লোহার কোট – ৪

ঊষার আভা তখন সবে পুব দিগন্তে দেখা দিয়েছে।

কেম্পেগৌডা টাউন থেকে সটান টেনিস ক্লাবে হাজির হল ইন্দ্রনাথ আর প্রেমাংশু।

 অদূরে চন্দনবন। এ পাশে পোলো গ্রাউন্ড।

পোলো গ্রাউন্ডে একটি অশ্বারূঢ় মূর্তি। কর্নেল হেব্বাল। বায়ুবেগে ঘোড়া ছুটছে, আচমকা মোড় নিচ্ছে, হ্রেষাধ্বনি আর অশ্বক্ষুরধ্বনি সবুজ মাঠের ওপর দিয়ে দিগন্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে।

টেনিস গ্রাউন্ডে প্র্যাকটিস করছেন ক্লাব সেক্রেটারি স্বয়ং।

 প্রেম আর ইন্দ্রকে দেখে দ্রুত চরণে কাছে এসে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক।

 বলুন স্যার।

ইন্দ্র একাই কথা বলল।

রোজ প্র্যাকটিস করেন?

হ্যাঁ।

কোন সময়ে?

ভোরে।

তারপর?

অন্যান্য মেম্বাররা এলে আমি তদারক করি।

 পরশুদিন বেলা দশটা থেকে বারোটার মধ্যে ছিলেন?

নিশ্চয়।

পাশের পোলো গ্রাউন্ডে কি তখন প্র্যাকটিস চলছিল?

কর্নেল হেব্বাল ছিলেন।

 রোজই থাকেন।

আর কেউ?

ব্রিগেডিয়ার মদন সিং ছিলেন।

আপনি কি ওঁদের কখনও চোখের আড়াল হতে দেখেছিলেন?

না তো। মাঠেই ছিলেন?

হ্যাঁ। কর্নেল হেব্বাল মাঠের এদিকেই ছিলেন। একবার শুধু বল নিয়ে ছুটে গেলেন চন্দনবনের দিকে।

তারপর?

বলটা বনের ভেতরে ঢুকে গেছিল বোধ হয়। ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন।

কতক্ষণ পরে বেরোলেন?

কতক্ষণ? পাঁচ মিনিটও নয়। ব্রিগেডিয়ার মদন সিং কর্নেলের নাম ধরে হেঁকে উঠলেন। সেই জন্যেই মনে আছে আমার।

পাঁচ মিনিটের বেশি ভেতরে ছিলেন না?

অতও নয়।

 বিকেলে দেখেছিলেন কর্নেলকে?

নিশ্চয়। সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে ছটা পর্যন্ত মাঠে ঘোড়া ছুটিয়েছেন।

আচ্ছা নমস্কার।

 বিমূঢ় বদনে দাঁড়িয়ে রইলেন সেক্রেটারি।

পোলো গ্রাউন্ডের দিকে পা বাড়িয়ে ইন্দ্র বলল–প্রেম, কী বুঝলি?

 কিচ্ছু না।

মূর্খ। আর একটা লাশ পড়েছে।

 লাশ!

পাঁচ মিনিটের বেশি চন্দনবনের মধ্যে ছিলেন না কর্নেল। প্রফেসর গোড়বোলে পিঁপড়ে আর শুঁয়োপোকার সূত্র থেকে কী বলেছেন খেয়াল করে দ্যাখ।

ললিত সন্ধ্যায় খুন হয়, সকালেও হত্যাকারী হাজির হয়েছিল সেখানে।

কেন? খুনের মহড়া দিতে নিশ্চয়। রিহার্সাল না দিলে এরকম পরিপাটি খুন সম্ভব না।

ইন্দ্র, তুই কি ওই ভদ্রলোককে খুনি ঠাউরেছিস? অঙ্গুলি সংকেতে ঘোড়সওয়ার কর্নেল হেব্বালকে দেখিয়ে বলল প্রেম।

যুক্তির অঙ্ক তাই বলছে। একটু থেমে–ললিত কাটার জানলা দিয়ে দেখেছিল নারায়ণ সিনয়ের বুকে বসে কিল মারছে কেকা। তারপরেই জলে ঠিকরে গেল নারায়ণ। কে ফেলেছে তাকে? কার ভয়ে সব দেখেও চেঁচিয়ে ওঠেনি ললিত?

কেকার ভয়ে নিশ্চয় নয়।

সহসা শিরপা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল তেজীয়ান ঘোড়া। কদম চালে এগিয়ে এল আগুয়ান দুই মূর্তির পানে।

নিম্নকণ্ঠে বললে ইন্দ্র–প্রেম, ললিত পারিবারিক কেলেংকারির সাক্ষী। নারায়ণ সিনয়ের মৃত্যুদৃশ্যের সাক্ষী। কর্নেল তা জেনেছিলেন। ললিতকে বাজে অছিলায় চন্দনবনে ডেকেছিলেন। সকালবেলা পাঁচ মিনিটের জন্যে বনে ঢুকে রিহার্সাল দিয়েছিলেন কীভাবে খুন করবেন। একটু থেমে–কিন্তু রিহার্সালের লাশটা কোথায় গেল?

জিপ ছুটেছে। এইমাত্র মানডিয়া পেরিয়ে এলাম। লাইন দিয়ে গরুর গাড়ি বোঝাই আখের স্তূপ চলেছে চিনির কলের দিকে।

আত্মগতভাবে ইন্দ্রনাথ বললে–চন্দনবনের খানাখন্দের মধ্যে বাড়তি লাশটা পাওয়া যাবে। তল্লাশের ব্যবস্থা করে এসেছে প্রেম।

রিহার্সালের বলি তাহলে কর্নেলেরই কুকুর? বললাম আমি।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাই। সকালের দিকেই নিশ্চয় বেঁধে এসেছিলেন চন্দনবনে। পোষা কুকুরকেই আচমকা খুন করা যায়। গলায় ফাঁস দিয়ে মেরেছেন, কাস্তে দিয়ে কুপিয়েছেন, তারপর কোনও খানায় ফেলে বেরিয়ে এসেছেন পাঁচ মিনিটের মধ্যে। খুব আশ্চর্য কি?

বোবা হয়ে থাকাই শ্রেয় মনে করলাম।

.

মাইশোর সিটি। চামুণ্ডা হিলের শীর্ষে চামুন্ডেশ্বরী মন্দিরের চুড়োয় মেঘের লুকোচুরি।

পাহাড়ের সঙ্গে সমান্তরাল রাস্তার একপাশে মিলিটারি ব্যারাক। শেষ প্রান্তে ললিতামহল– মহারাজার গেস্টহাউস।

অতদূর যেতে হল না। মাঝপথেই একটা প্রকাণ্ড বাড়ি। একতলা। কিন্তু আকার আয়তন। বিশাল।

ফটক পেরিয়ে জিপ ঢুকল ভেতরে। মহীশূরী প্রহরী অভিবাদন জানিয়ে সসম্মানে ভেতরে নিয়ে গেল আমাদের।

সুসজ্জিত বসবার ঘরে আসন গ্রহণ করতে না করতেই গম্ভীর মুখে ঘুরে ঢুকলেন এক বর্ষীয়সী মহিলা। শ্বেতশুভ্র মূর্তি। চুল সাদা, বর্ণ গৌর, বসন শুভ্র।

সৌজন্য বিনিময়ের পর বললেন–আমি কর্নেল হেব্বালের পিসিমা। এখুনি ফোন পেলাম। আপনারা জেরা করতে চান কেকা আর কলিকে?

ভদ্রমহিলা নিঃসন্দেহে মিতবাক।

ইন্দ্রনাথ বললে–আজ্ঞে হ্যাঁ। কলি ওঁর ছোট মেয়ে?

হ্যাঁ।

আগে তাকে পাঠান।

আমার থাকার দরকার আছে?

আপনি তো সবই শুনবেন পরে কেকা আর কলির মুখে।

বেরিয়ে গেলেন মহিলা। আধ মিনিট পরেই ঢুকল ফুটফুটে একটি মেয়ে। বছর দশেক বয়স। পরনে কাচের কাজ করা নীল রেশমের লাহেঙ্গা। জামাটা লাল রেশমের। গৌরবর্ণ, চঞ্চল চাহনি, মৃদুবাক

কর্নেল হেব্বালের মুখাবয়বের সঙ্গে আশ্চর্য সাদৃশ্য।

পাশে বসিয়ে নিমেষে আলাপ জমিয়ে ফেলল ইন্দ্রনাথ।

মিনিট দশেক ধরে কেবল বাজে কথাই বলে গেল। ধীরে ধীর অনাড়ষ্ট হয়ে এল কলি। শিথিল হল মনের আগল।

কথায় কী না হয়। কিন্তু কথার যাদুকর ইন্দ্রনাথ রুদ্রও হার মানল মৃদুবাক মেয়েটির কাছে।

কিছুই জানে না কলি–শুধু দুটি কথা ছাড়া।

দিদির বিছানায় নারায়ণ সিনয়ের এক পাটি মোজা পড়েছিল। সকালবেলা বিছানা ঝাড়তে গিয়ে চোখে পড়ে বুড়ি দাসীর।

আর, দিদিকে ললিতমোহন কী একটা খারাপ কথা বলেছিল। বাবা শুনে রেগে গিয়েছিলেন।

এর পরেই এল কেকা।

কৃষ্ণকায়া, কুচভারনা, ললিতা অলস চাহনি।

স্ফুরিত অধর,–যেন সদা অভিমানিনী।

ঘন চুলের মাঝে সূক্ষ্ম সিঁথি। যৌন-মদির হিল্লোলিত দেহবল্লরী। ষোড়শী।

ক্লান্ত চোখে চেয়ে রইল কেকা–যেন নীল পদ্মের পাঁপড়ি।

বসুন, বলল ইন্দ্রনাথ। বেশিক্ষণ বিরক্ত করব না।

আড়ষ্টভাবে বসল কেকা। বুঝলাম, চাপা ঠোঁটের আগল খুলতে বেগ পেতে হবে ইন্দ্রকে।

ললিতমোহন ছেলে কীরকম ছিল? সটান প্রশ্ন ইন্দ্রনাথের।

 ভালো।

জোর করে বলছেন না কেন?

আর কীভাবে বলব?

ললিত আপনাকে একটা নোংরা কথা বলেছিল কী বলেছিল আমি জানি।

 নিমর্ম কণ্ঠ ইন্দ্রনাথের।

 চমকে উঠল কেকা।

কী বলেছিল? বুঝলাম, এ মেয়ে ভাঙবে তবু মচকাবে না।

পালটা প্রশ্ন করল ইন্দ্রনাথও আক্রমণের ধারা নিয়েছে।

নারায়ণ সিনয় কীভাবে খুন হয়েছে ললিত তা দেখেছিল। কাজটা আপনি ভালো করেননি।

শক্ত মুঠিতে সোফার হাতল খামচে ধরল কেকা। নিরক্ত হয়ে গেল আঙুলের গাঁট। বিস্ফারিত হল চক্ষু।

মিথ্যে কথা! উত্তেজনায় বিকৃত শোনাল কেকাধ্বনি।

আপনার বিছানা থেকে নারায়ণ সিনয়ের মোজা আবিষ্কারটাও কি মিথ্যে? ছেদ নেই ইন্দ্রনাথের আক্রমণে।

নিরুদ্ধ নিঃশ্বাসে চেয়ে রইল কেকা।

পরক্ষণেই দু-হাতে মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠল অঝোর কান্নায়।

নিমেষে খাদে নেমে এল ইন্দ্রনাথের কণ্ঠ। আদ্রর্কণ্ঠে আপন করে নেওয়া সুরে একটির পর একটি প্রশ্ন করে চকিতে পৌঁছে গেল কেকার মনের মণিকোঠায়।

ঘটনাটা এই:

নারায়ণ সিনয় বদ ছেলে। চরিত্রহীন।

কেকার ওপর নজর ছিল প্রথম থেকেই। কিন্তু সুবিধে করে উঠতে পারেনি।

একদিন রাত্রে কিন্তু তার স্পর্ধা চরমে পৌঁছোল। খাওয়াদাওয়ার পর রোজকার মতো বাগানে বেড়িয়ে এসে শোবার ঘরে ঢুকে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল কেকা। বিছানায় শুয়ে নারায়ণ সিনয়। পরনে কেবল জাঙ্গিয়া। চোখে নীরব আমন্ত্রণ। ঠোঁটে কদর্য হাসি। সেদিন আর ধৈর্য রাখতে পারেনি কেকা। চেঁচাতেও পারেনি। মারতে মারতে নারায়ণকে বিতাড়িত করেছিল ঘর থেকে।

হতচকিত নারায়ণ কোনওমতে পাতলুন সার্টটা মাথায় গলিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে চম্পট দিয়েছিল নিজের ঘরে।

পড়েছিল একপাটি মোজা।

 বুড়ি দাসী আবিষ্কার করেছিল পরের দিন সকালে।

এই ঘটনার দিন কয়েক পরেই দুর্ঘটনা ঘটল সুইমিং পুলে। ডুবে মারা গেল নারায়ণ সিনয়।

ললিতমোহনের সঙ্গে আলাপ হল সাত আটদিন পর রামকৃষ্ণ মিশনে।

খুব মিশুকে ছেলে। এক রকম গায়ে পড়েই আলাপ করল কেকা আর কলির সঙ্গে। শুরু হল বাড়ি যাতায়াত।

কিন্তু ললিতমোহনকেও একদিন হাতেনাতে ধরে ফেলল কেকা শোবার ঘরে। কেকার প্রসাধন সামগ্রী নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল ললিত।

রেগে গিয়েছিল কেকা। দুটো মিঠেকড়া কথাও শুনিয়েছিল।

ললিতমোহন তখন বাঁকা সুরে বলেছিল–আমি খারাপ ছেলে, না, তুমি খারাপ মেয়ে? গভীর রাতে নারায়ণ সিনয়ের বুকে বসে কিল মারছিলে কেন? সিগারেট খাচ্ছিলে কেন? তুমিই তো ওকে ঠেলে ফেলে দিয়েছ জলে! সব দেখেছি আমি। তোমার বাবাকেও দেখেছি। প্রমাণ। এই লিপস্টিক।

পনেরো বছরের ছেলের মুখে পাকা পাকা কথা আর এক ঝুড়ি কুৎসিত মিথ্যে শুনে বাবার কাছে ছুটে গিয়েছিল কেকা।

কর্নেল হেব্বাল তক্ষুনি ললিতকে বার করে দিয়েছিলেন বাড়ি থেকে।

ললিতের সঙ্গে আর দেখা হয়নি।

.

সব শুনে ইন্দ্রনাথ শুধু একটা কথাই বলল–লিপস্টিকটা কোথায়?

চোখ মুছে উঠে গিয়েছিল কেকা। ক্ষণপরেই এনে দিল স্টেনলেস স্টিলের খাপে মোড়া অধররঞ্জনী। দেখে ভূকুঞ্চণ করলাম আমরা তিনজনেই।

লিপস্টিকটা কমলা রঙের।

.

ফেরার পথে আর একটি কথাও বলল না ইন্দ্র। নিমগ্ন চাহনি দেখে মনে হল যেন অথই জলে হাবুডুবু খাচ্ছে কুল পাচ্ছে না।

আসবার সময়ে হোটেল দশরাজে আকণ্ঠ ইডলি বড়া, রসম-সম্বর খেয়ে নিয়েছিলাম। ইন্দ্রনাথ কিছু মুখে দেয়নি। বিনিদ্র রজনীর পর উৎকণ্ঠাময় ঘটনাপরম্পরায় ওর পাকস্থলী এখন নিষ্ক্রিয়।

ব্যাঙ্গালোরে ফিরলাম বিকেল নাগাদ। ফ্ল্যাটে আমাকে আর ইন্দ্রনাথকে নামিয়ে দিয়ে প্রেম সটান গেল থানায়।

ঘরে ঢুকে গুম হয়ে বসে রইল ইন্দ্র। যেন ভারি গোলমালে পড়েছে।

 কবিতা এল। দরজা দিয়ে উঁকি মেরে ওর মুখচ্ছবি দেখে সরে পড়ল নিজের ঘরে।

একটু পরেই এল টেলিফোন। প্রেম ফোন করছে। কোচিং ক্লাসে খোঁজ নেওয়া হয়েছিল। সাতাশে ডিসেম্বরের আগে থেকেই ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করেছিল ললিতমোহন।

আটাশে ডিসেম্বর স্কুলে গিয়ে উন্মনা হয়ে বসেছিল লাস্ট বেঞ্চে–যা কখনও বসে না।

 রিসিভার রেখে পেছন ফিরতেই দেখি ইন্দ্ৰনাথ দাঁড়িয়ে। চোখে শূন্য দৃষ্টি।

বলল–কোচিং ক্লাসে যায়নি–রোজ টহলে বেরোতো বলে। আটাশে ডিসেম্বর উন্মনা ছিল সকালবেলা খবরের কাগজে উলটো খবর পড়ে। স্বচক্ষে দেখেছে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছে নারায়ণকে–খবরে ছাপা হল, মামুলি দুর্ঘটনা। বউদি, ঘরে আছ?

ঘর থেকে সাড়া দিল কবিতা–আছি। কিছু বলবে?

হ্যাঁ। কবিতার পাশে গিয়ে বসল ইন্দ্রনাথ। সামনে দাঁড়িয়ে আমি। বলল–বউদি, তুমি নিঃসন্তান। তবুও জিগ্যেস করছি।

লাল হল কবিতার ফর্সা মুখ।

ইন্দ্ৰনাথ দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বললে–প্রশ্নটা শিশু মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে। ললিতমোহন কিশোর হলেও একটি ব্যাপারে ওর জ্ঞান ছিল শিশুর মতোই। একটু থেমে–ছেলেটা অকালপক্ক ছিল না।

চেয়ে রইল কবিতা। ধরতে পারল না, ইন্দ্রনাথের গোল লেগেছে কোনখানে।

আনমনে বললে ইন্দ্রনারায়ণ সিনয়ের বুকে বসে কেকার কিল মারার অন্য অর্থও যে থাকতে পারে, ললিতমোহন তা ধরতে পারেনি।

অস্ফুট স্বরে বললাম আমি–মাই গড। কানের ডগা পর্যন্ত লাল হয়ে গেল কবিতার।

ঘাড় নেড়ে বলল ইন্দ্র–বউদি, ঠিক কিনা? আদিম মিলনকে মারপিট বলেই মনে হয়েছে ললিতের চোখে?

চোখ নামিয়ে নিয়ে সায় দিল কবিতা।

ইন্দ্রর মনের ধাঁধা কিন্তু কাটল না–সেই জন্যেই কেকা নারায়ণের সিগারেট খেয়েছে, অরেঞ্জ লিপস্টিকের দাগ লেগেছে। সেই কারণেই কেকার অরেঞ্জ লিপস্টিক চুরি করতে গিয়েছিল ললিত। দাগটা মিলিয়ে নেবে বলে। কিন্তু একটু চুপ করে থেকে–মৃগ, কেকা মিথ্যে বলছে। মনে হল কি?

এবার আমিও ধাঁধায় পড়লাম।

বললাম–না।

ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথ। রেলিংয়ে দুহাত রেখে চিন্তাকুল চোখে চেয়ে রইল নীচে।

তখন সন্ধে নামছে। রাস্তায় আলো জ্বলছে।

একটা অটোরিকশা এসে দাঁড়াল দোরগোড়ায়। ভাড়া মিটিয়ে তরতর করে ওপরে উঠে এল বনলক্ষ্মী আর ঋতেশ।

থমকে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথকে দেখে। শঙ্কাতুর চাহনি।

 ইন্দ্র কিন্তু অন্যমনস্ক। দেখেও দেখল না।

কবিতা এসে হাত ধরে ঋতেশ-বনলক্ষ্মীকে নিয়ে গেল ভেতরে। পাঁচ মিনিট পরে তিনজনেই নেমে গেল রাস্তায়।

ইন্দ্র শুধু চেয়েই রইল। কিছু বলল না।

আমি এসে দাঁড়ালাম পাশে–ইন্দ্র, কফি খাবি?

আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল ইন্দ্র–না। একটু বেরোব।

কোথায়?

কর্নেল হেব্বালের বাড়ি।

 কিছু জিগ্যেস করতে?

না। এক হাত তলোয়ার খেলতে। মনটাকে একটু ঘুরিয়ে দিতে চাই চিন্তার ধারা বড্ড এক খাতে বইছে।

চল।

.

নিঝুমভাবে অটোরিকশার কোণে বসে রইল ইন্দ্র।

কেম্পেগৌডা টাউনে যখন ঢুকলাম, তখন চাঁদ উঠেছে। মায়াপুরীর মতো মনে হচ্ছে। হালকা গোলাপি আর সাদা বাড়িগুলোকে।

কর্নেল হেব্বালের ফটক পেরিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। গোলাপ বাগিচায় পায়চারি করছে কেকা।

ও যে এত তাড়াতাড়ি মাইশোর থেকে চলে আসবে ভাবিনি।

চাঁদের ম্লান আলোয় নতমুখী কেকার পানে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিল ইন্দ্রনাথ।

 সঙ্গে-সঙ্গে বুঝলাম, ভুল করেছি দুজনেই।

কেকা নয়–কেকার মা। মধুমাধবী।

অপ্রস্তুতের হাসি হাসল ইন্দ্র–মাপ করবেন, কর্নেল আছেন?

 নীরব ঘাড় হেলিয়ে সায় দিলেন মধুমাধবী।

খবর দেবেন?

ঘাড় হেলিয়ে ধীর চরণে বাড়ির মধ্যে গেলেন মধুমাধবী। কর্নেল হেব্বাল নিশ্চয় খবর পেয়েই বেরিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু আমাদের দুজনের কাউকেই দেখতে পাননি।

অসভ্যের মতো ইন্দ্রনাথ আমার হাত ধরে ছুটছিল অটোরিকশার সন্ধানে।

.

এক ঘণ্টাও গেল না। দুটো পুলিশ ভ্যান এসে দাঁড়াল কর্নেল হেব্বালের গাড়িবারান্দায়।

আমি আর ইন্দ্রনাথ সটান গেলাম কর্নেলের খোঁজে। প্ৰেম গেল মধুমাধবীর খোঁজে।

তরবারিকক্ষে পায়চারি করছিলেন কর্নেল। চোখে ভ্রূকুটি। আমাদের দেখে থমকে দাঁড়ালেন।

কিন্তু একটি কথাও বললেন না। আরও নিবিড় হল ভ্রূভঙ্গি।

ইন্দ্রনাথ রুদ্রর এ মূর্তি তিনি আগে দেখেননি।

মুখ থেকে হাসি উবে গেছে, মুছে গেছে কৌতুক। স্বপ্নসুন্দর চোখে এখন ঈগল-চাহনি। পাথর মুখে ঝড়ের সংকেত।

দুই হাত পেছনে রেখে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল ইন্দ্র। আমি দাঁড়ালাম দোরগোড়ায়।

শুষ্ক কণ্ঠে বলল ইন্দ্র–কর্নেল হেব্বাল, আপনাকে একটা নাটক শোনাতে এসেছি!

কর্নেলের ক্রুর মুখে শুধু একটা কালোছায়া ভেসে গেল। কুঞ্চিত চক্ষুতারকায় যেন হায়নার দৃষ্টি।

হাত পেছনে রেখে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললে ইন্দ্রনারায়ণ সিনয় ভালো ছেলে ছিল না। সে আপনার মেয়ে কেকার ঘরে ঢুকেছিল। কিন্তু কেকা তাকে বার করে দেয়।

কিন্তু এই কেকাকেই গত সাতাশে ডিসেম্বর গভীর রাতে দেখা গেল নারায়ণ সিনয়ের বুকে বসে কিল মারছে। দেখল, ললিতমোহন। ক্ষুদে গোয়েন্দা। চোরের চেহারা দেখবার বাসনা নিয়ে জেদের বশে রোজ রাতে টহল দিত কেম্পেগৌডা টাউনে।

সাতাশে ডিসেম্বর এই বাড়ির উত্তরদিকের কাটাঝোপের একটা ঘুলঘুলি দিয়ে সে দেখতে পেল অদ্ভুত একটা দৃশ্য।

সুইমিং পুলের পাড়ে শুয়ে আছে নারায়ণ সিনয়। কেকা তার বুকে বসে কিল মারছে। আর সিগারেট খাচ্ছে। মারতে মারতে হঠাৎ তাকে গড়িয়ে ফেলে দিলে সুইমিং পুলে।

নারায়ণ ডুবে গেল। কেকা পালিয়ে গেল ভেতরে। ভোর রাতে মৃতদেহ আবিষ্কার করে ঘোর সন্দেহ হল আপনার।

পুলিশ তদন্ত করে গেল। নিছক দুর্ঘটনা। ধামাচাপা পড়ে গেল কেলেঙ্কারি।

আপনিও তাই চেয়েছিলেন। আপনার বংশমর্যাদা জ্ঞান অত্যন্ত প্রখর।

কিন্তু নৈশ কেলেঙ্কারির একমাত্র সাক্ষী ললিতমোহন অস্থির হয়ে রইল সেই থেকে। সুইমিং পুলের পাড় থেকে কেকার ফেলে দেওয়া সিগারেটটা সংগ্রহ করেছিল সেই রাতেই। কুকুরটা বাঁধা ছিল তখন। নইলে ললিতকে ছিঁড়ে ফেলত।

ললিতমোহন গোয়েন্দাগিরি করবে বলে রামকৃষ্ণ আশ্রমে গিয়ে গায়ে পড়ে ভাব করল আপনার মেয়েদের সঙ্গে। শুরু হল এ বাড়িতে যাতায়াত।

তারপর, একদিন কেকা তাকে হাতেনাতে ধরে ফেললে শোবার ঘরে। একটা অরেঞ্জ লিপস্টিক নিয়ে দেখছিল সে।

সুইমিং পুলের পাড় থেকে পাওয়া সিগারেটে অরেঞ্জ লিপস্টিকের দাগ ছিল। কেকার লিপস্টিক।

কেকা তাকে চোটপাট করতেই বাঁকা সুরে ললিত বলে দিলে, সে সব জানে। শুনে শিউরে উঠে কাঁদতে কাঁদতে কেকা গিয়ে নালিশ করল আপনাকে। ললিত নাকি বানিয়ে বানিয়ে নোংরা কথা বলছে।

সতর্ক হলেন আপনি। দূর করে দিলেন ললিতকে বাড়ি থেকে।

কিন্তু ললিত জেদি ছেলে। পুরো একটা মাস কাউকে কিছু বলল না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে চলল। শেষকালে আপনি তার মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা করলেন। সব কথা খুলে বলবার আশ্বাস দিয়ে বললেন, চন্দনবনে যেন সন্ধে ছটায় দেখা করে।

সেইদিন ভোরবেলা কুকুরটাকে বেঁধে রেখে এলেন চন্দনবনে। তারপর ব্রিগেডিয়ার সিংয়ের সঙ্গে পোলো প্র্যাকটিস করতে নামলেন মাঠে। টেনিস ক্লাবের ক্যাপ্টেনও দেখলেন আপনাকে। সাক্ষী রইল দুজন।

হঠাৎ বলটাকে চন্দনবনে ঢুকিয়ে দিয়ে আপনি গেলেন ভেতরে। কাস্তে সঙ্গেই ছিল। কাস্তে নিয়েছিলেন পুলিশকে ঘোল খাওয়ানোর জন্যে। তার-ও ছিল।

পাঁচ মিনিটের বেশি লাগল না কুকুরটাকে মারতে। লাশটা ফেলে দিলেন একটা ডোবায়। কাস্তে লুকিয়ে রাখলেন ঝোপের মধ্যে। সাকসেসফুল হল মহড়া।

সেইদিনই সন্ধ্যার সময়ে পোলো গ্রাউন্ড থেকে একই কায়দায় চন্দনবনে এলেন আপনি। খুন হয়ে গেল ললিতমোহন।

হিরের টুকরো ছেলে ললিতমোহন। অকালপক্ক মোটেই নয়। তাই কল্পনাও করতে পারে নি, সাতাশে ডিসেম্বর আধো-আলোয় দূর থেকে যা দেখেছে, যা ভেবেছে তা আগাগোড়া ভুল।

আসল সত্যিটুকু জানতেন শুধু আপনি।

আর জানেন আপনার স্ত্রী মধুমাধবী।

 বুকভরা নিঃশ্বাস নিল ইন্দ্রনাথ। কর্নেলের চোখের পাতা বুঝি পড়ছে না। মশাল জ্বলছে তারায় তারায়।

কর্নেল হেব্বাল, নীরস কণ্ঠে ফের বলল ইন্দ্র–আপনি জানতেন ললিত ভুল করছে। তবুও তাকে সরিয়ে দিলেন কারণ স্ত্রীর পাপ মেয়ের ঘাড়ে চাপছে।

সত্যটা একটু আগেই পরিষ্কার হয়ে গেল আপনার বাগানে পা দিতেই। আপনার স্ত্রী কে দেখে মনে হয়েছিল আপনার বড় মেয়ে।

এই একই ভুল করেছিল ললিত।

শুনেছি আপনার স্ত্রী আপনার চাইতে অনেক ছোট। বছর তিরিশ তাঁর বয়স। কেকার বয়স ষোল। দুজনকেই দেখতে প্রায় একরকম।

তা ছাড়া, ওই অবস্থায় আপনার স্ত্রীকে কল্পনা করার মতো পাকা মনও নয় ললিতের।

তাই কিল মারার দৃশ্যকে মারপিটের দৃশ্য বলেই ধরে নিয়েছিল চিরন্তন মিলনদৃশ্য বলে ভাবতে পারেনি।

কর্নেল হেব্বাল, কিছু বলার আছে আপনার?

 পেছনে হাত রেখে সটান দাঁড়িয়ে রইলেন কর্নেল।

অনেকক্ষণ পরে বললেন কাঠচেরা গলায়–প্রমাণ কী?

চোখের ইশারা করল ইন্দ্র। বেরিয়ে গেলাম আমি। ফিরে এলাম একটু পরেই। দুজন ধাঙ্গড় টিনের ট্রেতে চাপিয়ে নিয়ে এল একটা মরা লোমশ কুকুর। সারা গায়ে কাটাকুটি। লোম উঠে গেছে। পোকা থুক খুক করছে।

দুর্গন্ধে বমি আসছিল আমারও। অটল রইল শুধু ইন্দ্রনাথ।

বললে–লোমে ঢাকা পড়লেও মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তারের ফঁস পাওয়া গেছে। শুধু পাইনি কাস্তেটা। জলে ধুয়ে মাঠেঘাটে ফেলে দিয়েছিলেন বোধহয়। চাষাভুষো লোকে নিয়ে গেছে। তাই না?

কর্নেল নিরুত্তর। যেন, পাথর।

পেছন থেকে ডান হাতটা সামনে নিয়ে এল ইন্দ্রনাথ হাতে একটা রিভলভার। বলল– বংশমর্যাদার চাইতে বড় আপনার কিছুই নেই। পারিবারিক কেলেঙ্কারি গোপন করার জন্যে ললিতকে খুন করেছেন। এবার করুন নিজেকে আমি কথা দিচ্ছি পুলিশ তদন্তে লেখা হবে, আপনি আত্মহত্যা করেছেন–কেলেঙ্কারি প্রকাশ পাবে না।

কর্নেল নিথর।

ইন্দ্র মেঝের ওপর নামিয়ে রাখল রিভলভার–এ ছাড়া সম্মানজনক পরিত্রাণ আর নেই। বিদায়।

আমাকে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথ। বিদেয় হল ধাঙ্গড় দুজন।

এক মিনিট পরেই পিস্তল নির্ঘোষ শোনা গেল ভেতরে।

নারীকণ্ঠে আতীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এল অন্দরমহল থেকে। ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট ধরাল ইন্দ্রনাথ। একমুখ ধোয়া ছেড়ে বললে–আয়।

ঘরের একটিমাত্র সোফায় আড় হয়ে শুয়ে কর্নেল হেব্বাল। ডান হাতটা ঝুলছে বাইরে। হাতের মুঠোয় ৩৮ স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন রিভলভারটা। প্রেমাংশুর রিভলভার

কর্নেলের চোখ বন্ধ। বুকের বাঁদিকে এক ধ্যাবড়া বারুদের দাগ। কিন্তু রক্ত নেই।

সব চাইতে আশ্চর্য–নিঃশ্বাস পড়ছে, বুক উঠছে, নামছে।

জুতো মসমসিয়ে পাশে এসে দাঁড়াল প্রেম।

মধুমাধবী স্বীকার করেছেন। কেকার লিপস্টিক নিজেও মাখতেন, একটু বেশিই লাগাতেন।

জানতাম। মৃদু হাসল ইন্দ্রনাথ।

ঠক করে একটা শব্দ হল। কর্নেলের শিথিল মুঠি থেকে রিভলভারটা গড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে।

কুড়িয় নিল প্রেম। হোলস্টারে রেখে বলল তৃপ্ত কণ্ঠে–জ্ঞান নেই দেখছি।

 মাথায় জল ঢাল। জোর শক পেয়েছেন।

কিন্তু রক্ত কোথায়? বিমূঢ় স্বর আমার।

বেরোয়নি, কোটরাগত চোখ নাচিয়ে বলল ইন্দ্র–ব্ল্যাঙ্ক কার্টিজ। বারুদ থাকে–গুলি থাকে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *