লাবণির জীবনযাপন

লাবণির জীবনযাপন

লাবণি মজুমদার একটা নামকরা বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল সাতরং-এর ডেপুটি নিউজ এডিটর। সপ্তাহের ছটা দিন তার প্রচণ্ড কাজের চাপ থাকে। বুধবার শুধু ছুটি। চাপমুক্ত হয়ে এই দিনটা সে নিজের মতো করে হালকা মেজাজে কাটিয়ে দেয়।

আজ বুধবার। অন্য দিন সকালে সাতটা সাড়ে সাতটায় সে উঠে পড়ে। সাড়ে দশটায় তার আফিসের গাড়ি চলে আসে। তার মধ্যে স্নান-টান করে, ব্রেকফাস্ট সেরে তৈরি হয়ে নেব লাবণি।

আজ কোনওরকম তাড়াহুড়ো নেই। লাবণির ঘুম ভাঙল নটায়। তারপর সোজা বাথরুমে। মিনিট পনেরো বাদে, বেরিয়ে এসে বাসি নাইটি পালটে একটি ঢোলা হাউসকোট টাইপের গায়ে চাপিয়ে, হাতে মোবাইল নিয়ে দোতলার প্রশস্ত বারান্দায় একটি গদি-আঁটা চেয়ারে আয়েশ করে বসল লাবণি। পাশেই ছোট, নিচু একটা টেবিল। সেটার ওপর আজকের মর্নিং এডিশনের পাঁচটা খবরের কাগজ গুছিয়ে রাখা আছে। হাতের মোবাইলটা সেগুলোর পাশে রাখল সে।

এই দোতলা বাড়িটা তার বাবা দেবনাথ মজুমদার কুড়ি-বাইশ বছর আগে তৈরি করেছিলেন। বছর বারো আগে, মা মারা গেছেন। তিন বছর হল, বাবারও মৃত্যু হয়েছে। বাড়িটা এখন শুধু সে আর একমাত্র বিকলাঙ্গ ছোটভাই কমল, যার ডাকনাম সোমু। জন্মের পর থেকেই সে শয্যাশায়ী। লাবণির বয়স বত্রিশ-তেত্রিশ। কিন্তু এখনও যথেষ্ট সুন্দরী।

বাড়িতে কাজের লোক তিনজন। জবা, মুকুন্দ আর মালতী। জবা দুবেলা রান্না করে। ঘর ধোয়ামোছা, বাসনমাজা, কাপড় কাঁচা, বাজার করা, এমন ভারী ভারী কাজের দায়িত্ব মুকুন্দর। মালতী আয়া, সে সামুকে দেখাশোনা করে। তিনজনই খুব বিশ্বাসী।

জবা চা দিয়ে গেল। আলতো চুমুক দিতে দিতে টেবিল থেকে একটা কাগজ তুলে নিয়ে হেডলাইনগুলো দেখতে লাগল লাবণি।

হঠাৎ মোবাইলে বেজে উঠল। ছুটির দিন বলে রেহাই নেই। গন্ডা গন্ডা ফোন আসে। বেশিরভাগই অফিসের কলিগদের। যেহেতু লাবণি নিউজ ডিপার্টমেন্টের উঁচু পোস্টে আছে, রাজনৈতিক দলের তো বটেই, বিনোদন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের লোকজনও তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।

লাবণি মোবাইলের দিকে তাকাল। অচেনা একটা নাম্বার ফুটে উঠেছে। কে হতে পারে? ফোনটা তুলে নিয়ে হ্যালো বলতেই ভাঙা ভাঙা একটা গলা ভেসে এল–আমি কি লাবণি মজুমদারের সঙ্গে কথা বলছি? বয়স্ক কোনও মহিলার দুর্বল কণ্ঠস্বর।

আমিই লাবণি। আপনি কে বলছেন?

কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর শোনা গেল, আমি সরোজিনী। চিনতে পারছ মা? বলার ভঙ্গিতে কুণ্ঠা, দ্বিধা, হয়তো একটু আকুলতাও মেশানো।

নামটা শোনার পরও কিছুই পরিষ্কার হল না। কে সরোজিনী? লাবণি বলল, না, মানে, আপনাকে ঠিক

আমি সরোজিনী মল্লিক। লেক টাউনের

এবার মাথার ভেতরটা তোলপাড় হয়ে গেল লাবণির। অনেক আগেই মনে পড়া উচিত ছিল। কিন্তু যাদের জীবন থেকে চিরকালের মতো খারিজ করে দিয়েছে তাদের কেউ যে ফোন করতে পারে, ভাবা যায়নি। তা ছাড়া সরোজিনীর গলার স্বরটা আগের মতো নেই। মুখটা কঠিন হয়ে উঠল লাবণির। কঠিন গলায় বলল, হঠাৎ এতদিন পর আমাকে ফোন?

তুমি ছাড়া ফোন করার মতো আমার আর কেউ নেই লাবণি। কয়েকদিন ধরেই ভাবছিলাম, ফোনটা করব, কিন্তু সাহস হচ্ছিল না।

লাবণির মাথায় লেক টাউনের সেই বাড়িটার লোকজন সম্বন্ধে একসময় প্রবল ক্ষোভ, বিতৃষ্ণা এবং ক্রোধ জমা হয়ে ছিল। ধীরে ধীরে তার ঝাঁঝ কমেও এসেছিল। লেক টাউনের সেই মানুষগুলোর চেহারা ক্রমশ ঝাপসা হয়ে এসেছে। কিন্তু হঠাৎ সরোজিনীর ফোনটা আসার পর পুরোনো ক্ষোভ, রাগ স্মৃতির অতল স্তর ভেদ করে বেরিয়ে এসে যেন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিল। গলার স্বর উঁচুতে তুলে লাবণি বলল, অনেকদিন আগেই তো আপনাদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে। তা হলে আবার ফোন কেন? নতুন করে যোগাযোগ করার কী প্রয়োজন?

জানি, তুমি আমাদের বাড়িতে এসে শান্তিতে থাকতে পারোনি। চূড়ান্ত অপমানিত হয়েছ। তোমার ক্ষোভ, রাগ, এসব থাকা খুবই স্বাভাবিক। তবু একটা বিশেষ দরকারে ফোন করতে হল।

অরিজিৎ মল্লিক লাবণির প্রাক্তন স্বামী। লেক টাউনের বাড়িতে সে তাকে কম নির্যাতন করেনি। এই সরোজিনী মল্লিকও ছেলের সঙ্গে সমান তাল মিলিয়ে যেতেন। কিন্তু লাবণি অসভ্য, ইতর নয়। উম্মা যেটুকু প্রকাশ করার করেছে। নিজেকে এবার কিছুটা সামলে নিয়ে জিগ্যেস করল, আপনি আমার ফোন নম্বর পেলেন কীভাবে?

সরোজিনী বললেন, তোমাদের চ্যানেলে একজনকে দিয়ে ফোন করে জেনে নিয়েছি।

ও। তা দরকারের কথা যে বলছিলেন, সেটা কী?

তোমার সঙ্গে দেখা হলে বলব।

কী চান আপনি? ফের তিক্ত হয়ে উঠল লাবণিআমি লেক টাউনে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করব? একটা কথা স্পষ্ট শুনে রাখুন, যে বাড়ি থেকে একবার বেরিয়ে এসেছি সেখানে এ জন্মে আর কখনও যাব না।

না, না– সরোজিনী উতলা হয়ে উঠলেন। লেক টাউনে আমি আর থাকি না।

রীতিমতো অবাকই হল লাবণি। তা হলে কোথায় থাকেন?

 বছরখানেক হল বোড়ালের কাছে একটা বৃদ্ধাশ্রমে।

লাবণি চমকে উঠল-বৃদ্ধাশ্রম! মানে ওল্ড এজ হোম?

সরোজিনী মোটামুটি শিক্ষিতা। সেই আমলের ম্যাট্রিকুলেট। বললেন, হ্যাঁ।

লেক টাউন থেকে ওল্ড এজ হোম! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

তুমি ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। বলতে সাহস হয় না, তবু বলছি। পরশুর মধ্যে তুমি কি দয়া করে একবার হোমে আসতে পারবে? এলে সামনাসামনি বসে সব বলব। হোম থেকে আমাকে আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছে, পরশু পর্যন্ত ওখানে থাকতে পারব। তারপর এলে আমার সঙ্গে আর দেখা হবে না। বলে, একটু থেমে সরোজিনী ফের শুরু করলেন, তুমি যদি না আসো, একটা মারাত্মক অপরাধবোধ নিয়ে বাকি জীবনটা আমাকে রাস্তায় রাস্তায় কাটিয়ে দিতে হবে। তার শেষ কথাগুলো কাতর মিনতির মতো শোনাল।

যাবে কি যাবে না, ঠিক রতে পারছে না লাবণি। একদিন এই মহিলার কী না ছিল। লেক টাউনে তার স্বামীর মস্ত তেতলা বাড়ি, ব্যাঙ্কে লক্ষ লক্ষ টাকা, ছেলে অরিজিৎ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উঁচু পোস্টে। সেই তিনিই নাকি শেষ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে? তার সঙ্গে সরোজিনী যত দুর্ব্যবহারই করে থাকুন, এখন যেন একটু করুণাই হচ্ছে। সেই সঙ্গে কৌতূহলও। লাবণি মনস্থির করে ফেলে।–আচ্ছা যাব।

কবে মা?

আজই। আমাদের বাঁশদ্রোণীর বাড়ি থেকে বোড়াল খুব দুরে নয়। ঠিকানাটা দিন। ঘণ্টাখানেক ঘণ্টাদেড়েকের ভেতর পৌঁছে যাব।

সরোজিনী শুধু ঠিকানাই নয়, কীভাবে সেখানে যেতে হবে, সব বুঝিয়ে দিলেন।

ফোন অফ করে লাবণি জবাকে তাড়া দিল। জবাদি, আমাকে তাড়াতাড়ি দুটো টোস্ট আর ডিমের অমলেট করে দাও। সেই সঙ্গে আরেক কাপ চা। আমাকে এক্ষুনি বেরুতে হবে।

জবা কিচেনে খুটখাট, ঠুং ঠাং করে রান্নার তোড়জোড় করছিল। বলল, দিচ্ছি।

খাওয়া শেষ করে হাউসকোট ছেড়ে, শাড়ি-টাড়ি পরে, কিছু টাকা ব্যাগে পুরে বেরিয়ে পড়ল লাবণি। তাদের বাড়িটা প্রায় বড় রাস্তার ওপরে। সেখানে আসতেই একটা ফাঁকা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। কোথায় যেতে হবে, ট্যাক্সিওয়ালাকে জানাতেই গাড়িটা গড়িয়ার দিকে দৌড় শুরু করল।

কয়েক বছরের মধ্যে শহরের এই এলাকাটা আগাগোড়া বদলে গেছে। রাস্তার দুধারে আদ্যিকালের যেসব বাড়ি, ডোবা, পানাপুকুর, ঝোপঝাড় ছিল তার চিহ্নমাত্র নেই। লাইন দিয়ে এখন চোখধাঁধানো হাইরাইজ, আঁ-চকচকে কত যে শো-রুম, ব্যাঙ্ক, নানা ধরনের অফিস ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষজন বেড়ে গেছে বহুগুণ; তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রাইভেট কার, অটো, বাস, মিনি। পাশের টালির নালার ওপর দিয়ে অবিরল ছুটে চলেছে মেট্রো রেল।

জানলার বাইরে অন্যমনস্কর মতো তাকিয়ে আছে লাবণি। রাস্তায় গাড়ি-টাড়ি, লোকজনের ভিড়, কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছিল না। কী এক উজান টানে সে ন-দশ বছর আগের দিনগুলোতে ফিরে যাচ্ছিল।

.

বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে তখন তারা তিনজন। বাবা দেবনাথ মজুমদার, ছোট ভাই সোমু আর সে। যে তিনটি কাজের লোক এখন রয়েছে, তখনও তারাই ছিল। এর কিছুদিন আগে মায়ের মৃত্যু হয়েছে।

দেবনাথ রাজ্য সরকারের একটা ডিপার্টমেন্টের ছোটখাটো অফিসার। রিটায়ারমেন্টের তখনও দুতিন বছর বাকি।

লাবণি ছাত্রী হিসেবে যথেষ্ট ভালো মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক তিন-চারটে লেটার নিয়ে ফাস্ট ডিভিশন, একটা নামকরা কলেজ থেকে ইংরেজি অনার্স নিয়ে হাই সেকেন্ড ক্লাস। রেজাল্টগুলো উড়িয়ে দেবার মতো নয়।

দেবনাথের ইচ্ছা ছিল মেয়ে ইংরেজিতে এম.এ.-টা করে বি.এড-টাও করে নিক। তারপর স্কুল সার্ভিস কমিশনে বসুক। তুড়ি মেরে পাশ করে স্কুলের চাকরি পেয়ে যাবে। স্কুল টিচারদের মাইনে টাইনে খুবই ভালো। তা ছাড়া পার্মানেন্ট সার্ভিস। ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত। রিটায়ারমেন্টের পর পেনশন।

কিন্তু, তখন কি তারও আগে থেকে মিডিয়ার রমরমা শুরু হয়েছে। একদিকে নতুন নতুন কাগজ বেরুচ্ছে, অন্যদিকে টেলিভিশনে কিছুদিন পর পরই নতুন চ্যানেল খোলা হচ্ছে।

ইংরেজিতে অনার্স থাকলেও, বাংলাতেও লাবণির যথেষ্ট দখল। দুটো ভাষাতেই চমৎকার। কলেজে পড়তে পড়তেই সে স্বপ্ন দেখত সাংবাদিক হবে। দেবনাথ তা জানতেন। মেয়েকে বোঝাতেন কয়েকটা চ্যানেল আর চার-পাঁচটা বিখ্যাত কাগজ ছাড়া বাকিগুলো টিকে থাকবে কিনা সন্দেহ। লাবণি ভালো করে ভেবে দেখুক, কী করবে।

মিডিয়ার দুরন্ত মোহ, তাছাড়া লাবণির আত্মবিশ্বাসটা প্রচণ্ড। সে নিশ্চিত ছিল, প্রিন্ট মিডিয়া বা ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে সুযোগ পাবেই। খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা, অর্থ সবই হবে। স্কুল মাস্টারির ভ্যাদভেদে, একঘেয়ে জীবন তার আদৌ পছন্দ নয়। সে সোজা মাস-কমিউনিকেশনে কোর্স করতে ভর্তি হয়ে গেল। শুধু সে-ই নয়, তার কলেজের অনেক বন্ধু একই স্বপ্ন দেখত। যেমন রাঘব, নন্দিনী, গোপা, রণেন, সুব্রত এবং আরও কয়েকজন। তারই সঙ্গে ওরাও ভর্তি হল। এদের মধ্যে লাবণির সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হল রাঘব। ভারি সরল, অকপট, তার মধ্যে কোনওরকম নোংরামি নেই। মাথায় কোনও মতলব বা স্বার্থ নিয়ে সে কারও সঙ্গে মেশে না। বন্ধুদের কেউ, বিশেষ করে লাবণি ভালো কিছু করলে সেটা যেন তার নিজেরই সাফল্য।

হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর রাঘব আর সে আলাদা আলাদা স্কুল থেকে এসে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। তখনই আলাপ-পরিচয়, কয়েদিনের মধ্যে বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বটা দিনে দিনে আরও গাঢ় হয়েছে।

রাঘবদের বাড়ি টালিগঞ্জের চণ্ডীতলায়। সেখান থেকে বাঁশদ্রোণী আর কতদূর? অটোয় উঠলে মিনিট পনেরো কুড়ির মধ্যে পৌঁছনো যায়। রাঘব ছুটির দিনে প্রায়ই লাবণিদের বাড়ি চলে আসত। তার স্বভাবে এমন একটা আপন করা ব্যাপার আছে যে দেবনাথও তাকে খুব পছন্দ করতেন। রাঘব এলে খুশি হতেন।

মাস-কমিউনিকেশন সেশন শেষ হলে চ্যানেলে চ্যানেলে আর খবরের কাগজের অফিসগুলোতে হানা দেওয়া শুরু হল। মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত হলেও চাকরি জোটানো সম্ভব হচ্ছিল না। একমাত্র রণেনই নর্থ বেঙ্গলের একটা ছোট চ্যানেলে চাকরি পেল। বাকি সবাই কাজের চেষ্টায় ঘুরছে। নানা কাগজে টুকটাক এটা সেটা লিখে কিছু পয়সা পাচ্ছে।

রাঘব এসে একদিন খবর দিল একটা নামকরা বাংলা কাগজে আর একটা সর্বভারতীয় ইংরেজি ডেইলিতে চাকরি নয়, তবে ওদের ফরমাশমতো লিখলে আর সেই লেখা ওদের পছন্দ হলে ছাপবে। অবশ্য তারা নিজেরাও যদি চমকপ্রদ বিষয় খুঁজে নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে দেয়, ছাপা হবে। এর জন্য বেশ ভালো অঙ্কের টাকাও পাওয়া যাবে।

রাঘব লাবণিকে সঙ্গে করে দুটি কাগজের দুই বার্তা-সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করল। তারা কয়েকটা বিষয় জানিয়ে দিয়ে লেখা তৈরি করে আনতে বললেন।

মনে আছে লেখাগুলো খুব খেটেখুটে, সময় নিয়ে যত্ন করে, লিখে জমা দিয়ে এসেছিল লাবণিরা। তারপর একটা সপ্তাহ ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছে। লেখা ভালো না লাগলে নিশ্চয়ই নিউজ এডিটররা ছাপাবেন না। দুই কাগজের দরজা তাদের কাছে বন্ধ হয়ে যাবে।

সাতদিন পর দেখা গেল বাংলা ইংরেজি দুটো কাগজেই তাদের লেখা বেরিয়েছে। টেনশন থেকে পুরোপুরি মুক্ত। লাবণিরা দুই কাগজের অফিসে ছুটল। দুই বার্তা-সম্পাদক তাদের লেখার স্টাইল, ভাষা, প্রকাশভঙ্গির তারিফ করলেন–গুড।

সেই শুরু। তারপর বছরখানেক এভাবেই চলল। লাবণি আর রাঘবের লেখা সম্পর্কে বাংলা দৈনিকটির বার্তা-সম্পাদক অমলেশ সান্যালের ভালো ধারণা তো ছিলই, ওদের তিনি খুব পছন্দও করতেন। একদিন তিনি একটা সুখবর দিলেন। বছর দেড়েকের মধ্যে নিউজ ডিপার্টমেন্টের পাঁচজন সিনিয়র সাংবাদিক অবসর নিতে চলেছেন। তাঁদের শূন্যস্থানগুলি পূ রণ করার জন্য নতুন লোক নেওয়া হবে। তিনি কাগজের কর্তৃপক্ষকে লাবণি আর রাঘবের নাম সুপারিশ করলেন। ওদের চাকরি নিশ্চয়ই হয়ে যাবে।

কিন্তু কাগজের চাকরিটা করা হল না লাবণির। মিডিয়া ছিল তার পাখির চোখ। হঠাৎ এমন কিছু ঘটনা ঘটল যাতে আসল নিশানাটা বহুদূরে প্রায় মিলিয়ে গেল। জীবনটা তোলপাড় হতে হতে তাকে টেনে নিয়ে গেল অন্য এক দিকে, যার জন্য সে আদৌ প্রস্তুত ছিল না।

মাস কম-এ তাদের ব্যাচের নন্দিনীর দিদি মালিনীর সে বছর বিয়ে ঠিক হয়েছে। নন্দিনী বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে নেমন্তন্ন তত করলই, সেই সঙ্গে শাসিয়েও দিল, যে তার দিদির বিয়েতে যাবে না, ইহজীবনে সে তার মুখদর্শন করবে না।

হাজরা রোডে নন্দিনীদের বিরাট চারতলা বাড়ি। সামনের দিকে অনেকটা ফাঁকা জায়গা জুড়ে সামিয়ানা খাটানো হয়েছে। সেখানে নিমন্ত্রিতদের বসার ব্যবস্থা। মস্ত ছাদটা ঘিরে বিশাল প্যান্ডেল।

লাবণিরা ঠিক করেছিল, কয়েকটা গাড়ি ভাড়া করে বন্ধুরা একসঙ্গে বিয়ে বাড়িতে আসবে সন্ধের পর পর তারা এসেও গেল। নন্দিনীদের বাড়িটা অজস্র ফুল আর নানা রংয়ের আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। আকুল করা সুরে সানাই বেজেই চলেছে।

গিফট বক্স আর প্যাকেট-ট্যাকেট নিয়ে লাবণিরা গাড়িগুলো থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে সামিয়ানার কাছাকাছি চলে এসেছে, ছুটতে ছুটতে নন্দিনী এসে হাজির। হাসতে হাসতে বলল, তোরা এসেছিস! কী ভালো যে লাগছে! আয় আয়–

কলবল করতে করতে সবাই এগিয়ে চলল। নন্দিনী তাদের তেতলায় মস্ত এটা হলঘরে নিয়ে এল। এখানেও গেস্টদের বসার জন্য চমৎকার বন্দোবস্ত। বলল, বোস্ বোস্। কী দিতে বলব? কফি, কাবাব-টাবাব, না সরবত?

কেউ বলল না। বলল, ওসব পরে হবে। আগে দিদির কাছে নিয়ে চল–

তেতলারই একটা বিশাল ঘরের পুরো মেঝেটা দামি কার্পেট দিয়ে মোড়া। মাঝখানে ফুলের ঝালর দিয়ে সাজানো চাদোয়ার তলায় যে বসে আছে, সে যে মালিনী, দেখামাত্রই বোঝা যায়। পরনে মেরুন রংয়ের মহার্ঘ বেনারসি। তার গলা, কান, হাত, আঙুলের গয়নাগুলো থেকে হীরের ঝলক ঠিকরে ঠিকরে বেরুচ্ছে। তাকে ঘিরে ডজন ডজন কিশোর, তরুণী এবং কয়েকজন বয়স্ক মহিলা অবিরত কলর কর করে চলেছে। কোনও মজার কথায় একসঙ্গে সবাই গলা মিলিয়ে হেসে উঠছে। বিয়ের কনেকে ঘিরে যেমন হয় আর কী।

ঘরের চারপাশে ফ্লাওয়ারভাসের রজনীগন্ধা, গোলাপের তোড়া। ফুলে আর মেয়েদের পোশাক থেকে উঠে আসা পারফিউমের গন্ধে সারা ঘর ম-ম করছে।

মেয়েদের ভিড় সরিয়ে নন্দিনী সবান্ধবে মালিনীর কাছে চলে এল–দিদি, এরা আমার বন্ধু। একসঙ্গে মাসকম করেছি।

মিষ্টি হেসে মালিনী বলল, তোমরা এসেছ, খুব আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু আজ এমন একটা দিন যে জমিয়ে গল্প করব তার উপায় নেই।

সুধেন্দু বেশ হাসিখুশি, আমুদে ধরনের ছেলে। বলল, না, না, আজ আপনার এমন সময় নেই যে গল্প করবেন। দ্বিরাগমনে যখন আসবেন, নন্দিনী যদি আমাদের ইনভাইট করে জামাইবাবু আর আপনার সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দেব।

মালিনী ছোটবোনের দিকে তাকাল। এই ছুটকি, ওদের সেদিন কিন্তু আসতে বলবি।

নন্দিনীর ডাকনাম যে ছুটকি, সেই প্রথম জানল তার বন্ধুরা। ঠোঁট টিপে তার দিকে তাকিয়ে সবাই হাসতে লাগল।

এমন একটা বিদঘুটে ডাকনাম বন্ধুরা জেনে ফেলায় অস্বস্তি হচ্ছিল নন্দিনীর। কোনওরকমে একটু হাসল সে।

দিদি, হ্যাপি হ্যাপি হ্যাপি ম্যারেড লাইফ হই হই করে এই ধরনের শুভেচ্ছা জানিয়ে গিফটগুলো দিয়ে সুধেন্দু, গোপা, লাবণিরা হলঘরে ফিরে এল। সঙ্গে নন্দিনীও।

এদিকে হলঘর প্রায় ভরে গেছে। কয়েকটা বেয়ারা ট্রেতে কফি, চা, শরবত, কাবাব, চিকেন পাকোড়া, কাজু, পেস্তা ইত্যাদি নিয়ে ভিড়ের মধ্যে চক্কর দিচ্ছে। গেস্টরা যে যার ইচ্ছামতো কফি-টফি তুলে নিচ্ছে। লাবণিরাও নিল। খেতে খেতে লঘু মেজাজে গল্প চলছে।

গোপা নন্দিনীকে বলল, তুই এখানে বসে আড্ডা মারছিস কেন? দিদির বিয়ে, কাজ কর গিয়ে

তোদের অ্যাটেন্ড করাই আমার কাজ। অন্য কাজের জন্যে ডজন ডজন লোক আছে।

ঠিক আছে, মনপ্রাণ দিয়ে অ্যাটেন্ড কর।

আ যখন তুমুল হয়ে উঠেছে তখন কেউ ডেকে উঠল, ছুটকি—

দেখা গেল দোতলা থেকে প্রৌঢ়ত্বের শেষ সীমায় পৌঁছে যাওয়া একজন সুশ্রী মহিলা এবং একটি যুবক, বয়স তিরিশের নীচেই হবে, উঠে এল। যুবকটির পরনে ধাক্কাপাড় ধুতি, তসরের পাঞ্জাবি, হাতে বিদেশি রিস্টওয়াচ, পাঞ্জাবির বোতামগুলোতে হীরে বসানো। এমন সুন্দর মানুষ কচ্চিৎ কখনও চোখে পড়ে।

গোপা, সুধেন্দু, মঞ্জুশ্রীরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল।

এদিকে নন্দিনী প্রায় লাফিয়ে উঠেছে।–পিসি, অপুদা, তোমাদের তো সন্ধের আগে আসার কথা। এত দেরি করলে কেন?

মহিলা আর যুবকটির সঙ্গে নন্দিনীর কী সম্পর্ক, মোটামুটি বোঝা গেল।

অপু বলল, কী করে আসব? বেরিয়েছি পাঁচটায়। রাস্তায় যা জ্যাম ভাবতে পারবি না। ভিআইপি রোডে গাড়ি এত বেড়েছে যে নড়াচড়া করাই মুশকিল।

এদিকে বাবা আর মা মিনিমাম পঁচিশবার তোদের কথা জিগ্যেস করেছে।

মহিলা বললে, দাদা-বউদি কোথায় রে?

নন্দিনী বলল, দোতলায়। যেখানে বর আর বরযাত্রীরা এসে বসবে সেই জায়গাটা ঠিকমতো সাজানো হয়েছে কিনা, সার্ভে করতে গেছে।

মহিলা তার ছেলেকে বললেন, চল অপু, দাদা-বউদির কাছে যাই।

 অপু বলল, তুমি যাও। আমি পরে আসছি।

মহিলা চলে গেলেন। অপু রাঘব, সুধেন্দু, গোপালের দেখিয়ে বলল, এদের তো চিনতে পারলাম না।

নন্দিনী বলল, এরা আমার বন্ধু। একসঙ্গে আমরা জার্নালিজম মাস কমিউনিকশন পড়তাম।

আরে বাবা, একসঙ্গে আমি এত জার্নালিস্ট আগে আর কখনও দেখিনি।

সুধেন্দু বলল, পাশ করেছি, কিন্তু এখনও কেউ জার্নালিস্ট হইনি। হবার চেষ্টা করছি।

 লক্ষ্য করেছি এখানে বেশ আড্ডা চলছে। আমিও খুব আড্ডাবাজ। বসতে পারি?

সুদর্শন, ঝকঝকে, মিশুকে যুবকটিকে সবার ভালো লেগে গিয়েছিল। তারা হই হই করে উঠল–নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই

অপু বসে পড়ল। নন্দিনী বলল, অপুদা, আগে তোমাদের পরিচয়টা করিয়ে দিই

অপু বলল, দরকার নেই। ওটা আমি নিজেই করে নিচ্ছি। বলে সুধেন্দু, গোপা-টোপাদের দিকে তাকাল। –আমার ডাকনাম অপু। ভালো নাম অরিজিৎ মল্লিক। লেক টাউনে আমাদের ছোট একটা বাড়ি আছে, সেখানে আমার মা সরোজিনী মল্লিক আর আমি থাকি। একটা ছোট চাকরি করি। ব্যস–

নন্দিনী দুহাত নাড়তে নাড়তে চেঁচামেচি করতে লাগল। তোরা বিশ্বাস করিস না। লেক টাউনে অপুদাদের বিশাল তেতলা বাড়ি। ও আমেদাবাদের আইআইএম থেকে এমবিএকরেছে। ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির খুব বড় পোস্টে আছে।

এনাফ, এনাফ। এবার চুপ কর। নন্দিনীকে থামিয়ে দিয়ে একে একে সুধেন্দুদের নাম-টাম জেনে নিতে নিতে সবার শেষে লাবণির দিকে তাকাল।

লাবণি লক্ষ্য করেছে এতক্ষণ অন্য বন্ধুদের সঙ্গে অরিজিৎ কথা বলছিল ঠিকই, তবে বারবার তার চোখ এসে পড়ছিল তারই দিকে। সেই সময়ে লাবণি ছিল খুবই সুন্দরী, সপ্রতিভ। সে নিজেও কি অরিজিৎকে দেখছিল না?

অরিজিৎ হাসল, এবার আপনার কথা শুনি।

আমি লাবণি। আমাদের খুব সাধারণ মিড ক্লাস ফ্যামিলি। গলা উঁচু করে বলার মতো তেমন কিছুই নেই।

অরিজিৎ কয়েক লহমা তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে চোখ সরিয়ে নিল।

তারপর আজ্ঞা দারুণ জমে উঠল। কতরকম টপিক-পলিটিকস, ক্রিকেট, ফুটবল, সিনেমা, স্টেজ, আন-এমপ্লয়মেন্ট ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিজনেস ম্যানেজমেন্টের তুখোড় ছাত্র অরিজিৎ দেশের তো বটেই, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কত বিষয়েই যে জানে! বলার ভঙ্গিটাও চমৎকার। মুগ্ধ হয়ে শোনার মতো।

আচ্ছা যখন জমজমাট, সেইসময় কে এসে খবর দিল, ছুটকি, বর, বরযাত্রীরা কখন এসে গেছে। এখনি বিয়ে শুরু হবে। শিগগিরি বন্ধুদের নিয়ে আয়। বিয়ে দেখবি না!

বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে দোতলায়; ফুল-টুল দিয়ে সাজিয়ে একটা সামিয়ানার ভেতর। আড্ডায় সবাই এতটা মেতে ছিল যে কখন মালিনীকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কেউ খেয়াল করেনি। নন্দিনী প্রায় লাফিয়ে উঠে বন্ধুদের সঙ্গে অরিজিৎকে তাড়া দিতে দিতে দোতলায় নামিয়ে নিয়ে এল।

মুহুর্মুহু উলুধ্বনি, শাঁখের আওয়াজ আর পুরোহিতদের মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে বিয়ের কাজ চলছে। সামিয়ানার চারপাশ নানা বয়সের মেয়েদের ভিড়ে ঠাসা। চলছে তাদের কলকলানি, হাসাহাসি। পুরুষরা একটু দূরে থোকায় থোকায় দাঁড়িয়ে নানা রঙ্গকৌতুকে হেসে হেসে উঠছে।

নন্দিনীর মা-বাবা এখানেই ছিলেন। নন্দিনী তাদের সঙ্গে বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দিল। সবাই প্রণাম করতে যাচ্ছিল, নন্দিনীর বাবা হাত তুলে তাদের থামিয়ে দিয়ে হেসে হেসে বললেন, এতজনের প্রণাম নিতে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে। প্রণামগুলো ভোলা রইল, পরে একদিন হবে। ছুটকি, বিয়ে শেষ হতে মাঝরাত পেরিয়ে যাবে। তোর বন্ধুদের আগেই খাইয়ে দিস। ওদের তো বাড়ি ফিরতে হবে। লাবণিদের বললেন, এটা তোমাদের দিদির বিয়ে। আনন্দ করে খেয়ো। যার যেটা ইচ্ছে, চেয়ে নেবে কিন্তু

কিছুক্ষণ বিয়ের অনুষ্ঠান দেখার পর নন্দিনী বন্ধুদের নিয়ে ছাদে চলে এল। অরিজিৎও সঙ্গে এসেছে। বলল, আলাপ-পরিচয় হল। সবাই একসঙ্গে বসে গল্প করতে করতে খাওয়া যাবে। তাই এসে পড়লাম। আপত্তি নেই তো?

সবাই হই হই করে উঠল। একেবারেই না। আপনার কোম্পানি পাওয়া-ইটস আ প্লেজার।

লাবণি কিছু বলল না। নিঃশব্দে লক্ষ করতে লাগল।

ছাদের মস্ত প্যান্ডেলের বেশির ভাগটা জুড়ে টেবিল চেয়ার পেতে খাওয়ানোর ব্যবস্থা।

অন্য নিমন্ত্রিতদের মধ্যে অনেকেই এসে গেছে। প্যান্ডেলের এক ধারে মুখোমুখি লম্বা দুটো রো ফাঁকা রয়েছে। নন্দিনী বন্ধুদের সেখানে নিয়ে বসাল।

একটা রোয়ের শেষ দিকে বসেছে লাবণি। তার পর তিন চারটে খালি চেয়ার। আচমকা অরিজিৎ লাবণির ঠিক পাশের চেয়ারটায় এসে বসল।

অরিজিৎ কি লক্ষ রাখছিল তার পাশের চেয়ারটা কেউ দখল করেনি, তাই চটপট এসে বসে পড়ল। ওর মাথায় কি কোনও মতলব ঘুরছে? মনটা কেমন ঘোলাটে হয়ে গেল। সেই সঙ্গে একটু অস্বস্তিও হচ্ছে। আবার অল্প অল্প ভালোও লাগছে। কেন লাগছে লাবণি বলতে পারবে না।

গলা অনেকটা নামিয়ে অরিজিৎ বলল, তেতলার হলঘরে, আমরা সবাই যখন হইচই করে আড্ডা দিচ্ছিলাম, আপনি কিন্তু দুচারটের বেশি কথা বলেননি।

এটাও আপনার নজরে পড়েছে?

পড়বে না? মেয়েটা তত বেশি কথা বলে। আপনি একেবারে চুপচাপ।

আমার শুনতে বেশি ভালো লাগে।

 ইউ আর ভেরি স্পেশ্যাল।

আপনার সঙ্গে যখন পরিচয় হল, তখনই কিন্তু জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি মিডল ক্লাস ফ্যামিলির সামান্য একটি মেয়ে।

কে সামান্য, কে অসামান্য, মুখ দেখে খানিকটা বুঝতে পারি।

 ও বাবা, আপনার এই গুণটাও আছে।

অরিজিৎ হাসল।

কেটারারের উর্দিপরা বেয়ারারা খাবার এনে প্লেটে প্লেটে দিয়ে যেতে লাগল। দুই রোয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নন্দিনী অনবরত বলতে লাগল, একে ফ্রাই দাও, ওর পাত খালি, পোলাও আর কোর্মা নিয়ে এসো ইত্যাদি।

হই হই করে খাওয়া দাওয়া চলছে। খেতে খেতে অরিজিৎ অন্য সবার সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে, আবার কণ্ঠস্বর নামিয়ে লাবণির সঙ্গে দু-একটা কথা বলছে।

খাওয়া শেষ হলে সবাই নীচে নেমে এল। তখনও বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়নি। নন্দিনীর মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে লাবণিরা সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে বাইরের রাস্তায় চলে এল। যে সাতটা গাড়ি ভাড়া করে তারা এসেছিল সেগুলো লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এগুলোই তাদের সবাইকে বাড়ি পৌঁছে দেবে।

নন্দিনী বন্ধুদের রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছিল। সঙ্গে অরিজিৎ এসেছে। সবাই যখন একে একে গাড়িতে উঠছে, সেই ফাঁকে অরিজিৎ লাবণিকে বলল, আবার কবে দেখা হবে?

লাবণি স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। এইরকম কোনও অনুষ্ঠানে আপনাকে আর আমাকে যদি ইনভাইট করা হয় দেখা হলেও হতে পারে। তবে তার সম্ভাবনা অ্যাট অল আছে বলে মনে হয় না। বলেই গাড়িতে উঠে গেল।

.

 বাড়ি ফিরে শুতে শুতে বারোটা বেজে গেল। কিন্তু ঘুম আসছে না। বারবার অরিজিতের মুখটা মনে পড়ছে। এত সুপুরুষ, ম্যানেজমেন্টে চোখ-ধাঁধানো রেজাল্ট, দুর্দান্ত কেরিয়ার, পয়সাওয়ালা বাড়ির একমাত্র ছেলে। সবে তো সেদিনই আলাপ হয়েছে। দু-চারটের বেশি কথা হয়নি। তার সম্বন্ধে অরিজিতের এত আগ্রহ কেন? উটকো চিন্তাটা মাথা থেকে জোর করে বের করে দিতে সময় লাগল লাবণির। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন ঘুম ভাঙল বেশ বেলায়। মুখ-টুখ ধুয়ে চা খেয়ে লেখার টেবিলে গিয়ে বসল লাবণি। বাংলা কাগজের অমলেশদা আর ইংরেজি ডেইলির নিউজ এডিটর বিজয়দা অর্থাৎ বিজয় পালিত তাদর দুই কাগজের জন্য দুটো টপিক দিয়েছেন। লেখা দুটো চার কি পাঁচদিনের ভেতর দিতে হবে।

আগে থেকেই ঠিক করা আছে, বাংলা কাগজের লেখাটা প্রথমে শেষ করে ইংরেজি কাগজেরটায় হাত দেবে।

কাগজ-কলম-টলম টেবিলের ড্রয়ার থেকে বের করে মনে মনে লেখাটা শুরু থেকে শেষ অবধি মোটামুটি সাজিয়ে নিয়ে শুরু করতে যাবে, দেবনাথ দরজার বাইরে থেকে বললেন, বেরুচ্ছি রে। পৌনে দশটা বাজে। আজ অফিসে নির্ঘাত লেট। কাল রাত্তিরে তুই তখন বিয়েবাড়িতে, সোমুটার জ্বর এসেছিল। মালতী আছে, তবু তুই দু-একবার গিয়ে ছেলেটাকে দেখে আসিস।

আসব, আসব। তুমি ভেবো না।

দেবনাথ চলে গেলেন।

তারপর মাত্র দশ-বারো লাইন লিখেছে লাবণি, হঠাৎ রাঘবের ফোন-কাল নন্দিনীদের বাড়ি থেকে এত রাত্তিরে ফেরা হয়েছে। এখনও বিছানায় চিতপাত হয়ে পড়ে আছিস নাকি!

লাবণি বলল, না রে না, উঠে পড়েছি।

অমলেশদা খুব ভালো মানুষ, সিমপ্যাথেটিক, কিন্তু সময়মতো লেখা না দিলে ফায়ার হয়ে যান। তোর আর আমার লেখা পরশুদিন দিতে হবে। মনে থাকে যেন।

রাঘবের মতো বন্ধু হয় না। লাবণি বলল, সেই লেখাটা নিয়েই তো বলছি।

গুড ছাড়ছি।

আরও কয়েক লাইন লেখার পর আবার ফোন। এবার নন্দিনী। রীতিমতো অবাকই হল লাবণি। কী রে, বিয়েবাড়িতে এত ব্যস্ততা, তার মধ্যে হঠাৎ ফোন করলি? এনিথিং আর্জেন্ট?

নন্দিনী বলল, কাল খেতে বসে ফিসফিস করে কী বলছিল রে অপুদা?

তুই লক্ষ করেছিস?

আমি একা কেন, আরও কেউ কেউ দেখেছে।

অরিজিৎ যা যা বলেছে, সব জানিয়ে দিল লাবণি।

নন্দিনী বলল, তোকে একটা ব্যাপার জানানো দরকার। অপুদার মা আমার আপন পিসি নয়। আমাদের সঙ্গে লতায় পাতায় সম্পর্ক। তবে ঘনিষ্ঠতা আছে। আমাদের বাড়ির সব ফাংশনে ওরা আসে, ওদের বাড়ির ফাংশনে আমরা যাই। অপুদার সব ভালো, তবে সুন্দরী মেয়ে দেখলে কাত হয়ে পড়ে। এটা ওর ডিজিজ। বলেই লাইনটা কেটে দিল।

কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে লাবণি। তারপর ফের লিখতে লাগল। কাল রাত্তিরেই তো অরিজিতের চিন্তাটা খারিজ করে দিয়েছে। এ নিয়ে আর ভাবাভাবির প্রয়োজন নেই।

.

মালিনীর বিয়ের পর দশ-বারোটা দিন কেটে গেছে। দুপুরবেলা ড্রইংরুমে ডিভানে কাত হয়ে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল লাবণি, ল্যান্ড লাইনের ফোনটা বেজে উঠল। অন্যমনস্কর মতো সেটা তুলে হ্যালো বলতেই ওধার থেকে চেনা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন। চমকে উঠে বসল সে-আপনি। আমার ফোন নাম্বার পেলেন কী করে?

ওটা পাওয়া কি খুব কঠিন।

কতটা সহজ?

আপনি যে কাগজ দুটোয় লেখেন, সেই দুটোতেই আমার জানাশোনা কেউ কেউ কাজ করে। লেখার সঙ্গে ফোন নাম্বার, অ্যাড্রেস দিয়েছেন। এটাই নাকি নিয়ম। বুঝতেই পারছেন তাদের কারও কাছ থেকে দুটোই জেনে নিয়েছি। সে যাক আমার ইচ্ছে আপনার সঙ্গে একদিন দেখা হোক। যদি বলেন, ভালো কোনও রেস্তোরাঁয় টেবল বুক করি।

মুখটা কঠিন হয়ে উঠল লাবণির।অরিজিত্ত্বাবু, অনেক মিডল ক্লাস ফ্যামিলির ভ্যালুজ নষ্ট হয়ে গেছে; তারা বদলে গেছে। আমরা কিন্তু পুরোনো ভ্যালুগুলো ধরেই আছি। বার-কাম-রেস্তোরাঁয় কোনওদিনই যেতে পারব না।

না না, যে রেস্তোরাঁর কথা বলছি, সেখানে বার নেই।

না থাক। আমি যাকে একবার মাত্র দেখেছি, তার সঙ্গে রেস্তোরাঁয় যাব? ভাবলেন কী করে?

এক্সট্রিমলি সরি। ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করবেন। তা হলে আপনি যেখানে কমফর্ট ফিল করবেন সেখানেই আমাদের দেখা হবে।

.

মনে আছে, এক বৃহস্পতিবার ফোন করেছিল অরিজিৎ। তার ঠিক দুদিন বাদে রবিবার বিকেলে সে তাদের বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে এসে হাজির। বিতৃষ্ণায়, রাগে, গা রি-রি করে উঠেছে লাবণির। ভেবেছিল ঘাড় ধরে বের করে দেয়। কিন্তু পারা যায়নি। বাবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে হয়েছে। চা-মিষ্টি খেতে খেতে সে বাবার সঙ্গে ফুরফুরে মেজাজে গল্প করেছে। সোমুর ঘরে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে হেসে কথা বলেছে। যাবার সময় বাবার কানে যাতে না যায়, তাই গলা নামিয়ে বলে গিয়েছিল, বলেছিলাম দেখা করব, করলাম তো—

অরিজিৎকে, দেবনাথের খুব ভালো লেগেছে। সে চলে যাবার পর তিনি বললেন, ছেলেটা চমৎকার। কী সুন্দর ব্যবহার।

সেই শুরু। তারপর ছুটির দিনে তো বটেই, সপ্তাহের অন্য দিনেও সন্ধের পর আসতে লাগল অরিজিৎ। দেবনাথের সঙ্গেই গল্প করত বেশি।

প্রথম প্রথম তাকে দেখলে মুখচোখ শক্ত হয়ে উঠত লাবণির। কোন উদ্দেশ্য মাথায় পুরে সে লেক টাউন থেকে বাঁশদ্ৰোণীতে আসত তাই নিয়ে যথেষ্ট ধন্দ ছিল তার। কবে থেকে সংশয়, অস্বস্তি, বিরক্তি কেটে যাচ্ছিল খেয়াল নেই।

দেবনাথকে জানিয়ে দু-চারদিন লাবণিকে নিয়ে বেড়াতেও বেরিয়েছে অরিজিৎ। লাবণি খুব একটা আপত্তি করেনি। মনে হচ্ছিল অরিজিৎকে বিশ্বাস করা যায়। বাইরে বেরুলে কোনও দিনই বড় হোটেলে বা রেস্তোরাঁয় তাকে নিয়ে যায়নি। রাস্তার ধারে খুব সাধারণ চায়ের দোকানে ঢুকে চা টোস্ট কি অন্য কিছু খেত।

ততদিনে তারা একজন আরেকজনকে তুমি করে বলতে শুরু করেছে। চা-টা খেতে খেতে মজা করে লাবণি বলল, তোমরা তো সোসাইটির উঁচু স্তরের মানুষ। হঠাৎ মিডল ক্লাসের লেভেলে নেমে আসতে চাইছ যে

অরিজিৎ হাসত, উত্তর দিত না।

এদিকে আগের মতো আর লেখালেখিতে লাবণির তেমন মন নেই। লেখার জন্য তথ্য জোগাড় করতে কত জায়গায় ছুটত, ন্যাশনাল লাইব্রেরি ছাড়াও কলকাতার অন্য অনেক পুরোনো গ্রন্থাগারে গিয়েও বই ঘাঁটাঘাঁটি করত। অরিজিৎ তাদের বাড়িতে সেই যে প্রথম এসেছিল তার কিছুদিন পর থেকে লেখার উৎসাহ বা উদ্যম যেন কমে আসছিল। কাগজের অফিসগুলোতেও আগের মতো ততটা যেত না।

রাঘব ফোনে, কখনও কখনও লাবণিদের বাড়িতে এসে রাগারাগি করত।–দ্যাখ, আমাদের চাকরির সুযোগ এসে গেছে। অমলেশদার কথামতো লেখালেখিটা যদি সিরিয়াসলি না করিস তোর ওপর তার ইমপ্রেশনটা কী হবে? ওদিকে বিজয়দাও আমি গেলে তোর কথা জিগ্যেস করেন। সুযোগ কিন্তু বার বার আসে না।

রাঘব যে তার এত প্রিয় বন্ধু, এত হিতাকাঙ্ক্ষী, অরিজিৎ যে তাদের বাড়ি আসে, এ খবরটা তখনও তাকে দেয়নি লাবণি। রাঘবের তাড়ায় মাঝে মাঝে কাগজের অফিস দুটোতে যেত সে; অমলেশ বা বিজয়ের ফরমাশ মতো দু-একটা লেখা লিখে দিত।

এইভাবেই চলছিল। হঠাৎ একদিন রাত্তিরে খাওয়া দাওয়ার পর দেবনাথ তার ঘরে এলেন। একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন, তোর সঙ্গে দরকারি কথা আছে খুকু

লাবণি উৎসুক চোখে তাকিয়েছে। কী কথা বাবা?

অরিজিৎকে তো বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি। বেশ ভদ্র, ভালো ছেলে। উচ্চশিক্ষিত, লাইফে এস্টাব্লিশড। অরিজিৎ আমার কাছে একটা প্রোপোজাল দিয়েছে।

কীসের পোপোজাল?

 ও তোকে বিয়ে করতে চায়।

কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর লাবণি বলল, একটা কথা ভেবে দেখেছ বাবা?

কী?

তোমার বয়স হয়েছে। রিটায়ারমেন্টের আর দু-তিন বছর বাকি। মানুষ তো অমর নয়। আমি খারাপের দিকটা ভাবছি। ধরো আমার বিয়েটা হল আর হঠাৎ তোমার কিছু হয়ে গেল, সসামুর তখন কী হবে, কে তাকে দেখবে?

অরিজিতের সঙ্গে সে সব কথাও আমার হয়েছে। আমার কিছু হলে সে সোমুর দায়িত্ব নেবে।

বাবার সঙ্গে অরিজিতের এত সব কথা হয়েছে, আগে জানতে পারেনি লাবণি। সে চুপ করে থাকে। আগের মতো সংশয়, কাঠিন্য না থাকলেও অরিজিৎ সম্পর্কে বরাবর একটা দ্বিধা থেকে গেছে তার। সে তাদের বাড়ি আসে, তার সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়েছে। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু বিয়ে? বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সুন্দরী মেয়ের কি খুবই অভাব? অরিজিৎ আঙুল তুলে একটু ইশারা করলে লাবণির চেয়ে অনেক বেশি রূপসি, অনেক বেশি বিদুষী, অভিজাত পরিবারের মেয়েদের বাবারা তাদের লেক টাউনের বাড়ির সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে যেত। লাবণির মতো সাদামাটা, মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ের মধ্যে কী পেয়েছে অরিজিৎ? এই ধন্দটা কিছুতেই পুরোপুরি কাটছে না।

দেবনাথ বললেন, কী রে, কিছু বলছিস না যে!

আমাকে কদিন ভাবতে দাও।

শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয়েই গেল। বিয়ের অনুষ্ঠানটা লাবণি আর অরিজিতের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনরা হইহই করে মাতিয়ে দিল। শুধু দুজন বাদ! রাঘব আর নন্দিনী। রাঘব বলেছে, আর কদিন ওয়েট করলে চাকরিটা হয়ে যেত। চাকরি হলে পায়ের তলায় শক্ত জমি পাওয়া যায়। সেটা একটা বড় শক্তি। নন্দিনী বলেছে, অপুদাকে বিয়ে করলি। দেখা যাক সে হয়তো কোনও ইঙ্গিত দিয়ে চেয়েছিল, লাবণি শুনেও শোনেনি।

.

বিয়ের পর অরিজিতদের লেক টাউনের বিশাল বাড়িতে চলে এল লাবণি। প্রথম দিকে সরোজিনী ভালোই ব্যবহার করতেন, হেসে হেসে কথা বলতেন। মুখ কাঁচুমাচু করে অরিজিৎ একদিন বলেছে, দেখো, আমার যে টাইপের কাজ তাতে প্রায়ই পার্টিতে যেতে হয়। অনেককে সঙ্গ দিতে ড্রিংকও করতে হয়। দ্যাটস আ পার্ট অফ মাই জব। তুমি তো আবার পিউরিটান। রাগ করবে না তো?

লাবণি বলেছে, বাইরে যা খুশি করতে পারো। বাড়িতে এসে মাতলামি না করলেই হল। আরেকটা কথা। আমার বন্ধু রাঘবকে চেনো তো?

চিনি। তোমাদের সঙ্গেই তো মাস-কম করেছে। হঠাৎ তার কথা উঠছে কেন?

ওর মতো ছেলে হয় না। আমরা একসঙ্গে লেখালেখি শুরু করেছিলাম। আমার ধারণা, ও এখানে চলে আসতে পারে। ও চায় আমি লেখাটা যেন না ছাড়ি। সেজন্য তাড়া দিতে আসবে।

আসুক না। নো প্রবলেম

লেক টাউনে এসে যেন স্বপ্নের উড়ানে উঠে পড়েছিল লাবণি। জীবনটা মসৃণভাবেই কেটে যাচ্ছিল।

সত্যিই রাঘব কোনও কোনও দিন চলে আসত। বাংলা দৈনিকে তার চাকরি হয়ে গেছে। বলত, অমলেশদা তোর জন্যে একটা পোস্ট খালি রেখেছে। তুই গেলেই চাকরিটা হয়ে যাবে।

লাবণি বলত, চাকরি আমি করব না।

তাহলে লেখালেখিই কর। এত ভালো লিখিস। ওটা ছাড়িস না।

তাড়া দিয়ে দিয়ে চিৎ কখনও লাবণির কাছ থেকে দু-একটা লেখা আদায় করত রাঘব।

এর মধ্যে প্রায়ই উড়ো চিঠি আর অচেনা কারও ফোন আসত–যাকে বিয়ে করেছেন সেই লোকটা বদ, দুশ্চরিত্র। অনেক মেয়ের ক্ষতি করেছে। সাবধান

লাবণি পাত্তা দিত না। অরিজিতের কথাবার্তায় আচরণে এমন কিছুই পাওয়া যায়নি যা আপত্তিকর।

এইভাবেই চলছিল। হঠাৎ অরিজিৎ যেন বদলে যেতে লাগল। কোনও কোনও দিন তার ফিরতে মাঝরাত পেরিয়ে যায়। দু-একদিন ফেরেই না, জিগ্যেস করলে যা জবাব দেয় সেগুলো বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ নিয়ে বেশি বললে খেপে যায়। লাবণি টের পায়, লেক টাউনে আসার পর দিনগুলো যেভাবে কাটছিল তেমনটা আর নেই। সবসময় দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ। সরোজিনীকে বললে তিনি ঝাঁঝিয়ে ওঠেন–আমাকে এসব বোলো না। কেন আমার ছেলের নামে বদনাম করছ?

লাবণি হতবাক হয়ে যায়।

একদিন অরিজিতের অফিসের একটি জুনিয়র একজিকিউটিভ, নাম তরুণ সেন, লাবণিকে ফোন করল–ম্যাডাম অফিসের বাইরে একটা প্রাইভেট বুথ থেকে ফোন করছি। আপনাকে একটা খবর দিতে চাই, আমার নামটা জানাজানি হলে ভীষণ বিপদে পড়ব।

তরুণকে ভালোই চেনে লাবণি। অফিসের কাজে অরিজিতের কাছে লেক টাউনের বাড়িতে অনেকবার এসেছে। খুবই ভদ্র, বিনয়ী। লাবণি বলল, কেউ জানবে না, আপনি বলুন। খুব টেনশন চলছিল। সে কোনও দুঃসংবাদের জন্য আপেক্ষা করতে লাগল।

তরুণ যা জানাল তা এইরকম। তাদের অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের একজন জুনিয়র অফিসার, নাম কল্পনা মীরচন্দানির সঙ্গে অরিজিৎ জড়িয়ে পড়েছে। দু-একদিনের মধ্যে সপ্তাহখানেকের জন্য তারা মুম্বই যাবে। এই নিয়ে অফিসে সবাই ছি-ছি করছে। আগেও এরকম অন্য মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন স্যার। আপনাকে সাবধান করে দিলাম।

ফোনটা অফ করে বাকি দিনটা উদ্ভ্রান্তের মতো কাটিয়ে দিল লাবণি। রাত্তিরে অরিজিৎ ফিলে এলে খাওয়া-দাওয়ার পর তাকে জিগ্যেস করল, কল্পনা মীরচন্দানি কে?

অরিজিৎ চমকে উঠল। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল, দ্যাটস নান অফ ইওর বিজনেস। এ নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।

হবে। কারণ আমি তোমার স্ত্রী।

স্ত্রী! একটা থার্ড ক্লাস মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মেয়েকে করুণা করে বিয়ে করেছিলাম। আর কোনও কথা বলবে না।

একটা মানুষের রাতারাতি এমন পরিবর্তন ঘটতে পারে, ভাবাই যায় না। লাবণি বলল, আমি কি তোমার করুণা চাইতে এসেছিলাম?

স্টপ ইট।

এরপর শুরু হল অশান্তি, তিক্ততা, চিৎকার-চেঁচামেচি, নোংরা নোংরা গালাগাল, লাবণির ওপর তীব্র মানসিক নির্যাতন। আশ্চর্য, ছেলের সঙ্গে তার মা সরোজিনী মল্লিকও গলা মেলালেন।

জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। একদিন লাবণি বলল, এই নরককুণ্ডে আমার আর এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করে না।

অরিজিৎ খেপে ওঠেনি। শান্ত গলায় বলল, ভেরি গুড় ডিসিশন। চলল, কালই আমরা কোর্টে গিয়ে সেপারেশনের জন্যে একসঙ্গে অ্যাপিল করি। ব্যাপারটা পিসফুলি মিটে যাবে।

অত সহজে তোমাকে ডিভোর্স দেব না।

 কী চাও—টাকা? বলো, কত দিতে হবে।

টাকা দিয়ে তুমি ডিভোর্স কিনতে পারবে না। তোমাকে আমি একটা শিক্ষা দিতে চাই।

লেক টাউন থেকে বাঁশদ্ৰোণীতে বাবার কাছে চলে এল লাবণি।

মানুষ যে কত নীচের স্তরে নামতে পারে অরিজিতরা এবার দেখিয়ে দিল। ওরা ডিভোর্সের মামলা করল। বিবাহ-বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে লাবণির ব্যাভিচারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। রাঘব যে লেক টাউনে লাবণিকে লেখাটেখার জন্য তাড়া দিতে যেত সেটা ওরা কাজে লাগিয়েছে।

সরোজিনী মল্লিক আদালতে দাঁড়িয়ে হলফ করে বলেছেন, অরিজিৎ যখন বাড়িতে থাকত, দুপুরের দিকে প্রায়ই রাঘব আসত। অতবড় বাড়িতে তিনি তখন তার ঘরে ঘুমোচ্ছেন। কোনও কোনও দিন ঘুম না এলে এধারে-ওধারে হয়তো ঘুরছেন, হঠাৎ রাঘবের সঙ্গে লাবণিকে জঘন্য আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পেতেন। বকাবকি করেও ছেলের বউকে তিনি শোধরাতে পারেননি। অগত্যা ছেলেকে জানাতে হয়েছে, ইত্যাদি।

স্তম্ভিত হয়ে গেছে লাবণি। একজন ভদ্র বংশের বয়স্ক মহিলা শপথ নিয়ে কোর্টে মিথ্যা বলতে পারেন, ভাবা যায় না।

এই মামলা নিয়ে চারিদিকে এত কুৎসা রটেছিল যে কারও মুখের দিকে তাকানো যেত না। আদালতে যখন লাবণিকে তলব করা হত, তার মনে হত আগুনের বলয়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত ডিভোর্সটা হয়ে গেল।

তারপর অনেকদিন লাবণি বাড়ি থেকে বেরুত না। মুহ্যমানের মতো নিজের ঘরে বসে বা শুয়ে থাকত। খেতে চাইত না, ঘুমোত না। যে অভিযোগে বিবাহ-বিচ্ছেদটা হয়েছে সেটা তাকে এমন আঘাত দিয়েছে যে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কেনই বা অরিজিৎ তাকে বিয়েটা করল, আবার কেনই বা দুটো বছর পেরুতে না পেরুতে অন্য একটা মেয়ের জন্য রাঘবের মতো সরল ভালোমানুষকে তার সঙ্গে জড়িয়ে নোংরা খেলাটা খেলল সেই রহস্যের তলকূল পাওয়া যাচ্ছিল না। তার সঙ্গে বিয়েটা যে হয়েছিল তা কি অরিজিতের ক্ষণিকের মোহে?

সেই দুঃসময়ে পাশে থেকেছেন বাবা আর রাঘব। রাঘবের গায়ে তার জন্য তো কম পাক লাগেনি; তবু সে সময় পেলেই বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে চলে আসত। দুজনে তাকে বোঝাত, এত ভেঙে পড়লে চলবে না। আবার উঠে দাঁড়াতে হবে।

সময় এক আশ্চর্য জাদুকর। সব দাহ ধীরে ধীরে জুড়িয়ে দেয়। বুকের সেই দগদগে ক্ষতটা একদিন শুকিয়েও গেল।

সাতরং চ্যানেলের অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ রয়েছে রাঘবের। সে-ই তাদের ধরাধরি করে ওদের নিউজ ডিপার্টমেন্টে লাবণির চাকরির ব্যবস্থা করে। কয়েক বছর পর সে এখন সেখানকার ডেপুটি নিউজ এডিটর। দেবনাথ মারা গেছেন। বাড়িতে এখন সে আর সোমু এবং তিনটি কাজের লোক।

.

কতক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে ছিল খেয়াল নেই। হঠাৎ ট্যাক্সিটা বেশ ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। সেইসঙ্গে চালকের কণ্ঠস্বর কানে এল–দিদি, আমরা পৌঁছে গেছি। স্মৃতির অতল স্তর থেকে উঠে এল লাবণি। চোখে পড়ল সামনেই একটা বড় গেট, তার মাথায় আধখানা বৃত্তের আকারের সাইনবোর্ডে বড় বড় হরফে লেখা ও সেবা নিকেতন। গেটের পর সবুজ ঘাসের একটা লন পেরুলে হলুদ রংয়ের মস্ত চারতলা বিল্ডিং।

ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া-টাড়া মিটিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল লাবণি। একটা উঁচু টুলের ওপর দারোয়ান বসে ছিল। তাকে কিছু জিগ্যেস করতে যাবে, বাঁ-দিক থেকে একজন বৃদ্ধা এগিয়ে এলেন-এসো মা। তোমার জন্যে আমি এখানে অপেক্ষা করছিলাম।

চমকে উঠল লাবণি। একসময় কী স্বাস্থ্য ছিল সরোজিনীর; এখন আর চেনাই যায় না। গাল বসে গেছে, পুরু লেন্সের চশমার ওধারে চোখ দুটো কোটরে ঢোকানো, কণ্ঠার হাড়, শীর্ণ হাতের শিরাগুলো বড় বেশি প্রকট। সারা শরীর জুড়ে ভাঙচুরের চিহ্ন। যে সরোজিনী মল্লিককে সে লেক টাউনে দেখে এসেছিল ইনি যেন তাঁর ধ্বংসস্তূপ।

সবুজ লনটা পেরিয়ে দুজনে মেইন বিল্ডিংয়ে ঢুকল। তারপর বাঁদিকের প্রশস্ত করিডর দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে ডান পাশে একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন সরোজিনী। দরজায় পর্দা ঝুলছে। সেটার একপাশে কাঠের ফলকে ইংরেজিতে লেখা : অফিস। অন্য দিকে কাঠের ফলক। তাতে লেখা : ইন্দুমতী ব্যানার্জি, সুপারিনটেন্ডেন্ট।

পর্দাটা একধারে ঠেলে দেয় সরোজিনী। ভেতরে একটা গদি-আঁটা মস্ত চেয়ারে বসে আছেন বিপুল আকারের একজন মধ্যবয়সিনী। বোঝা গেল ইনিই ইন্দুমতী। তাঁর সামনে বড় টেবিল; টেবিলের এধারে কয়েকজন মহিলা বসে আছেন। ঘরের দেওয়ালগুলো জুড়ে ঢাউস ঢাউস স্টিলের আলমারি।

ইন্দুমতী সরোজিনীকে দেখতে পেয়েছিলেন। জিগ্যেস করলেন, কিছু দরকার আছে?

সরোজিনী বললেন, আমার একজন গেস্ট এসেছে। মেয়ের মতো। তাকে আমার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি।

ঠিক আছে।

বোঝা গেল, সুপারিনটেন্ডেন্টের অনুমতি ছাড়া এখানকার আবাসিকরা বাইরের কাউকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে পারে না।

কাছেই সিঁড়ি। সরোজিনী লাবণিকে সঙ্গে করে দোতলায় একটি ঘরে চলে এলেন। একজনের পক্ষে ঘরটা বেশ ভালোই। একধারে সিঙ্গল-বেড খাট, ছোটখাটো একটা আলমারি, এক দেওয়ালে টিভি আটকানো, ব্র্যাকেটে কিছু শাড়ি, নাইটি-টাইটি। তাছাড়া দু-তিনটে চেয়ার, একটা মাঝারি টেবিল, ইত্যাদি।

লাবণিকে একটা চেয়ারে বসিয়ে নিজে বিছানায় বসলেন সরোজিনী।

লাবণি বলল, আমি কিন্তু বেশিক্ষণ বসতে পারব না।

 সরোজিনী বললেন, জানি তুমি খুব ব্যস্ত মানুষ। আধঘণ্টার বেশি আটকে রাখব না।

লাবণি নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগল।

সরোজিনী বললেন, তোমার সঙ্গে আমি অনেক দুব্যবহার করেছি। বিশ্বাস করি তুমি সৎ, নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের মেয়ে। তোমার বন্ধু রাঘবও তাই। তবু আদালতে হলফ করে মিথ্যে বলেছি। গ্লানি আর অপরাধবোধে কতদিন যে ঘুমোতে পারিনি! তোমাদের দুজনের কাছে। আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

লাবণি উত্তর দিল না।

সরোজিনী থামেননি–কেন আমাকে এই পাপটা করতে হয়েছিল, কেন জানো? গর্ভে আমি একটা অমানুষ, জন্তুকে ধারণ করেছিলাম। তার চাপে, তার ভয়ে আমাকে এটা করতে হয়েছিল। কত মেয়ের যে ও ক্ষতি করেছে- তার গলা প্রায় বুজে এল।

অনুশোচনায় জর্জরিত বৃদ্ধাকে দেখতে দেখতে যে নিস্পৃহতা আর কাঠিন্য নিয়ে লাবণি এখানে এসেছিল সেসব ততটা তীব্র আর রইল না। নরম গলায় বলল, শান্ত হন, যা হবার তা তো হয়েই গেছে।

তুমি আমাকে ক্ষমা করলে কিনা–সরোজিনী ব্যাকুল হয়ে উঠলেন।

যা চুকেবুকে গেছে তা নিয়ে আমি আর ভাবি না। আপনি এ নিয়ে আর কষ্ট পাবেন না।

অনেকক্ষণ নীরবতা।

 তারপর লাবণি বলল, একটা কথা জিগ্যেস করব?

করো, করো

লেক টাউনে এত বড় বাড়ি থাকতে আপনি কেন এই ওল্ড-এজ হোমে?

তুমি কিছু শোনোনি?

কী শুনব?

 তোমার বন্ধু ছুটকি, মানে নন্দিনী তোমাকে কিছু বলেনি? ওর সঙ্গে অনেকদিন আমার যোগাযোগ নেই।

আমি যার গর্ভধারিণী সে-ই আমাকে এখানে পাঠিয়েছে। এরপর সরোজিনী যা বলে গেলেন তা মোটামুটি এইরকম। লাবণি চলে আসার পর কল্পনা মীরচন্দানি নামে একটা সিন্ধি মেয়েকে অরিজিৎ বাড়িতে এনে তোলে। কিছুদিন শান্তশিষ্টই ছিল ওরা। তারপর দিনের পর দিন পীড়ন চালিয়ে লেক টাউনের বাড়ি, ব্যাঙ্কের টাকা, লকার-টাকার সব নিজের নামে লিখিয়ে নেয়। তারপর বাড়িটাড়ি বিক্রি করে সরোজিনীকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আমেরিকায় চলে যায়। যাবার সময় বলেছিল, আমেরিকার জল-হাওয়া সরোজিনীর সহ্য হবে না, সেখানকার পরিবেশ অন্যরকম, তিনি এই বয়সে মানিয়ে নিতে পারবেন না। সেবা নিকেতন খুব ভালো ওল্ড-এজ হোম। চিকিৎসা থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়া, সমস্ত কিছুর ব্যবস্থা চমৎকার। যত্ন, সেবা, কোনও কিছুর ত্রুটি হবে না। মোটামুটি একটা হিসেব করে তার নাকি জীবনের জন্য যথেষ্ট টাকা এই হোমে জমা রাখা আছে। তাছাড়া বছরে এক-দুবার অরিজিতরা তো আসবেই।

বলতে বলতে বৃদ্ধার চোখেমুখে রাগ, ঘৃণা, বিতৃষ্ণা, উত্তেজনা, নৈরাশ্য, কতরকমের অভিব্যক্তি যে ফুটে উঠতে লাগল–ওরা আমাকে ঠকিয়েছে। জানো, কয়েকদিন আগে আমাকে হোম থেকে জানানো হয়েছে, যে টাকা অপুরা জমা দিয়ে গেছে তাতে আর মাত্র দুটো দিন চলবে। ওরা আমাকে সর্বস্বান্ত করে চলে গেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি দুহাতে মুখ ঢাকলেন। তার পিঠটা ফুলে ফুলে উঠতে লাগল।

বেশ কিছুক্ষণ পর মুখ থেকে হাত সরালেন সরোজিনী।

লাবণি বলল, পরশু তো আপনাকে হোম ছাড়তে হবে। তখন কী করবেন, কোথায় যাবেন, কিছু ঠিক করেছেন?

না। তবে রাস্তা আছে, গাছতলা আছে, লোকের বাড়ির রোয়াক আছে। রাতটা কোনও একটা জায়গায় কেটে যাবে। কিন্তু খিদের জ্বালাও তো থাকবে। কারও কাছে কোনওদিন হাত পাততে হয়নি। জানি না কী করব।

অনেকক্ষণ কী ভেবে লাবণি বলল, উঠুন। আমার সঙ্গে যাবেন।

 কোথায়?

আমাদের বাড়িতে। সেখানেই থাকবেন। পরশু আপনাকে সঙ্গে করে এখানে একবার আসতে হবে। আপনার কী জিনিসপত্র আছে চিনিয়ে দেবেন। সেসব নিয়ে আমরা ফিরে যাব।

বিহ্বলের মতো তাকিয়ে থাকেন সরোজিনী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *