পদ্মার ইলিস

পদ্মার ইলিস

ইলসা। খড়্গের মতো ধারালো জলতরঙ্গ। ঘোলা জলের ঢেউ খল-খল করে বাজে আচক্রবাল বিস্তারে। গম্ভীর রাত্রে আচমকা মনে হয় জিনলোকের সুপ্তিশয্যা থেকে কোটি কোটি প্রেতাত্মা জেগে উঠে মাতলা হাসি হাসতে হাসতে পারের জেলে কৃষাণের জীবন্ত জনপদগুলোকে অপমৃত্যুর ভয় দেখাচ্ছে। ধমনির ওপর এক ঝলক রক্ত চলকে ওঠে আতঙ্কে।

সেই ইলসা। ঢেউয়ের মুকুটে চড়িয়ে একমাল্লাই ই-ডিঙিগুলোকে বেপরোয়া উল্লাসে ছুঁয়ে দেয় মেঘের সামিয়ানা-টাঙানো আকাশে, তার পরেই মোচার ভোলার মতো টেনে নিয়ে আসে নিজের খরধারায়।

ইলসা-ডিঙিটার সামনের গলুই-এ বসে তিরিশ হাত জলের অতল গর্ভে কাসেম ছড়িয়ে দিয়েছে জালটা। হাতের সতর্ক মুঠোতে দড়ির খোট ধরা রয়েছে। তিরিশ হাত জলের অতলান্তে একটি অনিবার্য সংকেত; দড়িটায় স্পর্শ করেছে ইত্সার রুপালি ফসল। আর সঙ্গে সঙ্গেই মসৃণ নিয়মে দড়িটাকে টেনে দেবে কাসেম। জালের মুখ বন্ধ হয়ে যাবে ইসার গভীর পাতালে। তিরিশ হাত জলের অতলে, স্বাধীন বিচরণের সাম্রাজ্য থেকে বন্দি হয়ে কাসেমের ডিঙিতে উঠে আকাশ-প্রণাম করবে চাঁদের মতো রূপালি ইলিস। জালের খোট-ধরা মুঠোতে সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোকে কেন্দ্রিত করে বসে আছে কাসেম।

টিপটিপ করে ইলসেগুঁড়ি ঝরে খই-এর মতো ফুটে উঠছে নদীতে। আকাশের পটভূমিতে অপরাজিতার মতো স্তবকে স্তবকে মেঘ জমেছে। শেষ ক্ষেপটা নৌকার ওপর তুলে ডোবার নীচে প্রসন্ন চোখে তাকাল কাসেম। নাঃ, বিশ কুড়ির মতো ইলিস পড়েছে আজ। পাইকারের নৌকায় তুলে দিলে তিরিশ-চল্লিশটা টাকা আজ মিলবেই। জালটা গুটিয়ে পাটাতনের নীচে রেখে দিল কাসেম। আজ আর মাছ ধরবে না। তার পর গু-গুন্ করে একটি আবিষ্ট নেশার গান ধরল পুলকিত গলায়–

ওগো, আমার আহ্লাদের স্বামী,
শ্বশুর বাড়ি যাইতে চাই কো নাইয়র দিবা নি?
 এই ধর গো তুমি আমার চাবির ছোরানি।
তুমি আমার ট্যাকাপয়সা সিকি দোয়ানি।
ওগো, আমার আহ্লাদের স্বামী।

গানের রেশটা উজানি ঢেউ ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছড়িয়ে পড়ল দুরতর ক্রান্তিরেখার দিকে।

সঙ্গে সঙ্গেই কাছের ইলসা-ডিঙিটা থেকে একটা উদ্দাম রসিকতা ভেসে এল; কে রে কাসমা না কি? একটা বউর লেইগ্যা মনটা বুঝি ফাকুর ফুকুর করে?

নিভন্ত গলায় কাসেম বলল; আমি কি সোয়ামীর গান গাই না কি? আমি গাই বউর বুকের পোড়ানির গান।

হ, হ, আমরা বেবাকই বুঝি। তুই যা শয়তান! বউর নাম কইর‍্যা তুই নিজের বুকের পোড়ানি কমাইস।

গানের সুর থামিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে রইল কাসেম। দূরের নৌকা থেকে আবারও সেই উদ্দাম গলাটা ভেসে এল; কি রে ঘরে যাবি না? আইজ কোন গঞ্জের পাইকাররে মাছ দিবি?

ইনামগঞ্জের।

ক্যান অতখানি গাঙ পাড়ি দেওনের কোন কাম? যে মেঘ জমছে, ডরে বুকের লৌ (রক্ত) পানি হইয়া যায়। এই মামুদপুরে মাছ বেইচ্যা ঘরে গিয়া কাথা মুড়ি দিয়া ঘুম লাগা। গাঙ্গের গতিক আইজ ভালো না কিন্তুক।

অন্তরঙ্গ গলায় সতর্ক করে দিল পাশের নৌকার ইঙ্গ-মাঝি।

না, না, ইনামগঞ্জ থিকা বউঠাইনের লেইগ্যা একখান থান কাপর নিতে লাগব। মামুদপুরে থান পাওয়া যায় না। সেই লেইগ্যা যাওন।

ওঃ, সেই হিন্দু বিধবা মাগিটা! মাথাটা বুঝি চাবাইয়া খাইছে তোর! পেতনিটারে খেদাইয়া একটা বউ ঘরে আন।

পয়গম্বরের গলায় হাবশি উচ্চারণের মতো উদাত্ত ভঙ্গিতে একটা পবিত্র পরামর্শ ভেসে এল।

অমুন কথা মুখে আনাও গুণাহ। কাসেমের গলায় নির্বাপিত প্রত্যুত্তর।

তবে গোরে যা হারামজাদা জিন। ভাগীদার মইরা গেছে, তার বউরে তা বইল্যা পুষতে হইব–এই কথা কোন কোরানে লিখা আছে? তুই কি তার লগে নিকাহ বসবি?

ছিঃ ছিঃ, কি যে কও ফরিদ চাচা!

একটা তীক্ষ্ণ অপরাধ বোধে ব্রহ্মতালুর মধ্যে রঙ বিঘূর্ণিত হতে লাগল কাসেমের।

ততক্ষণে পাশের নৌকাটা দূরতর ব্যবধান রচনা করতে করতে বিন্দুর মতো মিলিয়ে গিয়েছে মামুদপুরের দিকে।

সামনের গলুইটা থেকে পেছনের গলুইর দিকে একবার তাকাল কাসেম। আর সঙ্গে সঙ্গেই ইন্সর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা দমকা বাতাসের মতো বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা হু-হুঁ করে উঠল। তিন মাস আগেও ওই গলুইতে হালের বৈঠাটা শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে বসত জলধর। তার এই ইলসা মাছ ধরার ভাগীদার সে। আজ সেখানে কাটাল কাঠের বৈঠাটাই আড়কাঠের সঙ্গে বেঁধে ডিঙির দিকনির্দেশ নির্ভুল রাখে কাসেন; আর সামনের গলুইতে বসে ইলসা-জাল বায়।

হালের গলুইতে এসে বলল কাসেম। বৈঠাটা আড়কাঠ থেকে খুলে নিয়ে আকাশের দিকে নজরটা একবার ছড়িয়ে দিল। নলখড়ি স্কুলের মতো মেঘের স্তবক থেকে সন্ধ্যার ঘন ছায়াভাস নেমে এসেছে, বেলা শেষের সূৰ্য্যের ওপর অন্ধকার গুণ্ঠনের যবনিক টেনে দিয়েছে। কেউ। ঢেউ-এর নাগরদোলায় দোল খেতে খেতে ছল-ছল করে ইমামগঞ্জের দিকে এগিয়ে চলেছে কাসেমের একমাল্লাই জেলে-ডিঙিটা।

আচমকা ইলসার অবারিত বাতাসের অশ্রান্ত আকুলতায় জীবনের পাণ্ডুলিপিটা এলোমেলো হয়ে দুবছর আগের একটা অধ্যায় চোখের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়াল। পদ্মাপারের মানুষ কাসেম। যাযাবর কোষ ডিঙিটায় ভাসতে ভাসতে কেমন করে যে ইসার পারে জলঘরের চৌচালা ঘরখানায় নোঙর ফেলেছিল–তা একটা অবাস্তব স্বপ্নের মতো অসত্য মনে হয়। এখানে এসেই তার বেবাজিয়া জীবনে প্রথম যতিচিহ্ন, প্রথম জন্মান্তর। তার পর জলধর আর জলধরের বউয়ের মায়ামধুর স্নেহ তার অস্থির পদচারণায় প্রথম বিশ্রান্তির কাছি পরাল। একসঙ্গে তারা খঙ্গাধার ইলসায় বের হত রুপালি ফসলের তল্লাশে। সেই জলধর-সাত দিনের জ্বরে চোখ দুটো পাকা ধানের রঙের মতো হলদে হতে হতে একদিন বিছানার মধ্যে নিথর হয়ে গেল; শরীরের সমস্ত উত্তাপ সরে গিয়ে একটা অর্থময় শীতলতা নেমে এল। সবচেয়ে বড় সত্যটা একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্কের মতো জলধরের বউয়ের মর্মবিদারী চিৎকারের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল। জলধরের ওপর মৃত্যুর নিম্মম একটা সমাপ্তি-রেখা টেনে দিয়েছে।

তার কয়েকদিন পর কাসেম বলেছিল ও তোমার কোনও কুটুম-বাটুম আছে বউ-ঠাইন; সেখানে যাইবা?

কোনও কালে আমার কেউ নাই ঠাকুরপো। আমি আর যামু কই? আমারে দুইটা লবণ-ভাত তুমি দিতে পারবা না? সোয়ামীর ভিটা ছাইড়্যা যামু আর কোন আখায়?

জলধরের বউয়ের বিবর্ণ চোখের তারায় সেদিন ছিল একটা অসহায় প্রার্থনা। অমুন কথা কইও না বউ-ঠাইন! আমার গুণাহ লাগে। আমি ভাবতে আছি, আমি মুসলমান, তুমি হিন্দু। মাইনষে কইব কি?

মাইনষের কওনেরে আমি ডরাই না, ঠাকুরপো তোমারে আমি আমার ছোট ভাই-এর লাঘান দেখি।

সেই থেকে জলধরের বউ আর কাসেম পাসাপাশি দুখানা চৌচালা ঘরের প্রতিমুগ্ধ আয়তনে ছড়িয়ে দিয়েছে নিজেদের।

ইতিমধ্যে নৌকাটা ইনামগঞ্জের বন্দরে এসে পড়েছে। দূর থেকে ইসা-মাঝিদের ডিঙিতে লাল লাল ইমলি পাখির মালার মতো রাশি রাশি আলোর লেখা দেখা যাচ্ছে।

.

ইলিস মাছ পাইকারের গাছি নৌকায় তুলে, বউঠাইনের জন্য একখানা থান কাপড় আর তিনপাসারী পানকাইজ ধান কিনে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত্রির পরমায়ু ত্রিযামা পেরিয়ে গেল। চারদিকের আকন্দ-বৈচির ঘুমন্ত অরণ্যবেষ্টনে জোনাকির দীপান্বিতা, আটকিরা-ঝোঁপের অন্তরাল থেকে ব্যাঙ আর ঝিঁঝিদের জলসার অকৃত্রিম ঐক্যতান ভেসে আসছে।

বৃষ্টিস্নিগ্ধ উঠান থেকে কাসেম ডাকল, বউঠাইন, বউঠাইনসঙ্গে সঙ্গেই কাঁচা বাঁশের ঝাঁপ খুলে বাইরে বেরিয়ে এল জলধরের বউ; হাতের কুপির আলো থেকে কনকপদ্মের মতো শিখা বিকীর্ণ হয়েছে তার নিঘুম আঁখিতারায়।

কাসেম বলল, এখনও ঘুমাও নাই বউঠাইন?

না, ঘরের পুরুষ মানুষ রইল বাইরে। আমি মাগি খাইয়া খাইয়া শরীলে (শরীরে) রস কইর‍্যা বুঝি ঘুমামু? অমুন আহ্বাদের মুখে ছালি পড়ুক। আস, আস খাইবার আস। এত দেরি করলা ক্যান?

ইনামগঞ্জে গেছিলাম। তোমার কাপড় নাই–এই ধরো। এইট্যা কিনতে গেছিলাম। আর এই ট্যাকাগুলা রাখো। আইজ বিস্তর মাছ পড়ছিল জালে। কোমরের গোপন গ্রন্থি থেকে অনেকগুলো কঁচা টাকা আর খানাখানা জলধরের বউয়ের হাতে ঢেলে দিল কাসেম।

তোমারে সেই কথা কইল কে? আমার কাপড় আছে আস্তা দুখান। এমুন কাম আর কইরো না।

বিব্রত গাম্ভীর্যের আবরণ নেমে এল জলধরের বউয়ের মুখের ওপর।

তোমার যে কত আস্তা কাপড় আছে, তা আমার জানা আছে। শিলাই কইর‍্যা পুরান কাপড়খান পরতে আছ আইজ এক মাস। আমার চৌখ আছে বউঠাইন! আমি অন্ধ না! আমি যা খুশি করুম। অভিমানের নিবিড় রেশ আসন্ন বর্ষণের প্রতীক্ষায় থম থম করতে লাগল কাসেমের গলায়।

এবারে ফিক করে হেসে ফেলল জলধরের বউ; আইচ্ছা, খুব কত্তা-পুরুষ হইছ একেবারে! এইবার থিকা যা খুশি কইর্যো। আমি কিছু কইতে যামু না। এখন খাইতে আস, রাইত পোহাইয়া আইল যে!

হ তাই করুম। তুমি কোনও কথা কইতে পারবা না। আমি না আইন্যা যদি জলধরদাদায় আইজ আইন্যা দিত! একদিন তুমি আমারে ছোট ভাই কইছিলা–মনে নাই? আমার মা-বাপের কথা মনে নাই! আছিলাম এক বেবাজিয়া (বেদে) বহরের মাঝি। তোমার কাছে মার সোহাগ পাইছি পরথম। অমুন কথা আর কইব না।

কান্নার মতো একটা ঘনকম্পিত অনুভূতি তখনও আঠার মতো জড়িয়ে রয়েছে কাসেমের গলায়।

এই মুহূর্তে সেই কান্নাটা সংক্রামিত হয়ে গেল জলধরের বউয়ের গলায়।

আর কইও না ঠাকুরপো! তুমি আমার মার প্যাটের ভাই এক দিকে, আর এক দিকে প্যাটের পোলা। তোমারে এটটু ঠাট্টা করছিলাম। তা-ও বোঝো না!

মাটির সানকিতে রাঙা বোরো চালের ভাত আর ইলিস মাছের সর্ষে-পাতরি সাজিয়ে কাসেমের সুমুখে এগিয়ে দিল জলধরের বউ। দু-এক গ্রাস ভাত মুখে দেবার পরেই জলধরের বউ বলল; একটা কথা কমু ঠাকুরপো?

কও। কদম্বরেণুর মতো গোঁফদাড়িতে আকীর্ণ মুখখানা তুলে ধরল কাসেম।

আমার কথা রাখলে তবে কই কথাটা।

তোমার কথা রাখুম না, এই একটা কথা হইল!

দুর্বিণীত অভিমানে ভাতের সানকি থেকে হাতখানা কোলের ওপর গুটিয়ে আনল কাসেম।

আমি রহিম খোন্দকারের মাইয়াটারে দেখেছি, বড় সোন্দর দেখতে। তোমার পাশে খাসা মানাইব। তোমার হইয়া আমি কথা দিয়া দিছি। পাঁচ কুড়ি টাকা বউ-পণ লাগব।

রুদ্ধশ্বাস আগ্রহে সামনে এগিয়ে এল জলধরের বউ।

না, না বউঠাইন! এখন সাদির ল্যাঠা থাউক। আর অত ট্যাকা দিমু কোথা থিকা বউ-পণের লেইগ্যা?

কাসেমের উদার আকাশের মতো দৃষ্টিতে বিস্ময়ের হালকা হালকা মেঘসঞ্চার।

ট্যাকার লেইগ্যা তোমার ভাবতে হইব না। আমি মুন্সীবাড়ি ভারা ভাইন্যা (ধান ভেনে) টাকার জোগাড় রাখছি। তুমি মত দিলেই হয়। বেরাজি হইও না। আমি একটা টুকটুকা বইন চাই। একলগে কাম করুম, একলগে হাসুম, একলগে গলা জড়াইয়া কান্দুম। জলধরের বউয়ের গলায় আকুলিত প্রার্থনা চকিত হয়ে উঠল।

বউ! তেইশ বছরের রোমাঞ্চিত কেলীতরঙ্গের মধ্য দিয়ে একটা অনাস্বাদিত শিহরণ বয়ে গেল কাসেমের। একটা বেনামি পুলকের অনুভূতিতে ধমনির ওপর রক্তে ঝলক লাগল আচমকা। ইসার নির্ধারিত পটভূমিতে আজ প্রথম সন্ধ্যায় বউর মোহকামনার স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিল পাশের নৌকার মাঝি।

নিবিড় গলার নিশ্চুপ স্বরে কাসেম বলল, কোন একা পেতনির বাচ্চারে ধইরা আনবা–তোমার যত কথা বউঠাইন

আচমকা কোথা দিয়ে কী ঘটে গেল। নিরুৎসাহ গলায় জলধরের বউ বলল, না, না, সাদি তোমারে করতেই হইব। তোমারে-আমারে লইয়্যা পাঁচ জনে মন্দ কয়।

কী কইল্যা!

 দূরের আকাশ থেকে দুজনের ব্যবধানের ভূমিতে একটা বজ্র এসে বিদীর্ণ হল যেন।

বাকি রাত্রিটুকু সন্নিহিত ঘরের মাচায় বিছানো জীর্ণ শয্যার ওপর বিনিদ্র চোখের প্রহর গুনে চলল কাসেম আর জলধরের বউ।

মাঝরাত থেকে ঝমঝম নূপুর বাজিয়ে বৃষ্টির উর্বশী-নাচ শুরু হয়েছে। ঘরের চালের ফাঁক দিয়ে বর্ষণ-প্লাবিত অন্ধকার আকাশ দেখা যায় এক টুকরো। দরের মাতলা ইলসার গজ্জিত ফোসানি ভেসে আসে। দুজনেই দুজনের নিধুম থাকার পরিষ্কার সংকেত পাচ্ছে।

আচমকা জলধরে বউ বলল, ঠাকুরপো!

কী? একটা গম্ভীর উত্তর ভেসে এল বেড়ার ও-পাশ থেকে। দরজাটা খুইল্যা কাথাখান নাও। বড় জবর কাল (শীত) পড়েছে। শ্যাষে আবার অসুখ-বিসুখ করতে পারে।

ঝাঁপ খুলে কথা হাতে বাইরে বেরিয়ে এল জলধরের বউ। পাশের ঘরের ঝপ খোলার শব্দ ভেসে আসে।

তিমির পিঠের মতো কালো আকাশের ওপর সপাং করে বিদ্যুতের চাবুক চমকাল একবার।

হো হো করে বৃষ্টি-তুফানের আবহ বাজনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হেসে উঠল কাসেম। আমরা গাঙের পোকা বউঠাইন। এট্ট কালে (শীতে) অসুখ ব্যারাম হইব আমাগো!

তার হাসিটা ইলসার দমকা বাতাসে মুছে গেল সহসা। খানিকটা সময়ের বিরতি-চিহ্ন। দুজনের মাঝখানে খানিকটা অন্ধকার অর্থহীন নীরবতায় স্থির হয়ে রয়েছে।

ফিসফিস গলায় জলধরের বউ বলল, সারা রাইত বিছানায় উসপাস্ করছ। ঘুমাও নাই এক দণ্ড-ক্যান ঠাকুরপো?

আশ্চর্য সংযত গলায় কাসেমের, তুমিও তো ঘুমাও নাই বউঠাইন, কি ভাবতে আছিলা? দাদার কথা?

সহসা কাসেমের সমস্ত শরীরে বর্ষাস্পন্দিত মেঘনার একটা চকিত দোলন লাগল। নীচু হয়ে জলধরের বউর পা দুখানার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সে; বউঠাইন, সত্য কথা কও। তুমি আমারে সন্দ করো? তবে আমি আইজই যামু গিয়া;

দুখানা হাতের স্নিগ্ধ বেষ্টনে কাসেমকে পায়ের আশ্রয় থেকে টেনে তুলল জলধরের বউ, ছিঃ, অমুন কথা আমার মনেও আসে নাই কোনও দিন, তুমি আমার ছোট ভাই। তবে মাইনষে কয়–তুমি সাদিটা কইর‍্যা ফেলাও। আমি বউ পণের ট্যাকা দিমু।

ও, এইর লেইগ্যা বুঝি আমারে না জানাইয়া মুন্সীবাড়ি ভারা ভাইন্যা (ধান ভেনে) টাকা কামাইছ? বেশ, তোমার কথা আমি রাখুম। তবে আমার মাথার কিরা আর কখনও দান ভানতে যাইবা না। আমি মরলে পরে যাইও। গাঢ় গলায় পিষ্ট কান্না ছড়িয়ে বলল কাসেম।

অন্ধকারের পটভূমিতে একটা দ্রোণফুলের মতো জলধরের বউয়ের হাসিটা ফিক করে ফুটে উঠল; হইচে, হইচে। এইবার ঘরে গিয়া শোও। এই নাও কাথাখান-মুড়ি দিয়া শুইও।

আর মস্করা কইরো না। কাথা দেওনের নাম কইর‍্যা নিজের জিদখান বজায় রাখলা। তুমি যা চতুর–এখন আর শুমু না। এইবার নদীতে যাই। আইজ বিস্তর মাছ পড়ব; মনে লয়।

দিকরাত্তিরে কাঁথা দেবার ভূমিকার নেপথ্যালোকে যে অর্থটি আত্মগোপন করে ছিল, তা পরিষ্কার ধরে ফেলেছিল কাসেম।

.

বউ-এর নাম ফুলমন। জলধরের বউ নিজের বেসর, বনফুল আর পৈছা সাজিয়ে দিল তার সারা দেহে। নাচের বিঘূর্ণিত ছন্দে যখন তখন ঘুরপাক খায় সে ঝম ঝম মল বাজিয়ে।

কবুতরের বুকের মতো নরম ঠোঁট দুটিতে পানের রক্তরাগ। সেই পানরাঙানো ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে মধুর ঝরাবার যে প্রত্যাশা ছিল জলধরের বউর, তার বদলে ফিনকি দিয়ে কালনাগিনীর বিষ বেরিয়ে এল এখানে আসার ষোলটা প্রহর পেরিয়ে যাবার পরই।

পাইকারের নৌকায় মাছ দিয়ে দশটা কাঁচা টাকা মিলেছিল; সেই টাকাটা জলধরের বউর হাতে যেই মাত্র অনেক দিনের মসৃণ অভ্যাসে গুঁজে দিল কাসেম; ঠিক তখনই চোখের মণিদুটো ভুরু-ধনু পার করে আসমানে তুলে ভুজঙ্গপ্রয়াত ছন্দে ঝঙ্কার দিয়ে উঠল; আগো আমার বাজান! কোন নিঃবইংশ্যার লগে আমার সাদি দিছিলা গো বাজান! ড্যাকরা হিন্দু বিধবা মাগির লগে মববৎ করে গো বাজান

বয়রা বাঁশের মাচায় একটা শরাহত ভাল্লুকের মতো গড়াতে লাগল ফুলমন।

কাসেম আর জলধরের বউ বদগ্ধ দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে রইল।

এক সময় রুদ্ধবাক গলায় বলল জলধরের বউ, এইবার থিকা বউর হাতেই ট্যাকা দিও ঠাকুরপো। সত্য কথাই তো আমি রাঢ়ি মাগি, অলক্ষী। বউ মানুষ–ঘরের লক্ষ্মী। তার হাতেই দিও ঠাকুরপো।

শান্তিনিবিড় পৃথিবীর যে আকাশটাকে রামধনুর স্বপ্নমায়ার রঙে রঙে প্লাবিত করে দেবার কোমল বাসনা ছিল তাদের; সেই আকাশে প্রথম কালবৈশাখীর সঞ্চারে একটা অনিবার্য অশুভের সংকেত সূচিত হচ্ছে। সে কালবৈশাখী ফুলমন।

জলধরের বউ ঘরের ভেতর এসে কাঁচা বাঁশের ঝপ টেনে দিল; আর কাসেম ইলসার দিকে আবার ক্লান্তমন্থর শরীরটাকে বয়ে বয়ে নিয়ে গেল। বড় বিস্বাদ, বড় অপ্রত্যাশিত ঠেকছে আজকের এই সকালটা। প্রসন্ন রোদের সোনা আচমকা মেঘের ছায়াপাতে যেন বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে।

বর্ষার বীতবর্ষণ আকাশের মতো থমথম করে কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেল। সন্ধ্যার সময় তিন চাঙাড়ি ইলিস মাছ এনে উঠানে নামাল কাসেম, তারপর ডাক দেয়, অ বউঠাইন, অ বউ-তোমরা সব বাইরে আস।

ত্রস্ত পদক্ষেপে বাইরে বেরিয়ে এল জলধরের বউ। ফুলমন সস্তা দামের আয়নার সামনে সমস্ত মুখখানা অমানবিক ভঙ্গিতে দুলিয়ে দুলিয়ে সূৰ্মার সতর্ক রেখা আঁকছিল চোখের কোলে। কাসেমের ডাকটা কানের গুহাপথে প্রবেশ করবার সঙ্গে সঙ্গে কুৎসিত গলায় চিৎকার করে উঠল : ক্যা, হইচে কী ড্যাকরার? পিরীতের নাগরীই তো রইছে। তার কানে কইলেই হইব। ফুলমনের উন্মনা ভূঁইচাপার মতো অকলঙ্ক মুখখানার মধ্যে এমন একখানা ক্ষুর-শাণিত জিভের অস্তিত্ব কোথায় ছিল, সাদির আগে কাসেম কী জলধরের বউ কেউ তা আবিষ্কার করতে পারেনি। কাসেম বলল : বউঠাই, এইগুলান দিয়া লবণ-ইলিশ কইর‍্যা কইলকাতায় চালান দিলে ভালো কারবার হইব; পয়সাও আসব ভালোই। তুমি আর বউ মাছ কাইট্যা লবণ মাখাইয়া রাখো। নিথর গলায় জলধরের বউ বলল বউ পোলাপান মানুষ; আমিই একলা কাইট্যা লবণ দিয়ে মাইখ্যা রাখুম! তুমি হাতমুখ ধুইয়্যা ভাত খাইবা আস ঠাকুরপো!

একটু সময় নীরবতার যতিচিহ্নের মতো কেটে গেল। তারপর কাসেম প্রখর অভিযোগের গলায় বলল কী বউই আইন্যা দিছিলা বউঠাইন! আমি তখন কত বার না করলাম–এইবার ঠেলা সামলাও।

চুপ করো, বউ আবার শুনতে পাইব। পোলাপান মানুষ–ওরে এট্ট সোহাগ-আহাদ কইরো।

রাত্রিবেলা শুয়ে শুয়ে ফুলমনকে নিবিড় আলিঙ্গনের বেষ্টনে জড়িয়ে বুকের কাছে টেনে নিয়ে এল কাসেম। অতিকায় একটা কালো মাছের মতো প্রচণ্ড ঝটকায় বিছানার আর এক প্রান্তে সরে গেল ফুলমন। সামনের ইসা থেকে সারেঙ্গীর সুরের মতো ঢেউ-এর বাজনা ভেসে আসছে সোঁ সোঁ করে, হিজল-সুপারীর পাতায় পাতায় বাতাসের অশ্রান্ত মৰ্ম্মর। কাসেম আকুলিত গলায় বলল : অমুন করে না বউ, বউঠানাই আমাগো কত ভালোবাসে। বেবাজিয়া নৌকার মাঝি আছিলাম আমি। পদ্মার ওই দূর দ্যাশ থিকা ইসায় আইলাম। জলধর দাদায় আশ্রয় দিল–বউঠাইন মায়ের লাঘান বুকে নিল। অমুন কথা বউঠাইনরে কইস না।

বুকে নিল! সোহাক কইর‍্যা নাগরেরে বুকে নিল। ওঃ, সেইর লেইগ্যা বুঝি টাকা আইন্যা ওর হাতে দিস ড্যাকরা। ওর হাতে মধু আছে, ওর হাতে ভাতে মধু আছে। যা, যা ওর ঘরে যা–দ্যাখ গিয়া তোর গায়ের গোন্ধ না পাইলে আবার সারা রাইত ঘুম আসব না।

খিক খিক করে সারা দেহ-মন্থন-করা জিনলোকের হাসি হেসে উঠল ফুলমন।

 বিস্রস্ত গলায় কাসেম বলল, চুপ চুপ! বউঠাইনে আবার শুনতে পাইব।

 শুনতে পাইব, তো আমার কী? শোননের লেইগ্যই তো কই।

এইবার চুপ না করলে কবুতরের লাঘান গলাটা ছিড়া ফেলমু-হারামজাদি কাছিমের ছাও শুওর।

কাসেমের গলাটা একটা ভয়ানক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিল।

চুপ করুম কার ডর! নিঃবইংশ্যা, ড্যাকরা, আল্লার অরুচি-ওগো বাজান! তোমার মনে এই আছিল! টাকার লেইগ্যা এই ছিনালের বাচ্চার লগে দিছিলা আমার সাদি গো বাজান!

বিনিয়ে বিনিয়ে আনুনাসিক গলায় সুর-লয়ে কান্নার ঢেউ ছড়াতে লাগল ফুলমন।

অনেকটা সময় দাঁতের ওপর দাঁত চাপিয়ে নির্মম সংযমে নিজের উত্তেজনাটাকে বাঁধ দিয়ে রাখল কাসেম; তারপর এক সময় ফুলমনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অনেক দিনের অসহ্য আর বন্দী ক্রোধটা কিল-চড় আর অবিশ্রাম লাথির মধ্যে মুক্তি পেয়ে আছড়ে পড়তে লাগল ফুলমনের সারা দেহে।

ফুলমনের কথাগুলো শুনতে শুনতে পাশের ঘরে বিধ্বস্ত অনুভূতি নিয়ে নিশ্চুপ পড়ে ছিল জলধরের বউ। এবার সে দানা-পাওয়া গলায় চিৎকার করে উঠল; কী করো কী করো ঠাকুরপো! মাইয়া মানুষের গায়ে হাত তুলতে সরম লাগে না?

ঝাঁপ খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে উঠানে দাঁড়াল কাসেম; কী বিজাত বউ যে আইন্যা দিছ বউঠাইন! সব তোমার দোষ, সব তোমার দোষ। এক মুহূর্তও আর ঘরে থাকতে ইচ্ছা হয় না। কাছিমের ছাওটা ঘরের মধ্যে যেন বিষ মাখাইয়া দিছে।

বিশৃঙ্খল পদসঞ্চারে ইলসার দিকে চলে গেল কাসেম।

মাছের চাঙাড়িগুলো উঠানের এক কিনারায় পড়ে রয়েছে; একটা উগ্র আঁশটে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে।

খানিকটা সময় স্তব্ধ থেকে কুপি জ্বালিয়ে বঁটি নিয়ে বসল জলধরের বউ। সন্ধ্যারাত্রিরে কুমারবাড়ি থেকে অনেকগুলো নতুন হাঁড়ি এনে দিয়েছিল কাসেম। মাছ কেটে কেটে হাঁড়ি ভৰ্ত্তি করে নুন জারিয়ে রাখতে লাগল জলধরের বউ।

পোহাতি রাতে কাসেম ফিরে এল আবার। ব্যস্ত গলায় বলল; বউঠাইন, তোমারে কইতে ভুইল্যা গেছি। লবণ-মাছের চালান পাঠাইতে হইব আইজ সকালেই। শয়তানের ছাওটা গণ্ডগোল কইরা দিছে।

তোমার ব্যস্ত না হইলেও চলব। তোমার মাছ কাইট্যা আমি গুছাইয়া রাখছি। এই লইয়্যা যাও ঠাকুরপো।

লঘু-মৃদু হাসল জলধরের বউ।

 অসীম কৃতজ্ঞতায় চোখ দুটো জলোচ্ছাসে ঝাপসা হয়ে গেল কাসেমের।

.

সকাল বেলা বয়রা বাঁশের মাচার ওপর থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে এল ফুলমন। সমস্ত মুখখানায় রক্তের ছোপ ছোপ স্বাক্ষর। কাসেমের হাত-পা ফুলমনের দেহের ওপর প্রলয় নাচ নেচেছে কাল রাত্রে।

ইতিমধ্যে গাঙের ঘাট থেকে গোটা কয়েক ডুব দিয়ে বিনিদ্র রাত্রির সমস্ত ক্লেদ ধুয়ে এসেছে জলধরের বউ; ফুলমনের মুখের ওপর আহত দৃষ্টিটা পড়তেই আর্তনাদ করে উঠল, ঠাকুরপোর রাগ উঠলে আর কাণ্ডজ্ঞেয়ান থাকে না। আয়, আয় বউ, আম তোরে গান্দার পাতা বাইট্যা দেই, মুখে লাগা।

একটা আলাদ গোক্ষুরের ল্যাজে যেন খোঁচা লেগেছে বল্লমের; সাঁ করে ফণা তুলে দাঁড়াল ফুলমন; হারামজাদি, কালামুখী বেউশ্যের আবার পীরিত উলাইয়া উঠছে। আমার লগে কথা কইবি না। তুই যেইখানে থাকবি, আমি সেইখানে নাই।

এই কী সব্বইশ্যা কথা কইস বউ!

গলাটা বিস্ময়ের কান্নায় রুদ্ধবা হয়ে রইল জলধরের বউয়ের।

সত্য কথা! তুই নামবি এই বাড়ি থিকা, না হয় আমিই এখন বাজানের বাড়িতে যামু গিয়া।

আমি গেলে গিয়া তুই খুশি হইস বউ? তোগো কাজিয়া বিবাদ যাইব গিয়া?

চোখের আকাশে যে বর্ষণ এতক্ষণ স্তব্ধ হয়েছিল, এবারে তা ঝরে ঝরে সমস্ত মুখখানা ভাসিয়ে দিল জলধরের বউয়ের!

নিচ্চয়; আমার সোয়ামীর কাঁচা মুড়াটা চিবাইছিস এতদিন, এইবার আমারে এট্ট চিবাইতে দে লো নটীর ছাও।

ফুলমনের গলায় আলাদ গোক্ষুরের ফণাটা ঘন ঘন আন্দোলিত হতে লাগল।

বেশ আমি যাইতে আছি গিয়া। আমার কে আছে–আমারে কে কী কইব? তুই ঘরের বউ, তুই সোয়ামীর ঘর থিকা নাইম্যা গেলে নিন্দা হইব, মাইনষে মোন্দ কইব।

হ হ, তাই যা তুই। মাগি রাঢ়ি বেউশ্যে।

এক সময় সামনের মুলিবাঁশ-ঝোপের ছায়ামেদুর যে পথটা কুমারীর অকলঙ্ক সাঁথির মতো নিরাভরণ রেখায় এঁকে বেঁকে মুন্সী-বাড়ির দিকে চলে গিয়েছে, সেই পথটার বাঁকের অদৃশ্য হয়ে গেল জলধরের বউ।

ঘরের ভেতর এসে ঝাঁপটা প্রচণ্ড শব্দে বন্ধ করে দিল ফুলমন। আর সঙ্গে সঙ্গে কাঁচা বাঁশের জানালার ওপর ভেসে উঠল দুটো কামনামুগ্ধ চোখ।

উচ্ছ্বসিত গলায় ফুলমন বলল; তুই আইছিস্ রুস্তম। কয়টা দিন হারামজাদা জিনের লগে শুইয়্যা আমার ঘুম হয় নাই। বাজানটা যা চশমখোর, ট্যাকার লেইগ্যা সাদি দিল এই বখিলটার লগে।

তোরে কয় দিন দেখি না। তুই একা খবরও দিস না। মাইয়া লোক যখন যেই মরদের গন্ধ পায়, তখন তার কথাই কয়।

অমুন কথা কইস না রুস্তুইম্যা। আমি তেমুন মাগি না। কিন্তু কী রকম, ওই বিধবা মাগিটা অষ্টপহর তাকে তাকে থাকে। শ্যাষে তোর আমার ব্যাপার জাইন্যা ওই মরদার কাছে কইলে, আমার পিঠের বাক্লা তুইল্যা ফেলাইত।

তা হইলে উপায়?

একটা অথৈ আশঙ্কার সমুদ্রে যেন নিরুপায় হয়ে হাবুডুবু খেতে লাগল রুস্তম। ডর নাই, মাগিরে কাইজা কইরা খেদাইছি। এইবার ঘর বান্ধনের ব্যবস্থা করো; আমি আর থাকুম না, এইখানে একদিনও।

ফিক করে আশ্বাসের হাসির প্রশ্রয় ছড়াল ফুলমন।

বেশ, ট্যাকা দে তিন কুড়ি।

নে। ভাঙা কাঠের বাক্স থেকে টাকা বের করে রুস্তমের হাতে ঢেলে দিল ফুলমন; এইবার যা। আবার আসিস রাইতে।

ঘরে তোর কাছে শুইতে দিবি তো?

ইলিশ মাছের রূপালি আঁশের মতো চকচক করতে লাগল রুস্তমের কদর্য চোখ দুটো।

যা ভাগ এখন, আসিস তো রাইতে। মরদটা না থাকলে

 ফুলমনের সমস্ত দেহটাকে আর একবার দৃষ্টিভোজ করে চলে গেল রুস্তম।

সূর্যের আকাশ থেকে রাশি রাশি সোনালি রোদের বন্যা এসে পড়েছে ইসা-পারের মাটিতে। সাদা সাদা রেণু ছিটানো মানকচুর অরণ্যে সোতা খালটা পান্নার কণার মতো ঝিলমিল করছে।

আনন্দিত পদক্ষেপে বৃষ্টিকোমল মাটিতে এসে পুলকিত গলায় ডাকল কাসেম, বউঠাইন, অ বউঠাইন

পাকের ঘরে আজ সর্বপ্রথম আবির্ভাব হয়েছে ফুলমনের; ডালের উগ্র সম্বরা দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল সে। প্রসন্ন হাসির অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল; আস ঘরে আস–

দৃষ্টিটা বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে এনে অস্থির গলায় কাসেম বলল; বউঠাইন কই? আইজ তার লবণ-ইলিসে এক কুড়ি পাঁচ ট্যাকা লাভ হইচে। কই গেল বউঠাইন? তার লেইগ্যা আর তোমার লেইগ্যা কাপড় আনছি নয়া।

কই দেখি কাপড়? ব্যগ্র কৌতূহলে উঠানের পরিসরে নেমে এল ফুলমন।

 বউঠাইন কই? কাসেমের গলায় কঠিনতম জিজ্ঞাসা।

 রাঢ়ি মাগিরে খেদাইয়া দিছি। নির্লিপ্ত জবাব ভেসে এল ফুলমনের।

খেদাইয়া দিছ! কাসেমের সমস্ত ভঙ্গিমার ঘনীভূত আর্তনাদটা গলা বিদীর্ণ করে বেরিয়ে এল।

খেদাইয়া দিছি। হিঁদু মাগির লগে কোন পীরিত?

তবে আইজ যে লবণ-ইলিশের বায়না লইয়া আইলাম একশো রাইঙ (হাঁড়ি); সেই সব বানাইয়া দিব কে? তুই তো বাদশাজাদি; সূৰ্মা পরতে কাইট্যা যায় বেলা তিন পহর!

তার আমি জানি কী? ওগো বাজান-নিঃবইংশ্যা আমারে দিয়া বলদের লাঘান খাটানের লেইগ্যা সাদি করেছে গো বাজান! তুমি আমারে এই ড্যাকরার লগে দিছিলা সাদি গো বাজান। ফুলমন কাঁসর-পেটানো গলায় বিনাতে শুরু করল।

সামনের সূৰ্য্যদীপিত পটভূমিটা যেন অন্ধকারের অতলতায় নিঃশেষে তলিয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো দুটো হাতের ঢাকনায় আবৃত করে উঠানের ওপর বসে পড়ল কাসেম; খেদাইয়া দিলা–খেদাইয়া দিলা বউঠাইরে

.

একটু পরেই গাব-মাদারের রোদ-ঝলমল ছায়ার জাফরি-কাটা পথটা ধরে মুন্সীদের চেঁকি-ঘরটার কাছে এসে দাঁড়াল কাসেম। চেঁকি-ঘরটার সন্নিহিত একখানা ভাঙা একচালা। অনেক দিনের ঝড়-বর্ষণের শরাঘাতে হেলে রয়েছে এক দিকে; মাটির দেওয়া ঝরে গিয়ে বাঁশের খুঁটির কঙ্কাল আত্মপ্রকাশ করেছে।

ইতিমধ্যে মেঝেটা পরিচ্ছন্ন করে নিকিয়ে নিয়েছে জলধরের বউ। ভাঙা ইটের টুকরো দিয়ে উনুন রচনা করেছে।

কাসেম কান্নাপ্লাবিত গলায় বলল, ঘরে লও বউঠাইন। এইখানে আসছ; মানুষে আমারে মন্দ কইব।

না, ঠাকুরপো! আমি তোমার উপুর গোসা হইয়া আসি নাই। তোমরা সুখে-শান্তিতে ঘর-গৃহস্থী কর; আমি দূর থিকা দেখি।

জলধরের বউয়ের গলায় তীব্র অভিমানের উত্তাপটুকু স্পষ্ট হয়ে ফুটে বেরিয়ে এল।

তুমি যাইবা না তবে? আমি তোমার পর বইল্যা খেদাইয়া দিলা!

নাঃ, আমি গেলেই আবার তোমার সংসারে আগুন লাগব। বউ আমারে চায় না। তুমি ঘরে যাও ঠাকুরপো!

বউরে আমি খেদাইয়া দেই। তবু তুমি লও।

তুমি কেমুনতর সোয়ামী, চন্দ্রসূয্য সাক্ষী কইর‍্যা যারে সাদি কইর‍্যা আনলা-তারে খেদাইতে চাও? যাও, বেলা নাইম্যা গেছে। খাইতে যাও। জলধরের বউর গলাটা তীক্ষ্ণ ধমকে উচ্চকিত হয়ে উঠল।

বেশ, কিন্তুক আইজ আবার লবণ-ইলিসের বায়না দিছে। ফুলবিবি তো সুম্মা আর গন্ধ তেল ছাড়া কিছুই ধরে না। আমার কেউ নাই এই দুনিয়ায়–থাকলে কি আর অমুন কইর‍্যা ফেলাইয়া আইতে পারত? কাসেম ছোরা-কাটা লুঙ্গির প্রান্তে অশ্রুকম্পিত চোখ মুছতে মুছতে সেই বনছায়ার গোরোচনা-আঁকা পথটা দিয়ে ছুটতে ছুটতে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ঠাকুরপো!

ডান হাতটা সামনের দিকে প্রসারিত করে চিৎকার করে উঠতে চাইল জলধরের বউ। কিন্তু ভারী পাথরের মতো কান্নার অবরোধ সরিয়ে স্বরটা অত্মপ্রকাশ করতে পারল না।

.

 সারাদিন আর উনুনের চিতা জ্বালেনি জলধরের বউ। মুন্সীদের ধান ভেনে একচালা ঘরখানায় এসে নতুন আখাটাকে ভেঙে ফেলল। তার পর উৎসুক-ব্যাকুল চোখ দুটো সতর্কভাবে পথের ওপর স্থির রেখে একটা অতি পরিচিত পদধ্বনি শুনবার জন্য চৌকাঠের ওপর বসে রইল। কিন্তু না, কৃষ্ণা চতুর্দশীর চাঁদটা পার হয়ে এসেছে। ত্রিযামা-পথিক শিয়ালের গলায় অনেকগুলো প্রহর ঘোষিত হয়ে গেল। তার আচ্ছন্নতা ছত্রখান করে মাঝে মঝে ঝরাপাতার ওপর দিয়ে ভাম-খটাসের শোভাযাত্রা চলে গেল। ধড়মড় করে উঠে বসেছে জলধরের বউ।

ততক্ষণে আসন্ন প্রভাতের আবছায়া আলোর ছোপ পড়েছে পুবালি দিয়ে। হাতের পাতা দিয়ে চোখ দুটো ঘষে ঘষে উঠে দাঁড়ালো জলধরের বউ।

কাসেম হয়তো তার তন্দ্রার অবসরেই মখমল-মৃদু পদক্ষেপে এ পথ দিয়ে চলে গিয়েছে; সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলো মথিত করে অশ্রুধারা নেমে আসতে চাইল জলধরের বউয়ের।

ইতিমধ্যে কখন যে মুন্সীবাড়ির ছোট কর্তা পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন খেয়াল ছিল না। পাশ ফিরতেই নজরে পড়ল ছোট কত্তার চোখজোড়া তার বিস্ত থানের বাতায়ন দিয়ে শরীরের অনাবৃত চামড়ার ওপর সড়কির আঘাতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এস্তে কাপড়খানা গুছিয়ে নিয়ে ভীতি-চকিত গলায় জলধরের বউ বলল; আপনে এইখানে ছোট কত্তা?

এই তোমার এট্ট খবর-বাত্তা নিতে আইলাম। এই একচালা ঘরখানে থাকতে ডর লাগে না তো রাইতে?

না। ডরের কী আছে, আমার কী-ই বা আছে?

ছোট কর্তা বৈষ্ণব। সমস্ত শরীরে শ্রীকৃষ্ণের চন্দন-পদচিহ্ন; পাতলা নিমার নীচে তুলসীর মালার আধ্যাত্মিক ঘোষণা; চোখে প্রসন্ন গোপিনীদৃষ্টি। হাতের জপের মালায় উত্তেজনার ঝড়।

আপাততঃ তিনি কৃষ্ণভাবে ভাবিত; না, কইলেই হইল? তোমার যে কী আছে; কী আর নাই, তা কি তুমি জানো সুন্দরী! কত সাপ-খোপ, বদমানুষ আছে। তাগো হাত থিকা বাঁচাইতে হইব না কৃষ্ণের জীবেরে। রায়, নারায়ণ। তোমার কিছু ডর নাই। এই জায়গাটা বেশ নিরালা রাত্রে আইস্যা তোমার লগে কৃষ্ণকথা কওয়া যাইব। নারায়ণ, নারায়ণ রহস্যময় হেসে সামনের হেউলি ঝোপটার আড়াল দিয়ে মিশিয়ে গেলেন ছোট কত্তা, অনেক দূর থেকে তার অমৃতনিঝর কণ্ঠ ভেসে এল কয়েক কলি গানের সঙ্গে–

কৃষ্ণের যতেকে লীলা,
 সর্বোত্তম নবলীলা,
নববধু তাহার স্বরূপ…

কানের ওপর একটা শঙ্খচূড় সাপের ছোবল পড়ল যেন। শিউরে উঠল জলধরের বউ।

.

সারারাত ক্ষ্যাপা নদীতে ইস্লা জাল বেয়ে অপরিসীম ক্লান্তির অবসাদে শরীরটা যেন ভেঙে ছত্রখান হয়ে গিয়েছে কাসেমের।

বাড়ির উঠানের ওপর আসতে আসতে মাথার ওপর সূর্যটা তির্যকভাবে লম্বিত হয়ে ঝুলতে লাগল; পায়ের নীচের ছায়াটা হ্রস্বতম হয়ে এসেছে। উঠানের ওপর পা দিয়েই শরীরের সমস্ত রক্ত ফেনিয়ে ব্রহ্মতালুতে গিয়ে আবর্তিত হতে লাগল কাসেমের।

নিরাবৃত বারান্দার ওপর রুস্তমের অন্তরঙ্গ আলিঙ্গনে ধরা রয়েছে ফুলমন। কী সে করতে পারে? হাতরে ধারালো ছেদা-খানা দুজনের গলার ওপ বসিয়ে একেবার সহমরণে পাঠিয়ে দেওয়া ছাড়া পুরুষের মতো বীৰ্য্যবান কাজ আর কী আছে? অথবা নিজের ঘাড়েই চাপিয়ে দেবে নাকি দা-টা? সমস্ত চিন্তা ইন্দ্রিয়কোষগুলো থেকে এক মুহূর্ত বিলুপ্ত হয়ে গেল কাসেমের।

আর বারান্দার ওপর থেকে রুস্তম আর ফুলমন একসঙ্গেই ভূত-দর্শনের পুলকিত শিহরণ অনুভব করল।

কয়েকটা নিষ্ক্রিয় মুহূর্ত রুদ্ধশ্বাস হয়ে রইল তিন জোড়া বজ্রপ্রহত চোখের নিস্পলক আয়নায়।

তারপর পুরুষের পলায়নের স্বাভাবিক প্রেরণায় রুস্তম ফুলমনকে বারান্দার ওপর আছড়ে ফেলে একটা জ্যা-মুক্ত তীরের মতো সাঁ করে বাইরে অরণ্যের বোরখায় মিলিয়ে গেল।

গন্ধসাবান-মাখা ফুরফুরে দেহটা থেকে ধূলোর কণাগুলো ঝেড়ে উঠে বসেছে ফুলমন।

কাসেমের গলাটা ডোরাকাটা বাঘের মতো গর্জন করে উঠল এই প্রথম। ও কে? ও আসে ক্যান?

প্রথমে রক্তধারার মধ্যে ভয়ের একটা আকস্মিক ছায়াপাত ঘটেছিল। এতক্ষণে নিজেদের সামলে নিয়েছিল ফুলমন; ও আসে ক্যান্ ওরে জিগাইও শরীরে তেল থাকলে! তুমি যাও ক্যান ওই রাঢ়ি মাগির বিছানায়?

সাবধান সুমুন্দির ঝি, তোরে আইজ কোতল করুম।

কাসেম হাতের ছো-খানা ছুঁড়ে মারার আগেই তৎপরতার সঙ্গে ঘরে ঢুকে ঝাঁপটা চক্ষের পলকে টেনে দিল ফুলমন। আর সেই কঁপের ওপর দা-খানা এসে আছড়ে পড়ল।

উঠান থেকে আবারও গর্জন করে উঠল কাসেম; তোরে আমি শ্যাষ করুম আইজ; তবে আমি শেখের ছাও। ওই কাছিমের বাচ্চাটারে আইন্যা একলগে তোগো দুইটারে ইসা মাছের লাঘান কুচি কুচি করুম।

ঘরের ভেতর থেকে আনুনাসিক ব্যঙ্গের অপমান ভেসে এল; তোর লাঘান কত ড্যাকরা দেখলাম রে নিঃবইংশ্যা! আমারে কাটব, আয় আগে তোর মাথা লামাইয়া দিই। রুস্তইম্যা তো আসবই, একশ ফির আসব। পারলে তুই তারে বান্ধিস, তবে বুঝুন এক বাপের বেটা তুই!

 আহত পৌরুষের দাবদাহে চোখের মণি দুটো ফেটে যেন ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসবে, মনে হল কাসেমের।

অনুপায় আক্রোশে উঠানের দিকে একবার তাকাল সে। কয়েকদিন আগে এক কিনারায় লবণ-ইলিস করার জন্য কয়েক কুড়ি মাছ এনে রেখেছিল কাসেম। নগণ্য অবজ্ঞায় সেগুলো তেমনি পড়ে পড়ে পচছে; একটা উগ্র দুর্গন্ধ বাতাসের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে গিয়েছে। দেখতে দেখতে কয়েক বিন্দু অশ্রু চোখের কোল বেয়ে লবণাক্ত আস্বাদের সঙ্গে ঠোঁটের ওপর এসে পড়ল কাসেমের। আর সঙ্গে সঙ্গেই চেতনার বিধ্বস্ত কোষে কোষে একখানা মুখ টলমল করে ভেসে উঠল। জলধরের বউ। বউঠাইন!

পেশিগুলো কেমন যেন অবসন্ন হয়ে আসছে। শিথিল পদসঞ্চারে বাইরে বেরিয়ে গেল কাসেম।

.

আবার তিন খণ্ড ইট তুলে এনে উনুন পেতে এক পাতিল ভাত ফুটিয়ে নিয়েছে জলধরের বউ।

এখন সন্ধ্যা। আম আর গাবপাতার প্রচ্ছটপটে রাত্রির শিলালিপি; মাঝে মাঝে জোনাকির সবুজ প্রদীপ জ্বলছে মিট মিট করে। টিনের কুপিটা থেকে ধোঁয়ামাখা লাল শিখাটা ছড়িয়ে পড়েছে অষ্টবক্র ঘরখানার আয়তনে।

মনের মধ্য দিয়ে ডুব-সাঁতারের মতো একটা অতঙ্ক পিছলে পিছলে গেল। একটু পরেই আবির্ভাব হবে ছোট কর্তার। এই ভাঙা ঘরের পাল্লাবিহীন আয়তনে অকলঙ্ক চরিত্রের নিরাপত্তা কোথায়? সে কি ফিরে যাবে কাসেমের কাছেই? কিন্তু ফুলমনের জিভ থেকেও গরল ঝরে যে!

আচমকা আত্মমগ্ন ভাবনাটা ছত্রখান হয়ে গেল। শুকনো ঝরা-পাতার ওপর পদধ্বনি। প্রথমে চমকে উঠেছিল জলধরের বউ। ছোট কর্তা নয় তো! নাঃ, টলতে টলতে মাতালের মতো মেঝের ওপর এসে আছড়ে পড়ল কাসেম। সারাদিন পেটের মধ্যে ক্ষুধার বাসুকি ফণা ঝাঁপটিয়েছে; চেতনার পর্দায় ফুলমন আর রুস্তমের বেআইনি আলিঙ্গনের যুগল-মূর্তি বিষের জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে।

দুহাত ধরে কাসেমের নির্জীব দেহটা তুলে বসাল জলধরের বউ; ব্যস্ত গলায় বলল : কী হইচে ভাই, অসুখ ব্যারাম না তো!

না, বউঠাইন!

সারা দিনে খাইছ? কাজিয়া করছ বউর লগে?

 জলধরের বউয়ের গলায় অবিরাম প্রশ্নের বিশৃঙ্খলা।

কী বউ যে দিছিলা বউঠাইন! ক্যান তুমি আমার লগে এই শত্রুতা করলা? ক্যান? আমি তোমার কাছে কী দোষ করছিলাম? সেই জবাব নিতে আইছি। দ্যাও জবাব দাও।

কাসেমের দুচোখ বেয়ে প্লাবন নেমে এল।

তোমার জবাব দ্যাওনের আগে আমার জবাব দ্যাও তো আগে। সারাদিনে প্যাটে দানা পড়ছে একটা? সত্য কইবা ঠাকুরপো!

গলার ওপর দিয়ে ইলসার একটা ঢেউ ছল ছল করে বয়ে গেল জলধরের বউ-র। আর মাথাটা গোঁজ করে নিরুত্তর বসে রইল কাসেম। তবে আগে ভাত খাইয়া লও।

হাত দুটো অঞ্জলির মধ্যে মুঠো করে একখানা মাটির সানকির সামনে কাসেমকে বসিয়ে দিল জলধরের বউ। তারপর পাতিল থেকে রাঙা আউশের মোটা মোটা ভাতগুলো ছড়িয়ে দিতে লাগল পাতের ওপর।

বিকেলের দিকে বৃষ্টি হয়েছিল; এখন আমের পাতা থেকে টুপ টুপ করে জলের বিন্দু ঝরছে।

এক গ্রাস সবে মাত্র মুখ তুলেছে কাসেম; আর সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে গেল ঘটনাটা।

ঘরের পৈঠার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন ছোট কর্তা। তাঁর চোখ দুটো তুলসী-বনের বাঘের মতো জ্বলছে ধক ধক করে। ঝকঝকে ছুরির ফলার মতো দাঁতগুলো বিকাশ করে চতুষ্পদের ভঙ্গিতে খিঁচিয়ে উঠল ছোট কর্তা, তাই কই নাগরখান কে? শ্যাষে শেখের হাতে ইজ্জৎ দ্যাও হিন্দুর বউ হইয়া! এই সব পাপ কাম এইখানে এই কৃষ্ণের রাজত্বে চলবে না। কলি কাল পড়েছে বইল্যা যা খুশি করবা মনে ভাইবো না।

কি কন আপনে? কাসেম আমার ছোট ভাই।

জলধরের বউয়ের গলায় ব্যাকুল আবেদন।

ছোট ভাই রাইতে আইস্যা বিছানায় থাকে বুঝি! দিনে খবর লয় না! আচমকা চিৎকার করে উঠলেন ছোট কর্তা। হরি, যুগেশ হরেন, সব লাঠি লইয়া আস-গেরামে পাপ রাখুম না। নারায়ণ, নারায়ণ-চক্ষের নিমেষে আটকিরার জঙ্গল দলিত করে লাঠি বল্লম নিয়ে শিকারের উত্তেজনায় ছুটে এল যোগেশরা।

ছোট কর্তা বৈষ্ণবীয় নির্দেশ দান করলেন, কিছু মনে কইরো না জলধরের বউ, সব কৃষ্ণের ইচ্ছা, যুগেশ

মুহূর্তে দুখানা লাঠি শূন্যে আন্দোলিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল কাসেমের ওপর। চড়াৎ করে খুলিটা ফেটে খানিকটা রক্ত চলকে এসে পড়ল সাদা সাদা ভাতের ওপর।

ও বাজান!

 কপালের ওপর হাতখানা চাপা দিয়ে সাকিটার ওপর আছড়ে পড়ল কাসেম।

হায় ভগবান! তোমার মনে এই আছিল–সারাদিনের না-খাওয়া মানুষ জলধরের বউয়ের বুকফাটা আর্তনাদটা কুণ্ডলিত হয়ে আকাশের দিকে উঠে গেল। মুচ্ছিত হয়ে মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়ল জলধরের বউ।

কৃষ্ণের ইচ্ছায় এইমাত্র যে কর্মটি হল সেই রক্তাক্ত বীরকীর্তির দিকে তাকিয়ে একবার প্রসন্ন গলায় নাম-কীর্তন করলেন ছোট কর্তা। নারায়ণ, নারায়ণ–

এত আনন্দের মধ্যেও একা অমসৃণ ভাবনা ময়না কাটার মতো চেতনায় খচখচ করতে লাগল। যবনের সঙ্গে কী করে পীরিত হল মাগিটার? সবই তার ইচ্ছা। মনে মনে ছোট কর্তা একবার জপ করে নিলেন; কৃষ্ণ পদে রাখ রে মন, সব জনমের ধন।

দিগ্বিজয় সমাপ্ত করে বাহিনী নিয়ে একটু পরেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন ছোট কর্তা।

.

চেতনা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি কাসেমের, কপাল ফেটে ভিরমি লেগেছিল। ছোট কর্তারা বীর কর্ম সমাপ্ত করে চলে যাবার পরই উঠে বসল কাসেম। পাশে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে রয়েছে জলধরের বউ। কাসেম ডাকল, বউঠাইন, বউঠাইন

কিন্তু জলধরের বউর দেহটা স্থির নিস্পন্দ। কুপির লালাভ আলোতে চোখের মণি দুটো নিথর হয়ে রয়েছে। এক পাশে ভাতের হাঁড়িটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে রয়েছে–চার দিকে রাশি রাশি ভাত ইতস্ততঃ ছড়ানো।

একটা নতুন পাতিল থেকে জল নিয়ে জলধরে বউর মুখে ঝাঁপটা দিতে লাগল কাসেম।

এক সময় বিস্ফারিত চোখের মণি দুটো নড়ে উঠল জলধরের বউর; গলার ধু ধু স্পন্দনে জীবনের মৃদু লক্ষণ, ঠাকুরপো।

তোমার মনে এই আছিল বউঠাইন, তোমার মনে এই আছিল–

জলধরের বউর শিয়র থেকে উঠে আম-সুপারীর গহন অরণ্যপথ ধরে ছুটতে শুরু করল কাসেম।

ঠাকুরপো-ঠাকুরপো–আমি কিছুই জানতাম না এইর

একটা করুণ আর্তনাদ যেন কাসেমের পদধ্বনি অনুসরণ করতে করতে একটা অপুর্ব মিনতির রেশ নিয়ে গড়িয়ে আসতে লাগল পেছন দিক থেকে।

সারাটা রাত ইলসার পার দিয়ে শ্মশান-কবর ডিঙিয়ে গতচেতন মাতালের মতো ঘুরপাক খেয়ে বেড়াল কাসেম। রাশি রাশি রক্ত মালতীর মতো আলো জ্বালিয়ে ইলিস-ডিঙিগুলো রুপালি ফসলের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু আজ আর ইসার জলতরঙ্গ তাকে হাতছানি দিল না। একটা নির্জন বিবরে জীবনের ক্ষতক্লেদ লেহন করবার জন্য নিরিবিলি অবসর খুঁজেছে সে; কিন্তু শরীরের সমস্ত রক্ত মাথার মধ্যে জমা হয়ে বিঘূর্ণিত হচ্ছে। আর সেই রক্তকেন্দ্র থেকে উল্কাপিণ্ডের মতো ছিটকে ছিটকে পড়ছে কতকগুলো মুখ-ফুলমন, বউঠাইন, মুন্সীদের ছোটকর্তা-দিবা-রাত্তিরে কাঁটালতা, ঝোপ-জঙ্গল আছাড় খেতে খেতে অবসন্ন চরণসঞ্চারে বাড়ির উঠানে পা দিল কাসেম; তার পর মৃত গলায় ডাকল, বউ, অ বউ-দুয়ার খোল।

দরজার পাল্লা খোলা রয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা কেমন যেন চমকে উঠল কাসেমের।

একটা বিরাট লাফে উঠান থেকে ঘরের মধ্যে এসে পড়ল কাসেম। মাচার ওপর জীর্ণ বিছানায় কেউ নেই।

চেতনার মধ্যে একটা বিদ্যুতের চমক বয়ে গেল যেন। এস্তে ভাঙা কাঠের বাক্সটার কাছে চলে এল কাসেম। ডালাটা খুলবার সঙ্গে সঙ্গেই মুখের সমস্ত রক্ত সরে বিবর্ণ হয়ে গেল। কয়েক কুড়ি টাকা এনে রেখেছিল কাসেম, তার মধ্যে একটি অচল কড়িও অবশিষ্ট নেই।

সেখান থেকে একটা অগ্নিমুখী হাউইর মতো সরে এল পশ্চিমের বাঁশের খুঁটিটার দিকে। ফুকর করে করে কয়েক কুড়ি কাঁচা টাকা রেখেছিল, বাঁশ খুঁটিটা দুখণ্ড হয়ে পড়ে রয়েছে।

ফুলমনের সঙ্গে সেই অপরিচিত লোকটার অশোভন আলিঙ্গনের অর্থটা এতক্ষণে স্বচ্ছ আয়নায় মতো পরিস্কার হয়ে এসেছে কাসেমের কাছে। ফুলমন পালিয়ে গিয়েছে। ঘরের অভিশপ্ত পরিবেষ্টন থেকে বাইরের বারান্দায় এসে বসল কাসেম। শরীরের জোড়গুলো যেন শিথিল হয়ে আসছে। দুটো হাতের আবরণে মুখটা ঢেকে একটা বজ্ৰপ্ৰহত মানুষের মতো বসে রইল কাসেম। উঠান থেকে কয়েক দিন আগে এনে রাখা পচা ইলিশ মাছের তীক্ষ্ণ দুর্গন্ধটা বাতাসে বাতাসে বিষ ছড়াতে লাগল।

এক সময় পুবের ক্রান্তিরেখায় সূর্য সঞ্চারিত হল। রোদের একটা সোনালি রেখা এসে স্থির হয়ে জ্বলছে কাসেমের কপালের রক্তচিহ্নে।

আরক্ত চোখ দুটো তুলে চারিদিকে একবার তাকাল কাসেম। পচা মাছের দুর্গন্ধ, উঠানের আবর্জনা, কাকের মুখে মুখে চলে-আসা মাছের কাটা আর থমথম নির্জনতায় আগামী গোরস্থানের ভয়াবহ ইঙ্গিত!

বিক্ষত স্নায়ুগুলোর মধ্যে কালকের রাত্রিটাকে একবার ধরবার চেষ্টা করল কাসেম। একটা আতঙ্কময় দুঃস্বপ্নের মতো সেটা বারবার ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে চেতনা থেকে।

উঠানের ওপর এসে দাঁড়াল মুন্সীদের ছোকরা গোমস্তা গোকুল, কাসেম ভাই, তোমার বউঠাইনে একবার যাইতে কইছে–

যাও, যাও। আমার বউঠাইন আবার কে? হিন্দু কখনও মুসলমানের আপন হয়? যাও, যাও

হাঁটু দুটোর অবরোধে মুখখানা আবার গোপন করল কাসেম। একটা বন্দী কান্নার আবেগ ঢেউ-এর মতো কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল সমস্ত দেহের ওপর।

গোকুল বলল, বেশ না আস, না আসবা। বউঠাইনে দুইটা ট্যাকা চাইছে। নৌকার ভাড়া লাগব। কেরায়া ভাড়া কইরা দিছি; পদ্মার পারে তার কোন মাসিবাড়ি যাইব না কী?

চকিত হয়ে উঠে দাঁড়াল কাসেম, কোনও চুলায় তার কোনও কুটুম আছে বইল্যা তো জানি না। কই সে?

খালের ঘাটে কেরায়া নৌকায় রইছে।

চিৎকার করে উঠল কাসেম। আমারে আগে কও নাই ক্যান, কেরায়া করণের আগে আমারে একবার খবর দিতে পারো নাই? দ্যাখতাম, কেমুন যাইতে পারে আমারে ফেলাইয়া। চলো, চলো। ইসার কাইতানের মতো হু-হুঁ করে খালের ঘাটে ছুটে এল কাসেম। কেরায়া নৌকার ছই-এর গুণ্ঠন থেকে জলধরের বউয়ের সাদা থানে আঁচল দেখা যায়।

নৌকার গলুইটা চেপে ধরল কাসেম। বিউঠাইন–গলা থেকে ভারী কান্না বেরুল তার।

না, ঠাকুরপো। আমার লেইগ্যা তোমার কষ্টের শ্যাষ নাই। বদনামের শ্যাষ নাই। কাইল আমার লেইগ্যাই মাইর খাইলা। আমারে দুইটা ট্যাকা দ্যাও। আমি যাই গিয়া।

জলধরের বউয়ের গলাটাও ঘনমন্থর।

তুমি আমারে ফেলাইয়া যাইতে পারবা?

বউ রইছে। তারে লইয়া সুখে ঘর করো ঠাকুরপো! রাজা হইও। একাট উত্তরঙ্গ কান্নার উৎক্ষেপকে দমন করে নিল জলধরের বউ।

জানো বউঠাইন, ওই কাছিমের ছাওটা কাইল একজনের লগে ট্যাকাপয়সা বেবাক লইয়্যা ভাগছে। এইর পরেও তুমি আমারে ছাইড়া যাইবা? অশ্রুঝরা চোখের করুণার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কাসেম।

ঘরের বউ পরপুরুষের লগে ভাগছে! ছই-এর অন্তরাল থেকে একটা চমকিত কণ্ঠ ভেসে এল।

হ, ভালোই হইছে। আপদটা ভাগছে। না হইলে কী তোমারে পাইতাম ফিরা? ঘরে মাছ পচতে আছে। একেবারে গোরস্থানের মতো হইয়া গেছে সব। আস, ঘরে চলো। এখন তুমি না থাকলে, আমি মইরাই যামু। বর্ষার ইসার মতো দুচোখ বেয়ে বন্যা নামল কাসেমের।

এতক্ষণ রোধ করে রাখবার পরে জলধরের বউয়ের কান্নাও সমস্ত বাঁধ ভাসিয়ে হু-হুঁ করে নেমে এল ছই-এর ভেতর।

মাঝি ব্যস্ত গলায় বলল, বেলা হইয়া গেল দুফার, এখন নৌকা না ছাড়লে, রাইত ভোর হইয়া যাইব পদ্মার পারে যাইতে।

রোদন আর পুলক-জড়ানো অপূর্ব অনুভূতির গলায় কাসেম বলল, তোমার আর রাইত ভোর করতে লাগব না মাঝি! বউঠাইনের যাওয়া হইব না। আমারে ফেলাইয়া কি বউঠাইন যাইতে পারি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *