লোহার কোট – ২

শ্যামলেন্দুকে সঙ্গে নিয়ে বসবার ঘরে ঢুকলাম আমি আর ইন্দ্রনাথ। হাতে টফির বাক্স।

লুঙ্গির ওপর ফুলকাটা ড্রেসিংগাউন চাপিয়ে তখন সোফায় জাঁকিয়ে বসেছেন রাখালরাজ। হাঁটুর ওপর খাতা খুলে বসে প্রেমাংশু। টিপয়ে ধূমায়িত কফি এবং ধোসা।

আমাদের দেখেই হারমোনিয়াম দাঁত বার করে অট্ট হেসে বললেন রাখালরাজ–আপনার পরিচয় এইমাত্র পেলাম ইন্দ্রনাথবাবু। গরিবের গৃহ ধন্য হল আপনার পদধূলিতে। হাঃ হাঃ হাঃ।

ভদ্রলোকের হাসিটা যেন কেমনতর।

 ইন্দ্রনাথ কাষ্ঠ হেসে ভদ্রতা জানাল। শুধোল প্রেমাংশুকে–জেরা শেষ?

একরকম। উনিও বলছেন, ললিত ছেলেটা হিরের টুকরো। এঁচড়ে-পাকা মোটেই নয়। খাতা-পেন্সিল মুড়ে ধোসার দিকে হাত বাড়াল প্রেমাংশু।

সত্যিই ভালো ছেলে মশাই। দাঁড়িয়ে কেন? বসে পড়ুন। ধোসা জিনিসটা জুড়িয়ে গেলে বিষ। ললিত আজকালকার ছেলেরে মতো সবজান্তা নয়। বলব কী মশায়, আমাদের সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশন পর্যন্ত গিয়ে বসে থাকে। ও কী..ও কী…ধোসা খেলেন না?

তিন চুমুকে কফির কাপ শেষ করে ঠন্‌ করে নামিয়ে রাখলে ইন্দ্রনাথ। বলল–আরেক দিন। আয় প্রেম।

সতৃষ্ণ নয়নে গরম ধোসার দিকে তাকিয়ে অগত্যা আমাকেও চুমুক দিতে হল কফির কাপে।

রাখালরাজ সত্যিই বেশি বকেন। শশব্যস্তে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–আমার মাইশোর সিল্কের কারবার, স্যার। চৌরঙ্গিতে শোরুম আছে। দরকার থাকলে বলবেন–লাভ নেব না।

আমি ব্যাচেলর, বলতে-বলতে বেরিয়ে গেল ইন্দ্রনাথ।

 দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাবি খেলেন রাখালরাজ।

গাড়িতে উঠে ব্যাজার মুখে বললে প্রেমাংশু–পণ্ডশ্রমই সার। বিকেল পাঁচটা থেকে ছটার মধ্যে ললিতমোহন কোথায় ছিল, কার কাছে ছিল–এখনও তা রহস্য।

টফির বাক্সর ডালাটা এঁটে গিয়েছিল। আঙুলের চাড় মেরে ইন্দ্রনাথ বললে–রহস্যের। সমাধান আমার হাতে।

সে কীরে?

 কবিতাও উৎসুক চোখে তাকাল বাক্সটার দিকে। টিনের বাক্স। ওপরে ফুলের ছবি।

আমি বললাম–কিন্তু তুই জানলি কী করে বাক্সটা ওখানে আছে?

ডালাটা সত্যিই এঁটে গিয়েছিল। এবার দু-হাত লাগিয়ে বললে ইন্দ্রনাথঃ

দুটো কারণে। প্রথমত বিপদ এলে মানুষমাত্রই আগে প্রাণপ্রিয় বস্তুটা বাঁচাতে চায়। পুলিশ দেখেই শ্যামলেন্দু গ্যারেজে পালাল কেন? আরও তো জায়গা ছিল। দ্বিতীয় কারণটা আরও সহজ। প্রেমাংশু এটা-ওটা নাড়ছিল বলে ভয়ে কাঠ হয়েছিল শ্যামলেন্দু। তাই ওকে সরিয়ে দিতেই স্বস্তি পেল ছেলেটা। আরও স্বস্তি পেল আমি পেছন ফিরতেই। হাঁফ ছেড়ে তাকাল মোটরের বডির দিকে।

কিন্তু পিছন না ফিরেই দেখলি কী করে?

আয়নার ভেতর দিয়ে।

 ঘটাং করে খুলে গেল টিনের ঢাকনি।

 ভেতরে কিছু নেই। খালি বাক্স।

.

মুখ কালো হয়ে গেল ইন্দ্রনাথ রুদ্রের। ঈষৎ কুঞ্চিত হল চক্ষুতারকা।

 কবিতা ঠাট্টার সুরে বললে–কী ঠাকুরপো, এই নাকি তোমার রহস্যের সমাধান।

চোখ তুলল ইন্দ্রনাথ। চোখ আর স্বপ্নসুন্দর নেই, ইস্পাতকঠিন। গলার স্বরেও শুনলাম রুদ্রকঠোর ডম্বরুধ্বনি–

আমাকেও বোকা বানিয়েছে। ফিরে চল প্রেম। কালো দাগটার মানে জেনে আসি।

কালো দাগ! কীসের?

শ্যামলেন্দুর গালে আর হাতে ভুসোর দাগ দেখিসনি?

 দেখেছি। কিন্তু

এই সময়ে গাড়ির পাশ দিয়ে একটি মহীশূরী দম্পতি হেঁটে গেল হাসিতে পথ মুখরিত করে। মেয়েটির খোঁপায় টাটকা ফুলের বেষ্টনী। দেখে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল কবিতা– উটি যাওয়া শিকেয় উঠল। শহরটা অন্তত দেখে আসি। ওগো–

দুষ্ট হাসি ভেসে উঠল ইন্দ্রনাথের পাতলা ঠোঁটের কোণে।

 যাও বৎস! বন-বিহার করে এসো।

 একটা চলন্ত অটো রিক্সা থামিয়ে গৃহিণীকে নিয়ে আমি রওনা হলাম লালবাগ অভিমুখে।

.

নাটক জমল রুদ্রমূর্তিতে ইন্দ্রনাথের ফিরে আসার পর। পেছনে প্রেমাংশু। বন-বেড়ালের মতো রাগের চোটে যেন ফুলে দ্বিগুণ।

বসবার ঘরে আমাদের উচ্ছিষ্ট না করা ধোসা খাচ্ছিল শ্যামলেন্দু। পাশে বসে গায়ে মাথায় হাত বুলোচ্ছে রাখালরাজ।

হেনকালে মূর্তিমান কালান্তকের মতো আবির্ভূত হল দুই বন্ধু। এবং বজ্রগম্ভীর স্বরে হাঁক দিল ইন্দ্রনাথঃ

শ্যামলেন্দু।

 চোখের তারা স্থির হয়ে গেল শ্যামলেন্দুর। স্থির হল রাখালরাজের জিহ্বা।

আপনারা দুজনেই শুনে রাখুন ললিত এখন কোথায়-একটু থেমে–পরলোকে।

অ্যাঁ!

আজ্ঞে হ্যাঁ। ললিত নৃশংসভাবে খুন হয়েছে কাল বিকেলে শ্যামলেন্দুর সঙ্গে দেখা করে যাবার পর। বুঝতেই পারছেন, আইনের চোখে শ্যামলেন্দু এখন এক নম্বর সন্দেহভাজন।

শুধু স্তম্ভিত নয়, অসম্ভব ভয় পেল শ্যামলেন্দু। ভয়ে গা সিঁটিয়ে উঠল। পরমুহূর্তেই হড়হড় করে বমি করে দিল টি-পয়ের ওপরেই।

.

গালের ওপর কালো দাগের রহস্য ফাঁস হয়ে গেল তার পরেই। একইরকম দাগ লেগে শ্যামলেন্দুর হাতে। প্রেমাংশুকে গ্যারেজে টেনে নিয়ে কাঠের আলমারিটা দেখাল ইন্দ্রনাথ। ভূসো লেগে আলমারির পাশের দেওয়ালেও। কেরোসিনের কুপি জ্বালানো হয় নিশ্চয়।

ইন্দ্ৰনাথ দেওয়ালে কপাল ঠেকিয়ে হেঁট হয়ে দৃষ্টি চালনা করল আলমারির পেছনে সঙ্কীর্ণ পরিসরে এবং হাত ঢুকিয়ে টেনে আনল পুরোনো খবরের কাগজে মোড়া একটা ছোট্ট প্যাকেট।

প্যাকেটের মধ্যে পাওয়া গেল তিনটে সমান সাইজের চৌকোনা টিশু পেপার। ঘুড়ির কাগজ বললেও চলে। সাদা।

ঠাসাঠাসি তিন লাইনের একটা সাংকেতিক লিপি লেখা প্রতিটা কাগজে। হরফগুলো দুর্বোধ্য এবং অজ্ঞাত।

.

শ্যামলেন্দু এলিয়ে পড়েছিল সোফার ওপরে। দমদম-দাওয়াই দিয়েও ক্ষান্ত হয়নি ইন্দ্রনাথ। বুলেটবর্ষণের মতো প্রশ্ন নিক্ষেপ করে গিয়েছিল বিরামবিহীন ভাবে।

অসংলগ্ন জবাবগুলো সাজিয়ে নিলে দাঁড়ায় এইঃ

লোহার কোট নামক ডিটেকটিভ ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ললিতমোহন স্বয়ং। এ ক্লাবের মোট সদস্য সংখ্যা পাঁচ। ললিত, শ্যামলেন্দু এবং আরও তিনজন। এক ক্লাসেরই বন্ধু।

কিছুদিন আগে কেম্পেগৌডা টাউনে হঠাৎ খুব চোরের উপদ্রব শুরু হয়। টাউনটা নতুন তৈরি হয়েছে। কোলার স্বর্ণ খনি যাওয়ার পথে পড়ে।

প্রায় প্রতি রাতেই নিশিকুটুম্ব হাজির হতে থাকে গৃহস্থদের বাড়িতে। উত্যক্ত হয়ে বাসিন্দারা পুলিশের শরণ নেয়। পুলিশের ব্যর্থতার পর স্থানীয় ইংরেজি দৈনিক ডেকান হেরাল্ড-এর সম্পাদক গরম গরম সম্পাদকীয় লিখতে শুরু করেন।

ব্যাঙ্গালোর শহরটা আর পাঁচটা শহরের মতো তস্কর-অধ্যুষিত নয়। চোর-ছ্যাচোড় এখানে নেই বললেই চলে। কেম্পেগৌডা টাউনের নিশিকুটুম্ব মহাশয় তাই রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠে সারা শহরে।

টনক নড়ে ললিতমোহনের। এই সময়ে হিচককের টু ক্যাচ এ থিফ ছায়াছবিটি এসেছিল অ্যাভিনিউ সিনেমায়। ললিত দেখেছিল ছবিটা। তারপরেই জরুরি মিটিং ডাকল লোহার কোট সংঘের।

উদ্দেশ্য : চোরধরা। হিচকক কায়দায় কেম্পেগৌড়া টাউনের নিশাচর দুবৃত্তকে ধরতে হবে। ধরা যদি সম্ভব নাও হয়, চোরের শারীরিক বর্ণনার বৃত্তান্ত ফাঁড়িতে পৌঁছে দিলেও কাজ হয়ে যাবে। চোর মহাপ্রভু নিশ্চয় সুচতুর। বয়স্কদের দেখলেই ঝোপের আড়ালে লুকোয়। ছেলে ছোকরা দেখলে পরোয়া করবে না। লুকোতেও যাবে না। সুতরাং

সামনে পরীক্ষা। তাই বাকি তিন সদস্য সন্ধের পর বাইরে থাকতে রাজি হল না। শ্যামলেন্দু নিমরাজি হল। দুই বন্ধুতে বেশ কয়েকদিন সাইকেলে করে রোদে বেরোল কেম্পেগৌডা টাউনের রাস্তায় রাস্তায়। তারপরেই একটা অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটল।

রাস্তার মাঝেই ওদের পথ আটকালো একটা পুলিশ ভ্যান। রাস্তার মাঝেই শুরু হল জবাবদিহি করার পালা। কোন এক ব্যাঙ্ক ম্যানেজার নাকি অভিযোগ করেছেন–অদ্ভুতদর্শন দুটি ছেলে রোজ তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে সাইকেল করে যাতায়াত করছে। তাদের চাহনি চোরের মতো, গতিবিধিও তাই।

তাই হাতেনাতে ওদের পাকড়াও করেছে। শ্যামলেন্দু বেচারি কেঁদে ফেলে আর কী। ললিতমোহন ভয়ের চোটে সমস্ত কবুল করে বসল। মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই যে লোহার কোট ডিটেকটিভ ক্লাবের সদস্যরা রাস্তায় বেরিয়েছে, শোনবার পর অট্টহেসে ওদের ছেড়ে দিয়েছিল পুলিশ। তবে নামধাম লিখে নিয়েছিল এবং কথা আদায় করেছিল–পরীক্ষার পড়া ফেলে আর ডিটেকটিভগিরি করবে না।

কেম্পেগৌডা তদন্তের ইতি হয়ে গেল সেইদিনই। মনকষাকষি ঘটল শ্যামলেন্দুর সঙ্গে ললিতমোহনের। ললিত চেয়েছিল পুলিশের চোখের আড়ালে কাজ চালিয়ে যাবে! শ্যামলেন্দু বেঁকে বসেছিল। ফলে মাসখানেক বন্ধ ছিল বাক্যালাপ এবং মুখদর্শন।

পরশুদিন আচম্বিতে বাড়ি বয়ে এল ললিতমোহন। শ্যামলেন্দু তো অবাক!

ললিত বললে, কেম্পেগৌডা নিশীথ রহস্যের সমাধান বলতে গেলে এখন তার হাতের মুঠোয়। আর একটু কাজ বাকি আছে। পরের দিনই একজনের সঙ্গে দেখা করে কেসটার ওপর যবনিকা টানবে সে। তদন্ত-ফল শুনলে পুলিশ নাকি লাফিয়ে উঠবে।

লোকটা কে, তা বলেনি ললিতমোহন। শ্যামলেন্দুও যেচে জিগ্যেস করেনি–জবাব পাবে না বলেই।

.

গতকাল পাঁচটার সময়ে ফের এসেছিল ললিত! টিনের টফি বাক্সটা শ্যামলেন্দুকে রাখতে বলেছিল। রহস্যের চাবিকাঠি নাকি ওর মধ্যেই আছে।

আজকে পুলিশ দেখে তাই ঘাবড়ে গিয়েছিল শ্যামলেন্দু। নিশ্চয় ললিত ফেঁসে গিয়েছে। এই আশঙ্কায় দৌড়ে গিয়েছিল গ্যারেজে। টিনের বাক্সটা ছিল গ্যারেজেরই আলমারিতে। ললিতই রাখতে বলেছিল। তাড়াতাড়ি সাংকেতিক হরফে লেখা কাগজ তিনটে বার করে ছেঁড়া কাগজে মুড়ে চালান করেছিল আলমারির পেছনে। খালি বাক্স রেখেছিল মোটরের বুটিতে।

ইন্দ্রনাথ আয়নার ভেতর দিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে দেখেই ইচ্ছে করেই বুটির দিকে আড়চোখে চেয়েছিল শ্যামলেন্দু যাতে খালি টিনটা নিয়েই পুলিশ সন্তুষ্ট হয় এবং আসল কাগজগুলো থেকে যায় ললিতমোহনের জন্যে।

ফাঁদে পা দিয়েছিল ইন্দ্রনাথ রুদ্র।

.

রাখলরাজ সাহার গোলাপ ভবন থেকে সটান মর্গে এসে পৌঁছোল ইন্দ্রনাথ আর প্রেমাংশু। ডক্টর ডিকসিট তখন লাশকাটার ঘরে।

পোর্সিলেন টেবিলে শুয়ে আছে ললিতমোহন। চুল কাটার সেলুনে চেয়ার সংলগ্ন হেডরেস্টের মতো মাথা রাখবার জায়গায় আলতো করে রাখা মাথাটা।

ডক্টর ডিকসিট চিন্তা-আবিল চোখে চেয়েছিলেন দগদগে ক্ষতস্থানগুলোর পানে। জোরালো আলোর নীচে ঈষৎ উন্মুক্ত অধরোষ্ঠের মতো হাঁ হয়ে রয়েছে কাটাগুলো। যেন অদন্ত শিশুর হাসি। চামড়ার ঠিক নীচের স্তরে চর্বির সাদা স্তরগুলো যেন দন্তহীন মাড়ি।

এমন সময়ে ঘরে ঢুকল প্রেম আর ইন্দ্র।

চোখ তুলে চাইলেন বৃদ্ধ ডাক্তার। ইন্দ্রনাথকে গত রাতে গাছতলায় দেখেছিলেন। এখন দেখলেন দিনের আলোয়। মনে মনে ভাবলেন, রবিশংকরের ভাই নাকি? বগলে সেতার কোথায়?

প্রেমাংশু শুধোল–কী পেলেন?

ললিতের পা দুটো ঈষৎ ফাঁক করে ধরে ঊরুর ভেতর দিকে একটা বড়রকমের কাটা। দেখালেন ডাক্তার–দেখেছেন? সারা গায়ে অনেক কোপ আছে। কিন্তু এই কোপটা অনেক স্পষ্ট।

অর্ধচন্দ্রাকারে উরু ঘিরে মাংস দু-ফাঁক হয়ে গিয়েছে এক কোপে। ডাক্তার বললেন–অস্ত্রটার ধরন আবিষ্কার করার চেষ্টা করছি। কিছু ধরতে পারছেন?

না।

আমিও না। ঊরুর এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত এক কোপে সমকোণে সমানভাবে কাটতে পারে এমন কোনও ছুরি কখনও দেখিনি। অদ্ভুত! একটু থেমে–ঠিক আছে, পুরো চামড়াটা কেটে নিয়ে দেখা যাক।

স্ক্যালপেল তুলে নিলেন ডাক্তার। দক্ষ হাতে চামড়া কেটে ক্ষতস্থানকে তুলে আনলেন একটা ছোট্ট ডিসের ওপর। এতক্ষণ যা অর্ধচন্দ্রাকারে ছিল, এখন তা চ্যাপ্টাভাবে রইল। হাতিয়ারের বিচিত্র বৈশিষ্ট্য প্রকট হয়ে উঠল জোর আলোর তলায়।

প্রেম আর ডাক্তার দুজনেই চোখ নামিয়ে আনল ডিসের কয়েক ইঞ্চি ওপরে। অদূরে বুকের ওপর দু-হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইল ইন্দ্রনাথ।

প্রেম বললে–ছুরির ফলাটা দেখছি সত্যিই বেঁকানো। নেপালি কুকরি, না, আরবি ছোরা?

মনে হয় না। ওসব ছুরির ডগা ক্রমশ সরু হয়ে আসে। আগা মোটা–ডগা সরু হয়। কিন্তু কাটা-টা দেখেছেন? আগাগোড়া সমান গভীর। ফলাটা সত্যিই খুব চ্যাটালো অমন ফাইন কোপ পড়েছে সেই কারণেই।

কপাল কুঁচকে ভাবতে লাগল প্রেম। ডাক্তার বললেন–চোটগুলোর প্যাটার্ন থেকেও ধরতে পারছেন না?

প্যাটার্ন!

উদ্দেশ্য তো শরীরটাকে ক্ষত-বিক্ষত করা। বেশি আক্রোশ ঊরুসন্ধিতে। ডাইনে বাঁয়ে তলপেটে এলোপাতাড়ি কোপ। ধরতে পারছেন না?

হাত ফসকেছিল তো? রাইট। কিন্তু হাত ফসকালো কেন? এই নিন আমার বলপয়েন্ট পেন। স্ট্যাব করুন! কুইক! ফসকালো না, দেখলেন?

হত্যাকারী হয়ত উত্তেজিত হয়েছিল।

উত্তেজিত হলে এমন সমানভাবে হাতে পায়ে কোপ মারে? এই নিন আমার ফুটরুল। আগাটা ধরুন। নিন, ডগা দিয়ে আমার আঙুলের ডগায় মারুন। কুইক! পারলেন না!

সত্যিই, এক ইঞ্চি দূর দিয়ে ফসকে গেল প্রেমাংশুর হাতের ফুটরুল। দ্বিতীয়বারে অবশ্য লক্ষ্যে পৌঁছোল রুলের ডগা।

ডান পা থেকে বাঁ-পায়ের দেহভার ন্যাস্ত করে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথ। ময়না তদন্ত আগ্রহের সঞ্চার করেছে তার মস্তিষ্কে।

ডাক্তার বললেন–তাহলেই দেখুন, অস্ত্র যত লম্বা হবে, আপনারও তত বেশি প্র্যাকটিস থাকা চাই। নইলে তত বেশি হাত ফসকাবে। কলমের পেছন ধরে কি লেখা যায়? নিবের কাছে ধরতে হয়। ঠিক কিনা?

বুঝলাম। ছুরিটা লম্বা।

খুবই লম্বা। শুধু লম্বা নয়, ফলাটা বাঁকানো। আধখানা চাঁদের মতো বললেও চলে। এরকম ছুরি কখনও দেখেছেন?

হত্যাকারী কি ল্যাটা? প্রেমাংশু পালটা প্রশ্ন করে বসল, ডাক্তারকে।

চোটগুলোর ধরন দেখে মনে হচ্ছে–ল্যাটা। বাঁ-হাতে অভ্যস্ত। দেখছেন না, ডানদিকে হেলে কোপ পড়েছে। অথচ গলায় তারের ফঁস দেখে মনে হচ্ছে ডান হাতটাই চলে ভালো।

দুজন হত্যাকারী ছিল কি?

 দরকার ছিল কি?

 কিন্তু বাঁ-হাতে ছুরি চালানো তো অসুবিধে।

তা হলে ছুরি নিয়েই আবার ভাবা যাক। বোর্ডটা দিন। এঁকে দেখিয়ে দিচ্ছি।

টেবিল থেকে বোর্ডে ক্লিপ দিয়ে লাগানো কাগজের প্যাডটা এনে দিল প্রেমাংশু। ডাক্তার পেনসিল দিয়ে ছুরির ফলা আঁকতে বসলেন। বক্রাকার ফলা। পেনসিলের রেখা শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে গেল কাগজের বাইরে।

হল না। বড় কাগজ দিন।

টেবিল থেকে বড় সাইজের একটা কাগজ নিয়ে এল প্রেমাংশু। ঘাড় বেঁকিয়ে নিবিষ্ট চোখে চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ।

ছুরির ফলা সাধারণত পাঁচ ইঞ্চি লম্বা হয়।

ডাক্তার তাই আরও দুই ইঞ্চি বাড়িয়ে দিলেন বক্রাকার শীর্ষদেশকে। কিন্তু বেগ পেলেন। হাতল আঁকতে গিয়ে। প্রতিবারেই মনে হল, বড় সাইজের একটা গজাল।

প্রেম বললে–হাতলটা বেমক্কা লম্বা নয় তো?

সেক্ষেত্রে চোটগুলো আরও গম্ভীর হত।

কিন্তু এরকম ছুরি হয় নাকি? আধখানা চাঁদের মতো ফলা–নিজেরই হাত কেটে যাবে যে।

ডাক্তারেরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটল এবার–সত্যিই তাই। এরকম ছুরি হতেই পারে না।

সহসা নড়ে উঠল ইন্দ্রনাথের দীর্ঘ দেহ। পায়ে-পায়ে এসে দাঁড়াল ডাক্তারের পেছনে– কাগজটা দেবেন? দেখি চেষ্টা করে।

চশমার ফাঁক দিয়ে শিবনেত্র হয়ে ক্ষণেক তাকালেন ডাক্তার। কিন্তু দ্বিরুক্তি না করে ইন্দ্রনাথের প্রসারিত হাতে তুলে দিলেন পেনসিল স্কেচটা।

কল্পচক্ষে ফলাটা অনুমান করতে পেরেছিল ইন্দ্রনাথ। তাই হাত চলল দ্রুত।

প্রলম্বিত ফলার সঙ্গে সমকোণে একটা লাইন টানল এবং খসখস করে মোটা করে এঁকে দিল হাতলটা।

কাস্তে! অবরুদ্ধ উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল প্রেমাংশু।

হৃষ্টচিত্তে ঘুরিয়ে, ফিরিয়ে স্কেচটা দেখতে-দেখতে আপন মনেই বলল ইন্দ্রনাথ–হ্যাঁ, কাস্তে। বাঁ হাতে চালাতে সুবিধে! থ্যাংক ইউ, ডাক্তার!

ত্রস্তে চশমা খুলে তীক্ষ্ণ চোখে ইন্দ্রনাথকে নিরীক্ষণ করলেন ডক্টর ডিকসিট!

.

ঠিক সেই সময়ে ফাঁড়িতে একটা খবর পৌঁছোল।

গতকাল রাত বারোটার সময়ে একটা ল্যান্ডরোভার গাড়িকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেছে অকুস্থল থেকে। পুলিশ ভ্যানের বাম্পারে ধাক্কা লেগেছিল নিশাচর গাড়িটার। আজ সকাল আটটার সময়ে আবার একই জায়গায় দেখা গেছে একই গাড়িকে। নাম্বার মনে ছিল পুলিশ ড্রাইভারের। খুনের তদন্তে যদি প্রয়োজন হয়, তাই ঘটনাটা নিবেদন করে গেল ফাঁড়িতে।

মর্গ থেকে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ফাঁড়ি ফিরেই খবরটা শুনে লাফিয়ে উঠল প্রেম।

ইন্দ্র, যাবি নাকি?

 ল্যান্ডরোভারের খোঁজে?

কাস্তের মালিকের খোঁজে। রাত বারোটার সময়ে চন্দনবনে যায় কে, দেখা দরকার বই কী! অপরাধীর সাইকোলজি তোর অজানা নয়। খুনের পর খুনি বারবার ঘুরে ফিরে আসে অকুস্থলে–

হাই তুলে তুড়ি মারতে মারতে বললে ইন্দ্রনাথ–তোর মতো অসুরের শরীর আমার নয়। আমার ক্ষিদে পাচ্ছে। আমার ঘুম পাচ্ছে। কাল রাত থেকে ধকল যাচ্ছে। তুই যা।

একা?

শালপ্রাংশু কলেবরের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে ইন্দ্রনাথ বলল–কাস্তেকেও ভয় পাস?

রসিকতা পরে করিস। চ, আগে ভুড়ি ঠান্ডা করে আসি। কেসটা একটা শেপ নিতে যাচ্ছে দেখছিস না?

তা তো দেখছি-ই, গাড়ির দিকে পা বাড়িয়ে বলল ইন্দ্রনাথ। বারো ঘণ্টার মধ্যেই অনেক তথ্য আবিষ্কৃত হল। কেম্পেগৌডা টাউনে নিশীথ রাতের আততায়ীর রহস্য উদ্ধার করতে পেরেছিল কিশোর গোয়েন্দা ললিতমোহন। কোনও দুবৃত্তের ঠিকুজিও নিশ্চয় জেনেছিল। ধাঁধা রচনা করে সেই তত্ত্বই হয়তো লিখে রেখেছিস সে। তারপর গিয়েছিল তার সঙ্গে দেখা করতে। কে সে?

ল্যান্ডরোভারের মালিক।

স্টার্ট নিল পুলিশ জিপ। অন্যমনস্কভাবে বাসন্তী রঙের নয়ন-মনোহর বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে বললে ইন্দ্রনাথকে জানে। কিন্তু মনটা খচখচ করছে অন্য কারণে।

কী কারণে?

তুই বলছিস সেক্স-মার্ডার। কিন্তু সেক্স-মার্ডারের পেছনে একটা উন্মত্ত জিঘাংসা থাকে, একটা এলোমেলো পৈশাচিকতা থাকে। কিন্তু, একটু থেমে ফের বলল ইন্দ্রনাথ–ছুরির কোপের প্যাটার্নগুলো অদ্ভুত। যেন ইচ্ছে করেই একটা মরা দেহকে কুপোনো হয়েছে বীভৎস রূপ দেওয়ার জন্যে। তার আগে পরিপাটি করে তার দিয়ে ফাঁস দেওয়া হয়েছে গলায়। সবার ওপরে একটা সত্য থেকে যাচ্ছে, কেম্পেগৌডা টাউনে একটা গোপন রহস্যে নাক গলিয়ে ফেলেছিল হতভাগ্য ললিতমোহন। প্রেম, এ কি শুধুই যৌন হত্যা?

শুঁয়োপোকার দ্বিখণ্ডিত লাশ আবিষ্কারের পর প্রমাণ পাওয়া গেল ইন্দ্রনাথের যুক্তিসিদ্ধ অনুমিতির।

.

প্রফেসর আই এস গোড়বোলের আবাসে হাজির হল ইন্দ্রনাথ, সঙ্গে প্রেমাংশু। সিঁড়ি বেয়ে উঠেই চওড়া বারান্দা। কাঠের রেলিং দিয়ে ঘেরা। বারান্দার ওপরেই কাচের দরজা। ওপাশে বসবার ঘর, সোফা সেট, টেবিল, কাবোর্ড টিপয়, বইয়ের আলমারি।

দরজার দিকেই কাবোর্ডের কাচের পাল্লার মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে হ্যাঁঙ্গারে ঝোলানো সারি সারি জ্যাকেট। চামড়ার, ফোম রাবারের এবং উলের। নীচের র‍্যাকে ছড়ি, কিটব্যাগ, ক্যানভাস থলি।

ইন্দ্রনাথের ঈগল-চাহনি কাচের দরজা খুঁড়ে কাবোর্ডের পাল্লা ভেদ করে নিবদ্ধ হল কিনারার জ্যাকেটের হাতায়। ধূসর রঙের চামড়ার জ্যাকেট। বাইরে বেরোনোর পোশাক। হাতায় এক ধ্যাবড়া বাদামি ছাপ।

এদিক-ওদিক দেখে নিল ইন্দ্রনাথ। বারান্দায় বা বাগানে কেউ নেই। আলবার্ট ভিক্টর রোড বেলা তিনটার সময়ে যানবাহন-শূন্য।

কাচের দরজা ঠেলতেই খুলে গেল। সটান কাবোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়াল দুই বন্ধু।

আঙুলের ডগায় খানিকটা বাদামি পদার্থ তুলে নিল ইন্দ্রনাথ। থুথু দিয়ে ভিজোতেই গোলাপি হয়ে গেল থুথুর রং।

আঘ্রাণ নিল নাকের কাছে তুলে। নাঃ, আর সন্দেহ নেই। রক্তই বটে!

দৃষ্টি বিনিময় করল দুই বন্ধু। কিন্তু উল্লাস উবে গেল আচম্বিতে পেছন থেকে বজ্রকণ্ঠে হুংকার শুনে,

হ্যান্ডস আপ।

রিভলভার বের করারও সময় পাওয়া গেল না।

 ঊর্ধ্ববাহু হয়ে গৌর-নিতাই বনে গেল দুই গোয়েন্দা।

অ্যাবাউট টার্ন, কচিকণ্ঠে নিনাদ শোনা গেল আবার।

যন্ত্রচালিতের মতো পেছন ফিরল মানিকজোড়। দেখল মেশিনগানধারী আততায়ীকে। বয়স তার বড়জোর পাঁচ। প্রায়-নীল সুন্দর চোখ, আপেল রাঙা টুকটুকে গাল, লাল বুট, কালো নাইলন টাউজার্স এবং ফোম রাবারের জংলি প্যাটার্ন জ্যাকেট। দু-হাতে রংবেরঙের প্লাস্টিকের তৈরি মেশিনগান।

ফিক করে গালে টোল ফেলে হেসে ফেলল শিশু-দস্যু।

 বলল–হু ইউ?

ফ্রেন্ড, হাত নামাল ইন্দ্র।

ফায়ার! কচিকণ্ঠে ফের ধ্বনিত হল বজ্রনিনাদ। সঙ্গে-সঙ্গে আঙুল ওঠানামা করতে লাগল মেশিনগানের ট্রিগারে।

অঁ-অঁ-আঁ-আঁ আওয়াজের সঙ্গে নলচের মুখ দিয়ে বিচ্ছুরিত হল আগুনের ঝিলিক চকমকির ফুলকি।

কপট আতঙ্কে শিউরে উঠেই বুক খামচে ধরে ধপ করে হাঁটুর ওপর বসে পড়ল ইন্দ্রনাথ। জিভ বের করে থুতনি নামিয়ে আনল বুকের ওপর।

ডেড। হৃষ্টচিত্তে বলল শিশু দস্যু।

 বিস্ফারিত চোখে এতক্ষণ তাকিয়েছিল প্রেম।

এবার বললে–কেয়া নাম হ্যায় তুমহারা?

 কোবিন।

 প্রফেসর গোড়বোলে কৌন হ্যায়?

 পিতাজী।

 চোখ খুলে বললে ইন্দ্রনাথ–দেখো কিতনি ব্লাড নিকলায়া।

ভয় কী? হিন্দিতেই বললে কোবিন, বাবার হাতে রোজ রক্ত লেগে থাকে।

তাই নাকি? কীসের রক্ত?

 খরগোশের। রোজ খরগোশ মেরে রক্ত নিয়ে যায় বাবা।

আস্তে আস্তে চোয়াল ঝুলে পড়ল প্রেমাংশুর। সকৌতুকে বন্ধুবরের মুখাবয়ব নিরীক্ষণ করে নিয়ে ফের শুধোলো ইন্দ্রনাথ–কী করেন বাবা?

রিসার্চ। মাঠেঘাটে ফাঁদ পেতে রাখে। আমি বাঘের কুকুর খাওয়া দেখেছি। সাপের ইঁদুর খাওয়া দেখেছি খাঁচার মধ্যে। বাবা দেখিয়েছে। আমার মা নেই কিনা, তাই।

আচমকা ভেতর থেকে ভরাট গম্ভীর গলায় হাঁক শোনা গেল—

কোবিন।

ছুটে ভেতরে ঢুকে গেল কোবিন। তড়বড় করে কী যেন বলল প্রশ্নকর্তাকে। পরমুহূর্তে হাত ধরে যাকে টেনে নিয়ে এল, তিনিই নিঃসন্দেহে প্রফেসর গোড়বোলে।

ভদ্রলোক অতিশয় দীর্ঘকায়। ছফুট হওয়াও বিচিত্র নয়। রোদেপোড়া তামাটে মুখ। বয়স কম করেও ষাট। মুখে এবং দেহে অনাবশ্যক মাংস বা মেদ নেই। হাড়ের ওপর শুধু চামড়া। অন্তর্ভেদী চক্ষু। সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য চোয়ালে। মুখের অনুপাতে বেশ বড়। ঠেলে বার করা। অসম্ভব আত্মপ্রত্যয়ের লক্ষণ।

প্রফেসর বোধহয় দিবানিদ্রায় মগ্ন ছিলেন। চোখে ঘুমের আভাস। পরনে স্লিপিং স্যুট।

ইন্দ্রনাথকে অঙ্গুলি সংকেতে দেখিয়ে লাফাতে-লাফাতে বললে কোবিন–একে মেরে ফেলেছি।

তীক্ষ্ণ চোখে দুই বন্ধুর আপাদমস্তক দেখে নিলেন প্রফেসর গোড়বোলে।

পুলিশ দেখছি। আমার কাছে কেন?

আমতা-আমতা করতে লাগল বেচারি প্রেমাংশু। আড়চোখে তাকাল ইন্দ্রনাথের পানে। কিন্তু দুই চোখে তার নীরব কৌতুক। ঠোঁট দৃঢ়সংবদ্ধ।

অগত্যা প্রেমকেই বলতে হল কাষ্ঠ-হেসে–গতকাল রাত বারোটায় আপনি চন্দনবনে গিয়েছিলেন?

তা তো যাবই। আজকেও গেছিলাম সকাল আটটায়। আবার যাব এখুনি–চারটে বাজলেই। আমার কাজই যে তাই।

কাজটা কী, তা প্রকাশ পেল অচিরেই। প্রফেসর গোড়বোলে মহারাষ্ট্রীয় ক্ষত্রিয়। পূর্বপুরুষ শিবাজীর পক্ষে অস্ত্র ধারণ করেছিলেন। উনি কিন্তু জীবজগৎ নিয়ে সমাহিত। ইকলজি ওঁর গবেষণার বস্তু। প্রাণীকুলের সাথে পরিবেশের সম্পর্ক–এই নিয়েই বছরের পর বছর তিনি বিস্তর তত্ত্ব আবিষ্কার করে চলেছেন।

ব্যাঙ্গালোর থেকে আড়াইশ মাইল দূরে ম্যাঙ্গালোর। ম্যাঙ্গালোর থেকে মাইল কয়েক উত্তরমুখো গেলেই আরব সাগরের তীরে মণিপাল। সেখানকার মেডিক্যাল কলেজে তিনি বহু জন্তু-জানোয়ার নিয়ে সাধনা করে চলেছেন বছর দশেক। ব্যাঙ্গালোরে এসেছেন বছর তিনেক।

রক্ত দরকার হয় ওই কারণেই। ইন্দ্রনাথের প্রশ্নের উত্তরে সুবিশাল চোয়াল নেড়ে শুষ্ক হেসে নিবেদন করছেন প্রফেসর। খরগোশ বা ওই জাতীয় নিরীহ প্রাণী হত্যা করে প্লাস্টিক থলি বোঝাই রক্ত নিয়ে যান বনে-বাদাড়ে। ফঁদের আশেপাশে ন্যাকড়ায় ভিজিয়ে ছিটিয়ে দেন রক্ত। নইলে বেঁজি ধরা পড়বে কী করে। ছুঁচো কী খায় এবং ছুঁচোকে কে খায়, জানবেন কী করে?

শুনে, দৃষ্টি বিনিময় করল প্রেম আর ইন্দ্র। রক্তে ন্যাকড়া চুবিয়ে ছিটোতে গেলে জ্যাকেটের হাতায় সে রক্ত লাগবেই। তাই খাঁটি বাংলায় প্রেমকে বললে ইন্দ্র–জহুরি জহর চেনে, বেগুনওলা চেনে বেগুন।–খুব হয়েছে, চল এবার।

ভ্রূকুঞ্চিত করে শুধোলেন বৃদ্ধ গোড়বোলে–কী বললেন?

বললাম যে, এভাবে রক্ত ছিটোচ্ছেন কদ্দিন?

বললাম তো তিন বছর।

বলেন কী?

কোনও খবরই রাখেন না। ইংল্যান্ডের সায়ান্টিস্টরা সাতাশ বছর ধরে জঙ্গলে বসে আছে একটানা। আমাকেও আসতে হয় আটঘণ্টা অন্তর। মরা ছুঁচো ফেলে দিয়ে নতুন ছুঁচো রাখি ফঁদে।

আচ্ছা তাহলে উঠি। অনেক ধন্যবাদ।

দাঁড়ান। যাবার আগে বলে যান কেন এসেছিলেন, দুই চক্ষু সঙ্কুচিত হল প্রফেসর গোড়বোলের। মুহুর্মুহু নড়তে লাগল চওড়া চোয়াল। এত বোকা ভাববেন না আমাকে। আমি চন্দনবনে রাত বারোটায় গিয়েছিলাম কিনা, তুচ্ছ এই ব্যাপারটা জানবার জন্যে একজন পুলিশ অফিসার বাড়ি বয়ে এলেন কেন? কেন আমাকে ঘুম থেকে না তুলে আমার ছেলেকে প্রশ্ন করলেন রক্ত সম্পর্কে? দুই চক্ষু আরও সূচ্যগ্র হয়ে এল বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিকের। বলুন, কী চার্জ আমার বিরুদ্ধে।

জীবনে এরকম ফাঁপড়ে পড়েনি প্রেমাংশু। নরহত্যার সন্দেহে খরগোশ-হত্যাকারীর পেছনে ধাওয়া করার কাহিনি কি বলা যায়? তাই করুণ চোখে ইন্দ্রনাথের পানে তাকাল প্রেমাংশু।

ব্যক্তিত্বই পুরুষের বড় সহায়। সঙ্গিন পরিস্থিতিতেও তাই অটল থাকে ইন্দ্রনাথ রুদ্র।

জাঁদরেল প্রফেসর গোড়বোলের সূচীতীক্ষ চাহনির সামনেও অমায়িক হেসে এগিয়ে এল ইন্দ্রনাথ।

দু-হাত বাড়িয়ে প্রফেসরের দক্ষিণ হস্ত মুঠির মধ্যে নিয়ে বললে–আমরা এসেছিলাম আপনার সাহায্য ভিক্ষা করতে। আপনার ব্যস্ততা দেখে ফিরে যাচ্ছি।

কী সাহায্য?

বলছি। কোবিনকে খেলতে পাঠান। এর সামনে বলা যাবে না।

মেশিনগানের ঘোড়া টিপতে টিপতে ভোঁ দৌড় দিল কোবিন।

ইন্দ্রনাথ তখন সংক্ষেপে নিবেদন করল ললিতমোহনের নৃশংস নিধনকাহিনি। শুনতে শুনতে চক্ষু বিস্ফারিত হল গোড়বোলের, নাসিকারন্ধ্র স্ফীত হল, চঞ্চল হল চোয়াল।

সবশেষে বলল একটা কাঁচা মিথ্যে–আপনার সুনাম আগেই শুনেছি। আপনি অকুস্থলে গিয়েছিলেন শুনে ছুটে এসেছিলাম যদি কোনও সূত্র পাওয়া যায়, এই আশায়। প্রকৃতির নিকেতন। আপনার নখদর্পণে। এক নজরে আপনি যা দেখবেন, আমাদের চোখে তা অদৃশ্য থেকে যাবে।

খোশামোদ শুনলে যমরাজও নাকি গলে যান। প্রফেসর তো মানুষ। একগাল হেসে আমন্ত্রণ জানিয়ে বসলেন তক্ষুনি।

এ আর বেশি কী কথা। আসুন আমার সঙ্গে।

.

বিকেল চারটে। চন্দনবনে সেই গাছ–যার দুটি শাখা গুলটিপের আকারে উঠে গেছে ঊর্ধ্বে।

অনতিদূরে ঝরাপাতা আর শুকনো ডালের তলা দিয়ে লাইন বেঁধে চলেছে পিঁপড়ের দল। একদৃষ্টে চেয়ে আছেন প্রফেসর। যেন নিমীলিতনয়ন বুদ্ধদেব। কাঁধে হ্যাভারস্যাক।

সিগারেটের প্যাকেট অর্ধেক করে এনেছে প্রেম আর ইন্দ্র। ধৈর্যচ্যুতি ঘটলেও প্রকাশ করছে না মুখে। বিরক্তির সঙ্গে যে কৌতূহলও মিশে রয়েছে।

কৌতূহল আধখানা শুঁয়োপোকা নিয়ে।

সবুজ রঙের শুঁয়োপোকা। সদ্য গুটি থেকে বেরিয়ে যারা বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে কেবল পাতা চর্বণ করে চলে, সেই পোকা।

কিন্তু তার আধখানা লাশ পাওয়া গিয়েছে। পিঁপড়েরা ঘাড়ে বয়ে নিয়ে চলেছে লোমশ পশ্চাৎপ্রদেশটি।

গোড়বোলে স্বগতোক্তি করলেন–ইন্টারেস্টিং।

 ইন্টারেস্টিং! প্রতিধ্বনি করল ইন্দ্রনাথ রুদ্র।

ঘাড় নাড়তে নাড়তে পিপীলিকা-বাহিনীর পানে তাকিয়েই বললেন প্রফেসর–এক মিনিটে কতটা পথ হাঁটছে, সে হিসেব বেরিয়ে গিয়েছে। এখন দেখছি শুঁয়োপোকাটাই বেশি ইন্টারেস্টিং।

কেন ইন্টারেস্টিং? ধ্যানস্থ গোড়বোলের কানের কাছে যেন মন্ত্রোচ্চারণ করল ইন্দ্রনাথ।

গোড়বোলের চোখ নেমে এল আধখানা শুঁয়োপোকার ছইঞ্চি ওপরে–ফাইন কাট। কুচ করে পরিষ্কারভাবে কাটা। পাখির চঞ্চুতে এত ধার থাকে না।

উদ্ভাসিত হল ইন্দ্রনাথের চক্ষু। আগ্রহের রোশনাই জ্বলে উঠল প্রেমাংশুর ব্যাজার মুখে।

জানেন তো শুঁয়োপোকারা গুটির খোলস থেকে বেরিয়ে ডালের ওপর দিয়ে গুটিগুটি যায় রেলগাড়ির মতো, ওপর দিকে তাকালেন প্রফেসর। ডালের ওপরে কে কাটল একে?

বলতে-বলতে উঠে দাঁড়ালেন ইকলজিস্ট এবং অস্ফুট চেঁচিয়ে উঠে দৌড়ে গেলেন। পিপীলিকা বাহিনীর লাইন বরাবর উলটোদিকে।

একটা চন্দনগাছের ডাল মাটি থেকে মাত্র এক হাত ঊর্ধ্বে সমান্তরালভাবে গিয়ে উঠে গেছে ওপরে। ডালটা এত নীচু যে দাঁড়িয়ে থেকে আঙুল দিয়ে স্পর্শ করা যায়।

ডালের ওপর একটা গভীর কাটার দাগ। অর্ধচন্দ্রাকারে ছালটা কেটে গেছে ডালের এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত।

চিন্তাকুল চোখে তাকিয়ে শুধোলেন প্রফেসর–ডালটা এভাবে কাটল কেন?

কাস্তের কোপ, বলল ইন্দ্রনাথ।

কাস্তে? ঠিক, ঠিক। কাস্তেই বটে। কেন?

 খুন করার জন্যে। রক্ত আছে? চুল?

না। একটু সবুজ ছোপ আছে কাটার দুধারে। শুঁয়োপোকা হত্যার চাক্ষুস প্রমাণ। বংশষ্টির মতো দীর্ঘকায় বপু বেঁকিয়ে পলকহীন চোখে বললেন প্রফেসর।

সত্যিই তাই। ডালের পাশে আরও কয়েকটি সদ্যোজাত শুঁয়োপোকার নড়াচড়াই তার প্রমাণ।

ইন্দ্রনাথও চেয়েছিল নির্নিমেষে, বলল মৃদুকণ্ঠে–হত্যাকারী অন্য কাজে হাত লাগিয়েছিল। তাই কাস্তেটাকে কোপ মেরে আটকে রেখেছিল গাছের ডালে।

সবাই তাই করে। কোবিনের জ্বালায় আমিও করি। বড় দুরন্ত ছেলে।

 হা-র-র-উ-ম গলা খাঁকারি দিল প্রেমাংশু।

কী হল? চমকে উঠল ইন্দ্রনাথ।

 কবজি ঘড়িতে তর্জনী ঠেকিয়ে বললে প্রেম–এক্ষুনি থানায় না গেলেই নয়।

সেকী কথা! যেন আকাশ থেকে পড়লেন প্রফেসর। শুঁয়োপোকার বাকি আধখানা না দেখেই যাবেন?

আপনি দেখুন।

চোয়াল সঞ্চালন করে শুষ্ক হেসে বললেন প্রফেসর–তাই কি হয়? আর একটা মিনিট থেকে যান। ইন্টারেস্টিং!

পিপীলিকা-বাহিনী যেদিকে চলেছে, সেইদিকেই অতি সন্তর্পণে পা টিপে টিপে এগিয়ে চললেন প্রফেসর এবং ধারাবিবরণী চলতে লাগল ভরাট গম্ভীরকণ্ঠে–পিঁপড়েরা মাথায় বোঝা নিয়ে সোজা লাইনে যায়–সেই হিসেবে আমি এখুনি বলে দেব শুঁয়োপোকা লুঠ করে গুদামে তুলতে ওদের কত সময় লেগেছে। এই দেখুন পিঁপড়ের বাসা। কী দেখছেন? মাটি যেন ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে। কেমন? পা দেবেন না…পা দেবেন না…কামড়ে ঘা করে দেবে। দিন তো আমার ছোট্ট শাবলটা…হ্যাবারস্যাকে আছে…থ্যাঙ্কস্।

হাতখানেক লম্বা একটা শাবল নিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করলেন প্রফেসর। পিঁপড়ের বাসা ঘিরে বৃত্তাকারে রেখায় কোপ মারতেই পিলপিল করে পিঁপড়ের দল বেরিয়ে এল পাতালরন্ধ্র থেকে। হাবভাব দেখেই বোঝা গেল, তারা বিলক্ষণ ক্রুদ্ধ। ভূগর্ভগৃহ আক্রান্ত হওয়ায় রেগে আগুন।

নিরাপদ ব্যবধানে সরে দাঁড়াল ইন্দ্র আর প্রেম। প্রফেসরের ভূক্ষেপ নেই। দুর্বোধ্য মারাঠি ভাষায় পিঁপড়েদের সম্বোধন করে ভাষণ দিয়ে চললেন বিরামবিহীনভাবে। ভদ্রলোক নিঃসন্দেহে ছিটগ্রস্ত।

পিঁপড়েরা পালিয়েছে। রুদ্রমূর্তি শাবলের ভয়ে, অথবা অনর্গল বচনের ভয়ে। একটা বড়সড় মাটির চাঙড় দু-হাতে তুলে উলটো করে বসালেন প্রফেসর।

মৌচাকের খুপরির মতো অসংখ্য গর্তের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন বিজয়োল্লাসে– দেখেছেন?

প্রথমে কিছুই দেখা গেল না। তারপর ভুরু কুঁচকে ইন্দ্রনাথ বললে–একটা সাদা গুটি দেখতে পাচ্ছি বটে।

মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম তন্তু দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা শ্বেত গুটিকাটি সন্তর্পণে তুলে নিয়ে আবরণ খসিয়ে ফেললেন প্রফেসর।

টুপ করে হাতের তেলোয় গড়িয়ে পড়ল আধখানা শুঁয়োপোকা, সবুজ রোমশ দেহ।

ফের সঞ্চালিত হল চোয়াল। খিকখিক হেসে বললেন প্রফেসর–এবার সময়টা শুনুন। শুঁয়োপোকা জবাই হয়েছে গতকাল দুপুরের আগে সকাল নাগাদ।

স্থির চোখে চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ।

প্রেমাংশু যেন খাবি খেল অকারণেই–বলেন কী! কাস্তে নিয়ে হত্যাকারী এখানে এসেছিল খুনের অনেক আগেই?

হ্যাঁ, অনেক আগেই শুষ্ককণ্ঠ ইন্দ্রনাথের। এবার বুঝলে কেন বলছিলাম এটা কি নিছক যৌন হত্যা?

আমি…আমি।

খুনটা সুপরিকল্পিত।

 প্রফেসর গোড়বোলেকে চন্দনবনে রেখেই ইন্দ্রনাথ আর প্রেমাংশু এল থানায়।

নটরাজ নামক অধস্তন অফিসারটি নীরস রিপোর্ট পেশ করে গেল সঙ্গে সঙ্গে। লোহার কোট ডিটেকটিভ ক্লাবের বাকি তিন সদস্যের বাড়ি তদন্ত করে এসেছে সে। সব জায়গাতেই একটি প্রশ্নই করা হয়েছে। গতকাল বিকেল পাঁচটা থেকে ছটার মধ্যে ললিতমোহন কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল?

কেউ সদুত্তর দিতে পারেনি।

যত ধোঁয়া তো ওইখানেই, টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে নাচাতে নাচাতে বলল প্রেমাংশু। পাঁচটা থেকে ছটার মধ্যে হত্যাকারী তাকে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল চন্দনবনে। ওইখানেই ওকে খুন করার মহড়াও দেওয়া হয়েছিল সকালবেলা। কিন্তু লোকটা কে?

জবাব ধাঁধার মধ্যে, সিগারেটের ছাই ফেলতে-ফেলতে বলল ইন্দ্রনাথ।

সুতরাং ইন্দ্রনাথ একাই ফিরল গান্ধীনগরের ফ্ল্যাটে।

তখনও খাটের কোণে দেহটাকে অদ্ভুতভাবে বেঁকিয়ে বসে আছে ইন্দ্র। যেন একটা ময়াল সাপ। কুণ্ডলী পাকিয়ে উপবিষ্ট। জ্বলন্ত সিগারেটের অগ্রভাগ সাপের মণির মতোই বিকিরণ করছে রক্তকিরণ।

মৃগ।

 হ্যাঁ, বল।

একটা প্রশ্ন। ললিতমোহন হিরের টুকরো ছেলে। কিন্তু হপ্তা তিন-চার একনাগাড়ে কোনও চাঞ্চল্যকর রহস্য নিয়ে যদি তার মগজ ব্যস্ত থাকে, তা হলে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটবেই দৈনন্দিন কার্যকলাপে। ঠিক কিনা?

বিলকুল।

আর একটা প্রশ্ন। শ্যামলেন্দুর সঙ্গে ললিতমোহনের আড়ি হয়ে গেল। কিন্তু জেদ চেপে গেল ললিতের। তার মানে কেম্পেগৌড়া টাউনে লুকিয়ে-চুরিয়ে টহল দেওয়া অব্যাহত রইল। ঠিক কিনা?

বিলকুল।

তবে চল।

কোথায়?

 বিন্দুমতীর কাছে।

 কফি খেয়ে যা।

কফি না আসা পর্যন্ত ময়াল সাপের মতোই কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে রইল বন্ধুবর। ধকধক করে কেবল জ্বলতে লাগল সৰ্পৰ্মণি।

কফি আর কাজু নিয়ে ঘরে ঢুকে আলেকজান্ডার ভড়কে গেল ইন্দ্রনাথের বসার ধরন দেখে। ট্রে-টা হাত থেকে টেনে নিয়ে ওকে বিদেয় করলাম ঘর থেকে।

বেদে চেনে সাপের হাঁচি। ইন্দ্রনাথ নিশ্চয় কোনও সূত্রের সন্ধান পেয়েছে।

.

অলংকার সিনেমার সামনে থেকে স্কুটার-রিকশা নিয়ে লালমহল পৌঁছোতে বিশ মিনিটও লাগল না।

প্রৌঢ় ভৃত্যটি আমাদের প্রতি চকিত চাহনি নিক্ষেপ করে ক্ষিপ্রপদে অন্তর্হিত হল অন্দরে। পরক্ষণেই বরান্দায় আবির্ভূত হল দীর্ঘকায়া বিন্দুমতী।

মোরাদাবাদী ল্যাম্পশেডের আল্পনা আলোছায়ার মধ্যে দিয়ে দেখলাম আজও তাঁর পরনে ছাপাশাড়ি। চওড়া চোয়াল যেন আরও রুক্ষ। শূকরের ল্যাজের মতো খর্বকায় বিনুনি এলিয়ে ঘাড়ের ওপর। বেশভূষায় সাজসজ্জায় কোনও ছিরিছাঁদ নেই।

সতর্ক চোখে আমাদের নিরীক্ষণ করে বললেন স্বভাবকোমল কণ্ঠে–আসুন।

বারান্দার চেয়ারেই বসলাম আমরা। বিন্দুমতী বসলেন সামনে। আল্পনা আলোছায়ায় দেখলাম, তার চোখের পাতা ফুলো। অন্ধকারে অশ্রুপাত করছিলেন।

ইন্দ্রনাথ বললে–আমাকে ক্ষমা করবেন এই সময়ে বারবার বিরক্ত করার জন্যে।

অসংকোচে বলুন।

ললিতের একদিনের কাজের রুটিন কী ছিল বলবেন?

সকাল ছটায় ঘুম থেকে উঠত। বাথরুম। ব্যায়াম। সাতটায় আমরা সবাই মিলে কাগজ পড়তে-পড়তে জলখাবার খেতাম। নটা পর্যন্ত পড়াশুনা। তারপর স্কুল। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে বেড়াতে যেত বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে। কোচিং ক্লাস সেরে বাড়ি ফিরত রাত নটায়। খাওয়া। ঘুম দশটার মধ্যে। যেন মুখস্থ বলে গেলেন বিন্দুমতী।

চমৎকার। এখন বলুন, মাসখানেকের মধ্যে এই রুটিনে কোনও হেরফের হয়নি?

না তো।

 ললিতের সঙ্গে পরিবারের প্রত্যেকে মুখোমুখি বসতেন কখন কখন?

সকালে খবরের কাগজ পড়বার সময়ে আর রাত্রে খাবার সময়ে।

গত এক মাসের মধ্যে এই দুই সময়ে তার মধ্যে কোনও চাঞ্চল্য, অস্থিরতা, অন্যমনস্ক ভাব লক্ষ্য করেছিলেন?

বিন্দুমতী নিজেই অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ পরে মাথা নেড়ে বললেন–মনে। রাখতে হবে বলে তো কিছু দেখে রাখিনি। তবে

তবে কী? বলুন?

একটা সামান্য ব্যাপার। ধর্তব্যের মধ্যে নয়।

বলুন না।

এদেশের মানুষ চিনি ছাড়া দই খায়নুন মিশিয়ে। ললিতও সেই অভ্যেস করেছিল। সেইজন্যে ঘরে পাতা দই-তে চিনি থাকত না। আমরা চিনি মিশিয়ে নিতাম–ও মেশাত নুন। কোনওদিন ভুল হয়নি। একদিন হয়েছিল। নুনের বদলে চিনি মিশিয়ে ফেলেছিল। আমি ধরিয়ে দিতেই দই না খেয়েই উঠে গিয়েছিল ঘরে।

উজ্জ্বল হল ইন্দ্রনাথের চক্ষু।

শুধোলো ঈষৎ ঝুঁকে পড়ে–সেটা কবে বলতে পারেন?

সেদিন ছিল রোববার। মনে-মনে হিসেব করলেন বিন্দুমতী। দুটো রোববারের আগের রোববার। মানে, সাতাশে ডিসেম্বর।

মানে পয়লা তারিখের আগে। ফাইন! ফাইন! রিয়ালি ফাইন! অদম্য উত্তেজনায় আরও ঝুঁকে পড়ল ইন্দ্রনাথ–নুনের বদলে চিনি মিশোল ললিত, তারপর কী করল?

বিন্দুমতী বিস্মিত হলেন সুদর্শন গোয়েন্দার আকস্মিক উত্তেজনা দেখে।

 বললেন–ঘুমিয়ে পড়ল।

আপনি দেখেছিলেন?

 আমি? না। তবে রাত জেগেছিল বোধ হয়। কেন না, পরদিন ঘুম থেকে উঠল সাতটায়।

 ফাইন! তারপর? আবার নুনের বদলে চিনি মেশায়নি?

এবার স্পষ্ট বিরক্তি দেখা গেল বিন্দুমতীর চোখে। বললেন–জলখাবারে দই খায় না কেউ।

তা ঠিক..তা ঠিক…কিন্তু জলখাবার খেতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়নি ললিত?

খেলো আর কোথায়? কাগজ পড়তে-পড়তে হঠাৎ উঠে গেল নিজের ঘরে।

কাগজ নিয়ে, না খাবার নিয়ে?

কাগজ নিয়ে। মেসোমশাই রাগারাগি করতে লাগলেন কাগজ না পাওয়ার জন্যে। সেই কাগজ পাওয়া গেল রাত্রে।

তার মানে? সেদিন তো সোমবার। কাগজ নিয়েই স্কুল গিয়েছিল নাকি?

 মনে তো হয়।

অস্থির হয়ে আঙুল মটকাতে-মটকাতে ইন্দ্রনাথ বললে–আঠাশে ডিসেম্বরের কাগজ কি এখনও আছে?

আছে। আমরা তিন মাস অন্তর কাগজ বেচি।

দেখতে পারি?

কাগজটা? নিশ্চয়। বসুন, এনে দিচ্ছি, বিখ্যাত গোয়েন্দার মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্বন্ধে সন্দিহান হয়েই যেন এস্তে উঠে গেলেন বিন্দুমতী।

অমনি ফিসফিস করে ইন্দ্রনাথ বললে–রাত জেগেছিল কেন বলো তো? নিশ্চয় লোহার কোটের সেই ধাঁধা রচনা করেছিল। পয়লা তারিখে ছেপে বের করতে হবে তো।

বিন্দুমতী ফিরে এলেন। হাতে পুরোনো ডেক্যান হেরাল্ডব্যাঙ্গালোরের ইংরেজি দৈনিক।

জ্বরগ্রস্ত ক্ষিপ্রতায় পাতা উলটে গেল ইন্দ্রনাথ।

 বিজয়োল্লাসে চেয়ে রইল মাঝের পৃষ্ঠার পানে।

ষষ্ঠ কলমের বেশ খানিকটা অংশ কাঁচি দিয়ে কেটে নেওয়া হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *