জবরখাকি

জবরখাকি

নাইটি দুধে ভেসে যাচ্ছিল আমার; মেয়ের গায়ের গন্ধ বুঝি এমনই হবে? ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আমি আমার বুকের ভিতর থেকে কী যেন কী শেষবারের মতো বের করে দিতে চাইলাম; টানা দশ-বারোবার চাপাস্বরে “হুঁহু-উহু” বলে উঠলাম। পর্দা-বেডশীট- দেয়াল, রুমের লাইট, হাতের পাতা, জন্ম-মৃত্যু-অসুস্থতা—সবকিছুর রঙই নামহীন গোর খুঁড়ে তোলা শিশুর কঙ্কালের মতো শাদা কেন? কেন? কেন? কেউ কি শুনতে পাচ্ছ? ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে ইচ্ছা করছিল না অ্যাটেন্ডেন্টের সোফায় সাব্বির শুয়ে কিম্বা বসে আছে কি নাই। এমন তো না যে, আমার ব্যথা করছিল! কোথায় ব্যথা? ওষুধ, গরম জামা, বাচ্চার ফুলো-ফুলো ব্যাগ, মেঝের স্টেরাইল গন্ধ, শাদা দেয়ালে কোনো ভিজিটর আত্মীয়র রেখে যাওয়া ময়লা আঙুলের ছাপ— জুতা খোলার সময় দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল নিশ্চয়ই, নকল কাঠের (প্লাইউড) টেবিলে নকল বেতের ঝুড়ির মধ্যে রাখা মাটির ব্যাংকের মতো দেখতে তিনটি আসল আম – আহা, চারিদিকে আমার মেয়ের আসন্ন শৈশবের আয়োজন। কোথাও কোনো ব্যথা নাই। একটু দূরে এই রকম শাদা আকাশের গায়ে নীল মেঘনা তো, নীল আকাশের গায়ে নাহ, নীল ইউনিফর্ম গায়ে নার্স; “পাম করতে হবে”, বলল দুইবার, অধৈর্য যন্ত্রের মতো, যেন সকাল থেকে স্টার্ট দিয়ে রাখা আছে তাকে, কিন্তু চালু করা হয় নাই।

তেরো ঘণ্টা লেবার পেইনের পর আমার মেয়ে হয়েছে রাতে—ছাপ্পান্ন ইঞ্চি, সাত পাউন্ড; একটা প্রাণের মতো যেন জ্বলে উঠে শেষ হয়ে গেছি আমি। শাদা বিছানায় আমার শরীরে শাদা চাদর মোড়ানো; আমার সাইলেন্ট করে রাখা ফোনটা আমার পেটের উপর নড়েচড়ে গেল ভাইব্রেশনে আর পর্দাভেদ্য আলোয়। সেইদিন সেই একই হসপিটালের অন্য কোনো ক্যাবিনে আশরীর, অর্থাৎ জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়ায় অসাড় হয়ে ঘুমাচ্ছিল শারমিন – জানলাম, ততক্ষণে ওর স্টিলবর্ন বেবিটা খালাস হয়েছে; ও জানতে পেরেছে কি না, কে জানে! আমিও কি জানতাম যে, ওর মরা বাচ্চাটা ওর বরের না? ছি! আমার বাচ্চাটা কোথায়? কোথা চাঁদো আমার? সোনাফুপির মাজাঘষা খোনা গলায়, দুখ-বেভুল উচ্চারণে আমার মাথায় বাজতে লাগল গানটা। “বুবনো বরিয়া মোর গিরিল আদার। কোথা চাঁদো আমার?” ভাষা নাই, শুধু লালা আছে আর গোলাপি চকচকে দুটো ঠোঁট আছে, এমন একটা ভেজা নিদন্ত মুখগহ্বর কোথা থেকে যেন চুকচুক করে উঠল। বিছানা ভিজে যাচ্ছিল দুধে। পাম করতে হবে। এবার কি ঘাড় ঘোরাতেই হবে?

*

একটু আগে বাইরে অনিচ্ছুক বৃষ্টি হয়েছিল, ভাইয়া বলত হাফ-আর্সড রেইন, বৃষ্টিতে বাতাস আরও ভ্যাপসা হয়ে গিয়েছিল। শারমিন আমার ঘরের জানালা খুলে দিলো; নিজের গায়ের ওড়না খুলল, তারপর ঘরের পর্দাও— শারমিন তো গায়ে কাপড়ই রাখতে পারে না। কতদিন আমার ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় আকাশের ছায়া পড়ে নাই! উলটাদিকে আন্ডার-কনস্ট্রাকশন বিল্ডিং, ছাইরঙা লেবারদের কাজের শব্দ, অশালীন হইহই আর তার প্রতিধ্বনি ভেসে আসত সারা দিন; পর্দা খুলে রাখলে ওই সমস্ত আওয়াজ আমার ঘরের আয়নায় প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে যেত। পর্দা টানা থাকলেও কে না জানে, একদল লেবারের গলার আওয়াজের ভিতর একজোড়া চোখ থাকে; আওয়াজের পর্দা চড়া আর নামার সাথে সাথে চোখদুইটা স্লো-মোশনে জ্বলে আর নেভে— সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি – সা আর সা-নি-ধা-পা-মা-গা-রে-সা; আমার ঘরের উলটাদিকে চব্বিশ ঘণ্টা লেবারদের কাজ চলত, তাই ওই চোখ দুইটা কখনোই যুঁজত না, তাই নিজেকে বেআব্রু লাগতো। রূপা বলত, এসব আসলে আমার মনের শয়তানি—মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে আমার মন সায় দেয় না, নাকি। আম্মা অনেকবার বলেছিল, ঘর বদল করতে, বলেছিল, ভাইয়া তো লন্ডন থেকে ফিরে বউ নিয়ে এই ঘরেই উঠতে পারে ইত্যাদি। ঘর বদল করতে আমার মন চায় নাই। শ্বশুরবাড়িতে একবার চলে যাওয়া মানেই যথেষ্ট বদল; এরপরে আরও বদলের প্রস্তাব বাড়াবাড়ি। উত্তর দিকের জানালাটার পাশে আমার ঘরের প্রতিবেশীভাবে পুরানো নারকেল গাছটা তখনো ছিল, ডেভেলাপারের হাতে যাওয়ার পরে ওটা কাটা গেছে আর জানালার পাল্লা বরাবর মরা ডালটার উপর প্রত্যেকদিন একটা কাক—একটা স্পেশাল কাকই, ওর একটা চোখ ঘোলা – এসে বসতো। আর ওর ট্রেডমার্ক ঘড়ঘড়ে গলায় ডাকত; আমি হুশ-হুশ করলেও যেত না, কারবালার কাকের মতো ঘড়র-ঘড়র করে “ঘায় ঘাসান, ঘায় ঘোসেন” বলে ঘ্যানঘ্যান করতো। নারকেল গাছটা পেরিয়ে আরও কয়েকটা ঝোপড়া গাছ, গরমে স্থির হয়ে থাকা পাতার পিছন থেকে দুই জোড়া পা হেঁটে আসছিল, একই স্কুলের ইউনিফর্ম পরা, লম্বা লম্বা ঘাসের ভিতর হামা দিয়ে আসতে থাকা বাঘের চারটা পায়ের মতো শাদা সালোয়ারের দুই জোড়া পা। জাবড়া পাতার কারণে ওদের বাকি অবয়বটুক দেখা গেল না। দুই জোড়া পায়ের কোনো একজোড়ার মালকিনের নিশ্চয়ই এক বিনুনি ঢিলা হয়ে গেছে, কিম্বা চুলের শাদা ফিতা মাঠে হারিয়ে গেছে, আরেক মালকিনের টিফিন নিশ্চয়ই কাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে, কিম্বা নেয় নাই, ভরপেটই খেয়েছে সে, হয়তো বন্ধুর টিফিন ডরিয়ে-ধমকিয়ে ছিনতাইও করেছে, বন্ধুর মাংশ দাঁতের ফাঁকে সুতার মতো ঝুলছে। আজকাল তো শাদা সালোয়ারদের মোবাইল ফোন থাকে, সামান্য টিফিন নিয়ে ওরা কেন মারপিট করবে? জোড়া পা দুইটা ডানে একটা গলিতে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমার পাশে আমার ডাঙার বাঘ। শারমিনকে সহ্য হচ্ছিল না। ভাইয়ার পুরানো স্যুটকেস খয়রাত নিতে এসেছিল ও। ওদের নাকি ট্র্যাভেল করার ভালো স্যুটকেস নাই। বুয়া একটু আগে আমার ঘরে দিয়ে গেছে ভোমা স্যুটকেসটা—তারও আগে ঘর মুছেছে, তাই ভেজা ফ্লোরে চাকার দাগ। স্যুটকেসটাকে মাটিতে দাঁড় করিয়ে রেখে ত্যানা দিয়ে ঝেড়ে মুছে দিয়েছে; হ্যান্ডেলের লাল ফিতাটা খুলে গেছিল, সযত্নে সেটাকে টাইট করে ফুল করে বেঁধে দিয়েও গেছে। শারমিন একবার “এহ!” বলে চুপ করে গেল। লাগেজ ব্যাগের গায়ে লাল ফিতা বাঁধা আর সদ্য-অক্ষরজ্ঞানপ্রাপ্ত হাতের লেখার মতো দেখতে ডামা-ডামা ইংরেজি অক্ষরে নাম-ঠিকানা লিখে আঠা দিয়ে সাঁটানো আম্মা আর ভাবির পুরানো অভ্যাস—এয়ারপোর্টে কত কত লাগেজ বেহাত হয়, আমি আর কী জানি? — শারমিনকে ওসব বলে লাভ নাই। এমনকি টাইট করে ফুল করে একটা পিচ্ছিল চকচকে লাল রঙের ফিতা বাঁধা হচ্ছে কারও হাতে, সেটা দেখতেও যে কী আরাম, ওকে বললেও বুঝত না। পিচ্ছিল, চকচকে, স্ফটিকের মতো আলো ঠিকরায়, আর পালিশ করা পাথরের মতো গতর—এমন সমস্ত জিনিস দূর থেকে দেখতে নয়, শুধু কিনতে শারমিনের ভালো লাগতো। স্বাস্থ্যবান বাচ্চাদের ও কিউট বলত; পাশে দাঁড়ানো, কিম্বা অন্য কারও কোলে পা ঝোলাতে থাকা শীর্ণ বাচ্চাদের বাদ দিয়ে ওদের ভাই-বোন-বন্ধু মোটা বাচ্চাটাকেই ও উলু-লুলু করতে করতে আদর করতো। ইটালিয়ান ক্রেপ কাপড় এনেছিল ভাইয়া-ভাবি আমার সব ফ্রেন্ডদের জন্য-লাক্সারিয়াস আর কাকে বলে, এক ফোঁটা আলো পড়লে তা-ও স্লাইড করে পিছলে যায়; দরজিকে দিয়ে তাতেও জারদোজির লেস, সোনালি ডলার আর হিরার লটকনের মতো দেখতে টাসেল লাগিয়ে নিয়েছিল শারমিন। ফেসবুকে ভাইয়া- ভাবির লন্ডনের বাড়ি—যেটার মর্টগেজ শোধ করতে ভাইয়াকে অফিসের পরেও রাতের শিফটে অড জব করতে হতো— দেখে শারমিন মাথা নামিয়ে নিজের ওড়নার প্রান্ত কুঁচি করতে করতে বলেছিল, “কিছু মানুষকে আল্লাহ্ সবকিছু দেয়, ওকে?” সেই শারমিন অফিসের টাকায় বসের সাথে বিদেশ যাচ্ছে, যাওয়ার আগেই যা গরম দেখাচ্ছে, আসার পর না জানি কী করে, তখন আমাদের ইনফেরিওটি-না-কী-যেন কমপ্লেক্সও কী আর চাপা থাকবে?—এইসব ভেবে আমি আর রূপা বিরলে মুখ বক্র করতাম আর মনে-মনে একটা পিচ্ছিল চকচকে লালরঙের ফিতায় তিনফুল দিয়ে টাইট একটা গিফটের বাক্সের মতো বেঁধে দিতাম শারমিনের মুখ।

“অক্টোপাস খাব না, দোস্তো। আর পর্ক তো প্রশ্নই আসে না। ওকে?”

“চিন্তা করিস না। ওইখানে নিশ্চয়ই আরও অনেক খাবার দিবে। ব্যুফে করবে ওরা, না রে?” আমি মনে-মনে হাভাতের মতো ঝোল টানলাম, কিন্তু অক্টোপাস আর পর্ক শারমিনের মুখ থেকে বের হয়ে তখনো ঘরের বাতাসে ঝুলছিল, তাই নিজের ঝোলে নিজেরই ঘেন্না লাগল। বুয়া নাস্তা দিতে দেরি করছিল।

“হুঁ। নভোটেল নামে একটা হোটেলে হবে। জামি ভাই অবশ্য চিনতে পারে নাই, এইটা কোন চেইন। আচ্ছা শাড়িই পরব তো, নাকি? একটা অন্যরকম ব্যাপার; সবাই বাংলাদেশকে চিনবে, ওকে? নাকি সবাই খ্যাৎ ভাববে? স্যুট বানায়া নিয়ে যাই? মানে ব্যাকআপ। লাগলে লাগল!”

“এত ফুটানির কী হইল, বুঝলাম না। খালি ফ্লাইট, হোটেল, জামাকাপড় আর ঠাটবাট নিয়া পড়ছস। তোর পেপার-টেপার কিছু প্রেজেন্ট করতে হবে না?”

“এইটা কি তোদের ডাক্তারি পাইছস? এইটা নেটওয়ার্কিং করার কনফারেন্স, ওকে? নতুন ক্লায়েন্ট ধরব; জামি ভাই বলে ‘নতুন মুরগা’। স্মার্ট ড্রেস-আপ লাগবে। ইংলিশ, ওকে? তারপর হ্যান্ডশেক– আল্লাহ্, আমার তো খালি হাত ঘামে!”

এই বলতে বলতে শারমিন ওর ঘামের হাতটা ফ্রিজ থেকে বের করা একদলা ঠান্ডা মাখনের মতো, এহ–আমার উলটানো কবজির পিঠে আচমকা ঘষে মুছে নিল। তারপর হাসতে হাসতে গড়িয়ে গিয়ে বিছানার অন্যপাশে, আমার নাগালের বাইরে চলে গেল। আমি চিৎকার করে উঠলাম “এই খাটাশ!” বলে—মাপা, প্রেডিকটেবল চিৎকার—আর ও চার হাত-পা বাঁকা করে বুকের কাছে জড়ো করে আমার বিছানার উপর চিত হয়ে শুয়ে একটা অসম্পূর্ণ বৃত্তচাপের মতো ডানে-বাঁয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে হাসতে লাগল। এটা আমাদের পুরানো নাটক; বাহাত্তরবারের মতো মঞ্চস্থ হচ্ছিল। আমরা নাইনে পড়াকালীন ওর ছিল এক হিন্দু স্যার অঙ্ক আর ইংলিশের- ভীষণ শরাফত তার, আমরা ওদের বাসায় স্কার্ট-টপ পরে যেতাম, চোখের দিকে পর্যন্ত চাইত না; শারমিনের আব্বু- আংকেল বলতেন, “খুব সম্ভ্রান্ত ঘরের।” সেই স্যার কবে অঙ্ক করাচ্ছিলেন ওকে আর যথারীতি ওর হাত ঘামছিল আর টপটপ করে সেই ঘাম পড়ছিল নিউজপ্রিন্টের দিস্তাখাতার উপর, সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটরের মোটা মোটা বোতামের উপর আর তাই দেখে সেই স্যার নিচু গলায় বলেছিলেন, “ইশ! কত ঘামে!” আর তাই শুনে শারমিন অপ্রস্তুত আর অধোবদন হয়ে গেছিল আর সেই স্যার ওর হাতটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে নিজের ডানহাতের সমস্ত পাতা দিয়ে ঘষে ঘামটা মুছে দিয়েছিলেন। আর শারমিন খাতার উপর থেকে ওর নত মুখ একটু উঁচু করে স্যারের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল—ওকে… এই মুখ উঁচু করে তাকিয়ে হাসার ব্যাপারটা শারমিন আমাদের বলে নাই; আমরা নিজেরা নিজেরা কল্পনা করে নিয়েছিলাম; এমনকি ওই স্যারের নাম সত্যি সত্যি পুলক স্যার ছিল, নাকি আমাদের দেওয়া, তা নিয়েও সন্দেহ আছে, কিন্তু ওইসব কল্পনা যোগ করে না নিলে তো মুশকিল ছিল; এমনিতেই এই ঘিনঘিনে লবণাক্ত তরল- টাইপের টপিক টিনেজ মেয়েদের চামড়া বেয়ে নামতে থাকে আর কেমন সুড়সুড়ি দেয়। তার উপর শারমিন যে বরাবরই একটু বাজে আর বেহায়া রকমের মেয়ে, এই ব্যাপারটাও পুরোটা ফোটে না ওই রকম একটা সমর্পিত হাসিমুখের দৃশ্য না থাকলে। তা সেই থেকে শারমিনের ঘর্মাক্ত হাত নিয়ে কিংবদন্তি চালু হয়েছিল আমাদের মাঝে আর চালু হয়েছিল আমাদের গায়ে আর গায়ের জামায় যখন-তখন শারমিনের ঘাম মোছা-ঘাম মোছা খেলা।

লোকে জানতে চাইত, আমি বাপের বাড়িতে কেন। অনেকে ভাবত, বরের সাথে বুঝি বনিবনা হচ্ছে না। আমার বরও ডাক্তার; কোম্পানিগঞ্জে পোস্টিং হয়েছিল সাব্বিরের। সারা জীবন পড়া-পড়া করে, তারপর পাশ করে আমার বর সাব্বির পেল অল্প টাকার সরকারি চাকরি-ডাক্তারিতে যেমন দস্তুর, শুক্র-শনিবার ঢাকা আসত, সেক্স করতো আর দাওয়াত খেতো শুধু; বাকি দিনগুলিতে আমি বাপের বাড়ি বিশ্রাম করতাম আর বিসিএসের টেস্ট পেপার সল্ভ করতাম। রূপা ইঞ্জিনিয়ার। শারমিন রূপাদের ক্লায়েন্টের অফিসে কাজ করতো। রূপার সুপারিশে শারমিনের চাকরিটা হয়েছিল। আর আজ আমাদের হরমোনতাড়িত ব্যাকবেঞ্চার নিম্ফো-বন্ধু শারমিন বরকে নির্যাতনের কেস করার হুমকি দিয়ে বাপের হোটেলে শোয় আর সকাল হলে সেজেগুজে ক্লায়েন্ট-মিটিং করতে যায় যে মেয়ে, সে এবার আমাদের সবাইকে থুয়ে বসের গায়ে হেলান দিয়ে কি না উড়ে যাচ্ছিল কয়েকশ দেশের সীমান্তের উপর দিয়ে ঠান্ডা নীল পৃথিবীর দুইদিকে ওর ঘর্মাক্ত হাতের পাতা দুইটা শেইমলেসলি ছড়িয়ে দিয়ে। আমি ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকলাম।

“প্রথমবার উনি আমাকে হোটেলে নিয়ে গেছিল, ওকে? তোরাই তারপরে বললি যে, হোটেলে প্রেম করা সম্মানজনক না।”

“আমরা বলছি?”

“আচ্ছা, তুই বলছিস শুধু। ওকে? এইবার ঠিক আছে? রূপা সবসময়ই নেগেটিভ ও বলছে, এইটা নাকি যৌন হয়রানি। রূপার সাথে কথা বলা যায় না আজকাল। কখনোই বলা যাইত না। টকশোয়ের ভাষায় কথা বলে খালি। আজাইরা। যৌন বুঝলাম; হয়রানি হইল কেমনে? উনি তো রেইপ করেন নাই আমারে। ওকে?”

“রেইপ না করলেও হয়রানি হইতে পারে। হ্যারাসমেন্ট।”

“হ্যারাসমেন্ট আর হয়রানি কি এক নাকি?”

“এক না তো কী? তুই এত অশিক্ষিত ক্যান? উনি যেহেতু তোর বস, ধর, উনি উনার ক্ষমতা ইউজ কইরা তোরে লাগাইছে। এইটা হয়রানিই, মানে হ্যারাস…”

“উনার আবার ক্ষমতা! হেহ। হাসাইস না, ওকে? উনি তো পাঁচ মিনিটেই খালাস।”

আমি হাসতে হাসতে হতাশ হয়ে চুপ করে গেলাম। রূপা সাধারণত চুপ করে না, তাই শারমিনের সাথে প্রতি বছর রূপার মনামনি হতো। ওই সময়ে রূপা আর শারমিনের বাৎসরিক ঝগড়া চলছিল, নইলে শারমিন কি আর লাগেজ-ব্যাগ নিতে রূপার কাছে না গিয়ে পক্ষীবৎসের মতো উড়ৎ করে আমার কাছে আসত? আমাদের ছয় বন্ধুর হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ঝগড়াটা লেগেছিল জামি ভাইকে নিয়ে। শারমিনের বস জামি ভাইকে রূপা দুই চোখে দেখতে পারতো না। জামি ভাই নাকি একবার অফিসে উনার কাচের ঘরের ভিতর ফ্লোরের সব ইয়াং মেয়েদের ডেকে এনে উনার ওয়ার্কস্টেশনের সামনে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে মুজরার ভিডিও দেখিয়েছিলেন, তাও আবার রানিং কমেন্ট্রিসহ। বলেছিলেন আরবদেশের কোন ক্রুজ শিপে নাকি নিজের নতুন ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করেছেন। আর ভিডিওটাও তেমন— মেয়েটার শরীরের মাংশে মাংশে এলোপাতাড়ি জুম হয়ে কম্পিউটারের পর্দা প্রায় ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। নর্তকীর বুক- পেট-পাছা ছাড়া পুরা স্ক্রিনে, পুরা পৃথিবীতে আর কিচ্ছু নাই। এমনিতেও তো মুজরার মেয়েগুলি বিশ্রী হয়—ওদের পুরাটা শরীরই তো একটা দীর্ঘ এককোষী পেট আর পেট ঘিরে লাফাতে থাকা ছোটো ছোটো নুন্টুর মতো ঝালরওলা গয়না। শারমিনদের কোন হিজাবি মেয়ে-কলিগ নাকি “ভাইয়া, আমাকে অমুক ভাই একটু ডাকছিলেন”, বলে পাশ কাটাতে চাইছিল। জামি ভাই ওকে যেতে দেন নাই। টানা পনেরো মিনিট মানে অনন্তকাল ধরে নাকি চলেছিল এই কাণ্ড। অফিসভরতি বাকি ছেলেরা নাকি হাসি-হাসি অপ্রস্তুত মুখ করে ওই গ্লাসহাউজের কয়েদিদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল আর রূপা বলতে চায়, জামি ভাই নাকি ভাবছিলেন, “দ্যাখ আমার পাওয়ার।” শুনে আমার গা শিউরে উঠেছিল—একদল সিঁটিয়ে-থাকা মেয়েজন্তু আর একজন সীমালঙ্ঘনকারী বনের রাজা, কেউ কাউকে আঘাত করছে না, চ্যালেঞ্জ করছে না, হালুম-হুলুম করে পসচারিং করছে না, এমনকি কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছে না, কেউ কাউকে দৃষ্টি দিয়ে ভায়োলেট কিম্বা ভস্ম পর্যন্ত করছে না; সবগুলি জন্তু তাকিয়ে আছে বড়ো বসের বড়ো মেশিনের বড়ো স্ক্রিনের দিকে, সেই জন্তুগুলি আবার একটা বড়োসড়ো কাচের ঘরে, যে ঘরের দেয়াল চাইলেই উল্লঙ্ঘন করা যায় না, বাইরের সবগুলি মানুষ আবার তাকিয়ে আছে সেই কাচের ঘরের দিকে… ধুত, রূপা শালি সবসময় বাড়িয়ে বলে সবকিছু আর আমিও হারামি আছি; মনে হয়, বাড়িয়ে ভাবি। শারমিন আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে রূপাকে জাজমেন্টাল বলে গালি দিয়েছিল। বলেছিল, জামি ভাইয়ের সমান পপুলারিটি কারও নাই, কেমন সূক্ষ্ম-সুন্দর একজন আলফা মেল; স্বল্পভাষী কিন্তু দুর্দান্ত সেন্স অভ হিউমার; মনাশ ইউনিভার্সিটির মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসের গ্র্যাজুয়েট; মেয়েদের সাথেও বন্ধুর মতন মেশেন। –আর সবচেয়ে বড়ো কথা, ওইদিনের ওই রুমের ভিতরের রক্ষণশীল হিজাবি মেয়েটার সাথে রূপার ফারাক কই? একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েমানুষ মুজরা নাচছে, দিনের পর দিন খাটাখাটনি করে পেটের পেশির উপর দখল কায়েম করেছে, এটা শিল্প নয়? ওই শিল্প কেন কয়েকজন কলিগের সাথে শেয়ার করা যাবে না? নাকি তাসের দেশ আর ওইসব ভানুসিংহের পদাবলিই একমাত্র শিল্প? নাকি মেয়ে-কলিগ দেখে ওই মেয়েগুলি কলিগই নয়? শারমিনের কথাতেও তো কিছু যুক্তি ছিল, তাই না? জামি ভাই যদি আমার হতো? যদি আমার ঘোষণা-দিয়ে-বলতে পারছি-না-তবু-বয়ফ্রেন্ড হতো? রূপা হারামজাদিকে হিপোক্রিট তো বলতামই বলতাম আমি।

জামি ভাই বা জামি ভাইয়ের মতো কেউ যে আমার হলেও হতে পারতো, মানে যদি আমি আর সব মেয়ের মতো হতাম, আমার সপ্তাহান্তে কোম্পানিগঞ্জফেরত বর বুঝি তা জানত। সাব্বির বড়ো ভালো মানুষ— ও পুরুষলোক হিসেবে একটু হীনম্মন্য, তাই ওর ভিতর আমার মতো হীনম্মন্য মেয়ের জন্য অনেক মায়া আর অনেকানেক কলায় আমাকে আয়ত্তাধীন করে ফেলার একটা নিবিড় উদ্যম ছিল, ভালো ছাত্ররা এমন তপস্বী হয়; তখন তো আর ও জানত না যে, আমার পুরুষলোক ভালো লাগে না। শারমিন ছিল সাব্বিরের ছায়াশিক্ষক — কয়েকদিন পরপর এসে ‘জামায়ণ’-এর বাণী দিয়ে যেত আর সাব্বির ছিল জামি ভাইয়ের ভাবশিষ্য। “বুঝলেন, সাব্বির ভাই, আপনার বউ তো খালি সারা দিন আমারে বলে তুই বেশি সাজিস, তুই বেশি শাড়ি-গয়না-জুতা-ব্যাগ কিনিস। কিনবই তো, ওকে? জামি ভাই তো ওইদিন আমাদেরকে জিগেস করলেন, বলো তো, ইওরোপের সমস্ত লাক্সারি ব্র্যান্ড কেন এশিয়ায় আসতেছে? দেখি বলেন তো আপনি, কেন চায়নায় আসতেছে? না, হয় নাই। এশিয়ান মেয়েদের হাতে এখন অনেক অনেক ডিসপোজাল ইনকাম। ওকে? ডিসপোজাল ইনকাম মানে বুঝলেন তো? মাসের সব বড়ো বড়ো খরচ করার পর মানে বাড়িভাড়া, বুয়ার বেতন, বাজার-সদাই, গাড়ির তেল, সিএনজি ভাড়া এইসব-এইসব সারার পর হাতখরচের যেই পয়সাটা থাকে, ওইটা। তো আমাদের হাতে এখন দুনিয়ার সমস্ত কনজ্যুমার গুড্স কেনার টাকা। ওকে? আমরা ফ্যামিলির ভিতর থাকি, আঠারো হইলেই লাফ দিয়ে বিদেশীদের মতন নিজের বাসায় উঠি না। তারপরে ধরেন, জামাইয়ের সাপোর্ট। ওকে? আমাদের হাতে এখন পয়সা। গুচি, ভারসাচি, এভি, ম্যাকের লিপস্টিক, ওকে?”

জামায়ণের আরও কয়েকটা কাণ্ড ছিল; একটা ছিল নামকাণ্ড—একবার পরিচয় হওয়ার পর আজীবন কারও নাম না-ভোলার বুদ্ধি, জনসংযোগে নাকি এইসব কাজে আসে। যেমন, কোনো ক্লায়েন্টের রিসেপশনিস্টের নাম যদি হয় মেরিনা, তাহলে সেই রিসেপশনিস্টের চেহারার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে মনে-মনে বারবার বলতে হবে, মেরিনা, মেরিনা, মেরিনা”, তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে ব্রেনকে এই নতুন ডাটা সেইভ করার টাইম দিতে হবে, তারপর চোখ বুঁজতে হবে, চোখ বুজে মেরিনার চেহারাটা মনে করতে হবে, তারপর চোখ খুলে মেরিনার সাথে কথা বলা শুরু করতে হবে; কথা বলার সময় প্রত্যেকটা বাক্যের শুরুতে, শেষে আর মাঝে ‘মেরিনা’ শব্দটা ব্যবহার করতে হবে। এতে মেরিনাকে যেমন সহজে খুশি করা যাবে—কারণ কে না জানে মানুষের কানে সবচেয়ে সুমধুর ঠেকে নিজের নামগান-তেমন সারা জীবনের জন্য মেরিনাকে মনে রাখার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। জামি ভাইয়ের বডি অভ নলেজে এমন আরেকটা কাণ্ড ছিল সত্যকাণ্ড। “সেল্স পিচে যাওয়ার আগে আজকে জামি ভাই বলতেছিলেন, বুঝলি, সত্যি আর মিথ্যা—দুইটাই কনফিডেন্টলি বলতে হয়। ওকে? তাতে মিথ্যা অবশ্যই সত্যি হয়া যায় না; কিন্তু সত্যি তার প্রেডিকটিভ ফেস-ভ্যালু হারায়। একটু ফিলোসফিক্যাল তো। ওয়াও। না?” রূপার বর বাপ্পি ভাই বলতো শারমিনের বস নাকি শারমিনের জীবনের সবচেয়ে কোটেবল পার্সন। “জামি ভাই বলছে, নিজের মাকে খুন করা উচিত; ওকে?”—এই কথা বলে শারমিন ওর আম্মু-আন্টিকে যে-কোনো দিন মেরে ফেললেও নাকি বাপ্পি ভাই অবাক হবে না। পাতাপচা গরমে বার্গারের দোকানে বসে এইসব বলতে বলতে বাপ্পি ভাই দেখলাম ওয়েটারকে ডেকে বিল দিলো। খানিক পরে দেখলাম, কী ভেবে আবার ওয়েটারকে হাতের ইশারায় ডেকে আনলো আর তারপর ওদের কালো-খয়াটে রেক্সিনে বাঁধানো বিলের ফোল্ডারের ভিতর গুনে-গুনে দশ পার্সেন্ট টিন্স দিলো। টিপ্স দিতে-দিতে বাপ্পি ভাই এমন একটা ষড়যন্ত্রী রবিন হুডের হাসি হাসল, যেন ওয়েটারের সাথে ওর কতদিনের বা জটিল, মহান ও গোপন আঁতাত। বাপ্পি ভাইয়ের উপরও কি জামি ভাই আছর করেছে?

“দোস্তো, শোন না। তুই কি জানিস ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের দাম কীরকম হয়?” শারমিন নিজের গায়ের জামা দুইদিক থেকে খামচে টেনে ধরে আমার ঘরের আয়নার গায়ে প্রায় মুখ ঠেকিয়ে মনোযোগ দিয়ে নিজের বুক দেখছিল। আয়নার গায়ে ওর নিশ্বাসের বাষ্প জমছিল।

“আমি কোত্থেকে জানব? আবার তোর মাথায় এইসব ভূত চাপছে?” আমার মনে পড়ল সেভেনে পড়তে মুখে একবার এক্সপায়ার্ড চন্দনবাটা কি উপটান মেখে শারমিনের সমস্ত মুখে পাকা পাকা বিচি উঠেছিল। নাইনে পড়তে ওর আব্বু-আংকেলের রেজর দিয়ে বগল চাঁছতে গিয়ে বগলে একটা দশমাথাওলা রাবণগোটা বাঁধিয়েছিল। ইউনিভার্সিটি আমলে এক হাতুড়ে জাপানি ডার্মাটোলজিস্টের ক্যালিগ্রাফি-আঁকা কাগজের পর্দা-ঝোলানো দোকানে গিয়ে বলেছিল, “আমার ওই জায়গা অনেক কালো, ফরসা করে দাও।”

“কালকে রাতে স্বপ্নে দেখলাম, প্লেনে উঠতেছি আর আমার অনেক ভয় করতেছে। জামি ভাই বলতেছেন, ধুরো বোকা মেয়ে, ফ্যান্টাসি কিংডমে রোলার কোস্টারে উঠছ না? প্লেন তো সেই রকমই একটা জিনিস। তারপর দেখলাম, রোলার কোস্টারে সেই যে লোকটা সিটবেল্ট ঠিকঠাক বানছি কি না চেক করার বাহানায় একে-একে আমাদের প্রত্যেকের বুকে হাত দিছিল—আরে ওই লোকটা! মনে নাই?— তো ওই লোকটা রাস্তার পাশে দেখি আইসক্রিম বেচতেছে। ওকে? কী হাস্যকর না? জামি ভাই বলল, এইটা ব্যাংকক। আমি বললাম, জামি ভাই, আমি কিন্তু হাতে একটা প্রজাপতি ট্যাটু করব, ওকে? ব্যাংককের ট্যাটু যে শস্তা, স্বপ্নের মধ্যেও আমি ভুলি নাই। ওকে? হাহা। উনি আমারে ট্যাটু করায়া দিলেন একটা পার্লারে নিয়া গিয়া। স্বপ্নে আমার আর মনে হয় নাই যে, আমাদের তো লন্ডন যাওয়ার কথা ছিল কনফারেন্স করতে। আমরা ব্যাংকক ক্যান? তারপর দেখলাম আবারও আইসক্রিম খাইতেছি। আইসক্রিম খাইতে খাইতে আমি উনারে বলতেছি যে, উনারে ছাইড়া যামু গিয়া। লোকে খারাপ বলে আর তাছাড়া উনার তো বউও আছে। ওকে? উনি অনেক কানলেন। তারপর কী কী বললেন, সব মনে নাই। খালি মনে আছে কানতে কানতে বলতেছেন, উনার এক এক্স-কলিগ নাকি মেয়ে লাগাইতে ব্যাংকক গিয়া ভুলে একটা তিনকোনা মাছের কাঁটা গিলে ফেলছে। তারপর যতই পানি খায় আর ঢোঁক গিলে, ততই নাকি ওই তিনকাঁটা উনার গলবিল চিরতে চিরতে নিচে নামে। এক ইঞ্চি, এক ইঞ্চি করে চিরতে চিরতে কাঁটাটা শেষে উনার পাকস্থলিতে গেল, আর তখনই লোকটা লাস্ট এক ঢোঁক পানি গিলে প্লেটের উপরে মাথা রেখে একা একা মরে গেল। এইসব শুনতে শুনতে দেখি আমিও আর আইসক্রিমের ভ্যানের পাশে নাই। আমি একটা রেস্টোর‍্যান্টে মাংশ খাইতেছি একলা। সামনে একটা শাদা প্লেট রাখা আমারও। ওকে? তারপর শোন না—সেই প্লেটের উপর যেই মাংশের বড়ো ড্যালাটা রাখা, দেখি, ওইটার মধ্যে আরবিতে আল্লাহর নাম লিখা। আমি আল্লাহরে বলি, আল্লাহ, আমি এই ট্যাটু উঠায়া ফালাব, আল্লাহ। আমি এরপর থেকে প্রত্যেকটা রোজা রাখব, হিজাব করব আল্লাহ। কবজি পর্যন্ত জামার হাতা পরব। হাতের নখ পর্যন্ত ঢেকে রাখব, ওকে? তারপর আর কিছু মনে নাই। তারপর তো ঘুমই ভাইঙ্গা গেল।”

“তোর এই পুরা স্বপ্ন ক্যামনে মনে আছে? নাকি চাপা মারতেছিস?”

“আরে, না না। সকালে তো আরও মনে ছিল। এখন অনেকটুক ভুইলা গেছি। সূর্য যত মাথার উপর উঠে, স্বপ্নের স্মৃতি তত হালকা হইতে থাকে। আম্মু বলছিল।”

“ট্যাটু পরে উঠাইছিলি আর? মনে কইরা দ্যাখ।”

সেইটা আর মনে নাই রে। আমি তো এই স্বপ্ন দেখার আগে জানতামই না যে, একবার ট্যাটু কইরা ফেললে আবার পয়সা দিয়া ট্যাটুর দাগ উঠানো যায়। ওকে? সকালে গুগল করে দেখলাম যে, সেইটাও করা যায়। তবে ট্যাটু করার চেয়ে ট্যাটু উঠানোর দশগুণ দাম। শুনছি অনেকসময় স্কিনে ইনফেকশনও হয়ে যায়। ভাগ্যিস সত্যি সত্যি ট্যাটু করি নাই!” শারমিন ওর নিজের হাতের চামড়ার উপর মায়ের হাতের মতো হাত বোলাতে থাকল।

*

ক্লাস এইটের প্রথম ছয় মাস আমাদের সবার শুধু একটা স্বপ্নই ছিল। কোনো একদিন আমাদের পাসপোর্ট হবে; আর আমরা সবাই মিলে প্লেনে করে পাকিস্তান যাব।

আমার সত্যি সত্যি মনে নাই, কবে কখন কীভাবে আমরা ছয় বান্ধবী এই স্বপ্নের ব্যাপারে একমত হলাম। তবে খুব ভালো মনে আছে, ইংলিশ গ্রামারের ম্যাডাম, যাকে আমরা ‘হায়না’ বলে ডাকতাম, একদিন ক্লাসে ফিউচার পারফেক্ট টেন্সের উদাহরণ চেয়েছিল আর শারমিন আমাদের সবার ঠ্যালাঠেলি খেয়ে হাত তুলে অ্যাকাবেঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে লজ্জা-লজ্জা গলায় বলেছিল, “আপা, আফটার আই শ্যাল হ্যাভ গ্রোন ওল্ডার, আই শ্যাল ফ্লাই টু পাকিস্তান”। হায়না ভাঙা গলায় বলেছিল, “অ্যাবসোলিউটলি কারেক্ট!” হায়না জবাব দেওয়ার সাথে-সাথে আমরা ছয় জন সমবেত হাততালিতে ভেঙে পড়েছিলাম ছয়টার-এক সেট কাচের বাটির মতো। শারমিন একেবারে মিস ইন্ডিয়া হয়ে দুই গালে হাত দিয়ে বসে পড়েছিল; ওর বিশ্বাসই হচ্ছিল না যেন এই প্রস্তাবের জবাবে শিক্ষক-অভিভাবক অর্থাৎ শত্রুপক্ষের মুখ থেকে ওই রকম সর্বাত্মক ‘হ্যাঁ’ আসতে পারে। আহা, সেইদিন শারমিনটা সাহস করে দাঁড়িয়ে আমাদের সম্মিলিত স্বপ্নের কথা ইংরেজিতে মানে সাংকেতিক ভাষায় সবাইকে জানিয়ে দিয়ে যা করেছিল, তা এখনো আমাদের সবার মুখেমুখে ফেরে! আমাদের চারপাশের তিক্ত মহিলাগুলি-হায়না, পাবদা, সিটিএন, ফাটা ফুটবল, নাগাসাকি এইসব নাম যাদের, যাদের চোখের সামনে আমরা আমাদের স্কুল-ইউনিফর্মের চিকন, শাদা, ভি-ওড়নাটাকে পারলে ময়দার লেইয়ের মতো চওড়া করে বিছিয়ে নিজেদের রুটি-বেলার পিঁড়ির মতো বুকহীন করে রাখতাম, যাদের নিয়ম মোতাবেক আমরা সকালের সমাবেশে লাইন ধরে দাঁড়াতাম আর কুচকাওয়াজ করতাম–পিটার প্যাটার রেইন, যারা হেঁটে আসতে থাকলে আমরা একে অন্যের কোমরে জড়িয়ে রাখা আমাদের হাত চকিতে সরিয়ে নিতাম, যাদের ভয়ে আমরা নিচু হয়ে স্কুল-কেডসের ফিতা বাঁধতাম না, পাছে আমাদের গোপন যৌবন প্রকাশ্যে চলে আসে, তাদের কাছ থেকে – হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাদের কাছ থেকেই—আমাদের সম্মিলিত প্রেমের ব্যাপারে সম্মতি আদায় করে এনেছিল আমাদের দলপতি শারমিন। স্বাগতিক দলকে হারিয়ে একটা সবুজ সূর্যসংকেত ছিনিয়ে আনা, যাকে বলে একটা অ্যাডভেঞ্চার, আমরা সবাই মিলে করতে চাই, আর সেই অ্যাডভেঞ্চারের শেষ সীমানারেখার উপর দিয়ে আমরা সাঁই-সাঁই করে পৌঁছে যাচ্ছিলাম (কোনো একদিন বল চলে যাবে মাঠের বাইরে) যেই ভবিষ্যৎ কোনোভাবেই সম্ভাব্যতার ভিতর পড়ে না, সেই ভবিষ্যতের একদম মধ্যবিন্দুতে।

যেসব পাকিস্তানি ছেলেদের আমরা চিনতাম, তাদেরকে আমরা নিজেদের মধ্যে ভাগ-যোগ করে নিয়েছিলাম। মিশু নিয়েছিল আমির সোহেল, সুরভী আকিব জাভেদ। ওয়াসিম আকরামের বয়স একটু বেশি হওয়ায় শান্তা শুরুতে একটু দোনোমোনো করলেও পরে মেনে নিয়েছিল। রূপা আর শারমিন তো ছিল এক বনে এক বাঘের দুই মাথা—কামড়াকামড়ি সম্ভব নয়, সেটা নিয়মও নয়, কিন্তু ওদের মধ্যে একটা টেনশন তো চলছিলই সবচেয়ে এলিজিবল ছেলেটাকে নিয়ে। শারমিন একদিন স্কুলের মাঠে নিয়ে এসেছিল ওই ছেলেটার লাল শর্টস পরা অর্থাৎ ফরসা লোমশ পা বের করা একটা ছবির পোস্টকার্ড–প্যান্টের হাই অস্বাভাবিক রকমের হাই। পোস্টকার্ডটা মেয়েদের কাড়াকাড়িতে দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল। ছেলেটার নাকি বয়স সতেরো হয় নাই। নাম শুনলাম শহিদ আফ্রোদিতি। সেইদিন স্কুল ভলিবলের ম্যাচ ছিল; পিটি আপা ফুররর- ফুররর করে বাঁশি বাজিয়ে মেয়ের দলকে ছত্রভঙ্গ করেছিলেন। ভলিবল টিমে ছিল শুধু শারমিন; আমরা কেউ অত লম্বা না আর মাথা উঁচু করে কাঁধের কাছ থেকে দুই হাত ‘এসো, আমাকে হাতকড়া পরিয়ে নাও’ রকমের মুদ্রায় বাড়িয়ে ধরে বলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকা আর সূর্যের মাঝখান থেকে ক্রমে পড়তে থাকা বলের গায়ে হাতের ওই চুড়ি পরার জায়গাটা দিয়ে সর্বশক্তিতে আঘাত করার ক্ষমতা শুধু শারমিনেরই ছিল। আর কী যে অদ্ভুত – বাংলা ফার্স্ট পেপার টেক্সটবুকের দ্রবময়ীর গায়ে যেমন পালাজ্বর আসত কয়দিন পরপর ঘুরে-ঘুরে, তেমন দুই-তিন সপ্তাহ পরপর শারমিনেরও মাসিক হতো, ইরেগুলার। ওইদিনও সেইম ছিল; খেলতে খেলতে নীল ইউনিফর্মের পাছা লাল হয়ে গিয়েছিল ওর। ফাইনালে কোন হাউজ জিতেছিল, এখন আর মনে নাই; তবে দুই বান্ধবীর মধ্যেকার ডেডলক ওইদিনই সেটল হয়ে যায়—রূপা ওয়াকার ইউনিসকে নিজের বলে মেনে নেয়। এরপর পুরা স্কুলের সব মেয়েদের মধ্যে একটা প্রেমঘটিত বৈকল্য ছড়িয়ে পড়ে— হায়না বলেছিল, ‘ম্যাস হিস্টিরিয়া’—কয়েকশ মেয়ে যৌবনের আগুনে পুড়ে যায়। সি সেকশনের তাহমিনা কাঁটাকম্পাস দিয়ে হাত কেটে কার যেন নাম লেখে। কানিজ ফাতেমার গোপন ডায়েরি ধরা পড়ে, যে ডায়েরি পুরাটাই একটা প্রেমপত্র; সেটা শুরু হয় সোনু নিগামকে দিয়ে আর শেষ হয় ক্লাস টেনের নতুন ফিজিক্স স্যারকে (‘টেসলা’) দিয়ে।

মাস ছয়েক কি আষ্টেক পর পেপসির বিজ্ঞাপন আর টিভির সবুজ মাঠ থেকে দিগন্তরেখায় বসে থাকা এই আমাদের কাছে সশরীরে উঠে এসেছিল আফ্রোদিতি ছেলেটা। তখন তো গাছপাকা ফল আর মাঠপাকা ফসলের দিন; বৃত্তি-পরীক্ষার রেজাল্ট আসবে-প্রত্যেক বছরের মতো ওই বছরও কে ট্যালেন্টপুল আর কে জেনারেল গ্রেড, সেই খবর লীক হয়ে গিয়েছিল। শোনা যাচ্ছিল রূপা জেনারেল; মনটা খারাপ ছিল বেচারির। কমার্সের ফারজানার সাথে সিকরুমের বিছানায় আমাকে খুঁজে পেয়েছিল ‘ফাটা ফুটবল’– আমরা দুইজন শুধু ওড়না-পায়জামা খুলে শুয়ে ছিলাম; প্রমিস, আর কিছু করি নাই, তবু সমস্ত শত্রুপক্ষ জিঘাংসা নিয়ে হামলে পড়েছিল আমাদের উপর। রূপা ছাড়া আমাদের আর সব বান্ধবী আমাকে মনে-মনে ত্যাজ্য করেছিল। শারমিন তো ওর উঁচু দাত দুইটা বের করে হাসতে হাসতে “কী রে? সিকরুমে গিয়া সিকগিরি করতেছিলি?” পর্যন্ত বলেছিল। রূপা আগেও আমাকে অসংখ্যবার বাঁচিয়েছিল আমাদের বাকি বান্ধবীদের রোষ আর হিংস্রতা থেকে; সেইবারও “বেচারি রেজাল্টের টেনশনে একটু পাগলামি করে ফেলছে। বাদ দে না!” বলে আমার পক্ষ নিয়েছিল রূপা। আমরা তো ভালো ছাত্রী; কমার্সের ফারজানার সাথে আমি কেন এত মিশতে গেলাম আর আমাকে এইসব মানায় কি না, নিরালায় এইসব জিজ্ঞেস করে আমাকে ওই যাত্রা ছেড়ে দিয়েছিল রূপা। রূপার বশংবদ হয়ে যাওয়ার কারণে ফারজানাকে —ফজুকে— দেখলেই আমি এরপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতাম। ফজু বেচারি স্কুল বদলাবে—এমন কথাও শোনা যাচ্ছিল। “বদলাক স্কুল। ওরে টিসি দিক। তোরে নষ্ট করছে তো ও-ই।’ ওদের সাথে-সাথে আমারও একবার মনে হলো না, কেন সেই ফরসা-সুন্দর পাকিস্তানি ছেলেদের উপর আমি কখনো নিজস্ব ক্লেইম নিয়ে চড়াও হই নাই, কেন ‘আচ্ছা, তাইলে আমি কি সাইদ আনোয়ারকে নিব?’ বলে আমার বান্ধবীদের সাথে মুলামুলি করি নাই, কেন ‘সবাই করছে তাই আমিও করলাম’ রকমের আহা-উহু ওই আফ্রোদিতিকে নিয়ে করলেও—এমনকি ওর নাম যে আফ্রোদিতি না, আফ্রিদি, সেটাও আমি জেনেছিলাম অতদিন পর—আমি মাধুরী, কাজল, জুহি চাওলার ছবি আর ব্রা-প্যান্টির বিজ্ঞাপনের কাটিং জমাতাম, কেন স্কুলের মাঠে টিফিন নিয়ে হুটাপাটি করার সময় নাকে শারমিনের পোলাওগন্ধী চুল আর পিঠে ওর বুকের চাপ লাগলে গা শিরশিরিয়ে উঠত। শীতকালে মালীরা ছুটিতে গেলে পরে স্কুলের মাঠের শুকনা পাতাগুলি ঝাড়বাহিনী ডাইনির দ্রুত নিঃশ্বাসে একধার থেকে আরেকধারে গড়িয়ে যেত— চোখের পলকে——অতটুকু আমি দেখেছিলাম। জীবনে ওই রকম ফাস্ট টেম্পো থাকা চাই; কোনো ভাবনা, দেয়ালে- ক্লাসঘরে-স্টাফরুমের আলমারিতে ঝুলে থাকা কোনো তীব্র গম্ভীর সংলাপের কোনো কণা, সেই পলকে পলকে যাপিত জীবনে বেশি সময় পেতে পারবে না, এমনই নিয়ম। লাইফ হলো ননি; সেটা ঘুঁটতে ঘুঁটতে অল্প টাইম থেকে আরও অল্প টাইম বের করে দিচ্ছিল কেউ আমাদেরকে, তার উপর আমাদের শত্রুপক্ষ তো সারা ক্ষণ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল যে আমাদের টাইম আসলে আমাদের নিজেদের নয়, আমাদের টাইম আসলে ওদের কাছ থেকেই ধারকর্জ করে নেওয়া। তো টিভির ভিতর থেকে ওই আফ্রোদিতি-না-আফ্রিদি যদি সেই বছর ইন্ডিপেন্ডেন্ট কাপ খেলতে ঢাকায় না আসত, কার অত টাইম থাকত ওকে নিয়ে পড়ে থাকবার? ততদিনে যুগল হংসরাজও পুরানো হয়ে গিয়েছিল, তারপর আমাদের আকরাম খান একটু হৃষ্টপুষ্ট হলেও, পাইলট তো শুকনা—এইসব নতুন কনসিডারেশন বিস্তার লাভ করছিল, সংসদ অধিবেশনে ‘হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে, হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে, হ্যাঁ জয়যুক্ত’ হয়েছিল। কমবয়সি মেয়েদের মন ‘চিতচকোর’ ইত্যাদি হলে কী হবে? চকোরের যত পিপাসাই লাগুক বাপ, আজীবন একখানে তো থাকবে না; পাখনা থাকলে ভিন্ন জলাশয়ে উড়ে যাবে চাঁদের টলটলে ছায়া দেখতে। আম্মারা বলত, “কানে ফোন, হাতে টিভির রিমোট আর টিভিতে ডিশের লাইন থাকলে তো মেয়েদের পাখনাও লাগে না, ভাবি!”

বৃত্তি-পরীক্ষার রেজাল্ট আমাদের প্রত্যেকেরই বেশ খারাপ হলো। সবার ফলাফল একই রকম খারাপ আসায় আমাদের শত্রুপক্ষের কালেকটিভ অবসেশন কয়েক মাসের জন্য ঠিক হয়ে গেল, আমাদের গোটা স্কুলকে ইচ্ছা করে ডাউন দেওয়া হয়েছে—মর্মে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব দাঁড় করানো হলো এবং তাতে আমরা একে অন্যের সাথে তুলনায় নামার অসুস্থতা থেকে রেহাই পেলাম। আম্মারা কোনোদিন আমাদেরকে লক্ষ্মী ময়ে, সোনা মেয়ে বলত না ফোনে বলাবলি করল, “মায়ের নজরই কি লাগল শেষে, ভাবি? আল্লাহপাক ছাড়া আর সত্যি সত্যটা কে জানে?” এদিকে মাস না গড়াতেই সমস্ত স্কুলে আবার একটা বিপুল তরঙ্গ বয়ে গেল–শারমিনের আব্বু-আংকেল শারমিনের বার্থডে উপলক্ষ্যে মেয়েকে অগ্রিম গিফট দিচ্ছেন শহিদ আফ্রিদির সাথে এক সন্ধ্যা, সাথে শারমিনের পাঁচ বান্ধবীও থাকবে। পুরা ইন্ডিয়া আর পাকিস্তান ক্রিকেট টিম বাংলাদেশে এসেছিল ইন্ডিপেন্ডেন্ট কাপ খেলতে। সবাই জানত, সবগুলি খেলাতেই বাংলাদেশ হারবে, কিন্তু সেটা কোনো বিষয় নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সিলভার জুবিলি আর শারমিনের সুইট সিক্সটিন্থ বার্থডে গোলেমালে একই সময়ে চলে আসলো- দুইটাই আমাদের যার-যার জগতের চেয়ে অনেক বড়ো ঘটনা। আমরা যখন শারমিনের চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম কীভাবে ওর আব্বু-আংকেল উনার পুরানো ডিজি সাহেবকে হাত করে সোনারগাঁও হোটেলের স্যুইটে আফ্রিদির সাথে আমাদের একান্তে কিছু সময় কাটানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, আমাদের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল; শারমিনের গলা কাঁপছিল, হাত কাঁপছিল। স্কুলের বারান্দায় আমরা একদল উন্মাদিনির মতো গড়াতে-গড়াতে চিৎকার করছিলাম। এলোপাতাড়ি হাত ছুঁড়ছিলাম যার-যার বুকের মাঝখানটা মুঠি করে, যেন একটা অদৃশ্য কলিজাফুলের মালা ছিঁড়ে-বিড়ে চারিদিকে ছিটিয়ে দিচ্ছিলাম, যেন আমাদের একটা নিজস্ব দেশ মাত্রই স্বাধীন হয়েছিল। ইয়াল্লাহ, এটা কী হলো? সত্যিই? কিন্তু আমাদের ইংরেজি তো খুব খারাপ! আমরা কি হিন্দিতে কথা বলব? আর বাসা? আমরা বাসায় কী বলব?

আফ্রিদির সাথে দেখা করতে শেষমেশ আমার বান্ধবীরা আমাকে নিয়ে যায় নাই; আমাকে বাথরুমে রেখে ওরা গাড়ি করে চলে গেছিল। বাকিটা মিসঅ্যাডভেঞ্চার।

রূপার বাসা বরাবরই আমাদের যে-কোনো এক্সপেডিশনের শুরুর বিন্দু। ফেব্রুয়ারিতেই তো বাসায় কিছু না বলে আমরা রূপার বাসা থেকে রিকশা করে বইমেলায় গিয়েছিলাম। মাস দুয়েক আগেই আবার দল বেঁধে গিয়েছিলাম নিউ মার্কেট; ফোটোগ্রাফির দোকানে নানান পারমুটেশনে কম্বিনেশন করে দাঁড়িয়ে গ্রুপ ফোটো তুলেছিলাম; প্রত্যেকটা সোনার দোকানে হানা দিয়েছিলাম – সানন্দা, আমিন, আপন; দোকানিদের বলেছিলাম, বিয়ের জড়োয়া গয়না নামিয়ে দিতে। ওদের দোকানের স্পটলাইট পড়া বিশাল- বিশাল আয়নার সামনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কেউ মিনাকারি করা আর কেউ নবরত্ন বসানো চোকার-সীতাহার গলার কাছে আলতো করে ধরে হবু বধূর মতো মুখ টিপে হেসেছিলাম একে অন্যের দিকে তাকিয়ে, হিন্দুরা যেমন বরের দিকে তাকায় শুভদৃষ্টির সময়। তো সেবারও শারমিনের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাব, বলায় আমাদেরকে রূপার বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমরা অনেক সময় নষ্ট করেছিলাম সোনারগাঁও যাওয়ার জামা বাছতে গিয়ে। তারপর কে কোন শেডের লিপস্টিক লাগাব আর আইশ্যাডো লাগাব, সেইসব নিয়েও কিছু কালক্ষেপণ হলো। ঘণ্টাখানেক গেল সুরভীর ইলেকট্রিক রেজর দিয়ে গণে পায়ের লোম চাঁছতে। আফ্রিদিকে আমরা কী কী বলব, তার একটা স্ক্রিপ্টের মতো তৈরি করতে হলো। “আব্বু বলছে, লবিতে আমার জন্য বেলুন আর কেক থাকবে”—শারমিন এই কথা বলার পর আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমাদের ছয়জনের কাফেলা কেমন নকশার হবে—খিলানের মতো নাকি চলন্ত পিরামিডের মতো, কে কার সামনে থাকবে, শারমিনকে ব্যূহের ভিতর কীভাবে দাঁড় করালে মধ্যেখানে কলাগাছ বা কলাবউয়ের মতো ও ফুটে থাকবে, আফ্রিদির হাতে হাত রেখে ও কেমন করে কেক কাটলে ভালো হবে—এইসব নির্ণয়ে; যেন আমাদের সখীরানির বিবাহ হচ্ছিল। এত বড়ো আয়োজনের মধ্যে শেষ মুহূর্তের তাড়াহুড়ায় আমাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার কথা তো ওরা ভুলে যেতেই পারে, তাই না? এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল; আর শেষ মুহূর্তেই আমার টয়লেট চাপতে হলো! আমার ব্লাডার এত দুর্বল কেন?

রাতের দিকে জানতে পারলাম, শারমিন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে গেছে। “কী হইছিল রে?”

“জানি না। বলে নাই আমারে। সব তো ঠিকঠাকই যাইতেছিল। আংকেল আমাদেরকে আফ্রিদির রুমে নিয়ে গেল। লবিতে আফ্রিদি ঢুকলে মিডিয়া-টিডিয়া গেঞ্জাম করতো, ওইজন্য কেকও ওই স্যুইটের মধ্যেই কাটাকাটি হইল। শারমিন কী যে ঢংটা করল, যদি দেখতি! আর সিনেমার মতো হিন্দিতে কথা, ইস! আমি কিন্তু ইংলিশেই বলছি। মিশু তো কয়েকবার তোতলাইল, বাংলা-হিন্দি মিলায়া। পনেরো মিনিটও টাইম দেয় নাই। আর ওয় তো একটা ধামড়া ব্যাটা। টিভিতে দেখতেই বেশি ভালো দেখা যায়। ওর বয়স নাকি সতেরো! বাইশের থেকে এক পয়সাও কম না।”

“কান্নাকাটি কখন হইল?”

“আমরা তো খোদা হাফেজ বলে বের হয়েই গেলাম। আংকেল ড্রাইভার ডাকতে গেছিল। শারমিনের তো তেল কমে না; বলল চিঠি লিখছে নাকি; আফ্রিদিরে দিতে ভুইলা গেছে। আচ্ছা, বল, ওর কী দরকার ছিল একা-একা ওইরম একটা হুমদা ব্যাটাছেলের রুমে যাওয়ার?”

“চিঠি লিখছে মানে? এমন কোনো প্ল্যান তো হয় নাই! তারপর?”

“তারপরে তো কানল। দুঃখী নায়িকার মতো দৌড় দিয়া বের হয়ে আসলো। আমার হ্যান্ডব্যাগ থেকে টিস্যু চাইলো। ভাগ্যিস আংকেল দেখে নাই!”

“আফ্রিদি ওর সাথে খারাপ কিছু করে নাই তো?”

“খারাপ কী করবে?”

আমি চুপ করে গেলাম। রূপা বোকা মেয়ে না।

পাকিস্তানি হারামজাদা! আসলেই তো, আমার মাথায় আসে নাই এইটা। বহুত হইছে পাইক্কাদের নিয়ে মাতামাতি। আমি আম্মাকে বলে দিব। ইস। পুরা গা ঘিনঘিন করতেছে রে! ভালো হইছে তুই যাস নাই….” তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে আমাদের নিজ-নিজ মনঘরের কোনায় ফাঁদে আটকা অপাপবিদ্ধ টিনএজ ইঁদুরগুলিকে এক- এক ঠ্যাং ধরে তুলে নিয়ে আমরা ইটাল মেরে ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম। ওই মুহূর্তে আমাদের কিশোরীবেলা খতম হয়ে গেল। ওতে আমাদের কোনোরকম অনুশোচনা হলো না। আমরা খুশি হয়ে ভাবলাম, অকুস্থল পরিষ্কার। কোস্ট ক্লিয়ার।

“আন্টিকে বলিস না। ভেজাল হয়ে যাবে। বুঝলি?”

“আচ্ছা। দেখি।”

“তোরা এমনে আমাকে ফালায়া চলে গেলি…”

জানা কথা, রূপা বরাবর বাথরুমে যাওয়ার আগেও আমাদেরকে ওর রুম থেকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিত, শারমিন বলতো, ওর আমেরিকান মামির পাঠানো লিপস্টিক আর অন্যসব সাজের জিনিস যদি আমরা চুরি করে নিয়ে যাই, সেই ভয়ে—ওতে আমাদের তেমন অপমান হয় নাই, কিন্তু সেইদিন সারা দিন একটা ঝিমঝিমে কানে- তালা-লেগে-যাওয়া অপমান নিয়ে আমি রূপার ঘরে বন্দি হয়ে ছিলাম। লাগোয়া বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখি, ওরা সবাই আফ্রিদির কাছে চলে গেছে; সালমার মা-র নাকি হাতটান আছে, তাই অভ্যাসবশে নিজের ঘর বাইরে থেকে লক করে গেছে রূপা। বিছানা জুড়ে সব্বার ছেড়ে যাওয়া ঘর্মাক্ত জামা, ওড়না আর সোনার জলে নাম-লেখা শস্তা সাজের বাক্স পড়েছিল। ঘরময় পারফিউমের গন্ধ। রেজর দিয়ে চাঁছা ছয়জোড়া পায়ের লোম উড়ছিল ফ্লোরের উপর, অসংখ্য ফুলের কেশর ছিঁড়েছে যেন কেউ। ছিঃ। আমার বয়সি একটা মেয়ের ফেলে যাওয়া ঘর যে কত বাসি, বদবু-ওলা, শ্যাওলা-চিতি-ছাতাপড়া সবুজ হতে পারে, এই বিষয়টা এতদিন আমরা আর আমাদের আম্মারা কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলাম? ওর ঘরের সাথে যে বারান্দাটা, সেখানে দড়িতে ঝোলানো সোঁদা টাওয়েলের পিছনে মুখ লুকিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। মনে হচ্ছিল, যেন বনবাসে এসে আমার সব হারিয়ে গেছে। কী করি, আমি কী করি, আমি কী করি? বারান্দার ফুলগাছের পাতায়-পাতায় অজস্র ধুলা, কয়েকটা পাতা পোকায় কি মাকড়শায় কাটা, গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাউজওয়াইফের গলার মতো ডাঁটি বের করে ফুটেছিল একটা কটকটে লাল ফুল। রাস্তায় একটা ফেরিওলা চোখ ড্যাবড্যাব করে একটা মেয়ের পিছন দেখছিল — মেয়েটার কামিজের পিঠ গভীর করে কাটা, তাতে আবার ফিতা লাগানো আর ফিতাটা হালকা করে বাঁধা; মেয়েটার পিঠে একটা নগ্ন হার্ট-শেইপ ফুটে উঠেছিল। মেয়েটা চলে গেলে পরে ফেরিওলাটা তার নীল লুঙ্গিতে ঢেউ তুলে প্রায় থাই পর্যন্ত অনাবৃত করে একটা বিড়ালকে জোরসে লাথি দিলো। কেন আমাকে ওরা সবসময় এমন অবহেলা করে? আমি কি এতই অদ্ভুত? ভাইয়া ছোটোবেলায় আমাকে ডাকত সাইকো কিড; কিন্তু এখন তো আর আমি ছোটো নই। আমি তো আমার বান্ধবীদের মতোই সাজপোশাক পরি, ওদের মতোই কথা বলি, ওদের কত-কত বিশ্রম্ভালাপ মনের ভিতরে শুধু টোকা মেরেই সরে যায়, তবু তো আমি ভাণ করি ওইসব হাবিজাবি ডে-ড্রিমিং আমার পরানে একদম পশে যাচ্ছে। কেন, কেন তবু ওরা আমাকে দেখতে পারে না? কেন হাসতে হাসতে আমাকে লেসবিয়ান বলে গালি দেয়? রূপার আম্মু-আন্টি অফিস থেকে ফিরে দরজা খুলে না-দিলে আমি তো না-খেয়েই মরতাম, ছুটির ঘণ্টা সিনেমার ওই অসহ্য ছেলেটার মতো।

“হইছে। এখন আবার তুই কান্দন শুরু করিস না, বাপ। তোদেরকে ঘরের ভিতর ঢুকতে দেওয়াই ভুল হইছে আমার।” রূপা একবার স্যরি পর্যন্ত বলল না। অভিমানে আমি নিশ্চুপ হয়ে গেলাম।

স্কুলে এরপর আমরা সেই সন্ধ্যার বিষয়ে আর একটিবারও মুখ খুললাম না। সি সেকশনের মেয়েরা লুকিয়ে স্কুলে রেডিও নিয়ে আসা শুরু করল। অফ-পিরিয়ডে স্কুলের মাঠে বসে-বসে ক্রিকেটের বাংলা ধারাভাষ্য শোনার দস্তুর চালু হলো। স্টেডিয়াম কাঁপছিল তিন দেশের হেভিওয়েটদের ভারে। পুরা স্কুল ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানে ভাগ হয়ে গেল। বাংলাদেশ প্রত্যেক ম্যাচে গোহারা হারল। শারমিনের প্রতি আমাদের একটা নীরব দায়িত্ব ছিল, তাই আমরা ওইসব ভিড়ের ধারে-কাছে ভিড়লাম না। কোন এক মেয়ে নাকি বিশাল এক প্ল্যাকার্ডে ‘ম্যারি মি, আফ্রিদি’ লিখে গ্যালারিতে দাঁড়িয়েছিল, টিভিতে সবাই দেখেছে। সি সেকশনের জিনিয়া এসে টিপ্পনি কেটে বলে গেল, “কী রে? ওই মাইয়া কে? আমাদের শারমিন না তো?” আর আমরা অর্থাৎ শারমিনের পদাতিক সেনার দল মুখ-চোখ কঠিন করে বললাম, “বাজে কথা আরেকবার বললে সিধা প্রিন্সিপাল আপার রুমে নিয়ে যাব।” জিওগ্রাফির মনিরা আপা স্তেপ-তৃণভূমি নিয়ে এক লাইন পড়াতেন, তো দুই লাইন দিতেন নীতিশিক্ষা; উনি বললেন, “মিনিমাম আত্মসম্মান থাকলে কেমন করে একটা বাঙালি মেয়ে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে ওই রকম বেহায়ার মতো একজন পাকিস্তানি প্লেয়ারকে বিয়ে করতে চাইতে পারে! সমস্ত জাতির কাপড় খুলে উলঙ্গ করে দিয়েছে এই মেয়ে।” মনিরা আপার নেতৃত্বে পুরা ক্লাসরুমভরতি মেয়ের দল সমস্ত শরীর ঘুরিয়ে লাস্ট বেঞ্চে বসা আমাদের দিকে রোষের দৃষ্টিতে চেয়ে রইল, অথচ এই মেয়েরাই অফ-পিরিয়ডে কেউ পাকিস্তান আর কেউ ইন্ডিয়ার জন্য জান দিয়ে দিত। এদিকে শারমিন ছাত্রী বিশেষ ভালো নয় দেখে, দিন দুয়েকের মধ্যে ওর স্কুলজীবন দুর্বিষহ করে তুলল শত্রুপক্ষ। শোনা গেল, সহপাঠী মেয়েদেরকে অনৈতিক আচরণে প্ররোচিত করার অপরাধে ওকে কয়েক সপ্তাহের জন্য সাসপেন্ড করা হবে। ওকে মাথায় তুলে নষ্ট করার দায়ে ওর আব্বু-আংকেলকেও স্কুলে ডেকে আনা হলো। উনি শত্রুপক্ষকে নরম ভাষায় বলে গেলেন যে, ভালো ছাত্রীদের মধ্যেও কেউ-কেউ আছে, অনৈতিক কাজকারবারে দড়; কেউ-কেউ সমকামীও আছে—তাদের বিষয়ে সতর্ক হওয়ার সময় হয়েছে। সর্বনাশ! শত্রুপক্ষের সকলের দৃষ্টি তখন ঘুরে গেছে আমার উপর। শারমিনের নাকিকান্না আর বান্ধবীদের পাহারাদারির মাঝখানে আমি একলা এক রাজবন্দির মতন দাঁড়িয়ে রইলাম ছেলেদের প্যান্ট-শার্ট-পাম্পশু পরে। সবশেষে প্রিন্সিপাল আপার রুমে আমাকে যখন ডেকে পাঠানো হলো, আপাকে একটা ডায়েরির পাতা দেখিয়ে রূপা আমাকে ছাড়িয়ে আনলো ওই ঠান্ডা ঘর থেকে। ওই কাগজের এক পৃষ্ঠায় অবিকল আমার হাতের লেখায় লেখা ছিল:

বিশ্বকাপ শেষ হলো। এবারও টিভিতে ওয়াকারকে দেখে আশ মিটল না। আরও চার-চারটি বছরের অপেক্ষা। চার বছর পর ও হবে আরও পরিপক্ব খেলোয়াড়, আর আমিও তখন পূর্ণযুবতী। আমাদের যখন সন্তান হবে, ক্রিকেট খেলাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করব ওকে আমি। মা হিসেবে এ আমার অঙ্গীকার।

চিরকুটের আরেক পৃষ্ঠায় একটা স্তম্ভের আকারে লেখা ছিল কয়েকটি আরবি নাম— রেহান, সাফওয়ান, নামির, আশকার, ফাদির, হামজা, আয়মান। ওয়াকার ইউনিস আর আমার সম্ভাব্য ছেলেসন্তানের নাম তো আরবিতেই রাখা হবে, নাকি? স্টাফ-রুমের প্যাসেজে রূপা বিরলে আমার হাত ধরল আর চোখ টিপল।

*

মেয়ে হওয়ার আনন্দে সাব্বির বেশ খানিকটা ফরসা হয়ে গেছে; মেয়ে যেন আমার ভিতর থেকে বের হয়ে সাব্বিরের ভিতরে খানিকটা ঢুকে গেছে।

মেয়ে আমার এমন কেন হলো? বিছানায় শুতেই চায় না। সারা ক্ষণ বুকের সাথে লেপ্টে রাখতে হয় ওকে। ঘুমিয়ে গেছে ভেবে, দৈবাৎ কখনো শোয়াতে গেলে চামড়ার ওম মিস করে, টের পায়, ঘুম ভেঙে কেঁদে ওঠে। সাব্বির রাত-দিন সেইসব ভিডিও করে আর ওর ফ্রেন্ডদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পাঠায়। আর আমার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ? সেখানে দিনভর কাজিয়া আর কলতলার সালিশ। আমার মেয়ে হওয়ার পর হসপিটালে রূপা আমাকে দেখতে গিয়ে ওর বর বাপ্পি ভাইকে নাকি আবিষ্কার করেছে হসপিটালের নিচে, উনি নাকি মহাচিন্তায় মুখ কালো করে সিগারেট ফুঁকছিলেন। শারমিনের যে বাচ্চাটা নষ্ট হলো, ওটা আসলে বাপ্পি ভাইয়ের। রূপার চোখকে ফাঁকি দিয়ে এতদিন পরকীয়া চালিয়ে গেছে, কিন্তু এখন দুইজনই স্বীকার করে নিয়েছে। আমার পক্ষে এসব আর নেওয়া সম্ভব না; ক্ষীরের পুতুলের মতো একটা মেয়ে হলো আমার, আমার, আমার; কিন্তু ওরা সেই স্কুলজীবন থেকে শুধু পড়ে আছে ওদের নষ্টামি, ওদের কেলেঙ্কারি আর ওদের হিংস্র খুনাখুনি নিয়ে। আমি কেউ না ওদের। ঠিক আছে। আমার মেয়েও ওদের কেউ না। গ্রুপ চ্যাট মিউট করে রেখেছি। আমি সাব্বিরকে চাই নাই। যাকে চেয়েছিলাম, তাকে চাওয়া বারণ। সাব্বিরের কাছে আমি সত্য লুকাই নাই; সাব্বির আর ওর দয়ার্দ্র চোখ দুইটাও আমাকে প্রতারণা করে নাই, প্রায় হাতজোড় করে বলেছে, “একটা বাচ্চা চাই।” বলেছে, আমাদের যৌথতাকে সুন্দর, সহনীয় আর নিঃসন্দেহ করতে হলেও আমাদের বাচ্চা চাই, বাচ্চা, বাচ্চা, বাচ্চা চাই—একবার বাচ্চা হয়ে গেলে সাব্বির আর আমাকে বিছানায় চাইবে না; আমি আবার পুরানো আমির মতো আমার ক্লজেটে ঢুকে যেতে পারব। আমি মেনে নিয়েছিলাম। আমি ছেলে চেয়েছিলাম। “তুই হওয়ার পর তোর সোনা ফুপি বলছিল কী জানিস? বলছিল, এইবার হইছে একটা মাগি”, আম্মা আমার চুলে বেণি বাঁধতে বাঁধতে হাসতে- হাসতে বলেছিল। আমি হিক্কা তুলে কেঁদেছিলাম। সোনা ফুপি আমাকে এমন গালি দিতে পারে বুঝি? আমাকে কাঁদতে দেখে আম্মা আরও জোরে জোরে হেসেছিল। সাব্বিরকে সেদিন বললাম এই গল্প, সাব্বির বিশ্বাসই করতে পারে নাই। উলটা মেয়ের গালে একটা আঙুল ছুঁইয়ে আমার দিকে সন্দিগ্ধ চোখে চেয়েছে, যেন আমার কোলে ওর মেয়ে সেইফ না–ঢং—যেন ওর মেয়ের জন্য হুমকি হচ্ছি আমি, যেন দশ-পনেরো বছর আগেও সাব্বিররা দলে-বলে অন্য কারও মেয়েকে এলিফ্যান্ট রোডের রাস্তায় কি কোচিং সেন্টারের বাইরে চড় মারে নাই, যেন প্রেমে কোনো মেয়ে ‘হ্যাঁ’ না-বললে কমপক্ষে তার চরিত্রে কালি দেওয়ার হুমকি দেয় নাই।

আম্মা হাতে গরম ইস্ত্রি নিয়ে ঘরে ঢুকল, মেয়ের পেটে নাকি সেঁক দিতে হবে; আমি আঁতকে উঠলাম। “ধুর, বোকা। মেয়ের পেটে গ্যাস হইছে, টের পাস না? দ্যাখ খালি কান্দে আর কেমন মুলার মতো গন্ধ। তোরে কত সেঁক দিছি! তুই আরামে ঘুমায়া যাইতি।” আম্মা বিছানার উপর এসে বসল। আমি আম্মার পেটের কাছে মাথা নিয়ে গেলাম, মনে হলো, ওখানেই আমি আজীবন বন্দি হয়ে আছি; কখনো আমাকে পেট চিরে বের করা হয় নাই। কোনখান থেকে যেন একটা সুর আসলো কানে, যেন খুঁতখুঁতে মেজাজের কেউ অনেকক্ষণ ধরে একটা দোতারা টিউনিং করছে। “ধুর বোকা। ওইটা তুলাধুনার শব্দ।” হজরত মনসুর হাল্লাজ নামে নাকি এক ফকির ছিলেন—আউলিয়া একজন; উনি নাকি একটা তুলার স্তূপের দিকে তাকানোমাত্র পুরা স্তূপটা ধুনা কমপ্লিট হয়ে যেত, সেই থেকে উনার নাম হলো হাল্লাজ — আরবি শব্দ — এর অর্থ হচ্ছে ধুনকার। “আম্মা, আম্মা, ধুন মানে তো সুর। গানের সুর। হিন্দিতে…।”

“আচ্ছা, বাপ, আচ্ছা।” আম্মা সমানে ওলি-আউলিয়াদের কথা বলে যেতে লাগল—আহারে, দিল্লি গেলাম, নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজার দেখলাম কিন্তু আজমির দেখলাম না; রাস্তায় তো অ্যাক্সিডেন্ট হলেও হতে পারতো—এইসব। আমার আর আম্মার কপালগুণে মেয়ে আমার একটু ঘুমিয়েছে। বাসায় কোনো হেল্পিং হ্যান্ড না-থাকায় আম্মা আমার ঘর ঠিকমতো রেডি করতে পারে নাই। ফ্লোরের উপর ডাঁই করে রাখা অজস্র পুরানো পত্রিকা ধ্বংসপ্রাপ্ত পুরাকীর্তির আধভাঙা স্তম্ভের মতো সারা ঘরজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আম্মাকে ভাইয়া ডাকে হোর্ডার- খালি পুরানো জিনিস জমায়; কিছুই ফেলে না। জানালার কাছে ওই নারকেল গাছটা আর নাই; মরা ডালে বসতো যে মরা চোখওলা কাকটা, সে বুঝি মরেছে।

আম্মা বিছানার উপর পেপার পেতে দিয়ে খাবারের প্লেট সাজিয়ে দিলো। গ্লাসে পানি ঢালার শব্দে আমার পেশাব পেতে থাকল— মেয়ে হওয়ার পর ব্লাডার আরও দুর্বল হয়ে গেছে। হসপিটাল থেকে ফিরেছি পর আমার খাওয়ার রুচি নাই। আম্মা সালাদের বাটিতে লেবু কেটে বিছানায় পাতা পেপারের উপর রাখল, ইংলিশ পেপার। সেই কবে ভাইয়া স্যাট দেওয়ার জন্য ইংলিশ পেপার রাখা শুরু করেছিল, সেই থেকে বাসায় প্রতি শুক্রবার ইংলিশ পেপার দিয়ে যায়, কেউ ছুঁয়েও দেখে না। ঝোলের বাটির নিচে একটা হেডলাইন হারিয়ে গেছে; অস্ট্রেলিয়ার এক ফেমিনিস্ট বুড়ি মারা গেছে, তাই পত্রিকার সাহিত্যপাতায় বুড়ির লেখা ছেপেছে বড়ো করে। এত বড়ো ইংলিশ আর্টিকেল পড়তে পারি না। বক্স করে দিয়েছে শুধু এই অংশটুকু:

The compelled mother loves her child as the caged bird sings.
The song does not justify the cage, nor the… <আর দেখা যাচ্ছিল না। >

*

শারমিন বাসায় হাজির আমাদের সেই স্যুটকেসটা ঠেলতে ঠেলতে, এতদিন পর ওটা ফেরত দেওয়ার কথা মনে হলো ওর। ড্রয়িং রুম থেকে প্যাসেজ পেরিয়ে আমার রুমে ঢুকতে ওকে অসংখ্য ডুমো ডুমো পুঁতির মালা ঝোলানো পর্দার ভিতর দিয়ে আসতে হয়েছে—নিঃশব্দ আগমন ওর দ্বারা সম্ভব নয়, এমনকি ও নিজে চাইলেও নয়। ওর পায়ে রানিং শু— ভেজা আর নোংরা। মেঝের উপর ছোপ-ছোপ পড়েছে। শারমিনের চালচলনে প্রাপ্তবয়স্ক সংবদ্ধতা ছিল না একফোঁটা, এখনো নাই— বাচ্চাদের মতো অনির্দেশ্য, কেমন ঢেপসা আর র‍্যান্ডম ওর মুভমেন্ট। ঘরে ঢোকার মুখে চৌকাঠে নিচু হয়ে বসে ভেজা জুতার ফিতার লুপ একটা-একটা করে টেনে-টেনে খুলতে লাগল ও; আগের মতো ‘সই, ভালো করে বিনোদবেণী’ রকমের অসহায় মুখ বানিয়ে আমার দিকে তাকাল না একবারও; গোঁয়ারের মতো মাথা নামিয়ে জুতা খুলতে লাগল।

“আল্লাহ, ঘরের অবস্থা দেখো!” শারমিন নিজের ক্লামজি অবস্থা থেকে আমার চোখ সরাতে চাইল। নবজাতকের ঘর তো এমনই হয়; আর ও আমার মেয়েকে দেখতে এসেছে নাকি আমার ঘর দেখতে এসেছে? আমি এইসব বলায় ও লজ্জা পেয়ে নৌকার মতো হাত করে সেই হাতের কোটরে মেয়েকে তুলে নিল। আমরা ব্লিডিং-এর অবস্থা জিজ্ঞেস করলাম একে অন্যকে, পেশাদার ধাত্রীদের মতো। “ডাক্তারগুলি সারা দিন সি সেকশনের বুদ্ধি দেয়, কিন্তু নিজের বউদেরকে বলে লেবার পেইন সহ্য করতে। তোরা কিন্তু হিপোক্রিট আছস।” আমি হাসলাম। ভাব দেখালাম, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কী হচ্ছে, না-হচ্ছে, কিছুই আমি জানি না। শারমিন প্রত্যেকটা বাক্য শেষ করছিল এমনভাবে, যেন ওর মাথার উপরেই একটা ফলের গাছ বাতাসে দুলছে আর গাছের ডালে ধরে থাকা পাকা-পাকা ফলগুলি একটুর জন্য ওর নাগালের বাইরে আর ও আশা করছে বাতাসের তোড়ে একটা ফল ডাল থেকে ছিন্ন হয়ে ওর হাতে আসবে—তাই ও ক্ষণে-ক্ষণে করুণ দৃষ্টিতে ফলটার দিকে, মানে আমার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু আমি ধরা তো দেবো না, আহারে, আমায় পাবে না, পাবে না, আহারে!

মেঝের উপর খোলা ডায়াপারের পাহাড়, সেইসব অতিক্রম করে শারমিন ঘরের কোনায় রাখা পুরানো পত্রিকার স্তূপের কাছে চলে গেল। তারপর মেয়েকে কোলের উপর দোলাতে-দোলাতে বলল, “আরে! ইংলিশ পেপারেই আসছিল আমাদের ছবি। আমি আর বাপ্পি ভাই সামনাসামনি বসে আছি লিটল ইটালিতে। মানে আশুলিয়ায় পিৎজা খাইতেছিলাম। ওকে? লিটল ইটালির রিভিউ আসছিল তো। পত্রিকার ফোটোগ্রাফারদের কোনো আক্কেল নাই। একবার পারমিশনও চায় নাই। বাপ্পি ভাইয়ের জায়গায় যদি জামি ভাই থাকত একদম ওদেরকে স্যু করতো, ওকে?”

“আচ্ছা, ভালো কথা, তোর জামি ভাইয়ের কী খবর? অনেকদিন কিছু শুনি না। “ তবু আমি বাপ্পি ভাইয়ের টপিকের আশেপাশেও যাব না।

“উনাকে স্টেপ ডাউন করতে বলছে বোর্ড থেকে। পয়সা নিয়ে কিছু কমপ্লেইন ছিল; আমাদের কর্পোরেট সেল্সের কাজে তো বুঝিসই, পয়সা খাওয়ানোর রেওয়াজ আছে, ওকে? আর তাছাড়া এক মেয়ে কমপ্লেইন করছিল। ভাগ্যিস আমার প্রোমোশনের রেকমেন্ডেশনটা আগে করে দিয়ে গেছিল ব্যাটা। নতুন বস আসতেছে। এইবার আর প্রেম করব না, প্রমিস! এইবার প্রেম-ট্রেম দেখে অন্যদিকে তাকায়া থাকব। ওকে? খুশি? হি হি…

“শারমিন, একটা কথা বলি। কিছু মনে করিস না, ওকে? তোর কি একবারও মনে হয়, আংকেল বেঁচে থাকলে কী বলতেন?”

আমাদের বিয়ের ঠিক পরপর শারমিনের আব্বু-আংকেল মারা যান। একদিন বাসার ছাদে গেলেন – আত্মহত্যা না, পানির ট্যাংকি চেক করতে— আর ফেরেন নাই। ফরেনসিক প্যাথোলজি থেকে ভুলভাল রিপোর্ট আসে, যদিও সাব্বির মোটামুটি নিশ্চিত যে, ওটা কার্বন-মনোক্সাইড পয়জনিং ছিল। অনেকদিন ধরেই ট্যাংকিতে গ্যাস জমা হচ্ছিল তো। শারমিনের আব্বু-আংকেল তামাশার লোক ছিলেন, একটু পাগলা সায়েন্টিস্টও। মাঠা থেকে ইলেকট্রিসিটি বানানোর কথা কে আগে শুনেছে? উনার মনোহর পাগলামি দেখতে-দেখতে কারও আর মনে থাকত না যে, উনার প্রথম পক্ষের বউ-বাচ্চা ছিল গ্রামে। শারমিনের আম্মু-আন্টিকে উনি উনার ভাতিজার পাত্রী হিসেবে পছন্দ করতে গিয়েছিলেন; নিজের পছন্দ হয়ে যাওয়ায় নিজেই বিয়ে করে ফেরেন তারপর। আমার আর সাব্বিরের বিয়েতে আংকেল অনেক দোয়া করেছিলেন। ততদিনে উনার মেহেদি দেওয়া কমলা দাড়ি হয়েছিল। আমার মাথায় হাত দিয়ে সাব্বিরের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে আংকেল বলেছিলেন, “বাবা, এরা কিন্তু ডিয়ারিং মেয়ে, ডিয়ারিং মেয়ে।” সাব্বির আর আমি এত হেসেছিলাম পরে—এরপর থেকে নাটক-সিনেমায় জীবনে কোনো সাহসী-সংগ্রামী মেয়ে দেখলেই আমরা বলতাম ডিয়ারিং মেয়ে।

শারমিন আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল, কোলে মেয়ে। পিছনে নীল-কমলা পর্দাটানা জানালা থেকে চাপা আলো ঠিকরাচ্ছিল; গির্জায় রঙিন স্টেইন্ড কাচের ভিতর দিয়ে ওই রকম আলো আসে। শারমিন যদি বিদেশীদের মতো ফরসা হতো, তাহলে ওকে কুমারী মাতা মেরি বলে মনে হতো। রূপের কম্পিটিশনে আমি রূপার কাছে হেরে গেলেও শারমিন সহজে হার মানার নয়—চর্চা করতে-করতে শারমিন অনেক দূর চলে গেছে। দেখলাম, গাঢ় করে ভুরু এঁকেছে শারমিন-একটা রামকোকিলের ডানার মতো মুখের দুইদিকে ছড়িয়ে গেছে রেখা দুইটা।

“শোন। আমার আর বাপ্পি ভাইয়ের ওই এক সপ্তাহের ঘটনা, ওইটা কেউ মনে রাখবে না, ওকে? লাইফে আরও অনেক বড়ো-বড়ো জিনিস হয়।”

‘হুঁ। বড়ো-বড়ো জিনিস হয়। যেমন ধর, আমার মেয়ে হইছে। এইটা বড়ো জিনিসই তো। কই তোদের তো তাতে কিছু আসলো-গেল না!”

“মেয়ে হইছে, অবশ্যই বড়ো জিনিস”, শারমিন হঠাৎ মেয়েকে হাতের কোলের মধ্যে নতুন করে দোলাতে শুরু করল, যেন হঠাৎ ওর মনে পড়ে গেছে যে, আমার মেয়ে হয়েছে। “আমারও বাপ্পি ভাইয়ের সাথে একটা মিসক্যারেজ হইছে। তার আগে আমার জামি ভাইয়ের সাথে ব্রেকআপ হইছে। তারও আগে আমার জামাইয়ের সাথে সেপারেশন হইছে। ওকে? বাকিদের কথা বাদ দিলাম, তুই আর রূপা তো কই আমার কোনো বড়ো জিনিসরে আমার বড়ো জিনিস হিসেবে দেখিস নাই! তোরা আমার প্রোমোশন হওয়া নিয়ে কতই না আহা-উহু করলি; কই আমার এনগেজমেন্ট রিং দেইখা তোরা তো সিনেমার বিদেশী মেয়েদের মতো চিল্লাচিল্লি করলি না! কেন করস নাই, আমি জানি। তোরা তো ভালোই জানোস, এইসব সিনেমা-টাইপ ব্যাপার আমার ভাল্লাগে, তাই তোরা ক্যালকুলেশন কইরা ঠিক করছস, এইসব আমারে তোরা দিবি না। ওকে? তোদের যেইটা ঠিক মনে হবে, শুধু সেইটায় তোরা আমারে আশকারা দিবি। যেমন, প্রোমোশন হওয়া। প্রোমোশন হওয়া তোদের চোখে ঠিক আছে। বসের সাথে সেক্স করা তোদের চোখে ঠিক নাই। ওইটা খারাপ। বন্ধুর জামাইয়ের সাথে সেক্স করাও ঠিক নাই। ওইটাও খারাপ। আমি আসলে কে? আমি কি তোদের একটা বইয়ের মেয়ে?”

“না, তুই আমাদের সিনেমার মেয়ে।”

শারমিন আমার খোঁচা পাত্তা দিলো না। “তোদের মুখে সারা জীবন শুনলাম, শারমিন একটা বাজে মেয়ে। শারমিন শাড়ি পরলে নাভি দেখা যায়। শারমিনের সেক্স বেশি মানলাম, সেক্স বেশি। ওকে? মানলাম, আমি অ্যাবনরমাল। ওকে? তোরা খুব নরমাল নাকি রে? মনে করছস, তোর বাচ্চা হইছে, তাই তুই নরমাল হইয়া গেলি? মানে আমার বাচ্চাটা যদি নষ্ট না হইত, আমিও নরমাল হইয়া যাইতাম? ওকে? গোঁজামিল দিয়া বুঝ দিতি যে, শারমিন নরমাল, শারমিনের বাচ্চা নরমাল, শারমিনের জামাইও নরমাল; ওই লোক শারমিনরে পিটাইলেও বাচ্চা দিয়া যায়, যেই বাচ্চা আবার দেখতে বাপ্পি ভাইয়ের মতো… তোদের এইসব বালের নরমালরে আমি ***, ওকে?”

মেয়ে কোলে নিয়ে শারমিন অবলীলায় গালিগালাজ করে গেল আমাদেরকে। গালির মধ্যে মধ্যে যতবার ‘ওকে? ওকে?’ বলছিল ও, ততবার ওর গলা ভেঙে আসছিল, কিন্তু ওর চোখে একফোঁটা পানিও ছিল না। আমার সমস্ত শরীর গুলিয়ে কান্না পাচ্ছিল— বিবেক-টিবেক ওইসব নয়–আমার মেয়েকে আমি আমার কোলে চাই। আম্মা একবার হসপিটালে ছিল, পাশের বেড়ে ছিল সর্বাঙ্গে ব্যান্ডেজ বাঁধা এক রোগিণী। তখনো ভাইয়া-ভাবির বিয়ে হয় নাই; আম্মার বেডের পাশে বসে ভাইয়া চিৎকার করতে- করতে ঝগড়া করছিল আম্মার সাথে। কী নিয়ে ঝগড়া, এখন আর মনে নাই; মনে হয় ভাবিকে নিয়ে। আম্মাকে মাগি ডেকেছিল ভাইয়া ওইদিন। ছি। আমি টের পাচ্ছিলাম, পাশের বেডের শাদা ব্যান্ডেজ-ক্যাসপার মহিলাটা অতিকষ্টে উনার ঘাড় নাড়িয়ে নিঃশব্দে প্রতিবাদ করছিলেন। কিন্তু ওই রকম একজন ইনভ্যালিড মানুষ তো মানুষই না—নোবডি। ভূত। ওই রকম ভূতের উপস্থিতিতে সব কথা বলা যায় একে অন্যকে। কিছুই আটকায় না। কিন্তু, কিন্তু, কিন্তু আমার মেয়ে তো ভূত না। আমার মেয়ে তো নোবডি না। “দে দেখি। দে ওকে”, বলে আমি বিছানা ডিঙিয়ে মেয়েকে টেনে নিলাম। মেয়ে কাঁদছিল না। ক্ষণে অবাক, ক্ষণে বিরক্ত হয়ে দেখছিল শারমিনকে। তবু আমি ওর পাছায় তালে-তালে হালকা চাপড় দিয়ে বললাম, “না, না।”

শারমিন বিছানায় এসে বসল প্রথমে। জুত হচ্ছিল না দেখে, উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল সরীসৃপের মতো। তারপর মেয়ের সাথে এই প্রথম দীর্ঘ দৃষ্টিবিনিময় করল। খিলখিল-খুলখুল করে হাসল। মেয়েকে নানান অদ্ভুত-অদ্ভুত নামে ডাকল, কয়েকটা নাম সুরে-সুরে ইম্প্রোভাইজ করল। তারপর আমার দিকে ফিরল।

“একটা জিনিস দেখবি? দ্যাখ, দ্যাখ। আমার ডান ভুরু অর্ধেকটা নাই।”

শারমিন ওর ঘামে ভেজা হাত আমার থাইয়ের উপর রেখে ভর দিয়ে উঠে আমাকে ওর ভুরু দেখাল। আমি “ইয়াল্লাহ!” বলে চোখ বড়ো-বড়ো করলাম। শারমিন মতিচ্ছন্নের মতো হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে আমার বিছানার উপর চিত হয়ে গেল—ওর মাথা মেয়ের কাঁথার উপর; হাত দুইটা বুকে বাঁধা।

“তোর মনে আছে, আমরা মেয়েরা মিলে যে একবার ছন্দ সিনেমা হলে দুপুরের শো দেখতে গেছিলাম?”

“হুঁ। কী একটা জানি ছবি ছিল। কী বিশ্রী!” নায়ক ছিল কাজী মারুফ, নায়িকাটা ছিল দৃষ্টিকটু-রকমের বিশালবক্ষা; নাম মনে নাই। চুমুর সিনে কিম্বা নায়িকার বুকে নায়কের সসম্মানে মাথা-ঘষার সিনে হলভরতি লোকেরা সবাই মিলে একটু পরপর গালি দিয়ে উঠছিল। সে কী ম্যাডনেস! আমরাও সমানে গালি দিচ্ছিলাম। রূপা আমাদের সামনের রোতে বসেছিল—ও বাপ্পি ভাইকে নিয়ে এসেছিল আর একটু পরপর ঘেন্নায় চোখ বুঁজে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছিল। পর্দার আলোতে ওর ফকফকা ফরসা পিঠভরতি লাল- লাল তিল দেখা যাচ্ছিল। ওর ব্লাউজের হাতা বরাবরই ঢলঢলা; ও মনে করতো ব্লাউজ ফুঁড়ে মৃণালভুজ-শেইপ যদি স্পষ্ট বোঝা যায়, তাহলে মেয়েদের বড়ো অশালীন লাগে, তখন সমস্ত বুকে শাড়ির আঁচল দলা পাকিয়ে ফেলে রাখলেও কাজ হয় না।

“কাজী মারুফের সাথে বাপ্পি ভাইয়ের চেহারার কী মিল, না?” এহ। রূপার বর আর তার বিশাল বিশাল রোমকূপওলা নাক ফসিল হয়ে যাওয়া প্রবালখণ্ডের মতো দেখতে—চোখে ভেসে উঠল আমার। কাজী মারুফের যেমন ‘ভোঁতা তলোয়ার টাইপ যৌবন’ ছিল, বাপ্পি ভাইয়েরও নাকি তেমন, শারমিন বলল।

“ওই, থাম। টিএমআই। “

“টিএমআই মানে কী? ডাক্তারি টার্ম কোনো?”

“টিএমআই=টু মাচ ইনফরমেশন। এইসব জানতে চাই নাই।”

ততক্ষণে আমাদের দুই বান্ধবীর মন আশুলিয়ার মাঠ—আগাছা, চোরকাঁটা। বাপ্পি ভাইয়ের অফিস উত্তরায়। উত্তরা পেরিয়ে গেলেই ঢাকা শহরের আর কোনো শেইপ নাই—কে না জানে? এরপরে শহর অসংবদ্ধ, টঙ্গি আর আশুলিয়া দুই পায়ের মতো দুইদিকে ছড়ানো। তুরাগ নদী অনেকটা ভরাট হয়ে গেছে, কিন্তু তবু নৌকা চলে। শারমিন আর বাপ্পি ভাই কোনো এক নৌকার মাঝিকে বখশিস দিয়ে গলুইয়ের দুইদিকে প্লাস্টিকের পর্দা গুঁজে সেক্স করেছে। তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছিল, ওদের পাছার নিচে নদীর প্রাত্যহিক ঢলাঢলি ইত্যাদি; শারমিন ওই মুহূর্তটাকে স্মরণীয় করে রাখতে ব্যাগ থেকে মোমবাতি বের করেছিল। বাপ্পি ভাইয়ের প্যান্টের পকেটে লাইটার ছিল। সিনেমার মতো মোমবাতি জ্বালিয়ে করবে—আহা, কী শখ!

“তুই কি পারভার্ট নাকি রে?”

“এই যে শুরু হইল তোর…, ইচ্ছা হইছিল, ওকে? কেমন একটা গ্রামের ঘরের মতো ব্যাপার।”

“তারপর?”

“তারপরে তো… হি হি… ভুরু পুড়ে গেল অর্ধেক। ভাগ্যিস চামড়ায় লাগে নাই। চুলপোড়া গন্ধ সাথে-সাথে, হা হা… আমি বাপ্পি ভাইকে বললাম, আর করব না।”

“উনি শুনল?”

“নাহ। শুনে নাই হারামজাদা। ফুঁ দিয়া মোমবাতি নিভায়া চালায়া গেছে। এত ব্যথা দিছে। ওকে? আমি বললাম, ইউ আর রেইপিং মি।”

“আল্লাহ!”

মেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। শারমিন মুখ নামিয়ে মেয়ের গলার কাছের গন্ধ নিল। “মাঝি ফেরত আসলো। বলল, কাছেই কোথায় এক মেয়েলোকের লাশ ভাসতেছে। যেই মাঝি লাশটা স্পট করছে, সে নাকি প্রথমে ভাবছে একটা ঝাড়ু ভাসতেছে, ওকে? তারপর নৌকা নিয়া কাছে গিয়ে দেখে লাশ নদীর পানিতে ঠান্ডা হয়ে শক্ত হয়ে আছে। হাঁটু নাকি থুতনির কাছে চইলা আসছে। চুলে মুখ ঢাকা। হাত মুঠি করা। গায়ে কাপড় নাই। কী ভয়ংকর! বুঝলি? পরে যখন আল্ট্রাসোনো রিপোর্টে বাচ্চার ছবি দেখছিলাম, মনে হইছিল, ওই, ওই, ওই মেয়েলোকটা ভাসতেছে অ্যামিবাটিক ফ্লুইডে।”

“অ্যামনিওটিক ফ্লুইড।’

হুঁ। ওইটা। এমন ভয়ের ছিল আশুলিয়ার ওই সন্ধ্যাটা। আর সাথে আমার ওই জায়গায় প্রচণ্ড ব্যথা। বাপ্পি ভাই আমার মন অন্য দিকে ফিরাইতে তুরাগের পারে মাছ নিয়া দামাদামি করল। পাঁচ কেজির একটা মাছ হাতে তুলে দেখল। মহাশোল না কী যেন মাছ। আমাকে বলল সেলফি নিব কি না। “

“এই রকম একটা আকাট লোকের সাথে…”

“হ। আকাট লোকের সাথে রূপা সংসার করে। সেইটা ভাব আগে।”

রূপা সবসময় বিশ্বস্ত বটগাছের মতো আমার জন্য শিকড় নামিয়ে দিয়েছে। আমি কি রূপাকে এইসব বলব? এখন না হোক, পরে এক সময়? বলে কী হবে?

“ওইটা টেকনিকালি রেইপ ছিল।”

“হুঁ। কী আর?”

“জানালাটা একটু খুলে দিবি?”

“ওই, ঠিক আছিস তুই?”

আমার দমবন্ধ লাগছিল। ব্লাডার থেকে চাপ সরে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, মগজের কেন্দ্র থেকে শুরু করে চামড়ার নিচে, নাকের কোষে, হৃৎপিণ্ডের প্রকোষ্ঠে, জঙ্ঘার কোটরে বয়ে চলা সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রীকে পাটের আঁশের মতো টেনে-টেনে ছিঁড়ে নিয়ে একত্র করে কেউ যেন একপ্রান্তে খুব সযত্নে গিঁট দিয়ে একটা আঁটি বেঁধেছে, আর তারপর সেই আঁটিটাকে মানুষের মাথার খুলির মতো শেইপ দিয়েছে আর তারপর বিশাল একটা শাদা পলিথিন ব্যাগ নিয়ে ওই খুলিটার চারদিকে সজোরে পেঁচিয়ে ধরে স্নায়ুর ড্যালাটাকে শ্বাসরোধ করে খুন করতে উদ্যত হয়েছে।

“পানি খা।”

“পানি খাইলে পেশাব লাগে।”

“তো? করবি পেশাব। খা পানি। ওকে?”

শারমিন সাঁই-সাঁই করে পর্দা খুলে দিলো। ঘরে আলো আসলো। আমি পানি খেয়ে মিনিট পাঁচেক থম মেরে বসে রইলাম। পাশের অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দা পর্দাঘেরা। শারমিন আমার মাথার ঠিক মাঝখানে একদম ব্রহ্মতালুতে চুমু খেলো। ছুটির দিন। কে যেন গজল শুনছে কোন বাড়িতে।

“আইসসালা। গুলাম আলি! দুনিয়া ফারেবি দেতে হ্যায় … লা লা লা…”, শারমিন ভুলভাল গাইলো।

“গুলাম আলি ওই গায়কটা না, যারে শহিদ আফ্রিদির পছন্দ ছিল খুব?”

“হ রে! তোর এখনো মনে আছে? আফ্রিদি ব্যাটা তো আমার বার্থডে উপলক্ষ্যে গানও গাইছিল। দিল মেঁ এক লহর সি উঠি হ্যায় অভি। এইটা।”

“ও তো আরেক হারামজাদা।”

“হা হা। ওইদিন দেখলাম, কোন ইন্টারভিউতে বলতেছে, পাকিস্তানের মেয়েরা ক্রিকেট খেলতে পারে না। খাতুনদের বাসায় বসে রুটি বেলার পরামর্শ দিছে আমার আফ্রিদি ভাইয়া।”

“ওরে আবার ভাইয়া ডাকস? ভুইলা গেছস সব?”

‘ও কিন্তু আসলেই আমার সাথে খারাপ বরতাভ করে নাই রে। আমি রুমে ঢুকছি পরে খালি বলছিল, আমি দেখতে ওর বোনের মতো। বহেন বলছিল খালি। ওকে?”

“তাতেই তুই কাইন্দা কাইটা দুনিয়া উদ্ধার…”

“ছোটো ছিলাম তো।”

“হ। তুই তো সবার চেয়ে ছোটো। এই যে, আমার মেয়েও তোর চেয়ে বড়ো।”

“তুই বাথরুম করবি না? যা।”

“যাব পরে। তুই চুপ কর।”

“চল, আজকে একটা পরকীয়ার ডকুমেন্টারি দেখি। হু কিল্ড ডক্টর বোগল আর মিসেস চ্যান্ডলার, দেখবি?”

“কেমন?”

“শুনছি জোস। ট্রেইলার দেখবি?” ডক্টর বোগল আর মিসেস চ্যান্ডলার কোনো এক থার্টি-ফার্স্ট নাইটে পরকীয়া করতে নদীর ধারে যায়। সেখানেই ওদের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। পুলিশ, গোয়েন্দা, ময়নাতদন্তের লোকেরা, ভিকটিমের আত্মীয়স্বজন—সবাই মিলে মূল ঘটনা ধামাচাপা দিতে উঠে পড়ে লাগে। জনতার সন্দেহ গিয়ে পড়ে মহিলার বর, অর্থাৎ মিস্টার চ্যান্ডলারের উপর। দীর্ঘদিন পরে আবিষ্কার হয় যে, নদীদূষণের হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাসবর্জ্য ফুসফুসে যাওয়ায় ওরা মরেছে। শটগুলি কী সুন্দর! বিশাল বারান্দাওলা গোল টুপি, ফুল-ফুল ছাপের জামা। আটা-ময়দার মিল থেকে বর্জ্য এসে গলগল করে পড়ছে নদীতে। শহরের একটা মেইন সুয়ারেজ লাইন, যেটা নদীর নিচ দিয়ে যাচ্ছিল, তার একটা ভালভ খুলে গিয়ে জলের ঘূর্ণি করছে। নদীর গলা কেউ যেন টিপে ধরেছে; ক্লোজ শটে দেখা যাচ্ছিল নদীমুখে গ্যাজলার মতো শাদা ফেনা উঠেছে। নদী মরার আগে মেরে মরেছে ডক্টর বোগল আর মিসেস চ্যান্ডলারকে।

“প্রকৃতির প্রতিশোধ।” আমি বললাম।

“তোর মাথা।”

“না। তোর মাথা। পরকীয়া করতে গিয়া রেইপ হয়ে আসছস। আবার কথা কস।” শারমিন এইবার আর হাসল না। সিরিয়াস মুখ করে কী যেন ভাবল। সিনেমা চালু করল। এই প্রথম আমার সত্যি-সত্যি খারাপ লাগল।

“শোন, ওইদিন আমারে বাসায় নামায়া দেওয়ার সময় বাপ্পি ভাই অনেক কানছে। বলছে, শারমিন, তুমি আমারে রেইপিস্ট বললা? বলতে পারলা এমন কথা তুমি? আমার খুব মায়া লাগছে উনার কথা শুনে। বুঝলি? জীবনে কখনো কি আমরা একটা জিনিস দেখি? আমরা বরং… মনে কর… একটা জিনিসের চোখে আরেকটাকে কেমন দেখায়, সেইটা খেয়াল করি। ওকে? এই যে তুই, সংসার থেকে বাইর হইলি না। রাইট? এখন আর বাইর হইতে পারবিও না। এইটাকে বাইরে থেকে কেমন দেখা যায়, ভাবছিস?”

“ কেন আমি সংসার থেকে বাইর হব? আমি তো হ্যাপি। এখন আমার সুন্দর একটা বাচ্চাও আছে। হ্যাঁ, এইটা সত্যি যে, আমার কখনো-কখনো মনে হইছে যে, আমার ব্যাটাছেলেদেরকে ভালো লাগে না। কিন্তু শুধু মনে হওয়ার কারণে তো আর আমি সংসার ভাঙব না!”

“রূপা না, কী জানি বলে খালি? কনসেন্ট। সম্মতি। ওকে? তো তুই ঠিকই বলছিস। সারেন্ডার আর কনসেন্ট তো একই জিনিস।”

“এইসব জ্ঞানের আলাপ অফ কর। সিনেমার মধ্যে কথা বলতে ভাল্লাগে না।” শারমিন সিনেমা পজ করল। তারপর উঠে বসল। “আচ্ছা, এইবার বলব কথা?” অগভীর থাকতে পারার প্রতি যে গভীর কমিটমেন্ট শারমিনের ছিল, আমার নিষ্ঠুরতা আর হিপোক্রিসির কারণে সেটাও বুঝি ও হারাল। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।

“না। আমার বাথরুম পাইছে। আসতেছি, একটু দাঁড়া।”

বাথরুম থেকে এসে দেখলাম, মেয়ে তার শারমিন খালামণির কোলে দুলতে- দুলতে কাঁদছে। শারমিন ওর কান্না থামাতে মুখস্থ কবিতা বলছে—

বিল্লিগ্নি আর শিখলে যত টোবে
গালুমগিরি করছে ভেউয়ের ধারে
আর যতসব মিসে বোরোগোবে
মোমতারাদের গেবগেবিয়ে মারে।
তোর হাতেতেই জবরখাকি গেল?
শুধায় বাপে (না…) শুধায় মায়ে চামুক হাসি হেসে,
আয় বাছাধন আয় রে আমার কোলে…

“কোলে না, কোলে না। কেলো। আয় বাছাধন আয় রে আমার কেলো”, আমি ঠিক করে দিলাম।

“কেলো আবার কী জিনিস?”

“হইব কিছু একটা।”

সোনা ফুপি ঠিক এভাবে আমাকে ছড়া শোনাত আর ছড়া বলতে-বলতে ফ্লোরের উপর ছ্যাক করে থুতু ফেলত।

“সিনেমা অন কর। ওরে আমার কোলে দে। আমার কোলে ঘুমায়া যাবে ঠিক- ঠিক।”

সিনেমায় সাবটাইটেল আসতে থাকল একের পর এক: ‘sheep bleating’, ‘horse neighing’, ‘goose honking’। আমি মেয়ে-কোলে শারমিনের গায়ে হেলান দিয়ে মন দিয়ে সিনেমা দেখতে থাকলাম। অন্য সময় হলে ও বলত, “সর, শালি, ওকে? লেসবিয়ান কোনখানকার!” কিন্তু এখন ও খালি ওর ঘর্মাক্ত হাত দিয়ে আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিলো। যেন আমি একটা পশু–সিনেমার একটা ঘোড়া যেন আর আমার বাদামি রঙের অনেক বড়ো বড়ো লোম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *