রসুল মাঝির গল্প

রসুল মাঝির গল্প

মাঝিঘাটা থেকে মেঘনাকে খুবসুরৎ দেখায়। আসমানে ছেঁড়া ছেঁড়া নীলচে রঙের মেঘ, নীচে উদ্দাম মেঘনা, রাশি রাশি ঢেউ আর হু-হুঁ বাতাস। মাঝিঘাটার ওপাশে লঞ্চঘাটা। চিলগুলো পাক খেয়ে খেয়ে জলের ওপর ছোঁ দিয়ে পড়ছে। ভেঁ দিয়ে একটা লঞ্চ ছেড়ে দিল। বড় বড় কয়েকটা ঢেউ এসে মাঝিঘাটাকে দুলিয়ে গেল।

এক-মাল্লাই নৌকোর গলুইতে বসে ছিল রসুল মাঝি। শেষবেলার রোদ, চিল, ঢেউ আর মেঘ দেখছিল। দেখতে ভালো লাগছিল।

এমন সময় সওয়ারি এল।

 ও মাঝি, চরলখিন্দর কেরায়া যাবা নাকি?

চমক ভাঙল। রসুল মাঝি ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। পরের মাটিতে এক মিঞা সাহেব এসে দাঁড়িয়েছে। মাথায় লাল ফেজ, রেশমি লুঙ্গি, পায়ে বাহারি নাগরা। সমস্ত শরীরে শৌখিন চেকনাই। পিছনে বোরখা-ঢাকা একটি মূর্তি। খুব সম্ভব মিঞা সাহেবের বিবি। এক পাশে স্তু পাকার মালপত্র।

রসুল মাঝি বলল, যামু না ক্যান মিয়া ছাহাব? যাওনের জন্যই তো বইস্যা রইছি। চরলখিন্দর পাঁচ টাকা কেরায়া লাগব।

মিঞ্চা সাহেব দরাদরি করল না। বোরখা-ঢাকা বিবিকে নিয়ে নৌকোয় উঠতে উঠতে বলল, পাঁচ টাকাই সই। মালপত্তর উঠাও মাঝি।

মনে মনে আপসোস করল রসুল মাঝি। কেরায়া আর একটু চড়িয়ে বললেই হত। এখন আর উপায় নেই।

একটু পরেই নৌকা ছেড়ে দিল। মাঝনদীতে এসে বাদাম খাটাল রসুল মাঝি। হু-হু বাতাস সাঁই সাঁই বাজছে। বাদামটা ফুলে রয়েছে। হালের বৈঠাটা কঠিন মুঠোয় চেপে গলুইতে কাত হয়ে বসল রসুল।

জল-কাটার একটানা শব্দ হচ্ছে। শেষবেলার রোদ নিবু নিবু হয়ে আসছে। আকাশটা আবছা দেখাচ্ছে। একটা ধোঁয়া রঙের পর্দা সমস্ত আসমান আর নদীটাকে যেন একটু একটু করে ঘিরে ধরছে।

ছইয়ের মধ্য থেকে মিঞা সাহেব বলল, চরসোহাগীতে একবার নৌকা ভিড়াইও মাঝি। রান্নাবান্না করতে হইব।

আইচ্ছা-রসুল মাঝি সংক্ষিপ্ত জবাব দিল।

কাল এক পহর বেলায় চরলখিন্দরে যাইতে পারুম না মাঝি?

মনে হত হয়।

এর পর কাটা কাটা দু-একটা কথা হল। কেরায়া নৌকার এই গলুইতে হালের বৈঠাটা চেপে একটানা ঢেউ আর বাতাসের শব্দ শুনতে শুনতে মনটা কেমন যেন উদাস উদাস লাগে রসুল মাঝির। তখন মেজাজটা আলাপ জমাবার মতো খোশবন থাকে না। আসমান-জমিন একাকার করে মনের ওপর কত ভাবনার যে ছায়া পড়ে, তার ইয়ত্তা নেই। রসুল মাঝির দিক থেকে তেমন উৎসাহ না পেয়ে অগত্যা মিঞা সাহেবকে থামতেই হল।

আজকাল ইলিশ মাছের মরশুম। ঘোট ঘোট জেলে-ডিঙিতে মেঘনা ছেয়ে গিয়েছে। দূরে কাছে যতদূর নজর চলে শুধু একের পর এক ইলশা-ডিঙি। মেঘনায় এই ইলশা-ডিঙি দেখলে রসুল মাঝির বুকের মধ্যেটা যেন হু-হুঁ করে ওঠে। অতীত জীবনটাকে মনে পড়ে। আর সেই সঙ্গে এক দুর্বোধ্য যন্ত্রণায় দেহমন বিকল হয়ে যায়।

জাল বাইতে বাইতে একটা ডিঙি পাশে এসে পড়েছিল। অভ্যাসবশে রসুল মাঝি জিগ্যেস করল, কেমুন মাছ পড়তে আছে মাঝি?

জবর।

ডিঙির খোলে ইলিশ মাছের স্তূপ জমেছে। রপালি আঁশগুলি শেষবেলার রোদে চকচক করে। চোখের মণিগুলো নীলার মতো জ্বলে। কানসার ফাঁকে তাজা রক্ত জমে রয়েছে। বড় একটা নিশ্বাস ফেলল রসুল মাঝি।

ঢেউয়ের মাথায় দুলতে দুলতে ইলশা-ডিঙিটা ফারাকে সরে গেল।

সামনেই একটা বিরাট ঘূর্ণি। কালো জল সোঁ-সোঁ শব্দে পাক খাচ্ছে। অসাবধান হলে আর উপায় থাকবে না। ঘূর্ণিতে পড়লে একটা মোচার খোলার মতো সোঁ করে একমাল্লাই নৌকোটাকে কোন অতলে টেনে নেবে। মেঘনা নদীর পাকা মাঝি রসুল। সুকৌশলে ঘূর্ণির পাশ ঘেঁষে নৌকা চালাচ্ছিল। আচমকা কানে এল

ছইয়ের মধ্যে বিবিজান মিঞা সাহেবকে ধমকাচ্ছে এই নৌকায় উঠলেন ক্যান মিঞা? কোরায়া-ঘাটায় কি আর মাঝি ছিল না?

মিঞা সাহেব বিব্রত হল। ফিসফিস গলায় বিবিজানকে সামলাতে লাগল : চুপ চুপ বিবি। মাঝি শুনতে পাই। মাঝনদীতে মাঝিরে ক্ষ্যাপাইলে উপায় থাকব না। জান পরাণ যখন তার হাতে। বাঁচাইলে সে, মারলেও সে।

তার আমি কী জানি! পারে নাইম্যা নৌকা বদল করেন।-বিবিজান আবার ঝামটা দিল? এই নৌকায় যামু না।

ভুরু কুঁচকে, বাঁ চোখটা ছোট করে রসুল মাঝি তাকাল। ভাবল, মেঘনা নদীর সঙ্গে তার কতকালের মহব্বত। কোথায় কোন ঘূর্ণি রয়েছে, কোথায় কয় বাঁও জল, কোথায় চোরাঘুর্ণির ফাঁদ পাতা রয়েছে, সব–সবকিছু তার জানা। ইচ্ছে করলেই বিবিজানের চোখের পলক পড়বার আগেই তার বদখত মেজাজটাকে ঠান্ডা করে দিতে পারে রসুল। ছোট্ট এক-মাল্লাই নৌকোটাকে ডুবিয়ে দিতে কতক্ষণই বা লাগে। মেঘনা নদীর মাঝি। সওয়ারি ডুবিয়ে দাঁতে নৌকোর রশি চেপে একটা কুটোর মতো ভাসতে ভাসতে এক সময় পারে উঠতে সে পারবেই।

ব্যঙ্গভরা গলায় রসুল মাঝি বলল, বিবিজান যেন আমার নৌকাটার উপুর জবর গোঁসা হইছেন। নৌকাটা কি কসুর করল?

ধড়ফড় করতে করতে ছইয়ের মুখে চলে এল মিঞা সাহেব : কিছু না, কিছু না মাঝি। বিবি ছেলেমানুষ। কী কইতে কী কয়, ঠিক নাই। তুমি ইদিকে কান দিও না। যেমুন বাইতে আছ, তেমুন বাও।

বিবি ছেলেমানুষ! মিঞা সাহেবের দিকে এতটুকু লক্ষ নেই রসুল মাঝির। তার চোখ দুটো ছইয়ের মধ্যে বিবিজানকে তল্লাশ করতে লাগল।

মিঞা সাহেব সমানে তোয়াজ করতে লাগল : তুমি কিছু মনে কইরো না মাঝি। হে-হে, বিবির আমার মাথার ঠিক নাই।

রসুল মাঝি জবাব দিল না।

ছইয়ের মধ্যে ঢুকে বোরখা খুলে ফেলেছে বিবিজান। ডুরে শাড়ির ঘোমটার ফাঁকে একরাশ ঘন চুল, দুটি সুর্মা-আঁকা ঘনপক্ষ্ম চোখ, নাকে সোনার বেশর আর একটি শ্যামলা রঙের মিষ্টি মুখ দেখা যায়। সে মুখ সরস লাবণ্যে ঢলঢল করছে। আড়চোখে চেয়ে রয়েছে বিবিজান। দেখতে দেখতে ভয়ানক চমকে উঠল রসুল মাঝি। কণ্ঠার ফাঁকে অসহ্য যন্ত্রণা। বুকের মধ্যে একটা শক্ত থাবায় কেউ যেন বাতাস চেপে চেপে ধরছে। তালুটা শুকিয়ে আঠার মতো চটচট করছে।

হালের বৈঠাটা হাতের মুঠি থেকে আলগা হয়ে গিয়েছে। খসে পড়বার আগেই চেপে ধরল রসুল মাঝি। নৌকাটা একটা গোত খেয়ে উজানের দিকে ঘুরে গেল।

মিঞা সাহেব চিৎকার করে উঠল, কী হইল মাঝি। হায় খোদা, এই মাঝগাঙে কি সব্বনাশ হইল!

আস্তে গলায় রসুল মাঝি ধমক দিল, চুপ করেন মিঞা ছাহাব। রসুল মাঝির হাতে বৈঠা থাকতে নৌকা ডুবব না।

ঘন ঘন বৈঠার পাড় দিয়ে উজানের দিক থেকে নৌকাটাকে ভাটির মুখে ঘুরিয়ে দিল রসুল মাঝি তার পর হালের বৈঠাটি চেপে আবার ডোরায় এসে বসল।

ডুরে শাড়ির ঘোমটার ফাঁকে একরাশ ঘন চুল, দুটি সুর্মা-আঁকা চোখ, সোনার বেশর, শ্যামলা রঙের মিষ্টি মুখে সরস লাবণ্য-অনেকদিন আগের আজিমা নামে এক সোহাগ-বউ মনের নিবিড়ে ঘন হয়ে এল। রসুল মাঝি ভাবে, কতকাল আগে আয়ু থেকে, জীবন থেকে সেই মধুর দিনগুলি খসে পড়েছে। কতকাল আগে তারা সত্য ছিল।

সে সব দিনে ইলিশ মাছের মরশুমে পদ্মা আর মেঘনায় পাঁচ মাস ইলশা-জাল বাইত রসুল মাঝি। চার মাস চাটগাঁয়, কক্সবাজারে কি নোয়াখালির গঞ্জে-বন্দরে নোনা ইলিশের কারবার করত। মেটে হাঁড়িতে কাটা ইলিশ নুনে জারিয়ে ঢাকা, কলকাতা কি আরও দূর দূর দেশে চালান দিত। সে সব দিনে রেশমি লুঙ্গি, ডোরাকাটা পিরহান আর বাহারি জুতো পরত রসুল মাঝি। কানে আতর দিত। মাথায় ফুলের তেল দিয়ে পরিপাটি করে টেরি বাগাত। গা থেকে ভুরভুরে গন্ধ বেরুত। ফুরফুরে জীবন। গলায় সিল্কের রুমাল বেঁধে দামি সিগারেট ফুকত। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কায়দা করে ধোঁয়া ছাড়ত। কথায় কথায় মেজবান করত। খুশির খেয়ালে মুঠো মুঠো টাকা উড়িয়ে দিত।

ফেচুপুর গ্রামের কুমারি মেয়েরা বলাবলি করত, দিল বটে একখান! যেমুন ট্যাকা কামায়, তেমুন উড়ায়। অনেকের ঘরেই তো ট্যাকা আছে, কিন্তুক এমুন মন নাই সারা গেরামে।

একা মানুষ, পরাণভরা শখ আর শখ, খেয়াল আর খেয়াল।

 কেউ বলে, রসুল মিয়ার চেহারাখানও জবর সোন্দর।

মোট কথা, ফেচুপুর গ্রামের কুমারী চোখগুলিকে মুগ্ধ করেছিল রসুল, কুমারী মনগুলিকে মজিয়ে দিয়েছিল। পাঁচ মাস ইলশা-জাল বাইত, চার মাস চাটগাঁ কি নোয়াখালিতে ব্যাপার করত আর বাকি তিনটে মাস একটা শৌখিন তৃষ্ণার মূর্তি হয়ে শিস দিয়ে দিয়ে ফেচুপুর গ্রামের আনাচে-কানাচে, মাঠে-ঘাটে, ব্যাপারী আর মাঝি-বাড়ির উঠানে দাওয়ায় ঘুরে ঘুরে বেড়াত রসুল।

সব বাড়িতেই রসুলের জন্য কপাট খোলা, দিল দরাজ। সদর-অন্দর একাকার। খাতির-আদরে এতটুকু খুঁত নেই। মীর বাড়িতে দুপুরে মেজবান থাকলে, মৃধা-বাড়ি রাত্তিরে দাওয়াত দেয়। ব্যাপারীরা কোর্মা খাওয়ালে মাঝিরা মোরগ-মুসল্লম ফরমাস করে আনায় গঞ্জ থেকে। শহর-বন্দরের গল্প করতে করতে যখনই রসুল চোখ তোলে তখনই ছিটে বেড়ার জানলার পাশ থেকে চট করে একটা মুখ সরে যায়! সে মুখে শ্যামল আশনাই, সুর্মা-আঁকা চোখ, কানে বনফুল, হাতের পাতায় মেহেদী মাখা, সুডৌল হাতে আয়নাচুড়ি। সব বাড়িতেই জানলার পাশে এক ছবি দেখতে দেখতে চোখ সয়ে গিয়েছে। বলা যায়, অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ওতে আর সাতাশ বছরের কঁচা প্রাণটা আজকাল এতটুকু চঞ্চল হয় না। জানলার পাশে খুবসুরৎ তরুণীর ছবি আপ্যায়নের একটা অঙ্গ হিসাবেই মেনে নিয়েছে রসুল। দূরের আকাশ, নদী, জারুল কি হিজল বনের মতো ওগুলোর আবেদন নিছক নিসর্গশোভা ছাড়া তার কাছে আর কিছু নয়।

খাওয়া-দাওয়ার পর বাটার সুগন্ধি মসলা এগিয়ে দিতে দিতে মৃধারা বলে, ব্যাপারীরা বলে, মাঝিরা বলে, সবাই বলে ও রসুল মিঞা, এইবার একটা সাদি করেন। সাদির সময় কিন্তুক আপনের হইছে।

রসুল জবাব দেয় না। মিটিমিটি হাসে। ব্যাপারীরা, মৃধারা, মাঝিরা ভাবে, শহরে-বন্দরে ঘুরে ঘুরে রসুল মিয়ার হালচাল, আদবকায়দাই বদলে গিয়েছে।

আবার শোনা যায়ঃ যদি মত করেন, তা হইলে আমার ছোট মাইয়াটা আছে। নাম রোশেনা। হে-হে, বুঝলেন কি না।

এবারও কোনও কথা বলে না রসুল। তবু সেই মিটিমিটি হাসিটাকে রহস্যময় করে তোলে। তারপর সুগন্ধি মসলা চিবুতে চিবুতে রাস্তায় গিয়ে নামে।

তিন বছর ধরে ফেচুপুর গ্রামে আছে রসুল। এর আগের চব্বিশ বছরের জীবনের ইতিহাস কেউ জানে না। সে সম্বন্ধে কেউ ভাবেও না। রসুল মিঞা, তার নোনা-ইলিশের ফলাও কারবার, শৌখিন রুচি আর হাল হকিকত ছাড়া আর কিছু তারা জানতেও চায় না।

তিনটে বছর এ-বাড়ি সে-বাড়ি মেজবান খেয়ে আর দাওয়াত দিয়ে দিয়েই কাটিয়ে দিল রসুল। ফেচুপুর গ্রামের জীবনে এই দাওয়াত আর মেজবানের পালা একটা অভ্যস্ত রীতির মতোই দাঁড়িয়ে গেল। এ ব্যাপারে আর চমক রইল না।

কিন্তু চমকের সবটাই বাকি ছিল। রাতারাতি নিকারীপাড়ায় মোল্লা-মুচ্ছল্লি ডাকিয়ে যেবার আজিমাকে সাদি করে আনল রসুল, সেবার সমস্ত ফেচুপুর গ্রামটা বেয়াড়া ধরনের এক বিস্ময়ে ঘায়েল হয়ে পড়েছিল। নিকারীদের ঘরে পচা চাচের দেওয়াল, ফুটি-ফাটা খাপরার চালে রোদবৃষ্টি বাগ মানে না। নিকারীদের ঘরে মাটির সানকি আর পিতলের গোটা দুই গ্লাস ছাড়া আর কোনও আসবাব নেই। সেই বাড়ির মেয়েকে সাদি করার মতো এত বড় একটা আহামুকি যে রসুল মিঞার মতো একটা শৌখিন খুশির মুর্তি করে বসতে পারে, তা কেউ ভাবতেই পারেনি। সারা ফেচুপুর, গ্রামটা কুৎসায় নিন্দায় সরগরম হয়ে উঠল। মৃধারা, ব্যাপারীরা, মাঝিরা একযোগে কাদা ছিটোতে লাগল। রসুল মিঞার মতো শয়তান, ইবলিশ আর কুচরিত্র মানুষ এত বড় আসমানের নীচে, এতবড় দুনিয়াটায় না কি আর একটিও নেই।

কিন্তু যাকে নিয়ে এত কুৎসা রটানো, এত নিন্দা ছড়ানো, সে একেবারেই নির্বিকার। কোনদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই।

সাদি করে নদীর কিনার ঘেঁষে ঘর তুলল রসুল। উপরে ঢেউটিনের চাল, দুপাশে ময়ুরমুখ আঁকা, ফরিদপুরের কারিগর কাঠের দেওয়ালে বাটালি দিয়ে কেটে কেটে ফুলপাতা বার করল।

ব্যবসা আরও বড় হয়েছে রসুলের। চাটগাঁ, কক্সবাজার কি নোয়াখালির গঞ্জ-বন্দর ছাড়িয়ে আকিয়াব-আরাকানে ছড়িয়ে পড়েছে।

নাকে বেশর, কানে বনফুল, চোখে সুর্মা, হাতে মেহেদী, একরাশ চুল আর শ্যামলা রঙের ঢলল মুখ আজিমা ছুটে বেড়ায়। ইলিশ মাছ কাটে, নতুন মেটে হাঁড়িতে নুন দিয়ে সেই মাছ জারায়। হাঁড়ির মুখে সরা দিয়ে গুনতি করে। কিছুদিন মক্তবে পড়েছিল, তার দৌলতে কাগজে-কলমে হিসাব রাখে আজিমা। লোকজন খাটে। ঠিক ঠিক হিসাব করে তাদের মজুরি দেয়।

রসুল বলে, বুঝলি সোহাগ-বউ, তোর বরাতে আমার বরাত খুলল। এই ব্যবসা যে এত বড় হইছে, সব তোর জন্যে। তোরে যেদিন সাদি করছি, সেদিন থিকাই আমার কপাল খুলছে। আগে-আগে আমার মাছ নোয়াখালি-চাটগাঁর গঞ্জে যাইত। আইজকাল আকিয়াব, আরাকান, এমুন কী রেঙ্গুনেও চাহিদা হইছে।একটু ছেদ, আবার তোর হাতে জাদু আছে সোহাগ-বউ। আর সকলের মাছ পাঁচ-ছমাসেই পচে গলে, কিন্তু আমার মাছ এক বছরেও যেমুনকে তেমুনই থাকে। লবণের লগে মাছে আর কি দিস রে বউ?

আজিমা হাসে, বলে, তোমার মাছে আমার মনের ঝাঁঝ মিশাই। সেই ঝাঁঝে মাছ পচন-গলন লাগে না। বুঝলা মিঞা। আর কথা না। এইবার খাইবা আসো।

আগে বল, কী মিশাইয়া দিস? না কইলে খামু না।

কপট রোষে ফুঁসে ওঠে আজিমা এই দিকদারি আর ভালো লাগে না মিঞা। আগে খাইবা চলো।

তুই তা হলে বলবি না বউ?–কঠিন গলায় রসুল বলে।

হালকা তামাসায় সব-কিছু উড়িয়ে দিতে চায় আজিমা : কী আবার কমু! হাতের গুণ মিঞা, হাতের গুণ। এমুন হাতের গুণ যে পচন-গলন তো দূরের কথা, কাটা মাছ জোড়া দিয়া জলে ছাড়লে তাজা হইব।

বেশ, না বললি।–গুম মেরে বসে থাকে রসুল।

রাত্রে আজিমার পাশে শুয়ে শুয়ে রসুল ভাবে, মৃধাপাড়া, ব্যাপারীপাড়া, মাঝিপাড়ার তিন বছরের দাওয়াতকে অগ্রাহ্য করে নিকারীদের মেয়ে বিয়ে করেছে; সে কি নিছকই একটা খেয়াল মাত্র! নিতান্ত উদারতার বশেই কি মাঝি-ব্যাপারীদের গরানকাঠের পঁচিশ বন্দের ঘর, ভারী ভারী মকরমুখী পালঙ্ক, কঁসার বাসন, দোফসলা জমির লোভ ছেড়ে নিকারীদের পচা ধসা বাড়ি, অভাব, হতাশা, দারিদ্রের টানে সে ছুটে গিয়েছিল?

কাত হয়ে একবার দেখল রসুল। আজিমা ঘুমুচ্ছে। নিশ্বাসের তালে তালে সুডৌল বুকটা উঠছে, নামছে। রসুল ভাবল, দুবেলা বাপজানের বাড়িতে ঠিকমতো খেতে না পেয়েও আজিমা যে কোথা থেকে এমন অফুরন্ত যৌবন জোটাল, সেটাই এক বিস্ময়ের ব্যাপার। এ ভাবনাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। আগের ভাবনাটা মনের মধ্যে আরও স্পষ্ট হল। রক্ত-মাংস, হাত-পা, ইন্দ্রিয়গ্রাম, যৌবন, স্বাস্থ্য, রূপ নিয়ে যে কোনও একটি খুবসুরৎ মেয়েই তো সাদির পর তার পাশে এসে দাঁড়াতে পারত! দুনিয়ার এত মেয়ে থাকতে আজিমার জন্যেই বা কেন তার পক্ষপাত! রসুল ভাবে, তিনটি বছর ফেচুপুর গ্রামের মাঠে ঘাটে, আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে একটা খবর সে যোগাড় করেছিল। নিকারীপাড়ার মেয়েরা নোনা ইলিশের সঙ্গে এমন কিছু মেশায়, যাতে পচন-গলন লাগে না। নিকারীদের ব্যবসার মগজ নেই। তাই ব্যবসার এমন মন্ত্রগুপ্তি জানা সত্ত্বেও সারা বছর তাদের পাড়ায় হতাশা, দারিদ্র আর মড়ক চক্কর মেরে বেড়ায়। নিকারীদের একটি মেয়েকে সাদি করে এনে যদি মাছের পচা-গলা রোধ করার অমোঘ কায়দাটা শিখে নেওয়া যায়, তা হলে রসুল দোজখ-বেহস্ত-ঘেরা দুনিয়ার মাঝখানে তার নোনা ইলিশের কারবার ছড়িয়ে ফেলতে পারবে। পদ্মা কি মেঘনার তিরিশ-চল্লিশ হাত জলতল থেকে একান্তে অবলীলায় ইলিশ মাছ তুলে আনে রসুল। কিন্তু নিকারীদের মেয়ে বোধহয় মেঘনা-পদ্মার ইলিশের চেয়েও গভীরচারী। সহজে আজিমা ধরা দেয় না। ব্যাবসার গোপন খবরটা জানায় না। আচ্ছা রসুলও পাকা ইলশা-মাঝি, সে-ও দেবে নেবে নিকারীদের মেয়ের দৌড় কত? দেখবে, কবে সে তার জালে ধরা দেয়?

দিন কতক পর কমলাঘাটের বন্দর থেকে রূপার মল আর পৈছা নিয়ে এল রসুল, বলল, এগুলি পর দেখি সোহাগ-বউ। তোরে জবর মানাইব।

দেখি, দেখি–নিমেষে কোমারে পৈছা, পায়ে মল পরে ফেলল আজিমা। নাকে বেশর, কানে বনফুল, হাতের পাতায় মেহেদী, দুটি ঘনপক্ষ্ম চোখ, আজিমাকে বুকের কাছে টেনে গাঢ় গলায় রসুল বলল, তুই কি সোন্দর বউ? আসমান-দুনিয়ায় তোর মতো খুবসুরৎ মাইয়া আর আমি দেখি নাই।

মিছা, মিছা। তুমি আমার মন রাখা কথা কও।

না, না। খোদার কসম। এই তোর গা ছুঁইয়া কই।–একটু থেমে রসুল বেজার গলায় বলল, আমি তোরে এত পিরীত করি, মব্বৎ করি আর তুই আমারে ইটুও পিরীত করিস না। বরাতটাই আমার মন্দ। সাদি করা বউর কাছ থিকা মহব্বৎ মিলে না।

আমি তোমারে পিরীত করি না!–ঝটকা মেরে দূরে সরে যায় আজিমা। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ে। রোষে, ক্ষোভে শ্যামলা রঙের মুখখানা লাল দেখায়। চোখের কোণে নোনা জল টলটল করেঃ কেমনে বুঝলা আমি তোমারে পিরীত করি না?

বুঝি বুঝি! আমি সবই বুঝি। এক বছর সাদি হইছে, তবু বিশ্বাস কইর‍্যা একটা কথা আমারে কইতে পারলি না! ভার-ভার মুখ করে রসুল বলে।

কী কথা!

নোনা ইলিশের লগে কী মিশাইল?

একটুক্ষণ চুপ। তারপর আজিমা বলল, সে কথা কইতে বাপজান বারণ কইরা দিছে। আমি গরিব নিকারীর মাইয়্যা। জানো তো, নোনা ইলিশের ব্যবসার গুণ আছে আমাগো হাতে। আর ওই গুণেই আমাগো সাদি হয়। এই গুণ সকলে জাইন্যা ফেললে নিকারী মাইয়্যার আর সাদি হইব না। এমুন বিশ্বাসঘাতী কাম আমি করুম না।

আমি তোর সোয়ামী। আমারে কইলে কেউ জানব না। কারুরে জানামু না। না যদি কইস, তা হইলে একদিকে যামু গিয়া। ঠিকই যামু, খোদার কসম। বাপজানের বারণ আর এই বাড়িঘর লইয়্যা তুই থাকিস মনের সুখে।নির্বিকার ভঙ্গিতে খোদার নামে কসম খেয়ে বসে রসুল, মুখে চোখে একরোখা ভাব ফুটে বেরোয়।

ছুটে এসে রসুলের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আজিমা : না না, তুমি যাইও না। কমু, নিচ্চয় কমু। শোনো, নোনা ইলিশের লগে কচুরিফুলের রস, আদা আর পেঁয়াজের রস, বিটলবণ মিশাইলে পচন-গলন লাগে না। কইলাম, তোমার উপুর বিশ্বাস রাখলাম। বিশ্বাস রাখা এইবার তোমার ধর্ম।

মাসখানেকের মধ্যে পাঁচশোমণী নৌকা ভরে নোনা ইলিশের চালান নিয়ে আকিয়াব রওনা হল রসুল। দুমাস পরে আকিয়াব থেকে ফিরে সে একেবারে আলাদা মানুষ। ঘরে বসে মদ খায়। চোখ টকটকে লাল। মাথা টলমল করে। পরনে রেশমি লুঙ্গি, ডোরাকাটা পিরহান, কানে আতর, গলায় সিল্কের রুমাল, সরু শিস দিয়ে দিয়ে মৃধাপাড়া, মাঝিপাড়া, ব্যাপারীপাড়ায় শৌখিন খুশির মূর্তি সেজে আবার ঘুরে বেড়াতে লাগল রসুল। নতুন করে দাওয়াত আর মেজবানের পালা শুরু হল। ব্যাপারীদের মেয়ে রোশেনাবানুর উপর নজর পড়েছে রসুলের।

সব–সব খবর কানে আসে আজিমার। নোনা ইলিশের কারবারে লোকজন খাটে। তারাই ঠিক ঠিক খবর যোগায়। প্রথম প্রথম কয়েকদিন আজিমা বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদল।

রসুল ধমকে ওঠে, চুপ কর মাগি। মড়াকান্না কান্দে, কোন নাগর মরছে তোর? চুপ না মারলে গলা টিপে ধরুন।

রসুলের হাল হকিকত দেখে আর দিল-জ্বালানো বোলচাল শুনে কয়েকটা দিন স্তব্ধ হয়ে রইল নিকারীদের মেয়ে আজিমা। তারপর নিজের হক অধিকারের কথাটা স্মরণ করে কঠিন গলায় বলল, বড় যে কুচরিত্তির ইইছ! মদ খাও, ঘরে বউ থাকতে ব্যাপারীপাড়ায় যাও রোশেনাবানুর কাছে! সব খবরই আমার কানে আসে। কিন্তুক মতলবখান কী তোমার?

লাল চোখ তুলে টেনে টেনে হাসে রসুল : সব খবরই তোর কানে আসে। তুই জানিস তোর থিকা রোশেনাবাবু অনেক খুবসুরৎ?

কী কইতে চাও তুমি?–চমকে তাকাল আজিমা।

শোন তা হইলে। সিধা কথাটা সিধা কইর‍্যাই কই। রোশেনাবানুরে আমি নিকাহ করুম।

রোশেনাবানুরে নিকাহ করবা! ফিসফিস গলায় বলল আজিমা। বুকটা ধুক ধুক করল। সমস্ত হৃৎপিণ্ডটা মোচড় দিয়ে উঠল। অসহ্য যন্ত্রণায় দেহ মন ইন্দ্রিয় শিরা স্নায়ুগুলো যেন ছিঁড়ে ছিঁড়ে পড়ছে। রক্ত মেদ হাড়ের বস্তুময় দেহে যেন প্রাণের চিহ্ন নেই আজিমার।

হ।

তা হইলে বাপজানের কাছে আমারে পাঠাইয়া দাও।

একেবারে জন্মের মতোই পাঠাইয়া দিমু। শোন, তোরে তালাক দিমু।

দিন কয়েক পর মুছল্লির যোগসাজসে আর আইনের কারসাজিতে বাইন তালাক দিয়ে দিল রসুল। কালো বোরখায় সারা গা ঢেকে বাপজানের সঙ্গে নিকারীপাড়ায় চলে গেল আজিমা।

মাঝখানে একটা দিন। তারপরেই রোশেনাবানুর বাপ বড় ব্যাপারী এসে বলল, এইবার তা হলে দিন দেখি রসুল মিয়া!

দ্যাখেন! মাস তিনেকের মধ্যে একটা চালান নিয়া আরাকান যামু, সেখান থিকা ফিরা রোজা পাইল্যা নিকাহ করুম-খুসবু তামাকের ডিবে এগিয়ে দিতে দিতে রসুল বলল।

.

আরাকানের বিরাট চালানটা একেবারে বরবাদ হয়ে গেল রসুলের। জোয়ার ভাটা আর উজানি বাতাসের মর্জি এবং মেজাজ খোশ থাকলে আরাকান পৌঁছতে মাস দেড়েক লাগে। কিন্তু পৌঁছবার আগেই মাছে পচন ধরল। সমস্ত বর্ষার যত ইলিশ সে ধরেছে, তা বাদে কর্জ করে আরও অজস্র কিনেছে। সে সব ইলিশ কেটে মেটে হাঁড়ি ভর্তি করে পাঁচশোমনি নৌকো নিয়ে আরাকানের পথে পাড়ি জমিয়েছে রসুল।

আজিমার কাছ থেকে নোনা ইলিশের পচন রোধ করার মন্ত্রগুপ্তি জেনে নিয়েছিল। কিন্তু কতটা পরিমাণ বিটলবণ, কচুরিফুলের রস, আদার রস মেশাতে হবে, সে হিসাবটা শিখে রাখা হয়নি। মনে মনে আপসোসের অন্ত রইল না রসুলের। হাঁড়ি-বোঝাই পচা ইলিশ গাঙের জলে ফেলে ফেচুপুরে ফিরে আসতে হল।

গঞ্জের মহাজনের কাছে প্রচুর ধার। আরাকানের এত বড় চালানটা নষ্ট হল। দিনরাত গুম মেরে বসে থাকে রসুল। কাজকর্মে ফুর্তি নেই। মাসখানেকের মধ্যে চোখ কোটরে ঢুকল, হনু দুটো ফুঁড়ে বেরুল। মুখের টান টান সতেজ চামড়ায় ভাঁজ পড়ল।

প্রথম প্রথম দু-চারদিন বড় ব্যাপারী আসত। বলত, রসুল মিঞা, এইবার সাদিটা চুকাইয়্যা ফেলুন। বেফয়দা দেরি কইর‍্যা লাভ নাই।

রসুল জবাব দিত না, শুধু মাথা নাড়ত। তাতে হানা বোঝার উপায় থাকত না। উদাস চোখে সামনের মজা খাল আর বাজপোড়া ন্যাড়া তালগাছটার মাথায় একটা চিলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকত।

খোঁজখবর নিয়ে রসুলের হাল হকিকত জেনে গেল বড় ব্যাপারী। বাজারে প্রচুর দেনা। আরাকানের চালান বরবাদ। বড় ব্যাপারীর আসা বন্ধ হল।

গ্রামের এক প্রান্তে নিরালা নির্জন পঁচিশ বন্দের ঘরখানায় আরও দিনকতক কাটিয়ে এক নিবুনিবু রোদের বিকেলে নিকারীপাড়ার দিকে পা বাড়িয়ে দিল রসুল। আজিমাকে তালাক দেওয়ার পর এই বাড়ি কি নিরানন্দ, কি শ্রীহীন হয়ে গিয়েছে। তাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। যেমন করেই হোক। আজিমার মুল্যে সে রোশেনাবানুকে চেয়েছিল। কিন্তু কিসমাতের মর্জি বোধ হয় অন্যরকম। রসুলের মনে হল, নিকারীদের মেয়ের মেহেরবানি না পেলে আরাকানের বিরাট চালানটার মতো তার জীবনটা বরবাদ হয়ে যাবে।

নিকারীপাড়ায় যাবার পথে বিশাল রবিশস্যের মাঠ। আলপথে কাসিমালি নিকারীর সঙ্গে দেখা হল। কাসিমালি আজিমার চাচাজান।

ভাঙা ভীরু গলায় রসুল বলল, চাচা, আজিমারে তালাক দিয়া গুনাহ করছি। কসুর মাপ করেন। আজিমারে আবার দেন আমারে। ওরে না পাইলে, এই জনম নষ্ট হইয়া যাইব আমার।

কাসিমালি নিকারীর গলায় বিদ্রূপ ফুটল, মস্করা করেন না কি রসুল মিঞা! বড় ব্যাপারীর মাইয়া রোশেনাবানুর লগে আপনের নিকাহ হইব। সারা গেরামের মানুষ সেই খবর জানে। গরিব মানুষেরে নিয়া খেলা করনের মর্জি এখনও যায় নাই!

না না, চাচা। কোনও মন্দ মতলব নাই আমার আর্তনাদ করে উঠল রসুল। নিবুনিবু রোদের বিকেলটা চমকে উঠল।

রসুলের মুখ চোখ দেখে আর আর্তনাদ শুনে কিছু একটা আন্দাজ করল কাসিমালি নিকারী। সহজ স্বাভাবিক, একটু বা সহানুভূতির সুরেই বলল, কিন্তু কই রসুল মিঞা, দিন তিনেক হইল আজিমার যে আবার নিকাহ হইছে। ফরিদপুরে সোয়ামীর ঘর করতে গেছে আজিমা।–ক্ষিপ্র অস্বাভাবিক দ্রুত পা ফেলে কাসিমালি চলে গেল।

কিছুক্ষণ আচ্ছন্নের মতো দাঁড়িয়ে রইল রসুল। এই দেহে প্রাণ আর যেন বাজছে না। মন চেতনা ভাবনা সব অথর্ব হয়ে গিয়েছে। সারা দেহের হাড় মাংস রক্ত তালগোল পাকিয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। একটু পরে এই ভাবটা কেটে গেলে রসুলের মনে হল, অসহ্য ভয়ানক এক যন্ত্রণা দেহটাকে মনটাকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে দুমড়ে মুচড়ে চুরমার করে দিচ্ছে। এলোমেলো পায়ে টলতে টলতে বাড়ি ফিরে এল রসুল।

পরের দিনই বাড়ি বেচে মহাজনের দেনা শোধ করে ফেচুপুর ছেড়ে চলে গিয়েছিল রসুল। সেই থেকে আর ইলশা-জাল বায় না, নোনা ইলিশের চালান নিয়ে নোয়াখালি কি কক্সবাজারের দিকে পাড়ি জমায় না। নিকারীদের মেয়ে আজিমার সঙ্গে সঙ্গে নোনা ইলিশের ব্যবসার পালা চুকে গিয়েছে। ঘুচে গিয়েছে। ইলিশ মাছের উপর কেমন একটা বিতৃষ্ণা ধরে গিয়েছিল রসুলের। ইলিশ মাছ সে খায় না, ছোঁয় না। দেনা শোধ করে এক-মাল্লাই নৌকা কিনেছিল। সেটা নিয়ে গঞ্জে বন্দরে, চর-চরান্তরে কেরায়া বায়। সওয়ারি পারাপার করে। পদ্মা-মেঘনা ইলশা কালাবদরের ঢেউ কেটে কেটে তার একমাল্লাই ছুটে চলে।

.

তাজ্জবের ব্যাপার। এত বছর পর, বলা যায়, নতুন এক জন্মান্তরে সেই আজিমা যে মিঞা সাহেবের বিবিজান হয়ে তার নৌকার সওয়ারি হবে, এ কথা কি কোনওদিন আন্দাজ করতে পেরেছিল রসুল মাঝি! আজিমার নিকাহর কথা শোনার পর যেমনটি হয়েছিল, ঠিক তেমনি এক দুঃসহ যন্ত্রণা বুকের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে শ্বাসনালীর কাছে ফুলে ফুলে উঠছে।

নিবু নিবু রোদ মুছে গেল। আকাশ নদী জল ঢেউ–সব এখন আবছা, সব অস্পষ্ট। শুধু হাহাশ্বাসের মতো পালে একটানা বাতাস বাজছে।

আজিমা, না-রসুল মাঝি দেখল, মিঞা সাহেবের বিবিজান এখন তেরছা হয়ে ঘুরে বসেছে। শ্যামলা রঙের টলটল মুখ, একরাশ চুল, নাকের বেশর দেখা যাচ্ছে না।

উৎসুক গলায় রসুল মাঝি বলল, মিঞা সাহেবের ঘর কোথায়? কী কাজকাম করেন?

মিঞা সাহেব কিছু বলার আগেই বিবিজান শাণিত কষ্ট গলায় চেঁচিয়ে উঠল, মাঝির আবার অত খবরের দরকার কী?

বড় একটা নিশ্বাস ফেলে রসুল মাঝি বলল, দরকার আর কী বিবিজান? দরকার না থাকলেই কি জানাটা দোষ?

ছটফট করতে করতে ছইয়ের মুখে এল মিঞা সাহেব। তুমি কিছু মনে করো না মাঝি। বউটা আমার ছেলেমানুষ, মাথার ঠিক নাই।–একটু ছেদ, আবার : ফরিদপুরে আমার দেফসলা জমি আছে দুই শো কানি, সুপারি আর পাটের ব্যাপার আছে। খোদার ফজলে দিনকাল ভালোই চলে।

ভালো, ভালো।-ঘন ঘন মাথা নেড়ে রসুল মাঝি বলল, বিবিজান যে আপনের কাছে সুখে আছে, তাই জাইন্যা সুখ। ভালো, ভালো। জবর খোশ খবর।

ঘন রোমশ ভুরু দুটো একটু কুঁচকে গেল। তার পরেই হো হো শব্দে হেসে উঠল মিঞা সাহেব? আমি সুখ দেওনের কে? সবই খোদার মার্জি।

একটুক্ষণ চুপচাপ।

মিঞা সাহেব আবার বলল, গোঁসা হইলা না তো মাঝি?

না।–হালের বৈঠাটা শক্ত মুঠোয় চেপে নিরাসক্ত গলায় জবাব দিল মাঝি রসুল।

অন্ধকার একটু একটু করে ঘন হল। আকাশে একখানা গোল চাঁদ আর তারা দেখা দিল। জলো দুধের মতো ফিকে জ্যোৎস্না আকাশ-নদী মুড়ে রেখেছে।

কাছে দূরে, আরও দূরে ইলশা-ডিঙি ঘুরে বেড়ায়। এখন ইলিশের মরশুম। রাশি রাশি জোনাকির মতো ইলশা-ডিঙির আলোগুলো নদীময় ছুটাছুটি করে।

মনটা কেমন জানি উদাস উদাস লাগে রসুল মাঝির। পালের বাতাসের শব্দ, ঢেউয়ের একটানা শব্দ, মেঘনার রাশি রাশি ইলশা-ডিঙি আর ছইয়ের মধ্যে আজিমা-না না, মিঞা সাহেবের বিবিজান–সব মিলিয়ে এক দুর্বোধ্য অথচ ভয়ানক যন্ত্রণা সমস্ত মনকে অসাড় করে রাখে। জীবন তত তার বরবাদই হয়ে গিয়েছে। রসুল মাঝি ভাবল, নৌকা ডুবিয়ে আজিমার সাধের আর সুখের জীবনটাকে সে দুনিয়া থেকে মুছে দেবে। আবার ভাবল, পাটাতনের নীচে বড় একটা কোঁচ রয়েছে। সেটা দিয়ে মিঞা সাহেবকে কুপিয়ে মেঘনার খরধারায় ভাসিয়ে আজিমাকে নিয়ে সন্দীপ কি হাতিয়ায় পাড়ি জমাবে। অজানা অচিন জায়গায় নতুন করে জীবন শুরু করবে। ভাবল, কিন্তু হালের বৈঠাটা শক্ত মুঠোয় চেপে বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করল না রসুল মাঝি। পারল না।

মাঝখানে জেলেদের কাছ থেকে গোটা দুই ইলিশ মাছ কিনে নিল মিঞা সাহেব।

রাত্রি আরও ঘন হল। চাঁদের আবছা আলো ঢেউয়ের মাথায় মাথায় দোল খায়। ইলশা-ডিঙির আলোগুলো জ্বলে নেবে, নেবে জ্বলে।

লখাইর চর, ভাতারখাকির চর, নাককাটির চর পেরিয়ে চরসোহাগীর চরে নৌকা ভিড়াল রসুল মাঝি। এখন মাথার উপর চাঁদটা উঠে এসেছে।

মিঞা সাহেব আর বিবিজান চরের মাটিতে নামল।

মিঞা সাহেব বলে, চুলা আছে মাঝি?

নিঃশব্দে পাটাতনের তলা থেকে উনুন বের করে দিল রসুল। কাঠকুটো জ্বালিয়ে ভাত চাপিয়ে দিল বিবিজান। পাশে বসে রান্নাবান্নার যোগান দিতে দিতে অবিরাম বকর বকর করে মিঞা সাহেব। আর নৌকার গলুইতে আচ্ছন্নের মতো বসে থাকে রসুল মাঝি। দুর্বোধ্য ভীষণ যন্ত্রণাটা হাড়ে মজ্জায় শিরায় শিরায় পাক দিতে থাকে।

উনুনের গনগনে আগুনে বিবিজানের শ্যামলা মুখখানা লাল দেখায়। নাকের বেশরটা ঝিকমিক করে। এক গোছা এলোমলো চুল সারা গালে মাখামাখি হয়ে রয়েছে। দেখতে দেখতে ইন্দ্রিয়গুলি বিকল হয়ে যায়।

কত কি ভাবে রসুল মাঝি! ফেচুপুর গ্রামের কথা, নিকারীদের মেয়ে আজিমার কথা, বড় ব্যাপারী আর রোশেনাবানুর কথা, আরাকানের বড় চালানটার কথা, আসমান-জমিন একাকার করে নানা কথা ভাবে। সে ভাবনার তল-কুল-বাঁও মেলে না।

অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল রসুল মাঝি। এক দৃষ্টে বিবিজানের দিকে তাকিয়ে রইল। আরও খানিকটা পর মিঞা সাহেব ডাকতে এলঃ মাঝি খাইবা আস।

মিঞা সাহেবের পিছু পিছু সম্মোহিতের মতো উঠে এল রসুল মাঝি। দেহ-মনের উপর নিজের কোনও মজিই ক্রিয়া করছে না। এখন এমন অবস্থা, কেউ তাকে চালনা করলেই তবে সে চলতে পারে।

খেতে বসে ককিয়ে উঠল রসুল মাঝি? আমি যে ইলিশ মাছ খাই না।

হালকা গলায় মিঞা সাহেব বলল, খাও, খাও মাঝি। পয়লা বর্ষার মাছ। জবর স্বোয়াদ। জবর তেল।

কোনও কথা না বলে উঠে দাঁড়াল রসুল মাঝি। আর সহসাই ঘটে গেল ঘটনাটা। কেউ কিছু করবার বা বলবার আগেই। দুটি নধর নরম হাত দিয়ে রসুল মাঝির একটা হাত চেপে ধরল আজিমা। গাঢ়, থামা-থামা, ভেজা গলায় বলল, খাও মাঝি, আমি রান্না করছি। আমি কইতে আছি।

নিরালা নির্জনচর। হু-হুঁ বাতাস। মেঘনার একটানা ঢেউয়ের শব্দ। ফিকে ফিকে আবছা জোছনা। ভাত খেতে খেতে রসুল মাঝির মনে হল, তার চোখ থেকে জল ঝরে ঝরে ইলিশের স্বাদকে বড় নোনা করে তুলেছে।

দুচার গরাস ভাত খেয়ে মুখ তুলল রসুল মাঝি। চোখাচোখি হল। এক রাশ চুল, নাকে সোনার বেশর, কানে বনফুল, শ্যামলা রঙের একটি ঢলঢলে মুখ। দুটি ঘনপক্ষ্ম কালো চোখ তার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রয়েছে। অস্পষ্ট চাঁদের আলোতে রসুলের মনে হল, সে চোখ দুটিতে জল চিকচিক করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *