জাঙ্গলিক

জাঙ্গলিক

তোমার খবর পেলাম টোপ বাহাদুরের কাছে, মেজদা, ঠিক শেষ শটে যখন কমলেশদা দাঁড়িয়ে ছিলেন দুটো শালগাছের মাঝখানে—এটাই আমার শেষ শট; শ্যুটিং তো আগেই প্যাক-আপ হয়ে গেছে—আর জানলাম আমার ওপর তোমার নাকি বেজায় রাগ, কারণ আমি নাকি ‘হারামখোর’ আর থিয়েটারের ঋণ ভুলেই গেছি আর তোমার ঋণের কথাও কাউকে বলি না আর মা নাকি তোমায় বলেছে, আমার জন্য মেয়ে দেখতে, অর্থাৎ এমনকী মা-ও মনে করে, তুমি ছাড়া আমি অচল। একটা মিনিট দাঁড়াও মেজদা—শ্যুটিং ইউনিট আর কমলেশদা এক মুহূর্ত দাঁড়াবার (তোমাদের পূর্ব-বঙ্গের ভাষায় ‘দুই পাও একত্র করার’) ফুরসত পাচ্ছে না—তাই আমিও পাচ্ছি না, বুইলে তো?—সবটুকু খোলাসা করে বলছি তোমায়। তার আগে বল, তোমার বড়দাদা যে সেনিলিটিতে ভুগছিলেন, রামকৃষ্ণ মিশন সেবাপ্রতিষ্ঠানে যে সিট পাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন বউদিই, অর্থাৎ কমলেশদার ওয়াইফ—কানেকসন ছাড়া আজকাল কিচ্ছু হয় না— ওঁর অবস্থা কী আজকাল? উৎপলদার দলে রদবদল হলো কিছু? গ্রুপ থিয়েটার করে গণআন্দোলন জমানোরই বা কতদূর? পার্টি নাকি আবার ভাঙছে? চারুদা-কানুদা নাকি এবার M-এর পরে L লাগাচ্ছেন? উৎপলদাও নাকি ‘বন্দুকের নল শক্তির উৎস’ বলে প্রচারণা চালাচ্ছেন? তা উনি পার্টির পোটার বয় যতদিন আছেন, ততদিন ওঁর এসব তামাশা তো দেখে যেতেই হবে।

যাক্! এবার লাঞ্চের ব্রেক – এবার বলি, শোনো, মেজদা, তোমার ঋণ কী করে ভুলি, বল তো? কী করে ভুলি, সেই যে তোমার শাশুড়ি ওঁর ট্যাক্সিতে কার যেন ভুলে ফেলে যাওয়া ক্যাননেট QL17 কুড়িয়ে পেয়ে তোমার হাতে দিলেন, আর তুমি সবার আগে ভাবলে আমার কথা, ভাবলে ‘সুবিমলটা ফোটোগ্রাফির ম্যাগাজিন জমায়, ওকে দিই গে’– নোনাধরা দেয়ালের মেসের ঘরে তখন রাজ্যের অ্যালমানাক অভ ফোটোগ্রাফিক জার্নালের পুরোনো কপি, তাই দিয়ে তুমি দরজার তল দিয়ে আসা জল আটকাতে আর আমি মেজাজ দেখাতাম — তারপর আমার হাতে ক্যামেরাটা গছিয়ে দিয়ে বললে, “শোন্, বাবু, আমার কিছু দেনা ছিল তোর কাছে—জানিস্ তো? ওটা ভুলে যা।” কী মারাত্মক ভালো ক্যামেরা ছিল ওটা বল? কুইক লোড, অটো এক্সপোজার—আর লেন্সের কী স্পিড বাওয়া!—কী করে ভুলি, মাল খেয়ে একদিন আমায় বলেছিলে, “থিয়েটার কইরা কী হইব? তুই ফিল্মে ট্রাই কর্ গা!”, আর কী করে ভুলি, তুমি বলেছিলে, সিনেমার বন্ধুদের কাছ থেকে বাড়তি কাটপিস ফিল্ম মানে রোলের ক্যানের শেষ অংশটুকু এনে আমায় দেবে, কারণ ফিল্ম কেনার পয়সা নেই আমার, আর কী করে ভুলি, কমলেশদার (তখনো আমার কাছে পদ্মভূষণ শ্রীযুক্ত কমলেশ রায়) ছবির লোকেশনে মজা দেখতে গিয়ে সেই যে একটা ছবি তুলেছিলাম তোমার দেওয়া ক্যামেরাটা দিয়ে — সেই যে গাছের তলে রাখা একখানা ঢোলের ছাউনির উপর জল পড়ছিল পাতা বেয়ে টুপ্-টুপ্ শব্দ করে, আর তাতে একটা নিবিড় ‘ছম-ছটম-ঢম-ঢম-টম’ ছন্দে বেজে উঠছিল ঢোলটা~~তাতেই আমার জীবনের খেলা ঘুরে গেল? গড়িয়াহাটে সেই যে ছবি ডেভেলপ হলো, আর তুমি সেই ফোটো দেখে বললে কমলেশদার সিনেমা আর তোমার দেখার দরকার নেই, কারণ সিনেমার সিন্থেটিক আওয়াজ আমার স্থিরচিত্রের কাছে কোন্ ছার আর তাস খেলতে খেলতে তুমি তোমার ইয়ারদোস্তদের কাছে আমার কথা বললে; বললে, “ছেলেটার কম্পোজিশন শেন্স দারুণ!”, আর ওদের মাঝে কমলেশদার ইউনিটেরই একজন ছিল, যে কিনা আমায় নিয়ে গেল কমলেশদার কাছে, আর গিয়ে আমি ওঁকে বোকার মতো বলে বসলাম, “আমি থিয়েটার করি। আমায় আপনার ছবিতে নিন।” আর উনি আমার তোলা ছবি হাতে নিয়ে হেসে পিঠ চাপড়ে বললেন, “তুমি তো আমার অ্যাঙ্গেল মেরে দিয়েছ হে! ছবি তুলুন, মশাই, ছবি তুলুন” – কমলেশদা এমনই করেন আমার সাথে; তুই-তুমি-আপনি গুলিয়ে ফেলেন- সেসব কথা ছবির চেয়েও পষ্ট মনে আছে আমার, মেজদা। তবে কিনা, তুমি তো আমার আপন দাদা নও—কলকাতার সক্কলের ‘মেজদা’–সেই কথা ভুললেও চলবে কেন? আজ নয় ওসব দাদাগিরি ভুলে যাও; চলো, আবার আমরা দুই বন্ধু হয়ে যাই—মাইরি বলছি, ফিল্মের লাইনে তোমার মতো বন্ধু পাব না গো।

দাঁড়াও, কমলেশদা লাস্ট কী বললেন, মিস্ করে গেলাম। আচ্ছা, “উনি বললেন শালশা নাচের শিনটা কলকাতায় গিয়ে আগের ক্যামেরাতেই স্যুট্ করতে হবে” – আমার দিকে খাবারের বাকসো বাড়িয়ে দিতে দিতে এইমাত্র জানাল মানিক, মানে সিনেমাটোগ্রাফারের অ্যাসিস্ট্যান্ট। রবারের সাপের মতো ঠান্ডা হাত মানিকের—হাতের পাতা সব সময় ঘামে ভেজা। কমলেশদার বই মানেই মানিকের টেনশন। অভিনেতাদের তো টেনশনের পালা শেষ। গাড়ির ভেতর থেকে দুই নায়িকা শব্দ করে মাত্রই হেসে উঠল—শুনলেই মন সাফ হয়ে যায়, মনে হয়, পৃথিবীতে কোনো কষ্ট নেই। চারজন যুবক, দুটো যুবতী মেয়ে—তার মধ্যে একটি অকালবিধবা—একটি মেয়ের বাবা, আর একটি সাঁওতাল মেয়ে নিয়ে ছবির গল্প; ছবির নাম ‘জাঙ্গলিক’। ‘দুই নায়িকা’ মানে কিন্তু ওই দুটো যুবতী মেয়ে নয়; সাঁওতাল মেয়েটি আর দুই যুবতীর একজন—এই দুটো রোলে কমলেশদা যাদের নিয়েছেন, তাদের কথা বলছি, বুইলে? তো তারা আবার পুরোনো বন্ধু। সাঁওতাল সেজেছে— বললে বিশ্বাস করবে না—রাজ কাপুরের আবিষ্কার, বম্বের রেশমা। আরেক নায়িকা ওর বান্ধবী, তোমার অতি প্রিয় সঙ্গীতা—’অভিপ্ৰায়’, ‘অতলের অভিসার’, ‘করিম মাঝির সংসার’ এইসব ছবির হিট নায়িকা সঙ্গীতা—তা সঙ্গীতা তো আর সঙ্গীতা নয়, বেগম খানবাহাদুর; মাস তিনেক আগে ছোট নওয়াবকে বিয়ে করেছে কিনা— বিয়েতে নেমন্তন্ন করেনি তোমায় নিশ্চয়ই? তা আমার মতো গাছের সাথে মিশে থাকা অংশত -পাতা-অংশত-বাঁদর ফোটোগ্রাফারকে চেনার ওর দায় পড়েনি, তবু শুনি, গালভরা কথা বলায় নাকি জুড়ি নেই ওর—ওর ক্রিকেটার বর নাকি কোন্ ম্যাচে বোলিংয়ের সময় আম্পায়ারকে হেঁকে বলেছিল ‘হাউ’জ দ্যাট”, আর আম্পায়ার নাকি মৃদুস্বরে জবাব দিয়েছিল, “হুজুর, ওটা তো আউট নয়!” যতসব গালগপ্পো। ইউনিটে তো সবাই এই নিয়েও হাসাহাসি করতো যে, ছোটো নওয়াব তার বেগমের মন জোগাতে গালিবের শের নিজের নামে চালিয়ে দিত আর বেগম ভাবত, “আহা, আমার স্বামীর যেমন প্রতিভা, তেমন প্রেম।” মাগিটা ছিল যেমন বোকা, তেমন হিংসুটে। তোমাদের পূর্ব-বঙ্গের ববিতাকে অন্য এক ছবিতে গ্রামের বউ চরিত্রে নিলেন কমলেশদা, সঙ্গীতাকে না-নিয়ে, তাই নিয়ে হেভি হল্লা মচিয়েছিল ও–ববিতার নাকি ইয়া লম্বা-লম্বা নেইলপলিশ-মারা নখ ছিল, গ্রামের মেয়ে আবার ওরম হয় নাকি?—যেন কমলেশদা বেগমসাহেবার কাছ থেকে শিখবেন, কী করে কাস্টিং করতে হয়। তা কমলেশদারও ওর উপর রাগ ছিল বইকী—বম্বে গেলি ভালো কথা, বাঙালি মেয়ে কেন ওরম বিকিনি পরে শট দিতে গেলি ফিল্মফেয়ারের পাতায়? আর ও কোনো ফোটোগ্রাফি হলো? না কোনো কমপোজিশন, না কোনো টেকনিক, না কোনো আর্ট—শুধু পাছার মাংস। ছি! বম্বের নায়িকা, সে তো রেশমাও যে সে নায়িকা নয়, রাজ কাপুরের নায়িকা — কী বলব, মেজদা, কী ক্লাশ মেয়েটার! ইংরিজি কী উচ্চারণ! আর কী গ্রেশফুল! পেডিগ্রি বুঝিয়ে ছেড়েছে এই মেয়ে—বিলেতে বড় হয়েছে কিনা। আরও বলি, শোনো শোনো— ছোট নওয়াব, যাকে সঙ্গীতা পাকড়াও করে ভেড়া বানিয়ে ছাড়ল—তার সাথে প্রেম ছিল এই রেশমারই। ভাবতে পার? সঙ্গীতার জন্য শেষমেশ ওর বান্ধবী রেশমাকেই লেঙ্গি মারলেন নওয়াবসাহেব। রেশমার ফ্ল্যাটে সিধে গিয়ে বললেন, “আমায় মুক্তি দাও”, আর এই রেশমা নাকি নাকের-জল-চোখের জল বুকে চেপে নওয়াবকে বলেছে, “আরে, গ্লাশের জল যে গ্লাশেই রয়ে গেল তোমার? একটু লেমোনেড দোবো?”–বিলিতি শিক্ষা বাওয়া! এখানেই শেষ নয়, নওয়াব বিদায় নেওয়ার সময় ওঁর আপত্তি উপেক্ষা করে লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিতেও গেছে রেশমা—আর ওই মুহূর্তেই ঘটল অনর্থ। সিঁড়ির মুখে কেন্নোর মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে অপেক্ষা করছিল—আর কেউ নয়, রেশমার প্রাণের বন্ধু সঙ্গীতা-নীল ঘাগরা, সবুজ চোলি শ্রীরাধিকে। রেশমাকে দেখে কুণ্ডলীর প্যাচ খুলে গেল শ্রীরাধিকার, সিঁড়ি বেয়ে তড়িঘড়ি নামতে গিয়ে হিলতোলা উঁচু জুতো সামলাতে না- পেরে পপাত ধরণিতল—একেবারে মাঝসিঁড়িতে। নওয়াবসাহেব ওকে ধরতে গেলেন না, ওদিকে তাকালেন না পর্যন্ত— যেন কিছুই দেখেননি— এরম ভাব করে লিফটের বোতাম চাপতে লাগলেন উন্মাদের মতো। পরিস্থিতি জঙ্গম, তাই রেশমা বেচারি স্থবির হয়ে গেল—ওর ছবি তো দেখেছ; কেমন শান্ত-স্থির নির্মেঘ আকাশের মতো ও; বিলেতে যেরম আকাশ দেখা গেলে লোকে বলে ‘ইন্ডিয়ান সামার’— দৃশ্যটা কল্পনা কর, মেজদা! নন-সেকোইটরের ভালো বাংলা কী হবে গো? উৎপলদা শিখিয়েছিলেন কি? মনে পড়ছে না। তো গতবছরের ডিশেম্বরে ধুমধাম করে শুভকাজ সমাধা করে বেগমসাহেবা আজকাল চুটিয়ে কাজ করছেন—শুনেছি, রেশমাও গেছিল ওদের বিয়েতে; প্রাণভরে আশির্বাদ করে এসেছে। আর করবে না-ই বা কেন? রেশমা তো আর সঙ্গীতার মতো হিংসুটে ছোটলোক নয়, আর নওয়াবসাহেবের মতো ক্লাশলেস পয়সাওলাও নয়। তবে বিয়ের পর সঙ্গীতার জেল্লাটা যা খুলেছে না, মেজদা, মাইরি! শ্যুটিংয়ের ছবিগুলো ডেভেলপ করলে আর পত্রপত্রিকায় ছাপা হলে দেখতে পাবে, ব্লাউজের খাটো আর আঁটসাঁট হাতার নিচে স্বাস্থ্যময় শাদা বাহুবল্লরী ঠেলে বেরিয়ে আসছে—কনুই ভাঁজ করলে টুলটুল করে। বন্দুকের দানার মতো বুনিদুটো। সঙ্গীতা, গড় হই মহারানি লক্ষ্মীছাড়ি! থুড়ি, মহারানি নয়; বেগমসাহেবা।

ভেবো না যা-যা বললাম, তার সবটুকু কানকথা। রেশমা নিজমুখে এসব বলেছে আমায়, শ্যুটিং ব্রেকের ঠান্ডা অবকাশে আর রাত্তিরের জঙ্গলের টুপটাপ শব্দের মধ্যিখানে, বুইলে? আমি ভেবে নিয়েছিলাম, নওয়াবকে নিয়ে সঙ্গীতার ওপর হওয়া ক্ষোভ আর প্রতিহিংসে চাপতে চাপতেই বুঝি জেরবার হয়ে গেছে মেয়েটা; কিন্তু ও আমায় বলেছে, সঙ্গীতা যে আজও ওর বন্ধু—’কমরেড’ বলে ডেকেছে সঙ্গীতাকে, ভাবতে পারো?—তার প্রমাণ দিতে-দিতে যদি ওকে শেষ হয়ে যেতেই হয়, হলোই বা শেষ। বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে বলেছে এসব রেশমা আমায়; বলেছে, “আপনার কাছেই সিখে নোবো”; বলেছে, “অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরবাবুর ইতনা টাইম কাঁহা আমাকে বাংলা সিখানোর?” আমি মনে-মনে বলেছি, “হ্যাঁ, কমরেড, ওঁদের টাইম কোথায় আমাকেও সিনেমা বোঝানোর?” আদতে তো এরা সব চোতামারা ছাত্র; হাইবেঞ্চের খাঁজের ভেতর নকল গুঁজে রেখে তাই দিয়ে পাশ করেছে। “অত কাছে যেও না। অত কাছে গেলে ডেপ্‌থ অভ ফিল্ড পাবে কী করে?”- ক্যামেরার ছেলেদেরকে এইসবও বলে দিতে হয় কমলেশদার। অথচ আমি কাজ করি এতটা নিভৃতে, নির্দেশনাবিহীন, একা—”আজ তবে আসি দাদা” বলবার আগপর্যন্ত কমলেশদা টেরটি পর্যন্ত পান না যে, আমিও সেটে ছিলাম।

তো যা বলছিলাম, কলকাতার সুধীমহলের অনেকেই আছেন কমলেশদার বর্গে, যাঁদের সামনে ভাষা এসে নুয়ে পড়ে—এমন দখল ওঁদের ভাষার ওপর—আরও কতকিছুরই ওপর! কমলেশদার ইউনিটেই তো রয়েছেন কতক রসজ্ঞ। সেদিন একজন বললেন, “আরে দূর-দূর! জ্ঞানবাবুর গান কিছুই হয় না। গানের মতো গান ছিল সেই উত্তরপাড়ার শ্রীময়ী ঘোষালের। আহাহা… কী সে পঞ্চম’সে গারা!” কমলেশদা আশেপাশে থাকলে এঁরা ঠুটো জগন্নাথ—কমলেশদা পরচর্চার মধ্যে নেই, বাঙালির আড্ডাবাজ স্বভাবও ওঁর মধ্যে পাবে না— ওঁর সময়ের অনেক দাম বাওয়া। তবে কমলেশদা নিজের আয়ত্তের বিষয়গুলো নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন—আর তুমি তো জানই, মেজদা, গান উনি গুলে খেয়েছেন—কী ধ্রুপদী, কী পাশ্চাত্য! ওঁর ছবিতে অন্যরা গানের ডিরেকশন দেবে কী? ওস্তাদ-কালোয়াত তো কম এলো-গেল না। হা! ওদের কী সাধ্যি কমলেশদার গানের যে সুরম্য ছবি, তাকে ধরবে? ধরবে না তো, ধ্যাড়াবে। সেই যে বিরাট রসজ্ঞ গুণির কথা বলছিলাম, জ্ঞানবাবুর গানে যিনি রস পান না, তাঁকে বেজায় আমতা-আমতা করে কমলেশদা যখন বললেন, “আচ্ছা, শুভেন্দু—খুব মুশকিলে পড়ে গেছি, জানো? জ্ঞানবাবুর যে একটা গান আছে কলাবতী রাগে—’ছলনা জানি’ বলে—ওই গানটার উঠান কি চোদ্দ মাত্রা থেকে নাকি সাড়ে চোদ্দ মাত্রা থেকে, বল তো!” বলতে-বলতে উনি গানটার মুখড়া আধাসুরে গুনগুন করে উঠছিলেন আর হাতে তালি দিয়ে আর আঙুলের গাঁট গুনে গুনে রীতিমতো অস্থির-চঞ্চল, আর নিজের ওপর প্রায়-বিরক্ত হয়ে উঠছিলেন, আর শুভেন্দুর— বলাই বাহুল্য — স্পিকটি নট। এমন নয় যে, শুভেন্দুকে একহাত নিতেই কমলেশদা ওরম করলেন—উনি আত্মকেন্দ্রিক, স্বভাবগম্ভীর এবং অবসেসিভ হলেও সরল; কিম্বা কে জানে হয়তো শুভেন্দুর মতো দুনিয়াজোড়া রসজ্ঞদের দেখে নেওয়াই ওঁর যাকে বলে ‘চূড়ান্ত অভীপ্সা’। গতকাল রাতে যেমন উনি বলছিলেন— পর্তুগিজ জলদস্যু – যাদের আমরা হার্মাদ বলি, ওরা আসলে হার্মাদ নয়; আর্মাডা। আর্মাডা শব্দটা আদিতে ছিল রণতরীর এক বিশাল বহরের নাম — ইংরেজদের শিক্ষা দিতে স্পেনের রাজার পাঠানো; যদিও সামুদ্রিক ঝড়ে আর শক্ত প্রতিপক্ষের হাতে ওই বহরের ভরাডুবি হয়েছিল। বোঝ! কী শব্দ, অথচ কী তার অর্থ! কমলেশদা মাঝেমাঝে একটা শব্দ নিয়ে পড়তেন, ফুলের মতো শব্দটাকে তুলে ধরে চারিদিক দিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের একটা ‘তিনসো সাট ডিগ্রি’ আন্দাজ দিতেন। ধরো, এমন একটা ফুল, যেটা পুজোআচ্চায় লাগে না, উপহার-সম্বর্ধনাতেও জোটে না – ধরো, সরষেফুল বা ধরো, ঘাসফুল; তো খেতে- খামারে অনাদরে ফুটে থাকা তেমন একটা ফুলের মতো নৈমিত্তিক, কিম্বা গহীন জঙ্গলে নীরবে ঝরে যাওয়া একটা ফুলের মতো একটা ‘অবৃদ্ধিওর’ শব্দকে আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে, উনি যাকে বলে ‘এলুশিডেট’ করা—তাই করতেন। শব্দটাকে যখন ব্যবচ্ছেদ করতেন—মানে বিশ্লেষণ করে দেখাতেন, ফুলের মতো শব্দটাকে তুলে ধরে পাপড়ি টেনে ছিঁড়তেন না কিন্তু কখনো – ব্যবচ্ছেদ হতো মনে-মনে; ফুলটা অক্ষত থাকত। বোঝো, এই না-হলে আর্টিষ্ট!

আমি আর কে? কুড়িয়ে পাওয়া ক্যামেরায় ক’বার শাটার টিপলেই তো বড় আর্টিষ্ট হওয়া যায় না গো। ফিল্ম এমন একটা মিডিয়ম, যাতে কর্মযোগের মন্ত্র হচ্ছে ‘কর্ম হোক যথা তথা, যোগ হোক ভালো’। বুইলে কিনা? তা যোগ মানে তো আর যোগব্যায়াম নয়, যোগ মানে জনযোগ; জনসংযোগ বললাম না – কেমন কেরানী- কেরানী গন্ধ ওতে। এখানে প্রতিষ্ঠা হাশিলের ইঁদুর-দৌড়ে নামতে যাকে হয়, তাকে আগে ধেড়ে ইঁদুর হয়ে একদল নেংটে ইঁদুরকে ইন্সপায়ার করার গুণ রপ্ত করতে হয়। যেমন ধর, কলকাতায় কমলেশদার ইউনিটের সক্কলের পোর্ট্রেট তোলার পর ছবি যখন ডেভেলপ হয়ে এল, ভেবেছিলাম আরও কিছু তারিফ আর পিঠ-চাপড়ানি জুটবে, তা কমলেশদা সরাসরি চুমুই খেয়ে বসলেন গালে। ভাবতে পারো?

অন্য দাদাদের সাথে কমলেশদার ফারাকটা কোথায়, বল তো? উনি পিঠ-চাপড়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে পালে ভিড়িয়ে দেন না—উনি কাগজে-কলমে কারবার করেন—ওঁকে সেই অর্থে কমলেশ না ডেকে ‘কলমেশ’ও ডাকতে পারো। উনি দস্তুরমতো চিঠি লিখে ওঁর ইউনিটে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্টটা সিদ্ধ করেছিলেন—ভাবতে পারো? এই দেখো চিঠির ভাষা—

সুপ্রিয় সুবিমল

আমরা অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে সাদা পর্দায় প্রক্ষেপিত প্রবহমান আলোকচিত্র-সম্বলিত যে দৃশ্যমালা দেখি, যাকে চলচ্চিত্র বা সিনেমা বলে, তার একটি জটিল অন্দরমহল আছে। সেই সিনেমা তৈরি করতে প্রচুর উদ্যোগ-আয়োজন প্রয়োজন হয়, আর আমরা স্বভাবতই ভেবে থাকি, সেই নেপথ্য কাহিনি দর্শকের জানার দরকার হয় না। তাই এই নেপথ্য সাধারণত অজানাই থেকে যায়। তবু যদি দর্শক জানতে আগ্রহী হন সিনেমা তৈরির সেই নেপথ্য ইতিহাস, অন্তর্নিহিত বিভিন্ন মানবিক সম্পর্ক, তাহলে তাঁর সামনে এক নতুন জগৎ উন্মীলিত হতে পারে। পৃথিবীর অনেক বড় চলচ্চিত্রকারই এই বিষয়ে একমত। আমার বন্ধু ফরাসি চলচ্চিত্রকার ত্রুফো তো একটি সিনেমাই করতে যাচ্ছেন এই সিনেমা তৈরির সিনেমা নিয়ে। আমার এই বন্ধুটি একদা ছিলেন আমার কট্টর সমালোচক – আমার প্রথম ছবি, অনেক আশা নিয়ে যে ছবি আমি নিয়ে গেছিলাম বিশাল বিশ্বের মঞ্চে, সেই ছবির শো’য়ে মাঝপথে উঠে গেছিলেন ক্রফো। বলেছিলেন, একদল গেঁয়ো চাষা হাত দিয়ে ভাত খাচ্ছে, এর মাঝে দেখার কী আছে? সেই গল্প অন্যত্র। মোটকথা, সিনেমার নেপথ্যের অনেক প্রয়োজনীয় ও কৌতুকদীপ্ত ইতিবৃত্ত বর্তমানে পত্র-পত্রিকা, এবং পরবর্তী প্রজন্মের দর্শক ও চলচ্চিত্রকারদের কাছে প্রয়োজনীয় বলে গণ্য হচ্ছে এবং হবে। এই নেপথ্যের কথা লিখে রাখতে পারলে যাঁরা সিনেমা করেন এবং যাঁরা সিনেমা দেখেন উভয়ই উপকৃত হতে পারেন; কিন্তু সেটা লিপিবদ্ধ করা খুব দুরূহ।

আপনার তোলা ছবি দেখে আমি শুধু মুগ্ধই হইনি, আপনার কাজের অমিত সম্ভাবনা ও কার্যকারিতা নিয়েও নিঃসন্দেহ হয়েছি। শব্দ যেখানে ব্যর্থ, ছবি সেখানে সফল। বিলিতিরা বলে, A picture is worth a thousand words ।

প্রথমত, আমার এবং আমার ইউনিটের সকলের কয়েকটি পোর্ট্রেট এবং কয়েকটি গ্রুপ ফোটো তুলে দেওয়ার জন্য আমি আপনাকেই অনুরোধ করলাম। আপনার পূর্ণ ক্রেডিটসহ ছবিগুলো যাবে, যেখানেই যাক। দ্বিতীয়ত, আমার পরবর্তী ছবি (সম্ভাব্য প্রযোজকের বিবেচনাধীন) ‘জাঙ্গলিক’-এ আপনাকে ইউনিটের চিত্রগ্রাহক হিসাবে পেলে বিশেষ আনন্দিত হব। শ্যুটিংয়ের বেশিরভাগ অংশ ডালটনগঞ্জ (পালামৌ সদর, ঝাড়খণ্ড, বিহার) এলাকার কাছে ছিপাদোহর নামে একটা লোকেশনে সারা হবে। শিগগিরি আমাদের কর্মসচিব অখিল শ্যুটিংয়ের শিডিউল, আপনার সম্মানী এবং আপনার কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশার ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ করতে আপনার সাথে যোগাযোগ করবে।

দ্রুত আপনার মতামত জানতে পারলে কৃতজ্ঞ থাকব।

শুভেচ্ছা রইল
কমলেশ রায়

কেমন বুঝলে সহবত, বল? এই চিঠি পেয়ে আমার তো একেবারে উৎপলদার ভাষায় ‘বজ্রের সমান করে বুকেতে নির্ঘাত’। এই ব্রেকটা না পেলে একদিন-না-একদিন তিক্ত হয়েই যেতাম তোমার মতো, মেজদা। ভাবতাম, “যাহ্ সালা, ভাসিয়ে দোবো সব গঙ্গার জলে! কিসের কী ছবি বাল!” যদিও এই কাজ না-জুটলে কিছু একটা করে খেতাম নিশ্চয়ই। তোমার মতো পরিবহণ দপ্তরের চাকরি না হোক, অন্য কিছু। ধর, দেয়ালে কি ল্যাম্পপোস্টে হ্যান্ডবিল সাঁটাবার কাজ। ঘাড়ে মই, আঠার বালতি। বার্নল, দাদের অত্যাশ্চর্য ঔষধ, সাধনা ঔষধালয়ের লোকাল ক্ষীণপ্রতাপ কমপিটিটরদের বিজ্ঞাপন। “আমাদের পরিবারের ছেলে হয়ে, বাবু, তুই এই কাজ করবি?”— ঘরে যেদিন ভীষণ তর্কাতর্কি লেগেছিল, কাকু বলেছিল। ছোঃ। যতসব ভেতো পরম্পরার ধ্যাষ্টামো। বাবা চলে না-গেলে এই কাকুটা কাঁটাবাজি করার সুযোগই পেত না। যাক, এখন আর কিছু না হোক, তিরিশ নয়া পয়সা দিয়ে প্যাকেট সিগারেট কেনার ক্ষমতা তো হলো। রেশমার সামনে সেদিন হামফ্রে বোগার্টের মতো করে ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়ে একটু চিবিয়ে-চিবিয়ে কথা বলতে গেলাম– রেশমা বলল, ওর মার্লোন ব্রান্ডো পছন্দ। রাত্তিরে লালরঙের মরচে-বৃষ্টি হয়েছিল। শ্যুটিংয়ের গাড়িগুলোর কাচে দেখলাম খয়েরি জলের ফোঁটা ব্রণের মতো শুকিয়ে আছে। একপাশে জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়, অন্য পাশে নদী পেরিয়ে আদিবাসীদের কয়েকটি গ্রাম। তারপর ধু-ধু টাঁড়। কার যেন বাচ্চা কেঁদে উঠল এমন শব্দ করে—জং-ধরা পাল্লার দরজা খুলে যাবার শব্দ যেমন হয়— চৌকিদারের ছেলে হয়তো। কারা যেন শুওরের বাচ্চার মতো হর্ন বাজাচ্ছিল জঙ্গলের ডাক অগ্রাহ্য করে। (আমাদের শ্যুটিংয়ের রাস্তাই নয় তো সেটা— যেখানে এক নায়ক আরেক নায়ককে গাড়ির ভেতর থেকে মুখ বের করে সংলাপ ছেড়েছিল, “তুই তো জঙ্গল-জঙ্গল করে হেজিয়ে গেলি?”) বাংলো পেরিয়ে একটা গুমটি আর সেই গুমটির বাইরে নারকোলের দড়ির মুখে আগুন জ্বলছিল। আমি আর রেশমা সকাল-সকাল হাঁটতে বেরিয়েছিলাম রেশমা বলছিল, ও যে পারফিউম মাখে, তা বার্লিন ছাড়া নাকি কোত্থাও পাওয়া যায় না। কী তার বিশেষত্ব? না, সেই পারফিউমের মিডল নোট লিলি অভ দ্যা ভ্যালি, টপ নোট লেমন আর বেইজ নোট নাকি ভ্যানিলা; তায় আবার উচ্চমাত্রার ‘High sillage’ (উচ্চারণ: ‘সিঁয়াজ’, জানতে?) আমি হাঁ করে শুনছিলাম — রেশমার সখী আমি; হয়তো রেশমাও মুগ্ধ হয়ে শোনে আমার মুখে ক্যামেরার বর্ণনা—যখন ও বলল, গত বছর ববি কেনেডি খুন হওয়ার খবরে ও কত কেঁদেছিল, কিম্বা এ বছর জুডি গারল্যান্ডের চলে যাওয়ার খবরে।

রেশমার এখানে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল বাথটাব, গ্যাস গিজার, চব্বিশ ঘণ্টা গরম জল পেয়ে যে মেয়ে অভ্যস্ত, সেই মেয়ে ফরেস্ট রেস্ট হাউজে ঘর ভাগ করে শোয়, বাথরুম নেই তাই সক্কাল সক্কাল জঙ্গলে গিয়ে কাজ সারে আর তারপর লক্ষ্মী হয়ে বসে সাঁওতাল মেয়ের মেকআপ নেয়— গালে, পিঠে, পেটে, হাতে, পায়ে, এমনকি কানের বারান্দায়, শাড়ি-মাকড়ি-হাঁসুলি-কল্কেফুল পরে নেয়, তারপর মাটিতে শুয়ে চার নায়কের একজনের সাথে কেলির শীন করে (সেই ছবিও তুলে নিয়েছি বইকী), কমলেশদার হাড়-কাঁপানো ঠান্ডা মেজাজ সামলায়, সন্ধেবেলা চারঘণ্টা লাগিয়ে মেকআপ তোলে—মানে অন্যে তোলে, কিন্তু ওকে তো বসে থাকতে হয়। প্রথম চারদিন তো কমলেশদা ওকে কাজই দিলেন না; চরিত্র বোঝাতে ওকে নিয়ে গেলেন ভাটিখানায়—মানে যেখানে আদিবাসীরা মহুয়া আর হাঁড়িয়া খায় –কমলেশদা মদ ছোঁন না, আর আমরাও নীট খাইনি বাওয়া, গাড়ি করে কোল্ড ড্রিংক আনা হয়েছিল বেতলা কিম্বা রাঁচী মেট্রো থেকে, আর রেশমা বলেছে, ‘কান্ট্রি লিকার’ খাবেই না, যদিও ছবিতে ওর রোলটা মূলত চকচকে বগল খুলে মহুয়া খেতে-খেতে মাতলামো করা একটা লোকাল মেয়ের। সঙ্গীতাকে নেওয়া হয়নি; ও তো শ্যুটিংয়ের সময় ছাড়া বাকি সময় নিজের রুমে বসে থাকে; ফ্লোরে এসেও ডায়ালগের পাতায় মুখ ঢেকে রাখে—উৎসুক জনতা এড়াতে—তা যে-দেশের লোক রবীন্দ্রনাথের মৃতদেহ থেকে পর্যন্ত চুল-দাড়ি টেনে ছিঁড়ে নেয়, তারা যে সুযোগ পেলে সঙ্গীতা-কি-রেশমার বুক খুবলে নেবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? যা হোক, মাতাল হয়ে শুভেন্দু তো কুরোশাওয়া কচলে খেল—নিকুচি করেছে ওর কুরোশাওয়া- আর তারপর কমলেশদার ওখানে না-থাকার ফায়দা ষোলআনা নিয়ে বলল, “বম্বের আনন্দম পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যা তিন কপি নিয়ে ঘুরি আমি সব-সোময়, বুইলে বাবা? ওতে আমার নাম আছে কমলেশদার ক্রু-মেম্বার হিসেবে। হুঁ!” রেশমার দিকে ইশারা করে অন্যদের বলল, “ওরে! হিরোইনকে লেমোনেড দে। কমলেশদাকে বুঝলুম না, বাবা। জল খেতে কিনে এনেছেন হিরের গবলেট।” রেশমা তো বাংলা মাত্র শিখছে; বেচারী হয়তো বোঝেইনি জড়ানো গলায় মাতালটা ওকে নিয়ে কী বলল। নিশ্চয়ই কোনো হাসির কথাই হবে, ভেবে একটু হাসল পর্যন্ত ও। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কী দরকার ছিল ওর এসে এখানে বসবার! বাংলোতে বসে সঙ্গীতা আর কমলেশদার সাথে শ্যারাড বা স্ক্র্যাবল বা মেমরি গেম খেললেই পারত। মেমরি গেম জানো তো? একজন একটা বিখ্যাত মানুষের নাম বলবে, পরেরজন সেই মানুষটার নামের সাথে আরেকজন বিখ্যাত মানুষের নাম যোগ করবে, পরেরজন যোগ করবে আরেকজন বিখ্যাত মানুষের নাম—এইভাবে খেলা চলবে। নামের সিরিয়ালে যার ভুল হবে কিম্বা কোনো একটা নাম বলতে যে ভুলে যাবে—সে হয়ে যাবে আউট। সঙ্গীতা আর রেশমা ক’দিন আগে রেস্ট হাউজের ঘরে বসে পরদিনের শটের রিহার্সাল দিতে-দিতে মেমরি গেম খেলছিল— আর আমরা ক’জন ছিলাম দর্শক

রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ, কার্ল মার্ক্স

রবীন্দ্রনাথ, কার্ল মার্ক্স, ক্লিওপ্যাট্রা

রবীন্দ্রনাথ, কার্ল মার্ক্স, ক্লিওপ্যাট্রা, অতুল্য ঘোষ

রবীন্দ্রনাথ, কার্ল মার্ক্স, ক্লিওপ্যাট্রা, অতুল্য ঘোষ, হেলেন অভ ট্রয়

রবীন্দ্রনাথ, কার্ল মার্ক্স, ক্লিওপ্যাট্রা, অতুল্য ঘোষ, হেলেন অভ ট্রয়, সেক্স-পিয়র

রবীন্দ্রনাথ, কার্ল মার্ক্স, ক্লিওপ্যাট্রা, অতুল্য ঘোষ, হেলেন অভ ট্রয়, সেক্স-পিয়র, মাও সে তুং

রবীন্দ্রনাথ, কার্ল মার্ক্স, ক্লিওপ্যাট্রা, অতুল্য ঘোষ, হেলেন অভ ট্রয়, সেক্স-পিয়র, মাও সে তুং, ব্র্যাডম্যান

তো বুইলে তো? এরম খেলা চলছে দু’জনে; টানটান উত্তেজনা। শেষে এসে যেই না “রবীন্দ্রনাথ, কার্ল মার্ক্স, ক্লিওপ্যাট্রা, অতুল্য ঘোষ, হেলেন অভ ট্রয়, সেক্স-পিয়র, মাও সে তুং, ব্র্যাডম্যান, রানি রাসমণি, কেনেডি, টেকচাঁদ ঠাকুর, নেপোলিয়ন, মমতাজ মহল”-এ এসে ঠেকেছে খেলা, আর শিকার স্পট-করা বনবেড়ালের মতো বিছানার ওপর বসে সঙ্গীতা প্রায় ঝুঁকে পড়েছে রেশমার দিকে, রেশমা মারল এক শুইঙ্গিং ইয়র্কার। সবগুলো নাম ঠিক ঠিক বলে শেষে যোগ করে দিল, ‘মুর্তাজা’। ব্যস্! জানো নিশ্চয়ই, নওয়াবসাহেবের মানে সঙ্গীতার ক্রিকেটার বরের—আসল নাম ছিল মুর্তাজা। লোকে বলে, রেশমা ছাড়া দুনিয়ার কেউ নাকি নওয়াবসাহেবকে ওই নামে ডাকত না, আজও ডাকে না। সঙ্গীতার প্রায়-জিতে-গেছি মুখ পাঁশুটে হয়ে গেল। একদম ঠিক হয়েছে! অন্যের পছন্দ নিয়ে ভাগবে তুমি, আর তোমায় কেউ কিছু বলবে না! মামদোবাজি? তা খেলা ওখানেই শেষ। দর্শকদের মধ্যে প্রসঙ্গ পালটে কে যেন বলে উঠল, “এই শোন্ না! কমলেশদার জন্মদিন তো এবার শ্যুটিংয়ের মাঝেই পড়ল। কী করা যায়, বল্ তো?”

নিশ্চয়ই ভাবছ, সুবিমলটার মেয়েলি স্বভাব গেল না—কান পেতে মেয়েমরদের ঝগড়া শুনতে পেলে আর কিছু চায় না। হা হা, প্রথমেই পষ্ট করে বলি যে, শ্যুটিংয়ের শেষদিন আজ, অতএব দু’পাত্তর পড়েছে—তাই একটু চড়েছে। তার ওপর আমরা ক্রিয়েটিভ মানুষ, মেজদা। তোমার আর্ট তুমি দলেবলে কর, তবে আমাকে তো একলা করতে হয়। এ শোলো আর্টিষ্ট ইন এ ইঁদুর-থুড়ি-ভেড়ার পাল। তা জানো তো, কল্পনার অনাথ সৎবোন হচ্ছে কৌতূহল! কিম্বা, কল্পনা যদি একটা অসীম সংখ্যারাশির সাগর হতো—উৎপলদার ভাষায় ‘বেবাম সায়র’, আর সেই সংখ্যাসাগরের এক ঘটি জল যদি তুলে নিয়ে আসা হতো, আর সেই এক ঘটি জল যদি একটা ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে ঘরে তোলা হতো, তাহলে দেখা যেত, সেই সংখ্যাগুলি হয় দুই, নইলে তিন, নইলে সাত, তেরো কিম্বা সাঁইতিরিশ। কৌতূহল কল্পনার চেয়েও অবিভাজ্য, মৌলিক। কৌতূহল হাত দিয়ে ভাত মেখে খায়, আর কল্পনা সেই হাতে-ঝোলে মাখামাখির দৃশ্য দেখে পাবলিকলি উঠে চলে যায় ক্রফোর মতো, আর গোপনে গোপনে কৌতূহলের সাথে ফ্রেন্ডশিপের চুক্তি করে।

আর বিশেষ কী? আমাদের জঙ্গলের কাজ—জাঙ্গলিকের কাজ–শেষ। রেস্ট হাউজ থেকে আর কর্নেল পালিতের বাংলো থেকে কাল সকালে মাল বেঁধেছেদে নেওয়া হবে। অনেক শট কলকাতাতেই নেওয়া হবে—কিছু হবে প্রিয়ার ড্রেসিং রুমে, আর কিছু সহজ পাসিং শট্স এখানে-ওখানে। জানি, কলকাতা ফিরে গিয়েও তোমার সাথে দেখা হবে না-বলতে পারো, একরকম মেনেই নিয়েছি তোমার ইনশিকিউরিটি, তোমার অভিমান। এদিকটায় তুমি এলে গাছপালা, জন্তুজানোয়ার নিয়ে মেতে থাকতে জানি—আমি তো ছবিই তুলি এদের, চেনো তো সব তুমি। কমলেশদা বার্কিং ডিয়ার চেনালেন—কটরা বলে এদিকটায়— তুমি থাকলে হয়তো ওদের কত শিংয়ে ক’টা শাখা, মুখস্থ বলে দিতে।

ওদিকটা দেখি গিয়ে। ইউনিটের জংলিগুলো হই-হই করে বলছে, সঙ্গীতার রবীন্দ্রসঙ্গীতের টেস্ট নেবে। ভাটিখানায় একটা সত্যিকারের সাঁওতাল মেয়েকে কে যেন ‘এ বাউরি, এ বাউরি’ বলে শিস দিয়ে ডাকছে। চলি এবার, মেজদা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *