাল নাড়াতে নাড়াতে বলেন, হুজুর অন্য রেকাবি চেয়ে আর কি করবেন? আপনার পোলাওর রেকাবিতো খালি হয়ে যাচ্ছে?
নওয়াব তাঁর এমন সরাসরি কথায় হেসে ওঠেন এবং রেকাবিতে যেটুকু অবশিষ্ট ছিল সেটুকুই তাঁর দিকে এগিয়ে দেন।
গালিব হাসতে হাসতে আলতফের দিকে নিজের অর্ধেক খাওয়া পেয়ালা এগিয়ে দিলে বলেন, খাবে নাকি এক চুমুক?
না। আলতফ ঘনঘন মাথা নেড়ে বলেন।
তাহলে বোতলের বাকিটুকু রাতে খাবো। এখন না হয় থাক।
শুধু রাতে কেন, দু’দিন ধরে খাবেন। এখন রেখে দিন। যথেষ্ট হয়েছে।
ঠিকই বলেছো।
গালিব বোতলের গায়ে চুমু দিয়ে সরিয়ে রাখেন। কাল্লু মিয়াকে ডাকেন। মদের বোতল রাখার জন্য তাঁর একটি কাঠের বাক্স আছে। সেই বাক্সের চাবি থাকে কাল্লু মিয়ার কাছে। এক ডাকেই কাল্লু মিয়া কাছে এসে দাঁড়ায়।
বোতলটাকে তালাবদ্ধ করো কাল্লু মিয়া। আর এই গোলাপ জলের বোতল দুটো সরিয়ে ফেলো।
কাল্লু মিয়া আপনার খুব ভালো সেবক।
তোমরা সবাই তা জানো। ওকে আমি একদিনই বলে দিয়েছি যে আমার নেশা হলে যদি বেশি পান করতে চাই, তাহলে একদমই আমার কথা শুনবে না। বাক্সের চাবি আমাকে দেবেও না। ও কথা রেখেছে। একদিনও কথার বরখেলাপ করেনি। তাই না কাল্লু মিয়া?
কাল্লু মিয়া লাজুক হেসে মাথা নত করে।
আলতফ বলেন, সাবাস কাল্লু মিয়া। আমরা জানি তুমি আমাদের ওস্তাদকে খুবই ভালোবাসো। শুনেছি তুমি কখনোই ওস্তাদকে চাবি দাওনি।
কাল্লু মিয়া আবারও ঘাড় কাত করে বলে, জ্বী হুজুর।
আমি যে মদের সঙ্গে দু-তিন ভাগ গোলাপ জল মেশাই এটা ও ভালো জানে। আমার এদিক-ওদিক হলেও কাল্লু মিয়ার হাতের মাপ একদম ঠিক। তাই না কাল্লু মিয়া?
ও আবারও একই ভঙ্গিতে বলে, জ্বী হুজুর। আমি তো জানি গোলাপ জল মদের তেজ কমিয়ে দেয়। কটু ঝাঁঝটাও হালকা করে।
দু’জনে হেসে উঠে বলেন, তুমি কি করে জানলে?
‘কাল্লু মিয়া উত্তর না দিয়ে ছুটে পালায়।
আলতফ হেসে বলেন, আমি কি আপনার কথা আপনাকে আবার শোনাবো?
কোন কথা?
ওই যে বলেছিলেন, ‘খোদা গালিবকে বাঁচিয়ে রাখুন, আসল শরাবে গোলাপ জল মিশিয়ে খাওয়া তাঁর অভ্যাস।’
গালিব বিষণ্ণ কণ্ঠে বলেন, নেশাকে বশে রাখতে চেষ্টা করেছি বলে তো রাখতেও পেরেছি। তারপরও নেশা আমার স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে ছাড়লো। আমাকে মাফ করলো না। তোমরাতো জানো আমি বেশ কম মাত্রায় মদ পান করি।
আজ কি আপনার দিল খুশ হয়নি?
হয়েছে, হয়েছে। তুমি আমার বেঁচে থাকার সাধ বাড়িয়ে দিয়েছো।
গালিব আলতফের দু’হাত জড়িয়ে ধরেন।
আমি এখন যাই। আমার একটু কাজ আছে। যেতে হবে। ও হ্যাঁ, নওয়াব জিয়াউদ্দিনের কোনো খবর পেয়েছেন?
না, পাইনি। আমার বিবিতো তাঁর ভাইয়ের খবরের জন্য অস্থির হয়ে আছে।
হবেইতো। তিনি একজন গুণী মানুষ।
গালিব উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন, আহা, হা, যেমন তাঁর কবিতা, তেমন গদ্য লেখা। কত বিষয়ে যে তাঁর পড়ালেখা আছে, দেখে আমি অবাক হই। আহা, জিয়াউদ্দিন, কি যে ভালো সে আমাকে বাসে। ঠিক আছে, তুমি আজ যাও। কাল আবার এসো। তুমি ওর কথা উঠিয়ে আমার মনটা খারাপ করে দিলে আলতফ।
আমি ওর কথা না উঠালেও আপনি ওর কথা ভাবেন ওস্তাদজী। আমিতো জানি জিয়াউদ্দিন আপনার মনের গভীরে আছে।
গালিব বিষণ্ণভাবে ঘাড় নেড়ে বললেন, তা ঠিক।
আলতফ চলে যান, কিন্তু জিয়াউদ্দিনকে রেখে যান তাঁর মনে। তিনি স্মৃতি টেনে এনে নিশ্চুপ হয়ে যান। তিনি যা কিছু লিখতেন জিয়াউদ্দিন তার নকল রাখতেন। এ ব্যাপারে তাঁর কোনো গাফিলতি ছিল না। অলসতাও করতো না। গালিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলেন। যেন বুকের ভেতরে কষ্টের যমুনা বইছে। জিয়াউদ্দিনের বাড়ি এবং লালকেল্লার গ্রন্থাগারটি লুট হয়ে গেলে তাঁর আজীবনের সম্পদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। গালিবের লেখা সংগ্রহ করে রাখার জন্য তিনি অনেক অর্থ ব্যয় করেছিলেন। নয়শ পৃষ্ঠা গদ্য এবং পনেরশ থেকে দুই হাজারটি কবিতা চামড়ায় বাঁধাই করে সোনা-রূপার জল দিয়ে তার অলঙ্করণ করিয়েছিলেন। বাদশাহর পুত্র মীর্জা জাফর ছিলেন গালিবের সাগরেদ। হায়, শাহজাদা! গালিব দু’হাতে চোখের পানি মুছলেন। নিজেকেই বললেন, বেঁচে আছ, না মরে গেছ তার কিছুই জানি না। তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হলো না। তুমিই তো জিয়ার সংগ্রহ থেকে আমার সব লেখার প্রামাণ্য নকল লালকেল্লার গ্রন্থাগারের জন্য সংগ্রহ করেছিলে। আহ, আমার মনে কি শান্তি ছিল। ভেবেছিলাম আমার সব লেখার সংরক্ষণ হলো। কে আর আমাকে মুছে ফেলবে? এ বিষয়ে আমার নিজের চিন্তা করার কিইবা আছে! নিজেতো এতটা জীবনে কোনো লেখাই ঠিকমতো গুছিয়ে রাখলাম না। ভেবেছিলাম জিয়াউদ্দিন যা করেছে তারপরে আমার আর দরকার কি গোছানোর!
তিনি কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বিলাপের মতো করে বললেন, আমার সব ধ্বংস হয়ে গেছে। হায় খোদা, এমনই নসীব আমার।
তিনি উদ্ভ্রান্তের মতো পায়চারী করেন। গদরের পরে এমন একটি খবর পেতে তাঁর বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু এতই বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন যে শোক প্রকাশের মতো অবস্থা হয়েছিল। এখন কিছুটা সামলে উঠেছেন। কিন্তু বুকের ভেতরের জমাট অগ্নিকুণ্ডুতো প্রায়শ অগ্ন্যুৎপাত ঘটায়। তখন নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি পায়চারি করতে করতে বলেন, আমার পুরনো কবিতাগুলো আর একবার দেখার জন্য আমার প্রাণ ফেটে যাচ্ছে। ওহ, খোদা!
ঘরে ঢুকে থমকে যান উমরাও বেগম।
দু’পা এগিয়ে কাছে গিয়ে বলেন, কি হয়েছে?
আমার কবিতা—
উমরাও বেগম আর্তকণ্ঠে বলেন, ওহ, আমার ভাই।
গালিব বিড়বিড় করে বলেন, জিয়াউদ্দিন কি আর একবার আমার কবিতাগুলো সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা নেবে?
আপনিতো জানেন না যে আমার ভাই বেঁচে আছে কিনা।
গালিব মাথা নেড়ে বলেন, হ্যাঁ তা জানি না। তবে তো তাঁরা শহরের বাইরে চলে গেছে। নিশ্চয়ই ভালো আছে।
আল্লাহ মালুম।
উমরাও বেগম ওড়না দিয়ে চোখ মোছেন। তারপর কাঁদ কাঁদ কণ্ঠে বলেন, কতদিন পরে খবর পেলাম যে ইংরেজ সৈন্য শহর দখল করার পরে আমার চাচাতো ভাইয়েরা শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ঠিক করলেন।
গালিব তাঁর কথার সূত্র ধরে বলেন, এবং তাঁরা চলে গেলো। আমরা জানতেও পারলাম না।
কারণ তখন শহরের অবস্থা এতই খারপ ছিল যে জানার কোনো উপায় ছিল না। আমরা সবাই ভয়ে-আতঙ্কে ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছিলাম।
গালিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, নসীব! নসীব! এত বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে আছি, এইসব দেখার জন্য কি আমি বেঁচে আছি! হায় খোদা, জানি না আর কতদিন আমার বেঁচে থাকতে হবে!
আপনি শরবত খাবেন?
না, থাক। আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমার পুরনো কবিতাগুলো দেখার জন্য আমার বুকের ভেতরটা আইঢাই করছে। বিবি, তোমার কি মনে আছে যে একজন ফকির কোথাও থেকে আমার একটি গজল জোগাড় করে সুন্দর গলায় গেয়ে ভিক্ষা করছিল।
উমরাও বেগম উৎসাহিত কণ্ঠে বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে আছে। কি সুন্দর গলার স্বর ছিল ফকিরের। কত দরদ দিয়ে যে গাইছিল। আমার শুনতে খুব ভালো লাগছিল। আপনি যখন ওকে জিজ্ঞেস করলেন যে এই গজলটি কার লেখা। ও তখন আপনাকে একটি কাগজের টুকরো দেখিয়েছিল।
ওর হাতের কাগজের টুকরো দেখে আমার চোখ পানিতে ভরে গিয়েছিল বিবি।
আমারও চোখও পানিতে ভরে গিয়েছিল। পানি মুছে আমি শেষ করতে পারছিলাম না।
জিয়াউদ্দিনের বাড়ি কিংবা লালকেল্লার লাইব্রেরি থেকে লুট হয়ে যাওয়া আমার বইয়ের কাগজের টুকরোটি ফকির কোনোভাবে পেয়েছিল বিবি।
তাই হবে। আমার ভাই আপনাকে যে কত ভালোবাসে তা তো আমি জানি। এই জীবনে আমার ভাই আপনার জন্য আর কিছু করার কি সুযোগ পাবে! কে জানে!
পাবে। সুযোগ পাবে।
পাবে? উমরাও বেগমের দৃষ্টি প্রসারিত হয়।
আমি মারা গেলে জিয়াউদ্দিন আমার দাফনের ব্যবস্থা করবে।
গালিবের বিষণ্ণ কণ্ঠ উমরাও বেগমকে স্পর্শ করে। তিনিও বিষাদমাখা কণ্ঠে বলেন, আমিতো কবিতার কথা বলেছি। আপনি–
গালিব উমরাও বেগমের দু’হাত জড়িয়ে ধরে বলেন, আমার মৃত্যুও আমার কাছে কবিতা বিবি। আমার জন্ম-মৃত্যুও আমার কবিতা। যে ফকির গজল গায় সে আমাকে পিতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বাদশাহর যে পুত্র আমার সাগরেদ সে আমাকে কবিতার বেহেশতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আমার মনে হয় আমি আমার মায়ের কাছে যাচ্ছি। আমার যে বন্ধু আমার কবিতা আবৃত্তি করে সে আমাকে আমার শ্বশুরের কাছে নিয়ে যায়। শ্বশুর এই দিল্লি শহরের সব রাস্তাগুলো আমাকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন। জিয়াউদ্দিন একদিন আমাকে বলেছিল, আমার শ্বশুরের কবরের পাশে আমাকে কবর দেবে।
ওহ, এসব কথা আমি শুনতে পারছি না।
উমরাও বেগম দোপাট্টায় মুখ ঢেকে বেরিয়ে যান। একলা ঘরে দাঁড়িয়ে থাকেন গালিব। কিন্তু এই মুহূর্তে নিজেকে একটুও নিঃসঙ্গ মনে হয় না। মনে হয় চারপাশে হাজার হাজার লোক। তারা করতালিতে মুখর করে তুলেছে চারদিক। তিনি দেখতে পান আকাশ থেকে ফুলের পাপড়ি উড়ে এসে পড়ছে। বাতাসে ফুলের সৌরভ। তিনি ঘুমুতে যাচ্ছেন। শান্তির ঘুম। তাঁর কোনো ভয় নেই। কোনো তৃষ্ণা নেই। কোনো ক্লান্তি নেই। অদ্ভুত প্রশান্ত আলো চারদিকে। তিনি ‘দস্তাম্বু’ লেখার জন্য টেবিলে গিয়ে বসেন।
পরদিন আলতফ হুসেন হালি আবার আসেন। হাতে ফলের ঠোঙা। ঘরের এক জায়গায় রেখে বলেন, এগুলো বাচ্চাদের জন্য। ওরা ফল খেতে ভালোবাসে। মিঠাইও।
গালিব মাথা নাড়েন। তিনি তখন মদের পাত্রে গোলাপ জল মিশিয়ে শতরঞ্জির উপর পা ছড়িয়ে বসেছেন। আলতফ তাঁর মুখোমুখি বসে বলেন, ভেবেছিলাম জিয়াউদ্দিনের কোনো খবর আপনার জন্য আনতে পারবো। পারলাম না।
গালিব এক চুমুক পান করে বলেন, শুনেছি ওরা যখন শহর ছেড়ে চলে যায় তখন ওদের সঙ্গে ছিল বিবি বাচ্চাসহ আশ্রিতদের বড় দল। তার ওপর ছিল তিনটা হাতি ও চল্লিশটা ঘোড়া। তারা গেলো নিজেদের জমিদারি এলাকা লোহারু পরগণায়। এটুকু বলে গালিব আবার মদের পেয়ালায় চুমুক দিলেন।
আলতফ তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন বাকির আর হুসেন ঘরে ঢোকে। আলতফের কাছে গিয়ে বলে, নানা আপনি বলেছেন আমাদের জন্য-
আলতফ ওদের থামিয়ে দিয়ে বলে, তোমাদের জন্য কি আনব বলেছিলাম?
দুজনেই চেঁচিয়ে বলে, আনার আনবেন বলেছিলেন।
দেখো ওটার মধ্যে কি আছে।
দুজনে ছুটে গিয়ে ঠোঙা খুলে বলে, আনার, আনার। শুকরিয়া নানা, শুকরিয়া।
দু’জনে যেভাবে ছুটে ঘরে ঢুকেছিল ঠিক একই ভঙ্গিতে ঠোঙা হাতে ছুটে বেরিয়ে যায়।
গালিব মদের পেয়ালা উপরে তুলে ধরে বলেন, বাচ্চারা হলো সবচেয়ে বড় আনন্দ। আরিফের ছেলেগুলোকে না পেলে আমি ঘরে বাচ্চা থাকার আনন্দ বুঝতে পারতাম না। বড় অল্প বয়সে ও মরে গেলো। খুব ভালো কবি ছিল। আমার সাগরেদ আরিফের জন্য বড় কষ্ট হয়। ভাগ্যিস ওর ছেলে দুটোর দায়িত্ব আমার বিবি নিয়েছিল।
ওস্তাদ আপনি আমাকে জিয়াউদ্দিনের কথা বলছিলেন।
আমি তোমাকে আমার কষ্ট আর আনন্দের কথা শোনাচ্ছিলাম। তোমার কি শুনতে ভালো লাগছে না?
আরিফের কবিতার বিষয়ে আমি জানি। ওর বাচ্চাদের কথা আমি জানি। কিন্তু জিয়াউদ্দিনের খবর আমি জানি না। জিয়াউদ্দিন এই সময়ের মানুষ। ইংরেজরা তাঁকে নাজেহাল করছে। আমি তার কথা শুনতে বেশি আগ্রহী।
গালিব গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে পেয়ালায় চুমুক দিলেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কবির মৃত্যুতো শেষ কথা নয়। ভালো কবিকে বাঁচিয়ে রাখে ইতিহাস। গালিবতো সময়ের পৃষ্ঠায় বাড়তি হরফ নয় যে কাল তাকে মুছে ফেলবে।
তিনি আবার এক চুমুক পান করলেন।
আলতফ মৃদু হেসে বলেন, ইতিহাস বিচার করবে গালিবকে, সে সাধ্য কি ইতিহাসের আছে? ইতিহাস গালিবকে মাথায় তুলে রাখবে।
গালিব হা-হা করে হাসতে হাসতে দু’পা ছড়িয়ে দেন সামনে। তারপর আলতফের মাথার ওপর হাত দিয়ে বলেন, তুমিই আমার প্রকৃত সাগরেদ।
আলতফ মৃদুস্বরে বলেন, আমি নওয়াব জিয়াউদ্দিনের কথা শুনবো।
তুমি খুব জেদী মানুষ।
তিনি এক চুমুক পান করে পেয়ালাটা নিচে রাখেন। পা গুটিয়ে বসেন। অন্যদিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন, শুনেছি লোহারু যাওয়ার পথে জিয়াউদ্দিন তাঁর দলবল নিয়ে মেহরৌলি পৌঁছে সেখানে বিশ্রাম করার জন্য দু’দিন থেকে যান। খবর পেয়ে লুটেরা সিপাহিরা সেখানে চলে আসে। ওদের পরনের কাপড় বাদ দিয়ে বাকি সবকিছু লুট করে নিয়ে যায়। গোলমালের আশঙ্কার খবর পেয়ে পথের সাথীরা হাতি তিনটিকে অন্যদিকে সরিয়ে রেখেছিল। বেঁচে গেলো হাতিগুলো। সঙ্গে সঙ্গে খানিকটুকু বেঁচে গেলো জিয়াউদ্দিনের নসীব। হালি এই হাতিগুলোর জন্য তোমার কি কোনো উপমা মনে আসছে?
গালিব আলতফের মুখের দিকে তাকান। আলতফ মাথা নিচু করে এক মুহূর্ত ভাবেন। তারপর নিষ্প্রভ কণ্ঠে বলে, আপনার মনে নিশ্চয় কোনো উপমা আছে। আপনিই বলুন।
গালিব এক নিঃশ্বাসে বললেন, হাতিগুলো থেকে গেলো পুড়ে যাওয়া শস্যক্ষেত্রে তিনটি অক্ষত ধানের গোলার মতো। লুণ্ঠিত ধনের সামনে তিনটি বিশাল আকার স্তুপ। বিপন্ন মানুষেরা যার দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে।
বাহ্ চমৎকার! এর চেয়ে সুন্দর উপমা আর হয় না।
গালিব এক চুমুকে পেয়ালার বাকি মদটুকু শেষ করলেন।
আলতফ উদগ্রীব কণ্ঠে বলেন, তারপর।
তারপর? তারপর বিপন্ন, বিপর্যস্ত লুণ্ঠিত দলের মানুষেরা আবার পথে নামে। এবার ওরা যাত্রা করে দুজানার দিকে।
গালিব থামলে আলতফ বলেন, আর একটু মদ পান করবেন?
না। তুমিতো জানো আমি পরিমিত খাই। কিন্তু নেশা ছাড়তে পারি না। আমি মদ খাই, আর নেশা আমার শরীর খায়। নেশা একটা ঘুণ পোকা। একটু একটু করে কাটছে আমাকে। এতো কিছু জানার পরও নেশা থেকে আমার মুক্তি নাই হালি।
গালিব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
আলতফ মৃদু হেসে বলেন, নেশাকে আপনি ভালোবাসেন। নওয়াব জিয়াউদ্দিনকেও।
যাঁর সর্বস্ব লুট হয়ে যায় সে একজন অসহায় মানুষ হয়ে পড়ে।
হ্যাঁ, তা সত্যি। এটাও বুঝি যে এই ধকল কাটাতে দীর্ঘ সময় লাগে। ধকলতো মনের ওপর চাপ ফেলে বেশি।
জিয়াউদ্দিন দুজানার পথে রওনা করলো। পথের সীমাহীন দুর্ভোগ শেষে দুজানায় পৌঁছাল। হুসেন আলি খান দুজানার একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। সৎ, অত্যন্ত সৎ। মানুষ তাঁকে খুব মান্য করে। তিনি জিয়াউদ্দিনকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বললেন, আমার ঘর আপনাদের ঘর। জিয়াউদ্দিন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। হুসেন আলী খান বাহাদুরের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলেন জিয়াউদ্দিন। কারণ তিনি অতিথিদের তেমনই খাতির করলেন যেমন ইরানের বাদশাহ হুমায়ুনকে করেছিলেন।
বাহ, নওয়াব জিয়াউদ্দিন খুবই ভাগ্যবান।
নসীব। নসীব আপনা আপনা। এই পরিবারের দুর্গতির কথা আমি তোমাকে বলতে পারবো না আলতফ।
থাক দুর্গতির কথা বিস্তারিতভাবে বলার দরকার নেই। আমি শুনতে চাই না। আপনারও কষ্ট হবে। তারপরে?
হুসেন আলী খান বাহাদুরের আতিথেয়তায় যখন নওয়াব জিয়াউদ্দিনের কথা শুনলেন দিল্লির কমিশনার বাহাদুর তখন তিনি তাকে ডেকে পাঠালেন। পথিমধ্যে তাঁর যে দুর্ভোগ ঘটেছিল সে কথাও তার কানে গিয়েছিল। জিয়াউদ্দিন দিল্লিতে এসে কমিশনার সাহেবের সঙ্গে দেখা করলেন। শুনেছি প্রথমে তিনি খুব কড়াভাবে তাঁকে নানা প্রশ্ন করেছেন। জিয়াউদ্দিন প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর খুব বিনয়ের সঙ্গে দিয়েছে। তার বিনয়ে কমিশনার সাহেব নিজেও শান্ত হয়। বিনয়ের উত্তরে ঔদ্ধত্য দেখাতে পারেনি কমিশনার বাহাদুর। ভদ্রতা-বিনয় ব্যক্তির বড় সম্পদ হালি।
আলতফ মাথা নেড়ে বললেন, জানি। বিনয়ই পারে উগ্রতাকে শীতল করতে। তারপর কি হলো?
তারপর কমিশনার সাহেব লালকেল্লার একটি প্রাসাদে তাঁদেরকে বাস করার হুকুম দিল।
হুকুম? নওয়াব জিয়াউদ্দিনকে হুকুম?
দিল্লি শহরের মুসলমানদের তারাতো এখন হুকুমই দেয়। ওরা পারলে একজন মুসলমানকেও বাঁচিয়ে রাখবে না।
জিয়াউদ্দিন কি লালকেল্লায় যাবে?
হুকুম হলেতো যেতেই হবে। শুনেছি বাদশাহর খানসামা যে ঘরে থাকতেন তার পাশের ঘরে জিয়াউদ্দিনের পরিবারের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।
জিয়াউদ্দিন কি দুজানা থেকে ফিরে এসেছেন?
এসেছে। ওর পাঠানো লোকের কাছ থেকেই তো আমি এত খবর পেয়েছি। সবচেয়ে দুঃখজনক কি জানো হালি, মেহরৌলিতে জিয়াউদ্দিনের পরিবারের সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেলো লুটেরারা। আর দিল্লিতে তার যে বাড়িঘর তাও লুটপাট করে শেষ করে দেয়া হলো। মেহরৌলিতে তারা সব হারিয়ে প্রাণ নিয়ে বেঁচে ছিল। আর দিল্লির যে প্রাসাদ ছিল তার, সেখানকার ইট-কাঠ আর পাথর ছাড়া সব দামি জিনিস লুটেরাদের হাতে গিয়ে উঠলো। কোনো কিছুর চিহ্নমাত্র রইলো না। এখন শুধু নির্দোষদের জন্য দোয়া ছাড়া আমার আর কিছু করার নাই। খোদাতালা যেন তাদেরকে বহাল তবিয়তে রাখেন। তাঁরা যেন নিশ্চিন্তে আয়ু পায়। যেন শান্তির জীবন পায়। যেন জ্ঞান চর্চার জায়গা পায়। যেন মনের আবেগে কবিতা লিখতে পারে। কবির জীবনইতো কবিতার জীবন। আমরাতো এর বেশি কিছু চাই না। কবিতার মতো সম্পদ যার জীবনে থাকে ক্ষুধা নিবৃত্তি ছাড়া আর কিছু তার চাইবার থাকে না।
গালিব আর কথা বলতে পারেন না। তাঁর দু’চোখ পানিতে ভরে যায়। কাঁদতে থাকে আলতফ। কেঁদে তাঁরা নিজেদের বুকের ভার কমান। মুসলমান মুঘল বাদশাহর দায়ভার নিয়ে দিল্লি শহর অন্য মুসলমানদের জন্য অচেনা শহরে পরিণত হয়েছে। তারপরও গালিব বুকের গুড়গুড় ধ্বনি প্রাণপণ চেষ্টায় দমিয়ে বলেন, দিল্লি আমাদেরও। আমি দিল্লির বোঝা নই যে এই শহর আমাকে বাইরে ঠেলে দেবে।
না, একদমই না।
আলতফ ঘড়ঘড় কণ্ঠে বলেন। তারপর নিজেকে শান্ত করে বলেন, আপনার জন্য আরও খবর আছে।
খবর? আর কোন খবর?
আলতফ স্থির কণ্ঠে বললেন, ঝঝরের হাকিম আবদুর রহমানকে একজন সামান্য অপরাধীর মতো ধরে নিয়ে গেছে গোরা সৈন্যরা। ওরা একজন হাকিমের মান-সম্মানের দিকটাও দেখলো না।
মুসলমান যে।
মুসলমান হলেই সবাইকে এক পাল্লায় ওঠাবে? আলতফের কণ্ঠ ঈষৎ রূঢ়। গালিব চুপ করে থাকলেন।
আলতফ কণ্ঠস্বরের একই ঝাঁঝ নিয়ে বললেন, তারপর কি করেছেন জানেন? দীওয়ান-এ-আমের এক কোণায় তাঁকে থাকার জায়গা দেয়া হয়েছে। তাঁর পুরো জায়গীর ইংরেজ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছে।
হায় খোদা! গালিব দু’হাতের তালুতে নিজের কপাল রাখেন। সহসা কোনো কথা বলতে পারেন না।
আলতফ কণ্ঠস্বরে একই ঝাঁঝ নিয়ে বলেন, এই তো গত শুক্রবার ফররুখনগরের হাকিম আহমদ আলী খানকেও একই রকম অবস্থায় ধরে নিয়ে গিয়েছে। কেল্লারই কোথাও থাকতে দিয়েছে শুনেছি। আর লুটেরারা ফররুখনগরের ঘরবাড়ি লুট করে। সব মালামাল ও আসবাব লুটেরাদের দখলে চলে গেছে। এই শহরে ওদের কাছে ইনসাফ বলতে কিছু নেই।
প্রবল মনোকষ্ট নিয়ে গালিব চুপ করে থাকেন। আস্তে করে এক সময় বলেন, আমাকে এসব আর শুনিয়ো না তুমি।
আপনাকে শুনতে হবে। আমি আরও বলবো।
গালিব চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকেন। প্রবল অবসন্নতা তাঁকে পেয়ে বসে।
তাকিয়ে আছেন যে?
তুমি যা বলবে তা আমি শুনবো?
চোখ দিয়ে শুনবেন।
না, আমি কান দিয়েও শুনবো। তুমি বলো।
আলতফের কণ্ঠস্বরের ঝাঁঝ একটুও কমেনি। বলেন, দাদরি ও বাহাদুরগড়ের হাকিম বাহাদুর জঙ্গ খানকেও গ্রেফতার করে আনা হয়েছে। তাঁকে কেল্লার যেখানে ফেলে রাখা হয়েছে তিনি সেখানেই আছেন। পরের শনিবার বল্লভগড়ের হাকিক রাজনাহর সিংকে ধরে আনা হয়েছে। কেল্লায় বন্দি হাকিমদের সংখ্যা বেড়েছে আরও একজন।
গালিব গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠেন। তাঁর অবসন্ন ভাব কেটে যায়। তিনি দীপ্র চোখে আলতফের দিকে তাকিয়ে বলেন, আমি জানি দিল্লি এজেন্সির অধীনে সাতটি জায়গীর আছে।
হ্যাঁ, ঠিক।
নামগুলো বলতো দেখি। আমার আবার সব নাম মনে থাকে না।
জায়গীরগুলো হলো ঝঝর, বাহাদুরগড়, বল্লভগড়, লোহারু, ফররুখনগর, দুজানা ও পতৌদি। এর মধ্যে পাঁচটি জায়গীরের হাকিমকে কেল্লায় বন্দি রাখা হয়েছে।
জানি। আর যে দুজন বাকি আছেন তাঁরা হলেন পতৌদি ও দুজানার হাকিম। হাঃ নসীব। ওরা এখন আতঙ্কিত। ওরা মৃত্যুভয়ে কাতর। নসীব এমনই। কোথায় থেকে কোথায় যে নিয়ে যায়।
আপনি কি এর জন্য আফসোস করেন?
আফসোস! গালিব থমকে থাকেন।
না, বলছিলাম আপনি কি আফসোস করেন, নাকি নসীবকে মেনে নেন?
নসীবকেইতো মেনে নিতে হয়। নসীবকে না মেনে কি উপায় আছে? আমাদের সামনে আরও কত কি দেখতে হবে কে জানে!
তেমন খবরওতো আমাদের পাওয়া হয়ে গেছে।
বলো, শুনি। গালিব আলতফের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
এটাতো লুকোছাপানো কিছু নয় যে শহরের এই হাঙ্গামায় অনেকেই পরিবার নিয়ে শহরের বাইরে চলে গেছেন।
হ্যাঁ, তাতো ঠিকই। কে গেছে এটা গুণে লাভ নেই, কারা আছে তার হিসেবই করো আগে।
কারা আছে সে হিসেব আর কীভাবে পাবো। যারা নেই তাদের হিসেব আগে করি।
করো। শুনি তোমার কথা।
মুজফফর-উদ-দৌলা, সৈয়দউদ্দীন হায়দার খান ও জুলফিকারউদ্দিন হায়দার খান শহর ছেড়েছেন। দামি জিনিসপত্রে ভরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পথে নেমে গেছেন। ভবঘুরের জীবন বেছে নিয়েছেন। প্রাসাদের মতো বিশাল এদের বাড়িগুলো ছিল পাশাপাশি। এদের জমি মাপলে তা একটি গ্রামের সমান তো হবেই, শহরের সমান না হলেও। ভেবে দেখুন এদের দৌলতের হিসেব কত। সবই লুটেরাদের হাতে ধ্বংস হয়ে গেলো। কবে এরা ফিরবে, কবে আবার সব গড়ে উঠবে, আদৌ উঠবে কিনা কে জানে!
চুপ করো হালি। আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। শুনতে মন চাইছে না।
চুপতো করবোই। তার আগে আর একটু বলে নেই। যেদিন ভোরবেলা রাজানাহর সিংকে গ্রেফতার করা হলো সেদিন রাতে দেখা গেলো বাড়িগুলো দাউদাউ জ্বলছে। আগুনের শিখা অনেক দূর থেকে দেখা গেছে। তেমন দামি নয় এমন কিছু জিনিসপত্রতো তখনো ছিল। হলঘরের পর্দা, শামিয়ানা, কার্পেট, শতরঞ্জি এমন আরও অনেক কিছু।
আহ্ চুপ করো আলতফ। ওই বাড়ি পুড়ে যাওয়ার আগুনের শিখাতো আমিও দেখেছি। লকলকে শিখা যেন বাড়িগুলোকে ঘিরে আকাশে নৃত্য করছিল। আর সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিলো। আগুনের উত্তাপ আমি অনুভব করছিলাম। আমার শরীরে আগুনের আঁচ লাগছিল। বাতাসে উড়ে আসা ছাইয়ে আমার চোখ জ্বালা করছিল। যেন পুড়ে যাচ্ছে আমার শরীর। আমার আয়ু। আমার ছেড়ে আসা বয়সের সবটুকু।
শুধু বেঁচে ছিল আপনার কবিতা। তাই না?
বোধহয় তাই। সে সময়ে কি মনে হয়েছিল জানো?
বলুন। নাকি সেই গজল গেয়ে ভিক্ষা করা ফকিরের কণ্ঠস্বরের কথা মনে হয়েছিল আপনার?
না, সেসব কিছু নয়। মনে হয়েছিল নিজের ঘরে বসে প্রতিবেশির ঘরের সঙ্গীত যদি উপহার হিসেবে পাই, তবে আগুন লাগলে তার ছাই প্রতিবেশি উপহার হিসেবে নেবে না কেন? তোমার কি মনে হয়?
আমার মনে হয় নেয়াইতো উচিত।
আমিও তাই ভেবেছিলাম। হুসেন মির্জার পুড়ে যাওয়া বাড়ির ছাই আমার কাছে উপহারই ছিল।
গালিবের ভারী কণ্ঠ থামলে নিস্তব্ধ হয়ে যায় ঘর। যেন কোথাও কেউ নেই। পরের ঘটনাটি দুজনের কেউই আর উচ্চারণ করেন না। দুজনেই দু’হাঁটুর ওপর মাথা ঠেকিয়ে রাখেন। তাঁরা জানেন তাঁদের দু’জনের হৃদয়ে শোকের কোনো বাণী অবশিষ্ট নেই। তাঁরা দু’জনে কাছাকাছি হয়েছেন শোকের মাতমে স্থির থাকার জন্য।
তাঁরা জানেন ঝঝর, বল্লভগড় ও ফররুখনগরের হাকিমদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে। একদিনে নয়, বিভিন্ন দিনে। তারিখগুলোর উল্লেখ তাঁরা করতে পারবেন না। কার কোন কোন বারে ফাঁসি দেয়া হয়েছে সেটা তাঁরা জানেন না। শুধু তাঁরা জানেন এমনভাবে তাঁদের হত্যা করা হয়েছে যে কোনো রক্ত ঝরেনি 1 কেউ বলতে পারবে না যে তাদের রক্তে ভিজে গেছে মাটি। কেউ বলতে পারবে না যে রক্তের রেখা তৈরি হয়েছিল মাটির উপরে। সেই রক্তের খোঁজে উড়ে এসেছিল নীল মাছি।
তখন গালিব মাথা তুললেন। তাকালেন আলতফের দিকে। আলতফ মাথা তুলে তাকালেন গালিবের দিকে। গালিব নিজের শের আবৃত্তি করলেন —
‘এক একটি শোণিত বিন্দুর হিসেব দিতে হলো আমায়,
হৃদয়ের জিম্মা বন্ধুর আঁখি পল্লবের ওপর ছিলো।’
শেরটি শুনে আলতফের চোখ থেকে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে। তখুনি হাতে ছোট একটি রেকাবি নিয়ে ঘরে ঢোকে বাকির আর হুসেন। দু’জনের চোখে পানি দেখে ওরা থমকে দাঁড়ায়।
একই সঙ্গে বলে, কি হয়েছে আপনাদের?
কিছু তো হয়নি আমাদের।
তাহলে কাঁদছেন কেন?
তোমরা আমাদের জন্য কি এনেছো?
আনার। খাবেন?
হ্যাঁ, খাবো। দাও।
একটা কথা আছে।
কথা আছে? কি কথা?
আপনারা কিন্তু আর কাঁদবেন না। শুধুই আনার খাবেন।
দাও। রেকাবিটা আমার কাছে দাও।
দু’ভাই আলতফের হাতে রেকাবি রেখে চলে যায়। আবার নিস্তব্ধতায় ভরে যায় ঘর। আবার দুজনে হাঁটুর ওপর মাথা রাখেন।
.
পরদিন ‘দস্তাম্বু’ লিখতে বসেন গালিব। কলম চোবানো হয় দোয়াতে। সাদা কাগজ ভরে ওঠে কালির রেখায়।
লিখছেন : জানুয়ারি মাসে শহরের চেহারা বদলাতে শুরু করেছে। যারা শহরের বাইরে চলে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে হিন্দুদের শহরে ফিরে আসার অনুমতি দিয়েছে ইংরেজ সরকার। যে যেখানে ছিল খবর পেয়ে শহরে ফিরে আসতে শুরু করেছে তারা। মুসলমানরা শহরে ফেরার অনুমতি পায়নি। মুসলমানরা যে বাড়িগুলো ফেলে চলে গিয়েছিল সেসব বাড়িতে ঘাস গজিয়েছে। দেয়াল সবুজ হয়ে গেছে। দরজাগুলো তেমন শ্যাওলাভরা। এই সবুজ রঙ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে মুসলমানদের বাড়িগুলো পরিত্যক্ত। বাড়িতে কোনো বাসিন্দা ফিরে আসেনি।
এটুকু লিখে তিনি থামলেন। চেয়ারে মাথা এলিয়ে খানিকটুকু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেন। শুনেছেন, দিল্লির হাকিমের এমন ধারণা হয়েছে যে পাতিয়ালের রাজা নরেন্দ্র সিংয়ের আশ্রিত এলাকায় বেশ কিছু সংখ্যক মুসলমান লুকিয়ে আছে। এমন ধারণাও হাকিমের হয়েছে যে মাঝে মাঝে তারা এলাকায় জমায়েত হয়। গালিব এই এলাকার বাসিন্দা। এখন পর্যন্ত তাঁকে তেমন কোনো বড় ধরনের হাঙ্গামায় পড়তে হয়নি। কিন্তু তিনি জানেন না আর কতদিন এভাবে চলবে।
তিনি টেবিল ছেড়ে উঠলেন। উমরাও বেগমকে দরকার। আজকে তাঁকে শামী কাবাব বানাতে বলবেন। গোস্ত কোথায়? জানি না। আসবে কোথা থেকে? জানি না। গালিব নিজেকে সামলাতে পারেন না। অস্থিরতা বোধ করেন।
পরদিন দিল্লির হাকিম কয়েকজন সিপাইকে সঙ্গে নিয়ে গলি বল্লিমারোঁওতে এসে হাজির হয়। সবাইকে ডাকলেন। গালিব যে বাড়িতে থাকেন তার মালিকসহ বেশ কয়েকজন নির্দোষ মুসলমানকে ধরে নিয়ে গেলেন। তাদের জিজ্ঞাসা করা হবে যে সিপাহী বিদ্রোহের সময় তাঁরা সিপাহীদের কতটা সহযোগিতা দিয়েছিলেন। বাদশাহকেই বা কি ধরনের সমর্থন জুগিয়েছিলেন। গালিব নিজের ঘরে বসে চুপচাপ আছেন। মনে পড়ছে তফজ্জুল হুসেন খানের কথা। তখন চারদিক থেকে সিপাহীরা এসে জমা হচ্ছিল শহরে। বাদশাহর সমর্থনের কথা প্রচার হয়ে গিয়েছিল। তাই দূর-দূরান্ত থেকে বিভিন্ন জায়গীরের সেনানায়করা নিজেদের সেনাবাহিনী নিয়ে দিল্লির পথে যাত্রা শুরু করে দিয়েছিল। তফজ্জুল ছিলেন ফররুখাবাদের হাকিম। তিনি বাদশাহকে কখনো দেখেননি। তাঁর সঙ্গে কোনো যোগাযোগও ছিল না। তিনি বিদ্রোহীদের পক্ষে বাদশাহকে অভিবাদন জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। জানিয়েছিলেন যে তিনি বাদশাহর সঙ্গে আছেন।
এখন তফজ্জুল হুসেন খান কোথায়? গালিব প্রবল বিষণ্নকণ্ঠে নিজেকেই শোনালেন, নেই। এই দুনিয়ায় নেই। ইংরেজ সরকার নৃশংসভাবে প্রতিহিংসা নিয়েছে। আজ কি করবে তারা? যাদের ধরে নিয়ে গেলো? তারা নির্দোষ। তারা বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।
.
পরদিন খবর পেলেন যাদের ধরে নিয়ে গিয়েছেন তাদেরকে হাওয়ালাতে রাখা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের পরে তেমন কিছু না পেলে ছেড়ে দেয়া হবে। গালিব কাল্লু মিয়াকে বললেন, ওদের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধই খুঁজে পাবে না দিল্লির হাকিম।
কাল্লু মিয়া খুশি হয়ে বলে, তাঁদেরকে বহাল তবিয়তে রাখা হয়েছে হুজুর।
তাহলে তাদের সম্মানের দিকে নজর রাখতে ভোলেনি হাকিম। যাক, ভালো কথা।
গালিব কাল্লু মিয়াকে নির্দেশ দিলেন বোতলের শেষ মদটুকু পেয়ালায় ঢেলে গোলাপ জল মেশাতে।
পরদিন ফিরে এলো মেহমুদ খান, মুর্তাজা খান ও হাকিম কালে। তাদের সঙ্গে ফিরে এলো আরও কয়েকজন। এরপর মাত্র তিনজকে ছেড়ে দেয়া হলো। তবে বেশির ভাগই রয়ে গেলো হাওয়ালাতে।
গালিবের মন খারাপ হয়ে থাকে।
উমরাও বেগম বলেন, এত ভাবার কি আছে। যা হওয়ার হবে।
হওয়াটাতো খুব ছোট্ট কিছু না। সেটা রক্তপাতহীন ফাঁসি।
উহ, খোদা। উমরাও বেগম দু’হাত কান চাপা দেন।
উমরাও বেগমের কণ্ঠের অস্ফুট ধ্বনিতে চমকে ওঠেন গালিব। ইদানীং এমন হচ্ছে। সামান্য শব্দও তাঁকে বিচলিত করে।
আপনি এমন চমকে উঠছেন কেন?
আমারতো এমনই হচ্ছে। জানি না কেন।
তবিয়ত ঠিক আছেতো?
না, ঠিক নেই। খারাপ লাগছে।
বুখার হয়েছে?
না।
তাহলে কি?
গালিব রাগতস্বরে চেঁচিয়ে বলেন, জানি না কি। তুমি তোমার ঘরে যাও বিবি।
উমরাও বেগম ক্রুদ্ধ হয়ে দুপদাপ পা ফেলে চলে যান। গালিব মদের পেয়ালা নিয়ে বসেন।
.
কদিন পরে আটক করে রাখা বাকিদের ছেড়ে দেয়া হয়। ওরা ফিরে এলে হল্লা করে গলির লোকেরা। আনন্দের হল্লা। তাতেও চমকে ওঠেন তিনি। কাল্লু মিয়া এসে খুশির স্বরে বলে, ওরা সবাই ফিরে এসেছে হুজুর। একজনও আর হাওয়ালাতে আটক নেই।
ওরা আবার আসবে নাতো? ওরাতো আমাকে ধরতেও আসতে পারে?
আপনার মতো মানী লোককে ওরা ধরবে না।
এখন পর্যন্ত ওরা আমাকে কোনো ঝামেলায় ফেলেনি।
ওরা তো জানে আপনি কে? আপনার মতো কবি এই শহরে আর কে আছে?
কাল্লু মিয়া।
জ্বী হুজুর, আমাদের বাড়িওয়ালা এমন কথাই বলেছেন। বলেছেন ওরা আর বল্লিমারোতে আসবে না।
তারপরও আমি সারাদিন দুশ্চিন্তায় থাকি। আমি রাতে ঘুমুতে পারি না।
আজ থেকে আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে যান। আজ থেকে আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমুবেন। আমি আপনার ঘরের দরজায় বসে পাহারা দেবো।
ওরা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকবে। তুমি কি করবে?
আমার কলিজাটা ওদের পায়ে থেঁতলাতে দেবো।
ওহ, কাল্লু মিয়া!
আপনার মদের বোতল শেষ হয়ে গেছে। আমি হাকিম মুহম্মদ খানের কাছে যাচ্ছি। দেখি আর একটি বোতল জোগাড় করা যায় কিনা!
গালিব পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, হে বুলবুল চলে যাচ্ছে বসন্তের দিন।
শেষ চুমুকের মদটুকু যতক্ষণ গলা বেয়ে নেমে গেলো ততোক্ষণ তিনি তা উপভোগ করলেন। ধ্যানস্থ হয়ে কতক্ষণ বসে রইলেন। বসে থেকে বুকের আনন্দ দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখার চেষ্টা করলেন। অনেকক্ষণ বসে থেকে শতরঞ্জি ছেড়ে উঠে কলম ডোবালেন দোয়াতে। লিখলেন :
‘মদ, যা আমি পান করি এবং ধারণ করি,
সিনাই পর্বতশৃঙ্গে যে বাজ পড়ল-
তা আমার উপরেই পড়া উচিত ছিল।’
তিনি মাথা সোজা রাখতে না পেরে শতরঞ্জির ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন। যেন শুনতে পাচ্ছেন ঘরের ভেতরে নিজেরই কণ্ঠ ধ্বনিত হচ্ছে :
‘আমার দৃষ্টি উন্মুক্ত, বাগান মুগ্ধ দৃশ্যময়,
সমস্তই বিফল, আমি একটি শিশির বিন্দু,
সূর্য তাকে স্পর্শ করেছে।’
তাঁর দু’চোখে ঘুম নেমে আসে। প্রবল দুশ্চিন্তা তাঁকে ঘুমের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দেয়। কিন্তু তাতেও রক্ষা হয় না। মুহূর্তে ভেঙে যায় ঘুম। আবার আতঙ্ক তাঁকে গ্রাস করে। তিনি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ছাদের দিকে। ভেসে ওঠে লালকেল্লার ছবি। তাঁর কবি জীবন খ্যাতির শিখরে উঠেছিল বাদশাহর মুশায়রার আসরে যোগ দিয়ে। এই কিল্লাই-মোলাইকে ঘিরেইতো তাঁর কবি জীবন কেটে গেলো। তাঁরই চোখের সামনে ভেঙে পড়লো মুঘল শাসন। একটু একটু করে দেখেছেন তাদের ক্ষয়ে যাওয়া অবস্থা। তিনিতো দীর্ঘ বছরের সাক্ষী। বুকের ভেতরে ধস নামে যখন কোনো কিছুর মুছে যাওয়াকে নিজের চোখে দেখতে হয়। বাদশাহর অবস্থাতো তিনি এভাবে বিলীন হয়ে যেতে দেখছিলেন। তবু মেনে নেয়া কঠিন। বাদশাহর এই আকস্মিক পতনের জন্য তিনিতো নিজেকে প্রস্তুত করেননি। তাঁর জীবনের একটি বড় জায়গা, পবিত্র স্থান, কবিতার শব্দরাজির ধ্বনি ছড়িয়ে আছে যেখানে সেই লালকেল্লার এমন নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ দেখার জন্যওতো তিনি তৈরি ছিলেন না। বাদশাহর প্রতি ভয়াবহভাবে রূঢ়, অমানবিক আচরণ করেছে ওরা, শাহজাদাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, কালাই-মোলাইয়ের সৌন্দর্যমণ্ডিত দেয়ালগুলোর কারুকাজ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে আর প্রাসাদের কক্ষগুলোর সৌন্দর্যমণ্ডিত বাহারকে পরিণত করা হয়েছে সৈনিকদের ব্যারাকে। জীবন এখন আতঙ্কে ভরপুর। বেঁচে থাকার সাধ সৈনিকের বন্দুকের মাথায় এসে ঠেকেছে।
গালিবের শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে। তিনি উঠে বসেন। যতদিন বাদশাহ ছিলেন ততদিন কবিতার জয়গান ছিল। তাঁরা সেই আনন্দময় সময়ের মানী মানুষ ছিলেন। কিন্তু এখন এই শহরে নিজেকে একজন উদ্বাস্তু মানুষ মনে হয়। মনে হয় তাঁর জন্য কোনো নির্দিষ্ট জায়গা আর কোথাও নেই।
তিনি দু’হাতে মাথা চেপে ধরলেন।
শুনেছেন যেদিন শহরটি ইংরেজদের দখলে চলে যায় সেদিন ব্রিটিশ সেনাপতি জেনারেল উইলসন দিল্লির দেওয়ানি-খাসে নৈশভোজ দিয়েছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের বিজয়ের ঘোষণা দিয়েছিল। তারা আকণ্ঠ স্যাম্পেন পান করে জয়ের উৎসব উদযাপন করেছিল।
ওহ, নসীব!
গালিবের কণ্ঠ থেকে গোঙানির শব্দ বের হয়। তিনি জানেন এরপর থেকে ধীরে ধীরে প্রাসাদ লুট হতে থাকে। হিংসায়, ক্রোধে, দম্ভে উন্মত্ত হয়ে ওরা লুটের কাজটি করেছে। মাতাল সৈনিকেরা হাসতে হাসতে ঝাড়বাতিগুলো ভেঙে ফেলেছে। যে রত্ন পাথর দিয়ে ঘরের মোজাইকে নকশা করা হয়েছিল সেগুলো বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তোলা হয়েছে। ঘরের ছাদ যেখানে সোনা দিয়ে খোদাই করা হয়েছিল সেগুলো আঁচড় কেটে, ভেঙে নষ্ট করা হয়েছে। যে মতি মসজিদের শীর্ষ সোনার পাতে মোড়া ছিল সেগুলো উপড়ে তুলে বিক্রি করে সেনাবাহিনীর পেছনে ব্যয় করা হয়েছে। কিছু পুরনো বই, জামাকাপড় এবং ওষুধ মাত্র পড়ে রইল। দেওয়ান-ই-আম পরিণত হলো একটি চিকিৎসা কেন্দ্রে।
গালিব উঠে পায়চারি করলেন কিছুক্ষণ।
টেবিলের ধারে দাঁড়িয়ে দেখলেন বাদশাহর দুটি গজল পরিমার্জনা করার জন্য তাঁর টেবিলে রয়েছে। তিনি পরিমার্জনা করেন নি। কারণ সেগুলো দরবারে নিয়ে যাওয়ার মতো সময় তিনি আর পাননি। তিনি পরে জেনেছিলেন যে লালকেল্লার একটি ছোট কুঠুরিতে বাদশাহকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। সেই কুঠুরির ছাদ খুবই নিচু আর দেয়াল চুনকাম করা মাত্র। দেয়ালের রঙ সাদা হওয়ার কারণে তিনি কাঠকয়লা দিয়ে সেই দেয়ালে কবিতা লিখেছেন। তিনি লালকেল্লায় যাওয়া-আসা করার অনুমতি পেয়েছিলেন এমন লোকদের দেখার বস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। গালিব শুনেছেন যে তাঁকে উঁকি দিয়ে দেখতে যেতো ব্রিটিশ কমিশনারের স্ত্রীরা। এমনকি নিচের দিকে কর্মরত ব্রিটিশরাও তাঁকে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে পড়তো।
কয়দিন আগে একজন এসে গালিবকে কেঁদে কেটে বলে গেলো বাদশার করুণ অবস্থার কথা। হায় খোদা, গালিব জোরে জোরে দম নিলেন। লোকটি বলেছিল, ছোটখাটো জীর্ণ মানুষটি জীর্ণতর হয়ে পড়েছিলেন। সুতি পোশাক পরে সারাদিন একটি নিচু চারপাইয়ের উপর বসে থাকতেন। অযত্ন অবহেলায় পোশাক নোংরা হয়ে গিয়েছিল। তাঁর শরীরে জড়ানো থাকতো নোংরা লেপ- চাদর। যে কেউ তাঁর ঘরে ঢুকলে তিনি তাঁকে কুর্নিশ করতেন। যে হুক্কাটি থেকে তামাক সেবন করতেন সেটি একপাশে সরিয়ে রাখতেন। আর যাদের কুর্নিশ করতেন তাদের বলতেন আপনাকে দেখে আমি খুশি হয়েছি।
গালিব দু’হাতে চোখের পানি মোছেন। ভাবেন, তিনিতো এই বাদশাহকে দরবারে দেখেছেন। তাঁর সামনে কেউই বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারতো না। তিনি ভীষণ অপছন্দ করতেন। রেগেও যেতেন। মানুষ এভাবেই বদলায়। এভাবেই পরিস্থিতি মানুষকে অন্য মানুষ করে দেয়। গালিব আর একজনের কাছে শুনেছেন যে শেষের দিকে তিনি একদম উদাসীন হয়ে গিয়েছিলেন। কোনো কথা বলতেন না। রাতদিন স্তব্ধ হয়ে থাকতেন। যেন তিনি মৌনব্রত অবলম্বন করেছিলেন। এই পৃথিবীতে তার সব কাজ ফুরিয়ে গেছে। বেঁচে থাকাটাও তার জন্য আর কোনো কাজ নয়।
তারপর গালিব অন্যজনের কাছ থেকে শুনেছেন যে তিনি নিজের কবিতা আপন মনে বলে যেতেন। কবিতাই তো বলবেন তিনি। কবিতাই তাঁর শেষ নিয়তি। কবির জীবনে পরিষ্কার কাপড় ছিল না, আরামদায়ক শয্যা ছিল না, তামাক সেবনের হুক্কাটি অকেজো হয়ে পড়েছিল, সাদা রঙের সুতি কাপড়ের পোশাকে স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না, কিন্তু চিত্তের সুস্থিরতার জন্য কবিতা ছিল, শুধুই কবিতা। চুনকাম করা সাদা দেয়াল ছিল কবিতার জন্য বিশাল ক্যানভাস। আহ, কবিতাই তো শেষ কথা। কবির জীবনে কবিতা ছাড়া আর কিইবা অবশিষ্ট থাকবে।
গালিব এইসব ভেবে অনেকক্ষণ ধরে বুক উজাড় করে কাঁদলেন। কাঁদার পর মনে হলো তাঁর ভেতরে নতুন করে শক্তি ফিরে আসছে। তিনি হৈ চৈ করে কাল্লু মিয়াকে ডাকলেন।
কাল্লু মিয়া এলো না। অন্য কেউও না। এমন কি বাচ্চা দু’জনও না। শেষ ভরসা উমরাও বেগম। তিনিও এলেন না। গালিব ধরে নিলেন আশেপাশে কেউ নেই। কোথায় গেলো সবাই? শহরটাতো এখন পর্যন্ত কোথাও যাওয়ার অবস্থায় ফিরে আসেনি।
যেদিন জেনারেল উইলসন দেওয়ানি খাসে বসে স্যাম্পেন পান করছিলেন দিল্লি তখন বিরান শহর। ব্রিটিশ সেনাদের অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য যে যেখানে পেরেছিল পালিয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় কোনো চিন্তা করার সময় ছিল না। সুযোগও ছিল না।
তারা শহরের বাইরে গিয়ে তাঁবু খাটিয়ে কিংবা মাথার ওপর সামান্য কিছুর ব্যবস্থা করে খোলা আকাশের নিচে বাস করতে শুরু করলো। মাথার ওপর রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-বাদল বয়ে গেলো। দুর্দশা চরমে উঠলো। বর্ষা গেল, শরৎ- হেমন্ত গেল—ঋতুতো আসবে, যাবে। পালা পরিক্রমায় ঋতু বদল ঘটবে। শীতকালে তাদের দুর্দশার সীমা রইল না। তারপরও ব্রিটিশরা তাদেরকে শহরে ঢোকার অনুমতি দিল না। কারাগারগুলোতে তিল ধারনের জায়গা ছিল না। শহরে ভৌতিক নিস্তব্ধতা ছমছম করতো। যারা শহর ছেড়ে যায়নি তাদের মধ্যে আমি একজন। আমি মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব—আমার ধনদৌলত কিছু নেই, সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে পেনশন বন্ধ—আমার আছে শুধু গজল। এই গজল নিয়েই আমি কবরে যাব। তিনি দ্রুতহাতে ‘দস্তাম্বু’র পৃষ্ঠা উল্টান। এই শহরে একা থাকার অনুভবে তিনি লিখেছিলেন, পুরো দিল্লি শহর খুঁজে এক হাজারের বেশি মুসলমান পাওয়া কঠিন। আমিতো তাদেরই একজন। যারা শহর ছেড়ে চলে গেছে তারা এত দূরেই গেছে যে মনে হয় তারা কখনোই দিল্লিতে বাস করেনি। গণ্যমান্য যারা, তাদের মধ্যে অনেকে আরাবল্লী পর্বতের ধারে কুঁড়েঘর বানিয়ে কিংবা মাটির নিচে গর্ত করে থাকতে শুরু করেছে। দেখেশুনে মনে হয় তাদের ভাগ্য ঘুমিয়ে পড়েছে। তারা এমনই অন্ধ যে কোনো দিনই আর তাদের চোখ খুলবে না।
‘দস্তাম্বু’তে অনেক কিছুই তো লিখেছেন, পাতার পর পাতা উল্টেপাল্টে পড়লেন। কখনো দম নিলেন, কখনো পানি খেলেন। ইদানীং সকালের নাস্তা, দুপুরের বা রাতের রুটি-কাবাব আর তেমনভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। কয়দিন ধরে সকালে মিসরির শরবত আর বাদামের গুঁড়ো খাচ্ছেন। উমরাও বেগমকে বললে তিনি বলেন, এটুকু খেয়েই আল্লার কাছে শোকর গোজারি করেন।
বড় কঠিন কথা বিবি। দিলে চোট লাগে।
স্বামীর কথা শুনে উমরাও বেগম কথা বাড়ান না। তারপর মৃদু স্বরে বলেন, কতদিন ধরে পেনশন বন্ধ ভুলে গেছেন?
ভুলবো কেন? আমিতো মনভোলা কবি নই।
তাহলে অনুযোগ করেন কেন?
অনুযোগ নয় বিবি। দুঃখ। দুঃখের ভাষা আমি খুঁজে ফিরি। জেনে রেখো কবিরও কখনো কখনো শব্দের অভাব হয়। কবি তাঁর ভাষা খুঁজে পান না।
আপনার এতসব কঠিন কথা আমি বুঝি না। আমি যাই। নাতি দুটো কোথায় গেলো দেখি।
উমরাও বেগম চলে গেলে তিনি গালে হাত দিয়ে ভাবেন, তিনি কি কখনো তাঁর বিবির দুঃখের ভাষা শুনেছেন? তাঁর কান্নার শব্দের মানে খুঁজেছেন? তিনি মাথা নেড়ে বলেন, না খুঁজিনি। অত কঠিন কাজ করার কথা আমি ভাবিনি। আমিতো নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত।
এই মুহূর্তে তিনি ‘দস্তাম্বু’র পৃষ্ঠায় দেখলেন খান বাহাদুর খাঁয়ের কথা লিখেছেন। তিনি বেরিলীতে সৈন্য জড়ো করেছিলেন। তাদের সর্দার হয়ে বসেছিলেন। বাদশাহকে উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন। একশো আশরাফি, অনেক রকম পণ্যের উপহারসামগ্রী, এমনকি হাতি, ঘোড়াও বাদশাহর জন্য পাঠিয়েছিলেন। এখন খান বাহাদুর খাঁ কেমন আছেন?
গালিব মাথা ঝাঁকালেন। মাঝে মাঝে মাথায় কিছু ভর করেছে মনে হয়। ভারী লাগে তখন। ঝাঁকালে খানিকটুকু স্বস্তি পান। এ অভ্যাসটি ইদানীং বেশি হচ্ছে। ভাবতে ভাবতে মাথাটা চেয়ারে হেলিয়ে দেন। ভাবেন, কতকাল তিনি আর কবিতার সঙ্গে থাকতে পারবেন? এখন বাদশাহ নেই, দরবারও নেই। মুশায়রার আসর নেই। ওহ, না, এভাবে জীবন বেশিদিন চলতে পারে না। তিনি ভীষণ অবসন্ন বোধ করেন।
আবার তাঁর মাথায় কিল্লায় যাতায়াতের দিনগুলো ভর করে। কিল্লার শেষের দিনগুলোতে তিনি আরাম-আয়েসে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। এর একটি কারণ বয়স। প্রৌঢ় হয়ে যাওয়ার ফলে স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটা। অন্য কারণ নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়ার ফলে অনিশ্চয়তার অনুভব। একই সঙ্গে কাজ করতো ঠিকমতো শুনতে না পাওয়ার অস্থিরতা। কেউ যখন কথা বলতো তখন তিনি তাঁর ঠোঁটের নড়াচড়ার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। বুঝতে চেষ্টা করতেন যে কি বলা হচ্ছে। বেশিরভাগ সময় বুঝতে না পারার কারণে নিজের ওপর রাগ বাড়তো। তখন আরও দুর্বল মনে হতো নিজেকে। সে সময় সপ্তাহে দু’একবার কেল্লায় যেতেন। যাওয়াটি বাধ্যতামূলক ছিল। না গিয়ে তো দরবারের সম্মান রক্ষা করা যায় না। তাই তাঁকে যেতে হতো। এই যাওয়ার সঙ্গে মাসিক পেনশনের হিসাব জড়িত ছিল। যেদিন বাদশাহ নিজের মহল থেকে বের হতেন সেদিন তাঁর সামনে হাজিরা দিতেন। কাজটি করতে তাঁর ভালো লাগতো। কারণ বাদশাহ কবি ছিলেন। একজন কবি তো আরেকজন কবির সামনে হাজির থাকবেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলবেন। তাঁর কথা শুনবেন। সৌজন্য বিনিময় হবে এবং এই বিনিময়ের মধ্যে কবি দীর্ঘ আয়ুর স্বপ্ন দেখবেন। আহ, কি সুখের দিন ছিল সেগুলো। যেদিন বাদশাহ নিজের মহল থেকে বের হতেন না, সেদিন তাঁর খারাপ লাগতো। অস্থিরতা বোধ করতেন। মনে হতো কবিতার পাতাগুলো উড়ে যাচ্ছে সময়ের ঝড়ে। দেওয়ান-খাস-এ বসে থেকে বাড়ি ফেরার সময় নিজেকে শোকার্ত মানুষের মতো মনে হতো। সে সময় বাদশাহর কবিতার পরিমার্জনা কারো হাতে দিয়ে আসার স্বস্তি পেতেন না। কিন্তু উপায় ছিল না। কাজটি যে করেছেন তা বোঝানোর জন্য কারো না কারো কাছে রেখে আসতে হতো। তারা পাঠাতেন বাদশাহর কাছে। সেদিন কবির সঙ্গে কবির যোগাযোগ হতো না। মনে হতো তিনি আড়াল হয়ে গেলেন কোনো শূন্যে। তারপরও তো খাদ্যের নিশ্চয়তা ছিল জীবনে। কেল্লার সঙ্গে এই সম্পর্ক ছিল বলেইতো সংসার সচল ছিল। নাতিদের ফল-মিঠাই ছিল। নিজের জন্য রুটি-কাবাব ছিল। সবচেয়ে প্রিয় শরাব ছিল। আহ শরাব! না খেলেতো বেঁচে থাকা ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতো।
বাড়ি ফেরার পথে আকাশ দেখতেন। চাঁদনি চক, জামা মসজিদ দেখতেন আর ভাবতেন আকাশের ইচ্ছা অন্যরকম। শহরে জোর গুজব চলছে যে সিপাহীদের একটি অংশে এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজকে কেন্দ্র করে ধূমায়িত ক্রোধ জমেছে। ভারতীয় সৈনিকদের প্রতি ব্রিটিশদের আচরণ খুবই বৈষম্যপূর্ণ। এটিও ক্ষোভের আর একটি কারণ ছিল। একজন ভারতীয় সেনা সবচেয়ে যে উঁচু পদে পৌঁছতে পারে তাহলো সার্জেন্টের পদ। অন্যদিকে যে কোনো ব্রিটিশসেনা সরাসরি উঁচু পদে যোগ দেয়ার সুযোগ পায়। আরও যে দিকটি দীর্ঘদিন ধরে বিক্ষোভকে ধূমায়িত করেছিল তাহলো ব্রিটিশসেনাদের মেস এবং ভারতীয় সেনাদের থাকার জায়গার মধ্যে ছিল আকাশ-পাতাল তফাৎ। এত বৈষম্য মেনে নেয়া কঠিন।
শেষে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠার জন্য ধর্মকে কাজে লাগানো হলো। এনফিল্ড কার্তুজে গরু ও শুয়োরের চর্বি আছে, যে কার্তুজ দাঁত দিয়ে ছিঁড়তে হয়, এমন প্রচারণা শুরু হলো। এটুকু ভেবে গালিব আকাশের দিকে তাকালেন। মনে হলো আকাশের ইচ্ছা একটি নতুন বিদ্রোহ জন্ম দেওয়ার। তিনি চারদিকে তাকিয়ে বললেন, আমিতো কবি। আমি আরাম এবং শান্তি চাই। আমি নিশ্চয়তা চাই। আমি অনবরত কবিতার ফুল ফুটে ওঠা দেখতে চাই। এসব কিছু ধ্বংস হোক আমি তা চাই না। যদি এর উল্টো কিছু ঘটে তবে শত্রু ও বন্ধু সবাইকেই আকাশের ধ্বংসমুখী ইচ্ছায় শেষ হয়ে যেতে হবে। এটাই হবে নিয়তির শেষ কথা।
তিনি আরও শুনতে পান যে দিল্লির কট্টর মুসলমানরা সিপাহীদের এই বিক্ষোভে সমর্থন দিচ্ছে। জেহাদের ডাক দেয়ার কথা ভাবছে। তাঁর বুক দুরদুর করে। এমন কিছু ঘটার আশঙ্কায় থাকেন। এবং শেষ পর্যন্ত তাই ঘটে। ১০ মে কার্তুজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করে মীরাটের সিপাহীরা। তাদেরকে কঠিন শাস্তি দেয়া হয়। ফলে সেনানিবাসে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।
ব্রিটিশ সেনা ও অনেক অফিসারকে হত্যা করে সিপাহীরা দিল্লির পথে যাত্রা করলো। দিল্লিতে যে সৈনিকরা ছিল তারা বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিল।
শহর দখল করল বিদ্রোহীরা।
ইংরেজ অফিসার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে সিপাহীদের হত্যা করার প্রতিশোধ নিল।
এরপর ওরা লালকেল্লায় গেল।
ওখানে ছিল ব্রিটিশের পেনসন লাভ করা নামমাত্র সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। তাঁকে তারা বাধ্য করলো হিন্দুস্থানের শাসক হিসেবে দায়িত্ব নিতে।
বিদ্রোহীদের একটি আবেদনে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হলেন বাদশাহ।
দিল্লির উলেমারা জেহাদের ঘোষণা দিলেন। দিল্লির কয়েকজন অভিজাত শ্রেণীর ব্যক্তিকে নিয়ে একটি সরকার গঠিত হলো। বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর স্বাধীনতার প্রতীক হলেন। নতুন করে ফিরিয়ে আনা স্বাধীনতা। এতকিছু ভাবনার পরে তিনি নিজেকেই বললেন, ইতিহাসের একটি ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলেন গালিব। কিন্তু নিজেকে প্রকাশ করার সাধ্য তাঁর নেই। নিজে নিজে ক্রুদ্ধ হতে পারেন। ঘটনার বিশ্লেষণ করতে পারেন। বুকের কথা বুকের ভেতর রাখতে হবে তাঁকে। কারণ ব্রিটিশের পেনসনের কাছে জিম্মি তাঁর জীবিকা। হায় গালিব! হায় কবি! হায় কবিতা!
.
পরদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন পণ্ডিত মতিলাল। গালিব তাঁকে দেখে খুশি হন।
কেমন আছেন পণ্ডিতজী?
এটাতো ভালো থাকার সময় নয় মির্জা সাহেব।
ঠিক বলেছেন।
গদরের পর থেকে তো আপনি দরবারে অংশ নেয়ার অনুমতি পাননি।
সত্যি কথা। পেনশনও বন্ধ।
খুব কষ্ট হচ্ছে?
গালিব বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়েন। তারপর দ্রুত মাথা নেড়ে বলেন, নিজের অভাবের কথা এত বলা ঠিক নয়।
শুনেছিলাম আপনার বিবির গয়নাগুলো লুট হয়ে গিয়েছে কালে সাহেবের বাড়ি থেকে।
ঠিকই শুনেছিলেন। এখন আমার বাড়িতে বিছানা আর পরার কাপড়চোপড় ছাড়া আর কিছু নেই। দামী জিনিসপত্র যা ছিল সেগুলোও আমার বিবি কালে সাহেবের হেফাজতে দিয়েছিল।
থাক আফসোস করবেন না।
আফসোস করব না? গালিব খানিকটা উত্তেজিত হন। বলেন, আফসোস করার বাকি কিছু নেই পণ্ডিতজী। শুনুন এতটা বছর ধরে একদিনও যদি শরাব পান করে না থাকি তাহলে আমি কাফের। আর একবারও যদি নামাজ আদায় না করেছি তাহলে আমি অপরাধী। বুঝুন এবার, এরপরও সরকার আমাকে বিদ্রোহী মুসলমানদের মধ্যে ফেলেছে। বলুন এর কি কোনো উত্তর পাওয়া যাবে?
পণ্ডিত মতিলাল বলেন, বোধহয় না। আমি অন্তত তাই বুঝি।
পণ্ডিতজী আপনি পাঞ্জাবের লেফটেন্যান্টের মীর মুনসী-
থাক, থাক। এসব কথা আর বলবেন না। আপনি তো শুনেছেন যে বোম্বের গভর্নর লর্ড এলফিনস্টোন ইংরেজ সৈনিকদের বর্বরোচিত আচরণকে অপরাধ বলে মন্তব্য করেছেন।
হ্যাঁ, আমি একথা শুনেছি। তবে এটাও সত্যি যারা বিজয়ী হয় তারা কখনোই পরাজিতদের দয়া দেখায় না। ইতিহাস এমন কথাই বলে। ব্রিটিশসেনাদের নির্মমতা নাদির শাহকেও হার মানিয়েছে।
ঠিক বলেছেন। ওরা বাদশাহর বিচার করেছে ওদের আদালতে। শাহাজাদাদের বেশির ভাগেরই কোনো বিচার হয়নি। তাঁদের জন্য একটাই শাস্তি ছিল। মৃত্যু। ব্রিটিশ অফিসার হডসন ওদের নির্যাতন করে মেরে ফেলার দায়িত্ব নিয়েছে।
হডসন অনেককে এক সঙ্গে ফাঁসি দিয়েছে। ওহ নিষ্ঠুরতা।
গালিব অস্ফুট আর্তনাদ করে।
মতিলাল ভাঙা কণ্ঠে বলে, সামনে আরও কত কি দেখতে হবে জানি না।
গালিবের কণ্ঠে আগের মতোই আর্তনাদ, আমরাই বাঁচবো কিনা জানি না।
হ্যাঁ, আমরাও। মতিলালের ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে ঘরের নিস্তব্ধতা প্রগাঢ় হয়। যেন এই ঘরের কেউ কোনোদিন নিঃশ্বাস ফেলেনি। এখানে জীবন নামক কোনো শব্দ ধ্বনিত হয় না।
কাল্লু মিয়া এক গ্লাস মিসরির শরবত নিয়ে আসে। সঙ্গে দুটো আখরোট।
গালিব নিস্তেজ কণ্ঠে বলে, আপনাকে আপ্যায়নের জন্য আমার এটুকুই সম্বল মাত্র।
শুকরিয়া, মির্জাজী।
মতিলাল পণ্ডিত এক চুমুকে শরবত শেষ করেন। বোঝা যায় যে তিনি খুব পিপাসার্ত। গালিব দু’চোখ মেলে পণ্ডিতের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বলেন, আপনার খুব পিপাসা পেয়েছিল পণ্ডিতজী। আমাদের সবার বুকের মধ্যে ভীষণ পিপাসা। আমরা হা-হুতাশ করে দিন কাটাচ্ছি।
মতিলাল পিরিচের ওপর ঠক করে গ্লাস রাখেন। গালিব নিশ্চুপ বসে থাকেন। বয়সী মানুষের ক্লান্তি তাঁকে পেয়ে বসে। গ্লাস রেখে রুমাল বের করে মুখ মোছেন মতিলাল। গলা উঁচু করে বলেন, ব্রিটিশরা নিজেদের সভ্য জাতি বলে মনে করে। কিন্তু যে নির্মমতা দেখাচ্ছে ওরা তাতে সভ্য শব্দের মানে খোঁজা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।
গালিব নিশ্চুপ বসে থাকেন। মনে হয় তাঁর শরীরজুড়ে ব্যথা হচ্ছে। কানে তো অনেকদিন ধরে কম শোনেন, এখন যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না। পুরো বধির হয়ে গেলেন বুঝি।
মতিলাল বলে যাচ্ছেন, ব্রিটিশরা শহর থেকে বের করে দিয়েছে অসংখ্য মানুষকে। তার কোনো হিসেবে নেই। ‘কানপুর ডিনারের’ নামে করা হয়েছে নৃশংস কর্মকাণ্ড। মুমূর্ষু সিপাহীদের মুখে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে নিষিদ্ধ গরু ও শূকরের মাংস। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে কাজটি করা হয়েছে। আরও শুনবেন ওস্তাদজী?
গালিব এখনো নিশ্চুপ। ঘাড় নেড়েও প্রকাশ করেন না যে তিনি শুনবেন।
মতিলাল বলতে থাকেন, ব্রিটিশ সেনারা কলকাতা থেকে দিল্লি আসছিল। তাদের সেনাপতি বারানসী ও এলাহাবাদের শহরগুলোকে ছারখার করে দিয়েছে। বিদ্রোহী সিপাহী ও শহরের বাসিন্দাদের অকাতরে নিধন করেছে। তার নিষ্ঠুরতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন লর্ড ক্যানিং। সেই সেনাপতির জায়গায় নিয়োগ দিয়েছেন হ্যাভলককে। তিনিও সভ্য ব্রিটিশদের একজন যিনি হত্যাকাণ্ডে অত্যন্ত পারদর্শী।
গালিব মতিলালের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কানপুর শহরের নানা সাহেবকে আমি চিনি। তিনি মারাঠা রাজবংশের উত্তরাধিকারী।
এটুকু বলে চুপ করে গেলেন গালিব। অন্য দিকে মুখ ফেরালেন।
মতিলাল তাঁর কথার জের টেনে বললেন, নানা সাহেব বিদ্রোহীদের নেতা। তাঁর দেহরক্ষীর নাম তাঁতিয়া তোপী। তাঁর সচিব পণ্ডিত আজিমউল্লাহ।
এটুকু বলার জন্য গালিব আবার সরাসরি মতিলালের চোখে চোখ রাখলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আজিমউল্লাহ পণ্ডিত মানুষ।
মতিলাল আবার তাঁর কথার সূত্র ধরে বললেন, তিনি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ মেধাবী লোক। বেশ কয়েকবার ইউরোপ ঘুরে এসেছেন।
কেমন আছেন তাঁরা?
গালিব এবার সরাসরি মতিলালের দিকে তাকান না। অন্য দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটি করেন।
মতিলাল সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলেন, হ্যাভলক সেনাপতির পদ পেয়ে আরও নিষ্ঠুর হয়ে উঠল। কানপুরে সিপাহীদের খাদ্যের অভাব দেখা দিল। পাশাপাশি ছিল আরও নানা রকম সমস্যা। এই সুযোগে সিপাহীদের সঙ্গে যুদ্ধবাধায় হ্যাভলক। তারপরও তাকে দু’বার যুদ্ধ করতে হয়। শেষ পর্যন্ত দখল করে কানপুর।
জানতে চেয়েছিলাম যে কেমন আছেন নানা সাহেব আর আজিমউল্লাহ?
শুনেছি তাঁরা পালিয়ে গেছেন।
পালিয়ে গেছেন? কোথায়?
ব্রিটিশের চোখে ধুলা দিয়ে তাঁরা নেপালে চলে গেছেন।
ওহ, এটি একটি সুসংবাদ। খোদাতালা তাদের রক্ষা করুন।
নানা সাহেবের দেহরক্ষী তাঁতিয়া তোপী গোয়ালিয়র থেকে সৈন্য সংগ্ৰহ করে যত সম্ভব দ্রুতগতিতে কানপুরে পৌঁছান। সেখানে গিয়ে ব্রিটিশ সেনাপতি উইন্ডহ্যামকে পরাজিত করে আবার কানপুর দখল করে নেন। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেননি। সেনাপতি ক্যাম্বেল খবর পেয়ে কানপুরে আসেন। তাঁতিয়া তোপীকে পরাজিত করে কানপুর দখল করে।
শুনেছি ক্যাম্বেল লক্ষ্ণৌতে আছে?
এই বিষয়টি পুরোপুরি জানি না। শুধু এটুকু জানি যে তিনি লক্ষ্ণৌ দখল করতে পারেননি। সিপাহীরা দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্ণৌ অবরোধ করে রেখেছে। ব্রিটিশ ক্যান্টনমেন্টের সৈনিকরা রেসিডেন্সিতে আশ্রয় নিয়েছে। হ্যাভলক তাদেরকে উদ্ধার করতে গিয়েছিল। কিন্তু সিপাহীরা তাকেও অবরুদ্ধ করে রাখে। সেনাপতি ক্যাম্বেল গোলান্দাজ বাহিনীর সহায়তায় অবরোধ ভেঙে ফেলছে। কিন্তু লক্ষ্ণৌ দখল করতে পারেনি।
এটুকু বলে মতিলাল থামলেন। যেন তার দম নেয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কিন্তু গালিব তাকে অবসর দিলেন না। দ্রুত জিজ্ঞেস করলেন পন্ডিতজী আপনি কি জানেন আহমদউল্লাহর খবর?
তাঁর নেতৃত্বে ওয়াজেদ আলি শাহর নাবালক ছেলেকে তখতে বসানো হয়েছে। তারা এখনো শক্ত অবস্থানে আছে। শাসন ব্যবস্থা এখনো ভেঙে পড়েনি। তবে আমার মনে হয় কানপুর তো দখল করেছে ব্রিটিশরা। এবার বোধহয় লক্ষ্ণৌর ওপর বড় ধরনের আক্রমণ হবে।
সামনে অনেক যুদ্ধ পণ্ডিতজী। আমরা এই কালের সাক্ষী হয়ে রইলাম। দুজনে আবার স্তব্ধ হয়ে যান। আবার স্তব্ধ সময়ের নিঃশব্দ স্রোত বয়ে যায় তাঁদের উপর দিয়ে। তাঁরা মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেন।
কাল্লু মিয়া প্রবেশ করে। বলে, হুজুর, আমার মায়ের পেট ব্যথা করছে। দাওয়াই লাগবে।
মতিলাল নিজের পকেট থেকে পয়সা বের করে কালুকে দেন। কালু চলে যায়। গালিব কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, শুকরিয়া পণ্ডিতজী। আপনি সাহায্য না করলে আমি ওর মাকে দাওয়াই কিনে দিতে পারতাম না।
থাক, দুঃখ করবেন না। আমাদের এমন দূরবস্থার অবসান ঘটবে নিশ্চয়ই।
মতিলাল যাবার জন্য উঠে দাঁড়ান। দাঁড়িয়েই বলেন, দিল্লির চিফ কমিশনারের আগমনের কথা শুনেছি। তিনি এলে আপনার পেনশনের একটা সুরাহা হতে পারে হয়তো।
আমিতো বরাবরই কোনো হাকিম দিল্লি এলে তাঁর উদ্দেশে একটি কসীদা লিখে পাঠাই। এবার কে এসেছেন? তাঁর নাম কি?
স্যার জন লরেন্স।
ঠিক আছে তাঁর প্রশংসায় একটি কসীদা লিখবো।
নিশ্চয় বিজয় ও অভ্যর্থনাসূচক রচনা হবে?
হ্যাঁ, তাই। এর বেশি আর কি।
মতিলাল যেতে যেতে বলেন, হ্যাঁ, এর বেশি আর কি। আর কিছু না।
গালিব ভাবলেন, একটি কসীদা লিখে শুক্রবারই ডাকে পাঠিয়ে দেবেন।
কসীদা লিখবেন বলে ভাবছিলেন তখন উমরাও বেগম এলেন।
কিছু হয়েছে বিবি?
দোকানদার আমাদেরকে ধারে জিনিস দেবে না বলেছে। আজ রাতে শুকনো রুটি খেতে হবে।
গালিব চুপ করে থাকেন।
উমরাও বেগম আবার বলেন, বাচ্চারা এসব খেতে চায় না। ওরা খুব অস্থির হয়ে পড়েছে।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে উমরাও বেগম আবার বলেন, এদিকে জিনিসপত্রওতো ঠিক মতো পাওয়া যায় না। আমরা যে কি করবো।
আমি কিছুই জানি না বিবি।
আমি কি করবো? কি হবে বাচ্চা দুটোর?
উমরাও বেগম বলতে বলতে বেরিয়ে যান। তিনি বিছানায় শুয়ে পড়েন। মনে হয় চারদিকে ভীষণ অন্ধকার। এই অন্ধকার কাটার অপেক্ষায় কতকাল থাকতে হবে কে জানে! মনে মনে আওড়াতে থাকেন নিজেরই লেখা শের :
‘কানে আর আসে না কোনো বার্তা,
চোখ দেখতে পায় না তার রূপ,
একটি তো হৃদয়, তাও হতাশায় এমন বিক্ষত।’
একটি শের দু’তিন বার আউড়িয়ে তিনি আবার অন্যটিকে সামনে আনলেন :
‘বাসনার বর্ণে উজ্জ্বল ফুলবাগিচা তো হেমন্তের স্পর্শে শুকিয়ে গেলো;
তবু বাকি রইলো এমন এক বসন্ত যার রঙ ফিকে,
যার বাতাসে মুমূর্ষু আশার শেষ দীর্ঘশ্বাস।’
একটি শেষ হলে আর একটি শের তাঁর মনে আসে। তিনি আবার সেটি বলতে থাকেন। বলেই যান। তিনি আজ নিজের শেরের ঘোরে ঢুকে পড়েন। বুকভরা আর্তনাদে ভরপুর শেরগুলো আঁকড়ে ধরে তিনি বেঁচে থাকার আশ্রয় খোঁজেন। ভাবেন এভাবেই তো কাটলো জীবন, সামনে আর কয়দিনই বা আছে? ভাবতে ভাবতে ঘুম আসে তাঁর।
ঘর জুড়ে ধ্বনিত হতে থাকে তাঁর কণ্ঠ :
‘একটু সামলে নিতে দাও, হে নৈরাশ্য; এ কী প্রলয় কাণ্ড!
বন্ধুর ধ্যানের যে অঞ্চল প্রান্তটুকু আমার হাতের মুঠোয়
ছিল তা-ও ফসকে যাচ্ছে।’
কণ্ঠস্বর কোনো স্তব্ধতার আড়ালে চাপা পড়ে না। গালিবের কণ্ঠস্বর দিল্লির মাটি ছুঁয়ে ভেসে যায় হিন্দুস্থানের সবখানে — গালিবের কণ্ঠস্বর সময়ের পৃষ্ঠা ছুঁয়ে ভরে দেয় ইতিহাসের খেরোখাতা। স্বপ্নের ভেতরে গালিব তখনও আউড়ে যান নিজের লেখা শের।
.
পরদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে হীরা সিং। গালিবের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের পরিচয়। সে তাঁর সাগরেদও একজন। গালিবের মতে সে একজন সৎ যুবক। নিজের কাজটি ভালো বোঝে। বেশ অনেকদিন পরে দেখা করতে এসেছে। গালিব তাকে দেখে খুব খুশি হলেন।
তুমি কেমন আছ হীরা সিং?
ওস্তাদজী আপনি আমাকে মাফ করবেন। আমি অনেকদিন আসতে পারিনি।
আগে তুমি নিয়মিত আসা-যাওয়া করতে।
আগে নিয়মিত আসা-যাওয়ার সময় ছিল। এখন তো তা নেই।
তোমার জীবনও কি তোমার হাতের মুঠোয়?
সে রকমইতো মনে হয়।
বিনয়ে মাথা নিচু করে রাখে হীরা সিং। গালিব নিশ্চুপ হয়ে যান। আর কি বলবেন? কথা তো এক রকম ফুরিয়ে গেছে বলেই মনে হয়।
হীরা সিং হাতের পোটলা থেকে এক বোতল দেশী মদ বের করে। ওটার দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে গালিবের চোখ।
ওস্তাদজী আমি শুনেছি আপনি এখন আর নিয়মিত শরাব পান করতে পারেন না।
কি করে পারবো? দোকানদার বাকি দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সংসারের রোজকার জিনিসপত্রই মিলছে না।
কাল্লু মিয়াকে একটি পেয়ালা আনতে বলুন।
কিন্তু হীরা সিং আমি যে গোলাপ জল মিশিয়ে মদ পান করি সেই গোলাপ জলও এখন আমার মজুত নাই।
আপনি চিন্তা করবেন না। আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।
হীরা সিং বেরিয়ে যায়। বোতলটা গালিবের পায়ের কাছে রাখা। তিনি সেটা হাতে উঠিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেন। তারপর আগের জায়গায় রেখে দেন। কাল্লু মিয়াকে পেয়ালা আনার জন্য ডাকবেন ভাবলেন, কিন্তু ডাকলেন না। অপেক্ষা করলেন হীরা সিংয়ের ফিরে আসার জন্য। সেই সময় শিবজী রামের কথাও মনে হলো। ওতো তাঁর ছেলের মতো। তাঁর ভালো মন্দের দিকে খেয়াল রাখে। একবার দোকানের দেনা শোধ করে এসে দোকানির দেয়া কাগজের উল্টো পিঠে একটা শের লিখে দিতে বলেছিল। অনেক দিন শিবজী রামের দেখা নেই। ও সুস্থ আছে তো? বালমুকুন্দই বা কেমন আছে? শিবজী রামের ছেলে ও। বালমুকুন্দও বাবার মতো ওর দিকে খেয়াল রাখে। কতইবা বয়স ওর? মাঝে মাঝে বাদাম নিয়ে এসে বলতো, দাদু আপনার জন্য। কাল্লু মিয়াকে বলবেন এগুলো যেন আপনাকে গুঁড়ো করে দেয়।
হায় নসীব, কত প্রিয় মুখ এখন পাশে নেই। ফিরে আসে হীরা সিং। হাতে বেশ কয়েকটি গোলাপ জলের শিশি। মদের বোতলের কাছে ওগুলো রাখতে রাখতে বলে, কয়েক তোলা বাদামও এনেছি। আপনি বাদাম খেতে ভালোবাসেন।
ভালোবাসার সবকিছু কি আমার পাশে আছে হীরা সিং?
সময়টাতো খারাপ। থাকবে কি করে?
আমার প্রিয় বন্ধু হরগোপাল তুফতা এখন আমার কাছে নেই। দূরের শহরে বাস করছে এখন।
আপনি ওকে প্রীতির বশে মির্জা তুফতা বলে ডাকেন।
গালিব হেসে বলেন, তুমি মনে রেখেছো দেখছি।
আপনার কত কিছু যে আমার স্মৃতিতে গাঁথা আছে তা আমি আপনাকে
বলে শেষ করতে পারবো না।
আহ, হীরা সিং তোমার মতো যুবক হয় না। আসলে ভালোবাসা আর যত্ন পেলে আমি কৃতার্থ হই।
কাল্লু মিয়াকে পেয়ালা আনতে বলি?
বলো।
হীরা সিং কাল্লু মিয়াকে ডাকে। একটু পরে পেয়ালা আসে। কাল্লু মদের সঙ্গে গোলাপ জল মিশাতে থাকে।
গালিব হাসতে হাসতে বলেন, কয়দিন আগে মির্জা তুফতা আমাকে মীরাট থেকে একটি হাঁড়ি পাঠিয়েছে। চিঠি আর গজল ও সব সময় পাঠায়। এতে ওর ভুল হয় না। বরং গজল পরিমার্জনা করতে দেরি হলে তাগাদা পত্ৰও দেয়।
কাল্লু মিয়া মদের পেয়ালা বাড়িয়ে ধরে বলে, হুজুর।
শুকরিয়া কাল্লু মিয়া।
কাল্লু বেরিয়ে গেলে হীরা সিংও উঠে দাঁড়ায়। গালিব তার হাত ধরে বলে, আর একটু বোস।
আমার একটু কাজ আছে।
জরুরি কাজ?
হ্যাঁ, একটু জরুরি। আমি আপনাকে দেখতে এসেছিলাম।
নাকি এই বোতলটা দিতে?
দুটোই। দুটো মিলেই একটি।
আবার কবে আসবে?
খুব শিগগিরই। দেখি যত তাড়াতাড়ি পারি।
বড্ড একা হয়ে পড়েছি।
হীরা সিংয়ের মনে হয় বড় মিনতিভরা কণ্ঠ। গালিব তো এমন মানুষ নন। গালিব মদের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলেন, ঠিক আছে যাও।
হীরা সিং চলে যাওয়ার পরও ঘরের দরজা খোলা থাকে। মৃদু বাতাস ঢোকে ঘরে। গালিব আরাম বোধ করেন। একটু একটু করে প্রিয় নেশায় মগ্ন হওয়ার পরও বিষণ্ণতা তাড়াতে পারেন না। ভাবতে কষ্ট হচ্ছে যে এই শহরে মুসলমান কত কমে গেছে। আগে শহরের প্রায় প্রতিটি ঘরে তাঁর চেনাজানা ছিল, বন্ধুরা ছিল। প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসতো। গালগল্প হতো। চৌরস খেলা জমে উঠতো। রাতে সেইসব বাড়িতে আলো জ্বলতো, সকালে চুলোয় ধোঁয়া উড়তো। এখন তেমন কিছুই নেই। যেন নিভে গেছে সব আলো। কোথাও কোলাহল নেই।
তিনি পেয়ালায় শেষ চুমুক দিলেন। নিজেকেই বললেন, এখন আমি নিজের ছায়ার সঙ্গে একাই বসে থাকি। হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ভাবলেন, শের ও কবিতার ঐশ্বর্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখবো কীভাবে? যতক্ষণ প্রবল যন্ত্রণায় মথিত হতে থাকব, ততক্ষণ অন্য কোনো অনুভবই আমাকে ছুঁতে পারবে না।
পরদিনই তেরোটি তোপের শব্দ শুনতে পেলেন তিনি। বুঝতে পারলেন যে চিফ কমিশনার দিল্লিতে পৌঁছে গেছেন। তোপের ধ্বনিতে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়েছে। গালিব খুশি হয়ে উমরাও বেগমকে ডাকলেন।
উমরাও বেগম কাছে এসে দাঁড়ালে বললেন, তোপের আওয়াজ শুনেছো বিবি?
শুনেছি। আপনার কোনো উপকার হবে তাতে?
হতে পারে বিবি। এবার হয়তো পেনসনের ব্যবস্থা হবে।
উমরাও বেগম অবসন্নের মতো বসে পড়েন। তিনি ক্লান্ত এবং বিপর্যস্ত। স্বামীর কথায় খুব একটা উৎসাহিত হন না। ক্লান্ত কণ্ঠে বলেন, যতক্ষণ পেনসন না হবে ততক্ষণ আমার বিশ্বাস নেই।
ধৈর্য ধর বিবি। তোমার ভাই জিয়াউদ্দিন আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে পেরেছে, এটাও আমাকে আশাবাদী করছে।
আপনাকে করতে পারে, আমাকে করছে না।
কেন? তিনি লোহারু বংশের সূত্রে নওয়াব বলে?
না। উমরাও বেগম শক্ত মুখে কথা বলেন।
তবে? গালিব অবাক হন।
তিনি জামা মসজিদের দশজন সদস্যের একজন বলে। এতে আর ক্ষমতার এমন কি হলো?
বিদ্রোহের পরে ইংরেজরা ভারতীয়দের আবার বিভিন্ন কাজে যুক্ত করছে বিবি। এটি একটি আশার কথা।
করতেইতো হবে। ওরা কি জাহাজ বোঝাই ইংরেজ এনে ভারতবর্ষ ভরে ফেলবে নাকি? এত সোজা?
গালিব স্ত্রীর কথায় বিস্মিত হন। উমরাও বেগমতো ঠিক কথাই বলেছেন। একদম খাঁটি কথা। তবে আশার কথা এই যে, শুধু হিন্দুদের প্রশাসনে যুক্ত না করে মুসলমানদেরও করছে। মিউনিসিপ্যালিটি ও জামা মসজিদ কমিটিতে ভারতীয়রা প্রতিনিধিত্ব করছে। তবে যেসব মুসলমানরা মুঘল দরবারের সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের ডাকা হলো না। মেরে ধরে শেষ করার পরও এখনও অনেকে কষ্টকর জীবনের পীড়নে দিন গড়াচ্ছে। সে তো তিনি দু’চোখে দেখতে পাচ্ছেন।
আপনি কিছু বলছেন না যে?
তুমি ঠিক কথা বলেছো বিবি। মসজিদ কমিটির ভূমিকা এই যে জামা মসজিদ সৈনিকদের হাত থেকে ছাড়া পেয়েছে। সিঁড়িতে আবার বসেছে কাবাবের দোকান। বিক্রি হচ্ছে মুরগির ডিম আর পায়রা।
গালিব হা হা করে হেসে উঠলেন। উমরাও বেগম অনুভব করলেন যেন দমকা বাতাস বেরিয়ে গেল তাঁর স্বামীর বুকের গহ্বর থেকে।
হাসছেন যে?
আমি মুরগির ডিম খেতে ভালোবাসি। পায়রার গোস্তও।
নির্বিকার ভঙ্গিতে উমরাও বেগম বললেন, দিল্লি বহুত দূরস্ত।
তুমি আমার সঙ্গে রসিকতা করছ বিবি?
তওবা, তওবা, আমি তা করবো কেন।
কারণ আমরা এখন বিছানা আর পরার কাপড় বিক্রি করে দিন চালাচ্ছি।
উমরাও বেগম কথা বললেন না। কেবল শ্বাস ফেললেন।
গালিব জোরের সঙ্গে বললেন, এতে কি এই মনে হয় না যে অন্যরা রুটি খায়, আর আমি খাই কাপড়। ভয় পাচ্ছি যে সব কাপড় খাওয়া হয়ে গেলে আমাদের কি হবে?
আপনি রসিকতা করছেন। আমি জানি আপনি রসিকতা করতে পছন্দ করেন।
আমিতো খাঁটি কথাই বোঝাতে চাই।
কখনো তা তীরের মতো বুকে এসে বিঁধে।
উমরাও বেগমের কথা পাশ কাটিয়ে তিনি বললেন, ভেবে দেখো বিবি যে এখনও পুরনো চাকর-বাকরদের মধ্যে দু-তিনজন আমাদের ছেড়ে যায়নি।
এটা আমাদের সৌভাগ্য।
ওদেরকে আমার খাওয়াতে হচ্ছে।
ওদের ছাড়া আমাদের চলে না। আমরা ওদের ওপর নির্ভরশীল।
ওরা অনেক কিছু চায় যা আমি পূরণ করতে পারি না। তখন আমার বেঁচে থাকা অসহ্য লাগে। এইভাবে আর কতদিন? এর থেকে মুক্তির নামইতো মৃত্যু? তাই না?
না। আমরা অনেক মৃত্যু দেখেছি। সাতটি সন্তান হারিয়েছি।
হায় বিবি, নসীব আপনা, আপনা।
আপনার দিনলিপিটি লেখা কবে শেষ হবে?
জানি না, জানি না। এমন হতে পারে যে যেটুকু লিখেছি তার বেশি আর লেখা হবে না। আমার পাঠকরা খুবই হতাশ হবে। ভবিষ্যতে নিন্দা আর ধিক্কার ছাড়া আমার ভাগ্যে আর কিইবা থাকবে।
গালিব দু’হাতে মুখ ঢাকেন।
নিশ্চুপ বসে থাকেন উমরাও বেগম। তাঁর মুখে কথা নেই। একজন কবির আর্তনাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কথা বলার সাধ্য কি তাঁর আছে?
এক সময় দু’হাত চুলে ঢোকান তিনি। দাড়িতে হাত বোলান। উমরাও বেগমের দিকে না তাকিয়েই বলেন, একদিন যদি আমার আবার পেনসন পাওয়া যায় তবুও আমি কি দুঃখ তাড়াতে পারবো? বোধহয় না। যে ঋণ আমার ঘাড়ে আছে সেটাও বোধহয় শোধ করতে পারবো না। আর যদি পেনসন না পাই তাহলে পুরো বুক ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। তখন আমার আর দিল্লিতে থাকা হবে না। অন্য কোথাও চলে যেতে হবে।
উমরাও বেগম উঠে দাঁড়ান।
গালিব মৃদু হেসে বলে, কোথাও যেতে হলে আমি আগ্রায় যাবো।
আমিও আগ্রাতেই যেতে চাই।
আমাদের দুজনেরই প্রিয় শহর। তাই না বিবি?
আহা রে, ছোটবেলার দিনগুলো যদি ফিরে পেতাম!
ওহ সেই যমুনা নদী। যে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আমি সূর্য ডুবতে দেখেছি। সূর্যের শেষ রশ্মির লাল আভায় রঙিন হয়ে যেতো নদীর পানি। এখনও সেটা আমার স্বপ্নের মতো লাগে। সেই আগ্রাতেই আমি কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম।
ঘরে পায়চারি করেন গালিব। বেরিয়ে যান উমরাও বেগম। গালিব ভাবলেন, ‘দস্তাম্বু’র শেষ অংশটা লিখে শেষ করা উচিত। তারপর বইটি ছাপতে হবে। ছাপার কাজটি কাকে দেবেন তা ভাবতে থাকেন।
.
দুদিন পরে আলতফ এলেন। কথা বলার আগেই চোখ মুছলেন। গালিব অস্থিরভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। অপেক্ষা করলেন। তাকে শান্ত হওয়ার সময় দিলেন।
এক সময় গালিব নিজেই জিজ্ঞেস করলেন, বড় ধরনের খারাপ খবর?
আপনিতো জানেন কবি তর্ক ইংরেজরা দিল্লি দখলের পরে আত্মীয়- পরিজনসহ শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
হ্যাঁ, শুনেছিলাম। তিনিই ছিলেন দিল্লির সেরা মহিলা কবি।
তিনি আর নেই।
মানে? নেই মানে?
গালিব বিমূঢ়ের মতো উচ্চারণ করে পরক্ষণে মিনমিনিয়ে বলেন, নেই মানে তো আমি বুঝি। বুঝবো না কেন? কিন্তু এতকিছু মেনে নেয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কি হয়েছিল এমন এক অভিজাত বংশীয়ার?
পথের কষ্টে, শ্রমে কাহিল হয়ে পড়েছিলেন।
তাই অকালেই গেলেন। কি চমৎকার কবিতা লিখতেন।
আপনিতো তাঁকে কোনোদিন দেখেননি?
না, তিনি পর্দার আড়ালে থেকে আমাকে কবিতা শোনাতেন। তাঁর মামার সঙ্গে আমি ওই বাড়িতে যাতায়াত করতাম। ঠিক আছে। থাক তাঁর কথা। আমরাই বা কে কখন যাবো কে জানে।
আজ যাই। তর্ক-এর মৃত্যুর খবর শুনে মনটা ভালো নেই। আর একদিন আসবো ওস্তাদ।
আর একটুক্ষণ বোস। তোমরা কেউ থাকলে স্বস্তি পাই। এখনতো শহরে আর এক উৎপাত শুরু হয়েছে। সারাদিন ভাঙা আর খোঁড়ার শব্দ কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। ঘরে শুয়ে বসে থেকেও শান্তি নাই।
ইংরেজদের চোখে আমরা তো সব বিশ্বাসঘাতক। আমাদেরকে উচিত শাস্তি দেয়াই এখন ওদের কাজ। তাই তারা দিল্লি শহরকে ধুলোয় মিশিয়ে দেবে বলে ঠিক করেছে। শুনতে পাচ্ছি লালকেল্লা আর জামা মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে ভিক্টোরিয়ার নামে প্রাসাদ আর ক্যাথেড্রাল বানানো হবে। শেষ পর্যন্ত কি করবে কে জানে।
এসব দেখার জন্য আমি অতদিন বেঁচে থাকবো না। তুমি থাকবে হালি। তুমি আমার কত ছোট বল তো?
আলতফ আঙুল গুনে বলে, প্রায় চল্লিশ বছর হবে।
হ্যাঁ, তা তো হবেই। আমি ১৭৯৭। আর তুমি ১৮৩৭। নাকি?
আলতফ মৃদু হেসে বলেন, তাই। তবে কষ্ট নিয়ে আমি বেঁচে থাকতে চাই না। বেদনা সহ্য করা কঠিন
এই বেদনা নিয়ে আমি তুফতাকে একটা চিঠি লিখেছি। তোমাকে পড়ে শোনাই হালি?
হ্যাঁ, আমি শুনবো।
দেখো কত দুঃখের কথা লিখেছি। আমারতো বুক ফেটে যায়। আমিতো আমার গজল নিয়ে এই শহরে মেতে ছিলাম। আমার চেয়ে কে আর বেশি এই শহরকে ভালোবাসে।
কথা বলতে বলতে গালিব চিঠিটা বের করেন টেবিলে রাখা কাগজপত্রের মধ্য থেকে। তারপর পড়তে শুরু করেন খুব মনোযোগ দিয়ে — জামা মসজিদের চারপাশের বেশ অনেকটা জায়গা খালি করার জন্য ঘরবাড়ি, দোকান, গাছপালা সব ভেঙে বা কেটে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হলো। বিখ্যাত দারুল বাকাও ভেঙে ফেলা হয়েছে। আজুরদার বানানো এই স্কুলটায় বিনা বেতনে পড়ালেখা শেখানো হতো। শেখানো হতো সাহিত্য, ওষুধ ও ধর্ম বিষয়। এখানে অবশিষ্ট যা রয়ে গেছে তা হলো আল্লাহর নাম। চারদিক থেকে শোনা যায় কোদালের খোঁড়াখুঁড়ির শব্দ। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সুযোগ-সুবিধার দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে নির্বিকারে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছে। এই শহরে এখন না আছে সংবিধান, না আছে আইন!
এটুকু পড়ে তিনি দম নিলেন। হাতের কাছে রাখা গ্লাস থেকে পানি খেলেন। তারপর আবার শুরু করলেন-বন্ধু একথা সত্য যে দিল্লি চারদিক থেকে আক্রান্ত হয়েছে। এ শহরকে উন্নত শহর হিসেবে গড়ে তোলার কথা ইংরেজরা যতই বলুক না কেন, ওদের কাজের মধ্যে প্রতিশোধ নেয়ার মনোভাবই বেশি দেখা যাচ্ছে। একে একে ঘাসবাজার, উর্দুবাজার, ঘরমকাবাজার ধুলোয় মিশিয়ে ফেলা হয়েছে। ভেবে দেখো এগুলো ছিল দিল্লির বিখ্যাত বাজার। চিরদিনের মতো মুছে ফেলা হলো পুরনো মহল্লার চিহ্ন। সেই সঙ্গে গেলো এলাকার ছোট ছোট বাজারগুলোও। একই সঙ্গে ধুলো হয়ে গেলো শহরের চেনাশোনা জায়গাগুলো। কিংবা বন্ধুদের ছোট ছোট ঘর, অনেক লোক যাতায়াত করে এমন বড় বাড়ি বা রাস্তার ধারের অনেক স্মৃতিচিহ্ন। জায়গায় জায়গায় স্তূপ করে রাখা ইট-পাথর দেখে মনে হয় দিল্লি বুঝি জঞ্জাল সরিয়ে রাখার পরিত্যক্ত জমি। চোখের সামনে দিল্লি মরুভূমি হয়ে গেছে। কুয়োগুলো সংস্কার করার কোনো উদ্যোগ নাই। পানির জন্য মানুষ হাহাকার করে। প্রবল জলকষ্টে আমরা হয়রান হয়ে পড়েছি।
জামা মসজিদ থেকে শুরু করে আশেপাশের রাস্তাঘাট সবই বাতিলযোগ্য জমি। চারদিকে তাকালে আতঙ্কিত হয়ে থাকতে হয়। ভয়ে শরীর হিম হয়ে যায় এ জন্য যে কোথায় সেই দিল্লি? যেখানে মানুষের স্বাভাবিক বাসস্থান ছিল। যাতায়াত ছিল। উৎসব-আনন্দ ছিল। সমস্ত শহরই এখন সেনাদের ঘাঁটি। আমরা এই ঘাঁটিতে বন্দি মানুষ। এখানে কবিতা নেই। মুশায়রা নেই। বন্ধু ভেবে দেখো কি দারুণ আকাল আমাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে।
এটুকু পড়ে তিনি থামলেন। আবার পানি খেলেন। আলতফের দিকে তাকিয়ে বললেন, আর পড়বো?
আলতফ মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, হ্যাঁ।
গালিব মাথা নেড়ে বললেন, থাক। আর ভালো লাগছে না।
আপনি কি আমাকে চিঠিটা পোস্ট করতে দেবেন?
আজ থাক। আমার আরও কথা লেখার আছে। যদিও আমি জানি আমার এক জীবনে আমি এইসব কথা লিখে শেষ করতে পারবো না।
‘দস্তাম্বু’ তো শেষ হয়নি?
না হয়নি। হয়ে যাবে। ছাপার কাজটাও তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলতে হবে।
শরীর ঠিক আছে তো ওস্তাদজী?
শরীর? আবার পানি খেলেন তিনি। তারপর সরাসরি উত্তর না দিয়ে নিজের শের আওড়ালেন :
‘একটু কেঁদে নিতে দাও, ভর্ৎসনা কোরো না বন্ধু;
কোনো এক সময়ে তো হৃদয়ের ভার হালকা করবে মানুষ।’
আলতফ আর একটি কথাও না বলে বিদায় নিলেন। যেতে যেতে ভাবলেন, এখন এই একলা ঘরে ওস্তাদজী নিশ্চয় তর্ক-এর কথা মনে করে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলবেন। তিনি তাঁর কবিতা খুব পছন্দ করতেন। যদিও সেই পর্দানশীন কবিকে কখনও দেখার সুযোগ হয়নি। কিন্তু হৃদয়ের টান কি পর্দা মানে? পর্দা উড়ে যায় মানস চোখের সামনে থেকে। ওস্তাদজীর সামনে এখন পর্দা নেই। তিনি ঠিকই দেখতে পাচ্ছেন সেই রমণীকে, যাঁর মুগ্ধতায় তাঁর অনেক সময় কেটেছে।
আলতফ চলে গেলে নিঃসঙ্গ কবি খোলা দরজার দিকে তাকালেন। দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, রাতের কোন তারাটা তুমি হবে। ‘জীবন তো এমনিতেই কেটে যেতো। কেন তোমার পথের কথা মনে এলো।’
তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। প্রবলভাবে বয়ে আসা চোখের জল দু’হাতে মুছেও শেষ করতে পারছেন না। চোখ আজ কত বড় সাগর হয়ে গেলো? এত জল কতদিন ধরে ওখানে জমা হয়েছে? পরক্ষণে অনুভব করলেন কাঁদতে পারাই তাঁর এই মুহূর্তের স্বস্তি।
.
কয়েকদিন পরে সন্ধ্যাবেলা কামান গর্জনের শব্দ ধ্বণিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। কাল্লু মিয়া এসে খবর দিলো, হুজুর ইংরেজরা লক্ষ্ণৌ জয় করেছে। তাই এত আনন্দ উল্লাস।
বলেই চলে যাচ্ছিল কাল্লু। তিনি ওকে ডেকে বললেন, লক্ষ্ণৌ আমার প্রিয় শহর কাল্লু। বিদ্রোহীরা শহরটাকে অবরোধ করে রেখেছিল।
তিন মাস তো হয়ে গেলো হুজুর। বিদ্রোহীরা আর বোধহয় ধরে রাখতে পারেনি।
ঠিক আছে তুমি যাও। আরও খবর পেলে আমাকে জানিও।
পরদিনই জানতে পারেন যে ক্যাম্বেল পঁয়তাল্লিশ হাজার সৈন্য নিয়ে লক্ষ্ণৌর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রায় দু’লাখ মানুষ শহরে একত্র হয়েছিল। তারা প্রাণপণ লড়াই করে। কিন্তু তাদের যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। দক্ষ সেনাপতিও না। শেষ পর্যন্ত পরাজিত হতেই হলো তাদের। যদিও এক মাস ধরে যুদ্ধ করেছিল তারা। শহর দখল হয়ে গেলে সিপাহীরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
শরীর খারাপ হয়ে পড়ে। নানা কিছুতে তিনি খুবই কাহিল হয়ে পড়েছেন। একদিকে আর্থিক অনটন। অন্যদিকে মানসিক টানাপোড়েন। শহরের হাকিমের কাছে খেতাব, দরবারী পোশাক আর পেনসনের জন্য আবেদন করেছিলেন। তার কোনো জবাব পাননি। শহরের খারাপ পরিস্থিতির কারণে চিঠিটা ডাকে পাঠিয়েছিলেন। হাকিমের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি।
কিছুদিন পর খবর পান ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া সিপাহীরা বিভিন্ন অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আর ব্রিটিশরা যে শহর জয় করছে সেখানেই ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। প্রতিশোধের জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠেছে তারা। নির্বিচার প্রতিশোধের কোনো সীমা-পরিসীমা নাই। পুরুষদের অবলীলায় হত্যা করছে, নারীদের ধর্ষণ করছে, বাড়িঘর লুট করে সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে তাদের, যারা তখনও হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ নিয়ে বেঁচে আছে।
গালিব বিছানায় নিস্তেজ পড়ে থাকেন। হাঁটতে ভালো লাগে না। এমনকি বিছানায় উঠে বসে থাকতেও। কালু মিছরির শরবত আনলে রেগে যান। গ্লাস ছুঁড়ে ফেলতে চান। উমরাও বেগমকেও সইতে পারেন না। মনে হয় শহরটা জনশূন্য হয়ে গেলে শহর জুড়ে নেমে আসুক আকাশের তারা। তারার আলো শরাব হলে তিনি সাকী হবেন। যেন জীবনের অন্তিম সময় ঘনিয়েছে। এমন একটি ইচ্ছা ছাড়া তাঁর আর কিছু চাইবার নাই।
.
দুদিন পরে শহরের হাকিমের কাছ থেকে আসা চিঠিটা উমরাও বেগমই তাঁর কাছে নিয়ে আসেন। তাঁর বুকের ভেতরে আশা যে হয়তো পেনসন মঞ্জুর হয়েছে এমন একটি খবর আজ পাবেন।
গালিব চিঠি খুললেন।
উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন উমরাও বেগম। তাঁর চিঠি পড়া শেষ হলে বললেন, কি বার্তা এসেছে? ভালো না খারাপ?
ভালো। ভালোই বলতে হবে।
ভালো! হায় খোদা এবার বোধহয় আমরা বেঁচে যাব।
না, বিবি এই চিঠিতে বেঁচে যাওয়ার কোনো খবর নেই।
তাহলে? তাহলে কি লেখা হয়েছে এই চিঠিতে?
হাকিমের কাছে আমি যে তিনটি প্রার্থনা করেছিলাম তার একটি নাকচ করে দিয়েছেন তিনি। আমি খেতাবের জন্য আবেদন করেছিলাম। জানানো হয়েছে যে খেতাব দেয়া সম্ভব হবে না।
এটা ভালোর কি হলো? উমরাও বেগম ভুরু কুঁচকে তাকান স্বামীর দিকে।
এখনতো আমার দরকার রুটি। আমি অভুক্ত থাকছি। আমি খেতাব দিয়ে কি করবো? এটাতো ভালো খবরই।
হায় খোদা, এক নিষ্ঠুর রসিকতা।
উমরাও বেগম আর দাঁড়ান না। গালিব চিঠিটা খামে ভরে বালিশের নিচে রেখে দেন। এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ান। উমরাও বেগম তাঁর কথাকে নিষ্ঠুর রসিকতা বললেন, আসলেই কি নিষ্ঠুরভাবে বলা হয়েছে? তিনি তো সত্যি কথাই বললেন। এইভাবে বেঁচে থাকাই তো চরম রসিকতা। জীবন কি এতই ক্ষুদ্ৰ যে একজন কবিকে এভাবে বেঁচে থাকতে হবে? কখনো বাদশাহর কিংবা কোনো নওয়াবের বৃত্তিভোগী হয়ে? নইলে দেশের শাসনভার যারা গ্রহণ করে তাদের কাছে আর্জি পেশ করে? কেন ওরা আসবে না কবির কাছে? কেন বলবে না যে এই আপনার যোগ্য সম্মান দিয়ে গেলাম? হায়, এই জীবনে আর এই স্বপ্ন দেখতে হবে না।
খেতাব পাওয়ার আবেদন পত্রটি ফেরত পাঠানো হয়েছে, কিন্তু পেনসনের ব্যাপারে কোনো চিঠি পাঠায়নি হাকিমের অফিস।
সেদিন বিকেলে হীরা সিং চিঠিটা দেখে বললো, পেনসন বোধহয় এমনিতে হয়ে যাবে। সে জন্য আবেদনের উত্তর দেয়নি।
গালিব চুপ করে শুনলেন। কিছু বললেন না।
হীরা সিং বাকির আর হুসেনের জন্য কিছু ফল আর মিঠাই এনেছে। দুই ভাই সেগুলো পেয়ে মহা খুশি। ঘরজুড়ে লাফালাফি করছে আর মিঠাই খাচ্ছে। ওদের দিকে তাকিয়ে থেকে গালিব ভাবলেন, পৃথিবীর আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য!
বাচ্চারা চলে গেলে হীরা সিংকে বললেন, ভাবছি পেনসনের ব্যাপারে মহামান্য চার্লস সন্ডার্সকে আবেদনপত্র পাঠাবো ।
হীরা সিং মাথা নেড়ে সায় দেয়। বলে, আবেদন পত্রটি কি এখন লিখবেন? তাহলে আমি ডাকে দিয়ে দিতে পারি?
না। এখন লিখবো না। ডাকে পাঠানোর ব্যবস্থা আমিই করবো।
ছুটে আসে হুসেন। লাফাতে লাফাতে বলে, নানা মনে হচ্ছে আজ একটি ঈদের দিন।
হ্যাঁ, তাইতো। আনন্দের দিনকে ঈদের দিন মনেই হতে পারে।
তাহলে আমাকে দোকানে নিয়ে চলেন।
দোকানে? কেন?
আমি খেলনা চাই। অনেক খেলনা।
খেলনা? গালিব বিষণ্ণ দৃষ্টিতে অন্যদিকে তাকান।
হুসেন তার হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে, হ্যাঁ খেলনা, খেলনা, অনেক খেলনা। আমার খেলনাগুলো সব ভেঙে গেছে।
আজ আমার শরীর খুব খারাপ। আমিতো দোকানে যেতে পারবো না ভাইয়া।
কবে পারবেন?
তবিয়ত আচ্ছা হলে।
কবে তবিয়ত আচ্ছা হবে?
গালিব উপরের দিকে হাত তুলে বলেন, আল্লাহ মালুম।
আচ্ছা যাই। নানিকে বলি, আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতে। যেন আল্লাহ আপনাকে ভালো করে দেন।
হীরা সিং দেখলো বাচ্চাটি ঘর ছাড়ার আগেই তাঁর প্রিয় কবির চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো।
গালিব শতরঞ্জির উপর পা ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, বাচ্চাটা ঈদের আনন্দের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হচ্ছিল আগে এই শহরে কত না উৎসব হতো। দুই ঈদ ছাড়াও নওরোজ উৎসব হতো। দিওয়ালি, হোলি, মহররম, সলোনো, ফুলের মালা, মুকুট ধারণ উৎসব, শেষ বুধবার এমন কত না উৎসব পালন করতেন বাদশাহ। পৃথিবীতে ফেব্রুয়ারি মাস আর নওরোজ আসতো। ফেব্রুয়ারির দু-চার তারিখে নওরোজ পালিত হতো। নববর্ষের দিন একটি নতুন দিন। আনন্দের শেষ থাকতো না সেদিন। এ বছর ফেব্রুয়ারি কোথা দিয়ে চলে গেলো কেউ খোঁজ রাখলো না।
রাখবে কি করে, সেই অবস্থা তো নেই।
হীরা সিংয়ের কথা ধরে গালিব বললেন, ঠিকই বলেছো। এখন এটা মৃতদের শহর। গালিব কৌতুকের ঢঙে বলেন, আমিই কি জীবিত হীরা সিং?
ওস্তাদজী, এভাবে বলবেন না।
ফেব্রুয়ারি চলে গেলো। কিন্তু এই শহরে বসন্ত এলো না। দেখতে পাচ্ছি, কেউই নতুন বছরের কথা আলোচনা করছে না। রাস্তায়, বাজারে, দোকানপাটে, অন্দরমহলে নববর্ষের ছোঁয়া নাই। কেউ বলছে না যে এটা কততম সাল। এই শহরের জ্যোতিষীদের কি মৃত্যু হয়েছে?
তিনি থামলেন। দম নিলেন। হীরা সিংহের মুখেও কথা নাই। তিনি একটু কাশলেন। বুঝলেন, বুকে কফ জমেছে। শরীরও গরম হয়েছে। জ্বর এসেছে বোধহয়।
দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, দিনের রাজা সূর্য। কেউ যদি বলে যে দিনের রাজার দিনলিপি লেখা বন্ধ হয়ে গিয়েছে তবে তা মিথ্যা বলা হবে। সূর্য রোজ যে পরিভ্রমণ করে সে কথা সূর্য ভোলেনি। সূর্য ভোলেনি যে ঘাস গজাবে না বা ফুল ফুটবে না। প্রকৃতির নিয়ম কখনো বদলায় না। আকাশও এ নিয়মের বাইরে যেতে পারে না।
হীরা সিং বুঝতে পারে যে গালিবের কণ্ঠস্বর ভার হয়ে গেছে। তিনি খুব আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছেন। এমন একটি মুহূর্তে প্রিয় মানুষের সামনে বসে থাকা খুবই কষ্টকর।
ও বলে, আমি বাচ্চাদের ডাকি?
না, ডেকো না।
ওরা সামনে থাকলে আপনার ভালো লাগবে।
মোটেই তা নয়। আমার বুক ভেঙে যায় যখন ওদের হাসিখুশি উজ্জ্বল মুখের বদলে করুণ চেহারা দেখি।
হীরা সিং মাথা নত করে। তার মনে হয় কবির দিকে না তাকানোই উচিত। আসলে ওর চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
তখন গালিব ওকে বলেন, আসলে কি জানো প্রকৃতির কথা ভেবে নয়, কিংবা ফুলের বাগানের কথা ভেবে নয়, আমি নিজের কথা ভেবেই চোখের পানি ফেলছি। বসন্তের প্রতি আমার অভিযোগ নেই। নিজের মন্দ কপালের কথাই স্মরণ করছি। নসীব খারাপ হলে তার নিন্দা করাই উচিত। এসব কথাই আমি ‘দস্তাম্বু’তে লিখছি হীরা সিং।
কবে বের হবে ‘দম্বাম্বু?
দেখি, দু’চার মাসের মধ্যেই বের করে ফেলবো।
আজ আমি যাই?
গালিব ঘাড় কাৎ করলেন। বেরিয়ে গেলো হীরা সিং। তিনি ‘দস্তাম্বু’ যে খাতায় লিখছিলেন সেটা খুলে বসলেন। কলম ঢুকে গেলো দোয়াতে। সাদা পৃষ্ঠায় ভরে ওঠে কালো কালির আঁচড়। মাত্র কয়েকটি বাক্য লিখলেন কবি : পৃথিবী ফুলে রঙিন হয় আর গোলাপের সৌরভে ভরে থাকে। কিন্তু আমি এক কোণায় বসে থাকি। নিরূপায়, অসহায়। আমার কিইবা আর করার আছে! বসন্ত এসেছে। পত্র-পল্লব পূর্ণ হয়ে আছে। আমি হতাশায় ভুগছি। কপর্দকশূন্য এই আমি। আমার ঘরের দরজা বন্ধ।
.
রাতেই জ্বর এল তাঁর।
দিনভর প্রবল জ্বরে কাতরালেন।
দু’দিন পরে জ্বর খানিকটা কমলেও সারা গায়ে ফোঁড়ার মতো উঠে ঘা ছড়িয়ে গেল।
লোকজন বলাবলি করতে লাগলো যে খাবার পানি দূষিত হয়ে মহামারীর আকারে দিল্লিতে সোর দেখা দিয়েছে। চারদিকে মানুষের দুর্দশার অন্ত নেই।
কীভাবে কয়দিন কেটে গেল গালিব নিজেও বুঝতে পারলেন না। আধাজাগরণে অচৈতন্যে বারবারই মনে হয়েছে তিনি দীর্ঘ পথে কবি তর্কের সঙ্গী হয়েছেন। দু’জনে কবিতা আবৃত্তি করতে করতে চলে যাচ্ছেন। কোথাও বিশ্রামের জন্য বসছেন। কোনো নদীর ধারে বসে তৃষ্ণার জল পান করেছেন। নীলিমার দিকে তাকিয়ে দুজনে হাত ধরে হাঁটেছেন। এমন একটি অপরূপ যাত্রাপথে থমকে গেছে কবি তর্ক। তাঁর নশ্বর দেহের ওপর নেমে এসেছে হাজার হাজার পাখির ছায়া। সেই ছায়ার দিকে হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছেন গালিব।
তাঁর গোঙানির শব্দ শুনে উমরাও বেগমকে ডেকে আনে কাল্লু মিয়া। উমরাও নিমীলিত চোখের তারায় আঙুল ছুঁইয়ে বলেন, কি হয়েছে?
তিনি অস্ফুট আর্তনাদের স্বরে বলেন, কষ্ট।
কোথায়? কোথায় কষ্ট?
সবখানে।
কোনো ঘায়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে?
বুকের ভেতরে।
বুকের ভেতরে? উমরাও বেগম থমকে যান। বুকের ভেতরে কি ফোঁড়া উঠেছে? সেটার আকার কি সবচেয়ে বড়? আসলে মানুষটা এভাবে নিজের কষ্ট সব জায়গায় ছড়িয়েছেন।
কতদিন যে সময় লাগলো তাঁর ভালো হতে। খেয়ে না খেয়ে বিছানায় গড়াতে গড়াতে, নিজের শরীরের ক্ষতের দুর্গন্ধ সহ্য করে সুস্থ হয়ে উঠতে উঠতে একদিন বসন্ত ফুরিয়ে গেল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন হাকিম মহম্মদের বাড়ির ছাদে বসে আছে একদল কাক। নিঃশব্দ। কণ্ঠে কা কা ধ্বনি নেই। বড় অদ্ভুত লাগছে কালো রঙের কাকগুলোকে দেখতে। তিনি ‘দস্তাম্বু’র পৃষ্ঠা খুলে লিখলেন : এই দুনিয়ায় তেষট্টি বছর কাটিয়ে দিলাম। এতদিনের হাজার রকম দুঃখ থেকে বুঝে গেছি যে এর থেকে বেরিয়ে আসার আর কোনো আশা নেই আমার। ডুবে থাকতে হবে এই অন্ধকারেই। এই মুহূর্তে আমার শেখ সাদির কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে সাদির লেখা শের :
‘হায় আমি যখন থাকব না তখনও পৃথিবীতে
বারবার বসন্ত আসবে, ফুল ফুটবে,
গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ স্বর্গের ঋতু আসবে
আমার শরীর তখন ধুলোয় মিশে যাবে।’
এটুকু বলে তিনি থামলেন। শরীর এখন শুকনো ঝরঝরে। লিখতে ক্লান্তি লাগছে না। কিন্তু মন দুঃখবোধ নিয়ে ভারাক্রান্ত। সবকিছু ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টায় আবার লিখতে শুরু করলেন : সত্য কথা গোপন রাখা কোনো ভালো মানুষের ঠিক কাজ নয়। আমি অর্ধেক মুসলমান, ধর্মের নিয়মকানুনে আমি বাধা পড়িনি। বদনাম ও নিন্দায় আমার কিছু যায় আসে না। বুঝে ওঠার পর থেকে আমি শরাবে আসক্ত হই। রাতে ঘুমুনোর আগে শরাব পান করা আমার অভ্যেস। আজকাল শহরে বিদেশি শরাবের মূল্য আকাশছোঁয়া।
আর আমি কপর্দকশূন্য।
কলমটি রেখে দিয়ে, দোয়াত বন্ধ করতে করতে নিজের শের শোনালেন নিজেকে :
‘এখানে যাবজ্জীবন বন্দী হয়ে আছে লক্ষ কামনা-বাসনা, অবসাদ,
আমার রক্তাক্ত বক্ষকে কারাগার বলেই জানি।’
শের আওড়াতে আওড়াতে তিনি দরজায় এসে দাঁড়ালেন। দেখলেন বল্লিমারো গলিটি একদম ফাঁকা। যেন তাঁর শূন্য পকেটের মতো জনশূন্য। রাস্তায় নামলেন তিনি। ভাবলেন, একজন কেউ তো রাস্তায় থাকুক
পাখির উড়ে যাওয়ার শব্দে উপরের দিকে তাকালেন। কা কা শব্দে উড়ে যাচ্ছে কাকগুলো। হোক পাখির ডাক, তারপরওতো এই মৃতপ্রায় শহরে কোলাহল শোনা গেল। তিনি হাঁটতে হাঁটতে গলির মাথায় এসে দাঁড়ালেন। এই সময়ে প্রিয় শহরকেও কারাগার বলে জানি।