লজ্জা (০১-খ)

এখনও সেইসব দৃশ্য সুধাময়ের চোখে ভাসে। কাকা পিসি মামা মাসিমা একে একে চলে যাচ্ছেন। ময়ময়সিংহ জংশন থেকে ট্রেন ছাড়ে ফুলবাড়িয়ার দিকে। কয়লার ইঞ্জিন এক আকাশ কালো ধোঁয়া ছেড়ে যখন পুঁউউ হুইসেল বাজায়, ট্রেনের কমপার্টমেট থেকে বুক ভাঙা কান্নার শব্দ ভেসে আসে। পাড়া-পড়শিও যাচ্ছে আর তাগাদা দিচ্ছে—‘সুকুমার, এ হচ্ছে মুসলমানের হোমল্যান্ড। এখানে নিজের জীবনের কোনও নিশ্চয়তা নেই।’ সুকুমার দত্ত এক কথার লোক, তিনি বললেন—‘নিজের জন্মের মাটিতে যদি নিরাপত্তা না থাকে, নিরাপত্তা তবে পৃথিবীর কোথায়? দেশ ছেড়ে পালাতে আমি পারব না। তোমরা যাচ্ছ যাও। আমার বাপ ঠাকুরদার ভিটে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। নারকেল সুপুরির বাগান, ধানি জমি, দু বিঘার উপর বাড়ি—এসব ছেড়ে শিয়ালদা স্টেশনের উদ্বাস্তু হব এ আমার ইচ্ছে নয়।’ সুধাময়ের তখন উনিশ বছর বয়স। কলেজের বন্ধুরা চোখের সামনে চলে যাচ্ছে, বলছে—‘তোর বাবা কিন্তু পরে পস্তাবে।’ সুধাময় তখন বাবার মত বলতে শিখেছেন—‘নিজের দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যাব কেন? মরলে এই দেশেই মরব, বাঁচলে এই দেশেই।’ কলেজ ফাঁকা হয়ে গেল সাতচল্লিশে, যারা যায়নি, তারা যাব যাব করছে। হাতে গোনা কয়েকজন মুসলমান ছাত্র আর রয়ে যাওয়া কিছু দরিদ্র হিন্দুর সঙ্গে কলেজ পার করে লিটন মেডিকেলে লেখাপড়ে করলেন সুধাময়।
বাহান্নোয় চব্বিশের টগবগে যুবক তিনি। ঢাকার রাস্তায় তখন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা—মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে উঠেছে সাহসী ও সচেতন বাঙালি তরুনেরা। তারা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নত ন্যুব্জ মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়েছে, মিছিলে পুলিশ গুলি ছোঁড়ে, রক্তে রাজপথ ভেসে যায়, তবু কেউ দাবি ছাড়েনি, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করবার দাবি। সুধাময়ের তখন প্রচণ্ড উত্তেজনা, মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ‘বাংলা চাই’ শ্লোগান দিয়েছেন। পুলিশের গুলিতে যেদিন রফিক সালাম বরকত জব্বার প্রাণ হারান, সুধাময় ছিলেন সেই মিছিলে। তাঁর বুকেও লাগতে পারত গুলি। তিনিও হতে পারতেন এ দেশের মহান শহীদদের একজন।
উনসত্ত্রের গনআন্দোলনেও সুধাময় ঘরে বসে থাকেননি। আয়ুব খানের পুলিশবাহিনী তখন মিছিল দেখলেই গুলি ছোঁড়ে, এগারো দফা নিয়ে বাঙালি তবু মিছিলে নামা ছাড়ে না। পুলিশের গুলিতে নিহত আলমগীর মনসুর মিণ্টুর লাশ কাঁধে নিয়ে তিনি ময়মনসিংহের রাস্তায় হেঁটেছেন, পেছনে শত শত শোকস্তব্ধ বাঙালি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আরেকবার মুঠো শক্ত করেছে।
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নোর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, চৌষট্টির সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, আটষট্টির আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এ কথা প্রমাণ করেছে যে দ্বিজাতিতত্ত্বের কারণে দেশভাগ হওয়া ছিল ভুল একটি সিদ্ধান্ত। আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন– It is one of the greatest frauds on the people to suggest that religious affinity can unite areas which are geographically, economically and culturally different. It is true that islam sought to establish a society which transcends racial, linguistic, economic and political forntiers. History has however proved that after the first few decades or at the most after the first century, Islam was not able to unite all the muslim countries on the besis of Islam alone.
জিন্নাহও জানতেন দ্বিজাতিতত্ত্বের অসাড়তার কথা। মাউন্টব্যাটেন যখন পাঞ্জাব আর বাংলা ভাগ করবার পরিকল্পনা করছিলেন, তখন জিন্নাহ নিজেই বলেছিলেন—A man is Punjabi or a Bengali before he is Hindu or Moslem. They share a common history, language, culture and economy. You must not divide them. You will curse endless bloodshed and trouble.

১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালি Endless bloodshed and trouble দেখেছে যার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এক লক্ষ বাঙালির রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা একথা প্রমাণ করেছে যে, ধর্ম কখনও জাতিসত্তার ভিত্তি নয়। ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাসই জাতি গঠনের ভিত্তি। পাঞ্জাবি মুসলমানের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের একজাতিত্ব একদিন পাকিস্তান এনেছিল সত্য কিন্তু হিন্দু-মুসলমান দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণা ভেঙে এদেশের বাঙালিরা দেখিয়ে দিয়েছে তারা পাকিস্তানের মুসলমানের সঙ্গে আপস করেনি।
একাত্তরে সুধাময় ছিলেন ময়মনসিংহের এস কে হাসপাতালের ডাক্তার। ঘরে বাইরে ব্যস্ততা তখন, বিকেলে স্বদেশিবাজারের এক ওষুধের দোকানে প্র্যাকটিস করেন। কিরণময়ীর কোলে ছ’মাসের বাচ্চা, বড় ছেলে সুরঞ্জনের বয়স বারো। দায়িত্ব কম নয়। হাসপাতালও প্রায় একা সামলাতে হয়। সময় পেলে শরিফদের আড্ডায় যান। তখন মার্চের আট কী নয় তারিখ হবে। রেসকোর্সের মাঠে শেখ মুজিবের সাতই মার্চের ভাষণ শুনে এসেছে ওরা, শফিক বাবলু ফয়জুল নিমাই, রাত বারোটায় ওরা কড়া লাগে সুধাময়ের ব্রাহ্মপল্লীর বাড়ির দরজায়। শেখ মুজিব বলেছেন—‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয় তবে তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবারে সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
ওরা উত্তেজনায় কাঁপে। টেবিল চাপড়ে বলে—‘সুধাদা, কিছু একটা করতেই হবে।’ বসে থাকলে যে চলবে না সুধাময়ও বুঝেছিলেন। তারপর পঁচিশে মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি সৈন্য যখন বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, আবার কড়া নড়েছিল সুধাময়ের দরজায়, ফিসফিস করে ওরে বলেছিল—‘যুদ্ধে যেতে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই।’ তাঁর ভরা সংসার, বয়সটাও যুদ্ধে যাবার জন্য সুবিধের নয়। তবু হাসপাতালে তাঁর মন বসে না; করিডরে একা পায়চারি করেন। যুদ্ধে যাবার তীব্র একটি ইচ্ছে মাঝে মাঝেই তাঁকে গ্রাস করে। ঘরে তিনি অন্যমন, কিরণময়ীকে বলেন—‘কিরণ, তুমি কি একা সামলাতে পারবে সংসার? ধর, আমি কোথাও চলে গেলাম।’ কিরণময়ী নীল হয়ে যান আশঙ্কায়, বলেন—‘চল ইন্ডিয়া চলে যাই। আশেপাশের সবাই চলে যাচ্ছে।’
সুধাময় নিজেও লক্ষ্য করেছেন সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, সুধাংশু হালদার, নির্মলেন্দু ভৌমিক, রঞ্জন চক্রবর্তী সব চলে যাচ্ছে, সাতচল্লিশে যেমন চলে যাবার ধুম পড়েছিল, তেমন। ওদের তিনি কাওয়ার্ড বলে গাল দিতেন। নিমাই একদিন সুধাময়কে বলল—‘সুধাদা, আর্মিরা শহরের রাস্তায় হাঁটছে, ওরা হিন্দু ধরছে, পালাই চলুন।’ সাতচল্লিশে সুকুমার দত্তের কণ্ঠে যে জোর ছিল, সেই জোর সুধাময় তাঁর কণ্ঠে ধারণ করেন। তিনি নিমাইকে বললেন—‘তুমি যাচ্ছ যাও, আমি পালাচ্ছি না। পাকিস্তানি কুকুরগুলোকে মেরে স্বাধীন করব দেশ। আর তখন পারো তো ফিরে এস।’
ঠিক হল ফয়জুলের গ্রামের বাড়ি ফুলপুরে কিরণময়ীদের রেখে শরিফ বাবলু ফয়জুলের সঙ্গে নালিতাবাড়ির দিকে তিনিও চলে যাবেন। কিন্তু ধরা পড়ে গেলেন পাকিস্তানি আর্মির হাতে। তালা কিনতে বেরিয়েছিলেন, চরপাড়া মোড়ে কোনও তালা পাওয়া যায় কি না, বাড়িতে তালা দিয়ে রাতের অন্ধকারের মোষের গাড়িতে উঠবেন। উত্তেজনায় আবেগে বুক কাঁপছে তার। শ্মশানের মত শহরটি। শুনশান। দু-একটি দোকানের ঝাঁপ অর্ধেক খোলা। হঠাৎ হল্ট বলে ওরা আটকালো তাঁকে। তিনজন ছিল ওরা। একজন তাঁর পেছন থেকে সার্টের কলার ধরে হেঁচকা টান দিয়ে জিজ্ঞেস করল—নাম কেয়া হ্যায়?
সুধাময় কী নাম বললেব বুঝে পাননি। তার মনে পড়ল কিরণময়ী বলেছিলেন তাকে নাকি পাড়ার লোকেরা বলেছে বেঁচে থাকতে চাইলে নাম পাল্টাতে, ফাতেমা আখতার জাতীয় কিছু রাখতে। সুধাময় ভাবেন তার হিন্দু নামটি নিশ্চয় এই মুহূর্তে নিরাপদ নয়। তিনি বিস্মৃত হন তার নাম, পিতা সুকুমার দত্ত, ঠাকুরদা জ্যোতির্ময় দত্তের নাম। সুধাময় নিজের কণ্ঠস্বরে নিজেই চমকে ওঠেন যখন নিজের নাম তিনি বলেন—সিরাজউদ্দিন হোসেন। নাম শুনে একজন মোটা গলায় চেঁচালো—লুঙ্গি খোল। লুঙ্গি সুধাময় খোলেননি, ওরাই টান মেরে খুলেছিল। সুধাময় তখন বুঝেছিলেন নিমাই সুধাংশু রঞ্জন কেন পালিয়েছিল। ভারত ভাগের পর দেশ ত্যাগ করেছে প্রচুর হিন্দু। সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তান ভাগ হবার পর হিন্দুদের জন্য সীমান্ত খোলা ছিল। উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীরা ভারত চলে যান।
১৯৮১ সালের লোক সেনসাস মতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ১ কোটি ৫ লক্ষ ৭০ হাজার অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ১২.১ শতাংশ। বারো বছরে এ সংখ্যা বেড়ে নিশ্চয় দু কোটিতে দাঁড়িয়েছে অথবা আড়াই কোটি। সরকারি হিসেবে হিন্দু সংখ্যা কমিয়ে বলা হয়। সুধাময় অনুমান করেন মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ হিন্দু আছে দেশে। ১৯০১ সালের হিসেব বলে পূর্ববঙ্গে হিন্দু ছিল ৩৩.০ শতাংশ, ১৯১১ সনে এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৩১.৫ শতাংশ। ১৯২১ সনে ৩০.৬ শতাংশ। ১৯৩১ সালে ২৯.৪ শতাংশ। ১৯৪১-এ ২৮ শতাংশ। ৪১ বছরে ভারত ভাগের আগে হিন্দু কমে ২২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ৪০ বছরে যা হ্রাস পায়নি, ১০ বছরে তার চেয়ে বেশি হ্রাস পেল। পাকিস্তান আমলে হিন্দুরা চলে যেতে থাকে ভারতে। ১৯৬১ সালের হিসাবে হিন্দু সংখ্যা ১৮.৫ শতাংশে দাঁড়ায়, ১৯৭৪ সালের হিসেবে ১৩.৫ শতাংশে। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পরে হিন্দুসংখ্যা হ্রাসের হার কমে যায় অনেকটা বিভাগপূর্ব কালের মত। ১৯৭৪ সালে হিন্দু জনসংখ্যার হার ১৩.৫ শতাংশ এবং ১৯৮১ সালে যদি ১২.১ শতাংশ হয়, তবে তো নিশ্চয় করে বলা যায় যে, সংখ্যালঘুরা ভিটে ছাড়ছে আগের চেয়ে কম। কিন্তু কত সাল অবধি এই সংখ্যা কম? তিরাশি, চুরাশি, পঁচাশি, ঊননব্বই, নব্বই? নব্বই-এর পর কি হিন্দুসংখ্যা হ্রাস পাবে না দেশে? বিরানব্বই-এর পর?
সুধাময়ের বুকের বাঁদিকে ব্যথা শুরু হয়। পুরনো ব্যথা। মাথার পেছনেও যন্ত্রণা হচ্ছে। প্রেসার বেড়েছে বোধহয়। সি এন এন-এ বাবরি মসজিদ প্রসঙ্গ এলেই অফ করে দেয়া হচ্ছে দৃশ্য। সুধাময় অনুমান করেন, এই দৃশ্য দেখে লোকে হিন্দুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে তাই সরকার দয়া করছেন। কিন্তু আঁচড় লাগলেই ঝাঁপিয়ে পড়া অভ্যেস যাদের, তারা কী আর সি এন এন-এর দৃশ্য দেখবার অপেক্ষা করবে? সুধাময় বুকের বাঁদিকটা চেপে ধরে শুয়ে পড়েন। মায়া তখনও অস্থির পায়চারি করছে ঘরে বারান্দায়। সে কোথাও চলে যেতে চাইছে। সুরঞ্জন না উঠলে কোথাও যাওয়াও তো সম্ভব হচ্ছে না। সুধাময় অসহায় দৃষ্টি ফেলে রাখেন রোদ পড়া বারান্দায়। দীর্ঘ হচ্ছে মায়ার ছায়া। কিরণময়ী স্থির বসে আছেন, তাঁরও চোখে কাতর অনুনয়—চল বাঁচি। চল চলে যাই। ঘর বাড়ি ছেড়ে যাবেন কোথায় সুধাময়! এই বয়সে তাঁর পক্ষে কী আগের মত দৌড়ঝাঁপ সম্ভব! আগে যেমন মিছিল দেখলেই দৌড়োতেন। পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে যে কোনও আন্দোলনে সবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন। ঘর তাকে আটকে রাখতে পারেনি। সেরকম শক্তি কোথায় তার আর! তিনি ভেবেছিলেন স্বাধীন সেক্যুলার বাংলাদেশে হিন্দুরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে। কিন্তু ধীরে ধীরে এ দেশের রাষ্ট্র কাঠামো থেকে খসে পড়ে ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের রাষ্ট্রধর্ম এখন ইসলাম। যে মৌলবাদী দলটি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, আর দেশ স্বাধীনের পর গর্তের মধ্যে লুকিয়েছিল তারা আজ গর্ত থেকে মাথা বের করেছে। তারা আজ গর্ত থেকে মাথা বের করেছে। তারা আজ সদর্পে ঘুরে বেড়ায়, মিছিল মিটিং করে, তারাই নব্বই-এর অক্টোবরে হিন্দুর মন্দির, ঘরবাড়ি, দোকানপাট লুট করে ভেঙে পুড়িয়ে দিয়েছে। সুধাময় চোখ বুজে শুয়ে থাকেন। এবার কী হবে তিনি জানেন না। বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলেছে উগ্র উন্মত্ত হিন্দুরা। তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে এখন বাংলাদেশের হিন্দুদের। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সুধাময়রা মৌলবাদী মুসলমানের থাবা থেকে নব্বই-এ মুক্তি পায়নি, বিরানব্বই-এ পাবে কেন? এবারও সুধাময়দের ইঁদুরের গর্তে লুকোতে হবে। কেন, হিন্দু বলে? যেহেতে হিন্দুরা ওখানে মসজিদ ভেঙেছে? এই দায় কেন সুধাময়ের হবে! তিনি আবার বারান্দায় মায়ার ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন। ছায়াটি নড়ছে, কোথাও স্থির থাকছে না। ছায়াটি নড়তে নড়তে একসময় অদৃশ্য হয়। মায়া ঘরে ঢোকে। শ্যামল মায়াবী মুখখানায় ঘামের বিন্দুর মত আশঙ্কা জমছে। মায়া বলে, চেঁচিয়েই বলে—তোমরা তা হলে এখানেই পড়ে থাকো, আমি যাচ্ছি।
কিরণময়ী ধমকে ওঠেন—কোথায় যাবি?
মায়া দ্রুত চুল আঁচরায়। বলে—পারুলদের বাসায়। তোমাদের যদি বাঁচতে ইচ্ছে না হয় আমার করার কিছু নেই। দাদাও মনে হয় কোথাও যাবে না।
–আর তোর নীলাঞ্জনা নামটি কী করবি? সুধাময় মাথা তুলে প্রশ্ন করেন। মুহূর্তে তার মনে পড়ে নিজের সিরাজউদ্দিন নামটির কথা।
মায়ার কণ্ঠ কাঁপে না। বলে—লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ বলে নাকি মুসলমান হওয়া যায়, তাই হব, নাম হবে ফিরোজা বেগম।
–মায়া! কিরণময়ী মায়াকে থামাতে চান।
মায়া ঘাড় কাত করে তাকায় কিরণময়ীর দিকে। যেন সে মন্দ কিছু বলছে না, এটিই হওয়া স্বাভাবিক। কিরণময়ীর মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে মায়ার সিদ্ধান্তের কোনও পরিবর্তন হয় না। সুধাময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকান একবার মায়ার মুখে, একবার কিরণময়ীর মুখে। মায়া ছটফট করছে। একুশ বছরের প্রাণবান তরুণী মায়া, সাতচল্লিশের দেশভাগ দেখেনি সে, পঞ্চাশ বা চৌষট্টির দাঙ্গা দেখেনি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, বুদ্ধি হবার পর দেখেছে দেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, দেখেছে সে এবং তার পরিবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, তাদের অনেকরকম আপস করতে হয় সমাজের সঙ্গে। দেখেছে সে নব্বই-এর লেলিহান আগুন। জীবন জীবন বাঁচাতে মায়া এখন যে কোনও চ্যালেঞ্জে যেতে প্রস্তুত। মায়া পুড়তে চায় না অন্ধ আগুনে। সুধাময়ের দৃষ্টির শূন্যতা মায়াকে গ্রাস করে নেয়। তার সামনে মায়া বলে আর কেউ থাকে না। তার বুকের ভেতর তীব্র একটা যন্ত্রণা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে।

2 Comments
Collapse Comments

মূল বই’র চেয়ে অনেক বেশি লাইন রয়েছে এখানে। এসব কোথা থেকে লিখেছেন!!!!!! এছাড়াও প্যারা’র ব্রেকগুলো ঠিক হয়নি।

Bangla Library (Administrator) August 28, 2020 at 8:16 pm

এটা আনন্দ পাবলিসার্স-এর এডিশন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *