আর্টিস্ট

আর্টিস্ট

মাহমুদ প্রথমবার জমীলাকে দেখে বাগ-এ জিন্নাহয়ে।

জমীলা তার বন্ধুদের সঙ্গে বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সবারই পরনে কালো বোরখা, কিন্তু মুখটা খোলা। মাহমুদ ভাবল, ‘এ আবার কেমন পর্দা! বোরখা পরেছে, এদিকে মুখ ঢাকেনি!…এরকম পর্দার দরকারটাই বা কী!’

কিন্তু তার জমীলাকে দেখে ভীষণ ভালো লেগেছিল।

জমীলা বন্ধুদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করতে করতে হাঁটছিল। মাহমুদ তার পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করল। কাজটা যে বেশ অনৈতিক, সে খেয়াল তার ছিল না। বারবার সে জমীলার দিকে আড়চোখে তাকাতে লাগল। দু-একবার চোখ দিয়ে ইশারা করারও চেষ্টা করল। কিন্তু জমীলা বিন্দুমাত্র পাত্তা দিল না। বন্ধুদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে সে এগিয়ে গেল। সেই বন্ধুরাও বেশ সুন্দর দেখতে। কিন্তু জমীলার মধ্যে যেন একটা আলাদা আকর্ষণ ছিল। চুম্বকের মতো তা মাহমুদকে টানছিল।

একটু এগোনোর পর মাহমুদ সাহসে ভর করে জমীলার কাছে গিয়ে বলল, ‘হুজুর, নাকাবটা সামলে নিন…হাওয়ায় উড়ছে!…’

জমীলা প্রথমে থতমত খেয়ে গেল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে সে চেঁচিয়ে উঠল। তার চিৎকারে বাকি লোকজনের সঙ্গে সঙ্গে দুজন পুলিশও এসে পড়ল। পুলিশ দুজন তখন ওই বাগানেই ডিউটিতে ছিল। তারা দৌড়ে এসে জমীলাকে জিগ্যেস করল, ‘কী হয়েছে, বোন?’

জমীলা মাহমুদের দিকে দেখিয়ে বলল, ‘এই ছেলেটা তখন থেকে আমায় বিরক্ত করছে!…যখন থেকে বাগানে ঢুকেছি, আমার পিছু নিয়েছে!’

মাহমুদ তখন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে। পুলিশ মাহমুদের চোদ্দোপুরুষের খবর নিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে ঢুকিয়ে দিল। কিন্তু তার জামিন হতে বেশি দেরি হল না।

এরপর শুরু হল মোকদ্দমা। তার বিস্তৃত বিবরণের প্রয়োজন নেই। শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট যে মাহমুদের অপরাধ প্রমাণিত হয়ে গেল। সাজা হল দু’মাসের সশ্রম কারাদণ্ড। তার বাপ-মা গরিব ছিল। সেশন আদালতে আপিল করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। মাহমুদও আশ্চর্য হয়ে গেছিল। কোন দোষে তার এত শাস্তি হল? তার তো একজন মেয়েকে ভালো লেগেছিল, আর সে তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিল! শুধুমাত্র এইটুকু অপরাধে তার দু’মাসের জেল হল! তাও সশ্রম!

জেলের মধ্যে সে বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি করতে শুরু করল। তার আঁকার শখ ছিল। এদিকে জেলে তাকে ঘানি টানতে হচ্ছিল।

কুড়িদিন মতো কেটে গেল। তারপর একদিন এক পুলিশ এসে তাকে বলল, তার সঙ্গে দেখা করতে কেউ এসেছে। সে অবাক হয়ে গেল। তার সঙ্গে কে দেখা করতে আসবে! বাবা তো রাগে কথাই বলছিলেন না, আর মা বিকলাঙ্গ। আর কোনো আত্মীয়ও ছিল না তার। তাহলে কে এল!

পুলিশ তাকে দরজার কাছে নিয়ে গেল। তাতে লোহার শিকের গরাদ। গরাদের পিছনে জমীলা দাঁড়িয়ে।

সে আরো অবাক হল। ভাবল, নিশ্চয়ই অন্য কাউকে দেখতে এসেছে। কিন্তু জমীলা তাকে দেখতে পেয়ে তার দিকেই এগিয়ে এল।

‘আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’

মাহমুদের বিস্ময়ের ছিল না।

‘আমার সঙ্গে!’

‘জি!…ক্ষমা চাইতে এসেছি!…সেদিন আমি না ভেবেচিন্তে দুম করে চিৎকার চেঁচামেচি করে ফেলেছিলাম। তাই আজ আপনাকে এখানে আসতে হয়েছে।’

মাহমুদ হেসে ফেলল, ‘হে অনুতপ্ত, অচিরেই দেখি অনুতাপ হল তেমার!’

জমীলা বলল, ‘গালিব না?’

‘জি গালিব সে ছাড়া! আর কে মানুষের অনুভূতি এমন করে লিখতে পেরেছে!…যাই হোক। আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম…কিন্তু এটা তো আমার বাড়ি নয়, সরকারের বাড়ি!…তাই ঠিক করে অতিথির সেবা করতে পারলাম না…আমায় আপনি ক্ষমা করবেন…।’

জমীলার চোখ জলে ভরে উঠল, ‘ও কথা বলবেন না। আপনি কেন আমার সেবা করবেন!…বরং আমিই আপনার সেবিকা!…’

আরো কিছুক্ষণ ধরে দুজন কথাবার্তা বলল। পূর্বরাগ থেকে প্রেমের শপথ অবধি নানারকম কথা! জমীলা তার জন্য একটা সাবান এনেছিল, আর কিছু মিষ্টি।

এরপর প্রত্যেক পনেরো দিনেই জমীলা মাহমুদের সঙ্গে দেখা করতে আসতে লাগল। ধীরে ধীরে দুজনের প্রেম আরো গভীর হয়ে উঠল।

জমীলা একদিন মাহমুদকে বলল, ‘জানো, আমার খুব গানের শখ!…তাই ইদানীং খাঁ সাহেব সালাম আলী খাঁয়ের কাছে তালিম নিতে শুরু করেছি।

মাহমুদ বলল, ‘আমারও আঁকার শখ…জেলে শুধু একটাই দুঃখ যে আঁকতে পারি না…পরিশ্রমে আমার ভয় নেই, কিন্তু যে শিল্প আমায় ভিতর থেকে বাঁচিয়ে রাখে, তার সাধনা করার কোনো অবকাশ নেই এখানে!…না আছে আলো, না আছে রং, না কাগজ, না পেনসিল—কিছুই নেই!’

জমীলার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল, ‘আর কয়েকটা দিন, ব্যস…তারপর তুমি বেরিয়ে আসবে…তখন এ সবকিছুই করতে পারবে, দেখো!’

দু’মাস পর মাহমুদ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গেল। সেদিনও জমীলা জেলের দরজায় দাঁড়িয়েছিল। সেই কালো বোরখা পরে। যদিও তখন সেই বোরখার রং চটে গেছে, জায়গায় জায়গায় কাপড় ছেঁড়া।

দুজনেই আর্টিস্ট। তারা ঠিক করল বিয়ে করবে।…বিয়ে হয়ে গেল।

জমীলার বাবা-মা তার জন্য অল্প কিছু সম্পত্তি রেখে গেছিল। তাই দিয়ে তারা একটা ছোট্ট বাড়ি তৈরি করাল। তারপর আনন্দের সঙ্গে নতুন জীবন কাটাতে লাগল।

মাহমুদ একটা আর্ট স্টুডিওয় যেতে শুরু করল। আর জমীলা খাঁ সাহেব সালাম আলী খাঁয়ের কাছে আবার তালিম নিতে ভর্তি হল।

এক বছর এরকমভাবেই কেটে গেল। দুজনেরই তালিম চলল—একজনের আঁকার, আরেকজনের গানের।

ধীরে ধীরে যেটুকু পয়সাকড়ি ছিল, তাও শেষ হয়ে গেল। এমনকী দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোটানোও মুশকিল হয়ে পড়ল। কিন্তু দুজনই ছিল শিল্পের জন্য পাগল! তাদের ধারণা ছিল, অভুক্ত থেকেই শিল্পের সঠিক সাধনা সম্ভব! তাই এমন দুরবস্থাতেও তারা খুশিই ছিল।

একদিন জমীলা তার স্বামীকে বলল, সে এক বড়লোকের মেয়েকে গান শেখানোর প্রস্তাব পেয়েছে।

মাহমুদ শুনেই তাকে বলল, ‘না! টিউশন-ফিউশন ফালতু জিনিস!… আমরা আর্টিস্ট।’

তার স্ত্রী খুব নরম গলায় বলল, ‘কিন্তু এভাবে চলবে কী করে, বল?’

মাহমুদ তার সুতো উঠে যাওয়া কোটের কলার বড়লোকি চালে ঠিক করতে করতে উত্তর দিল, ‘আর্টিস্টরা এসব অর্থহীন জিনিস নিয়ে ভাবে না…আমরাই আর্টের জন্য বেঁচে, আর্ট আমাদের জন্য না!’

জমীলা আনন্দের সঙ্গে বলল, ‘ঠিক বলেছ!…আমি তো ভাবছিলাম তোমার আঁকার কথা!…মাসে মাসে আর্ট স্টুডিওর ফি দিতে হয় তোমায়!…সেটার ব্যবস্থা তো করা দরকার!…তার উপর খাওয়াদাওয়ার খরচ আছে!’

‘আমি আপাতত আঁকা শিখতে যাওয়া বন্ধ রেখেছি। অবস্থা একটু ভালো হলে আবার শুরু করব।’

এটা শুনে জমীলা চুপ করে গেল।

পরেরদিন যখন সে বাড়ি ফিরল, তার ব্যাগে পনেরো টাকা। টাকাটা স্বামীর হাতে দিয়ে সে বলল, ‘আমি টিউশন শুরু করে দিয়েছি। পনেরো টাকা অগ্রিম দিয়ে দিয়েছে। তুমি আবার আঁকা শিখতে যাও।’

মাহমুদের পৌরুষে যেন আঘাত লাগল, ‘আমি চাই না তুমি চাকরি করো। আমার চাকরি করা উচিত।’

জমীলা বড় বড় চোখ তুলে তার দিকে তাকাল, ‘হায় আল্লাহ, আমি কি তোমার পর?…অল্প সময়ের জন্য চাকরি করলে কী হবে!…ওরা খুব ভালো আর ভদ্রলোক…যাকে গান শেখাই, সেই মেয়েটাও খুব মিষ্টি। আর ছাত্রী হিসেবেও বেশ ভালো।’

শুনে মাহমুদ চুপ করে রইল। সে আর কথা বাড়াল না।

পরের সপ্তাহে সে পঁচিশ টাকা এনে স্ত্রীকে দিল, ‘আমার একটা আঁকা বিক্রি করলাম। খরিদ্দারের খুবই পছন্দ হয়েছে। কিন্তু লোকটা রামকিপটে! তাই মাত্র পঁচিশ টাকাই দিল…আশা করছি আমার বাকি আঁকাগুলোও ভালোই বিক্রি হবে।’

জমীলা হাসল, ‘তাহলে তো আমরা বড়লোক হয়ে যাব গো!’

মাহমুদ তাকে বলল, ‘আমার কাজগুলো ভালোমতো বিক্রি হতে থাকলে আমি কিন্তু আর তোমায় টিউশন করতে দেব না।’

জমীলা স্বামীর টাইটা ঠিক করে বাঁধতে বাঁধতে আদুরে গলায় উত্তর দিল, ‘তুমিই আমার মালিক…তুমি যা হুকুম করবে, বাঁদী তাই মেনে চলবে…’

দুজনেই খুব খুশি! তাদের একে অন্যের প্রতি অগাধ প্রেম! মাহমুদ জমীলাকে বলল, ‘তুমি কিচ্ছু চিন্তা কোরো না। আমার কাজ ঠিকঠাকই শুরু হয়েছে।…চারটে আঁকা কাল-পরশুর মধ্যে বিক্রি হয়ে যাবে। ভালো দামও পাব। তুমি তোমার গানের তালিম আবার শুরু করে দিও।’

একদিন বিকেলে যখন জমীলা বাড়ি ফিরেছে, তার চুলের মধ্যে তুলোর রোঁয়া জমে! ঠিক মাঝবয়সি লোকেদের দাড়ি পাকলে যেমন লাগে!

মাহমুদ জিগ্যেস করল, ‘হ্যাঁ গো! চুলের কী অবস্থা করেছ!…গান শেখাতে যাও, না তুলোর কারখানায় যাও!’

জমীলা মাহমুদের নতুন কম্বলের তুলো ধুনছিল। সে হাসতে হাসতে বলল, ‘আমরা আর্টিস্ট। এসবের খেয়াল থাকে নাকি আমাদের?’

মাহমুদ হুঁকোর নলটা মুখে পুরে তার দিকে তাকাল, ‘সত্যিই খেয়াল থাকে না।’

জমীলা তার কাছে এসে তার চুলে আঙুল বোলাতে লাগল। বোলাতে বোলাতে তার ভুরু সামান্য কুঁচকে গেল, ‘তোমার চুলেরই বা কী হয়েছে!! এই তুলো আর রোঁয়া তোমার চুলে কী করে এল?’

মাহমুদ হুঁকোয় একটা টান দিয়ে উত্তর দিল, ‘যেভাবে তোমার চুলে এসেছে…আমরা দুজন একই তুলোর কারখানায় কাজ করি…শুধু আর্টের জন্য…!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *