শাদা বরফ

শাদা বরফ

রাস্তায় এক ফুট বরফ জমে গেছে এতক্ষণে। এই শহরের নাকি একখানা স্পিরিট আছে, সেইটা বরফের নিচে তলিয়ে যায় নাই এখনো। ট্যুরিস্টদের নিয়ে ডাবল-ডেকার বাস চলছে; প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও সিটি স্কয়ারে বডিস্যুট পরে মিকি মাউজরা নাচছে, বডিস্যুটের ভিতরেই হয়তো দুর্যোগের চিন্তায় তাদের প্রত্যেকের কলিজা ছোটো হয়ে এতটুকু হয়ে গেছে, কিন্তু তাতে কী? যতক্ষণ শিফ্‌ট চলবে, ততক্ষণ ওরাও থাকবে। এই যে দোকানপাট বন্ধ হচ্ছে, তাঁবু গুটানো হচ্ছে, শাটার নামানো হচ্ছে, এর মধ্যে একটা দীর্ঘসূত্রিতা আছে, ইতস্তত একটা ভাব, এমনকি প্রকৃতির কাছে হার স্বীকার করার একটা লজ্জাও আছে। হাফসা এইসব টের পায়। হাফসার সকল ইন্দ্রিয় এখন তীক্ষ্ণ। ইন্টারস্টেট-৯৫ বাসের রুটে চেকিং হয় শুনেছে— পারভেজই বলেছিল স্যুটকেস গোছানোর সময়– মূলত ড্রাগের চালান রোধ করতে। লাশের চালান রোধ করতে এরা কী করে? বস্তুত কিছুই করে না, করলে কি আর হাফসা ওর বোনের বাসা থেকে স্যুটকেস টানতে-টানতে আর তারপরে বাসে করে একটানে, নির্বিঘ্নে এই শহরে চলে আসতে পারতো? ফারিয়া অফিস শেষে ওর সাথে দেখা করবে বলেছে নিতান্ত অনিচ্ছায়। এই শহরে হাফসার আর কেউ নাই; বাধ্য হয়ে ফারিয়াকেই বলতে হলো, তার আগে স্যুটকেসটার সদ্‌গতি করতে হবে। তুষারঝড়ের কারণে ব্যাপারটা সহজ কিম্বা কঠিন হবে হয়তো, কে জানে! হাফসার তো লাশ গুম করার পূর্ব-অভিজ্ঞতা নাই।

হাফসা রাস্তার সকলের চোখ এড়িয়ে স্যুটকেসের কাছে নাক নিয়ে আরেকবার গন্ধ শোঁকে। লাশ থেকে এখনো গন্ধ বের হয় নাই। হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রা, মাইনাস দুই কি তিন হবে—এইটাই ভরসা। আকাশ অন্ধকার হয়ে আসছে; দুপুর নাকি সন্ধ্যা, ঠাহর করা যাচ্ছে না। চোখের সামনের দৃশ্য, পরিচিত দিনের আলোতেও যেমন দৃশ্যমান ছিল, তেমন আর নাই। রাস্তা, বিল্ডিং, গাড়ি, ট্রাফিক লাইট, মানুষের অবয়ব — গুঁড়িগুঁড়ি বরফে সবকিছু নিজ-নিজ রেখা হারিয়ে সমান হয়ে যাচ্ছে। কোনো অতিকায় লোকের পায়ের চাপে মটমট করে গাছের চিকন ডালের মতো ভেঙে পড়ছে শহরের দৃশ্য, এর সটান ইমেজ। লোকে আরেকটু দ্রুত গতিতে দোকানপাট বন্ধ করছে, তাঁবু গুটাচ্ছে, শাটার নামাচ্ছে; বাতাস নাকি ঘণ্টায় ষাট মাইল বেগে ছুটছে। মেক্সিকান উপসাগর থেকে এসে তুষারঝড় সমস্ত ইস্ট কোস্টকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। সপ্তাহ দুয়েক আগেও হাফসা জানত না ইস্ট কোস্ট কোন কোন প্রদেশকে বলে। এই দেশে আসার আগে পারভেজই শিখিয়ে-পড়িয়ে এনেছে—আবার বোকার মতো কিছু না বলে বসে হাফসা কলিগদের সামনে, এই ভয়ে।

এমন হবে, হাফসা ভাবে নাই। হাফসার জামাই পারভেজ ছোটোখাটো নিপাট অমায়িক লোক, কিপটা, শুচিবায়ুগ্রস্ত আর স্বার্থপর হলেও হিংস্র নয়। তার আঘাত করার দৌড় মুখের কথা পর্যন্তই। উচ্চতায় হাফসার চেয়ে ইঞ্চিখানেক কম। গায়ে হাত তোলার ক্ষমতা নাই, সে নাকি আবার পুরুষ! বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্টটাইম শিক্ষক। ছিল। এখন আর নাই। পরকালের দিকে ঝুঁকেছিল ইদানিং, তবে তাতে হাফসার কোনো হাত ছিল না। লোকটা এমনই নির্বিষ – পরপুরুষের সাথে হাফসার অতিরিক্ত মাখামাখি দেখে কটু আল্টিমেটামের চেয়ে বেশি কিছু দেয় নাই। একটা বিস্তৃত টাইমলাইন ধরে হাফসার বহিরঙ্গের পরিবর্তনগুলি ঘটতে দেখেছে লোকটা, অন্ধ তো আর ছিল না, তবু তেমন রা কাড়ে নাই। তার অনেক সাধের কনফারেন্সের জন্য আর কোনো বিকল্প ছিল না দেখে হাফসার বোনের বাড়িতে সপ্তাহ দুয়েক থাকবে মর্মে রাজিও হয়েছিল। ক্রিসমাসের আশেপাশের সময়ে হোটেল দুর্মূল্য। যেই বাড়ির ছেলেকে জড়িয়ে এত কেলেঙ্কারি, পয়সা বাঁচানোর জন্য সেই বাড়িতে বউকে নিয়ে উঠতেও তার কোনো আপত্তি ছিল না। এই ছিল হাফসার জামাই। কনফারেন্সের জন্য পারভেজ আর হাফসাকে শেষতক খালি বাড়িতে উঠতে হলো। আসমারা বাড়ি থুয়ে দেশে গেছে। আবরারের মা- হাফসার বুজি আসমা বরাবরই মেজাজি আর বড়ো অগোছালো: তার শেল্ফের তাকে পুরু ধুলা, তার ফ্রিজে বাসি খাবার আর খালি দুধের কার্টন, তার গয়নার বাক্সে পাথর খসে যাওয়া জেওর। হাফসাদের রওনা হওয়ার এক সপ্তাহ আগেও আসমা জানায় নাই যে, ক্রিসমাসের ছুটিতে তারা সপরিবারে দেশের বাড়ি যাবে! অবশ্য সেই উপায়ও ছিল না খুব; আসমার শাশুড়ি মারা গেলেন, আসমার জামাই মনসুর কোন মূল্যহ্রাসের ডীল ধরে কোন চিপা দিয়ে শস্তায় টিকেট পেয়ে গেল, এক যাত্রায় দুই তীর্থ: সপরিবারে বীচ হলিডেও কাটিয়ে আসবে তারা। মা-মরা ছেলে এমন চশমখোর হয়! মনসুর আবার ঢং করে বলেছে সেকেন্ড হানিমুন। হাফসা খুব ভালো করেই জানে, বোনের থেকে ছেলেকে যতদূরে সম্ভব সরিয়ে রাখাই ওর বুজির মতলব। মনসুরের মা মরেছে, মনসুর একা যাক না! পারভেজও মনে-মনে খানিকটা বিরক্ত হয়েছিল; ও হয়তো খুব ভেবে রেখেছিল ওর পেয়ারের ভায়রা ওকে এই শহর, সেই শহর ঘুরিয়ে দেখাবে, এখানে-ওখানে ডে-ট্রিপে নিয়ে যাবে, ভেবেছিল, ভায়রার ঘাড়ে চড়ে খাবে-দাবে-ঘুরবে-ফিরবে। সেইসব কিছুই হলো না; তার বদলে বউয়ের হাতে জান দিলো পারভেজ।

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়। এক মুহূর্তের জন্যও আকাশ নিরবচ্ছিন্ন, খালি চেহারা দেখায় নাই, টিপটিপা বরফ, গুঁড়িগুঁড়ি তারার মতো এখানে-ওখানে বেঘোরে ঝরছে, বাতাস তীব্রতর হচ্ছে—কার যেন গাড়ির ভিতর থেকে বিশ ডলারের নোট উড়ে গেল সিনেমার মতো, কিন্তু সিনেমার মতো আনন্দ নাই কোথাও। আসন্ন ঝড় এই শহরের স্পিরিটের মধ্যেও এতক্ষণে সংক্রমিত হয়েছে। হাফসা পাতালরেল ধরে ফেরি টার্মিনালের কাছের স্টেশনে নামে। রাস্তায় অনেক খানাখন্দ, ভারী স্যুটকেস নিয়ে চলতে কষ্টই হচ্ছে। প্রতিটা পদক্ষেপ যেন একটা-একটা ডালাভরতি অন্ধকার শাট করে খুলে যাচ্ছে, আর তার পরের পা ফেললেই পিছনে বরফ নেমে এসে অনুগত চোরের মতো সেই ডালা বন্ধ করে ঢেকে দিচ্ছে। চারিদিকে সকলের প্রায়-বিপন্ন চেহারা, তাও নিজেরা নিজেরা জেদ করে বিপন্ন না হওয়ার প্রাণপণ কসরত করে যাচ্ছে; গত পঞ্চাশ বছরে এমন তুষারঝড় যে কেউ দেখে নাই, প্রতিবেশী শহরগুলিকে যে উলটে-পালটে তছনছ করে দিয়ে এই ঝড় এইদিকে আসছে, এই সবকিছু তারা প্যাকেট-প্যাকেট তথ্যের মতো মুখেমুখে বিলি করছে, তাই হাফসার বিপন্নতা কেউ বিশেষ খেয়াল করে না। বড়ো শহর এমনই হয়। তাই হাফসা এইখানে এসেছে। এইখানে লোকে অ্যানোনিমিটি পায় আর হাফসা অ্যানোনিমিটি চায়। অত্যন্ত ইন্টিমেট অপরিচয়ের বন্ধনে পড়ে হাফসার নিরাপদ লাগতে থাকে। সন্ধ্যায় ফারিয়ার সাথে সাক্ষাৎ। ফারিয়াও মনে হয় ওর নাগরিক ইগোতে আঘাত লাগার ভয়ে ফোনে জোরে- জোরে “হুঁ-হুঁ, আয় আয়” বলতে-বলতে দেখা করতে রাজি হয়েছে। ফারিয়ার সাথে দেখা করার স্থান-কাল ঠিক করার আগে পারভেজের ফোনটাকে বিসর্জন দিয়েছে হাফসা। ঝড়ের কারণে সাবওয়ের সিস্টেম ক্র্যাশ করেছিল, বিদ্যুৎসংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়েছিল; ওই পাবলিক কেওসের মধ্যে একটা দীর্ঘদিন গোসল না-করা ছেলের ফোন চেয়ে নিয়ে, সেই ফোন থেকে ফারিয়াকে কল করেছে। ব্যস, একটা রাত শুধু। এরপর কে আর জানবে হাফসার কীর্তির কথা?

ফেরি টার্মিনালের কাউন্টার মূলত একটা গুমটিঘর, কয়শ বছর আগের কাঠামো কে জানে? এইখানে কাজ করেন খিটখিটা শাদা-কালো নারীরা। প্রতি চল্লিশ মিনিট অন্তর ফেরি ছাড়ে; কাচের জানালার উপরে শিডিউল টাঙানো—সাথে মুক্তিকুমারীর মূর্তির আইকনিক ছবির পোস্টার, রঙিন ও জ্বলজ্বলা। এইসব সাঁটানো কাগজে খিটখিটা নারীদের মুখ ঢেকে গেছে। শিডিউল বলছে, বিকাল সাড়ে চারটায় ছাড়ে দিনের শেষ ফেরি, সেই ফেরি ধরে আধা ঘণ্টায় আইল্যান্ডে পৌঁছে যাওয়া যাবে; তারপর আইল্যান্ডের তাম্রমূর্তি পরিদর্শন, ঘোরানো সিঁড়ি ধরে মূর্তির মাথা পর্যন্ত আরোহণ, আইল্যান্ডের পার্ক-পরিভ্রমণ, সুভেনিরের দোকানে উইন্ডো-শপিং কিম্বা এমনি শপিং, বগলভরতি করে দাবার ঘুঁটির মতন দেখতে মুক্তিকুমারীর ফিগারিন ইত্যাদি বহন, চাইলে প্যাকেজ হিসেবে গাইডেড ট্যুরও নেওয়া যাবে। নতুবা অডিও ট্যুর। এমনকি হেলিকপ্টার ট্যুরও আছে; ওইসব ট্যুর সেলিব্রেটিরা নেয়। ফেরির ট্যুর রাউন্ড ট্রিপ। হাফসা একটা টিকেট চাইলো। পোস্টারে মুখঢাকা এক খিটখিটা নারী দুঃসংবাদ দিলেন। জানালেন, খারাপ আবহাওয়ার কারণে সাড়ে চারটার ফেরি বাতিল করা হয়েছে। সাড়ে তিনটার ফেরি ধরতে রাজি থাকলে হাফসা যেন দ্রুত ষোলো ডলার বের করে, কারণ অলরেডি তিনটা সতেরো বেজে গেছে। গুমটিঘরে খিটখিটা নারীদের মাথার পিছনে দেয়াল ঘড়ি—স্লো হয়তো; তিনটা বারো দেখাচ্ছে। হাফসা ঢোলা ওভারকোটের পকেট থেকে ওয়ালেট খুঁজে বের করতে চায়, হাতড়াতে হয় তার; ওভারকোটের সাইজ এত বড়ো যে, পকেটের ভিতর ওর হাত ডুবে যায়। বামহাতে স্যুটকেস ধরে রেখেছে, ওজন ক্রমে বাড়ছে স্যুটকেসের, কিম্বা হাফসা কল্পনা করছে তেমন, তাই দেখে খিটখিটা নারী খিটখিটিয়ে উঠলেন। বললেন, এইখানে লকারের ব্যবস্থা নাই। স্যুটকেস নিয়ে ফেরিতে ওঠা যাবে না।

“তাহলে আমি কী করব?”

“কী করবা, আমি কেমনে বলব? গাড়ির মধ্যে রাইখা আসো।”

“গাড়িতে আসি নাই তো। আমি ট্যুরিস্ট।”

“তাইলে হোটেল বা এয়ারবিএনবি যেইখানে উঠছো, সেইখানে রাইখা আসো।”

“হোটেলে উঠি নাই।”

খিটখিটা নারী যেন বিশ্বাস করতে পারেন না, এমন একটা ঘটনা এই মুহূর্তে টিকেট কাউন্টারে ঘটছে। গজগজ করে ‘ফাকিং অ্যাবসার্ড’ বা ‘প্রিপোস্টারাস’—এমন কিছু একটা বলেন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে। হাফসা পরিষ্কার বুঝতে পারে না, এই শব্দ এই শহরের মানুষ কত খারাপ গালি দিতে ব্যবহার করে; অপমানে তার চোখে জল এসে যায়। আশেপাশে নানান দেশের ট্যুরিস্ট; হাফসার পিছেও জনাকতক দাঁড়িয়ে গেছে। খিটখিটা নারী হাফসার পিছনে দাঁড়ানো, স্পষ্টতই-এশিয়ান ছেলেটার দিকে মাথা বেঁকিয়ে তাকান। এর অর্থ হচ্ছে: “লিসেন। এই যে আমার সামনে দাঁড়ায়ে আছে গুড ফর নাথিং হাকুইল্লা মেয়েলোকটা, এই মুহূর্তে আমার কাছে ওর কোনো অস্তিত্ব নাই। নেক্সট কি তুমি? তাইলে সামনে আগাও।” তবু ছেলেটা নিতান্ত ভদ্রগোছের, খিটখিটা নারীর চোখের সম্মতি পেয়েও হাফসার দিকে কিন্তু-কিন্তু করে তাকাচ্ছে। হাফসার চোখে যে জল প্রায় এসে গেছে, তা তার চোখে পড়েছে। হাফসা এক কাপড়ে এসেছে, হোটেলে ওঠে নাই, তাহলে এই বিরাট স্যুটকেসে কী থাকতে পারে—এই রকম সন্দেহ যে যে-কেউ করতে পারে, হাফসার আগে সেইটা মাথায় আসে নাই। এশিয়ান ছেলেটার নীরব প্রশ্রয় পেয়ে হাফসা হঠাৎ টিকেট কাউন্টার থেকে ছিটকে বের হয়ে স্যুটকেসটাকে এক টানে মাটির উপর ফেলে তার উপর প্রায় পা ছড়িয়ে বসে হাউমাউ করে কান্না ধরে। তার কান্না আরও বেগ পেতে থাকে, অর্ধেক নিজের বোকামিতে, অর্ধেক খিটখিটা নারীর ব্যবহারে আর বাকি তো কোনো অর্ধেক থাকে না, তবু বাকি অর্ধেকটা এই কেয়ামতের মতো এগিয়ে আসা তুষারঝড়ে। প্রথমে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, তারপর হিক্কা তুলে, তারপর স্যুটকেসের উপর আধশোয়া হয়ে বামহাতে চোখ চেপে ধরে সিলিং বরাবর মুখ তুলে ভয়ানক কান্না। “কী হইছে? তর কি সোয়ামি মরছে?” “হ। হ।” – হাফসা নিজের মনে নিজের সাথে কথা বলে। এইখানে, হাফসার এই অবস্থায়, হাফসার পাশে পারভেজ নাই। নাই, নাই, সে তো নাই। মৃত জামাইয়ের মৃত্যুশোক হাফসাকে কোনোদিন স্পর্শ করবে না, কারণ সেই জামাইকে হাফসা নিজহাতে মেরেছে। হায়, বৈধব্যের অশ্রু কাকে বলে, কোনোদিন জানবে না সে। এই ভয়ানক শূন্যতা সে মেটাবে কী দিয়ে? এমনকি মুক্তিকুমারীকে কাছ থেকে দেখতে পেলেও সেই শূন্যতা মিটবে না; এতই বড়ো সেই শূন্যতা মৃত্যুশোকের চেয়েও এত বড়ো! মৃত জামাইয়ের লাশবাহী স্যুটকেসটাকে হাফসা তার চার হাত-পা দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চায়, শেইপলেস সামুদ্রিক জন্তুর মতো। কিন্তু মানুষের শরীর ওইভাবে ম্যানুফ্যাকচার্ড নয়, তাই আশেপাশের সব মানুষ হাফসাকে দেখে একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী ইতর প্রাণীকে দেখছে—এমন ভাব করে ঘৃণায় সটকে পড়তে চায়। একটা কমবয়সি যুগল তবু কিন্তু-কিন্তু করে দাঁড়িয়ে পড়ে। এই দুর্যোগের মধ্যেও, এই মূত্রগন্ধময় টিকেট কাউন্টারেও এই শহরের বিখ্যাত স্ট্রিট আর্ট—যার একমাত্র কুশীলব হাফসা, আর একমাত্র প্রপ হাফসার স্যুটকেস চালু আছে, ভাবে তারা। কিন্তু হাফসার একক পারফর্ম্যান্স এত নিটোল জটিল, বাস্তব আর আনথিয়াট্রিকাল যে, তারা নিশ্চিত হতে পারে না এইরকম আর্টের ভোক্তা হওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে পড়া তাদের আর্টিস্টিক চেতনার সাথে যায় কি না। ওদেও ‘বাস্তবানুগ’ পছন্দ; ‘বাস্তব’ নয়। টিকেট লাইনের এশিয়ান ছেলেটা আর হাফসার দিকে ফিরে তাকায় না। ফেরি ছাড়বে এখনই। ওর দয়া-মায়া- করুণার পাত্রখানি এখন এই দুর্যোগের ভিতরে ফিনিশ। আর দয়া-মায়া-করুণা বাদ দিলে থাকে কী? আর্ট? আর্টের সময় কই তার?

বাতাসের দমকে উলটে যেতে থাকা একটা বিশাল ছাতির নিচে দাঁড়িয়ে পুশকার্টে সসেজ বেচছিল এক বান্দা, সম্ভবত পূর্ব-ইউরোপের লোক। সসেজ তোলার চিমটাটা তার কার্টের সাথে ঝুলিয়ে রেখে, সে দুই কদম এগিয়ে আসে। গলা নরম করে বলে, “হ্যালো। আই অ্যাম বরিস। কান্দো কেন, ইয়াং লেডি?” কথা বলতে এসে লোকটা হাফসাকে বিপুল অন্তর্ঘাতের ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচায়। হাফসা চোখ মোছে। উঠে দাঁড়ায়। স্যুটকেসটা যে তার শরীরের অংশ নয়, স্যুটকেসটা যে জড়, স্যুটকেসের ভিতরের মানুষটা যে মৃত, হাফসার সেই চৈতন্য আসে।

“একটা রাতের জন্যই আসছি আমি। ভোরবেলাই চলে যাব। আমি অনেক-অনেক দূর থেকে আসছি। ফেরি আর একটু পরেই ক্লোজ করে দিবে। আমার স্যুটকেসের জন্য আমাকে উঠতে দিতেছে না।”

“কোন দেশ থেকে আসছো? ইন্ডিয়া?”

“বাংলাদেশ।”

“আহা রে, অনেক আশা কইরা আসছিলা?”

“আমার সারা জীবনের স্বপ্ন মুক্তিকুমারীর মুকুটের কাছে দাঁড়ায়া উনার চেহারার পাশে আমার চেহারার সেল্ফি তুলব।” বানিয়ে-বানিয়ে এই কথা বলার সময় আসমা টের পায় মুক্তিকুমারীর সাথে ঘেঁষটে দাঁড়ানোর তার আকুতি পুরা মিথ্যা নয় বা মিথ্যা হিসেবে বলতে-বলতেই, তা একটা সত্যে পরিণত হচ্ছে। নতুন এক বাতাসের ঝাপটায় হাফসার প্রচণ্ড শীত লাগে। বরিস লোকটাও নিজের জ্যাকেট ইধার উধার থেকে টানতে থাকে। তার চুলে বরফ পড়ে আর সে হাত দিয়ে বরফ সরাতে গিয়ে চুল লেপটে ফেলে। পৃথিবীর অন্য কোনো শহর হলে সে হাফসাকে ভাবত পাগল, আত্মপ্রেমী কিম্বা গ্রীডি। এই শহরে এই রকম কেউ ভাবে না।

“তুমি এক কাজ করো। এই যে কাউন্টারের সামনে চত্বর, এইটা ঘুরে গেছে। তুমি পুবদিকে গিয়া দেখবা আনোয়ার নামে আমার এক দোস্ত তার পুশকার্ট নিয়া দাঁড়ায়া আছে। সে-ও বাংলাদেশি। তোমার এই অবস্থায় সে তোমারে নিশ্চয়ই হেল্প করবে। তুমি তার কাছে তোমার স্যুটকেসটা রাইখা দৌড় দিয়া ফেরিতে উঠতে পারো কি না, দেখো। আনোয়ারকে গিয়া বলবা, বরিস পাঠাইছে। ঠিক আছে?”

বরিস লোকটা এত ভালো— শুধু কথা বলতে গেলে একটু থুতু ছেটায় — হাফসার মনে হয়, এই শহরের যেই স্পিরিটের কথা সে শুনে এসেছে, সেই স্পিরিটের স্বাদ সে এইমাত্র পেল। বরিসের দয়ার্দ্র চোখদুইটা দেখে হাফসার মনে আসলো না যে তাকে জিজ্ঞেস করে বরিস নিজেই কেন দয়া করে স্যুটকেসটা রাখে না। বাংলাদেশি আনোয়ারের কাছে হাফসাকে কেন পাঠাচ্ছে সে? কাউন্টারের দেয়ালের ঘড়ির দিকে চোখ যায় হাফসার। মনে-মনে হিসাব করে; স্লো ঘড়ির হিসাবে তার হাতে এখন আর কয় মিনিট আছে। খিটখিটা নারী এই আবহাওয়ায় কখন বাড়ি যাবেন, সেই টেনশনেই মনে হয় আরও দুইজনের সাথে খিটখিট করছেন। বেচারির বাচ্চারা হয়তো বাজে ওয়েদার দেখে তাড়াতাড়ি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছে, মায়ের পথ চেয়ে আছে, বাতাসে হয়তো বেচারির বাড়ির বাগানের ন্যাড়া ফলগাছ ভেঙে পড়েছে, হয়তো বাড়িতে কারেন্টও নাই, কে জানে? বরিস এসে হাফসাকে বাকি দুনিয়ার প্রতি উদার আর রহমদিল করে রেখে গেছে।

গুমটিঘরের পিলারের ফাঁক দিয়ে অসীম জল দেখা যায়। জলের মুখে ফেরি পার্ক করে রাখা, বিশাল লম্বা লাইন দিয়ে ছেলে-বুড়া উঠছে তাতে ধীরে-ধীরে। আসমা স্যুটকেস হাতে হাঁটতে গিয়ে ঠেকে-ঠেকে যায়, তাও পড়ি-মরি করে ছুট লাগায় চত্বরের পুবদিকে; আনোয়ার ভাইকে খুঁজে বের করা জরুরি। একেবারে পারফেক্ট হতো, যদি ফেরিতে স্যুটকেসসহ উঠে যাওয়া যেত আর একফাঁকে যখন কেউ দেখবে না, টুপ করে স্যুটকেসটা ফেলে দেওয়া যেত বরফশীতল নদীর পানিতে। তা যখন হচ্ছে না, মুক্তিকুমারীও দেখা হোক, স্যুটকেসও গছিয়ে দেওয়া হোক আজকের এই মহাদুর্যোগের দিনে। নদীর উপর শীত আরও ভয়ঙ্কর; গ্লাভ্স পরা উচিত ছিল।

*

“তুই আমার জামা পর। আমি সোফায় ঘুমাব। আর তুই আমার বিছানায়, ওকে? হীটার বাড়ায়া দিস রাতে”, ফারিয়া সারা দিন অফিস করে বিধ্বস্ত, তবু অনিচ্ছার মেহমান- নওয়াজির শিক্ষা আছে তার। মাকে দেখেছে মেহমানকে পোষা প্রাণীর সন্তানের মতো দেখভাল করতে।

জানালার বাইরে দুধের মতো শাদা আবহাওয়া। জানালা-দরজা খোলা নিষেধ। ফারিয়ার বাপ-মা বাসায় নাই; দুইদিন হলো ফ্লাইট ধরে ছেলের বাসায় গেছেন। ঝড়ে আটকা পড়েছেন উনারা। বিমানবন্দর নাকি দুই ফুট বরফের নিচে। ফারিয়া ওর ভাইয়ের কালো গাড়ির ছবি দেখায় বরফ এমনভাবে সেঁটে গেছে যে, দেখে মনে হচ্ছে, পৃথিবীর বুকে ল্যান্ড করা কোনো এলিয়েন গাড়ি। গাড়ির বুটে স্টিকার মারা—নো টেইলগেইটিং।

ফারিয়ার কাল সকালে আবার অফিস; রাত জাগার বিলাসিতা নাই, তবু ফারিয়া হাফসার সাথে রাত জাগে। স্কুলজীবনের ভাঙা-ভাঙা স্মৃতি তুলে আনে। হাফসার আম্মার কথা বলতে-বলতে অশ্রুপাত করে। প্রিয়জনের মৃত্যু কেমন করে মানুষকে দুই জাহানের ধারণার কাছাকাছি নিয়ে যায়, সেই বিষয়ে আধখ্যাচড়া, ইল-কনসীড় আইডিয়া শেয়ার করে। হাফসার বোন এখন যেইখানে ট্র্যাভেল করছে, ওইখানে চাইনিজ রকেট পড়বে, তাই নিয়ে দুইজনে যুগ্মভাবে ভয় পায়। এইখানে ঝড় হচ্ছে, কিন্তু এমনভাবে তারা ওইখানের দুর্যোগ নিয়ে কথা বলে, যেন এইখানে কিছুই হচ্ছে না। ওইখানের বিপদের কথা ভেবে জোরে জোরে “ইয়া নফসি, ইয়া নফসি” করে। একটু পরে জানালার বাইরে ঝড় যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন তারা বুঝে যায় যে, রকেট নিয়ে ভয় পাওয়া সুপারফ্লয়াস। তখন দুইজনই চুপ হয়ে যায়।

‘কালকে সক্কাল সক্কাল তোরে ফেরি কাউন্টারে নামায়া দিব। তুই তো ব্যাগ-বুগও কিছু আনস নাই। গোছগাছ করার ঝামেলা নাই। সকালে লাইন দিয়া দ্যাখ, সেকেন্ড টাইম লাকি হস কি না। আজকে রাতে তো আর জানার উপায় নাই, কালকে ফেরি চলবে কি না। ইনশাল্লাহ এনজয় করিস।” ফারিয়াও এই শহরের স্পিরিট ছাড়বে না; আজকে খারাপ দিন তো তাতে কী? কালকে আমরা বলব, “জান হ্যায়, তো জাহান হ্যায়।” কালকে জান থাকবে তো? দুইজনেরই? ফারিয়া নিশ্চিত, থাকবে।

ফারিয়া তো আর জানে না, হাফসার ব্যাগ-বুগ কোথায়, কোন রাস্তার মোড়ে তুষারসমাধিতে শুইয়ে রাখা আছে। পাঁচ নম্বর অ্যাভিনিউতে সেন্ট্রাল পার্কের দক্ষিণ কোণে, যেইখানে শপিং ডিস্ট্রিক্টের একটা পাল্লা শেষ হয়েছে, সেইখানে একটা উঁচু সিলিংয়ের দোকানের গায়ে নীল সমুদ্রের পটে কালো মেয়েদের উন্মুক্ত শরীরের ছবি সাঁটানো—লার্জার দ্যান লাইফ আর ডিপ্রেসিং। ফেরি কাউন্টার থেকে ট্যাক্সি নিয়েছিল হাফসা—বাম্পার টু বাম্পার ট্রাফিক, বরফজমা অযোগ্য রাস্তা, আপৎকালীন উদ্বেগ, তার মাঝে ট্যাক্সির গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় চার কিলোমিটার; এমনই হাস্যকর। পথচারী পারাপারের কয়েক গজ আগে, টারম্যাক ফেলা রাস্তায়, বরফ জমে আইসক্রিমের মতো হয়ে যাওয়া ঝোপের আড়ালে যেই স্পটে স্যুটকেসটা শুইয়েছে সে, সেইখানে নিশ্চয়ই দুই ফুট বরফ জমেছে এতক্ষণে। শহরের যাবতীয় ক্যামেরা, যাবতীয় লেন্স, যাবতীয় চোখ নিশ্চয়ই বরফের কুয়াশায় আজ শাদা ছাড়া আর কিছুই দেখবে না। হোয়াইটআউট-ট্যাক্সি ড্রাইভার একটা নতুন শব্দ শিখিয়েছে হাফসাকে।

ঘুমের জামায় সাবানের গন্ধ। ফারিয়ার রুম একটা অসম্পূর্ণ আর্ট-প্রজেক্ট। তালাকের পরে বাপের ঘরে ফিরে এসেছে তো, এখন এমনই অস্থায়ী নিবাসের রূপ ধরে থাকবে ওর ঘর। তবে তাতে একটা পাখিসব করে রব গোছের সদাপ্রকাশ আর্ট থাকা চাই-ই চাই। শহরের স্পিরিট বলে কথা। মুক্তিকুমারীর দ্বীপ যেই নদীর উপরে, সেই নদীর পানি কি আজ রাতে বরফ হয়ে যাবে? বরফিলা নদীর পানির ঘনত্ব কি কম হয় নাকি বেশি? নিশ্চয়ই কম হয়, তাই তো আইসবার্গের মাথা পানিতে ভাসে। স্যুটকেসটা যদি লাশসহ এখন বরফপানিতে ভাসত, তাহলে তার কত অংশ ডুবত আর কত অংশ ভাসত? কত নিউটন বলপ্রয়োগ করে স্যুটকেসটা ছুঁড়ে মারলে, তা ফেরি থেকে নিরাপদ দূরত্বে ল্যান্ড করতো? পতনশীল বস্তুর সমীকরণ কয়টা ছিল স্কুলের ফিজিক্স বইয়ে? ফারিয়া ঘুমিয়ে গেছে, নইলে জিজ্ঞেস করতো। দেয়ালে একটা চিড়েচ্যাপটা মথ সেঁটে আছে, কেউ কোনোদিন নিশ্চয়ই একটা রোল করা ম্যাগাজিন বাগিয়ে স্যাট করে মেরেছিল ওইটাকে। হাফসা আজ রাতে ঘুমাবে না।

*

বরফের উপর এই রকমভাবে জ্বলতে থাকা সূর্য শুধু সকালেই সম্ভব। ঝড় শেষ; আজ থেকে বরফ কিছু গলবে আর কিছু উঠিয়ে নেবে পৌর কর্পোরেশন। বরফসেঁচার গাড়ি কাজে নেমে গেছে; ফারিয়ার গাড়ির রেডিও বলছে, কয়েকটা স্নো-প্লাউ অকেজো হয়ে গেছে—এত বরফ। ফুটপাথে গৃহস্থগণ কুকুর হাঁটাতে বেরিয়েছেন। বরফ পেয়ে কুকুরগুলির ফুর্তি দেখে কে! রাস্তার মাথার গ্যাস স্টেশনে দাঁড়িয়ে হোমলেস-দেখতে লোকে ডোনাট খাচ্ছে, এরা রাত্রে কোথায় শুয়েছে? ফারিয়া হাফসাকে কিছু যেন বলতে চায়। হাফসার চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে সে চোখ ঘোরায়। হাফসার পায়ে শস্তা ব্যালেরিনা শুজ—সুপারমার্কেট থেকে কিনেছিল। “এই জুতা পরে বরফে হাঁটবি তুই?” বলতে-বলতে গাড়ি ডানে ঘোরালো ফারিয়া; ডানে হরেকরকমবা দোকান। বন্ধুকে দশ ডলার দিয়ে বুট কিনে দেবে নাকি। হাফসা গাড়ির ঘড়ি দেখে।

*

মাথার উপর শাদা ঝড় না থাকলে মুক্তিকুমারী দেখতে মহামুক্তির মতোই। পিতলা ধাতুর উপর পুরু সবুজ প্যাটিনা পড়ে আছে। তিন মিনিটের দর্শন, কুমারীর গা বেয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওঠা, অনন্ত ঠ্যালাঠ্যালি, ঘণ্টাখানেক বরফের বুকে পা রেখে লাইনে দাঁড়ানো আর পা জমে যেতে ধরলে কয়েক সেকেন্ড এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা, দীর্ঘ সময় ধরে সিকিউরিটি চেক, ফেরির বাঁশি, নদীর বাতাসে হুম-হুম করে কাঁপতে থাকা—এই সমস্তই এক ঘণ্টার মধ্যে ফুরিয়ে গেল। টিকেট কাউন্টারের নারী বদলেছে। বরিস আজও বসেছে। হাফসাকে আজ তার পাত্তা দেওয়ার টাইম নাই। সসেজ- হটডগ বেচা হচ্ছে দেদারসে। পুশকার্টের চাকা বরফের উপর কামড়ে বসেছে। খুবই স্পিরিটেড কামড়। হাফসা গতকালকের হিসাব চুকাতে উদ্গ্রীব। বরিসের সাথে নয়, আনোয়ারের সাথে। টিকেট কাউন্টারের সামনের চত্বরের লাল টালির কাঠামো গতকালও দেখা যাচ্ছিল, আজ বরফ সবকিছু সমান করে দিয়েছে। পুবদিকে ঘুরে গেল হাফসা, ক্লিশে ও নাটকীয়ভাবে বলল, “লুক হুজ হিয়ার!” আনোয়ার দাঁড়িয়ে- দাঁড়িয়ে হালাল চিকেনের উপরে ঢালার সস খুঁটছে। হাফসাকে না-চেনার ভাব করল লোকটা। অথচ গতকালই মায়ের নামে কিরা কেটে বলেছিল, “বিশ্বাস করেন, আপা। ইমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার করবে, আমি এখনই গাড়ি গুটায়া বাসায় যাব। আপনি ফেরি কইরা ফিরতে-ফিরতে আমারে তো আর পাবেন না। এমনকি আপা… আমি কালকেও বসব না। কালকে যদি বসতাম, আমার বইন আপনে, আপনার স্যুটকেসটা এক রাত রাখতে কি আর পারতাম না? মা-কসম আপা, আমার দ্বারা সম্ভব হবে না।” হাফসা তখনও কেঁদেছে—অভিনয়ের কান্না নয়, ভয়ের কান্না, মাদার নেচারের ডাইনি হয়ে মার-মার করে উঠে আসার ভয়, লাশ নিয়ে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়, দুনিয়াকে পায়ের তলে পিষ্ট করে রাখে একটা শহর, সেই শহরের প্রলয়ংকরী স্পিরিটের পেটে যাওয়ার ভয়। হৃদয়ভঙ্গেরও কান্না — ভারী স্যুটকেস নিয়ে এতদূর এসে মুক্তিকুমারীকে এক নজর না দেখে ফেরার বেদনা, সিনেমার পর্দায় হাজার-হাজারবার বোমারু বিমান, এলিয়েনের আক্রমণ ইত্যাদির ফলে মুক্তিকুমারীকে ধ্বংস হয়ে যেতে দেখার পর আজকে তার কাছে এসে ‘লাব্বায়েক’ বলামাত্রই সত্যি-সত্যি কেয়ামতের শিঙ্গায় ফুঁক পড়ার বেদনা। এইসব কিছুই বুঝল না আনোয়ার; প্রতিদিন যেই লোক লেটুসশাক দিয়ে হালাল মুরগি ঢেকে পুশকার্ট ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, প্রতিদিন যেই লোক সফরবাজ মানুষের উৎসব-উল্লাস-উত্তেজনা দেখে, প্রতিদিন যেই লোক জন্মদিনের শিশু, মাটিতে হাঁটু-মুড়ে বসা প্রেমিক, বাগদত্তা মেয়েলোক আর শ্যুটিংয়ের পার্টি দেখে—দেখে তারা আসছে, যাচ্ছে, থামছে, ভেঙে পড়ছে; তার এইসব বোঝার কথা নয়। তার যে বোঝার কথা নয়, তা থিওরেটিকালি বুঝতে পারে বটে হাফসা। হাফসা বোঝে না শুধু এই বিষয়টা—আনোয়ার যদি বুঝতও, অচেনা-অজানা এক ট্যুরিস্টের ব্যাগ সে কেন নেবে? সত্যি-সত্যি আনোয়ার যদি কাল ব্যাগ নিত আর যদি আজ বোকার মতো ব্যাগ ফেরত নিয়ে এসে হাফসাকে না পেত, ব্যাগ কি সে খুলত না? তখন? তখন কী হতো? এইসব চিন্তা হাফসার মাথায় কাজ করে না।

আনোয়ার ধরা পড়ে যাওয়ার ফলে মুখ বানায়। অবন্ধুসুলভ চেহারা করে জিজ্ঞেস করে, “ইয়েস? হাউ মে আই হেল্প ইউ?”

তাই শুনে হাফসার মেজাজ চড়ে যায়। বাংলায় বলে, “আপনি না মায়ের কিরা কাটলেন? বললেন যে, আজকে বসবেন না? এইসব বইলা গতকালকে আমার ব্যাগ নিলেন না? তো এখন এইখানে কী করেন?”

আনোয়ারের মুখে আর আগল থাকল না। “হারামজাদি, মাগি, গেলি এইখান থেইকা!” বলে গালাগাল করে ওঠে। হাফসা হতভম্ব হয়ে যায়। গতকাল ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে এই লোক “বোন-বোন” করছিল আর আজকে রোদ উঠতেই তার এই মূর্তি! কয়েক সেকেন্ড লাগে হাফসার মুখে বোল ফুটতে।

“শুয়োরের বাচ্চা, তুই আমারে গালাগালি দেস? চ্যাং কাইটা একদম… একদম তোর ওই বরিসের দোকানের হটডগ বানায়া, তারপর দেখবি বনরুটির মধ্যে ভইরা খাইতে দিমু। নিজের চ্যাং টেস্ট করবি”, হাফসার মুখ দিয়ে এইসব অকথ্য শব্দ নির্বিকারে বেরিয়ে আসে। কেটে, ভরে, খুঁড়ে, কবর দিয়ে, ছুরি দিয়ে কেটে, গার্বেজ ব্যাগে ভরে, শাবল না পেয়ে, না খুঁড়ে, কবর না দিয়ে, বেডকভার দিয়ে রক্ত মুছে, ওয়াশিং মেশিনে ধুয়ে, হাত-পা বেঁকিয়ে ঠেসে ভরে, ব্যাগের ভিতর ভরে, ভরে, কেটে, ভরে, ঘামতে ঘামতে চেইন টেনে, ভরে, কবর দিয়ে, কেটে, টেনে-হিঁচড়ে—এই শব্দগুলিও বনবন করে মাছির মতো ওর চারিদিকে ঘুরতে থাকে; শুধু মুখে আসে না। আনোয়ার আবার চেষ্টা করে গালি দিয়ে উঠতে। হাফসা আরও জোরে হেঁকে গালি দেয়। আনোয়ার এমনটা আশা করে নাই দেখে মাথা নিচু করে ফেলে। হাফসা বাতাসের উলটাদিকে হাঁটা দেয়; গালির রেশ তখনও উলবুগ-উলবুগ করে চুইয়ে পড়ছে মুখ থেকে। গালি দিতে-দিতে চলে যাওয়ার, বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ার, বাস ধরে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ার অপশন তার আছে। এই আনোয়ারের তা নাই। তাকে পুশকার্ট ধরে এইখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

*

আসমার বুড়ি প্রতিবেশী প্রতিদিন বারান্দায় বসে থাকে, চেয়ারটা জায়গা থেকে নড়ে না। সেই একই চেয়ারে স্থির বসে থেকে সে বুড়া-মানুষদের মতো লাগাতার অর্থহীন আওয়াজ করতে থাকে। যেন বুড়া হলে শরীরের ভিতরে কোনো একটা নতুন জায়গা গজায়, যেটার অস্তিত্ব আরও বুড়া হওয়ার আগে টের পাওয়া যায় না, সেখানে থাম্বেলিনা-রকমের একটা ছোটো পরি থাকে যে কি না টরে-টক্কা কোড দিয়ে কথা বলে যায় আর বুড়া মানুষেরা তার উত্তর দিতে থাকে। উঁ-উঁ-হুঁ করে।

মহিলা ডে-ওয়ান থেকেই হাফসাকে দেখে মনে করে আসমা।

ডে-ওয়ানে সাবার্বে বরফ পড়েছিল। বুড়ি বসেছিল চেয়ারে—দুই হাঁটুর মাঝখানে মরিচাধরা গাঁইতি চেপে ধরা, যেন একটু পরেই বরফছাওয়া বাগানে টমেটোর চারা বুনতে নামতে হবে তার, বলে, “তুমি তাইলে সারেন্ডার করলা আফটার অল? তোমার ছেলে তাইলে তোমারে বুরকা পরায়াই ছাড়ল! যাক। মন ছোটো কইরো না। হ্যাপিনেস পাইতে হইলে সারেন্ডার করতে হয়; আমিও বহুত করছি।” শুনে হাফসা থমকে যায়। মুখ খোলে, কিন্তু জবাব দেয় না; তরবারি গিলে ফেলা বাজিকরের মতন বুড়ির কথাগুলি হাসতে-হাসতে গিলে ফেলে। তো এই হলো ব্যাপার? বুজির ছেলে বুজিকেও পথে ভিড়ানোর চেষ্টা করেছে এবং বলা বাহুল্য, বিফল হয়েছে! সেইসব ঘরের কথা বুজি আবার এই অনাত্মীয় বুড়ি বেটিকে গিয়ে-গিয়ে বলেছেও! থমকে গেলেও হাফসা অবাক হয় না। এইসবই আসমা আর মনসুরের ভালো মাইগ্র্যান্ট হওয়ার উপরি চেষ্টা। নিজেদের হিপোক্রিসি, নিজেদের ডিজোন্যান্স কর্তৃপক্ষের কাছে ফাঁস করে দেওয়ার মাধ্যমে এরা কর্তার বিশ্বাসভাজন হতে চায়।

এরপর যতবারই দেখা হয়, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই কথা বুড়ির। বুড়ি এমনকি মনেও রাখতে পারে না, কোন কথা সে অলরেডি বলে ফেলেছে আর কোন কথা সে এখনো কাউকে বলে নাই, শুধু কল্পনায় কিম্বা মনে-মনে বলেছে। একই দিনে গুড মর্নিংই বলে বুড়ি পাঁচবার। মৃত স্বামীর নাম বলে, পোস্টম্যান উলির কথা বলে। “শোনো, আসমা, আমার কত-কত সিক্রেট, তুমি তো কিছু জানো না”, হাফসার হাসি পায়। আর কী এই “আসমা, আসমা, আসমা” ডাক? আসমা কি বুড়িকে আদৌ জানিয়ে গেছে যে, কয়েক সপ্তাহের জন্য তারা দেশে যাবে আর বাড়িতে তার সহোদরাকে রেখে যাবে? জানিয়েছে নিয্যশ, এমনকি হাফসার জন্য রেফ্রিজারেটরের গায়ে নোটও রেখে গেছে, “কোনো হেল্প লাগলে ডেব্রাকে জানাইস। বুড়ি খুবই আলাভোলা ভালোমানুষ।” কচু ভালোমানুষ। হাফসাকে ভেবে বেড়াচ্ছে আসমা। হাফসার শরীর রাগে রি-রি করে; কোনদিক দিয়ে সে দেখতে আসমার মতো? ছো! ডাকের সুন্দরী ছিল সে। তবে সেইটাও বিষয় না পারভেজ যেমন বলেছিল, “এ কেমন কথা যে, শুধু খয়েরি রং দেখলেই ভেবে নিতে হবে, আসমা = হাফসা?” তবু কেন যেন হাফসা আর বুড়ির ভুল ভাঙায় না। লম্বা সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বুড়ির বাড়ির বেড়ার সাথে হেলান দিয়ে শীতে কাঁপতে-কাঁপতে অসুস্থ আনন্দে আসমার চরিত্রে অভিনয় করে যায়। ‘ম্যান- সুর’-এর নামে সত্য-মিথ্যা লাগানি ভাঙানি করতে থাকে বুড়ির কাছে। ছেলের নামে বুরাঈ করে, ছেলে গেছে-গেছে-গেছে ফ্যানাটিক হয়ে। বোনের নামে, অর্থাৎ নিজের নামেই কুৎসা গায়। বলে ছোটো বয়সে মামার উপর ক্রাশ ছিল তার, অর্থাৎ আসমার। এদিকে বোন হাফসার তা সইবে কেন? ডেইলি গামছা দিয়ে মেইক-বিলীভ লম্বা চুল বানিয়ে মামা আসবে বলে বারান্দায় বসে থাকত। তখনও কত ছোটো হাফসা, অথচ মামার মনোযোগ পাওয়ার জন্য নাক-কান-ফোঁড়ানোর বায়না করে বসল। আর সে কী কান্নাকাটি তার! সুন্দরী বলে দেমাগও কত্ত! আসমা চরিত্রটি হাফসাকে কুত্তি বলে ডাকে ইংলিশে। বুড়ির কপালের ভাঁজগুলি ভুরুর সাথে সমান্তরাল হয়ে ওঠে-নামে। চারিদিকে অকথ্য-অপার-শীতল বরফ, তার মাঝে দাঁড়িয়ে আসমার প্রিয়জনদের প্রতি বুড়ির হৃদয় শীতল হতে থাকে। সাবার্বের বরফ এই রকম। হাফসা শহরে এমন দেখে নাই।

*

“আমার বাবা বিয়ারের বটলিং ফ্যাক্টরিতে কাজ করতো। হাড়হারামজাদা ছিল, বুঝলা আসমা?”

হাফসা বলে,

“তাই?”

“হুঁ। আমার মাকে সে সন্দেহ করতো। আমাদেরকে বাড়ির ভিতরে রাইখা, বাইরে থেকা তালা দিয়া কাজে যাইত ডেইলি। অথচ নিজে টাউনে গিয়ে মেয়ে লাগাইত হরদম। একবার হইল কী—হাই তুলতে গিয়া মায়ের চোয়াল লক হয়া গেল। দরজাও তো লক। আমরা দুই ভাই-বোন কানতেছি আর কানতেছি। ভাই গিয়া মায়ের গালে সপাটে এক থাপ্পড় দিলো কানতে কানতে। আমার বয়স বারো হওয়ার আগেই বাপ নিরুদ্দেশ হইল, জীবনে আমাদের খোঁজ নেয় নাই। নতুন সংসার বসাইছে ইত্যাদি খবর পরে পাইছি। আমার নাকি একটা হাফ-সিস্টার আছে। যেই ট্রমা দিছে আমারে দ্যাট সান অভ আ গান…”

“হরিবল! বেটালোক… বুঝলা ডেব্রা?” এই গল্প আরও বারতিনেক শুনেছে হাফসা। হাফসারও বুড়িকে ওর মায়ের গল্প বলতে ইচ্ছা করে। আম্মা একবারই এসেছিল এই দেশে—বুজিরা নতুন বাড়ি কেনার আগে। মেয়ের জন্য শুঁটকি, কচুর ছড়া, কাঁঠালের বিচি ইত্যাদি বয়ে নিয়ে যেতে দেবে না—দেখে এয়ারপোর্টের স্টাফের সাথে ঝগড়া করেছিল আম্মা। মাতৃভান্ডারের ভাঁড় বেয়ে ঘন রস পড়ে কাউন্টারের উপরের ল্যামিনেশন করা পাতটা চিটচিটে করে দিয়েছিল নাকি। সেই আম্মা মরলো হাফসার হাতে মাথা রেখে। কোথায় ছিল বুজি? নতুন বাড়ির জন্য পর্দা অর্ডার দিচ্ছিল।

বুড়ির ঘরে টিভি চলছে; একটা সিরিজ দেখাচ্ছে, যেইখানে একটা দ্বীপে একটা মা আর একটা মেয়েকে বন্দি করা হয়েছে। সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং—মা মেয়েকে আগে খায়, নাকি মেয়ে মাকে আগে খায়, তাই নিয়ে বাজি ধরাধরি চলছে। বুড়ির এইসব অনুষ্ঠান ভালো লাগে। হাফসা আজকে বুড়ির বাসায় খাবে। মুরগি রেঁধেছে নাকি বুড়ি—আটবার বলেছে হালাল, সাথে আলু-গাজর-বরবটির সিদ্ধ। সোফায়, কুশনে, টেবিলক্লথে বুড়া মানুষের বর্ণ-গন্ধ। বাইরে মৃদু বাতাসের শব্দ; কে বলবে, দুইদিন আগেও স্মরণকালের সর্ববৃহৎ ঝড় এই পাড়ার উপর দিয়ে বয়ে গেছে! এখন চিরপরিচিত বরফে মোড়ানো শাদা গ্রহ পৃথিবী। কোথায় যেন কোন ছোটো পাখি মা প্রতিবেশী কাক-শকুনকে ধমকাচ্ছে—”কী ও?”

বুড়ি বলে, “আরে, ও কিছু না। কোনো লোক টানা হাঁচি হাঁচতেছে। দুই বাড়ি পরে থাকে যে, অ্যান্ড্রু, মনে হয় ও-ই। ওর বউ একটা ভুটকি।” অ্যান্ড্রুর কথাও আগে শুনেছে হাফসা।

বাসে করে ফিরতে-ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেছিল হাফসার; বুজির বাড়ির পর্দা সরিয়েছে টেনে-টেনে, অকুস্থলে দাঁড়িয়ে বড়ো করে শ্বাস নিয়েছে। মেঝের উপর বুকে হেঁটেছে প্রায়। ওয়াশিং মেশিনের গুহা থেকে মরা গোখরো সাপের মতো বেডকভার টেনে-টেনে বের করেছে। উলটে-পালটে চেক করেছে, রক্তের দাগ রয়ে গেছে কি না। নিজেকে খুঁটিয়ে দেখেছে বাথরুমে। ধীরগতিতে নিশ্চিত হয়েছে যে, এই যাত্রা সে অক্ষতই আছে।

বুড়ি ডিনার সার্ভ করার সময় ইতস্তত ভাব করে। খাবার টেবিলের উপর রাজ্যের হাউজকীপিং ম্যাগাজিন, উলের গোলা আর বিভিন্ন নম্বরের কাঁটা ডাঁই করে রাখা, তার মাঝে বোতলে শস্তা ওয়াইন, পুরানো হয়ে ভিনেগার হয়ে গেছে নির্ঘাত। বুড়ি বলে, “নো আসমা, ইউ আর রং। আমার কোনো ড্রিংকিং প্রবলেম নাই। তোমাদের ড্রিংক করা মানা, তাই এক চুমুক গিললেই তোমরা হাঁ-হাঁ কইরা উঠো।”

চেয়ারে বসে খেতে-খেতে বুড়ি আবার বুড়া মানুষের মতো উঁ-উঁ-হুঁ করে ওঠে। এক গাজর সে চৌদ্দ টুকরা করে। তারপর খানিক ভেবে আবার বলে, “আচ্ছা, আসমা, তুমি না বলছিলা তোমার ওই বিচ ছোটো বোনটা আসবে? কবে আসবে?”

হাফসা কাঁটা হয়ে যায়। তারপর বলে, “এখনো কনফার্ম করে নাই।”

“তোমার জামাই যে অফিসের কনফারেন্সে গেল, এইটা একদিক দিয়া ভালোই হইছে। আমরা গার্ল-টক করতে পারতেছি। আমি আসলেই জানি না—বুঝলা, আসমা, কোনটা বেশি খারাপ? একটা অবিশ্বাসী জামাই নাকি একটা ফ্যানাটিক পোলা নাকি একটা বিচ ছোটো বোন? তোমার কী মনে হয়, কও তো?”

হাফসা কিছু বলে না। হাসির মতো একটা কিছু দেওয়ার চেষ্টা করে।

“অথচ তুমি—আসমা এত্ত উঈক। এত্ত উঈক ক্যান তুমি? ম্যান-সুরকে তুমি ছাড়বা না এতকিছুর পরও। ক্যান আসমা? আমারে দেখো। আমার বয়স জানো? একা থাকি আমি। একা। সিঙ্গল। অ্যালোন, নট লোনলি,” হাউজকীপিং ম্যাগাজিন থেকে শিখেছে এইসব বুড়ি।

হাফসা বলে, “তুমি তো অনেক স্ট্রং, ডেব্রা। আমি তোমার মতো হইতে চাই।”

“আমার মতো হওয়া এত সোজা না গো, মেয়ে। তুমি আমারে খালি বলো, তোমার নাকি সিরিয়াল কিলারের ভয়। জামাই না থাকলে সিরিয়াল কিলার নাকি আইসা তোমারে মাইরা ফালাবে। কে দেখাইছে তোমারে এই ডর? তুমি কি লিটল গার্ল নাকি?”

হাফসার এমন হাসি পায় যে, মুখ থেকে চিবানো গাজরের মণ্ড প্রায় ছিটকে পড়ে। বুজির নাকি ভয় সিরিয়াল কিলারের? নিজে সারা দিন আত্মহত্যার ভয় দেখিয়ে বেড়ায়, জীবনের কোনো চিপায় কোথাও উনিশ-বিশ হলে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ওডি করে, ছেলেকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে, অথচ নেহায়েত সিরিয়াল কিলারের ডরেই নাকি মনসুরের সাথে ঘর করছে বুজি?

“বললাম তো, আমি সাহসী হইতেই চাই।”

“হুঁ। ভালো। গুড গার্ল তো তুমি।”

খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকলে বুড়ি একটু জিরায়। সোফার উপর বসে-বসে ঝিমাতে থাকে, গাল ঝুলে বুড়ির মুখটা বিকৃত দেখায়; হাফসার তাই দেখে বড়ো মায়া লাগে। বুড়ি চ্যানেল বদলে দিয়েছে। সাউন্ড অভ মিউজিক চলছে এইবার। এইসব এখনো কেউ দেখে! প্রাচীনার বাড়িতে হাফসার জেও কেমন শিথিল হয়ে আসে। বিজ্ঞাপনবিরতি চলে, তার মাঝে শহরের খবরও। এখনো ফুটকে ফুট বরফ সমস্ত ইস্ট কোস্ট জুড়ে—পথের ধারে, বাস-স্টপে, পার্কিং লটে। বরফের রং এখন আর নিদাগ শাদা নাই, ইগলের ডানার মতো ধূসর-কালচে ছোপ আর ডোরা বেরিয়ে আসছে। বরফের উপর মানুষের হাঁটা দেখে হাফসা অবাক হয়ে যায়, যেন এই ঘটনা নতুন, যেন সে নিজে বারো ঘণ্টা আগেও বরফের উপর কাগজের মতো পাতলা সুকতলার জুতা পরে হেঁটে দেখে নাই। কেউ হাফসাকে একটাবার বলেও তো দেয় নাই, এই বরফ হাঁটার উপযোগী কি না, নাকি শুধু ডুবে যাওয়া, তলিয়ে যাওয়ার জিনিস এইটা। অথচ লাইফ অর ডেথ তথ্য ছিল সেইটা, জীবন-মৃত্যুর মতো বড়ো ব্যাপার। পারভেজ তাকে বেহুদা ইস্ট কোস্ট-ওয়েস্ট কোস্ট শিখিয়েছে; এদের সিনেমা, এদের সংগীত শুনিয়েছে; এদের দস্তুর, এদের আদব-লেহাজের সাথে পরিচয় করিয়েছে; বউকে নিয়ে এদের পাশে কাঁটা হয়ে থেকেছে, পাছে হাফসা কোনো ভুল করে বসে। কোথায় সেই পারভেজ আজ? মুরোদ থাকলে বরফের উপর হাঁটত। ডুবেই তো গেল।

“এস্কিমোদের ভাষায়—বুঝলা, আসমা, বরফ বুঝানোর জন্য পঞ্চাশটা শব্দ আছে। আর আমাদের আছে মোটে একটা।”

“আইস আছে। স্লো আছে। ফ্রস্ট আছে। আরও অনেক আছে নিশ্চয়ই”, হাফসা বুড়িকে ছোটো মানুষ জ্ঞান করে সান্ত্বনা দেয়।

“আইস ইজ নট স্নো। ইউ আর ফানি।” বুড়িও টিনেজারদের মতো কথা শোনায়।

হাফসা লজ্জা পায়। ঠিকই তো। ঝড় আর বৃষ্টি কি এক?

“আমার বাপ। হারামি লোকটা জীবনে আমাদের কোত্থাও বেড়াইতে নিয়া যায় নাই। আমার এক ক্লাসমেট ছিল, হেনরি নামে। ও আমারে একটু পছন্দই করতো। ওরে আমার মাঝে-মাঝে থাপড়াইতে মন চাইত, বিশেষ করে যখন বলত, তার বাপ তারে কই-কই নিয়া গেছে হলিডে করতে। একবার নাকি সেইলিং করতেও নিয়া গেছিল শীতের সমুদ্রে। উত্তর অ্যাটলান্টিক। কী তার বিবরণ! রাতে খাওয়ার জন্য বীফ প্যাটি আর পাই নিয়া গেছিল; শীতে নাকি পাইয়ের মাঝখানটা পুরা ফ্রোজেন হইয়া থাকত। লাকি বাস্টার্ড। সে নিশ্চয়ই বরফের অন্যান্য নামও জানত। আমারে বলে নাই। সিক্রেট রাখছে। নাকি মনে হয় তোমার?”

বুড়ি আবার তার এক-একখানা রসোত্তীর্ণ পুরানো গল্প রিপীট করার রুটিনে ফিরে গেছে।

“হুঁ। আলবত। সিক্রেট রাখছে।”

“ম্যান-সুরকে তোমার ছাইড়া দেওয়া উচিত। লুক অ্যাট ইউ, স্বাস্থ্য কত্ত ভালো ছিল তোমার দুই সপ্তাহ আগেও। আর এখন? কেমন হাড়জিরজিরা হইছো। বুরকা পরতেছ আজকাল। ওয়েল, আই হোপ ইটস জাস্ট আ ফেইজ, ইয়াং লেডি …

হাফসা রগড় করতেই বলে, “ইউ আর রাইট, ডেব্রা। আমি তো আসলে আসমা। নট এনিবডি এলস। আই শুড নট ফরগেট দ্যাট।”

বুড়ি থতমত খেয়ে যায়। গভীর দৃষ্টিতে হাফসার দিকে তাকায়। “আমি কিন্তু সিরিয়াস, আসমা! কেমন লস্ট দেখতে লাগে তোমারে। যানি আজকেই কেউ আইসা থপ কইরা তোমারে এইখানে এই পাড়ায় রাইখা গেল। যানি তোমার কোনো আইডিয়াই নাই এরপরের ধাপে তোমার কী করণীয়। তুমি কি ভুইলা গেছ, তুমি কে? গেট আ গ্রিপ! তুমি আসমা। লীভ হিম। প্লিজ। হি ইজ নট গুড ফর ইউ।”

হাফসা একনজরে বুড়ির অন্তরের ভিতরটা দেখতে পায়—হাফসার ভগ্নী যেন বুড়ি, সবর্ণ, কিন্ড্রেড স্পিরিট। সাহস পেয়ে বলে, “ইয়েস, ইয়েস। আমি ওরে ছাইড়া দিব।”

রাত হয়। “চলো, তোমারে বাড়ি পর্যন্ত আগায়া দিয়া আসি।”

“না, না। কেন? আমি নিজেই…”

বুড়ি তবু হাফসার মানা শোনে না। দরজা লক করে পকেটে চাবি ভরে হাঁটা ধরে। হাফসাও তার পাশে-পাশে চলে।

“শীত পড়তেছে আবার, দেখো। এই রকম বরফের রাতে আমি তারে ফ্রন্টইয়ার্ডে গোর দিছিলাম। নাকি ব্যাকইয়ার্ডে?”

“কারে?” বরফের উপর দুই নারীর শরীরের ছায়া, একজোড়া পোষা জন্তুর মতো একে অন্যের পাশে নড়েচড়ে। হাফসার পায়ে ফারিয়ার কিনে দেওয়া বুট – বামপায়েরটা, একটু ঢিলা হয়, তাই ওর হাঁটা ঢিমা আর অকওয়ার্ড।

“নোবডি।”

“ব্রো। হু ওয়জ ইট?”

“কী ফানি, দেখো। হোয়াট ওয়জ ইট—বলতেছ না তুমি, আসমা। যেন তুমি ধইরাই নিছ, আমি কোনো মানুষ মারছি আর তারে লুকায়া বরফের তলে কবর দিছি,” ডেব্রা এমন করে হাসে, বুড়িদের এমন হাসি এমনিতেই অপ্রকৃতিস্থ লোকের হাসির মতো হয়; পাশের বাড়ির বারান্দার বাতি একবার জ্বলে ওঠে। দুই সেকেন্ড পরে আবার নিভে যায়।

“একটা পেঁচা—বুঝলা, আসমা, ব্লিজার্ডের মধ্যে, শীতের মধ্যে একটা পেঁচা বইসা ছিল আমার বাথরুমের শাওয়ারহেডের ডান্ডির উপ্রে। ছোটো কাজ করতে বসছিলাম, উপ্রের দিকে তাকায়া ভয়ে আমার কলিজা শুকায়া গেল। পেঁচাটা আমার দিকে তাকায়াছিল। অবিকল বুড়া মানুষের মতো চেহারা। চোখ দুইটায় উইসডম আর বাঁচার আকুতি আর জান্তব একটা কিছু একত্রে মিশাছিল। দরকার পড়লে, সে আমারেও ঠোকরাবে—এমন একটা মোশন ছিল পেঁচাটার মধ্যে। তো আমি করলাম কী… আচ্ছা, তোমার বেডটাইম পার হয়ে যাইতেছে না তো?”

“না, না, বলো, তুমি তারপরে কী করলা!”

“আমি গিয়ে ব্যাকইয়ার্ড থেকা লম্বা ডাঁটির ঝাড়ু নিয়া আসলাম। বাইড়াইয়া ওরে…”

হাফসার হাত মুঠি হয়।

“ডানায় ব্যথা পাইছিল, কিন্তু ঘুলঘুলি দিয়া উইড়া গেল কোনোমতে। পরদিন সকালে দেখি, এই যে, এই আপেল গাছটার তলে মইরা আছে। আই ফ্ৰোজ হিম টু ডেথ। বুঝলা? তারপরে বরফ খুঁইড়া, শাবল-টাবল আইনা দাফন করলাম আর কী।”

বুড়ি এই গল্প আজকেই প্রথম বলল। “সো, এইটাই তোমার সেই মহান সিক্রেট?”

“ভয় পাইছো, আসমা? তুমি তো আবার চিকেন-হার্টেড। সিরিয়াল কিলার নাকি আসবে তোমারে মারতে…” বুড়ি হা-হা করে হাসতে থাকে।

হাফসা হাসি ম্যানেজ করে। তারপর বলে, “বাসায় আসো। কফি খাওয়াই। ডিক্যাফ।”

বুড়ি এই টপিক ছাড়বে না সহজে। বলে, “তুমি সিরিয়াল কিলার ডরাও দেইখা তোমার জামাইরে ডিভোর্স দাও না। আর আমার বাপ, আমার সেই হারামজাদা বাপ— সিফিলিসও হইছিল, ইস—তার সেকেন্ড বউরে ডিভোর্স দিবে না বইলা তার সেকেন্ড বউ করল কী… জানে মাইরা ফেলল তারে। আয়রনি, বুঝলা? শিখো, আসমা, এদের থেকা শিখো কিছু … “

বুড়ি খোলাসা করে না, করবে কোনো একদিন, পঞ্চাশতম বারের মতো এই গল্প যেইদিন বলবে, সেইদিন–বুড়ির নতুন মা ধরা পড়েছিল কি না। বুড়ির সহজ হাসিতে বোঝা যায়- নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই ধরা পড়েছিল মহিলা। হয়তো সেই বেটি বাঘ কি সিংহ কি বুনো শুকর—খুন করেও অনায়াসে ঘুরে বেড়াতে পারতো। খুন করেও সীমান্ত পাড়ি দিতে পারতো। কেউ তাকে থামাত না। খুন করেও ভোল পালটে হাতে মশাল, বুকে বিধির বিধান নিয়ে মুক্তিকুমারীর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো তুষারঝড়ের ভিতরে।

বুড়ি হাফসাকে আন্তরিকভাবে জড়িয়ে ধরল, শুভরাত্রি বলল টাইট করে ধরে আর পোষা কুকুরের মতো ওর মাথার পিছে হাত রেখে সামনের ঘোমটার প্রান্ত সরিয়ে চুলের গন্ধ নিল। ওই গন্ধ নেওয়ার মধ্যে সিনিস্টার কিছু ছিল না— খুবই আদরের, বড়ো স্নেহময় একটা ব্যাপার ছিল ওইটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *