রেইনকোট

রেইনকোট

ভোররাত থেকে বৃষ্টি। আহা! বৃষ্টির ঝমঝম বোল। এই বৃষ্টির মেয়াদ আল্লা দিলে পুরো তিন দিন। কারণ শনিতে সাত মঙ্গলে তিন, আর সব দিন দিন। এটা জেনারেল স্টেটমেন্ট। স্পেসিফিক ক্ল্যাসিফিকেশনও আছে। যেমন, মঙ্গলে ভোররাতে হইল শুরু, তিন দিন মেঘের গুরুগুর। তারপর, বুধের সকালে নামল জল, বিকালে মেঘ কয় এবার চল। বৃহস্পতি শুক্র কিছু বাদ নাই। কিন্তু এখন ভুলে গেছে। যেটুকু মনে আছে, পুরু বেড-কভারের নিচে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আর-একপশলা ঘুমিয়ে নেওয়ার জন্যে তাই যথেষ্ট। অন্তত তিন দিন ফুটফাট বন্ধ। বাদলায় বন্দুক-বারুদ কি একটু জিরিয়ে নেবে না? এই কটা দিন নিশ্চিন্তে আরাম করো।

তা আর হলো কৈ? ম্যান প্রোপোজেস। এমন চমৎকার বাদলার সকালে দরজায় প্রবল কড়া নাড়া শেষ হেমন্তের শীত শীত পর্দা ছিঁড়ে ফালাফালা করে ফেলল। সব ভেস্তে দিল। মিলিটারি! মিলিটারি আজ তার ঘরে। আল্লা গো। আল্লাহুম্মা আন্তা সুবহানকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জোয়ালেমিন। — পড়তে পড়তে সে দরজার দিকে এগোয়। এই কয়েকমাসে কত সুরাই সে মুখস্ত করেছে। রাস্তায় বেরুলে পাঁচ কলেমা সব সময় রেডি রাখে ঠোঁটের ওপর। কোনদিক থেকে কখন মিলিটারি ধরে।—তবু একটা না একটা ভুল হয়েই যায়। দোয়া মনে হলো ঠিকই কিন্তু টুপিটা মাথায় দিতে ভুলে গেল।

দুটো ছিটকিনি, একটা খিল এবং কাঠের ডাঁশা খুলে দরজার কপাট ফাঁক করতেই বাতাস আর বৃষ্টির ঝাপ্‌টার সঙ্গে ঘরে ঢোকে প্রিন্সিপ্যালের পিওন। আলহামদুলিল্লাহ! মিলিটারি নয়। পিওনকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু লোকটার চিনচিনে গলা গম্ভীর স্বরে হাঁকে, ‘স্যর নে সালাম দিয়া।’ বলেই ভাঙাচোরা গালের খোঁচাখোঁচা দাড়িতে লোকটা নিজের বাক্যের কোমল শাঁসটুকু শুষে নেয় এবং হুকুম ছাড়ে, তলব কিয়া। আভি যানে হোগা।’

কী ব্যাপার?

বেশিকথা বলার সময় নাই—কলেজের দেওয়াল ঘেঁষে কারা বোমা ফাটিয়ে গেছে গত রাতে।

মানে?

‘মিসকিরিয়ান লোগ ইলেকটিরি টেরানসফার্মার তোড় দিয়া। অওর ওয়াপস যানে কা টাইম পিরিনসিপাল সাহাবকা কোঠিমে গেরেনড ফেকা। গেট তোড় গিয়া।’

ভয়াবহ কাণ্ড। ইলেকট্রিক ট্র্যানসফর্মার তো কলেজের সামনের দেওয়াল ঘেঁষে। দেওয়ালের পর বাগান, টেনিস লন। তারপর কলেজ দালান। মস্ত দালান পার হয়ে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার মাঠ। মাঠ পেরিয়ে একটু বাঁ দিকে প্রিনসিপ্যালের কোয়ার্টার। এর সঙ্গে মিলিটারি ক্যাম্প। কলেজের জিমনাশিয়ামে এখন মিলিটারি ক্যাম্প। প্রিনসিপ্যালের বাড়ির গেটে বোমা ফেলা মানে মিলিটারি ক্যাম্প অ্যাটাক করা। সামনের দেওয়ালে বোমা মেরে এতটা পথ ক্রস করে গেল কী করে? সে জানতে চায়, ‘ক্যায়সে?’

প্রিনসিপ্যালের পিওন জানবে কী করে? উও আপ হি কহ সকতা।’

মানে? সে-ই বা বলবে কী করে? পিওন কি তাকে মিসক্রিয়ান্টদের লোক ভাবে নাকি?–তার মাথাটা আপনাআপনি নিচু হলে মুখ দিয়ে পানির মতো গড়িয়ে পড়ে, ‘ইসহাক মিয়া, বৈঠিয়ে। চা টা খাইয়ে। আমার এই পাঁচ সাত মিনিট লাগেগা।’

‘নেহি।’ নাশতার আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়ে ইসহাক বলে, আব্দুস সাত্তার মিরধাকা ঘর যানে হোগা। আপ আভি আইয়ে। এক কর্নেল সাহাব পছ গিয়া। মিরধাকা ঘর যানে হোগা। আপ আভি আইয়ে।‘

কর্নেলের নেতৃত্বে মিলিটারির হাতে কলেজটা এবং তাকেও ন্যস্ত করে ইসহাক বেরিয়ে যায়, রাস্তায় ঘরঘর-করতে-থাকা বেবি ট্যাকসির গর্জন তুলে সে রওয়ানা হলো জিওগ্রাফির প্রফেসরের বাড়ির দিকে। ইসহাক নিজেই এখন মিলিটারির কর্নেল বললেও চলে। তবে ভোরবেলা কলেজের ভেতরে কর্নেল খোেদ চলে আসায় সে হয়তো ডেমোটেড হয়েছে লেফটেনান্ট কর্নেলে। আরো নিচেও নামাতে পারে। কিন্তু ক্যাপ্টেনের এদিকে তাকে ঠেলা মুশকিল। মিলিটারি প্রাদুর্ভাবের পর থেকে তাকে দেখে কলেজের সবাই তটস্থ। এপ্রিলের শুরু থেকে সে বাংলা বলা ছেড়েছে। কোনকালে দাদা না পরদাদার ভায়রার মামু না কে যেন দিল্লিওয়ালা কোন সাহেবের খাস খানসামা ছিল, সেই সুবাদে দিনরাত এখন উর্দু বলে। প্রিনসিপ্যাল গাট্টাগোট্টা বেঁটেখাটো মানুষ, নিজের চাপরাশির সঙ্গে নতুন জবাব লব্‌জ করতে গিয়ে গলায় তার রক্ত উঠে যায়, ‘ইসাক মিয়া, দেশতে বহুত মুসিবত হো রহা হ্যায়। প্রফেসর লোক আদমিকো হুঁশিয়ার থাকতে বলিয়ে। গুজব বোলনা মানা কর দিজিয়ে। আভি মিলিটারি সাহাবকো মদদ করনা এখন ফরজ কাম হ্যায়।

‘জরুর। দেশলাইয়ের কাঠির মতো রোগাপটকা শরীরের ওপর ফিট-করা ভিজে বারুদের মতো ছোট্ট মাথাটা ঝাঁকিয়ে ইসহাক আরো তিনবার সম্মতি দেয়, ‘জরুর। জরুর। জরুর।‘ কয়েকদিন আগের ইসহাকের এই ‘জরুর’ বৃষ্টিতে ভিজে আরো টাটকা হয়ে তার কানে বাজতে না বাজতে শব্দটিই কোথায় যেন ফেটে পড়ে দুম করে। এই বৃষ্টিতে কি ফের শুরু হলো নাকি?–না, না, এটা স্রেফ মেঘের গর্জন। বৃষ্টি বোধহয় বাড়ছে। না—। এখন বেরুতেই হয়। আল্লা ভরসা।

‘যেতেই হবে? অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজে তোমার হাঁপানির টানটা বৌয়ের এসব সোয়াগের কথা শুনলে কি তার চলবে? বৌ কি প্রিনসিপ্যালের ধমকের ভাগ নেবে? এর ওপর কলেজে কর্নেল এসেছে। কপালে আজ কী আছে আল্লাই জানে! ফায়ারিং স্কোয়াডে যদি দাঁড় করিয়েই দেয় তো কর্নেল সাহেবের হাতে পায়ে ধরে ঠিক কপালে গুলি করার হুকুম জারি করানো যায় না? প্রিনসিপ্যাল কি তার জন্যে কর্ণেলের কাছে এই তদবিরটুকু করবে না? পাকিস্তানের জন্যে প্রিনসিপ্যাল দিনরাত দোয়া-দরুদ পড়ছে। সময় নাই অসময় নাই আল্লার দরবারে কান্নাকাটি করে এবং সময় করে কলিগদের গালাগালিও করে। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি প্রিনসিপ্যাল মিলিটারির বড়োকর্তাদের কাছে সবিনয়ে নিবেদন করেছিল, পাকিস্তান যদি বাঁচাতে হয় তো সব স্কুলকলেজ থেকে শহিদ মিনার হঠাও। এসব আনঅথরাইজড কনস্ট্রাকশন হলো হিন্দুর শিবলিঙ্গের সামিল, এগুলো হলো পাকিস্তানের শরীরের কাটা। পাকিস্তানের পাক সাফ শরীরটাকে নীরোগ করতে হলে এসব কাঁটা ওপড়াতে হবে। তা মিলিটারি ডক্টর আফাজ আহমদের পরামর্শ শুনেছে, গ্রামে-গঞ্জে যেখানেই গেছে, প্রথমেই কামান তাগ করেছে শহিদ মিনারের দিকে। দেশে একটা কলেজে শহিদ মিনার আর অক্ষত নাই। তা প্রিনসিপ্যাল তাদের এত বড়ো একটা পরামর্শ দিল, আর সামান্য এক লেকচারারকে গুলি করার সময় শরীরের আলতুফালতু জায়গা বাদ দিয়ে কপালটা টার্গেট করার অনুরোধটা তার মানবে না? আবার প্রিনসিপ্যালকে সে এত সার্ভিস দিচ্ছে, তার কলিগের, তওবা, সাব-অর্ডিনেটের জন্যে এতটুকু করবে না?

প্যান্টের ভেতর পা গলিয়ে দিতে দিতে সে শোনে রান্নাঘর থেকে বৌ বলছে, ‘তাড়াতাড়ি চলে এসো। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে মীরপুর ব্রিজের দিক থেকে গুলির আওয়াজ আসছিল। কখন কী হয়।’

এসব কথা এখন বলার দরকারটা কী?—রেডিও টেলিভিশনে হরদম বলছে, সিচুয়েশন নর্মাল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক। দুষমনকে সম্পূর্ণ কব্‌জা করা গেছে। মিসক্রিয়েন্টরা সব খতম। প্রেসিডেন্ট দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। কিছুদিন বাদে বাদে তার ভাষণ শোনা যায়, আওয়ার আলটিমেট এইম রিমেইনস দ্য সেম, দ্যাট ইজ টু হ্যান্ডওভার পাওয়ার টু দি ইলেকটেড রিপ্রেজেনটেটিভস অব দ্য পিপল। সবই তো নর্মাল হয়ে আসছে। বাঙালি, আই মিন, ইস্ট পাকিস্তানি গভর্নর, মন্ত্রীরা ইস্ট পাকিস্তানি। সবই তো স্বাভাবিক। এখন বৌ তার এসব বাজে কথা বলে কেন? ইস! আসমাকে নিয়ে আর পারা যায় না। পরশু রাতে বিছানায় ছটফট করতে করতে বলে কি, রাত্রে দুই-চারবার গুলিগালাজের আওয়াজ না শুনলে ঘুম হয় না।–এর জন্যেই তার ঘরে কখন যে কী মুসিবত নেমে আসে আল্লাই জানে।

‘এই বৃষ্টিতে শুধু ছাতায় কুলাবে না গো।’ বৌয়ের আরেক দফা সোয়াগ শোনা গেল, তুমি বরং মিন্টুর রেইনকোটটা নিয়ে যাও।’

ইস! আবার মিন্টু। বৌয়ের এই ভাইটার জন্যেই তাকে এক্সট্রা তটস্থ হয়ে থাকতে হয়। বাড়ি থেকে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তার মগবাজারের দুই কামরার ফ্ল্যাট থেকেই তো মিন্টু চলে গেল জুন মাসে, জুনের ২৩ তারিখে। জুলাইয়ের পয়লা তারিখে সে বাড়ি শিফট করল। বলা যায় না, ওখানে যদি কেউ কিছু আঁচ করে থাকে। ও চলে যাবার তিনদিন পরেই পাশের ফ্ল্যাটের গোলগাল মুখের মহিলা তার বৌকে জিগ্যেস করেছিল, ‘ভাবি, আপনার ভাইকে দেখছি না। ব্যস, এই শুনেই সে বাড়ি বদলাবার জন্যে লেগে গেল হন্যে হয়ে। মিলিটারি লাগার পর থেকে এই নিয়ে চারবার বাড়ি পাল্টানো হলো। এখানে আসার পর নিচের তলার ভদ্রলোক একদিন বলছিল, ‘আমার ভাইটাকে আর ঢাকায় রাখলাম না। যে গোলমাল, বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম।’ শুনে বুকটা তার টিপটিপ করছিল, এবার যদি তার শালার প্রসঙ্গ তোলে? নিরাপত্তার জন্যেই সে এখানে এসেছে। কলেজ থেকে দূরে, আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে। শহর থেকেও দূরেই বলা যায়। ভেবেছিল নতুন এলাকা, পুবদিকে জানলা ধরে দাঁড়ালে চোখে পড়ে বিল আর ধানক্ষেত। তা কী বিপদ! এদিকে নাকি নৌকা করে চলে আসে স্টেনগানওয়ালা ছোকরার দল। এদিককার মানুষ চোখে খালি নৌকা দেখে, নৌকা ভরা অস্ত্র। এর ওপর বৌ যদি মিন্টুর কথা তোলে তো অস্ত্র ঢুকে পড়ে তার ঘরের মধ্যিখানে। মিন্টু যে কোথায় গেছে তা সে-ও জানে তার বৌ-ও জানে। আবার দেখো, নিজের ভাইয়ের গৌরব প্রতিষ্ঠা করতে আসমা ছেলেমেয়েদের কী বলেছে, তারা পর্যন্ত বলে, ‘ছোটোমামা গেছে খানসেনাদের মারতে।’ কোন কথায় কী বিপদ হয়, কেউ বলতে পারে? তা আসমার যদি এতই সাহস তো সেও ভাইয়ের সঙ্গে কোমর বাঁধল না কেন? –মুখে বলা যায় না, কিন্তু বলার জন্যে তার জিভ কাঁপে, মিন্টুর কথা ভুলে যাও আসমা, ভুলে যাও। আমাদের সঙ্গে কেউ নাই, কেউ নাই। কিসিনজার সাহেব বলেছে, এসব হলো পাকিস্তানের ইনটার্নাল অ্যাফেয়ার। —মানুষ মেরে সাফ করে দেয়, বাড়িঘর, গ্রাম, বাজারহাট জ্বালিয়ে দিচ্ছে–কারো কোনো মাথাব্যথা নাই। এসব হলো ইনটার্নাল অ্যাফেয়ার। –না, না, এ ধরনের ভাবনা ধারে কাছে ঘেঁষতে দেওয়াও ঠিক নয়। নিচের ফ্ল্যাটে থাকে এক ওয়েলডিং ওয়ার্কশপের মালিক, তার শ্বশুর নিশ্চয়ই সর্দার গোছের রাজাকার। সপ্তাহে দুইদিন-তিনদিন মেয়ের বাড়িতে রেফ্রিজারেটর, টেপ রেকর্ডার, দামি দামি সোফাসেট, ফ্যান, খাট-পালং সব চালান পাঠায়। একদিন এমনকি হিন্দুদের কোন দেবতার মূর্তি পর্যন্ত এসেছিল, সোনার কিনা কে জান। ট্রাক-ট্রাক মাল আসে, আবার চলেও যায়। রাজাকার এসব পায় কোথায়? লোকটা যদি টের পায় যে তার জামাইয়ের ওপরতলায় প্রফেসারের শালা হলো মিসক্রিয়েন্ট, মিলিটারি খতম করার নিয়ত করে সে চলে গেছে এই বোনের ঘর থেকেই, তা হলে গোলাগুলি চলবে এই বাড়িতেই, এই ঘরের মধ্যে। সেই গুলির বোলে আসমাকে ঘুম পাড়তে হবে সারা জীবনের জন্যে। এখানে কথাবার্তা বলার সময় হুঁশ ঠিক রাখা দরকার।

‘দেখি তো, ফিট করে কিনা। আসমা এগিয়ে এসে তার গায়ে রেইনকোট চড়িয়ে দিতে দিতে বলে, ‘মিন্টু তো আবার অনেক লম্বা। তোমার গায়ে হবে তো?’–দেখো, ফের মিন্টুর দৈর্ঘ্যের তুলনা করে তার সঙ্গে। এই ভাইকে নিয়ে এরকম বাড়াবাড়ি করাটা কি আসমার ঠিক হচ্ছে?

‘ভালোই হলো। তোমার গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা পড়েছে। পায়েও বৃষ্টি লাগবে না। এখানেই আসমার শেষ নয়। রেইনকোটের সঙ্গেকার টুপি এনে চড়িয়ে দেয় তার মাথায়। মিন্টুটার কাজ! শালা তার আবার কী মহৎ কীর্তি স্থাপন করল। না, এবার তার কৃতিত্ব অন্যরকম। কী? না, ‘আলনায় ঝুলিয়ে গেছে রেইনকোট, টুপিটা রেখে গেছে ওয়ার্ডরোবের মাথায়। কাল কোরান শরিফ নামাতে গিয়ে দেখি ওটা পড়ে আছে।’

আর কিছু রাখেনি তো? নিজের চোখে দেখতে সে ওয়ার্ডরোবের ওপরটায় ভালো করে চোখ বোলায়। মগবাজারে এক বাড়িতে মিলিটারি ঢুকে খাটের নিচে চাইনিজ রাইফেল পেয়েছিল তিনটে। অথচ বাড়ির বাসিন্দা, গোবেচারি ডাক্তার এর কিছুই জানত না। ঘরের জিনিসপত্র রোজ রোজ দেখে রাখা ভালো।

‘আব্বু ছোটোমামা হয়েছে। আব্বু ছোটোমামা হয়েছে। মেয়ের সদ্য-ঘুম-ভাঙা গলায় ভাঙা ভাঙা বুলি শুনে সে চমকে ওঠে, মিন্টু কি ঢুকে পড়লো অস্ত্রশস্ত্র হাতে? এর মানে ওর পিছে পিছে ঢুকছে মিলিটারি। তার মানে —। না, দরজার ছিটকিনি ও খিল সব বন্ধ। আড়াই বছরের কন্যা বিছানায় বসে বসেই হাততালি দেয়, ‘আব্বু ছোটোমামা, আব্বু ছোটোমামা।

তাকে কি মিন্টুর মতো দেখাচ্ছে? মিলিটারি আবার ভুল করে বসবে না তো? এর মধ্যে তার পাঁচ বছরের ছেলেটা গম্ভীর চোখে তাকে পর্যবেক্ষণ করে রায় দেয়, আব্বুকে ছোটোমামার মতো দেখাচ্ছে। আব্বু তা হলে মুক্তিবাহিনী। তাই না?’

এ তো ভাবনার কথা। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের নতুন রূপে সে ভ্যাবাচ্যাকা খায়। রঙ খাকি নয়, আবার জলপাই রঙও নয়। মাটির মতো রঙটা একটু জ্বলে গেছে, তবে তাতে জেল্লা কমেনি। দেখতে একটু মিলিটারি মিলিটারি লাগছে। মিলিটারির মতো দেখা নিরাপদ নয়। রেইনকোট পরাকে মিলিটারির ছদ্মবেশ বলে গণ্য করলে তাকে ধরে সোজা পাঠিয়ে দেবে ক্যান্টনমেন্ট। না—! খামাখা ভয় পাচ্ছে। বৃষ্টির দিনে রেইনকোট গায়ে দেওয়াটা অপরাধ হবে কেন? মিলিটারির কি আর বিবেচনাবোধ নাই? প্রিনসিপ্যাল ডঃ আফাজ আহমদ ঠিকই বলে, ‘শোনেন, মিলিটারি যাদের ধরে, মিছেমিছি ধরে না। সাবভার্সিভ অ্যাকটিভিটিজের সঙ্গে তারা সামহাউ অর আদার ইনভলভড়।’ তা সে তো বাপু এসব থেকে শতহাত দূরে। শালা তার বর্ডার ক্রস করল, ফিরে এসে দেশের ভেতরে দমাদম মিলিটারি মারে। তাতে আর দুলাভাইয়ের দোষটা কোথায়? এই যে মিলিটারি প্রত্যেকদিন এই ঢাকা শহরেই বাজার পোড়ায়, বস্তিতে আগুন লাগিয়ে টপাটপ মানুষ মারে, মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়, সে কখনো এসব নিয়ে টু শব্দটি করেছে? কলেজের দেওয়াল ঘেঁষে প্রিনসিপ্যালের কোয়ার্টারের পাশে মিলিটারি ক্যাম্প, ক্লাশটাশ সব বন্ধ। ছেলেরা কেউ আসে না। মাস্টারদের হাজিরা দিতে হয়, তাও বহু টিচার গা ঢাকা দিয়েছে কবে থেকে। সে তো রোজ টাইমলি যায়। স্টাফ রুমে কলিগরা ফিসফিস করে, কোথায় কোন ব্রিজ উড়ে গেল, কোথায় সাত মিলিটারির লাশ পড়েছে ছেলেদের গুলিতে, এই কলেজের কোন কোন ছেলে ফ্রন্টে গেছে, কৈ, সে তো এসব আলাপের মধ্যে কখনো থাকে না। এসব কথা শুরু হলেই আলগোছে উঠে সে চলে যায় প্রিনসিপ্যালের কামরায়। ডঃ আফাজ আহমদের খ্যাসখ্যাস গলায় হিন্দুস্তান ও মিসক্রিয়েন্টদের আশু ও অবশ্যম্ভাবি পতন সম্বন্ধে নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী শোনে। ঐ ঘরে আজকাল সহজে কেউ ঘেঁষে না। উর্দুর প্রফেসর আকবর সাজিদকে প্রিনসিপ্যাল আজকাল তোয়াজ করে। তো ঐ সাজিদ আবার স্যরকে আমল দেয় না। বরং মাঝে মাঝে আপকা তবিয়ৎ ভালো হ্যায়?’ বলে প্রিনসিপ্যালের উর্দুচর্চা নিয়ে ঠাট্টা করে। ডঃ আফাজ আহমদ পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য উদ্বিগ্ন থাকে বলে কিংবা জবাব দেওয়ার জন্যে ঠিকঠাক উর্দু বাক্য গঠন করতে পারে না বলে চুপ করে থাকে। আবার কথার জবাব না পেয়ে সাজিদ পাছে রাগ করে এই ভেবে হেঁ হেঁ করে, জি হাঁ। আপনার মেহেরবানি। সাজিদ হাসে, ‘আমার মেহেরবানি? আমি মেহেরবানি করার কে? বলিয়ে জেনারেল সাহাবকো মেহেরবানি।’ এরপর কথা বলতে গেলে উর্দু জবাবে আর কুলাবে না বলে প্রিনসিপ্যাল খামোশ মেরে যায়। উর্দুর প্রফেসারকে নিয়ে লোকটা মুশকিলে পড়েছে। কোনটা তার ঠাট্টা আর কোনটা অ্যাপ্রিসিয়েশন বোঝা দিনদিন শক্ত হয়ে পড়েছে। এমনকি মিলিটারির তৎপরতায় অভিভূত প্রিনসিপ্যালের যুদ্ধ সম্বন্ধে বিশ্লেষণ শুনতে শুনতে সাজিদ একদিন আপনি মিলিটারি সায়েন্সের ওপর ডক্টরেট করে ফেলেন স্যার। মোহাম্মদপুরের এক এল এম এফ ডাক্তার আজকাল হোমিওপ্যাথি শুরু করেছে, অ্যালোপ্যাথি ভি ছাড়ল না। তো মহল্লার মানুষ ওর নাম দিল ডবল ডক্টর। তা আপনি ডবল ডক্টর হয়ে যান।’ বলতে বলতে হো হো করে হাসলে ডঃ আফাজ আহমদকে তার সিঙ্গল ডক্টরেট নিয়েই হেঁ হেঁ করতে হয়। কলিগরা পড়ে বিপদে। এই অসময়ে কোন রসিকতায় হাসাটা নিরাপদ তারা ঠিক ঠাহর করতে পারে না।

মিন্টুর ফেলে-যাওয়া নাকি রেখে যাওয়া রেইনকোটে ঢোকার পর থেকে তার পা শিরশির করছে, আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। প্রিনসিপ্যাল তাকে ডেকে পাঠিয়েছে সেই কখন!

রাস্তায় একটা রিকশা নাই। তা রিকশার পরোয়াও সে এখন করছে না। রেইনকোটের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে বাসস্ট্যান্ডে যেতে তার কোনো অসুবিধে হবে না। রেইনকোটের ওপর বৃষ্টি পড়ছে অবিরাম। কী মজা, তার গায়ে লাগে না একটি ফোঁটা। টুপির বারান্দা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লে কয়েক ফোঁটা সে চেটে দেখে। ঠিক পানসে স্বাদ নয়, টুপির তেজ কি পানিতেও লাগল নাকি? তাকে কি মিলিটারির মতো দেখাচ্ছে? পাঞ্জাব আর্টিলারি, না বালুচ রেজিমেন্ট, না কম্যাণ্ডো ফোর্স, নাকি প্যারা মিলিটারি, না মিলিটারি পুলিশ,–ওদের তো একেক গুষ্টির একেক নাম, একেক সুরত। তার রেইনকোটে তাকে কি নতুন কোনো বাহিনীর লোক বলে মনে হচ্ছে? হোক। সে বেশ হনহন করে হাঁটে। শেষ হেমন্তের বৃষ্টিতে বেশ শীত শীত ভাব। কিন্তু রেইনকোটের ভেতরে কী সুন্দর ওম। মিন্টুটা এই রেইনকোট রেখে গিয়ে কী ভালোই যে করেছে। এটা নিতে ছোঁড়াটা যে করে ফেরে!— আহা, এই তুমুল বৃষ্টির মধ্যে ছেলেটা কোথায় কোন নদীর তীরে ওৎ পেতে বসে রয়েছে। হয়তো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি প্ল্যাটুন গ্রাম জ্বালিয়ে শ-দুয়েক মানুষ মেরে লাশগুলোকে ফেলে জিপে করে নিয়ে যাচ্ছে জ্যান্ত জোয়ান মেয়েদের, মিন্টুর স্টেনগান নিশ্চয়ই তাক করে রয়েছে ঐ মিলিটারিগুলোর দিকে। মিলিটারির সব কটাকে খতম করে মেয়েগুলোকে বাঁচাতে পারবে তো? পারবে না?—বড়ো রাস্তায় মিলিটারির লরি দেখে তার চৈতন্যোদয় ঘটে। মিন্টুকে নিয়ে এতক্ষণের ভাবনা আড়াল করতে নিজের চোখজোড়ায় পুরু করে ভক্তি মাখিয়ে সে তাকিয়ে থাকে লরিটার দিকে। না বাবা। ওদের সঙ্গে চোখাচোখি না হওয়াই ভালো। লরি চলে যায় উত্তরে, তাকে তাই তাকাতে হয় দক্ষিণের দিকে। কিন্তু লরির বৃষ্টি-ভেজা আওয়াজ মুছে ফেলা কি এতই সোজা? মীরপুর ব্রিজ থেকে আসমা কাল রাতে গোলাগুলির আওয়াজ পেয়েছে, লরি কি ওদিকেই গেল? –আরে কোথায় কী হয়, আর আসমা নিত্য শোনে গুলির শব্দ। এসব স্রেফ গুজব। প্রিনসিপ্যাল বলে, গুজব ছড়ানো আর গুজবে কান দেওয়া সমান অপরাধ। ঐ যে, পদ্য আছে, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে। এটা হিন্দুর লেখা বলে কিংবা পরের কথাগুলো মনে নাই বলে প্রিনসিপ্যাল ঐ পর্যন্ত বলেই থেমে যায়। বরং উর্দুতে বলে, ‘সাজিদ সাহেব, গুজব সব গজব হোতা।‘ সাজিদ সঙ্গে-সঙ্গে ছন্দ লাগায়, ‘গুজব জো থা ওহি সব আজ গজব হো চুকা হ্যায়।’ প্রিনসিপ্যাল ভক্তিগদগদ হয়ে ঘর্ঘর গলায় বলে, ‘ইকবালের নাকি? দাঁড়ান লিখে নিই।’ আকবর সাজিদ বাধা দেয়, ‘তওবা। ইকবালের কেন হবে। গুজব তো বাংলা কথা হলো। উর্দুমে ইসকো’—প্রিনসিপ্যালের তর সয় না, ‘এটাই ভালো। আপনি বলেন, আমি লিখে নিই।’ অনুপ্রাসটি রাখার খাতিরে সাজিদ গুজবের উর্দু প্রতিশব্দ ব্যবহার করে না। এর সঙ্গে সে আবৃত্তি করে পরের লাইনটি, ‘আর্মি কে আরমান পুরে হো চুকে হ্যাঁয়।’

‘মানে?’

‘মানে হলো আর্মির ইচ্ছা ফুলফিল হয়েছে।’ বলতে বলতে সাজিদ আরো চরণ তৈরি করে। হাত পা নেড়ে সে পুরো কবিতাটি আবৃত্তি করে,

গুজব জো থা ওহি সব আজ গজব হো ঢুকা হ্যাঁয়।
আর্মি কে আরমান পুরে হো চুকে হ্যাঁয়।
আল্লা এক, রসুল এক, পাকিস্তান ভি এক,
ইসে জিসকো ঈমান নেহি উও নালায়েক।
কুচল দো উস গাদ্দারকো জাঁহা ভি মিলে,
পাকিস্তানি ফওজ কভি পিছে না হিলে।

স্টাফরুমে এসে সাজিদ বলে, প্রিনসিপ্যাল যদি এটা কোনো মেজর কি কর্নেলকে শোনায় তো তার শাস্তি হবে, মিলিটারি বলবে, তুম মজাক কর রহা? তার কলিগরা চুপ করে থাকে। সাজিদের সামনে এখন কেউ এসব নিয়ে কথা বলতে চায় না। এমনকি তার বন্ধু হিস্ট্রির আলী কবিরও একটু এড়িয়েই চলে। ওদিকে নিজের কামরায় বসে খাস পিওন ইসহাকের সামনে প্রিনসিপ্যাল বাংলা হরফে লেখা এই উর্দু পদ্যটি বারবার আবৃত্তি করে এবং কয়েকদিনের মধ্যে এটিকে স্বরচিত বলে ভাবতে শুরু করে। আবৃত্তি করার সময় সুখে ও ভক্তিতে তার চোখজোড়া খুঁজে খুঁজে আসে।

রেইনকোটে বৃষ্টির জলতরঙ্গ বাজে ঐ কবিতার ছন্দে এবং হঠাৎ করে তার মনে হয়, প্রিনসিপ্যাল হয়তো কর্নেলকে ওটাই আবৃত্তি করে শোনাচ্ছে। গুজবের উর্দু প্রতিশব্দ জানতে চেয়ে জবাব না পেয়ে কর্নেল যদি হঠাৎ করে চটে যায়? উর্দুর প্রফেসর আকবর সাজিদ সেনাবাহিনীর তৎপরতা নিয়ে নানারকম ঠাট্টা-মশকরা করে। জিওগ্রাফির আব্দুস সাত্তার মৃধা ফিসফিস করে বলে, নিজের মাতৃভাষাকে বর্মের মতো ব্যবহার করে লোকটা নিশ্চয়ই মিসক্রিয়ান্টদের হয়ে কাজ করছে। আবার ইংরেজির খোন্দকার একদিন সবাইকে হুঁশিয়ার করে দেয়, ‘ওর কথায় সায় দেবেন না। ও আসলে এইসব বলে আপনাদের অ্যাটিচুডটা জানতে চায়। বেটা নির্ঘাৎ আর্মির লোক।’ তা আকবর সাজিদ কয়েকদিন হলো একটু চুপচাপই থাকে। স্টাফরুমে সে বসলে সবাই উসখুস করে, আবার প্রিনসিপ্যালের কামরায় যেতেও তার ভালো লাগে না। সে নিজেও সাজিদের কাছ থেকে দূরে দূরেই থাকে। দরকার কী? তবে, রেইনকোটের কল্যাণে গায়ে পানি না লাগিয়ে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আকবর সাজিদের সঙ্গে গোপনে কয়েকটা কথা বলার জন্যে প্রাণটা তার আইটাই করে। এর মানে কী?

না, এসব হাউস ভালো নয়। সেনাবাহিনী নিয়ে বাংলা কিংবা উর্দুতে ঠাট্টা-মশকরা করার ভাবনা থেকে যতটা মুক্ত থাকা যায়। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে বাসের জন্য তাকে তাকাতে হয় উত্তরেই। মিলিটারি লরির ল্যাজটাও দেখা যাচ্ছে না। আবার তার বাসেরও তো নামগন্ধ নেই। বাসস্ট্যান্ডে জনপ্রাণী বলতে সে একেবারে একলা। রাস্তার পাশে পান-বিড়ি-সিগ্রেটের ছোটো দোকানটার ঝাঁপ একটুখানি তুলে দোকানদারও তাকিয়ে রয়েছে উত্তরেই, ওদিকে কি কোনো গোলমাল হলো নাকি? দোকানদার ছেলেটা একটু বাচাল টাইপের। বাসস্ট্যান্ডে তাকে দেখলেই ছোঁড়াটা বিড়বিড় করে, ‘কাল শোনেন নাই? মিরপুরের বিল দিয়া দুই নৌকা বোঝাই কইরা আইছিল। একটা জিপ উড়াইয়া দিছে, কমপক্ষে পাঁচটা খানসেনা খতম। বিবিসি কইছে, রংপুর-দিনাজপুরে হাফের বেশি জায়গা স্বাধীন, কাল চরমপত্র শুনছেন?’ এর সামনে সে বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না। এসব গুজব শোনার সময়ও সে যদি ধরা পড়ে তো! গুজব জো থা ওহি সব আজ গজব হো চুকা হ্যায়। প্রিনসিপ্যাল বলে, গুজবই হলো বাঙালির কাল। গুজবের আকর্ষণ ভারি তীব্র, গুজব মাত্রেই সুস্বাদু। এই যে এখন বৃষ্টির আড়াল পেয়েও হতে পারে, কিংবা রেইনকোটের কল্যাণে বৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পাবার স্বস্তির ফলেও হতে পারে, সে এগিয়ে গেল দোকানদারের দিকে। একটা গুজব শোনার হাউস করে সে জিগ্যেস করে, ‘বাস আসেনি কতক্ষণ?’

‘আর বাস! বাস আসবে কৈ থাইকা?’ বলে ছেলেটা তাড়াতাড়ি ঝাঁপ ফেলে মুখ গুঁজে দিল দোকানের ভেতরে। তার ভাবনা হয়, বাস ডিপোতে কোন হামলা হয়েছে নাকি? আসমার শোনা ঐ গোলাগুলির শব্দ কি আসছিল বাস ডিপো থেকে? মিলিটারি লরি কি ওদিকেই গেল? বাস ডিপোর পেছনে একটা বস্তি আছে, সেখানে মিলিটারি কি আগুন দিতে গেল? জায়গাটা খুব একটা দূরে তো নয়, সে একবার ঘুরেও তো আসতে পারে। বৃষ্টিটাও ধরে এসেছে। যাবে নাকি একবার? –তার যাওয়া হলো না। এর মধ্যেই ছিপছিপে বৃষ্টিতে লালচে আভা তুলে এসে পড়ল লাল রঙের স্টেট বাস।

বাসে যাত্রী কম। না, না, কন্ডাক্টররা সবসময় যেমন খালি গাড়ি বলে চ্যাঁচায়, সেরকম নয়। সত্যি সত্যি অর্ধেকের বেশি সিট খালি। সে বাসে উঠলে তার রেইনকোটের পানি পড়তে লাগল বাসের ভিজে মেঝেতে। এ জন্যে তার একটু খারাপ কথা, অন্তত টিটকিরি শোনার কথা। কিন্তু তাকে কেউ কিছু বলে না।

বাসে এত খালি সিট। বাঁশ বনে ডোম কানা—প্রবাদটি মনে না পড়লেও ঠোঁটে তার একটু হাসি বিছানো থাকে। এই নীরব কিন্তু স্পষ্ট হাসির কারণ কি এই যে, তার রেইনকোটের পানিতে বাসে সয়লাব হয়ে গেলেও কেউ টু শব্দটি করছে না? তার পোষাক কি সবাইকে ঘাবড়ে দিল নাকি?

খালি রাস্তা পেয়ে বাস চলে খুব জোরে। কিন্তু তার আসনটি সে নির্বাচন করতে পারছে না। টলতে টলতে একবার এই সিট দেখে, পছন্দ হয় না বলে ফের ঐ সিটের দিকে যায়। এমন সময় পেছনের দিক থেকে দুজন যাত্রী উঠে পড়ে তাড়াহুড়া করে, ‘রাখো রাখো’ বলতে বলতে ঝুঁকি নিয়ে তারা নেমে পড়ে চলন্ত বাস থেকে। সে তাদের দিকে তাকায় এবং বুঝতে পারে, এরা পালাল ঠিক তাকে দেখেই। লোক দুটো নিশ্চয়ই ক্রিমিনাল। একটা চোর, আরেকটা পকেটমার। কিংবা দুটোই চোর অথবা দুটোই পকেটমার। নামবার মুহূর্তে দুটোর মধ্যে সর্দার টাইপেরটা তার দিকে পেছন ফেরে তাকাল। সেই চোখ ভরা ভয়, কেবল ভয়।

জুৎসই সিট বেছে নিয়ে সে ধপাস করে বসতেই ফোমে ফস করে আওয়াজ হয় এবং তাইতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় সামনের সিটে বসা তিনজন যাত্রী। হুঁ! এদেরও সে ঠিক চোর অথবা পকেটমার বলে ঠিক শনাক্ত করে ফেলে। ডাকাতও হতে পারে। কিংবা মিলিটারি কোনো বস্তিতে আগুন লাগিয়ে চলে এলে এরা ছোটে সেখানে লুটপাট করতে। অথবা মিলিটারি কোথাও লুটপাট করলে এরা গিয়ে উচ্ছিষ্ট কুড়ায়। তিনটেই পরের স্টপেজে নামার জন্যে অনেক আগেই ধরফর করে উঠে দাঁড়ায় এবং বাস থামার সঙ্গে-সঙ্গে নেমে পড়ে ঝটপট পায়ে। তিনটে ক্রিমিনালের একটাও তার দিকে আর ফিরেও তাকায় না। তার মানে তাকে বেশ ভয় পেয়েছে বলেই তার সঙ্গে চোখাচোখি এড়াতে এদের এত কসরৎ।

যাক, মিন্টুর রেইনকোটে তার কাজ হচ্ছে। চোর ছ্যাঁচোর পকেটমার সব কেটে পড়ছে। ভালো মানুষেরা থাক। সে বেশ সৎসঙ্গে চলে যাবে একেবারে কলেজ পর্যন্ত।

আসাদ গেট বাসস্টপেজে ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল বেশ কয়েকজন মানুষ। ছাতা হাতে কেউ-কেউ নিজ-নিজ ছাতার নিচে এবং ছাতা ছাড়া অনেকেই অন্যের ছাতার নিচে মাথার অন্তত খানিকটা পেতে দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট থেকে আত্মরক্ষা করতে শরীরগুলোকে আঁকাবাঁকা করছিল। বাস থামলে সে দেখল, একে একে নয়জন প্যাসেঞ্জার বাসে উঠল। সে বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবাইকে দেখে। তো তার দিকে তাকিয়ে নয়জনের তিনজন ‘আরে রাখো-রাখো’ এবং একজন ‘রোখো রোখো বলতে বলতে নেমে পড়ল ধরফর করে। শেষের জন বোধ হয় এমনি অর্ডিনারি চোর, ছিঁচকে চোর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর প্রথম তিনটে মিলিটারির হোগায় হোগায় ঘোরে। কোথাও সুন্দরী মেয়েমানুষ দেখলে মিলিটারিকে খবর দেয় কিংবা মিলিটারির কাছ থেকে বন্দুক নিয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে মহল্লায়-মহল্লায় ঘোরে আর সুন্দরী মেয়েদের ধরে এনে পৌঁছে দেয় মিলিটারি ক্যাম্পে। এগুলো হলো ভাউরা, রাজাকার ভাউরা। ফের নতুন করে অপরাধীমুক্ত বাসে যেতে এখন ভালো লাগছে। জানালার বাইরে বৃষ্টির আঁশ উড়ছে ঠাণ্ডা হাওয়ায়, গাছপালা ও লোকজন ও দোকানপাট ও বাড়িঘরের ওপর ট্রান্সপারেন্ট আবরণ দেখে তার এক্সট্রা ভালো লাগে। সমস্ত ভালো-লাগাটা চিড় খায় বাস হঠাৎ করে ব্রেক কষলে। তখন তাকে তাকাতে হয় বাঁয়ে, চোখে পড়ে নির্মীয়মান মসজিদের ছাদের দিকে। দরজা থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া এসে লাগে তার মুখে এবং নাকের ভেতর দিয়ে সেই হাওয়া ঢুকে পড়ে বুকে, সেখানে ধাক্কা লাগে; ক্রাক-ডাউনের রাত কেটে ভোর হলে মিলিটারির গুলিতে এই মসজিদের ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিল মোয়াজ্জিন সাহেব। ঠাণ্ডা হাওয়ার ধাক্কা রেইনকোটের তাপে এতটাই গরম হয়ে ওঠে যে, মনে হয় ভেতরে বুঝি আগুন ধরে গেল। মসজিদের উল্টো দিকের বাড়িতে তিনতলায় থাকত তখন তারা! রাতভর ট্যাঙ্কের হুঙ্কার আর মেশিনগান আর স্টেনগানের ঘেউঘেউ আর মানুষের কাতরানিতে তাদের কারও ঘুম হয়নি সে রাতে। ছেলেমেয়ে নিয়ে ছেলেমেয়ের মায়ের সঙ্গে সে শুয়েছিল খাটের নিচে। ভোরবেলা মিলিটারি মানুষ মারায় একটু বিরতি দিলে ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়ে এবং বন্ধ জানলার পর্দা একটু তুলে সে রাস্তা দেখতে থাকে। রাস্তার ওপারে মসজিদের ছাদে মোয়াজ্জিন সাহেব দাঁড়িয়েছিল আজান দিতে। সাধারণত জুম্মার নামাজটা সে নিয়মিত পড়ে। তবে সেই ভোরে তার আজান শুনতে ইচ্ছা করছিল খুব। মোয়াজ্জিনের আজান দেওয়াটা সম্পূর্ণ দেখবে বলে সে জানলার ধার থেকে সরে না। সারা এলাকায় ইলেকট্রিসিটি নষ্ট, মসজিদের মাইক্রোফোন অকেজো। মোয়াজ্জিন সাহেব গমগমে গলায় যতটা পারে জোর দিয়ে বলে উঠল ‘আল্লাহু আকবর।’ দ্বিতীয়বার আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা করার সুযোগ তার আর মেলেনি, এর আগেই সম্পূর্ণ অন্যরকম ধ্বনি করে লোকটা পড়ে যায় রাস্তার ওপর। সেদিন সকালে বৃষ্টি ছিল না। আজ বৃষ্টির সকালে মিলিটারি কি ঐ দৃশ্যের পুনর্ঘটনের পাঁয়তারা করছে? এখন তো কোনো নামাজের ওয়াক্ত নেই, তবে আজান দেওয়াবে কি করে? এরা বোধহয় যে কোনো সময়কেই নামাজের ওয়াক্ত ঘোষণা করে নতুন হুকুম জারি করেছে।

মিলিটারি এখন যাবতীয় গাড়ি থামাচ্ছে। গাড়ির প্যাসেঞ্জারদের নামিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয় রাস্তার ধারে। আরেক দল মিলিটারি স্টেনগান তাক করিয়ে রেখেছে এই মানুষের সারির ওপর। অন্য একটি দল ফের ঐসব লোকের জামাকাপড় ও শরীরের গোপন জায়গাগুলো তল্লাসি করে। মিলিটারি যাদের পছন্দ করছে তাদের ঠেলে দিচ্ছে পেছনে দাঁড়ানো একটা লরির দিকে। তাদের বাসটিতে এসে উঠল লম্বা ও খুব ফর্সা এক মিলিটারি।

এখন বাসের ভেতর কোনো আওয়াজ নাই। যাত্রীদের বুকের টিপটিপ শব্দ এই নীরবতার সুযোগে বাড়ে এবং এটাই তার মাথায় বাজে দ্রাম- দ্রাম করে। বারান্দাওয়ালা টুপির নিচে শব্দের ঘষায় ঘষায় আগুন জ্বলে এবং তার হল্কা বেরোয় তার চোখ দিয়ে। তবে একটু নড়ে বসলে মাথার ও বুকের ধ্বনি নিয়ন্ত্রণে আসে এবং এসবকে পরোয়া না করে সে সরাসরি তাকাল মিলিটারির মুখের দিকে। মিলিটারির চোখ ছুঁচলো হয়ে আসে এবং ছুঁচলো চোখের মণি কাঁটার মতো বিঁধে যায় তার মুখে। সেও তার চোখের ভোঁতা কিন্তু গরম চাউনিটাকে স্থির করে আলগোছে বিছিয়ে দেয় মিলিটারির খাড়া নাকে, ছুঁচলো চোখে, গোঁফের নিচে ও নাক, গোঁফ ও চোখের আশেপাশের ও নিচের লালচে চামড়ায়। এতে কাজ হলো। মিলিটারির চোখা চোখ সরে যায় তার মুখ থেকে, নেমে পড়ে তার রেইনকোটের ওপর। মনে হয় রেইনকোটের পানির ফোঁটাগুলো লোকটা গুণে গুণে দেখছে। ভেতরের তাপে এইসব পানির ফোঁটা কি একটু লালচে দেখছে? পানির দেশে মানুষ মারতে এসে পানির ফোঁটা দেখে মিলিটারির এত থ মেরে যাবার কী হলো? লোকটা কি এগুলোতে রক্তের চিহ্ন দেখে? রেইনকোটের বৃষ্টির ফোঁটা গোণাগুনতি সেরে মিলিটারি হঠাৎ বলে, ‘আগে বাঢ়ো।’ বাস হঠাৎ স্টার্ট দিয়ে কয়েক পা লাফিয়ে আগে বাড়ে এবং যাত্রীদের স্বস্তির নিশ্বাসের ধাক্কায় অতিরিক্ত বেগে ছুটে পার হয়ে যায় ঢাকা কলেজের গেট। নিউ মার্কেটের সামনে এসে পড়লে সে উঠে দাঁড়ায় এবং হুকুম করে, ‘রাখেন নামবো।’ বাস একটু স্লো হলে তার রেইনকোটের জমানো পানি গড়িয়ে পড়তে দিয়ে অপরাধীমুক্ত বাস থেকে নামতে নামতে সহযাত্রীদের দিকে তাকিয়ে সে ঠোঁট বাঁকায়, এতে তার সামনের সারির দাঁতও কেলিয়ে পড়ে। যারা দেখেছে তারা তার সেই ভঙ্গিটিকে ঠিক হাসি বলে শনাক্ত করতে পেরেছিল বলে তার ধারণা হয়।

প্রিনসিপ্যালের কামরায় প্রিনসিপ্যালের সিংহাসন-মার্কা চেয়ারে বসে রয়েছে জাঁদরেল টাইপের এক মিলিটারি পাণ্ডা। তার ভারিক্কি মুখ থেকে অনুমান করা যায়, পাণ্ডাটি কর্নেল কিংবা মেজর জেনারেল, অথবা মেজর বা ব্রিগেডিয়ার। তাকে দেখে প্রিনসিপ্যালের কালো মুখ বেগুনি হয়, ডক্টর আফাজ আহমদ এম. এস.সি, পি. এইচ. ডি, ই পি এস ই এস হওয়ার চেষ্টা করতে করতে সার বলে, ‘হি ইজ প্রফেসর নুরুল হুদা।’

কিন্তু ডঃ আফাজ আহমদ এম. এসসি, পি. এইচ. ডি নিজের ভুল সংশোধন না করে পারে না, ‘সরি হি ইজ নট এ প্রফেসর। এ লেকচারার ইন কেমিস্ট্রি।’

‘শাট আপ।’

এবার প্রিনসিপ্যাল থামে।

তাকে এবং আবদুস সাত্তার মৃধাকে নিয়ে মিলিটারি জিপে তোলার আগে জাঁদরেল কর্নেল না ব্রিগেডিয়ার প্রিনসিপ্যালকে কড়া গলায় বলে, সেনাবাহিনীকে নিয়ে মজাক করে শায়েরি করা খুব বড়ো অপরাধ। এবার তাকে ছেড়ে দেওয়া হলো, তবে কড়া ওয়াচে রাখা হবে। উর্দুর প্রফেসর আকবর সাজিদের দোহাই পেড়ে প্রিনসিপ্যালের সুবিধা হয় না। নুরুল উদ্বিগ্ন হয়, সাজিদ সাহেব যদি পালিয়ে না থাকে তো তার কপালে যে কী আছে তা জানে এক আল্লা আর জানে এই মিলিটারি।

তাদের দুজনের চোখ বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, জিপ চলছিল এঁকেবেঁকে। মস্ত উঁচু একটা ঘরে তাদের এনে ফেলা হলো। চোখ খুলে দিলে সে আবদুস সাত্তার মৃধাকে দেখতে পায় না। জায়গাটাও একেবারে অচেনা। একটা ডেক-চেয়ারে সে যে কতক্ষণ বসে থাকল তার কোনো হিসাব নেই। তার সামনে একটা চেয়ারে এসে বসল এক মিলিটারি। তাকে ইংরেজিতে নানান প্রশ্ন করে, সে জবাব দেয়। লোকটা চলে গেলে তাকে অন্য ঘরে নিয়ে ফের অন্য একটা লোক এসে তাকে প্রশ্ন করে এবং সে জবাব দেয়। প্রশ্নগুলো প্রায় একইরকম এবং তার উত্তরেরও হেরফের হয় না। যেমন, কিছুদিন আগে তাদের কলেজে কয়েকটা লোহার আলমারি কেনা হয়েছে। ওগুলো বয়ে নিয়ে এসেছিল কারা?

সে জবাব দেয়, ঠিক। অফিসের জন্যে তিনটে, বোটানি হিস্ট্রি জিওগ্রাফি ডিপার্টমেন্টের জন্যে দুটো করে এবং ইংরেজির জন্যে একটা, সর্বমোট দশটি আলমারি কলেজে নিয়ে আসা হয়েছে।

এত কথা বলার দরকার নাই তার। ঐ আলমারিগুলো নিয়ে আসা হয় কয়েকটা ঠেলাগাড়ি করে। ঠেলাগাড়িওয়ালাদের তো সে ভালো করেই চেনে।

নুরুল হুদা জবাব দেয়, তাদের সে চিনবে কোত্থেকে? তারা হলো কুলি, সে একজন লেকচারার।

তাহলে সে তাদের সঙ্গে এত কথা বলছিল কেন?

আদেশে সে আলমারিগুলোর স্টিলের পাতের ঘনত্ব, দেরাজের সংখ্যা ও আকার, তালাচাবির মান, রঙের মান প্রভৃতি পরীক্ষা করে দেখছিল, তার দায়িত্ব ছিল–।

মিলিটারি শান্ত গলায় তথ্য সরবরাহ করার ভঙ্গিতে বলে, মিসক্রিয়েন্টরা কলেজে ঢুকেছিল কুলির বেশে। এটা তার চেয়ে আর ভালো জানে কে? তারা আজ ধরা পড়ে নুরুল হুদার নাম বলেছে। তাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ নিয়মিত, সে গ্যাঙের একজন সক্রিয় সদস্য।

‘আমার নাম? সত্যি বলেছে? আমার নাম বলেছে?’ নুরুল হুদার হঠাৎ চিৎকারে মিলিটারি বিরক্ত হয় না, বরং উৎসাহ পায়। উৎসাহিত মিলিটারি ফের বলে, কুলিরা ছিল ছদ্মবেশী মিসক্রিয়েন্ট। তারা কলেজের টিচারদের মধ্যে নুরুল হুদার নামই বলেছে।

নুরুল হুদা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারা কি তাকে চেনে? কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে আলমারি সাজিয়ে রাখার সময় এক কুলি দাঁড়িয়েছিল তার গা ঘেঁষে। তখন তো ঘোরতর বর্ষাকাল, ঢাকায় এবার বৃষ্টিও হয়েছে খুব। রাতদিন এই বৃষ্টি নিয়ে সে কী যেন বলেছিল, তাতে কুলিটা বিড়বিড় করে ওঠে, ‘বর্ষাকালেই তো জুৎ।’ কথাটা দুবার বলেছিল। এর মানে কী? স্টাফরুমে কে একজন একদিন না দুদিন ফিসফিস করেছিল, বাংলার বর্ষা তো শালারা জানে না। রাশিয়ায় ছিল জেনারেল উইনটার, আমাদের জেনারেল মনসুন। ঐ ছদ্মবেশী ছেলেটা কি এই কথাই বুঝিয়েছিল? তার ওপর তাদের এত আস্থা?–উৎসাহে নুরুল হুদা এদিক-ওদিক তাকায়। তার মৌন মিলিটারিকে আরেকটু নিশ্চিত করে।

কিছুক্ষণ পর, কতক্ষণ পর সে বুঝতে পারে না, মিলিটারি তাকে ফের একই প্রশ্ন করে জবাব না পেয়ে প্রবল বেগে দুটো ঘুষি লাগায় তার মুখে। প্রথম ঘুষিতে সে কাত হয়, দ্বিতীয় ঘুষিতে পড়ে যায় মেঝেতে। মেঝে থেকে তুলে তাকে মিলিটারি ফের জিগ্যেস করে, ওদের আস্তানা কোথায় সে খবর তার তো ভালোভাবেই জানা আছে। সে জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ!’

ঐ ঠিকানাটা বলে দিলেই তাকে সসম্মানে ছেড়ে দেওয়া হবে এই নিশ্চয়তা দিয়ে তাকে পাউরুটি ও দুধ খাওয়ানো হয়। তাঁকে ভারতে সময় দিয়ে মিলিটারি চলে যায়। কিছুক্ষণ পর, কতক্ষণ সে জানে না, মিলিটারি ফিরে এসে ফের বলে, মিসক্রিয়েন্টদের ঠিকানা তো তার জানা আছে। সে ফের জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ।’ কিন্তু পরের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে মিলিটারি তাকে নিয়ে যায় অন্য একটি ঘরে। তার বেঁটেখাটো শরীরটাকে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো ছাদে লাগানো একটা আংটার সঙ্গে। তার পাছায় চাবুকের বাড়ি পড়ে সপাৎ সপাৎ করে। তবে বাড়িগুলো বিরতিহীন পড়তে থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যে সেগুলো নুরুল হুদার কাছে মনে হয় স্রেফ উৎপাত বলে। মনে হচ্ছে যেন বৃষ্টি পড়ছে মিন্টুর রেইনকোটের ওপর। রেইনকোটটা এরা খুলে ফেলেছে, কোথায় রাখল কে জানে। কিন্তু তার ওম তার শরীরে এখনো লেগেই রয়েছে। বৃষ্টির মতো চাবুকের বাড়ি পড়ে তার রেইনকোটের মতো চামড়ায় আর সে অবিরাম বলেই চলে, মিসক্রিয়েন্টদের ঠিকানা তার জানা আছে। শুধু তার শালার নয়, তার ঠিকানা জানার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নাই, সে ছদ্মবেশী কুলিদের আস্তানাও চেনে। তারাও তাকে চেনে এবং তার ওপর তাদের আস্থাও কম নয়। তাদের সঙ্গে তার আঁতাতের অভিযোগ ও তাদের সঙ্গে তার আঁতাত রাখার উত্তেজনায় নুরুল হুদার ঝুলন্ত শরীর এতটাই কাঁপে যে চাবুকের বাড়ির দিকে তার আর মনোযোগ দেওয়া হয়ে ওঠে না।

রচনাকাল : ১৯৯৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *