সুরঞ্জনের চায়ের তৃষ্ণাটি যায় না। সে উঠে কলঘরে যায়। মুখ না ধুয়েই এক কাপ চা খেতে পারলে ভাল হত। মায়ার সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটি কি চলেই গেল! সুরঞ্জন দাঁত মাজে, অনেকক্ষণ সময় নিয়ে মাজে। বাড়িতে অদ্ভুত এক থমথমে ভাব, যেন এক্ষুণি কেউ মরবে। এক্ষুণি বাজ পড়বে বাড়িতে, সবার যার যার মৃত্যের অপেক্ষা করছে। সুরঞ্জন চায়ের তৃষ্ণাটি নিয়ে সুধাময়ের ঘরে যায়। বিছানায় পা তুলে আরাম করে বসে। মায়া কোথায়? সুরঞ্জনের প্রশ্নের উত্তর কেউ দেন না। কিরণময়ী জানালার সামনে উদাস বসেছিলেন, তিনি কোনও বাক্য খরচ না করে রান্নাঘরের দিকে উঠে যান। সুধাময় কড়িকাঠের দিকে ভাবলেশহীন তাকিয়েছিলেন, তিনি চোখ বুজে পাশ ফিরে শুয়ে থাকেন। কেউ সম্ভবত প্রয়োজন বোধ করছে না খবরটি তাকে জানাতে। সে বোঝে সে ঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। তার যা করা উচিত ছিল, বাড়ির সবাইকে নিয়ে কোথাও পালানো, সেটি সে সম্ভব করতে পারছে না। অথবা তার সম্ভব করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মায়ার সঙ্গে জাহাঙ্গীর নামের এক যুবকের প্রেম, সুরঞ্জন খবর পেয়েছে। মায়া নিশ্চয়ই এই ছেলের সঙ্গে চান্স পেলেই ডেটিং-এ যাবে। ঘর থেকে বেরিয়েছে যখন, তখন আর ভাবনা কী! দাঙ্গা বাঁধলে হিন্দুরা কেমন আছে, কী করছে এসব খবর নেওয়া মুসলমানদের এক ধরনের ফ্যাশন। এই ফ্যাশন নিশ্চয়ই জাহাঙ্গীরও করবে। আর মায়া ধন্য হবে। মায়া যদি ধন্য হতে হতে একসময় বিয়েই করে ফেলে জাহাঙ্গীরকে! মায়ার দু ক্লাস ওপরে পড়ে ছেলেটি। সুরঞ্জন আশঙ্কা করে জাহাঙ্গীর মায়াকে শেষ অবধি বিয়ে করবে না। সুরঞ্জন তার নিজের জীবন দিয়ে বোঝে, পারভিনের সঙ্গে বিয়ে হয় হয় করেও তার হয়নি। পারভিন বলেছিল, তুমি মুসলমান হও। সুরঞ্জন বলেছিল, ধর্ম পাল্টানোর প্রয়োজন কী, তার চেয়ে যার যা ধর্ম তাই থাকুক। যার যা ধর্ম তাই থাকবে প্রস্তাবটি পারভিনের পরিবারের মনঃপুত হয়নি। তাঁরা একটি মুসলমান ব্যবসায়ীর সঙ্গে পারভিনের বিয়ে দিয়ে দিলেন। সেও কেঁদে-কেঁদে বিয়ের পিঁড়িতে বসল।
সুরঞ্জন উদাস চোখে চেয়ে থাকে একচিলতে বারান্দার দিকে। ভাড়া বাড়ি, উঠোন নেই, মাটি নেই খালি পায়ে হাঁটবার দৌড়োবার। কিরণময়ী চা নিয়ে ঘরে ঢোকেন। মায়ের হাত থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে যেন কিছুই হয়নি সুরঞ্জন বলে—ডিসেম্বর চলে এল, অথচ শীত তেমন পড়েনি, ছোটবেলায় শীরের ভোরে খেজুরের রস খেতাম।
কিরণময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন—ভাড়া বাড়ি, খেজুরের রস কোথায় পাবি। নিজের হাতে লাগানো সব গাছ-গাছালির বাড়ি তো জলের দরে বিক্রি করে এলাম।
সুরঞ্জন চায়ে চুমুক দেয় আর তার মনে পড়ে রসের হাঁড়ি নামিয়ে আনত গাছ কাটার লোক। মায়া আর সে নীচে দাঁড়িয়ে থিরথির কাঁপত। কথা বললে মুখ থেকে সাদা ধোঁয়া বের হত। সেই খেলে বেড়ানো মাঠা, সেই আম জাম কাঁঠাক পেয়ারা সুপুরি নারকেলের বাগান আজ কোথায়! সুধাময় বলতেন—এ হচ্ছে তোর পূর্বপুরুষের ভিটে, এই ভিটে ছেড়ে কখনও কোথাও যাবি না।
শেষ পর্যন্ত বাড়িটি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন সুধাময় দত্ত। মায়ার যখন ছ’বছর বয়স, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরবার পথে একবার সে হারিয়ে যায়। শহরের কোথাও তাকে পাওয়া যায় না। কোনও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যায়নি, চেনা কারও বাড়িতেও নয়। সে এক টেনশনের ব্যাপার ছিল বটে। সুরঞ্জন অনুমান করেছিল এডওয়ার্ড স্কুলের গেটে আড্ডা দেয় কিছু ছেলে, পকেটে ছোরা থাকে, ওরাই মায়াকে তুলে নিয়ে গেছে। দু দিন পর মায়া ঘরে ফিরে এসেছে। একা। কোত্থেকে এসেছে, কারা ধরে নিয়েছিল কিছু বলতে পারেনি। পুরো দু মাস সে অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। ঘুমের মধ্যে চমকে চমকে উঠত। মানুষ দেখলে ভয় পেত। রাতে রাতে ঢিল পড়ত বাড়িতে, উড়ো চিঠি আসে মেয়েকে ধরে নিয়ে যাবে তারা, বাঁচতে চাইলে টাকা দিতে হবে তাদের। সুধাময় জি ডি এন্ট্রি করতে থানায় গিয়েছিলেন। থানার পুলিশ এন্ট্রি খাতায় নাম-ধাম টুকে রাখল, ব্যস আর কিছু নয়। ছেলেরা বাড়িতে ঢুকে গাছের ফল পেড়ে নিয়ে যায়, সবজির বাগান মাড়িয়ে যায়, বাগানের ফুল ছিঁড়ে নিয়ে যায়। কেউ কিছু বলতে পারে না। পাড়ার ক’জনের কাছে সমস্যাটি পেড়েও কোনও লাভ হয়নি। তাঁরা বলেছেন, আমরা কী করতে পারি বলুন! এরকমই চলে আসছিল, অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। সুরঞ্জন তার ক’জন বন্ধু নিয়ে ওদের সামাল দেবার চেষ্টা করেছিল। সামাল দেওয়া হয়ত যেত, সুধাময় রাজি হননি। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ময়মনসিংহ থেকে বদলি হয়ে যাবেন। বাড়ি বিক্রি করবেন। বাড়ি বিক্রি করবার আরও এক কারণ ছিল, এটি নিয়ে মামলা চলছিল দীর্ঘদিন। পাশের বাড়ির শওকত আলী জাল দলিল করে বাড়ির দখল নিতে চেষ্টা করছিলেন। এসব ঠেকাতে কোর্ট-কাছারি করতে করতে সুধাময় বড় বিরক্ত ছিলেন, বড় ক্লান্ত। সুরঞ্জন বাড়ি বিক্রির পক্ষে ছিল না। সে তখন কলেজে পড়া তাজা যুবক। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে কলেজ সংসদের নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জিতেছে। সে ইচ্ছে করলে ওই বদমাশ ছোকরাদের পেটাতে পারত। কিন্তু সুধাময়ই অস্থির হয়ে গেলেন বাড়ি বিক্রি করতে। তিনি আর এ শহরে থাকবেন না, ঢাকায় চলে যাবেন। এ শহরে প্র্যাকটিসও নাকি ভাল জমছে না, স্বদেশি বাজারের ফার্মেসিতে বিকেলে বসে থাকেন, রোগী নেইম দু-চারটে যা রোগী আসে, হিন্দু, দরিদ্র, এত দরিদ্র যে পয়সা নিতে ইচ্ছে করে না। সুধাময়ের অস্থিরতা দেখে সুরঞ্জনও আর চাপাচাপি করেনি। এখনও মনে পড়ে দু বিঘা জমির ওপর তাদের সেই বিশাল বাড়িটির কথা। যেদিন দশ লাখ টাকার বাড়িটি রইসউদ্দিন সাহেবের কাছে মাত্র দু লাখ টাকায় বিক্রি করে দিলেন সুধাময়, কিরণময়ীকে বললেন—চল চল তৈরী হও, জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। মাটিতে আছড়ে পড়ে কেঁদেছিলেন কিরণময়ী। সুরঞ্জনের বিশ্বাস হয়নি সত্যিই বাড়িটি ছেড়ে তারা চলে যাচ্ছে। জন্ম থেকে চেনা ঘরদুয়োর ছেড়ে, শৈশবের খেলার মাঠ ছেড়ে, ব্রহ্মপুত্র ছেড়ে, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে তার চলে যেতে ইচ্ছে করেনি। যে মায়ার জন্য যাওয়া সেই মায়াই যেতে চায়নি, সে ঘাড় নেড়ে বলেছে—‘আমি সুফিয়াকে ছেড়ে যাব না।’ সুফিয়া তার স্কুলের বন্ধু। কাছেই বাড়ি। বিকেলে উঠোনে বসে দুজনে পুতুল খেলে, হাঁড়ি পাতিল খেলে। সেও মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিল। সুধাময় মানলেন না। যদিও শেকড়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কই ছিল বেশি। তিনিই বললেন—জীবন আর ক’দিনের, ছেলেমেয়ে নিয়ে একটু নিশ্চিন্ত বাস করতে চাই।
নিশ্চিন্ত বাস কি কোথাও সম্ভব? সুরঞ্জন জানে সম্ভব নয়। যে ঢাকায় এসে সুধাময় হাঁফ ছেড়েছিলেন, সেই ঢাকায়, একটা স্বাধীন দেশের রাজধানী শহরে সুধাময়কে ধুতি ছেড়ে পাজামা পরতে হয়েছে। সুরঞ্জন টের পেয়েছে পিতার যন্ত্রণা, তিনি মুখ ফুটে বলেননি কিছু, তবু তো তাঁর দীর্ঘশ্বাস বাড়ির দেওয়ালগুলোতে আঘাত খেত, বুঝত সব সুরঞ্জন। সামনে তাদের দেওয়াল ছিলই একটি, এত চেয়েছে অতিক্রম করতে, কেউই পারেনি। না সুধাময়, না সুরঞ্জন।
সুরঞ্জন বারান্দায় রোদের দিকে মগ্ন চোখে তাকিয়েছিল। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসা একটি মিছিলের শব্দ তাকে সজাগ করে। মিছিলটি কাছে আসতেই সুরঞ্জন শুনতে চেষ্টা করে কী বলে মিছিলে, সুধাময় আর কিরণময়ীও কান পেতে থাকেন। সুরঞ্জন লক্ষ্য করে কিরণময়ী উঠে জানালা বন্ধ করে দেন। জানালা বন্ধ করলেও মিছিলটি যখন বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে পার হয় তখন স্পষ্ট শোনা যায় মিছিলের শ্লোগান—‘একটা দুইটা হিন্দু ধর, সকাল বিকাল নাস্তা কর।’ সুরঞ্জন লক্ষ্য করে সুধাময় কেঁপে উঠলেন। কিরণময়ী স্থির দাঁড়িয়েছিলেন বন্ধ জানালার দিকে পিঠ দিয়ে। সুরঞ্জনের মনে পড়ে নব্বইয়েও এই শ্লোগান দিয়েছিল ওরা, ওরা হিন্দুদের নাস্তা করতে চায়, তার মানে খেয়ে ফেলতে চায়। সুরঞ্জনকে এই মুহূর্তে হাতের কাছে পেলে ওরা খেয়ে ফেলবে। কারা এরা, পাড়ার ছেলেপুলেরাই তো! জব্বার, রমজান, আলমগীর, কবীর, আবেদিন এরাই তো। এরা বন্ধুর মত, ছোট ভাইয়ের মত, সকাল বিকেল কথা হচ্ছে, পাড়ার সমস্যা নিয়ে আলাপ আলোচনা হচ্ছে। দল বেঁধে সমাধানও হচ্ছে। এরা আজ সাতই ডিসেম্বরের চমৎকার শীতের সকালে সুরঞ্জনকে নাস্তা করবে!