লোহার কোট – ৩

থানা।

প্রেমাংশু অবাক হয়ে চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথের রক্তাভ চক্ষু আর উত্তেজনা থরথর মুখের দিকে। থেকে থেকে গালের পেশি কঁপছিল ইন্দ্রনাথের। স্নায়বিক উত্তেজনায় এভাবে ওকে কখনও পীড়িত হতে দেখিনি।

কী ব্যাপার ইন্দ্র?

 প্রেম, সশব্দে চেয়ার টেনে নিয়ে সশব্দে আসীন হল ইন্দ্রনাথ।

একটা ঠিকানা দিচ্ছি, লিখে নে। এখানে কোচিং ক্লাস হয়। খোঁজ দিয়ে দ্যাখ সাতাশে ডিসেম্বরের আগে এবং পরে ললিতমোহন নিয়মিত ক্লাস করত কিনা।

দ্বিরুক্তি না করে ঠিকানাটা টুকে নিয়ে বেল টিপল প্রেম। মেঝের দিকে আয়ত চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ।

সম্বিৎ ফিরল নটরাজের বুট ঠোকার শব্দে।

বলল–আর একটা ঠিকানা দিচ্ছি। ললিতমোহনের স্কুলের ঠিকানা। খোঁজ নে, আটাশে ডিসেম্বর ললিত স্কুলে সারাদিন কী করেছিল এবং কার কার সঙ্গে দেখা করেছিল।

এবারেও দ্বিরুক্তি না করে ঠিকানাটা লিখে নিল প্রেমাংশু। নটরাজকে নির্দেশ দিয়ে যেই বিদেয় করেছে, ফের বলে উঠল ইন্দ্রনাথ।

আর একটা জিনিস চাই। আটাশে ডিসেম্বরের ডেক্যান হের‍্যান্ড।

এবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল প্রেমাংশুর।

 দাঁত খিঁচিয়ে বললে–যা-যা দরকার একবারে বল।

আর কিছু দরকার নেই। কাগজটা পেলেই হবে।

পুরো কাগজটারও দরকার হল না। যে-খবরটা সযত্নে কেটে নিয়েছিল ললিতমোহন, কাগজ আসতেই ঘাড় কাত করে নির্বিশেষে সেই খবরের দিকে চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ।

খবরটা একটা দুর্ঘটনার। জলে ডুবে মৃত্যু। অকুস্থল সেই কেম্পেগৌডা টাউন। মৃত্যুর দিন–সাতাশে ডিসেম্বর।

কর্নেল হেব্বালের এক কানাডাবাসী অতিথি সাঁতার জানতেন না। তাই পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন বাগানের সুইমিং পুলে। ময়না তদন্তের রিপোর্টও তাই জলে ডুবে মৃত্যু।

অতিথিটির নাম নারায়ণ সিনয়।

পলকহীন চোখে খবরটার পানে চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ।

স্বর ফুটল অনেকক্ষণ পরে। চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে বললে–কে এই কর্নেল হেব্বাল?

প্রেম বললে–মাইশোরের রাজা চামরাজাবাহাদুরের আত্মীয়। রাজরক্ত নিয়েই জন্ম। কিন্তু রাজত্বে অধিকার নেই। আত্মসম্মান প্রখর। প্রচণ্ড অহংকারী। মিলিটারিতে থেকেই বোধ হয় মেজাজটাও মিলিটারি। তবে ভালো স্পোর্টসম্যান। ব্যাঙ্গালোর পোলো ক্লাব ওঁর উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত। টেনিস, সাঁতার, ভলিবলেও সমান দক্ষতা। কলকাতার পোলো মরশুমে খেলতে যান ফি-বছর। হেব্বালের রাইফেল-রেঞ্জে যাতায়াত আছে!

একটু থেমে নিমীলিতনয়ন ইন্দ্রনাথের পানে বিরাগপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফের হেব্বাল চরিত আরম্ভ করল প্রেমাংশু।

.

কর্নেল হেব্বাল শুধু উত্তম ক্রীড়াবিদ নন। বিপুল বিত্তের অধিকারীও বটে। পৈতৃক সম্পত্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্ত্রীর সম্পত্তি। কলকাতার রেসকোর্সের তত্ত্বাবধানের ভার নিয়েছিলেন। অবসর নেওয়ার পর। সেই সময়ে রেসের গ্রাউন্ডে আলাপ হয় ভদ্রমহিলার সঙ্গে। নাম তার মধুমাধবী। বঙ্গললনা।

মধুমাধবী নাম শুনলেই অবশ্য নীল-পদ্মের পাঁপড়ির কথা মনে পড়ে। যেন তার নীল নিচোল ঘিরে মুক্তাবলী, তমাল বেদিকায় এলিয়ে দিয়েছে তরুণ তনুশ্রী।

সেরকম কিছুই নয়। মধুমাধবী তিনি নামেই। সারা মুখে তার রক্তজবার অনুরাগ ছড়ানো। চোখে-মুখে অধরে চিবুকে রুদ্র ও ললিত লাস্যের নৃত্য।

মধুমাধবী একটি বিতর্কিত রূপ। অগ্নির মতো আকর্ষণীয়…স্নিগ্ধ নয়–উগ্র।

ঘোর কৃষ্ণবর্ণা, নাক মোটা, অধর পুরু, ভুরু ঘন। তা সত্ত্বেও অপূর্ব তাঁর দেহকান্তি, রক্তপদ্ম আঁখির তারায় অহর্নিশ চঞ্চলতা, পাতলা কোমর, গুরু নিতম্ব, পীবর বুকে উদ্দাম উচ্ছলতা।

মধুমাধবী! মধুমাধবী! মধুমাধবী! বছর কয়েক আগে এই মধুমাধবীকে নিয়ে চঞ্চল হয়েছিল স্বভাবশান্ত ব্যাঙ্গালোর নগরী। কর্নেল হেব্বাল আশ্চর্য সুপুরুষ। কর্নেল হেব্বাল রাজবংশীয়। সর্বোপরি, তিনি কর্ণাটক ক্ষত্রিয়। কিন্তু কী দেখে সহধর্মিণী রূপে নির্বাচন করলেন সুদূর বঙ্গ দেশের কৃষ্ণকায় রমণীকে? মধুমাধবী বয়েসেও অনেক ছোট। পিঙ্গল চোখে অনঙ্গ-দৃষ্টি। যেন রতি প্রতিমা।

বংশ মর্যাদায় আত্মসচেতন কর্নেল হেব্বাল যত্র-তত্র নিয়ে যেতেন না স্ত্রী-কে। বাজে লোকের সঙ্গ একদম পছন্দ করতেন না। কিন্তু উঁকিঝুঁকি মেরেও যেটুকু দেখা গিয়েছিল, তা যথেষ্ট।

প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী কর্নেল হেব্বাল যুবতী স্ত্রীকেও পর্দানশিন রাখার মন্ত্রগুপ্তি জানেন। কালক্রমে তার দুটি মেয়ে হয়েছে। কিন্তু মধুমাধবী আজও এক রহস্য।

এত কড়াকড়ির মধ্যেও কর্নেল হেব্বাল উদার ছিলেন। কেবল রামকৃষ্ণ আশ্রমের ক্ষেত্রে নাস্তিক। কিন্তু মেয়েদের নিয়ে মধুমাধবী প্রায়ই যান রামকৃষ্ণ আশ্রমে।

এহেন হেব্বাল পরিবারে আতিথ্য গ্রহণ করলেন নারায়ণ সিনয়। কানাডা প্রবাসী ম্যাঙ্গালোর তনয়। মাতৃভাষা, কঙ্কানীহঠাৎ শুনলে বাংলা ভাষা বলেই মনে হয়। কেন না, কঙ্কানীরা নিজেদের গৌরসারস্বত বলে। কারণ পূর্বপুরুষরা বাংলাদেশ থেকে এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে বাণিজ্য করতে যেতেন গুজরাত অভিমুখে।

নারায়ণ সিনয় বাবা-মা-ভাই-বোনকে কানাডায় রেখে ব্যাঙ্গালোর এসেছিল বৈষয়িক কাজে। বাবার বন্ধু কর্নেল হেব্বালের আমন্ত্রণে উঠেছিল তার ভবনে। দিন পনেরো পরেই ঘটল এই দুর্ঘটনা।

.

নির্দয়ভাবে গালের একটি ব্রণকে নিষ্পেষন করতে করতে ইন্দ্রনাথ বললে–এত কথার মধ্যে একটা কথাই শুধু কাজের কথা।

কোনটা? ক্ষুব্ধ কণ্ঠ প্রেমাংশুর।

 দুই মেয়েকে নিয়ে প্রায়ই রামকৃষ্ণ আশ্রমে যেতেন মধুমাধবী!

তাতে কী হল?

ললিতমোহনও রামকৃষ্ণ আশ্রমে যেতে ভালোবাসত। সেখানেই ওদের মধ্যে পরিচয় ঘটেনি তো?

.

জবাব শোনবার জন্যে ফের গেলাম বিন্দুমতীর কাছে। সঙ্গে প্রেমাংশু।

ললাট কুঁচকে উঠল বিন্দুমতীর। ভ্রূক্ষেপ না করে এবং বিন্দুমাত্র ভণিতা না করে ইন্দ্রনাথ শুধোলো–আপনি কি বলতে পারেন ললিতমোহনের সঙ্গে কর্নেল হেব্বালের মেয়েদের আলাপ হয়েছিল কিনা?

না।

রাখালরাজ সাহার গোপাল ভবন।

ভদ্রলোকের বিশাল গোঁফ ঝুলে পড়ল আমাদের ত্রিমূর্তি দেখে।

অকারণ হাসি হাসতেও বিস্মৃত হলেন।

বিনা গৌরন্দ্রিকায় শুষ্ককণ্ঠে শুধোলো ইন্দ্রনাথ–প্রবাসে বাঙালি মাত্রই সজ্জন, তাই তো?

আজ্ঞে?

শ্যামলেন্দু কোথায়?

আজ্ঞে..আজ্ঞে…

ডাকুন। এখুনি।

ত্বরিৎপদে অন্দরে অন্তর্হিত হলেন রাখালরাজ। হাত ধরে নিয়ে এলেন শ্যামলেন্দুকে। বেচারির শ্যামলিমা কালিমায় পরিণত হয়েছে একদিনের উদ্বেগ ভাবনায়।

শ্যামলেন্দু।

চশমার আড়ালে অশ্রুসাগরের আভাস পাওয়া গেল ওর ভীরু চোখে।

কেঁদো না। কোনও ভয় নেই। ললিত রামকৃষ্ণ আশ্রমে যেতে ভালোবাসত?

হ্যাঁ।

কর্নেল হেব্বালের স্ত্রী আর মেয়েরাও সেখানে যেতেন?

 হ্যাঁ।

ললিতের সঙ্গে ওঁদের আলাপ ছিল কি?

আগে ছিল না, চশমা খুলে চোখ মুছতে মুছতে বলল শ্যামলেন্দু। আমার সঙ্গে কথা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আলাপ হয়েছিল।

তুমি কীভাবে জানলে?

স্কুলের বন্ধুদের কাছে। ললিতের সঙ্গে ছোট মেয়ের ভাব হয়ে গিয়েছিল। বাড়িতেও যেত।

কেম্পেগৌডার বাড়িতে?

হ্যাঁ।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইন্দ্রনাথ–যাও, আর প্রশ্ন নেই।

শঙ্কিত, তটস্থ, হতচকিত রাখালরাজের সঙ্গে সৌজন্যসূচক বাক্য বিনিময় না করেই পেছন ফিরল ইন্দ্রনাথ।

গাড়িতে উঠেই বললে–প্রেম, মৃগ, ললিতমোহন মার্ডারের খবরটা আজকের কাগজে বেরোয়নি। কিন্তু কালকের কাগজে বেরোচ্ছেই। তাই তো?

নিশ্চয়। রিপোর্টাররা জ্বালিয়ে মারছে সারাদিন আমাকে আর ডাক্তারকে।

রাইট। কাল ভোর হওয়ার আগেই আরও খানিকটা তদন্ত যদি এগিয়ে রাখি, তোর আপত্তি হবে?

আপত্তি?

তবে চল আগে থানায়। নারায়ণ সিনয়ের জলে ডুবে মৃত্যুর পুলিশ রিপোর্ট দেখব।

তার কী দরকার? ডক্টর ডিকসিটের কাছেই চল না কেন? উনিই তো পোস্টমর্টেম করেছিলেন। কিন্তু তোর উদ্দেশ্য বুঝছি না। নারায়ণ-তদন্তে কোনও ফাঁক নেই। কেসটা এই শৰ্মাই হ্যান্ডল করেছিল। সেটা অ্যাকসিডেন্ট, আর ললিতমোহনেরটা মার্ডার।

জানি। উত্তেজনায় আঙুল মটকাতে মটকাতে বলল ইন্দ্রনাথ। খটকা লাগছে শুধু একটা জায়গায়।

কোন জায়গায়?

নারায়ণ সিনয় জলে ডুবে মারা গেছে ২৭ ডিসেম্বর। সেইদিন খুব অস্থির, অন্যমনস্কভাবে বাড়ি ফিরেছিল ললিতমোহন। রাত জেগে খুব সম্ভব ধাঁধা রচনা করেছিল এবং পরের দিন সকালে খবরের কাগজ থেকে খবরটা কেটে রেখেছিল। কেন?

.

রাত তখন নটা। ব্যাঙ্গালোরের পরিচ্ছন্ন পথঘাটে যানবাহনের সংখ্যা কমে এসেছে। স্টিয়ারিং ধরে নারায়ণ-তদন্তের প্রাঞ্জল বর্ণনা করল প্রেমাংশু।

কর্নেল হেব্বালের বাড়ির সামনে বাগান, পেছনে বাগান। ডাইনে গ্যারেজ, আস্তাবল, চাকরদের আউটহাউস। বাঁয়ে শেডের নীচে সুইমিং পুল। মানুষ-সমান উঁচু পুরু কাঁটাঝোঁপ দিয়ে আগাগোড়া ঘেরা।

নারায়ণ সাঁতার জানত না। তবুও জামাকাপড় পাড়ে খুলে রেখে নেমেছিল জলে। আর উঠতে পারেনি।

মোজাইক পাড়ে অ্যাশট্রেতে সিগারেটের ছাই পড়ে ছিল–সিগারেট ছিল না। সম্ভবত পাড়ে বসে ধূমপান করছিল নারায়ণ। হয়ত পা পিছলে পড়ে যায় আচমকা। অথবা, নিজে থেকেই সাঁতার শিখতে গিয়েছিল। তখন রাত গভীর।

প্রেমাংশু গিয়ে দেখেছিল, সবুজ রং করা সাঁতার কুণ্ডের তলদেশে চিৎপাত হয়ে শুয়ে নারায়ণের উলঙ্গ দেহ। হিপির মতো লম্বা চুল পাতাল নাগের মতো সহস্র ফণা বিস্তার করে রয়েছে ফর্সা মুখের ওপর। বছর তিরিশ বয়স। সুঠাম দেহ।

শুধু শুনেই গেল ইন্দ্রনাথ। প্রশ্ন করল না।

ঘাড় কাত করে অনিমেষ নয়নে কী যেন ভাবতে লাগল আপন মনে।

.

ডিকসিট ডাক্তারের অফিস কক্ষটি প্রাণীতত্ত্ববিদের সংগ্রহশালা বললেও চলে। চেয়ারের পেছনে কাচের শোকেসে ঝুলন্ত নরকঙ্কাল। পাশেই আর একটি শোকেস। তাতে রক্ষিত দুটি বানরের কঙ্কাল। বইয়ের আলমারি, যন্ত্রপাতির আধার, মাইক্রোকোপ, বেলজার।

প্রেম বলল–আমরা এসেছি।

তা তো দেখতেই পাচ্ছি, চেয়ার দেখিয়ে বললেন ডাক্তার–কিন্তু কেন?

নারায়ণ সিনয়ের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট শুনতে।

নারায়ণ সিনয়! ঈষৎ ঝুঁকে অসমান দাঁতের সারি বার করে যেন খিঁচিয়ে উঠলেন ডাক্তার তার সঙ্গে এই মার্ডারের কী সম্পর্ক?

ঝটিতি বচনজাল বিস্তার করল ইন্দ্রনাথ। সংক্ষেপে ব্যক্ত করল আপন সন্দেহ।

ডাক্তার উত্তর্ণ হয়ে শুনলেন। প্রথমে বাম কান পেতে। তারপর ডান কান ফিরিয়ে। শুনতে-শুনতে বাড়তে লাগল ছটফটানি। আর্মচেয়ারের হাতলে চঞ্চল হল দু-হাত। লাল হয়ে গেল কান। শেষকালে ফেটে পড়লেন বোমার মতো–ড্যাম ইট, ম্যান। কী বলতে চান? ভুল করেছি?

ভুলটা খুবই ছোট্ট, ডক্টর। কিন্তু আগে শেষ করতে দিন। ধরুন, ললিতমোহন চোর ধরার ফিকিরে একাই ঘুর ঘুর করত কেম্পেগৌড়া টাউনের রাস্তাঘাটে..হঠাৎ একদিন একটা শব্দ শুনল কর্নেল হেব্বালের বাড়ি থেকে। সন্দেহজনক শব্দ। গেল তদন্ত করতে। গিয়ে এমন কিছু দেখতে পেল, যে প্রসঙ্গে শ্যামলেন্দুকে পরে বলেছিল–পুলিশ শুনলে লাফিয়ে উঠবে। ও কি নারায়ণ সিনয়কে ডুবতে দেখেছিল?

স্বচক্ষে সে-দৃশ্য দেখবার পর কেউ মুখ বুজে থাকে?

তা ঠিক। মারপিট?

মারপিট! নারায়ণের সঙ্গে ধস্তাধস্তি?

 ওইরকম কিছু।

অসম্ভব!

কেন?

নারায়ণ ছোকরা মারা গেছে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে– কার্ডিয়াক ইনহিবিশন।

 কিন্তু রিপোর্টারদের কাছে তা তো বলেননি?

কী বলেছিলাম?

পেপারকাটিংটা বার করে দিল ইন্দ্রনাথ–বলেছেন মামুলি জলেডোবা মৃত্যু।

ককখনো বলিনি।

এটা কী লিখেছে?

চোখ বুলিয়েই দমাস করে ইয়া মোটা বইটার ওপর মুষ্ট্যাঘাত করলেন ডাক্তার–ব্লাড়ি ফুল! ডাক্তারি কথা বলতে গেলে ইংরেজিতে ছাড়া কি বলা যায়? রিপোর্টার যদি শুনতে ভুল করে তো আমি কী করব।

আপনি কি বলেছিলেন?

আমি বলেছিলাম–Atypical drowning, ওরা লিখেছে–A typical drowning যার মানে একেবারেই উলটো।

চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ।

ডাক্তার দাঁত খিঁচিয়ে বললেন–অ্যাটিপিক্যাল–একটা শব্দ। মানে অস্বাভাবিক। ওরা সেটা এ টিপিক্যাল লিখে মানে করল, মামুলি! দুর! দুর!

ভুলটা কারও চোখে পড়ল না?

কী করে পড়বে? সবাই চাইছে ঝটক্সট ফাইল ক্লোজ করতে।

তা ঠিক। কাষ্ঠহেসে সায় দিল প্রেম।

ডাক্তার বললেন–নারায়ণ সিনয়ের মৃতদেহ প্লেনে করে কানাডায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মনে আছে? সেখানকার প্যাথলজিস্ট খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে যা বলেছিলেন, আমিও পুলিশ রিপোর্টে তাই লিখেছি–ভেগাস নার্ভ উত্তেজিত হওয়ায় হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে গেছে।

তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে রগ টিপে ধরে কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইল ইন্দ্রনাথ। তারপর –নারায়ণ সিনয়ের মৃত্যুর কারণটা তাহলে কী?

বললাম তো, ফের দাঁত খিঁচোলেন ডাক্তার। ভেগাস নার্ভ উত্তেজিত হলে কার্ডিয়াক ইনহিবিশন হয়। জলে ডুবে মৃত্যু হলেও এরকম ঘটতে পারে।

কীরকম ভাবে?

ল্যারিংক্স অর্থাৎ স্বরযন্ত্রে ধাঁ করে খানিকটা জল ঢুকে গেলে ভেগাস নার্ভ খেপে ওঠে– ফলে ফুস করে থেমে যায় হার্ট। ভেগাস নার্ভকে হার্টের ব্রেক বলতে পারেন। ব্রেকের ওপর থেকে পা তুলে নিন অর্থাৎ ভেগাস নার্ভকে কেটে দিন–হার্ট ধড়ফড় করতে করতে এলিয়ে থেমে যাবে। আবার ঠিক উলটোটা ঘটবে ব্রেক টিপে ধরলে, ভীষণ ক্ষেপে উঠে ভেগাস নার্ভ হার্টকে ঘ্যাঁচ করে থামিয়ে দেবে। মিনিট কয়েকের মধ্যেই মৃত্যু ঘটবে। নারায়ণের ক্ষেত্রে মামুলি জলে ডোবা মৃত্যুর সচরাচর লক্ষণ দেখা যায়নি।

যথা–

মুখ বা নাকে ফেনা ছিল না। শিরাগুলোও দড়ির মতো হয়নি। দম বন্ধ হয়ে মারা গেলে রক্তের মধ্যে অক্সিজেন কমে যায়, কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়ে ওঠে। রক্তক্ষরণ হয়। কিন্তু নারায়ণের চামড়া ছিল ফ্যাকাসে।

এত গেল না-পাওয়ার ফর্দ। কাজের পয়েন্ট কিছু পেয়েছেন কি?

গুড পয়েন্ট। এতক্ষণ বললাম নেগেটিভ পর্যবেক্ষণ। এবার বলছি পজিটিভ পর্যবেক্ষণ। আমি দেখলাম, সে ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল কিনা, অথবা কোনও চোট পেয়েছিল কিনা।

কোনওটাই পেলেন না?

কনুই আর গোড়ালিতে সামান্য ঘষটানির দাগ ছিল। সুইমিং পুলের তলাটা খুব এবড়ো খেবড়ো। চৌবাচ্চার পাড়ও খুব মসৃণ নয়। সুতরাং ওরকম ঘষটানি অস্বাভাবিক নয়। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, নারায়ণের মুখের ভাব। যেন, অপ্রস্তুত ছিল, ভীষণ চমকে উঠেছিল। মুখ নীচের দিকে করে জলে ঝাঁপ দিলে এরকম হয়। জলের ওপর সপাং করে মুখটা আছড়ে পড়লে চমকে ওঠা স্বাভাবিক।

পেছন থেকে হঠাৎ কেউ ঠেলে ফেলে দিতেও তো পারে?

বললাম না, মারপিটের চিহ্ন পাইনি।

মারপিট করার দরকার কী? কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকলে পেছন থেকে জোর ধাক্কা মারলেই তো হল।

তা হতে পারে। কিন্তু ওইভাবে কেউ খুন করে কি?

 হয়ত ঠাট্টাচ্ছলে ঠেলে দিয়েছিল।

কে ঠাট্টা করবে? গভীর রাত। বাড়িসুদ্ধ লোক ঘুমে অচেতন। ফটকে তালা। আস্তাবল, গ্যারেজ, চাকরদের কোয়ার্টারে খিল তোলা।

হা-র-র-উ-ম! গলা খাঁকারি দিল প্রেম–লাথি মেরে ফেলে দেয়নি তো?

ক্লিষ্ট হাসি হাসল ইন্দ্রনাথ, একটা লোক কিন্তু এখনও নিপাত্তা।

কে?

নিশাচর চোর।

চোরের সঙ্গে ধস্তাধস্তি দৌড়োদৌড়ি করলে কিন্তু নারায়ণের রক্তে অ্যাড্রেনালিন বেড়ে যেত। হৃদযন্ত্র চঞ্চল হত। ভেগাস নার্ভ সুবিধে করে উঠতে পারত না।

মাথা নাড়তে নাড়তে ইন্দ্রনাথ বললে–উলটোটাও তো ঘটতে পারে। ধরুন, গভীর রাতে বাড়ি ঢুকেছে চোর। এমন সময়ে দেখল নারায়ণ সিনয় সুইমিং পুলের পাড়ে দাঁড়িয়ে। পালাতেও পারছে না–কেননা পালানোর পথের দিকেই ফিরে দাঁড়িয়ে আছে সিনয়। তাই চুপিচুপি পেছনে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে ওকে জলে ফেলে দিয়েই ভো দৌড় দিয়েছে বাইরে। পুরো দৃশ্যটাই হয়ত দেখে ফেলেছিল ললিতমোহন বাইরে থেকে।

মাই গুড ডিটেকটিভ, মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন ডাক্তার–এ দৃশ্য দেখবার পর ললিতমোহন কি বাহবার লোভে তক্ষুনি পুলিশকে খবর দিত না?

হার মানল ইন্দ্রনাথ।

.

কাপের ওপর, ধোঁয়ার সুতোর পানে তাকিয়ে আত্মগতভাবে বলল ইন্দ্রনাথ-চারটে বস্তু আমরা চার জায়গায় পেয়েছিলাম। কিন্তু একবারও চারটে জিনিসকে পাশাপাশি রেখে একসঙ্গে চিন্তা করিনি। করলাম কাল রাতে। সমাধান পেলাম।

ডাগর চোখে অসীম কৌতূহল নিয়ে কেবল চেয়ে রইল কবিতা কথা বলল না।

ইন্দ্রনাথ তখন সিরিয়াস। ঈষৎ কুঞ্চিত চোখে একাগ্র তীক্ষ্ণতা। কণ্ঠে মাদলের দ্রিমি-দ্রিমি ধ্বনি।

এক নম্বর বস্তু–একটা সিগারেটের দগ্ধাবশেষ।

দুনম্বর বস্তু–চুইংগামের মোড়ক।

 তিন নম্বর বস্তু হিজিবিজি লেখা টিশু বা ট্রেসিং পেপার।

চার নম্বর বস্তু–লোহার কোট ম্যাগাজিন।

পোড়া সিগারেট পড়ে ছিল ললিতমোহনের মৃতদেহের কিছু দূরে, কিন্তু বনলক্ষ্মী-ঋতেশের প্রেমশয্যা থেকে অনেক দূরে।

চুইংগামের মোড়ক ছিল ললিতমোহনের পকেটে।

ট্রেসিং পেপার ছিল শ্যামলেন্দুর জিম্মায় কফির বাকসে।

 লোহার কোট ম্যাগাজিন ছিল ললিতমোহনের ঘরে।

পাশাপাশি চারটে জিনিস টেবিলে রেখে দেখলাম, শুধু সিগারেটটি ছাড়া সবগুলি বস্তুই ললিতমোহনের। সিগারেটটাই বা তার হবে না কেন?

ললিতমোহন হিরের টুকরো ছেলে। ধূমপান করে না। ঋতেশ করে। কিন্তু বনলক্ষ্মীকে ও যেখানে সাময়িক গৃহলক্ষ্মী বানিয়েছিল–

ভদ্রভাষায় বলো, ঘাড় কাত করে গালে হাত দিয়ে শুনতে শুনতেই মন্তব্য করল কবিতা।

সেখান থেকে পোড়া সিগারেট অতদূর যেতে পারে না। আরও একটা কারণে পোড়া। সিগারেটটা ঋতেশের নয়–তাতে অরেঞ্জ লিপস্টিকের ছাপ থাকলেও।

সে-কারণটা হল ফরেনসিক রিপোর্ট। পোড়া সিগারেটটা নাকি যথেষ্ট নাড়াচাড়া করা হয়েছে। সিগারেটের কাগজ দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। তাছাড়া, তামাকটা সদ্য পোড়া নয়– অনেকদিনের পোড়া।

অতএব ঋতেশ বাদ গেল।

সিগারেটটা তা হলে কার? হত্যাকারীর? যে ব্যক্তি এত আটঘাট বেঁধে হত্যা করে, সে এরকম অসতর্ক হবে, ভাবতেই পারি না। সূত্রটা অত্যন্ত মূল্যবান। কেননা, অকুস্থলে সিগারেট ফেলে যাবার মতো নির্বোধ নয় হত্যাকারী।

তবে কি পোড়া সিগারেট ললিতমোহনের পকেটেই ছিল?

ললিতমোহনের পকেটের ফরেনসিক রিপোর্ট পড়তেই অন্ধকারে আলো দেখলাম। পকেটে পোড়া সিগারেটের তামাক পাওয়া গেছে। একই তামাক।

বউদি, কফিতে এতক্ষণে চুমুক দিয়ে বলল ইন্দ্রনাথ, বলো দিকি এ থেকে কী সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত?

পোড়া সিগারেট ললিতের পকেটে ছিল। হত্যাকারী আসার আগেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।

ব্র্যাভো, মাই ডিয়ার বউদি। এইজন্যেই যুগে-যুগে মেয়েরাই ভালো গোয়েন্দা গল্প লিখছেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে সিগারেটটা এতদিন পকেটে রেখে দেবার পর ছুঁড়ে ফেলে দিল কেন?

স্ত্রীর প্রশংসায় আহত কণ্ঠে আমি বললাম হত্যাকারীর হাতে সূত্র দিতে চায়নি বলে।

কিন্তু মৃগ, ললিত জানত না ও খুন হতে চলেছে। ও এসেছিল অ্যাপয়েন্টমেন্ট মত। কেম্পেগৌড়া টাউনের নিশীথ রহস্য শুনতে। রহস্যের নায়ক স্বয়ং যখন হাজির হচ্ছে, তখন পোড়া সিগারেটের সূত্র রেখে আর লাভ কী, এই ভেবেই হয়ত ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল হত্যাকারীর প্রতীক্ষার উশখুশ করার সময়ে। যুক্তিযুক্ত?

মুখ গোঁজ করে রইলাম আমি। শিবনেত্র হয়ে রইল প্রেম। অপাঙ্গে আমার অবস্থা অবলোকন করে হৃষ্টকণ্ঠে কবিতা বলল–কারেক্ট।

ইন্দ্রনাথ বললে–এবারে এসো আসল প্রশ্নে। তুমি কিন্তু এখনও জানো না, পোড়া সিগারেটটা কার এবং ললিত পেল কোথায়।

নারায়ণ সিনয়ের সিগারেট নয় তো? তীব্র সন্দেহটা আচমকা আলোকসম্পাত করল। আমার মস্তিষ্ক-গগনে।

এই তো ব্রেন খুলছে, টিটকিরি দিল ইন্দ্রনাথ। তবে এখনও পুরো খোলেনি। তুই প্রেমাংশুর কথাটাই পুনরাবৃত্তি করলি। চৌবাচ্চার পাড়ে রাখা অ্যাশট্রেতে সিগারেটের ছাই ছিল– কিন্তু সিগারেট ছিল না।

হা-র-র-উ-ম্। গলা সাফ করল প্রেম।

ঠোঁট বেঁকিয়ে কবিতা বললে–কফি খেলেই তো হয়। তারপর?

নারায়ণ সিনয়কে অস্বাভাবিকভাবে মরতে দেখেছে ললিত। মনে রেখো, নিছক জলেডোবা মৃত্যু নয়–অস্বাভাবিক মৃত্যু।

মনে আছে। তারপর?

তার মানে কি এই নয় যে, অকুস্থলে নারায়ণ ছাড়াও আরও একজন ছিল? এমন একজন ছিল যাকে দেখে চুপ করে থেকেছে, নইলে নিশ্চয় চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করত?

চোখ কুঁচকে রইল কবিতা। এমনকী আমিও ক্ষোভ ভুলে চনমনে হলাম। সাসপেন্সের কী মহিমা!

ইন্দ্রনাথ কফি না খেয়েই বলে চলল–নারায়ণের পোড়া সিগারেট নিয়ে ললিতের লাভ কী? নিজেকে যে হবু গোয়েন্দা মনে করে, সে তো হত্যাকারীর সূত্রই পকেটস্থ করার চেষ্টা করবে। বন্ধুগণ, পোড়া সিগারেটটা তাহলে কার?

হত্যাকারীর। ঊর্ধ্বনেত্র হয়ে বলল প্রেম।

এক চুমুকে উত্তাপহীন কফি নিঃশেষিত করে ঠন করে কাপ নামিয়ে রাখল ইন্দ্রনাথ।

বলল–গুড পয়েন্ট। পোড়া সিগারেট তাহলে হত্যাকারীর। সে শুধু সিগারেটই খায় না, তাতে অরেঞ্জ লিপস্টিকও লেগে থাকে। পয়েন্টটা খেয়াল রেখ বউদি। বনলক্ষ্মীর ঠোঁটেও অরেঞ্জ লিপস্টিক ছিল।

প্রখর হল কবিতার হরিণী চক্ষু।

ইন্দ্রনাথ বলল, তোমরা এখনও জানো না, কাল রাতেই কেম্পেগৌডা টাউনের চোর ধরা পড়েছে। অপরাধও স্বীকার করেছে। সে ছিঁচকে চোর-খুন করা তার ঠিকুজিতে নেই। সব ক্রিমিন্যালেরই কাজের নিজস্ব ধারা আছে।

মনুষ্যচরিত্র অতীব বিচিত্র, মন্তব্য করলাম আমি।

বুঝলাম। অর্থাৎ চোরও খুন করতে পারে। নারায়ণ সিনয় হয়ত দেখে ফেলেছিল– তাই তাকে ধাক্কা মেরে জলে ফেলে সে চম্পট দিয়েছে। প্রথমে আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, পালাবার জন্যেই যে ধাক্কা মারবে সিনয়কে, সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে যাবে কেন?

রাইট, প্রেমের মন্তব্য।

সবচেয়ে বড় প্রমাণ, চোরমহাশয় মাইশোর বিড়ির ভক্ত সিগারেটের নয়। বন্ধুগণ, চোরকে সম্ভাব্য খুনির আওতা থেকে বাদ দিতে পারি?

স্বচ্ছন্দে, রায় দিল কবিতা।

এবার দুনম্বর বস্তুর বিশ্লেষণ, চেয়ারের পেছনে মাথা ছেড়ে দিয়ে টেবিলের তলায় পা দুটো টান টান করে ছড়িয়ে দিল ইন্দ্রনাথ–চুইংগামের মোড়ক।

ঘর নিস্তব্ধ। আমরা যেন কাঠের পুতুল।

চোখ মুদে রইল ইন্দ্রনাথ। সেকেন্ড কয়েক নীরবতার পর চোখ মুদেই বললে–চুইংগামের মোড়ক। নির্মাতা, ব্যাঙ্গালোরের একটি কোম্পানি। চুইংগাম খাওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু কী আশ্চর্য! মোড়কটা রয়েছে পকেটে! এরকম কখনও হয়? চোখ খুলল ইন্দ্রনাথচুইংগাম খেয়ে মোড়ক পকেটে রাখা হল কেন?

জবাব নেই।

ইন্দ্রনাথ বললে–এবার তিন নম্বর বস্তু। টিশু পেপারের হিজিবিজি ধাঁধা। সবচেয়ে জটিল হেঁয়ালি।

সাইফার আর কোড-এর মধ্যে তফাত আছে। দুটোই সাংকেতিক পন্থায় লেখা গুপ্তলিপি। কিন্তু সাইফার পদ্ধতিতে লেখা গুপ্ত-দলিল রহস্য নির্ভর করে একটি চাবির ওপর। সব-খোল চাবি বলা যায় তাকে। সেইটি জানলেই পুরো হেঁয়ালির সমাধান করা সম্ভব।

কিন্তু কোড তা নয়। অনেকগুলো প্রতীকচিহ্ন দিয়ে কোড লিখতে হয়। তাই কোড পদ্ধতিতে লেখা গুপ্ত-দলিল পড়তে হলে হাতের কাছে কোড বুক থাকা দরকার। বুঝলে?

না, গালে হাত দিয়ে বলল তীক্ষ্ণ নয়না গৃহিণী।

প্রাঞ্জল করছি। বর্ণমালার প্রত্যেকটা হরফের একটা চিহ্ন থাকে। যেমন, কয়ের বদলে জাহাজ, খয়ের বদলে পাহাড়, গয়ের বদলে চাঁদ। ক খ গ লিখতে হলে জাহাজ পাহাড় চাঁদ আঁকতে হবে। ক্লিয়ার?

হ্যাঁ।

 ললিতমোহনের ঘরে কোডবুক পেয়েছিলাম কি?

 না।

তাহলে সে সাইফার পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। মূল সূত্র একটাই। চিন্তার ক্ষেত্র ছোট করে এনে যেই ভাবনা শুরু করেছি, অমনি একটা বাজে কথা বলে ঘোট পাকিয়ে দিল প্রেম।

হা-র-র-উ-ম! বৃংহিত ধ্বনি করল প্রেম।

মনে পড়ে প্রেম কী বলেছিল টিশু পেপারের সাইফার দেখে?

না, কবিতা বললে।

বলেছিল, তামিল, কানাড়া আর মালয়ালম–এই তিনটে দক্ষিণী ভাষার অক্ষর দেখা যাচ্ছে সংকেতলিপির মধ্যে। যেমন, কানাড়া বর্ণমালা থেকে নেওয়া হয়েছে ল আর ব। তামিল থেকে ড আর মালয়ালম থেকে ট৷

আমি বলেছিলাম কিছু ইংরেজি অক্ষরও ওপর-ওপর লেখা হয়েছে, বলল কবিতা। আর আমার কত্তা বলেছিল, হাতে সময় চাই। পরে বলব।

কিন্তু বলেনি। সেই কারণেই বলছিলাম, মেয়েরাই ভালো গোয়েন্দা-লেখিকা হয়–যেমন তুমি।

আমি?

লোকে সন্দেহ করছে, মৃগ-র লেখাগুলো তুমিই লিখে দাও। যেমন ধরো না কেন, টিশু পেপারের সাইফার রহস্য সবাই ভুল করল–তুমি বাদে।

অক্ষরগুলো ইংরেজি?

হ্যাঁ। আমাকে ভুল পথে চালিয়েছে প্রেম ওর স্বল্প জ্ঞান দিয়ে।

হা-র-র-উ-ম!

তুমিই প্রথম আমার মাথায় সূত্রটা ঢুকিয়ে দিলে ইংরেজি অক্ষর। দক্ষিণি হোক, ইংরেজি হোক–অক্ষর। প্রমাণ–একই মাপের আয়তক্ষেত্রের মধ্যে প্রতিটি ইকড়িমিকড়ি ফিট করে যায়।

এ থেকেও প্রমাণিত হল–লিপিটা কোড নয়। কোড হলে হরফগুলো রকমারি সাইজের ছবি হত।

প্রেম আমার সোজা চিন্তাকে ভন্ডুল করে দিল দক্ষিণি অক্ষরের কথা বলে। কাল রাতে তোমরা যখন ঘুমিয়ে কাদা, আমি তখন আলেকজান্ডারকে টেনে তুলেছিলাম। দক্ষিণ ভারতের অনেকেই তামিল, কানাড়া, মালয়ালম, তেলেগু–এই চারটি দক্ষিণী ভাষা রপ্ত করে ফেলে। আলেকজান্ডার তার ব্যতিক্রম নয়।

ওকে আমি বললাম, কানাড়া ভাষায় লি আর ব, তামিল ভাষায় ড আর মালয়ালম ভাষায় ট লিখতে। সাইফার লেখা কাগজ তিনটেও দেখালাম। ঘুমচোখে ও দেখল, কিন্তু লিখে দিল। সে লেখা দেখে চোখ খুলল আমার এবং বুঝলাম প্রেম একটা।

কী লিখল, তাই বল। কবিতা বললে রুদ্ধশ্বাসে।

আলেকজান্ডার চারটে ইংরেজি অক্ষর লিখে দিয়ে ঘুমোতে চলে গেল।

আবার ঘর নিস্তব্ধ। প্রেম শিবনেত্র। কবিতার ললাট কুঞ্চিত। আমি হতচকিত। ইন্দ্রনাথ পা নাচাতে নাচাতে বললে-বন্ধুগণ, কানাড়ায় ল মানে ইংরেজি C, ব মানে W, তামিল ড হল ইংরেজি L, আর মালয়ালম ট হল ইংরেজি S।

ঘুরেফিরে তাহলে বউদির সিদ্ধান্তেই আসতে হল। অক্ষরগুলো ইংরেজি। কিন্তু সাদৃশ্য আছে দক্ষিণি হরফের সঙ্গে।

টিশু পেপার তিনটে জোর আলোর নীচে রেখে ফের দেখলাম, পেনসিলের দাগ, কাগজ ফুঁড়ে বেরোয়নি, পেছনেও উঁচু-উঁচু হয়নি। অর্থাৎ পাতলা কাগজটাকে হয় টিন, না হয় প্লাস্টিকের ওপর রেখে লেখা হয়েছিল।

ললিতমোহনের ঘরের প্রতিটি বস্তু চোখের সামনে ভেসে উঠল। টিন বা প্লাস্টিক বা ওই জাতীয় মসৃণ, কঠিন বস্তু দেখেছি বলে মনে পড়ল না।

অথচ আমরা জানি, রোববার ওই দৃশ্য দেখে বাড়ি ফেরার পর রাত জেগে ঘরের মধ্যেই ধাঁধা রচনা করেছে ললিত।

অন্যমনস্কভাবে চুইংগামের মোড়ক আর টিশু-পেপারগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছি, এমন সময়ে লক্ষ্য করলাম, মোড়কের যা সাইজ, টিশু পেপারেরও সেই সাইজ।

বুকের রক্ত ছলকে উঠল। ওপর-ওপর রাখতেই বুঝলাম, টিশু-পেপার মোড়কের ভেতরেই ছিল। চুংগাম প্যাক করার রীতিই তাই।

মোড়কের সঙ্গে পাতলা কাগজ মিলিয়ে রাখতে গিয়ে দেখলাম, অধস্বচ্ছ টিশু-পেপারের মধ্যে দিয়ে মোড়কের লেখা দেখা যাচ্ছে। লেখাটা ইংরেজি।

এবং অক্ষরগুলো পাতলা কাগজের ওপর পেনসিলে লেখা অক্ষরের মাপের।

পাতলা কাগজ সরিয়ে নিলাম। দেখলাম, মোড়কের পেছনে একটা মজার ছড়া লেখা। আবোল তাবোল ইংরেজি ছড়া।

আমার বুকের মধ্যে ঢেঁকির পাড় পড়তে লাগল। পাতলা কাগজটাকে ট্রেসিং পেপার হিসেবে ব্যবহার করা হয়নি তো?

আবার কাগজটাকে রাখলাম মোড়কের ওপর। স্পষ্ট দেখতে পেলাম না। আলোর সামনে তুলে ধরলাম। দেখলাম একই মাপের হরফ।

কিন্তু শূন্যে তুলে ধরে কপি করি কী করে?

ললিতমোহনও নিশ্চয় একই সমস্যায় পড়েছিল। কপি করেছিল কী করে?

ললিতের ঘরটা ফের চোখের সামনে ভেসে উঠল। শোবার ঘরের পাশেই রাস্তা। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো জানলার কাঁচে পড়ে। ট্রেস করার উপযুক্ত ব্যবস্থা। কাচের ওপর কাগজ রেখে পেনসিল দিয়ে কপি করা কি কিছু কঠিন?

একটার পর একটা আবিষ্কার রেস-হর্সের মতো ছুটতে লাগল মাথার মধ্যে দিয়ে। শক্ত, নিরেট মসৃণ বস্তুটা তাহলে জানলার কাঁচ। গুড।

আমি আলোর সামনে রেখে মোড়কের হরফের সঙ্গে পাতলা কাগজের হিজিবিজি হরফগুলো মিলিয়ে দেখতে লাগলাম। সময় লাগল অনেক। কিন্তু সমাধান এসে গেল হাতে।

থামল ইন্দ্রনাথ। তাকিয়ে দেখি, কবিতার নাসারন্ধ্র স্ফীত। দুই ভুরুর মাঝে সমান্তরাল দাঁড়ি। এক কথায়, চূড়ান্ত তন্ময়তা।

বউদি, বলল ইন্দ্রনাথ। ললিত সত্যিই ভালো গোয়েন্দা হতে পারত। ক্ষণজন্মা ছেলে। উদ্ভট ইংরেজি ছড়ার কতকগুলো শব্দের শুধু প্রথম অক্ষরটাও ইচ্ছে করেই জড়িয়ে মড়িয়ে কপি করেছে পাতলা কাগজে। লেখা আছে কয়েকটি অক্ষর।

বীজগণিতের ফর্মুলা মনে হচ্ছে, মন্তব্য করলাম আমি।

মনে করানোর জন্যেই ওইভাবে লেখা হয়েছিল, এমনও তো হতে পারে? প্রতিবাদ জানাল কবিতা।

উষ্ণকণ্ঠে বললাম–তাই নাকি?

আমার উষ্মা উপভোগ করল ইন্দ্রনাথ। বলল হৃষ্টকণ্ঠে বন্ধুবর মৃগাঙ্ক, বউদি ঠিকই বলেছে। ওটা বীজগণিতের অঙ্ক নয়।

কবিতা বললে–শুনতে পেলে না ঠাকুরপো কী বলল? ইংরেজি ছড়ার কতকগুলো শব্দের প্রথম অক্ষরগুলো শুধু কপি করেছে ললিতমোহন। তার মানে কি এই নয় যে, প্রত্যেক অক্ষরের সঙ্গে লাগোয়া পুরো শব্দটা বেছে নিলেই ধাঁধার জবাব মিলবে?

এগজ্যাক্টলি, সায় দিল ইন্দ্রনাথ।

এবং পাঞ্জাবির পকেট থেকে এক তাড়া কাগজ বার করে বাড়িয়ে দিল–শব্দগুলো সাজিয়ে লিখলে এই দাঁড়ায়–

এক নং টিশু পেপারের সমাধান

 Current Issue.

Iron Coat.

দু নং টিশু পেপারের সমাধান

 See Quiz.

 তিন নং টিশু পেপারের সমাধান

First Word.

Third Live.

সোজা বাংলায়, লোহার কোট ম্যাগাজিনের বর্তমান সংখ্যার ধাঁধা দেখুন। প্রতি তৃতীয় পঙক্তির প্রথম শব্দটি তুলে নিন।

সাবাস! সপ্রশংস চাহনি কবিতার–ম্যাগাজিনটা কোথায়?

এই তো, আরেক পকেট থেকে বেরোল লোহার কোট পত্রিকার চলতি সংখ্যা। কবিতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললে–জোরে পড়ো।

কবিতা পড়ল। সত্যিই উদ্ভট ছড়া! শিরোনাম–মজার নাচন।

কেকা নাচে কুকুর নাচে নাচেরে বাটপার,
 ক্ষিদের জ্বালায় শিশু নাচে নাচে মজুতদার।
 হিপির সঙ্গে হিপিনী নাচে খেয়ে ধেনো চোলাই,
ভদ্দর মেয়ে নাচছে পথে।
 বলিহারি যাই।
বুকে বসে পুলিশ নাচে লয়ে হাতে ডান্ডা,
 ছাত্রছাত্রী নাচছে ক্লাসে
 হাতে নিয়ে ঝান্ডা।
 বসে বসে নাচে ডাক্তার রুগি অক্কা পেলে,
ভূত নাচে পেতনি নাচে
দল ভারি হলে।
কিল চড় খেয়েও নাচে শুড়িখানার মাতাল,
 গরু নাচে মোষ নাচে
প্রমাণ ওই খাটাল।
মারছে সবাই–পাগলা নাচন তবুও নাহি থামে;
ধিন ধিনা ধিন তুনকাতুনা
মুনকামুনা গানে।

প্রোজ্জ্বল চোখে বললে কবিতা–ঠাকুরপো, সমাধানটা আমি বলছি, প্রতি তৃতীয় লাইনের। প্রথম শব্দ তুলে নিচ্ছি। শোনো এবার…

হি-পি-র বুকে বসে কি-ল মা-র-ছে। একটু থেমে–কে কিল মারছে, ঠাকুরপো?

কেকা, দুই চোখে হাসি উপচিয়ে বলল ইন্দ্রনাথ! প্রথম লাইনের প্রথম শব্দটা।

চোখ কুঁচকে চেয়ে রইল কবিতা–ইন্টারেস্টিং! কেকা হি-পি-র বুকে বসে কিল মা-র-ছে! হিপি মানে তো নারায়ণ সিনয়, তাই না ঠাকুরপো? হিপির মতো চুল রাখত?

এগজ্যাক্টলি।

 কেকা কার নাম?

বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল ইন্দ্রনাথ–কর্নেল হেব্বালের বড় মেয়ের নাম।

হা-র-র-উ-ম্! চোখ নামিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল প্রেম–দশটা বাজতে চলল। উঠে পড়, ইন্দ্র।

হ্যাঁ, যাই চল।

কোথায় যাবে? বিমূঢ় কণ্ঠ কবিতার। বিমূঢ় আমিও–একেবারে বারহিত।

কর্নেল হেব্বালের বাড়ি। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

অ্যাপয়েন্টমেন্ট? কখন হল?

আজ ভোরে। উনি ঘোড়া নিয়ে পোলো প্র্যাকটিস করছিলেন, আমি আর প্রেম হাওয়া খাচ্ছিলাম। আলাপ হয়ে গেল।

হঠাৎ ওখানে হাওয়া খেতে গেলে কেন?

কেন না, চন্দনবন, টেনিস ক্লাব, পোলো গ্রাউন্ড আর কর্নেল হেব্বালের বাড়ি এক লাইনে বলে।

এক লাইনে?

হ্যাঁ। চন্দনবনের একদিকে টেনিস ক্লাব। টেনিস ক্লাবের পাশেই পোলো গ্রাউন্ড। কেম্পেগৌডা টাউন মাইল দুয়েক দূরে–একই লাইনে।

ঠাকুরপো, তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইল কবিতা–তুমি কর্নেলকে কী চোখে দেখছ?

হেসে উঠল ইন্দ্রনাথ–প্রেম, পাঁচ মিনিট সময় নিচ্ছি। বউদি শোনো, কেকা কর্নেলের বড় মেয়ে। বাড়িতে কানাডা প্রবাসী হিপি টাইপের অতিথি। হয়ত শ্লীলতাহানি করতে গিয়েছিল। গভীর রাতে। কেকা বাঘিনীর মতো কিল চড় ঘুসি মেরে শুইয়ে দিয়েছিল।

তারপর? সূচী-তীক্ষ্ণ চাহনি কবিতার।

তারপর দুটো সম্ভাবনা থাকছে। মারতে মারতে কেকা হিপিকে ফেলে দিতে পারে সুইমিং পুলে, অথবা কর্নেল হেব্বালের মাথায় খুন চেপে যাওয়ায়–

নিজেই ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন। কেমন?

ফ্যামিলি কেলেঙ্কারী এড়াতে মানুষ সব করতে পারে। বিশেষ করে কর্নেলের মতো মানুষ যিনি বংশমর্যাদা সম্বন্ধে বেশি সচেতন।

ঘড়ি দেখে উঠে পড়ল প্রেম–আর নয়, দেরি হয়ে যাবে।

তুমি কি কেকা-কে জেরা করবে? কবিতাও উঠে দাঁড়াল।

ইন্দ্রনাথ বললে–কেকা বাড়িতেই নেই। মাইশোরে গেছে। কর্নেল দুই মেয়েকেই সরিয়ে দিয়েছেন বাড়ি থেকে।

বলো কী?

কিন্তু আমরা ছাড়ছি না। কর্নেলের সঙ্গে মোলাকাত করেই আমি যাব মাইশোর। ফিরব রাত্রে।

ধড়মড়িয়ে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়লাম আমি–ইন্দ্র, আমি যাব।

.

স্টুয়ার্ট গ্র্যাঞ্জারের স্ক্যারামুস দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। দীর্ঘ, দৃপ্ত বপু। তীক্ষ্ণ নাক। কানের ওপর চুলে পাক। পুরুষসিংহ বলতে যা বোঝায়। আকাশের বিদ্যুৎ যেন হাতে পায়ে ভর করে অসিচালনার সময়ে।

সিনেমার স্টুয়ার্ট গ্র্যাঞ্জারকে মূর্ত হতে দেখলাম কর্নেল হেব্বালের মধ্যে। অবিকল সেই চেহারা, সেই ক্ষিপ্রতা, সেই পৌরুষ।

তফাৎ শুধু মুখচ্ছবিতে।

স্টুয়ার্ট গ্র্যাঞ্জার কৌতুকরসে টলমল।

কর্নেল হেব্বাল গম্ভীর, গড়ুর নাসিকায় অসীম ঔদ্ধত্য, চাপা ঠোঁটে নিঃসীম দম্ভ, গ্রানাইট চোখে নীরব নিষ্ঠুরতা।

রোদেপোড়া তামাটে রং। যেন, ব্রোঞ্জ মূর্তি।

চাকরবাকরকে বলে রেখেছিলেন, আমরা এলেই যেন বসবার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। মস্ত হলঘর। মহার্ঘ আসবাবপত্র। একদিকের দেওয়ালে কড়িকাঠ থেকে মেঝে পর্যন্ত একটা তৈলচিত্র। চওড়ায় পনেরো ফুট, লম্বায় বিশ ফুট। এতবড় অয়েল পেন্টিং শুধু ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলেই দেখেছিলাম।

এক ফুট চওড়া সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো তৈলচিত্রের মানুষটি যেন জীবন্ত। অসিচালনায় ব্যস্ত। প্রতিপক্ষের মুখে মুখোশ। কর্নেল হেব্বালের মুখ অনাবৃত। বাঁ হাত শূন্যে উত্থিত। ডান হাতে ঝিকিমিকি তরবারি।

বিমুগ্ধ চোখে চেয়েছিলাম পুরুষসিংহের প্রতি। ভদ্রলোক যে অসিচালনাতে নিপুণ, তা তো জানতাম না।

সহসা কানে ভেসে এল অসির ঝনঝনানি। ইস্পাতে-ইস্পাতে ঠোকাঠুকির ঝনকার। যেন। স্ফুলিঙ্গ বৃষ্টি হচ্ছে। মরণপণ দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে দুই যোদ্ধা।

না, কল্পনা নয়। সত্যি। পাশের ঘরে বুঝি মহড়া চলছে তরবারি যুদ্ধের।

সন্ত্রস্ত ভৃত্যটি এস্তে অন্তর্হিত হল অন্দরে। ক্ষণপরেই স্তব্ধ হল তরবারির ঝনৎকার। দীর্ঘ পদক্ষেপে জুতো মসমঁসিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন গৃহস্বামী কর্নেল হেব্বাল।

হাতের দস্তানা খুলতে খুলতে পর্যায়ক্রমে চাইলেন আমাদের ত্রিমূর্তির পানে। তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, শাণিত দৃঢ় চিবুক আর প্রশস্ত চিক্কণ ললাট। প্রখর ব্যক্তিত্ব। পরনে ঘোড়সওয়ারের বেশ। আঁটসাট পাতলুন, পুলওভার।

দস্তানা খোলা হয়ে গেল। ডান হাতে দস্তানা ধরে বাঁ-হাতের তালুতে মৃদু আছাড় মেরে বললেন কুলিশ কঠোর কণ্ঠে–আপনারা দেরি করেছেন।

বসতেও বললেন না। নিজেও বসলেন না। দুপা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে রইলেন প্রকাণ্ড তৈলচিত্রের সামনে।

কাষ্ঠহেসে প্রেম বলল–একটু দেরি হয়েছে।

অনিমেষ রইল মর্মভেদী চাহনি–টিপিক্যাল ইন্ডিয়ান।

 অ্যাটিপিক্যাল, মুখ টিপে বলল ইন্দ্রনাথ।

ঈষৎ উত্থিত হল ডানদিকের ভুরু–মানে?

ঠিক উলটো।

কুলিশ কঠোর চাহনি ক্ষণেক স্থির রইল ইন্দ্রনাথের ভাবলেশহীন মুখে।

 তারপর-ইনি কে? প্রশ্নটা আমাকে নিয়ে।

আমাদের বন্ধু। লেখক মৃগাঙ্ক রায়।

বসুন, নিজে বসলেন একটা কেদারায়–আমার কাছে কেন এসেছেন? প্রশ্নটা নিক্ষিপ্ত হল প্রেমাংশুর প্রতি উপেক্ষা করা হল ইন্দ্রনাথকে।

ভীম কলেবর নাড়িয়ে সোজা হয়ে বসল প্রেম–ললিতমোহন এ-বাড়িতে আসত। তাই কয়েকটা প্রশ্ন জিগ্যেস করতে চাই।

তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন কর্নেল–দিনকয়েক এসেছিল। তারপর আমি বারণ করে দিয়েছিলাম। বাজে ছেলে।

ললিতের শোচনীয় মৃত্যু আপনার মনে কোনও দাগ কাটেনি দেখছি।

 চোখে চোখে চেয়ে রইল প্রেম।

চোখ না সরিয়েই বললেন কর্নেল–বাজে ছেলেকে নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।

আশ্চর্য! সবাই কিন্তু ওকে হিরের টুকরো বলছে।

আপনার জিজ্ঞাসাগুলো তাদেরকে জিগ্যেস করলেই পারতেন।

রূঢ়কণ্ঠ। কিন্তু তিলমাত্র বিচলিত হল না প্রেম।

আপনি রেগে যাচ্ছেন। ললিত আপনার বিরাগভাজন হল কেন, সেইটাই জানতে চাইছি।

কৃষ্টির অভাব। ওই সোসাইটির ছেলের সঙ্গে আমি আমার মেয়েদের মিশতে দিই না।

ললিত কিন্তু রামকৃষ্ণ আশ্রমে পরিচিত হয়েছিল আপনার স্ত্রী আর মেয়ের সঙ্গে। সেখানে বাজে লোক যায় না।

হতে পারে। কিন্তু ভালো বংশের ছেলে নয়।

শিরায় নীলরক্ত নেই, এই কি তার অপরাধ?

কী বলতে চাইছেন? কড়া গলা কর্নেলের।

আপনি তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন কেন? সমান উষ্ণতা প্রেমের কণ্ঠেও।

আপনার কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি নই আমি। আপনারা আসতে পারেন।

রক্তোচ্ছাস দেখা গেল প্রেমের চোখে। কর্নেল কিন্তু নিথর।

হেসে উঠল ইন্দ্রনাথ–আপনার পারিবারিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার কোনও অধিকার আমাদের নেই, কর্নেল। ললিতের সঙ্গে আপনার মেয়েদের গল্পসল্প হত। তাই এসেছিলাম নতুন সূত্রের আশায়।

ছেলেটা অকালপক্ক–এ ছাড়া কিছু বলার নেই।

অকালপক্ক! ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবল ইন্দ্রনাথ। তা হতে পারে। মাইশোরে আপনার মেয়েরা কোথায় উঠেছে?

কেন?

তাদের সঙ্গে কোনও অশোভন আচরণ করা হয়েছিল কি না জানতে চাই।

সেরকম কিছু হলে আমি জানতে পারতাম।

সম্ভব নয়, কর্নেল। মেয়েরা এসব ব্যাপার বাবাকে বলে না।

 বাঁ হাতের তালুতে ডান হাতের দস্তানা আছড়ে পড়ল একবার…দুবার..তিনবার।

ধীর কণ্ঠে বললেন কর্নেল–লিখে নিন ঠিকানা। কিন্তু মনে রাখবেন, আমার পারিবারিক সম্মান যেন কোথাও ক্ষুণ্ণ না হয়। পুলিশ আমার মেয়েদের জেরা করুক, আমি তা চাই না। কিন্তু এই একটি কথা জিগ্যেস করলেই যদি এ-বাড়িতে পুলিশের আনাগোনা বন্ধ হয়, তবে তাই হোক।

লাঞ্ছিত মুখে ঠিকানাটা লিখে নিল প্রেম।

কেদারা ছেড়ে উঠি-উঠি করে কর্নেল বললেন–তাহলে?

আর একটা প্রশ্ন, বলল ইন্দ্রনাথ। নারায়ণ সিনয়ের মৃত্যু সম্পর্কে দু-একটা খবর জানতে চাই।

চোখের ভুল কি না জানি না, নিমেষের মধ্যে একটা চাপা উদ্বেগ যেন ভেসে গেল কর্নেলের পাথর কঠিন চোখের তারায়।

বললেন ধীর স্থির কণ্ঠে–তার সঙ্গে এ খুনের কী সম্পর্ক?

কোনও সম্পর্ক নেই। খবরের কাগজে যে খবরটা ছাপা হয়েছিল, তাতে বানান বিভ্রাট ছিল। তাই একটা কৌতূহল মিটিয়ে নেব।

এবার আর ভুল নয়। স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম, উদ্বেগের পাষাণটা নিমেষ মধ্যে যেন নেমে গেল কর্নেলের বুক থেকে।

ইন্দ্রনাথ বললে–খবরের কাগজে লিখেছে এ টিপিক্যাল ড্রাউনিং মামুলি জলে ডোবা মৃত্যু। কিন্তু করোনার বলছেন, ওটা হবে অ্যাটিপিক্যাল ড্রাউনিং–অস্বাভাবিকভাবে জলে ডুবে মৃত্যু।

নির্নিমেষে চেয়ে রইলেন কর্নেল।

তফাতটা জানতে এলাম, নিরীহ কণ্ঠ ইন্দ্রনাথের। উত্তেজনার কোনও কারণ ঘটেছিল কি?

উত্তেজনা? নারায়ণ সাঁতার জানত না। সবাই টিটকিরি মারত। তাই বোধহয় রাতবিরেতে একাই সাঁতার শিখতে গিয়েছিল।

একেবারে উলঙ্গ হয়ে? যেন শেলবর্ষণ করল ইন্দ্রনাথ।

থ হয়ে বসে রইলেন কর্নেল।

উঠে পড়ল ইন্দ্রনাথ। গূঢ় হেসে বললে–প্রশ্ন তো সেইখানেই, কর্নেল। সাঁতারের পোশাক না পরে কেউ জলে নামে?

থেমে-থেমে বললেন কর্নেল–মনে রাখবেন, নারায়ণ কানাডায় মানুষ। আমাদের চোখে যা দৃষ্টিকটু, ওদেশে তা আকছার ঘটছে। ন্যুড ক্লাব ওদেশেই সম্ভব–এদেশে নয়।

কথাটা মনে ধরল ইন্দ্রনাথের–তা ঠিক…তা ঠিক। মৃগাঙ্ক, তোমার পয়েন্ট তুমি পেয়ে গেলে। এবার শুরু করো লেখা। আচ্ছা আসি, কর্নেল। ও হ্যাঁ, একটা কৌতূহল যে এখনও গেল না।

আবার কী?

আপনার ফেন্সিং মাস্টার কে?

এই প্রথম হাসতে দেখলাম কর্নেলকে। বিচিত্র হাসি। যেন পাথর কুঁচকে উঠল ভূগর্ভ আলোড়নে।

বললেন–দেখবেন আসুন।

আমরা তিনজনেই গেলাম পাশের ঘরে। ঘর নয়–হলঘর। একদম ফাঁকা। দেওয়ালে দেওয়ালে রকমারি তরবারি, ঢাল, কুঠার, টাঙি, বর্শা।

ঘরের ঠিক মাঝখানে লোহার বর্মপরা একটি মূর্তি।

মাথায় লোহার শিরস্ত্রাণ। ডান হাতে সুতীক্ষ্ণ তরবারি। মুখে লৌহ মুখোশ।

সুইচ বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে একটা সুইচ টিপে দিলেন কর্নেল। অমনি নড়ে উঠল লৌহমূর্তি। পদযুগল সেঁটে রইল মেঝেতে। চঞ্চল হল উধ্বাঙ্গ এবং ডান হাতের তরবারি।

স্পিংয়ের স্বয়ংচালিত পুতুল। ঠিক অসিযোদ্ধার মতোই অসি ঘুরতে লাগল ডাইনে-বাঁয়ে।

কাঠের র‍্যাকে সারি-সারি সাজানো তরবারির মধ্যে থেকে একটি বেছে নিলেন কর্নেল। বাঁ-হাত শূন্যে তুলে ডান হাতের তরবারি মিলোলেন লৌহমূর্তির হাতিয়ারে।

মনের চোখে ভেসে উঠল স্ক্যারামুস ছায়াছবি। সেই ক্ষিপ্রতা, সেই পৌরুষ, সেই ঝনকার!

সুইচ টিপে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন কর্নেল।

পাথর কঠিন হেসে বললেন–আমার আবিষ্কার। প্র্যাকটিস করার দোসর পাওয়া মুশকিল–তাই।

সপ্রশংস চোখে বলল ইন্দ্রনাথ–হাতের কাজ মিটে গেলে এক হাত খেলে যাওয়ার ইচ্ছে রইল।

আপনি? জানেন ফেন্সিং?

সামান্য। কলকাতায় ফ্রেঞ্চ এক্সপার্টের কাছে রপ্ত করেছিলাম কারণ থ্রিল আমার রক্তে। কারণ আমি পেশাদার। তাই বছরে একবারও রিভলভার ছোঁড়ার দরকার না হলেও, রাইফেল ক্লাবে যাই নিয়মিত। জাপানি মাস্টারের কাছে জুডো শিখি, ক্যারাটে মাস্টারের কাছে ক্যারাটে। কারণ আমি প্রফেশন্যাল–অ্যামেচার নই। আচ্ছা, আসি কর্নেল।

ভ্রুকুটি চোখে তাকিয়ে রইলেন কর্নেল হেব্বাল।

নমস্কার জানিয়ে বেরিয়ে এলাম গাড়ি বারান্দায়। জিপের সামনে দাঁড়িয়ে অঙ্গুলি সংকেতে মালিকে ডাকল ইন্দ্রনাথ।

শুধোলো কুকুরটা কোথায়?

 মারা গেছে।

 কবে?

পরশু।

 চলন্ত জিপে প্রথম প্রশ্ন করলাম আমি।

ইন্দ্র, বাড়িতে কুকুর আছে, তা না হয় জেনেছিস ফটকের Beware of Dog বিজ্ঞপ্তি দেখে। কিন্তু এত প্রাণী থাকতে শুধু কুকুরের খোঁজ পড়ল কেন?

স্টিয়ারিংয়ে হাত আর চোখ সামনে রেখে অকস্মাৎ গর্জে উঠল প্রেম–দ্যাট স্কাউন্ডেল কর্নেল

প্রেম, অ্যাকসিডেন্ট করিসনি, বলল ইন্দ্রনাথ। তদন্ত বেশ সন্তোষজনক হয়েছে মনে হল হৃষ্ট স্বর শুনে। মৃগ, তোর কথার জবাব দেব মাইশোর যাওয়ার পথে। তার আগে কাটার জানলাটা দেখে যা।

কাঁটার জানলা!

প্রেম, ওই তো জায়গা..দাঁড়া। কাঁচ করে ব্রেক কষল প্রেম। আমাকে নিয়ে নেমে পড়ল ইন্দ্র।

চওড়া রাস্তা। দূরে দূরে ফিকে গোলাপি আর সাদা রঙের বাড়ি। নবনির্মিত স্যাটেলাইট কলোনি। রাস্তায় পথচারী এবং যানবাহন দুটিই কম।

ফুটপাতের ওপর দিয়ে কাটাঝোপের মানুষ-সমান প্রাচীর। কর্নেল হেব্বালের পুরো বাড়ি ঘিরে রয়েছে এই কাটার প্রাচীর। ইন্দ্রনাথ আমাকে নিয়ে এল এই কাটার দেওয়ালের সামনে।

বলল–আজ সকালে অকারণে হাওয়া খেতে বেরোইনি। টাউন পরিক্রমায় বেরিয়ে কোন ফোকর দিয়ে সুইমিং পুল দেখতে পেয়েছিল ললিত, আবিষ্কার করতে এসেছিলাম।

প্রথমে একটা চক্কর দিলাম। কিন্তু পুরু ঝোপের মধ্যে দিয়ে চোখ চলল না।

তারপর খেয়াল হল, আমি ললিতের চেয়েও লম্বা। ললিতের সমান লম্বা না হলে কাটার জানলা চোখে পড়বে কেন?

তাই মাথা খাটো করে ফের হাঁটতে লাগলাম কাটার দেওয়ালের পাশ দিয়ে।

 এইখানে এসে পেলাম জানলাটা। দেখেছিস?

তর্জনী সংকেতে ফোকরটা দেখিয়ে দিল ইন্দ্রনাথ। ছোট্ট একটা ঘুলঘুলি। সদ্য ভাঙা ডাল তখনও পড়ে পায়ের কাছে।

ফোকরে চোখ রাখতেই দেখলাম একটা সবুজ জলাধার। বাঁধানো পাড়। বেশ খানিকটা দূরে যদিও–তাহলেও স্পষ্ট।

.

জিপ ছুটল মাইশোর সিটি-র দিকে।

 ইন্দ্রনাথ প্রসন্ন চোখে বাইরে তাকিয়ে বললে–প্রেম, কতক্ষণ লাগবে?

 খুব জোর আড়াই ঘণ্টা–আশি মাইল পথ তো।

ইন্দ্র, কুকুরের মৃত্যু নিয়ে তোর টনক নড়ল কেন, এখনও বলিসনি, বললাম আমি। ইন্দ্রনাথ যা বলল, তা এইঃ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *