লোহার কোট – ১

লোহার কোট অদ্রীশ বর্ধন

আমি ভালোবাসি দেশে-দেশে ঘুরতে, ভালোবাসি দেশ-বিদেশের বই পড়তে। আমি ভালোবাসি নানান দেশের সাহিত্যের মালঞ্চ থেকে ফুল সংগ্রহ করে মনের সুতো দিয়ে মালা গাঁথতে। আমি ভালোবাসি জীবনের ঘটনায় কল্পনার পাল তুলে দিয়ে মন-পবনের নাওয়ে ভাসতে এবং পাঠককে ভাসাতে। আমি ভালোবাসি প্রিয় বন্ধু ইন্দ্রনাথকে চাঞ্চল্যকর কাহিনির নায়ক সাজিয়ে রোমাঞ্চ-দরিয়ায় অবগাহন করতে। আমি ভালোবাসি এমনই অনেক কিছু কিন্তু ভালোবাসি না কোনও কিছুরই প্রভাবকে অস্বীকার করতে। ঋণী আমি স্রষ্টার কাছে, জীবনের কাছে, মানুষের কাছে।

লোমহর্ষক এই কাহিনি এই সব কিছুরই ফলশ্রুতি। শিহরন এর লতায়-পাতায়, উৎকণ্ঠা আনাচে-কানাচে, রহস্য অলিতে-গলিতে! বয়স যাদের অপরিণত, সাহস যাদের অপ্রতুল, স্নায়ু যাদের দুর্বল, বিভীষিকা যাদের হৃৎকম্পের কারণ–এ কাহিনি তাদের কাছে নিষিদ্ধ।)

ইন্দ্রনাথ রুদ্র ব্যাঙ্গালোর গিয়েছিল অভ্র কেলেঙ্কারির গোপন ঘাঁটির সন্ধানে। সে কেস মিটতে না মিটতেই জড়িয়ে পড়ল একটা অত্যন্ত নৃশংস হত্যারহস্যে।

রাত তখন নটা।

প্রেমাংশুর গান্ধীনগরের ফ্ল্যাটে বসে জিনিসপত্র গুছোচ্ছি আমি, কবিতা আর ইন্দ্রনাথ। পরের দিন সকালের বাসে মাইশোর যাব। সেখান থেকে উটি।

এমন সময়ে থানা থেকে ফোন করল প্রেমাংশু।

এখুনি চলে আয়। সেক্স মার্ডার! বীভৎস!

প্রেমাংশু আমার আর ইন্দ্রনাথের সতীর্থ। ভীষণ কালো, ভীষণ লম্বা, থ্যাবড়া নাক, পুরু ঠোঁট। মাথায় এবং কানে কুঁচকোনো চুল। সব মিলিয়ে নিগ্রো-নিগ্রো চেহারা। আমরা ওকে নিগ্রো বলেই ডাকতাম। ওর রাগ ছিল না। প্রেমাংশুর জন্ম এই ব্যাঙ্গালোরেই। শৈশব থেকেই কানাড়া ভাষায় চোস্ত। তাই প্রাদেশিকতার প্রাচীর ডিঙিয়ে চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে এখানকার পুলিশ মহলে।

এখন ও মাইশোর পুলিশের বড় অফিসার। ব্যাচেলর। খুনে-গুন্ডারা ওর চেহারা দেখে আঁতকে ওঠে, ওপরতলা ভয় পায় ওর বচনকে। মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স আর ফরেনসিক সায়ান্স ওর কণ্ঠস্থ। প্রেমাংশু দিলখোলা। সেই কারণেই বড় দুর্মুখ।

অভ্র কেলেঙ্কারির জট ছাড়াতে প্রেমাংশুই আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ইন্দ্রনাথকে। সে কেস সাঙ্গ হতে না হতেই ফের ডাক পড়ল লোহার কোট মামলায়।

পুলিশ ফাঁড়ি। অধিকারী থানাদারের ঘর। রেকসিন-ছেঁড়া টেবিলের পাশে ঘটোৎকচ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে প্রেমাংশু। হাঁড়িমুখের ভাঁটা-চোখ দিয়ে যেন দগ্ধ করছে সামনে উপবিষ্ট যুগলমূর্তিকে।

মেয়েটির মুখে আড়ষ্ট ভয়ার্তি। চাহনির মধ্যে শূন্যতা। প্রেমাংশুর আখাম্বা চেহারা, জাঁদরেল ধড়াচূড়া আর রক্তচক্ষু দেখেই বোধ হয় সিঁটিয়ে রয়েছে।

বয়স বড়জোর পনেরো কি ষোলো। পানের মতো মুখের গড়ন। কিন্তু বেশ গোলগাল। ফরসা। মুখশ্রী মার্জিত। চোখ দুটি কাজল ছাড়াই কালো এবং বুদ্ধি উজ্জ্বল। শ্যাম্পু করা চুল ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা। চুলের মধ্যে ঘাস লেগে রয়েছে। শাড়িতে রক্ত।

মেয়েটির শাড়ি ব্লাউজের মধ্যেও আধুনিকতার ছাপ। গোলাপি শাড়ি, গোলাপি ব্লাউজ। হাতা নেই। মসৃণ পেলব কাঁধে শুধু ফিতে। ঠোঁটে অরেঞ্জ লিপস্টিক।

ছেলেটির বয়স কুড়ির নীচে। গোঁফ-দাড়ি কামানো। ফরসা। চোখ দুটি বড় বড় এবং প্রাণবন্ত। সরু ধারালো নাক। দীর্ঘ কেশের অগ্রভাগ ঘাড়ের ওপর ঈষৎ বক্র। গালে আর ঘাড়ে শুকনো রক্ত।

পরনে গাঢ় নীল রঙের বুশসার্ট এবং স্টিল-গ্রে ট্রাউজার্স। স্মার্ট ফিগার। ঋজুদেহে সটান চেয়েছিল প্রেমাংশুর পানে। চাহনির মধ্যে বিদ্রোহ।

কোঁচার খুঁট-টা মুগার পাঞ্জাবির পকেটে সযত্নে রেখে পরিষ্কার বাংলায় বললে ইন্দ্রনাথ বৎস প্রেম, রোষ সম্বরণ কর। ভস্ম হয়ে যেতে পারে।

যুগল মূর্তি চমকে উঠল। কবিতার পরনে লালপেড়ে শাড়ি, কপালে লাল টিপ আর সীমান্তে সিঁদুর দেখে অকৃত্রিম বিস্ময় ফুটে উঠল মেয়েটির চোখে।

গলা খাঁকারি দিয়ে বললে প্রেমাংশু–বাংলা রসিকতাও এরা বোঝে। কারণ এরা বাঙালি।

তাই নাকি? পর্যায়ক্রমে যুগল-মূর্তির ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল ইন্দ্রনাথ। নাম কী?

ঋতেশ রায়, বনলক্ষ্মী বক্সী, জবাব দিল প্রেমাংশু।

 নমস্কার বিনিময় করার পর আমরা সকলেই বসে পড়লাম।

প্রেমাংশু বললে–এরাই লাশ আবিষ্কার করেছে।

 সকৌতুকে বন্ধুবরের ভাটা-চক্ষুর পানে তাকিয়ে ইন্দ্রনাথ বলল-সেটা কি খুব অপরাধ?

সমস্ত ঘটনাটা শুনলে বুঝবি কেন রেগে আছি। বলল প্রেমাংশু। ঋতেশ রায় কলকাতার ছেলে। জুনিয়র টেনিস চ্যাম্পিয়ন। বেঙ্গল টিমের সঙ্গে এসেছে ব্যাঙ্গালোর টিমের সঙ্গে খেলবে বলে। উঠেছে ব্যাঙ্গালোর ক্লাবে। কালকে ওদের খেলা।

বনলক্ষ্মী বক্সী এখানকার মেয়ে। রিচার্ড টাউনে থাকে। মহারানী কলেজে পড়ে। ঋতেশ রায় ওর পত্ৰবন্ধু। তাই ওকে নিয়ে বেরিয়েছিল শহর দেখাতে।

মার্করার দিকে যে রাস্তাটা গেছে, ব্যাঙ্গালোর ক্লাব সেই দিকেই। ওই পথেই চন্দন খেতও আছে কয়েকটা। চন্দনগাছ আকারে ছোট। তাই ঝুপসি অঞ্চল চন্দন খেতে থাকে না। কিন্তু চামুণ্ডা এস্টেটের খেতে চন্দন ছাড়াও অন্যান্য গাছও আছে। জায়গাটা বড় রাস্তা থেকে দূরে। ঝোপে ঘেরা।

এইখানে একটা চন্দন গাছের গায়ে একটা লাশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে বনলক্ষ্মী আর ঋতেশ। গাছের দুটো শাখার জয়েন্টে চিবুক আটকে দুহাত দু-পাশে ছড়িয়ে দাঁড়িয়েছিল। একটা উলঙ্গ দেহ। বছর চোদ্দ পনেরো বয়স। সারা গায়ে ছুরির কোপ। ফালাফালা করে চেরা। জ্যাক দি রিপারের আধুনিক সংস্করণ।

ঋতেশ রায় ছেলেটির কাধ ধরেছিল। ফলে লাশটা ওদের ওপর এসে পড়ে। জামা কাপড়ে রক্ত লেগেছে সেই কারণেই।

এই দেখেই দুজনে দৌড়োতে-দৌড়োতে থানায় এসে খবর দিয়েছে আমাকে। কিন্তু বলে থামল প্রেমাংশু।

এই সময়ে আমার চোখ পড়ল ইন্দ্রনাথের পানে। কবি কবি চোখে ওমর খৈয়ামের স্বপ্ন ভাসিয়ে ও অপলকে চেয়ে আছে বনলক্ষ্মীর প্রায় অনাবৃত পিঠের দিকে।

দুই চোখে নীরব ভৎর্সনা নিয়ে কবিতাও দেখছিল ইন্দ্রনাথের কাণ্ড। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই যেন নির্ভাষ টেলিপ্যাথি দিয়ে বললে?

এই জন্যেই বলেছিলাম ঠাকুরপোর বিয়ে দাও।

 প্রেমাংশু কিন্তু বলে থামতেই সম্বিৎ ফিরল ইন্দ্রনাথের।

 স্বপ্ন-সুন্দর চোখে তাকিয়ে বললে–কিন্তু কী?

জায়গাটা শহরের বাইরে। সব চন্দন খেতই শহরের বাইরে। কিন্তু শহর দেখানোর জন্যে ওখানে যাওয়া হয়েছিল কেন?

ঘর নিস্তব্ধ। ঋতেশ রায়ের বড় বড় চোখে শুধু বিদ্রোহ নয়, এবার খানিকটা ভয়ও জাগ্রত হল।

আরও আড়ষ্ট হল বনলক্ষ্মী।

 খুব মৃদু মসৃণ কণ্ঠে বললে ইন্দ্রনাথ–প্রশ্ন আরও আছে।

কী?

ঋতেশবাবু–

উচ্চৈঃশ্রবার মতো ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল ঋতেশ। তেজি ছেলে। বেকায়দায় পড়ে বোবা হয়ে রয়েছে। নইলে

ইন্দ্রনাথ স্মিতমুখে বললে–আপনারা চন্দন খেত দেখতে গিয়েছিলেন, তাই না?

ঢোঁক গিলে বললে ঋতেশ–হ্যাঁ।

বনলক্ষ্মী? তুমিও?

 জবুথবু বনলক্ষ্মী চমকে উঠল প্রশ্ন শুনে। ত্ৰাসকম্পিত চোখে শুধু ঘাড় নাড়ল।

 চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথ। বনলক্ষ্মীর পেছনে দাঁড়িয়ে বললে–মিথ্যে কথা।

 বিবর্ণ হয়ে গেল বনলক্ষ্মী।

তর্জনী দিয়ে বনলক্ষ্মীর পিঠ দেখিয়ে বলল ইন্দ্র : প্রেম, দাগটা তোর আগেই দেখা উচিত ছিল।

দাগ? উঠে এল প্রেমাংশু। তাই বল। রক্তের দাগ। লাগবেই তো। লাশটা যে ঘাড়ের ওপর পড়েছিল।

কিন্তু আমি বুঝলাম, কেন এতক্ষণ নির্লজ্জভাবে বনলক্ষ্মীর পিঠ দেখছিল ইন্দ্রনাথ।

দাগটা রক্তের সন্দেহ নেই। কিন্তু তার আধখানা জেগে রয়েছে ফর্সা চামড়ার ওপর, বাকি আধখানা ঢাক পড়েছে গোলাপি ব্লাউজের তলায়।

মানেটা অতি সুস্পষ্ট।

প্রেমাংশু থানাদার হলেও চিরকুমার। তাই বোধহয় একটু বুঝতে সময় লাগল। সত্যটা হৃদয়ঙ্গম হতেই হুংকার ছাড়ল বাজখাই গলায়? তাই ত বলি, সন্ধের সময়ে ঝুপসি জায়গায় যাওয়া কেন– হাতের ইঙ্গিতে থামিয়ে দিল ইন্দ্রনাথ।

বলল রেশমকোমল কণ্ঠে–বনলক্ষ্মী।

মুখ তুলে চাইল বনলক্ষ্মী। গোল ফর্সা মুখটা ভয়েলজ্জায় শুকিয়ে গেছে।

আমি পুলিশ নই। আমার নাম ইন্দ্রনাথ রুদ্র।

কেঁপে উঠল বনলক্ষ্মীর চক্ষুপল্লব। ঈষৎ বিস্ফারিত হল চক্ষুতারকা।

চিনতে পেরেছ? একটু-আধটু গোয়েন্দাগিরি করি। এই আমার জীবনীকার মৃগাঙ্ক রায়। আর এই হল মৃগাঙ্কর গৃহলক্ষ্মী–তোমাদের কবিতা বউদি।

একটু থেমে ফের বললে ইন্দ্রনাথ–এ ঘরের পাশে একটা ঘর আছে। সে ঘরে জানলা নেই। কেউ আড়ি পাতবে না। কবিতা বউদির সঙ্গে ওই ঘরে যাও সব কথা বলো। গোপন করবে না, কেমন?

বনলক্ষ্মী– চেয়ার ছেড়ে উঠতে গেল ঋতেশ।

ইন্দ্রনাথ কাধ ধরে ফের তাকে বসিয়ে দিলে চেয়ারে।

 বলল–আপনার জামা খুলুন। কোথায় কোথায় রক্ত লেগেছে দেখান।বউদি?

কবিতাকে আর কিছু বলতে হল না। উঠে দাঁড়িয়ে সস্নেহে বনলক্ষ্মীর বাহু ধরে নিয়ে গেল পাশের ঘরে।

বেরিয়ে এল দশ মিনিট পরে। যা বলল, তা এই ও

.

তখন গোধূলি। রক্তসন্ধ্যার মুহূর্ত।

গাছে-গাছে পাখির কলরব থেমে আসছে। কিন্তু অন্ধকারের যবনিকা নামতে এখনও অনেক দেরি।

নিঝুম বনতলে মুখ হেঁট করে বসে বনলক্ষ্মী। পাশে ঋতেশ।

বাঁ-হাতের তর্জনী দিয়ে ঘাসের ওপর আলপনা আঁকছে বনলক্ষ্মী।

 লজ্জায় আয়ত চোখ তুলে তাকাতেও পারছে না।

কানের কাছে ভ্রমর গুঞ্জনের মতো গুনগুনিয়ে চলেছে ঋতেশ।

বনলক্ষ্মী–

তোমার বাবা রাজি হবে?

 ধেৎ।

বলব?

 জানি না।

আজ কিন্তু আমাদের শুভদৃষ্টি।

অসভ্য।

শুনছ না পাখিরা মন্ত্র পড়ছে? বিয়ের মন্ত্র। চন্দনবনে আজ আমাদের বিয়ে।

তারপর? অপাঙ্গে তাকাল বনলক্ষ্মী।

বাসরঘর। বলে, আলতো করে ঠেলে বনলক্ষ্মীকে শুইয়ে দিল ঋতেশ। নিজেও শুয়ে পড়ল পাশে।

.

বনলক্ষ্মীর কপালে চিবুক রেখে সামনে দৃষ্টি প্রসারিত করল ঋতেশ। শরীরের প্রতিটি অণুপরমাণুতে তখন অসীম অবসাদ, নিঃসীম আবেশ আর অননুভূত আনন্দ।

ঠিক এই সময়ে তৃণভূমির কিনারায় চন্দন শাখার সন্ধিস্থলে একটি মুণ্ড দেখা গেল। দাঁত বের করে হাসছে একটি ছেলে।

চক্ষের পলকে শরীরের সমস্ত রক্ত যেন ধেয়ে গেল মস্তিষ্কের কোষে কোষে। রাগে অন্ধ হয়ে সামনে ছিটকে গেল ঋতেশ। বাঁ-হাতে ছেলেটার মুঠি ধরে ডান হাত তুলল শূন্যে।

ভয়ংকর দৃশ্যটা চোখে পড়ল তখনই। শিথিল মুষ্টি থেকে খসে গেল মুণ্ড–উলঙ্গ লাশটা লুটিয়ে পড়ল ঘাসের ওপর।

বনলক্ষ্মী শঙ্কিত হয়েছিল ঋতেশের অকস্মাৎ লাফিয়ে ওঠা দেখে। তনু-মনের অণুপরামাণুতে যখন ভূপালি রাগিণীর উচ্ছ্বাস, ঠিক তখনি শ্লথ বাহুপাশ থেকে জ্যামুক্ত তীরের মতো ছিটকে বেরিয়ে যাওয়াটা–আচম্বিতে একটা ঝপ শব্দ ভেসে এল কানে। তারপর সব নিস্তব্ধ।

ঋতেশ?

কোনও সাড়া নেই।

ঘাসের কার্পেটে গড়িয়ে গিয়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে উধ্বাঙ্গ তুলে শব্দের উৎস অন্বেষণ করল বনলক্ষ্মী।

দেখল, একটা নরদেহ ঘাড় মুচড়ে ভূমিশয্যায় শয়ান। ভঙ্গিমাটা অস্বাভাবিক। আকাশের আলো তখন ক্ষীণ। এর বেশি দেখা গেল না।

ঋতেশ?

ধড়মড়িয়ে উঠে ছিটকে গেল বনলক্ষ্মী। নগ্নপদে প্যাট করে বিঁধে গেল একটা নিষ্ঠুর কাটা। ডুকরে উঠে আছড়ে পড়ল নরদেহের ওপর।

ঋতেশ! ঋতেশ! কী হয়েছে তোমার

 সাড়া এল পাশ থেকে–আমি এখানে।

রুধিরসিক্ত নরদেহটা ফেলে দিয়ে পিছু হটতে গিয়েছিল ঋতেশ। শেকড়ে পা বেঁধে পড়ে গিয়েছে। আর ওঠেনি। কথাও বলতে পারেনি।

চমকে উঠল বনলক্ষ্মী? কার নগ্নদেহে শুয়ে আছে বনলক্ষ্মী? সারা শরীর ভিজে কেন?

ঘাড় তুলে দেখল বনলক্ষ্মী।

পরক্ষণেই বুকভাঙা চিৎকার করে গড়িয়ে পড়ল ঘাসের ওপর।

প্রেমাংশুর একটা বদভ্যেস আছে। উত্তেজনার কারণ ঘটলেই কানের চুল টানতে থাকে নির্মমভাবে।

সেইভাবেই বললে ইন্দ্রনাথকে–বুঝলি তো? খাঁটি সেক্সমার্ডার। বাচ্চা ছেলে। সারা শরীরটাকে চিরেছে। ঠিক যেভাবে জ্যাক দি রিপার বারবণিতা বধ করত লন্ডন শহরে, যেভাবে কলকাতার রাস্তাঘাটে মেয়েদের পেট আর কোমর চিরে দেওয়া হত কিছুদিন আগেও।

বুঝলাম। এখন কী করবি। রাত কটা বাজল খেয়াল আছে?

দশটা। যাবি নাকি?

কোথায়?

 অকুস্থলে।

এরা? ঋতেশ-বনলক্ষ্মীর দিকে চোখের ইশারা করল ইন্দ্রনাথ।

বসে থাকবে। আমি সরেজমিন তদন্ত করে আসার পর ছাড়ব। নটরাজ?

ইয়েস, স্যার। সহকারী থানাদার স্যালুট করে দাঁড়াল চৌকাঠে।

আমি না আসা পর্যন্ত এদের ছাড়বে না। বউদি, তুমি বাড়ি যাও।

 কেন? ভ্রূকুটি করল কবিতা।

 নৃশংস খুন শোনা যায়, দেখা যায় না। রামনাথ, গাড়ি বার কর।

এদিকে এসো ঠাকুরপো, ইন্দ্রনাথকে বলল কবিতা। একটা কথা বলব।

কী?

চুপিচুপি বলল কবিতা–মেয়েদের অনেক সমস্যা। বনলক্ষ্মীর গায়ের রক্তটার গ্রুপ কি দেখো তো। কৌতূহল হচ্ছে।

কেন বলো তো?

ওর নিজেরও তো হতে পারে।

অকুস্থল।

প্রেমাংশুর ব্যবস্থার ত্রুটি নেই। ফায়ার ব্রিগেড থেকে দুটো পোর্টেবল জেনারেটর এসে গেছে। গাছের ডালে বড় বড় সার্চলাইট বাঁধা হয়েছে। হেভি ডিউটি ইলেকট্রিক কেবল ঘাস। জমির ওপর এলোমেলো ভাবে ছড়ানো রয়েছে।

মাঝের চত্বরে কেউ পা দেয়নি। প্রেমাংশুর নিষেধ আছে।

আমরা তিন বন্ধু জিপ থেকে নামতেই চালু হল জোড়া জেনারেটর। বার কয়েক নিভু নিভু হয়ে জ্বলতে জ্বলতে পুরো তেজে জ্বলে উঠল সার্চলাইটগুলো।

অন্ধকার চন্দনবনে যেন পূর্ণিমা হেসে উঠল মাঝের ঘাস জমিতে। পায়ে-পায়ে আমরা এগিয়ে গেলাম ভূলুণ্ঠিত নরদেহটির দিকে।

ছেলেটি সুদর্শন। ফর্সা, মৃত্যুনীল মুখ। চোখের পাতা খোলা। চাহনিতে জমাট বিস্ময়।

হাঁ করে নিঃশ্বাস নিতে গিয়েছিল মৃত্যুর মুহূর্তে–এখনও দাঁত খিঁচিয়ে আছে–যেন হাসছে।

উলঙ্গ দেহ। হাত এবং পায়ে আড়াআড়িভাবে কোপের চিহ্ন লম্বালম্বি নয়। সবচেয়ে বেশি আক্রোশ ঊরুসন্ধিতে।

পেছনে দু-হাত দিয়ে পলকহীন চোখে চেয়েছিল ইন্দ্রনাথ। ধীরে-ধীরে কঠিন হয়ে উঠল চোয়ালের হাড়। দ্রুত রূপান্তর ঘটছে ইন্দ্রনাথ রুদ্রের। জাগ্রত হচ্ছে বজ্র কঠিন সত্তা।

প্রেমাংশু খাতা-পেনসিল বার করে বলল-ইন্দ্রনাথ, তুই বল। আমি লিখছি।

নতজানু হয়ে ঘাসের ওপর বসে পড়ল ইন্দ্রনাথ।

বলল–মার্জিনে লেখ, এক নম্বর–ডেডবডি। কিশোর। গলায় তারের ফাঁস, পেছনে আটটা মোচড়। ধস্তাধস্তি বা আত্মরক্ষার চোট হাতে পায়ে নেই। হঠাৎ আক্রান্ত হয়েছিল পেছন থেকে। কোপগুলো দেওয়া হয়েছে পরে। তারের বর্ণনা : প্যাকিং বাক্স বাঁধবার দশ গেজ তার। নরম। সহজেই বাঁকানো যায়। মরচে নেই। চার ইঞ্চি অন্তর ভাঁজ করার মোচড়। ভাঁজ করে অকুস্থলে আনা হয়েছিল।

কানে পেনসিল গুঁজে ফস করে একটা পানামা ধরিয়ে নিল প্রেমাংশু। পেনসিল নামিয়ে বললে–দুনম্বর?

চিবুকের তলায় আর চোয়ালের দুপাশের ছাল উঠে গেছে গাছের ঘষটানিতে। গাছের নম্বর লেখক। ক গাছের ছাল এখনও লেগে রয়েছে ছড়া জায়গায়। ঋতেশের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। লাশকে ক গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল সে চিবুকটা আটকে ছিল দুটো ডালের সন্ধিস্থলে। গাছের তলায় রক্তের পুকুর জমে গেছে ওই কারণেই।

এবার তিন নম্বর সারা গায়ে কোপের দাগ। বাঁ হাতের বাহুমূল থেকে কব্জি পর্যন্ত ছটা কোপ। ডান হাতেও তাই। প্রতিটি ঊরুতে চারটে করে কোপ–পায়ের ডিমেও তাই। কোপগুলো এমন একটা কিছু দিয়ে মারা হয়েছে যার ফলাটা বাঁকা। এলোপাতাড়ি কোপ মারা হয়েছে উরুসন্ধিতে–দেহটা দাঁড় করানো অবস্থায়। খুব সম্ভব এক হাতে চুলের মুঠি ধরে আরেক হাতে কোপ মারা হয়েছে। পাগলের মতো ছুরি মেরেছে বলেই হাত ফসকেছে অনেকবার– ঊরুসন্ধি দ্রষ্টব্য। হত্যাকারী নিঃসন্দেহে যৌন বিকৃতিতে ভুগছে। রক্তপাত ততটা হয়নি। কেন না, কোপগুলো মারা হয়েছে মৃত্যুর পর।

চার নম্বর পিঠ ফালা ফালা করে কাটা। কোনাকুনিভাবে কাটা হয়েছে ঘাড় থেকে কোমরের তলা পর্যন্ত।

পাঁচ নম্বর–ডান কাঁধে জরুল চিহ্ন।

ইন্দ্রনাথের এই রূপান্তর দেখে আজকাল আর অবাক হই না। পরিহাসপ্রিয়, দিলখোলা মানুষটা হঠাৎ পালটে যায়–মুখের হাসি মুছে যায়, চোখের স্বপ্ন ভেসে যায়, কণ্ঠের কৌতুক চলে যায়। তখন ও দুর্জ্ঞেয়, কর্তব্যকঠোর, নীরস।

আমি লেখক মানুষ। নরম ধাতু। রক্ত, বীভৎসতা স্নায়ুর ওপর বড় উৎপীড়ন করে। তাই মুখ ফিরিয়ে চেয়ে রইলাম ঘাস জমির দিকে।

শুনলাম ইন্দ্রনাথ বলছে–গাছের গোড়ায় পড়ে আছে ছেলেটার সাদা শার্ট আর নীল প্যান্ট। পকেটে রয়েছে লাল রুমাল, পেনসিল ইরেজার, চুইংগামের তিনটে মোড়ক, আর একটা পেনসিল কাটা ছুরি।

জমিটা দেখবি তো? প্রেমাংশু বলল।

বড় টর্চটা দে, ইন্দ্রনাথের কণ্ঠ। ঘাসের ওপর স্বাভাবিকভাবে হাঁটলে পায়ের ছাপ পড়ে না। কিন্তু কেউ যদি পা টিপে টিপে হাঁটে, গোড়ালির ওপর চাপ পড়ে বেশি। কী দেখছিস?

চোখ ফেরালাম। ঘাসের ওপর হুমড়ি খেয়ে রয়েছে ইন্দ্রনাথ। টর্চের মুখ লেগে রয়েছে। ঘাসের ডগায়।

ঘাস দুমড়ে গেছে, তাই তো? রাস্তার দিক থেকে কেউ উঠে এসেছিল দেখছি। ইন্টারেস্টিং। লিখেছিস?

লিখেছি। এবার ওঠ। ডাক্তার এসে গেছে।

ছাগলদাড়ি নেড়ে চত্বরে উঠে এলেন খর্বকায় এক প্রৌঢ়। শীর্ণ মুখ। ব্যাকব্রাশ করা চুল। চোখের কোণে চামড়া কুঁচকোনো।

আলাপ করিয়ে দিল প্রেমাংশু। ডাক্তারের নাম মোতি ডিসিট। খাঁটি কর্ণাটক ব্রাহ্মণ। খুব চটপটে এবং কাজের মানুষ।

শবদেহ ছুঁয়ে বললেন–দেহ তো এখনও গরম দেখছি, বলে ব্যাগ থেকে বার করলেন একটা থার্মোমিটার। ঘাড় মুচড়ে দমবন্ধ করে মারলে অনেকক্ষণ পর্যন্ত দেহ গরম থাকে। মাথায় রক্তক্ষরণ হলেও এমনই অবস্থা দেখা যায়। জেলের মধ্যে একটা মেয়ে গলায় দড়ি দিয়েছিল। তিন ঘণ্টা পরেও থার্মোমিটার লাগিয়ে দেখি একশর ওপর উঠে যাচ্ছে পারদবলতে-বলতে শবদেহ থেকে থার্মোমিটার টেনে বার করলেন ডাক্তার। ব্যাগ থেকে খানিকটা তুলো টেনে নিয়ে থার্মোমিটার মুছলেন এবং তুলে ধরলেন আলোর দিকে।

প্রথম বারো ঘণ্টায় প্রতি ঘণ্টায় দু-ডিগ্রি করে তাপমাত্রা কমে–সেদিক দিয়ে হিসেব সহজ। কিন্তু এ ছোঁড়া তো পড়ে আছে খোলা জায়গায়। ছেলেমানুষ বলেই মাংস পেশির আস্তরণ কম।

অনিমেষে চেয়ে আছে ইন্দ্রনাথ। প্রেমাংশু কানের চুল টানছে নির্মমভাবে।

ডাক্তার বলে চলেছেন–লাশ সরানো হয়েছে। দেখি হাত-পা কত শক্ত…নাঃ, রাইগার দেখে হিসেব করা এখন সম্ভব নয়। একে ছেলেমানুষ, তার ওপরে গা গরম–

এবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল প্রেমাংশুর।

আরে ডাক্তার, আন্দাজেও বলতে পারছেন না কখন মারা গেছে?

কেন পারব না? সন্ধে ছটা নাগাদ। পাঁচটার আগে নয়।

 থ্যাংকস।

ডেডবডি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছিলাম বলেই জিনিসটা চোখে পড়ল ঠিক সেই সময়ে।

একটা সাদা বস্তু। ঘাসের মধ্যে পড়ে আছে হাত কয়েক দূরে। সিগারেটের দগ্ধাবশেষ। হাতে তুলে নিলাম। শেষ প্রান্তে পানামা ছাপটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

কমলা রঙের ফিকে দাগটা লেগে রয়েছে তার ওপরেই। লিপস্টিকের দাগ।

অরেঞ্জ লিপস্টিক। আজই কোনও সুন্দরীর অধরোষ্ঠে প্রলেপ দেখেছি। কবিতার ঠোঁটে নয় তো?

না। কবিতার রূপচর্চার তত্ত্ব আমার মাথায় ঢোকে না। ইলেকট্রন মাইক্রোসকোপ দিয়ে নাকি ও দেখিয়ে দিতে পারে, কৃত্রিম প্রসাধন মাত্রই চুল এবং চামড়ার ঔজ্জ্বল্য হরণ করে।

তবে কার ঠোঁটে দেখলাম কমলা আস্তরণ?

সম্বিৎ ফিরল ইন্দ্রনাথের প্রশ্নে–কীরে মৃগাঙ্ক?

 পোড়া সিগারেটটা শুধু হাতে তুলে দিলাম। আর কিছু বলতে হল না। শাণিত চোখে বস্তুটা উলটেপালটে দেখে নিয়ে পকেটস্থ করল ইন্দ্রনাথ।

রাত একটার সময়ে ফিরে এলাম থানায়।

.

রাত পেরোতে না পেরোতেই প্রেমাংশুকে ঘেরাও করল তিনজন ভদ্রলোক। উৎকণ্ঠায়, উদ্বেগে তিনজনেই অস্থির।

দীর্ঘদেহী সুপুরুষ ভদ্রলোক বনলক্ষ্মীর পিতৃদেব। সার্কাসের সঙের মতো থমথমে চেহারার ভদ্রলোক ব্যাঙ্গালোর ক্লাবের সেক্রেটারি এবং ক্ষুদ্রাকায় হলেও হাতুড়ি দিয়ে পেটা শরীর যাঁর, তিনি কলকাতা টিমের কোচ।

তিনজনেরই বক্তব্য মোটামুটি একরকম। টেনিস স্টার ঋতেশ রায়ের যশসূর্য কালকের খেলাতেই মধ্যগগনে উঠত কিন্তু পুলিশের উৎপাতে সব পণ্ড হতে বসেছে।

প্রেমাংশু অটল রইল এই হট্টগোলের মধ্যে। আমাকে নিয়ে ইন্দ্ৰনাথ হনহন করে প্রবেশ করল থানাদারের ঘরে। কাঠের পুতুলের মতো বসে আছে ঋতেশ-বনলক্ষ্মী। ঋতেশ ঋজু। বনলক্ষ্মী জবুথবু। মুখ শুকনো। চোখের কোণে কালি।

ইন্দ্রনাথের পায়ের শব্দে মুখ ফিরিয়ে তাকাল ঋতেশ। ভাঙা গলায় বললে–আর কতক্ষণ আটকে রাখবেন? ওঁদের সঙ্গে যেতে দিন।

দেব, মধুক্ষরা কণ্ঠে বলল ইন্দ্রনাথ। তার আগে একটা ছোট্ট পরীক্ষা আছে।

এতক্ষণে নজর পড়ল বনলক্ষ্মীর চারু অধরে। অজন্তা ঠোঁটে অরেঞ্জ প্রলেপ।

দেখেই মনটা দমে গেল। ভেবেছিলাম, হত্যাকারীর সূত্র আবিষ্কার করেছি। কিন্তু তা তো নয়!

ইন্দ্রনাথ চেয়ারে না বসে টেবিলের ওপর কাগজ হাতড়াতে হাতড়াতে বললে– ঋতেশবাবু, সিগারেট খান?

খাই।

আজ সন্ধ্যায় খেয়েছিলেন?

 সারাদিনই খাচ্ছি।

ওটা জবাব হল না। সন্ধ্যায় খেয়েছিলেন?

সন্ধ্যায় কখন?

কখন আপনি জানেন না? এবার ঈষৎ কঠিন হল ইন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর। কিন্তু আমি জানি। সাড়ে ছটা। ঠিক?

কী করে জানলেন?

 ছ;টায় ছেলেটা মারা গেছে বলে।

সহজভাবেই বলল ইন্দ্রনাথ। কিন্তু ভয় পেয়ে গেল ঋতেশ।

আমি…আমি…।

পানামা সিগারেট, ঠিক?

হ্যাঁ। কিন্তু ইন্দ্রনাথ একটা কাগজ টেনে নিয়ে এসে দাঁড়াল বনলক্ষ্মীর সামনে। বাঁ হাতে মাথাটা কোলের কাছে টেনে নিয়ে ডান হাতে কাগজটা চেপে ধরল অজন্তা ঠোঁটে।

সাদা কাগজে ছাপা হয়ে গেল মিষ্টি ঠোঁটের মিষ্টি ছবি।

কোণ ধরে কাগজটা ঝুলিয়ে ধরল ইন্দ্রনাথ। বলল–বনলক্ষ্মী।

চোখ তুলে চাইল বনলক্ষ্মী। চোখের তারায় ভয়ের কাঁপন।

অল্প লিপস্টিকে মন ওঠে না, তাই না? এত লাগাও কেন?

চুপ করে রইল বনলক্ষ্মী।

 ইন্দ্রনাথ এবার ঋতেশকে বললে–মুখটা আলোর দিকে ফেরান।

 কেন?

যা বলছি, করুন।

বিদ্রোহী ঋতেশ ঘাড় ফেরাল কড়িকাঠের আলোর দিকে। হেঁট হয়ে কী যেন দেখলে ইন্দ্রনাথ। তারপর তর্জনী দিয়ে নাকের নীচে একটা আবছা দাগ দেখিয়ে বললে–বনলক্ষ্মী, বাঁধনছেঁড়া প্রেমের বিপদ অনেক। দাগটা কীসের তোমার বাবা দেখলেই ধরে ফেলবেন।

দাগটা অরেঞ্জ লিপস্টিকের। কিন্তু কিশোরী বনলক্ষ্মীকে অত ভয় দেখানোর দরকার ছিল কি?

ঠিক এই সময়ে পুলিশি জুতোয় ঘর কাঁপিয়ে আবির্ভূত হল প্রেমাংশু–কী হল?

কিচ্ছু না। এদের ছেড়ে দিতে পারিস, লিপস্টিক-রঞ্জিত কাগজ আর পোড়া পানামা একটা খামের মধ্যে রাখতে রাখতে বললে ইন্দ্রনাথ–অভিসার নিয়ে তোর মাথা ঘামানোর সময় নেই।

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঋতেশ-বনলক্ষ্মীকে নিয়ে উধাও হলেন তিন উদ্বিগ্ন ভদ্রলোক।

প্রেমাংশু হাই তুলে বললে–চল, এবার বাড়ি যাওয়া যাক।

 চল।

গাড়িতে উঠে ইন্দ্রনাথকে বললাম–তুই একটা সেক্স-পারভার্ট।

 চোখ তুলে ও বলল–সে কীরে।

প্রথম প্রণয়ে অমৃত থাকে। নিজে ব্যাচেলর তো, ঈর্ষার জ্বালায় ঋতেশ-বনলক্ষ্মীর সঙ্গে রুক্ষ ব্যবহার করলি! প্রেম করার সময়ে সবাই সিগারেট খায়।

তাই বল, এতক্ষণে হাঁ বন্ধ করে বলল ইন্দ্রনাথ। মন উচাটন হয়েছে। চল বাড়ি, তোর হচ্ছে।

বাড়ি গিয়েই দরজা ঠেঙিয়ে কবিতাকে ঘুম থেকে তুলল ইন্দ্রনাথ।

বলল সোল্লাসে–বউদি, ঋতেশ-বনলক্ষ্মীর প্রেম দেখে তোমার কথা মনে পড়েছে। মৃগাঙ্কর।

তাই নাকি? এতদিন পরে? চোখ ঘুরিয়ে বলল কবিতা–তোমার মত ভীতু নয়– সাহস আছে।

কার? বলি আমি।

ঋতেশের। পুরো রুপোর টাকা লিখতে হয়েছিল আমাকে কজায় আনতে। মনে পড়ে?

ঋতেশ স্টাইলের প্রেমই কি তুমি চেয়েছিলে? বলগা ছাড়া বাঁধনহারা?

 বাহুতে ছোট্ট চড় মেরে কবিতা বললে–মরণ আর কী।

.

সকাল হতেই আলেকজান্ডার চা-জলখাবার নিয়ে হাঁকডাক আরম্ভ করল দোরগোড়ায়।

আলেকজান্ডার প্রেমাংশুর সচিব, সেবাদাস এবং পাঁচক। কানাছেলের নাম পদ্মলোচন। অর্থাৎ, আলেজান্ডারের শৌর্যবীর্য এবং বপু মোটেই ইতিহাসের আলেকজান্ডারের মতো নয়।

এ আলেকজান্ডার কেরালার খ্রিস্টান। টিংটিংয়ে চেহারা। বাড়তি মাংস বা চর্বি কোথাও নেই। হাসতেও জানে না। তবে রাঁধতে জানে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে চারজনে টেবিলে বসতেই এল গরম গরম ডিমটোস্ট, ওপরে টম্যাটো সস আর চিজ পাউডারের পুরু আস্তরণ। সবে একটা কামড় বসিয়েছি, এমন সময়ে টেলিফোন এল থানা থেকে।

খেতে খেতেই কথা বলে চলল প্রেমাংশু।

কাঁধে জরুলওলা ছেলেটির হদিশ মিলেছে। বসভনগুড়িতে থাকে। নাম, ললিতমোহন পণ্ডিত। পনেরো বছর বয়স। সাইকেল নিয়ে বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল। আর ফেরেনি। সাইকেলটাও পাওয়া গেছে চন্দন ঝোপের ধারে। ললিতমোহনের আঙুলের ছাপ ছাড়া আর কারও আঙুলের ছাপ সাইকেলে নেই।

রিসিভার রেখে ঘড়ি দেখল প্রেমাংশু। পুরো ডিমটোস্টটা বিশাল মুখগহ্বরে নিক্ষেপ করে বললে জড়িত স্বরে–ঠিক তেরো মিনিটের মধ্যে খাওয়া শেষ করতে হবে। গ্রিনরুম-সাজের জন্যে বউদিকে বাড়তি দু-মিনিট। কুইক বলেই হাত বাড়াল আর একটা টোস্টের দিকে।

.

গাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল।

 ইন্দ্রনাথ বললে–ব্যাঙ্গালোরে এত বাঙালি আছে জানতাম না।

আমিও জানতাম না সায় দিলাম আমি। মালেশ্বরমে বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন আছে। জানতাম। কিন্তু বসভনগুড়িতে

ইদানীং হয়েছে, বললে প্রেমাংশু। ব্যাঙ্গালোরে মাছ সস্তা, সবজি টাটকা, আর হাওয়া মনোরম। সেই জন্যেই তো শহরটা যাদের, সেই কানাড়াভাষীরাই সংখ্যায় কম এখানে। তামিল ভাষীরাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বাঙালিও বিস্তর।

কিন্তু ললিতমোহনের নিখোঁজ হওয়াটা রহস্যময়, বলল ইন্দ্রনাথ। থানায় ডায়েরি হয়েছে কখন?

আজ ভোরের দিকে।

 কেন? বিকেল থেকে ছেলে নিখোঁজ, বাপ-মায়ের টনক নড়ল আজ ভোরে।

সেইটাই তো জানতে যাচ্ছি।

ঢেউখেলানো চওড়া রাস্তার দুদিক দিয়ে সাইকেলের সারি। ব্যাঙ্গালোরে বাস কম, ট্যাক্সি আরও কম। স্কুটার রিক্সা আর সাইকেলই এ শহরের প্রধান বাহন।

মন্দির পেরিয়ে মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পর জিপ থামল। বাড়িটা সাদা চুনকাম করা। একতলা। সামনে বাগান।

লোহার ফটকের বাঁদিকের থামে লেখা বাড়ির নাম–লালমহল। ডান দিকের থামে প্রস্তরফলকে লেখা গৃহস্বামীর মাম ও ডাঃ লালমোহন পণ্ডিত। ফটকের বাইরে পাহারায় দাঁড়িয়ে দুজন মহীশূরী চৌকিদার। শুঁটকি মাছের মতো শুকনো আকৃতি। দেখে ভক্তি হয় না মোটেই। প্রেমাংশু শালপ্রাংশু বপু নিয়ে নামতেই দুজনেই স্যালুট করল টকাস করে বুট ঠুকে। কবিতা গাড়ি থেকে নামল না।

বলল–শোকতাপের মধ্যে দলবেঁধে যাওয়া মানায় না। তোমরা যাও। কবিতার সূক্ষ্ম অনুভূতিতে যা আগেই ধরা পড়েছিল, বাড়ির ভেতরে পা দিতে না দিতেই তা উপলব্ধি করলাম। একজন আধবুড়ো চাকর এস্তে সরে দাঁড়াল আমাদের দেখে। সারা বাড়ি নিঝুম, থমথমে, শোকস্তব্ধ।

বাড়ির চারিদিকে চওড়া বারান্দা। কেরালা বেতের চেয়ার আর নীচু-টেবিল পাতা।

ইঙ্গিতে চাকরটিকে ডাকল প্রেমাংশুবাবু কোথায়?

এজ্ঞে, ঘুমাইতাছেন।

ঘুমোচ্ছন?

ডাগদারবাবু ছুঁচ ফুড়ে দিলেন যে! বড্ড কাঁদতে ছিলেন।

 অ। আর কে আছে বাড়িতে?

 দি-মণিকে ডাকব?

 ডাকো।

 একরকম ছুটেই পালিয়ে গেল প্রৌঢ় ভূত্য।

আমরা বসলাম বেতের চেয়ারে। একটু পরেই একজন ভদ্রমহিলা বারান্দার কোণ ঘুরে দাঁড়ালেন আমাদের সামনে।

সে কী ভদ্রমহিলা! নারীত্বের সুষমা কোথাও নেই। মাথায় আমার চাইতেও লম্বা। শুকনো খটখটে। অন্তঃস্রাবী গ্রন্থির গোলমাল আছে মনে হয়। পুরুষ কঠিন মুখাবয়ব, তামাটে রং। প্রেমাংশু অপ্রসন্ন চোখে দেখছিল ভদ্রমহিলাকে। সম্ভবত নিহত ললিতমোহনের সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজছিল, কিন্তু পাচ্ছিল না।

ভদ্রমহিলা হাতজোড় করে নমস্কার করে বসলেন আর একটা চেয়ারে।

বললেন–মাসিমা আর মেসোমশাই দুজনকেই ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আমি এখনও খাড়া আছি।

থাকাটাই স্বাভাবিক। যা চেহারা–

প্রেমাংশু বললে কাষ্ঠহেসে–এ অবস্থায় আসতে হল শুধু কর্তব্যের খাতিরে। ললিতমোহন আপনার মাসতুতো ভাই?

হ্যাঁ। ছাপাপাড় সাদা শাড়ির খুঁটটা আঙুলে জড়াতে-জড়াতে বললেন হিড়িম্বারূপিণী। আমি স্বামী পরিত্যক্তা, মাসির কাছেই মানুষ! ললিত আমার আপন ভাইয়ের মতো। মাসিমা আমাকে মেয়ের স্থান দিয়েছিলেন। আমার আর কেউ নেই। বাবা-মা গত হয়েছেন।

গলার স্বরে উত্থান-পতন নেই, বিষাদও নেই–নির্বিকার। বাইরের রূপ দেখে বিরূপ মনোভাবের জন্যে ঈষৎ অনুতাপ এল মনে।

প্রেমাংশু নিজেও থিতিয়ে গিয়েছিল বিষণ্ণ বয়ান শুনে। দুঃখে যাদের জীবন গড়া তাদের আবার দুঃখ কীরে? শোকমগ্ন লালমহলে তাই তিনি এখনও নিথর অচঞ্চল।

গলা খাঁকারি দিল ইন্দ্রনাথ–বেশি সময় নেব না আপনার। যে যায় সে ফিরে আসে, কিন্তু তবুও আমাদের কর্তব্য করতে হয়। প্রশ্ন শুরু করি?

করুন। কোলের ওপর দুটি শীর্ণ শিরা বার করা হাত তুলে বসলেন ভদ্রমহিলা। তারপর ধরা গলায় একে-একে অনেক কথাই বললেন, নাম তার বিন্দুমতী। কাজ করেন স্থানীয় টেলিফোন কারখানায়। মেসোমশাই অর্থাৎ লালমোহন পণ্ডিত বিমান কারখানার ডাক্তার। ললিত অত্যন্ত ভালো ছেলে। পড়াশুনায় ভালো, স্বভাবচরিত্রও ভালো। অজাতশত্রু। তা সত্ত্বেও কে তাকে এভাবে খুন করল, সেটাই রহস্য।

গতকাল চারটের সময়ে স্কুল থেকে ফিরেই আবার বেরিয়ে গিয়েছিল ললিত। সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিল, বলছিল, শ্যামলেন্দুর বাড়ি যাচ্ছি।

শ্যামলেন্দু ওর সহপাঠী। রাসেল মার্কেটের কাছে থাকে। রাত আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরেও যখন সে এল না, তখন মাসি-মেসোকে নিয়ে মালেশ্বরম গিয়েছিলেন বিন্দুমতী বিয়ের নেমন্তন্ন রাখতে। চাকরকে বলেছিলেন, ললিত এসে যেন বিয়েবাড়ি চলে যায়।

কিন্তু ললিত আর আসেনি। আজ ভোরে বাড়ি ফিরেই থানায় ডায়েরি করা হয়। তারপর থেকেই মাসি ফিট হচ্ছেন–মেসো এলিয়ে পড়েছেন।

প্রেমাংশু খাতা বন্ধ করে বললে–ললিতের ঘরটা একবার দেখব।

আসুন। কপালের ওপর থেকে শুকনো চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন বিন্দুমতী। বারান্দার কোণ ঘুরে দাঁড়ালেন একটা দরজার সামনে। হাতকয়েক তফাতে আর একটা দরজা।

বললেন–ওপাশের ঘরটা আমার।

সাদা রং করা পাল্লা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। ঘরটা যে আধুনিক ছাত্রের তা এক দর্শনেই মালুম হয়। খবরের কাগজ আর বিভিন্ন সাময়িকপত্র থেকে হরেক রকম ছবি কেটে আঠা দিয়ে লাগানো দেওয়ালে, কিন্তু প্রতিকৃতি কোথাও নেই।

দক্ষিণ দিকের জানলার সামনে কাঠের টেবিলে বইখাতার স্তূপ। পাশের দেওয়াল আলমারিতে ইংরেজি আর বাংলা বই। গল্পের বই বেশি। কয়েকটা বই আমারই লেখা। ইন্দ্রনাথ রুদ্রর কাহিনি। পাশের বইগুলিও ডিটেকটিভ কাহিনি।

দেওয়াল ঘেঁষা সিঙ্গল খাট। মাথার কাছে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতিকৃতি। পাশেই নিকেল ফ্রেমে বাঁধানো ললিতমোহনের ফোটো। আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। সাদা সার্ট আর শর্ট পরে। ক্রিকেট ব্যাট বগলে দাঁড়িয়ে আছে খেলার মাঠে। চোখ দুটি প্রাণবন্ত। যেন অনুসরণ করছে। আমাদের প্রত্যেককে। নিষ্পাপ চোখে অসীম কৌতূহল।

ইন্দ্রনাথ গম্ভীর হয়ে গিয়েছে ছবিটা দেখে। হেঁট হয়ে টেনে দেখল টেবিলের ড্রয়ার দুটো। ভেতরে একরাশ তারের ধাঁধা।

আমি তর্জনী নির্দেশ করে শুধোলাম–আমার লেখা বই রয়েছে দেখছি।

 চকিত চাহনি নিক্ষেপ করলেন বিন্দুমতী–আপনি মৃগাঙ্ক রায়?

হ্যাঁ।

উনিই তাহলে ইন্দ্রনাথ রুদ্র। ললিত আপনার ভীষণ ভক্ত ছিল।

ফিরে চাইল ইন্দ্রনাথ–তাই নাকি?

বইয়ের পোকা ছিল। বিশেষ করে ডিটেকটিভ বই। বলত, বড় হলে ইন্দ্রনাথ রুদ্র হবে। আচ্ছা, হীরামনের হাহাকার-এর ভ্রমর মেয়েটা কি জীবন্ত চরিত্র?

মৃগাঙ্গ বলতে পারে, প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে পালটা প্রশ্ন করল ইন্দ্রনাথ-ললিত সম্বন্ধে একটা কথা জিগ্যেস করতে পারিনি। এখন করছি। ও কি মেয়েদের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসত? সোজা কথায় ললিত কি অকালপক্ক ছিল?

না। ঠিক উলটো ছিল। শ্যামলেন্দু ওর প্রাণের বন্ধু। একপাল ছেলে নিয়ে একটা ডিটেকটিভ ক্লাব খুলেছিল। ও ছিল সেক্রেটারি। একটা হাতে লেখা ম্যাগাজিনও বার করত।

বলেন কী! অকপট বিস্ময় প্রকাশ করল ইন্দ্রনাথ। নিবিষ্ট মনে খাতা খুলে নোট নিয়ে চলল প্রেমাংশু।

ললিত বলত, সাহিত্যের স্কুলে পড়ে যেমন সাহিত্যিক হওয়া যায় না, গোয়েন্দা স্কুলে পড়েও তেমনি গোয়েন্দা হওয়া যায় না। দরকার অনুশীলনের। তাই তো সাইকেল নিয়ে টো টো করত সারা শহরে।

কেন?

আপনি নাকি কোথায় লিখেছেন, চোখের ব্যবহার না করলে গোয়েন্দা হওয়া যায় না। ও তাই রাস্তাঘাটে টহল দিত। বলত, এইভাবেই ঘুরতে-ঘুরতে চোর-ঘঁচোড়ের টিকি ধরে ফেলবে। তারপর পুলিশের কাছে খবর পাঠালেই পুলিশ লোহার কোটকে স্বীকৃতি দেবে।

লোহার কোট? খসখস শব্দ স্তব্ধ হতে দেখি লেখা থামিয়ে জুলজুল করে চেয়ে আছে। প্রেমাংশু।

ওর ডিটেকটিভ ক্লাবের নাম। লোহার কোটের মতোই নাকি দুর্ভেদ্য। হাতে লেখা ম্যাগাজিনগুলো দেখবেন?

কই দেখি।

টেবিলের তলা থেকে এক গোছা পত্রিকা বের করে আনলেন বিন্দুমতী। ইন্দ্রনাথের পরিচয় পাওয়ার পর থেকেই ভদ্রমহিলার মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে। আমার অস্তিত্ব যেন বিস্মৃত হয়েছেন।

ম্যাগাজিনগুলো চার পৃষ্ঠার চটি ম্যাগাজিন। ডিমাই কাগজে সাইক্লোস্টাইল করা। গোটা গোটা অক্ষরে ওপরে লেখা ও লোহার কোট।

তারপর, পরিচ্ছন্ন হরফে সম্পাদকীয় বিবৃতি, সদস্যদের চিঠিপত্র, টুকরো খবর এবং কিশোর গোয়েন্দাদের সারা মাসের প্রগতি প্রতিবেদন।

ভুরু কুঁচকে শুধোলো ইন্দ্রনাথহাতের লেখাটা কার?

ললিতের।

 সুন্দর লেখা। সাইক্লোস্টাইল হত কোথায়?

 সিটি মার্কেটের একটা দোকান থেকে।

ম্যাগাজিনগুলো আমি নিয়ে যাচ্ছি–পরে ফেরত দেব। আপনি শ্যামলেন্দুর ঠিকানা জানেন?

জানি।

ঠিকানা লিখে নিয়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম সকলে। বিদায় মুহূর্তে দেখলাম, বিষাদ মেঘ ঘনিয়েছে বিন্দুমতীর মুখদেশে। চক্ষু সজল।

বললেন ধরা গলায়–আমি নিয়তি বিশ্বাস করি। যা হবার তা হবেই, কেউ রুখতে পারবে না। ক্ষণজন্মা ললিতকেও যেতে হল সময় ফুরিয়েছিল বলে। কিন্তু

কিন্তু কী? বিরাগপূর্ণ চোখে বলল প্রেমাংশু।

কৌতূহল হচ্ছে, নিমিত্ত হল কোন জন?

কোনও এক নরপশু। নামটা যথাসময়ে জানাব, বলে হনহন করে বেরিয়ে এল প্রেমাংশু।

গাড়িতে উঠে বললে–দ্যাখ ইন্দ্র, খোশামুদ শুনে তুই গলে যেতে পারিস, আমি যাইনি। বিন্দুমতীও ললিতকে খুন করতে পারে।

বলিস কীরে?

ঠিকই বলছি। স্বামী পরিত্যক্তা খাণ্ডারনি তো! তার ওপর ললিত মরলেই পোয়াবারো। মেসোর সম্পত্তিটা হাতানো যাবে।

বিস্ফারিত চোখে কেবল চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ।

তোয়াক্কা না করে প্রেমাংশু বললে–ওই ঋতেশ ছোঁড়াও খুন করতে পারে। অকর্ম করতে গিয়ে ধরা পড়ায়–

প্রেম, ললিতকে হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় খুন করা হয়নি। খুন করবে বলেই খুনি ভাঁজ করা তার নিয়ে গিয়েছিল সঙ্গে। ঋতেশ খুনি নয়।

কিন্তু ছুরির কোপগুলো দেখেছিস? এলোপাতাড়ি। রাগের মাথায় ঠিকমতো টিপ করতেও পারেনি। বিন্দুমতীর চেহারাটাও সাংঘাতিক।

হেসে বলল ইন্দ্রনাথবেশ তো, তুই বিন্দুমতী আর ঋতেশকে নিয়ে চিন্তা কর। আপাতত আমাকে নিয়ে চল শ্যামলেন্দুর কাছে।

হঠাৎ বিন্দুমতীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল ফটকের কাছে।

 ইন্দ্রনাথবাবু, একটা কথা বলা হয়নি। আপনারাও জিগ্যেস করেননি।

 কী বলুন তো?

 কবিতার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিলেন বিন্দুমতী।

 লিলিতের একটা উৎকট হবি ছিল।

কী?

ধাঁধা তৈরি করা।

চোখের সামনে ভেসে উঠল ড্রয়ার ভরতি তারের ধাঁধা!

.

চলন্ত গাড়ির জানলা দিয়ে অন্যমনস্কভাবে ফুটপাতের দিকে চেয়েছিল ইন্দ্রনাথ। হাওয়ায় রেশমমসৃণ চুল উড়ছে। সুন্দর চোখ দুটোর দুপাশ ঈষৎ কুঁচকে রয়েছে। চোখে কুহেলি দৃষ্টি।

কী ভাবছ ঠাকুরপো? ইন্দ্রনাথের গায়ে ঠেলা দিয়ে বলল কবিতা।

 অতীত।

 হঠাৎ?

বিন্দুমতীর ভাগ্য দেখে।

জিজ্ঞাসু চোখে আমার পানে চাইল কবিতা। সংক্ষেপে বললাম তদন্ত বিবরণ। সবশেষে বললাম–বিন্দুমতী সত্যিই ভাগ্যহীনা। তাই নিয়তিকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে।

ইন্দ্রনাথ যেন স্বগতোক্তি করল–ভাগ্য আমারও খারাপ। আমিও জ্ঞান হওয়ার আগেই বাবা-মাকে হারিয়েছি। মাসির কাছে মানুষ হয়েছি। সেই মাসি পরলোকে চম্পট দেওয়ার পর থেকেই আমি বড় একা।

ইন্দ্রনাথের বাল্যকাল আমি জানি। কবিতাও জানে। ওর স্বপ্নিল চাহনির গভীরতা অনুধাবন করতে পারে বলেই অষ্টপ্রহর আগলে রাখে স্নেহ ভালোবাসার তাড়না দিয়ে।

তাই হঠাৎ কোনও কথা খুঁজে পেল না কবিতা। অন্য সময়ে হলে তেড়ে উঠত। এখন বলল ছোট্ট করে–আমরা তো রয়েছি।

কবিতার দিকে ফিরে ম্লান হাসল ইন্দ্রনাথ।

 দুর্বোধ্য সেই হাসি। সুগভীর।

 বলল–তা আছ।

হা-র-র-উ-ম্! হঠাৎ গলা সাফ করল প্রেমাংশু। অথচ শত চেষ্টাতেও এক ফোঁটা কফও বেরোল না কণ্ঠদেশ থেকে। কিন্তু নিমেষে লঘু হয়ে গেল পরিবেশ। ভুরু কুঁচকে বললে কবিতা– গলায় কী ঢুকল? আরশুলা?

না, ধাঁধা।

রাসেল মার্কেটের সামনে থেকে যে রাস্তাটা ক্যান্টনমেন্টের দিকে গেছে, তার ওপরেই রাখালরাজ সাহার বাড়ি।

ব্যাঙ্গালোরের আরেক নাম গার্ডেন সিটি। বাড়িগুলোই তার চাক্ষুস প্রমাণ। রাখালরাজ সাহার বাড়িও তার ব্যতিক্রম নয়।

মস্ত বাগানে খোন্তা হাতে গোলাপ চারা লাগাচ্ছিলেন রাখালরাজ নিজেই। মাথার সামনে চুল নেই–পেছনে আছে। কপালে তিন ভাঁজ ত্রিবলী রেখা। নাকটি টিয়াপাখির নাকের মতো টিকালো।

গড়ুর নাসিকার ঠিক নীচেই এক জোড়া পুষ্ট গুম্ফ।

খোন্তা নিয়ে দৌড়ে এলেন রাখালরাজ।

আসুন আসুন, কী সৌভাগ্য। লালমোহনের ফোন পেয়েছি। ললিত ফিরেছে? ভদ্রলোকের উল্লাস দেখে প্রথমে ভূ কুঞ্চন করেছিলাম সকলেই। শেষ কথাটা শুনে বুঝলাম, দুঃসংবাদটা জানেন না।

আমরাও জানালাম না।

কোমরের বেল্টটা টেনে তুলতে-তুলতে এগিয়ে গিয়ে প্রেমাংশু বলল–ঘরে চলুন, আপনিই শ্যামলেন্দুর বাবা?

আজ্ঞে, হ্যাঁ। রাখালরাজ সাহা।

ইন্দ্রনাথ গোলাপ দেখছিল তন্ময় হয়ে। স্মৃতির রোমন্থন এখনও যায়নি চোখ থেকে।

সাইজখানা দেখেছেন স্যার? অট্টহাস্য করে বললেন রাখালরাজ। স্খলিত লুঙ্গি বাঁ-হাতে চেপে ধরে খোন্তা দিয়ে গোলাপ দেখিয়ে বললেন–কালচার করা গোলাপ। লালবাগ থেকে কিনেছি। ডালিয়া কি গোলাপে ধরা যায় না।

অন্যমনস্কভাবে ইন্দ্রনাথ বললে–তা ঠিক। শ্যামলেন্দু কোথায়?

এই তো ছিল। আপনাদের দেখেই ভো দৌড় দিল। হাঃ হাঃ হাঃ। সখের গোয়েন্দা মশাই, বুঝলেন কিনা, পুলিশ দেখলেই ভড়কে যায়।

ঠিক বলেছেন, ইন্দ্রনাথের পানে অপাঙ্গে তাকিয়ে মন্তব্য করল প্রেমাংশু। আপনার ছেলেরও গোয়েন্দাগিরির বাতিক আছে নাকি?

হাঃ হাঃ হাঃ! তবে আর বলছি কী! কোথায় গেলি রে শ্যামলা…নাঃ জ্বালালে তো ছেলেটা…গগন…ও গগনচাঁদ, দ্যাখ না বাবা শ্যামলা কোথায় গেল! আপনারা আসুন। কফি খেয়ে যান। ধোসা খান তো? বাড়িতে তৈরি মশায়। উনি নামলেন না গাড়ি থেকে?

শেষ কথাটা নিক্ষিপ্ত হল কবিতাকে উদ্দেশ্য করে।

 ওঁর মাথা ধরেছে, বললাম আমি। চলুন এগোই।

এমন সময়ে গগনচাঁদ আবির্ভূত হল আমাদের সামনে। তেল চুকচুকে নধরকান্তি বপু দাদাবাবু গ্যারেজে ঢুকে বসে আছেন। আসবেন না।

দৃষ্টি বিনিময় করল ইন্দ্রনাথ আর প্রেমাংশু।

 চলুন, আমরাই যাচ্ছি গ্যারেজে, বলল প্রেমাংশু।

গোলাপি রং করা বাসভবনের পেছনে দুটি ছোট ছোট ঘর। একটিতে গগনচাঁদের সংসার। আর একটিতে একটি শেভ্রলে গাড়ি। ব্লু বডি। নিয়মিত মাজাঘষায় চকচকে। এককোণে একটা কাঠের আলমারি। যন্ত্রপাতি থাকে। দেওয়ালে ভুষো। রাখালরাজ লুঙ্গি খামচে ধরে উধাও হলেন বাড়ির মধ্যে। পুলিশকে খাতির করতে চায় সকলেই।

আমাদের দেখেই গ্যারেজের কোণ থেকে উঠে দাঁড়াল একটি ছেলে। চোখে চশমা। বাপের মতোই গড়ুর নাসিকা। শ্যামলবরণ। গাঢ় নীল রঙের পুলওভারটি বেশ মানিয়েছে ঘন লাল ট্রাউজার্সের ওপর।

ছেলেটির চোখমুখ বুদ্ধিদীপ্ত। কিন্তু ভয়ার্ত। গালে ভুসোর দাগ। হাতেও তাই।

এগিয়ে গিয়ে সস্নেহে বলল ইন্দ্রনাথ–ভয় কীসের শ্যামলেন্দু?

ট্রাউজার্সের দু-পকেটে হাত ঢুকিয়ে জোর করে হেসে বলল শ্যামলেন্দু–না, না, ভয় কীসের। ললিত ফিরেছে?

না। তোমার সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল কখন?

কালকে বিকেলে।

স্কুলে?

 স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর।

কখন?

তখন প্রায় পাঁচটা। সাইকেলে করে এসেছিল, বলে ঢোক গিলল শ্যামলেন্দু।

ও। তারপর?

চলে গেল।

কোথায়?

বলেনি।

তুমি আঁচ করতে পারছ না?

না।

কারও সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল?

জানি না।

কারও সঙ্গে ঝগড়াঝাটি হয়েছিল?

 জানি না।

 টহল দিতে বেরিয়েছিল কি?

 ইয়ে…মানে…।

তুমিও তো ‘লোহার কোট’-এর মেম্বার?

 চমকে উঠল শ্যামলেন্দু–আপনি জানলেন কী করে?

আমি জানি। জানাটাই আমার কাজ। তারপর বলল খাটো গলায় আমার নাম ইন্দ্রনাথ রুদ্র।

চশমার আড়ালে জুলজুল করে উঠল শ্যামলেন্দুর দু-চোখ–সত্যি?

সত্যি। এই হল লেখক মৃগাঙ্ক রায়। আর উনি প্রেমাংশু রায়। পুলিশ অফিসার।

প্রেমাংশু তখন ঘুরঘুর করছে গ্যারেজের মধ্যে। যন্ত্রপাতির বাক্স নাড়ছে। গাড়ির তলা দেখছে। শ্যামলেন্দুর ভয়মাখানো চাহনি অনুসরণ করছে তাকে।

চঞ্চল চাহনিটা নজর এড়ায়নি ইন্দ্রনাথের। তাই হঠাৎ বললে প্রেমাংশুকে–প্রেম, তুই বরং রাখালবাবুকে যা জিগ্যেস করবার করে নে। আমি যাচ্ছি।

অর্থপূর্ণ চোখে তাকিয়ে বিনা বাক্যব্যয়ে বেরিয়ে গেল প্রেমাংশু।

 একটু সহজ হল শ্যামলেন্দু।

ইন্দ্রনাথ আমাকে ইশারা করতে আমিও বেরিয়ে এলাম বাইরে।

আয়নাটা কার? শুনতে পেলাম ইন্দ্রনাথের প্রশ্ন।

 গগনচাঁদের। জবাব দিল শ্যামলেন্দু।

 দেখি।

আয়না নিয়ে আলোয় দাঁড়িয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের মুখখানা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ইন্দ্রনাথ।

তারপর আয়না ঝুলিয়ে রাখল দেওয়ালের পেরেকে।

শ্যামলেন্দু তখনও আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে ঘরের কোণে। কাছে গিয়ে কাঁধে এক হাত রেখে স্মিত মুখে বলল ইন্দ্রনাথ–শ্যামলেন্দু?

চোখ তুলে চাইল শ্যামলেন্দু।

ললিত খুব ধাঁধা ভালোবাসে, না?

 খু-উ-ব।

প্রেমাংশু এখন নেই। সত্যি করে বলো তো, ওকে দেখে এখানে পালিয়ে এলে কেন?

শ্যামলেন্দু নিরুত্তর।

এক হাত শ্যামলেন্দুর কাঁধে, আরেক হাত শেভ্রলের পেছনের বুটিতে রেখে বললে ইন্দ্রনাথ–আমি বলব?

শ্যামলেন্দুর চোখে এবার শঙ্কার শিহরন।

এক ঝটকায় ঢাকনি তুলে বললে ইন্দ্রনাথ–এই জন্যে।

 বলেই, ভেতর থেকে একটা টিনের কৌটো ছোঁ মেরে তুলে নিল ইন্দ্রনাথ।

 জিনিসটা একটা টফির বাক্স।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *