আগুন

আগুন

চিঠিখানা এসেছে সকালের ডাকে। নীল খামের চিঠি। পাওয়ামাত্রই সেটা খুলতে পারেননি সুনীতি। তখন সে অবকাশ ছিল না।

স্বামী পাবলিক প্রসিকিউটর; সাড়ে দশটায় তাকে কোর্টে হাজিরা দিতে হয়। বড় ছেলে বিমল লক্ষৌয়ে একটা ব্যাঙ্কের বিরাট অফিসার; নটার লোকাল ট্রেনটা ধরতে না পারলে লেট হওয়া অবধারিত। ছোট ছেলে কমল আর একমাত্র মেয়ে সুরভি কলেজে পড়ে; তাদের ক্লাসও এগারোটার মধ্যেই।

এদিকে কপালগুণে যে রাঁধুনিটা জুটেছে তার নড়তে চড়তেই প্রহর কাবার। অতএব সবার সঙ্গে তাল দিয়ে ফিরতে ফিরতে সকালের দিকটা চোখে আর কিছু দেখতে পান না সুনীতি। অবশ্য বড় ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। বউমাটি হয়েছে মনের মতো; সব সময় তাঁর পায়ে পায়ে ঘুরে ঝক্কিগুলো ভাগাভাগি করে নেয়।

যাই হোক অফিসযাত্রী, কলেজযাত্রী আর এজলাসযাত্রীদের যার যার গন্তব্যে পাঠিয়ে দিয়ে খাওয়ার পালা চুকিয়ে যখন খামখানা হাতে নিয়ে বসলেন তখন দক্ষিণায়ণের সূর্য পশ্চিম আকাশের ঢাল বেয়ে অনেকখানি নেমে গেছে। সময়টা অঘ্রাণের মাঝামাঝি; এর মধ্যেই উত্তর প্রদেশের শীত বেশ সমারোহ করেই নামতে শুরু করেছে। রোদটা স্তিমিত, নিষ্প্রভ, অনুজ্জ্বল। বাতাসেও বেশ টান ধরেছে।

খামটা হাতে দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন সুনীতি। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তার নামে চিঠি আসে। দাদারা লেখেন, দিদিরা লেখেন, বাবা-মা লেখেন। তাঁদের হাতের লেখার সঙ্গে তিনি পরিচিত। কিন্তু এই খামটার ওপর যে নাম-ঠিকানা রয়েছে সে হস্তাক্ষর তার সম্পূর্ণ অচেনা। কিছুটা বিস্ময়ের বশে, কিছুটা বা কৌতূহলে নীল আবরণ ছিঁড়ে চিঠিটা বার করে পড়তে লাগলেন সুনীতি।

প্রিয়ংবদে না সুহাসিনী, কী নামে সম্বোধন করব, বুঝে উঠতে পারছি না। এখনও তোমার কথা শুনলে হৃদয় ময়ুরের মতো পেখম মেলে কিনা অথবা হাসলে সুধা ঝরে কিনা, কিছুই জানা নেই। অতএব সম্বোধনের বালাইটুকু বাদ দিলাম।

খবর পেয়েছি চুটিয়ে সংসার করছ। তোমার স্বামী কাড়ি কাড়ি টাকা রোজগার করেন; বড় ছেলেটিও কৃতী হয়েছে। অন্য ছেলেমেয়েরাও বেশ ভালো; বড়বউমাটিও চমৎকার। অতএব আশা করি সুখ আর টাকার টনিকে ফুলে ফুলে একটি মৈনাক পর্বত হয়ে উঠেছ। অবশ্য এটা আমার নিছক অনুমান।

একদিন দেখেছিলাম হরিণীর মতো তোমার চোখ। মেঘের মতো চুল, চম্পাকলির মতো আঙুল, নবীন বর্ষার সজীব লতাটির মতো শরীর। সেই যে তোমাদের কবি কী যেন ছাই বলেছেন, মধ্যে ক্ষীণা, নিম্নে বিশালাঃ, নগ্রোধপরিমণ্ডলা, তা-ই ছিলে তুমি। আমার দেখা তুমি আর আমার অনুমান করা তুমি, এই দুয়ের ভেতর মিল আছে কিনা বড় জানতে ইচ্ছে করছে।

একদিন তো ছিলে সুললিতে রসবতী; প্রাণটি ছিল সরোবরের মতো টলটলে। সে সরোবর মজে হেজে বুজে গেছে কিনা কে বলবে! বুধবার পাঁচটা নাগাত এলাহাবাদ থেকে লক্ষৌ যাবার পথে আমার ট্রেনটা তোমাদের স্টেশনে মিনিট দশেকের জন্য দাঁড়াবে।

যমনাপুলিনে কৃষ্ণকানাইয়ার বাঁশি শুনে শ্রীরাধিকে যেমন লোকলজ্জা ভুলে বেরিয়ে আসত, একদিন আমার ডাকে তুমিও তেমনি আসতে পারতে। আমার সেই সুখের দিন আজ আর আছে কিনা, জানি না। যাই হোক, ইতিতে নামটা দিলাম না। চিনতে পারলে স্টেশনে এসো।

চিঠিখানা পড়ে ভ্রুকুঞ্চিত করলেন সুনীতি; যারপরনাই বিরক্ত হয়েছেন তিনি। তার চিঠি এলে সবাই খুলে পড়ে। ভাগ্যিস আগেভাগে কেউ খোলেনি; খুললে কারো দিকে মুখ তুলে তাকানো যেত না।

ইতির পর নাম নেই, তবু পলকেই চেনা গেল। এমন চিঠি একটি মানুষই নিক্ষেপ করতে পারেন। তিনি সোমনাথ। তার মতো মাত্রাজ্ঞানহীন বাঁচাল-চুড়ামণি জগতে আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ।

সোমনাথের ওপর বিরক্ত হয়েও হঠাৎ উজান টানে জীবনের পিছন দিকে ফিরলেন সুনীতি এবং মুহূর্তে স্মৃতির ভেতর বিভোর হয়ে গেলেন।

এক-আধটা দিন নয়, প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেল। মনে পড়ছে, তখন তাঁর বিয়ে হয়নি। কলকাতায় বাপের বাড়ি। সেখানেই থাকতেন।

বড়দির বিয়ে হয়েছিল হাওড়ায়, মেজদির বর্ধমানে, কিন্তু সেজদির বিয়ে হয়েছিল সুদূর পাঞ্জাবে। চাকরির খাতিরে সেজ জামাইবাবুরা ওখানকার প্রবাসী। বড়দি-মেজদির সঙ্গে প্রায়ই দেখা হত কিন্তু সেজদির পক্ষে পাঞ্জাব থেকে যখন তখন আসা সহজ নয়। বিয়ের পর বার দুই এসে আসাটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর বছর তিনেক চিঠিপত্র ছাড়া আর যোগাযোগ ছিল না।

মনে পড়ছে সেবার বাবার খুব অসুখ। সেজদিকে টেলিগ্রাম করা হয়েছিল। সেজ জামাইবাবু আসতে পারেননি। এক দেওরকে সঙ্গে করে সেজদি চলে এসেছিলেন। সেজদির সেই দেওরটিই সোমনাথ।

সেজদিরা এসে পৌঁছবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাবা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। যাই হোক, এতদিন পর সেজদি আসায় বাড়িতে উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছিল। তবে উৎসবের ঘটাটা তার দেওরটিকে নিয়েই বেশি হয়েছিল।

সেজদির দেওরটি অর্থাৎ সোমনাথ অসাধারণ কৃতী ছাত্র। সে-সময় ইউনিভার্সিটিতে অঙ্কের দুরূহ একটা বিষয় নিয়ে কী গবেষণা করছিলেন। দেখতেও চমৎকার। তীক্ষ্ণ নাক, মেদহীন দীর্ঘ শরীর, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, উজ্জ্বল কপাল, স্বণাভ গাত্রবর্ণ-সব মিলিয়ে আশ্চর্য সুপুরুষ। এটুকুই তাঁর পরিচয় নয়। ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন, আবৃত্তি করতে পারতেন সুন্দর। তাছাড়া ছিলেন অত্যন্ত হাসিখুশি, রগুড়ে, আমোদপ্রিয় এবং বোধহয় কিঞ্চিৎ ফাজিলও। এসেই সবাইকে মাতিয়ে দিয়েছিলেন সোমনাথ।

মনে পড়ে সবার মতো তার সঙ্গেও সোমনাথের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সেজদি। তখন তার কত আর বয়স? খুব বেশি হলে অষ্টাদশীই হবেন। চোখ বড় বড় করে সোমনাথ বলেছিলেন, বোনটি তত তোমার খাসা দেখছি বউদি।

প্রথম পরিচয়ের দিন এভাবে কেউ বলতে পারে, ভাবা যায়নি। মুখ লাল হয়ে উঠেছিল সুনীতির। লজ্জায় জড়সড় হয়ে চোখ নামিয়ে নিয়েছিলেন।

সেজদি ঠোঁট টিপে হেসেছিলেন, তোমার যেন খুব মনে ধরেছে–

ধরেছে বলে ধরেছে। ওই যে কী বলে, মুনিগণ ধ্যান ভাঙি দেয় পদে তপস্যার ফল–সেই রকম দেখতে।

সুনীতি আর বসে থাকতে পারেননি; ছুটে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

সেবার মাসখানেকের মতো থেকে গিয়েছিলেন সেজদি। অগত্যা সোমনাথকেও থাকতে হয়েছিল। চলে যেতে অবশ্য চেয়েছিলেন, বাবা-মা একরকম জোর করেই ধরে রেখেছিলেন।

দিন কয়েক সবাইকে নিয়ে মাতামাতির পর সোমনাথের সমস্ত মনোযোগ এসে পড়েছিল তার ওপর। সর্বক্ষণ তাকে প্রায় ঝালাপালা করে রাখতেন সোমনাথ। এমন একেকটা কথা বলতেন, রসিকতা করতেন যে লজ্জায় সুনীতির মাথা কাটা যেত।

এমনিতেই তার বাপের বাড়ির সংসারটা ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল; মেয়েদের চলাফেরার ব্যাপারে চারদিকে অনেক গন্ডি কাটা ছিল। কিন্তু সোমনাথ আসার পর কড়াকাড়ি বেশ আলগা হয়ে গিয়েছিল। অন্তত সুনীতির পক্ষে।

সোমনাথের আগ্রহে সবাই মিলে একদিন বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাওয়া হয়েছিল পিকনিক করতে। তাছাড়া প্রায়ই কলকাতার একটা করে দর্শনীয় জায়গায় বেড়াতে যেতে হত। অবশ্য রোজ সবার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হত না। তবে সেজদি আর সুনীতি সোমনাথের সঙ্গে বেরুতেনই।

সব চাইতে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, একদিন সোমনাথ একলা তাকে সিনেমায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আরেকদিন নিয়ে গিয়েছিলেন গঙ্গার ধারে। এর আগে দাদা বউদি বা মায়ের সঙ্গে ছাড়া বাড়ির বাইরে একটি পা-ও বাড়াননি। সোমনাথের সঙ্গে বেরুতে গিয়ে লজ্জায়, কুণ্ঠায় আর খুশিতে হৃৎপিণ্ডে এস্রাজে ছড় টানার মতো কিছু একটা হচ্ছিল যা ঠিক মুখের কথায় বোঝানো যায় না। একটা ব্যাপার লক্ষ করেছিলেন সুনীতি; সোমনাথের সঙ্গে বেরুতে কেউ আপত্তি তো করেনইনি, বরং সবাই যেন খুশিই।

ঘরে-বারান্দায় খিলানে-অলিন্দে–বাড়ির সর্বত্র একটা গুঞ্জন শুরু হয়েছিল। গুঞ্জনটা যে তাকে আর সোমনাথকে ঘিরে, একটু কান পাতলেই তা টের পাওয়া যেত। একটি রমণীয় পরিণামের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন সবাই।

মনে আছে সে-সময় কারো দিকে তিনি তাকাতে পারতেন না। শুধু মনে হত ঘুমঘোরে সুখের এক সরোবরে রাজহংসীটির মতো ভেসে বেড়াচ্ছেন।

শুধু বাইরে বেরুনোই নয়, সেজদি আরেক বিপদে ফেলেছিলেন। তার দেবরটি নাকি ভীষণ খেয়ালি, আত্মভোলা গোছের। তার খাওয়া-দাওয়া-স্নান ঠিক মতো হচ্ছে কিনা তা সুনীতিকেই দেখতে হবে। অতএব বাবুর ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই চায়ের পেয়ালাটি নিয়ে শিয়রে দাঁড়াতে হত। স্নানের জন্য সকাল দশটা থেকেই তাগাদা দিতে হত। সময়টা ছিল কার্তিক মাস। ছাদে বসে হিমের মধ্যে রাতের দুটো প্রহরই হয়তো বাঁশি বাজিয়ে গেলেন সোমনাথ, তাড়া দিয়ে তাকে শুতে পাঠাতে হত।

দেখতে দেখতে একটা মাস কেটে গিয়েছিল। একটা মাস বা দীর্ঘ তিরিশটা দিন নয়; মনে হয়েছিল একটা মাত্র নিমেষ। ভোরের বাতাসে বয়ে আসা এক ঝলক সৌরভের মতো দিনগুলো কখন কীভাবে ফুরিয়ে গেছে তা যেন টের পাওয়া যায়নি। যাই হোক, সেজদিরা আর থাকতে পারলেন না। তাদের পাঞ্জাবে ফিরে যেতে হল।

মনে আছে, যাবার আগের দিন ছাদের নিভৃত কোণে দাঁড়িয়ে সামনাথ বলেছিলেন, কাল চলে যাচ্ছি; তবে হৃদয়খানা কলকাতাতেই রেখে গেলাম।

খুব খারাপ লাগছিল সুনীতির; ভয়ানক কান্না পাচ্ছিল। মাত্র কয়েকটা দিনের মধ্যেই সোমনাথ তাঁর প্রাণে গভীর রেখায় কীসের একটা ছাপ ফেলে দিয়েছেন। কঁপা শিথিল সুরে সুনীতি জিগ্যেস করেছিলেন, আবার কবে দেখা হবে?

মাঝখানে বাবা-মা একবার আসবেন। তারপর একেবারে টোপর মাথায় দিয়ে আমার আবির্ভাব হবে। তখন দেখা হবে।

সুনীতি আর কিছু বলতে পারেননি। শুধু মনে হয়েছিল হৃৎপিণ্ড উচ্ছলিত হয়ে কোথায় যেন ঢেউ উঠেছে।

সোমনাথেরা চলে যাবার পর পাঞ্জাব আর কলকাতায় দুপক্ষের অভিভাবকদের মধ্যে বিয়ের ব্যাপারে চিঠি যাওয়া-আসা করেছে। সুনীতি আশায় আশায় থেকেছেন। কিন্তু মাস ছয়েক পর হঠাৎ খবর এসেছিল দুর্লভ একটা স্কলারশিপ পেয়ে সোমনাথ লন্ডন চলে গেছেন। গবেষণার জন্য সেখানে তাঁকে বছর কয়েক থাকতে হবে। শুনে সুনীতি নিভৃতে বসে নীরবে শুধু কেঁদেছেন।

সোমনাথ কবে ফিরবেন তার স্থিরতা নেই। সুতরাং বাবা-মা নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকতে পারেননি। অন্য ছেলের সন্ধান করে তার বিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে উত্তর প্রদেশের এই শহরে চলে এসেছেন সুনীতি। তারপর লম্বা তিরিশটা বছর কেটে গেছে। এখন তিনি পরিপূর্ণ সংসারের মাঝখানে রাজেন্দ্রাণী হয়ে আছেন। সুখ-সৌভাগ্য-বাড়ি-গাড়ি-পরিতৃপ্তি, কোনও কিছুর অভাব নেই। জীবন তার দুহাত ভরে অজস্র দিয়েছে।

সবাই বলে তিনি গম্ভীর, অসাধারণ ব্যক্তিত্বময়ী। সোমনাথের সঙ্গে জড়ানো সেই একটা মাস নিতান্তই ছেলেমানুষি; অতএব অনাবশ্যক। এই তিরিশ বছরে একবারও সে-কথা তিনি স্মরণ করেননি; সেদিনের স্মৃতিকে প্রশ্রয় দেবার মতো কোনও কারণও খুঁজে পাননি সুনীতি।

কাছেই থানা। সেখানকার পেটা ঘড়িতে তিনটে বাজল। স্মৃতিভারে বিভোর সুনীতি চমকে উঠে পড়লেন। আজই তো বুধবার। উঠে ঘরের দিকে যেতে যেতে স্থির করলেন, স্টেশনে যাবেন। সোমনাথকে বুঝিয়ে দিয়ে আসবেন, এ জাতীয় চিঠি তিনি পছন্দ করেন না। বাচালতা-চপলতার জন্য তাকে যথেষ্ট তিরস্কার করবেন।

.

একমাত্র গাড়িখানা নিয়ে স্বামী কোর্টে গেছেন। অতএব টাঙা ডেকে স্টেশনে এলেন সুনীতি। সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনটা এসে পড়ল। উন্মুখ হয়ে এদিক সেদিক তাকাতেই ডাকটা কানে এল, সুনীতি, সুনীতি

চোখ ফেরাতেই সুনীতি দেখতে পেলেন প্রথম শ্রেণির একটি কামরা থেকে মুখ বাড়িয়ে হাতছানি দিচ্ছেন সোমনাথ। তিরিশ বছর আগের মতোই আছেন তিনি, তেমনই উজ্জ্বল সুদীপ্ত চেহারা। শুধু কিছু চুল সাদা হয়েছে। একরকম ছুটেই গাড়িতে উঠে সোমনাথের মুখোমুখি গিয়ে বসলেন সুনীতি।

হাসি হাসি চোখে তাকালেন সোমনাথ, আমার চিঠি তা হলে পেয়েছিলে?

সুনীতি গম্ভীর হতে চেষ্টা করলেন, না পেলে আর এলাম কী করে।

তা বটে। বলে একটু চুপ করে থেকে সোমনাথ আবার শুরু করলেন, অনেক দিন পর দেখা হল। তা তুমি কিন্তু সেদিনের মতোই সুন্দরী রসের আগরী হয়েই আছ।

কথাটা মিথ্যে নয়। তিনটি ছেলেমেয়ের জননী সুনীতি; বয়সও শতাব্দীর অর্ধেক, কিন্তু দেহে সামান্য একটু ভার পড়া আর কটি চুলের রঙ বদলে যাওয়া ছাড়া প্রায় অষ্টাদশীর মতোই আছেন। রাগ করতে গিয়েও চপল হলেন তিন। তরল গলায় বললেন, ফাজলামি হচ্ছে! আমি না হয় রসের আগরী কিন্তু তুমি? তুমি যে নটবরটি হয়ে আছ!

খুব জব্দ করলে যা হোক।

এরপর এলোমেলো অনেক কথা হল। তার মধ্য থেকে সুনীতি যেটুকু জানতে পারলেন, তা এইরকম। সোমনাথ ইদানীং দিল্লিতে সরকারি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল, বিয়ে করেননি। ভৃত্যতন্ত্রের হাতে নিজের সমস্ত দায়িত্ব সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত আছেন।

সব কথা সুনীতি জানতেন না। তার বিয়ের পর থেকে, সেজদির সঙ্গে নিয়মিত চিঠি লেখালেখি হচ্ছে। ইচ্ছা করলে অনায়াসেই এ খবর জানতে পারতেন। কিন্তু সঙ্গত কারণেই ইচ্ছা হয়নি। সেজদিও সোমনাথ সম্বন্ধে একেবারে নীরব থেকেছেন।

সুনীতি বললেন, তা চিরকুমার ব্রত নিলে যে হঠাৎ?

তোমার জন্যে। পদপল্লবে তো আর জায়গা দিলে না।

সুনীতি বিব্রত বোধ করলেন। প্রসঙ্গ বদলের জন্য তাড়াতাড়ি বললেন, যা আত্মভোলা লোক তুমি; কোনওদিকে হুঁশ নেই। দুপুরবেলা খেয়েছিলে তো?

ওই দেখো, একদম ভুলে গেছি। সোমনাথ হাসলেন।

সুনীতি তাড়াতাড়ি প্ল্যাটফর্ম থেকে মিষ্টি আর ফল কিনে সযত্নে সাজিয়ে দিয়ে বললেন, খাও।

খেতে খেতে সোমনাথ সুনীতির সংসার সম্পর্কে প্রশ্ন করে করে কিছু খবর সংগ্রহ করলেন। তারপর হঠাৎ আড়াই যুগ আগে ফিরে গিয়ে বললেন, বউদির সঙ্গে কলকাতায় তোমাদের বাড়ি গিয়ে কটা দিন কি চমৎকারই না কাটিয়ে এসেছিলাম। মনে পড়ে, বোটানিক্যাল গার্ডেনে পিকনিকে গিয়েছিলাম?

সুনীতি চুপ; চোখ নামিয়ে আঙুলে শাড়ির আঁচল জড়াতে লাগলেন।

 সোমনাথ আবার বললেন, মনে পড়ে তোমাকে নিয়ে জীবন-মরণ ছবিখানা দেখতে গিয়েছিলাম?

সোমনাথ বলতে লাগলেন, গঙ্গার ধারে দুজনে বেড়াতে বেড়াতে চাঁদ উঠেছিল; তুমি আস্তে আস্তে একখানা গান গেয়েছিল। সে-সব কথা নিশ্চয়ই তোমার মনে নেই?

খুব আছে, খুব আছে। কিন্তু মুখ ফুটে কী করে তা বলেন সুনীতি? হঠাৎ চোখ তুলে তিনি যেন আবিষ্কার করলেন, এই বিকেল পাঁচটাতেই কার্তিকের সন্ধ্যা ঘনতর হয়ে আসছে; হিমেল বাতাস সাঁই সাঁই বয়ে যাচ্ছে। দেখলেন, সামান্য একটা সুতির জামা পরে আছেন সোমনাথ। বললেন, তোমার গরম পোশাক কোথায়?

সোমনাথ একটা সুটকেস দেখিয়ে দিলেন। সেটা খুলে কোট বার করে সুনীতি বললেন, পরে ফেলো।

পরে পরব।

উঁহু, ভুলে যাবে। তারপর ঠান্ডা লেগে এক কাণ্ড বাধাবে।

সোমনাথ খেতে খেতেই কোট পরলেন। সুনীতি বোতাম আটকে দিলেন।

কিছুক্ষণ পরে সোমনাথ আবার বললেন, কী, আমার কথাগুলোর জবাব তত দিলে না–

সুনীতি কী বলতে যাচ্ছিলেন; সেই সময় বাইরে ট্রেন ছাড়ার প্রথম ঘণ্টি পড়ল। দশটা মিনিট কখন কেটে গেছে, কারো খেয়াল নেই। সোমনাথ চকিত হয়ে বললেন, নামো সুনীতি, ট্রেন ছেড়ে দেবে।

সুনীতি বললেন, আরে বাপু, নামছি।

একটু পরেই দ্বিতীয় ঘন্টি পড়ল। কাণ্ডজ্ঞানহীন সোমনাথ এবার এক কাণ্ডই করে বসলেন; হাত ধরে সুনীতিকে প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে বিপর্যয়টা ঘটে গেল। অভিমানিনী কিশোরীর মতো অবরুদ্ধ সুরে সুনীতি বললেন, চিরদিন আমাকে দূরেই সরিয়ে রাখতে চেয়েছ। সেদিন বিদেশে চলে গেলে। আজও

তার কথা শেষ হতে না হতেই গার্ডের হুইসিল শোনা গেল। ট্রেন ছেড়ে দিল। বিমূঢ় সোমনাথ জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে বিভ্রান্তের মতো তাকিয়ে রইলেন।

একসময় সোমনাথকে নিয়ে ট্রেনটা ডিসট্যান্ট সিগনালের ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেল। আর তখনই আত্মবিস্মৃতির ঘোরটা কেটে গেল সুনীতির। কী করতে এসেছিলেন সোমনাথের কাছে আর এ কী করে গেলেন? নিজের অগোচরে অভিসার করতেই কি বেরিয়েছিলেন সুনীতি? গ্লানিতে, আত্মধিক্কারে নিজের কাছেই অত্যন্ত ছোট হয়ে গেলেন তিনি।

কিন্তু সুনীতি কি জানতেন, সব আগুন নেভে না? ভস্মেই সব আগুনের পরিণাম লেখা নেই? সংসার-সুখ-স্বামী-সন্তান এবং তিরিশটা বছর দিয়ে যে স্ফুলিঙ্গকে তিনি আড়াল করে রেখেছিলেন, কে জানত একটুতেই প্রাণের অতল থেকে ঊর্ধ্বমুখ শিখার মতো তা বেরিয়ে আসবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *