প্রেমের গপ্পো

প্রেমের গপ্পো

‘মাগো! তুমি এত মজা করে কথা বলতে পারো! তারপর? মেয়েটা তোমাকে কি বলল?’ বুলার হাসি আর থামে না, স্বামীর প্রাক্-বিবাহ প্রেমের গল্প শোনে আর হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে, খিলখিল এবং থিকথিক আওয়াজ বন্ধ হবার পরেও গোলগাল ফর্সা মুখের এ-কোণে ও-কোণে হাসির কুচি চিকচিক করে। উৎসাহে জাহাঙ্গীরের ঠোঁট উপচে পড়ে, আমাকে বলে পুরুষ মানুষ, তার বড়ি হবে পুরুষ মানুষের মতো। হেঁটে গেলে মাটি কাঁপবে।’

‘ধ্যাৎ’ বুলা ফের হাসে, ‘মেয়েরা এভাবে কথা বলে নাকি?

‘বললাম না, অন্য কিসিমের মাল।’ বলেই জাহাঙ্গীর তার ভাষা ঠিক করে, ‘অন্য ধরনের মেয়ে। বুঝলে না? সব সময় খেলাধূলা নিয়ে থাকে। আমার সঙ্গে আলাপ হয় স্টেডিয়ামে। আমি তখন ডিসকাস থ্রো প্র্যাকটিস করতে যাই, তো একদিন শাহীন বলল–‘

‘শাহিন কে? পরশু না নাম বললে শাহনাজ!’

‘ঐ তো ভালো নাম শাহনাজ। ডাকনাম শাহীন।’ জাহাঙ্গীর একটু থেমে বলে, ‘মানুষের দুটো নাম থাকে না? তোমার নাম।’

‘বুঝেছি। শাহীন না শাহনাজ কী বলল?’

‘আমার থ্রো দেখে বলে, আপনার হাতের মুভমেন্ট খুব ম্যাজেস্টিক, আবার খুব ফাস্ট।

–ওর বড়োভাই ভালো জিমন্যাস্ট ছিল, আমাকে একদিন বলে, ‘আপনি যদি শাহীনকে একটু দেখিয়ে দিতেন তো ভালো হয়। এবার মেয়েদের মধ্যে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ান না হলে পাগল হয়ে যাবে।’

‘তারপর?’

‘গাড়ি করে ওদের বাড়ি নিয়ে গেল। গুলশানের বাড়ি। বিরাট বাড়ি, সামনে লন, পেছনে মাঠ। মনে হয় হাফ স্টেডিয়াম। বাড়িতে টেনিস থেকে শুরু করে ক্রিকেট বলো, বাস্কেট বল বলো : সব কিছুর ফুল অ্যারেঞ্জমেন্ট। সুইমিং পুল পর্যন্ত আছে। একটা সাইডে শটপুট প্র্যাকটিসের জায়গা করা হলো, আমি সপ্তাহে চারদিন যাই আর কায়দা টায়দাগুলি দেখাই।

‘তাম ছাড়া আর যেত।’

‘বিকেল হইল আর লাইন দিল মনে হয় কসকরের দুধ ছাড়তাছে।’

বুলা ফের হাসে, ‘আবার ঢাকাইয়া ল্যাঙ্গুয়েজ।

কিন্তু জাহাঙ্গীরের তখন ফ্লো এসে গেছে। ‘এক্কেরে লাইন। বনানী, গুলশান, ধানমন্ডির বড়লোকের বাচ্চাগুলি গাড়ি হাঁকাইয়া আসত। ইস্কাটন থাইকাও মনে হয় একজন আসত।’

‘তোমাদের শাহীন বোধহয় সবাইকে নাচাত?’ বুলার কথায় একটু ঈর্ষার খোঁচা থাকায় জাহাঙ্গীর আরো চাঙ্গা হয়, ‘আরে সেইগুলির একেকজনের শালা একেকরকম নকশা।’ জাহাঙ্গীর এবার অঙ্গভঙ্গি করে শাহীন বা শাহনাজের প্রেমপার্থীদের চেহারা ও হাঁটবার বৈশিষ্ট্য দেখায়, ‘একটা আসত, চিকনা, হাঁটতে গেলে হাড্ডিগুলো বাজে, চশমার আড়াল থাইকা কুকুতাইয়া চায়। শুনি সেইটা নাকি ইউনিভার্সিটিতে পড়াইত, এইবার পরীক্ষা দিয়া ফরেন সার্ভিস পাইছে। আমি কই, এইটা ফরেন সার্ভিস পাইয়া ভালো হইছে। ক্যান?–ফরেনাররা অ্যারে দেখলেই লগে এইড পাঠাইয়া দিবো। —আরেকটা হোঁৎকা মোটা, সোজা হইয়া হাঁটতে পারে না। টেনিস র‍্যাকেট দুলাইতে দুলাইতে আসত, শুনি সেটা নাকি কোনো সেক্রেটারি না জয়েন্ট সেক্রেটারির পোলা।–তা যত বড়ো মানুষ আসুক, আমার কি? …আমি এসবের মধ্যে নাই। আমার ডিউটি আমি করি, শটপুট দেখাইয়া দেই। ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ান করা চাই।’

‘হয়েছিল? সেবার ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল?’

‘ক্যামনে হয়? আমিই তো কাইটা পড়লাম।’

‘আবার তোমার ঢাকাইয়া শুরু হলো?’ বুলার এই আঠালো ধমকে জাহাঙ্গীর এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলে বুলা নিজেই অপ্রস্তুত হয়, ‘হ্যাঁ কেটে পড়লে কেন!’

এর আগেও একবার-বলা গল্পটার উপসংহার টানে জাহাঙ্গীর, মাঝে মাঝে গ্যাপ গেলেই স্টেডিয়ামে লোক পাঠায়। সেবার আগা খানা টুর্নামেন্ট নিয়ে আমি খুব ব্যস্ত, কয়েকদিন যেতে পারিনি। তো যেদিন গেলাম, ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করছি, এসে আমাকে দেখে আর কথা বলে না। কথাই বলে না। আমি বলি, চলেন প্র্যাকটিস আরম্ভ করি। হঠাৎ আমার পাশে এসে দাঁড়াল। জিগ্যেস করে, আচ্ছা সত্যি তো আপনাকে কেউ কিছু বলেছে?–আমাকে? না আপনি প্রায়ই আসেন না কেন? আপনাকে কি কেউ তো অবাক! আমাকে কী বলবে! আমার সঙ্গে লাগতে আসবে কে?’ বলতে বলতে জাহাঙ্গীর নিজের হাতের মাসল ফুলিয়ে দেখায়। বুলা গদগদ গলায় বলে, ‘তারপর?’

‘আমি বললাম, না—আমাকে কে কী বলবে? –তা শাহীন বলে, না আপনি জানেন না, এরা আপনাকে হিংসা করে। –আমাকে? কেন?–বোঝেন না? এই রাতদিন বকবক করা ছাড়া ওদের আছে কী? খালি প্যাঁচাল, খালি প্যাঁচাল। বড়ো-বড়ো কথা, খালি বড়ো বড়ো কথা। নিজেদের সব ইন্টারন্যাশনাল ফিগার মনে করে। আমিও বলে দিচ্ছি এখানে লাস্টিং করবেন শুধু আপনি, আর সব আউট হয়ে যাবে। —মানে? লাস্টিং করব মানে?–বোঝেন না? দুর, আপনি না এক্কেবারে একটা ইসে।’

‘ইসে কী? ইয়ে বলো।’ বুলার এই ভাষাশুদ্ধির প্রচেষ্টা জাহাঙ্গীরের বাক্যপ্রবাহে এতটুকু বিঘ্নের সৃষ্টি করতে পারে না, শাহীন বা শাহনাজ নামে মেয়েটির উক্তিকে সে বুলার কাছে প্রতিষ্ঠিত করে ছাড়বে, ‘ঠিক বলেনি? বুলা, ঠিক বলেনি? খালি চালবাজি করলে পুরুষমানুষ হইতে পারে।’

‘আচ্ছা মেয়েটা ঐভাবেই বলল?’

‘আরে বড়োলোকের মেয়ে, ওদের কথাবার্তা অন্যরকম।’

‘তুমি কী করলে?’ বুলা জানতে চায়, তবে জানা-জবাব শোনবার আগেই হাসতে শুরু করে।

‘আমি তো ঘাবড়াইয়া গেছি। বললাম, মাথাটা ধরছে, যাই। বলে, যাবেন মানে? ওষুধ দিচ্ছি, মাথা টিপে দিই। আমি কি আর থাকি? শাহীন ডাকে, দাঁড়ান, ড্রাইভারকে বলি, গাড়ি করে দিয়ে আসুক।— গাড়িগুড়ির গুলি মারি, স্লামালেকুম — খোদা হাফেজ কইয়া করাইয়া একবারে ছয়নম্বর বাস ধরছি, জিন্দেগিতে আর বনানী যাই নাই।’

হাসতে হাসতে বুলা হাঁপায়। জাহাঙ্গীর তেলতেলে চোখ করে বৌকে দেখে। বুলাটা একেবারেই ছেলেমানুষ। অথচ এত বড়ো মেয়ে, কলেজে পড়ছে আজ তিন বছর, ছাত্রীও ভালো, এসএসসি, এইচএসসি দুটোতেই সেকেন্ড ডিভিশন। ওদের কলেজে নাকি চোথাও চলে না। অথচ দেখো কী রকম সাদাসিধা মেয়ে, যা বলা যায় তাই গোগ্রাসে গেলে। স্বামীকে বিশ্বাস করার জন্য একেবারে উদগ্রীব হয়ে আছে, শুধু কথা বলার অপেক্ষা। বিশ-বাইশদিন হলো বিয়ে হয়েছে, অথচ মনে হয় একে ছাড়া এতদিন ছিল কী করে? হাসি এবং আঁচল সামলে বুলা জিগ্যেস করে, ‘তুমি চলে এলে, তোমার মোটর সাইকেল?’

জবাব দিতে জাহাঙ্গীরের একমিনিটও দেরি হয় না, সেদিন বললাম না মাথা ধরেছিল। মোটর সাইকেল রেখে গিয়েছিলাম।’

‘তা তুমি ওরকম পালিয়ে এলে কেন? গুলশানের বাড়ি, গাড়ি সবই পেতে। এত বড়লোকের মেয়ে।’

আল্লায় বাঁচাইছে, নিজের নাক ও কানে আঙুল ছুঁয়ে জাহাঙ্গীর তওবা করার ভঙ্গি করে, ‘বড়লোকের মাইয়া বিয়া কইরা তারে কৈ রাখুম, কী খাওয়ামু! গাড়ি-বাড়ির আমার দরকার নাই বাবা।’ তার শেষ বাক্যটি সে আবার সঙ্গে-সঙ্গে সংশোধন করে, ‘গাড়ি-বাড়ি আমি নিজে করতে পারি না? হবে না? ম্যানেজিং ডিরেক্টর এই তো পরশু কইল, জাহাঙ্গীর, অর্ডার তো ভালোই আনতাছ। গুড। ভালো করে দুইদিন পর পাখনা গজালেই অন্য ফার্মে যাবার তাল উঠবে। এখানেই কাজ করো, ফার্মটারে তোলো, তোমরাও উঠতে পারবা। এখানে সিনসিয়ারলি কাজ করলে তোমার গাড়ি-বাড়ি সবই হবে। বেশিদিন লাগে না, বুঝলা, আমাদের ইসেকে দেখলাম—।

এই হলো তার স্বামীর আরেকটা দোষ। কথা বলতে-বলতে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে এল তো মূল বিষয় তার মাথায় উঠল! এখন কোথায় গিয়ে যে থামবে! বুলা তাই স্বামীর মনোযোগ ঠিক করার জন্যে তাড়াতাড়ি বলে, ‘তা মেয়েটার সঙ্গে তোমার আর দেখা হয়নি?’

‘পাগল! আমি আর ওদিকে যাই?’

‘ও, এই মেয়ে তাহলে সেই পুলিশের মতো ধাওয়া করেনি, না?’

‘পুলিশ? পুলিশ আমারে কী করবে?’ জাহাঙ্গীরের আত্মসম্মানবোধ আহত হয়, ‘আরে পুলিশ আমারে বাপ ডাকছে, বুঝলা? কলেজের অ্যাথলেটিক সেক্রেটারি আছিলাম, কলেজ তো কলেজ, কলেজের চারপাশে যতটি মহল্লা আছে এর কোনো জায়গায় কোনো গ্যানজাম হইলে ওসি নিজে আসছে। কী ব্যাপার ওসি সাব?— জাহাঙ্গীর ভাই, কেসটা ট্যাকল করেন! — আবার আমার কলেজের একটা হোস্টেলের লগে সিনেমা হল আছে, পোলাপানে দুই-একদিন শয়তানি কইরা মাগনা বই দেখতে চায়। ওসি আবার আসছে।—এইবার কী?—না জাহাঙ্গীর ভাই, আপনার পোলাপানেরে সামলান। আমি উল্‌টা ধামকি দিছি, আরে রাখেন। সিনেমার মালিক মালপানি বহুত কামাইছে, আমার পোলাপান মাগনা দুইটা শো দেখব তো এত হাউকাউ কীসের?–শুইনা পুলিশে কথা কয় নাই। শোনো, পুলিশের কথাই যখন তুললা তো কই।

‘আরে না, না! বুলা অধৈর্য হয়ে বলে, তোমার পুলিশের ভয়ের কথা কে বলল? ঐ যে এক মহিলা-পুলিশ তোমার প্রেমে পড়েছিল, ঐ যে সেদিন বললে না?’

‘ও! ‘এতক্ষণে জাহাঙ্গীর থিতু হলো, তুমি হিপ হিপ হুররের কথা কও?’

‘কী নাম বললে?’ বুলা হাসে, ‘হিপ হিপ হুররে? মেয়েছেলের নাম?’

‘আরে নাম না, টাইটেল, উপাধি!’

‘ও মা!’ বুলা অবাক হয়, ‘পুলিশের নাম দিয়েছিল হিপ হিপ হুররে?’

‘পুলিশ তো হইল অনেক পরে। কলেজে আমাদের সঙ্গে পড়ত। তখনি ওর হিপ দুইটা, মানে পাছা ছিল খুব প্রমিনেন্ট, তাই দেইখা ছেলেরা টাইটেল দিল হিপ হিপ হুররে।

‘ম্যাগো! তোমরা কী অসভ্য ছিলে? ক্লাসমেটের এই নাম দিতে? এই ধিক্কার দিলেও বুলার ফের হাসির একটা দমক আসে, কোনোরকমে নিশ্বাস টেনে নিতে নিতে বলে, ‘তোমরা সব ভারি অসভ্যতা করতে, না?’

‘কেন, তোমাদের কলেজের ছেলেরা তোমাদের নিউ ইয়ারের টাইটেল দেয় না? ঐগুলো মনে হয় ম্যাদামার্কা মতো না?’ বলে জাহাঙ্গীর নিজেই তার বিবৃতি সংশোধন করে, ও হো! তোমার তো উইমেন্স কলেজ, পর্দা-টাঙানো হারেম শরীফ। তোমাদেরটা আবার ডবল প্রোটেকটেড জোন! উঁচু দেওয়াল।’

‘আব্বা আবার কো-এডুকেশন পছন্দ করে না।‘

‘তোমার বাবা একেবারে উডেন মোল্লা।’

‘মানে?’

‘কাঠ মোল্লা আর কি! মেয়েকে ছেলেদের সঙ্গে পড়তে দেয়নি, ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়নি কো-এডুকেশনের ভয়ে, তাই না?’

বুলার গলা একটু ভারি হয়, ‘আমার বাবা কি তোমার কেউ নয়?’ সঙ্গে-সঙ্গে জাহাঙ্গীরের আফসোস হয়, বৌ-দের কাছে তাদের বাবা-মা সম্বন্ধে একটু সাবধানে কথা বলা দরকার। ‘ওরে আমার পিছু রানী, রাগ করলে?’ বুলার মাথা সামনে টেনে জাহাঙ্গীর তার গালে দুটো চুমু খায়। দুটো চুমুর পর খ্যাও দেওয়ার বান্দা সে নয়। তবে এখন গল্প বলার বেগ এসেছে, চুমু-টুমুর ব্যাপার পরে দেখলেও চলবে। বুলা মাথা নিচু করে বলে, ‘আব্বা কিন্তু মোটেই কনজারভেটিভ নয়। তাহলে কি আমাকে গান শেখাত? পাড়ার কলেজ, পড়াশোনা ভালো হয়, তাই ওখানে দিয়েছে।’

‘আচ্ছা, আমার ভুল হয়ে গেছে। এই মাপ চাইলাম।’ জাহাঙ্গীর হাত জোড় করে এমনভাবে তাকায় যে বুলা হেসে ফেলে। বুলা আসলে ঠিকই বুঝেছিল। বিয়ের পর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই স্বামীটিকে সে চিনে ফেলেছে। লোকটা একেবারে খোলামেলা, মানুষ এত ফ্রাঙ্ক হতে পারে! বাপ-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি যার সম্বন্ধে যা মনে হচ্ছে সঙ্গে-সঙ্গে বলে ফেলছে। আবার দেখো, বাপ-মা তো বটেই শ্বশুর সম্বন্ধেও সিরিয়াসলি কেউ খারাপ কিছু বললে সঙ্গে-সঙ্গে রুখে দাঁড়ায়। কোথাও কোনো রাখোঢাকো নেই, যা বলার অকপটে বলে ফেলে। মিষ্টি-মিষ্টি মুখ করে বুলা স্বামীর দিকে তাকায়, ‘আমি এমনি বলেছি। যাক, তারপর? তোমাদের হিপ হিপ হুররের কথা বলো?’

‘হ্যাঁ, শোনো।’ জাহাঙ্গীর নতুন উদ্যমে শুরু করে, সবসময় তার বুক উঁচু করে চলা, কাউকে কেয়ার-না-করা—এইসব দেখে ছেলেরা মাঝে মাঝে সাউন্ড দিত।’

‘সাউন্ড দিত মানে?’

‘আ—! তুমি কিচ্ছু বোঝ না।’ স্ত্রীর অজ্ঞতার জাহাঙ্গীরের উৎসাহ বাড়ে, ‘সাউন্ড দিত মানে একটু রিমার্ক পাস করতো। তো হিপ-হিপও চেইতা যাইতো, একদিন কয় আপনাদের বাড়িতে মা বোন নেই? পোলাপান কি কম? কয়, আছে কিন্তু বাপেরা আর দুলাভায়েরা সেইগুলি দখল কইরা রাখছে।’

‘ছি ছি! এ-রকম বলে, অ্যাঁ!’

বুলার বিস্ময় ও ধিক্কারে জাহাঙ্গীর হাসে, ‘যাই কও পোলাপানে ভালোই জবাবটা দিছিলো, না?’ হিপ হিপ হুররে মেয়েটি সম্বন্ধে গল্প তার অব্যাহত থাকে। ছেলেরা একদিন করল কী, হিপ-হিপের গায়ে কলম ঝাড়ে, এবার হিপ হিপ নালিশ করল প্রিন্সিপালের কাছে। প্রিন্সিপাল আর কী করতে পারে? ঐ ক্লাসে নিজে গিয়ে ছেলেদের খুব বকে দিলেন। ছুটির পর মেয়েটির অবস্থা সেদিন খুব খারাপ। ছেলেরা সব এখান থেকে সাউন্ড মারে, ওখান থেকে সাউন্ড মারে। জাহাঙ্গীর তো এসবের মধ্যে কখনো যায় না। ক্লাশও করে না, মেয়েদের পেছনে ঘোরাঘুরিও করে না। সে আছে তার নিজের ও কলেজের খেলাধুলা নিয়ে, তার কাজ হলো কলেজের খ্যাতি যেন কোনোভাবেই নষ্ট না হয়। আর কী করে? কলেজে কোন বিচিত্রানুষ্ঠান হলে জানপ্রাণ দিয়ে খাটা এবং স্টেজে একবার দাঁড়িয়ে শরীরচর্চা প্রদর্শন করা। যাক, সে সেদিন ওদিক দিয়ে যাচ্ছিল, মেয়েটা কাঁদো-কাঁদো গলায় এসে বলে, ‘দ্যাখেন তো! সবই কী করছে আমার সঙ্গে?’ জাহাঙ্গীর বুলার কাছে তার সেদিনকার প্রতিক্রিয়ার কথা বলে, ‘বুঝলা বুলা, আমি হাঁক দিয়া কই, কী তোমরা পাইলা কী? ক্লাশমেটের সঙ্গে ইয়ার্কি মারো, রাস্তায় দেখলে তারে সাউন্ড দাও, এইগুলি কী? কলেজের বেইজ্জতি না?’

বুলা বলে ‘তোমার সাহস তো কম না। এতগুলো ছেলেকে বললে, সবাই মিলে তোমাকে যদি ধরত? তোমাদের কলেজের যা নামডাক!’

‘আরে, আমারে কে কী কইব? কলেজের আমি অ্যাথলেটিক সেক্রেটারি। মহল্লা কন্ট্রোল করি আমি–।’

ফের শুরু হলো। বুলা বলে, ‘তারপর?’

তারপর কয়েকটা ছেলে এগিয়ে এসে তাকে বলে, জাহাঙ্গীর ভাই, আমাদের ধরার আগে বিচার চাই।’ –বিচার? কীসের বিচার? — তাদের অভিযোগ খুব স্পষ্ট তাদের ক্লাশমেট প্রিন্সিপ্যালের কাছে গেল কেন? প্রিন্সিপ্যাল সবাইকে অপমান দেখল, সে করল, এর বিচার করবে কে? জাহাঙ্গীর ও বটে। মেয়েটাকে ধমকায়, ‘আপনে স্যারেরে কইলেন ক্যান? আমরা নাই?’ মেয়েটি ভ্যাবাচ্যাকা খায়, দারুণ দাপটের ডাকু টাইপের লড়কি, তার গলা কাঁদো-কাঁদো হয়ে পড়ে, ‘আপনিও তাই বললেন?’

বুলা জিগ্যেস করে, ‘মানে তোমাকে আলাদা করে দেখে?’

‘আরে আমি কী ঐ বিচ্ছুগুলির লগে হাউ-কাউ করি? আমি ক্লাশও করতাম না, জানিও না কোন ছেমরি কী পড়ে?’

‘ক্লাস করনি তো বি. এ. পাস করেছ কীভাবে?’ বুলার প্রশ্নের ভঙ্গিতে জাহাঙ্গীর একটু থতমত খায়। ছ-সাত দিন আগেও পরীক্ষার হলে ওর নকল করার বাহাদুরি নিয়ে খুব গল্প করেছে। স্যাররা ওর ভয়ে হলের ভেতর ঢুকত না, বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করে তিনটে ঘন্টা কাটিয়ে দিত। কিন্তু এখন ঐ গল্প করতে একটু বাধো বাধো ঠেকছে, সে তার পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে যায়, ‘আমি কই আপনে স্যারেরে কইয়্যা কামটা ভালো করেন নাই। পোলাপানে কয় আর জাহাঙ্গীর ভাই, আপনার কাছে কইলেও তো পারত।

‘কী করি? ছেমরিটা কাঁদতে আরম্ভ করল। আমি নিয়া রিকশায় উঠাইয়া দিলাম, তো কয়, আপনারেও যাইতে হইব। পাগল নাকি? এক রিকশায় তার বাড়ি যাই আর একটা কেলেঙ্কারি। আমি তখন কলেজের অ্যাথলেটিক সেক্রেটারি, বুঝলা না?’

গল্পটা কেবল জমে উঠেছে, এমন সময় এসে পড়ে বুলার বড়ো ভাই হাফিজ, পুরু লেন্সের চশমা পরে। ছাত্রও খুব ভালো, ফিজিক্সে ফার্স্টক্লাস পেয়ে অ্যাটমিক এনার্জিতে ঢুকেছে, অ্যামেরিকান ইউনিভার্সিটিগুলোতে একটার পর একটা দরখাস্ত পাঠাচ্ছে, লেগে গেলেই উড়াল দেবে। এমনিতে লোকটা ভালো, যখনি আসে হাতে জাহাঙ্গীরের প্রিয় মিষ্টির প্যাকেট। তবে গম্ভীর টাইপের এই লোকটার সঙ্গে জাহাঙ্গীরের ঠিক জমে না, সম্বন্ধীর সামনে জাহাঙ্গীর সব সময় উসখুস করে। হাফিজ আজ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে তার এক বন্ধুকে। এটার নকশা অবশ্য অন্যরকম। রোগা ও লম্বা, পাজামা, পাঞ্জাবি, চোখে চশমা নাই, মুখে পান, হাতে সিগারেট জ্বলছে। ড্রয়িংরুমে বসেছিল দুজন, জাহাঙ্গীর ঢুকতেই লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ায়, বুলার ভাই নাম বলে পরিচয় করিয়ে দেয়, ‘আমার বন্ধু, নাম শুনেছেন নিশ্চয়, সরোদ বাজায়—’

জাহাঙ্গীর সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘টিভিতে প্রায়ই দেখি।’

হাফিজ হেসে ফেলে, ‘কী মুশতাক, তুমি কি আজকাল জনগণের মনোরঞ্জনে মগ্ন নাকি?’

‘মুশতাক ভাইকে রেগুলার প্রোগ্রাম দিলে পাবলিক চটে যাবে না?’ বুলা যে কখন এসেছে কেউ টের পায়নি। তার কথা শুনে মুশতাক চমকে ওঠে, একটা ঢোক গিলে হাসতে হাসতে বলে, ‘আমাকে প্রোগ্রাম দেয় কোন শালা? তার চাকরি যাবে না?’

লোকটাকে জাহাঙ্গীরের ভালোই লাগছে। আসতে না আসতে কেমন সহজ হয়ে উঠেছে। আহা, টেলিভিশনে প্রোগ্রাম পায় না! মাঝে মাঝে প্রোগ্রামের ব্যবস্থা তো সে-ই করে দিতে পারে। চেনাজানা কয়েকজন আছে, একটু ধমক গিলে বাপ-বাপ করে প্রোগ্রাম দেবে। কিন্তু কথাটা কিভাবে পাড়বে ভাবতে ভাবতেই মুশতাক বলে, ‘বুলা, কেমন আছো? তোমার বিয়েতে আসতে পারলাম না। কুমিল্লা গিয়েছিলাম। জানো বোধহয় সুনীলদার শরীর খুব খারাপ।’

‘হ্যাঁ, শুনেছিলাম। এখন কেমন?’

‘ভালো না।’

শুনে বুলার মুখটা ঝুলে পড়ে। জাহাঙ্গীর এদিক-ওদিক দেখে। কে এই সুনীলদা যার শারীরিক অসুস্থতার খবরে বুলা এভাবে ভেঙ্গে পড়ে! জাহাঙ্গীরকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে মুশতাক, ‘সুনীল সেনগুপ্ত। জানেন বোধহয় আমাদের দুজনের হাতেখড়ি হয় সুনীলদার হাতে। হারমোনিয়াম ধরতে শেখায় সুনীলদা। তখন কী রাগী ছিল, না? একটু এদিক-ওদিক হলে কী রকম ধমক দিত মনে আছে?’

আমাদের দুজনের বলতে মুশতাক কী বোঝাচ্ছে?—মানে মুশতাক আর বুলা?

—জাহাঙ্গীর একটু অস্বস্তিবোধ করে,–বুলা গানবাজনার চর্চা করে—এ খবর সে জানে, কিন্তু এই ব্যাপারে তার আবার সঙ্গীও আছে একজন, সে আবার তার ভাইয়ের বন্ধু –বুলা তো কোনোদিন বলেনি! কেন বলেনি?

‘ধমক দেয়ার কথা কী বলছো? কিঞ্চিৎ উত্তম-মধ্যমও পিঠে পড়ত, সেটা কি ভুলে গিয়েছ?’ হাফিজের মাইনাস পাঁচ লেন্স ও ভাঙ্গাচোরা গাল পেরিয়ে এই রসিকতা পড়তে না পড়তে বুলা খিলখিল করে হাসে, সেটা মুশতাক ভাইয়ের পিঠে। সুনীলদা আমাকে কখনো মারেনি।’

‘তোমার পিঠটা অক্ষত কারণ সুনীলদা তোমার ব্যাপারে বেশিরকম উইক। এবারও বারবার জিগ্যেস করে, বুলা রেওয়াজ করে তো?’ বলতে বলতে মুশতাক নিজেই প্রশ্নটা করে, ‘রেওয়াজ করো না? আমি বললাম বুলা কী ছাড়তে পারে?’

জাহাঙ্গীর উসখুস করে। হাফিজ বলে, ‘আর গান-বাজনা? মেয়েদের ব্যাপার, বোঝো না? বিয়েও হলো, গান-বাজনা, পড়াশোনা সব মাথায় উঠল। সেরকম পরিবেশ পেলে অবশ্য—’

জাহাঙ্গীর এবার উঠে দাঁড়ায়, আপনারা বসেন। আমি একটু আসি। এই যাব আর আসব, পাঁচ মিনিট!’

হাফিজ বলে, ‘বসেন, আমাদের জন্য কিচ্ছু আনতে হবে না। বুলা চা করুক।’ বুলার সঙ্গে জাহাঙ্গীরও রান্নাঘরে ঢোকে। এই মেয়েটাকে একটু আগে মনে হচ্ছিল নিজেরই হাত পা-নাক-কানের মতো। এখন এরকম অপরিচিত মনে হচ্ছে কেন? বুলা বলে, ‘কোথায় যাবে? ভাইয়া তো মিষ্টি নিয়েই এসেছে।’

‘তাই হয়? মেহমানের খাবার দিয়া মেহমানদারি চলে? দেখি হান্নানের দোকানে যাই। পাঁচ মিনিটও লাগবে না।

‘বাদ দাও। আমি চা করি, তুমি বরং ওদের সঙ্গে গল্প করো।’ গল্পে সুবিধা করতে পারবে না বলেই জাহাঙ্গীর তাড়াতাড়ি বাইরে যেতে চাইছে। তুমি চা পরে কইরো। আমি দেখতে-দেখতে ব্যাক করুম।’ বলে জাহাঙ্গীর আরো একবার বাথরুমে যায়। তারপরে বসার ঘরে ঢুকে ঠুকঠুক শব্দ করে ক্যাসেট বদল করে টেপরেকর্ডার চালিয়ে দিয়ে বলে, ‘গান শোনেন। মাহমুদ শাহেদের এই রেকর্ড খুব হিট করেছে। আমার ফ্রেণ্ড। টিভিতে উইকে দুইটা-তিনটা প্রোগ্রাম করে!’ বাংলা ভাষায় পপ গান বিকট জোরে বাজে; পা পাছা পিঠ ও ঘাড় দোলাতে দোলাতে জাহাঙ্গীর উঠে বাইরে যায়। তার ভেসপায় স্টার্ট দেওয়ার আওয়াজ এই উচ্চকণ্ঠ ধ্বনিসমষ্টিতে একটুও বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে না।

কাঁঠালপাতার ঠোঙা থেকে মোরগ-পোলাও প্লেটে সাজানো হয়। জাহাঙ্গীর নিজেও বুলাকে সাহায্য করে। এখন কী প্রসঙ্গ নিয়ে কথা শুরু করবে ভাবতে-ভাবতে জাহাঙ্গীর খেয়াল করল যে টেপরেকর্ডারটা বন্ধ। কী ব্যাপার? মাহমুদ শাহেদের এতগুলো গান। — কী ব্যাপার? বন্ধ কইরা দিছেন?’

‘হ্যাঁ, কথা বলছিলাম।’ বুলার ভাইয়ের এই কৈফিয়ৎ জাহাঙ্গীরের আরো খারাপ লাগে। কথা বলছিল তো আমি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল কেন? মুশতাক বলে, ‘মাহমুদ শাহেদ আপনার বন্ধু? এখন তো টপে আছে, না?’ এবার জাহাঙ্গীরের জড়তা কাটে, ‘হ্যাঁ। অনেকদিনের বন্ধু। আমরা একসঙ্গে একই ক্লাবে খেলাধুলা করছি। এখন এত ফেমাস হইয়াও পুরানো ফ্রেন্ডদের ভোলে নাই। কলেজে আমি অ্যাথলেটিক সেক্রেটারি ছিলাম। তো, অরে দুইবার ফাংশনে নিয়া গেছি। তারে দেইখা আর সব গান ক্যান্সেল করতে হইল। পোলাপানে আর কিচ্ছু শুনতে চায় না। তার গান শুইনা সমস্ত হল নাচতে শুরু করল। উই নিজেও নাচে, আমরাও নাচি। আরে তার গান শুনলে আমি তো চেক দিতে পারি না। নাচতেই হয়।’ মুশতাক বলে, ‘অনেক কষ্ট করে গান করে। বেচারাদের কোমরে ব্যাথা হয়ে যায়।

‘তা তো করেই। তবে কিনা অভ্যাস হইয়া গেছে।’ জাহাঙ্গীর তার প্রিয় গায়কের নৈপুণ্যে একটু গর্ববোধ করে বৈ কি!

‘বেচারাদের গলায় তো তেমন পরিশ্রম হয় না, সুর তালের জন্যেও কোনো পরোয়া না করলেও চলে। বেচারাদের খাটনি সব শরীরে।

হাফিজ হো-হো করে হেসে ওঠে। জাহাঙ্গীরের থতমত খাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে একটু সামলাবার চেষ্টা করে, ‘কেন? টিভিতে তো দেখি বেশিরভাগই আজকাল শরীর দুলিয়ে গান করে।’

‘সেজন্যেই ওদের গান বন্ধ করা উচিত নয়, গলা বা সুর তো এদের কাছে মাইনর ব্যাপার। তবে ধরেন গান বন্ধ করলে এদের বাত ধরে যেতে পারে।

‘বাত?’ জাহাঙ্গীর অবাক হয়, কিন্তু হাফিজ ও বুলা দুজনেই হাসতে শুরু করে। মুশতাক গম্ভীর মুখ করে বলে, ‘ওদের গান মানে তো ফিজিক্যাল মুভমেন্ট। গান বন্ধ হলে বাত হবে না? রিকশাওয়ালাদের শেষ জীবনে কী হয়?’

সবাই হাসে। জাহাঙ্গীরও হাসে, তবে ঠোঁটে হাসির দাগটা ফুটিয়ে তুলতে ওর জান বেরিয়ে যাবার দশা হয়।

রাত্রে বিছানায় শুয়ে বুলা বলে, ‘মুশতাক ভাইয়ের কথাবার্তা খুব ফ্রাঙ্ক, ঠিক তোমার মতো, না? যা মনে হয় তাই বলে। কেমন হাসাল আজ, দেখলে না?’

‘বহুত মজা করল, গান-বাজনা করে না?’

‘হ্যাঁ। সরোদ বাজায়। সুনীল সেনগুপ্তের খুব প্রিয় ছাত্র। মুশতাক ভাই খুব সিনসিয়ার আর্টিস্ট। ক্ল্যাসিক্যালের নিচে নামবে না। দেখলে না টিভির ওপর কেমন চটা?’

‘প্রোগ্রাম না পাইলে চেতবো না? আরে একটা প্রডিউসারকে কইলেই তো প্রোগ্রাম দেয়। উনার পুরা নামটা কও তো।’

‘না, না, উনি ইচ্ছা করেই প্রোগ্রাম নেন না। এইসব ন্যাকামো বাঁদরোমো ছ্যাবলামো মুশতাক ভাই সহ্য করতে পারে না।’

জাহাঙ্গীরের কাছে ব্যাপারটি স্পষ্ট হয় না। হাজার হাজার নরনারীর সামনে নিজেকে দেখাবার এরকম সুযোগ কি কেউ ইচ্ছা করে হারায়? বুলা তো মিথ্যা কথা বলে না। নিশ্চয়ই ঠিকঠাক জানে না। জাহাঙ্গীর বলে, একটা দুইটা প্রোগ্রাম পাইলেই দেখবা মুশতাক ভাইও নাচতে শুরু করবো, টিভির পর্দা ফাটাইয়া ফালাইবো।’

‘বললাম তো মুশতাক ভাই অন্যধরনের লোক। সঙ্গীত উনার রক্তের মধ্যে, তাই ইয়ার্কি মারা সহ্য করতে পারে না। বুলার কথা শুনে জাহাঙ্গীর একেবারে চুপ করে যায়। কিছুক্ষণ পর বলে, ‘তোমার আসলে বিয়ে হওয়া উচিত ছিল ঐসব হাই-থটের গান বাজনা করা লোকের সঙ্গে। আমি ঐগুলি বুঝি না।’

বুলার যেন চৈতন্য ফিরে আসে। জাহাঙ্গীরের পিঠে হাত রেখে বলে, ‘তুমি রাগ করলে?’

‘না, না। রাগ করিনি। গলা খাঁকরে সমস্ত এক্সট্রা রসালো ভাব ঝেড়ে ফেলে জাহাঙ্গীর বলে, ‘রাগ করব কেন? মানে আমি তো এইসব ঠিক বুঝি না। তোমাদের ঐসব গান বাজনায় আমার ইন্টারেস্ট নাই। ধরো ঐ লাইনের মানুষকে বিয়ে করলে তোমাকে হেলপ করতে পারত, মানে একই লাইনের হাজব্যাণ্ড-ওয়াইফ হলে!’

‘এসব কথা আর বলবে না!’ বলতে-বলতে বুলা ডানহাতের চারটে আঙুল দিয়ে জাহাঙ্গীরের ঠোঁট চাপা দেয়। একটু আগে পাঙ্গাশ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছে, বুলার হাতের আঁষটে গন্ধ নাকে থাপ্পর মারলে নিশ্বাস বন্ধ করে জাহাঙ্গীর বুলার আদর নেয়। বুলা বলে, ‘আমি ঠিক এইরকম লোকই চেয়েছি। এইরকম হাসিখুশি, এইরকম কাজের লোক, এইরকম ফিগার, হেঁটে গেলে মাটি কাঁপে—এই আমার ভালো!’

।তবে ধরো আমার পক্ষে গান বাজনার ব্যাপার—।’

‘আবার! চোপ!’ বুলার হাত আরো চেপে বসে, ‘ঐসব লোক গুণীলোক, ওদের খুব শ্রদ্ধা করি, কিন্তু ওদের ভালোবাসা মুশকিল। বুঝলে না, রাতদিন বিছানার ওপর বসে খালি রেওয়াজ করে, বাইরে যায় না—এসব পুরুষমানুষের সঙ্গে ঘর করা যায়?’

জাহাঙ্গীরের কোনো সাড়া না পেয়ে বুলা ফের বলে, ‘একই লাইনের হাজব্যাণ্ড-ওয়াইফের কথা বলছ? তুমি তাহলে গুলশানের মেয়েটাকে বিয়ে করলে না কেন? এইবার বলো তো?’

জাহাঙ্গীর কী বলবে? গুলশানের মেয়েটিকে বিয়ে করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তবে ওরকম কোনো মেয়ের সঙ্গে সত্যি সত্যি আলাপ থাকলে মাঝে মাঝে যাওয়া যেত। বুলা বলে, ‘বলো তো, এইসব গুণীলোক কি তোমার মতো এরকম বেপরোয়া মোটর সাইকেল চালাতে পারে?’

বুলার আঙুলে জাহাঙ্গীর চুমু খায়। এমনকি তার তর্জনী নিয়ে একটু চুষতেও শুরু করে। বুলা ফের বলে, ‘বলো ওরা পারে?’

জাহাঙ্গীর এবার আত্মসমর্পন করে, ‘আমাদের হিপ হিপ হুররেও আমার ভেপা চালাবার ভঙ্গি দেখেই ধরে ফেলল।

‘ও হ্যাঁ, গল্পটা শেষ করলে না? ভাইয়েরা এসে সব মার্ডার করল।’

মহা-উৎসাহে হিপ-হিপের গল্প শুরু করলেও এবার তেমন জমে না। সেই যে সাউন্ড-মারা ছেলেদের হাত থেকে উদ্ধার করে জাহাঙ্গীর তাকে রিকশায় উঠিয়ে দিল এরপর থেকে

‘তা মেয়েটার সঙ্গে তোমার যোগাযোগ কেটে গেল কী করে?’ গল্পটা তো আগেও শোনা হয়েছে। সেই স্মৃতি থেকে বুলা এই প্রশ্ন করে।

কিন্তু জাহাঙ্গীর এবার অন্যরকম কথা বলে, ‘যোগাযোগ বন্ধ হইবো ক্যান্? না মানে ধরো, একই ক্লাসে পড়ি, রোজ দেখা হয়। আবার কোনো অসুবিধা হইলে আমারেই ধরত।’ বলতে বলতে জাহাঙ্গীর একটু লাজুক মতো হাসে, ‘ছেলেরা একটু ঠাট্টাও করত। একবার পিকনিক করতে গেলাম চন্দ্রা, আমরা কয়জন হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে একটু নির্জন ঝোপের দিকে গেছি তো হঠাৎ দেখি, বুঝলা আমাগো দুইজনের একলা ফালায়া বিচ্ছুগুলি কৈ ভাগছে। আমরা হাসি। ইসে কয়, ‘আরে বসো না।’

‘তোমার নিশ্চয়ই ভালো লাগল।’ বুলা প্রায় উঠে বসে।

‘তা অস্বীকার করতে পারব না, একটু ভালো তো লাগতই।’

‘সত্যি? ডুবে ডুবে জল খেয়েছ না?’ বুলা আরো শোনার জন্য উদগ্রীব। এই গল্পের আগেকার ভার্সনে কিন্তু জাহাঙ্গীরের সঙ্গে হিপ-হিপের এতটা মাখামাখি বা পিকনিক এইসব ব্যাপার ছিল না।

‘আমাকে বলে, আমাদের বাসায় তো আসলেন না। আমার মা আর বড়ো আপা আপনাকে দেখতে চায়।’

‘মানে মেয়েটি তাহলে বাড়িতেও সব বলেছে।’ বুলার এই উদ্বিগ্ন জবাবে জাহাঙ্গীর বলে, মনে হয়।’

‘তুমি ওদের বাসায় গেছ?’

‘আমি’ জাহাঙ্গীর একটু ভেবে বলে, ‘বাসায়-টাসায় যাইতে ভালো লাগে না। মেয়েদের বাসায় বাসায় ঘোরা, কার্পেটের উপরে বইসা হারমোনিয়াম একখান লইয়া প্যাঁ-প্যা করা আমার পোষায় না।’

বুলা কিছু বলে না। জাহাঙ্গীরের কথায় এ-ধরনের ঝাঁঝ আগে কখনো দেখেনি। জাহাঙ্গীর বলতেই থাকে, ‘মেয়ে ক্লাশমেটের বাড়ি গিয়ে ডাক দিমু ও মিনু, ও ডলি, একটা গান ধরো তো! তারপর শিঙাড়া, চানাচুর, চা খাইয়া ঘরে ফেরা—এইগুলি পুরুষমানুষের কাম না, বুঝলা? এইগুলি করে হিজড়ারা, বুঝলা? হঠাৎ বেড-সুইচে খুট করে শব্দ হয়, ঝলমলে আলোয় জাহাঙ্গীর ঝুঁকে বুলার মুখ দেখে। ফর্সা মুখ কাগজের মতো ফ্যাকাশে, ‘কী হলো?’

‘তোমার মুখটা দেখতে ইচ্ছা করল।’ বুলার জন্যে তার মায়া হয়, হাজার হলেও মেয়েমানুষ, এভাবে কথা না বললেই পারত। কিন্তু তাকে চুমুও খায় না। মেরামত করার চেষ্টা করে এইভাবে, ‘তোমার গালের রঙ এত সুন্দর।’

চোখ বন্ধ করে বুলা হাসে, ‘তারপর?’

জাহাঙ্গীর একটানা কথা বলে। মেয়েটির সঙ্গে সে দু-একবার চাইনীজও খেয়েছে। কিন্তু মেয়েদের মন বুঝে চলা তার স্বভাবে নেই। সে ছিল কলেজের অ্যাথলেটিক সেক্রেটারি, কত ছেলে কত মেয়ের সঙ্গে তার মেলামেশা করতে হয়। একটি মেয়েকে নিয়ে হিপ হিপ তাকে সন্দেহ করতে শুরু করে। অথচ দেখো মেয়েটার সঙ্গে এমন কিছু মাখামাখি হয়নি—তার বড়ো ভাই ছিল জাহাঙ্গীরের বন্ধু, একদিন এসে বলে, দেখ তো, আমার বোনটা ভর্তি হতে পাচ্ছে না, দেরি করে ফেলেছে, দে না তোদের কলেজে ম্যানেজ করে। তা সে হলো কলেজের

অ্যাথলেটিক সেক্রেটারি, প্রিন্সিপ্যালকে গিয়ে বলে স্যার খেলাধুলা করে, এই মেয়েটাকে চাই।’ নাজমা তো অবাক। জাহাঙ্গীরকে ডেকে আমি খেলাধুলা করি আপনাকে কে বলল?’ জাহাঙ্গীর বলে, ‘নাজমা–’

‘সেদিন না বললে পারভীন?’ বুলা হঠাৎ বাধা দিলে জাহাঙ্গীর দমে যায়।

‘পারভীন? ও এর কথা বলেছি?’

‘বলনি? বলেছ। আগে তোমার হিপ-হিপের কথা বলো। আমার ঘুম পাচ্ছে।’

এইসব গল্প শুনতে তার ঘুম পায়? জাহাঙ্গীর একটু থেমে ফের শুরু করে। তারপর অনেকদিন কোনো যোগাযোগ ছিল না। মাস তিনেক আগে জাহাঙ্গীর খুব স্পীডে ভেসপা চালিয়ে রামপুরা যাচ্ছে, মালিবাগে পুলিস-বক্সের ভেতর থেকে একদল মহিলা-পুলিশ ট্রাকে ওঠার জন্যে বেরিয়ে আসছে। এদের একজন হঠাৎ তার দিকে বাঁশি বাজিয়ে হাত তোলে। ভেস্পার ব্রেক কষতেই সামনে এসে বলে, ‘এত ওভারটেক করতে চান কেন? দেখি লাইসেন্স। দেখি।’ মহিলা-পুলিশের ধৃষ্টতা দেখে জাহাঙ্গীরের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। কী সাহস! চোখমুখ লাল করে জাহাঙ্গীর তার দিকে তাকালে পুলিশ ফিক করে হেসে ফেলে। আরে এ তো শালার সেই হিপ হিপ হুররে। — ‘কী জাহাঙ্গীর, কোথায় যাও?’—বুলা একটু সংশোধন করার জন্য উসখুস করে। কারণ এর আগে গল্পটা বলার সময় সংলাপে মেয়েটি জাহাঙ্গীরকে জাহাঙ্গীর ভাই’ বলে সম্বোধন করেছিল এবং তাকে আপনি করে বলেছিল–কিন্তু জাহাঙ্গীরের বাক্যবেগে বাধা দেওয়া যায় না। তার বাক্যধারা তুমুল প্রবাহিত হয়, ‘আমি জিগাই তুমি?–আমি তো পুলিশে ভর্তি হইছি—খুব ভালো। — তুমি কৈ যাও? জানো তোমারে আমি এক্ষুণি অ্যারেষ্ট করতে পারি—তা তো পারই, কিন্তু আমার বিরুদ্ধে অ্যালিগেশন কী? — চলো, তোমার সঙ্গে যাবো, যাইতে যাইতে বলবো। – তারপর সে করল কী আমার পেছনে উইঠা আমারে জাপটাইয়া ধরল।’ বুলা এখানেও তাকে একবার থামাতে পারত। পরশুদিন বলার সময় এই পর্যন্ত ছিল, ‘চলেন, আপনার সঙ্গে যাব।’ কিন্তু জাহাঙ্গীর তাকে নেয়নি, না, আজ একটু কাজ আছে, আরেকদিন আসব।’ জাহাঙ্গীর তাকে রেখেই স্পীডে মোটর সাইকেল চালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন জাহাঙ্গীরকে থামানো অসম্ভব।

‘আমারে কয় তোমার বিরুদ্ধে অ্যাবস্কন্ডিং হওয়ার অ্যালিগেশন। তোমাকে আমি সব জায়গায় খুঁজি–কেন আবার কী? তোমাকে চাই।’ আবার কি আলো জ্বালাবে? বুলার মুখটা দেখা যেত। কিন্তু সুইচে হাত দেয়ার আগেই বুলার মিহি স্বরের নিশ্বাস শোনা যায়। আরে, এ তো ঘুমিয়ে পড়েছে! তার পাতলা ফর্সা রোগা হাতটা জাহাঙ্গীরের ঘাড়ের ওপর আলগোছে রাখা। — হাতটা ধরে জাহাঙ্গীর পাশে রেখে দেয়, নিজেও শোয়, একটু দূরে সরে। এই মেয়েটা স্বামীর প্রেমের গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। জাহাঙ্গীরের ব্যাপারে কি তার কোনো মনোযোগ নেই? জাহাঙ্গীর উঠে বাথরুমে যায়। এসে খাটের ধারে বসে থাকে। মনে হয় একা শুয়ে থাকাটা অনেক আরামের। এইটুকু সেমি-ডবল খাট, সেখানে দুজনে ঘুমানো? বিশ্রী!–কাল ভোরবেলা বেরিয়ে যাবে,–সারাদিন, এমনকি রাত্রি পর্যন্ত অফিসের কাজ করবে। কত কাজ বাকি পড়ে আছে। বায়তুল মোকাররম-গুলিস্তান এলাকার বড়ো দোকানদাররা দেশি ফার্মের ওষুধ রাখতে চায় না। তাদের কনভিন্স করা দরকার। ম্যানেজিং ডিরেক্টর দিন দিন তার ওপর বিরক্ত হয়ে উঠছে, ‘অর্ডার আসে না কেন? কবীর অর্ডার আনে, বেলাল অর্ডার আনে, তুমি করো কী? কবীর কী বেলাল তো তার মতো এরকম এলিয়ে পড়েনি। সকাল নেই বিকাল নেই রাত নেই –বৌয়ের সঙ্গে ম্যাদামার্কা ছেলেদের মতো দিনরাত কেবল ফুসুর ফুসুর করবে তো অর্ডার আনবে ওর কোন বাবা? –তাও যদি মেয়েটা ওকে বিশ্বাস করত–তা বুলা ওকে বিশ্বাস না করলে সে কী করতে পারে? দোষ তো শালার মহিলা-পুলিশের। হিপ হিপ হুররে যদি সত্যি সত্যি ওকে ডেকে একটু কথা বলত তা হলে বুলা কি অবিশ্বাস করে এত সহজে পার পায়? হিপ হিপ হুররে কি তার সঙ্গে পড়ত না? তারা কি এই মেয়েটিকে হিপ হিপ হুররে উপাধি দেয়নি? তবে অবশ্য কলেজে পড়তে কোনো মেয়ের সঙ্গেই জাহাঙ্গীরের কথাবার্তা হয়নি। না, হিপ-হিপের সঙ্গেও হয়নি। তো, পুলিসে পরিণত হওয়ার পর কথা বললে মেয়েটার কী এমন ক্ষতি হতো?

সকালে ঘুম ভাঙে তার বেশ দেরিতে। মুখ ধুয়ে এসে দেখে চা-টা সাজিয়ে অপেক্ষা করছে বুলা। এর মধ্যেই বুলার গোসল-টোসল সারা। তার খোলা ভিজে কালো চুলের মধ্যে ফর্সা মুখটা ভারি কচি ও নিষ্পাপ। কী সুন্দর না? ভেসপায় স্টার্ট দিতে দিতে জাহাঙ্গীর ঠিক করে, বিকেলবেলার আগেই ঘরে ফিরবে। বুলাকে ধরে ঠেসে চুমু খাবে। তারপর ওকে পেছনে বসিয়ে নিয়ে অনেক দূর ঘুরে আসবে। মালিবাগের ওদিকটাও যাবে। পুলিশবক্সে মেয়েটা থাকলে চোখজোড়া মেলে একটু দেখবে। দেখানো দরকার।

কিন্তু বিকেলবেলা ভেসপার আওয়াজে বুলা বেরিয়ে এলে ওর মুখটা ভার-ভার ঠেকে। কী ব্যাপার? মুশতাক ভাই এসেছিল। আবার মুশতাক ভাই?—দুর! ফার্মেসিগুলো একবার ঢুঁ মেরে এলে হতো, কিছু না কিছু অর্ডার কি আর পেত না?—কেন, মুশতাক ভাই কেন? সুনীলদাকে আজ সকালে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে, মেডিক্যাল কলেজে আছে। বুলা এক্ষুণি দেখতে যাবে। জাহাঙ্গীরকেও যেতে হবে। আবার সুনীলদা! আবার মুশতাক ভাই!

‘আমি কী করব? তুমি যাও।’

‘ওমা! তাই কি হয়? সুনীলদা তোমাকে দেখবে না? আমাদের ছোটেবেলার গানের ওস্তাদ। আমাকে কী আদর করতো!’

‘যাব?’ জাহাঙ্গীর চা খেতে খেতে বলে, ‘কিন্তু আমার তো আফসের খুব জরুরি কাজ। তোমারে বরং মেডিক্যালে নামাইয়া দিয়া যাই।’

‘ফিরব কী করে?’

‘একলা আসতে পারবা না? মুশতাক সাহেব পৌঁছাইয়া দিতে পারব না?‘

‘থাক। আমার আর গিয়ে কাজ নেই।’ বুলার একটু ভিজে গলার স্বর ও একটু ঝাপসা নোনতা চোখের কোঁচকানোটা এত সুস্বাদু লাগে যে জাহাঙ্গীর সঙ্গে সঙ্গে কাত হয়, ‘আচ্ছা চলো।’

ভেসপার পেছনে বসে বুলা বকবক করে যাচ্ছিল, কথা একবার শুরু করলে মেয়েটা থামতে পারে না। কথাও বলে এত মিষ্টি করে, এর আগে এ-রকম মিষ্টিভাষায় কথা বলা মেয়ের সঙ্গে জাহাঙ্গীর কোনোদিন আলাপ করেনি। জাহাঙ্গীর সিনা টান করে মাথা সোজা রেখে ভেস্‌পা চালায়। বুলা একনাগাড়ে কত কথা বলে। বেশিরভাগই তাদের ছেলেবেলার কথা। খুব ছেলেবেলায় তারা কুমিল্লায় থাকত। —সুনীল সেনগুপ্ত না থাকলে তার গান শেখাই হতো না। —মুশতাক থাকত তাদের পাশের বাড়ি। তারা একসঙ্গে গান শিখেছে। — কুমিল্লা কী সুন্দর শহর, ঢাকার মতো এ-রকম মানুষ গিজগিজ করে না–ঢাকায় সুনীলদার মতো লোক একটাও নেই। –বেচারা বিয়ে-থা করেনি। এখন বয়স ষাটের কোঠায় পড়েছে, দেখার লোক নেই একটাও—দেখো, বিধবা বড়োবোনও ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্যেই বিয়ে করল না, অথচ ভাগ্নে-ভাগ্নীগুলো চাকরি নিয়ে বিয়ে করে সব ড্যাং-ড্যাং করে চলে গেল ইণ্ডিয়ায়, এখন তাকে দেখবে কে?–বুলাকে এত ভালোবাসত, এত যত্ন করে গান শিখিয়েছে, বলত, তুই কোনোদিন গান ছাড়িস না।–সুনীলদা যদি শোনে যে বুলা গান ছেড়ে দিয়েছে তো এত কষ্ট পাবে। জাহাঙ্গীর ভাবে, কেন? বুলা গান ছাড়বে কেন? বুলাকে তার বলতে ইচ্ছা করে, তুমি গান শিখতে চাও, শেখো। যতো টাকা লাগে আমি রোজগার করে আনব। দরকার হলে কোথাও পার্ট-টাইম কাজ নেব। দেশের বেস্ট ওস্তাদকে রেখে দেব। তোমার কথা এত মিষ্টি, এই কথায় সুর দিলে না জানি কী সৃষ্টি হবে—কিন্তু এসব কথা বলাটা মুশকিল। এ ছাড়া মেডিক্যাল কলেজের গেটও এসে পড়ে। দোতলায় ওয়ার্ডের এককোণে নাকে অক্সিজেনের পাইপ-গোঁজা রোগা সুনীল সেনগুপ্তকে দেখে জাহাঙ্গীরের বুক উথলে ওঠে। হায় রে, মানুষটা একেবারে নি—সঙ্গ শুয়ে রয়েছে! বুলা পায়ে হাত রেখে সালাম করলে জাহাঙ্গীরও নি—শব্দে তাকে অনুসরণ করে। সুনীল সেনগুপ্ত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে মুশতাক এসে পড়ে, তার হাতে ফ্লাস্ক। মুশতাক ঝুঁকে বলে, দাদা, বুলার হাজব্যাণ্ড, চিনতে পেরেছেন? সুনীলদার ঠোঁট কাঁপে, ঠোঁটে হাসির চিকন একটি রেখা তৈরির চেষ্টা তার ব্যর্থ হয়।

নার্স এসে টেম্পারেচার নেয়, খাটের মাথায় ঝোলানো চার্টে লেখে। স্ট্যান্ডে ঝোলানো ব্যাগ থেকে নল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা স্যালাইন ঢুকছে সুনীলদার হাতের শিরায়। জাহাঙ্গীর টুলে বসে চুপচাপ দেখে। অন্য হাতের তালুতে জাহাঙ্গীর একটা হাত রাখে। সুনীলদার হাত ও আঙুল একটু একটু কাঁপে। আঙুল দিয়ে লোকটা জাহাঙ্গীরকে কী বলছে? হয়তো বলছে, ‘বুলার গলা একেবারে তৈরি, গান ওর রক্তের মধ্যে। তুমি দেখো।’—জাহাঙ্গীরের চোখ ছলছল করে। আস্তে আস্তে উঠে দেখে, বুলা কিংবা মুশতাক ঘরে নেই। কোথায় গেল? মস্ত বড়ো ওয়ার্ডের এ-মাথা থেকে ও-মাথা—কোথাও নেই। পেছনের দিককার বারান্দায় বুলার শাড়ি দেখা যাচ্ছে। জাহাঙ্গীর বারান্দায় যায়। রেলিঙে ঝুঁকে দুজনে কাঁদছে। জাহাঙ্গীরকে দেখে বুলা কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘সুনীলদার গলায় ক্যান্সার। বাঁচবে না।’ মুশতাকও রুমাল দিয়ে চোখ মোছে, ক্যান্সার প্রথম দিকে ধরা পড়লেও ট্রিটমেন্ট করা যেত। সেবার কুমিল্লা গেলাম, কত বললাম, সুনীলদা, ঢাকায় চলেন। ভালো করে ডাক্তার দেখান। না—একটা ভালো ছেলে পাওয়া গেছে, গলাটা এত মিষ্টি। ওকে একটু দেখিয়ে দিয়ে তারপর যাব। এখন এসে কী লাভ হলো?’ বুলাও কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘কেন? আমাদের একটা দিন কামাই দিতে দিত না। মুশতাক ভাই, মনে নাই?’ –জাহাঙ্গীরের ছলছল চোখ থেকে জল বাষ্প হয়ে উড়ে যায়, চোখ বড়ো-বড়ো করে সে এদের একই বেদনা ও একই স্মৃতির ছোঁয়াছুঁয়িটা দেখে, তার চোখ খটখটে হয়ে আসে। হঠাৎ পকেটে হাত দিয়ে কী মনে পড়ে তার, বলে, ‘বুলা ভুল কইরা আমার অফিসের চাবি নিয়া আসছি। যাই, পিওনটারে দিয়া আসি। না হইলে কাল ওরা বিপদে পড়বে।’

মুশতাক ও বুলার নীরব কান্না অব্যাহত থাকে। জাহাঙ্গীর ফের বলে, ‘মুশতাক সাহেব কষ্ট কইর‍্যা বুলারে একটু পৌঁছাইয়া দেবেন।’

বুলা বলে, ‘চলো, আর দশ-পনেরো মিনিট পরে একসঙ্গে যাই।’

‘না-না, উনারে একলা ফালাইয়া যাইবা? থাকো না, কিছুক্ষণ থাকো।

‘ছ’টার পরে থাকতে দেবে না, চলো।’

‘আরে রাখো! কে থাকতে দেবে না?’ জাহাঙ্গীরের আবার কলেজের অ্যাথলেটিক সেক্রেটারি হয়ে যাবার উপক্রম হয়, ‘ক্যাঠায় কী কইবো? আমি মেট্রনরে বইলা যাই।’

ভেসপায় স্টার্ট দিতে দিতে জাহাঙ্গীর শিস দেয়, হাম-তোম এক কামরেমে বন্দ হ্যায় আওর চাবি খো যায়–হাতের মুঠোয় স্পীড দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে চলে আসে মতিঝিল। অফিসের কথাটা যখন বলেছে এদিকে এবার ঘুরে যাওয়াটা উচিত। অফিসের সামনে একটা চক্কর দিয়ে বাঁদিকে গিয়ে স্টেডিয়ামের পিছন দিয়ে বায়তুল মোকররমের পেছনটাকে বাঁয়ে রেখে জাহাঙ্গীরের ভেস্পার চাকাজোড়া মোড় নিল বিজয়নগরের রাস্তায়। এই রাস্তায় শেষ মাথায় ট্রাফিক সিগনালের লাল আলো জ্বলে উঠলে জাহাঙ্গীর ভেস্পা থামায়। এটার দরকার ছিল না, কারণ সে তো যাচ্ছে বাঁদিকে। তবে ধীরে-সুস্থে যাওয়াই ভালো। কাকরাইলের মোড় ঘুরে শান্তিনগর চৌরাস্তায় এসে সিগন্যালে নীল আলো থাকা সত্ত্বেও ওর স্পীড একেবারে জিরোতে নামে। তবু মালীবাগের পুলিশবক্স এসে পড়ে। পুলিশবক্সের একটু সামনে গিয়ে জাহাঙ্গীর ভেপা থামিয়ে রাস্তায় নামে। পুলিশবক্সের বারান্দায় কেউ নেই। ভেতরে? না, ভেতরে কোনো মহিলা-পুলিশ নেই। তার শরীরে স্বস্তির হাওয়া ‘কী খেলে। তবু ভালো করে দেখা দরকার। বারান্দায় উঠলে একজন পুলিশ বলে, ভাই?’ জাহাঙ্গীর বলে, ‘টেলিফোন করব।’ ‘টেলিফোন নষ্ট।’ জানলা দিয়ে ভেতরটা ভালো করে দেখে জাহাঙ্গীর ভেসপায় ফেরে। না—ভালোই হলো। মেয়েটা থাকলেই বা কী হতো? ওর সঙ্গে জীবনে কোনদিন সে কথাও বলেনি। এর মধ্যে একদিন এদিক দিয়ে যাবার সময় দেখে কি, আরো কয়েকজন মহিলা-পুলিশের সঙ্গে ট্রাকে ওঠার সময় তার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। তা তো হতেই পারে। যারা কলেজে তাকে হিপ হিপ হুররে বলে সাউন্ড মারত জাহাঙ্গীর তাদের একজন গৌণ সদস্য ছিল। তো, এখন দেখা হলেই বা তাকে কী বলত? কলেজে থাকতেই কথা বলা হলো না, আর অ্যাদ্দিন পর এখন সে কী বলবে? তা বলতে পারত, আমাকে চিনলেন না? এখনো কি মস্তান পোলাপানের দলে পেছনে দাঁড়িয়ে মেয়েদের টিটকারি দেন নাকি? এখন কিন্তু আমি অ্যারেস্ট করতে পারি জানেন?’ তা অ্যারেস্টেড হতে ওর আপত্তি কী? তারপর ওরা না হয় ট্রাকের ওপর উঠেই কিছুক্ষণ গল্প করত। আর কিছু না হোক বাংলার ইয়াসিন স্যারের তোতলামো নিয়ে হাসাহাসি করতে পারত। না, এতকাল পর ইয়ার্কি ফাজলামো ভালো না। ঠিক আছে, তাহলে ওদের হিষ্ট্রি পড়াতেন আজম সাহেব, খুব ভালো পড়াতেন, লোকও খুব ভালো, বছরখানেক হলো মারা গেছেন, তাঁকে নিয়ে মন খারাপ করতে কী আপত্তি ছিল? আজম সাহেব কীভাবে মারা গেছেন? মনে হয় ক্যান্সার হয়েছিল। ক্যান্সার? কোথায়? বোধহয় গলায়। ট্রাকের রেলিঙে ঝুঁকে দুজন কথা বলত, দুজনের চোখে জল, নিজের শরীরের দিকে স্যারের কোনো খেয়াল ছিল না। তোমার মনে নাই হিপ-হিপ–দুর নামটাও মনে নেই। —নাঃ হলো না। তারা একসঙ্গে মন খারাপ করবে কী নিয়ে? জাহাঙ্গীরের ভেস্পা চলছে ভোঁ ভোঁ করে। রেলগেট বন্ধ বলে ব্রেক কষতে হয়। আরে মহাখালি এসে গেছে! তাহলে গুলশান-বনানীটা একবার ঘুরে আসা যাক।— গুলশান-বনানীর ছোট-বড়ো রাস্তাগুলো ছবির মতো পেছনে সরে যায়। কিন্তু শাহীন না শাহনাজ–বুলাকে সে কোন্ নামটা যেন বলেছে—তার বাড়ি তো তার চেনা নেই। মেয়েটাকে একদিন দেখেছিল স্টেডিয়ামে। একদিন কি দুদিন। খালেক ভাই দেখিয়ে দিয়েছিল, ‘শটপুটে এবার মেয়েদের মধ্যে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ান হবে, দেখিস।’ আরেকদিন খালেক ভাই আর কাউকে, না তাকে নয়, বলেছিল, ‘আরে ওরা বাড়িতেই প্র্যাকটিস করে। গুলশানে বিরাট বাড়ি, সবরকম খেলার অ্যারেঞ্জমেন্ট আছে।’—তা কোন্ বাড়ি, কার বাড়ি, কত নম্বর রোড, কত নম্বর প্লট—কিছুই জানে না। দাঁড়াবে কোথায়? –সুতরাং অ্যাবাউট টার্ন।—দুই নম্বর মার্কেটের সামনে ছয়নম্বর বাস; এই বাসে করেই না জাহাঙ্গীর পালিয়ে গিয়েছিল ওর নাছোরবান্দা প্রেমিকার বাড়ি থেকে। সুতরাং এই বাসের পেছনে সে ভেস্পা চালায়। বাস যেখানে দাঁড়ায়, সেও একটু দাঁড়ায়। কিন্তু পুরনো এয়ারপোর্টের কাছাকাছি এসে ধৈর্য থাকে না। বাসটাকে ওভারটেক করে চলে যায়। একটু দূর থেকে ফার্মগেটের ওভারব্রীজের গায়ে লেখা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। কিন্তু একটি বর্ণও তার মাথায় ঢোকে না। হঠাৎ করে স্পীড বাড়িয়ে মগবাজার দিয়ে মালিবাগ এসে পড়ে। না, পুলিশবক্সের সামনে দাঁড়িয়ে লাভ কি? মেয়েটার নামটাও যদি মনে রাখত! তবে? সুতরাং ভেসপার চাকাজোড়া তার কেবল গড়িয়েই চলে।

রচনাকাল : ১৯৭৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *