১২ক.
সুরঞ্জন বিছানা ছাড়ে। সকাল দশটায়। সে দাঁত মাজছিল বারান্দায় দাঁড়িয়ে। শুনতে পায় খাদেম আলীর ছেলে আশরাফ কিরণময়ীকে বলছে-মাসিম, আমাদের বাড়ির পুটু কাল সন্ধের দিকে মায়ার মত এক মেয়েকে গেণ্ডারিয়া লোহার পুলের নীচে ভেসে থাকতে দেখেছে।
রঞ্জনের টুথব্রাশ ধরা হাতটি হঠাৎ পাথর হয়ে যায়। সারা শরীরে ইলেকট্রিক কারেন্ট বইলে যেমন লাগে, তেমন লাগে তার শরীরে। ভেতর থেকে কোনও কান্নার শব্দ আসে না। স্তব্ধ হয়ে আছে বাড়িটি। যেন কথা বললেই গমগম করে বাতাসে প্রতিধ্বনি হবে। যেন সে ছাড়া হাজার বছর ধরে এ বাড়িতে কেউ ছিল না। বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সুরঞ্জন বোঝে, গতরাতের বিজয় উৎসবের পর শহরের ঘুম এখনও ভাল করে ভাঙেনি। টুথব্রাশ হাতে নিয়েই সে দাঁড়িয়ে ছিল, হায়দার জার্সি পরে রাস্তায় হাঁটছিল, তাকে দেখে থামে, চোখ পড়েছে বলেই ভদ্রতা করে থামে সে, ধীর পায়ে সামনে আসে, জিজ্ঞেস করে–কেমন আছ?
সুরঞ্জন হেসে বলে—ভাল।
এর পরই মায়ার প্রসঙ্গ উঠবার কথা কিন্তু হায়দার সে প্রসঙ্গ তোলে না। সে রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। কলে–গতকাল শিবিরের লোকেরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলে যে গণকবরের স্মৃতিফলক ছিল তা ভেঙে দিয়েছে।
সুরঞ্জন থুক করে একদলা পেস্ট ফেলে মাটিতে, বলে— গণকবর মানে?
— গণকবর মানে তুমি জানো না? হায়দার বিস্মিত চোখে তাকায় সুরঞ্জনের দিকে।
মাথা নাড়ে সুরঞ্জন, সে জানে না। অপমানে হায়দারের মুখ নীল হয়ে ওঠে। সে বুঝতে পারে না। সুরঞ্জন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্রের নেতা হয়েও গণকবর মানে জানে না বলছে কেন। শিবিরের লোকেরা গণকবরের স্মৃতিফলক ভেঙে দিয়েছে, ভেঙে দিক। ওদের হাতে অস্ত্ৰ এখন, অস্ত্ৰ ওরা কাজে লাগাচ্ছে, কে বাধা দেবে ওদের! ধীরে ধীরে ওরা ভেঙে ফেলবে অপরাজেয় বাংলা, স্বোপার্জিত স্বাধীনতা, ভেঙে ফেলবে সাবাস বাংলাদেশ, জয়দেবপুরের মুক্তিযোদ্ধা। এত বাধা দেবে কে? দু-একটা মিছিল মিটিং হবে। জামাত শিবির যুব কমান্ডের রাজনীতি বন্ধ হোক’ বলে কিছু প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল চিৎকার করবে-এই তো! এতে কি হবে, সুরঞ্জন মনে মনে বলে কচু হবে।
হায়দার মাথা নীচু করে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবার পর বলে–শুনেছি তো, পারভিন এখন এখানে। ওর ডিভোর্স হয়ে গেছে।
সুরঞ্জন শোনে, বিনিময়ে কিছু বলে না। পারভিনের ডিভোর্স হওয়াতে তার কোনও কষ্ট হয় না। বরং মনে হয় বেশ হয়েছে। মজা হয়েছে। হিন্দুর কাছে বিয়ে দাওনি, মুসলমানের কাছে দিয়েছিলে, এখন কেমন? পারভিনকে সে মনে মনে একবার রেপ করে। এই সকলে দাঁত মাজা অবস্থায় রেপ তেমন স্বাদের হয় না, তবু মনে মনের রেপ-এ স্বাদ থাকে।
হায়দার কিছুক্ষণ পর বলে—চলি। হায়দারের চলে যাওয়ায় সে আপত্তি করে না।
সুধাময় এখন উঠে বসতে পারেন। পেছনে বালিশ রেখে শব্দহীন বাড়িটির শব্দ শোনেন। সুধাময়ের মনে হয় এ বাড়িতে সবচেয়ে বেশি বেঁচে থাকবার সাধ ছিল মায়ার। তাঁর এই দুর্ঘটনাটি না ঘটলে মায়াকে পারুলের বাড়ি থেকে আসতে হয় না, এমন নিখোঁজও হতে হয় না। ওকে নাকি কে লোহার পুলের নীচে পড়ে থাকতে দেখেছে। কিন্তু লাশ দেখতে যাবে কে? সুধাময় জানেন কেউ যাবে না। কারণ সকলে বিশ্বাস করতে চায় একদিন নিশ্চয়ই ফিরে আসবে মায়া। যদি পুলের নীচে পড়ে থাকা লাশটি মায়ারই হয়, তবে তো চিরকালের মত একটি আশা অন্তত বুকে করে বাঁচতে পারবে না। ওঁরা যে মায়া ফিরবে, আজ হোক কাল হোক পরশু হোক ফিরবে, এক বছর দু বছর পাঁচ বছর পর হলেও ফিরে আসবে মায়া। কিছু কিছু আশা আছে মানুষকে বাঁচায়, এই সংসারে বেঁচে থাকবার অবলম্বন এত কম, সামান্য কিছু আশা অন্তত থাক। সুরঞ্জনকে অনেকদিন পর তিনি কাছে ডাকেন। পাশে বসতে বলেন। ভাঙা কণ্ঠে বলেন—দরজা জানালা বন্ধ করে থাকতে বড় লজ্জা হয়।
–তোমার লজ্জা হয়? আমার তো রাগ হয়।
—তোর জন্যও বড় দুশ্চিন্তা হয়! সুধাময় ছেলের পিঠে বাঁ হাতটি রাখতে চান!
কেন?
রাত করে ঘরে ফিরছিস। কাল হরিপদ এসেছিল, ভোলায় নাকি খুব খারাপ অবস্থা। হাজার হাজার লোক খোলা আকাশের নীচে বসে আছে, বাড়িঘর নেই। মেয়েদেরও নাকি রেপ করছে।
—এসব কি নতুন খবর ?
—নতুনই তো। এসব কি আগে কখনও ঘটেছে ? তাই তো তোকে নিয়ে ভয় সুরঞ্জন।
–আমাকে নিয়েই ভয় ? কেন তোমাদের জন্য ভয় নেই। তোমরা হিন্দু নও ?
–আমাদের আর কি করবে ?
—তোমাদের মুণ্ডু বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে। এখনও চেননি এ দেশের মানুষকে, হিন্দু পেলে ওরা নাস্তা করবে, বুড়ো ছেলে মানবে না।
সুধাময়ের কপালে বিরক্তির ভাঁজ। তিনি বলেন—এ দেশের মানুষ কি তুই নস?
–না। আমি নিজেকে আর এ দেশের মানুষ ভাবতে পারছি না। খুব চাইছি ভাবতে। কিন্তু ভাবা সম্ভব হচ্ছে না। আগে কাজলদারা বৈষম্যের কথা বলত, খুব মেজাজ খারাপ করতাম। বলতাম বাজে কথা রাখুন তো, দেশে বড় বড় অনেক কাজ আছে, কোথায় হিন্দুদের কি হচ্ছে ক’জন মরছে এসব নিয়ে সময় খরচা করার কোনও মানে আছে ? ধীরে ধীরে দেখছি ওরা ভুল বলে না। আর আমিও কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি। এরকম হওয়ার কথা ছিল না বাবা। সুরঞ্জনের কণ্ঠস্বর বুজে আসে।
সুধাময় হাত রাখেন ছেলের পিঠে। বলেন–মানুষ তো রাস্তায় নামছে। প্রতিবাদ হচ্ছে। কাগজে বিস্তর লেখালেখিও হচ্ছে। বুদ্ধিজীবীরা প্রতিদিন লিখছেন।
—এসব করে ছাই হবে। সুরঞ্জনের গলায় রোষ।
দা কুড়োল নিয়ে নেমেছে একদল আর ওদের বিরুদ্ধে হাত উচিয়ে গলা ফাটালে লাভ হবে না কিছু। দায়ের প্রতিবাদ দা দিয়ে হয়। অস্ত্রের সামনে খালি হাতে লড়াই করতে চাওয়া বোকামি।
–আমরা কি আদর্শ বিসর্জন দেব ?
—আদর্শ আবার কি ? বোগাস জিনিস।
সুধাময়ের চুলে এ ক’দিনে আরও পাক ধরেছে। গাল ভেঙে গেছে। স্বাস্থ্য অর্ধেক নেমে এসেছে। তবু মন ভাঙে না তাঁর। বলেন—এখনও তো অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে কথা বলছে মানুষ। এই শক্তিটি কি সব দেশে আছে ? প্রতিবাদ করার অধিকার ?
সুরঞ্জন কথা বলে না। সে অনুমান করে ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ নামটি উঠে গিয়ে খুব শিগরি এটি ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’-এ পরিণত হবে। দেশে বিরাজ করবে শরিয়তি আইন। মেয়েরা বোরখা পরে রাস্তায় বেরোবে, টুপি দাড়ি পাঞ্জাবিঅ’লা লোক বেড়ে যাবে দেশে, স্কুল কলেজের বদলে শনৈ শনৈ বাড়বে মসজিদ মাদ্রাসা, হিন্দুদের নীরবে ধ্বংস করে দেবে, ভেবে সে শিউরে ওঠে। কুনো ব্যাঙের মত ঘরে বসে থাকতে হয়। বাইরে আন্দোলন দেখলে, প্রতিবাদ প্রতিশোধের শব্দ শুনলে সামিল না হয়ে দরজায় খিল এঁটে বসতে হয়। কারণ তাদের বেলা রিস্ক বেশি। মুসলমানরা অসঙ্কোচে দাবি আদায়ের শ্লোগান দিতে পারে, হিন্দুরা তা পারে না। হিন্দুদের ওপর অবিচার হচ্ছে এই কথাটি যত জোরগলায় একজন মুসলমান বলতে পারে, তত জোরে হিন্দুরা পারে না। কারণ তার গলা আটকে আসে বলতে গেলে, কখন আবার কে রাতের আঁধারে এই জোরগলার জন্য গলাখানি কেটে রেখে যায়, বলা যায় না। আহমদ শরীফকে মুরতাদ ঘোষণা করেও বাঁচিয়ে রাখে ওরা, কিন্তু সুধাময় উল্টোসিধে কথা বললেই নিঃশব্দে কতল হয়ে যেতে হবে। হিন্দুকে অতি মারমুখো দেখলে মৌলভিরা তো নয়ই, কোনও প্রগতিবাদী মুসলমানও তা সহ্য করবে না। সুরঞ্জনের ভেবে হাসি পায় প্রগতিবাদীরা আবার হিন্দু বা মুসলমান নাম ধারণ করে। সুরঞ্জন নিজেকে একজন আধুনিক মানুষ ভাবত। এখন কেমন হিন্দু হিন্দু লাগে নিজেকে। সে কি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? সে বোধহয় নষ্টই হয়ে যাচ্ছে। সুধাময় সুরঞ্জনকে তাঁর আরও কাছে সরে আসতে বলেন, ভাঙা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন–মায়াকে কি কোথাও পাওয়া যাবে না খুঁজে?
—জানি না।
—কিরণ তো সেই থেকে একটি রাতও ঘুমোয় না। আর তোকে নিয়েও ভাবে। এখন তোর কিছু হলে….
—মরে গেলে মরে যাব। কত লোকই তো মরছে।
—এখন একটু বসতে পারি, কিরণ ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যায়। পুরো সুস্থ না হলে রোগী দেখাও তো সম্ভব নয়। দু মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি। তুই একটা চাকরি-বাকরি…
—পরের গোলামি আমি করব না।
—সংসারটা আসলে.আমাদের সেই জমিদারিও তো আর নেই। গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, গোয়ালভরা গরুর স্বাদ আমরা পেয়েছি। তোদের কালে আর কী দেখেছিস; গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে ফেলেছিলাম, সেগুলো থাকলেও তো শেষ বয়সে গ্রামে গিয়ে শনের একটি ঘর তুলে বাকি জীবন পার করা যেত।
সুরঞ্জন ধমকে ওঠে–বোকার মত কথা বলছি কেন? গ্রামে গিয়েই বা তুমি বাঁচতে পারতে নাকি? মাতব্বরের লেঠেলরা তোমার মাথায় লাঠি মেরে সব কেড়ে নিত না!
–সবাইকে এত অবিশ্বাস করছিস কেন? দেশে কি দু-একটা ভাল লোকও নেই?
–না নেই।
—তুই অযথা হতাশায় ভুগছিস।
— অযথা নয়।
—তোর বন্ধুবান্ধব? এতকাল যে কম্যুনিজমের ওপর লেখাপড়া করলি, আন্দোলন করলি, যাদের সঙ্গে চললি ফিরলি, ওরা কেউ ভালমানুষ নয়?
—না কেউ নয়। সবাই কম্যুনাল।
—আমার মনে হয় তুইও কিছু কম্যুনাল হয়ে যাচ্ছিস?
–হ্যাঁ হচ্ছি। এই দেশ আমাকে কম্যুনাল করছে। আমার দোষ নেই।
—এই দেশ তোকে কম্যুনাল করছে? সুধাময়ের কণ্ঠে অবিশ্বাস ভর করে।
–হ্যাঁ দেশ করছে। সুরঞ্জন দেশ শব্দটির ওপর জোর দেয়। সুধাময় চুপ হয়ে যান। সুরঞ্জন ঘরের ভাঙা জিনিসগুলো দেখে। ভাঙা কাচ এখনও মেঝোয় ছড়ানো। পায়ে বেঁধে না এসব? পায়ে না বিঁধলেও মনে তো বেঁধে!
১২খ.
সারাদিন ঘরেই শুয়ে থাকে সুরঞ্জন। তার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। কারও সঙ্গে কথা বা যে সময় কাটাবে, সে ইচ্ছেও নেই। একবার কি যাবে লোহার পুলে, একবার তাকাবে নীচের দিকে, মায়ার গলে যাওয়া ফুলে ওঠা শরীরটি দেখতে? না, সে আজ কোথাও যাবে না।
দুপুর পার হলে সুরঞ্জন বাড়ির পাকা উঠোনটিতে হাঁটে। একা এক উদাস হাঁটে। একসময় ঘরে গিয়ে ঘরের বই সব উঠোনে ফেলে। কিরণময়ী ঘরে বসে ভাবেন ও বোধ হয় বই রোদে দিচ্ছে, পোকায় কাটা বই। দাস ক্যাপিটাল, লেনিন রচনাবলি, এঙ্গেলস মার্কস-এর রচনা, মরগ্যান, গোর্কি, দস্তয়েভস্কি, টলস্টয়, জ্যাঁ পল সার্ত্র, পাভলভ, রবীন্দ্রনাথ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নেহরু, আজাদ…সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, রাজনীতি, ইতিহাসের থানইট সাইজ বইগুলোর পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে উঠোনে ছড়ায় সুরঞ্জন, জড়ো করে, তারপর ম্যাচের একটি কাঠি জ্বেলে ওতে ফেলে। হিন্দু পেলে উগ্র মুসলমান মৌলবাদী যেমন জ্বলে ওঠে, কাগজ পেলে আগুনও তেমনই দাউ দাউ জ্বলে ওঠে। কালো ধোঁয়ায় ভরে যায় উঠেন। পোড়া গন্ধ পেয়ে দৌড়ে আসেন কিরণময়ী। সুরঞ্জন হোসে বলে—আগুন তাপাবে? এস।
–কিণময়ী অস্ফুট কণ্ঠে বলেন—তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?
–হ্যাঁ মা। অনেকদিন ভালমানুষ ছিলাম তো। এবার পাগল হচ্ছি। পাগল না হলে মনে শান্তি পাওয়া যায় না।
কিণময়ী দরজায় দাঁড়িয়ে সুরঞ্জনের যজ্ঞধূম দেখেন। তিনি যে কলতলা থেকে বালতি করে জল এনে আগুনে ফেলবেন, এই বোধও তাঁর লোপ পায়। কালো ধোঁয়ার আড়ালে সুরঞ্জনের শরীর ঢেকে যায়। কিরণময়ীর মনে হয়, সুরঞ্জন আসলে বই নয়, নিজেকে পোড়াচ্ছে।
সুধাময় ভাবেন প্রখর মেধার প্রাণবান ছেলেটি যে নিজেই বিষহরা মন্ত্রের কাজ করত, সে এখন পান করছে বিষ, বিষ পান করে করে ও নীল হয়ে যাচ্ছে, তার নিঃশব্দে শুয়ে থাকা বন্ধুদের সঙ্গে চেঁচিয়ে কথা বলা, রাতে মেয়ে নিয়ে ঘরে ঢোকা, মুসলমানদের গালাগাল করা, বই পোড়ানো…সুধাময় বোঝেন সুরঞ্জন আসলে অভিমান করেছে খুব। সংসার, সমাজ, রাষ্ট্র সকল কিছুর ওপর তীব্র অভিমান করে ও নিজেকে পোড়াচ্ছে হীনমন্যতার অন্ধ আগুনে।
সুরঞ্জনের বেশ আনন্দ হয় আগুন দেখতে। দেশ জুড়ে হিন্দুর বাড়িঘর এমন আগুনেই পুড়েছে। এমন লেলিহান আগুনে। কেবল কি বাড়িঘর আর মন্দিরই পুড়েছে, মানুষের মন পোড়েনি? সুধাময়ের আদর্শ ধুয়ে সুরঞ্জন আর জল খাবে না। সুধাময় বামপন্থী মানুষ, সুরঞ্জনও গড়ে উঠেছিল একই বিশ্বাসে। এসব এখন আর বিশ্বাস করে না সে। সে অনেক বামপন্থীকেও তাকে গাল দিতে দেখেছে ‘শালা মালউন’ বলে। ‘মালাউন’ শব্দটি সে স্কুল থেকে শুনে আসছে। ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক লাগলেই ওরা দু-এক কথার পরই বলত ‘মালাউনের বাচ্চা’। সুরঞ্জনের চোখ জ্বালা করে জল জমে উঠে সে বুঝে পায় না। এই জল কি কোনও কষ্ট থেকে এল, নাকি আদর্শ পোড়া ধোঁয়া থেকে! পোড়া শেষ হলে সুরঞ্জন স্বস্তির শ্বাস ফেলে। শুয়ে থেকে থেকে এই বইগুলোর ওপর এ ক’দিনে যখনই তার চোখ পড়েছে, বইগুলো থেকে নানারকম নীতিকথার কীট তাকে কুরে খেয়েছে। সে আর নীতি-ফীতি মানে না। কষে একটি লাথি লাগাতে পারত যদি এতকালের বিশ্বাসের ওপর। কেন সে ধারণ করবে এসব, জ্ঞানের পেয়ালা মানুষ ঠোঁট পর্যন্ত ঠেকায়, অন্তরে নেয় না। অন্তরে একা নেবে কেন সে?
যজ্ঞ শেষে লম্বা একটি ঘুম দিতে চায় সে। ঘুম আসে না। রত্নাকে মনে পড়ে। অনেকদিন দেখা হয় না। কেমন আছে মেয়েটি। রত্নার গভীর কালো চোখদুটো পড়া যায়, ওর আর কথা বলবার প্রয়োজন হয় না। ও নিশ্চয়ই ভাবছে হঠাৎ একদিন ওর বাড়ির দরজায় কড়া নাড়বে সুরঞ্জন, চায়ের সঙ্গে জীবনের গল্পগুলো পেতে বসলে রাত পার হয়ে যাবে। সুরঞ্জন ভাবে আজ রাতে সে যাবে রত্নার বাড়িতে। বলবে—কেবল কি আমিই দেখতে আসব? আর কারও কি ইচ্ছে করে না কাউকে দেখতে যাবার?
সুরঞ্জনের বিশ্বাস হয় রত্না হঠাৎ এক বিষয় বিকেলে তার বাড়িতে উঠবে এসে বলবে–কেমন জানি খালি খালি লাগে সুরঞ্জন ৷ ‘ সুরঞ্জনকে কতদিন চুমু খায় না কেউ। পারভিন খেত। পারভিন তাকে জড়ীয়ে ধরে বলত, ‘তুমি আমার, আমার, আমার ছাড়া আর কারও না, তোমাকে আজ একশ চুমু খাব।‘ ঘরে হঠাৎ কিরণময়ী ঢুকে পড়লে ওরা বিযুক্ত হত। মুসলমানের সঙ্গে বিয়ে হলে বুট-ঝামেলা নেই, সেরকম জীবনই সে বেছে নিয়েছিল। রত্নার তো আর ‘জাত’-এর প্রবলেম নেই। ওর কাছেই সমৰ্পণ করবে। এই পোড়খাওয়া জীবন। সুরঞ্জন যখন এরকম ভাবছে, আজ রাতে সে যাবে, শরীরে যত বুল কালি জমেছে। সব ধুয়ে, ধোয়া একটি শার্ট গায়ে দিয়ে সে রত্নার বাড়িতে যাবে–তখনই দরজায় টোকা পড়ে। দরজা খুলে দেখে রত্না দাঁড়িয়ে আছে। বেশ সেজেছে। ঝকমকে শাড়ি, হাত ভর্তি চুড়ি, রিন রিন করে বাজলও বোধহয়। রত্না মিষ্টি করে হাসছে, ওর হাসি সুরঞ্জনকে বিস্মিত ও অভিভূত করে। ‘আসুন ভেতরে আসুন’ বলতে বলতেই সে লক্ষ করে সুদৰ্শন এক ভদ্রলোক রত্নার পেছনে দাঁড়ানো।
রত্নাকে সে বসাবে কোথায়। যে বিচ্ছিরি অবস্থা ঘরের। তবু ‘বসুন বসুন’ বলে ভাঙা চেয়ারটি এগিয়ে দেয়। রত্না হেসে বলে—বলুন তো কাকে নিয়ে এসেছি?
রত্নার দাদাকে দেখেনি সুরঞ্জন। ভাবে সে-ই কি না। সুরঞ্জনকে বেশি ভাবতে দেয় না। রত্না, তার হাতের চুড়ির মত রিন রিন হেসে বলে—ওর নাম হুমায়ুন, আমার বর।
বুকের মধ্যে মুহুর্তে এক ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়, ঝড়ে তার যে শেষ বৃক্ষটি ছিল আকড়ে ধরবার, সেটিও শেকড়সুদ্ধ উপড়ে পড়ে। জীবনের অনেকটা বছর হেলায় হারিয়ে বড় ইচ্ছে ছিল বাকি জীবন রত্নাকে নিয়ে একটি ছোটখাট সংসার করবে। আর রত্না কিনা মুসলমান স্বামী নিয়ে এই সন্ত্রাসের দেশে বেঁচে থাকবার বিকল্প ব্যবস্থা নিয়েছে! সুরঞ্জন অপমানে ক্ৰোধে নীল হয়ে ওঠে। সে এখন তার এলোমেলো দরিদ্র ঘরটিতে রত্না আর তার সুদৰ্শন সম্ভবত বিত্তবানও, স্বামীকে বসিয়ে ভালমানুষের মত ভাল ভাল কথা বলবে, তার সঙ্গে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করবে, চা খেতে দেবে, যাবার সময় হেসে বলবে ‘আবার আসবেন’! না, সুরঞ্জন এসব কিছুই করবে না। এসব ভদ্রতা তার করতে ইচ্ছে করছে না। সে হঠাৎ ঘরের অতিথি দুজনকে অবাক করে দিয়ে বলে—’আমি খুব জরুরি কাজে বাইরে বেরোচ্ছি, আপনাদের সঙ্গে কথা বলার সময় আমার নেই।‘ ওরা এত অপমানিত হয় যে ‘দুঃখিত বলে দ্রুত বেরিয়ে যায়। সুরঞ্জন দরজার পাল্লাদুটো শব্দ করে লাগায়, লাগিয়ে পিঠ ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, তার সম্বিত ফেরে কিরণময়ী ঘরে ঢুকে যখন বলেন–যে টাকা কটা ধার করেছিলি, ফিরিয়ে দিয়েছিস তো? ‘ধার’ শব্দটি বিষমখা তীরের মত বেঁধে সুরঞ্জনের বুকে। সে কিরণময়ীর উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকায় শুধু, কিছু বলে না।
রঞ্জনের বড় দমবন্ধ লাগে। ঘরটি যেন একটি লোহার বাক্স, খুলে সে বেরোতে পারছে না। বরান্দায় হাঁটে কিছুক্ষণ, তবু তার ওপর শ্রাবণের বৃষ্টির মত কেঁপে নামে এক আী শ দুঃখ। কিরণময়ী নিঃশব্দে এক কাপ চা রেখে যান টেবিলে। সুরঞ্জন দেখে, কিন্তু চাত্রে দিকে হাত বাড়ায় না। খানিকক্ষণ শোয়, আবার ওঠে, সে কি একবার লোহার পুল যাব? লোহার পুলের কথা ভাবতে গেলেই বুক কেঁপে ওঠে, মনে হয় তারও লাশ বুঝি গলে পচে পড়ে থাকবে নীচের নর্দমায়। বাড়িটি একটি স্থবির ডোবার মত নিস্তব্ধ। জহির ওপর জলপোকা যেমন নিঃশব্দে চলে, নিস্তব্ধতার মধ্যে বাড়ির তিনটি প্রাণী তেমন জলপাকার মত হাঁটে, কেউ কারও পায়ের শব্দ শুনতে পায় না।
হঠাৎ সব ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা ভেঙে দেন কিরণময়ী। কোনও কারণ নেই, কিছু নেই, সুধাময়কে তিনি এক কাপ চা দিয়েছেন কিছুক্ষণ আগে–তিনি কেঁদে ওঠেন, তাঁর কান্নার তীব্র শব্দে সুধাময় চকিতে উঠে বসেন, সুরঞ্জন ছুটে আসে। দেখে কিরণময়ী ঘরের দেয়ালে মাথা রেখে কাঁদছেন, তার সাহস হয় না এই কান্না থামাতে, এ কান্না থামবার নয়, এই কান্না কেঁদে যাবার, দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনীর জল যখন জমতে জমতে বুকের নদী উঠি পড়তে চায়, কোনও বাঁধ থাকে না তাকে আটকে রাখে। সুধাময়ও নতমুখ, স্থির; কান্না থেকে উঠে আসা তীব্ৰ হাহাকার তাঁর বুকেও গিয়ে বেঁধে। কান্না থামে না। কেন কাঁদছেন কিরণময়ী কেউ জিজ্ঞেস করে না; কেন তাঁর এত বুকফাটা আর্তনাদ, তা সুধাময় সুরঞ্জন দুজনই যেন জানে, তাদের আর জানিবার দরকার হয় না।
সুরঞ্জন দরজায় দাঁড়িয়েছিল, নিঃশব্দে ঘরে ঢোকে যেন কিরণময়ীর কান্না তার পায়ের শব্দে থেমে না যায়। তাঁর ভেতরের ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ে, চূর্ণ হয়, পুড়ে যায়, ছাই হয়ে যায় তার সাজানো স্বপ্ন। কিরণময়ী যেমন হঠাৎ বাড়িটির নিস্তব্ধতা ভেঙে কেঁদে উঠছেন, তেমন সুরঞ্জনও হঠাৎ কান্না ভেঙে চিৎকার করে ওঠে–বাবা।
সুধাময় চমকে তাকান। সুরঞ্জন তাঁর দুটো হাত চেপে ধরে, বলে–বাবা, আমি কাল সারারাত একটা কথা ভেবেছি, তুমি আমার কথা রাখবে না জানি। তবু বলছি তুমি আমার কথা রাখো। কথাটা রাখো বাবা। চল আমরা চলে যাই।
সুধাময় জিজ্ঞেস করেন—কোথায়?
–ইন্ডিয়া।
–ইন্ডিয়া? সুধাময় এমন আঁতকে ওঠেন যেন অদ্ভুত একটি শব্দ শুনলেন তিনি, যেন ইন্ডিয়া অত্যন্ত অশ্লীল একটি শব্দ, একটি নিষিদ্ধ শব্দ, এটি উচ্চারণ করা অপরাধ।
কিরণময়ীর কান্না ধীরে ধীরে থেমে আসে। গোঙাতে থাকেন। তিনি, গোঙাতে গোঙাতে মেঝেয় উপুড় হয়ে পড়ে। সুধাময়ের কপালে বিষম বিরক্তির ভাঁজ, বলেন–ইন্ডিয়া তোর বাবার বাড়ি না ঠাকুদদার বাড়ি? তোর চৌদ্দ গোষ্ঠীর কার বাড়ি ইন্ডিয়া যে ইন্ডিয়া যাবি? নিজের দেশ ছেড়ে পালাতে চাস, লজ্জা করে না?
–দেশ ধুয়ে জল খাব বাবা? দেশ তোমাকে কি দিচ্ছে? কি দিচ্ছে আমাকে? মায়াকে কি দিয়েছে তোমার এই দেশ? মা’কে কেন কাঁদতে হয়? তোমাকে কোন রাতে রাতে গোঙাতে হয়? আমার কেন ঘুম আসে না?
–দাঙ্গা তো সব দেশেই হয়। ইন্ডিয়ায় হচ্ছে না? ওখানে মরছে না মানুষ? কত লোক মরছে খবর রাখিস?
–দাঙ্গ তো ভাল জিনিস বাবা, এখানে দাঙ্গা হচ্ছে না, এখানে মুসলমানরা হিন্দুদের মারছে।
—নিজেকে হিন্দু ভাবছিস তুই? সুধাময় উত্তেজিত হয়ে বিছানা থেকে উঠতে চান। তাঁকে দু হাতে থামিয়ে সুরঞ্জন বলে—যত নাস্তিকই হই আমরা যত মানবতাবাদীই হই লোকে আমাদের হিন্দুই বলবে। মালাউনই বলবে। এই দেশকে যত ভালবাসাব, যত আপন ভাবব, এই দেশ আমাদের তত দুরে সরাবে। মানুষকে যত ভালবাসাব, মানুষ তত একঘরে করবে আমাদের। এদের বিশ্বাস নেই বাবা। তুমি তো কত মুসলমান পরিবারকে বিনে পয়সায় চিকিৎসা কর। এই দুর্যোগের দিনে তারা ক’জন তোমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে? আমাদের সবাইকে মায়ার মত লোহার পুলের নীচে মরে পড়ে থাকতে হবে। বাবা, চল চলে যাই। সুরঞ্জন ঝুঁকে পড়ে সুধাময়ের ওপর।
–মায়া ফিরে আসবে।
—মায়া ফিরবে না বাবা। মায়া ফিরিবে না। সুরঞ্জনের কণ্ঠ থেকে এক থোকা কষ্ট উঠে আসে।
সুধাময় শুয়ে পড়েন। শিথিল হয়ে পড়ে শরীর তাঁর। বিড়বিড় করে বলেন–মায়াকেই যদি রক্ষা করা গেল না, কাকে রক্ষা করতে যাব?
— নিজেদের। যেটুকু হারিয়েছি, সেটুকুর জন্য শোক করার জন্য এখানে বসে থাকব? এই ভয়ঙ্কর নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে? তার চেয়ে চল চলে যাই।
—ওখানে কি করব?
–ওখানে যা হোক কিছু করব। এখানেই বা কি করছি? আমরা কি খুব ভাল আছি? খুব সুখে?
—শেকড়হীন জীবন।
—শেকড় দিয়ে কি করবে বাবা? শেকড় দিয়ে যদি কিছু হোতই তবে ঘরের দরজা জানোলা বন্ধ করে বসে থাকতে হয় কেন? সারা জীবন এমন কুনো ব্যাঙের জীবন কাটাতে হবে। এরা কথায় কথায় আমাদের বাড়িঘরে হামলা করার, আমাদের জবাই করার অভ্যোস রপ্ত করে ফেলেছে। এরকম ইঁদুরের মত বেঁচে থাকতে আমার লজ্জা হয় বাবা। বড় রাগ হয়। আমি কিছু করতে পারি না। রাগ হলে আমি কি ওদের দুটো বাড়ি জ্বালিয়ে দিতে পারব? আমরা কি এমন বোকার মত তাকিয়ে তাকিয়ে আমাদের সর্বনাশই দেখব? কথা বলার, কোনও মুসলমান আমার গালে এক চড় দিলে তাকে উল্টে চড় দেবার অধিকার কি আমার আছে? চল চলে যাই।
—-এখন তো শাস্ত হয়ে আসছে পরিস্থিতি। এত ভাবছিস কেন? আবেগে ভর করে জীবন চলে না।
–শান্ত হয়ে আসছে? সব ওপরে ওপরে। ভেতরে হিংস্ৰতা আছেই। ভেতরে ভয়ঙ্কর দাঁত নখ বের করে ওরা ফাঁদ পেতে আছে। তুমি ধুতি ছেড়ে আজ পাজামা পর কেন? কেন তোমার ধুতি পরবার স্বাধীনতা নেই? চল চলে যাই।
সুধাময় দাঁতে দাঁত পেষেন রাগে, বলেন–না। আমি যাব না। তোর ইচ্ছে হয় তুই চলে যা।
—যাবে না তুমি?
–না। ঘৃণায়, বিরক্তিতে মুখ ফিরিয়ে নেন সুধাময়।
—আবারও বলছি বাবা, চল ঘাই চল। সুরঞ্জন বাবার কাঁধে হাত রেখে নরম স্বরে বলে। স্বরে তার কষ্ট থাকে, কান্না থাকে।
সুখময় কষ্ঠে আগের সেই দৃঢ়তা নিয়েই বলেন—না।
এই না’ শব্দটি সুরঞ্জনের পিঠে ইস্পাতের চাবুকের মত পড়ে। ‘
সুরঞ্জন ব্যর্থ হয়। সে জানত সে ব্যর্থ হবে। সুধাময়ের মত কঠিন চরিত্রের মানুষটি লাথিঝাঁটা খেয়েও মাটি কামড়ে পড়ে থাকবেন। মাটির সাপ বিছুরা তাঁকে কামড়াবে, তবু তিনি মাটিতেই কামড় দেবেন, মাটিতেই মুখ থুবড়ে পড়বেন।
কিরণময়ীর কান্না থেমেছে। তিনি ঝুঁকে আছেন একটি রাধাকৃষ্ণের ছবির সামনে। এর আগে সুরঞ্জন একটি গণেশের মূর্তি দেখেছিল। ঘরে, সম্ভবত মুসলমানেরা ওটি ভেঙে ফেলেছে। গোপনে কোথাও হয়ত কিরুণাময়ী লুকিয়ে রেখেছিলেন রাধাকৃষ্ণের এই ছবিটি, এটিকে সামনে নিয়ে তিনি ঝুঁকে আছেন, ভগবান কৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করছেন নিরাপত্তার, নির্ভাবনার, নিশ্চয়তার, নিরুপদ্রব জীবনের।
নিরাশার উজান-জলে সুরঞ্জন একা একা সাঁতরায়। রাত হয়। রাত গভীর হয়। বড় একা লাগে তার। কেউ নেই, কেউ সহায় নয় তার। নিজ দেশে নিজেকে পরবাসী বলে মনে হয়। নিজের যুক্তি-বুদ্ধি বিবেকসহ সে গুটিয়ে যেতে থাকে নিজের ভেতর। তার উদারতা, সহিষ্ণুতা, যুক্তিবাদী মন হরতাল কারফিউ আর সন্ত্রাসের দেশে ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসে, ভয়ংকর এক একাকীত্ব তাকে নিঃশেষ করে আনে, সে তার দরজা জানালা বন্ধ করা ঘরে নিঃশ্বাস নেবার অমল হওয়া পায় না। যেন ভয়াবহ কোনও মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। এখন আর মায়ার জন্য নয়, নিজের ভবিষ্যতের আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে সবার হৃদয়। তারা একা হয়ে যাচ্ছে, চেনা লোকেরা, মুসলমান বন্ধু বা পড়শি দেখতে আসছে কিন্তু কেউ বলতে পারছে না—আমাদের যেমন নিশ্চয়তা আছে জীবনের, তোমাদেরও আছে। তোমরা কুষ্ঠিত হয়ো না। কুঁকড়ে থেকে না। তোমরা নিৰ্ভয়ে হাঁটো, নির্বিঘ্নে কাজ কর, প্রাণখুলে হাসো, নিশ্চিন্তে ঘুমাও।
সারারাত এক ভয়ঙ্কর অস্থিরতা সুরঞ্জনকে ছিড়ে খায়।