চশমে ক্বাতিল

চশমে ক্বাতিল

শামীম হারামজাদার শার্টটা বুকখোলা; চোখ দুইটা নিরেট। তাতে দশ মিনিট আগেও কোনোরকম অনুশোচনা ছিল না। গ্রিনরোডে ওর খালার বাসা থেকে প্রায় ঘাড় ধরে ওকে গাড়িতে উঠিয়েছি। ওর দুঃসাহস কী! সিঁড়িঘর থেকে শাদা লুঙ্গিতে পেঁচিয়ে কী যেন একটা নিয়ে এসে বলে, গাড়ির ডিকিতে তোল! কী ওইটা? করাত। অ্যাঁ? করাত। করাত চিনস না? কাঁঠালবাগান হইয়া যাইতে হইব একটু; এইটা ফিরত দিতে হইব। না, ওইসব হবে না। শহরের এই অবস্থায়… আরে, তোল, তোল। কিছু হইব না। শামীম, এইটা দিয়া কী করছস? ব্যারিকেড; ব্যারিকেড দিছি। মানে করাত দিয়া না। গাছ দিয়া। শামীম হাসে নাই; আমার গতানুগতিক উদাসীনতা ও স্বার্থপরতা নিয়ে বরাবরের মতো পোকার-ফেইস বানিয়ে বিদ্রুপ করেছে— পরিষ্কার। আমিও আজকে ছাড়লাম না; হারামজাদাকে খুঁজতে সারা দিন কম নাকাল হতে হয় নাই। “আর কিছু উঠাইবি না গাড়িতে? স্টেনগান কিম্বা গ্রেনেড? বাঁশ কিম্বা ট্যাটা? এক কাম করি! আওলাদ হোসেন মার্কেট থেইকা কয়টা ঠেলাগাড়ি উঠায়া লইয়া যাই ডিকিতে, আরও কয়টা ব্যারিকেড দিতে পারবি।” শামীম কিছু বলল না; ওর চোখও কখনো কিছু বলে না। কিন্তু ফার্মগেটের কাছ থেকে লোক দুইটা গাড়িতে ওঠার পর ওর চোখে প্রথমবারের মতো আমি মৃত্যুভয় দেখলাম। ও, ও কি তেমন কিছু দেখেছে আমার চোখে? আমি যদিও কারও দিকেই তাকাচ্ছি না; ওদের কথামতো গাড়ি চালাচ্ছি। আমার চোখ সামনের দিকে।

“আলিয়া মাদ্রাসা? ক্যালকাটা?” গায়ে কেরোসিনের গন্ধওয়ালা লোকটা পিছনের সিট থেকে পশ্চিমা টানে জিজ্ঞেস করল।

“নো, নো। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি। ইউপি। ইন্ডিয়া।” আমি অমায়িক গলা করে বললাম। আমার আব্বা আলিগড়ের ছাত্র ছিল, তাই শুনে লোকটার মুখে কেমন একটা কিন্তু-কিন্তু লেগে রইল। হয়তো ইন্ডিয়াতে কোনো মুসলিম ইউনিভার্সিটি আছে, সেই তথ্যটাই তার মগজে সইছিল না। যদিও লোকটা যথাবিহিত পেশাদার। ভোক্সওয়াগন দেখে শুরুতেই বুঝেছে আমলার গাড়ি। জানতে চাইল, আমার আব্বা বনানীতে কবে প্লট পেয়েছেন। জানতে চাইল, আজিমপুরের সরকারি আবাসন ছেড়ে নতুন বাসায় আমরা কোন মাসের কত তারিখে উঠেছি। কেরোসিনের গন্ধওয়ালা লোকটা তারপর আব্বার ব্যাপারে বিশেষ কিছু আর জিজ্ঞেস করল না। জানতে চাইল, শামীমের আব্বা কী করেন। আমি ইংরেজিতে বললাম, উনি আর্মিতে মেজর ছিলেন। আর্মস অ্যামিউনিশন। চৌষট্টি সনে রিটায়ারমেন্টে গেছেন। ক্যান্টনমেন্টে, মানে কচুক্ষেতে বাসা। সেই বাসায় শামীমকে নামিয়ে দিয়ে আমি বাড়ি ফিরব, তেমন পরিকল্পনা ছিল আমাদের, বললাম।

“আই অ্যাম শিওর দিস আর্মি ম্যান ওয়জ নট এজুকেটেড ইন কলকাত্তা!” ত-য় ত-য় সংযুক্ত অক্ষরটা বড়ো করে উচ্চারণ করল অন্য লোকটা। তারপর দুইজনই হাসতে লাগল। এরা গোয়েন্দা না হয়ে যায়ই না। আর্মড ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স। অন্য লোকটা মনে হয় পাঞ্জাবি। সেদ্ধ টমেটোর মতো মুখ। এর জামায়ও কেরোসিনের গন্ধ। কেন? সহিংসতার আগুনে সৈনিক জ্বালানির মতো নিজেকে অর্পণ করে, সেইজন্য?

গাড়িতে ওঠার পর ফার্মগেট ইস্তক শামীমের সাথে গজগজ করছিলাম আমি। কীসের কাঁঠালবাগান? ওর বাপ না হয় ঠান্ডা ইংরেজিতে দুই বাক্যে সারবে, কিন্তু আমার কী হবে? এত রাত করে কচুক্ষেত গিয়ে, বিপদের তো হাত-পা নাই, শামীমকে বাসায় নামিয়ে, তারপর আমার বাড়ি ফিরতে রাত কত হবে, ওর হিসাব আছে? আর রাতটা কেমন গা ছমছমে, সেটা কি সে একবার দেখবে না? খেঁকিয়ে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় রিয়ারভিউ মিররে দেখলাম আমাদেরকে একটা জিপ ফলো করছে। শেষে ফার্মগেট পুলিশবক্সের কাছে আমাদের থামানো হলো।

কলকাত্তা নিয়ে এদের রগড় থামল না। “জাস্ট ইম্যাজিন, বেজ। ক্লোজ ইয়োর আইজ অ্যান্ড ইম্যাজিন”, সেদ্ধ টমেটোকে বলল কেরোসিনের চুলা। বলল, চোখ বন্ধ করে কল্পনা করতে যে, ভারত আর ইস্ট পাকিস্তান সীমান্তের আকাশে বিমান। গোলাগুলি চলছে। বোমা পড়ছে। কলকাত্তার দুবলা বাঙ্গালিলোগ একে একে আমাদের তাবাহ করে দিচ্ছে। “হেসো না, দোস্ত। হেসো না, বেরুজ। হি হি। স্যরি।”

আমি জোর করে জোরে জোরে হাসলাম। তাতে পিছনের সিটে বসা ওরা আশ্বস্ত হলো। ওদের হাসির রেশ কোমল হয়ে ধীরে মিলিয়ে গেল। “আহ, বেজ…”, নরম করে বলল কেরোসিনের চুলা, তারপর আলগোছে হাসি সামলে নিল।

বেরুজ নামটা শুনে মনে পড়ল, শিরিনের ভাইয়ের নামও ছিল বেরুজ। জিন্নাহ অ্যাভিনিউতে ছিল শিরিনের ভাইয়ের অফিস। সেই ব্যবসা এখনো টিকে আছে কি না, কে জানে? শিরিনও যে এখন কেমন আছে, আল্লাহ্ জানেন। কার খবর কে রাখে? কলেজে বুড়া ভাইয়ের জুলুমে অতিষ্ঠ হয়ে শেষদিকে বাধ্য হয়ে নেকাব ধরেছিল শিরিন; তাতেও শেষরক্ষা হয় নাই। বুড়া ভাই তো লিডারের ছেলে, সহিংস না হয়েও প্রতিহিংস কীভাবে হতে হয়, তার ভালোই জানা। শিরিনরা থাকত বেলালাবাদ কলোনি। শিরিনের বাবার দিকের আত্মীয়রা বংশপরম্পরায় গুজরাটের খানদানি ব্যবসায়ী আর শিরিনের মা সিলেটি—উনি আবার ওর বাপের দ্বিতীয় বউ। শিরিন সিলেটি বলতে, হয়তো লিখতেও পারতো। সাতষট্টির পর থেকে ওদের এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসায় মন্দা লাগে। বছর দুয়েক আগে কলেজে শিরিনের জীবনে ঘটে যাওয়া সেই ভয়ানক ঘটনার পর আমরা সবাই যখন ওদের বাড়িতে গেছিলাম — সাথে বুড়া ভাইও গেছিল মাফ চাইতে—সেই সময় শিরিনের ভাইকে শেষবার দেখি আমরা। মাজাভাঙা অসুস্থ ঘোড়াকে যেমন মশা ঘিরে ধরে, একবার দেখেছিলাম তেমন ঘোড়া রেসকোর্সের রাস্তায়, সেই রকম দেখতে লাগছিল উনাকে উনাদের বাড়ির বসার ঘরে। সন্ধ্যা নামি- নামি করছিল; বসার ঘরে বাতি ছিল না। একটা জানালার পাল্লায় লাগানো মশার নেট মাঝবরাবর গোলমতনভাবে ছিঁড়ে গিয়েছিল আর জানালার হাঁ-করা মুখের ভিতর দিয়ে মশা ঢুকে যাচ্ছিল ঝাঁকে-ঝাঁকে।

সেদ্ধ টমেটো আমার কাছে পানি খেতে চাইল। তারপর বলল, গতকাল সন্ধ্যায় আরেক বাঙালি মেজরের ছেলের সাথে নাকি তাদের এনকাউন্টার হয়েছে। সেই ছেলের নাম নাকি সুলতান। তেজগাঁও কলেজে পড়ত। বাগাওয়াটি কাজকর্মের সাথে জড়িত ছিল। এর আগেও হাতাহাতি আর টুকরো-টাকরা সংঘর্ষে অভিযুক্তদের খাতায় ওর নাম উঠেছে। ওর বাবা আন্ডারটেকিং দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে বহুবার। লিডারের ছেলের সাথেও এই সুলতানের দারুণ মাখামাখি ছিল নাকি। যদিও লিডারের ছেলে এখন পলাতক।

আমি আড়চোখে শামীমকে দেখলাম। শামীমের ট্র্যাক-রেকর্ডও তো ভালো নয়। ইলেকশনের সময় আদমজী কলেজ কেন্দ্রেই না-ভোট দেওয়া নিয়ে মিলিটারির কার সাথে হাতাহাতি করল? সিপাহি থেকে হাবিলদার—কচুক্ষেত বাজারে কে ওর হাতে নাজেহাল হয় নাই? ওরা নাকি খেয়ে পয়সা দিত না। মাংশ-মুরগি-ডিম উঠিয়ে নিয়ে চলে যেত। কলেজপাড়ায় বাঙালি মেয়েদের সাথে ওদের ভাষায় ছেড়খানি করতো। শামীমের রক্ত গরম।

সেদ্ধ টমেটো মোলায়েম কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে জানতে চাইল, শামীম কেন কথা বলে না। “কথা যেহেতু বলে না, ইয়েহ জনাব তাহলে নিশ্চয়ই গান গাইবে!”—বলল কেরোসিনের চুলা। আমি নীরবে ড্রাইভ করতে—অর্থাৎ পূর্বনির্দেশিত সার্কিটে চক্কর কাটতে থাকলাম। পিআইএ-র নতুন বিল্ডিং পাঁচবার পেরিয়ে গেল। সুলতান নামের ছেলেটাকে কি শামীম চেনে? বুড়া ভাইয়েরও কি খোঁজ করছে এরা? আমি তো জানি, বুড়া ভাই কোথায়। আমি তো জানি। দুপুর থেকে শামীমকে খুঁজতে খুঁজতে তার খবরও তো পেয়েছি। আমাদেরকে ওরা কী করবে? ধরে নিয়ে যাবে? তারপর টর্চার? ডিকি খুললেই তো আমরা ধরা পড়ে যাব। এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো হয় কী করলে? পালিয়ে যাব? গাড়ি রেখে জীবন নিয়ে ভাগব? রমনা পার হওয়ার সময় পালানোর কথা ভাবা উচিত ছিল কি? ওরা তো সশস্ত্র। গাড়ির দরজা খুলে আমি লাফিয়ে পড়ি যদি? তাহলে তো শামীমকে ওরা শেষ করে ফেলবে। মাথার ভিতর তখন আমার একটা ঠান্ডা কালো মেঝে অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত আর তার উপর অজস্র মানুষের মাথার বাদামি খুলি নারকেলের মতো ফেটে পড়ছে আর তার ভিতরকার জমাটবাঁধা ঘিলু আর জেলির মতো কালো রক্ত প্রথমে দিগবিদিক ছড়িয়ে যাচ্ছে, তারপর কালো মেঝের সাথে কিলবিল করে একাঙ্গি হয়ে শেষে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কারা যেন বুড়িগঙ্গার পানি বড়ো বড়ো হোসপাইপ দিয়ে টেনে আনছে আর মেঝেতে ঢালছে। সেই পানির রংও কালো।

কেরোসিনের চুলা আবারও গান শোনানোর আবদার করল। এইবার আদেশই করল আসলে। সাথে নিজেও খানিক গুনগুন করল। আমি শামীমের দিকে তাকালাম। শামীম আমাকে দেখল না। ওদের কথার উত্তরে বলল যে, ও আলবত গান জানে। কী গান জানে শামীম? ওই তো ছায়ানটে যেসব শেখায়? “প্রভাত-হিল্লোলে ভুলে, দিয়েছিলেম পাল তুলে?” নাকি ওইটা? “ভেসেছিলেম স্রোতের ভরে, একা ছিলেম কর্ণ ধরে?” দুইটার মধ্যে কোনো একটা কি অতুলপ্রসাদের লেখা? হবে! পথের ধারে শিশুগাছে একদল বাদুড় গাছের একটা কেন্দ্র থেকে হঠাৎ ছিটকে উড়ে গেল, যেন একটা বিস্ফোরক ফুটল আর একটা মানুষের দেহ তাতে খণ্ড-বিখণ্ড হলো আর অংশগুলি ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে গেল ঊর্ধ্বাকাশে 1

মেহদি হাসান সাহেব নিজে গেয়েছেন, এমন কিছু শোনাতে পারলে ভালো হয়, বলল কেরোসিনের চুলা। শামীম কিছুক্ষণ হাসিহাসি মুখে চুপ করে রইল। দশ সেকেন্ডে কেমন প্রস্তুতির চেহারা করে নিয়ে তারপর বলল, ও বাহাদুর শাহ জাফরের লেখা একটা কিছু গাইবে। পিছনের সিটে হর্ষধ্বনি উঠল।

শামীম গাইলো, “বাত করনি মুঝে মুশকিল কভি অ্যায়সি তো না থি। জ্যায়সি অব হ্যায় তেরি মেহফিল, কভি অ্যায়সি তো না থি। চশম-এ-কাতিল মেরি দুশমন থি হামেশা, লেকিন জ্যায়সে অব হো গয়ি কাতিল কভি অ্যায়সি তো না থি।” প্রেয়সীর চোখ তো খুনে চোখ আর সেই চোখ তো আমার আজন্মশত্রু, কিন্তু আজ সেই চোখে যে খুন চেপেছে, তেমন তো আগে চাপে নাই! প্রেমের জোয়ারে ভাসালে দোঁহারে, বাঁধন খুলে দিলে, কিন্তু যে তীরে ভেড়ার তৃষ্ণা আজীবনের, সেই তীরের সন্ধান পাওয়া এত কঠিন, তা তো আগে জানা ছিল না!

এই গান আমার জানা নাই। শিরিন নিশ্চয়ই জানত। পিছনের সিটের ওরা বলল শরিক-এ-হায়াত ছবির গান। তিন বছর আগে নাকি রিলিজ পেয়েছে। ওই ছবিতে নুর জেহানের গাওয়া একটা গানও নাকি ছিল। সেদ্ধ টমেটো এবার গুনগুন করল। “তেরে লিয়ে, ও জানে-জাঁ, লাখোঁ সিতম উঠায়েঙ্গে।” লোকটার গলা দরাজ না, কিন্তু সুর কায়েম করতে সচেষ্ট ছিল। গান শেষ হলো একটা গুনগুনে সুরে, তাই ঠিক কখন শেষ হলো বোঝা গেল না। যানহীন, জনহীন রাস্তা আর অস্ফুট সুরের রসায়নে একটা প্রশান্ত ক্লান্তির মেঘ পিছনের সিটে থিতু হচ্ছিল। আমরা কি মুক্তি পাব?

পাব, না চাইতেই জানাল সেদ্ধ টমেটো। তবে সেটা নিঃশর্ত নয়, বুঝলাম।

কেরোসিনের চুলা বলল গাড়ি ঘোরাতে ক্যান্টনমেন্ট। তারপর আমাদের যার যার বাড়ি। তার গলা শুনে মনে হলো ঘুম পেয়েছে। “ইওর ডিকশন, ইওর ডিকশন”, শামীমের উর্দুর গালভরা তারিফ করল কেরোসিনের চুলা।

“এবার বল।”—সেদ্ধ টমেটোর কণ্ঠে বেসুর, সমাপনী প্রত্যয়।

“ইকবাল হল।” আমি নিচুগলায় বললাম।

সেখানে কে?”

“লিডারের ছেলে। যদি এতক্ষণে বুড়িগঙ্গার ওপারে চলে না-গিয়ে থাকে।”

“আচ্ছা।”

শামীমের দিকে তাকানোর সাহস হলো না আমার। সেদ্ধ টমেটো আমার পরিত্রাণে এগিয়ে এলো। শামীমকে বারবার বলতে লাগল, আর্মি অফিসার নেওয়ার সার্কুলার হবে সামনেই। ও যেন অবশ্যই অ্যাপ্লাই করে। একবার কমিশনড হয়ে গেলে আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না। ফৌজিপরিবারে জন্ম নেওয়া মানে মহাজাগতিক জ্যাকপট হিট করা। এমন ব্রাইট নওজওয়ানকেই তো চায় পাকিস্তান! এই সুযোগ হেলায় হারানো ঠিক হবে না।

“ম্যাডনেস ইজ সামথিং রেয়ার ইন ইন্ডিভিজুয়ালস” -সেদ্ধ টমেটো বলল। অর্থাৎ ব্যক্তি—মানে আমরা – গোবেচারা নির্দোষ। ব্যক্তি নয় উন্মাদনার একক। উন্মাদনার আর উচ্ছৃঙ্খলতার অপরাধ করে গোষ্ঠী, দল, জাতি। এমনকি সময়। তাই সময়ের দোষে, গ্রহ-নক্ষত্রের দোষে, সঙ্গদোষে ব্যক্তিকে ভুগতে হয়। “সাম ওয়েস্টার্ন ফিলোসফার” নাকি এই কথা বলেছেন। আমি ম্যাকিয়াভেলি পড়েছি কি না, জানতে চাইল সেদ্ধ টমেটো।

ক্যান্টনমেন্টের আর্মি ব্যারিকেড পেরিয়ে কচুক্ষেত যাওয়া পর্যন্ত পথে কেউ কোনো কথা বলল না। রাস্তা ঝকঝকে। প্রত্যেকটা স্ট্রিট-লাইট জ্বলছে, অমঙ্গলের দিনে এ কেমন ষড়যন্ত্র, এরা কি আগেও এত কাছাকাছি জ্বলত?

পথে একটা কুকুর মরে পড়ে আছে—অন্য কারও গাড়ির চাকায় আগেই পিষ্ট হয়েছে, কিন্তু অণ্ডথলিটা অক্ষত। চেষ্টা করেও মড়া কুকুরটাকে গাড়িচাপা দেওয়া এড়াতে পারলাম না। পিছনের চাকায় থেঁতলে গেল কুকুরটা। মাঝরাস্তা দখল করে পড়ে থাকা লাশটা এবার কেউ দেখলে কুকুর বলেই হয়তো চিনতে পারবে না। কচুক্ষেতে শামীমের বাসা চিনে নিল ওরা। ওদের জংলা সবুজ জিপ হাজির হলো। ওরা আমাদের গাড়ির ডিকি খুলল না। ওরা চলে গেল।

আমরা দুইজন গাড়ি থেকে নামলাম।

“হুদাই ভয় পাইছিলাম রে। খালি গাড়ি পাইলে তাতে জবরদস্তি উইঠা যায় তো ওরা আজকাল। সিভিলিয়ান গাড়িতে টহল দেয় আর কি।” আমার টাগরায় কথা বেজে-বেজে যাচ্ছিল, কিন্তু অন্তরের ভিতরের কী জানি কী চাপা দিতে দিতে আমি যা মনে হলো, বললাম। হাতের তালু ঘেমে গেছিল আমার। প্যান্টে হাত মুছলাম। পকেট হাতড়ে ম্যাচ বের করলাম। সিগারেট লাগবে।

শামীম দেখি রাস্তায় বসে পড়ল। “ক্যান? ক্যান?” শামীম করুণভাবে অদৃশ্য মাটি, অদৃশ্য ঘাস খাবলে ধরল আর চাষার মতো আর্তনাদ করতে লাগল কিন্তু চাপাস্বরে, যাতে গৃহস্থবাড়ির কেউ না জাগে। “বুড়া ভাই, বুড়া ভাই”—শামীম কেমন ঘড়ঘড় করতে লাগল।

শামীমের এই কুকুরের মতো প্রভুভক্তি দেখে আমার ঘেন্নায় চোখ সরিয়ে রাখতে হলো। কুকুরের লাশটা থেঁতলে গেছিল, সেই দৃশ্যটা মনে পড়ল আর কেমন বমি উঠে আসতে লাগল। শামীমকে কিছু বলা দরকার। “হারামজাদা, শিরিনরে তুই ভালোবাসিস নাই? তাইলে বুড়া ভাইয়ের চেলাচামুণ্ডারা যেইদিন শিরিনরে উঠায়া নিয়া গিয়া ওর চুল কাইটা দিলো, কই আছিলি তুই? শিরিন—শিরিন আমার বোনের মতো ছিল। হাঁটু পর্যন্ত চুল ছিল শিরিনের!”

শামীম থতমত খেলো। “শিরিন? মানে কলেজের? হ্যায় কইত্থেইকা…”, কয়েক মুহূর্ত শামীমের চেহারায় আমি ব্যথা আর হতবিহ্বলতার দাগ দেখলাম, যেন ওর খুব নিষিদ্ধ নাজুক জায়গা আমি ন্যাংটা করে দিয়েছি, যেন শুধু বুড়া ভাইয়ের সাথে নয়, শামীমের সাথেও আমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। ও ঢোক গিলল। তারপর সামলে উঠল। চোয়াল কঠিন করল, নিজের অভিব্যক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ খুঁজে পেল বুঝি। শামীম টের পেল যে, আমার মধ্যে রাজনীতি কেন, কোনো নীতিই নাই; শুধু মানবিক জিঘাংসা আর প্রতিশোধস্পৃহা ছাড়া আমার মধ্যে আর কিচ্ছু নাই। আমাকে আমার প্রাপ্য ঘৃণা ডেলিভার করার জন্য শামীম ওর মুখ সরু করল। তারপর ভেবেচিন্তে কুৎসিত কিছু জুৎসই কথা বলল থেমে থেমে।

“শিরিন? তোর বোন? ক্যামনে? মানে বুড়া ভাই শিরিনের দখল নেওয়ার পরে তোর মতো বিচিছাড়া হিজড়াগুলা যেমন সবতে ডরে শিরিনের ভাই হইয়া গেছিল, তেমনে?”—শামীম রাস্তায় থুথু ফেলল। থুথুটাও ওর পারফর্মেটিভ বক্তব্যের একটা অংশ হলো।

আমি গাড়ির চাকার পাশ থেকে একটা আধলা তুললাম। উবু থেকে আমার উঠে দাঁড়ানোর মধ্যে এমন কিছু ছিল, শামীম আমার উপর এক মুহূর্তে হামলে পড়ল। আমাকে মারতে নয়, থামাতে। শরীরের সমস্ত ওজন নিয়ে গাড়ির বনেটের উপর হেলে পড়লাম আমরা। না থামালে, বুঝি মেরেই ফেলতাম শামীমকে আমি।

দোতলার বাতি জ্বলে উঠল। কান্নার বেগে আমি অবিবর্তিত বানরের মতো ঝুঁকে পড়ছিলাম। আমার খোলা কিন্তু বোবা মুখ থেকে লালা ঝরছিল। গলির শেষ মাথায় একটা গাড়ির বাতি কি জ্বলল-নিভল? এত সহজে নিশ্চয়ই গোয়েন্দা ওরা চলে যায় নাই। নিশ্চয়ই আমাদের পরবর্তী মুভমেন্টের জন্য ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করছিল!

গলির মুখে তেমাথার দেয়ালে গাড়ির ত্বরিত আলো ঠিকরে পড়ল। শামীম ও দেখল নিশ্চয়ই। ও আচমকা আমার হাত থেকে আধলাটা খামচে নিল। তারপর স্ট্রিটলাইটের দিকে সই করে মারল। কাচ ভাঙার শব্দে—অন্ধকারে নয়, পুরা পাড়া জেগে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *