কান্না

কান্না

‘ওয়া ইয়ারহামুনাল্লাহু ওয়া ইয়াকুম। আমিন।’ জিয়ারতের এই দোয়ার পর কয়েক পলকের বিরতির সুযোগে সবুজ সোয়েটার ও সবুজ-হলুদ চেক-কাটা লুঙি পরা লোকটি কী বলতে এগিয়ে আসছিল, তার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে আফাজ আলি একনাগাড়ে আয়াত পড়তে শুরু করে। এক সুরা শেষ করে ধরে আরেক সুরা, কোনো কোনো সুরা ৩ বার এমনকি ১০ বার পর্যন্ত পড়েও সে ক্লান্ত হয় না। আফাজ আলি পড়ে একটু ধীর লয়ে। আবৃত্তিতে তার করুণ সুর, পড়তে পড়তে ঝাপসা কান্নায় গলা ভিজে ভিজে যায়, কিন্তু ভিজে শব্দের উচ্চারণ বেশ স্পষ্ট। সামনে দামি ইণ্ডিয়ান আগরবাতির আবছা ধূসর ধোঁয়ায় এবং হাল্‌কা মিষ্টি গন্ধে কবরের ভেতরকার লাশটির চেহারা বাইরের জ্যান্ত মানুষের জোড়া জোড়া চোখে ভাঙা-চোরা আকার পায় এবং অপরিচিত পবিত্র ভাষার রহস্যে কবরের ভিতর-বাইরের ফারাক কমতে থাকে। আফাজ আলির কাঁদো-কাঁদো গলার ঢেউ ভাষার দুর্বোধ্যতাকে ছাপিয়ে মরহুমের প্রতি সবার আবেগকে চড়িয়ে দেয় নিবেদনের চূড়ায়, সেখান থেকে হঠাৎ করে নামা কঠিন। আয়াতের ভাষায় কারও দখল না থাকায় সব কথাই হয়ে দাঁড়ায় মুর্দার সঙ্গে প্রত্যেকের যোগাযোগের প্রকাশ। তার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের মিহি ও মোটা কাহিনী একাকার হয়ে সবাইকে ব্যাকুল করে তোলে এবং শোকের আগুন উত্তাপ হয়ে ফাল্গুনের এই শেষ দুপুরে তাদের শরীরে একটু-একটু ওম দেয়। আফাজ আলি বিড়বিড় করতে করতে সবুজ সোয়েটার ও সবুজ-হলুদ চেক-কাটা লুঙিকে আরেকবার দেখে, লোকটি কৃষ্ণকাঠির কুদ্দুস হাওলাদারের ছেলে মনুমিঞা, আফাজ আলির ছেলের চাকরির ব্যাপারে কয়েকবার বরিশাল আসা-যাওয়া করেছে। দেখা হলেই টাকা, দেখা হলেই টাকা। একে এত দিলে চাকরি হবে, ওকে এত না দিলে হওয়া চাকরিটা ফসকে যাবে। এখন দেখো, একেবারে ঢাকায় গোরস্তান পর্যন্ত হানা দিয়েছে। আফাজ আলির এখন কথা বলার সময় কোথায়? জিয়ারতের দোয়া পড়ার সুরে মুর্দার আত্মীয়স্বজন ফোঁপাতে শুরু করেছে, এই রেশটা সে নষ্ট করে কীভাবে? একটু তফাতে দাঁড়ানো মনুমিঞার মুগ্ধ চোখ সেঁটে গেছে দুই দিকের কবরগুলোর ওপর। দেখুক, ব্যাটা ভালো করে দেখে নিক। ৭৮০৪ নম্বর কবর আগাগোড়া পাথরে বাঁধানো, লাল সিরামিক ইটে গাঁথা ৭৮১৯, সাদা সিমেন্টের ওপর মোজাইক করা ৭৯৮৪,–সবগুলো সে নয়ন ভরে দেখুক। প্রতিটি কবরের শিয়রে সেট-করা সাদা পাথরে আল্লার কালামের ২/১টা লাইন, তার নিচে মুর্দার নাম, ফেলে-যাওয়া ঠিকানা এবং জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ। খোদার কালাম বুঝতে না পারুক, বাংলা কথাগুলোই পড় ক। তাতেও তার সময় কাটবে। কত কবরের ওপর সবুজ ঘাসের গালিচায় লাল চিনা ঘাসের বর্ডার, কোনো-কোনোটির মাঝখানে বা একধারে গোলাপ, রজনীগন্ধা কিংবা ডালিয়া। সারি সারি কবরের মাঝ দিয়ে জিন্দা মানুষের চলাচলের জন্যে সরু পাকা রাস্তা, মনুমিঞা একটু ঘুরে ঘুরে দেখুক না। এখানে খামাখা দাঁড়িয়ে থাকে কেন? আফাজ আলির এখনো তো ঢের দেরি। মোনাজাতের জন্যে সে হাত তুললে সবার হাত উঠল। অথচ ঐ বেআক্কেল ছোঁড়াটা তাও করে না। আফাজ আলি মরহুমের নাম করে তাকে বেহেশত নসিব করার জন্যে আল্লার দরবারে এবার মিনতি জানায় বাংলায়। তার মিনতির আর শেষ নাই। মরহুমের বাবা-মা এবং আরো আগেকার পূর্বপুরুষদের সঙ্গে মরহুম সুখে-শান্তিতে বেহেশতবাসী হোক, আল্লা তাদের গুনাখাতা মাফ করে দিক। আল্লার দয়ার সীমা নাই, গুণাগার মানুষের ওপর রহম বর্ষণ করেন বলেই তিনি রহমানুর রহিম। মোনাজাত শুনতে শুনতে কারো কারো চোখে পানি আসে, মোনাজাতের জন্যে এক হাত নিয়োজিত রেখে অন্য হাতে চোখ মুছতে গেলে নোনা পানি নামে দুই চোখ কেঁপে। বেদনা ও মিনতিতে গলা কাঁপিয়ে আফাজ আলি বলে, ‘হায়াৎ হোসেন খান সাহেবকে তুমি উঠিয়ে নিয়েছ, তোমার বান্দাকে তুমি ফিরিয়ে নিলে, আমাদের কোনো নালিশ নাই। আল্লা, তুমি তাঁর বিবি ও আওলাদদের এই শোক সহ্য করার তৌফিক দাও, হে আল্লা রাব্বুল আলামিন।’ মরহুমের ছেলেরা হাপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করলে মনুমিঞা রঙবেরঙের কবরের সৌন্দর্য উপভোগ করা স্থগিত রেখে শোকার্ত জটলার কাছাকাছি চলে আসে। শোকাভিভূত ও কান্নায় ভেঙে পড়া কেউ কেউ এক হাতে নিজের নিজের পাঞ্জাবি বা প্যান্টের পকেট ছুঁয়ে দেখে। দিনকাল খারাপ, যেখানে সেখানে পকেটমার, প্রাণ ভয়ে কাঁদার পথও ভদ্রলোকদের বন্ধ হয়ে আসছে। এদের নিরঙ্কুশ শোক উদ্‌যাপনের সুযোগ দিতে আফাজ আলি চোখের ইশারায় মনুমিঞাকে একটু সরে যেতে বললেও তার অশ্রু ভেদ করে চোখের নির্দেশ বোঝা মুশকিল। আফাজ আলির মোনাজাতেই সে বরং মশগুল, তাদের কৃষ্ণকাঠির আফাজ আলি মৌলবি ঢাকার এত বড়ো বড়ো মানুষের শোককে কীভাবে উস্কে দিচ্ছে তাই দেখে সে অভিভূত। আফাজ আলিকে জরুরি খবরটা দেওয়া দরকার, যত তাড়াতাড়ি পারে তাকে নিয়ে লঞ্চঘাটে যেতে হবে—এসব কথা তার মনেই থাকে না।

মোনাজাত চলতে চলতেই কবরের চারদিকে বাঁশের বেড়া দেওয়া হচ্ছে। মালি ও গোরকোনদের নিজেদের মধ্যে কথা-বার্তা ও কথাকাটাকাটি কিংবা গোরস্তানের শেষ মাথা থেকে একটি কোকিলের অবিরাম ডাক কিংবা নতুন লাশ নিয়ে ঢোকা শবযাত্রীদের কলেমা শাহাদত আবৃত্তি—কোনো কিছুই আফাজ আলির মোনাজাতে বিঘ্ন ঘটাতে বা শোকার্তদের প্রতিক্রিয়ায় চিড় ধরাতে পারে না। আফাজ আলি মোনাজাতের প্রায় শেষে এসে ‘আল্লা পরওয়ার দিগার, মোহাম্মদ হাবিবুল্লার জন্যে তোমার এতগুলো বান্দা আজ—’ বলতেই শবযাত্রীদের একজন বলে, ‘হায়াৎ হোসেন খান। ‘ — নাম ভুল করলেও আলিমুল গায়েব আল্লা ঠিকই সংশোধন করে নেবেন—এই আস্থা থাকা সত্ত্বেও আফাজ আলি বিব্রত হয়, মুর্দার নাম বলতে নিজের ছেলের নাম বলে ফেলায় তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। তবে কয়েক মুহূর্তেই সামলে নিয়ে মোনাজাত অব্যাহত রাখে।

কয়েক সারি সামনে ডোরা-কাটা নীল শার্ট গায়ে, চশমা-পরা কাঁচা-পাকা চুল-মাথা লোকটিকে হেঁটে যেতে দেখে এবং আসরের নামাজের আর দেরি নাই বলেও বটে, শবযাত্রীরা টের না পেলেও আফাজ আলি দীর্ঘ মোনাজাত শেষ করে একটু আকস্মিকভাবে। মুর্দার আত্মীয়স্বজনদের নেতৃস্থানীয় মুরুব্বির হাত থেকে ১০০ টাকার ২টা নোট এবং মুর্দার কবর ও আখেরাতের হেফাজতের দায়িত্ব নিয়ে সে বিদায় নেয়। এবার তাকে ছুটতে হয় সামনের কয়েক সারি পর আরেকটি কবরের দিকে, ৮২২২ নম্বর কবরের দিকে ছোটার তাগিদে মনুমিঞার কথাও তার মনে থাকে না। ৮২২২ নম্বরের আজ মৃত্যুদিবস, সকালবেলাতেই শরিফ মৃধাকে লাগিয়ে কবরের শুকনা ঘাসে পানি দিয়ে রেখেছে। আগাছা পরিষ্কার করে টালির রেলিংটা ভিম দিয়ে ঘষতে বলেছিল, তা মৃধা বলে, ঐ সাহেবের বিশ্বাস নাই, না-ও আসতে পারে, তখন ভিমের দাম দেবে কে? লোকটা এসেই পড়েছে যখন তো এখন বরং মৃধাকে দিয়ে সাফ করাবার কাজটা শুরু করা যায়। কিন্তু শরিফ মৃধা গেল কোথায়? আফাজ আলি লম্বা আলখাল্লা ও লুঙি সামলে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে ৮২২২-এ পৌঁছুবার আগেই কাঁচা-পাকা চুলের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করে দিয়েছে কাল্লুমিঞা। শরিফ মৃধা কোথায় মরতে গেল? শরিফ মৃধা আর কাল্লুমিঞা দুজনেই এই গোরস্থানের গোরকোন-কাম-মালি, কিন্তু বেশ আগে থেকে কাজ করছে বলে কালুমিঞার দাপটটা একটু বেশি। হায়দর বখস ও কালুমিঞা পরস্পরের পৃষ্ঠপোষকতা করে, কবর জিয়ারতের জন্যে লোকজনকে হায়দর বখাসের কাছে ধরে আনে কালুমিঞা এবং হায়দর বখস আবার কালুমিঞাকে কবর দেখাশোনার কাজ জুটিয়ে দেয়। হায়দর বখস লালবাগের মানুষ, ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় কিছুদিন আসা-যাওয়া করেছে, উর্দু ভাষাটা তার অল্পস্বল্প জানা, এমনকি মোনাজাতের সময় উর্দু বাক্যাংশ পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু পান-জর্দা-কিমাম-ঘষা গলায় তার কাঁদোকাঁদো ভাব প্রায় আসেই না এবং উর্দু-শব্দখচিত হলেও তার মোনাজাত সংক্ষিপ্ত। তাই দাপটের গোরকোন-কাম-মালি কালুমিয়াকে দিয়ে হায়দর বখস পার্টি হাতাবার যত ফন্দিই করুক, আফাজ আলির দোয়া-দরুদ আর মোনাজাত শোনার পর কারও সাধ্য নাই যে তাকে বাদ দেয়। আবার মুর্দার কবর কি তার আখেরাতের হেফাজতের চেয়ে বরং বড়ো-বড়ো বাড়িতে মিলাদ পড়াবার দিকে হায়দর বখসের ঝোঁকটা বেশি। আফাজ আলি কি ইচ্ছা করলেই ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানীর আলিশান বাড়িতে সামিয়ানা-টাঙানো মহফিলে মিলাদ পড়াতে যেতে পারে না? শুধু ইশারা করা। তারপর দেখো, গাড়ি এসে নিয়ে যাবে, গাড়ি দিয়ে যাবে। কিন্তু এই গোরস্তানের বাইরে বেশিক্ষণ থাকতে হলে তার ছটফট-ছটফট লাগে। কত কবরের তদারকি তাকে করতে হয়, কবরের বাসিন্দাদের জন্যে দোয়া পড়া, কোরান খতম করে তাদের নামে বকশানো, এমনকি শরিফ মৃধাকে তাগাদা দিয়ে কবরের আগাছা ছাঁটা, ঘাস গজানো, গাছ লাগানো ও ফুল ফোটাবার দায়িত্বও তো পালন করতে হয় তাকেই। এসব কাজে হায়দর বখসের মনোযোগ কম। বেশ তো, বড়ো-বড়ো বাড়ি ঘুরে তুমি মিলাদ পড়ো, চেহলামের দিন কেরাত করে নাজাতের দোয়া পড়ো, –না করেছে কে? এইসব নিয়েই থাকো। এখানে আফাজ আলির ভাগে হাত বসাতে আসো কেন? এই দেখো, কালুমিঞা এখানে দাঁড়িয়েই কী কেরামতি করে ফেলেছে, হায়দর বখস এসে এখন কথা বলছে ঐ কাঁচা-পাকা চুলের সঙ্গে। না—। আফাজ আলির এতদিনের পার্টি, আর রাখা গেল না! কাঁচাপাকাচুলের সঙ্গে ক্রমবিলীয়মান দূরত্বের তুলনায় আফাজ আলি অনেক চেঁচিয়ে বলে, ‘আসসালামো আলায়কুম। আসছেন? আমি তো সকাল থিকাই পথের দিকে চাইয়া রইছি।’ সালামের জবাবটা পর্যন্ত না দিয়ে কাঁচা-পাকা চুল হায়দর বখসকে হুকুম করে, ‘শুরু করেন। হায়দর বখস দোয়া পড়ার পাঁয়তারা করতে করতেই আফাজ আলি বলে, ‘আপা আসে নাই?’ এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া অনাবশ্যক বিবেচনা করে কাঁচা-পাকা চুল তাকে জিগ্যেস করে, ‘কী হুজুর, আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট কোথায়? ঈদের দিন এতগুলো টাকা দিয়ে গেলাম, চীনা ঘাসের বর্ডার দেবে, আপনার কথামতো আবার গোলাপের চারা লাগাবার জন্য এক্সট্রা টাকা দিলাম, কৈ, কিছুই তো করেনি।’

হারামজাদা শরিফ মৃধা করলটা কী? সকালে এক পানি ঢালা ছাড়া ৮২২২-এ কোনো কাজই সে করেনি। আফাজ আলি কি বেইজ্জতটাই না হলো! ওদিকে হায়দর বখসও লম্বা লম্বা দোয়া পড়ছে খুব কায়দা করে। আফাজ আলি ঠিকই বোঝো, এসব হলো মক্কেল ভাগাবার মতলব। তা এত যে গলা সাধছে, কাঁচাপাকাচুল এসবের কোনো পরোয়া করে? মোনাজাতে শামিল না হয়ে শ্বশুরের কবরের সামনে সে কিনা সিগ্রেট ধরায়। বেয়াদবের একশেষ! সিগ্রেটে টান দিতে দিতে আফাজ আলিকে খামাখা বকে, ‘আপনারা গোরস্তানে ব্যবসা ফেঁদেছেন তো ভালোই, তা টাকা নিয়ে কাজ করেন না কেন?’ লোকটার কথার ধরনই এরকম, সুযোগ তৈরি করে মুনসি মৌলবিদের ওপর এক চোট ঝাড়ে। তারা নাকি ধর্মের নামে ব্যবসা করে, তাদের পয়সার খাই নাকি বেশি, তাদের দারুণ খাবার লোভ!— বললেই হলো? আরে, মৌলবি-মুনসি ছাড়া চলবে তোদের? আফাজ আলির শ্বশুর মওলানা আশরাফুদ্দিন উজিরপুরী বলে, মানুষ যত বড়োই হোক না কেন, ধনদৌলত বিদ্যাবুদ্ধি যতই হোক, মৌলবি ছাড়া তার জানাজা পড়াবে কে? মৌলবি ছাড়া তোদের বিয়ে পড়াবে কে? জন্মের পর আকিকা হবে মৌলবি ছাড়া? আকিকা, শাদি ও মওত—জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মুসলমানের পদে পদে মৌলবি দরকার। ‘দোলনা হইতে কবর তক মৌলবি ছাড়া মুসলমানের উপায় নাই, উপায় নাই, উপায় নাই!’ এসব নসিহত দেওয়ার সময় শ্বশুর সাহেবের গলায় ওয়াজের সুর এসে পড়ে। দপদপিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখেল পাশ করে হাবিবুল্লা বাকেরগঞ্জ কলেজে ভর্তি হওয়ার জেদ ধরলে আশরাফুদ্দিন জোর বাধা দেয়, অন্তত আলেম পর্যন্ত পড়ো, আল্লার এলেম বরকত দেয়। হাবিবুল্লার উদ্বেগ, মাদ্রাসা লাইনের ভবিষ্যৎ কী? তারই গ্রামের কলেজে পড়া ছেলেরা তার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে ছোট্ট করে হাসে, তার সহ্য হয় না। বাপ তো মৌলবি লাইনে পড়েছে, বৌ-ছেলে-মেয়ের ভরণপোষণের জন্যে তাকে পড়ে থাকতে হয় ঢাকার গোরস্থানে। এইসব শুনে আফাজ আলি উসখুস করলেও তার গোপন সায় কিন্তু ছেলের ইচ্ছায়। বি.এ., এম.এ না হোক, আই.এ পাস করেও ছেলের যদি ছোটো-খাটো চাকরি একটা জোটে তো জীবিত অবস্থায় কবরবাস থেকে সে রেহাই পায়। শ্বশুরের সঙ্গে সে তো আর বেয়াদবি করতে পারে না, কিন্তু হাবিবুল্লা নানার মুখের ওপর জবাব দেয়, মাইজা মামুরে তাইলে মাদ্রাসা থাইকা ছাড়াইয়া লইলেন কেন?’ মওলানা আশরাফুদ্দিন উজিরপুরীর মেজো ছেলে পড়ে বরিশাল পলিটেকনিকে, পাশ করে চাকরি তো পাবেই, আর ‘মাইজা মামু বেতন যা পাইবো, উপরি পাইবো কম করিয়া তার পাঁচগুণ।’ নাতির এরকম বেতমিজি কথার ঝাঁকুনিতে আশরাফুদ্দিনের নসিহত থেকে ওয়াজের সুর ঝরে পড়ে, সরাসরি ভঙ্গিতে সে বলে, ‘চাকরির বাজার ভালো না। এম.এ, বি.এ পাস করিয়া ছ্যামরাগুলি পথে পথে ঘুরতেয়াছে, নজরে ঠেহে না?’ কিন্তু ‘চন্দ্ৰসূর্য যতোদিন জ্বলবে, মানুষের হায়াত মওতের আইন আল্লা যতদিন দুনিয়ায় জারি রাখবে, মৌলবি ছাড়া মানুষের চলবে না। কথাটা ভাবিয়া দেখিও।’

তা এখন মনে হয়, কথাটা আশরাফুদ্দিন ঠিক বলেছিল। একবার ফেল করে সেন্টার বদলে বোর্ড-অফিসে পয়সা খরচ করে হাবিবুল্লা এইচ.এস.সি সেকেণ্ড ভিভিশনেই পাস করল, তাতে লাভটা হলো কী? চাকরি তো জোটে না। তার চাকরির জন্যে ঘুষের টাকা জোগাতেই আফাজ আলির কাহিল হাল। মাসখানেক আগে আবদুল কুদ্দুস হাওলাদারের কাছ থেকে ৫০০০ টাকা হাওলাত করে বরিশালে ঘুষ দিয়ে এসেছে। কুদ্দুস হাওলাদারের ছেলে মনুমিঞা এখন হাজির হয়েছে ঘুষের ২য় কিস্তির টাকা আদায় করতে। তিনবছর কলেজে পড়েই চাকরি করে জাতে উঠতে পোলা তার পাগল হয়ে উঠেছে, তা সেই জাতে ওঠার জন্যে টাকাটাও তার বাপকে কামাই করতে হয় মুর্দাদের জন্যে দোয়া-দরুদ পড়ে। আল্লার কালামের বরকত না থাকলে তার সংসার চলে? মওলানা আশরাফুদ্দিন উজিরপুরী যে সে মানুষ নয়, সমস্ত থানার মধ্যে নামকরা আলেম, তার জবাবের কথা কি আর মিথ্যা হতে পারে? এই ব্যাটা কাঁচাপাকাচুল যদি সেই কথা একটুও বোঝে! তার দিকে চশমার ভেতর দিয়ে কীরকম তাকিয়ে বলে ফেলল, ‘আপনে যান হুজুর, এখানে দাঁড়িয়ে মিছেমিছি ক্লায়েন্ট হারান কেন? বড়োলোকের লাশ আবার মিস করবেন না। লোকটা ‘হুজুর’ কথাটাও এমন বাঁকা করে বলে যে এর চেয়ে একটা গালি শোনা বরং ভালো। আরে ২০ টাকার বেশি তো দেওয়ার মুরোদ নাই, তোমার অত তেজ কীসের? বৌ সঙ্গে থাকলে কথাবার্তা প্রায় একরকম হলেও কিন্তু ৫০ টাকা ছাড়ে। বৌকে ব্যাজার করতে ভয় পাও, আর আখেরাতের কথা ভাবো না? কোন কলেজের মাস্টার, এই গোরস্তানে ঐসব মানুষকে পৌঁছে কে? মুর্দা হোক আর জিন্দা হোক, এখানে আসে সব বড়ো-বড়ো মার্চেন্ট, ফরেনারদের অফিসে কাজ করা সায়েবরা এখানে আসে, এই কাঁচাপাকাচুলকে এখানে গুনতির মধ্যে ধরা যায়? মরহুম শ্বশুরের জন্যে তবু এখন আসতে পারো, মরলে তোমার লাশ ঢুকতে পারবে এখানে? আজিমপুরায় রিকশাওয়ালা আর ফেরিওয়ালাদের পাশে সাড়ে তিন হাত জায়গা পেলেই বর্তে যাবে। এইসব প্রফেসর লাইনের মানুষদের আফাজ আলি হাড়ে হাড়ে চেনে। হাবিবুল্লাকে সেকেণ্ড ডিভিশনে পাশ করিয়ে দিতে ঘুষ নিল যে লোকটা, দবিরুদ্দিন না কবিরুদ্দিন মোল্লা, সেও তো কোন কলেজের মাস্টারই ছিল। আবার মনুমিঞার সঙ্গে গিয়ে আফাজ আলি ছেলের চাকরির জন্যে ১ম কিস্তি ঘুষ দিয়ে এল, জাহাঙ্গীর কাজী,–সে লোকটিও তো বরিশাল না খুলনা না যশোর কলেজের প্রফেসর, কী একটা অফিসার পোস্টে বদলি হয়ে এসেছে ২০০০ সাল নাগাদ সবার জন্য শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নারীশিক্ষা বিস্তার প্রকল্প’ অফিসে। এখানে যতদিন থাকে দুই হাতে টাকা কামাবে, তারপর সরকারের মর্জিমতো কোথায় কোনো কলেজে ঠেলে পাঠাবে, আবার সেই মাস্টার তো মাস্টারই! তবে, কাজ করার মুরোদ আছে বলেই না সে টাকা নেয়। কাঁচাপাকাচুল তো সেটাও পারে না। তার এত তেজ কিসের? রাগে আফাজ আলির কদমে যেন হাওয়া লাগে, খুব তাড়াতাড়ি হেঁটে সে একরকম ছুটতে থাকে গোরস্তানের গেটে মসজিদের দিকে। এই রাগ তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার জন্যে কাঁচাপাকাচুলের ওপর, না ছেলের চাকরির ঘুষের ১ম কিস্তির টাকা-নেওয়া সেই অফিসারে-পরিণত-প্রফেসরের ওপর, না তার পুরনো পার্টি ভাগিয়ে নেওয়ার জন্যে হায়দর বখসের ওপর, না হায়দর বখসকে ডেকে আনার জন্যে কালুমিঞার ওপর, না ঠিকমতো হাজির না থাকার জন্যে শরিফ মৃধার ওপর—স্থির করতে না পারায় উত্তেজিত হয়ে সারি-সারি কবরের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যার সঙ্গে ধাক্কা খায়, চোখ মেলে দেখে যে সেই লোকটি হলো মনুমিঞা। সঙ্গে-সঙ্গে তার রাগের টার্গেট পেয়ে আফাজ আলি প্রায় ধমক দিয়ে জিগ্যেস করে, ‘কী মিঞা, কী মনে করিয়া?’

‘চাচা আপনে ঐ গোরের দাফন করিয়া কৈ গেলেন আমি আর দেহি না।‘

‘আরে, আমর কি মরনের টাইম আছে? লও, আগে নমাজ পড়িয়া আসি। আজান হইল, লও যাই।’

কাতারে দাঁড়িয়ে ৪ রাকাত সুন্নত বেশ তাজিমের সঙ্গে পড়লেও ফরজের ২য় রাকাতের রুকুতে যাবার সময় ইমাম সায়েবের বুলন্দ গলার ‘আল্লাহ আকবর’ আওয়াজ ছাপিয়ে আফাজ আলির কানে বেজে ওঠে গোরস্তানের গেটে কয়েকটা গাড়ি থামার, গাড়ির দরজা খোলার ও বন্ধ করার মিঠে বোল। এই বোলেই গাড়ির খানদানের ইশারা স্পষ্ট। এইসব গাড়ির সঙ্গে মানানসই কোনো শরিফ ভদ্রলোক দুনিয়া থেকে চিরকালের জন্যে বিদায় নিয়েছে! এখন নিশ্চয়ই অ্যাডভান্স পার্টি এল, কবরের জায়গা বাছাই করবে, কবর কাটার গোরকোন নিয়োগ করবে। বাদ মগরেব বা বাদ এশা বায়তুল মুকাররমে জানাজার পর লাশ আসবে। এই লাশের দাফন, জিয়ারত, মোনাজাত ধরতে পারলে কিছু কামাই হয়, তাহলে মনুমিঞাকে দিয়ে বাড়িতে কয়েকটা টাকা পাঠানো যায়। হাবিবুল্লার চাকরির কদ্দুর কী হলো কে জানে? আবার কত টাকার বাক্কা! এখন কাল্লু মিঞা আবার এই নতুন পার্টিকে হাত না করে ফেলে!

না, গোরস্তানে লাশ এখন পর্যন্ত আনা হয়নি। আহা রে! জোয়ান ছেলে এভাবে মরে! বাপ কোন ফরেন কোম্পানির খুব বড়ো অফিসার, ছেলের লাশ নিয়ে পৌঁছেছে আজ দুপুরবেলা। আহা! বাপের কষ্টের সীমা নাই। ২/৩ মাস লাখ-লাখ টাকা খরচ করে ছেলের চিকিৎসা করাল লন্ডনে; আবার দেখো, নিজে এসেছে ছেলের কবরের জায়গা ঠিক করতে। মরহুমের ভাই-বোন সব থাকে অ্যামেরিকা, জার্মানি, জাপানে। সবাই এসে পড়েছে, জার্মানির বোন না ভাইয়ের ফ্লাইট আসবে সন্ধ্যার দিকে। সে এসে পড়লে বাদ এশা জানাজা, বায়তুল মুকাররম থেকে লাশ নিয়ে সোজা গোরস্তান। এদের আয়োজন সব নিখুঁত, গোরস্তানে এত সব রডলাইটের ছড়াছড়ি, রাতদিনের ফারাক নাই, কিন্তু এর মধ্যেও এরা নিয়ে এসেছে ১৫/২০টা চার্জ লাইটার। শরিফ মৃধা এখন আর গাফলতি করেনি। কবর খোঁড়া, বাঁশ, চাটাই জোগাড়ের ভার সে দখল করে নিয়েছে, তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তার পিছে ঘুরছে মনুমিঞা। আফাজ আলি মসজিদে ঢুকলে ছোকরা সটকে পড়ল কখন? যাক, হ্যামরা সফরে আছে, নামাজ কাজা করে পড়লেও চলে। গেরাইম্যাটা বরং ভালো করে সব দেখুক, দেখুক টাকা রোজগারের জন্যে আফাজ আলির খাটনির কোনো সময় অসময় নাই, রাতদিন তাকে দুই পায়ে খাড়া থাকতে হয়। তাকে দেখে মনুমিঞা এগিয়ে আসে, বলে, ‘চাচা, হাবিবুল্লার খবর তো ভালো না।’

‘কেন? ট্যাহা তো তোমার মোকাবেলাইতে দিলাম। আরেক কিস্তি এই মাসে আর পারলাম না। শবে বরাত যাউক, ট্যাকা দেমানে? ঐ সায়েরে তোমারে কিছু কইছে? হাবিবে তোমারে পাঠাইলো কোন আক্কেলে? হারামজাদায় ভাবলে ঢাকায় বুঝি ট্যাকার গাছ আছে, না? হ্যায় বললে আর মুই গাছ থন ট্যাকা পাড়িয়া দিলাম?’ দীর্ঘ সংলাপের ঝাঁঝে কিছুক্ষণ আগের মুর্দার জন্যে রোনাজারি সম্পূর্ণ মুছে গেলে সে থামে। এই সুযোগে মনুমিঞা বলে, ‘না চাচা, ট্যাকার মামলা না। কয়দিন হাবিবের খুব দাস্ত। আর–’

‘অর দাস্তের সোম্বাদ পৌঁছাইতে তুমি ঢাকা আইছো? বাকেরগঞ্জে সরকার হাসপাতাল বানাইলো কি তোমাগো বায়োস্কোপ দ্যাহাইতে?’

‘না চাচা, কথা হেইডা না। কথাডা শোনেন। মনুমিঞার কথা শেষ করার আগেই শরিফ মৃধা এগিয়ে এসে তাকে একটু আড়ালে নিয়ে যায়। এখানে দুই সারি কবরের মাঝখানে সরু রাস্তার ৪টে কবর আফাজ আলি আর শরিফ মৃধার এখতিয়ারে। পাথরে বাঁধানো কবর ঘেঁষে আফাজ আলি দাঁড়ালে শরিফ মৃধা বলে, ‘হুজুর, আপনে আজই বাড়ি যান। আপনের পোলার কঠিন ব্যারাম। এই লোকে আমারে সব বলছে।’

কয়েক হাত দূরে নতুন সারির শুরুতেই ওপরে রডলাইট এবং নিচে চার্জলাইটের চোখ ঝলসানো আলোয় কবর খুঁড়ছে গোরকোনরা, ফাল্গুন মাসেও তাদের মাটি-মাখা গেঞ্জি ঘামে কাদা। এত আলো, অথচ তাদের কালো-কালো গতর ও সেইসব গতরের আরো-কালো ছায়ায় কবরের ভেতরটা আন্ধার ঠেকে। মনুমিঞা মরিয়া হলে বলে, ‘চাচা, গেলে আজই মেলা করা লাগে। হাবিবের অবস্তা আমি যা দেখিয়া আসছি–।’

সে কী দেখে এসেছে? এই জন্যেই কি একটু আগে ১২৩৪৫ নম্বরে দাফনের পর মোনাজাতে আল্লা তাকে দিয়ে হাবিবুল্লার নামে আগাম আরজি করে রাখল?–৭৭৬৯ নম্বরের পাথরের চওড়া ও মসৃণ রেলিঙে আফাজ আলি ধপ করে বসে পড়লে তারই তদারকিতে ও শরিফ মৃধার হাতে লাগানো গোলাপের কাঁটা তার ঘাড়ে খোচা মারে। গর্দানটা তার একটু মোটাই, কিন্তু চামড়া সে তুলনায় পুরু নয় বলে ঘাড়টা চিনচিন করে উঠল। এই সঙ্গে অনেক আগেকার শিশু হাবিবুল্লা তার ঘাড়ের ওপর বসে দোল খেতে থাকলে সেখানটা শিরশির করে এবং আরেকটু ওপরে খচখচ করে বেঁধে এখনকার হাবিবুল্লার চাকরির ঘুষ বাবদ হাওলাত-করা ৫০০০ টাকার নোটের কোণাগুলো। গোলাপকাঁটার খোঁচা থেকেই যায়, টাকার চাপে মিলিয়ে যায় শিশু হাবিবুল্লার ছোট্ট পায়ের দুলুনি। টুপির নিচে তার গোটা মুণ্ডু জ্বলে ওঠে দপ করে; শবে বরাতের বাকি মোটে ৬ দিন, এখন কি তার বাড়ি যাবার সময়? কত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, সাফসুতরো করতে হবে কত মুর্দার নাম এবং তাদের জন্মমৃত্যুর তারিখ। ৬৬৯৮ নম্বরে গালিচার মতো ঘাস না দেখলে মুর্দার মেজর জেনারেল ছেলে আফাজ আলির ওপরে কী অপারেশন চালাবে আল্লা মালুম। উত্তরের শেষ কবর অনেক দিনের, এর বাসিন্দার মৃত্যুর সময় তার ছেলের বয়স ছিল ১৫/১৬। লোকটি এখন ৩৫/৩৬ তো হবেই, এই ২০টি বছর ধরে শবেবরাতের সন্ধ্যায় সে একবার আসবেই। কবরের বেলফুলের গাছগুলো সাফ করাতে হবে। এ কি একটা দুটো কবর? পুরনো সব পার্টির অনেকে মুর্দার কথা ভুলে যায়। নিজের বাপ মায়ের কবর, এমনকি কেউ কেউ ছেলেমেয়ের কবর বাঁধিয়ে দিয়ে গেছে কবে! অনেকেই মালিও হয়তো ঠিক করে গিয়েছিল মাসকাবারি চুক্তিতে, ২/১ বছর নিয়মিত আসা-যাওয়া করতে করতে তাদের শোক চাপা পড়েছে নানা ধান্দায়। হয়তো ৩/৪ বছর ধরে লাপাত্তা। হয়তো এর মধ্যে মুর্দার ছেলের হার্টের বাইপাশ সার্জারি হবে ব্যাঙ্ককে কিংবা তার একমাত্র মেয়ের ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়েছে, চিকিৎসা করতে রওয়ানা হবে অ্যামেরিকা, মুর্দার বিধবা স্ত্রী এসে স্বামীর কাছে দোয়া চাইতে এলে আফাজ আলি তার মোনাজাতকে প্রথমে ফোঁপানি ও ক্রমে হাউমাউ কান্নায় চড়িয়ে সেই বিবিসায়েবকে কাবু করে ফেলেছে। শোকের ওপর চাপা দেওয়া ছাই উড়ে গেলে বেগমসায়েবের কাছে ২০০/৩০০ এমনকি ৫০০ টাকাও কোনো ব্যাপারই নয়। আফাজ আলির হাতে টাকাটা ধরিয়ে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে পা ছেঁচরে ছেঁচরে হেঁটে গেটে গিয়ে সেই যে গাড়িতে উঠল, হয়তো ৪ বছর তার আর দেখাই নাই। তবে তাদের সবার নাম, ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর সব নোট করা আছে আফাজ আলির ডায়রিতে। শবেবরাতের আগে আগে কাছাকাছি কয়েকটা দোকান থেকে আফাজ আলি তাদের সবাইকে টেলিফোন করে। কারো কারো ফোন নম্বর পালটে গেছে, তাদের হদিস করা যায় না; বাপ-মা কি ছেলেমেয়েকে আন্ধার গোরে সেঁধিয়ে কেউ-কেউ পাড়ি দিয়েছে সৌদিতে কি সিঙ্গাপুরে কি অ্যামেরিকায়। যাদের পাওয়া যায় তাদের কেউ কেউ বলে, আফাজ আলিকে আব্বার কি আম্মার ভার দিয়ে তারা নিশ্চিন্তে আছে। স্মৃতিতে বেদনায়-ভারি-গলায় তারা বলে, ‘আব্বা গোলাপফুল বড়ো ভালোবাসতেন হুজুর, কররে ভালো গোলাপের চারা লাগিয়ে দেবেন? দাম যা লাগে দেব। শবেবরাতের রাতটা আব্বার সঙ্গেই থাকব ভাই।’ কারও মায়ের প্রিয় ফুল ছিল রজনীগন্ধা। মুর্দাদের পছন্দ অনুসারে ও তাদের ছেলেমেয়েদের অনুরোধে গোলাপ, রজনীগন্ধা, ডালিয়ার চারা লাগানো হয়। ছেলেমেয়েরা অনেকেই অর্ডার দিয়েই খালাস, শেষ পর্যন্ত আসতে পারে না। যারা আসে তাদের কাছ থেকে আফাজ আলি আর শরিফ মৃধা বাধ্য হয়ে দাম নেয় তিনগুণ চারগুণ। লোকসান পুষিয়ে না নিলে তাদের চলবে কেন? তবে খোদার রহমতে শবেবরাতে তার লোকসান হয় না। ঐ রাতে এখানে যেন মেলা বসে যায়। মুর্দার সাথে জিন্দার সেদিন মিলনের রাত। মুর্দা প্রিয়জনদের জন্যে জিন্দা মানুষের মোহাব্বত ছোটে সেদিন নহরের পানির মতো। গোরস্তানের বাইরে ফকির মিসকিনের ভিড় ঠেলে মানুষের ঢুকতেও খুব কষ্ট হয়। গাড়ি থাকে সেদিন ঐ দূরে বড়ো রাস্তার কিনারে। গোরস্তানের ভেতরে যেমন জিন্দার সাথে মুর্দার মিলন, বাইরে তেমনি খালি গাড়ি আর ভিখারি। এত গাড়ি আসে যে, সামলাতে ডজন-ডজন পুলিশ হিমসিম খায়। ফকির-মিসকিনদের সেদিনকার রোজগার তাদের সারা বছরের কামাইয়ের সমান। লোকে পয়সা, দেয়, রুটি হালুয়াও দেয় দেদার। রুটি যা মেলে ব্যাটা ফকুরনির বাচ্চারা রোদে শুকিয়ে বাড়ি নিয়ে যায়, কয়েক সপ্তাহ ধরে তাই গেলে। সে তুলনায় হুজুরদের রোজগার আর কী? এর ওপর মানুষ কত ফন্দিই শিখেছে। আজকাল যেখানে-সেখানে মাদ্রাসা, মাদ্রাসা করার চেয়ে সোজা কাজ মনে হয় আর কিছু নাই। দীনের নামে সব ফেরে বাজি। মাদ্রাসার তালেবেলেমদের ধরে এনে তাদের দিয়ে দোয়া পড়িয়ে লোকজন সস্তায় বেহেশতে পাঠাতে চায় বাপ-মাকে। অত সোজা? আল্লার কালাম জানে না, দোয়া পড়তে পারে না সহিমতো, তাদের দিয়ে তোমরা আখেরাতের ফায়দা লুটতে চাও? তবে হ্যাঁ, আছে, বুঝদার শরিফ মানুষও আছে, তারা মুনসি মৌলবি ঠিকই চেনে, কদরও করতে জানে। টেলিফোনে সেইসব মানুষকেই বাপ-মায়ের প্রতি তাদের দায়িত্বের কথাটা মনে করিয়ে দেয় আফাজ আলি। শবেবরাতের পবিত্র রাতে এসে তারা নিজেদের ইহকাল ও মৃত আত্মীয়স্বজনের আখেরাতের জন্যে বড়ো উদ্বিগ্ন ও বিচলিত হয়। মরহুম আব্বা-আম্মা কিংবা ভাইয়া ও আপাদের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আফাজ আলির মোনাজাত শুনতে শুনতে তারা ফোঁপায় এবং কারো কারো ফোঁপানি গড়ায় কান্নায়। তারপর দায়িত্ব সম্পন্ন করে ঘরে ফেরার সময় তাদের কারুকাজ-করা পাঞ্জাবির পকেট থেকে পুরুষ্টু মানিব্যাগ বের করে আফাজ আলির হাতে যা দেয় তাতেই সে সন্তুষ্ট। পার্টির সামনে টাকা সে গুনেও দেখে না। এই ফজিলতের রাতে গোরস্তান জুড়ে আল্লার ফেরেশতা, যেখানে যা পাওয়া যায় তাতেই বরকত। মাত্র কয়েকদিন বাদে শবেবরাতের এই বেহেশতি মহফিলে শরিক হতে না পারলে আল্লার রহমত তার জুটবে কোত্থেকে? হাবিবুল্লার চাকরির জন্যে ঘুষের ২য় কিস্তির অন্তত সিকিটা পেলেও একটু এগিয়ে থাকা যায়। বাকি টাকার জন্যে হাত পাততে হবে কুদ্দুস হাওলাদারের কাছে। ৫০০০ নেওয়ার সময় চুক্তি হয়েছিল যে, চাকরি হলেই প্রথম মাসের বেতনের সবটাই কুদ্দুসকে দিতে হবে। বাকি টাকা শোধ হবে মাসে ৪০০ টাকা করে দিয়ে। এর ওপর লাভ দিতে হবে ২০% হারে। পরহেজগার মানুষ, কুদ্দুস সুদ নিতে পারে না বলে লাভের অংশ নেয়। তাকে লাভ দিতে দিতেই তো হাবিবুল্লা ফতুর হয়ে যাবে, আফাজ আলি নিজে কিছু দিতে পারে তো কুদ্দুসকে লাভ দেওয়া থেকে খানিকটা বাঁচা যায়। এই সময় বাড়ি না গেলেই কি নয়?

‘মনুমিঞা, হাবিবুল্লার অবস্থা কি খুব খারাপ ঠেহে? ধরো, শবেবরাতটা যদি পার করিয়া যাই—’

‘চাচা, গেলে আইজই মেলা করা লাগে।’ মনুমিঞাকে সমর্থন করতে এগিয়ে আসে শরিফ মৃধা, হুজুর, বাড়ি যান। শবেবরাতের অহনও ছয় দিন। আপনের আসা-যাওয়া ধরেন দুই দিন, বাড়ি থাকবেন একদিন। ঢাকায় আওনের বাদেও আপনে তিনদিন পাইতাছেন।’

ভোরে বরিশাল ঘাটে নেমে প্রথম বাসে বাকেরগঞ্জ পৌঁছেই ইসহাক রিকশাওয়ালার মুখে খবর পাওয়া গেল। হাবিবুল্লার দাফন হয়ে গেছে কাল বিকালে। ওর রিকশায় উঠে আফাজ আলি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। দোয়া-দরুদ পড়া দূরের কথা, ইন্নালিল্লা বলার কথাও তার মনে নাই। আড়াইবাঁকি ঘাটে খেয়া নৌকায় পায়রা নদী পাড়ি দিতে দিতে ঢেউয়ে ঢেউয়ে নৌকা দোলে, আফাজ আলির দিকে তাকিয়ে অপরিচিত কোনো যাত্রী বলে, ‘হুজুর দোয়া-দরুদ পড়েন। এই রবিবার দিন শিবপুরের মধু সাহার গুয়ার নাওখান ডোবলো। কন তো, ফাল্গুন মাসিয়া নদী, বাও নাই বাতাস নাই, কৈ থন কী হইয়া গেল!’ আফাজ আলি শুধু পায়রার ঢেউ দেখে। ফাল্গুনের রোদে ঢেউগুলো রোদ পোহায়, এইসব ঢেউয়ের নিচে জলস্রোত ওঠানামা করে জলে-ডোবা মানুষের লাশের ওপর। নিচে কী হলো যে কবরগুলো এভাবে কাঁপে? ওখানে কি গোর-আজাব হচ্ছে? চমকে উঠে আফাজ আলি আস্তাগফেরুল্লা পড়ে এবং গ্রামের ঘাট পর্যন্ত আস্তাগফেরুল্লা পড়াই অব্যাহত রাখে।

আফাজ আলি বাড়ির ভেতরে ঢোকার আগেই হামলে কেঁদে ওঠে হাবিবুল্লার মা। দরজায় তাকে জড়িয়ে ধরে তার শ্বশুর, ‘বাবা, আর একটা দিন আগে আসলে দেখা হইতো।’ তারপর সে সান্ত্বনা দেয়, আল্লার মাল, আল্লায় নিছে। মনডা শক্ত করো, শক্ত করো।

না, মনুমিঞা ঢাকায় গিয়ে খবর গোপন করেনি, হাবিবুল্লা মারা গেছে মনুমিঞা যখন বরিশাল থেকে ঢাকায় রওয়ানা হয়ে গেছে। দাস্তের রোগী, পরে বমিও হচ্ছিল, এই রোগীর লাশ বেশিক্ষণ রাখা নিরাপদ নয়। এই দক্ষিণে দাস্তের ব্যারাম খুব হচ্ছে, শরিয়তমতো সব লাশের দাফন পর্যন্ত করা যাচ্ছে না। বাকেরগঞ্জ হাসপাতালে ডাক্তারদের কেউই সপ্তাহে দুই দিনের বেশি হাসপাতালে থাকে না। ছোকরা এক নতুন ডাক্তার এসেছে, সে একাই সামাল দিচ্ছে কয়েকটা ইউনিয়নের রোগী। হাসপাতালে স্যালাইনের ব্যাগ ছিল মোটে কয়েকটা, মওলানা আশরাফুদ্দিন উজিরপুরীর প্রভাবে তার একটির নোনাজল মিশেছে হাবিবুল্লার পানসে রক্তের সঙ্গে। হায়াৎ নাই, ওষুধ থাকলেই আর কী হতো?

খালের ধারে মাঝে মাঝে বেতবন, খাল পেরিয়ে গোরস্তান। গোরস্তানের অপর পাশে মোটা-মোটা বাঁশের ঘন ঝাড়। দাস্ত-বমিতে কয়েকদিন হলো রোজই মানুষ সাফ হচ্ছে, এখানেও কয়েকটা নতুন কবর। আবদুল কুদ্দুস হাওলাদার জিয়ারতের দোয়া পড়তে মওলানা আশরাফুদ্দিন উজিরপুরীকে অনুরোধ করলে সে আবার বলে আফাজ আলিকে, ‘দাফনের সময় আমি দোয়া পড়ছি। তুমি নিজে জিয়ারত করো, মোনাজাত করো, বাপ-মায়ের কান্দন খোদায় শোনে।’

বিড়বিড় করে জিয়ারতের দোয়া পড়তে শুরু করে আফাজ আলি। একটু হোঁচট খায়। না, না, দোয়া তার ভুল হয়নি, কখনো হয়ও না। এই গোরস্তানের কি ছিরি, এখনে এই দোয়া পড়ে আল্লার কালাম নাপাক করে ফেলা হয় না? এ কী গোরস্তান না ভাগাড়? এ সব কি মুর্দাকে ইজ্জতের সঙ্গে দাফন করা, নাকি লাশ দড়ি বেঁধে টেনে এনে পুঁতে রাখা হয়েছে? খালের ধারে বেতবন থেকে মানুষের ও বাঁশঝাড় থেকে পর্দানশিন মেয়েমানুষের গুয়ের গন্ধ, রাত্রে শেয়ালের-খোঁড়া কবরগুলোর ভেতর থেকে উঁকি দেওয়া বয়স, লিঙ্গ ও পেশা নির্বিশেষে মুর্দাদের খুচরা-খাচরা ঠ্যাং, রান বা হাঁটুর গন্ধ এবং গিজগিজ করা গাছপালা-লতাগুলোর ভেষজ গন্ধ মিশে ফাল্গুনের ফুরফুরে হাওয়ায় অবিরাম ঘুরপাক খায়। দুষ্টুমি করে এর সঙ্গে লুকোচুরি খেলে নদীপথ হয়ে খালের পানিতে ভেসে আসা নোনা বাতাসের ঝাপ্‌টা। স্থানীয় গন্ধের অবিরাম ঘুরপাক ও সমুদ্রের বাতাসের অনিয়মিত ধাক্কা সামলানো আফাজ আলির পক্ষে ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ে। জিয়ারতের দোয়া তবু মুখস্ত পড়া গেল। —আল্লা তার ছেলেকেই নিল, তা আল্লার কালাম আল্লাকে নিবেদন করতে আফাজ আলির আর কী কষ্ট হবে? কঠিন কাজ হলো আল্লার দরবারে মোনাজাত করা, আল্লার কাছে সে চাইবে কী? ছেলের রুহের মাগফেরাতের জন্যে আর্জি করতে গেলেই তার গর্দানে লাগে আবদুল কুদ্দুস হাওলাদারের নিশ্বাস। মোটা গর্দানের তুলনায় পাতলা চামড়ায় ছ্যাক লাগে। ছেলের রোজগারে মাসে মাসে ঋণশোধের রাস্তা তার চিরকালের জন্যে বন্ধ হয়ে গেল। হায়রে, নিজের আওলাদ তাকে এটুকু সাহায্যও করল না! নদীপথ হয়ে খালের ওপর দিয়ে আসা সমুদ্রের নোনা বাতাসে আফাজ আলির চোখে পাতলা মেঘ জমতে না জমতে আবদুল কুদ্দুস হাওলাদারের নিশ্বাস মেশানো স্থানীয় হাওয়া সব শুষে ফেলে এবং সেই সঙ্গে গলার আর্দ্রতাও শুকিয়ে গেলে দুই হাত তুলেও লোকটা কিছুই চাইতে পারে না। গোরস্তান থেকে ফিরতে ফিরতে এমনকি তার শরীরের রক্ত পর্যন্ত শুকিয়ে যাওয়ার দশা হয়, আফাজ আলি সেই শুকনা শরীরে বল সঞ্চয়ের আশায় কথা বলতে চায় মনুমিঞার সঙ্গে। কিন্তু কী বলবে তাও মনে করতে পারে না।

সেই কথা তার মনে পড়ে পরদিন। হাবিবুল্লার চাকরির জন্যে দেওয়া ঘুষের ১ম কিস্তির টাকাটা কি মনুমিঞা ফেরত আনতে পারে?

না, তা হয় কী করে? বন্ধুবিয়োগে কাতর মনুমিঞা জানায়, ২০০০ সাল নাগাদ সবার জন্য শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নারীশিক্ষা বিস্তার’ অফিসার জাহাঙ্গীর কাজী স্যর তো টাকাটা পেয়েই বিভিন্ন জায়গায় ভাগবাটোয়ারা করে দিয়েছে, তার পকেটে গেছে সামান্য একটি অংশ। তবে টাকা পরিশোধের জন্যে আফাজ আলি এত অস্থির হচ্ছে কেন? আবদুল কুদ্দুস হাওলাদার তো টাকাটা এক্ষুণি চাইছে না। এটা কোথাও খাটালে তার কিছু লাভ তো হতোই, আফাজ আলির এত বড়ো বিপদ, লাভ যতটা কম দেওয়ার জন্যে সে বরং একটু তাড়াতাড়ি টাকাটা শোধ করুক। পাশের গাঁয়ের মানুষ, নানাদিক থেকে আত্মীয়তাও আছে, আফাজ আলির বিপদ মানে তারও বিপদ। আফাজ আলিও যেন তার কথা ভাবে।

এদিকে বাড়িতে আফাজ আলির বৌয়ের দাস্ত শুরু হয়েছে। আফাজ আলির এখন উপায়? শবেবরাতের আর মোটে ৪ দিন বাকি। তার সমস্যা বোঝে আশরাফুদ্দিন, ‘কত বড়ো বড়ো মানুষ তাগো মুর্দা ময়মুরুব্বির জিম্মাদারি তোমার হাতে ছাড়িয়া দিয়া নিশ্চিন্তে আছে, তুমি এখানে বসিয়া থাকলে চলবে?’ তারপর যেচে সে জামাইয়ের হাতে ১০০০ টাকা তুলে দিয়ে পরামর্শ দেয়, এটা সে বাড়িতে রেখে যাক, এ দিয়ে হাবিবুল্লার মায়ের চিকিৎসা হবে, কয়েক দিন তার সংসারও চলবে। তবে শবেবরাতের পরপরই আফাজ আলি যেন টাকাটা মানি অর্ডারে পাঠিয়ে দেয়। তার নিজের টাকা হলে কথা ছিল না, কিন্তু মাদ্রাসা ফাণ্ডের টাকা, ‘এম পি সায়েরে বহুত তদবির করিয়া তিরিশহাজার স্যাংসন করাইছে, আমার হাতে দশহাজার দিয়া বললে, এই দিয়া বিসমিল্লা করেন, টাকা আসতে আছে। শবেবরাতের পর কনোসটেরাকশনের কামে ইনশাআল্লা হাত দিমু। টাকা নাজাই পড়লে শরম পামু, মনে করিয়া পাঠাইয়া দিও বাবা।’ বলতে বলতে মওলানার শোককাতর গলার ভার লাঘব হয়, সে জানায় এদিকে মাদ্রাসায় মাদ্রাসায় কাজের ধুম পড়ে গিয়েছে। আফাজ আলির ছোটোছেলে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়েছিল হাবিবুল্লার তাগাদায়, ঝড়ে ঐ স্কুল ভেঙে যাওয়ার পর এখনো মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। তার কাছেই এবতেদায়ি মাদ্রাসায় দেওয়া হচ্ছে নতুন টিনের ছাউনি, সামনের বার মেঝেও পাকা হবে,–আফাজ আলি বললে আশরাফুদ্দিন ছেলেটাকে ওখানে ভর্তি করিয়ে দেবে। বাকেরগঞ্জে আলিয়া মাদ্রাসার বিল্ডিং করার টাকা এসেছে মেলা, বিলাত না অ্যামেরিকার কোন নাসারা প্রতিষ্ঠান টাকা ঢালছে আমাদের দীনি এলেমের জন্যে, তারা বুঝতে পাচ্ছে, ইসলাম ছাড়া আর গতি নাই। আফাজ আলির চিন্তার কোনো কারণ নাই, এই লাইনে পড়লে তার ছোটোছেলের রুজির অভাব ইনশাআল্লা কখনো হবে না।

আল্লার এলেম শিখতে শিখতে ছেড়ে দিয়েছিল বলে হাবিবুল্লার ওপর আল্লা কি নারাজ হয়েছে? হঠকারি জ্যেষ্ঠ পুত্রের ওপর ক্ষোভে তার জন্যে আফাজ আলির শোক দানা বাঁধতে পারে না, আবার টলোমলো শোক এলিয়ে দেয় তার ক্ষোভকে। শোক বা ক্ষোভ তাকে জ্বালাতে বা বিধতে না পারলে তার সামনে সব বড়ো ফাঁকা ফাঁকা ঠেকে। ফাঁকা শরীর ও ফাঁকা মাথার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তবে তাকে সচল রাখে আসন্ন শবেবরাত। শবেবরাতের আর ৪ দিন, প্রতি পলকে সময়টা কমে আসছে। দুপুরে ভাত খেয়ে রওয়ানা হলে সন্ধ্যার মধ্যেই বরিশাল। বরিশাল থেকে ৮টার লঞ্চ ধরতে পারলে পরদিন ভোরবেলা ঢাকা। তাহলে কালকের দিনটা পুরো কাজে লাগানো যায়। কত মানুষকে টেলিফোন করতে হবে, এবার দরকার হলে সে না হয় বাড়ি-বাড়ি ঘুরে মানুষের ছাইচাপা শোককে উকিয়ে দিয়ে আসবে।

‘আসসালামুআলায়কুম ইয়া আহলালে কুবরে’। নিজের কর্মস্থলে পা দিয়ে আফাজ আলি গভীর তাজিমের সঙ্গে মুর্দাদের সালাম করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, কবরগুলো থেকে নীরব জবাব তার কানে আসে, ‘ওয়ালেকুম সালাম ইয়া রহমতুল্লা ইয়া বরকাতুহু ইয়া মাগফেরাতু। শবেবরাতের সাজো সাজো রব পড়ে গেছে, গোরস্তানের বাইরে থেকেই এর আয়োজন শুরু। দেশের নানা এলাকা থেকে ফকির-মিসকিন এসেছে সপরিবারে, সারি করে বসেছে তারা রাস্তা জুড়ে, নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি ও মারামারির মধ্যে দিয়ে চলছে তাদের উৎসব এবং মহোৎসবের প্রস্তুতি। এদের ওপর আফাজ আলির কোনো রাগ নাই আজ, গরিবের দোয়া আল্লা কবুল করে সবার আগে।

ভেতরে ঢুকতেই পাওয়া গেল শরিফ মৃধাকে। ৮১৩০ নম্বর কবর বড়ো অবহেলায় ছিল, সেটা সাফ করা হয়েছে তো? ৫০৬৮তে গোলাপ ফুটল? এই মুর্দা গোলাপ পছন্দ করত, তার মেয়ে প্রতি শবেবরাতের দিন বিকালবেলা এসে বাপের কবর থেকে বাপের লাশের বাসিরক্তে-লাল ও শুকনা-মজ্জায়-পুরুষ্টু একটি গোলাপ তুলে ভ্যানিটি ব্যাগে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফেরে, ঐ ১টি গোলাপের দাম এমনকি ২০০ টাকা পর্যন্ত উঠতে পারে, এর ১৫০ টাকাই তার, বাকিটা দিতে হয় শরিফ মৃধাকে। ৬৬৯৮-এ সবুজ ঘাসের গালিচা না দেখলে মুর্দার মেজর জেনারেল ছেলের শোক ঠিক মতো জমে না। ঘাস গজাবার কদ্দুর কী হলো?

‘সবই হইবো হুজুর, ঘাবড়ায়েন না। শরিফ মৃধা তাকে আশ্বস্ত করে। কিন্তু আরো জরুরি কাজ পড়ে রয়েছে, হুজুর বরং সেদিকে নজর দিক। কী?–‘সেইদিন যে পার্টি দেইখা গেলেন, উনিরা আসছে। আপনে তো বাড়ি গেলেন গিয়া, দাফনের সব বন্দোবস্ত করলাম আমি। কাল্লুরে ঢুকবার দেই নাই। হায়দর বখস হুজুরে ঐদিন দোয়া পড়ছে। আজ অগো কুলখানি, অহন তারা আইছে জিয়ারত করতে। কয়টা গাড়ি ভইরা মানুষ, মনে হয় ১৫/২০ জনের কম না। গাড়িই আইছে ৮/১০ খান। হায়দর বখস হুজুরে গেছে ইসকাটন, মিলাদ পড়াইতে। আপনে জিয়ারত পড়েন। পার্টি মালদার। আমার কথাটা কইয়া রাইখেন। হায়দর বখসরে দিয়া কালু এইটা দখল করার তালে আছে। দেইখেন কিন্তু।’

ঐ কবরের সামনে ভিড়। ওদের দেখে লম্বাচওড়া এক ভদ্রলোক বলে, মওলানা সাহেব কোথায়? দাফনের দিন ছিলেন, তিনি নেই?’

‘ঐ হুজুরে বাড়ি গেছে, তার ছেলের অসুখ।‘ শরিফ মৃধার এই জবাবে আফাজ আলি চমকে উঠে প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে জানায়, ‘তিনি কোথায় মিলাদ পড়াতে গেছেন। এসে পড়বেন। আপনারা একটু অপেক্ষা করবেন?’

কবরের চারদিকে বাঁশের চাটাই দিয়ে কী সুন্দর বেড়া দিয়েছে, অস্থায়ী বেড়া, তাতেই কী কারুকাজ! মুর্দার শিয়রে বেড়ার সঙ্গে ঝুলছে দামি অ্যালুমিনিয়ামের পাত, সাদা ঝকঝকে পাতে ঘন কালো বর্ডারের ভেতর কালো অক্ষরে ফুটে উঠেছে মুর্দার নাম এবং তার জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ। জন্ম ও মৃত্যুর দিন, মাস ও বছর। হাবিবুল্লার জন্ম তারিখ আফাজ আলির ঠিক মনে পড়ছে না, কিন্তু সাল কি ভুলতে পারে? কাঙালের মতো আফাজ আলি মিনতি করে, ‘আমি জিয়ারত পড়িয়া দেই স্যর। আমারে পড়তে দেবেন?’

অনুমতি পাওয়ার আগেই আফাজ আলি জিয়ারতের দোয়া পড়তে শুরু করল।

কবরের চার কোণা থেকে ওঠে দামি আগরবাতির ধোঁয়া, সেই ধোঁয়ার গন্ধ খচিত হয় পাশের কবরের গোলাপ ও উল্টোদিকের কবরের বেলফুলের গন্ধে। জমায়েত শোকার্ত আত্মীয়স্বজনের কারো কারো পারফিউমের সুবাস ও মুরুব্বিগোছের কারো জামার মেশঅম্বর আতরের খু ঐ আগরবাতি, গোলাপ ও বেলফুলের গন্ধের সঙ্গে মিশে আফাজ আলির কণ্ঠের আয়াতগুলোকে আলগোছে ঝুলিয়ে রাখে কবরের ওপর এবং একই সঙ্গে পরম যত্নে গুঁজে গুঁজে দেয় কবরের চারপাশে। ছেলেটা ঘুমাক, মশা-মাছিতে সে যেন এতটুকু উসখুস না করে। তার কাফনে কি মাটির দাগ লেগেছে? গোসল করানোর সময় তার শরীর থেকে দাস্তের সমস্ত চিহ্ন ভালো করে মুছে ফেলা হয়েছে তো? মাটির ভেতরে শুয়ে থাকা তার শরীরের সমস্ত নাপাক জিনিস সাফ করতে আফাজ আলি দোয়া পড়ে একটু ঝুঁকে। ধীরে ও বিলম্বিত লয়ে আয়াত পড়তে পড়তে অনেকক্ষণ পান-না-খাওয়া গলা তার ভিজে যায় এবং সেই সঙ্গে ভেজায় শোকার্ত আত্মীয়স্বজনের চোখের কোণ। মোনাজাতের জন্যে হাত তুললে আগরবাতির ধোঁয়ার মেঘ নামে তরল হয়ে, তরল ধোঁয়ার সঙ্গে পারফিউম, মেশক্‌অম্বর আতর, গোলাপ ও বেলফুল এবং সর্বোপরি আগরবাতির গন্ধ আফাজ আলির বিড়বিড় করা ঠোঁটের ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়ে তার গলায়। জিয়ারতের দোয়া শেষ হলে ঐ গলায় তার মোনাজাত বলকায়, আল্লা পরওয়ারদিগার, তোমার রহমতের শেষ নাই। তোমার পেয়ারের বান্দাকে তুমি তোমার কোলে টেনে নিয়েছ, তাকে তুমি বেহেশত নসিব করো আল্লা। তার আব্বা-আম্মা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আজ তোমার দরবারে তার রুহের মাগফেরাত চাইতে এসেছে, আল্লা রাব্বুল আলামিন, তাদের দোয়া তুমি কবুল করো আল্লা।’ একটু থেমে সে ফের নতুন উদ্যমে শুরু করে, ‘আল্লা, তোমার পেয়ারের বান্দাকে তুমি তোমার কোলে টেনে নিয়েছ, আমাদের কোনো নালিশ নাই, কারো কোনো নালিশ নাই, আমার কোনো নালিশ নাই!’ শেষ শব্দদুটি ভাঙা রেকর্ডের মতো তার ভাঙাচোরা গলা থেকে বারবার বেরুতে থাকলে শোকার্তদের কারো কারো চোখে বিষাদের সঙ্গে মেশে বিস্ময়। এবারে ‘আল্লা’ বলে আফাজ আলি মোনাজাতে তোলা দুই হাতের চওড়া ফাকের ভেতর দিয়ে কবরের বেড়ায় ঝোলানো অ্যালুমিনিয়ামের পাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। বেশ কয়েক সেকেন্ড ধরে চোখের নোনা মেঘের আড়াল ছিঁড়ে তরুণ মুর্দার নাম সে ভালো করে পড়ে নেয়, বানান করে করে পড়ে, স্পষ্ট করে পড়ে। তারপর ধীরে ধীরে বলে, ‘শাহতাব কবির তোমার পেয়ারের বান্দা, তুমি তাকে তুলে নিলে, কারো কোনো নালিশ নাই আল্লা।তুমি তাকে এতই মোহাব্বত করো যে, তার বাপ-মায়ের কথা তোমার একবারো মনে পড়লো না? আল্লা পরওয়ারদিগার, তোমার রহমতের দরিয়া কি শাহতাব কবিরের ওপর ঢেলে ঢেলেই শুকিয়ে ফেললে?’ এইবার সে ফোঁপায়, গলা খাঁকারি দিয়ে ফোঁপানি নিয়ন্ত্রণে মধ্যে এনে ফের বলে, ‘আল্লা, এত বড়ো উপযুক্ত পোলাডারে তুমি বাপের বুক হইতে কাড়িয়া লইলা? অর মায়ের বুকডা তুমি খালি করিয়া দিলা?’ কবরের পাশে দাঁড়ানো লোকজন তাদের রক্তসূত্রে পাওয়া অভিজাত সংযমে কান্নাকে লুকিয়ে রাখে শরীরের খাঁজে খাঁজে, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে তারা শোককে আব্রু দিতে জানে। কিন্তু তাদের জোয়ান ছেলের জন্যে আফাজ আলির মোনাজাত তাদের চাপা ঠোঁটে ঢুকে পড়েছে; তারা একটু বিহ্বল হয় এবং মৌলবিটার প্রতি কৃতজ্ঞতায় এই কবরে প্রতিদিন নিয়মিত কোরানপাঠের কাজে তাকে মাসকাবারি চুক্তিতে নিয়োগদানের বিষয়ে বিবেচনা করে। আফাজ আলি আল্লাকে জিগ্যেস করে, ‘আল্লা, তার নাদান বাপটার কথা একবার তুমি ভাবিয়া দেখলা না?’

মোনাজাতে আফাজ আলির গেরাইম্যা লজের প্রয়োগে শরিফ মৃধা উদ্বিগ্ন হয়, মোনাজাতে হুজুরের জবান সবসময় খুব চোস্ত। শোকার্ত আত্মীয়স্বজনের দিকে তাকিয়ে শরিফ মৃধা তাদের চোখমুখের জরিপ করে। না, ওদিকে মুসিবতের আভাস নাই। অনেকের চোখেই মেঘ জমেছে, এখন মেঘ থেকে অঝোরে পানি ঝরানো চাই। কিন্তু আফাজ আলির এরকম দশা শরিফ মৃধা আগে কখনো দেখেনি। মোনাজাত করতে করতে আবার ভুলভাল কিছু বলে ফেললে সব পণ্ড হবে।

আফাজ আলি শরিফ মৃধার দিকে খেয়াল না করে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, ‘আল্লা, আল্লা রাব্বুল আলামিন, শাহতাব কবিররে তুমি বেহেস্ত নসিব করো আল্লা। কিন্তু, পাক পরওয়ারদিগার, তার বাপটারে কি তোমার নজরে পড়লো না? বাপটা কি তামাম জীবন খালি গোরস্তানে গোরস্তানেই থাকবো?’ এবার শোকার্তদের বেশ কয়েকজনের শরীরের ভেতর লুকিয়ে রাখা-শোক ধাক্কা দেয় তাদের গলায় এবং তাদের অন্তত তিনজনের মোনাজাতে নিয়োজিত হাতের বিন্যাস ভেঙে পড়লে সেইসব হাত নিজেদের মুখে চেপে ধরে তারা ফৌপায়। প্রায় একই সময়ে আফাজ আলির হাতও ঝুলে পড়ে নিচে এবং উপুড় হয়ে পড়ে যাওয়া ঠেকাতে ঐ হাতজোড়া দিয়ে সে আঁকড়ে ধরে কবরের বেড়ার দুটো খুঁটি। তাতে একটু বল পেয়ে সে বলে, ‘আল্লা, তার নাদান বাপটা কি খালি গোর জিয়ারত করার জন্যেই দুনিয়ায় বাঁচিয়া থাকবো। আল্লা!’ তার ফোঁপানি চড়ে গেছে কান্নায়, আল্লার প্রতি তার নিবেদন এবং আল্লার কাছে তার মোনাজাত চাপা পড়ে তার ভেউভেউ কান্নার নিচে। আফাজ আলি প্রাণপণে ডাকে, ‘আল্লা, আল্লা গো! আল্লা।’ তার কান্নায় আল্লার নাম ভিজে চপচপে হয়ে যায়, ভিজতে ভিজতে এমনকি মুছে যাবার হাল হলেও আফাজ আলি হাউমাউ করে কাঁদে।

রচনাকাল – ১৯৯৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *