ফোঁড়া

ফোঁড়া

রিকশাটা এসে দাঁড়াল মামুনের গা ঘেঁষে, ‘যাবেন?’

‘কাটনারপাড়া।’

‘চলেন।’

‘কত? করোনেশন স্কুলের পেছনে।

‘ওঠেন না। ভাড়া যা দেন তাই দিবেন।

রিকসা পেতে মামুনকে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো পাক্কা পনেরো মিনিট। অথচ হাসপাতালের গেটের উল্টা দিকে শিরীষ গাছের নিচে চার-পাঁচটা রিকসা। প্যাসেঞ্জারের সিটে বসে ঠ্যাংগুলো নিজেদের আসনে ফিট করে বাঁ হ্যান্ডেল পর্যন্ত সম্প্রসারিত করে রিকশাওয়ালারা বিড়ি টানে, যানবাহন ও পথচারীদের দেখে, নিজেদের মধ্যে গপ্পো মারে। দুই-একজন যেতে রাজি হয় তো ভাড়া হাঁকে দ্বিগুণ-তিনগুণ। ঘন্টাখানেক আগে মামুন অবশ্য আরো বেশি ভাড়া দিয়ে হাসপাতালে এসেছে। তখনো রিকশার জন্য হাঁটতে হয়েছে আধমাইল। রাস্তায় তখন মেলা রিকশা, কিন্তু প্রত্যেকটিতে প্যাসেঞ্জার, কোনো-কোনোটায় তিনজন এমনকি একটিতে চারজন পর্যন্ত লোক বসে ও দাঁড়িয়ে মহা হৈ চৈ করতে করতে যাচ্ছে। মামুনের হাতের এই টিফিন ক্যারিয়ারের তিনটে বাটিই তখন পোলাও, কোর্মা, টিকিয়া এবং সেমাই-জর্দায় ঠাসা। তাতে কোনো অসুবিধা হয়নি। রিকশা না পেলে হেঁটে হেঁটে হাসপাতাল চলে আসত। তাড়াতাড়ি করতে হলো নইমুদ্দিনের কথা ভেবে। ঈদের দিন বেচারা নামাজও পড়তে পারল না, ছেলেমেয়েও সঙ্গে নাই,–ভালোমন্দ কিছু মুখে পড়লে ফাটা মাথা নিয়ে হাসপাতালে থাকার দুঃখ খানিকটা লাঘর হয়।

কিন্তু হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় মামুন কিছুতেই বেশি ভাড়া দেবে না। রিকশা পেতে দেরি হয় আর সংকল্প ক্রমে শক্ত হয়ে ওর মুখের শিরা-উপশিরাগুলোকে আড়ষ্ট করে তোলে। এর কারণ স্পষ্ট নয়। তবে অনুমান করি নইমুদ্দিনকে না পেয়ে ওর মেজাজ বেশ ভেতর থেকে খিচড়ে গেছে।

রিকশায় ওঠার পর মামুনের চোখমুখের বাঁধন শিথিল হয়। রিকশাটা চলছে রাস্তার এক পাশ দিয়ে আস্তে আস্তে। এটা বরং ভালো। লোকটা রিকশাই চালাচ্ছে, রিকশার প্যাডেলকে ট্রাকের গিয়ারের গৌরব দেওয়ার চেষ্টা করছে না।

আস্তে আস্তে প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে বিকশাওয়ালা তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, ‘হাসপাতালে আসিছিলেন কিসক?’

‘কাজ ছিল।’

মামুনের সংক্ষিপ্ত জবাবে রিকশাওয়ালা দমে না, ‘হামাক চিনলেন না? নুইমুদ্দি হামার মামাতো ভাই।’

মামুন চিনতে পারল না।

‘আপনার মনে নাই? তার এই খবর পায়া হামিই তো তার বৌ-ব্যাটা-বিটিকে লিয়া হাসপাতাল আসিছিনু, আপনার মনে নাই?’

না, মামুনের মনে নাই। তবে নইমুদ্দিনের আত্মীয় হওয়ায় এই লোকটার ওপর রাগটা ঝাড়া যাবে বলে মামুনের রগটগগুলো আরেকটু শিথিল হয়।

‘নইমুদ্দিন হাসপাতাল থেকে পালাল কেন?’

‘পলাবি কিসক? ছোলপোলের সাথে ঈদ করব্যার বাড়িত গেছে?’

‘ঈদ করার জন্যে হাসপাতাল থেকে রোগী বাড়ি যেতে পারে?’

‘ছুটি লিয়া গেছে।’

‘এ কী অফিস না কারখানা যে ছুটি নেবে? এই শরীর নিয়ে হাসপাতাল ছাড়ল, অবস্থা কী হতে পারে, জানো?’

রিকশাওয়ালা চুপসে গেল। কিন্তু মামুনের রাগ কমে না। ঈদের দিন, তার বাড়ি-ভরা আত্মীয়স্বজন। এমনকি পার্টির নেতা ঢাকা থেকে এখানে এসেছে শ্বশুরবাড়িতে ঈদ করতে, যে-কোনোসময় পার্টির ওয়ার্কারদের নিয়ে তার বাড়িতে আসতে পারে। আর সে কিনা তড়িঘড়ি করে আম্মা ও ভাবীর ওপর একরকম জুলুম করে একগাদা খাবার নিয়ে চলে এল হাসপাতালে। ২ নম্বর ওয়ার্ডে ঢুকে দেখে অর্ধেক ঘর ফাঁকা, ১২ নম্বর বেডেও কেউ নাই। কী ব্যাপার?

ব্যাণ্ডেজ ও স্যালাইনের বন্ধনের ভেতর থেকে মিনমিন করে ১১ নম্বর বেডের বোগী ‘পরশুদিন ডাক্তার সাহেব লিজে কত বুঝ দিল, পুরা তিন দিন বেহুঁশ আছিলা, এখন এট্টু ভালোর দিকে –এখন লড়াচড়া করলে হামরা দায়িত লিবার পারমু না। তখন কিছু কলো না। লে শালা কাল পাছবেলা বিছনা থ্যাকা উঠ্যা মর্দ ছোলের ঘাড়ত হাত দিয়া হাঁটা দিল। কী? –না, ঈদের দিন বৌ-ব্যাটা-বিটির সাথে থাকবার না পারলে তাঁই বলে দম বন্ধ হয়া মরবি! ল্যান ঠ্যালা!’

মামুন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। হাতের টিফিন ক্যারিয়ার এত ভারি ঠেকে যে ঠক করে রেখে দেয় ১১ নম্বর বেডের খাটের পা ঘেঁষে। মোজাইক-করা মেঝের নোঙরা চিটচিটে পরতে ভোঁতা আওয়াজ হয়। সেদিকে তাকালে চোখে পড়ে রোগীর ব্যবহৃত বেডপ্যান। গোটা ওয়ার্ডের গন্ধের উৎসটি পাওয়া গেল। তবে এটাই একমাত্র উৎস না-ও হতে পারে। আরো দুটো বিছানার নিচে বেডপ্যান শোভা পাচ্ছে। সেগুলো খালি কী ভরা কে জানে?

দরজার পাশে ১ নম্বর বেডের রোগীর ঘাড়ের সঙ্গে ঝোলানো ট্রাকশন। ঐ অবস্থাতেই নইমুদ্দিনের সমালোচনায় মুখর হতে তার অবশ্য অসুবিধা হয় না, ‘ছেলেমেয়ের সঙ্গে ঈদ করার জন্যে একেবারে হন্যে হয়ে উঠেছিল। বলে ঈদের দিনও যদি বাড়ি যেতে না পারে। অন্য একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এই সমালোচনার সূত্রপাত করে ওয়ার্ডের আরেক প্রান্তের রোগী, তার প্লাস্টার-জড়ানো ঠ্যাং ঝোলানো রয়েছে একটা স্ট্যাণ্ডের সঙ্গে। তা নামাজ-রোজায় কারো গাফিলতি দেখলে ক্ষোভ প্রকাশের হক তার আছে বৈ কি! এই লোকটি মালতীনগরের নতুন মসজিদের মোয়াজ্জিন। দোসরা কি তেসরা রোজার দিন তারাবি পড়ে রওয়ানা হয়েছিল চাঁদনি বাজারের দিকে। রোজার মাসটা লাচ্ছা সেমাইয়ের সারি সারি দোকান রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত জমজমাট থাকে। ওখানে রাস্তার একধারে টেবিল পেতে সাজানো মোয়াজ্জিনের আতর সুর্মা ও তসবির দোকান। দোকানে যেতে তড়িঘড়ি করতে গিয়ে মসজিদে পানির লাইন নেওয়ার জন্যে খুঁড়ে রাখা গর্তে পড়ে তার ডান পায়ে ফ্র্যাকচার হয়েছে। গোটা মাসের তারাবি খুঁড়ে-রাখা নামাজ ও সুর্মা-আতর- তসবি বেচা — দুই-ই মাটি। পরকাল ও ইহকালের এই লোকসানে লোকটা বড়ো ভেঙে পড়েছে, রোজগারের মাস বলতে তার একটাই, তার পুরোটাই এবার পণ্ড হলো। নইমুদ্দিনের প্রসঙ্গ অনেকদিন পর তাকে চাঙা করে তোলে, এই জাহেলগুলির ঈদের সখ একটু বেশি।

রিকশাওয়ালার মাধ্যমে এই কথাগুলো নইমুদ্দিনের কানে পৌঁছে দিতে পারলে মামুন স্বস্তি পায়। তার আগে রিকশাওয়ালাই বলে, ‘কাল বেনবেলা অর বাড়িতে গেছি। হামাগোরে ধরেন একই গাঁও, একটু বাঁশের আড়া পার হলেই অর ঘর। অক হামি পুছ করন, ক্যারে তুই বাড়ি আসল কিসক?–তা কয় ওটি ফাঁপড় ঠেকে। কয়, ডাক্তোর ঢাকাত গেল, হামিও বাড়িতে আনু।

‘ডাক্তার ছুটি নিতে পারে, ও ছুটি নেয় কীভাবে?’ মামুনের রাগ হয়, কী যুক্তি, অ্যা? এত কষ্ট করে বাঁচিয়ে তোলা হলো, এখন হুট করে বাড়ি চলে গেল। আর ফাঁপরের কী হলো? পার্টির লোক সবসময় কেউ না কেউ যাচ্ছিল, ওর বৌকে পর্যন্ত একদিন পরপর আসা-যাওয়ার ভাড়া দেওয়া হচ্ছিল।

রিকসাওয়ালা আমতা আমতা করে, ‘না মনে করেন লিজের বাড়ি এক কথা, আর ইটা হলো হাসপাতাল। ধরেন—।‘

‘হাসপাতাল ভালো লাগে না তা হাসপাতালে না নিয়ে এলে প্রাণটা বাঁচত?’ রিকশাওয়ালা আস্তে প্যাডেল ঘোরায়। একটা পায়ে বোধহয় জোর কম, বাঁ পাটাই বেশি তৎপর। ব্যাপারটা কী? কিন্তু এখন মামুনের সারা মাথা জুড়ে কেবল নইমুদ্দিন। তার অন্তর্ধানের কারণ ধরতে পেরেছে ৭ নম্বর বেডের পেশেন্ট। রাজমিস্ত্রির জোগানদার এই ছেলেটি তিনতলা একটা বাড়ির বাইরের দেওয়ালে চুনকাম করার সময় বাঁশের ভারা থেকে পড়ে হাত-পা ভেঙে ফেলেছে। নইমুদ্দিনের আচরণ সে ব্যাখ্যা করে প্রাঞ্জলভাবে, ‘বুঝলেন না? ট্যাকা পায়া শালার মাথা খারাপ হচ্ছে। আপনে ট্যাক্যা দিলেন, ট্যাকা লিয়া বাড়িতে গেছে, এখন তাই খরচ করিচ্ছে।’

দিন দুয়েক আগে মামুন একশোটা টাকা নইমুদ্দিনের হাতে দিয়ে এসেছিল। না দিয়ে করবে কী? সকালে ডাক্তার একবার রাউন্ড দিয়ে যায় আর নার্স এসে একটা স্লিপ রাখে বালিশের পাশে, ‘এটা বাইরে থেকে আনিয়ে নেবেন।’ এটা বলতে ঔষুধপত্র, ব্যাণ্ডেজ, তুলা, স্যালাইন–যে-কোনো কিছু হতে পারে। এমনকি শালার সরকারি হাসপাতালে ইঞ্জেকশনের সুঁচটা পর্যন্ত রোগীদের কিনে দিতে হয়। যে-তিনদিন অজ্ঞান হয়ে ছিল সেই কয়েকদিন নইমুদ্দিন কথা বলেনি, জ্ঞান ফেরার পর থেকে প্রথমে মিহিসুরে এবং পরে ক্রমে জোরে প্যানপ্যান করতে শুরু করে, ‘মামুন ভাই, দশটা ট্যাকা দিয়া যান, এই ওষুধ আনা লাগবি।’ ‘পাঁচটা ট্যাকা দ্যান, পরটা লিয়া অ্যাসা খামু, এটিকার ভাত মুখোত দেওয়া যায় না। মুখে যা তোলা যায় না পেটের ভেতর তাই চালান করে দিতে কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। তবু টাকা না দিয়ে উপায় কী? ওদিকে পার্টি থেকে বারবার বলা হচ্ছে, নইমুদ্দিন যেন হাতছাড়া না হয়। মালিকপক্ষের লোকজন নাকি ওর বৌকে পটাবার তালে আছে, ওকে দিয়ে পাল্টা ইউনিয়ন দাঁড় করাবে। বৌটাকে ঠিক রাখার দায়িত্ব পার্টির যে মহিলার ওপর অর্পিত তার কাজের কোনো লেখাজোকা নাই। একটা কিণ্ডারগার্টেন চালায়, গানের স্কুলের প্রধান, সেলাই শেখায়, আবার মহিলা সমিতির মিটিংগুলো ব্যবস্থা করতে হয় তাকেই। তার ওপর কতটা ভরসা করা যায়? সুতরাং ওসব বৌ-টৌয়ের পিছে বেশি না ঘুরে বরং সমস্ত মনোযোগ দাও স্বামীটার ওপর। শালার ঝামেলা কি কম? মামুন তো অষ্টপ্রহর হাসপাতালে বসে থাকতে পারে না। তাই একশোটা টাকা নইমুদ্দিনের হাতে দিয়ে বলল, ‘একটু সাবধানে রেখো। যখন যা লাগে খরচ করো।’—তা সেই টাকার সদ্ব্যবহার করার জন্যে কি তাকে হাসপাতাল ছাড়তে হলো? এই ধরণের দায়িত্বহীন কর্মী নিয়ে পার্টি কী করতে পারবে? ডাক্তার এতবার বলল যে তিনমাস বিশ্রাম না নিলে সম্পূর্ণ সুস্থ ও কোনোদিনই হতে পারবে না। সে জায়গায় পঁচিশদিনও তো হয়নি। হ্যাঁ, ঐ রকমই হবে। গতমাসের বারো কি তেরো তারিখে নইমুদ্দিনের কারখানায় ছাঁটাই হলো, মামুনদের পার্টি এর প্রতিবাদে স্ট্রাইক কল করল পনেরো তারিখে। এই ডাকে সাড়া দিয়ে মিছিলের সঙ্গে মিল-এলাকা থেকে বেরুবার সময় মালিকপক্ষের গুণ্ডার ডাঙার বাড়িতে নইমুদ্দিনের মাথা ফাটল। তাহলে পঁচিশদিন হলো না?—পার্টির কর্মীদের নিয়ে মামুন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। অবস্থা যা হয়েছিল, আর পনোরো মিনিট দেরি হলে গুণ্ডারা তাকে জ্যান্ত গুম করে ফেলতে পারত। মালিকপক্ষ এমনকি ওকে নিজেদের কব্‌জায় নিয়ে মামুনদের পার্টির নৃশংস আক্রমণের শিকার বলে খবরের কাগজে ওর ছবি পর্যন্ত ছাপিয়ে দিত। সরকারি উদ্যোগে নতুন শ্রমিক সংগঠন দাঁড় করানো হচ্ছে। কল করখানার মালিকদের কাছে সামরিক কর্তাব্যক্তিরা তাদের বেসামরিক কর্মচারীদের দিয়ে, কখনো-বা নিজেরাই নির্দেশ পাঠাচ্ছে। উ ৎপাদনমূখী রাজনীতি চালু করার জন্যে নবীন বঙ্গ শ্রমিক সঙ্ঘের বিকাশ ঘটানো চাই, নইলে কল-কারখানায় তালা লাগাবার ব্যবস্থা করা হবে। এ তো ইনকাম ট্যাক্স কমিশনারের চিঠি নয়, সুতরাং এই নির্দেশ পালনে মালিকদের আগ্রহের অভাব থাকবে কেন? নইমুদ্দিনের সঙ্গে আহত হয়েছিল আরো পাঁচজন। এদের দুজনকে ফার্স্ট-এইড দিয়ে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, আর বাকি তিনজনের একজন পালিয়ে গেছে, দুজনকে নিয়ে গেছে মালিকের লোক। তাদের পটিয়ে কর্তৃপক্ষ নিজেদের পক্ষের আধা-শহিদ বলে ঘোষণা করেছে। নইমুদ্দিনকে হাত করার চেষ্টা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

তবে সুবিধা করতে পারেনি। ওর ভার মামুনের ওপর। মামুনের ওপর পার্টির আস্থা প্রায় নিরঙ্কুশ। তা মামুন করেও তো যাচ্ছে। ভাগ্যটা ভালো, হাসপাতালের সিনিয়ার কনসালট্যান্টের সঙ্গে একটা কানেকশন বের করা গেল, মামুনের এক বন্ধুর ভগ্নীপতি। সেই বন্ধু আবার মামুনদের পার্টির সাপোর্টার ছিল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে যখন পড়ত মামুনদের পোস্টার-টোস্টার লিখে দিত, পাশ করে চাকরি পাবার পরও ওদের কালচারাল ফ্রন্টের গানবাজনার আসরে তার যাতায়াত ছিল। এখন সে চাকরি করে লিবিয়ায়, যোগাযোগ করলে ভগ্নীপতিকে চিঠিও লিখত। দরকার হয়নি। ডাক্তার সায়েব মামুনকে যথেষ্ট পাত্তা দিল। বড়ো ডাক্তার পাত্তা দেওয়ায় মেজো ডাক্তার, নার্স, ব্রাদার, ওয়ার্ড-বয় সবাই নইমুদ্দিনের দিকে একটু মনোযোগী হলো। নইলে ইহজীবনে ওর জ্ঞান ফিরত কী না সন্দেহ। তবে তিনমাসের পূর্ণ বিশ্রামটা একেবারে অপরিহার্য। মাথা তার এখনো টলে, বিছানায় ঘন্টাখানেক বসে থাকলে মাথা ঢুলতে শুরু করে, আর দেখো সেই রোগী কিনা রিকশা করে বাড়ি চলে যায় ঈদ করতে।

‘ডাক্তার সায়ের পারমিশন দিলেন কীভাবে?’—ডাক্তার সায়েবের ওপর মামুনের ক্ষোভ ঢেঁকে না। ওয়ার্ডের প্রায় সব রোগী কলরব করে ওঠে, ডাক্তার সায়েব ঢাকায় গেছে ঈদ করতে, কাল বেলা এগারোটার কোচে গেছে, কয়েকটা দিন ছুটি কাটিয়ে ফিরবে।

‘তার পরিবার ছোলপোল মোগলি তা ঢাকাত থাকে। তার বড়ো ব্যাটা ডাক্তারি পড়ে, বেটিও বলে ডাক্তারি পড়বি।’ ডাক্তার সায়েবের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ১১ নম্বর বেশ গর্বিত, ‘দুই বেটি, এক বেটা’ অন্যান্য ডাক্তার? তারা এই শহরেই আছে, তবে আজ হাসপাতালে আসবে না। মোয়াজ্জিন সাহেব প্লাস্টারের ভেতর হাত ঢুকিয়ে চুলকাবার চেষ্টা করে আর বলে, তারাও তো মানুষ! তাদের ঈদ নাই? তাদেরও তো আত্মীয়স্বজন আছে!’

আর নার্স? একজন নার্সকে মামুন অবশ্য দেখল, বারান্দায় হেঁটে যাচ্ছে, আরেকজন সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিল। তাহলে কি দু’জন নার্স হাসপাতাল চালাচ্ছে? -না তা কেন? মেথর এবং ওয়ার্ড-বয়ও আছে। মেথরের ওপর এই ওয়ার্ডের সবাই চটা। ঈদের দিন তো তোর কী?–সকাল থেকে ব্যাটা একবার উঁকিও দিয়ে যায়নি। ওয়ার্ড-বয়দের বিরুদ্ধেও রোগীরা খুব ঐক্যবদ্ধ। তরুণসুলভ উত্তেজনায় ৭ নম্বর ছটফট করে, ঈদের বকশিস লিবার জন্যে উগল্যান খালি নাফ পাড়িচ্ছে। পয়সা দিলেন তো কাম করবি, না হলে কুটি যায় যে থাকে তামাম দিন চিক্কুর পাড়লেও ছায়াটাও দেখবার পারবেন না।‘

মোয়াজ্জিন সায়েব এই ব্যাপারে তার সঙ্গে একমত। তার গলা চড়ে যায় আজান দেওয়ার উচ্চগ্রামে, ‘টাকা-পয়সা হাতে পড়লে ছোটোলোকের ঈমান ঠিক থাকে না। এই নইমুদ্দিনকে দেখেন না, আপনি টাকাটা দিলেন আর—।‘

এখন নইমুদ্দিনের টাকা খরচের হিসাব দিচ্ছে এই রিকশাওয়ালা, ‘কাল যায়া দেখি ব্যাটাক দিয়া আজভোগ চাল কিনিছে দুই সের, গোকুলের হাটোত গরু জবাই হছে, গোশত লিয়া আসিছে দ্যাড় সের। তারপর ধরেন লাচ্ছা, সেমাই, দুধ—।‘

তাহলে কী ভোজনের লোভে নইমুদ্দিন হাসপাতাল থেকে পালাল? কিন্তু হাসপাতালেও তো বিরিয়ানি দেওয়ার কথা। এ সম্বন্ধে ২ নম্বর ওয়ার্ডের রোগীরা অবশ্য একমত নয়। মোয়াজ্জিনের আশাবাদ নস্যাৎ করে দেয় ৭ নম্বর, ‘কীসের বিরিয়ানি? বিরিয়ানি পাক করলে বাস্না আসত না?’

১১ নম্বরের হতাশাই সবচেয়ে চূড়ান্ত, সে একরকম নিশ্চিত যে বিবিয়ানি হলেও গোশতো-টোশতো তাদের বরাতে জুটবে না, সেগুলো ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেবে হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সেরা। এর চেয়ে বরং যারা বাড়িতে গেছে তারাই সুখে আছে। বুঝলেন না? বছরগার একটা দিন, ভালোমন্দ দুইটা মুখোত পড়বি, ছোলপোলের সাথে বস্যা খাবি!’

কিন্তু বাড়ি গেলে সুস্বাদু খাবার জুটবে এ নিশ্চয়তা এরা পায় কোথায়? তবে নইমুদ্দিনের ব্যাপারে বলা যায় যে ঈদ উপলক্ষে বাড়িতে সে ভালোরকম ভোজের আয়োজন করেছে। সাক্ষী তার ফুফাতো ভাই এই রিকশাওয়ালা। জনাকীর্ণ থানা রোড ধরে ধীরগতিতে রিকশা চালায় আর ঘুমের ঘোরে কথা বলার মতো সে বিড়বিড় করে, শালার বাড়িত খালি ঘিয়ের বাসনা!’ মামাতো ভাইয়ের বাড়িতে ভালো খাওয়াদাওয়ার আয়োজন দেখে বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, এরকম ইতরামি মামুনের কাছে অরুচিকর, ও কী খাচ্ছে না খাচ্ছে তারই খোঁজ নিতে ওর বাড়ি গিয়েছিলে?’

ভিড়ের মধ্যে রিকশা ইচ্ছা করলেও তাড়াতাড়ি চালানো যায় না। রাস্তা জুড়ে রিকশা আর মানুষ। এইটুকু রাস্তায় দুটো সিনেমাহল, সিনেমাহলের সামনে ‘হাউস ফুল’ ঝোলে, দুই ‘হাউস ফুল’-এর মাঝখানে স্পেস জুড়ে টিকেট ব্ল্যাক হচ্ছে, ব্ল্যাক মার্কেটিয়ার একেকজনের পেছনে দশজন ক্রেতা। কে কোন সিনেমার টিকেট কিনছে বোধহয় ভালো করে বুঝতেও পারছে না। বোঝার তেমন ইচ্ছাও আছে বলে মনে হয় না। ঈদের দিন ছবি একটা দেখলেই হলো। আবার পথচারীদের ভেতর কম করে সিকিভাগ হলো ভিখারি। এমনি নিয়মিত ও যথার্থ ভিখারি তো আছেই, এ ছাড়া পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গ্রাম থেকে ভিখারি বা অভিখারি অনেকেই এসেছে। পবিত্র ঈদুল আজহায় কিন্তু ভিখারিদের ভিড় এতটা হয় না। তখনো গ্রাম থেকে ভিখারি আসে বটে, কিন্তু মাংস সংগ্রহের ব্যাপক অভিযানে এখানকার অনেক ভিখারি তখন চলে যায় ঢাকায়। ফলে একটা ব্যাল্যান্স হয়।

‘হামি ‘না ভাইজান’ বিকশাওয়ালা মামুনের অভিযোগ অস্বীকার করে, গেছিলাম ট্যাকা করজ করবার, বেশি লয়, পঞ্চাশটা ট্যাকা হলে হামার ঈদের খরচটা হয়া যায়। আপনারা তো পার্টি থ্যাকা অক পাঁচশো ট্যাকা দিলেন—‘

‘পাঁচশো টাকা কে বলল? একশোটা টাকা দেওয়া হয়েছে চিকিৎসার জন্যে, ঈদের দিন খাওয়া-দাওয়ার জন্যে নয়।’

‘অর ঘরোত যায়া দেখি হুলুস্থুল কাবরার!’ টাকার অঙ্ক সম্বন্ধে মামুনের সংশোধনী উক্তিকে রিকশাওয়ালা আমল দেয় না, মালিকের মানুষ মাথা ফাটায়া শালাক নবাব বানায়া দিছে। প্যাটেত ভাত জোটে না, সেই মানুষ বলে পোলোয়া কোর্মা খায়!’

ঝাউতলা রেলওয়ে ক্রসিং বন্ধ। রিকশা থামিয়ে রিকশাওয়ালা ডান পায়ের উরুর নিচে হাত বুলায়।

‘কয়দিন গাড়ি চালাবার পারি নাই। বাড়িত একদম বসা, পসাকড়ি নাই। মনে করনু লইমুদ্দি এতগুলো ট্যাকা পালো–।’

‘কাজ করোনি কেন?’

ঢাকা মেল চলে গেলে রেলওয়ে ক্রসিঙের গেট খুলে গেল, সেই সঙ্গে খোলে রিকশাওয়ালার মুখ। উরুতে নিচের দিকে বাঁদিক ঘেঁষে একটা ফোঁড়া হয়েছিল তার। মস্ত বড়ো ফোঁড়া, তার মুখ নাই, সেটা পাকেও না। ফোঁড়ার ব্যাথায় রিকশাওয়ালার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। ওর আরেক রিকশাওয়ালা বন্ধু কী-এক গাছ থেকে গোল-গোল পাতা এনে দিল, সেটা বেঁধে দেওয়া হলো, তোকমার পট্টি দেওয়া হলো, কিন্তু শালার ফোড়া দিন দিন কেবল বেড়েই চলে। ফোঁড়ার জন্যে লোকটা বেরুতে পারে না, রোজগারপাতি বন্ধ। তার বৌ এক ভদ্রলোকের বাসায় কাজ করে, বিবিসাহেবের হাতে-পায়ে ধরে কুড়িটা টাকা নিয়ে এলে রওশন ডাক্তারের কাছে গিয়ে ফোঁড়া কাটিয়ে নেওয়া হলো। সেও প্রায় তিন-চারদিনের ঘটনা, ব্যথা এখন পর্যন্ত সারেনি, দূষিত রক্ত বোধ হয় এখনো রয়েই গেছে। আজ রিকশা নিয়ে বেরিয়েছে বটে, এটা তার দ্বিতীয় ট্রিপ, কিন্তু প্যাডেল ঘোরাতে তার জান বেরিয়ে যাবার দশা।

মামুন এবার বুঝতে পারল যে উরুতে কষ্ট হচ্ছে বলে লোকটা এত আস্তে রিকশা চালায়, নিয়ম পালন বা দুর্ঘটনা এড়াবার তাগিদে নয়।

রিকশাওয়ালার ফোঁড়ার বিষ তার গলায় উঠে এসেছে, তেতো গলায় সে মামাতো ভাইয়ের উদ্দেশে সেই বিষ ঝাড়ে। আপন মামাতো ভাই, মাথা ফাটিয়ে এতগুলো টাকা কামাই করল, অথচ দেখো, তাকে একটা পয়সা ধার দিল না। উপরন্তু তাকে বলেছে যে সে আজরাইলের হাঁ থেকে ফিরে এসেছে, সে কি মাগনা মাগনি? উলটো টাকা চেয়ে বসেছে তার কাছেই।

‘আরে হামার বলে বৌ-ছোল-বিটি লিয়া মরার দশা, হামার কাছে তাই হাত পাতে, কন তো শালার বিবেচনাটা কেমন? আরে এই ফোঁড়াটা না হলে হামি অর বাড়িতে মুতবারও যাই না।’ নইমুদ্দিনের জন্য তাকে দণ্ডও তো কম দিতে হয়নি। মাথা ফাটিয়ে ব্যাটা হাসপাতালে গেল, তার বৌ-ছেলে-মেয়েকে নিজের রিকশায় চাপিয়ে এই রিকশাওয়ালা তাদের নিয়ে গেল হাসপাতালে, এতে ওর প্রায় আট টাকার ট্রিপ নষ্ট

‘এই ফোঁড়া হামার সাড়ে সর্বনাশ করা দিলো ভাইজান! না হলে – ‘

ঝাউতলা রোড পার হয়ে বড়োগোলার মোড়ে এসে লোকটা হঠাৎ করে নিজের লুঙি হাঁটুর ওপর ওঠায়। কিন্তু ফোঁড়া তার আরো ওপরে এবং উরুর নিচের দিকে। এইভাবে প্যাসেঞ্জারের সিটে বসে মামুনের পক্ষে সেটা দেখা বোধহয় বেশ কঠিন। এদিকে বড়োগোলার দিক থেকে একটা মিলিটারির জিপ আসছে, উরুর ফোঁড়া দেখার জন্য রিকশাওয়ালা এখানে বসে কসরৎ করতে থাকলে জিপটা রিকসার ওপর চড়ে যেতে পারে। মামুন বলে, ‘ঠিক আছে চলো, আমার বাসায় গিয়ে দেখব।’ ফোঁড়া দেখাতে না পেরে রিকশাওয়ালা বোধহয় আরো ধীরগতি হয়ে পড়ল। তার গেঞ্জির পেছনটা ঘামে ভিজে গেছে, মনে হচ্ছে ফোঁড়ার ব্যথা বোধ হয় পিঠ পর্যন্ত উঠে পিঠটাকে আরো নুইয়ে নুইয়ে দিচ্ছে। মামুন জিগ্যেস করে, তা টাকা পেলে?’

না। নইমুদ্দিনের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় দুঃখে রিকশাওয়ালা অনেকক্ষণ কথা বলে না। দত্তবাড়ির উল্টোদিকে বাঁদিকে কাটনারপাড়া ঢোকার রাস্তা। সেদিকে মোড় নিতে নিতে তার দুঃখ লাঘব করে এইভাবে, ‘ট্যাকা কি খালি উঁই দিবার পারে? আর মানুষ নাই, কন? অর কাছে না পায়া গেনু মাঝিড়া।’

শহরের ওপর দিয়ে বাসে করে সে গেছে মাঝিড়ায় তার ভায়রার বাড়ি। ভায়রার কাছে পঁচিশটা টাকা তার পাওনা, ভায়রা কয়েক কিস্তিতে ধার নিয়েছে, শেষবার নিল সাত টাকা,–সেও প্রায় মাস দেড়েক আগে। না-না, ভায়রার অবস্থা ভালো। বগুড়া-মহাস্থান রুটে টেম্পো চালায়, মালিককে দিয়ে-থুয়ে যা থাকে তাতে তার দুধে-ভাতে থাকার কথা। কিন্তু লোকটার বদভ্যাস একটাই, পকেটে দুটো পয়সা বেশি এলেই ঢুকে পড়ে বাংলা মদের দোকানে এবং সর্বস্বান্ত না হওয়া পর্যন্ত বোতলের পর বোতল সাবাড় করে। না হলে তার মতো লোককে কারো কাছে হাত পাততে হয়।

ভায়রা বাড়ি ছিল না। রিকশাওয়ালার শালি জানায় যে সকালবেলা উঠেই সে টাউনে গেছে, ওর টেম্পোর সিরিয়াল বেলা এগারোটায়। ঈদের আগের দিন, প্যাসেঞ্জার খুব বেশি পেলে শিবগঞ্জ পর্যন্ত ট্রিপ মারবে। আর রিকশাওয়ালার বাড়ি হয়েই তো যাবে। কেন? —আগের রাত্রে বৃষ্টির পর বাড়ির পেছনে বিলের ধারে গিয়ে টেম্পো-ড্রাইভার অনেকগুলো কৈ মাছ ধরেছে, কয়েকটা দেবে ভায়রাকে। কৈ মাছের কথা শুনে রিকশাওয়ালা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে।

মাঝারি আকারের ছটা কৈ, বাজারে কম করে হলেও দশটা টাকা তো নেবেই। বৌকে কৈ মাছ কুটতে দেখে রিকশাওয়ালা খুশি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটি কাঁটা বেঁধে। না, মাছের কাঁটা নয়, মাথাটা খচখচ করে। ভায়রা এই মাছ কটা নিয়ে পাওনা টাকাটা মেরে দেবে না তো? ওদিকে মাছ দেখে বৌয়েরও দুশ্চিন্তা। কেন?

‘না মাছ তো আপনি আলো, আল্লাই জোটাল, কিন্তু খাবি কী দিয়া? উটি দিয়া কি কৈ মাছ খাওয়া যায়?’

‘কেন, তোমরা ভাত খাও না?’ মামুন অবাক হলে রিকশাওয়ালা বলে, না ভাতই খাই। তো কয়দিন হামার উজি ওজগার বন্দ, হামার পরিবার যে বাসাত কাম করে সেটি থ্যাক্যা গম পাচ্ছিল। তাই —।’

‘বাসায় কি কাজের বিনিময়ে গম চালু হয়েছে নাকি?’

‘না ভাইজান, তাও লয়।’

তাহলে কী?—ঐ সায়েব ঈদ করতে চলে গেছে কুমিল্লা। বিবিসায়েবটা ভালোমানুষ, যাবার আগে ঠিকা ঝির হাতে ওর বেতনটা তুলে দিয়ে বলে গেছে, এবার তাদের গমটা যেন সে-ই তুলে নেয়।

‘মানে ওদের রেশনের গম?’

‘না, এশনের গমের মদ্যে বারো আনাই বালু, খাওয়া যায় না।’

‘তাহলে?’

বিবিসায়েবের ভাই মিলিটারির সায়েব। কী রকম সায়ের — মামুনের এই না কৌতূহল রিকশাওয়ালা মেটাতে পারে না। ক্যাপ্টেন, না মেজর, মেজর-জেনারেল—এসব সে জানে না। তবে বড়ো ধরনের সায়েবই হবে, কারণ লোকটা ক্যান্টনমেন্টে রেশন যা পায় তাতে তার মতো দশজন লোক খেয়ে কুলিয়ে বাকিটা উঠতে পারে না। খাওয়ার পর যা থাকে তার অর্ধেক ঢালে বোনের বাড়ি, বিক্রি করে। ধরেন মিলিটারির মানুষ, খোরাকটা বেশিই লাগে! আল্লা অগোর গাওত বল দিছে, আবার খোরাকও দিছে তার সাথে মিলায়া!’ ‘গায়ের বলের তুলনায় খোরাকটা বোধহয় একটু বেশিই পায়।‘

মামুনের এই বিদ্রূপটা রিকশাওয়ালা ধরতে পারে না। সে দুঃখ করে বলে যে বিবিসায়েবের প্ররোচনায় তার বৌ বেতনের পুরো পঁচিশ টাকা দিয়ে মিলিটারির গম কিনে নিয়েছে। মিলিটারির সায়েরা প্রায় বিনা পয়সায় গম-চিনি-তেল-চাল পায় বলে লোকজন তাদের হিংসা করে। কিন্তু রিকশাওয়ালা মামুনকে একটু ভেবে দেখতে অনুরোধ করে, অরা তিনগুণ চারগুণ এমনকি পাঁচগুণ লাভ করা গম বেচলেও ঐ গম বাজারত কিনব্যার গেলে কম করা হলেও পঁয়ত্রিশটা ট্যাকা লাগত!’

‘তাহলে তোমার বৌ অন্যায়টা করল কী?’

‘না, তার দোষ দেই না। কিন্তু ব্যাটা-বিটি হামার বায়না ধরিছে, ভাত খামো। হামাগোর বাঙালি জাতের এই এক দোষ। ঐ মিলিটারির সায়ের একদিন বেড়াবার অ্যাসা গপপো করিচ্ছিলো—।‘

‘তোমার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল?’

মামুনের এই প্রশ্নটিকে ভয়াবহ উদ্ভট বলে বিবেচনা করে রিকশাওয়ালা তার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। মামুনকে তবে পাগল ঠাওরায়নি, এর পরেও তাই তার প্রসঙ্গ পাল্টায় না। — মিলিটারির সায়ের গিয়েছিল তার বোনের বাড়িতে, সেখানে হতাশা ব্যক্ত করেছে এই বলে যে বাঙালির খাবার অভ্যাস বদলাতে না পারলে কোনো আশা নাই। হাজার ঢালো, বাঙালির খিদে মেটানো অসম্ভব। কারণ একটাই, এই জাত খালি ভাত খাবে আর ভাত খাবে।

‘চাল কিনেছ?’ মামুনের পক্ষে ধৈর্য রাখা শক্ত হয়ে পড়ছে। রিকশাওয়ালা সরাসরি জবাব দেয় না। বলে, ‘আসরের নামাজের আজান পড়লে গেনু হামার মহাজনের বাড়িতে। মহাজন সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ পরিচিতি দেয়, তারপর জানায় যে সে সরাসরি উপুড় হয়ে পড়েছে তার পায়ে। এতে তার ফোঁড়া থেকে একটু পুঁজ বেরিয়ে লুঙিতে লাগে। ঐ লুঙিটাই তার ভালো, রাত্রে এসে ধুয়েও দিয়েছিল, কিন্তু শুকায়নি বলে ঈদের দিন তাকে ছেঁড়া লুঙি পরে থাকতে হচ্ছে, এমনকি নামাজও পড়া হলো না, এই ছেঁড়া লুঙি পরে নামাজ পড়লে নামাজ কবুল হবে কিনা সেই ব্যাপারে সে খুবই সন্দিহান।

‘টাকা পেলে?’

হ্যাঁ, মহাজন তাকে তিরিশ টাকা দিয়েছে, মহাজনের রিকশা চালিয়ে প্রত্যেকদিন ভাড়ার ওপর পাঁচ টাকা করে দেবে, এইভাবে আটদিন দিলেই টাকা শোধ, সব ল্যাটা শেষ।

‘তাহলে তো চল্লিশ টাকা নেবে।‘

‘দশটা ট্যাকা লাভ তো লিবিই! তাই তো দিল, লইমুদ্দি হামার আপন মামাতো ভাই, আপনারা পাট্টি থ্যাকা তাক লগদ পাঁচশো ট্যাকা দিলেন–।’

‘পাঁচশো না, একশো। চিকিৎসার জন্যে দেওয়া হয়েছে। আমাদের কি দালাল পার্টি পেয়েছ নাকি যে শ্রমিকদের ঘুষ দেব?’

মামুনের এই ধমকে লোকটা মিইয়ে যায়। মামুন বলে, ‘টাকা দিয়ে চাল কিনেছ?’

‘জে।’ বলে রিকশাওয়ালা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তবে চুপ করে করে থাকা তার স্বভাবে নাই। কিংবা এমন হতে পারে যে তার ফোঁড়ার ব্যাথার প্রকোপ কমাবার জন্য তাকে কথা বলতেই হয়। কিংবা অন্য কারণও থাকতে পারে। একটু পর সে বলে, দুইসের চাল কিনলাম বারো ট্যাকা দিয়া। একসের সেমাই নয় ট্যাকা। একপোয়া চিনি পাঁচ ট্যাকা, তেল-মশলা তিন ট্যাকার।’

মামুন হিসাব করে বলল, ‘আর এক টাকা?’

‘ব্যাটার হাতোত দিলাম। ঈদের দিন ফকির ফাকরাক ভিক্ষা দেওয়া লাগে না? কন তো?’

‘সেমাই কিনলে কেন?’ মামুন ওর অপচয়ে বিরক্ত, ‘সেমাইয়ের টাকায় তোমার দেড়সের চাল হতো।’

‘তা ধরেন ঈদের দিন, বছরকার একটা দিন। ব্যাটা হামার হাউস করছে, তার আবার লাচ্ছা খাবার শখ। ধরেন সাতমাথা থ্যাকা ওদিকে বড়োগোলার মাথা—তামাম ঘাটাত খালি লাচ্ছা ভাজার ঘেরান। গরিব মানষের ব্যাটা হলে কী হয়, ব্যাটার হামার লজরখানা বড়ো!’ নয় বছরের ছেলের বড়ো নজরের দৃষ্টান্ত দিতে দিতে রিকশাওয়ালা সোজা হয়ে বসে।

‘লাচ্ছাই কিনলে?’

‘না ভাইজান। লাচ্ছার সের পঞ্চাশ-ষাট টাকা। এমনি সেমাই কিনল্যাম।‘

‘আজ কি সেমাই খেয়ে বেরিয়েছ?’

‘না, সেমাই পাক করছে কাল আত্রে।

‘ঈদ করতে তুমি সেমাই কিনলে আর সেই সেমাই খেয়ে ফেললে ঈদের আগের রাত্রে?’

‘কী করি, কন? আটার উটি খাতে খাতে ব্যাটা-বিটি-পরিবার–সোগলির জিভাত বাত ধরিছে, জিভা বলে বলে খালি শুলায়! ঐ মিলিটারির সায়ের কয়, বাঙালি যদি ভাত খাবার অভ্যাস–

আবার মিলিটারি! নিরস্ত্র মানুষের মধ্যে মিলিটারির হামলা ঠেকাবার জন্য মামুন তাকে থামিয়ে দেয়, ঈদের আগের রাত্রে সব সেমাই খেয়ে ফেললে কেন?’

‘না, আল্লা রেজেকে থোয় নাই, সেমাই আর খাওয়া হলো না।’

‘মানে? খাওনি?’

এখন বাঁয়ে করোনেশন স্কুল। স্কুলের লাল দালানের পেছনে মামুনদের বাড়ি। নাঃ! বড্ডো দেরি হয়ে গেল! দলের কেন্দ্রীয় নেতা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে। ঈদের দিন এরকম একজন অতিথিকে বসিয়ে রাখাটা কেমন দেখায়?

হামিদ ভাই কালকেই চলে যাবে দিনাজপুর, তারপর পার্বতীপুর হয়ে রংপুর, রংপুর থেকে ট্রেনে ফিরবে ঢাকা। মাসখানেকের মধ্যে দেখা হবে না। অথচ এখানকার সমস্যা নিয়ে অনেক কথাবার্তা বলা দরকার। দুটো কারখানায় ওদের পার্টি খুব সফল হরতাল করল। সিগ্রেট ফ্যাক্টরিতে মালিকপক্ষের গুণ্ডাদের আক্রমণ সত্ত্বেও ওদের প্রভাব কমেনি। কটন মিলের শ্রমিকদের বেশির ভাগ ওদের হাতে ছিল, পাকিস্তান-আমল থেকেই ওদের হাতে। মিলিটারির লোকজন খুব হাম্বিতাম্বি করছে, নবীন বঙ্গ শ্রমিক সংঘ প্রতিষ্ঠা করা চাই। কটন মিলের মালিক ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়েছে পঞ্চাশ লাখ টাকার ওপর, মিলিটারির দাপটে তারা একটু বেসামাল। নবীন বঙ্গের গুণ্ডাপাণ্ডাদের কারখানার আশেপাশে টিনের ঘর তুলে দিয়েছে, তারা প্রত্যেক দিন একবার করে হামলা চালায়। বাস টারমিনালে ঐ গুণ্ডারা ছুরি দেখিয়ে চাঁদা আদায় করছে, ক্যান্টনমেন্ট থেকে নাকি আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, বড়ো ধরনের সংঘর্ষ বাধলে সেগুলো এসে পড়বে। তখন মানুষেরা ওদের ঠেকাবে কীভাবে?–এত সব সমস্যা, হামিদ ভাইয়ের পরামর্শ খুব দরকার। রিকশাটা খুব স্লো। পায়ের চেয়ে রিকশাওয়ালার মুখ অনেক বেশি সচল। এখন সে ব্যাখ্যা করছে সেমাই না খাওয়ার কারণ, সেমাই পাক করার আগে ভালো করা ভাজা লাগে, তাই লয়? তাই লয় ভাইজান?’

এ-সম্বন্ধে মামুনের ধারণা স্পষ্ট নয়। সুতরাং সে জবাব দেয় না। তাতে রিকশাওয়ালার কিছু আসে যায় না। সে বলেই চলে, তার বৌ করেছে কি হাঁড়িতে পানি, চিনি, তেল ও মশলা দিয়ে তার ভেতর সেমাই ঢেলে খুন্তি দিয়ে খুব করে নেড়েছে। ফলে সব সেমাই পরিণত হয়েছে আটার দলায়।

‘আহা! মামুন সত্যি সত্যি দুঃখিত হলো, ‘বৌকে মারধোর করনি তো?’

না। খালি মাথায় একটা ঠোনা মারিছি। চিনি গেল, তেল গেল, মশলা গেল। বৌয়েক কলাম, তুই খা, আত্রে তোর এটাই খাওয়া লাগবি। উই একলাই ঐ আটার দলা খালো।

‘আর তোমরা?’

‘হামার পরিবার আটা লিয়া বসল উটি বানাবি, তা ব্যাটা হামার জেদ ধরল, না উটি খাবি না, ভাত রান্দা লাগবি। তা কী করা যায়, হামিও কলাম, ভাতই পাক করো। আত্রে কৈ মাছ দিয়া ভাত খাওয়া হলো।‘

‘আর আজ? ঈদের দিন খাবে কী?’ মামুন থ হয়ে যায়। লোকটা কী পাগল নাকি? ধারকর্জ করে জোগাড় করা ঈদ উদযাপনের সমস্ত উপাদান সে শেষ করে ফেলল ঈদের আগের রাত্রে!

‘সোগলি মিল্যা কৈ মাছ দিয়া আত্ৰে ভাত খাওয়া হলো।’ কৈ মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ার কথা বারবার বলে সে জিভে কৈ মাছের স্বাদ অনুভব করে, ‘ভাত রান্দিছিল দেড়সের চাউলের, বৌ তো খালো না, কড়কড়া ভাত এ্যানা আছিল, মাছের সুরুয়া দিয়া খায়া হামি গাড়ি লিয়া বারালাম।’

‘বৌকে ভাত খেতে দিলে না?’

‘একসের সেমাইয়ের দলা খালো, আবার ভাত খাবি কি?’

স্ত্রীর সঙ্গে রিকশাওলার এই ব্যবহার মামুন অনুমোদন করে না, ওরা বাপ-ছেলেমেয়ে কৈ মাছ দিয়ে ভাত খেল আর বৌকে খেতে হলো আটার দলা, এসব কী? কিন্তু রিকশাওয়ালা স্ত্রীকে শাসন করার ব্যাপারে খুব কড়া, ‘বুঝলেন ভাইজান, শাস্ত্রে কয়, গোরু আর জরু,–জগতের এই দুইটা জীব লাঠির ডাং না খালে ঠিক থাকে না।’ মামুন তবু তার সঙ্গে একমত না হলে সে জানায় যে কৈ মাছ তো তিনটে আছেই, চালও আছে আধসের। বৌকে সে নির্দেশ দিয়ে এসেছে, ভাত রেঁধে ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঐ মাছ কটা দিয়ে খেয়ে নেবে।

এবার মামুন বলে, ‘তোমার ছেলেকে একটা টাকা দিয়ে এসছ না? ঐ টাকা দিয়ে কিছু কিনে খেতে বলতেই তো পারতে!

‘কোন্ ট্যাকা?’

‘ঐ যে বললে ফকিরকে ভিক্ষা দেওয়ার জন্যে দিয়ে এসেছ?’

‘ঐ ট্যাকাত হাত দিবি কিসক? নিয়ত যখন করিছি তখন ভিক্ষাই দেওয়া লাগবি!’

‘তোমরা খেতে পাও না, এদিকে ফুটানিটা আছে ষোলোআনা!’ মামুন রাগ করে, ‘খাবার জন্যে টাকা ধার করো, আবার ভিক্ষা দাও। ভিক্ষা করে ভিক্ষা দাও, লজ্জা করে না?’

মামুনদের গলিতে ঢোকার পর রিকশার গতি আরো কমে, প্রায় ডেড-স্লো বলা যায়। রাস্তা সংস্কারের কাজ চলিতেছে’ বলে এই বর্ষাকালে রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে, একপাশের অনেকটা জুড়ে লাল মাটির কাদা। এর মধ্যে রিকশা চালানো মুশকিল। আবার রিকশাওয়ালার উরুর ফোঁড়াও হয়তো টনটন করছে, তার মন্থরতর গতির এটাও একটা কারণ হতে পারে।

মামুনের ধমক খেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর রিকশাওয়ালা কৈফিয়ৎ দেয়, ‘এই ফোঁড়াটা না হলে ইগল্যান ঝামেলা হয়? আপনে কোদ্দ করেন আর আগ করেন, হামি কই এই ফোঁড়া না হলে হামি আজ পোলোয়া কোর্মা না হলেও খিচড়ি আর গোরুর গোশতো ব্যাটা-বিটির মুখোত ঠিকই তুল্যা দিতাম। এই শালার চুতমারানি ফোঁড়া, শালার ফোঁড়ার হামি গোয়া মারি।’

মামুনদের বাড়ি এসে পড়েছে। বাড়ির সামনে পার্টি কর্মীদের দেখে বোঝা যাচ্ছে যে কেন্দ্রীয় নেতা এসে পড়েছে। হয় এক্ষুণি এল, না হয় বেরিয়ে যাবার উদ্যোগ করছে। রিকশাওয়ালা বলে, ‘দ্যাখেন না, শালার কত বড়ো ফোঁড়া! এখন পুঁজ সব বার হয়া যায় নাই। পুঁজগুলা বার করা দিবার পারলে আরাম হয়!’ রিকশা থামিয়ে ডান পা তুলে সে লুঙির অনেকটা ওপরে ওঠায়। কিন্তু ফোঁড়াটা দেখা মামুনের পক্ষে বেশ কঠিন, অন্তত প্যাসেঞ্জারের আসনে বসে ওটা দেখা একেবারেই অসম্ভব।

‘দেখবার পারিচ্ছেন না?’

মামুনের জবাব শোনার আগেই রিকশাওয়ালা তার নিজের আসনে বসে পা উলটিয়ে ফোঁড়া দেখাবার চেষ্টা করে।

আহা, থাক না! দাঁড়াও, আমি আগে রিকশা থেকে নামি। কিন্তু ওখানে নামা সম্ভব নয়। নামলেই পা পড়বে লাল মাটির কাদায়। পাজামা তো যাবেই, আঠালো কাদা থেকে পা তুলতেও বারোটা বাজবে। রিকশা আরেকটু সামনে বাড়ালে একেবারে ওদের বাড়ির গেটে নামা যায়।

মামুনের নির্দেশকে তোয়াক্কা না করে রিকশাওয়ালা তার ডান পা উল্টিয়ে ফোঁড়া দেখাবার তৎপরতায় লিপ্ত হলো। না! মামুনের এবার নেমে পড়াই ভালো। নইলে সম্পূর্ণ পুঁজমুক্ত না-হওয়া এবং ব্যাথায় টনটন করা ফোঁড়া দেখাতে এবং ব্যাথায় টনটন করা ফোঁড়া দেখাতে গিয়ে রিকশাওয়ালা সিট থেকে পড়ে যেতে পারে।

উরুর ফোঁড়া দেখাবার জন্যে মরিয়া হয়ে রিকশাওয়ালা তার সংশ্লিষ্ট ঠ্যাংটিকে সম্পূর্ণ ঘোরাবার উদ্যোগ নিলে মামুনের অনুমান যথার্থ প্রমাণিত হয়। রিকশাওয়ালা একরকম চিৎ হয়ে রাস্তায় পড়ে গেল। রিকশাটা একটুখানি দুলে উঠতেই মামুন লাফিয়ে পড়ল। কাদায় পতন থেকে বাঁচার জন্যে সে ছোট্টো কিন্তু নিপুণ একটি লং-জাম্প দিলে তার ডান পায়ের স্যান্ডেলশুদ্ধ পাটা পড়ল রিকশাওয়ালার বাঁ হাতের কবজির ওপর।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সামলে উঠে মামুন শুকনো জায়গায় দাঁড়িয়ে রিকশাওয়ালাকে উঠে বসতে সাহায্য করে। ওর লুঙির ওপর দিকটা রক্তাক্ত, আবার গেরো খুলে যাওয়ায় কিছু পয়সা ছিটকে পড়েছে কাদার ওপর এবং লুঙি খানিকটা নেমে পড়ায় লোকটার নিমাঙ্গের বেশির ভাগই এখন অনাবৃত। সেদিকে আমল না দিয়ে রিকশাওয়ালা মিনতি করে, ‘ভাইজান, ফোঁড়াটা দ্যাখেন, এই-যে দ্যাখেন! অক্ত বারাচ্ছে গো! পুঁজগুলা সব বার করবার পারলে শালাক আটো করবার পারি। দ্যাখেন না!’

কিন্তু তার আহবানে সাড়া দিতে গেলে মামুনের চোখে পড়ে রিকশাওলার নুনু ও বিচি। ফোঁড়ার ব্যাথায় লোকটা কি পাগল হয়ে গেল? ‘আরে মিয়া কাপড় ঠিক করো!’ বলে তার দিকে পাঁচ টাকার একটা আস্ত নোট ছুঁড়ে মামুন বাড়ির দিকে পা ফেলে।

বাড়ির ভেতর ঢুকে গেট বন্ধ করার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়ে মামুন দেখে যে লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে রিকশাওয়ালা পা মেলে বসে পড়েছে কাদার ওপর। কাপড় সামলাবার দিকে তার খেয়াল নাই। দুই হাতে ফোঁড়ার চারদিকে টিপে টিপে পুঁজ বার করার কাজে রিকশাওয়ালা মহা ব্যস্ত।

রচনাকাল : ১৯৮০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *