৬ক.
সকালে চায়ের সঙ্গে পত্রিকা হাতে নেয় সুরঞ্জন। আজ মন ভাল তার। রাতেও ভাল ঘুম হয়েছে। পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে মায়াকে ডাকে সে।
—ফিরে তোর হয়েছে কি! এত মন খারাপ করে বসে থাকিস কেন?
—আমার আবার কী হবে। তুমিই তো ঝিম ধরেছ। একবারও বাবার কাছে বস না।
—আমার ওসব দেখতে ভাল লাগে না। সুস্থ সকল মানুষটি মড়ার মত বিছানায় পড়ে আছে দেখলে আমার রাগ ধরে। আর তোরা পাশে বসে মিউ মিউ করে। সারাক্ষণ কাঁদিস, এসব আরও ভাল লাগে না। আচ্ছা, মা টাকা রাখেনি কেন? খুব টাকা বুঝি তাঁর?
–মা গয়না বিক্রি করেছে।
—এ কাজটা অবশ্য ভাল করেছে। গয়না-টয়না। আমি একদম পছন্দ করি না।
—পছন্দ কর না। পারভিন আপকে তো ঠিকই মুক্তোবসানো আংটি দিয়েছিলে?
—তখন কাঁচা বয়স ছিল, মনে রঙ ছিল, এত বুদ্ধি হয়নি তো, তাই।
—এখন বুঝি খুব পেকেছ? মায়া হেসে বলে।
মায়ার মুখে কতদিন পর হাসি দেখল সুরঞ্জন। হাসিটিকে আরও কিছুক্ষণ দেখবে বলে সে পত্রিকার প্রথম পাতার খবরটি দেখায়। বলে-দেখেছিস, নগরীতে শান্তি মিছিল হয়েছে, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আমরা আছি বাংলাদেশে। সাম্প্রদায়িকতা রুখে দাঁড়াও—সর্বদলীয় শান্তি মিছিলের দৃপ্ত ঘোষণা। যে কোনও মূল্যে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ও লুটেরাদের প্রতিরোধ করার আহ্বান। ভারতে সহিংসতা স্তিমিত। উত্তরপ্রদেশ সরকারের মসজিদের জমি দখলকে হাইকোর্টে অবৈধ ঘোষণা। নরসিমা রাও বলেছেন, বাবরি মসজিদ ভাঙার জন্য কেন্দ্র নয়, উত্তরপ্রদেশ সরকারই দায়ী। পশ্চিমবঙ্গ, গুজরাট, মহারাষ্ট্রে এখনও সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের জেহাদ ঘোষণা। আজ পল্টন মোড়ে সি পি বি-র সমাবেশ আছে। আওয়ামি লিগ বলেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় শান্তি ব্রিগেড গঠন করতে হবে। নগর সমন্বয় কমিটি বলেছে দাঙ্গা বাঁধানোর দায়ে নিজামি কাদের মোল্লাদের গ্রেফতার করুন। নির্মূল কমিটিরও সমাবেশ আজ। টঙ্গীতে সর্বদলীয় শান্তি মিছিল। সাংস্কৃতিক জোটের শ্লোগোন-সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজাদের রুখবে এবার বাংলাদেশ। পনেরো জন বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতি সাম্প্রদায়িক সম্প্ৰীতি সবার নাগরিক দায়িত্ব। কর্নেল আকবর বলেছেন ফ্যাসিবাদী শক্তি জামাতকে নিষিদ্ধ করতে হবে। বরিশালে সম্মিলিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা পরিষদ গঠিত। ঢাকা ভার্সিটির শিক্ষক সমিতি সাম্প্রদায়িক সমিতি বিনষ্ট হলে বিজয়ের মাসের পবিত্ৰতা নষ্ট হবে বলেছেন। ধামরাইয়ে মন্দির ভাঙার অভিযোগে আঠাশ জন গ্রেফতার। জ্যোতি বসুর অনুশোচনা ভারতের মুখ দেখাবার জায়গা নেই। –কেবল ভাল খবরগুলো পড়ে গেলে? মায়া বিছানায় পা তুলে আসন করে বসে। পত্রিকাটি টেনে নিয়ে সে বলে—আর বাকি খবরগুলো? ভোলার দশ হাজার পরিবার গৃহহারা। চট্টগ্রামে সাতশ বাড়ি ভস্মীভূত। কিশোরগঞ্জে মন্দির ভাঙচুর। পিরোজপুরে একশ চুয়াল্লিশ ধারা। সীতাকুণ্ড মিরসরাই-এ সাতশ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ।
-আজ কোনও মন্দ খবর শুনতে চাই না। আজ আমার মন ভাল।
–কেন পারভিন আপা ডিভোর্স দিচ্ছে বলে? এসেছিল কাল, বলল স্বামী নাকি তাকে প্রতি রাতে পেটায়।
—এখন কেন? মুসলমানকে বিয়ে করলেই নাকি অপার শান্তি? নারে পারভিন না। আমার মন মজেছে অন্য কোথাও। এবার আর মুসলমান নয়, যেন বিয়ের আগে কাঁদো কাঁদো গলায় না বলতে পারে, তুমি ধর্ম পাল্টাও।
মায়া হেসে ওঠে। অনেকদিন পর মায়া হাসছে।
সুরঞ্জন হঠাৎ গভীর হয়ে বলে–বাবার অবস্থা এখন কেমন? ভাল হয়ে উঠবেন না শিগরি?
—আগের চেয়ে ভাল এখন। ভাল কথা বলতে পারছেন। ধরে ধরে বাথরুমে নিচ্ছি। নরম খাবারও খেতে পারছেন। ও শোনো, কাল সন্ধ্যায় বেলাল ভাই এসেছিলেন। তোমার খোঁজে। বাবাকে দেখে গেলেন। বললেন তুমি যেন বাইরে না বেরোও। বাইরে বের হওয়া এখন রিস্কি।
–ও।
সুরঞ্জন হঠাৎ এক লাফে দাঁড়িয়ে যায়। মায়া বলে–কি ব্যাপার কোথাও যাচ্ছ মনে হয়?
–আমি কি ঘরে বসে থাকার ছেলে?
—তুমি বাইরে গেলে মা যে কি দুশ্চিন্তা করেন। দাদা, তুমি যেও না। আমারও খুব ভয় ভয় লাগে।
—পুলককে টাকাটা ফেরত দিতে হবে। তোর কাছে কিছু টাকা হবে নাকি? তুই তো আবার রোজগোরে মেয়ে। দে না তোর ফান্ড থেকে সিগারেট কেনার টাকা?
—উহু, সিগারেট কেনার টাকা আমি দেব না। তুমি খুব শিগরি মরে যাও এ আমি চাই না।
মায়া বলে কিন্তু দাদার জন্য ঠিকই একটি একশ টাকার নোট এনে দেয়। ছোটবেলায় এই মায়া একবার কেঁদে বুক ভাসিয়েছিল। তাকে স্কুলের মেয়েরা ক্ষেপাত ‘হিন্দু হিন্দু তুলসীপাতা, হিন্দুরা খায় গরুর মাথা।’ মায়া বাড়ি ফিরে কেঁদেকেটে সুরঞ্জনকে জিজ্ঞেস করেছিল—আমি নাকি হিন্দু। আমি কি হিন্দু দাদা?
–হ্যাঁ। সুরঞ্জন বলেছিল।
–আমি আর হিন্দু হব না। হিন্দু বলে ওরা আমাকে ক্ষেপায়।
সুধাময় শুনে বলেছিলেন–তুমি হিন্দু কে বলল? তুমি হচ্ছে মানুষ। মানুষের চেয়ে বড় কিছু জগতে নেই। সুধাময়ের প্রতি শ্ৰদ্ধায় নুয়ে আসে সুরঞ্জনের প্রাণ। সে এত মানুষ দেখেছে, সুধাময়ের মত আদর্শবান, যুক্তি বুদ্ধি বিবেকসম্পন্ন মানুষ সে খুব কমই দেখেছে। ঈশ্বর যদি সে কাউকে মানে, সুধাময়কেই মানবে। এত উদারতা, সহনশীলতা, যুক্তিবাদী মানুষ সংসারে ক’জন হয়?
৬খ.
চৌষট্টিতে সুধাময় শ্লোগান দিয়েছিলেন ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’। সেদিনের সেই দাঙ্গা বাড়তে পারেনি। শেখ মুজিব এসে থামিয়েছিলেন। আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন যেন বাড়তে না পারে, সে কারণেই দাঙ্গা বাঁধিয়েছিল সরকার নিজে। সরকার-বিরোধী আন্দোলনের জন্য সরকার ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের করল। সুধাময় ছিলেন মামলার একজন আসামী। সুধাময় অতীত নিয়ে ভাবতে চান না। তবু অতীত এসে মনের ওপর নগ্ন হয়ে দাঁড়ায়। দেশ দেশ করে কী হয়েছে দেশের? কতটুকু কল্যাণ? পাঁচাত্তরের পর থেকে দেশটি মৌলবাদীদের মুঠোর মধ্যে চলে যাচ্ছে। সব জেনে বুঝেও মানুষগুলো নিস্পন্দ, স্থির। এই প্রজন্ম কি চেতনাহীন? এদের রক্তে কি সেই রক্ত বইছে না, বাহাম্নোয় রাষ্ট্রভাষা করবার দাবিতে যে রক্ত ঝরেছে রাস্তায়, উনসত্তরের গণঅভু্যুত্থানের রক্ত, একাত্তরের ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্ত? সেই উত্তাপ কোথায়? যে উত্তাপ উত্তেজনায় সুধাময় ঝাঁপিয়ে পড়তেন আন্দোলনে? কোথায় টগবগে যুবকেরা এখন? কেন এরা আজ সাপের মত শীতল? কোন ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশে মৌলবাদ খুঁটি গাড়ছে? কেউ কি বুঝতে পারছে না কি ভীষণ দুযোগের দিন আসছে? সুধাময় সমস্ত শক্তি খরচ করে বিছানা থেকে উঠতে চান। পারেন না। মুখ তাঁর বেদনায়, অক্ষমতায়, আক্ৰোশে নীল হয়ে ওঠে।
আইয়ুব খানের শত্ৰু সম্পত্তি আইন আওয়ামি লিগের আইন মন্ত্রী আবার বহাল করলেন সংসদে। অবশ্য নাম পাল্টে। তিনি নাম রাখলেন ‘অৰ্পিত সম্পত্তি আইন। দেশ ছেড়ে হে হিন্দুল্লা চলে গেছে, তাদের সম্পত্তিকে বলা হত শক্রির সম্পত্তি। সুধাময়ের কাক, জাঠা, মামারা কি দেশের শত্রু ছিল? এই ঢাকা শহরে জ্যাঠা মামাদের বড় বড় বাড়িঘর ছিল, সোনারগাঁয়ে ছিল, নরসিংদি, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুরে ছিল, এগুলো কোনওটি কলেজ হয়েছে, কোনওটি হয়েছে পশু হাসপাতাল, পরিবার পরিকল্পনা অফিস, আয়কর রেজিস্ট্রি অফিস। অনিল কাকার বাড়িতে ছোটবেলায় আসতেন। সুধাময়। রামকৃষ্ণ রোডের মন্ত বন্ড বাড়িটিতে দশটি ঘোড়া ছিল, অনিল কাকা তাকে ঘোড়ায় চড়াতেন। সুধাময় দত্ত এখন টিকাটুলির একটি অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে বাড়িতে দিন কাটান, অথচ কাছেই নিজের ককার বাড়ি এখন সরকারের নামে। অৰ্পিত সম্পত্তি আইন বদল হয়ে সম্পত্তি উত্তরাধিকার অথবা সগোত্রে অর্পিত হলে অনেক হিন্দুর দুর্দশা ঘুচত। সুধাময় এই প্রস্তাবটি অনেক হোমরাচোমরা ব্যক্তিকে করেছিলেন, কাজ হয়নি। তিনি তাঁর অচল। অথর্ব। জীবনে আজকাল ক্লান্তি বোধ করেন। বেঁচে থাকবার কোনও অর্থ খুঁজে পান না। জানেন, এই বিছানায় এখন নিঃশব্দে মরে গেলে কারও কোনও ক্ষতি হবে না। বরং নিরস্তুর রাত্রি জাগরণ আর সেবাশুশ্ৰুষার দায়িত্ব থেকে বাঁচবে কিরণময়ী। ‘
১৯৬৫-র পাক-ভারত যুদ্ধের বিশেষ পরিবেশে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কারণে শক্ৰ সম্পত্তি আইন হয়েছিল, স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশে সুকৌশলে সেই আইনের টিকে থাকা দেখে অবাক হন সুধাময়। স্বাধীন একটি দেশের জন্য, বাঙালি জাতির জন্য এ কলঙ্কের ঘটনা নয়? এই আইন দু কোটি মানুষের মৌলিক, মানবিক, গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকার হরণ করেছে, শাসনতন্ত্রের সমঅধিকার আর সামাজিক সাম্য নীতির পরিপহী এ আইন বহাল রেখে দু কোটি মানুষকে তাদের ভিটে বািড় থেকে উচ্ছেদ করে অসহায় সৰ্ব্বনাশা পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এই কারণে হিন্দুদের মধ্যে যদি চরম নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে, এ দোষ কি হিন্দুদের? সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপণ হচ্ছে সমাজের গভীর মাটিতে। বাংলাদেশের সংবিধানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের সমনিরাপত্তা ও সমঅধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা হলেও সরকার অর্পিত (শত্রু) সম্পত্তি আইন বহাল রেখে শাসনতন্ত্রের বিধান লঙ্ঘন করে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা দেখাচ্ছে। অথচ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রের মৌলিক অধিকার এই ধারার কথা বলে—
২৬ (১) এই ভাগের বিধানাবলির সহিত অসামঞ্জস্য সকল আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ এই সংবিধান প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।
(২) রাষ্ট্র এই ভাগের কোনও বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোনও আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোনও বিধানের সহিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনও আইন প্রণয়ন করিকেন না। এবং অনুরূপ কোনও আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোনও বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।
২৭. সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।
২৮ (১) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বৰ্ণ, নারী পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনও নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিকেন না।
৩১. আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইল্যানুযায়ী ব্যবহার লাভ যে কোনও স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনও ব্যবস্থা করা যাইবে না, যাহাতে কোনও ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।
১১২ নং ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে ‘All authorities, executive and judicial, in the Republic shall act in aid of the Supreme Court.’
পাকিস্তানি প্রতিরক্ষণ আইন ৬৫’-র ধারাগুলো এরকম ছিল :
- any state, or sovereign of a state, at war with, or engaged in military operation against Pakistan, or
- any individual resident in enemy territory, or c. anybody of persons constituted or in corporation in enemy territory, or in or under the laws of a state at war with, or engaged in military operations againt Pakistan, or
- any other persons or body of persons declared by the Central Govt. to be an enemy, or
e, any body of persons (whether incorporated or not) carrying on business in any place, if and so long as the body is controlled by a person who under this rule is an enemy, or
f, as respect any business carried on in enemy territory and individual or body of persons (whether incorporate or not) carrying on that business.
১৬৯.১. Enemy subject means:
(a) any individual who possesses the nationality of a state at war with, or engaged in military operation against Pakistan, or having possessed such nationality at any time has lost without acquiring another nationality, or b) any body of persons constituted or incorporated in or under the laws of such state.’
১৬৯ (৪) ‘Enemy property means: any property för the time being belonging to or held or managed on behalf of an enemy as defined in rule 161, an enemy subject or any enemy firm, but does not include the property which is ‘Evacuee property’ under the Pakistan (administration of evacuee property) Act, 1957 (xll of 1957).’
আরও বলা হয় ‘Where an individual enemy subject dies in Pakistan any property, which, individually before his death, belonged to or was held by him, or was managed on his behalf, may not withstanding his death continue to be regarded as enemy property for the purpose of rule 182.’
সাতচল্লিশের পর পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে লক্ষ লক্ষ হিন্দু ভারত পাড়ি দেয়। তখনকার পাকিস্তান সরকার East Bengal Evacuees (administration of property) Act VIII of 1949, the East Bengal Evacuees (Restoration of possession) Act XXIII of 1951-the East Bengal Evacuees (Administration of Emmoveable property) Act XXIV of 1951 জারি করেন। ১৯৫১ সালের East Bengal Evacuees (Admiistration of Immoveable Property) Act XXIV-iq ritPt 33, The evacuee property committees constituted under this Act shall not take charge of any evacuate property.
- if the sole owner or all the co-sharer owners of the property object to the management of such property by the committee on the ground that he or they has or have made other arrangements for the management and utilisation of the property and if the committee is satisfied that the a large ent so Inade proper and adequate, or
- if an objection is filed and allowed under this section.
এই আইনে আরো বলা হয় the property shall be vested only on the applications of the evacuees and it shall be wested with the right to dispose of property as het likes.
১৯৫৭ সালে পাকিস্তান সরকার এই আইনের আরও কিছু বদল করে জারি করলেন Pakistan (administration of evacuee property) Act XII of 1957. এই আইনে বলা হল ‘properties of the persons who is resident in any place in the territories now comprising India or in any area occupied by India and is unable to occupy supervise or manage in person his property in then Pakistan or is being occupied, supervised or managed by a person.’ এই আইনও হিন্দুদের তত অসুবিধে করেনি, যত অসুবিধে করেছে East Pakistan Disturbed Persons and Rehabilitation Ordinance 1964.
১৯৬৫-র পাক-ভারত যুদ্ধের কারণে পাকিস্তান সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে পাকিস্তান শাসনতন্ত্র ১৯৬২-এর পরিচ্ছদ নং ১ ও ২-এর জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করে ৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ তারিখে Defence of Pakistan Ordinance mo, XXIII মত Defence of Pakistan Rules Sasa set (stry Defence of Pakistan Rules 1965-এর ১৮২ ধারায় বলা হয় ‘with a view to preventing the payment of money to an enemy firm, and to provide for the administration and disposal by way of transfer or otherwise of enemy property and matters connected there with or incidential thereto, the Central Government may appoint a Custodian of enemy property for Pakistan and one or more Deputy Custodian and Asstt. Custodians of enemy property for such local areas as may be prescribed and may, by order-vest or provide for and regulate the vesting in the prescribed custodian such enemy property as may be prescribed-এর ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিরক্ষণ আইন ও বিধির আওতায় অন্তর্ভুক্ত সব সম্পত্তি সরকারে ন্যস্ত হল। সে সব শক্ৰ সম্পত্তির প্রকৃত মালিকদের যুদ্ধকালীন অবস্থায় আটক বা চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় এবং তাদের সম্পত্তির যথাযথ পরিচালনা নিরাপদ না মনে হওয়ায় সে সব সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য শক্ৰ সম্পত্তির মালিকদের অধিকার বা স্বার্থের পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা দেবে বলে সে সব সম্পত্তি প্রকৃত মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকারে অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার Enemy Property (Custody and Registration) Order১৯৬৫ জারি করেন এবং পরে Enemy Property (Land and Building) Administration & Disposal order, ১৯৬৬-এর আওতায় ওই সম্পত্তিসমূহের অর্থ ও ক্ষতিপূরণ আদায়, দেওয়া নেওয়ার জন্য আলাদা আলাদা ভাবে হিসাব সংরক্ষণ সহ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পাকিস্তান সরকারের একজন কর্মকর্তার ওপর অৰ্পিত হয়।
পাক-ভারত যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরও আগের আইন বহাল রাখার উদ্দেশ্যে Enemy Property (Continuance of Emergency Provision) Ordinance No 1 of 1969 জারি করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত মিত্ৰ শক্তি হওয়া এবং দু দেশের মধ্যে কোনও যুদ্ধাবস্থা না থাকার পরও রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ২৯/১৯৭২ অর্থাৎ Bangladesh vesting of property and assets Order স্থায়ী বলে কথিত শত্রু সম্পত্তি যা পাকিস্তান সরকারের কাস্টেডিয়ানের ওপর ন্যস্ত ছিল, তা বাংলাদেশ সরকারের কাছে ন্যস্ত হয়। আসলে ১৯৬৯-এর পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর Enemy Property (Continuance of Emergency Provision) ordinance বহাল রেখে জনগণের মানবিক মর্যাদা, সামাজিক অধিকার ও সমতা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করা হয়। পাকিস্তান আমলের মতই স্বাধীন বাংলাদেশেও শত্রু সম্পত্তির তদারকি অত্যন্ত অন্যায় ভাবে অব্যাহত রাখা হয়। জনগণের দাবি উপেক্ষা করেও শত্রু সম্পত্তি আইন (Continuance of Emergency Provision) Repeal Act XLV of 1974 জারি করে বাতিলেরনাম করে Vested & Non-Resident Property (Administration) Act XLVI of 1974-এর আবরণে পাকিস্তান আমলে সরকারের হাতে ন্যস্ত সম্পত্তি সহ বাংলাদেশের স্থায়ী অধিবাসী নয় has ceased to be permanent resident বা বৈদেশিক নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন এমন লোকের সম্পত্তি সরকারে ন্যস্ত করবার মধ্য দিয়ে সব সম্পত্তি পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করেন। এই কমিটিকে নিজ উদ্যোগে বা অনাবাসীর আবেদনের প্রেক্ষিতে বা সরকারের নির্দেশে ঘোষিত সম্পত্তির দায়িত্ব অৰ্পণ করা হয়। এই আইনের আওতায় কেবল পাকিস্তানি আমলের শক্ৰ সম্পত্তি হিসেবে যেসব সম্পত্তি তালিকাভুক্ত হয় সেগুলোই নয়, পাকিস্তানি সরকার বা শত্ৰু সম্পত্তি তত্ত্বাবধায়কেরা যেসব সম্পত্তি তাদের তদারকিতে আনেননি, সেগুলোও আনবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু আইন কার্যকর হবার আগেই ১৯৭৬ সালের Ordinance no. XCIII জারি করা হয়। এই আইনে বলা হয়-Those properties which have had wested under the Act shall be administered, controlled, managed and disposed of by transfer or otherwise, by the Government on such officer or authority as Government may direct এরপর এক বছর যেতে না যেতেই ১৯৭৭ সালের মে মাসের ২৩ তারিখে এক সার্কুলারে বলা হয়-10 kathas of vacant non-agricultural land shall be given long term lease to a person deserving to get it, realising full market value as premium and proper rent, that non-agricultural lands situated in business centre shall be settled in open auction with the highest bidder. অর্থাৎ বাংলাদেশের দেড়-দু কোটি জনগণের যে অকৃষিজাত জমিতে অংশ বা দখল রয়েছে তা নিলামে দীর্ঘমেয়াদী ইজারা দেবার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে। নির্দেশের ৩৭ অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে, তহশীল অফিসের যে সব তহশীলদার বা কর্মচারী নিজ নিজ এলাকার গোপন ন্যস্ত সম্পত্তি খুঁজে বের করে দিতে পারকেন, বা ওই সংক্রান্ত খবরাখবর দিতে পারবেন তাদের পুরস্কার দেওয়া হবে।. ৩৮ অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে, এ কাজে নিয়োজিত অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), সকল মহকুমা প্রশাসক, সার্কেল অফিসার (রাজস্ব), এবং ভূমি প্রশাসক ও ভূমি সংস্কার বিভাগের কর্মচারীদের সম্মানী দেওয়া হবে। পুরস্কার পাবার লোভে এরা ন্যস্ত সম্পত্তি খুঁজে বের করবার নামে হিন্দুদের ভিটে বাড়ি থেকে বা তাদের দখলকৃত অংশ থেকে জোর করে উচ্ছেদও করেছে।
১৯৬৬-র পর পূর্ব পাকিস্তান সরকার সারাদেশে জরিপ চালিয়েছিলেন, এতে দেখা যায়’৪৭-এর দেশত্যাগ, ‘৫০ ও’৫৪-র দাঙ্গার পর যারা তাদের সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা তদারকি এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাদের পরিবারের সদস্য, সহঅংশীদার, বা অন্য আত্মীয়স্বজনদের বা অন্য নাগরিকের সঙ্গে শাসন সংরক্ষণ বা ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারত চলে গেছে কেবল তাদের বাড়িঘর, পুকুর বাগান, পারিবারিক শ্মশান, মঠ, মন্দির, কৃষিজাত অকৃষিজাত সম্পত্তি শত্ৰু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। এ ছাড়াও যে হিন্দুরা ভারতে যায়নি, ভারতের বাইরে যারা বিদেশে থাকেন অস্থায়ীভাবে ভারতে থাকে, তাদের সম্পত্তিও শক্ৰ সম্পত্তির আওতায় আনা হয়। অথচ যে মুসলমানরা ভারত বা ভারতের বাইরে চলে গেছে তাদের সম্পত্তি কিন্তু শত্ৰু সম্পত্তির আওতায় আনা হয়নি। এ জন্য কোনও জরিপ ও চালানো হয়নি। হিন্দু যৌথ পরিবারের আইনের বিধান অনুযায়ী পরিবারের অনুপস্থিত সদস্যের সম্পত্তির মালিকানা যৌথ পরিবারের সারভাইভিং সদস্যদের ওপর ন্যস্ত হবে এবং তারা ভোগদখল করবে। অথচ এইসব সম্পত্তি সরকারের ওপর ন্যস্ত হচ্ছে।
সুধাময় ভাবেন, নিয়াজ হোসেন, ফজলুর আলম, আনোয়ার আহমেদরা ফ্যামিলিসহ তো তাঁর চোখের সামনেই লন্ডন আমেরিকায় চলে গেলেন, তাঁদের দেশের বাড়িতে দুল্পসম্পর্কের আত্মীয়রা বাস করছে, কেয়ারটেকার রেখে গেছেন, কেউ আবার ভাড়া দিয়ে গেছেন বাড়ি, কারও মাধ্যমে ভাড়া তুলে নেন। তাঁদের সম্পত্তিকে তো শত্ৰু সম্পত্তি বলা হয় না। সুধাময় উঠে দাঁড়াতে চান, তাঁর গা ঘামছে। কেউ নেই ঘরে, মায়া, কিরণময়ী সব গেল কোথায়?
৬গ.
সুরঞ্জন পুরনো ঢাকার রাস্তায় হাঁটে আর ভাবে এই শহরে এত হেঁটে বেড়িয়েও ময়মনসিংহকে সে ভুলতে পারেনি। ওই শহরে তার জন্ম, শুই ছোট্ট শহরে কেটেছে তার শৈশব, কৈশোর। বুড়িগঙ্গায় পা ডুবিয়ে রেখে ব্ৰহ্মপুত্রের কথাই সে ভাবে বেশি। মানুষ যদি তার জন্মকে অস্বীকার করতে চায়। তবেই বোধহয় ভুলতে পারে জন্মের মাটিকে, জন্মপাড়ের নদীকে। গৌতমরা চলে যাচ্ছে দেশ ছেড়ে। তারা ভাবছে। এই দেশ তাদের জন্য আর নিরাপদ নয়। কিন্তু যাবার আগে হু হু করে কাঁদছে কোন! পাঁচ বছর আগে তার মামা এসেছিলেন। কলকাতা থেকে, ব্ৰাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়ে কী যে শিশুর মত কাঁদলেন। তিনি। কিরণময়ী বলেছিলেন–সুরঞ্জন, যাবি নাকি তোর মামার সঙ্গে কলকাতায়? শুনে ছিঃ ছিঃ করে উঠেছিল সুরঞ্জন।
চার-ছয় বছর আগে পার্টির কাজে তাকে যেতে হয়েছিল ময়মনসিংহ। জানালায় বসে বুজ ধানক্ষেত, দিগন্ত অবধি বৃক্ষরাজি, কুড়েঘর, খড়ের গাদা, বিলে দৌড়ঝাপ করে উলঙ্গ শিশুদের গামছা পেতে মাছ ধরা, ট্রেন দেখে ফিরে চাওয়া সরল কৃষকের মুখ, দেখতে দেখতে তার মনে হয়েছে সে বাংলার মুখ দেখছে। জীবনানন্দ এই মুখ দেখেছিলেন বলে পৃথিবীর আর কোনও রূপ দেখতে চাননি। সুরঞ্জনের মুগ্ধতা হঠাৎ হোঁচটি খেল রামলক্ষ্মণপুর নামের স্টেশনটি আহমদ বাড়ি হয়ে গেছে দেখে, এক এক করে সে দেখল বালীর বাজারের নাম ফাতেমা নগর, কৃষ্ণনগরের নাম আওলিয়া নগর। ইসলামাইজেশন চলছে। সারাদেশ জুড়ে, ময়মনসিংহের ছোট্ট স্টেশনগুলোও বাদ গেল না। ব্ৰাহ্মণবাড়িয়াকে লোকে বলে বি বাড়িয়া, বরিশালের ব্ৰজমোহন কলেজকে বলে বি এম কলেজ, মুরারি চাঁদ কলেজকে ডাকা হয় এম সি কলেজ, হিন্দু নামগুলো বেরিয়ে আসে বলেই বুঝি সংক্ষেপের আশ্রয়? সুরঞ্জন আশঙ্কা করে। অচিরে এই সংক্ষেপগুলোও বিদেয় হয়ে মোহাম্মদ আলি কলেজ, সিরাজউদ্দৌলা কলেজ হয়ে যাবে ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন্নাহ হলের নাম গল্টে সূর্য সেন হল করায় স্বাধীনতার একুশ বছর পর স্বাধীনতা বিরোধী লোকেরা বলছে সূর্য সেন ডাকাত ছিল, ডাকাতের নামে কী করে হলের নাম হয়? এর মানে নাম পল্টানোর আবদার। সরকার যে কখনও এই আবদার রাখবেন না, তা মনে হয় না। কারণ মৌলবাদী শক্তির সহায়তায় বি এন পি ক্ষমতায় বসেছে, তারাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মীেলাবাদীদের স্বার্থরক্ষা করছে।
পুরনো ঢাকার অলিগিলিতে হাঁটতে হাঁটতে সুরঞ্জন দেখে অক্ষত হিন্দু দোকানগুলো বন্ধ, ওরা যে কপাট খুলবে, কী ভরসায় খুলবে। তবু নব্বই-এর পর খুলেছিল, বিরানব্বইয়ের পরও হয়ত খুলবে। হিন্দুর গায়ের চামড়া বোধহয় গণ্ডারের। তা না হলে ওরা ভাঙা ঘর আবার বাঁধে। কী করে। ভাঙা দোকান আবার জোড়া লাগায় কী করে!! ঘরবাড়ি দোকানপাট না হয় চুন সুরকি দিয়ে জোড়া লাগে। ওদের ভাঙা মন কি জোড়া লাগে?
নব্বই-এ পাটুয়াটুলির ব্ৰাহ্ম সমাজ, শাঁখারি বাজারের শ্ৰীধর বিগ্ৰহ মন্দির, নয়াবাজারের প্রাচীন মঠ, কায়েতটুলির সাপ মন্দিরে লুটপাট, ভাঙচুর আগুন লাগানো হয়েছে। পটুয়াটুলির বিখ্যাত এম ভট্টাচার্য এন্ড কোং, হোটেল রাজ, ঢাকেশ্বরী জুয়েলার্স এভারগ্রীন জুয়েলার্স, নিউ ঘোষ জুয়েলার্স, আল্পনা জুয়েলার্স, কাশ্মীরি বিরিয়ানি হাউজ, রূপশ্রী জুয়েলার্স, মানসী জুয়েলার্স, মিতালি জুয়েলার্স, শাঁখারি বাজারের সোমা স্টোর, অনন্যা লন্ড্রী, কৃষ্ণা হেয়ার ড্রেসার, টায়ার টিউব রিপেয়ারিং, সাহা কেন্টিন, সদরঘাটে ভাসমান হোৱাটল উজালা, পান্থনিবাস লুট করে ভেঙে পুড়িয়ে দিয়েছে। নয়াবাজারের মিউনিসিপ্যালিটি সুইপার কলোনি লুট করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা জেলা আদালতের সুইপার ব্যক্তিটা পুরো জ্বলিয়ে দেওয়া হয়। কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া পূর্বপাড়ার হরিসভা মন্দির, কালী মন্দির, মীর বাগ-এর মন্দির, গোশম বাজার আখড়া, শুভাঢ়া গোসাইর বাগের দুর্গ মন্দির, চন্দ্রাণিকারার মন্দির, পশ্চিম পাড়ার কালী মন্দির, শ্মশানঘাট, তেঘরিয়া পূকনদীর রামকানাই মন্দির, কালিন্দী বাড়ীশুর বাজারে দুর্গ মন্দির, কালী মন্দির, মনসা মন্দিরে হামলা, লুটপাট মুর্তি ভাঙা সবই ঘটেছে। শুভাঢ্যার খেজুর বাগ-এর প্যারীমােহন মিশ্রের ছেলে রবি মিশ্রেীর বাড়ি সহ পঞ্চাশটি ভাড়া বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তেঘরিয়ার ভাবতোষ ঘোষ, পরিতোষ ঘোষ, কালিন্দীর মান্দাইল হিন্দু পাড়ায়, আর বনগাঁও ঋষিপাড়ায় তিনশ বাড়ি ভেঙে লুট করে পুড়িয়ে ফেলেছে। সুরঞ্জন এসব কিছু দেখেছে, কিছু শুনেছে।
সূরঞ্জন কোথায় যাবে ঠিক বুঝে পায় না। এই ঢাকা শহরে তার আপনি কে আছে? কার কাছে গিয়ে দুদণ্ড বসবে, কথা বলবে? আজি মায়া তাকে দেবে না দেবে না বলেও একশ টাকা দিয়েছে। বুক পকেটে নোটটি রাখা, খরচ করতে ইচ্ছে করছে না। দু-একবার ভেবেছে এক প্যাকেট বাংলা ফাইভ কিনবে, কিন্তু কিনলেই তো ফুরিয়ে যাবে। টাকার মায় সে কখনই করে না। সুধাময় তাকে শর্ট-প্যান্ট বানাবার টাকা দিতেন, সেই টাকা সে বন্ধুবান্ধবের পেছনে খরচ করত, কেউ হয়ত পালিয়ে বিয়ে করবে, টাকা পয়সা পাচ্ছে না, সুরঞ্জন বিয়ে করবার খরচ দিয়ে দিল, একবার পরীক্ষার ফিস দিয়ে দিল রহমত নামের এক ছেলেকে। ছেলেটির মা ছিল হাসপাতালে, ওষুধ কিনবার টাকা ছিল না হাতে, ব্যস সুরঞ্জন ফিসের টাকাটি তাকে দিয়ে দিতে সামান্যও দেরি করেনি। একবার কি রত্নার কাছে যাবে। সে স্ট্র রত্না মিত্ৰ? এরকম হয় না বিয়ের পর সে রত্নার পদবী আর বদলালো না? মেয়েরা কেন বিয়ে হলেই পদবী বদলায়? বিয়ের আগে বাবার লেজ ধরে বেঁচে থাকে, বিয়ের পর ধরে স্বামীর লেজ। যত্তসব। সুরঞ্জনেরও ইচ্ছে করে নিজের নাম থেকে দত্ত পদবী তুলে দিতে। মানুষের এই ধর্ম বর্ণ ভেদাই মানুষকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। বাঙালি সে হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, বাংলা নাম রাখবে। মায়ার নাম সে অনেকদিন ভেবেছে নীলাঞ্জনা মায়া হলে বেশ হত। আর তার নাম হতে পারত, কী হতে পারত, ‘নিবিড় সুরঞ্জন? সুরঞ্জন সুধা’? ‘নিখিল সুরঞ্জন? এরকম কিছু হলেই ধর্মের কালি আর গায়ে মাখতে হয় না। বাঙালি মুসলমানের মধ্যেও সে আরবি নাম রাখবার প্রবণতা লক্ষ করেছে। অতি প্রগতিবাদী ছেলেও যে কি না বাঙালি সংস্কৃতির কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে সেও তার বাচ্চার নাম রাখতে গেলে রাখে ফয়সল রহমান, তৌহিদুল ইসলাম, ফাইয়জ চৌধুরি। কেন গো? বাঙালি মানুষের আরবি নাম থাকবে কেন? সুরঞ্জন তার মেয়ের নাম রাখবে স্রোতস্বিনী ভালবাসা, অথবা অর্থই নীলিমা; অর্থই নীলিমা বরং মায়ার নীলাঞ্জনা নামের সঙ্গে মেলে। এই নামটি মায়ার মেয়ের জন্য না হয় দিয়ে দেওয়া যাবে।
সুরঞ্জন হাঁটতে থাকে। এলোমেলো হাঁটা, অথচ বাড়ি থেকে বেরোবার সময় মনে হয়েছে কত তার কাজ। বাইরে বেরোলেই আর সে যাবার জায়গা পায় না খুঁজে। যেন সবাই ব্যস্ত, যে যার কাজে ছুটছে সবাই, কেবল তারই কাজ নেই, তারই কোনও ব্যস্ততা নেই। সে এই সন্ত্রাসের শহরে কারও সঙ্গে বসে দুটো কথা বলতে চায়। বংশালে দুলালের বাড়ি যাবে নাকি? নাকি আজিমপুরের মহাদেবদার বাড়ি? ইস্পাহানি কলোনিতে কাজল দেবনাথের বাড়িও যাওয়া যায়। যাবার কথা উঠতেই তার কেবল হিন্দু নাম মনে পড়ছে কেন? কাল বেলাল এসেছিল, সে তো বেলালের বাড়ি একবার যেতে পারে। হায়দার ফিরে গেল সেদিন, হায়দারের বাড়িতেও আডিডা দেওয়া যায়। এদের বাড়িতে গেলে সেই একই কথার ফুলকি উঠবে, বাবরি মসজিদ। ভারতে কী হচ্ছে ক’জন মরল, বি জে পি নেতারা কী বলল, সেনা নামিল কোন কোন শহরে, কারা গ্রেফতার হল, কোন দল নিষিদ্ধ হল—ভবিষ্যৎ কী হবে, এইসব। এগুলো শুনতে আর ভাল লাগে না তার। ওখানে বি জে পি যা, এখানে জামাতি তা। উদ্দেশ্য দু দলের একই। মৌলবাদকে প্রতিষ্ঠিত করা। দুটো দেশ থেকে যদি ধর্মের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা যেত! ধৰ্ম এমন জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছে, এ থেকে তৃতীয় বিশ্বের নিরন্ন, নিরীহ, নির্যাতিত মানুষের বোধহয় মুক্তি নেই। কার্ল মার্ক্স-এর এই কথাটি বড় প্রিয় তার, ভিড়ের মধ্যে বিড়বিড় করে বলে—’ধমীয় ক্লেশ হল একই বাস্তব ক্লেশের অভিব্যক্তি এবং বাস্তব ক্লেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও। ধর্ম হল নিপীড়িত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, ঠিক যেমন সেটা হল আত্মাহীন পরিবেশের আত্মা। ধর্ম হল জনগণের জন্য আফিম। ‘
হেঁটে হেঁটে ওয়ারি, নবাবপুর, নয়াবাজার, তাঁতিবাজার, কোর্ট এরিয়া, রজনী বসাক লেন, গেণ্ডারিয়া, বেগম বাজার ঘুরে ঘুরে দুপুর পার করে সুরঞ্জন শেষ পর্যন্ত কাজলের বাড়িই যায়। তাকে বাড়িতেই পাওয়া যায়, আজকাল সব হিন্দুকে বাড়িতে পাওয়া যায়। হয়। বাড়ির বাইরে কোথাও লুকিয়ে থাকে, নয় ঘাপটি মেরে বাড়িতে বসে থাকে। আড্ডা দিয়ে বেড়ানোর জন্য বেকার সুরঞ্জনের জন্য ভালই হল, কাজলকে পেয়ে সে মনে মনে বলে। কাজলের ঘরে আরও ক’জনকে পাওয়া যায়। সুভাষ সিংহ, তাপস পাল, দিলীপ দে, নির্মল চ্যাটার্জি, অঞ্জন মজুমদার, যতীন চক্রবর্তী, সাইদুর রহমান, কবীর চৌধুরি।
—কি খবর বেশ হিন্দু সমাগম দেখছি।
সুরঞ্জনের কথায় কেউ হাসে না। সে নিজেই বরং হেসে ওঠে।
—কি খবর সবার এত মন খারাপ কেন? হিন্দুদের মারা হচ্ছে বলে? সুরঞ্জনই প্রশ্ন করে।
—মন ভাল থাকবার কোনও কারণ আছে? সুভাষ বলে।
কাজল দেবনাথ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ করে। সুরঞ্জন এই পরিষদকে কখনও সমর্থন করেনি। তার মনে হয়েছে এটিও একটি সাম্প্রদায়িক দল। এই দল সমর্থন করলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করবার দাবিটিতে তেমন জোর থাকে না। এ প্রসঙ্গে কাজল অবশ্য বলেন, চল্লিশ বছর প্রত্যাশায়, প্রতীক্ষায় থেকে নিরাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষার, স্বনির্ভরতার তাগিদে এই পরিষদ গঠন করেছি।
—খালেদা কি একবারও স্বীকার করেছে দেশে সাম্প্রদায়িক হামলা হচ্ছে? একবারও তো বিধবন্ত এলাকা দেখতে গেলেন না। তিনি। আসরের একজন এই কথা বলতেই কাজল বলেন-আওয়ামি লিগই বা কি করেছে। বিবৃতি দিয়েছে। এরকম বিবৃতি জামাতে ইসলামি দিয়েছে আগে। গত নিবাচনে আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় এলে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ রাখবে না বলে এক ধরনের অপবাদ প্রচার হয়েছে। তারা এখন ক্ষমতায় না। যেতে পেরে ভাবছে। এইটথ এমেন্ডমেন্টের বিরুদ্ধে কথা বললে জনপ্রিয়তা কমে যাবে।
আওয়ামি লিগ কি ভোটে জিততে চায় নাকি নীতিতে অটল থাকতে চায়? অটল থাকলে এই বিলের বিরুদ্ধে কোনও কথা বলছে না কেন?
—ভেবেছে ক্ষমতায় আগে তো যাই, তারপর যা রদবদল করা দরকার, করা যাবে। সাইদুর রহমান আওয়ামি লিগের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করান।
–কাউকে বিশ্বাস নেই। সবাই ক্ষমতায় গিয়ে ইসলামের গান গাইবে আর ভারতের বিরোধিতা করবে। এ দেশে ভারত বিরোধিতা এবং ইসলাম লোকে খায় ভাল। কাজল মাথা নেড়ে বলেন।
হঠাৎ সুরঞ্জন আলোচনার প্রসঙ্গে না গিয়ে তার পুরনো প্রশ্নটিই করে—কিন্তু কাজলদা, আপনাদের এই সাম্প্রদায়িক পরিষদটি না করে অসাম্প্রদায়িক মানুষের একটি দল করলে ভাল হত না? আর এই পরিষদে সাইদুর রহমান নেই কেন, জানতে পারি?
যতীন চক্রবর্তী ভারী কণ্ঠে বলেন–সাইদুর রহমানকে না নিতে পারা আমাদের ব্যর্থতা নয়। ব্যৰ্থতা রাষ্ট্রধর্ম যারা তৈরি করেছে, তাদের। এতকাল তো আমাদের এরকম পরিষদ করতে হয়নি, এখন করতে হয় কেন? বাংলাদেশটি এমনি এমনি গড়ে ওঠেনি। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান সকলেরই অবদান ছিল, কিন্তু একটি বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা মানে অন্য ধর্মের মানুষদের মনে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম দেওয়া। স্বদেশের প্রতি ‘ভালবাসা কারও চেয়ে কারও কম নয়। কিন্তু যারা দেখে ইসলাম তাদের ধর্ম না। হওয়ায় রাষ্ট্রের চোখে তাদের পৈত্রিক ধর্ম দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর ধর্ম বলে বিবেচিত হয়, এবং ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক কারণেই তারা দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়ে গেছে, তখন তাদের অভিমান মারাত্মক হয়। এ কারণে যদি তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বদলে সাম্প্রদায়িকতার চেতনাই প্রবল হয়ে ওঠে, তবে তাদের দোষ দেওয়া যায় কি?
উত্তরটি যেহেতু সুরঞ্জনের দিকে ছুড়ে দেওয়া, সুরঞ্জন আই নীচু কণ্ঠে বলে-কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রে এরকম একটি সম্প্রদোয়ভিত্তিক সংগঠন থাকার যুক্তি কি?
যতীন চক্রবর্তী মুহূর্ত দেরি না করে বলেন—কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এ রকম সম্প্রদায়ভিত্তিক সংগঠন করতে বাধ্য করেছে। কারা? যারা রাষ্ট্ৰীয় ধর্মের প্রবক্তা, তারা নয়? একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের রিলিজিয়নকে রাষ্ট্রধর্ম বানালে সেই রাষ্ট্রটি তো আর জাতীয় রাষ্ট্র থাকে না। যে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রধর্ম আছে, সে রাষ্ট্র ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হতে পারে যে কোনও মুহুর্তে। এই রাষ্ট্র দ্রুত সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হচ্ছে, এখানে জাতীয় সংহতির কথা বলা হাস্যকর। এইটথ এমেন্ডমেন্ট যে আসলে বাঙালিকে কলা দেখানো তা সংখ্যালঘুরা বুঝতে পারছে কারণ তারা ভুক্তভোগী।
–আপনি কি ভাবছেন মুসলমানদের জন্য রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়া, বা ধর্মীয় রাষ্ট্র হওয়া কল্যাণকর? আমি কিন্তু তা মনে করি না।
—-নিশ্চয়ই না। এটা তারা আজ না বুঝলেও একদিন বুঝবে।
—আওয়ামি লিগ কিন্তু এ সময় ভাল একটি ভূমিকা রাখতে পারত। অঞ্জন বলে।
সুরঞ্জন বলে—হ্যাঁ আওয়ামি লিগের বিলেও অষ্টম সংশোধনী বাতিলের প্রস্তাব নেই। যে কোনও আধুনিক গণতন্ত্রী মানুষ জানে গণতন্ত্রের অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। আমি বুঝি না যে দেশের শতকরা ছিয়াশি জন মুসলমান, সে দেশে ইসলামকে রাষ্ট্ৰীয় ধর্ম করার দরকার কী। বাংলাদেশের মুসলমানেরা এমনিতেই ধর্ম পালন করে, তাদের জন্য রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার কোনও দরকার পড়ে না।
যতীনবাবু নড়েচড়ে বসে বলেন–নীতির প্রশ্নে কোনও আপিস হয় না। আওয়ামি লিগ তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার হচ্ছে বলে এক ধরনের আপিস করছে।
সুভাষ চুপচাপ কথা শুনছিল। এবার বলে—আসলে জামাতি আর বি এন পি-র সমালোচনা না করে আমরা খামোক আওয়ামি লিগকে নিয়ে পড়েছি। ওরা কি আওয়ামি লিগের চেয়ে ভাল কাজ করছে। কাজল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন–আসলে যারা চিহ্নিত শত্ৰু, তাদের সম্পর্কে বলার কিছু থাকে না। কিন্তু যাদের ওপর আশা করি, তাদের স্খলন দেখলেই মনে লাগে বেশি।
কবীর চৌধুরি হঠাৎ মাঝখান থেকে বলেন—এত যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছে সবাই, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কিন্তু সকল ধর্মের প্রতি একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা, এখানে পক্ষপাতিত্ব বলে কিছু নেই। আর সেকুলারিজম শব্দটির মানে হচ্ছে ইহজাগতিকতা, সোজা ভাষায়, রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক থাকবে না।
কাজল দেবনাথ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, বলেন–দেশ বিভাগের সময় মুসলিম মৌলবাদ জিতে পাকিস্তানের জন্ম দেয়। ভারতে হিন্দু মৌলবাদ। কিন্তু হেরে যায়। হেরে যায় বলেই ভারত একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হতে পেরেছে। ভারতীয় মুসলমানদের জন্য এ দেশের হিন্দুদের জিম্মি বলে ঘোষণা হয়েছিল। কেবল হিন্দু বিতাড়নের অজুহাত হিসেবে, মূল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু সম্পত্তি দখল। পাকিস্তান আমলের কায়দায় আবার যখন ইসলামি ব্যবস্থার জিগির শোনা যায়। তখন হিন্দুল্লা ভয় পাবে না কেন? এ দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র না করলে হিন্দুদের বাঁচা অসম্ভব। আমাদের আরও দাবি শত্ৰু সম্পত্তি আইন বাতিল করতে হবে। এডমিনিষ্ট্রেশনে কোনও হিন্দু নেই। পাকিস্তান আমল থেকে কোনও সেক্রেটারি পদে হিন্দুদের নেওয়া হচ্ছে না। আমিতে হিন্দু সংখ্যা খুবই কম। যারা আছে কারোরই প্রমোশন হয় না। নেভি বা এয়ারফোর্সে হিন্দু কেউ আছে বলে তো মনে হয় না।
নির্মল বলে–কাজলদা, হিন্দুদের মধ্যে কোনও ব্রিগেডিয়ার বা মেজর জেনারেল নেই। কর্নেল সত্তরজনে একজন, লেফটেনেন্ট কর্নেল চারশ পঞ্চাশজনে আটজন, মেজর এক হাজার জনে চল্লিশজন, ক্যাপ্টেন তেরশজনে আটজন, সেকেন্ড লেফটেনেন্ট নয়শীজনে তিনজন, সিপাহি আশি হাজারে মাত্র পাঁচশজন। চল্লিশ হাজার বি ডি আর-এর মধ্যে হিন্দু মাত্র তিনশজন। সেক্রেটারি কেবল হিন্দু নেই বলছেন কেন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানও তো নেই। এডিশনাল সেক্রেটারিও তো নেই। জয়েন্ট সেক্রেটারি আছেন একশ চৌতিরিশজনে মাত্র একজন।
কাজল আবার শুরু করেন—ফরেন সার্ভিসে সংখ্যালঘু কি আছে। একজনও? আমার তো মনে হয় নেই।
সুভাষ মোড়ায় বসেছিল, হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়। বলে—না কাজলদা নেই।
ঘরে কার্পেট পাতা। সুরঞ্জন কর্পেটে বসেই একটি কুশনে হেলান দেয়। তার বেশ ভাল লাগছে আলোচনা শুনতে।
কবীর চৌধুরি বলেন–পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আওয়ামি লিগের আমলে একমাত্ৰ মনোরঞ্জন ধরকে কিছুদিনের জন্য জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত করা হয়েছিল।
—হায়ার স্টাডিজের জন্য, বিদেশে ট্রেনিং এসব ব্যাপারে হিন্দুদের এভিয়েড করা হয়। কোন লাভজনক ব্যবসাই এখন হিন্দুদের হাতে নেই। ব্যবসা বাণিজ্য করতে গেলে মুসলমান অংশীদার না থাকলে কেবল হিন্দু প্রতিষ্ঠানের নামে সব সময় লাইসেন্স পাওয়া যায় না। তা ছাড়া শিল্পঋণ সংস্থা থেকে ইন্ডাস্ট্রি করার জন্য ঋণ দেওয়া হয় না।
অঞ্জন বলে–হ্যাঁ, আমিই তো গামেন্টস করার জন্য জুতোর সুকতলি খরচ করে ফেললাম। ব্যাঙ্ক-এর কোনও হেলপ পেলাম না। তারপর আফসারকে পার্টনার করে লোন নিতে হল।
সুভাষ বলে–একটা ব্যাপার লক্ষ করেছেন, রেডিও টেলিভিশনে কোরানের বাণী দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। কোরানকে পবিত্র গ্রন্থ বলা হচ্ছে। কিন্তু গীতা বা ত্রিপিটক থেকে পাঠ করার সময় কিন্তু পবিত্র বলা হচ্ছে না।
সুল্লঞ্জন বলে—আসলে কোনও ধর্মগ্ৰন্থই তো পবিত্র নয়। যতসব বদমায়েসি এসব। সব বাদ দিলেই তো হয়। দাবি করা যেতে পারে রেডিও টিভিতে ধর্মপ্রচার বন্ধ করতে হবে।
আসর খানিকটা চুপ হয়ে যায়। সুরঞ্জনের চা খেতে ইচ্ছে করে। সম্ভবত চায়ের কোনও ব্যবস্থা এ বাড়িতে হচ্ছে না। তার শুয়ে পড়তে টুচ্ছে করে কার্পেটটিতে। শুয়ে শুয়ে সবার ভেতরকার কষ্টগুলোর যে উদগীরণ হচ্ছে, তা সে উপভোগ করবে।
কাজল দেবনাথ তার না শেষ হওয়া কথা বলতে থাকেন–সরকারি যে কোনও অনুষ্ঠানে, প্রতিটি সভা-সমিতিতে কোরানের সূরা পাঠ করা হয়। কই, গীতা থেকে তো করা হয় না? সারা বছরে সরকারি হিন্দু কর্মচারীদের জন্য মাত্র দুদিন ছুটির ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের ঐচ্ছিক ছুটির অধিকারও তেমন নেই। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে মসজিদ নিমণি করান্ধি ঘোষণা করা হয়, কিন্তু মন্দির নিমণ করার কথা তো বলা হয় না। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করে নতুন মসজিদ করা হচ্ছে, অথবা পুরনো মসজিদের সংস্কার চলছে, কিজ মন্দির গিজা প্যাগোড়ার জন্য কিছু কি খরচ করা হয়?
সুরঞ্জন শোয়া থেকে মাথা উঠিয়ে বলে—রেডিও টিভিতে গীতা থেকে পাঠ হলে খুশি হন? মন্দির নিমণি হলে খুব মঙ্গল হবে? একবিংশ শতাব্দী এসে যাচ্ছে, আমরা আজও ধমের প্রবেশ চাচ্ছি সমাজে, রাষ্ট্রে। তার চেয়ে বলুন রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি ধর্মীয় অনুপ্রবেশ থেকে মুক্ত থাকবে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষত চাই মানে তো এই নয় যে এখন কোরান পড়লে গীতাও পড়তে হবে। আমাদের চাইতে হবে রাষ্ট্ৰীয় সমস্ত কাহকিলাপে ধমীয় অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ধমীয় প্রার্থনা, পাঠ্য বইয়ে কোনও ধর্মীয় নেতার জীবনী দেওয়াও নিষিদ্ধ করতে হবে। ধমীয় কার্যকলাপে পলিটিক্যাল লিডারদের সহযোগিতা নিষিদ্ধ করতে হবে। যদি কোনও নেতা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নেয়, অথবা পৃষ্ঠপোষকতা করে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে। সরকারি প্রচার মাধ্যমে ধর্মীয় প্রচার নিষিদ্ধ করতে হবে। কোনও আবেদন পত্রে আবেদনকারীর ধর্ম জানতে চাওয়া হবে না।
সূরঞ্জনের কথায় কাজল দেবনাথ হেসে ওঠেন, বলেন–তুমি বেশি এগিয়ে যাচ্ছ ভাবনায়। একটি সেকুলার দেশে তোমার প্রস্তাবগুলো চলে, এই দেশে চলে না।
সুভাষ উসখুস করছিল, ফাঁক পেয়ে বলে–আজ বাংলাদেশ ছাত্র-যুব ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে প্রেস ক্লাবের সামনে মিটিং করেছি। হোম মিনিস্টারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি, ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির পুনর্নির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘরের ক্ষতিপূরণ দান, সহায় সম্বলহীনদের ত্রাণ ও পুনর্বাসন, দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি ছিল ওতে।
সুরঞ্জন কুশনে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিল, উঠে বলে—তোমার একটি দাবিও এই সরকার মানবে না।
কবীর চৌধুরি বলেন—তা মানবে কেন? হোম মিনিস্টার তো আস্ত একটা রাজাকার। শুনেছি এই লোক একাত্তরে কাঁচপুর ব্রিজে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্প পাহারা দিত।
সাইদুর রহমান বলেন–রাজাকারগুলোই তো এখন ক্ষমতায়। শেখ মুজিব এদের ক্ষমা করেছে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসিয়েছে। এরশাদ এদের আরও শক্তিশালী করেছে। আর খালেদা জিয়া সরাসরি রাজাকারদের সহযোগিতায় ক্ষমতায় বসেছে।
—কক্সবাজারের খবর পেলাম, সেবাখোলার মন্দিরটি ভেঙে ফেলেছে। চিন্তামন্দির ছিল একটি, সেটিও। জালালাবাদের ঈদগাঁও বাজারের কেন্দ্রীয় কালী মন্দির, হিন্দুপাড়ার আগুনে পুড়ে ছাই করে দিয়েছে। ইসলামাবাদের হিন্দুপাড়ায় সার্বজনীন দুর্গ মন্দির, বোয়ালখালির দুর্গ মন্দির, অদ্বৈত চিন্তাহরি মঠ, মঠাধ্যক্ষের বাড়ি, সঙ্গে আরও পাঁচটি পারিবারিক মন্দির সম্পূর্ণ ছাই করে দিয়েছে। বোয়ালখালির হরি মন্দির লুট করেছে। চৌফলদভীর আটটি মন্দির, ছটি বাড়ি, দুটো দোকান পুরো ছাই করে দিয়েছে। হিন্দু পাড়ায় মোট একশ পয়ষট্রিটি পরিবারের সব কিছু লুট হয়ে গেছে। বাজারের পাঁচটি হিন্দু দোকান লুট, হিন্দুদের যেখানে পাচ্ছে মারছে। হিন্দু বাড়িগুলোর ধানের গোলায় কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। উখিয়ার ভৈরববাড়ি পুরো ধ্বংস করে দিয়েছে। টেকনাফের কালীবাড়ি, পুরোহিতের বাড়িঘর জ্বলিয়ে পুড়িয়ে ছাই করেছে। সারাবাং-এর মন্দিরও ভেঙে পুড়িয়ে দিয়েছে ৭ মহেশখালির তিনটি মন্দির এগারোটি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। চারটি গীতা স্কুলও পুড়িয়ে দিয়েছে। কালারমার বাজারে কালী মন্দির আর হরি মন্দির ভেঙে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। কুতুবদিয়ার বড়ঘোপা বাজারের কালী মন্দির নাটমন্দির, সব মিলিয়ে ছটি মন্দিরে আগুন দিয়েছে। বাজারের চারটি কর্মকারের দোকান লুট করেছে। আলী আকবর ডেইল-এ একাল্পটি জেলে পরিবারের ঘরবাড়ির যাবতীয় জিনিস সম্পূর্ণ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। কুতুবদিয়ার এইসব আগুন লাগানোয় তিনটি বাচ্চা মারা গেছে। রামুর ঈদগড়ে সার্বজনীন কালী মন্দির আর জেলে পাড়ায় হরি মন্দির ভেঙে পুড়িয়ে দিয়েছে। ফতেখাঁরকুলে অনেক বাড়িঘর জ্বলিয়ে পুড়িয়ে ছারখার…
তাপস পালকে থামিয়ে দিয়ে সুরঞ্জন বলে–ধুত্তোরি, রাখো তোমার জ্বালানো পোড়ানো খবর। তার চেয়ে বরং একটা গান গাও।
—গান? আসরের সবাই অবাক হয়। গান আবার এ সময় হয় নাকি! আজি কি আর অন্য দিনের মত দিন? দেশে হিন্দুদের ঘরবাড়ি মন্দির দোকান লুট হচ্ছে, ভাঙছে, পুড়ছে। আর সুরঞ্জনের কি না গান শোনার শখ হল।
হঠাৎ গানের প্রসঙ্গ ছেড়ে সুরঞ্জন বলে—খুব ক্ষিদে পেয়েছে কাজলদা। ভাত খাওয়াবেন?
—এই অসময়ে ভাত? দু-একজন অবাক হয়।
পেট ভরে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে সুরঞ্জনের। একথাল ভাত, চেপা শুটকি দিয়ে মেখে মেখে খেতে ইচ্ছে করছে। ভন ভন করে মাছি ঘুরবে, বাঁ হাত দিয়ে তাড়াবে আর খাবে। সে রামরতিয়াকে দেখেছিল এরকম খেতে, ব্ৰহ্মপল্লীর বাড়ির উঠোনে বসে। রামান্নতিয়া ছিল রাজবাড়ি স্কুলের সুইপার। মায়াকে নিয়ে এসেছিল স্কুল থেকে, সেদিন মায়ার পেট খারাপ ছিল, বাচ্চা মেয়ে, দৌড়ে বাথরুমে যাবে সে বুদ্ধি হয়নি, সাদা পাজামা হলুদ বানিয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল, হেডমিস্ট্রেস রামরতিয়াকে দিয়ে মায়াকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিরণময়ী রামারতিয়াকে ভাত দিয়েছিলেন খেতে, এত তৃপ্তি করে যে ভাতের মত জিনিস খাওয়া যায়, রামরতিয়ার খাওয়া না দেখলে সুরঞ্জন জানতই না। এখন সে একঘর লোকের সামনে ভাত খেতে চাইছে, সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে! পাগল হঁয়ত নয়, পাগল হলে কি বুক ভেঙে এমন কান্না নামে! গভীর আলোচনা হচ্ছে ঘরে, আর এর মধ্যে সে যদি হু হু করে কেঁদে ওঠে, কেমন বিচ্ছিরি লাগবে না। সারাদিন রোদে রোদে ঘুরেছে সে। পুলকের বাড়ি যাবার কথা। টাকা ফেরত দিতে হবে। মায়ার দেওয়া নোটটি এখনও খরচ হয়নি। রাতে একবার পুলিকের বাড়ি যেতে হবে। তার ক্ষিদে লাগছে, ঘুমও পাচ্ছে।
সুরঞ্জন তন্দ্রার ভেতরে শুনতে পায় কে যেন বলছে নরসিংদির লোহারকান্দা গ্রামের বাসন রানী চৌধুরিকে গ্রামের লোকেরা নিজের বাস্তুভিটে থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বাসনার ছেলেকে ছুরি দেখিয়ে স্ট্যাম্প ও সাদা কাগজে সই নেয়। ওরা যাবার আগে বলে যায়। এই ঘটনা কাউকে জানালে বাসনা আর তার দুই ছেলেকে মেরে ফেলা হবে। বাসনা কি করুণাময়ীর মত দেখতে? কিরণময়ীর মত নরম, নিরীহ, নিরুপদ্রব মানুষ? মাদারিপুরের রমজানপুর গ্রামে সবিতা রানী আর পুষ্প রানীকে ধর্ষণ করে ইউনুস সদরের লোকেরা। খুলনার ভুমুরিয়ায় অৰ্চনা রানী বিশ্বাস, ভগবতী বিশ্বাসকে বাজার.থেকে বাড়ি ফেরার পথে মালো পাড়ায় ভ্যান গাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে দু বোনকে নামিয়ে ওয়াজেদ আলীর বাড়িতে ধর্ষণ করে। কারা করে? কারা? কি যেন নাম, মধু, শওকত, আমিনুর। চট্টগ্রামের পটিয়ায় পরিমল দাসের ছেলে উত্তম দাসকে বাদশা মিয়া, নূর ইসলাম, নূর হোসেন রাত তিনটের সময় ঘরে ঢুকে হত্যা করে। মামলা করেছিল উত্তমের লোকেরা, এর ফলে এদের ভিােট ছাড়া করবার চক্রান্ত চলছে। সিলেটের বড়লেখা বিদ্যালয়ের ছাত্রী সবিস্তা রানী দে রাতে পড়ছিল, এমন সময় নিজামুদ্দিন গুণ্ডােপাণ্ড নিয়ে তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। সবিতার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। বগুড়ার নৃপেন্দ্ৰ চন্দ্র দত্তের মেয়ে শেফালি রানী দত্তকে অপহরণ করে নিয়ে জোর করে ধমন্তিরিত করা হয়। এডমিনিষ্ট্রেশন কোনও হেল্প করেনি। যশোরের শুড়ো আর বাগডোঙা গ্রামে আর্মস নিয়ে চারদিক ঘেরাও করে হিন্দুদের বাড়ি লুট করে, হিন্দুদের ইচ্ছেমত পেটায়, এগারোজন মেয়েকে সারারাত ধলে রোপ করে। তারপর, তারপর? কেউ বোধহয় জানতে চায়। যে জানতে চায় তার চোখ কি বিস্ফারিত হচ্ছে ভয়ে, ঘূণায় নাকি অন্যরকম এক পুলকে? সুরঞ্জনের চোখ বন্ধ, তার ঘুম পাচ্ছে, তার দেখবার ধৈর্য নেই কার এত কৌতুহল এসব শুনতে যে নোয়াখালির ঘোষবাগ এলাকার সাবিত্রী বালা রায় তার স্বামী মোহনবাসি রায় আর যুবতী মেয়ে নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আলিপুরের আবদুল হালিম ননু আবদুর রব বাচু মিয়ারা একদিন সাবিত্রী দেবীর বাড়ি গিয়ে মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য যে চাষযোগ্য জমি বিক্রি কল্লেছিলেন, সেই জমি বিক্রির আঠারো হাজার টাকা ছুরি দেখিয়ে ছিনিয়ে নেয়। তারা তাদের বাকি জমি তাদের নামে লিখে দিয়ে ভারত চলে যেতে বলে প্ৰাণনাশের হুমকি দেয়। তার যাবার সময় গোয়ালের গরুগুলোও নিয়ে যায়। যদি সাবিত্রীরা ভারত না যায় কি হবে? কী হবে। আর, মেরে ফেলা হবে। শেরপুরের সাপমারি গ্রামের তিনশ ষাটটি গোয়ালা পরিবার মৌলবাদীর অত্যাচারে দেশ ত্যাগ করেছে। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদির চারুচন্দ্ৰ দে সরকার, সুমন্তমোহন দে সরকার, যতীন্দ্রমোহন দে সরকার, দীনেশচন্দ্ৰ দে সরকারের প্রচুর জমাজমি জাল দলিলের মাধ্যমে এলাকার টাউট মুসলমানেরা দখল করে নিয়েছে। ময়মনসিংহের দাপুনিয়ার রঞ্জন রাজভর-এর পরিবারকে জাল দলিল করে ভিটে থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা করছে। রঞ্জনের দু বোন মালতী আর রামরতিকে জোর করে মুসলমান বানিয়ে বিয়ে করে, বিয়ের কিছুদিন পর দু বোনকেই তাড়িয়ে দেয়। জয়পুর হাটের বালিঘাটা গ্রামের নারায়ণ চন্দ্ৰ কুণ্ডের কুড়ি বিঘা জমি জোর করে দখল করে নিয়েছে মুসলমান বগর্দিাররা। তারা ওখানে ঘরবাড়িও বানিয়ে নিয়েছে। সুরঞ্জনের ঘুম পায়, আবার পায়ও না। সে শুনতে চায় না, তবু কানে ভাসে কারও কণ্ঠ-আলী মাস্টার, আবুল বাশার, আর শহীদ মোড়লরা বন্দুক স্টেনগান নিয়ে কমান্ডো কায়দায় নারায়ণগঞ্জের চরগোরকুলের ছটি হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়েছে। তারা সুভাষ মণ্ডল, সম্ভোষ, নেতাই, ক্ষেত্রমোহনের সব কিছু কেড়ে নিয়ে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে।
কে একজন সুরঞ্জনকে ডাকে-ওঠ, ওঠ সুরঞ্জন, খেয়ে নাও! ভাত দিয়েছে।
কাজলদাই ডাকছেন মনে হয়। মায়া এরকম ডাকে, দাদা এস, ভাত দিয়েছি, খেয়ে নাও। মায়ার নোটটি রাতে সে ভাঙাবো। কটা ঘুমের ওষুধ কিনবে। কতদিন মনে হয় ঘুমানো হয় না। তার। রাত হলেই ছারপোকা কামড়ায়। বিছানা ভরা ছারপোকা, ছোটবেলায় সুরঞ্জন দেখত কিরণময়ী হাতপাখা মেঝোয় টুকে ঠুকে ছারপোকা মারতেন। মায়াকে বলে আজ রাতেই ঘরের সব ছারপোকা মেরে ফেলতে হবে। টুকটুক করে কামড়ায় সারারাত। মাথার ভেতর কামড়ায়। সুরঞ্জনের আবার বিমঝিম করে ওঠে মাথা। বমি আসতে চায়। এর মধ্যে কে একজন বলে, তার বাড়ি রাজবাড়ি, সম্ভকত তাপসের গলা। এটি, আমাদের ওখানে তিরিশটি মন্দির আর মন্দিরের আশেপাশের বাড়িঘরে আগুন জ্বলিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে একটি কণ্ঠ সন্ধের ঝোঁকে গলগল করে বলে-নোয়াখালির খবর বলি শোন, সুন্দলপুর গ্রামে সাতটি বাড়ি আর অধরচাঁদ আশ্রম লুট করে আগুন জ্বলিয়ে দেয়। জগন্নানন্দ গ্রামে তিনটি বাড়িতে লুটপাটের পর আগুন লাগিয়ে দেয়। গঙ্গাপুর গ্রামেও তিনটি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ছাই করে দিয়েছে। রাগারগাঁও গ্রাম, দৌলতপুর গ্রাম, ঘোষবাগ, মাইজদি, সোনাপুরের কালী মন্দির, বিনোদপুর আখড়া, চৌমুহুনির কালী মন্দির, দুৰ্গাপুর গ্রাম, কুতুবপুর, গোপালপুর, সুলতানপুরের অখণ্ড আশ্রম, ছয়আনি বাজারের কয়েকটি মন্দির ভেঙে ফেলেছে। বাবুপুর তেতুইয়া, মহদিপুর, রাজগঞ্জ বাজার, টঙ্গির পাড়, কাজির হাট, রসূলপুর, জমিদারহাট, চৌমুহঁনি পোড়াবাড়ি, ভবভদ্রী গ্রামে দশটি মন্দির আঠারোটি বাড়িতে আগুন জ্বালানো হয়। কোম্পানিগঞ্জে বড় রাজপুর গ্রামে উনিশটি বাড়িতে লুটপাট, মেয়েদের নিয়ে যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটানো হয়। রামদি গ্রামে আজ বিপ্লব ভৌমিক নামের এক লোককে দা দিয়ে কোপানো হয়েছে।
সুরঞ্জন যদি তুলো দিয়ে কানের ফুটো দুটো বন্ধ করে রাখতে পারত। চারদিকে বাবরি মসজিদ প্রসঙ্গ, চারদিকে ভাঙা পোড়ার গল্প। আহ, যদি কোনও নির্জনতা পেত সুরঞ্জন। এই সময় ময়মনসিংহে চলে যেতে পারলে ভাল হত। এইসব ভাঙাভাঙিগুলো ওখানে কম। ব্ৰহ্মপুত্রে সারাদুপুর স্বান করতে পারলে বোধহয় শরীরে যে জ্বালা ধরছে, কিছু জুড়তো। ঝাঁট করে উঠে পড়ে সে। ঘরের লোক অনেকে এর মধ্যে চলে গেছে। সুরঞ্জনও যাবার জন্য পা বাড়ায়। কাজলদা বলেন–টেবিলে ভাত আছে, খেয়ে নাও। এই অসময়ে ঘুমোলে যে! শরীর খারাপ?
সূরঞ্জন আড়মোড়া ভেঙে বলে—না কাজলদা, খাব না। ইচ্ছে করছে না। শরীরটা যেন কেমন কেমন লাগছে।
–এর কোনও মানে হয়?
—মনে হয়ত হয় না। কিন্তু করব কি বলুন। একবার ক্ষিদে লাগে, একবার ক্ষিদে চলে যায়। টক ঢেকুর উঠছে, বুক জ্বলছে। ঘুম পায়, কিন্তু ঘুমোতে গেলে ঘুমও আসে না আর।
যতীন চক্রবর্তী সুরঞ্জনের কাঁধে হাত রেখে বলেন—তুমি ভেঙে পড়ছি সুরঞ্জন। আমাদের কি এভাবে হতাশ হলে চলবে? শক্ত হও। বেঁচে তো থাকতে হবে।
সুরঞ্জন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল, যতীনন্দার কথাগুলো সুধাময়ের কথার মত শোনায়। বাবার অসুস্থ শিয়রে তার কতদিন বসা হয় না। আজ আর দেরি করবে না বাইরে। কাজলদার বাড়ি এলেই এই হয়, নানারকম লোক আসেন। ধুম আড্ডা হয়। রাজনীতি, সমাজনীতির কঠিন কঠিন কথাবাত চলে অর্ধেক রাত পর্যন্ত। সুরঞ্জন কতক শোনে, কতক শোনে না।
টেবিলে বাড়া ভাত রেখেই সে চলে যায়। অনেকদিন বাড়িতে খায় না, আজ খাবে। আজি মায়া, কিরণময়ী, সুধাময়কে নিয়ে সে একসঙ্গে খেতে বসবে। এতদূরত্ব তৈরি হচ্ছে বাড়ির সবার সঙ্গে, দূরত্ব তৈরির কারণ অবশ্য সে নিজে। সামনে আর দেওয়াল রাখবে না। সুরঞ্জন। সকালে যেমন খুব মন ভাল ছিল, তেমন ভাল মন নিয়ে সে সবার সঙ্গে হাসবে, কথা বলবে, ছোটবেলার সেই রোদে বসে ভাপা পিঠে খাওয়ার দিনের মতা-মনেই হবে না। কেউ কারও পিতা পুত্র, কেউ কারও ভাই বোন, যেন বন্ধু সব, খুব কাছের বন্ধু। আজ আল্প কারও বাড়িতে যাবে না। সে, পুলকের বাড়ি না, রত্নার বাড়ি না। সোজা টুিকটুলি গিয়ে ডাল ভাত যা হোক খেয়ে সবার সঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করবে, তারপর ঘুম দেবে।
কাজলদা নীচের গেট অদি এগিয়ে দেন। খুব আন্তরিক কষ্ঠেই বলে-তোমার কিন্তু এভাবে বাইরে বের হওয়া ঠিক হচ্ছে না। আমরা এই বাউন্ডারির ভেতরেই যা চলাফেরা করছি, এর বাইরে নয়। এ বাড়িতে যারা এসেছে তারা কেউ দূর থেকে আসেনি। আর তুমি দিব্যি একা একা শহর ঘুরে বেড়ােচ্ছ। কখন কি ঘটে যায় বলা যায় না।
সুরঞ্জন কোনও কথা না বলে দ্রুত সামনে হাঁটে। পকেটে টাকা আছে, দিব্যি রিক্সা নেওয়া যায়। কিন্তু মায়ার টাকাটায় রীতিমত মায়া বসে গেছে, খরচ করতে ইচ্ছে করছে। না। সারাদিন সিগারেট ফোঁকেনি সে। টাকার মায়া ফুঁড়ে সারাদিন পর রাত ঘন হয়ে এলে তার সিগারেটের তৃষ্ণা হয়; দোকানো দাঁড়িয়ে এক প্যাকেট বাংলা ফাইভ কেনে, রাজা রাজা লাগে নিজেকে। হেঁটে হেঁটে কাকরাইলের মোড়ে এসে সে রিক্সা নেয়। শহর যেন অনেক আগেই আজকাল ঘুমিয়ে পড়ে। অসুস্থ থাকলে মানুষ যেমন সকাল সকাল ঘুমায়, শহরও তেমনি। শহরের রোগটা কি? ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়ে তার এক বন্ধুর পাছায় বড় এক ফোঁড়া হয়েছিল, দিনরাত চিৎকার করত, কিন্তু ওষুধ দেখলে ভয় পেত, ইনজেকশন দেখে তার রীতিমত কাঁপুনি উঠত। শহরের পাছায় কি তেমন একটি ফোঁড়া হয়েছে। সুরঞ্জনের সেরকমই মনে হয়।
৬ঘ.
-আচ্ছা মায়া, সুরঞ্জনের হয়েছে কি বল তো? সে এ সময় বাইরে বাইরে ঘুরছে। কোথায় বল তো দেখি। সুধাময় জিজ্ঞেস করেন।
—পুলকদার বাড়ি যাবে বলেছে। ওখানে আড্ডায় বসেছে নিশ্চয়।
—তাই বলে সন্ধের আগে বাড়ি ফিরবে না?
—কী জানি, বুঝতে পারি না। ফেরা তো উচিত?
–সে কি একবারও ভাবে না বাড়িতে মানুষগুলো দুশ্চিন্তা করছে, এবার বাড়ি ফিরি।
মায়া থামিয়ে দেয় সুধাময়কে। —থাক তুমি এত কথা বলে না। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তোমার। উচিতও নয়। চুপচাপ শুয়ে থােক। এখন অল্প একটু খাবে। এরপর কোনও বই-টই যদি পড়ে শোনাতে হয়, শোনাব। ঠিক দশটায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে যাবে। এর মধ্যে দাদা ফিরবেই, তুমি ভেব না।
—তুই আমাকে শিগরি ভাল করে তুলছিস মায়া। আমি না হয় আরও কটা দিন পড়ে থাকতাম বিছানায়। ভাল হওয়ার কিন্তু বিপদও আছে।
—কি রকম বিপদ? মায়া বিছানায় বসে ভাত চটকায় আর জিজ্ঞেস করে।
সুধাময় হেসে বলেন–তুই মুখে তুলে খাওয়াচ্ছিস, কিরণময়ী হাত পা মালিশ করছে। মাথা টিপে দিচ্ছে। এত আদর কি ভাল হয়ে গেলে পাব? তখন রোগী দেখ, বাজার কর, মায়ার সঙ্গে দুবেলা ঝগড়া কর। সুধুময় হেসে ওঠেন। মায়া অপলক সুধাময়ের হাসির দিকে তাকিয়ে থাকেন। অসুখের পর আজ প্রথম হাসতে দেখছে সে সুধাময়কে।
তিনি কিরণময়ীকেও বলছেন—আজ সব জানালা খুলে দাও তো। ঘর এত অন্ধকার হয়ে থাকে, ভাল লাগে না। আজ একটু হাওয়া ঢুকুক। শীতের হাওয়ার স্বাদই পেলাম না। কেবল কি বসন্তের হাওয়ায় সব ভাল লাগা? যৌবনে কনকনে শীতে দেওয়ালে পোস্টার লাগাতাম। গায়ে একটা ফিনফিনে শার্ট থাকত। মনি সিং-এর সঙ্গে সুসং দুগাপুরের পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরেছি। সে সময়ের টংক আন্দোলন, হাজং বিদ্রোহের কথা কিছু জানো কিরণময়ী?
কিরণময়ীরাও মন ভাল, বলেন—তুমি বিয়ের পর কত না গল্প করেছ। নেত্রকোণার এক অচেনা বাড়িতে মনি সিং-এর সঙ্গে রাত কাটিয়েছিলে!
—আচ্ছা কিরণ, সুরঞ্জন কি গরম কাপড় পরে গেছে।
মায়া ঠোঁট উল্টে বলে—আরে না। তোমার মতই ফিনিফিনে শার্ট পরা। তিনি তো আবার এ কালের বিপ্লবী। গায়ে তার প্রকৃতির হাওয়া লাগে না। যুগের হাওয়া সামলাতে ব্যস্ত।
কিরণময়ীর কণ্ঠে রাগ ফোটে–সারাদিন কোথায় থাকে, কী খায় না খায়। আন্দেী খায় কি না। ওর উচ্ছঙ্খলতা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
তখনই দরজায় খুটি খুঁট শব্দ। সুরঞ্জন এল নাকি? সুধাময়ের শিয়রের কাছে বসেছিলেন কিরণময়ী, উঠে যান দরজার দিকে। সুরঞ্জন ঠিক এভাবেই শব্দ করে। বেশি রাত হলে ও অবশ্য তার ঘরেই সোজা ঢোকে। কখনও দরজায় তালা দিয়ে যায়। তালা না দিলেও বাইরে থেকে ভেতরের ছিটিকিনি খুলবার কায়দা জানে। ও। বেশি রাতে যখন হয়নি, সুরঞ্জনই বোধহয়। মায়া সুধাময়ের জন্য জাউদ্ভাতে ডাল মাখছিল। খাবার ডলে ডলে সে নরম করছিল, সুধাময়ের খেতে যেন অসুবিধে না হয়। অনেক দিন লিকুইড খাওয়ানো হয়েছে। ডাক্তার সেমি সলিড খাবার কথা বলে গেছেন। শিংমাছের ঝোল করা হয়েছে। সামান্য ঝোল নিয়ে মাখছে। যখন মায়া, তখনই দরজায় খুঁট খুঁট শব্দ শোনে। কিরণময়ী দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করছেন কে। ওদিক থেকে কি উত্তর আসে কান পেতেছিলেন সুধাময়। কিরণময়ী দরজা খুলবোর সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে ঢোকে সাতজন যুবক। চারজনের হাতে মোটা লাঠি, আর বাকি তিনজনের হাতে কি দেখবার আগেই ওরা কিরণময়ীকে ডিঙিয়ে ভেতরের ঘরে ঢোকে। বয়স ওদের একুশ বাইশ হবে। দুজনের মাথারটুপি, পাজামা পাঞ্জাবি পরা। বাকি তিনজনের শার্ট প্যান্ট। ওরা ঢুকে কারও সঙ্গে কোনও কথা নেই টেবিল চেয়ার, কাচের আলমারি, টেলিভিশন, রেডিও, থালাবাসন, গ্লাস, বাটি, বইপত্র, ড্রেসিং টেবিল, কাপড়াচোপড়, পেডেস্টাল ফ্যান যা সামনে পাচ্ছে উন্মত্তের মত ভাঙতে শুরু করে। সুধাময় উঠে বসতে চান, পারেন না। মায়া চিৎকার করে ওঠে বাবা বলে। কিরণময়ী দরজা ধরে স্তব্ধ দাঁড়িয়েছিলেন। কী বীভৎস দৃশ্য। একজন কোমর থেকে একটি রামদা বের করে, বলে—শালারা বাবরি মসজিদ ভেঙেছিস। তোদের আস্ত রাখব ভেবেছিস?
ঘরের একটি জিনিসও আস্ত থাকে না। ঝনঝনি করে সব ভেঙে পড়তে থাকে। মুহুর্তের মধ্যে তছনছ হয়ে যায় সব, কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই। মায়াও ছিল স্থির, স্তব্ধ। হঠাৎ সে চিৎকার করে ওঠে যখন তার হাত ধরে টান দেয়। ওদের মধ্যে একজন। কিরণময়ীও তার ধৈর্য ভেঙে আর্তনাদ করে ওঠেন। সুধাময় গোঙান কেবল। তাঁর ভাষা ফোটে না। তিনি চোখের সামনে দেখেন মায়াকে ওরা টেনে নিচ্ছে। মায়া খাটের রেলিং ধরে নিজেকে আটকে রাখছে। কিরণময়ী দৌড়ে এসে দু হাতে আটকে রাখেন মায়াকে। দুজনের গায়ের শক্তি, দুজনের আর্তনাদকে ছুড়ে দিয়ে ওরা মায়াকে টেনে নিয়ে যায়। পেছন পেছন দৌড়েন। কিরণময়ী। চিৎকার করে বলতে থাকেনা-বাবারা ছেড়ে দাও। আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও।
রাস্তায় দুটো বেবি ট্যাক্সি দাঁড়ানো ছিল। মায়ার হাতে তখনও সুধাময়ের জন্য ভাত মাখানোর দাগ। ওড়না খুলে পড়ে গেছে। ওর। সে ‘মা গো মা গো চিৎকার করছেই। পেছনে আকুল চোখে তাকাচ্ছে কিরণময়ীর দিকে। কিরণময়ী তাঁর শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়েও মায়াকে ধরে রাখতে পারেননি। ওদের চকচকে রামদাকে তুচ্ছ করে কিরণময়ী ঠেলে সরাতে চেয়েছিলেন দুজনকে। পারেননি। ছুটে যাওয়া বেবি ট্যাক্সির পেছন পেছন তিনি দৌড়োতে থাকেন। পথচারী যাকে পান, বলেন-আমার মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে। একটু দেখুন, দেখুন না। দাদা। মোড়ের দোকানে কিরণময়ী থামেন। চুল খোলা, খালি পা, কিরণময়ী মতি মিয়াকে বলেন-একটু দেখবেন দাদা, কারা এইমাত্র ধরে নিয়ে গেল মায়াকে, আমার মেয়েকে। সকলে নিরুজ্ঞাপ চোখে তাকায় কিরণময়ীর দিকে। যেন পথের পাগল আবোল-তাবোল বকছে। কিরণময়ী দৌড়োতে থাকেন।
সুরঞ্জন বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে অবাক হয়। দরজা হাট করে খোলা! জিনিসপত্র সব তছনছ, টেবিল উল্টে পড়ে আছে, বইপত্র মেঝোয় গড়াচ্ছে। বিছানার তোষক চাদর বিছানায় নেই। আলনা ভেঙে পড়ে আছে, কাপড়চোপড় ছড়িয়ে আছে। সারা ঘরে। তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে ঢোকে। মেঝে ভর্তি ভাঙা কাচের টুকরো, চেয়ারের ভাঙা হাতল, ছেড়া বই, ওষুধের শিশি। সুখময় উপুড় হয়ে পড়ে আছেন ঘরের মেঝোয়। কাতরাচ্ছেন। মায়া, কিরণময়ী কেউ নেই। সুরঞ্জনের জিজ্ঞেস করতে ভয় হয় বাড়িতে কী হয়েছে’। সুধাময় নীচে পড়ে আছেন কেন? ওরাই বা কোথায়? জিজ্ঞেস করতে গিয়ে সুরঞ্জন ট্রের পায় তার গলা কাঁপছে। সে হতভম্ব দাঁড়িয়ে থাকে।
সুধাময় ধীরে, বেদনায় উচ্চারণ করেন-মায়াকে ধরে নিয়ে গেছে।
সুরঞ্জন আমূল কেঁপে ওঠে–ধরে নিয়ে গেছে? কারা নিয়েছে, কোথায়? কখন?
সুধাময় পড়ে আছেন, না পারছেন নড়তে, না পারছেন কাউকে ডাকতে। সুরঞ্জন আলগোছে সুধাময়কে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়। দ্রুত শ্বাস ফেলছেন তিনি, কুলকুল ঘামছেন।
—ম কোথায়? সুরঞ্জন অক্ষুট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
সুধাময়ের নীল হয়ে গেছে মুখ শঙ্কায়, হতাশায়। সারা শরীর কাঁপছে তাঁর। প্রেসার বাড়লে যে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সে এখন সুধাময়কে দেখবে, নাকি মায়াকে খুজতে যাবে। কিছুই স্থির করতে পারে না। সুরঞ্জন। তারও গা হাত পা কাঁপে। তার মাথার ভেতর পাক খায় ক্রুদ্ধ অস্থির জল। পাক খায় একপাল হিংস্ৰ কুকুরের মুখে পড়া একটি আদুরে বেড়ালী ছানার মায়াময় মুখ। সুরঞ্জন দ্রুত বেরিয়ে যায়। সুধাময়ের অচল হাতটি ছুঁয়ে বলে যায়–মায়াকে যে করেই হোক নিয়ে আসব বাবা।
হায়দারের বাড়ির দরজা জোরে ধাক্কায় সুরঞ্জন। এত জোরে যে হায়দার নিজে দরজা খোলে।
সুরঞ্জনকে দেখে চমকে ওঠে। বলে–কী খবর সুরঞ্জন? হয়েছে কি তোমার?
সুরঞ্জন প্রথম কিছু বলতে পারে না। গলার কাছে আটকে থাকে দালা-পাকানো কষ্ট। –মায়াকে ধরে নিয়ে গেছে। কলবার সময় কণ্ঠ বুজে আসে সুরঞ্জনের। তার আর বোঝাতে হয় না। মায়াকে কারা ধরে নিয়ে গেছে।
–কখন নিয়েছে?
সুরঞ্জন উত্তরে কিছু বলে না, কখন নিয়েছে এই খবরটির চেয়ে মায়াকে যে নিয়ে গেছে, এটিই কি জরুরি নয়? হায়দারের কপালে ভাঁজ পড়ে ভাবনার। দলের মিটিং ছিল, মিটিং সেরে সে মাত্রই বাড়ি ফিরেছে। এখনও কাপড় পাল্টানো হয়নি। শার্টের বোতাম খুলছে কেবল। সুরঞ্জন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে হায়দারের দিকে। বানে সৰ ভেসে গেলে যেমন দেখতে হয় মুখ, তাকে ঠিক লাগছে তেমন। সূরঞ্জন দাঁড়িয়েছিল। দরজা ধরে, যে হাতে দরজা ধরা সে হাতটি কাঁপছে তার। কপিন থামাবার জন্য সে মুঠি করে ধরে হাতটি। হায়দার তার কাঁধে হাত রেখে বলে-শান্তু হয়ে ঘরে বস, দেখি কি করা যায়।
কাঁধে হাত পড়তেই ডুকরে কেঁদে ওঠে সুরঞ্জন। হায়দারকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে বলে–মায়াকে এনে দাও হায়দার। মায়াকে দাও।
সুরঞ্জন কাঁদতে কাঁদতে নত হয়। নত হতে হতে সে হায়দারের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে। হায়দার অবাক হয়। এই লোহার মত শক্ত ছেলেটিকে কখনও সে কাঁদতে দেখেনি। তুলে তাকে দাঁড় করায় সে। হায়দার তখনও রাতের খাবার খায়নি, ক্ষিদে পেটে। তবু চল দেখি বলে বেরিয়ে যায়। হোন্ডার পেছনে সুরঞ্জনকে বসিয়ে টিকাটুলির অলিগিলিতে খোঁজে। সুরঞ্জন চেনে না। এমন সব ঘরে ঢেকে। টিমটিম করে বাতি জ্বলছে এমন কিছু পান বিড়ির দোকানঅলার সঙ্গেও ফিসফিস করে কথা বলে। টিকাটুলি পার করে ইংলিশ রোড, নবাবপুর, লক্ষ্মীবাজার, লালমোহন সাহা স্ট্রিট, বকশি বাজার, লালবোগ, সূত্রপুর, ওয়াইজ ঘাট, সদরঘাট, প্যারীমোহন দাস রোড, অভয় দাস লেন, নারিন্দা, আলু বাজার, ঠাঁটারি বাজার, প্যারীদাস রোড, বাবুবাজার, উর্দু রোড, চক বাজারে বোঁ বোঁ করে ঘুরুল হায়দারের হোন্ডা। এঁদো গলির ভেতর কাদাজলে হাঁটু ডুবিয়ে গিয়ে এক-একটি অস্বীকার বাড়ির কড়া নেড়ে হায়দার কাকে যে খোঁজে, সুরঞ্জন বুঝে পায় না কিছু। হায়দার এক-এক জায়গায় নামে আর সে ভাবে এখানেই বুঝি আছে মায়া। মায়াকে বোধহয় এখানেই হাত পা বেঁধে ওরা পেটাচ্ছে, কেবল কি পেটাচ্ছেই নাকি আরও কিছু করছে। সুরঞ্জন কান পেতে থাকে মায়ার কান্নার শব্দ কোথাও থেকে ভেসে আসে কি না।
লক্ষ্মী বাজারের কাছে একটি কান্নার শব্দ শুনে সুরঞ্জন হোল্ডা থামাতে বলে। বলে–শোন তো, মায়ার কান্না মনে হচ্ছে না?
কান্নাটির পেছন পেছন যায়। তারা দেখে টিনের একটি দোচালা বাড়িতে বাচ্চা কাঁদছে। বিলি কেটে কেটে খোঁজে হায়দার। রাত গভীর হতে থাকে। সুরঞ্জন থামে না। গলিতে গলিতে দিলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে লাল চোখের ছেলেরা, দেখে সুরঞ্জনের মনে হয়, বুঝি। এরাই নিয়েছে, এরাই বুঝি তার নিরীহ মায়া মায়া মুখের বোনটিকে আটকে রেখেছে।
—হায়দার, পাচ্ছ না কেন? এখনও পাচ্ছ না কেন মায়াকে?
–আমি তো চেষ্টা করছিই।
—যে করেই হোক মায়াকে আজ রাতের মধ্যেই পেতে হবে।
—এমন কোনও মস্তান ছেলে নেই যাকে খুঁজছি না। না পেলে কি করব বল। সুরঞ্জন একটির পর একটি সিগারেট ধরায়। মায়ার টাকায় কেনা সিগারেট।
—সুপারস্টারে চল কিছু খেয়ে নিই। ক্ষিধে পেয়েছে।
পরোটা মাংসের অডার দেয় হায়দার। দু প্লেট। সুরঞ্জন খেতে চায়, পরোটার টুকরো তার হাতেই রয়ে যায়, মুখে ওঠে না। যত সময় যায়, বুকের মধ্যটা খালি হয় তত। হায়দার গোগ্রাসে খায়। খেয়ে সিগারেট ধরায়। সুরঞ্জন তাড়া দেয়। —চল উঠি, এখনও তো পাওয়া যাচ্ছে না।
–আর কোথায় খুঁজিব, বল। বাকি তো রাখিনি কোনও জায়গা। নিজের চোখেই তো দেখলে!
–ঢাকা একটা ছোট্ট শহর। এখানে মায়াকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, কথা হল? থানায় চল।
থানায় ঘটনাটি জানালে পুলিশের লোক ভাবলেশহীন মুখে ডায়রি করুবার খাতা টেনে নাম-ধাম লিখে রাখে। ব্যস। থানা থেকে বেরিয়ে সুরঞ্জন বলে-ওরা কোনও কাজ করবে বলে মনে হচ্ছে না।
—করতেও পারে।
–ওয়ারির দিকটা চল যাই। ওখানে চেনা কেউ আছে-তোমার?
–আমি পাটির ছেলেদের লাগিয়ে দিয়েছি। ওরাও খুঁজবে। তুমি ভেব না তো।
হায়দার চেষ্টা করছে, তবু দুশ্চিন্তার বোলতা সুরঞ্জনের সারা শরীর কামড়ায়। সারারাত হায়দারের হোন্ডটি পুরনো শহরে ঘোরে। মস্তানদের মদের আড্ডা, জুয়োর আড্ডা, স্মাগলারদের ঘুপচি ঘর খুঁজতে খুঁজতে একসময় আজান পড়ে। আজানের সুরটি সুরঞ্জনের ভালই লাগত, ভৈরবী রাগে গাওয়া। এটি আজ বড় বিচ্ছিরি লাগে তার। আজান হচ্ছে, তার মানে রাত শেষ হয়ে এল, মায়াকে পাওয়া হল না!! টিকাটুলিতে এসে হোল্ডা থামায় হায়দার। বলে—সুরঞ্জন, মন খারাপ করো না। কাল দেখি কী করা যায়।
লণ্ডভণ্ড ঘরে বসে কিরণময়ী ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে ছিলেন দরজার দিকে, সুরঞ্জন মায়াকে নিয়ে ফিরবে। এই আশায় সুধাময়ও তাঁর চেতনাহীন অঙ্গ নিয়ে নিদ্রাহীন উদ্বিগ্ন সময় পার করছিলেন। ওঁরা দেখেন ছেলে খালি হাতে ফিরেছে। মায়া নেই। ক্লান্ত, ব্যর্থ নতমুখ, বিষন্ন সুরঞ্জনকে দেখে দুজনই বাকরুদ্ধ হন। তবে কি মায়াকে আর পাওয়া যাবে না? দুজনই ভয়ে সিঁটিয়ে আছেন। বাড়ির দরজা জানোলা সব বন্ধ, কোনও ঘরে ভেন্টিলেটর নেই। হাওয়া আটকে আছে। ঘরে। ভ্যাপসা গন্ধ বেরোচ্ছে। হাত পা মাথা গুটিয়ে বসে আছেন ওঁরা। কেমন ভূতের মত দেখতে লাগে ওঁদের, সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে না। কারও সঙ্গে কথা বলতে। ওঁদের দু চোখে একগাদা প্রশ্ন। সব প্রশ্নের তো উত্তর একটিই, মায়াকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মেঝোয় পা ছড়িয়ে বসে পড়ে সুরঞ্জন। তার বমি বমি লাগে। এতক্ষণে মায়ার ওপর সম্ভবত গণধর্ষণও সারা। আচ্ছ এরকম কি হতে পারে না, ছ। বছরের মায়া যেমন দু দিন পর ফিরে এসেছিল, সেরকম এবারও ফিরে এল! সুরঞ্জন দরজা খুলেই রেখেছে, মায়া ফিরে আসবে, ফিরে আসুক মায়া, ছোটবেলার মত উদাসীন পায়ে হেঁটে ফিরে আসুক। এই ছোট্ট, বিধ্বস্ত, সর্বস্বাস্ত সংসারে ও ফিরে আসুক। হায়দার কথা দিয়েছে মায়াকে খুঁজবে আরও। কথা যখন দিয়েছে, সুরঞ্জন কি এই স্বপ্ন দেখতে পারে যে মায়া ফিরবে! মায়াকে কেন ধরে নিয়ে গেল ওরা? মায়া হিন্দু বলে? আর কত ধর্ষণ, কত রক্ত, কত ধনসম্পদের বিনিময়ে হিন্দুদের বেঁচে থাকতে হবে এই দেশে? কচ্ছপের মত মাথা গুটিয়ে রেখে! কতদিন? সুরঞ্জন নিজের কাছে উত্তর চায়। পায় না।
কিরণময়ী বসেছিলেন ঘরের এক কোণে, দেওয়ালে পিঠ রেখে, কারও জন্য নয়, নিজেকে শুনিয়ে তিনি বলেন–ওরা বলল, মাসিমা, আপনাদের দেখতে এসেছি কেমন আছেন। আমরা পাড়ারই ছেলে। দরজাটা খুলুন। ওদের বয়স আর কত, কুড়ি একুশ, বাইশ এরকম। আমি কি ওদের সঙ্গে পারি শক্তিতে? পাড়ার বাড়িগুলোয় গিয়ে কেঁদে পড়লাম, সবাই শুনল শুধু। চুক চুক করে দুঃখ করল, কেউ কোনও সাহায্য করল না। ওদের একজনের নাম রফিক, টুপিঅলা একটা ছেলেকে ডাকতে শুনলাম। পারুলের বাড়ি লুকিয়ে ছিল। ক’দিন। ওখানে থাকলে বেঁচে যেত। মায়া কি ফেরত আসবে না? তার চেয়ে বাড়িটা পুড়িয়ে দিত। নাকি বাড়িঅলা মুসলমান বলে পোড়ায়নি। তার চেয়ে মেরে যেত, আমাকেই মেরে যেত। তবু নিরপরাধ মেয়েটিকে রেখে যেত। জীবন তো শেষই ছিল আমার, ওর তো ছিল শুরু।
প্রচণ্ড ঘুরে ওঠে মাথা সুরঞ্জনের। সে গলগল করে বমি করে কলঘর ভাসিয়ে ফেলে।