শেষ স্যালুট

শেষ স্যালুট

কাশ্মীরের যুদ্ধটা ছিল অদ্ভুত! সুবেদার রব নওয়াজের মাথায় কিছুই ঢুকছিল না।

আগের বড় যুদ্ধে সে অনেকগুলো মোর্চার হয়েই লড়েছিল। গুলিগোলা, মারামারিতে তার জবাব ছিল না। সাহসী এবং বুদ্ধিমান সিপাই হিসেবে অফিসারদের মধ্যে তার বেশ খ্যাতি ছিল। প্লাটুন কমান্ডার কঠিন কাজগুলো তাকেই দিত আর সে প্রত্যেকবার সবক’টা কাজ সুসম্পন্ন করে আসত। কিন্তু এই যুদ্ধটা ছিল অন্যরকম। উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি ছিল না। ক্ষিদে-তেষ্টা অগ্রাহ্য করে শুধু লড়াইয়ের অদম্য ইচ্ছা! শত্রুকে শেষ করে দেওয়ার চাড়!

কিন্তু শত্রুর মুখোমুখি হলেই চেনা মুখ দেখতে পাওয়া যেত। এককালের বন্ধুদের মুখ। যাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আগের যুদ্ধে মিত্ররাষ্ট্রের পক্ষে লড়েছিল, এখন শত্রু হিসেবে তাদেরকেই আক্রমণ করার নির্দেশ ছিল।

মাঝে মাঝে সুবেদার রব নওয়াজের আগের যুদ্ধটাকে স্বপ্নের মতো লাগত। যুদ্ধের ঘোষণা; মিলিটারিতে ভর্তি; ছাতি আর উচ্চতার পরিমাপ; পি টি আর চাঁদমারী থেকে মোর্চা; এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে এখানে; অবশেষে যুদ্ধের অবসান; তারপর হঠাৎ করে পাকিস্তানের জন্ম আর তার সঙ্গে সঙ্গে কাশ্মীরের জন্য যুদ্ধ—এসব কি ভেবেচিন্তে করা হয়েছিল যাতে লোকজন কিছু মাথামুন্ডু বুঝতে না পারে?! তা না হলে এইটুকু সময়ের মধ্যে এত পরিবর্তন কী করে সম্ভব!

রব নওয়াজ শুধু এটুকু বুঝত যে তারা কাশ্মীর দখলের জন্য লড়ছিল। কাশ্মীর দখল করে কী হবে সে সম্বন্ধেও তাদের বেশ বোঝানো হয়েছিল। পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্য নাকি কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন!

কিন্তু নিশানায় তাগ করতে গিয়ে যখন সে কোনো পরিচিত মুখ দেখতে পেত, এক মুহূর্তের জন্য ভুলে যেত যে কীসের জন্য এই যুদ্ধ, আর কোন রাজ্যপাট হাসিল করতে সে বন্দুক ধরেছে!

বারবার সে তখন নিজেকে মনে করাত, এই যুদ্ধ শুধু মাইনে আর খেতাবের জন্য নয়, এ তার দেশের জন্য। এই দেশ আগেও তারই দেশ ছিল; শুধু এখন তা পাকিস্তানের অন্তর্গত। আর তার লড়াই তার সেই বন্ধুদের বিরুদ্ধে যারা বংশপরম্পরায় তার দেশেরই বাসিন্দা।

কিন্তু এখন তাদের দেশ হিন্দুস্তান, যার জল-মাটির সঙ্গে তাদের কোনোকালে কোনো আত্মীয়তা ছিল না। আর এই নতুন দেশের দোহাই দিয়ে তাদের হাতেও বন্দুক তুলে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ‘এই দেশ এখন তোমার নিজের দেশ! এখানে তোমার বাড়িঘর, জমিজায়গা, আত্মীয়স্বজন কিছু নেই বটে; কিন্তু এটাই তোমার দেশ! যাও, এই দেশের জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াই করো…সেই পাকিস্তানের সঙ্গে, যাকে এত বছর ধরে তুমি নিজের দেশ বলে জেনে এসেছ!’

রব নওয়াজ জানত যে এই একই অবস্থা সেই মুসলমান সিপাইদেরও, যাদের বাড়ি হিন্দুস্তানে। পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়ে তাদের কাছ থেকে সবই ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল; শুধু হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল বন্দুক! সেই একই ওজন, একই হুলিয়া আর একই ছাপের!

আগে সবাই মিলে একজোট হয়ে ধন-মানের শত্রুর সঙ্গে লড়ত; আর এখন নিজেরাই দুটো দলে ভাগ হয়ে গেছিল। আগে সবাই হিন্দুস্তানি সিপাই ছিল। এখন একদল হিন্দুস্তানি আর একদল পাকিস্তানি সিপাই! কিছু মুসলমান হিন্দুস্তানি সিপাইও ছিল।

তাদের ব্যাপারে ভাবলে রব নওয়াজের মাথা গুলিয়ে যেত। আর কাশ্মীরের ব্যাপারে ভাবতে গেলে তো সে দিশেহারা হয়ে যেত। পাকিস্তানী সিপাইরা কাশ্মীরের জন্য লড়ছিল নাকি কাশ্মীরের মুসলমানদের জন্য?

কাশ্মীরের মুসলমানদের জন্য যদি হয়, তাহলে হায়দ্রাবাদ আর জুনাগড়ের মুসলমানরা কী দোষ করেছিল যে তাদের জন্য লড়াই হচ্ছিল না!? আর যদি এটা কট্টর ইসলামি যুদ্ধই হয়, তবে দুনিয়ার বাকি মুসলমান দেশগুলো এতে কেন যোগ দেয়নি?

অনেক ভেবেচিন্তে রব নওয়াজ এই সিদ্ধান্তে এসেছিল যে এসব সূক্ষ্ম ব্যাপারে সিপাইদের না থাকাই উচিত! তাদের কাজ শুধু যুদ্ধ করা। সিপাইদের বুদ্ধি একটু কম থাকলেই মঙ্গল। তবু কখনো কখনো তার মাথায় এগুলো চলে আসত। নিজের উপর জোর হেসে সে মাথা থেকে এসব বের করে ফেলত।

গঙ্গার ধার দিয়ে যে রাস্তাটা মুজফফরাবাদ থেকে করনের দিকে যায়, সেটাকে দখল করার জন্য বেশ কিছুদিন ধরে লড়াই হচ্ছিল। অদ্ভুত সে লড়াই! রাতের অন্ধকারে আশপাশের পাহাড় থেকে গুলির বদলে অশ্রাব্য গালিগালাজের ধোঁয়া উঠত।

একবার সুবেদার রব নওয়াজ প্লাটুনের জওয়ানদের সঙ্গে রাতে হামলা করার তোড়জোড় করছিল। এমন সময় দূরে নীচের এক খাদের মধ্যে থেকে গালিগালাজ শুরু হল। প্রথমে তো সে হকচকিয়ে গেল। মনে হচ্ছিল অনেকগুলো ভূত একসঙ্গে নাচছে আর হাসাহাসি করছে! সে বিড়বিড় করে বলল, ‘শুয়োরের বাচ্চা!…এটা কী হচ্ছে?!’

এক সিপাই সেই আওয়াজের উদ্দেশ্যে একটা চোখা গালি ছেড়ে রব নওয়াজের দিকে ফিরে বলল, ‘সুবেদার সাহেব, মা তুলে খিস্তি করছে!’

রব নওয়াজ সেই গায়ে জ্বালা ধরানো গালিগুলো খানিকক্ষণ ধরে মন দিয়ে শুনল। তার বন্দুক চালানোর হুকুম দিতে ইচ্ছা করছিল; কিন্তু সে জানত সেটা বোকামি। তাই সে চুপ করে রইল। তার সিপাইরাও বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ ছিল। শেষে আর থাকতে না পেরে তারাও গলা ছেড়ে গাল পাড়তে শুরু করে দিল।

রব নওয়াজ এরকম যুদ্ধ আগে কখনো দেখেনি। এক দুবার সে সিপাইদের চুপ করে থাকার নির্দেশ দিল। কিন্তু এমনই সব গালিগালাজ শোনা যাচ্ছিল যে উত্তর না দিয়ে পারা সম্ভব না!

শত্রুপক্ষের সিপাইদের দেখা যেত না, কি দিনের আলোয়, কি রাতের অন্ধকারে! শুধু তাদের গালাগালি পাহাড়ের নীচ থেকে পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে হাওয়ায় ভেসে বেড়াত। রব নওয়াজের মনে হত যে তার সিপাইদের গালগুলো যেন নীচ অবধি পৌঁছোত না; বরং হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে আকাশের দিকে উঠে যেত। তাতে তার আরো রাগ ধরত। রেগেমেগে সে শেষে গুলি চালানোর হুকুম দিল।

ওই পাহাড়গুলোর একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ছিল। কোথাও পাহাড়ের চড়াই গাছে গাছে ভরে থাকত, এদিকে ঢালটা পুরো ন্যাড়া! আবার কোথাও চড়াই রুক্ষ তো ঢাল সবুজে সবুজ! বড় বড় গাছের লতায় পাতায় সিপাইদের বুট পিছলে যেত। সুবেদার রব নওয়াজের প্লাটুন যে পাহাড়ে ঘাঁটি গেড়েছিল, তাতে গাছপালা প্রায় ছিল না বললেই চলে। ফলে হামলা করা বিপজ্জনক!

কিন্তু সিপাইরা সাগ্রহে তাতে রাজি হয়ে গেল। খিস্তির শোধ তুলতে তারা ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল। আক্রমণ সফল হল। যদিও দুজন সিপাই মারা গেল আর চারজন জখম হল, কিন্তু শত্রুর ঘাঁটি দখল হয়ে গেল। শত্রুপক্ষের তিনজন মারা পড়েছিল আর বাকিরা জিনিসপত্র ছেড়ে পালিয়ে গেছিল।

সুবেদার রব নওয়াজ আর তার জওয়ানদের যারপরনাই দুঃখ হল যে একজনও জীবিত অবস্থায় তাদের হাতে এল না। তাদেরকে বাছা বাছা গালি দেওয়ার ইচ্ছাটা অপূর্ণই রয়ে গেল।

যাই হোক, এই হামলার পর একটা গুরুত্বপূর্ণ পাহাড় রব নওয়াজদের দখলে চলে এল। ওয়ারলেসে সে প্লাটুন কমান্ডার মেজর আসলামকে খবরটা জানিয়ে দিল। তার বাহাদুরির মুকুটে আরেকটা পালক যোগ হল।

প্রায় সব পাহাড়ের চুড়োতেই একটা করে জলাশয় ছিল। কিন্তু এই পাহাড়ের জলাশয়টা অন্যগুলোর চেয়ে অনেকটাই বড়। জলও বেশ পরিষ্কার আর স্বচ্ছ। ঠান্ডা থাকা সত্ত্বেও সবাই জলে ডুব দিল। দাঁতে দাঁত লেগে গেল, সবাই ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল; কিন্তু কেউ উঠল না।

স্নানে ব্যস্ত অবস্থাতেই তারা হঠাৎ শুনতে পেল ফায়ারিংয়ের আওয়াজ। চট করে উঠে সবাই খালি গায়েই মাটিতে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর সুবেদার রব নওয়াজ দূরবীন দিয়ে ঢালের দিকটা দেখতে লাগল। কিন্তু শত্রু চোখে পড়ল না। দেখতে দেখতে আবার ফায়ার হল। ঢালের ঠিক পাশেই একটা অপেক্ষাকৃত ছোট পাহাড় থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে সিপাইদের সেদিক লক্ষ্য করে গুলি চালানোর আদেশ দিল।

দুদিক থেকে দুমদাম গুলি চলতে লাগল।

সুবেদার রব নওয়াজ দূরবীন দিয়ে শত্রুর পজিশন ভালো করে লক্ষ্য করল। তারা বোধ হয় বড় বড় পাথরের পিছনে লুকিয়ে ছিল। রব নওয়াজ জানত যে এইরকম জায়গায় বেশিক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব নয়। পাথরের পিছন থেকে একটু সরলেই তারা চোখে পড়তে বাধ্য!

কিছুক্ষণ ফায়ারিং চলল। তারপর রব নওয়াজ সিপাইদের আর গুলি নষ্ট করতে বারণ করে দিল। শুধু অপেক্ষায় থাকা যে কখন কেউ একটু নড়ে! নড়তে দেখলেই গুলি চালানো হবে। নির্দেশ দিয়ে নিজের নগ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে রব নওয়াজ নিজের মনে বিড়বিড় করতে লাগল, ‘শুয়োরের বাচ্চা!…জামাকাপড় ছাড়া মানুষকে দৈত্যের মতো দেখতে লাগে! ছিঃ!’

বহুক্ষণ পর পর ওদিক থেকে একটা আধটা ফায়ারিং হত। উত্তরে এদিক থেকেও কখনোসখনো গুলি চলত। এইভাবে দুদিন কেটে গেল।

হঠাৎ করেই বেশ ঠান্ডা পড়ে গেছিল। দিনের বেলাতেও যেন রক্ত জমে বরফ হয়ে যেত। সুবেদার রব নওয়াজ চায়ের ব্যবস্থা শুরু করল। আগুনে কেটলি বসানোই থাকত। বেশি শীত করলেই একটু চা খেয়ে নিত সবাই। সঙ্গে সঙ্গে শত্রুর উপরও নজর রাখা হচ্ছিল। একজন সিপাই সরলেই আরেকজন দূরবীন নিয়ে বসে পড়ত।

এদিকে শীতের চোটে মজ্জায় মজ্জায় কাঁপুনি ধরার উপক্রম!

পাহারায় বসে থাকা সিপাই হঠাৎ সুবেদারকে বলল, ওদিকে পাথরের পিছনে কী একটা যেন হচ্ছে। রব নওয়াজ দূরবীনটা নিয়ে ওদিকে ভালো করে দেখতে লাগল। কোনো নড়াচড়া তার চোখে পড়ল না। তখনই ওপাশ থেকে একটা জোর আওয়াজ ভেসে এল। রব নওয়াজ কিছু বুঝতে পারল না। উত্তরে সে বন্দুক চালিয়ে দিল। বন্দুকের শব্দ পাহাড়ে পাহাড়ে ঠোকর খেয়ে থেমে গেলে আবার একটা আওয়াজ হল। আওয়াজটা তার উদ্দেশ্যেই ছিল, কিন্তু তার বেশি কিছু বোঝা গেল না।

রব নওয়াজ চেঁচিয়ে বলল, ‘শুয়োরের বাচ্চা, কী বলছিস ঠিক করে বল!’

দূরত্ব খুব বেশি ছিল না। সুবেদার রব নওয়াজের গলা ওই পাহাড় অবধি পৌঁছে গেল। একটু পরেই ওদিক থেকে উত্তর ভেসে এল, ‘খিস্তি দিস না ভাই!’

রব নওয়াজ নিজের সিপাইদের দিকে তাকাল। অবাক হয়ে সে অস্ফুটে উচ্চারণ করল, ‘ভাই…!’ তারপর মুখের সামনে দু’হাত দিয়ে চোঙা বানিয়ে চিৎকার করল, ‘ভাই আবার কী শালা!…এখানে সব তোর মায়ের ইয়ে!’

উত্তর এল, ‘রব নওয়াজ!!’ গলায় যেন একটা তীব্র কষ্ট!

রব নওয়াজ কেঁপে উঠল।

ডাকটা যেন চারিপাশের পাহাড়গুলোকে ধাক্কা দিতে দিতে রক্ত জমানো ঠান্ডা হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে উড়ে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পর রব নওয়াজ প্রশ্ন করল, ‘কে ওদিকে?!’ মনে মনে বিড়বিড় করল, ‘শুয়োরের বাচ্চা!’

সে জানত যে টেটবালের পাহাড়ে সাধারণত ৬/৯ রেজিমেন্টের সিপাইরাই থাকত। সে এককালে এই রেজিমেন্টেই ছিল। কিন্তু এটা কার গলা?! ওই রেজিমেন্টের প্রচুর লোককে সে চিনত। সেখানে তার খুব কাছের কিছু বন্ধুও ছিল, আর কিছু লোকের সঙ্গে তার নিত্যকার ঝগড়াও ছিল। কিন্তু তার খিস্তিতে খারাপ কার লাগতে পারে!

রব নওয়াজ আবার দূরবীন লাগাল। কিচ্ছু দেখতে পেল না। দু’হাতে চোঙা বানিয়ে সে আবার চিৎকার করল, ‘কে ওদিকে?…আমি রব নওয়াজ!.. রব নওয়াজ…রব নওয়াজ…।’

বেশ কিছুক্ষণ অবধি ‘রব নওয়াজ’ পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ঠোক্কর খেয়ে চলল।

রব নওয়াজ বিড়বিড় করল, ‘শুয়োরের বাচ্চা…!’

ওদিক থেকে ভেসে এল, ‘আমি!…আমি রাম সিং!’

নাম শুনে রব নওয়াজ লাফিয়ে উঠল। পারলে সে লাফ দিয়ে টপকে ওই পাহাড়ে চলে যেত। প্রথমে সে নিজের মনে বলে উঠল, ‘রাম সিং…!’ তারপর আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার দিল, ‘রাম সিং! রাম সিংঘা…! ব্যাটা শুয়োরের বাচ্চা…!’

‘শুয়োরের বাচ্চা’-র প্রতিধ্বনি শেষ হতে না হতেই রাম সিংয়ের গলা এল, ‘ব্যাটা কুমোরের পো!’

রব নওয়াজ নিজের সিপাইদের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল, ‘শুয়োরের বাচ্চা শালা…বাজে বকে!’ তারপর রাম সিংয়ের উদ্দেশ্যে চেঁচাল, ‘ব্যাটা শিখের বাচ্চা!…বলির শুয়োর…!’

রাম সিং হো-হো করে হেসে উঠল। রব নওয়াজও হাসতে লাগল। হাসির আওয়াজে যেন পাহাড়গুলোও অল্প কেঁপে উঠল।

সুবেদার রব নওয়াজের সিপাইরা চুপ করে রইল।

হাসি মিলিয়ে যেতে রাম সিংয়ের গলা ভেসে এল, ‘ভাই, চা খাব!’

রব নওয়াজ বলল, ‘খা না!…কে বারণ করেছে!’

‘শালা! খাব-টা কী করে?!…জিনিস তো সব ওপাশে!’

‘কোন পাশে?’

‘যেখানে গেলেই তুই আমায় গুলি করবি!’

রব নওয়াজ হেসে উঠল, ‘কী চাস ব্যাটা শুয়োরের বাচ্চা?’

‘আমায় জিনিস নিয়ে আসতে দে!’

রব নওয়াজ নিজের সিপাইদের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল, ‘নিয়ে আয়।’

রাম সিং চিন্তিত গলায় বলল, ‘তুই মেরে দিবি আমায়, আমি জানি! কুমোরের পো!’

রব নওয়াজ রেগে গেল, ‘সন্তোখসরের কচ্ছপ শালা! বাজে কথা বলিস না!’

রাম সিং হাসল, ‘কসম খেয়ে বল মারবি না?’

‘কার কসম খাব?’

‘যার ইচ্ছা!’

রব নওয়াজ হেসে ফেলল, ‘ভাগ ব্যাটা! যা নিয়ে আয়।’

কিছুক্ষণ চারদিক নিস্তব্ধ! দূরবীন হাতে যে সিপাই বসেছিল, সে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে রব নওয়াজের দিকে তাকাল। বন্দুক চালাতে যাবে, এমন সময় রব নওয়াজ এক লাফে তার কাছে গিয়ে দৃঢ়স্বরে বলল, ‘না!’

দূরবীনটা নিয়ে রব নওয়াজ নিজেই বসে পড়ল।

শত্রুদের এক সিপাই ভয়ে ভয়ে পাথরের পিছন থেকে উঠল। বেরিয়ে একছুটে একটু দূরের একটা ঝোপের আড়ালে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ পরে সেখান থেকে দু’হাতে কিছু নিয়ে আবার তীর বেগে ছুটে আগের পাথরটার পিছনে লুকিয়ে পড়ল। সে দৃষ্টির বাইরে বেরিয়ে যেতে রব নওয়াজ বন্দুক তুলে একটা ফায়ার করল। বন্দুক আর রব নওয়াজের হাসি মিলিয়ে চারদিক গমগম করে উঠল।

ওদিক থেকে রাম সিংয়ের গলা পাওয়া গেল, ‘থ্যাঙ্কু…!’

‘নো মেনশন…!’ রব নওয়াজ সিপাইদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এক রাউন্ড হবে নাকি?’

এমনি-এমনিই সময় কাটাতে দু’তরফ থেকে গালিগালাজ শুরু হল। কিছুক্ষণ বন্যা বইয়ে তারপর আবার সবাই চুপ করে গেল।

রব নওয়াজ দূরবীনে দেখল ওদিকের সুরক্ষিত পাথরটার পিছন থেকে ধোঁয়া উঠছে। সে ডাক দিল, ‘রাম সিংঘা…চা হল?’

‘এত তাড়াতাড়ি কী হবে? সাধে তোকে কুমোরের পো বলি!’

রব নওয়াজ জাতে কুমোর ছিল। জাত তুলে কেউ কিছু বললে তার গা জ্বলে উঠত, রক্ত ফুটতে আরম্ভ করে দিত। শুধু রাম সিংয়ের তাকে ‘কুমোর’ বলার অবিসংবাদিত অধিকার ছিল। রাম সিং আর রব নওয়াজ ছিল ছোট্টবেলার বন্ধু। একই গ্রামে জন্ম, বড় হওয়া। বয়সে তারা মাত্র কয়েকদিনের ছোট-বড়। দুজনের বাপ-ঠাকুরদাও একে অপরের প্রাণের বন্ধু ছিল। এরা দুজন একই স্কুলে পড়ত। একই সঙ্গে ফৌজে ভর্তি হয়। আগের যুদ্ধে বিভিন্ন মোর্চার হয়ে তারা একসঙ্গে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত লড়ে।

রব নওয়াজ নিজের সিপাইদের সামনে কুমোরের উল্লেখে একটু অস্বস্তিবোধ করল।

‘শুয়োরের বাচ্চাটা বদলাল না…!’ বলে রাম সিংয়ের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠল, ‘থাম শালা উকুনের বাচ্চা!’

রাম সিং উচ্চস্বরে হাসতে লাগল।

রব নওয়াজও হাসতে হাসতে এমনিই বন্দুকটা তুলে একটা গুলি ছুঁড়ল।

একটা গগনভেদী আর্তনাদ ভেসে এল।

সঙ্গে সঙ্গে দূরবীন চোখে দিয়ে রব নওয়াজ দেখল, পাথরের আড়াল থেকে একটু দূরে রাম সিং দু’হাতে পেট চেপে মাটিতে পড়ে গেল।

‘রাম সিং…!’ বলে তীক্ষ্ন চিৎকার দিয়ে রব নওয়াজ এক লাফে উঠে দাঁড়াল।

ওদিক থেকে দু-তিনটে গুলি ছুটে এল। একটা রব নওয়াজের ডান কাঁধ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। সে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল।

দুদিক থেকে গোলাগুলি আরম্ভ হয়ে গেল। গণ্ডগোলের ফাঁকে ওদিকের কয়েকজন সিপাই পাথরের আড়াল থেকে পালানোর চেষ্টা করছিল। এদিক থেকে ফায়ারিং চলল। গুলি এদিক ওদিক পাথরে ধাক্কা খেতে লাগল।

রব নওয়াজ নিজের সিপাইদের পাহাড় থেকে নেমে ওই পাহাড়ে ওঠার আদেশ দিল। তিনজন সিপাই গুলিবিদ্ধ হলেও বাকিরা হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় করতে করতে অন্য পাহাড়টায় পৌঁছে গেল।

রাম সিংয়ের শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। পাথুরে জমির উপর শুয়ে সে গোঙাচ্ছিল। তার পেটে গুলি লেগেছিল। রব নওয়াজকে দেখে তার চোখ চকচক করে উঠল। হেসে বলল, ‘এটা কী করলি, কুমোরের পো?’

রাম সিংয়ের ক্ষত রব নওয়াজ নিজের শরীরে অনুভব করতে লাগল! সে কাষ্ঠহেসে রাম সিংয়ের উপর ঝুঁকে পড়ে তার পেটের বাঁধন খুলতে শুরু করল, ‘শুয়োরের বাচ্চা! তোকে কে বলেছিল পাথরের আড়াল থেকে বেরোতে!’

বাঁধন খোলার সময় ব্যথায় রাম সিং ছটফটিয়ে উঠল।

রব নওয়াজ ভালো করে তার ক্ষতস্থান পরীক্ষা করল। জখমটা মারাত্মক!

রাম সিং রব নওয়াজের হাত ধরে বলল, ‘আমি তোকে নিজের মুখ দেখাতে বাইরে এসেছিলাম…তুই…শালা রবের পো, গুলি চালিয়ে দিলি!’

রব নওয়াজের গলা বুজে এল, ‘আল্লাহর কসম, আমি এমনিই গুলি চালিয়েছিলাম!…আমি জানতাম না যে তুই বেরিয়ে এসেছিস!…আমায় মাফ করে দে, রাম সিংঘা!’

অনেকটাই রক্ত বেরিয়ে গেছিল। রব নওয়াজ আর তার সিপাইরা বেশ কয়েক ঘন্টা পর সেখানে পৌঁছেছিল। ততক্ষণে তো এক জালারও বেশি রক্ত বেরিয়ে যাওয়ার কথা!

রব নওয়াজ আশ্চর্য হয়ে গেছিল যে রাম সিং এতক্ষণ বেঁচে! সে ভাবেনি রাম সিংকে জীবিত দেখতে পাবে। তাকে নাড়াচাড়া করা বিপজ্জনক ছিল। তাই রব নওয়াজ ওয়ারলেসে প্লাটুন কমান্ডারকে অনুরোধ করল ডাক্তার নিয়ে আসতে…তার বন্ধু রাম সিং গুরুতর আহত!

ডাক্তারের ওখানে ঠিক সময়ে পৌঁছনো অসম্ভব ছিল। রব নওয়াজ বুঝতে পেরেছিল যে রাম সিং হয়তো আর বেশিক্ষণ নেই। তবু সে শেষ চেষ্টায় ওয়ারলেসে খবর দিল। তারপর রাম সিংয়ের দিকে ফিরে বলল, ‘চিন্তা করিস না…ডাক্তার আসছে!’

রাম সিং একটু অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘চিন্তা আর কী!…একটা কথা বল তো! আমার ক’টা জওয়ানকে মেরেছিস?’

‘একটাই।’

দুর্বল গলায় রাম সিং আবার প্রশ্ন করল, ‘আর তোর ক’জন মরেছে?’

রব নওয়াজ নিজের সিপাইদের দিকে একবার তাকিয়ে উত্তর দিল, ‘ছ’জন!’

‘ছ’জন…ছ’জন…!’ রাম সিং যেন মনে মনে গুনল,’আমার চোট লাগায় আমার জওয়ানরা ভীষণ হতাশ হয়ে গেছিল…আমি বললাম, যাও, লড়ে এস…ছয়…ছয়…ঠিক আছে!’ তারপর হঠাৎ অতীতের কথায় চলে গেল, ‘রব নওয়াজ…তোর মনে আছে?’

রাম সিং পুরোনোদিনের গল্প শুরু করল। গ্রামের কথা, স্কুলের ঘটনা, ৬/৯ রেজিমেন্টের কাহিনি, কমান্ডিং অফিসারদের গল্প, বাইরের দেশের অচেনা মেয়েদের সঙ্গে প্রেমালাপ…!

পুরনো দিনের গল্প করতে করতে রাম সিং হঠাৎ কী যেন ভেবে হাসতে শুরু করে দিল। তার চোটের জায়গাটা টনটন করে উঠল। কিন্তু সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সে হাসতে হাসতেই বলল, ‘ওই, শুয়োরের পো!…তোর সেই ম্যাডামকে মনে আছে?’

‘কোন ম্যাডাম?’

‘আরে সেই…সেই ইতালির ম্যাডাম…কী নাম যেন রেখেছিলি তুই ওর?… রাগী আর ঝগড়ুটে সেই ম্যাডামের?’

রব নওয়াজের মনে পড়ে গেল, ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ…সেই ম্যাডাম মনীতা ফনীতো!… পয়সা ফেকো, তামাশা দেখো!…কিন্তু ওই মুসোলিনির ছেমড়ি তোকে তো মাঝে মাঝে ছাড় দিত!…’

রাম সিং হো-হো করে হেসে উঠল। তার ক্ষত থেকে একদলা রক্ত বেরিয়ে এল।

রব নওয়াজ চিন্তিত গলায় বলল, ‘রাম সিং! এবার চুপ কর।’

রাম সিংয়ের গায়ে তখন জ্বর! কপাল তাপে পুড়ে যাচ্ছে। কথা বলার ক্ষমতা কমে এসেছে। তবু সে বলতেই থাকল। মাঝে মাঝে একটু থেমে বোধহয় দেখে নিচ্ছিল ট্যাঙ্কে আর কতটা পেট্রল বাকি!

কিছুক্ষণের মধ্যে সে ভুল বকতে আরম্ভ করল। ভুল বকছে আর মাঝে মাঝে একটা দুটো স্বাভাবিক কথা বলছে! এরকম চলতে চলতে সে রব নওয়াজকে জিগ্যেস করল, ভাই…সত্যি করে বলবি…তোদের সত্যিই কাশ্মীর চাই?’

রব নওয়াজ মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ রে, রাম সিংঘা!’

রাম সিং হালকা মাথা নেড়ে বলল, ‘না…আমি মানি না…তোদের ভুল বোঝানো হয়েছে!’

রব নওয়াজ বিশ্বাস করানোর চেষ্টায় বলল, ‘না ভাই…তোদের ভুল বোঝানো হয়েছে…খোদাতাল্লার কসম!’

রাম সিং রব নওয়াজের হাত ধরল, ‘কসমের দরকার নেই ভাই। বলছিস যখন তখন নিশ্চয়ই ঠিক!’

কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে বিশ্বাসের আভাস পাওয়া গেল না।

সন্ধের একটু আগে প্লাটুন কমান্ডার মেজর আসলাম এল। তার সঙ্গে অনেক সিপাই ছিল, কিন্তু ডাক্তার ছিল না।

রাম সিংয়ের তখন প্রায় শেষ অবস্থা! সে বিড়বিড় করে চলেছিল। কিন্তু এত ক্ষীণ আর অস্ফুট স্বরে যে, কিছু বোঝা যাচ্ছিল না।

মেজর আসলাম আগে ৬/৯ রেজিমেন্টেরই ছিল। সে রাম সিংকে খুব ভালো করে চিনত। রব নওয়াজ তাকে অবস্থার বিবরণ দেওয়ার পর সে ডাকল, ‘রাম সিং…রাম সিং!’

রাম সিং চোখ খুলল। কোনওরকমে সে মন দিয়ে মেজর আসলামকে চেনার চেষ্টা করতে লাগল। চিনতে পারার সঙ্গে সঙ্গে শোয়া অবস্থাতেই সে অ্যাটেনশন পজিশনে তাকে স্যালুট ঠুকল। মুহূর্তের মধ্যে তার স্যালুটরত হাত বুকের পাশে ঢলে পড়ল। কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে অস্ফুটে বলল, ‘কিচ্ছু না…কেউ না…রাম সিং!…শালা শুয়োরের বাচ্চা ভুলেই গেছিস এই লড়াই কার…কার…’

রাম সিং আর কথা শেষ করতে পারল না…বুজে আসা চোখে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে রব নওয়াজের দিকে তাকাতে তাকাতে তার শরীর স্থির হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *