ইয়েজিদ

ইয়েজিদ

(ইয়েজিদ-ইবন-মুবিয়া ছিল আমীর মুবিয়ার ছেলে, উমাইয়াদ বংশের খলিফা। বিরুদ্ধাচরণ করার অপরাধে এই খলিফা হজরত মুহম্মদের বংশধর হজরত ইমাম হোসেন আর তার অনুসরণকারীদের কারবালার প্রান্তরে খাবার-জলের যোগান আটকে নির্মমভাবে মেরেছিল।)

উনিশশো সাতচল্লিশ। তুফান এল, এসে চলেও গেল। ঠিক যেমন কখনো কখনো হঠাৎ ঝড় ওঠে, আবার সব শান্ত হয়ে যায়। করীম দাদ অবশ্য একে আল্লাহর মর্জি ভেবে বসে থাকেনি। পুরুষের মতো সে এই ঝড়ের মোকাবিলা করেছিল। বহুবার লড়েছিল বিরোধীদের সঙ্গে। হারাবার জন্য নয়; কারণ সে জানত যে বিরোধীরা যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু শত্রুর সামনে অস্ত্র ছেড়ে দিয়ে বসে থাকাকে সে কাপুরুষোচিত মনে করত। তাই শুধু লড়বার জন্যই সে লড়েছিল। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, একথা কিন্তু কখনো তার মুখ থেকে শোনা যায়নি। যারা তার দুর্জয় সাহস দেখেছিল, এ তাদের কথা। করিম দাদকে যদি কখনো জিগ্যেস করা হত যে সে অস্ত্রত্যাগকে কাপুরুষতা মনে করে কিনা, সে খুবই চিন্তায় পড়ে যেত, যেন খুব কঠিন অঙ্ক কষতে দেওয়া হয়েছে।

যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগে তার কোনো মন ছিল না।

সাতচল্লিশের তুফান এসেছিল, এসে চলেও গেছিল। লোকজন তখন ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে মশগুল। জান-মালের হিসাব, লোকসানের হিসাব। কিন্তু করিম দাদ এসবে নিস্পৃহ। সে শুধু জানত যে তার বাবা রহীম দাদ এই যুদ্ধে শহীদ। সে-ই বাবার মৃতদেহ কাঁধে তুলে এনে একটা কুয়োর পাশে মাটি খুঁড়ে গোর দিয়েছিল।

গ্রামে আরো অনেক ঘটনাই ঘটেছিল। শয়ে শয়ে মানুষ খুন হয়েছিল, অসংখ্য মেয়ে নিরুদ্দেশ, কেউ কেউ নির্মমভাবে ধর্ষিত। ক্ষতবিক্ষত গ্রামবাসীর কান্না যেন চতুর্দিকে শোনা যেত; কেউ কপালকে দুষত, কেউ শত্রুকে। শুধু করিম দাদই অবিচলিত ছিল। তার চোখ দিয়ে কেউ একফোঁটা জলও বেরোতে দেখেনি। বাবা রহীম দাদের বীরত্বে সে যারপরনাই গর্বিত ছিল। পঁচিশ-ত্রিশজন সশস্ত্র লোকের সঙ্গে রহীম দাদ খালি হাতে একা লড়ে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়েছিল।

এ খবর শোনামাত্র করিম শুধু বাবার আত্মার উদ্দেশ্যে বলেছিল, ‘এটা ঠিক করলে না! কতবার বলেছিলাম একটা-দুটো হাতিয়ার রাখতে!’

মৃতদেহ একা কাঁধে তুলে গোর দিয়ে সে ফাতিহা পড়ার বদলে শুধু বলেছিল, ‘পাপ-পুণ্যের হিসাব আল্লাহ জানেন। তিনি তোমার বেহেস্তবাস মঞ্জুর করুন!’

রহীম দাদের বীভৎস মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে গ্রামের লোকের চোখে জল চলে আসত। সম্ভব হলে শুধু তাদের অভিশাপেই শত্রুর বংশ লোপ পেত! কিন্তু করিম দাদ কিচ্ছু বলত না। তার ফসল নষ্ট হয়েছিল, ঘরবাড়ি পুড়ে ছারখার হয়ে গেছিল, তবু সে চুপ। মাঝে মাঝে শুধু বলত, ‘আমারই দোষ!’ কী দোষ জানতে চাইলে সে আরো চুপচাপ হয়ে যেত।

গ্রামে তখনো শোকের আবহ, এমন সময় করিম দাদ বিয়ে করে ফেলল।

তার বহুদিনের প্রেমিকা জেনা। সেও শোকে মুহ্যমান। তার জোয়ান ভাই দাঙ্গায় মারা গেছিল। সেই ভাই ছাড়া তার আর কেউ ছিল না। করিমকে সে অসম্ভব ভালোবাসত, কিন্তু ভাইয়ের মৃত্যুর ছায়ায় যেন সেসব ঢাকা পড়ে গেছিল। করিম দাদ কান্নাকাটি একেবারে পছন্দ করত না। জেনার ভেজা চোখ দেখলেই তার ভীষণ কষ্ট হত, রাগ হত, কিন্তু তাকে আর কাঁদাতে করিমের মন চাইত না। তাই সে কিছু বলত না।

একদিন সে আর থাকতে পারল না। ক্ষেতের মধ্যে জেনাকে দু’হাত দিয়ে আটকে সে বলল, ‘এক বছর হয়ে গেছে। যারা মরে গেছে তারাও আর এই শোক সহ্য করতে পারবে না…এখনো কত কিছু দেখতে হবে কে জানে!…একটু চোখের জল বাঁচিয়ে রাখ।…বলা তো যায় না, কবে দরকার পড়ে!’

জেনার মনঃপূত হল না এই কথা। কিন্তু করিমকে সে সত্যিই ভালোবাসত। বাড়ি ফিরে সে তাই এ নিয়ে ভাবতে বসল। অনেক ভেবে শেষে মনস্থির করল, করিম দাদ যা বলে ঠিক বলে।

বিয়ের কথা উঠতে গুরুজনেরা বেঁকে বসেছিল। কিন্তু তাদের বিরোধিতায় আর জোর ছিল না। হা-হুতাশ করে করে তারা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। যেসব যুক্তিতর্ক দিয়ে এই বিয়ে নিশ্চিতভাবে আটকানো যেত, সেগুলোরও যেন জোর কমে এসেছিল। ফলে বেশি তর্কবিতর্ক ছাড়াই করিম দাদের বিয়ে হয়ে গেল। বাজনাও বাজল, আলোও জ্বলল। সমস্ত নিয়ম মেনে করিম আর জেনার নিকাহ সম্পন্ন হল।

দাঙ্গার এক বছর পর অবধিও সে গোরস্থান তখনো গ্রাম হয়ে উঠতে পারেনি। এর মধ্যে করিম দাদের বিয়ের জাঁকজমকে গ্রামের লোক ভয়ে কেঁপে উঠল, যেন কোনো ভৌতিক ঘটনা ঘটেছে!

করিম দাদকে তার বন্ধুরা এইসব গল্প বললে সে হা-হা করে হাসত। একদিন হাসতে হাসতে সে একথা তার নতুন বউকে বলল। জেনা শুনে ভয়ে শিউরে উঠল। করিম জেনার নরম চুড়ি-পরা হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, ‘এই ভূত তো এখন জীবনভর তোমার সঙ্গে সেঁটে থাকবে! রহমান বাবার ঝাড়ফুঁকেও নামবে না!’

জেনা মেহেন্দিরাঙা আঙ্গুল দাঁত দিয়ে চেপে মাথা নীচু করে বলল, ‘কীমে, তোমার কি কিছুতেই ভয় লাগে না!?’

করিম দাদ তার কালচে খয়েরি গোঁফে জিভ বুলিয়ে আবার হাসল, ‘ভয় আবার একটা জিনিস হল!’

জেনার দুঃখ অনেকটাই কমে এসেছিল। সে মা হতে চলেছিল। করিম দাদ তাকে দেখলেই উৎফুল্ল হয়ে উঠত, ‘আল্লাহর কসম জেনা, তুমি এত সুন্দর কোনোদিনও ছিলে না!…এ যদি এই বাচ্চাটার জন্য হয়, আমার সঙ্গে কিন্তু ওর ঝগড়া হয়ে যাবে!’

জেনা শুনেই লজ্জায় চাদর দিয়ে পেট ঢেকে ফেলত।

করিম দাদ তখনো হেসেই যেত, ‘চোরটাকে লুকাচ্ছ কী? আমি কি জানি না এত সাজগোজ সব এই শুওরের বাচ্চার জন্য!?’

জেনা গম্ভীর হয়ে যেত, ‘নিজের বাচ্চাকে কী যা-তা বল তুমি!’

করিম দাদের কালচে খয়েরি গোঁফ হাসির চোটে কাঁপতে লাগত, ‘করিম দাদ তো শুওর!’

ছোট ঈদ গেল, বড় ঈদ গেল—করীম দাদ সব উৎসবই খুব ধুমধাম করে করল।

দু’বছর আগে এই বড় ঈদেরই বারো দিন আগে তার গ্রামে দাঙ্গা হয়েছিল। করিম দাদের বাবা রহীম দাদ আর জেনার ভাই ফজল ইলাহী খুন হয়েছিল। জেনা বছরখানেক শোকে বিহ্বল ছিল। ধীরে ধীরে করিম দাদের সদাহাস্যময় সংস্পর্শে তার দুঃখ অনেকটাই কমে এসেছিল।

কখনো ভাবতে বসলে জেনা অবাক হয়ে যেত! কী তাড়াতাড়ি সে নিজের দুঃখ-কষ্ট ভুলে গেছে! বাপ মা-কে তার মনে নেই। ছ’বছর বড় দাদাই তার বাপ-মা ছিল। শুধু জেনার জন্যই সে বিয়ে করেনি! আর শুধু জেনার সম্মান বাঁচাতে গিয়েই সে দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছে! দাদার চলে যাওয়া তার জন্য কেবল একটা দুর্ঘটনাই ছিল না; তার জীবনের সবকিছু যেন ওই একটা ঘটনায় ভেঙে চুরমার হয়ে গেছিল! কিন্তু আজ সে সেই স্মৃতি থেকে কত দূরে!

মহরমের কিছু আগে করিম দাদকে সে জিগ্যেস করল, ‘আমি ঠিক থাকলে আমায় ঘোড়া দেখাতে নিয়ে যাবে?’

বন্ধুদের কাছে গল্প শুনে তার ঘোড়া আর তাজিয়া দেখার খুব ইচ্ছা হয়েছিল।

করিম দাদ হেসে বলল, ‘ঠিক না হলেও নিয়ে যাব। তোমাকেও আর এই শুওরের বাচ্চাটাকেও।’

জেনার এই গালি মোটেই ভালো লাগত না। সে রেগে যেত। কিন্তু করিম দাদের প্রাণখোলা কথাবার্তায় বেশিক্ষণ রেগে থাকা দায় ছিল। জেনা একটু পরেই হেসে ফেলত। ভাবত, ‘এত ভালোবেসে কেউ শুওরের বাচ্চা বলতে পারে!’

হিন্দুস্তান আর পাকিস্তানের যুদ্ধের ব্যাপারে অনেক গুজব শোনা যেত। দেশ ভাগ হতেই সবাই মোটামুটি জানত যে যুদ্ধ হবেই। কবে হবে সেটা কেউ জানত না।

করিম দাদকে এই নিয়ে কেউ কিছু জিগ্যেস করলে সে সংক্ষেপে উত্তর দিত, ‘যখন হবে হবে…এখন এই নিয়ে ফালতু ভেবে কী করব?’

জেনা কিন্তু যুদ্ধের কথা শুনলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ত। সে স্বভাবতই খুব শান্তিপ্রিয়। সামান্য ঘরোয়া ঝগড়াঝাঁটিও তার সহ্যের বাইরে ছিল। তার উপর দাঙ্গায় সে অনেক কিছু দেখেছিল, অনেক কিছু হারিয়েছিল। শঙ্কিত গলায় সে করিমকে জিগ্যেস করত, ‘কী মিঞা, কী হবে?’

করীম দাদ স্বভাবমতো হাসত, ‘আমি কী জানি! হবে কিছু একটা, ছেলে বা মেয়ে!’

জেনাকে তিতিবিরক্ত হতে দেখলেই করিম দাদ অন্য কথা পাড়ত। জেনাও এই-ওই কথায় আস্তে আস্তে বিরক্তি ভুলে যেত।

করীম একটা বন্দুক কিনেছিল। কিছুদিনের মধ্যেই নিশানায় সে পোক্তও হয়ে উঠেছিল। এটুকুতেই জেনা বেশ কিছুটা ভরসা পেত। তবু বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগাছায় যখনই যুদ্ধসংক্রান্ত বিভিন্ন গুজব শুনত, সে ভয়ে কুঁকড়ে যেত।

বখতো দাই রোজ জেনাকে দেখতে আসত। একদিন দাই খবর আনল হিন্দুস্তান নাকি নদীর জল আটকে দেবে।

জেনা তার মানে না বুঝতে পেরে জিগ্যেস করল, ‘নদীর জল আটকে দেবে মানে? কোন নদী?’

বখতো দাই উত্তর দিল, ‘আমাদের নদী! যা থেকে আমাদের জল আসে!’

জেনা একটু ভেবে ফিক করে হেসে দিল, ‘মাসি, কী যে বল তুমি! নদী আবার আটকানো যায় নাকি? এ কী মেয়ে নাকি যে আটকে রাখবে!’

বখতো জেনার পেটে হালকা মালিশ করতে করতে বলল, ‘আমি কি জানি বিবি! যা শুনেছি তাই বললাম। লোকজন বলেছিল এই খবর নাকি কাগজেও বেরিয়ে গেছে!’

‘কোন খবর?’ জেনার বিশ্বাস হল না।

বখতো তার কুঁচকানো হাতে জেনার পেটে হালকা থপথপিয়ে বলল, ‘এই নদীর জল আটকানোর খবর…।’ তারপর জেনার কামিজ টেনে পেটটা ঢেকে দিয়ে উঠে পড়ল। বলল, ‘আল্লাহ সব ঠিকঠাক রাখলে দশদিন বাদেই বাচ্চা হয়ে যাবে।’

করিম দাদ বাড়ি ঢুকতেই জেনা তাকে নদীর ব্যাপারে প্রশ্ন করল। প্রথমে তো সে কথা কাটানোর চেষ্টা করছিল, শেষে গত্যন্তর না দেখে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ। তাই তো শুনলাম।’

জেনা জিগ্যেস করল, ‘কী শুনলে?’

‘যে হিন্দুস্তানের লোক আমাদের নদীর পানি আটকে দেবে।’

‘কেন?’

‘আমাদের ফসল যাতে নষ্ট হয়ে যায়!’

তখন জেনার বিশ্বাস হয়েছে যে এটা করা সম্ভব। অসহায়ভাবে সে শুধু বলল, ‘এরা এত অত্যাচার করবে?’

করিম দাদ একটু হেসে জবাব দিল, ‘হুঁ।’ তারপর বলল, ‘দাই কী বলে গেল?’

‘বলল দশদিন বাদে বাচ্চা হয়ে যাবে?’

করিম দাদ স্লোগানের কায়দায় বলে উঠল, ‘জিন্দাবাদ!!’

অপ্রসন্ন জেনা স্বগতোক্তি করতে লাগল, ‘তোমার আনন্দ আর ফুরোয় না! ওদিকে না জানি কোন কারবালা কপালে আছে!’

করিম দাদ উত্তর না দিয়ে গ্রামপঞ্চায়েত-সভার দিকে রওনা দিল।

সভায় গ্রামের প্রায় সব ক’জন লোকই জড় হয়েছিল।

চৌধুরী নাত্থুকে ঘিরে সবাই নদী আটকানোর কথাই জিগ্যেস করছিল। কেউ কেউ নেহরুকে গাল দিচ্ছিল, কেউ অভিশাপ দিচ্ছিল, কেউ তখনো বিশ্বাসই করতে চাইছিল না যে এমন কিছু হতে পারে, কেউ একে নিজেদের কর্মফল বলে মেনে নিয়েছিল।

করিম দাদ এক কোণায় বসে চুপ করে সব শুনছিল।

হিন্দুস্তানকে গালি দেওয়ায় সবার আগে ছিল চৌধুরী নাত্থু।

‘নদী বন্ধ করা নিতান্তই ছোটলোকের মতো কাজ। খুবই অসভ্যতা… ইতরামি…ঘৃণ্য অত্যাচার…এটা পাপ…এটা ইয়েজিদগিরি!’

করিম দাদ বেশ কয়েকবার বসার ভঙ্গি বদলাল। কয়েকবার গলা খাঁকারি দিল যেন কিছু বলবে। চৌধুরী নাত্থু আরেক দফা গালাগাল করতেই সে আর থাকতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘চৌধুরী! অকারণ খিস্তি দিও না!’

মাতৃসম্বন্ধীয় একটা চোখা শব্দ চৌধুরীর গলায় আটকে গেল। সে অবাক হয়ে করিম দাদকে দেখল, ‘কী বললে?’

করিম দাদ ধীরে ধীরে দৃঢ়স্বরে বলল, ‘বললাম, অকারণ খিস্তি দিও না।’

গলায় আটকানো শব্দটা দ্বিগুণ জোরের সঙ্গে উৎক্ষেপ করে চৌধুরী তীক্ষ্নস্বরে বলল, ‘অকারণ! ওরা তোমার কে হয়, হ্যাঁ!?’

তারপর সভার সবার দিকে ফিরে বলতে লাগল, ‘শুনলে সবাই? বলে কিনা খিস্তি দিও না? ওরা কে হয় ওর!’

করিম দাদ উত্তর দিল, ‘আমা-র!…আমার শত্রু হয়!’

চৌধুরী গোঁফ-কাঁপানো হাসি হেসে বলল, ‘শুনলে? শুনলে সবাই? শত্রু! তা শত্রুকে ভালোবাসতে হয়, নাকি হে?’

‘না চৌধুরী। ভালোবাসতে বলিনি। বলেছি খিস্তি না করতে।’

করিম দাদের পাশে তার ছোটবেলার বন্ধু মীরাবকশ বসেছিল। সে জিগ্যেস করল, ‘কেন ভাই?’

করিম দাদ মীরাবকশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী লাভ! ওরা পানি বন্ধ করে তোমার ক্ষেত-টেত নষ্ট করার চেষ্টা করছে আর তুমি ভাবছ গাল পেড়ে হিসাব চুকিয়ে ফেলবে! এ কীরকম বোকার মতো কথা! যখন সব উত্তর শেষ হয়ে যাবে, তখন নাহয় গালি দিও!’

মীরাবকশ বলল, ‘তোমার কাছে এর আর কী উত্তর আছে?’

একটু ভেবে করিম দাদ জবাব দিল, ‘আমার একার ব্যাপার তো নয়! এটা লাখ লাখ লোকের সমস্যা। আমার একার উত্তর হয়তো সবার উত্তর নাও হতে পারে। এসব ব্যাপারে ভেবেচিন্তে একটা পাকা উত্তর তৈরি করতে হবে। একদিনে তো ওরা নদীর মুখ ঘুরিয়ে দিতে পারবে না! বেশ কবছর লাগবে। কিন্তু এখানে তো তোমরা গালি দিয়ে এক মিনিটেই ঝামেলা চুকিয়ে দিতে চাইছ।’ বলে সে মীরাবকশের কাঁধে হাত রাখল, ‘আমি তো বলছি হিন্দুস্তানকে নীচ, অসভ্য, ইতর, অত্যাচারী এসব বলাও অন্যায়!’

এবার চৌধুরী নাত্থু চিৎকার করল, ‘বাঃ! কী সুন্দর কথা! সবাই শোনো!’

করিম আবার মীরাবকশকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করল, ‘ভাই, শত্রুর কাছ থেকে মায়া-দয়ার আশা করাটাই তো মূর্খামি! এদিকে যুদ্ধ শুরু হচ্ছে আর ওদিকে আমরা কাঁদব যে শত্রুপক্ষ একটু বেশি বড় রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করছে…!! আমরা ছোট বোম মারি আর দেখো ওরা কীরকম বড় বোম ফেলছে! ছোট-বড় সব অস্ত্রই তো যুদ্ধে ব্যবহার হবে!! সত্যি করে ভেবে বল, এটা একটা অভিযোগ হল?’

মীরাবকশের পরিবর্তে এবার চৌধুরী নাত্থু ভাবতে লাগল। কিন্তু একটুক্ষণ পরেই বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কিন্তু ওরা নদী কেন আটকাবে?…আমাদের ক্ষিদে-তেষ্টায় মারার চেষ্টা কেন করবে!?’

মীরাবকশের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে করিম দাদ বলল, ‘চৌধুরী, হিন্দুস্তান যখন তোমার শত্রু জানোই, তখন এসব নালিশ করার কোনো মানে আছে? শত্রু তোমায় ক্ষিদে-তেষ্টায় মারবে না তো কি তোমার বাড়িতে পোলাও-কালিয়া-শরবৎ পাঠাবে? না কি তোমার ঘোরাফেরার জন্য বাগান তৈরি করবে?’

চৌধুরী চমকে গেল। মিনমিন করে বলল, ‘আরে! কী আবোলতাবোল বকছ?’

মীরাবকশও আস্তে করে বলল, ‘সত্যি, এ কী আবোলতাবোল বকছ?’

‘আবোলতাবোল নয় ভাই।’ বোঝানোর ঢঙে করিম দাদ আবার বলল, ‘তুমি একবার ভাব, যুদ্ধে দুই পক্ষই অন্যজনকে হারানোর পুরো চেষ্টা করে! পালোয়ান যখন কোমর বেঁধে আসরে নামে তখন সে সব মারপ্যাঁচই তো লাগায় জেতার জন্য।’

মীরাবকশ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, ‘এটা তো ঠিক!’

‘তাহলে নদীর পানি আটকানোও ঠিক। আমাদের জন্য এটা অত্যাচার, কিন্তু ওদের জন্য ঠিক।’

‘ঠিক!!’…চৌধুরী নাত্থু গর্জে উঠল, ‘যখন তুমি তেষ্টায় কাতরাবে, তোমার বাচ্চার খাওয়ার জন্য একটা দানাও থাকবে না, তখন দেখব এটা ঠিক না ভুল!’

করিম দাদ তার শুকনো ঠোঁটে উত্তর দিল, ‘আমি তখনো এটাই বলব, চৌধুরী! ভুলে যেও না যে ওরাই শুধু তোমার শত্রু নয়, তুমিও ওদের শত্রু!…আমাদের ক্ষমতা থাকলে আমরাও ওদের দানাপানি বন্ধ করে দিতাম।…ওদের ক্ষমতা আছে তাই করছে! আমাদের উচিত এর উপায় ভাবা। খিস্তি দিয়ে সময় নষ্ট করে কী হবে? শত্রু তোমার জন্য দুধের নদী কাটবে না। বরং সে তোমার কুয়োর বিষ মিশিয়ে দেবে। সে তুমি অন্যায়, অত্যাচার, ইয়েজিদগিরি যাই বল না কেন!! লড়াইয়ের এই অস্ত্র তোমার পছন্দ নয়, এ আবার কী বাচ্চাদের মতো দাবি! যুদ্ধ কি নিকাহ যে আগে শর্ত করে নেবে? ‘আমায় ক্ষিদে-তেষ্টায় মারা যাবে না…আমায় অমুক বোরের অমুক রাইফেল দিয়েই শুধু মারতে পারবে’…আসলে তো এটা আবোলতাবোল কথা! ঠান্ডা মাথায় ভাবো!’

চৌধুরী তখন প্রায় রাগে ফেটে পড়ে, ‘বরফ এনে রাখো তুমি নিজের মাথায়!’

‘এটাও আমিই আনব?’ বলে হেসে করিম দাদ চলে গেল।

বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতে তার বখতো দাইয়ের সঙ্গে দেখা হল। করিম দাদকে দেখে বখতো হেসে বলল, ‘মিঞা!! চাঁদের মতো ছেলে হয়েছে! এবার একটা নাম ভাবো!’

‘নাম?’ একমুহূর্ত ভেবে করীম বলে উঠল, ‘ইয়েজিদ!’

বখতো দাই হাঁ হয়ে গেল। তার মুখে আর কথা সরল না।

করিম দাদ স্লোগান দিতে দিতে ঘরে ঢুকল।

তক্তপোষের উপর জেনা শুয়ে। ফ্যাকাশে হলদে মুখ। তার কোলের কাছে গোলগাল পুঁটুলির মতো একটা ছোট্ট শিশু চুকচুক করে আঙুল চুষছে।

করিম দাদ গর্বিত চোখে পুঁটুলিটার দিকে তাকাল। কাছে গিয়ে আলতো করে গাল টিপে বলল, ‘আমার ইয়েজিদ।’

জেনার গলা দিয়ে ক্ষীণ আওয়াজ বেরোল, ‘ইয়েজিদ!!’

করীম দাদ মন দিয়ে তার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ… এর নাম!’

জেনার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছিল না, ‘মিঞা, কী বলছ তুমি? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার? ছেলের নাম ইয়েজিদ রাখবে!!’

করিম দাদ হেসে বলল, ‘তো কী হয়েছে? স্রেফ নামই তো!’

জেনা আরো অবাক হয়ে বলল, ‘কিন্তু কার নাম সেটা তো ভাবো!’

করীম দাদ শান্ত গম্ভীর স্বরে উত্তর দিল, ‘এও যে সেরকম হবে তার কী মানে?…সেই ইয়েজিদ নদীর পানি আটকেছিল আর আমাদের ইয়েজিদ খুলে দেবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *