রূপনগরের পিশাচিনী

রূপনগরের পিশাচিনী

বসন্তকালের এক বিকেলে একটি ট্যাক্সি এসে থামল রূপমঞ্জরীর মূল গেটের সামনে৷ ট্যাক্সি থেকে বেরিয়ে এল এক অপূর্ব সুন্দরী তরুণী৷ দীর্ঘাঙ্গী এবং তন্বী৷ ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে লম্বা শ্বাস নিল সে৷ ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহের বিকেলের হাওয়ায় আমের বোলের গন্ধ মেশানো থাকে৷ মেয়েটি বেশ কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস টানল৷ এই গন্ধ তাকে বরাবর পাগল করে দেয়৷ তার পরনে ডেনিম ব্লু জিন্স আর রেড কুর্তি৷ পিঠে কিটব্যাগ, হাতে ট্রলির হাতল৷ রূপমঞ্জরীর বিশাল উঁচু পাঁচিল আর মস্ত গেটের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল সে৷ তারপর আবার একটি শ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেল ওই গেটের সিকিউরিটি গার্ডের দিকে৷

কলকাতা শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে গড়ে উঠেছে আরেকটি শহর৷ নাম রূপনগর৷ রূপে, আভিজাত্যে সে প্রতিদিন গুনে গুনে দশ-বিশ গোল দেয় কলকাতাকে৷ যেমনই ঝকঝকে তার চেহারা তেমনই সুযোগ-সুবিধা৷ বছর কুড়ি আগে এই জায়গাটা ছিল জলাভূমি, বিস্তীর্ণ প্রান্তর, জনহীন৷ কয়েকঘর চাষি আর কিছু চাষের ক্ষেত, প্রচুর শেয়াল, ভাম, সাপ, বেজি ইত্যাদি মিলে চলে যাচ্ছিল বছরের পর বছর৷ তারপর মানুষ কলকাতামুখী হতে হতে একদিন দেখা গেল তিলোত্তমায় আর তিল ধারণের জায়গাটুকুও নেই৷ সরকার ভাবল এবার বিকল্প খুঁজতে হবে৷ বিকল্প নগরের জন্য জায়গা ঠিক হল এই জলাভূমি৷ শুরু হয়ে গেল কাজ৷ জলের ওপর মাটি পড়তে থাকল, আর তার তলায় চাপা পড়তে থাকল সাপ, বেজি, ভাম, আলু, ফুলকপি, পুরোনো কিছু ইতিহাস৷ পালাতে থাকল ওখানে থাকা মানুষেরা, শেয়ালেরা৷ হুড়মুড় করে গড়ে উঠতে থাকল আকাশ-ছোঁয়া সব বিল্ডিং, বহুজাতিক সংস্থার ঝাঁঝালো অফিস, কালো অজগরের মতো পিচ রাস্তা, নিখুঁত সাজানো উদ্যান, উড়ালপুল, মেট্রোরেল, মল, হসপিটাল ইত্যাদি আরও যা যা সভ্য জগতের মানুষের প্রয়োজন হয় সবকিছুই তৈরি হয়ে গেল এখানে৷ এই শহরের প্রবেশপথে বিশাল এক গেট সেখানে লেখা ‘রূপনগরে আপনাকে স্বাগত’৷ প্রতিদিন দুইবেলা মানুষ আসতে শুরু করল, থাকতে শুরু করল, বাঁচতে শুরু করল রূপনগরে৷ দেখতে দেখতে রূপনগর পার করে ফেলল তিরিশটি ঋতুচক্র৷ দিন যায়, কলকাতার বয়স বাড়তে থাকে আর ততই মোহময়ী হয়ে উঠতে থাকে গোটা দেশের বিস্ময় এই স্বপ্ননগরী৷

মেয়েটি এগিয়ে গেল সিকিউরিটি গার্ডের দিকে৷ দশাসই চারজন গার্ড৷ গার্ড না বলে প্রহরী বললেই ভালো৷ কারণ প্রত্যেকেই সেই প্রাচীন ভারতবর্ষের রাজা- রাজড়াদের দ্বারীদের সাজে৷ রূপমঞ্জরীর মূল আকর্ষণই এটা৷ প্রহরীরা রোবটের মতো স্থির৷ মেয়েটি একজন গার্ডকে বলল, মিস রেহানার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল৷

ম্যাম, আপনি ওইদিকে চলে যান৷ বাংলাতেই উত্তর দিল গার্ড৷

গার্ডের ইশারা অনুসরণ করে মেয়েটি গেল ওই ফটকের এক কোণে সিকিউরিটি অফিসের জানলার সামনে৷ গিয়ে আবারও বলল, আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল মিস রেহানার সঙ্গে৷

সিকিউরিটি অফিসার ইংরেজিতে বললেন, ম্যাম অ্যাপয়েন্টমেন্ট নাম্বারটা বলবেন, প্লিজ?

নিশ্চয়ই৷ বলে মেয়েটি তার মোবাইল থেকে একটি আট ডিজিটের কোড বলার পর সিকিউরিটি অফিসার ভেরিফাই করার জন্য তার নাম জিজ্ঞাসা করলেন৷

রূপসা দাশ৷

থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম৷ আপনার একটা আইডি দেখাবেন?

মেয়েটি তার পার্স থেকে বার করল ভোটার কার্ড৷

সিকিউরিটি অফিসার কার্ডটা একবার দেখে, মেশিনে স্ক্যান করে একটা কপি রেখে দিলেন তাঁর কম্পিউটারে৷ তারপর পেশাদারী হাসি দিয়ে বললেন, ম্যাম, রূপমঞ্জরী আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে৷ অনুগ্রহ করে ভেতরে আসুন৷

ধন্যবাদ৷ বলে রূপসা কার্ডটা পার্সে ভরল৷ সিকিউরিটি অফিসের ঠিক গায়ে লাগানো ছোট আরেকটি গেট৷ সেই অটোমেটিক দরজা খুলে যাওয়ার পর রূপসা সবে ঢুকতে যাবে হঠাৎই কোথা থেকে ছুটে এল এক মহিলা৷ চিৎকার করে উঠল, যাস নে, যাস নে৷ মরবি, মরবি বলে দিচ্ছি…

চমকে উঠে তার দিকে তাকাল রূপসা৷ বীভৎস তার রূপ৷ গোটা শরীরে দগদগে ঘা, শতচ্ছিন্ন, ময়লা একটা শাড়ি কোনও-মতে শরীরে জড়ানো৷ সেই শাড়ির ফাঁক দিয়েও উঁকি দিচ্ছে তার অঙ্গের গলিত কুৎসিত ক্ষত৷ ওহ! কী দুর্গন্ধ! গা ঘুলিয়ে উঠল রূপসার৷ পচে মরবি হারামজাদি৷ পালা পালা…বলে রূপসাকে ধরতে গেল সেই বিস্ফারিত রক্তচক্ষু, রুক্ষ, শণের মতো চুল, লোলচর্ম বৃদ্ধা৷

রূপসা সরে আসার আগেই সেই উন্মাদিনীকে ঘিরে ফেলল কয়েকজন গার্ড৷ তারপর লাঠি তুলে ভয় দেখিয়ে, খুঁচিয়ে, দুই-তিন ঘা দিয়ে দূর করল তাকে৷

খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল রূপসা এমন অতর্কিত হানায়৷ বুক ঢিপঢিপ করছিল৷

চিৎকার করতে করতে আবার তেমনই রূপনগরের রাস্তায় দৌড়তে দৌড়তে মিলিয়ে গেল সে৷

সরি ম্যাম, প্লিজ আসুন৷ সিকিউরিটি চেকিং-এর ঘরে ডাক পড়ল রূপসার৷ লেডি সিকিউরিটি গার্ড রূপসার গোটা শরীরে মেটাল ডিটেকটর ঠেকিয়ে যখন রূপসা নিরাপদ কি না বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন ওর তখন আচমকাই মনে পড়ছিল দীপুদার কথা৷ দীপুদা যখন ওর পুরুষযন্ত্রটি রূপসার গোটা শরীরে এইভাবে ছোঁয়াত, রূপসার মনে হত দীপুদা ওইভাবে বুলিয়ে যেন কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে৷ হাসি পেল ওর৷

থ্যাঙ্ক ইউ, ম্যাম৷ আপনার লাগেজ এখানে রেখে যান৷ আমরা পৌঁছে দেব৷ আর অনুগ্রহ করে আপনার সঙ্গে থাকা সবরকম ইলেকট্রনিক গ্যাজেট এবং গয়না ও টাকাপয়সা জমা করে দেবেন৷ আশা করি, আপনাকে এই ব্যাপারে আগেই জানানো হয়েছে৷

হ্যাঁ নিশ্চয়ই৷ বলে সবকিছু একে একে বার করে সামনে ডেস্কে রাখল রূপসা৷

গার্ড বললেন, ম্যাডাম আপনার হাতঘড়িটিও…

ও নিশ্চয়ই৷ রিস্টওয়াচটাও খুলে রাখল রূপসা৷ আই ফোন আর র‌্যাডোর ঘড়িটা রাখতে মন হু হু করে উঠছিল৷ দুটোই বড্ড প্রিয়, ফোনটা কিনেছিল নিজের টাকায় আর ঘড়িটা পেয়েছিল সুরজিত সিং নামের এক ক্লায়েন্টের কাছ থেকে৷

জিনিসগুলোর ছবি তুলল গার্ড, তারপর রূপসাকে দাঁড় করিয়ে ওই জিনিসগুলো সমেত আবার ছবি তুলল৷ কম্পিউটারে এন্ট্রি করে নিয়ে বলল, ধন্যবাদ ম্যাডাম৷

আচ্ছা৷ রেহানা ম্যামের কাছে কীভাবে যাব?

আপনাকে হেঁটে যেতে হবে না৷ ওই গাড়িতে বসে যান, আপনাকে পৌঁছে দেবে৷

রূপসা দেখল একটি ঘোড়ার গাড়ি ওর জন্য অপেক্ষা করছে৷ গাড়ি বলা ভুল হবে৷ বলা ভালো রথ৷ এবং গাড়ির চালক, ঘোড়া এবং সেই রথটি টিভিতে দেখা রামায়ণ- মহাভারতের স্টাইলে সাজানো৷ আবার হাসি পেল রূপসার৷ সেই রথে উঠে বসল৷ চলতে শুরু করল সেই ঘোড়ার গাড়ি৷ সারথির পোশাকেও বলা বাহুল্য সেই প্রাচীনত্বের ছোঁয়া৷ রঙিন ধুতি, উত্তরীয়, মাথায় বাহারি রঙের পাগড়ি, কানে মাকড়ি, দুই হাতে বালা৷ ছমছম শব্দ করতে করতে লাল মোরামের রাস্তা দিয়ে মৃদু লয়ে ছুটছিল ঘোড়ার গাড়ি৷ রূপসা মুগ্ধ হয়ে দেখছিল চারিদিক৷ একশো বিঘা জমির মধ্যে এ যেন একটুকরো অন্য ভারতবর্ষ৷ প্রাচীন ভারতকে ফিরিয়ে আনা৷ লাল রাস্তার দুই ধারে অপরূপ ফুলের বাগান, ময়ূর ঘুরছে, হরিণের পাল চরছে নির্ভয়ে৷ মস্ত দিঘিতে ফুটে রয়েছে পদ্ম, রাজহাঁস ঘুরছে৷ সার সার নৌকো বাঁধা রয়েছে ঘাটে৷ সেই নৌকোও কারুকাজমণ্ডিত৷ ঢালু মাঠগুলি কচি সবুজ ঘাসে ঢাকা৷ কোথাও আমবাগান, কোথাও গ্ল্যাডিওলাসের ঝাঁক৷ রূপসা মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল৷ রূপমঞ্জরী যে এমন সুন্দর জায়গা হতে পারে তা ওর কল্পনাতীত ছিল৷ গাড়ি চলছিল৷ পথে বেশ কয়েকটি বিদেশি ট্যুরিস্টের দলকেও দেখল৷ ইতস্তত তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ সাদা ধুতি, পাঞ্জাবি এবং পাগড়ি পরা গাইড ইংরেজিতে স্থান মাহাত্ম্য বোঝাচ্ছে৷ বাগান, দিঘি ইত্যাদি পেরোনোর পর শুরু হল খড়ে ছাওয়া ছোট ছোট মাটির বাড়ি৷ প্রতিটি বাড়ির সামনে নিকনো ছোট উঠোন, ফুলের বাগান৷

এই জায়গাটা কত বড়? সারথিকে জিজ্ঞাসা করল রূপসা৷

একশো বিঘা৷ সংক্ষেপে ইংরেজিতে উত্তর দিল সারথি৷

বাপ রে! রূপনগরের এই রূপমঞ্জরীর বিশাল এলাকা৷ তবে এখানে ইচ্ছে হলেই এসে ঘুরে বেড়ানো যায় না৷ অনেক ব্যাপার-স্যাপার রয়েছে৷ কেন কে জানে…ওর আবার মনে পড়ল সেই পাগলিটার কথা৷ কোথা থেকে ছুটে এল আর এমন ভয়ঙ্কর কথা কেন বলছিল? যাসনে, যাসনে, মরবি, পচে মরবি…কে ও? রূপসার মনে পড়ল গার্ডগুলো যখন ওকে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে ভাগানোর চেষ্টা করছিল তাদের মধ্যে একজন বলে উঠেছিল, আবার এসেছিস? দাঁড়া, এবার তোর পারমানেন্ট ব্যবস্থা করতে হবে৷

আবার এসেছিস মানে আগেও এসেছে এই পাগলি৷ গার্ডরা চেনে৷ কে জানে কে? অবশ্য পচে মরার জন্য রূপমঞ্জরীতে পা দেয়নি রূপসা৷ বরং সেখান থেকে বাঁচার জন্যই এখানে আসা৷

ঘোড়ার গাড়ি অনেক দূর চলার পর যেখানে থামল সেখানে আরেকটি ফটক৷ এবং এলাকাটি উঁচু পাঁচিলে ঘেরা৷ অদ্ভুত ব্যাপার৷ গেটের ভেতর আবার গেট! রথ থামতে সেই দরজা খুলে দিল দুই প্রহরী৷ একেবারেই বাহুবলী সিনেমার সৈনিকের সাজ৷ প্রহরীদ্বয়কে সম্ভবত আগে থেকেই নির্দেশ দেওয়া ছিল, সে কারণে কোনও জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই গাড়ি ঢুকে গেল গড়গড়িয়ে৷ এবারে আবারও বিস্ময়ের পালা৷ হাঁ হয়ে গেল রূপসা৷ মনে হল, কোনও সিনেমার সেটের ভেতর ঢুকে গিয়েছে যেখানে প্রাচীন ভারতবর্ষের এক শহরের সেট তৈরি৷ কী নিখুঁতভাবে গড়া এই নগরী৷ প্রতিটি বাড়ি যেন পাথর কুঁদে গড়া৷ অসামান্য সব ভাস্কর্য বাড়িগুলির গায়ে, পথের দুইপাশে৷ সব ভাস্কর্যই নারী ও পুরুষের মিলনভঙ্গি৷ খাজুরাহোর কথা মনে পড়ল রূপসার৷ না, কোনওদিন নিজে চোখে দেখেনি, তবে ছবিতে, বইতে জেনেছে৷ তবে এখানে মানুষ নজরে পড়ছে না৷ কেমন যেন মৃত নগরী৷ সারথিকে জিজ্ঞাসা করে জানার উপায় নেই৷ কারণ উত্তর মিলবে না৷

অবশেষে গাড়ি থামল একটি বাড়ির সামনে৷ বাড়িটি একতলাই কিন্তু উচ্চতায় দোতলা কিংবা তারও বেশি৷ সামনে বড় বড় ধাপের পাথুরে সিঁড়ি, শেষে চওড়া বারান্দা, বিশাল লম্বা-চওড়া কয়েকটি খিলান, সেখানেও ভাস্কর্য খোদাই৷ রূপসা ভাবছিল এমন একটি জায়গা নিজে চোখে না দেখলে সত্যিই বিশ্বাস করা কঠিন৷ কত কোটি টাকা খরচ করে এই নগর নির্মাণ হয়েছে কে জানে! যা হোক এবার যে উদ্দেশ্যে আসা সেটা হলেই ভালো৷ কে জানে…৷

চালক রূপসাকে বলল, ম্যাডাম আপনি সোজা গিয়ে ডানদিকের প্রথম ঘরে ঢুকে যাবেন৷ ওখানেই রেহানা ম্যাডাম বসেন৷ বাইরের ঘরে ওঁর সেক্রেটারি বসেন৷ ওঁকে গিয়ে বলুন৷

আচ্ছা৷ বলে নামল রূপসা৷ তারপর ওই চওড়া সিঁড়িগুলো পার হয়ে পৌঁছল নির্দিষ্ট ঘরটিতে৷

যেমনটি আশা করা গিয়েছিল তেমনই প্রাচীন সাজে সজ্জিত ঘরখানি৷ তবে প্রাচীনত্বের আড়ালে যে আধুনিকতা লুকিয়ে রয়েছে সেটা টের পাওয়া গেল এয়ারকন্ডিশনের ঠান্ডা হাওয়ায়৷ এসি মেশিনটা দেখা যাচ্ছে না ঠিকই কিন্তু তার শীতলতা দিব্যি ঘরময় বিরাজমান৷ ঘরে একজন সুবেশা মহিলা বসেছিলেন সিংহাসন ধরনের একটি চেয়ারে৷ বলা বাহুল্য তাঁর সাজও প্রাচীন ভারতীয় রমণীর৷

মহিলা মিষ্টি হেসে রূপসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বলুন, আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

মহিলার ইংরেজি অ্যাকসেন্ট তুখোড়৷ এখানে কথাবার্তা ইংলিশেই চালাতে হবে, রূপসা বুঝে গিয়ে বলল, মিস রেহানার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল৷

অনুগ্রহ করে আপনার কোড নাম্বারটা বলবেন?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই৷ রূপমঞ্জরী থেকে পাঠানো এস এম এস থেকে কোড নাম্বারটা বলল রূপসা৷

দয়া করে অপেক্ষা করুন, আমি এখনই খবর দিচ্ছি৷ বলে মহিলা তাঁর টেবিলের আড়ালে রাখা ফোন তুলে ওই কোড নাম্বার উল্লেখ করে কারও সঙ্গে কথা বললেন৷ তারপর ফোন নামিয়ে রেখে রূপসাকে বললেন, আপনি একটু বসুন, ম্যাডাম আপনাকে ডেকে নেবেন৷

আচ্ছা৷ বলে ঘরের একপাশে রাখা চেয়ারে বসল রূপসা৷ মিনিট দুয়েকও গেল না৷ সেতারের সুর বেজে উঠল ওই রিসেপশনিস্টের টেবিলে৷ ফোন তুলল সেই সেক্রেটারি৷ আচ্ছা ম্যাডাম৷ বলেই ফোন রেখে দিল৷ তারপর রূপসার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আসুন, ম্যাডাম ডেকেছেন৷

উঠে দাঁড়াল রূপসা৷

এদিকে আসুন, বলে সেক্রেটারি ঘরের ডানদিকের দেওয়ালের একটি স্থানে ঠেলা দিতেই একটা দরজার মাপে ফাঁক হয়ে গেল দেওয়ালের নির্দিষ্ট অংশ৷ রূপসা ভাবতেও পারেনি যে এই দেওয়ালের মধ্যেই মিশে রয়েছে দরজা৷ কোনও হাতলও নেই৷ শুধুই চমক৷

ভেতরে যান৷ ম্যাম রয়েছেন৷

ভেতরে ঢোকামাত্র চমকে উঠল রূপসা৷ এ যেন কোনও রাজা-বাদশাহর সভাকক্ষ৷ কী অসামান্য কারুকাজ! দেওয়ালে, ছাদে! পুরোটাই শ্বেতপাথরের ওপর কল্কা৷ রূপসার এক মুহূর্তে মনে পড়ল অনেককাল আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে আগ্রা ফোর্ট দেখতে যাওয়ার স্মৃতি৷ সেখানেও একটি অংশ ছিল এমনই শ্বেতপাথরের৷

আসুন, বসুন৷ রিনরিনে কণ্ঠে আপ্যায়ন করলেন যিনি তাঁর দিকে তাকিয়ে চোখেও ধাঁধা লেগে গেল৷ কী অপরূপ সুন্দরী! ইনিই রেহানা! এ যে ঊর্বশী, মেনকাকেও হার মানায়! একবার তাকালে আর চোখ ফেরানো যায় না এমন রূপের ছটা৷ ঘরের ভেতর আলোর পরিমাণ কম৷ প্রদীপের শিখার মতো হলদেটে আলো৷ মৃদু লয়ে সেতার বাজছে৷ গোলাপের গন্ধ৷ একটিও আধুনিক আসবাব নজরে আসছে না৷ তবে তিনি যে বিশাল টেবিলটির ওপারে বসে রয়েছেন সেই টেবিলের আড়ালে একটি কম্পিউটার রয়েছে বোঝা যাচ্ছে, কারণ তার আলো এসে পড়ছে রেহানার চোখে-মুখে৷ মহিলা অতীব ফর্সা এবং তেমনই সুন্দরী৷ সেজে রয়েছেন রাজরানির মতো৷ মনে হচ্ছে দক্ষিণী ছবির নায়িকা৷

রূপমঞ্জরীতে আপনাকে স্বাগত, রূপসা৷ কেমন রূপে রূপে মিলে গিয়েছে দেখুন, বলে খিলখিল করে হেসে উঠলেন রেহানা৷

রূপসা দেখল রেহানার দাঁত ঠিক যেন টগর ফুলের কুঁড়ির সারি৷ একে অসামান্য ফর্সা, তার ওপর এমন মাখনের মতো ত্বক যে হলুদ আলো গায়ে পড়ে পিছলে যাচ্ছে৷ কাঁধ, গলা, দুই বাহুতে চিকচিক করছে আলোর কণা৷

নাকে হিরের নথটি সামান্য ঠিক করে নিয়ে রেহানা বললেন, আচ্ছা রূপসা, আপনার সঙ্গে তো শেষ সাক্ষাৎকারে এখানকার সব শর্তের কথা হয়েই গিয়েছিল৷ আশা করি আপনি সেগুলিতে রাজি হয়েই এসেছেন৷

হ্যাঁ ম্যাম, আমি রাজি৷

বেশ৷

কথার মাঝেই ঘরে প্রবেশ করল একটি যুবতী মেয়ে৷ সুন্দরী নয়, তবে লাস্যময়ী অবশ্যই৷ মেয়েটির হাতে একটি রুপোর ট্রে৷ সেখানে একটি রুপোর লম্বা গ্লাস বসানো৷ মেয়েটি এসে ট্রে-সমেত সামান্য ঝুঁকল৷ রূপসা একটা গ্লাস তুলে নিল৷ হ্যাঁ, এটাও রুপোর গ্লাস৷ বেশ ঠান্ডা৷ ভেতরে সাদা তরল৷ ওপরে ঘন সাদা কিছুর ক্কাথ৷ দুটি গোলাপ ফুলের পাপড়ি ভাসছে৷ মেয়েটি চলে গেল৷ গ্লাসে চুমুক দিল রূপসা৷ আহ কী স্বাদ! কেশর বাদাম সরবত৷ ওপরে মালাই ভাসছে৷ পুরো গ্লাসটা ঢকঢক করে খেয়ে নিল রূপসা৷ গ্লাস রেখে দিল ট্রে-তে৷

রেহানা বলল, বেশ, তাহলে আপনি এখন আপনার ঘরে যান৷ চন্দ্রাবলী আপনাকে ঘর দেখিয়ে দেবে৷ আজ এইবেলা আপনি বিশ্রাম নিন৷ ইচ্ছে হলে রূপমঞ্জরী ঘুরেও দেখতে পারেন৷

রূপসা বুঝল চন্দ্রাবলী আসলে এই শরবত নিয়ে আসা মেয়েটির নাম৷

রূপসা উঠল৷ দুই হাত জড়ো করে নমস্কার জানাল রেহানাকে৷ তারপর চন্দ্রাবলীর সঙ্গে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল৷

প্রধান অফিস বিল্ডিঙের পিছনে একটি দরজা৷ সেই দরজা ঠেলে ঢুকতেই চোখে যেন ধাঁধা লেগে গেল৷ এ কী! এ যে অবিশ্বাস্য! দেখে মনে হচ্ছে প্রাচীন ভারতবর্ষের একটি খণ্ডকে কোনও দানব তুলে নিয়ে এসে এখানে বসিয়ে দিয়েছে৷ বেশ অনেকগুলি খড়ে ছাওয়া মাটির ঘর৷ ভারী সুন্দর করে সাজানো৷ প্রতিটি ঘরের সামনের দেওয়ালে দেবনাগরী অক্ষরে নাম খোদাই করে লেখা৷ কোনওটি কলাবতী, মোহিনী, রত্নাবলী, পদ্মিনী৷ প্রতিটি ঘরের মধ্যে দূরত্বও যথেষ্টই৷ তকতকে মাটির উঠোন, উঠোনের মাঝে নানা রঙের ফুলের বাগান৷ ঘরগুলির মাটির দেওয়ালেই বিচিত্র সব ছবি৷ সবই প্রাচীন স্টাইলে আঁকা মিথুন৷ মজা লাগল রূপসার৷ চন্দ্রাবলীকে জিজ্ঞাসা করল, এই ঘরগুলোতে কারা থাকে?

আপনার মতো অনেকে থাকেন৷ আসুন, আপনার ঘরটি দেখিয়ে দিই৷

গ্রামের মাটির বাড়িগুলি যেমন হয়, অবিকল তেমনই এই ঘরগুলি৷ ঘরের সামনে একধাপ সিঁড়ি, তারপর তকতকে দালান৷ যে ঘরটির সামনে এসে দাঁড়াল চন্দ্রাবলী সেই ঘরের দেওয়ালে লেখা রূপসা৷ আরে বাহ! মানে আগেই ঘর অ্যালট হয়ে গিয়েছে!

মোটা কাঠের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল চন্দ্রাবলী৷ এই কিছুক্ষণের অভিজ্ঞতায় ঘরের ভেতরটাও যেমন হতে পারে আন্দাজ করে নিয়েছিল, তার থেকেও বেশি৷ ঘরের ভেতরে ঠান্ডা হাওয়ার আভাস৷ বোঝাই যাচ্ছে এসি চলছে কিন্তু সেটা লুকোনো৷ মস্ত চওড়া একটি কাঠের পালঙ্ক৷ মখমলি চাদর পাতা৷ দুইটি বালিশ৷ কাঠের কেয়ার করা বেডসাইড টেবিলে হাঁসের গলার মতো প্যাঁচানো লম্বা নলওলা পিতলের জগ৷ দুটি স্ফটিকের পানপাত্র এবং গেলাস৷ ঘরের একপাশে একটি সুদৃশ্য ফুলদানিতে রজনীগন্ধার স্টিক আর মেঝেতে জলভরা বেশ বড় মাপের একটি পিতলের গামলায় পদ্ম, জুঁই ইত্যাদি ফুল ভাসছে৷ ঘর সুবাসিত হয়ে রয়েছে এই নানা ফুলের সমারোহে৷ বিছানাটা এত সুন্দর যে দেখেই শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করল রূপসার৷ খাটের পাশে ওর পেল্লায় ট্রলিব্যাগটা রাখা রয়েছে৷ আগেই পৌঁছে গিয়েছে ব্যাগ৷ ঘরের ভেতর খুব নরম হলদেটে আলো জ্বলছে৷ প্রদীপের আলো যেমন হয়৷ সেই আলোতে চন্দ্রাবলীকে আরও মোহময়ী দেখতে লাগছে৷ রূপসা আন্দাজ করল তার মানে ওকেও নিশ্চয়ই আরও সুন্দর লাগছে এখন৷

এইটি মিলন কক্ষ৷ বলে চন্দ্রাবলী বলল, অনুগ্রহ করে এইদিকে আসুন৷

এদের প্রত্যেকের ইংরেজি উচ্চারণ এত স্পষ্ট যে প্রতিটি শব্দ আলাদা করে কানে পৌঁছয় কিন্তু বলার ভঙ্গি ভারী সুমধুর৷ রূপসা গেল পাশের ঘরটিতে৷ সেই ঘরে দেওয়াল জোড়া একটি আয়না৷ আয়নার চওড়া ফ্রেমেও কাঠের কারুকাজ৷ আয়নার সামনে একটি টেবিল৷ টেবিলের ওপর নানা রকমের প্রসাধনী রাখা৷ এবং একটি চেয়ার৷ আয়নার মুখোমুখি এই চেয়ারে বসেই রূপচর্চার ব্যবস্থা৷

এই দেওয়ালে আপনার পোশাক রাখা রয়েছে৷

দেওয়ালের একটি ছোট হাতল ধরে সামনে টানতেই রূপসা দেখল দেওয়ালের একটি অংশ চৌকো মাপে খুলে গেল৷ ভেতরে থরে থরে পোশাক সাজিয়ে রাখা৷

আর এইটা আপনার স্নানাগার৷

অবিকল আরেকটি হাতল সামনে টানতেই ভেতরে টয়লেট দেখতে পেল রূপসা৷

স্নানাগারে ইন্টারকম রয়েছে৷ আপনার যা প্রয়োজন দুই ডায়াল করে বলবেন৷ পেয়ে যাবেন৷ আমি তাহলে এখন আসি? মৃদু হেসে বলল চন্দ্রাবলী৷

হ্যাঁ, আসুন৷ অনেক ধন্যবাদ৷ আচ্ছা, আমার বেশ ক্ষিদে পেয়েছে কিন্তু৷

আপনার যা প্রয়োজন দুই ডায়াল করবেন৷ আপনার খাবার দিয়ে যাবে৷

আচ্ছা, অসংখ্য ধন্যবাদ৷

বাইরে থেকে দরজা ভেজিয়ে চলে গেল চন্দ্রাবলী৷ রূপসা আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই মখমলি তুলতুলে নরম বিছানায়৷ আহহ! কী আরাম! শরীরের অর্ধেক ডুবে গেল সেই কোমল বিছানায়৷ এয়ার-কন্ডিশনের মিহি ঠান্ডা হাওয়া, পুরোনো ভয়াবহ জীবন থেকে মুক্তির আনন্দ রূপসাকে কয়েক মিনিটের মধ্যেই তন্দ্রাচ্ছন্ন করে তুলল৷ ঘুম ভাঙল বেশ কিছুক্ষণ পর৷ ধড়মড় করে উঠে বসল রূপসা৷ ঘরটা চিনতে দুই সেকেন্ড সময় লাগল, মনে হল অপরিচিত কোথাও চলে এসেছে৷ তারপরেই মনে পড়ল ওর অবস্থান৷

উফ! বেজায় ক্ষিদে পেয়েছে৷ এবার স্নান করে কিছু খেয়ে নিতে হবে৷ বিছানা ছেড়ে উঠে নিজের ব্যাগটা খুলল রূপসা৷ সেখান থেকে ভালো দেখতে একটা সালোয়ার কামিজের সেট বার করল৷ এটা গতবছর ওকে গিফট করেছিল অর্জুন৷ অর্জুন গুহ…পাক্কা শুয়োরের বাচ্চা একটা৷ মনে মনে একবার গালাগাল দিয়ে সালোয়ার এবং একসেট অন্তর্বাস নিয়ে টয়লেটে গেল ও৷ ভালো করে স্নান করতে হবে৷ তার আগে খাবারের অর্ডারটা দিয়ে ফেলা দরকার৷ টয়লেটও এমনই সাজানো৷ দুটো দেওয়াল আপাদমস্তক আয়না৷ এক দেওয়ালে গা ঘেঁষে বেশ বড় একটি বাথটাব৷ অন্য দেওয়ালে বেসিন, পাশের র‌্যাকে থরে থরে সাজানো নানা রঙের রূপের শিশি৷ তবে কোনও শিশির গায়েই কোম্পানির স্টিকার নেই৷ রূপসা কৌতূহলবশত দুই-একটা শিশি হাতে নিয়ে গন্ধ নিল৷ কোনওটা চন্দন, কোনওটা গোলাপ অথবা জুঁই ফুলের গন্ধ৷ কস্তুরীর গন্ধওলা শিশিটা জাস্ট পাগল করে দেওয়া! এরা কি এই সুগন্ধিগুলো নিজেরাই বানায়? হতে পারে৷

পনেরো দিন আগেও রূপসা স্বপ্নে কল্পনা করতে পারেনি ওর জন্য এমন এক অলীক জীবন, এমন এক স্বপ্নের জীবন অপেক্ষা করছে৷ বেসিনের পাশে রাখা টেলিফোন সেটটা অবিকল কাঠের তৈরি একটি মাছ৷ রিসিভার তুলে বুঝল কাঠ নয় ফাইবারের৷

দুই ডায়াল করল৷ ও প্রান্ত থেকে উত্তর এল, হ্যাঁ, বলুন৷

রূপসা ইতস্তত করে বলল, ইয়ে আমি রূপসা বলছি৷

হ্যাঁ জানি, বলুন কী সেবা চান?

রূপসা বুঝল, ওর আগমন সম্পর্কিত যেখানে যা যা তথ্য পৌঁছোনোর, তা সবই পৌঁছে গিয়েছে৷ জায়গাটা যে ভেতরে ভেতরে চূড়ান্ত প্রফেশনাল তা বলার অবকাশ থাকে না৷

খাবার চাই৷ খুব খিদে পেয়েছে৷

নিশ্চয়ই, অনুগ্রহ করে বলুন কী খাবেন?

খাব বলতে…এই ভাত-ডাল-মাছ এইসব…পাওয়া যাবে?

নিশ্চয়ই৷ আপনার কক্ষে পাঠিয়ে দেব?

হুঁ, তাই দিন৷ বলে রিসিভার নামিয়ে রাখল রূপসা৷ এবার স্নান করতে হবে৷

প্রথমেই ইচ্ছে হল বাথটাবে শরীর ডুবিয়ে স্নান করতে৷ জীবনে বহুবার বাথটাবে স্নানের সুযোগ ঘটেছে কিন্তু বাথটাবে স্নান করতে নামলেই ওই সেই পাঞ্জাবি ছেলেটার কথা মনে পড়ে৷ ওর সঙ্গে হোটেলে গিয়ে…কী যেন নাম ছেলেটার…খেয়াল নেই৷ কিন্তু ওর করা অত্যাচারগুলো মনে রয়েছে৷ উফফফ…! মনে পড়তেই আবার অজান্তে শিউরে উঠল রূপসা৷ জানা নেই এরপরের ভবিষ্যত কী৷ তবে এখন আর কোনও কিছুতেই ভয় লাগে না৷ সত্যিই… মনে হয় যা হবে হোক৷ মৃত্যুর অধিক তো কিছু নেই৷

শরীর থেকে ওর সালোয়ার, কামিজ, ব্রা, প্যান্টি সব একে একে ছেড়ে ফেলে টানটান হয়ে দাঁড়াল রূপসা৷ এই স্নানাগারের আয়তন যথেষ্টই বড়৷ এবং তিন দেওয়ালে আয়না থাকার ফলে সব ভঙ্গিতেই নিজেকে দেখা সম্ভব৷ নিজের লম্বা চুল খুলে দিয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে থাকল রূপসা৷ ও কোনওকালেই ফর্সা নয়, বরং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা৷ কিন্তু এমন মসৃণ আর উজ্জ্বল ত্বক যে একটা পিঁপড়ে উঠতে গেলেও পিছলে পড়ে যায়৷ রূপসার ঘন কালো ঢেউ খেলানো চুল নিতম্ব পর্যন্ত বিস্তৃত৷ ছোট কপাল৷ ধনুকের মতো ভ্রূ-যুগল৷ আর দীঘল গভীর দুটি চোখ৷ রূপসা নিজেও জানে ওর চোখের মধ্যে এমন এক আবেদন, এমন এক আকর্ষণ এবং মায়া রয়েছে যে একবার তাকাবে তার পক্ষে পরমুহূর্তে চোখ সরিয়ে নেওয়া কঠিন৷ তীক্ষ্ণ নাসা আর ঈষৎ পুরু ঠোঁট৷ ঠোঁটদুটিও যে কোনও পুরুষের কাছে একান্ত কাম্য৷ রূপসার গলায় তিনটি স্পষ্ট ভাঁজ৷ মাটির প্রতিমার যেমন থাকে৷ কাঁধ সামান্য ঢালু৷ স্তনদুটি যেন সৃষ্টিকর্তা কামনাজর্জর অবস্থায় রচনা করেছিলেন৷ দৃঢ়, সুডৌল, বর্তুলাকার এবং বৃন্তদুটি জাগ্রত ও তার চারিপাশ মসৃণ খয়েরি বলয়৷ খাজুরাহো মন্দিরের গায়ে প্রস্তরনির্মিত নারীমূর্তির স্তনের মতোই নিটোল এবং উন্নত৷ রূপসার নাভি গভীর, এতটাই গভীর যে কোনও পুরুষের নাক অর্ধেকের বেশি ডুবে যায় ওই গভীরতায়৷ কোমরের দুইপাশে সামান্য মেদের আভাস৷ অতিরিক্ত নয়, আবার একেবারে আধুনিকা তন্বী বা সাইজ জিরো বলতে যেমনটা বোঝায় তাও নয়৷ পিঠ থেকে কোমর পর্যন্ত ইংরেজি ভি-এর মতো আকৃতি তারপর আবার তরমুজের মতো স্ফিত নিতম্ব থেকে নিটোল পা দু’খানি নিম্নমুখী বল্লমের ফলার আকৃতি নিয়ে মাটিতে ছুঁয়েছে৷ রূপসার হাত দুটি দীর্ঘ এবং এতটাই নিটোল যে অস্থির অস্তিত্ব বোঝা যায় না৷ মণিবন্ধে তিনটি করে ভাঁজ, করতল সর্বদা ঈষদুষ্ণ, আঙুলগুলি বাস্তবিকই চাঁপার কলির মতো এবং ততোধিক কোমল৷ হাত এবং পায়ের প্রতিটি নখ নিয়মিত পরিচর্যায় উজ্জ্বল ও মসৃণ৷ বাহুমূল থেকে শুরু করে গোটা শরীর নির্লোম৷ শুধুমাত্র যৌনকেশটুকু নিপুণ ও আকর্ষণীয়ভাবে কামানো৷

এককথায় রূপসার শরীরটি ভারতীয় দেবীর মতো৷ নিজেকে বেশ কিছুক্ষণ আয়নায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল৷ আয়নার সামনে দাঁড়ালেই রূপসা নার্সিসাস সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়৷ দেখতে শুরু করলে সময়জ্ঞান থাকে না৷ এই অভ্যাস ওর আজকের নয়৷ সেই আট-নয় বছর বয়স থেকেই৷

নিজেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে আবারও নিজের শরীরের প্রতি মুগ্ধ হয়ে রূপসা স্নান করার জন্য দেওয়ালের কল ঘোরাল৷ সঙ্গে সঙ্গে ছাদ ফুঁড়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি! অবাক হল ও! শাওয়ারটা এমনভাবে তৈরি যে কল খোলার সঙ্গে সঙ্গে সিলিং-এর অসংখ্য ছিদ্র থেকে ঝমঝম করে বৃষ্টির মতো জলধারা পড়বে৷ গোটা স্নানঘর জুড়ে৷ ঠিক যেন আসল বৃষ্টির অনুভব৷ দুই হাত ছড়িয়ে দিল রূপসা৷ আহহহ! দুই হাত ছড়িয়ে ঘুরতে থাকল৷ হঠাৎই মনে পড়ল বহুযুগ আগের এই বৃষ্টিতে ভেজার কথা৷

.

আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার৷ কাল শেষ রাতে বেশ এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে৷ ঘুমের মধ্যেই টিনের চালে সেই বৃষ্টির শব্দ শুনেছে রূপসা৷ ঝমঝম করে সেই শব্দ মনে হয় যেন ঠিক গায়ের ওপরেই ঝরে পড়ছে৷ লোকে বলে নয়নপুরের মাটি বৃষ্টিখেকো৷ হয়তো কথাটা কিছুটা হলেও সত্যি৷ এই নয়নপুরে বৃষ্টি যেন একটু বেশিই হয়৷ বর্ষা আসার আগেই এখানে বৃষ্টি নেমে যায় আবার বর্ষা ফেরত চলে গেলেও বৃষ্টি নয়নপুরের মায়া ছাড়তে চায় না৷ গাছগাছালিতে ঘেরা এই ছোট জায়গাটি কলকাতা শহর থেকে রেলপথে ঘণ্টাতিনেক দূরে৷ এই জায়গার অধিকাংশ মানুষ নিজের জায়গা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়নি৷ ফলে অনেক পুরোনো বাসিন্দার বাস৷ জঙ্গল, ঝিল, জলাভূমি, শীতে পরিযায়ী পাখির আনাগোনা এবং টাটকা শাকসবজি, মাছের কারণে এই অঞ্চলের মানুষ দিব্যি সুস্থ এবং হাসিখুশি৷ লোকে খুব দরকার না পড়লে শহরে যায় না৷ কয়েক বছর আগেও এই নয়নপুরে মানুষের পাওয়া-চাওয়া কম ছিল, জীবন নিয়ে অভিযোগ কম ছিল৷

কিন্তু এই বছর কয়েক ধরে খুব ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছে নয়নপুর৷ প্রথমে রত্নেশ্বরী মন্দিরের পাশে বিশাল ঝিল সংলগ্ন বনে শীতকালীন পিকনিক হত৷ সেটা একসময় শুধুমাত্র অঞ্চলের মানুষরাই সপরিজন মিলে করত৷ প্রতি বছর নভেম্বর থেকে শুরু হত পিকনিক৷ চলত ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত৷ রত্নেশ্বরী বহু প্রাচীন এক দুর্গামন্দির৷ অন্তত পাঁচশো বছরের পুরোনো মন্দিরটি এককালে ঘন জঙ্গলের মধ্যেই ছিল৷ পরে জঙ্গল বেশ কিছুটা কেটে একসময় ওই মন্দিরের চারপাশ সাফসুতরো করে নিয়মিত পুজোআচ্চা করা শুরু হয়৷ সেও প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চলল৷ মন্দির থেকে কিছুটা পায়ে হেঁটে গিয়ে ঝিলের ধারে যে পিকনিক নয়নপুর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষ করত সেটা লোকমুখে ছড়াতে ছড়াতে একসময় আর স্থানীয় রইল না৷ ধীরে ধীরে শহর থেকেও লোকজন আসতে শুরু করল৷ সারাদিন ঝিলের ধারে-জঙ্গলে ঘুরে, ঝিলে স্নান করে, বক্স বাজিয়ে গান চালিয়ে হুল্লোড় করার পর সন্ধে নামতে আবার ফিরে যেত, ঝিলের ধারে পড়ে থাকত এঁটো শালপাতা, মাংসের হাড়গোড়, মদের শূন্য বোতল৷ মাঝে মাঝে শহরের পয়সাওলা লোকেরা এসে গ্রামের মানুষদের কাছ থেকে প্রায় ডবল দামে দেশি মুরগি, কচি পাঁঠা, শাকসবজি কিনত৷ গরিব মানুষগুলো দুটো অতিরিক্ত পয়সার মুখ দেখে বেমালুম খুশি হয়ে উঠত৷ অপেক্ষা করত বনভোজনের ঋতু ও শহুরে মানুষদের জন্য যারা দু’টাকার জিনিস অনায়াসে পাঁচ টাকায় কিনতে পারে৷

চাহিদা তৈরি হলে জোগানও হবে৷ নয়নপুরের গায়েও হালকা ঝাপটা মারল আধুনিকতা৷ স্টেশনের ধারে বিলিতি মদের দোকান তৈরি হল আর পঞ্চায়েত এবং স্থানীয় দাদাদের সিদ্ধান্তে তৈরি হল ঝিলের ধারে বেশ কয়েকটি কটেজ৷ উদ্দেশ্য পিকনিক পার্টিরা যদি খোলা জায়গায় পিকনিক করতে না চায় তাহলে রুম ভাড়া করেও করতে পারে এবং রাতে যদি থেকে যেতে চায় সেটাও ভাড়ার বিনিময়ে থেকে যেতে পারে৷ নাম হল নিরালা৷ চারটে ছোট ছোট কটেজ৷ সিঙ্গল রুম৷ অ্যাটাচড টয়লেট, কিচেন৷ টুকটাক বাসনপত্র৷ শহরের পিকনিক পার্টি মাঝে মাঝে এসে থাকতেও শুরু করল৷ সেবাযত্নের দায়িত্ব পেল পঞ্চায়েত থেকে রিক্রুট করা কয়েকজন স্থানীয় মানুষ৷ তার মধ্যে রূপসার থেকে ছয় বছরের বড় দাদা বিলুও কাজ পেয়ে গেল৷ পাক্কা হারামি বলতে যা বোঝায় বিলু হল তাই৷ ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়ে স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল বিলু৷ বাজে সঙ্গে মেলামেশা শুরু করল৷ মাঝে মাঝেই রাতে বাড়ি ফিরত না৷ কখনো অনেক রাতে ফিরত নেশা করে৷ বাবা কাজ করত ভূতনাথ রাইসমিলে৷ প্রচুর খাটুনি, পয়সা সামান্য৷ বাড়িতে চারটে পেটের জোগাড় দিতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যেত বাবা৷ অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে গিয়ে শরীর গেল ভেঙে৷ মা-ও তখন কাজ করতে শুরু করল৷ সংসারের কাজ সামলে মুড়িভাজা, আচার বানানো৷ সেইগুলো বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি৷ এক একসময় সব সামলে উঠতে পারত না মা৷ তখন রূপসাকে পাঠাত৷ রূপসার তখন ক্লাস সিক্স৷ একদিন রতনকাকার বাড়িতে আচারের কৌটো দিতে গিয়েছিল রূপসা৷ রতনকাকার একটা পা ছিল বাঁকা৷ খুঁড়িয়ে হাঁটত৷ বাড়ির সামনে ছোট একটা মুদির দোকান ছিল৷ ওই দিয়েই একার সংসার চালাত৷ রূপসার মায়ের কাছ থেকে আচার কিনত রতন৷ দোকানে বিক্রি করত নিজের লাভ রেখে৷ সেদিন দুপুরে রূপসা রতনের ঘরের দরজায় কড়া নাড়ার পর দরজা খুলে রতন তাকিয়েছিল রূপসার দিকে৷ ফ্রক পরা রূপসার চেহারাটা ক্লাস সিক্সের তুলনায় অনেক বেশি বাড়ন্ত৷ রতন বলেছিল, বাইরে কেন, আয় ঘরে আয়৷ ঘরটা পুরো অন্ধকার৷ রূপসার কেন কে জানে ইচ্ছে হয়নি ঘরের ভেতর ঢুকতে৷ সহজাত সাবধানতায় বলেছিল, না গো, পরে আসব৷

আরে আয় না, ভালো একটা জিনিস খাওয়াব তোকে৷ বলে আচারের বয়ামের সঙ্গে রূপসার হাতটাও ধরেছিল রতনকাকা৷

সেই ধরাটা ভালো লাগেনি রূপসার৷ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড় লাগিয়েছিল রূপসা৷ হাঁফাতে হাঁফাতে বাড়ি ফিরে মাকে আচারের শিশি ভরা ব্যাগটা ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিল, আমি আর কখনও রতনকাকার বাড়ি যাব না৷

মা কিচ্ছু জিজ্ঞাসা করেনি, শুধু একদৃষ্টে মেয়ের মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে কিছু একটা আন্দাজ করে নিয়ে বলেছিল, ঠিক আছে, আর যাস না৷ আর একটা কথাও জিজ্ঞাসা করেনি মা, কিন্তু তাই বলে রতনের দোকানে আচার দেওয়াও বন্ধ করেনি৷ নিজেই যেত৷

বাবার চালকল ধুঁকতে শুরু করল একসময়৷ খাবি খেতে খেতে একসময় যখন প্রায় চলে কি চলে না, তখন মা-ও সদর হাসপাতালের বেডে জায়গা না পেয়ে মেঝেতে শুয়ে৷ মায়ের জ্বর কমছিল না৷ আর সঙ্গে অসহ্য পেটে ব্যথা, বমি৷ মাকে দেখে চেনা যেত না৷ একটা কঙ্কালে চামড়া জড়ানো৷ রূপসা মায়ের কাছে যেতেও ভয় পেত৷ একবার মাত্র শুনতে পেয়েছিল হাসপাতালের ডাক্তারবাবু বাবাকে বলছে, এই পেশেন্টকে তো মেরেই এখানে নিয়ে এসেছেন৷ এতদিন কী করছিলেন?

খুব বেশিদিন থাকেওনি মা৷ দিন সাতেকের মধ্যেই চলে গিয়েছিল৷ বিলু মায়ের মুখাগ্নি করছিল যখন তখনও মুখে বাংলা মদের গন্ধ৷ শ্মশানযাত্রী বন্ধুদের খাওয়াতে গিয়ে নিজেও দুই ঢোক মেরে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারেনি৷

মা চলে যাওয়ার পরদিন থেকেই যেন সংসারটা কমজোরি দর্মার ঘর যেভাবে প্রবল ঝড়ে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে সেইভাবেই পড়ে গিয়েছিল৷ বাবার চালকল পুরো বন্ধ৷ হাতে একটা টাকাও নেই৷ বিলু নানারকমের বেনিয়মে রোজগারের ধান্দাই চালাতে থাকল৷ কখনও দালালি, কখনও সাট্টার ঠেকে নাম্বার লেখা, কখনও পার্টির ফাইফরমাশ৷ বিলুর সুপারিশেই ওই রত্নেশ্বরী ট্যুরিস্ট লজে বাবার একটা কাজ জুটে গেল৷ কেয়ারটেকার টাইপ কাজ৷ মাইনে সামান্যই৷ পঞ্চায়েত থেকে দেওয়া হত৷ তবু যাই হোক, কোনওমতে চলে যেত৷ বিলুর রোজগার সংসারে ঢুকত না৷ পারলে মাঝে মাঝে বাবার কাছে এসে বলত, শ’ দুয়েক দাও তো৷ টাইমে শোধ দিয়ে দেব৷

টাকা কোথায় পাব? লজ্জা করে না তোর বাপের কাছে এই বয়েসে টাকা চাইতে? বোনটা পর্যন্ত পড়াশোনার খরচ নিজে চালিয়ে আচার বানিয়ে, মুড়ি ভেজে ঘরে দুটো পয়সা আনছে আর তুই…

আরে ধুর ভাই, অত জ্ঞান মারাচ্ছ কেন? লোন চাইছি৷ দিতে পারলে দেবে, না হলে বলে দেবে স্টকে মাল নেই৷ অত হ্যাজানোর কী আছে? আর তোমার মেয়ে কী করে রোজগার করছে সেইসব আমাকে শুনিও না৷ বলে চলে গিয়েছিল বিলু৷

রূপসা ঘরে বসে কুলের আচার প্লাস্টিকের ছোট ছোট প্যাকেটে ভরতে ভরতে শুনেছিল বাবা দাঁতে দাঁত ঘষে বলছে, শুয়োর…জানোয়ার একটা!

বছর গড়িয়ে গেল৷ পড়াশোনা আর টানছিল না রূপসাকে৷ ভালো লাগছিল না৷ আম, কুল, চালতা, লঙ্কা—মায়ের কাছ থেকে শেখা আচার বানানোর বিদ্যেটা কাজে লাগিয়ে সংসারের জন্য কিছু পয়সা তুলছিল ঠিকই, কিন্তু ভালো লাগছিল না৷ বরং পাড়ায়-বেপাড়ায় যেখানেই যেত নানা বয়সের ছেলের হাঁ করে তাকিয়ে থাকাটায় প্রথম দিকে ভয় ভয় একটা অস্বস্তি লাগলেও একদিন কে যেন কানে কানে ফিস ফিস করে মন্ত্র পড়ে দিল, ভালোবাসতে শেখ, এই দেখাটাকে ভালো লাগাতে শেখ৷ তাই শিখতে শুরু করল রূপসা৷ এটা সত্যি, অভাবের অযত্নের ঘরে, সঠিক বয়েসের আগেই বড্ড বেমানানভাবে সুন্দর আর পরিপূর্ণ মেয়েদের মতো হয়ে উঠছিল ও৷ ঘরের কাজের কারণে স্কুলে রোজ যেতে পারত না, কিন্তু যেদিন যেত, আটোসাঁটো স্কুল ইউনিফর্ম পরা রূপসাকে দেখে কয়েকজন বন্ধু বলেই ফেলত, তুই তো হিরোইন হয়ে যাচ্ছিস, কী খাস? কী মাখিস গায়ে?

রূপসা হাসত, বুঝতে পারত বন্ধুদের এইসব প্রশ্নে যতটা না মুগ্ধতা, ভালোলাগা রয়েছে তার থেকে ঢের বেশি রয়েছে হিংসা৷ এই হিংসাকেও ভালো লাগাতে শুরু করল রূপসা৷ বুঝতে শুরু করল ঈশ্বর ওকে অন্য ঐশ্বর্য দিয়েছেন৷ সেই ঐশ্বর্যের মূল্য কিছুটা অন্তত যাচাই করার জন্যও মাঝে মাঝে ইচ্ছে হত রূপসার৷ কিন্তু ভয় হত৷

মায়ের বন্ধু ছিল পদ্মকাকিমা৷ রূপসাদের পাড়া থেকে আরও বেশ কিছুটা পশ্চিমে৷ সাইকেলে মিনিট কুড়ি লাগে৷ প্রতি দুই মাস অন্তর কাকিমার বাড়ি গিয়ে কয়েক রকমের আচার দিয়ে আসত মা৷ রূপসাও গিয়েছে মায়ের সঙ্গে৷ মা মারা যাওয়ার পর রূপসা দুই-তিনবার একাই সাইকেল চালিয়ে গিয়েছে আচার দিতে৷ পদ্মকাকিমার মন বড় ভালো৷ গেলে অনেক কিছু খাওয়ায়, শুধু তাই নয়, কিছু না কিছু জামাকাপড় কিনে রেখে দেয় রূপসার জন্য৷ আচারের দাম ছাড়াও দু-দশ টাকা বেশি গুঁজে দিয়ে বলে, নিজের ইচ্ছেমতো খরচ করিস৷ মা নেই তো কী হয়েছে, এই কাকিমাও কিন্তু তোর মায়ের মতোই৷ মনে রাখিস৷

সত্যিই পদ্মকাকিমা মস্ত একটা ভরসার জায়গা৷ বাবার শরীরের যা অবস্থা তাতে মনে হয় না আর খুব বেশিদিন কাজ করতে পারবে৷ আর গেস্ট হাউজের মাইনের নিয়ম যেদিন কামাই সেদিনের পয়সা বাদ৷ বাবার রোজগার তলানিতে৷ দাদার ওপর বিন্দুমাত্র আস্থা নেই৷ ছেলেটা এখন বাড়িতে থাকলেই বিরক্ত লাগে রূপসার৷ মনে হয় আপদটা ঘর থেকে কখন বেরোবে৷ মাঝে মাঝে বাড়িও ফেরে না৷ আবার কখনো সারাদিন ঘরের ভেতর শুয়ে থাকে৷ এক এক সময় উটকো ছেলেরা আসে মটোর বাইক চালিয়ে৷ ‘বিলু’, ‘এই বিলু’—বলে বাইরে থেকে হাঁক মারলে দাদা তাড়াতাড়ি গায়ে জামা গলিয়ে বেরিয়ে যায়৷ বাবা কখনও জিজ্ঞাসা করলে ইচ্ছে হলে উত্তর দেয়, বিজনেস করছি৷

কিসের বিজনেস কে জানে? একটা পয়সা তো চোখে দেখা যায় না৷ নিজের সাইকেলটা সারানোর জন্যও অনেক সময় রূপসার কাছে পয়সা চায়৷ একটাই ডায়লগ, লোন হিসেবে নিচ্ছি, পরে ইন্টারেস্ট সমেত ফেরত দিয়ে দেব৷

আজ সারা সকাল ধরে আচার বানানোর পর দুপুরে ভাত খেয়ে একটু শুতেই চোখ লেগে গিয়েছিল রূপসার৷ হঠাৎই ঘুম যখন ভাঙল বেশ বিকেল হয়ে গিয়েছে৷ বাবা ডিউটি গিয়েছে৷ ফিরতে সন্ধে হবে৷ আজ পদ্মকাকিমার বাড়ি যাবে বলে চারটে শিশিতে চার রকমের আচার ভরে ব্যাগে রেখে দিয়েছিল৷ জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল রূপসা৷ আকাশ সেই কালো৷ আর গুমোট গরম৷ কী করবে একটু ভেবে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, বেরোনো যাক৷ রাস্তায় ভিজলে ভিজবে৷ তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেলে আচারের থলে ঝুলিয়ে রওনা দিয়ে দিল রূপসা৷ খুব জোরে সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাতে থাকল৷ হাঁটু পর্যন্ত ফ্রক মাঝে মাঝেই দমকা হাওয়ায় উপরে উঠে যাচ্ছিল আর সেই মুহূর্তে কোনও পথচারী যতটা সম্ভব দেখে নিচ্ছিল রূপসার মসৃণ পা দুটিকে৷ এসব দৃষ্টিগুলোয় গা ঘিনঘিন করে না রূপসার৷ বরং মজা লাগে৷ নিজেকে আরও সুন্দর করে সাজাতে ইচ্ছে করে৷

মিনিট পনেরো দ্রুত সাইকেল চালিয়ে পদ্মকাকিমার বাড়িতে যখন পৌঁছল ততক্ষণে ঘেমে-নেয়ে অস্থির৷ কপালে, গলায়, কাঁধে ঘাম ঝিলিক দিচ্ছে৷

কাকিমা বলল, আহারে ঘেমে একেবারে স্নান করে গিয়েছিস! একটু জিরো৷ একগ্লাস জল আর বাটিতে দুটো নাড়ু এনে রাখল রূপসার সামনে৷ রূপসার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল৷ ঢকঢক করে জল খেয়ে টের পেল ক্ষিদেও পেয়েছে বেশ৷ ওর ক্ষিদে বরাবরই বেশি৷ এত ক্ষিদে কেন কে জানে৷ নাড়ু দুটো টপাটপ মুখে পুরে খেয়ে আবার একগ্লাস জল খেল৷

খুব খিদে পেয়েছে না রে? জিজ্ঞাসা করল কাকিমা৷

রূপসা উত্তর না দিয়ে শুধু হাসল৷

দাঁড়া, দুটো মুড়ি দিই তোকে৷

পদ্মকাকিমার বর মানে অসীমকাকা রেলক্যান্টিনে কাজ করে৷ কাজ করে মানে ক্যান্টিনটাই ওর৷ রেলের সঙ্গে কন্ট্রাক্টে কাজ৷ ভালোই পয়সা রোজগার করে৷ গোলগাল অসীমকাকু বেশ ভালো মানুষ৷ রোজ বাড়ি ফিরতে পারে না৷ শুক্রবার রাতে বাড়ি এসে শনি-রবিবার থেকে আবার সোমবার ভোরে বেরিয়ে যায়৷ ওদের একমাত্র ছেলে দীপু পড়াশোনায় বেশ ভালো৷ মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করেছে৷ সায়েন্স নিয়ে ইলেভেনে ভর্তি হয়েছে মাদারিহাট হাই স্কুলে৷ স্বভাব লাজুক দীপুদা সাত কথায় একবার উত্তর দেয়৷ লোকের সঙ্গে কথা বলতেও যেন ওর কষ্ট৷ খুব মজা লাগে রূপসার৷

বারান্দায় বসে কথা বলছিল দুজনে৷ ঘরের ভেতর থেকে দীপুদার গুনগুন শব্দ আসছে৷ পড়া মুখস্থর৷ একটা ছেলে সারাক্ষণ কী করে বই পড়তে পারে সেটা ভেবেই গায়ে জ্বর আসে রূপসার৷

কাকিমা এক বাটি মুড়ি নিয়ে এল৷ নে খা৷ রূপসা দেখল সর্ষের তেল আর চানাচুর মাখা মুড়ি৷ বড় লোভনীয় খাবার৷ চকাম চকাম শব্দে খেতে শুরু করল৷ রাক্ষুসে ক্ষিদে৷

অনেক কথা হল কাকিমার সঙ্গে৷ সব খোঁজখবর নিল৷ পড়াশোনা যেন বন্ধ না করে, যা দরকার পড়ে নিজের মা ভেবে যেন কাকিমাকে বলে ইত্যাদি আরও অনেক কিছু বলল পদ্ম৷

মুড়ি শেষ করে ফাঁকা বাটিটা যখন দাওয়াতে রাখল ততক্ষণে শেষ বিকেল৷ যেতে যেতেই সন্ধে নেমে যাবে৷

আমি আসি, কাকিমা৷

তোর দেরি হয়ে গেল৷ একা যাবি এতটা রাস্তা?

ও কিছু হবে না৷ বলল রূপসা৷

এখান থেকে রূপসার বাড়ি যেতে মাঝে বেশ অনেকটা রাস্তা নির্জন৷ রাস্তার ধারে কয়েকটা বট-অশ্বত্থ গাছ ছাড়া আর কিছু নেই৷ কাকিমার কাছ থেকে আচারের দাম নিয়ে সেটাকে বুকের বাঁদিকে গুঁজে নিল৷

ওখানে রাখলে পড়ে যাবে না তো?

নাহ, পড়বে না৷

শোন…বলে একটু থামল কাকিমা৷ রূপসার চেহারার দিকে এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, তুই এইভাবে টাকা রাখিস না, ফ্রকের ভেতরে কী পরিস?

রূপসা বলল, টেপজামা পরি তো৷

টেপজামার ভেতর দিয়ে গলে গেলে?

গলবে না৷ জামাটা ভেতরে প্যান্টের মধ্যে গোঁজা, বলে ফিক করে হাসল রূপসা৷

না, তুই আর টেপজামা পরিস না, বলে একটু ভেবে বলল, দাঁড়া৷ ঘরের ভেতরে গিয়ে আবার মিনিট কয়েক পর কাকিমা একটা প্যাকেট নিয়ে এসে নিচু গলায় বলল, এখানে আমার কয়েকটা পুরোনো ব্রেসিয়ার রয়েছে৷ তোর সাইজে হবে না হয়তো৷ আবার হতেও পারে৷ দেখিস তো পরে৷ সাইজে বড় হলে ফেলে দিস আর আমার কাছে এসে বলিস৷ আমি দোকানে নিয়ে যাব তোকে৷ নে, ব্যাগে ভরে নে৷ আর একা যাস না৷ আমি দীপুকে বলছি ও তোকে খানিকটা এগিয়ে দেবে৷

প্যাকেটটা হাতে নিয়ে কেমন গা সিরসির করে উঠল রূপসার৷ ব্রেসিয়ার! হ্যাঁ, ব্রেসিয়ার জিনিসটা খুব ভালো করেই জানে রূপসা৷ এটাও বোঝে যে ফ্রকের আড়ালে থাকা ওর স্তনদুটি বন্ধুদের তুলনায় অনেক বেশি পরিণত, পুরুষ্টু৷ বন্ধুদের আলোচনায় এর মধ্যেই ওর জানা হয়ে গিয়েছে ব্রেসিয়ার পরার উপকারিতা৷ কিন্তু ক্লাসে কেউই এখনও ওটা পরা শুরু করেনি৷ স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত সাদা জামা আর সবুজ ফ্রক৷ ক্লাস নাইন থেকে শাড়ি৷ তখন ব্লাউজের ভেতরে সকলে ওই পরা শুরু করে৷ তবে ক্লাস নাইন পর্যন্ত আর পড়ার ইচ্ছে নেই রূপসার৷ ভালো লাগে না৷

এই দীপু, তোর সাইকেলটা বার কর তো৷ রুপুকে একটু এগিয়ে দে৷ বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে কাকিমা বলল, আকাশের অবস্থাও ভালো নয়৷ তাড়াতাড়ি যা৷

দীপু বেরোল ঘরের ভেতর থেকে৷ একবার তাকাল রূপসার দিকে৷ পড়া ছেড়ে উঠতে হয়েছে বলে চোখেমুখে সেই বিরক্তি স্পষ্ট৷ দেখে বেজায় রাগ হয়ে গেল রূপসার৷ পদ্মকে বলল, থাক না কাকিমা, দীপুদা পড়ছে৷ আমি ঠিক চলে যাব৷

ও তো সারাক্ষণই পড়ছে৷ একটু সময় নষ্ট হলে এমন কিছু হবে না৷ যা দেরি করিস না৷

দীপু বাধ্য ছেলের মতো বারান্দা থেকে নিজের রেসিং সাইকেলটা নামিয়ে নিয়ে রূপসাকে বলল, চল তাড়াতাড়ি৷

দুজনে পাশাপাশি সাইকেল চালাতে থাকল৷ কারও মুখেই কথা নেই৷ দীপু নিজের বাকি পড়ার কথা ভাবতে চাইছিল কিন্তু ওর অবাধ্য চোখ বার বার চলে যাচ্ছিল হাওয়াতে ফ্রক উঠে গিয়ে রূপসার পা-দুটোর দিকে৷ হাঁটু পর্যন্ত ফ্রক হাওয়ায় এক এক সময় থাই পর্যন্ত উঠে যাচ্ছিল আর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল দীপুর৷ নির্লোম, মসৃণ থাই দুটো দীপুকে অস্থির করে তুলছিল৷ রূপসা শুধু মনে মনে ভাবছিল বাড়ি ফিরে আগে টাকাগুলো যত্নে গুছিয়ে রাখতে হবে৷ দাদার নজরে যেন না পড়ে, তারপর কাকিমার দেওয়া ব্রেসিয়ারগুলো পরে দেখতে হবে৷ জীবনে কোনওদিন পরেনি, আদৌ পারবে তো পরতে? কেমন দেখতে লাগবে পরার পর? আয়নার সামনে নিজেকে কল্পনা করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল রূপসা৷ হঠাৎই দমকা হাওয়া দিল একটা, আর সঙ্গে সঙ্গে ধুলোর ঝড়৷ সাইকেল থামিয়ে ফেলতে হল দুজনকেই৷ এত ধুলো যে চোখ মেলে রাখা যাচ্ছে না৷ ঝড় চলতে চলতেই গায়ে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি এসে পড়ল৷ এই সর্বনাশ! এখন যেখানে রয়েছে না যাবে এগোনো না যাবে ফেরা৷ কী করা যায় ভাবতে ভাবতেই মুষলধারে বৃষ্টি নেমে এল৷ কড় কড় করে ডেকে উঠল মেঘ৷

রূপসা দীপুর দিকে তাকিয়ে বলল, কী হবে এখন?

দুত্তেরি ভাল্লাগে না, আর কী হবে? ওই বটগাছটার নীচে এখন চল দাঁড়াই গিয়ে৷

রাস্তার একপাশে অদূরেই একটা মস্ত বটগাছ তার দীর্ঘ ডালপালা ছাতার মতো ছড়িয়ে যেন ওদের দুইজনের জন্যই অপেক্ষারত৷

হুড়মুড় করে দুজনেই ওই গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়াল৷ ততক্ষণে দুজনেই অনেকটা ভিজে গিয়েছে৷

ইস! পুরো ভিজে গেছিস তো তুই!

তুমিও তো তাই৷ হেসে ফেলে বলল রূপসা৷

দীপুর গালে কচি দুবেবাঘাসের মতো দাড়ি-গোঁফে জলকণা লেগে৷ একমাথা ঘন চুলও জলে ভেজা৷ গায়ের জামা আর সাদা পায়জামাটা ভিজে গায়ে সেঁটে রয়েছে৷

প্রবল বৃষ্টি আর তেমনই হাওয়া ওদের বার বার ভিজিয়ে দিতে চাইল৷ বটগাছ চাইছিল যতটা সম্ভব আড়াল দিতে৷ নিজেদের বাঁচাতে বাঁচাতে প্রায় দুজনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে গাছের কোটরের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল, হঠাৎ দীপু বলে উঠল, গাছের কোটরে যদি সাপ থাকে৷

সাপের কথা শুনতেই ‘ও মা’ বলে দীপুর বুকের কাছটা খামচে ধরল রূপসা৷ ওর গরম নিঃশ্বাস পড়ল দীপুর বুকে৷ খুব শীত করে উঠল দীপুর৷ আবার তাকাল রূপসার দিকে৷ ওর ফুলছাপ ফ্রকটা শরীরে লেপ্টে রয়েছে৷ কিশোরী বুকের স্তনবৃন্ত দুটি ফ্রক, টেপ-জামার আবরণ ভেদ করে স্পষ্টভাবে জেগে উঠেছে জলস্পর্শে, নাভির গভীরতাও সুস্পষ্ট৷ দীপুর কেমন যেন করতে থাকল৷ রূপসাও অস্থির হয়ে যাচ্ছিল৷ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল সব৷ দীপুদার সাদা পায়জামা লেপটে গিয়ে ফর্সা সুগঠিত রোমশ পা দুটো কী সুন্দর লাগছে!

দীপু কী করবে বুঝতে না পেরে রূপসার ভিজে কাঁধে একবার হাত রাখল৷ রূপসাও যেন শুধু এই ইঙ্গিতটুকুরই অপেক্ষায় ছিল৷ দুই হাতে দীপুর মাথাটাকে ধরে নিজের মুখের সামনে নিয়ে এল৷ প্রবল বৃষ্টিতে বটগাছের দুটি ঝুরির মতোই একে অপরকে জড়িয়ে থাকল দুজনে৷ জীবনের প্রথম অনভ্যস্ত চুম্বনে মিশল বৃষ্টির ফোঁটা৷ দুটি হূদয়ের শব্দ মেঘের ডাককেও ম্লান করে দিচ্ছিল৷ রূপসা আলিঙ্গনরত অবস্থাতেই বুঝতে পারল পায়জামার আড়ালে দীপুদা প্রবলভাবে জেগে উঠেছে৷ দীপু যেন উন্মত্ত হয়ে উঠল৷ রূপসার মুখে, ঘাড়ে এলোপাথাড়ি চুমু খেতে খেতে ওকে আরও সজোরে নিজের মধ্যে চেপে ধরছিল৷ মাতাল হয়ে উঠছিল রূপসাও৷ আহ! এত সুখ…এত সুখ জীবনে পায়নি কখনও… দীপুর অস্থির হাতদুটো ফ্রকের ওপর দিয়ে আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছিল আর শিউরে শিউরে উঠছিল রূপসা৷ হঠাৎই বুঝতে পারল দীপু ওর ফ্রকের ভেতরে হাত ঢোকানোর চেষ্টা করছে৷ গায়ের জোরে হাত ঢোকাতে গিয়ে পুরোনো ফ্রকের কিছুটা ফেঁসে গেল৷ সঙ্গে সঙ্গে দুই-পা সরে এল রূপসা৷ কেন সরে এল নিজেও জানে না৷ রূপসা সরে যেতে দীপুও থতমত খেয়ে গেল৷ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল রূপসার দিকে৷ তারপর বাকি বৃষ্টির সময়টুকু দুজনেই একে অপরের থেকে খানিক দূরত্বে দাঁড়িয়ে রইল৷

রূপসার আবার তীব্র ইচ্ছে হচ্ছিল দীপুদার শরীরের মধ্যে নিজেকে পিষে দিতে কিন্তু ভেতর থেকে কে যেন বার বার ওকে আটকে দিচ্ছিল, কিছুতেই আর পারল না কাছে যেতে৷

বৃষ্টির তোড় একটু কমতে দীপুকে রূপসা বলল, তুমি চলে যাও দীপুদা, বাকিটুকু আমি চলে যেতে পারব৷

দীপু কিছু না বলে শুধু তাকাল রূপসার দিকে৷ সেই চোখে কিছুক্ষণ আগের সেই আগুন, সেই মুগ্ধতা নেই, বরং ভয় জড়িয়ে রয়েছে৷ মায়া লাগল রূপসার৷

দীপুর হাত ধরে আবার কাছে টেনে নিয়ে চুমু খেল৷ ঠোঁটে ঠোঁট, জিভে জিভ ঠেকল৷ কিন্তু এবার যেন দীপু নিভে গিয়েছে৷ শুধু বলল, তোর জামাটা ছিঁড়ে দিলাম৷

ভয় পেও না, দীপুদা, আমি কাউকে কিছু বলব না৷ কথাটা কেন বলল রূপসা কে জানে৷

দীপু আবার তাকাল, চোখ থেকে সেই ভয়টা যায়নি৷ ধীরে ধীরে গাছের কাছ থেকে নেমে নিজের সাইকেলের দিকে গেল৷ তারপর সিটে বসে নিজের বাড়ির দিকে প্যাডেল চালাল৷ রূপসার দিকে একবারও ফিরে তাকাল না৷ বৃষ্টি পড়ছিল তখনও৷ রূপসা ভিজছিল, বাইরে, অন্তরে…

.

আচমকাই শাওয়ারটা বন্ধ করে দিল রূপসা৷ আহ! এতদিন পর আবার কেন? কেন যে বৃষ্টি হলেই এতকাল পরেও সেই স্মৃতি এসে মনে ঘা দেয়৷ অস্থির করে তোলে৷ সেই পুরোনো রূপসা তো আর সে নেই, কবে বদলে গিয়েছে৷ কেউ তাকে জোর করে বদলায়নি, স্বেচ্ছায় নিজেকে বদলেছে রূপসা৷ অন্তত নিজে তাই মনে করে৷ খরগোশের শরীরের মতো নরম আর সাদা তোয়ালে দিয়ে নিজেকে যত্ন করে মুছে টয়লেট থেকে নিজের ঘরে এল৷ তারপর ব্যাগ থেকে পছন্দসই একসেট নীল সালোয়ার বার করে পরে নিল৷ চুল ভালো করে ঝেড়ে খোঁপা পাকাতে গিয়ে শুনতে পেল গরে ভেতরে সিলিঙে একটা ছোট পিতলের ঘণ্টা টুং করে বেজে উঠল৷ তারপর দরজায় মৃদু করাঘাত৷

রূপসা গিয়ে দরজা খুলল৷ সামনে একটি লোক দাঁড়িয়ে৷ খালি গা, মাথায় রঙিন পাগড়ি, রঙিন ধুতি৷ কানে মাকড়ি, দুই হাতে বালা৷ একহাতে একটি থালা লাল কাপড়ে ঢাকা৷

আপনার খাবার এনেছি৷

ওহ হ্যাঁ, আসুন আসুন৷ দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল রূপসা৷

খাবারের থালাটা টেবিলের ওপর রেখে লোকটি বলল, আপনার খাওয়া শেষ হয়ে গেলে, জানাবেন, আমি নিয়ে যাব৷

আচ্ছা, অনেক ধন্যবাদ৷ বলল রূপসা৷ উত্তর পেল, স্বাগতম৷ লোকটি দুই হাত জড়ো করে রূপসাকে প্রণাম জানিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেল৷ রূপসার বেজায় হাসি পেল৷ মনে হল ও যেন এখানে কোনও নাটক দেখতে এসেছে৷ সকলে মিলে কোনও ঐতিহাসিক পালা করছে৷ বেশভূষা, কথাবার্তা সবই খুব মাপা৷ হয়তো এটাই নিয়ম৷

যাক গে, খেতে বসা যাক৷ থালার ওপর থেকে লাল কাপড়টা সরিয়ে দিল রূপসা৷ মস্ত একটা থালা৷ সম্ভবত জার্মান সিলভারের৷ থালার মাঝখানে ছোট সুন্দর একটি ওলটানো বাটির মাপে ভাত, সাদা ধপধপে, লম্বা চালের ভাত৷ আর কম করে ছয়-সাতটা বাটি৷ তাতে হরেকরকম তরকারি, মাছ, মাংস সবই রয়েছে৷ চমৎকার গন্ধ বেরোচ্ছে৷ ক্ষিদেটাও পেয়েছে জাঁকিয়ে৷ খেতে বসে রূপসা বুঝল ওর মন ভারী হয়ে উঠেছে৷ শালা এতগুলো বছর পেরিয়ে গেল তবু বৃষ্টিতে ভিজলেই সেই কত বছর আগের বৃষ্টিভেজা দিনটার কথা মনে পড়ে! আর তারপরেই অনিবার্যভাবে মনে পরে তারপরের দিনের দুপুরের কথাটা! রূপসা মনে করতে চায় না৷ তবু পড়ে৷ দীপু পরের দিন দুপুরে আচমকাই এসেছিল রূপসার বাড়িতে৷ তখন ভাত খেতে বসেছিল রূপসা৷ বাড়িতে কেউ ছিল না৷

দীপুদা তুমি! গত সন্ধে থেকে সারা রাত কাটিয়ে পরদিন দুপুর পর্যন্ত যে অপূর্ব এক ভালোলাগায় ভরেছিল রূপসা তা দীপুকে দেখামাত্র যেন কোটিগুণ বেড়ে গিয়েছিল৷ ওর মন বলছিল, হ্যাঁ, দীপুদা আসবে, আবার আসবেই ওর কাছে৷ আন্দাজ মিলে গিয়েছিল৷

খাওয়া ছেড়ে উঠে আসতে গিয়েছিল রূপসা৷

দীপু বাধা দিয়েছিল, না না, তুই খেয়ে নে৷ আমি অপেক্ষা করছি৷

রূপসা গোগ্রাসে ভাতটুকু খেয়ে হাত ধুয়ে দীপুর সামনে এসে একগাল হেসে বলেছিল, হ্যাঁ দীপুদা, বলো৷

বলছি যে…ইতস্তত করছিল দীপু৷ রূপসার দিকে ভালো করে তাকাতেও পারছিল না৷

আমি জানতাম তুমি আসবে৷ বলে ফেলেছিল রূপসা৷

রুপু, তুই প্লিজ কাউকে কিছু বলিস না, কেউ জানতে পারলে আমি মরে যাব৷

থমকে গিয়েছিল রূপসা৷ কথাগুলো কেমন অদ্ভুত শুনতে লাগছিল৷

এ মা কাকে বলব! কেন বলব?

তুই এটা রাখ, বলে প্যান্টের পকেট থেকে ভাঁজ করা দুটো দশ টাকার নোট রূপসার হাতে গুঁজে দিয়েছিল দীপু৷

এটা কী? টাকা কেন দিচ্ছ?

তুই রাখ৷ প্লিজ কাউকে বলিস না রুপু৷ যা খুশি করিস এটা নিয়ে৷ বলবি না তো কাউকে কালকের কথা!

রূপসার বুকের ভেতরে তখন নদীর পাড় ভেঙে পড়ার মতো শব্দ হচ্ছিল ক্রমাগত৷

খুব শান্তভাবে বলেছিল, আমি কাউকে বলব না, দীপুদা৷ তার জন্য আমার টাকা লাগবে না, নিয়ে যাও টাকা৷ বলে মুঠিতে ধরা টাকাটা ছুঁড়ে মেরেছিল দীপুর দিকে৷ দলাপাকানো কাগজ দীপুর বুকে ঠোক্কর খেয়ে মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল৷ দীপু তোলেনি, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ তীব্র কান্না পাচ্ছিল রূপসার, কিন্তু কান্না আসছিল না৷ বরং অসহ্য একটা জ্বালা শরীরময় ছোটাছুটি করছিল৷ নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল খুব৷ বিছানায় শুয়ে পড়েছিল৷ আর ঠিক মিনিট কয়েক পরেই ঘরে ঢুকেছিল বিলু৷ প্রথমেই মেঝেতে পড়ে থাকা দোমড়ানো নোটদুটোকে নিজের পকেটে ভরে নিয়ে রূপসার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, পদ্মকাকিমার ছেলেটা এসেছিল নাকি রে?

হুঁ৷

কেন?

আচারের টাকা দিতে৷

শুধু টাকা দিতে?

তা’লে ওকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করো কেন এসেছিল, ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল রূপসা৷

বোনকে আচমকা এমন জ্বলে উঠতে দেখে ভুরু কুঁচকে উঠেছিল বিলুর৷ ঠোঁট সরু করে ভুরু নাচিয়ে বলেছিল, এই মাটিতে যে টাকাটা পড়েছিল ওটা?

হুঁ৷

এমন ছুঁড়ে দিয়ে গেল?

কেন, তোর কিছু বলার আছে? ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল রূপসা৷

বিলু ঠোঁট চেটে চোখ ছোট করে বিশ্রী হেসেছিল, তারপর রূপসাকে বলেছিল, টাকাটা আমি লোন হিসেবে নিলাম৷ দুইদিনের মধ্যে দিয়ে দেব৷

উত্তর দেয়নি রূপসা৷ ভেবেছিল আর জীবনে কোনওদিন পদ্মকাকিমার বাড়িতে যাবে না৷ কিন্তু তারপরেও যেতে হয়েছিল, কারণ একটাই৷

.

ভাতে হাত রাখল রূপসা৷ উষ্ণ স্পর্শ৷ খেতে শুরু করল৷ খেতে খেতে ও টের পেল প্রথম দিকে ও কোনও খাবারে স্বাদ পাচ্ছিল না, এখন পাচ্ছে৷ ঠিক হয়ে আসছে মন৷

দীপুদা সেই কুড়িটা টাকা সেদিন হাতে গুঁজে না দিলে জীবনটা অন্যরকম হত রূপসার৷ কেমন হত তা জানা নেই৷

খাওয়া শেষ করে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে আবার ফোন করল রূপসা এঁটো বাসন নিয়ে যাওয়ার জন্য৷ তারপর কী করা যায় ভাবতে না ভাবতেই আবার ল্যান্ডফোন বেজে উঠল৷ ফোনের রিংটোন সেতারের মূর্ছনা৷ ভারী সুন্দর৷ রূপসা ফোন রিসিভার তুলে হ্যালো বলল৷

ওদিক থেকে এক মহিলা পরিষ্কার বাংলায় বললেন, রূপসা, আপনার খাওয়া হয়ে গেছে?

হ্যাঁ৷

তাহলে আপনি এখন বিশ্রাম নিন, ঠিক বিকেল পাঁচটায় তৈরি থাকবেন, আপনার কাছে রথ যাবে৷ ওতে চলে আসবেন প্লিজ৷

আচ্ছা ঠিক আছে৷

ফোন রেখে রূপসা ভাবল, কেসটা কী? যাক, সবে তো আসা হল, ধীরে ধীরে বোঝা যাবে কী ব্যাপার৷ আর সময় নষ্ট না করে, ওই নরম গদিওলা বিছানায় নিজের শরীর ডুবিয়ে দিল রূপসা৷ আহ! কী শান্তি! কথাটা ভাবতে ভাবতে গভীর ঘুমে ডুবে গেল রূপসা৷

.

ঘুম ভাঙল সেই সুরেলা ঘণ্টার শব্দে৷ দরজায় কলিং বেল বাজাচ্ছে কেউ৷ দু’বার বেজে উঠতেই ধড়মড় করে উঠে বসল৷ ঘরে এসির ঠান্ডা হাওয়া আর নরম বিছানা, চোখ যেন খুলতে ইচ্ছে করছে না৷ নিজেকে প্রায় টেনে তুলে, দরজা খুলল৷ সেই ড্রেস পরা সারথি৷ রূপসাকে দেখামাত্র দুই হাত জড়ো করে প্রণাম করে লোকটি বলল, শুভ সন্ধ্যা, আপনি কি প্রস্তুত?

হ্যাঁ, একটু অপেক্ষা করুন৷

নিশ্চয়ই, আপনি প্রস্তুত হয়ে, রথে আসুন৷ আমি অপেক্ষা করছি৷ বলে আবার প্রণাম করে লোকটি ঘোড়ার গাড়িতে গিয়ে বসল৷ আবার হাসি পেল রূপসার৷ ছোটবেলায় টিভিতে মহাভারত সিরিয়াল দেখত৷ কর্ণ, অর্জুনরা যেমন মাথায় ছাতা দেওয়া ঘোড়ায় টানা রথে চলত৷ জীবনে কখনও ভাবেনি নিজেকেও এমন রথে চড়তে হবে! মানুষের ভাগ্য যে কখন কাকে কোনদিকে নিয়ে যায়…

পোশাক পরাই ছিল৷ শুধু চুল ভালো করে আঁচড়ে, কপালে একটা টিপ পরে বেরিয়ে এল রূপসা৷ দরজায় শুধু একটি শিকল৷ সেটাই তুলে দিল৷ তারপর চড়ে বসল রথে৷ আবার সুন্দর ছন্দে ছুটতে থাকল কালো রঙের ঘোড়া৷ মোরাম বিছানো লাল রাস্তা৷ আবার সেই দুইধারে ফুল-ফলের বাগান, ছোট ছোট পুকুর৷ পুকুরে পদ্ম ফুটে রয়েছে৷ সাদা রাজহাঁস ঘুরছে৷ কোথাও নিশ্চিন্তে ঘুরছে হরিণের পাল৷ এমন পরিবেশে এলে যে কারোরই থেকে যেতে মন করবে৷

সামান্যই রাস্তা৷ মাত্র মিনিট পাঁচেক৷ এবার রথ এসে থামল একটি বিল্ডিং-এ৷ একতলা, কিন্তু বেশ উঁচু৷ সেই ইতিহাস বইয়ের ছবির মতো পাথরের বাড়ি৷ বাইরে ফলকে দেবনাগরী হরফে লেখা, কলাকুঞ্জ৷

এখানেই নামব? সারথিকে জিজ্ঞাসা করল রূপসা৷

হ্যাঁ, এই দ্বার দিয়ে সোজা চলে যান, মা আপনার জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন৷

মা! শব্দটা কট করে কানে লাগল রূপসার৷ রথ থেকে নেমে সেই বাড়িতে ঢুকল৷ পাঁচ ধাপ চওড়া সিঁড়ি ওঠার পর মস্ত চওড়া বারান্দা৷ তারপর বিশাল উঁচু সদর দরজা৷ দেওয়ালে, দরজায় খিলানে সর্বত্র খাজুরাহোর মন্দিরের গায়ের মতো মৈথুন ভাস্কর্য৷ সবই সিমেন্ট-বালি বা প্লাস্টার প্যারিসে তৈরি কিন্তু দেখলে মনে হবে পাথর কুঁদে গড়া৷ তবে কারুকাজ করা দরজা সত্যিই কাঠের৷ দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল রূপসা৷ বিশাল একটা হলঘর৷ এতটাই বড় যে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে দ্রুত পৌঁছতে গেলে দৌড়তে হবে৷ সেই ঘরে কম করে জনা পনেরো বিভিন্ন বয়সের মেয়ে৷ প্রত্যেকেই ছবির শকুন্তলার সাজে৷ বুকে কাঁচুলি বাঁধা, চুলে খোঁপা কিংবা বিনুনিতে ফুলের মালা জড়ানো৷ গলায়, হাতে ফুল অথবা সোনার অলংকার৷ নাক, কান, পাও আভরণহীন নয়৷ শাড়ি পরার ধরনটি এমনই যে শরীরের অধিকাংশ অনাবৃত৷ কেউ বসে মালা গাঁথছে, কেউ একে অপরের গায়ে চন্দনের প্রলেপ দিচ্ছে, কপালে কুমকুম পরিয়ে দিচ্ছে৷ একদিকে সেতার আর পাখোয়াজ বাজাচ্ছেন দুইজন শিল্পী আর সেই তালে দুটি মেয়ে নাচের পোশাকে পায়ে ঘুঙুর পরে নাচছে৷ অন্যদিকে একটি মেয়ে বীণা বাজাচ্ছে আর তার মুখোমুখি বসে গান গাইছে আরেকজন৷ সব মিলিয়ে বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দেওয়ার মতো ব্যাপার৷ যেন কোনও নাটক মঞ্চস্থ করার আগে কুশীলবরা শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিচ্ছেন৷ একটি মেয়ে, বছর কুড়ি বয়স হবে একেবারে বনবালার সাজ, রূপসার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল৷ তার হাতে একটি সাজিতে ফুল ভরা৷

রূপসাকে সম্ভবত সালোয়ার পরা এবং জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে থমকে দাঁড়িয়ে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?

হ্যাঁ, মানে…মা…

ওই তো মা, আসুন আমার সঙ্গে৷ বলে মেয়েটি নিজেই রূপসাকে নিয়ে গেল এক মহিলার দিকে৷ সেই বিশাল ঘরের একপ্রান্তে একটা বেঁটে সিংহাসনে বসে রয়েছেন এক মহিলা৷ তাঁর সামনে মাটিতে বসে রয়েছে চারজন মেয়ে৷ তার মধ্যে তিনজন ওই পুরোনো স্টাইলের পোশাকে আর একজন জিন্স আর টপ৷ রূপসার দিকে তাকিয়ে মহিলা হেসে চোস্ত ইংরেজিতে বললেন, তুমি রূপসা, তাই তো?

হ্যাঁ৷

আমার কলাকুঞ্জে তোমাকে স্বাগত৷ বোসো বোসো৷ ভারী আপন করে নেওয়া কথা বলার ধরন৷

রূপসা বসল হাঁটু মুড়ে৷

তোমার নামটি ভারী সুন্দর৷ তাই তোমার নামে কোনও পরিবর্তন ঘটাইনি৷ এসো, ওদের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দিই৷ ও বিশাখা, ও অপালা, ও চিরশ্রী আর তুমি হলে রূপসা৷ বিশাখা আর অপালা গতকাল এসেছে, তুমি আর চিরশ্রী আজই যোগ দিলে৷ আমি হলাম চিত্রলেখা৷ এই যে দেখছ এই ঘরে সব মেয়েদের, এরা সকলে আমার হাতে তৈরি৷ ওরা সবাই আমাকে মা ডাকে৷ তোমরাও তাই ডেকো৷ বলে স্মিত হাসলেন মহিলা৷

রূপসা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল পঞ্চাশোর্ধ্বা মহিলার দিকে৷ বয়সটা মোটের ওপর আন্দাজ করা গেলেও রূপ যেন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়৷ মিস রেহানার মতো কি তার থেকেও অধিক সুন্দর বললে অত্যুক্তি হবে না৷ চোখে যেন ধাঁধা লেগে যায়৷ কাজল পরা দীর্ঘ চোখ, বেণীতে ফুলের মালা জড়ানো, নানারকমের সোনার গয়না যেগুলোর নামই জানা নেই রূপসার৷ একটা ঘনসবুজ রঙের তসরের শাড়ি এবং মসলিন কাঁচুলি পরে রয়েছেন তিনি৷ অনাবৃত পেটে একটিমাত্র ভাঁজ, কিন্তু সেই ভাঁজে তাঁর অসামান্য নাভিটি ঢাকা পড়ে যায়নি৷

গোটা পরিবেশটাই ভারী অদ্ভুত৷ একদিকে তবলা, পাখোয়াজের সঙ্গে নূপুরপরা পায়ের থেইই…তা তা থেই তা থেই তা-র বোল৷ অন্যদিকে সেতার বাজছে, সঙ্গে এস্রাজ৷ ফুলের গন্ধে ভরে রয়েছে ঘরখানি৷

তোমরাও আমাকে আজ থেকে মা বলেই ডেকো৷ মা যেভাবে তার সন্তানকে সবকিছু শেখায় আমিও আগামী একমাস ধরে তোমাদের প্রশিক্ষণ দেব৷ তোমাদের এই প্রশিক্ষণপর্বে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দুইটি বিষয়েই প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে৷ তোমাদের প্রশিক্ষণ শুরু হবে আগামীকাল ভোর পাঁচটা থেকে৷ তার মধ্যে তোমরা স্নান পর্ব সেরে এখানে উপস্থিত হবে৷ তবে সবার আগে যেটা আজ থেকেই তোমাদের একেবারে নিজের আত্মাকে বিশ্বাস করতে শুরু করাও যে, তুমি ভুলে যাবে তোমার পূর্ব পরিচয়, কে তোমার মা-বাবা, কোথায় তোমার জন্ম, তোমার পুরোনো জীবনযাত্রা—সবকিছু মনে-প্রাণে ভুলে যাওয়ার অনুশীলন করো৷ কোনও স্মৃতিচারণ করবে না৷ মনকে স্বচ্ছ রাখো, কারণ মন সুন্দর থাকলে তবেই দেহপট সুন্দর থাকবে৷ তোমরা নিজেদের মনে করো এই যে প্রাচীন ভারতের পরিবেশ তোমরা ইতিমধ্যে এই রূপমঞ্জরীতে দেখেছ, আগামীতে আরও অনেক কিছু দেখবে, মনে করবে এটাই সত্য৷ তুমি আসলে আজ থেকে হাজার বছর পূর্বের ভারতবর্ষের এক নারী, সামান্যা নারী নয়, রূপ এবং গুণের দিক থেকে অতি কাঙ্ক্ষিত এক নারী৷ রূপ তোমাদের মধ্যে রয়েছে, কিছু গুণাবলীও রয়েছে যে কারণে তোমরা রূপমঞ্জরীতে প্রবেশাধিকার পেয়েছ৷ এবার বাকি কলাগুলির প্রয়োজনীয় কিছু কলা আমি আগামীকাল থেকে তোমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করব৷ আশা করি তোমরা সেই শিক্ষাকে অন্তর থেকে গ্রহণ করবে৷ আবারও বলছি আজ এই মুহূর্ত থেকে তোমরা ভুলতে শুরু করো তোমাদের অতীতকে৷ মনে করো তুমি সেই প্রাচীন ভারতবর্ষের একজন৷ কেননা মন থেকে তুমি যদি বিশ্বাস না করতে পারো তাহলে তোমার প্রশিক্ষণ বৃথা যাবে৷ এই যে আমার মেয়েদের দেখছ, এদের অনেকেরই শিক্ষা সমাপ্ত, এদের অধিকাংশই কিন্তু ভুলে গিয়েছে তাদের অতীত জীবন৷ তোমরা কথা বলে দেখো ওদের সঙ্গে৷ নিজেরাই বুঝতে পারবে৷

এতটুকু বলে হাসলেন তিনি৷ তারপর বললেন, বিশাখা, অপালা এবং চিরশ্রী তোমাদের যে এই নতুন নামকরণ করা হয়েছে, আজ থেকে তোমরাও এই নামেই নিজেকে সম্পৃক্ত করতে শুরু করবে৷ ভুলে যাও নিজেদের পুরোনো নাম কী ছিল৷ আর রূপসা, তোমার নামটি পুরোনো বলেই অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে আপাতত, কিন্তু যদি দেখো তোমার এই নাম তোমার অতীতকে ভুলতে বাধা দিচ্ছে তাহলে আমাদের অকপটে জানিও৷ আমি তোমারও নাম বদলে দেব৷ আর হ্যাঁ, আরও একটা কথা, আমাকে যেমন তোমরা মা বলে ডাকবে সেটা মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করবে, যখন যা সমস্যা, যা জানার আগ্রহ, যা তোমার মনের প্রশ্ন তা নিশ্চিন্তে আমার কাছে রাখবে৷ আমি চেষ্টা করব তোমাদের কৌতূহল মেটানোর৷ আমার কাছে কোনওপ্রকার আড়াল তোমরা রাখবে না৷

বিশাখা নামের মেয়েটি বলল, মা, আমি কি রূপমঞ্জরী সম্পর্কে কিছু জানতে পারি? মানে আমি এখানে সুযোগ পেয়েছি ঠিকই কিন্তু খুব বেশি কিছু ধারণা নেই৷ যদি একটু বলেন৷

চিত্রলেখা মৃদু হাসলেন৷ সেই হাসিটিও বড় মোহময়৷ রূপসা চিত্রলেখার প্রতিটি নড়াচড়া, কথা বলার ধরন খুব মন দিয়ে খেয়াল করছিল৷ মহিলার সবকিছুর মধ্যে অদ্ভুত একটা ছন্দ রয়েছে৷ আর সেই ছন্দ খুব আকর্ষণীয়৷ এটা এক-দুই দিনে রপ্ত হওয়ার নয়৷ অনেক শ্রম রয়েছে৷

আমার ধারণা এই প্রশ্ন তোমাদের সকলেরই কম-বেশি মাত্রায় রয়ে গিয়েছে, কী তাই তো?

রূপসা বলল, আমার সত্যিই খুব আগ্রহ রয়েছে৷ যার মাধ্যমে এখানে যোগাযোগ তার কাছ থেকে সামান্যই জানতে পেরেছিলাম, কিন্তু ওই সামান্যই এত কৌতূহল তৈরি করেছিল আমার মনে, যে ইন্টারভিউ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি, এবং কাজটা হয়েও গেল৷

বেশ, তাহলে তোমাদের কিছুটা ধারণা দিই, সামান্য তোমরা জানো ঠিকই, তবু আমার কাছ থেকে শোনো৷ আর বাকিটা থাকতে থাকতে নিজেই জেনে যাবে৷ বলে চিত্রলেখা শুরু করলেন৷

আজ থেকে মাত্র সাত বছর আগে রূপনগরে এই রূপমঞ্জরীর স্থাপনা হয়৷ প্রথম পরিকল্পনা করা হয়েছিল একশো বিঘা জমির ওপরে তৈরি করা হবে এক প্রাচীন ভারতবর্ষের রেপ্লিকা৷ গোটা পৃথিবীর মানুষ দেখতে আসবেন, থাকবেন, আমাদের ভারতবর্ষের প্রাচীন ঐতিহ্যকে বুঝবেন৷ সেই ভাবনামতোই কাজ শুরু হয়েছিল৷ কিন্তু তারপর কর্তৃপক্ষ ভাবলেন শুধু কি ঐতিহ্যের রেপ্লিকা দেখিয়ে সারা বছর ট্যুরিস্ট টানা যাবে? ভারতে এখনও বহু প্রাচীন স্থাপত্য থেকে ঐতিহ্যের নানা নিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, যেমন নালন্দা, যেমন তাজমহল কিংবা অজন্তা, ইলোরা, খাজুরাহো ইত্যাদি৷ তো সেই আসলগুলিকে ছেড়ে নকল দেখতে মানুষ কেন আসবেন? তখন ভাবা হল ভারতের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যগুলির মধ্যে এমন কোনটি রয়েছে যা পৃথিবীর সকল ধর্ম, সম্প্রদায়, জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি নির্বিশেষে সমান আকর্ষণীয়৷ জগতে একটি জিনিস রয়েছে যার মধ্যে সকল নারী-পুরুষ যুগ যুগ ধরে সুখ খুঁজে পায় তা হল কাম৷ শাস্ত্রে বলছে মানবজীবনের মূল লক্ষ্য হল তিনটি৷ এক ধর্ম, দুই অর্থ ও তিন কাম৷ এদের একত্রে ত্রিবর্গ বলে৷ মানবজীবনে সাফল্য পেতে হলে এই তিনটি অতি আবশ্যক৷ আর মৃত্যুর পর পরলোকের কামনা হচ্ছে মোক্ষ৷ অর্থাৎ বার বার জন্ম-মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাওয়া৷ যাই হোক, এসব তোমাদের প্রশিক্ষণের সময়ই বিস্তারিত বলব, তো কামই যদি যুগ যুগ ধরে মানুষের প্রধান আকর্ষণ হয় এবং একমাত্র ভারতবর্ষ হল সেই দেশ যে দেশে এই কামকে নিয়ে সেই হাজার বছর আগেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিপুল পরিমাণে গবেষণা হয়েছে৷ বাৎসায়নের কামসূত্রের কথা তো তোমরা শুনেইছ, শুধু আমরা কেন গোটা বিশ্ব শুনেছে৷ কারণ কামের ওপর এত অসামান্য শাস্ত্র পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত রচিত হয়নি৷ কাম যে এক শিক্ষণীয় এবং অতি প্রয়োজনীয় কলা তা প্রথম অনুভব করেছিলেন এই ভারতবর্ষেরই বাৎসায়ন৷ তাঁর সম্পর্কেও আমি পরে তোমাদের জানাব৷ বলে একটু থেমে পাশে রাখা লম্বা স্ফটিকের গ্লাস হাতে নিয়ে তার ঢাকনা সরিয়ে এক চুমুক জল খেলেন৷ তারপর আবার গ্লাসটি যথাস্থানে রেখে দিয়ে বললেন, তো ঠিক হল সেই হাজার বছরের পুরোনো পরিবেশ এবং ভারতীয় কামকলার যে অসামান্য প্রকাশ একসময়ে ভারতবর্ষের গৌরব ছিল তাকেই যদি ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে সব উদ্দেশ্য সফল হবে৷ অর্থাৎ এই রূপমঞ্জরীকে এমন একটি নগররূপে নির্মাণ করতে হবে যেখানে প্রবেশমাত্র যে কেউ বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন যে তিনি আসলে চলে এসেছেন হাজার, দুই হাজার বছরের পুরোনো ভারতবর্ষে৷ আড়ালে কাজ করবে আধুনিক প্রযুক্তি, আধুনিকতার সব রকম ব্যবস্থাই থাকবে, কিন্তু তা প্রকাশ্যে নয়৷ শুরু হয়ে গেল নির্মাণের কাজ৷ এবার প্রয়োজন হল কামকলায় পটিয়সী নায়িকার৷ সত্যি বলতে যে ভারতবর্ষ অন্যান্য সংস্কৃতির মতো কামকলাতেও চূড়ান্ত উৎকর্ষ লাভ করেছিল তা বাকি সবকিছুর মতো সেই উৎকর্ষ, সেই গরিমাও হারিয়েছে৷

এবার আমি নিজের সম্পর্কেও তোমাদের কিছু বলি৷ আমি জন্মসূত্রে একজন কেরালিয়ন৷ অল্প বয়স থেকেই পড়াশোনায় মেধা ছিল আমার৷ আমার বাবা একজন ধার্মিক পুরুষ হলেও কিন্তু আমার মা ছিলেন বহুগামিনী৷ তিনি বহু পুরুষের সঙ্গ পছন্দ করতেন, এবং সঙ্গ করতেন৷ মায়ের এমন স্বভাবের কারণে আমাদের সংসারে সুখ-শান্তি কিছুই ছিল না, কিন্তু আমার মা বহুগামিনী হলেও নিজের সংসারের প্রতি, আমার এবং বাবার প্রতি কর্তব্যে কোনও ত্রুটি রাখতেন না৷ অপরূপ সুন্দরী ছিলেন আমার মা৷ এবং দিনের একটা বড় অংশ তিনি ব্যয় করতেন নিজের শরীর-রূপচর্চায়৷ আমি সামান্য বড় হওয়ার পর তিনি আমারও রূপচর্চায় যত্ন নিতে শুরু করেন৷ মায়ের কাছেই আমি শিখতে শুরু করি কীভাবে নিজের অঙ্গসৌষ্ঠবকে আরও আকর্ষণীয় এবং দীর্ঘস্থায়ী করা যায়৷ বাবা এইসব একেবারেই পছন্দ করতেন না৷ এবং মাকে মাঝে মাঝেই বেশ্যা বলে গালাগাল করতেন৷ আমি ওই বয়সে বেশ্যা শব্দের মানে জানতাম না৷ মাকে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, বেশ্যা কী? মা বললেন, বেশ্যা একজন শিল্পী৷ একজন গায়ক, একজন কবি কিংবা একজন নৃত্যশিল্পীর মতো বেশ্যাও একজন কলাকার৷ তার কলার মাধ্যম হল তার শরীর এবং প্রেম৷ মায়ের কাছে এমন কথা শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম৷ আর আমার বাবা হয়েছিলেন চূড়ান্ত ক্রুদ্ধ৷ তিনি আমাকে মায়ের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতেন, কিন্তু পেরে উঠতেন না৷ কারণ আমার বাবা ধার্মিক এবং পেশায় একজন পুরোহিত হলেও তিনি ছিলেন একজন অলস এবং জুয়াড়ি৷ পাশা খেলায় তীব্র আসক্তি ছিল বাবার৷ পৌরোহিত্যের সামান্য উপার্জন, কিন্তু জুয়ায় মাঝে মাঝে সেই টাকাটুকুও খুইয়ে বসতেন বাবা৷ তখন সংসার চলত মায়ের টাকায়৷ মা যেসব পুরুষসঙ্গ করতেন তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন ধনী এবং সমাজে যথেষ্ট প্রভাবশালী৷ তাঁদের কাছ থেকে মা নিয়মিত অর্থ বা উপহার এবং নিরাপত্তার আশ্বাস পেতেন, ফলে বাবা মনেপ্রাণে মাকে ঘৃণা করলেও নিজের বাড়ি থেকে মাকে দূর করে দেওয়া বা আমাকে মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে ফেলার সাহস দেখাতে পারতেন না৷ শুধু তর্জন-গর্জনই সার ছিল৷ বাবা সুযোগ পেলেই আমাকে বোঝাতেন আমি যেন মায়ের সংসর্গ থেকে দূরে থাকি, নইলে খারাপ হয়ে যাব৷ কিন্তু আমাকে মা-ই বেশি টানতেন৷ মা শুধু সুন্দরীই ছিলেন না, বিদুষীও ছিলেন৷ আমার গৃহশিক্ষার দায়িত্বও ছিল তাঁর ওপর৷ স্কুলে পড়াশোনায় আমি বরাবরই প্রথম দিকের ছাত্রী ছিলাম তা মায়ের কারণেই৷ যখন বাল্যকাল পেরিয়ে আমি কৈশোরে এলাম, অনেককিছু বুঝতে শিখলাম, আমি মায়ের রূপের পাশাপাশি মায়ের জ্ঞান-বিদ্যার প্রতি মুগ্ধ হয়ে গেলাম৷ এমনও হয়েছে মায়ের কাছে এসেছেন কোনও ব্যক্তি, মা তাঁর সঙ্গে শাস্ত্র আলোচনা করছেন৷ এবং সংস্কৃত ভাষায়৷ আমি মায়ের কাছে সংস্কৃত শিখতে শুরু করেছিলাম অনেক অল্প বয়স থেকেই৷ এবং ইংরেজি শিখতাম স্কুলে৷ মা ইংরেজি জানতেন চলনসই৷ আমি ঋতুমতী হওয়ার কিছুদিন পরেই মা আমাকে মানব শরীর, স্ত্রী ও পুরুষের কাম, সঙ্গম ইত্যাদি বিষয়ে জানাতে শুরু করেন এবং শুধু তাই নয়, কাম যে এক অসামান্য কলা সেই বিষয়েও তিনি আমাকে শিক্ষা দিতে শুরু করেন৷ ষোল বছর বয়সের আগেই আমি কপিল বাৎসায়নের ভরত নাট্যশাস্ত্র থেকে শুরু করে আরও নানা বিষয়ে জেনে ফেলি৷ নৃত্য এবং সঙ্গীতের চর্চা আমার পাঁচ বছর বয়স হতেই শুরু হয়েছিল, তার ওপর এইসব শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ফলে আমি অচিরেই বিভিন্ন মহলে জনপ্রিয় হয়ে উঠলাম৷ স্কুল-কলেজের গণ্ডি পার করেছি যখন ততদিনে আমারও মায়ের মতো একাধিক পুরুষসঙ্গ হয়ে গিয়েছে এবং বুঝতে পেরে গিয়েছি কাম যে একটি কলা তা নারী এবং পুরুষ কেউই জানে না এবং তার ফলে এই কামকে ভালো করে উপভোগ থেকেও বঞ্চিত থাকে৷ আমি ওই সময়ে নিজ উদ্যোগে আমার বাড়িতেই ছোট একটি স্কুল তৈরি করি যেখানে সঙ্গীত, নৃত্যের প্রশিক্ষণ তো দিতামই তার সঙ্গে শেখাতাম কামকলার বিভিন্ন মুদ্রা৷ পাছে সামাজিক আক্রোশে পড়তে হয় তাই নৃত্যের বা অভিনয়ের ছলে এইগুলি শেখাতাম৷ ভেবেছিলাম কেউ আসবে না শিখতে, কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে খুব কম দিনের মধ্যেই বহু ছেলেমেয়ে আমার স্টুডেন্ট হয়ে উঠল৷

আমার স্কুলের পরিচিতি বাড়তে থাকল এবং তারপরেই যা হয় আর কি, সমাজের হোতাদের নজর গেল আমার দিকে৷ তাঁরা আমার দিকে আঙুল তুলে বললেন, আমার মা ছিলেন একজন গণিকা এবং আমি তাঁর সুযোগ্যা কন্যা এখন ভদ্র ঘরের ছেলে-মেয়েদের বেশ্যাবৃত্তি শিখিয়ে উচ্ছন্নে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি৷ ভারতের সংস্কৃতির বারোটা বাজিয়ে নতুন প্রজন্মকে পশ্চিমী সংস্কৃতিতে তাদের দীক্ষিত করছি, আমি আসলে তাদের দালাল, আমি নারী-পাচারকারি ইত্যাদি ইত্যাদি আরও অনেক কিছু…তাঁদের কিছুতেই বোঝানো গেল না আমি যা শেখাচ্ছি তা সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতিরই অঙ্গ৷ আমি বরং সেই কলাকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছি, কিন্তু কে কার কথা শোনে? সামাজিক, রাজনৈতিক চাপে আমার স্কুল গেল বন্ধ হয়ে৷ ইতিমধ্যে আমার মা মাত্র কয়েকদিনের অসুস্থতায় গত হলেন৷ আমি পুরো একা হয়ে গেলাম৷ কী করব বুঝতে পারছি না৷ ওই বাড়িতে একা বাবার সঙ্গে থাকার কোনো প্রশ্নই নেই, কারণ আমাদের দুজনের ভাবনা-আদর্শে আকাশ-পাতাল পার্থক্য৷ ওই অবস্থায় আমাকে বাঁচিয়ে দিল একটি ফেলোশিপ৷ আমেরিকার একটি ইন্সিটিটিউটে আমি ফেলোশিপের জন্য অ্যাপ্লাই করেছিলাম৷ আমার বিষয় ছিল ভারতীয় চৌষট্টি কলার আধুনিকীকরণ৷ ফেলোশিপটা যেন আমাকে বাঁচার দিশা দেখাল৷ চলে গেলাম৷ দুই বছর সেখানে থেকে নিজের কাজ শেষ করলাম৷ তারপর ওখানেই একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পেয়ে গেলাম কাজ৷ সেখানে ভারতীয় কামশাস্ত্র পড়াতাম ছেলে-মেয়েদের৷ দেখতাম কী অসীম আগ্রহে তারা আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতিকে জানছে, শিখছে৷ অথচ আমার এমনই পোড়া দেশ যেখানে নিজের সম্পদের প্রতিই কোনও সম্মান নেই৷

.

একটানা কথাগুলো বলে চিত্রলেখা থামলেন, হেসে বললেন, তোমরা ভাবছ আমি রূপমঞ্জরীর কথা বলতে গিয়ে শুধু নিজের জীবনের কথাই কেন বলে চলেছি? কারণ রয়েছে৷ তোমরা আমাকে আজ থেকে মা বলে ডাকবে, তোমরা হলে আমার সন্তান৷ একজন সন্তান যদি তার মাকে ভালো করে না জানে, না বুঝতে পারে তবে তার প্রতি শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা ততটা জন্মায় না৷ এই শিক্ষা পেয়েছিলাম আমি আমার মায়ের কাছ থেকে৷ কী অসামান্য স্পষ্ট ছিলেন তিনি আমার কাছে, সেই কারণেই তাঁকে আমার খুব কাছের মনে হত৷ যাই হোক, জীবনের তিরিশটা বছর আমি কাটিয়ে ফেললাম নিউ জার্সিতে৷ অবশ্য শুধু নিউ জার্সি বলা ভুল হবে৷ আমেরিকার বহু কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে স্পিচ দিতে যাওয়ার কারণে ওই দেশের নানা শহরে তো বটেই, ইয়োরোপেরও অনেক দেশ ভ্রমণ করতে হয়েছে আমাকে৷ এক এক দেশে থাকতেও হয়েছে কখনও এক মাস, কখনো বা দুই-তিন মাস৷ বলতে পারো এক পর্যটকের জীবন৷ নিজের কাজের কারণে পরিচিতিও বেড়েছিল ঢের৷ বিয়ে করিনি, কারণ কোনও এক পুরুষের প্রতি আমাকে আজীবন লায়াবল থাকতে হবে এমন রীতিতে আমি বিশ্বাসী নই৷ আবার আমার কারণে অন্য কেউ আঘাত পাবেন সেটাও কাম্য নয়৷ নিজের পরিবারের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছি বাবা-মায়ের নিয়ত অশান্তি হলে সন্তানের বড় যন্ত্রণা হয়৷ আর সেই দম্পতিও আজীবন প্রেমহীন জীবন যাপন করে৷ প্রেমহীন জীবন আসলে মৃত জীবন৷ তাই আমি মায়ের মতো ভুল করিনি৷ নিজের পছন্দমতো চাহিদামতো বিভিন্ন সময়ে পুরুষসঙ্গী নির্বাচন করেছি, প্রেমে পড়েছি, অসামান্য সুখের কিছু মুহূর্ত কাটিয়েছি৷ তারপর আবার যে যার মতো সরে গিয়েছি৷ এটাই আমার দর্শন৷

ভেবেছিলাম বাকি জীবনটা প্রবাসেই কেটে যাবে৷ তখন একদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল এই রূপমঞ্জরীর ম্যানেজমেন্ট৷ কনসেপ্টটা বোঝানো হল আমাকে৷ খুব অভিনব লাগল আমার৷ ভারতবর্ষ এমন এক প্রাচীন সভ্যতার দেশ যেখানে যুগ যুগ ধরে পর্যটকরা আসেন, ভবিষ্যতেও আসবেন৷ এই রূপনগরে তৈরি করা হচ্ছে প্রাচীন ভারতের আদলে এক নগর যার কিছুটা অংশ হবে আবার গ্রাম৷ এবং সেখানে এমন এক গণিকালয় তৈরি করা হবে যার গণিকারা হবেন ভারতীয় কামকলায় শিক্ষিত৷ শুধু কামকলা নয়, চৌষট্টি কলার মধ্যে বিবিধ কলায় তাঁরা পটিয়সী হবেন৷ ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বাছাই করে আনা হবে তাদের যারা আগ্রহী এবং যোগ্য৷ কারণ, সমীক্ষা বলে ভারতের আধুনিক গণিকাদের প্রায় কেউই ভারতের প্রাচীন কামকলায় শিক্ষিত নয়৷ তারা হয় আনাড়ি অথবা পাশ্চাত্যের অনুকরণ করে৷ কামের মধ্যে প্রেম না মিশলে সেই মিলন সুখকর হয় না৷ সঙ্গমকে প্রেমময় করে তোলার মধ্যেই রয়েছে জীবনের প্রকৃত আনন্দ৷ রূপমঞ্জরীর ম্যানেজমেন্টের এক উচ্চপদস্থ কর্ত্রী অনামিকা পাণ্ডে আমার দীর্ঘদিনের বিশেষ বন্ধু, আমার কাজ সম্পর্কে সে জানত, অনেক দেশে আমি যে ছেলেমেয়েদের ভারতীয় কামকলার প্রশিক্ষণ দিয়েছি সেটাও তার জানা ছিল৷ ফলত এমন একটি পরিকল্পনার গণিকাদের প্রশিক্ষক হিসেবে যুক্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ করল আমাকে৷ সত্যি বলতে আমি দীর্ঘ তিরিশ বছর দেশের বাইরে থাকলেও একটি মুহূর্তের জন্যও আমার দেশের মাটি আমার স্মৃতি থেকে বিচ্যুত হয়নি, তার অন্যতম কারণও হয়তো আমার কাজটিই ছিল ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে৷ সত্যি বলতে, দেশে ফিরে আসার টানও মাঝে মাঝে অনুভব করতাম, কিন্তু ফিরে এসে করব কী? এই দেশে গণিকার আইনি বা সামাজিক স্বীকৃতি নেই, নিরাপত্তা নেই, মানুষ গণিকালয়কে অস্পৃশ্য ভাবে৷ তাই এখানে এলে আমার কোনও কাজ হত না৷ তাই এমন অভিনব প্রস্তাব পাবার পর আমি খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিই এই দেশে চলে আসব৷ অবশ্য তার আগে আমি তিনবার এই দেশে এসে ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে মিটিং করেছি৷ আমার প্রস্তাব, তাঁদের পরিকল্পনা ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি৷ তারপর পাকাপাকি চলে এলাম এই দেশে৷

একটানা কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন চিত্রলেখা, কিন্তু কথা বলার স্টাইলও কী অসামান্য! এক মুহূর্তের জন্যও শ্রোতা বোর হবে না৷ বরং হাঁ করে শুনবে, আরও শোনার আগ্রহ জাগবে৷

এই সেশনে তোমরা চারজন মনোনীত হয়েছ৷ আগামীকাল থেকে ঠিক এক মাস তোমাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ চলবে৷ এই একটি মাস কিন্তু যথেষ্ট শ্রমসাধ্য, তোমরা মানসিকভাবে আজই তার জন্য প্রস্তুত হও৷ প্রাচীনকালে গণিকাদের বাল্যকাল থেকেই প্রশিক্ষণের রেওয়াজ ছিল ফলে তারা যৌবন প্রাপ্তির শুরুতেই একজন প্রকৃত নায়িকা হয়ে উঠতে পারত, কিন্তু তোমাদের ক্ষেত্রে সেই সুযোগ নেই৷ কারণ, তোমরা প্রত্যেকেই ইতিমধ্যে যুবতী, ফলে আগে নায়িকারা যতটা শিক্ষালাভ করতে পারত তা তোমাদের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়, আর সত্যি কথা বলতে এখন যারা তোমাদের নায়ক হবে তাদের মধ্যেও কামকলার রসবোধ প্রায় নেই-ই৷ সে কারণে প্রথম একমাস তোমরা শুধুমাত্র শিক্ষা এবং তারপরের একমাস কিছুটা কাজ এবং শিক্ষা এবং তারপরে কাজ এবং অনুশীলন—এই হল তোমাদের আগামীদিনের কর্মসূচি৷ আজ এইটুকুই৷ কাল থেকে তোমাদের প্রতিটি মুহূর্তের হিসেব আমি নিয়ন্ত্রণ করব, কখন কী করবে তার সবটাই হবে আমার নির্দেশে৷ অবশ্য ভেবো না এটা কোনও ফৌজি প্রশিক্ষণ, কিন্তু জানো তো কিছু শিখতে গেলে সবার আগে প্রয়োজন শৃঙ্খলা৷ তাই আশা করি তোমরা মন দিয়ে সবকিছু শিখবে এবং ভালোবেসে শিখবে৷ কী শিখবে তো? বলে ধনুকের মতো বাঁকা ভুরুদুটি অতি দ্রুত একবার নাচিয়ে মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা করলেন চিত্রলেখা৷

চারজনেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল৷

বেশ, তোমরা তাহলে আসতে পারো৷ নিজেদের সঙ্গে একটু আলাপ-পরিচয় করে নাও৷ ঘুরে চারদিক দেখো৷ কাল ভোরবেলায় তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে৷

রূপসা উঠতে গিয়ে কী মনে করে চিত্রলেখার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল৷ ওর দেখাদেখি বাকি তিনজনও প্রণাম করল চিত্রলেখাকে৷

চিত্রলেখা আপত্তি করলেন না৷ এই প্রণামে তিনি অভ্যস্ত৷ সকলের মাথায় আলতো করে হাত ছুঁয়ে বললেন, আশীর্বাদ করি চমৎকার নায়িকা হয়ে ওঠো৷

রূপসার কানে বার বার এই নায়িকা শব্দটা বাজছিল৷ নায়িকা মানে? হিরোইন? সে তো সিনেমা-থিয়েটারে হয়…অবশ্য এখানেও প্রায় সেইরকমই৷ যাক গে, পরে জানা যাবে৷

ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল চারজনে৷

.

প্রথম শব্দটাই ‘উফ’ করল চিরশ্রী৷ তারপর ইংরেজিতে বলে উঠল, হে ভগবান! কী কঠিন সব ব্যাপার! পুরো ঘেঁটে গেছি৷

ওর কথায় হেসে উঠল তিনজনে৷

অপালা বলল, আমি তো পুরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছি৷ এ কোথায় এলাম? রামোজি ফিল্মিসিটি মনে হচ্ছে৷

হি হি হি! আমার তো মনে হচ্ছে টাইম মেশিনে চেপে গুপ্তযুগে চলে এসেছি৷ হেসে বলল রূপসা৷

সে টাইম মেশিনে বৈদিক যুগেই আসি বা রামোজি সিটিতে এবার আমাদের জীবন, ভাগ্য সবই এখানে লেখা৷ কেউই জানি না আমাদের সঙ্গে কী ঘটতে চলেছে৷ তবে এইটুকু বুঝে গেছি পুরো দুর্ভেদ্য জায়গা৷ বিপদে পড়লে পালানোর কোনও রাস্তা নেই৷

বিশাখার কথায় সায় দিল রূপসা৷

ওরা মোরাম বিছনো রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল৷ সন্ধে নেমে এসেছে৷ রাস্তার দুইপাশে কিছু দূর অন্তর ল্যাম্পপোস্ট৷ পোস্টগুলো অবিকল মশালের মতো দেখতে৷

আচ্ছা, আমরা এবারে নিজেদের পরিচয় পর্বটা সেরে ফেলি, কাল থেকে তো চারজনেরই জীবন একই নিয়মে বাঁধা পড়তে চলেছে৷

রূপসার কথায় বিশাখা বলল, হ্যাঁ, আমি বলি৷ আমার নাম রিয়া কোহলি, পাঞ্জাব থেকে এসেছি৷ এখানে নাম পেলাম বিশাখা৷

আমারও অপালা নাম এখান থেকে দেওয়া, আমার নাম অদিতি আকুলা৷ অন্ধ্রের মেয়ে আমি৷

আর আমিও দক্ষিণেরই মেয়ে৷ তামিলনাড়ুর৷ আসল নাম জুলিয়ান চন্দ্রশেখর৷ এখানে চিরশ্রী নাম পেয়েছি৷

শুধু আমার নামটাই অক্ষুণ্ণ থেকে গেল৷

হ্যাঁ, তুমি তো বাঙালি তাই না? জিজ্ঞাসা করল অপালা৷

হ্যাঁ, আমি বাঙালি, রূপসা দাশ৷ তবে আমার বাড়ি এই শহরে নয়৷ অনেকটাই দূরে৷ বলল রূপসা৷ আমি আসলে কাজ করতাম একটা বারে৷ সন্ধেবেলায় গান করতাম আর তারপর ক্লায়েন্ট সার্ভিস৷ প্লেজার ট্রিপেও যেতে হত৷ যে রেটে পরিশ্রম করতে হত, রোজগার হচ্ছিল না৷ সিনেমায় ট্রাই করেছিলাম৷ প্রোডিউসার, ডায়রেক্টর শুধু আমাকে নেড়েচেড়ে ছেড়ে দিল, চান্স পেলাম না৷ আবার সেই পুরোনো ধান্দা৷ হঠাৎই আমার এক সহেলি এই রূপনগরের কথা জানাল৷ অ্যাপ্লাই করলাম, ইন্টারভিউ হল, তারপর জয়েনিং, ব্যাস৷ বলে থামল রূপসা৷

বিশাখা বলল, উফ এখানকার ইন্টারভিউ! কী কঠিন!

সত্যিই যা বলেছ! আমি তো কল্পনাই করতে পারিনি আমাদের প্রফেশনেও এমন পরীক্ষা দিতে হবে৷

চিরশ্রীর কথায় রূপসার মনে পড়ল সেই দিনের কথা৷ একদিন ইন্টারভিউ আর আরেকদিন মেডিকেল হয়েছিল৷ শহরের একটি নামী ক্লিনিকে শরীরের সবকিছু টেস্ট হয়েছিল ওর৷ সকাল থেকে বিকেল গড়িয়ে গিয়েছিল সেদিন ওই ক্লিনিকে৷ পেমেন্ট রূপমঞ্জরী থেকেই করা হয়েছিল এবং কোনও টেস্টেরই রিপোর্ট রূপসাকে জানানো হয়নি৷ শুধু দিন সাতেক পর একটা ফোন এসেছিল মোবাইলে, অভিনন্দন, আপনি রূপমঞ্জরীতে ট্রেনি হিসেবে মনোনীত হয়েছেন৷ আগামী তিনমাস আপনার প্রবেশন পিরিয়ড৷ আপনার স্যালারি…আপনার অমুক আপনার তমুক… আপনাকে এই জমা রাখতে হবে…গড়গড় করে ফোনে কথাগুলো বলে চলেছিল মেয়েটি আর রূপসার হাসি পাচ্ছিল খুব, শালা বেশ্যার চাকরি তার জন্য আবার ট্রেনিং এই সেই অমুক তমুক…৷ কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ছিল না শুধু মোবাইলে একটা কোড দেওয়া মেসেজ এসেছিল৷ ওটাই নাকি অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার৷ কিন্তু শহরের যে নামী পাঁচতারা হোটেলটিতে রূপসার ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছিল সেটা যথেষ্ট কঠিন৷ ইংরেজিতে কথা বলার ধরন, ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পর্কে কেমন জ্ঞান থেকে কারেন্ট ইস্যু এবং তারপর সেক্স সম্পর্কে জ্ঞান, কতরকমের পশ্চার জানা রয়েছে তা প্র্যাকটিক্যাল দেখানোর জন্য ওই হোটেলেই কোম্পানির আনা দুটি পুরুষের সঙ্গে সারাদিনে চারবার নানা ভঙ্গিতে সেক্স করতে হয়েছিল আর পুরোটাই ভিডিওশু্যট হয়েছিল৷ তিনজন ইন্টারভিউয়ার ছিলেন যার মধ্যে দুজন মহিলা এবং একজন পুরুষ৷ টানা দু’দিন থাকতে হয়েছিল ওই হোটেলে৷ রূপসার হাঁটাচলা, খাওয়া, স্নান, লোকের সঙ্গে কথা বলা, ঘুমোনো, সুইমিংপুলে সাঁতার কাটা সবকিছু ওয়াচ করেছিলেন তাঁরা৷ ব্যাপারটা নেহাত সহজ ছিল না৷ রূপসাকে জানিয়েই ওর রুমে বসানো হয়েছিল ক্যামেরা যাতে ওর প্রতিটি মুহূর্তের মুভমেন্ট খেয়াল করা যায়৷ অলকা নামের যে মহিলা সিনিয়র ইন্টারভিউয়ার ছিলেন কম করে ষাট বছরেরও বেশি বয়স৷ স্লিম, অসম্ভব ফরসা, খুব সাজতেন৷ মাথার চুল ছিল ডাই করা৷ চড়া লালরঙের লিপস্টিক, অত্যন্ত অমায়িক ব্যবহার৷ ওই ইন্টারভিউতে রূপসা একা ছিল না৷ আরও দুটি মেয়ে এসেছিল৷ তবে তাদের কেউই মনোনীত হয়নি৷

ইন্টারভিউ শেষে পরদিন বিকেলে চেক-আউটের সময় অলকা ম্যাডাম রূপসার কাঁধে হাত রেখে মুচকি হেসে বলেছিলেন, তুমি ট্যালেন্টেড, কিন্তু পুরুষকে এত ঘৃণা করলে কী করে চলবে? পুরুষ প্রেম চায়, আসলে ভিখিরি তো৷

কথাগুলো শুনে চমকে উঠেছিল রূপসা৷ উনি কী করে বুঝলেন এত কথা! রূপসা পালটা প্রশ্ন করেছিল, আমি কি তাহলে মনোনীত?

তার উত্তর কিন্তু উনি সরাসরি দেননি৷ শুধু বলেছিলেন, হোপ ফর দ্য বেস্ট৷

ওই ইঙ্গিতেই রূপসা যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল৷ ফোন এসেছিল ঠিক সাতদিন পরে৷

চারজনে হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়াল একটা সরোবরের সামনে৷ বেশ বড় সরোবর৷ অন্ধকার নেমে আসার ফলে ওপার দেখা যাচ্ছে না৷ শান বাঁধানো ঘাটের পাশে একটা নৌকো দাঁড়িয়ে৷ নৌকোয় একটি কেরোসিন বাতি জ্বলছে৷ সেই আলোয় চারপাশ সামান্য আলোকিত৷ নৌকোটির সামনের অংশ ময়ূরকণ্ঠী৷ রঙিন কাপড়ে সাজানো একটি ছাউনিও রয়েছে৷ নৌকোর একপ্রান্তে চুপ করে বসে রয়েছে মাঝি৷ ওদের দিকে একবার তাকাল, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, যাবেন?

এখানে সকলেরই ভাষা ইংরেজি৷ বাংলা তো নয়ই, হিন্দিও নয়৷ এর কারণ কী কে জানে! এখানে যতদিন থাকতে হবে বাংলা ভুলে থাকতে হবে, বঙ্গদেশে থেকেও বাংলাহীন৷ যাক গে বাংলা নিয়ে আদিখ্যেতা করার কিছু নেই, স্পোকেন ইংলিশটা বুদ্ধি করে শিখেছিল বলে এই কাজটা হয়েছে, শুধু এটা কেন? অনেক কিছুই হয়েছে৷

অপালা ওদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ঘুরতে যেতে বলছে, যাবে নাকি সান্ধ্য নৌকাবিহারে?

বাকি তিনজন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই দেখল এক মধ্যবয়সী দীর্ঘ পুরুষ একটি মেয়েকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে এল ঘাটে৷ মেয়েটি নিজের অনাবৃত পা দুটি দোলাচ্ছে, এবং নিজের দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে রয়েছে সেই পুরুষের কণ্ঠ৷ রূপসা দেখল লোকটার বয়স যথেষ্ট, টাক মাথা, ফ্রেঞ্চকাট, খালি গায়ে, পরনে শুধু একটি ধুতি, মেয়েটির গায়ে অনেকরকম গয়না, বুক অনাবৃত৷ পুরুষটি বার বার মুখ ঝুঁকিয়ে মেয়েটির ঠোঁটে, বুকে গভীরভাবে চুমু খাচ্ছে৷ আর ওহ বেবি উমম…হ! বলে উঠছে৷

একঝলক দেখেই বোঝা যায় খাঁটি ইউরোপিয়ান৷ লোকটা ওদের দিকে দেখলও না, মেয়েটিকে ওই কোলে নিয়েই সোজা উঠে পড়ল নৌকোতে৷ ছেড়ে দিল নৌকো, খুব ধীরভাবে ভাসতে শুরু করল সরোবরে৷ মেয়েটির খিলখিল হাসি আর গয়নার শব্দ মিশতে থাকল হাওয়াতে৷ খুব বেশিদূর গেল না নৌকো৷ পুরুষটি নৌকোর ছাউনির ভিতরে ঢুকল না, বাইরেই চিত হয়ে শুয়ে পড়ল, মেয়েটি চেপে বসল পুরুষটির ওপর৷ শুরু হল ফোরপ্লে৷ দুজনের শীৎকার এবং উদ্দামতায় নৌকো দুলতে থাকল৷ মাঝি নির্বিকার ভাবে বৈঠা বাইছে, কখনও থামছে৷

চিরশ্রী বলল, ওয়াও! এ তো পুরো শ্রীকৃষ্ণের নৌকাবিলাস! দারুণ তো!

আমাদেরও করতে হবে৷ হেসে বলল অপালা৷ তবে নৌকোয় কাজ আমিও অনেকবার করেছি৷ না, এমন পুরোনো নৌকোয় নয়, হাউসবোটে৷ ওড়িশার এক ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের ছেলের সঙ্গে গিয়েছিলাম চিল্কায়৷ দুইরাত্রি ছিলাম লেকের মাঝে৷ দারুণ অভিজ্ঞতা৷ ছেলেটা বেশ ফুর্তিবাজ ছিল৷ দিব্যি মজায় কাটিয়েছিলাম দুটো দিন৷

এবার এখানে কেমন কাটাও দেখো৷ হয়তো বাকি জীবন এই লেকেই কাটাতে হবে৷

রূপসার কথায় হেসে উঠল তিনজনেই৷

তা তুমি কীভাবে এলে এখানে, তোমার গল্পটা শুনি? রূপসাকে জিজ্ঞাসা করল বিশাখা৷

আমার আর গল্প! আমাদের সকলের গল্পই তো এক তাই না? সামান্য এদিক- ওদিক৷ বলল রূপসা৷

তা ঠিক বলেছ৷ আমাদের গল্পগুলো একই৷ তবে যেটুকু বুঝেছি, আমরা এখানে অনেক কঠিন পরীক্ষা দিয়েই মনোনীত হয়েছি, কারণ আমি যার মাধ্যমে এখানকার খোঁজ পেয়েছিলাম সে একজন এজেন্ট৷ ফ্রেন্ডশিপ কোম্পানির এজেন্সি রয়েছে৷

মানে ওই শুট অ্যান্ড বোল্ড বন্ধু পাতা কোম্পানি? ফিক করে হেসে জিজ্ঞাসা করল চিরশ্রী৷

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল বিশাখা—আমি নিজেও বছর তিনেক ওই কোম্পানিতে ছিলাম৷ ক্লায়েন্ট বলতে সব বুড়ো ভাম, এমনি রিলেশনই পারে না তো আবার বোল্ড…একদিকে ভালো, খুব বেশি পরিশ্রম করতে হত না আমাকে৷ অল্পেই দম বেরিয়ে যেত ওদের৷ শুধু একবার পুনাতে যেতে হয়েছিল এক ক্লায়েন্টের কাছে৷ ওরে বাব্বা আমার জীবন প্রায় বার করে দিয়েছিল, এই একহাত লম্বা পেনিস৷ দেখলেই ভয় লাগত, কাজ করব কী? আর তেমনি গায়ে ষাঁড়ের মতো শক্তি, কী খেয়ে বড় হয়েছে কে জানে, আধঘণ্টা পেরিয়ে যেত শালার বীর্যপাত হত না৷ ভালো পেমেন্ট পেয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু ওখান থেকে ফিরে তিনদিন বিছানায় শুয়েছিলাম, সারা গায়ে ব্যথা৷ বেশ কয়েকদিন কাজে বেরোতে পারিনি৷

রূপসা ওদের কথা শুনছিল আর ভাবছিল নিজের কথা৷ সকলকে মনে নেই, অনেকের মুখই ঝাপসা, সেটাই চায় রূপসা, পুরোনো সব মুখগুলো প্রাণপণে ভুলে যেতে চায়৷ আগেও যে একটা জীবন ছিল, কয়েকটা মানুষ ছিল সেই জীবনে, তার স্মৃতি মনে রাখতে চায় না ও৷ কোনও ঘটনা, কোনও মানুষ কিচ্ছু না৷ এমনকি মাকেও ভুলে যেতে চেষ্টা করে৷ কিন্তু এমনই অভিশপ্ত কপাল যে কিছুই মন থেকে মুছে যায় না৷ টাটকা ক্ষতের মতো প্রতিনিয়ত জেগে থাকে৷

নৌকোটা বেশ খানিক দূরে চলে গিয়েছে৷ ঝাপসা অন্ধকারে শুধু নৌকোর লণ্ঠনের আলোটা মিটমিট করে জ্বলছে৷

চলো, কাল থেকে আমাদেরও সব লক্ষ্মী-সরস্বতী সেজে স্টেজে নামতে হবে৷ মাঝে মাঝে যা হাসি পেয়ে যাচ্ছে না! মাইরি কী বলব! পুরো যাত্রাপার্টির মতো লাগবে আমাকে৷ আমি যে ঘরটা পেয়েছি সেই ঘরে একটা আলমারি রয়েছে৷ খুলে দেখলাম সব মোগল আমলের শাড়ি-কাপড় সাজিয়ে রাখা রয়েছে৷ ওগুলোকে পরতে হবে৷ কীভাবে পরে কে জানে?

আমার আলমারিতেও রয়েছে৷ শিখিয়ে দেবে নিশ্চয়ই৷ আচ্ছা, আমাদের কাল ভোরে কি ওইগুলো পরে যেতে হবে? মানে সেসব তো কিছু…

রূপসা মাথা নেড়ে বলল, আমার মনে হয় না৷ তাহলে সেটা উল্লেখ করে দিতেন উনি৷

মা!

হ্যাঁ, আমাদের নতুন মা৷ আবার হি হি করে হেসে উঠল তিনজন৷

চলো, এবার ফেরা যাক৷

হ্যাঁ, চলো৷ চারজন হেঁটে ফিরতে থাকল৷ একটি ঘোড়া মৃদুমন্দ ছন্দে ওদের পাশ দিয়ে গেল৷ ঘোড়ায় চড়ে বসে থাকা পুরুষটি সম্পূর্ণ উলঙ্গ এবং তার দিকে মুখ করে কোলে বসে থাকা যুবতীটিও পোশাকহীন৷ মেয়েটি জড়িয়ে রয়েছে পুরুষটিকে৷ ঘন ঘন চুমু খাচ্ছে৷

ওরেব্বাস! যা বুঝছি ঘোড়ায় চড়েও কাজ করতে হবে আমাদের৷

হা হা হা! সেটাই মনে হচ্ছে৷ পুরো আর্মি ট্রেনিং৷

ঘোড়া আর হরিণ দেখেছি কিন্তু হাতি দেখলাম না, রূপসা বলল৷

না না, হাতিও রয়েছে, আমি সকালে দেখেছি৷ সেই মহাভারত সিরিয়ালের মতো সাজানো হাতি৷

আহা! আমার খুব শখ হাতির পিঠে চাপার৷ মনে হয় এবার পূর্ণ হবে৷ বলল অপালা৷

হ্যাঁ, এখানে হাতি-ঘোড়া সকলের পিঠে চেপেই ডিউটি করতে হবে মনে হচ্ছে৷

দেখো ভাই, এখানে যা পে প্যাকেজ তা যদি সত্যিই দেয় তাহলে হাতি-ঘোড়া কেন, আমি শজারুর পিঠে চেপেও কাজ করতে রাজি৷

রূপসার কথায় হি হি করে হেসে উঠল তিনজনেই৷

তোমার তো দেখছি খুব রস!

হুঁ, কোথায় আর রস? সব তো নীচ দিয়েই গলে গেল৷

আবার হাসির তোড়৷

আমাদের ঘরগুলো কিন্তু খাসা৷

হ্যাঁ, সত্যি দারুণ৷ কিন্তু কার কোনটা খেয়াল করিনি৷

আমিও দেখিনি, তবে আমার মনে হয় সব ঘরগুলোই কাছাকাছি হবে৷

ওরা গল্প করতে করতে যেদিকটায় হাঁটছিল সেটা ওদের ঘরে ফেরার রাস্তা নয়৷ রাস্তাটা ফাঁকা জায়গা ছাড়িয়ে বেশ ঘন জঙ্গলের ভেতর চলে গিয়েছে৷ জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে মশালের আলো দেখা যাচ্ছে৷

কী হচ্ছে ওখানে, যাবে নাকি দেখতে?

থাক৷ একদিনে সব দেখে লাভ নেই৷ অনেক কিছুই দেখার রয়েছে৷ ধীরে ধীরে দেখা যাবে৷ এবার ঘরে ফেরা যাক৷

কী করব ঘরে গিয়ে৷ মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ সবই তো জমা করে দিতে হল! এটা কিন্তু খুব বিরক্তিকর৷

কিছু করার নেই৷ টার্মসেই ছিল এগুলো কিছুই ব্যবহার করা যাবে না৷

হুঁ, আসলে ওই পরিবেশটাকে পুরোনো বানিয়ে রাখার চেষ্টাতেই এমন পদ্ধতি৷ তবে বলেছে তো একটা ক্যাফে রয়েছে, সেখানে গিয়ে নেট ব্যবহার করতে পারব৷

হুঁ, তা বলেছে৷ আমার তো ফেসবুকের পুরো ভরপুর নেশা৷ বলল অপালা৷ প্রতি দশ মিনিট পর পর ফেসবুক দেখি৷ ওখান থেকে অনেক ক্লায়েন্টও পেতাম৷ সত্যি বলতে আমি আমার ক্লায়েন্ট ধরতাম মূলত ফেসবুক, ফ্রেন্ডবুক, ডেটক্লাব এইসব সাইট থেকেই৷ আগে কাজ করতাম একটা ফ্রেন্ডস ক্লাবে৷ সেখানে ঝামেলা করে বেরিয়ে এলাম৷ তারপর একবছর ধরে নিজেই নিজের ক্লায়েন্ট জোগাড় করেছি৷ একটু চাপ হয়ে যাচ্ছিল৷ মানে রিস্কি৷ বিকল্প খুঁজছিলাম, তখনই যোগাযোগ হল এখানে৷ ওয়েবসাইট দেখে অ্যাপ্লাই করেছিলাম৷

ওয়েবসাইট দেখে! অবাক হল বিশাখা৷ কিন্তু এদের যে ওয়েবসাইট রয়েছে আমি দেখেছি, সেখানে কেরিয়ার অপশনে তো আমাদের…

না না, গণিকা চাই বলে কি আর সরাসরি দিতে পারে? ঘুরিয়ে বলা ছিল৷ ও ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম কী চাইছে, তোমরাও বুঝতে পারবে৷ ইন্টারভিউতেও অনেক বুঝে-শুনে তারপর আসল কথায় এসেছিল ওরা৷

কথার মাঝেই চিরশ্রী বলে উঠল, উফ! আমার কি সিগারেট খেতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু এখানে আবার সিগারেট নিষিদ্ধ৷ মানে ক্লায়েন্ট খেতে পারবে, আমরা পারব না, যদি না ক্লায়েন্ট অফার করে৷

হুঁ, আমারও তো এইসময় দুই চুমুক লাগে৷ বরফ দিয়ে কিন্তু…

ঘরে রয়েছে তো৷ কিন্তু নিজে নিয়ে খাওয়া বারণ৷ ক্লায়েন্ট খেলে তবে৷

হুঁ, চলো এবার যে যার ঘরে যাওয়া যাক৷ রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ব৷ কাল ভোরে ওঠা৷

ওদের চারজনের ঘর খুব কাছে না হলেও এক ঘর থেকে অন্য ঘরটি দেখা যায়৷ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রায় দশ-বারোটি ঘর রয়েছে৷ সবকটাই একই ধরনের৷

আমাদের ঘরগুলো কিন্তু দারুণ তাই না? বলল চিরশ্রী৷

হুঁ, মিলনকক্ষ, স্নানকক্ষ দুটোই জব্বর৷

কেন, ছাদটা দেখোনি?

বিশাখার প্রশ্নে রূপসা অবাক হয়ে বলল আবার ছাদেও যাওয়া যায় নাকি?

হ্যাঁ, খুব সুন্দর ছাদ তো৷ বারান্দার এক কোণে দেখো একটা সিঁড়ি রয়েছে৷ ছাদেও বেশ সুন্দর একটা খাট, আরও সব টুকটাক জিনিস রাখা রয়েছে৷ মানে নাগরের ছাদে করার ইচ্ছে হলে ওখানে উঠেও পক পক করতে হবে বলে হাত দিয়ে সঙ্গমের ইঙ্গিত করল বিশাখা৷

কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম৷ বলল রূপসা৷

এবং সেটাও শাস্ত্রীয় পদ্ধতিতে৷

আবার হাসির রোল৷

কিন্তু এত আয়োজন, তেমন লোক কিন্তু দেখছি না৷ সবই ফাঁকা ফাঁকা৷

দাঁড়াও, রয়েছে নিশ্চয়ই৷ কতটুকুই বা দেখেছি একদিনে? জায়গাটা যে পেঁয়াজের খোসার মতো সেটা বুঝে গেছি৷ একের পর এক লেয়ার৷ এখানেই পৌঁছেছি কতগুলো গেট পেরিয়ে বলো৷

তা ঠিক৷ আরও অন্দরমহল রয়েছে নির্ঘাত৷

বিচিত্র জায়গা সত্যিই! এখানে থাকতে থাকতে কয়েকদিন পর আমি কোন যুগের মানুষ সত্যিই ভুলে যাব৷ অপালা বলল৷

যা বলেছ, বিচিত্র জায়গাই বটে, নইলে কোনওদিন ভাবতেও পারিনি সেক্স করানোরও স্কুল হতে পারে! বলে নিজেই হেসে উঠল রূপসা৷

চিরশ্রী বলল, না গো, এমন স্কুল ভারতে প্রথম হতে পারে, বা থাকলেও এমন পুরোনো স্টাইলের এটাই হয়তো প্রথম কিন্তু অন্য দেশে এমন স্কুল শুধু নয়, ইউনিভার্সিটিও রয়েছে, এবং সেখান থেকে রীতিমতো সার্টিফিকেট কোর্স করা যায়৷

মানে! অপালার গলায় বিস্ময়৷

চিরশ্রী হেসে বলল, পর্নস্টার হওয়ার কোর্স৷ তোমরা কেউ রকো সিফ্রেদির নাম শুনেছ?

বিশাখা বলল, শুনিনি আবার! ইতালিয়ান পর্নস্টার, ওয়ার্ল্ড ফেমাস৷ উফফ! কী হার্ড কক, একবার যদি পেতাম! ভারতে এমন ফিজিকও নেই, এত দমও কোনও ব্যাটাছেলের দেখিনি৷ আমি ওর টার্জান এক্স শেম অফ জেন অন্তত একশোবার দেখেছি, দেখে পুরো ফিদা হয়ে গেছিলাম উফফ, বলে শূন্যে একটা চুমু ভাসিয়ে দিল বিশাখা৷

চিরশ্রী বলল, হ্যাঁ, তেরোশোর বেশি পর্নো মুভির নায়ক ওই রকো সিফ্রেদিকে ইতালির স্ট্যালোন বলা হয়৷ সেই উনিই বছর দুয়েক আগে ইতালিতে একটা ইউনিভার্সিটি তৈরি করেছেন হার্ড অ্যাকাডেমি নামে৷ যারা পর্নস্টার হতে চায়, তাদের সবরকমের শিক্ষা দেওয়ার জন্য৷ এবং মজার ব্যাপার হল…বলে একটু থামল, আমি নিজে ওই ইউনিভার্সিটি থেকে স্পেশাল ট্রেনিং নিয়ে এসেছি৷

মানে! কী বলছ! প্রায় চিৎকার করে উঠল অপালা আর বিশাখা৷ রূপসাও নিজের বিস্ময় চেপে রাখতে পারল না৷ বলে উঠল, সত্যি!

হ্যাঁ, সত্যিই৷ আসলে আমার এই ছাব্বিশ বছরের জীবনে অনেক ব্রথেল ঘুরেছি আমি৷ তেরো বছর বয়েসে ইন্ডিয়ার সব থেকে ভয়ঙ্কর ব্রথেল এলাহাবাদের মীরগঞ্জে পাচার হয়ে গিয়েছিলাম৷ পাড়ার এক দাদা কাজ দেবে বলে আমাকে ওখানে নিয়ে গিয়ে বেচে দিয়েছিল, সেখান থেকে কখনও মুজফফরপুর, কখনও মুম্বই যখন যেখানে বিক্রি হয়েছি সেখানে চলে যেতে হয়েছে, এই বাংলার সোনাগাছিতেও কাজ করেছিলাম ছয় মাস, ওখান থেকেই সুযোগ বুঝে পালাতে পেরেছিলাম এক কাস্টমারের সাহায্যে৷

কাস্টমারের সাহায্যে! বলো কী! প্রেমে পড়েছিল নাকি?

হি হি হি! তা পড়েছিল, বিয়েও করতে চেয়েছিল আমাকে, আমি বারণ করেছিলাম৷ বেশ্যাকে বিয়ে করতে নেই বলে বুঝিয়েছিলাম৷ তা রাজিও হয়েছিল৷ সত্যি কথা বলতে ওসব বিয়ে-টিয়ের বাঁধনে পড়ার আমার আর ইচ্ছেও ছিল না৷ যে লাইনে একবার চলে এসেছি বুঝে গিয়েছি এই লাইনে যদি উন্নতি করতে পারি আমার পয়সা খাবে কে? তাই প্রাণপণে চেষ্টা করছিলাম উন্নতির৷ অনেক যোগাযোগ ছিল ছেলেটার, ওই আমাকে নামকরা একটা এসকর্ট সার্ভিসে ব্যবস্থা করে দিল৷ খুব দ্রুত ওখানে হাইপ্রোফাইল হয়ে উঠলাম আমি৷ কোম্পানির নিজস্ব পর্নো মুভি মেকিং-এর ইউনিট ছিল, আমাকে সেখানে নিয়ে নেওয়া হল৷ তোমরা জানো নিশ্চয়ই ওয়ার্ল্ডে পর্নো মার্কেটে ভারতীয় পর্নোর বিশাল কদর৷ আমি সেখানেও খুব উন্নতি করে ফেললাম৷ আমার পর্নোর সিডি খুব বিক্রি হতে থাকল৷ বেশ ভালোই কামাচ্ছিলাম৷ কিন্তু ইয়োরোপিয়ান বা নিগ্রো ছেলেগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছিলাম না, কারণ বিশাখা তুমি যা বললে ওটা ঠিক, ইন্ডিয়ান ছেলেদের অ্যাভারেজ পেনিসের সাইজ বলো বা সেক্স করার সময়সীমা যথেষ্টই কম, আর কায়দা-কানুনও বিশেষ জানা নেই৷ কয়েকজন হাইপ্রোফাইল জিগালো দিয়ে চেষ্টা করা হল কিন্তু ক্যামেরার সামনে ওরা আড়ষ্ট হয়ে যাওয়ায় ব্যাপার জমল না, আমিও সত্যি বলতে নাকের ডগায় ক্যামেরা নিয়ে খুব বেশি সহজ হতে পারতাম না৷ কোম্পানির ম্যানেজার একদিন আমাকে ডেকে অ্যাপ্লাই করতে বলল হার্ড অ্যাকাডেমিতে৷ আমারও ধারণার বাইরে ছিল এমন কোনও ইউনিভার্সিটি হতে পারে বলে…, তো নিজের প্রোফাইল ইত্যাদি সমেত অ্যাপ্লাই করলাম, তিনমাস পর ওখান থেকে রিপ্ল্যাই এল আমাকে ইতালি যেতে হবে ইন্টারভিউয়ের জন্য৷ আমার মাথায় হাত! বলে কী! জীবনে কোনওদিন বাংলাদেশই যাইনি তো ইতালি! পাসপোর্টও নেই৷ কিন্তু কোম্পানিই আমার সব ব্যবস্থা করে দিল৷ পাসপোর্ট, ভিসা, টাকাপয়সা সবকিছু দিয়ে পাঠিয়ে দিল সেই ইতালি৷ কী বলব ভাই, জীবনে কত রিস্ক নিয়ে কাজ করেছি, কিন্তু দেশের মাটি ছেড়ে প্রথমবার অন্য দেশে যাওয়ায় যে কী ভয় লাগে বলে বোঝাতে পারব না৷

উফফ! এ তো টানটান থ্রিলার দেখছি, তারপর কী হল? উত্তেজনায় টগবগ করে উঠল অপালা৷

তারপর পৌঁছলাম৷ এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে যাওয়া থেকে হোটেল, খাওয়া-দাওয়ার সমস্ত খরচ দিয়েছিল ওই ইউনিভার্সিটি৷ আর অ্যাকাডেমির কথা কী বলব! দেখে আমার দুই চোখ ছানাবড়া৷ ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে প্রায় দুশো ক্যান্ডিডেট এসেছিল ইন্টারভিউতে৷ চারজন ইন্টারভিউয়ার ছিলেন তারমধ্যে রকো নিজেও ছিলেন৷

তুমি দেখলে রকোকে! উফ! কী সৌভাগ্য! লাফিয়ে উঠল বিশাখা৷

বাবা, তুমি তো দেখছি রকোর বিশাল ফ্যান!

ফ্যান মানে! সেই ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময় প্রথম রকোর পর্নো দেখেছিলাম, ওই জিনিস দেখে আমার কয়েক রাত ঘুম হয়নি৷ পরে যখন প্রফেশনে এলাম, প্রথম দিকে কত ওইরকম চিজ খুঁজেছি, ধারেকাছে কেউ গেল না৷ পুরো শাল গাছের ডাল! উফ! একটা শটও যদি পেতাম…

বিশাখার এমন উচ্ছ্বাস, এমন আফশোস দেখে আর চুপ থাকতে পারল না রূপসা৷ বলে ফেলল, এতদিনেও তোমার শখ মেটেনি? মন থেকে ইচ্ছে জাগে?

হ্যাঁ, আমি আমার কাজটাকে ভালোবাসি, রীতিমতো উপভোগ করি আজকের দিন পর্যন্ত৷ বলল বিশাখা৷

বিশাখার ইংরেজি উচ্চারণ খুব স্পষ্ট এবং কাটাকাটা৷

চিরশ্রী বলল, ঠিক এই কথাটাই ট্রেনিং-এর প্রথম দিনে রকো আমাদের বলেছিলেন৷ যদি সব পেশার মতো এই পেশাটিকে মন থেকে না নিতে পারো, যদি ভেবে থাকো এই পেশা ঘৃণ্য, যদি প্রতিটি সঙ্গমকে উপভোগ না করার ক্ষমতা থাকে তোমার, দায়সারা শুধু অর্থ উপার্জন বলে মনে হয়, তাহলে এই পেশা তোমার জন্য নয়, তুমি কখনোই একজন ভালো পর্নস্টার হতে পারবে না৷

ঠিক কথা৷ আমিও এটাই মানি৷ তারপর বলো, তারপর কী হল? রকোর সঙ্গে করলে?

আরে, এই মেয়ে তো রকো রকো করে অস্থির! রকো রকো৷ না করিনি, মানে ওঁর সঙ্গে সেক্স করার সুযোগই পাইনি৷ উনি আমাদের চোদ্দদিনের ট্রেনিং দিয়েছিলেন৷ মোট সতেরোশো ছেলে-মেয়ে ওখানে ভর্তির আবেদন করেছিল, সেখান থেকে মাত্র সাতজন ছেলে আর সাতজন মেয়েকে বেছেছিলেন উনি৷ এবং আমার সৌভাগ্য আমি মনোনীত হয়েছিলাম৷ এবং সত্যি বলছি ওই কয়েকটা দিনে আমি যা শিখেছি তা সত্যিই অসাধারণ! তোমরা হয়তো আমার অভিনয় করা মুভি দেখোনি, না দেখাই স্বাভাবিক৷ কারণ আমার ভিডিওগুলো নেটে ফ্রিতে পাওয়া যায় না৷ দেখলে বুঝতে পারবে পারফরম্যান্সে আমি সানি লিওনের থেকে কোনও অংশে কম নই৷ কিন্তু ওর যে ব্র্যান্ড রয়েছে তা আমার নেই৷ ফলে…

আহা, ওসব ছাড়ো৷ তুমি তো আমাদের অবাক করে দিলে! মানে তুমি একজন ইতালি থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া পর্নস্টার!

অপালার কথায় যোগ দিয়ে বিশাখা বলল, এবং বিশ্ববিখ্যাত রকোর শিষ্যা৷

হ্যাঁ, ওঁর শিক্ষা সত্যিই আমার কাজে লেগেছে এবং রকো আমাকে একদিন একটা কথা বলেছিলেন, তুমি তো ইন্ডিয়া থেকে এসেছ যে দেশ কামকলার পীঠস্থান৷ এবং আমার অভিজ্ঞতা বলে আজও ভারতীয় মেয়েদের মতো কামোদ্দীপক এবং কামকুশলী আর হয় না৷ যৌনতা কীভাবে করে সেটা তুমিও জানো, আমিও জানি, কিন্তু ভারতবর্ষই প্রথম একটি দেশ যে শিখিয়েছিল যৌনতা আসলে একটি ভাষা, একটি সংস্কৃতি৷ সত্যি বলছি, রকোর মুখ থেকে ভারতের এমন প্রশংসা শুনে কী যে ভালো লেগেছিল আমার৷ তাই দেশে ফিরে বেশ কিছুদিন আমার কোম্পানিতে কাজ করার পর যখন এই রূপমঞ্জরীর হদিশ পেলাম আমি আর অপেক্ষা করিনি৷ আবেদন করে দিয়েছিলাম৷ এবং মনোনীত হওয়ার পর যখন আমার কোম্পানিতে ইস্তফাপত্র জমা দিলাম, সিইও স্যর নিজে আমাকে এই রূপমঞ্জরীর প্রায় দ্বিগুণ মাইনে দিয়ে রেখে দিতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলাম ভারতীয় কামকলা আমাকে শিখতে হবে৷ আর সেটার সুযোগই এখানে ছিল৷ তাই চলে এলাম৷ এবার দেখা যাক, জীবন কোনদিকে গড়ায়৷

উফ! দারুণ দারুণ…কিন্তু একবারও রকোর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেলে না! তোমার জায়গায় আমি থাকলে তো একবার হলেও ওকে রাজি করাতামই, বলে বিপাশা ওর ঠোঁটদুটো সরু করে চোষার ভঙ্গি করল৷

এই মেয়েটা খুব ফাজিল তো! বলল চিরশ্রী৷

যাক, এবার চলো অনেক গল্প হল৷ নিজ নিকেতনে ফেরা যাক৷ পরে আরও গল্প হবে৷

হ্যাঁ, কাল ভোরবেলায় দেখা হচ্ছে৷ শুভরাত্রি৷

চারজনই পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে যে যার ঘরের দিকে চলে গেল৷

নিজের ঘরের বারান্দায় উঠে থমকে দাঁড়াল রূপসা৷ আবার নীচে নেমে খোলা আকাশের দিকে তাকাল, ঘন কালো প্রশস্ত আকাশ৷ লম্বা শ্বাস নিল ও৷ বসন্তের রাতের মিঠে হাওয়া শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে৷ আগামীকাল থেকে আবার এক অজানা জীবনে ঝাঁপ৷ জীবন কখন কোনদিকে যায় কে জানে…৷

.

একটু আগেই ভোর হয়েছে৷ সূর্যের সোনালি আলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীতে৷ পাখির কলকাকলিতে শুরু হতে চলেছে একটি দিন৷ ওই সোনাগলা নরম আলোতে সবুজ ঘাসে মোড়া এক প্রশস্ত মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে চার তরুণী রূপসা, অপালা, বিশাখা এবং চিরশ্রী, চারজনেই সম্পূর্ণ পোশাকহীন, একটি সুতোও তাদের শরীর স্পর্শ করে নেই৷ মন্দিরগাত্রে খোদিত পাথরের নারীমূর্তির মতো স্থির প্রত্যেকে৷ সূর্যের প্রথম আলো স্পর্শ করছে তাদের খোলা চুল, গলা, স্তন, জঙ্ঘা, ঊরু, নিতম্ব, পায়ের প্রতিটি আঙুলকে৷ তাদের চারজনই স্থির হয়ে রয়েছে নৃত্যের ভিন্ন চারটি মুদ্রায়৷ আর তাদের খুব খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন চিত্রলেখা৷ কখনও খুব কাছে এসে, কখনও একটু দূরে গিয়ে৷ মাঝে মাঝে নির্দেশ দিচ্ছেন মুদ্রা বদলের৷ তাঁর পরনে রেশমের সাদা শাড়ি ধুতির মতো করে পরা, বুকের কাঁচুলিটিও সাদা৷ নানা অলংকারে সজ্জিত তিনি৷ চারজনের মধ্যে একমাত্র রূপসাই উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা, বাকি তিনজনই যথেষ্ট ফর্সা, বিশেষ করে অপালার গায়ের রঙ যেন দুধে-আলতায়, বিশাখার ত্বক কাঁচা হলুদের মতো উজ্জ্বল৷ স্বর্ণাভ সূর্যালোকে এই চার রমণীকে অপ্সরার মতো সুন্দর লাগছে৷ চিত্রলেখা ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে তাদের কাঁধ, স্তন, ঊরু, করতল স্পর্শ করছেন, কিছু বুঝতে চাইছেন৷

আজ ঠিক ভোর পাঁচটায় চারজন উপস্থিত হয়েছিল কলাকুঞ্জে৷ চিত্রলেখা ওদের জন্য তার আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন৷ ওদের নিয়ে এলেন কুঞ্জের পাশের মাঠে৷ চারজনকে পাশাপাশি পূর্বদিকে মুখ করে দাঁড়াতে বললেন৷ দাঁড়াল ওরা৷ তারপর বললেন, তোমরা নিরাবরণ হও৷

একটু অবাক হয়েছিল চারজনেই৷ যদিও বিবস্ত্র হওয়া তাদের কাছে নতুন কিছু নয়, নিরাবরণ শরীর নিয়ে তাদের অহংকার রয়েছে কিন্তু লজ্জাবোধ নেই৷ তবু এই ভোরবেলায় ফাঁকা মাঠে হঠাৎই বিবস্ত্র হওয়ার নির্দেশ বেশ চমকিত করেছিল ওদের৷ কিন্তু শিক্ষকের নির্দেশকে প্রশ্ন করেনি কেউ৷ নিঃশব্দে ছেড়ে ফেলেছিল নিজেদের পোশাক৷ তারপর মায়ের দেখানো মুদ্রায় দাঁড়িয়েছিল সকলে৷

চিত্রলেখা অন্তত পনেরো মিনিট ধরে ওদের শরীরকে দেখে তারপর বললেন, তোমরা এবার বসো৷

চারজনকেই চিত্রলেখা নগ্ন অবস্থায় ওই মাঠের ওপরে বসতে নির্দেশ দিলেন৷ নিজেও বসলেন৷ তারপর বললেন, আমি তোমাদের প্রকৃতি বুঝে নিলাম৷ আচার্য বাৎসায়ন বলেছেন রূপ, শীল ও গুণ অনুযায়ী নারী চারপ্রকার৷ হস্তিনী, পদ্মিনী, চিত্রিণী এবং শঙ্খিনী৷ তোমাদের গুণ আমার এখনও জানা হয়নি, বাহ্যিক রূপটি দেখলাম৷ তবে আমার এতদিনের অভিজ্ঞতায় তোমাদের বাহ্যিক রূপ দেখেই তোমাদের চরিত্র এবং রতির প্রকৃতি আন্দাজ হয়ে গিয়েছে৷ প্রথমে তোমরা খেয়াল করো অপালাকে৷ বলে উনি অপালাকে উঠে দাঁড়াতে বললেন৷

উঠে দাঁড়াল অপালা৷

তোমরা খেয়াল করো ওর শরীরের দিকে৷ ও দীর্ঘাঙ্গিনী৷ ওর দুই হাত এবং পা যথেষ্ট লম্বা, কপাল ছোট, স্তনের আকৃতিও বড় নয়৷ হাতের এবং পায়ের পাতার শিরা স্পষ্ট, ওর হাতের তালু এবং শরীর ছুঁলে তোমরা বুঝতে পারবে উষ্ণ অর্থাৎ পিত্তপ্রধান৷ আচার্য বাৎসায়ন এই আকারের নারীকে চিহ্নিত করেছেন শঙ্খিনী রূপে৷ বোসো তুমি৷ বিশাখা আর চিরশ্রী এবার দাঁড়াও৷

বিশাখা আর চিরশ্রী উঠে দাঁড়াল৷

চিত্রলেখা বললেন, রূপসা আর অপালা তোমরা এই দুজনকে খেয়াল করো৷ দেখো বিশাখার ও চিরশ্রীর ত্বক যেমন শুভ্র ততোধিক কোমল৷ এতটাই কোমল যে তোমাদের শরীরের যে কোনও অংশ একটু চেপে ধরলেই সেখানে আঙুলের ছাপ পড়ে যায়, লাল হয়ে ওঠে৷ তাই তো?

ঘাড় নেড়ে সায় দিল দুজনেই৷

চিত্রলেখা রূপসা আর অপালাকে বললেন, এবার ওদের মুখমণ্ডলের দিকে তাকাও৷ দেখো, দুজনেরই মুখের গড়ন গোলাকার, চোখ দীঘল এবং অক্ষিগোলক হরিণের মতো চঞ্চল৷ ওদের দুইজনের শরীর থেকে সবসময় সুগন্ধ বের হয়৷ ঘামের গন্ধটিও সুন্দর৷ গায়ের রং যেমন চাঁপা ফুলের মতো, চোখের পাতাও পদ্মের পাপড়ির রঙের৷ ওদের দুজনেরই নাক টিকলো এবং স্তন উন্নত, কটি ক্ষীণ এবং চলন রাজহাঁসের মতো ধীর৷ কণ্ঠস্বর মধুর৷ এই প্রকৃতি হল পদ্মিনী৷ আমি নিজেও পদ্মিনী৷ এবার রূপসা এসো৷

উঠে দাঁড়াল রূপসা৷ অনেক আগে একবার এসব শঙ্খিনী, পদ্মিনী শুনেছিল কিন্তু সেসব কী তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি৷ আজ মায়ের কাছে এমন ব্যাখ্যা শুনে বেশ মজা লাগছে৷ দেখা যাক মা কী বলে৷

রূপসাকে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াতে বললেন চিত্রলেখা৷ রূপসা তেমনই দাঁড়াল৷ চিত্রলেখা বললেন, তোমাদের মধ্যে একমাত্র শ্যামাঙ্গী হচ্ছে রূপসা৷ কিন্তু কী আশ্চর্য রূপময়ী দেখো! প্রকৃতির যে কোনও কিছুকে সর্বোত্তম দেখার শ্রেষ্ঠ সময় হল এই ভোর৷ সূর্যের প্রথম আলোতে তুমি যাকে দেখবে সেটাই তার প্রকৃত রূপ৷ সেই কারণেই সূর্যদেবের এই প্রথম রশ্মিতে তোমাদের দেখার আয়োজন৷ এই রূপমঞ্জরীতে যে গণিকারাই এসেছে তাদের প্রকৃতি নির্ধারণের জন্য আমি এই স্থান এবং এই সময়ই নির্বাচন করেছি৷ বলে চিত্রলেখা বললেন, রূপসার কণ্ঠ দেখো শঙ্খের মতো সুন্দর এবং তিনটি ভাঁজবিশিষ্ট৷ চুল কোঁচকানো, ওর স্তন, নিতম্ব, জঙ্ঘা সবই পুরুষ্টু এবং আকর্ষণীয়৷ তনুখানি নির্মেদ অথচ অতীব কোমল৷ এই প্রকৃতি হল চিত্রিণী৷ বলে চিত্রলেখা ডানহাতটি সামান্য তুলে বলে উঠলেন—

শ্যামপদ্মমুখী কুরঙ্গনয়না অভোদরীবৎসল্য

সঙ্গীতাগমোবোদিনী বরনতনুজং স্ত্রীণি শিল্পিনী৷৷

বাহ্যালাপরতা মবদজগতি সক্তং কুমাদ স্তনো৷

মত্তেয়ং কবি সাধবেন কথি তো চিত্রেপনা চিত্রিণী৷

যেমন স্পষ্ট ইংরেজিতে চিত্রলেখা কথা বলেন, তেমনই জড়তাহীন সংস্কৃত উচ্চারণ৷

রূপসার দিকে তাকিয়ে চিত্রলেখা বললেন, তুমি নাচ-গান জানো?

গান জানি না, তবে নাচ বলতে ওই আর কি…তেমন কিছু না৷

বেশ দেখব তোমার নাচ৷ আচার্য বলছেন, চিত্রিণী প্রকৃতির রমণী তার নায়কের কাছে বসে গল্প শুনতে ভালোবাসে, আর ভালোবাসে শৃঙ্গার করতে, নিজেকে পোশাকে, অলংকারে, ফুলে-মালায়-গন্ধে সাজাতে৷ আর সব থেকে মজার হল এরা রতিক্রিয়ায় আগ্রহী কম হয়, কিন্তু প্রেমের অভিনয়ে চৌখস৷

শুনে চমকে গেল রূপসা৷ এতক্ষণ চিত্রলেখার কথাগুলো শুনে নেহাৎই কথার কথা ভেবে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছিল না, কিন্তু ও যে কোনওকালেই ছেলেদের ভালোবাসতে পারেনি, শুধু একরাশ ঘৃণা ছাড়া ছেলেদের জন্য ওর কাছে আর কিছুই নেই সেটা ও ছাড়া আজ পর্যন্ত আর কেউ জানে না৷ না জানে…একজন শুধু জেনেছিল, দীপুদা৷ মন থেকে সঙ্গে সঙ্গে ভাবনাটাকে তাড়াল রূপসা৷

চিত্রলেখা বললেন, আরও একপ্রকার নারী রয়েছে হস্তিনী৷ এদের দেহ স্থূল, রোমশ এবং দাঁত বড়, এবং গাত্রবর্ণ রক্তাভ৷ এরা স্বভাবে বাচাল, অতিরিক্ত কামুক এবং ক্রোধী হয়৷ ঝাল-মশলা দেওয়া খাবার খেতে ভালোবাসে৷ আমাদের রূপমঞ্জরীতে তিনজন গণিকা রয়েছে হস্তিনী গোত্রের৷

বিম্বোষ্ঠী বহুভোজনরুচি রুষ্টৈশ্চ সাধ্যয়াতে

গৌরাঙ্গী করিয়ান গন্ধ রুচিরা সেয়ং সত্য হস্তিনী৷

চিত্রলেখা শ্লোকটি শেষ করা মাত্র বিশাখা বলে উঠল, কিন্তু মা, আচার্য কি শুধু হস্তিনী আর চিত্রিণীর জন্যই শ্লোক রচনা করেছেন? আর আমরা বাদ?

শুনে হেসে উঠলেন চিত্রলেখা৷ রূপসা খেয়াল করল মহিলা এমন সুন্দর করে হাসেন যে কেউ দেখে ওই হাসির প্রেমে পড়ে যাবে৷ এটাও কি ট্রেনিং নেওয়া হাসি?

না না, সকলের ক্ষেত্রেই বলেছেন আচার্য৷ বলব তোমাদের৷ এখন তো শুধু শরীরের গঠনগত দিক বললাম, যোনির গভীরতা ভেদেও মৃগী, বড়বা ইত্যাদি৷ আসলে নারীর যেমন এমন ভেদ রয়েছে ঠিক তেমনই প্রকারভেদ রয়েছে পুরুষদের ক্ষেত্রেও৷ এমন প্রকারভেদের কারণ হল, এক এক প্রকার পুরুষের সঙ্গে এক এক প্রকার নারীর রতিসুখ সর্বাপেক্ষা সুখকর হয়৷

পুরুষেরও বিভাগ?

নিশ্চয়ই৷ কাম কি শুধু নারীর একক? নারীর যেমন চারপ্রকার ভেদ, পুরুষের রয়েছে তিন৷ শশক, বৃষ এবং অশ্ব৷ পুরুষের শিশ্নর আকৃতি, দেহসৌষ্ঠব এবং স্বভাবদ্বারা এই প্রকারভেদ তৈরি করেছিলেন বাৎসায়ন৷ আচার্য বলছেন শশক জাতীয় পুরুষের সঙ্গে পদ্মিনী নারীর মিলন সুখের হয়, তেমনই বৃষজাতীয়র সঙ্গে শঙ্খিনী এবং অশ্বজাতীয়র সঙ্গে হস্তিনীর সঙ্গম সর্বাপেক্ষা সুখদায়ক৷ তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে আমরা হলাম গণিকা, আমাদের আবার বাছাবাছি কিসের? অর্থের বিনিময়ে নিরোগ যে প্রকার পুরুষই মিলনেচ্ছুক হবে তাকেই সঙ্গ দেব৷ সেটাই গণিকার ধর্ম৷ কিন্তু বলি, আমাদের এই রূপমঞ্জরীতে এমনও মক্কেল আসেন যিনি আমাদের ওপর দায়িত্ব দেন তাঁর উপযুক্ত সঙ্গিনী বাছাই করে দেওয়ার জন্য৷ তখন আমরা সেই মক্কেলের রূপ ও প্রকার বিচার করে তার সঙ্গে রমণে সর্বোচ্চ সুখপ্রদানকারী সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে নির্বাচন করে দিই৷

সঙ্গিনী?

হ্যাঁ, রূপমঞ্জরীতে পুরুষ এবং নারী উভয়প্রকার বেশ্যাই রয়েছে৷ পুরুষদেরও প্রশিক্ষণের কিছু অংশ আমিই দিয়ে থাকি৷ তোমাদের আগামী পনেরো দিন হবে শুধুমাত্র তত্ত্বগত শিক্ষা৷ এরপর ব্যবহারিক শিক্ষার সময়ে পুরুষদেরও প্রয়োজন হবে৷ রূপমঞ্জরীতে মোট নয়জন পুরুষ এবং ষোলোজন নারী বেশ্যা রয়েছে৷ ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত থেকে তাদের এখানে কাজে যোগ দেওয়ানো হয়েছে৷ তোমাদের চারজন সমেত মোট সাতজন এই মুহূর্তে প্রশিক্ষণ পর্যায়ে৷ তারা অবশ্য এখন তত্ত্বগত শিক্ষা শেষ করে ব্যবহারিক শিক্ষা নিচ্ছে৷ বাকিদের শিক্ষা শেষ৷ তারা নিয়মিত কাজ করছে৷ একটা কথা মনে রাখবে রূপমঞ্জরীর প্রশিক্ষণ শেষ করার পর তোমরা কিন্তু কেউই আর সাধারণ নারী থাকবে না৷ প্রত্যেকে হয়ে উঠবে পুরাকালের ঊর্বশী, মেনকা, রম্ভার মতো বিদুষী গণিকা৷ রূপমঞ্জরীতে যোগদানের সুযোগ পেয়েছ মানেই তোমাদের রূপ এবং গুণ অনন্যসাধারণ, এবার তাকে চূড়ান্ত উৎকর্ষ দেওয়ার দায়িত্ব আমার এবং তোমাদের নিজেদের৷ সবার প্রথমে একটা কথা ভালো করে মাথায় গেঁথে নাও, সেটা হল একজন আদর্শ বেশ্যা হল সে, যার অন্তরে প্রেম না থাকলেও প্রেমকলায় পটু৷ পুরুষ তার কাছে আসবে শুধু রতিসুখ নয়, প্রেম পেতে৷ শুধু যৌনতার জন্য নয়৷ পশুর সঙ্গে মানুষের রতিক্রিয়ার পার্থক্য এখানেই৷ মানুষ রতির সময় শুধু নিজ সুখের কথা ভাবে না, তার সঙ্গীকে সুখ দেওয়াও তার কর্তব্য বলে মনে করে৷ কিন্তু পশু শুধুমাত্র নিজ সুখের কারণেই রমণে লিপ্ত হয়, সে তার সঙ্গী সুখ পাচ্ছে কি না তা নিয়ে ভাবে না এবং রেতঃপাত হওয়া মাত্রই সে সঙ্গীকে ছেড়ে চলে যায়৷ রমণে এই যে অপরের সুখের কথা ভাবা তাই প্রেম যা পশুর মধ্যে নেই৷ এবং পশুর অভিনয়-ক্ষমতাও নেই৷ তাই সে ভান করতে জানে না৷ মানুষ প্রেমহীন হলেও প্রেমের অভিনয় করতে জানে, আর এই অভিনয়ে সর্বাপেক্ষা পটু হল একজন বেশ্যা৷ তোমরা কামসূত্রের নাম শুনেছ?

চারজনের মধ্যে শুধু বিশাখা বলল, হ্যাঁ মা, শুনেছি৷ কপিল বাৎসায়নের লেখা বই৷ তবে পড়িনি কখনও৷

বেশ, ওই গ্রন্থে আচার্য বলছেন, ভরতের নাট্যশাস্ত্রে লিখিত আছে যে নারী বিভিন্ন কলার প্রয়োগ জানে, যে বিবিধ শাস্ত্র ও কাব্যাদিতে পারদর্শী, চৌষট্টি কলায়, বিশেষ করে নৃত্যগীত ও বাদ্যাদিতে উৎকর্ষ লাভ করেছে, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, লাবণ্যময়ী, যার মনের জোর এবং উদ্দেশ্যের দৃঢ়তা আছে কিন্তু সে নম্র ও মাধুর্যশালিনী, সাধারণ রমণীর যে সব দোষ থাকে তা থেকে যে মুক্ত, বক্রোক্তিতে নিপুণা, ভাষায় যার জড়তা নেই এবং যে সহজে ক্লান্ত না হয়ে মাধুর্যের সঙ্গে কাজ করে তাকে গণিকা বলে৷ তাহলে বুঝতে পারছ তোমরা একজন আদর্শ গণিকার মধ্যে কত গুণ থাকে৷ এই কারণেই প্রাচীন ভারতবর্ষে গণিকার যথাযথ সম্মান ছিল৷ রাজা তাদের সম্মান করতেন, গুণবান মানুষ তার স্তুতি করতেন৷ কিন্তু সময় বদলের চক্রে গণিকারা হয়ে উঠেছে নেহাতই নির্গুণা, এমনকি কামকলাটিও তাদের ভালো করে রপ্ত নয়৷ ফলে তার স্থানও হয়ে গিয়েছে সমাজের সবচেয়ে নীচে৷ রূপমঞ্জরীর অন্যতম উদ্দেশ্যও হল ভারতের গণিকাদের যে হূতগৌরব তাকে আবার সসম্মানে নিজ আসনে প্রতিষ্ঠা করা৷ পৃথিবীর বৃহত্তম বেশ্যালয়গুলির মধ্যে কলকাতার সোনাগাছি অন্যতম৷ প্রায় এগারো হাজার বেশ্যা সেখানে কর্মরত কিন্তু ক’জন জানে ভারতীয় কামকলা? কেউ না৷ আমি নিজে ওখানে দীর্ঘদিন ঘুরেছি, নামী বেশ্যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, নাহ কেউ জানে না৷ গান বলতে চটুল হিন্দি গান আর নাচ বলতে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি৷ শুধু কলকাতা নয়, গোয়া, এলাহাবাদ, মুম্বই, মুজফফরপুর, বেনারস এবং ভারতের আরও যেসব জায়গায় বৃহৎ বেশ্যালয় রয়েছে আমি সেখানেও রূপমঞ্জরীর জন্য গিয়েছি, উপযুক্ত বেশ্যার সন্ধান করেছি, কিন্তু পাইনি৷ ইয়োরোপ, আমেরিকায় ভারতবর্ষের গণিকালয় বলতে বোঝানো হয় সোনাগাছির মতো অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকা, অশিক্ষিত বেশ্যাদের, তারা জানে না আজ আমস্টারডাম, লাসভেগাস পেন্টাহাউজের মতো কিছু বিখ্যাত বেশ্যালয় নিয়ে তারা আদিখ্যেতা করলেও ভারতবর্ষে গণিকাবৃত্তি একসময় যে উৎকর্ষে পৌঁছেছিল তা কোনওদিনই তারা পারবে না৷

খুব ধীরে ধীরে কথাগুলো একটানা বলে গেলেন চিত্রলেখা৷ এমনভাবে বললেন যে, প্রতিটি শব্দ ওদের চারজনের অন্তর পর্যন্ত পৌছল৷ রূপসা খুব মন দিয়ে খেয়াল করছিল চিত্রলেখার বাচনভঙ্গি, এবং কথা বলার সময় তাঁর চোখ, হাতের মনোমুগ্ধকর সঞ্চালনকে৷ সবই আপাতস্বতঃস্ফূর্ত হলেও আসলে তা দীর্ঘ অনুশীলনের ফসল৷ রূপসা-অপালাদের থেকে চিত্রলেখা অন্তত কুড়ি বছরের বেশি বয়স্কা হবেন, কিংবা হয়তো তারও বেশি, কিন্তু তাকিয়ে থাকলে কেমন যেন ঘোর লেগে যায়৷

সকাল হয়ে গিয়েছে৷ সূর্যের রশ্মি এখন আর সোনালি নয়, সাদা৷ কিন্তু সে আলোয় এখনও তেজ ধরেনি, কঠোরতা আসেনি৷

চিরশ্রী, তুমিই তো রোকোর আকাদেমিতে প্রশিক্ষণে ছিলে তাই না?

হ্যাঁ, মা৷

তোমার কষ্টটাই সব থেকে বেশি হবে, কারণ ওখানে যা শিখেছ সব তোমাকে আগে ভুলতে হবে৷ পারবে তো?

নিশ্চয়ই পারব৷ খুব জোরের সঙ্গে বলল চিরশ্রী৷

বাহ৷ হ্যাঁ, আমিও জানি তুমি পারবে৷ সেই ক্ষমতা তোমার রয়েছে৷ তোমরা এমন বারাঙ্গনা তৈরি হবে যে দেশ-বিদেশের নায়কেরা পাগল হয়ে যাবে তোমাদের জন্য৷

নায়ক?

অবাক হলে? আচার্য গণিকাকে সম্বোধন করেছেন নায়িকা বলে আর তার মক্কেলকে নায়ক৷ আমিও তোমাদের বোঝাব নায়ক এবং নায়িকা সম্বোধন করেই৷ চিত্রলেখা তাঁর পুরো ইংরেজিতে কনভারসেশনের মধ্যে নায়ক ও নায়িকা শব্দকে ইংরেজিতে ট্রান্সলেট করে হিরো বা হিরোয়িন ইত্যাদি করলেন না৷ যেমন কাম শব্দটিকেও ‘কামা’ বলে উচ্চারণ করছিলেন৷

আরে বাহ! তার মানে আমি হব ক্যাটরিনা আর আমার জন্য সলমন খানেরা আসবে!

বিশাখার ইয়ার্কিতে হেসে উঠল সবাই৷ চিত্রলেখাও হাসলেন তারপর বললেন, উঁহু, ক্যাটরিনা নয়, চেষ্টা করো হেমামালিনী কিংবা শ্রীদেবীর মতো হয়ে উঠতে৷ মানে ওদের শরীর যেমন খাঁটি ভারতীয় তেমন৷ তবে হ্যাঁ, সলমন খানও আসতে পারেন আবার ব্র্যাড পিটও আসতে পারেন৷ আবার এঁদের মতো চলচ্চিত্রের নায়ক কেউ না এলেও যাঁরা আসেন তাঁরা আর্থিক সচ্ছলতায় এঁদের থেকে কয়েকগুণ বেশি ছাড়া কম নয়, তাই এঁরাই হবেন তোমাদের নায়ক৷ এখানে কেমন ধরনের মক্কেল আসেন তার দুই-একটা উদাহরণ দিলে তোমরা আন্দাজ পাবে৷ ধরো আরবের কোনও ধনকুবের যাঁর দশটা তেলের খনি রয়েছে কিংবা কোনও আইটি কোম্পানির সিইও অথবা কোনো জাহাজ কোম্পানির মালিক৷ এরকম দুই-তিনটেই বললাম৷ এর থেকে বুঝে নাও কারা এখানে আসেন, কারণ রূপমঞ্জরীতে থেকে তার মজা নিতে হলে প্রতিদিন যা খরচ করতে হয় তা সামলানোর ক্ষমতা সাধারণ মানুষ তো বাদ দাও, অনেক ধনী ব্যক্তিরও নেই৷ এবং আমাদের মক্কেলদের মধ্যে অধিকাংশই আসেন ইউনাইটেড আরব অথবা আমেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন ধনী দেশ থেকে৷ ভারতীয় খুব কম৷ তোমাদের মনে রাখতে হবে রূপমঞ্জরীর রোজগারের উপায় হচ্ছ তোমরা৷ মক্কেলরা আসবেন প্রাচীন ভারতীয় প্রেমের স্বাদ নিতে এবং সেই স্বাদ দেওয়ার দায়িত্ব তোমাদের৷ একটা কথা মাথায় রেখো, রূপমঞ্জরী একটি গণিকালয়, তোমরা গণিকা৷ তোমরা তোমাদের মক্কেলের কাছ থেকে যতটা আদায় করতে পারবে তা রূপমঞ্জরীর লাভ এবং তার মানে তোমাদের বেতন এবং লভ্যাংশ ইত্যাদি৷

কয়েকটা প্রশ্ন রয়েছে, মা৷ বলল রূপসা৷

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই করবে, আমি আগে একটু বলে নিই কেমন? তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, মক্কেলদের সমস্ত খরচ করানোর দায়িত্ব কি তোমাদের? না, মক্কেলের ঘর, পানাহার এবং যাবতীয় খরচের হিসাব নেবে রূপমঞ্জরীর ব্যবস্থাপনা৷ তোমরা তাকে আরও অতিরিক্ত যতটা খরচ করাতে পারবে সেটাই তোমাদের কৃতিত্ব এবং তার থেকেই তোমাদের বেতন ছাড়া লভ্যাংশ, বেতনবৃদ্ধি ইত্যাদি নির্ভর করবে৷ সেই খরচগুলো কীভাবে করাবে সেটা আমি তোমাদের প্রশিক্ষণের অন্য দিনে বুঝিয়ে দেব৷ হ্যাঁ রূপসা, বলো কী বলছিলে?

আমরা কাল থেকে এখানে রয়েছি কিন্তু কাউকেই তো দেখতে পেলাম না তেমন৷ মানে কাল রাতে শুধু একজন ইয়ে মানে নায়ককে দেখেছিলাম এক নায়িকাকে কোলে নিয়ে নৌকোয় উঠল৷ কিন্তু আর কাউকে তো তেমন…

এবার একটু শব্দ করেই খিলখিল করে কিশোরী মেয়ের মতো হেসে উঠলেন চিত্রলেখা৷ তারপর বললেন, তোমরা এখন রয়েছ কলাকুঞ্জে৷ প্রেমকুঞ্জ আরও গভীরে রয়েছে৷ তবে এটাও প্রেমকুঞ্জের মধ্যেই পড়ে যদিও রাত ছাড়া এবং সরোবরে নৌবিলাস ছাড়া নায়করা প্রেমকুঞ্জের অন্দরমহল থেকে খুব বেশি বেরোয় না৷ যাই হোক৷ এবার তোমরা ওঠো৷ আমরা ভবনে যাব৷

.

ভোর পাঁচটা থেকে একটানা ন’টা পর্যন্ত ক্লাস চলল৷ তারপর একঘণ্টার জন্য টি-ব্রেক৷ ব্রেকফাস্টও ওই সময়ে দিয়ে দেওয়া হল৷ ভবন লাগোয়া আরেকটি মস্ত ঘর সেখানে খাওয়ার ব্যবস্থা৷ ঘরটায় চার দেওয়াল ঘেঁষে সার সার আসন পাতা এবং প্রতিটি আসনের সামনে একটি করে একফুট উঁচু কাঠের চৌকি৷ চৌকির ওপরে রেশমের চাদরঢাকা থালা গ্লাস বাটি ইত্যাদি৷ সকলে বসে পড়ল৷ খুব সাধারণ ব্রেকফাস্ট৷ হাতে গড়া রুটি, তরকারি, নানারকম ফল এবং চা৷ পরিমাণও অঢেল নয়৷ খাওয়া শেষ করে বাকি সকলের সঙ্গে পরিচয়পর্ব শেষ হল৷ সব মিলিয়ে জনা দশেক৷ সকলেই ট্রেনিং-এর বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে৷ সিনিয়ররা এখানে খেতে আসেন না৷ তাঁদের কেউ হয়তো নায়কের সঙ্গেই ব্রেকফাস্ট সারেন অথবা তাঁদের নিজেদের রুমে নির্দিষ্ট টাইমে পৌঁছে দেওয়া হয়৷ ওখানে কারও নাম শকুন্তলা, কেউ রম্ভা, কারও নাম কামিনী৷ উনিশ বছর বয়েসি মোহিনীর সঙ্গে আলাপ হল রূপসার৷ পাঞ্জাবের মেয়ে৷ অপরূপ সুন্দরী৷ যেমন লম্বা, তেমনই ফর্সা৷ চওড়া কাঁধ, টিকলো নাক৷ গালদুটো পাকা আপেলের মতোই টুকটুকে৷ পাতলা ঠোঁটদুটিতে যেন লাল লিপস্টিক মাখানো রয়েছে৷ লম্বাটে গড়নের মুখে কালো দীর্ঘ চোখদুটি খুব মায়াবী৷ যে দেখবে সেই ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়বে৷ হাসলে ডালিমের দানার মতো স্বচ্ছ এবং সুসজ্জিত দাঁতের সারি দেখা যায়৷ মেয়েটির সহজ এবং খিলখিল হাসি একেবারে সেতারের মূর্ছনার মতোই ছড়িয়ে পড়ে৷ রূপসা ওকে দেখে নিজেই গিয়ে আলাপ করল৷ চিত্রলেখা প্রথম দিনেই বলে দিয়েছিলেন এই কলাকুঞ্জে সকলের সঙ্গে সমভাবে মিশতে৷ এখানে যেন কোনওপ্রকার অপ্রীতিকর পরিবেশ কখনোই সৃষ্টি না হয়৷ এখানে প্রত্যেক গণিকার সমান সম্মান৷ কেউ যেন কারোর সঙ্গে কোনওপ্রকার অসম্মানসূচক ব্যবহার না করে৷ কোনওরকম সমস্যা হলে তা চিত্রলেখা অথবা রেহানাকে জানাতে৷ রূপমঞ্জরী প্রেম ও ভালোবাসার জায়গা, সুতরাং সেখানে সামান্যতম অশান্তিও কর্তৃপক্ষ বরদাস্ত করবেন না৷

মোহিনীকে বারো বছর বয়েসে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল গোয়ার এক বেশ্যালয়ে৷ সেখানে প্রায় দুই বছর কাটিয়ে আরও সাতঘাটের জল খেয়ে তারপর একবছর আগে এখানে সুযোগ পেয়েছে৷

কেমন আছ জিজ্ঞাসা করায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর, খুব ভালো৷ অনেক নিশ্চিন্ত এখানে৷

নিশ্চিন্ত এই শব্দটাই আলাদা করে কানে বেজেছিল রূপসার৷ সত্যিই মানুষ হয়তো চিরকাল নিশ্চিন্তিই খোঁজে৷

একঘণ্টা ব্রেকের পর আবার শুরু হল ক্লাস৷ কলাকুঞ্জের ভবনের মধ্যেই ক্লাস৷ রূপসা অবাক হয়ে দেখছিল চিত্রলেখাকে৷ সত্যিই কারও কাছে বয়স শুধু একটা সংখ্যামাত্র৷ একবার রূপসাদের কামকলার তত্ত্ব শেখাচ্ছেন, আরেকবার চলে যাচ্ছেন যারা নাচ শিখছে তাদের দিকে৷ নাচ শেখানোর শিক্ষিকা নিজেও একজন গণিকা৷ এবং সেও একসময়ে মায়েরই স্টুডেন্ট ছিল৷ অন্য একদিকে চলছে গান এবং মৃদঙ্গ, সেতার, বীণা, বাঁশি ইত্যাদি শেখানোর ক্লাস৷ গান মানে ঠুংরি অথবা গজল৷

চিত্রলেখা সবদিকে ঘুরে ঘুরে দেখছেন৷ কখনও গান কখনও নাচ এমনকি একটি মেয়ে মৃদঙ্গ বাজাচ্ছিল তাকেও তাল ধরিয়ে দিলেন৷ আশ্চর্য গুণী মহিলা৷ চিত্রলেখার রূপ এবং গুণ যত দেখছিল ততই এতদিনের পুরোনো অনেক ধ্যানধারণা খসে পড়ছিল৷

ক্লাস চলল দুপুর পর্যন্ত৷ তারপর চিত্রলেখা বললেন, আগামী তিনদিন তোমাদের একবেলা করে প্রশিক্ষণ চলবে৷ তারপর থেকে দুই বেলাই৷

দুপুরে ছুটি হয়ে গেল৷ এবার স্নান-খাওয়া করে নিজের ইচ্ছেমতো সময় কাটানো৷ চিত্রলেখা বললেন, তোমরা রূপমঞ্জরীর যে কোনও জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারো৷ সবখানেই অবাধ৷ এখানে অনেক কিছু রয়েছে দেখার৷ সাধারণ ট্যুরিস্টরাও তো বাইরের অংশ ঘুরতে আসেন, সেদিকটাও গিয়ে দেখতে পার৷

সুযোগ পেয়ে চিরশ্রী চিত্রলেখাকে জিজ্ঞাসা করল, মা, আমরা কি প্রেমকুঞ্জেও যেতে পারি?

চিরশ্রীর কথায় স্বভাবসিদ্ধ মিষ্টি হাসলেন চিত্রলেখা৷ বললেন, কয়েকটা দিন সবুর করো৷ তারপরে ওখানেই তো তোমাদের কাজ৷

সকলেই বুঝল, এখন ওখানে যাওয়ার পারমিশন নেই৷ চারজন ঘুরতে শুরু করল পায়ে হেঁটে৷ বিশাল অঞ্চল৷ পায়ে হেঁটে সবটা ঘুরে দেখা সম্ভব না৷ দরকারও নেই, একদিনে সব দেখার৷ রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে ঘোড়ায় টানা রথ যাচ্ছে, কোনওটিতে সওয়ারি রয়েছে, কোনওটিতে নেই৷ এদিকটায় ট্যুরিস্ট অ্যালাউড নয়৷ এর বাইরের চৌহদ্দিতেই ট্যুরিস্টদের আনাগোনা৷ গাছে ঘেরা লাল মোরাম বিছনো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রূপসা বলল, তোমরা কেউ শান্তিনিকেতনে গেছ?

সেটা কোথায়? জিজ্ঞাসা করল বিশাখা৷

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম শুনেছ? পোয়েট৷

টেগোর? হ্যাঁ, শুনেছি৷

শান্তিনিকেতন নামের একটা জায়গায় উনি থাকতেন৷ সেই জায়গাটার সঙ্গে এখানকার খুব মিল রয়েছে৷ বলতে বলতেই রূপসার মনে পড়ল একবার এক ক্লায়েন্টের সঙ্গে দু’দিনের জন্য শান্তিনিকেতনে ঘুরতে গিয়েছিল৷ কী যেন নাম ছিল হোটেলটার… এখন মনে পড়ছে না৷ বেশ ঝাঁ-চকচকে৷ ওখান থেকেই একদিন ঘুরতে গিয়েছিল শান্তিনিকেতনের ভেতরে৷ কী সুন্দর জায়গাটা! ইচ্ছে করছিল পুরোপুরি থেকে যেতে৷ তারপর সেখান থেকে খোয়াইতে সোনাঝুরির হাট৷ ওখানকার মেয়েদের সঙ্গে নেচেওছিল রূপসা৷ খুব মজা হয়েছিল৷ ক্লায়েন্টটা সম্ভবত ফিল্মি ডিরেক্টর ছিল… মুখটা আর মনে নেই৷ রূপসা খেয়াল করে দেখেছে বেশ কয়েক বছর ধরে ওর কোনও ক্লায়েন্টের মুখ মনে থাকে না৷ শুধু মুখ না, চেহারাটাও মনে পড়ে না, কিন্তু দীপুদা…হ্যাঁ, দীপুদাকে মনে পড়ে, এতকাল পরেও পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে পড়ে৷ বিশেষ করে ওর শোধ নেওয়ার সেই মুহূর্তটা৷ দীপু রূপসার বাড়ি এসে ওর হাতে দুটো দশ টাকার নোট দিয়ে যাওয়ার জ্বালাটা বেশ কয়েকদিন ধরে পরম যত্নে বুকের ভেতর জিইয়ে রাখার পর একটা শনিবার দুপুরে সাইকেলটা নিয়ে রওনা দিয়েছিল রূপসা৷ সাইকেল চালিয়ে সোজা পদ্মকাকিমার বাড়ি৷ শনিবার দুপুরে কাকিমা যে বাড়িতে থাকে না সেটা রূপসার জানা ছিল৷ পাশের পাড়াতেই কাকিমার বাপের বাড়ি৷ শ্মশানকালীর মন্দির রয়েছে খুব জাগ্রত৷ কাকিমা প্রতি শনিবার দুপুরে চলে যায়৷ সন্ধেবেলায় মন্দিরে পুজো দিয়ে, তারপর ফেরে৷ সেই কারণে রূপসাকে কখনও শনিবার দুপুরের পর আচার নিয়ে আসতে বারণ করে৷

কাকিমার বাড়ির সামনে গিয়ে যখন সাইকেলটা থামিয়েছিল রূপসা, তখন ঘেমে অস্থির৷ কপাল, নাকের পাটা, ঘাড়, গলা ঘামে জবজবে৷ একটু বেশিই হাঁপাচ্ছিল৷ সাইকেলের রডে ঝোলানো থলেতে একটা আচারের প্যাকেট৷

বারান্দায় বসে পড়ছিল দীপু৷ রূপসাকে দেখে থমকে গিয়েছিল৷ তারপর প্রথমেই বলেছিল, মা তো নেই৷

নেই? ওহো৷ আচ্ছা, বলে মুচকি হেসে রূপসা বলেছিল, আমাকে একটু জল খাওয়াবে, দীপুদা?

দীপু নিজের আড়ষ্টতা থেকে বেরোতে পারছিল না৷

জল, একটু জল খাওয়াতে পারো আমাকে? হাতে ইশারা করে দেখিয়েছিল রূপসা৷

হ্যাঁ দিচ্ছি৷ উঠে ঘরের ভেতর গিয়েছিল দীপু, আর রূপসা এক মুহূর্ত দেরি করেনি৷ একলাফে বারান্দায় উঠে ঘরের ভেতর ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে দরজা গার্ড করে দাঁড়িয়েছিল৷

দীপু রান্নাঘর থেকে জলের গ্লাস হাতে নিয়ে ওই ঘরে আসতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল৷ জানলা দিয়ে আধো অন্ধকার ঘরে সদ্য বিকেলের রোদ ঢুকছে৷

একটা জিনিস পরেছি দীপুদা, দেখবে? বলে ঠোঁট চেপে হেসেছিল রূপসা৷

দীপু কিছু বলেনি৷ পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিল এক জায়গায়৷

ঘামে ভেজা ফ্রকটা চামড়া ছাড়ানোর মতো করে গা থেকে নামিয়ে রূপসা বলেছিল, এই দেখো ব্রেসিয়ার পরেছি৷ কেমন লাগছে আমাকে?

দীপু কাঁপছিল৷ শীত করছিল ওর৷ হাফপ্যান্ট পরা পা দুটো কাঁপতে শুরু করেছিল৷

কী হল দীপুদা, আমাকে ভয় করছে? এসো, দেখো কেমন লাগছে এটা পরে?

দীপু অপলক তাকিয়েছিল সাদা ব্রেসিয়ারের আড়ালে থাকা বুক দুটির দিকে৷ যেন দুটি শঙ্খ অপেক্ষা করছে কেউ তাকে ঠোঁট ছুঁয়ে ধ্বনিত করবে বলে৷

এসো, আমার কাছে৷ বলে হাত বাড়িয়েছিল রূপসা৷ নিটোল ভরাট, হাতদুটি সাপের শরীরের মতো মসৃণ এবং পেলব এবং সুন্দর৷ ওই আহ্বান আর অস্বীকার করতে পারেনি দীপু৷ জলের গ্লাসটা মাটিতে রেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসেছিল রূপসার দিকে৷ রূপসার গলা দিয়ে ঘাম নামছিল দুই বুকের মাঝের গভীর পিচ্ছিল পথে৷ দুই হাত দিয়ে রূপসার বুক স্পর্শ করেছিল, প্রথমে ধীরে তারপর অনভ্যস্ত সজোরে৷

আচমকা বেদনায় আহ করে উঠেছিল রূপসা৷ দীপুর ততক্ষণে আর হুঁশ নেই৷ কখনও রূপসার কাঁধে কামড় বসাচ্ছে, কখনও নাভিতে চুমু খাচ্ছে, কখনও ঠোঁটে৷ ব্রায়ের ওপর দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাত বোলানোর পর ব্রায়ের হুক খোলার চেষ্টা করেছিল দীপু৷ পারল না৷ রূপসা টের পাচ্ছিল, ও নিজে মোটেই এই শরীরী সুখে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে না৷ বরং এক অন্যরকমের তৃপ্তি পাচ্ছে৷ সাদা ব্রায়ের ওপরে ওর নরম স্তনদুটিকে যত দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে দীপু, তার আনন্দমেশানো যন্ত্রণার থেকে এক অন্যরকমের তৃপ্তি পাচ্ছিল ও৷ আচমকাই রূপসা দীপুর পরনের স্যান্ডো গেঞ্জিটা এক টানে মাঝ বরাবর ফরফর করে ছিঁড়ে দিল৷ তারপর দীপুর পিঠে নিজের দুই হাতের নখ বসিয়ে চিরে দিল৷

আআআ করে কঁকিয়ে উঠল দীপু৷ তারপর ব্রা খুলতে ব্যর্থ হয়ে ওর ভেতরেই হাত ঢোকাতে গেল৷ তখনই দীপুকে হঠাৎ এক ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল রূপসা৷ তারপর আবার কাছে এনে দুই হাত দিয়ে ওর হাফপ্যান্টটা নামিয়ে দিয়েছিল৷ কাঁচা তেঁতুলের মতো দেখতে দীপুর পৌরুষটি তখন কঠিন, লালায়িত৷

দীপু রূপসাকে শুইয়ে দিয়েছিল মেঝেতে৷ তারপর পেটে, নাভিতে, থাইয়ে নিজের জেগে ওঠা অস্থির পুরুষাঙ্গটি ঘষছিল৷ কী করবে বুঝতে না পেরে রূপসার শরীরটাকে নিয়ে হাঁচোড়-পাঁচোড় করছিল কিন্তু মুখে কোনও কথা ছিল না৷ দু-একবার রূপসার প্যান্টিটা টেনে নামাতে গিয়ে রূপসার থেকে বাধা পেয়ে দুই হাত দিয়ে খামচে ব্রেসিয়ারটাকে যে মুহূর্তে সরাতে যাবে তখনই রূপসা দীপুর হাতদুটো ধরে বাঁকা হেসে বলেছিল, তোমার মায়ের দেওয়া ব্রেসিয়ার, দীপুদা৷ আজ প্রথম পরলাম, কাকিমার ব্রেসিয়ার৷ কী ভালো, না, পরে দারুণ আরাম লাগছে৷

কথাটা শোনার পর যেন চাবুকের আঘাত পেয়ে শিউরে উঠেছিল দীপু৷ চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে উঠেছিল৷ ছিটকে সরে গিয়েছিল রূপসার ওপর থেকে৷

বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার, দেখো, পুরোনো ব্রেসিয়ার৷ সামান্য একটু ঢিলেও হয়েছে৷ এই আগের দিনই কাকিমা দিয়েছিল কয়েকটা৷ দেখো সামনে থেকে৷

দীপু আর তার বুকের দিকেও তাকাচ্ছিল না৷ দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে বার বার বলছিল, তুই চলে যা…যা…! গোঙাতে শুরু করেছিল দীপু৷ অদ্ভুত শব্দ করে কাঁদতে শুরু করেছিল৷

উঠে দাঁড়িয়েছিল রূপসা৷ নিজের ফ্রক ঠিক করে নিয়ে দীপুকে বলেছিল, তোমার গেঞ্জিটা ছিঁড়ে ফেললাম দীপুদা, এই কুড়িটা টাকা রাখো, একটা স্যান্ডো গেঞ্জি কিনে নিয়ো৷ বলে ব্রেসিয়ারের ভেতরে ভরা দুটো ভাঁজ করা দশটাকার নোট দীপুর পাশে রেখে দরজা খুলে যখন বাইরে বেরিয়ে এসেছিল, একরাশ ঠান্ডা হাওয়া জড়িয়ে ধরেছিল ওকে৷ গত কয়েকদিন ধরে ভারী হয়ে থাকা মনটা এই কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো হালকা ফুরফুরে হয়ে উঠেছিল৷

সেদিন সন্ধেবেলাতেই ঝড় আছড়ে পড়েছিল রূপসার বাড়িতে৷ পদ্মকাকিমা, অসীমকাকু দুজনেই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রূপসার বাড়িতে৷ আমার ছেলেটার মাথা খাচ্ছিস! এত শয়তান! নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতাম তোকে, বেশ্যামাগী, খানকি হবি বড় হয়ে…আরও কী কী যেন সব অনর্গল বলে যাচ্ছিল কাকিমা চিৎকার করে৷ সেই অশ্রাব্য গালিগালাজের প্রায় কিছুই কানে ঢুকছিল না রূপসার৷ শুধু গালাগালি করেই ক্ষান্ত হচ্ছিল না পদ্মকাকিমা, চিৎকার করার মাঝে মাঝে রূপসার একমাথা লম্বা চুলও মাঝে মাঝে হিড়হিড় করে টেনে নাড়িয়ে দিচ্ছিল, গালে ঠাস ঠাস করে থাপ্পড় মারছিল৷ ঠোঁটের কোণ কেটে গিয়ে কষ বেয়ে ক্ষীণ রক্তধারা নামছিল রূপসার, জিভ বার করে সেই রক্তটুকু চেটে নিচ্ছিল ও৷ তাই দেখে পদ্ম আবারও হুংকার দিয়ে উঠেছিল, হ্যাঁ, ওই রক্তই খাবি তুই, পিশাচিনী! এই বয়েসেই এত রূপের দেমাক, একদিন এই রূপই তোকে খাবে এই বলে রাখলাম আমি৷ বেশ্যা কোথাকার!

রূপসার শরীরে পড়া প্রতিটি আঘাত, প্রতিটি কুৎসিত শব্দ ওকে আহত করার বদলে অদ্ভুত এক আনন্দ দিচ্ছিল৷ কেন দিচ্ছিল রূপসা ঠিক নিজেও বুঝতে পারছিল না কিন্তু মনে মনে একটা কথাই ভাবছিল৷ দীপুকে ছুড়ে দেওয়া ওই দশ টাকার নোটদুটো, পিঠে ইচ্ছে করে আঁচড়ের দাগ কেটে দেওয়া, যাতে পদ্মকাকিমা ছেলের পিঠের দাগগুলো দেখতে পায়৷ আচ্ছা দীপুদা কি ওর মাকে বলেছে যে ওর মায়েরই দেওয়া ব্রেসিয়ার পরে এসেছিল রূপসা, আর দীপু…

ভাবনার মাঝেই আবার গালে ঠাসিয়ে একটা থাপ্পড় পড়েছিল রূপসার, আর তখনই বাড়িতে ঢুকেছিল বিলু৷

ছোট মফসসল পাড়া৷ এক বাড়িতে চেঁচামেচি হলে তার কারণ জানতে গোটা পাড়া হামলে পড়ে৷ এই ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল৷ বিশেষ করে ব্যাপারটা আমিষ সেটা আন্দাজ করার পর প্রতিবেশীদের উঁকিঝুঁকি বাড়ছিল৷ বাবাকে অবিশ্রান্ত খারাপ কথা বলে অপমান করে যাচ্ছিল দীপুদার বাবা অসীম৷ রূপসার বাবা কিছুই বলছিল না, শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল দীপুদার বাবার দিকে৷ রূপসার দিকে একবারও তাকায়নি৷

বিলু বাড়িতে ঢুকে পদ্মকাকিমার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, কী কাকিমা, কী কেস হয়েছে?

পদ্মকাকিমা আবার হাঁউমাউ করে পুরো ঘটনাটা বলেছিল বিলুকে৷

বিলু খুব সিরিয়াস মুখ করে ব্যাপারটা শুনতে শুনতে বার বার রূপসার দিকে আপাদমস্তক তাকাচ্ছিল তারপর ঠোঁট উলটে বলেছিল, ভেরি সরি কাকিমা, কী বলব বলুন, আজকালকার মেয়ে…আমাদের ফ্যামিলি প্রেসটিজ বলে আর কিছু রাখল না৷ যাক আপনারা বাড়ি যান, আমি কেসটা দেখছি৷

কাকু-কাকিমাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল দাদা৷ ওরা চলে যাওয়ার পর বাবা ভাঙা গলায় শুধু বলেছিল, বেরিয়ে যা বাড়ি থেকে৷ আমার চোখের সামনে থেকে চলে যা৷ মরে যা তুই৷

দাদা ধমকে উঠেছিল বাবাকে, আহ, থামো তো! উঠতি বয়সে এমন টুকটাক কেস সবারই হয়, তোমারও হয়েছিল৷ যাও পাতলা হও তুমি৷

বাবাকে অন্য ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে, দাদা ঠোঁট চেটে বলেছিল, আর মাল পেলি না, শেষে ওই ঢ্যাঁড়শ দীপুটাকে…বলে গাল চুলকে বলেছিল, সেদিন ওই কুড়ি টাকাটা ওই দিয়ে গেছিল তো?

রূপসা দাদার চোখে চোখ রেখে বলেছিল, হ্যাঁ৷

বিলু পকেট থেকে খৈনির ডিবে বার করে মশলা বানাতে শুরু করে বলেছিল, আমি ঠিকই বুঝেছি৷ যাক, চিন্তা করিস না৷ এসব ঝামেলা শুরুতে একটু-আধটু হয়, পরে সব সেটিং হয়ে যায়, বলে বাঁকা হেসে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল দাদা৷ আর তার ঠিক দু’দিন পরেই পাড়ার অঞ্জনদা এসে সরাসরি অফার দিয়েছিল রূপসাকে৷

.

চলো, ঘোড়ার গাড়িতে চাপা যাক৷ চিরশ্রীর কথায় পুরোনো জীবন থেকে ফিরে এল রূপসা৷

নিজেকে সামলে নিল দ্রুত৷ সামনে একটি খালি রথ এসে দাঁড়িয়েছে৷ চারজনেই উঠে পড়ল রথে৷

সারথিকে বলা হল বিশেষ কিছু দেখাতে৷

প্রেমশিলায় যাবেন?

প্রেমশিলা? সেটা কী?

চলুন, ভালো লাগবে৷

বেশ, চলো তাহলে প্রেমশিলা৷

সারথি রথ ছোটাল৷ কিছুক্ষণ পর থামল একটি পাহাড়ের সামনে৷ হ্যাঁ নকল, এবং উচ্চতা কুড়ি ফুটের বেশি নয়, কিন্তু দেখে বোঝার উপায় নেই৷ পাহাড়ের গায়ে গাছপালাও রয়েছে৷

এই তাহলে প্রেমশিলা৷ দুরন্ত দেখতে কিন্তু৷ কিন্তু এই পাহাড়ে কি চড়া যায়? জিজ্ঞাসা করল বিশাখা৷

আজ্ঞে না৷ তবে ভেতরে ঢুকে দেখুন, ভালো লাগবে৷

বেশ, তাহলে তুমি অপেক্ষা করো৷ বলে নেমে গেল চারজন৷ সেই পাহাড়ের সামনে একটি গুহামুখ৷ গুহামুখটি লতাপাতা জড়ানো পাথুরে দরজা দিয়ে ঢাকা৷ সামনে দাঁড়িয়ে এক প্রহরী৷ ওরা সামনে দাঁড়ানো মাত্র প্রহরী দুই হাত জড়ো করে প্রণাম করে দরজা খুলে দিল৷ ভেতরে প্রবেশ করল চারজনে৷ ভেতরটা আলো-আবছায়া৷ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত৷ ভিতরে খুব হালকা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে৷ জায়গায় জায়গায় মশাল জ্বলছে৷ একটু খেয়াল করলে অবশ্য বোঝা যাবে ওগুলো প্রকৃত আগুন নয়, কিন্তু দেখতে আগুনের মতো, আর সেই মশালগুলির সামনে এক একটি করে মিথুন মুদ্রায় নারী ও পুরুষের ভাস্কর্য৷ সে যে কী অপূর্ব নিজের চোখকেও বিশ্বাস হয় না৷ রূপসার প্রথমটায় মনে হয়েছিল কলকাতার কোনও নামী ক্লাবের দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল৷ কিন্তু সেই ভাবনাটা পলকেই মিলিয়ে গেল ওই ভাস্কর্যগুলো দেখে৷

বিশাখা বলে উঠল, উফফ অসামান্য! ভাবা যায় না! এ যেন অজন্তা-ইলোরাকেও হার মানায়৷ কী নিখুঁত কাজ!

আমি কখনও অজন্তা-ইলোরা দেখতে যাইনি, তবে খাজুরাহো দেখেছি৷ এখানের মূর্তিগুলো যেন অবিকল সেইরকম৷

গুহা যেমন হয় ঠিক তেমনই দেওয়াল৷ আর মূর্তিগুলো, দেওয়ালচিত্রগুলো যেন পাথরের চিত্রিত এবং খোদিত এমনভাবে সৃষ্ট৷ কম করে তিরিশটি সঙ্গম- মুদ্রার ভাস্কর্য৷ ছুঁলে যেন নড়ে উঠবে এমনই জীবন্ত৷ এমন পরিবেশে এই মূর্তিগুলো দেখতে দেখতে একটা ছিকছিকে ভয় লাগছিল৷ মনে হচ্ছিল প্রতিটি মূর্তিই আসলে জ্যান্ত৷ মানুষের উপস্থিতিতে ওরা থমকে গিয়েছে৷ কিংবা কেউ জাদুমন্ত্রে এই রমণরত অবস্থাতেই থামিয়ে দিয়েছে৷ প্রস্তরীভূত করে দিয়েছে ওদের৷

প্রায় আধঘণ্টা ধরে ঘুরে ঘুরে দেখল ওরা৷ তারপর অপালা বলল, চলো এবার বেরোনো যাক৷ আজব একটা জায়গায় এসেছি বটে৷ দেখে মনে হচ্ছে জ্যান্ত মানুষকে ধরে পাথরের মূর্তি বানিয়ে রেখেছে, কেমন অস্বস্তি হয়৷

সায় দিল সকলেই৷ বেরিয়ে এল গুহা থেকে৷

রথে চড়ে বসল৷ এবার ঘরে ফেরার পালা৷ সকলেই চুপ৷ চারটি মেয়েই চুপ করে ভাবছিল তাদের অনাগত অজানা ভবিষ্যতের কথা৷

.

সময়কে স্রোতের সঙ্গে তুলনা করা হয়৷ কালস্রোত কথাটি সেই কারণেই৷ বহতা নদীর মতো সময় অস্থির, কোথাও তার এক মুহূর্ত থামার উপায় নেই৷ এই বিশ্বজগতের সবকিছুই ভেসে চলেছে এক অখণ্ড সময়ের স্রোতে৷ সেই বহমানতার নিয়মেই বদলাতে থাকে সবকিছু৷ রূপসা, অপালা, চিরশ্রী, বিশাখার এই রূপমঞ্জরীতে পা রাখার প্রথম দিনটিও কালের স্রোতেই ভাসতে ভাসতে এক মাস দুই মাস তিন মাস পেরিয়ে গেল কবে নিজেরাও তা টের পেল না৷ একমাত্র রূপসা বাদে সকলেই তার পুরোনো নামটুকুও বিস্মৃত হল৷ চিত্রলেখার শিক্ষায় কত রকমের কলায় যে নিপুণ হয়ে উঠল আরও চারটি মেয়ে৷ নৃত্য, গীত, বাদ্য, বসনভূষণ, ছলাকলা, অঙ্গরাগ শুধু নয়, কামকলার বহু রকমের মুদ্রায় শিক্ষিত হয়ে উঠল অপালা, চিরশ্রী, বিশাখা আর রূপসা৷ সব মিলিয়ে চব্বিশজন গণিকা রয়েছে এই রূপমঞ্জরীতে৷ বয়স তেরো থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে৷ দেশ-বিদেশ থেকে ক্লায়েন্টরা আসে৷ সকলেই কোটি কোটি টাকার মালিক৷ আসলে রূপমঞ্জরীর প্রেমকুঞ্জে একটি রাত্রিবাসের যা খরচ তা বহন করার সাধ্য সকলের নেই৷ একমাত্র হিসাব না করার মতো অর্থ এবং শখ থাকলে তবেই প্রেমকুঞ্জে থাকা যায়৷ প্রেমকুঞ্জ রূপমঞ্জরীর গর্ভস্থল৷ বহিরাংশে যে সকল ট্যুরিস্ট ঘুরতে আসেন বা কটেজে দুই-এক রাত্রিবাসও করে যান তাঁদের এই গর্ভস্থলে প্রবেশাধিকার শুধু নেই নয়, তাঁরা কেউ বুঝতেও পারেন না প্রেমকুঞ্জের অবস্থান কোথায়৷ এমনভাবেই তৈরি৷ রূপমঞ্জরীর ওয়েবসাইটেও প্রেমকুঞ্জের কোনও উল্লেখ নেই৷ কারণ, আধুনিক ভারতবর্ষ প্রকাশ্য গণিকাবৃত্তিকে স্বীকৃতি দেয়নি৷ তবে স্পা, ম্যাসাজ পার্লার, ইত্যাদির উল্লেখ রয়েছে৷ এবং সেইগুলির যা মূল্য তা থেকে যে কোনও বুদ্ধিমান ব্যক্তিই আন্দাজ করতে পারেন অন্দরমহলে কী কাণ্ড চলে৷ প্রশাসন সবই জানে, কিন্তু সেই সমঝোতা অন্য৷ এই দেশে বেশ্যাবৃত্তি বেআইনি হলেও পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বেশ্যালয় কিন্তু কলকাতা শহরের সোনাগাছিতেই, যা এই রূপনগরের পাশেই৷ সুতরাং…এর বেশি কিছু বলার অপেক্ষা থাকে না৷

রূপমঞ্জরীর মধ্যে প্রেমকুঞ্জে যাঁরা আনন্দ নিতে চান এবং গণিকাদের সাহচর্য নিতে আগ্রহী তাঁরা সব খরচ আর পাঁচটা হোটেলের মতো করে করলেও প্রেমকুঞ্জে যাঁরা থাকতে চান তাঁদের জন্য একটা স্পেশাল ব্যবস্থা৷

প্রেমকুঞ্জ এক অদ্ভুত জায়গা৷ কলাকুঞ্জের অন্দরমহল পেরিয়ে পিছনে একটি রাস্তা সোজা গিয়ে পৌঁছেছে প্রেমকুঞ্জে৷ মস্ত এক অট্টালিকা৷ প্রাচীন প্রাসাদ যেমন হয়, তেমনই স্থাপত্যে তৈরি৷ ভিতরে প্রবেশ করলে ঠিক যেন একটি ফ্রেম সমেত কাচ বাঁধানো ফটো৷ কাচের অংশটি পুরোটাই জলাশয়৷ অর্থাৎ সুইমিং পুল৷ শুধু নির্মাণটি রাজাদের আমলের৷ আর চারধারে ফ্রেম অংশটি লম্বা সার সার খিলানে সাজানো বারান্দা৷ এবং বারান্দার একপাশে পর পর ঘর৷ অধিকাংশ ঘরই মিলনকক্ষ৷ তার মধ্যে কোনওটি বিশাল হলঘর যেখানে সকলে মিলে নাচ-গান-পানাহারের ব্যবস্থাও রয়েছে৷ প্রেমকুঞ্জ যৌনতার মুক্তাঞ্চল গণিকারা এখানে তাদের নায়ক বা ক্লায়েন্টদের সঙ্গে তাদের ইচ্ছেমতো প্রেমলীলা করে৷ কোনও নিষেধ নেই৷ নায়কের নির্দেশেই সবকিছু চলে৷ তার জন্য দিন প্রতি এক একজন নায়ক প্রায় লক্ষাধিক টাকাও ব্যয় করে৷ অবশ্য প্রেমকুঞ্জে যারা নায়ক হয় তাদের কাছে এক লক্ষ টাকা হাতের ময়লা ছাড়া আর কিছুই নয়৷ নায়ক যদি ইচ্ছে করে তবে সে এখানেও তার ঈপ্সিত সুখ নিতে পারে অথবা তার ইচ্ছে হলে নায়িকা তাকে নিজের নামাঙ্কিত কক্ষেও নিয়ে যেতে পারে৷ রূপসা ও তার তিন সখী চিত্রলেখার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর যখন প্রেমকুঞ্জে কাজ করার অধিকার পেল, পুরো হতবাক হয়ে গিয়েছিল অন্দরমহলে গিয়ে৷ এ যেন প্রাচীন ভারতবর্ষের একখণ্ড এখনও থেকে গিয়েছে৷ আধুনিক সভ্যতা যাকে স্পর্শ করতে পারেনি৷ চারজন কেউই গণিকাবৃত্তিতে নতুন নয়, একাধিক পুরুষসঙ্গ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সকলের থাকা সত্ত্বেও এই পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে প্রথম দিকে বেশ অস্বস্তিই হত৷ সবই মনে হত যাত্রা, নাটক কিংবা সিনেমার শূটিং৷ তারপর ধীরে ধীরে মজা লাগতে শুরু করল৷ প্রথম দিকে মোবাইল, ল্যাপটপ, টিভি ইত্যাদির অভাব যেন দম বন্ধ করে দিত ওদের৷ সেটাও একসময় কেটে গেল৷ এমনকি এই রূপমঞ্জরীর বাইরে যে আধুনিক পৃথিবী রয়েছে তার থেকে বঞ্চিত থাকার কষ্টটাও কবে যেন কমে গেল৷ চিত্রলেখা ট্রেনিং-এর সময় মাঝে মাঝেই বলতেন, আমি জানি তোমাদের প্রথম প্রথম কষ্ট হবে, ইলেকট্রনিক গ্যাজেট, আধুনিক জীবনযাত্রা ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হবে, কিন্তু এটাও মনে রেখো, যেদিন এগুলোকে ভুলতে পারবে সেদিনই শান্তি পাবে৷ কী রয়েছে বলো বাইরের পৃথিবীতে? শুধু হানাহানি, খুন, লড়াই, ঈর্ষা, চুরি, ডাকাতি এই তো! এসব থেকে দূরে থাকাই ভালো৷ রূপমঞ্জরীর পৃথিবীতে শুধু প্রেম রয়েছে, ভালোবাসা রয়েছে৷ প্রকৃতির স্বাভাবিক সৌন্দর্য রয়েছে৷ তাকে উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছ তোমরা৷ গ্রহণ করো৷ ভুলে যাও বাইরের কদর্য জগতকে৷ এতকাল তো তোমরা বাইরের পৃথিবীকে দেখেছ, খুব সুখী হতে পেরেছ কি? পারোনি৷ কেউ সুখী নয়, এমন কি এখানে যারা তোমাদের সঙ্গসুখ লাভ করতে আসবে তারাও কেউ সুখী নয় বলেই আসবে৷ আর নিজে সুখী না হতে পারলে অন্যকে সুখী করবে কীভাবে? তাই নিজেকে বোঝাও৷ অতীতকে ভুলে গিয়ে মনে মনে এই ভাবনাকে প্রশ্রয় দাও যে তুমি প্রাচীন ভারতবর্ষের এক গণিকা৷

চিত্রলেখা এমনভাবে কথাগুলো বলতেন যে সরাসরি বুকের ভেতরে গিয়ে গেঁথে যেত৷ এবং দিনের পর দিন এক প্রাচীনতায় বসবাস করতে করতে একসময় সেটাই যেন সত্যি হয়ে উঠল৷ আর ইচ্ছে করত না বাইরের পৃথিবীকে দেখতে৷

এ যেন এক স্বপ্নের জগত৷ ঝগড়া, অশান্তি, খুনোখুনিহীন একটা আলাদা পৃথিবী৷

.

বিকেল চারটে নাগাদ রূপবাজারে ঘুরছিল রূপসা৷ সঙ্গে ফিলিপ৷ ফিলিপ একজন আমেরিকান ধনকুবের৷ বয়স একান্ন৷ শৌখিন লোক৷ ছয় ফুটের ওপর হাইট৷ পেটাই চেহারা৷ সোনালি চুল, দাড়ি-গোঁফ৷ খালি গা৷ পরনে একটি সিল্কের সাদা ধুতি৷ গলায় একটি সোনার হার, অন্যটি ফুলের, দুই হাতে সোনার বালা৷ ফিলিপের শরীর থেকে ভুরভুর করছে কস্তুরী আর চন্দন মেশানো গন্ধ৷ গত পরশু থেকে ফিলিপ রূপসার নায়ক হয়েছেন৷ নিউইয়র্কে থাকেন৷ ভারতবর্ষে বেড়াতে এসেছেন পনেরো দিন আগে৷ অনেক জায়গা ঘুরে শেষে কলকাতা এবং তারপর রূপনগরে৷ রূপনগরের প্রেমকুঞ্জের কথা তাঁর আগে থেকেই জানা ছিল, তাই সেক্রেটারি ওঁর হয়ে বুকিং করে নিয়েছিল আগেই৷ ফিলিপ প্রেমকুঞ্জে প্রবেশ মাত্র ওঁকে যখন ক্যাটালগ দিয়ে নায়িকা পছন্দ করতে বলা হয় উনি তখন রূপসাকে পছন্দ করেন৷ প্রেমকুঞ্জের নিয়ম এমনই৷ নতুন ক্লায়েন্ট এলে ওই সময় যে গণিকারা নির্দিষ্ট কারও সঙ্গে এনগেজড নেই তাদের প্রোফাইল দেখানো হয়, ক্লায়েন্ট সেখান থেকে নিজের ইচ্ছেমতো গণিকা বেছে নিতে পারে৷ একজনকেও বাছতে পারে অথবা একাধিকও৷ ফিলিপ শুধু রূপসাকে বেছেছেন৷ এই রূপমঞ্জরীতে রূপসার বেশ কদর রয়েছে৷ ওর শ্যামলা অথচ মসৃণ ত্বক এবং গোটা শরীরের মধ্যে ভারতীয় নারীত্ব পূর্ণমাত্রায়৷ ফলে ক্লায়েন্টদের কাছে রূপসার চাহিদা সবসময়েই৷ এই রূপমঞ্জরীতে রূপসাদের স্যালারি হয় একটি বিশেষ পদ্ধতিতে৷ একটা ফিক্সড স্যালারি তো রয়েছেই কিন্তু তার ওপর রয়েছে কমিশন৷ প্রতি মাসে তুমি যত ক্লায়েন্ট অ্যাটেন্ড করতে পারবে, তাদের স্যাটিসফাই করতে পারবে এবং তাদের থেকে আরও নগদ খসাতে পারবে তার জন্য আলাদা কমিশন৷ এই কমিশনের জন্যই এখানকার বেশ্যারা আপ্রাণ চেষ্টা করে তাদের ক্লায়েন্টকে নানা ছলাকলায় একবারে নিংড়ে নেওয়ার৷ কিন্তু ক্লায়েন্ট প্রেমকুঞ্জের ভেতর খরচ করবে কোথায়? তার জন্যই রূপবাজার৷ এই বাজারে হরেক রকমের দোকান৷ কোথাও সুগন্ধী বিক্রি হচ্ছে তো কোথাও অলঙ্কার, কোথাও বস্ত্র তো কোথাও কথা বলা তোতাপাখি৷ সুরা কিংবা পুষ্পহার ইত্যাদি নিয়ে এক একটি ছোট দোকানে এক একজন দোকানি বসে৷ আর নায়িকারা তাদের নায়কদের নিয়ে আসে এই বাজারে৷ বায়না করে আমাকে তোতাপাখি কিনে দাও কিংবা স্বর্ণালঙ্কার৷ কস্তুরী মৃগ কিংবা মুক্তাভস্ম দেওয়া তাম্বুল অথবা সুরা৷ প্রেমরসে মত্ত নায়ক তখন নায়িকার মুখ থেকে একটি আবদার শোনার অপেক্ষায়৷ সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রেশমি থলে থেকে বেরিয়ে আসে স্বর্ণমুদ্রা৷ হ্যাঁ, এটাই দস্তুর৷ এখানে এই রূপবাজারে কেনাকাটি করতে হলে ইউরো বা টাকা অথবা ডলার নয়, স্বর্ণমুদ্রায় পেমেন্ট করতে হয়৷ আর এই স্বর্ণমুদ্রা কিনতে হয় রূপমঞ্জরীর কাউন্টার থেকে৷ ধরা যাক ক্লায়েন্ট একলাখ টাকা জমা করল, তার পরিবর্তে কাউন্টার থেকে ওই মূল্যের স্বর্ণমুদ্রা দেওয়া হল৷ এবার গণিকার কাজ হল ওই স্বর্ণমুদ্রা সে যতটা খসাতে পারবে তার ওপর পারসেন্টেজ৷ এক একটি স্বর্ণমুদ্রার ক্রয়মূল্য এক হাজার টাকা৷ গণিকা তার নায়কের কাছে বায়না করল আমাকে একটি সোনার কর্ণিকা কিংবা কটিবন্ধ কিনে দাও৷ দোকানি তার দর হাঁকল দশ স্বর্ণমুদ্রা অর্থাৎ দশ হাজার টাকা৷ সেই অলংকার দিয়ে নায়ক তার নায়িকার মন জয় করল৷ এইভাবে সেই স্বর্ণমুদ্রা খরচ করে দেখা গেল সেই একশোটি মুদ্রার মধ্যে নব্বইটি খরচ করেছে৷ প্রেমকুঞ্জ থেকে ফেরার সময় বাকি দশটি মুদ্রা কাউন্টারে জমা দিলে তার দশ হাজার টাকা রূপমঞ্জরীতে তার থাকা খাওয়া ফুর্তি ইত্যাদি সহ মোট খরচের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট হবে৷ এটা নেহাতই একটা খেলা৷ আর ক্লায়েন্ট ফিরে যাওয়ার পর সেইসব জিনিস আবার বাজারে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেরত চলে যায়৷ শুধু সেই গণিকার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে যুক্ত হয় অতিরিক্ত ইনসেনটিভ৷ এই ইনসেনটিভটাই সবথেকে বেশি আকর্ষণীয়৷ সেই কারণে সকল গণিকাই তার নায়কের কাছ থেকে ছলাকলার মাধ্যমে যত বেশি সম্ভব মুদ্রা খরচ করানোর চেষ্টায় থাকে৷ কিন্তু এই সকল খরচই এমনভাবে করতে হবে যাতে নায়ক একবারের জন্যও রুষ্ট না হয়, একবারও তার মনে এমন ভাবনা না আসে যে তাকে ঠকানো হচ্ছে৷ চিত্রলেখা তাঁর প্রশিক্ষণকালে রূপসাদের শিখিয়েছিলেন, বারাঙ্গনা ছয় প্রকার, যথা, (১) পরিচারিকা, (২) কুলটা, (৩) স্বৈরিণী, (৪) নটী, (৫) শিল্পকারিকা, (৬) প্রকাশবিনষ্টা৷ এর মধ্যে তোমরা মূলত নটী৷ আর নটীর মধ্যে শিল্পকলার সমাবেশ সবথেকে বেশি থাকে৷ অভিনয়ও একটি কলা৷ যার দ্বারা তোমরা নায়কের মনকে বশ করবে৷ তাকে সম্মোহিত করবে৷ মনে রাখবে তোমার ক্লায়েন্ট কিন্তু এখানে অর্থব্যয় করতেই এসেছেন৷ তোমার কাজ হল তাঁর খরচটাকে বাড়িয়ে দেওয়া৷ কিন্তু সরাসরি জোর করে নয়৷ প্রেমের মাধ্যমে৷

রূপসা চিত্রলেখার প্রতিটি শিক্ষাকে এমনভাবে আত্মস্থ করেছে যে খুব দ্রুত রূপমঞ্জরীর একজন অন্যতম ব্যস্ত গণিকা হয়ে উঠেছে৷ ম্যানেজমেন্ট ওর কাজে খুশি৷ সারাদিনে যেটুকু সময় নিজস্ব অবসর জোটে তখন খুব মন দিয়ে চিত্রলেখার শিক্ষাগুলিকে মনে মনে আওড়ায়, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাচ, অভিনয় এবং নানারূপ আভরণ কীভাবে পরিধান করতে হয়, কী ভঙ্গিতে শরীরকে নিরাভরণ করলে নায়কের কাম সর্বাপেক্ষা অধিক বৃদ্ধি পায় এইসব অনুশীলন করে৷ এবং চিত্রলেখা কিছু বইও দিয়েছেন ওদের সকলকে, কামশাস্ত্র এবং অন্যান্য কলা বিষয়ক৷ সেগুলোকেও খুব মন নিয়ে পাঠ করে রূপসা৷ এখন ও নিজেও কোনো পুরুষকে দেখে অনায়াসে বুঝে যায় সে পুরুষ বৃষ না মৃগ, শশ না অশ্ব প্রকৃতির? যেমন এই ফিলিপ বৃষ জাতীয় পুরুষ৷

বহুগুণ বহু বন্ধুঃ কামোঃ নতাংগঃ

সকল রুচিত দেহঃ সত্যবাদী বৃষোহয়ম৷

বৃষ শ্রেণির পুরুষের কপাল উঁচু এবং চওড়া৷ গলা এবং পেট মোটা৷ দেহ গৌরবর্ণ, হাত এবং পা লম্বা হয়৷ হাত-পায়ের তালু রক্তাভ৷ মধুরভাষী, লজ্জা খুব কম এবং সিংহের মতো এদের বিক্রম হয়৷ প্রায় সবকটি লক্ষণই ফিলিপের সঙ্গে মেলে৷ ফিলিপের শিশ্নটি অন্তত নয় ইঞ্চি দীর্ঘ এবং দৃঢ়৷ মিলনের সময়ে প্রবল বিক্রম৷

অবশ্য দীর্ঘকাল আগে থেকেই সব পুরুষের শরীর রূপসার কাছে একইরকম লাগে৷ কোনও আলাদা অনুভূতি নেই৷ চিত্রলেখা অভিজ্ঞ, ঠিক চিনেছেন রূপসাকে৷ বলেছেন, তোমাকে নিয়ে আমার বেশ চিন্তা৷ তুমি পুরুষকে তীব্র ঘৃণা করো, তোমার সঙ্গমের মধ্যেও সেই ঘৃণা প্রকাশ পায় অথচ কামকলায় তুমি পটু৷ পুরুষকে ভালোবাসতে শেখো৷ তোমার কাজকে উপভোগ করো৷

রূপসা শুনে বলেছে, চেষ্টা করব, মা৷ পুরুষের কাছে আমি কোনওদিন এমন কিছু পাইনি যার জন্য তার প্রতি প্রেম জন্মাবে৷ তবু চেষ্টা করব৷

হ্যাঁ, সঙ্গমকে প্রতিহিংসা কোরো না, এ হল প্রেমের প্রকাশ৷

রূপসা শোনে, বোঝে, কিন্তু এটাও বোঝে পুরুষের জন্য ওর অন্তরে শুধু এক পৃথিবী ঘৃণা, আক্রোশ ছাড়া আর কিছু নেই৷ আর সেই ঘৃণা, সেই ক্ষোভকে উগরে দেওয়ার প্রশস্ত পথই এই গণিকাবৃত্তি৷ ওর রূপ, লাবণ্য, সঙ্গমের ক্ষমতা, উৎকর্ষের কাছে বিভিন্ন পুরুষ যখন ঘায়েল হয়ে সারমেয়বৎ আচরণ করে তখন রূপসার মনে হয় তার এই গণিকাবৃত্তি সার্থক৷

রূপসা আজ সেজেছে ফুলের সাজে৷ খোঁপায়, গলায়, দুই হাতে, কোমরে জুঁই ফুলের মালার সাজ৷ এ সবই একটু আগে ফিলিপ কিনেছে রূপবাজার থেকে৷ তারপর নিজে হাতে সাজিয়েছে রূপসাকে৷ রূপসাও একটি মালা নিয়ে পরিয়েছে ফিলিপকে৷

ফিলিপের একহাতে সুরাপাত্র, অন্যহাতে রূপসাকে বেড় দিয়ে জড়িয়ে ঘুরছে৷ বাজারের মাঝে মোরগের লড়াই চলছে৷ তাই দেখছে অনেকে ভিড় করে৷ এও এক খেলা৷ এখানেও বাজি লড়ে দুই গণিকার নায়ক৷ ওই স্বর্ণমুদ্রাতেই বাজি লড়া হয়৷ বাজারে ঘুরতে ঘুরতে ফিলিপ মাঝে মাঝেই রূপসাকে আলিঙ্গন, চুম্বন করছে৷ স্তনে, পিঠে, নিতম্বে ইচ্ছেমতো হাত বোলাচ্ছে৷ রূপসাও সাপের মতো প্রায় জড়িয়ে রয়েছে ফিলিপকে৷ ওর হাতেও একটি স্ফটিকের পানপাত্র৷ তারমধ্যে খুব সামান্যই অতি মূল্যবান সুরা অবশিষ্ট রয়েছে৷ আজ ফিলিপ ফিরে যাবে৷ এই দুইদিনে ফিলিপকে প্রচুর আনন্দ দিয়েছে রূপসা৷ ফিলিপও খুব খুশি রূপসাকে পেয়ে৷ ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ৷ বারবার বলেছে পৃথিবীর বহু দেশের নানা ব্রথেলে গিয়েছে ফিলিপ, সেরা সুন্দরীদের সঙ্গ করেছে কিন্তু রূপমঞ্জরীর মতো ব্রথেল এবং রূপসার মতো বেশ্যা ও আগে কখনও পায়নি৷

রূপসা খুব খুশি হয়েছে, মানে খুশির ভান৷ কারণ এখানে যে নায়করা আসে তাদের সকলেরই এক রা৷ রূপসারা আসলে হল সেলসম্যান৷ কাস্টমারকে মিষ্টি কথা, আচরণে সন্তুষ্ট করে তাদের কাছ থেকে সর্বাধিক খরচটি করিয়ে নেওয়ার কৌশলই হল একজন আদর্শ সেলসম্যানের কাজ৷

বাজার থেকে কেনাকাটি শেষ হওয়ার পর ফিলিপ বলল, চলো এবার স্নান করি৷

হ্যাঁ, চলো৷

বাজার ছেড়ে বেরিয়ে এল দুইজনে প্রেমকুঞ্জের স্নানাগারে৷ পাথরে বাঁধানো চৌকো একটি জলাশয়৷ বুক সমান সুগন্ধী জল৷ নানা রকমের ফুল ছড়ানো রয়েছে৷ সেখানে জলকেলিতে ব্যস্ত কয়েকজন গণিকা তাদের নায়কদের নিয়ে৷ খিলখিল হাসির রব উঠছে থেকে থেকে৷ কেউ আবার জলেই সঙ্গমরত৷ কারও পরনে নামমাত্র বস্ত্র, কারও সুতোটি নেই৷ ফিলিপ আগেই রূপসাকে নিরাবরণ করে ফেলল তারপর নিজের বস্ত্রটি খুলে ফেলে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে রূপসাকে পাঁজাকোলা করে জলে নামল, স্নানবিলাস চলল বেশ কিছুক্ষণ৷ তারপর ফিলিপ জল থেকে উঠে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল৷ রূপসা ফিলিপের গোটা শরীরে চন্দনবাটা লেপে দিতে থাকল৷ চন্দন, কুমকুম, নানারকমের ফুল, মালা, তাম্বুল, সুরা, সুগন্ধী ইত্যাদি সব রাখাই থাকে প্রেমকুঞ্জের বিভিন্ন স্থানে৷ রূপসার নিজের ঘরেও এইসকল উপচার সাজানো থাকে৷ পরিচারক এসে সাজিয়ে দিয়ে যায়৷ বৃষ প্রকারের পুরুষের যা গুণ থাকে তার প্রায় সবই ফিলিপের রয়েছে কিন্তু ফিলিপ সেই প্রকারের পুরুষ যারা সঙ্গম-এর সময় সঙ্গীকে যন্ত্রণা দিতে এবং নিতে ভালোবাসে৷ রূপসার এই অত্যাচার সহ্য হয় না৷ কিন্তু ওর কপালে অধিকাংশই জোটে এমন৷ শরীরের নানা জায়গায় কালশিটে, দংশন, নখের আঁচড়ের দাগ তো রয়েছেই তার সঙ্গে ফিলিপের পাশবিক শক্তির ঝাঁঝ সহ্য করা কোনও ভারতীয় মেয়ের পক্ষে খুব কঠিন৷ গোটা শরীরে ব্যথা করে দিয়েছে৷ কিন্তু উপায় নেই, ক্লায়েন্টকে কোনওভাবেই নিজের অপছন্দ জানানো যাবে না৷ পুরো কাহিল হয়ে পড়েছে রূপসা৷ আজ সন্ধেবেলায় ফিলিপ নিজের দেশে ফিরে যাবে৷ বিকেলেই এখান থেকে চলে যাবে ও৷ তারপর টানা একদিন রেস্ট নিতে হবে৷

চন্দন মাখাতে মাখাতেই ফিলিপ চিত হয়ে শুল৷ ওর পুরুষ অঙ্গটি আবার জেগে উঠেছে৷ অপরিসীম শক্তি৷ আজ সকাল থেকে এই দুপুরের মধ্যে তিনবার মিলিত হয়েছে ফিলিপ৷ কিন্তু ক্লান্তি নেই৷ ফিলিপ উঠে বসে রূপসাকে চিত করে শুইয়ে দিল তারপর রূপসার পা দুটিকে জড়ো করে সোজা ওপরে তুলে দিয়ে নিজের নিজেকে প্রবেশ করাল রূপসার মধ্যে৷ চোখ বন্ধ করে আহ করে উঠল রূপসা৷ মিলনের এই আসনটির নাম বেণুদারিতক৷ গতকাল ফিলিপকে শিখিয়েছিল রূপসাই৷ অনেকগুলো আসনের মধ্যে এটাই ওর পছন্দ হয়েছে৷ অনেকবার বলেছে রূপমঞ্জরীতে আবার আসবে, এত অসাধারণ জায়গা আগে কখনও দেখেনি, ওর মতে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ কলা নাকি কামকলা৷ শুনে বেশ হাসিই পেয়েছে রূপসার৷ এত কিছু থাকতে শেষে কামকলা! অবশ্য যার যা ভালো লাগে৷

আধঘণ্টা ধরে নানা ভঙ্গিতে সঙ্গম চলল দুজনের৷ কখনও ফিলিপের ওপর উঠে বসে পীড়িতক আসনে, কখনও ফিলিপ উঠে দাঁড়িয়ে রূপসাকে নিজের লিঙ্গে গেঁথে কোলে নিয়ে স্থিররত আসনে৷ ফিলিপ যেন একটা ঝড়৷

মিটে যাওয়ার পর ক্লান্ত রূপসা শরীর এলিয়ে দিল ফিলিপের কোলে৷ ফিলিপ দুটি সাজানো পান তুলে নিয়ে একটি পান রূপসার মুখে দিল, অন্যটি নিজের৷ গোটা শরীর ক্লান্তি আর বেদনায় জর্জরিত৷ ফিলিপও যেন একটু ক্লান্ত মনে হল এবার৷ রূপসাকে বলল, চলো, একসঙ্গে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করা যাক৷ তোমার ঘরেই কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে নিই৷

ক্লায়েন্টের আবদার৷ উঠল রূপসা৷ চিরশ্রীকে দেখল রূপসা, ও নিজের নায়কের সঙ্গে জলে নামছে৷ রূপসার সঙ্গে এক মুহূর্ত চোখাচোখি হতে রূপসা হাত নাড়ল৷ চিরশ্রীও চুমু খাওয়ার ভঙ্গি করল ওকে৷ ওর নায়কটিও হাসল রূপসাকে দেখে৷ রূপসাও৷ এখানে সকলে সারাক্ষণ হাসিখুশি৷ প্রেমকুঞ্জের বাইরে বেশ কয়েকটি রথ দাঁড়িয়ে৷ এদের এখানেই ডিউটি৷ একটিতে উঠে বসল রূপসা৷ সারথিকে বলল, রূপসায় চলো৷

গাড়ি চলতে শুরু করল৷ পথটুকু ফিলিপ নিজেই কথা বলে গেল৷ সেই একই বিষয়, রূপসার প্রশংসা, রূপমঞ্জরীর সুখ্যাতি৷ এখানে বিদেশি ক্লায়েন্টদের মধ্যে একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে রূপসা, এদের মধ্যে ভণ্ডামোটা কম৷ শরীর ভোগ করতে এসে সেটাই ভোগ করে এবং ভালো লাগলে শরীরেরই প্রশংসা করে৷ অনেক ইন্ডিয়ান আসে যারা আবার ন্যাকান্যাকা প্রেমের কথা বলে, ভালো লাগে না রূপসার৷ কিন্তু এই পেশায় আসলের থেকে ভণিতাটাই প্রধান৷ চিত্রলেখাও তাঁর ট্রেনিং-এ বারবার শেখান, শরীরভোগকে সর্বোচ্চ সুখকর করে তুলতে পারে প্রেম, নায়ককে যত প্রেমময় করে তুলতে পারবে সে তত সুখ পাবে৷

রূপসার নিজের ঘরে পৌঁছে দুজনেই সোজা বিছানায়৷ এসি অন করাই ছিল৷ ঘরের ভেতরে মনোরম ঠান্ডা৷ টাটকা ফুলের গন্ধে ম ম করছে৷ সুন্দর পরিষ্কার টান টান বিছানা৷

ফিলিপ বলল, এসো, আজকের মতো একসঙ্গে একঘণ্টা ঘুমিয়ে নিই৷ তারপর বিদায় নেব৷ তোমার জন্য আমি একটা বিশেষ উপহার রেখে যাব আজ৷ বলে নিজের আঙুল থেকে একটা হিরে বসানো সোনার আঙটি খুলে রূপসার আঙুলে পরিয়ে দিল৷ ফিলিপের যা মোটা আঙুল রূপসার বুড়ো আঙুলে পরালেও ঢিলে হবে তবু অনামিকায় ওই বহুমূল্য আঙটিটি পেয়ে খুব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ফিলিপকে গভীরভাবে চুম্বন করল৷ ঠোঁটে, গলায়, বুকে৷ আঙটিটির মূল্য কয়েক লক্ষ টাকা হবেই৷ এটা যদিও ফিলিপ জানে না যে ও চলে যাওয়ার পরেই রূপসাকে এই আঙটিটি জমা করে দিতে হবে রূপমঞ্জরীতে৷ গণিকারা যা ব্যক্তিগত উপহার পায় তা সবই জমা করে দিতে হয়, ফলে সকল গণিকার মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে ঈর্ষার কোনও সুযোগ নেই৷ এবং কে কী উপহার পেল তা যেহেতু একমাত্র সেই গণিকা এবং ম্যানেজমেন্ট ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না ফলে সকলের মধ্যেই দিব্যি সদ্ভাব৷ তবে প্রাপ্ত উপহারের মূল্য হিসেবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ইনসেনটিভ জমা পড়ে যায় গণিকার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে৷

এবার ফিলিপ আর আদরের আগ্রহ দেখাল না৷ রূপসাকে কোলবালিশের মতো জড়িয়ে শুয়ে পড়ল৷ আর শোবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম৷ ফিলিপের নির্লোম বিশাল চেহারার মধ্যে আটকে থেকে রূপসাও ঘুমিয়ে পড়ল একসময়৷

ঘুমের মধ্যেই ছেঁড়া ছেঁড়া কতগুলো ছবি তৈরি হতে থাকল তারপর ছবিগুলো পরপর জুড়ে গিয়ে চলচ্চিত্রের মতো একটা স্বপ্ন৷ স্বপ্নে চরিত্রগুলো কথা বলতে শুরু করল….

রূপসা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷

বিলু গাল চুলকোতে চুলকোতে বলছে, কোনও টেনশন নিবি না৷ চন্দনদা খুব ভালো লোক৷

রূপসা প্রথমটায় বুঝতে পারছিল না দাদা কী বোঝাতে চাইছে৷ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল৷

বিলু জড়তাহীন গলায় তার বোনকে বুঝিয়ে যাচ্ছিল, দেখ, বাবার কাজকম্ম করার দিন শেষ, আমি বিজনেসের ট্রাই মেরে যাচ্ছি, শুধু ভালো ক্যাপিটাল নেই বলে এখনও সুবিধা করে উঠতে পারছি না, ফালতু আচার, চাটনি বানিয়ে টাইম ওয়েস্ট কেন করবি? এতে তিনথালা ভাতও হচ্ছে না৷ আর পার্টি ধরলে দীপু-ফিপুর মতো ক্যালানেকে করে কোনও লাভ নেই৷ ধরলে শাঁসালো পার্টি ধর৷ আজ বিকেলে চন্দনদা আসবে৷ কথা বলে নিস৷ বাবাকে আমি সেটিং করে নেব৷ বলে বিলু বেরিয়ে গিয়েছিল৷

রূপসার বুঝতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল৷ দাদা হয়ে বোনের জন্য কাস্টমার ধরে আনবে…এতটা কি সম্ভব? যদিও বিলুর প্রতি ঘৃণা ছাড়া রূপসার মধ্যে কোনওদিন আর কোনও অনুভূতিই জন্মায়নি, তবু এই ব্যাপারটাই একটু যেন সংস্কারে বাধছিল ভেবে নিতে৷ কিন্তু বিলু সমস্ত সংস্কারের ঊর্ধ্বে৷ দুপুরবেলায় এসে নিজে হাতে ঘর ভালো করে চেক করে বাবাকে একপ্রকার জোর করেই সাইকেলে বসিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ যাওয়ার আগে শুধু রূপসাকে বলেছিল, কোনও টেনশন নিবি না৷ চন্দনদা লোক খারাপ না৷ বলে পাক্কা দালালের মতো খৈনির দলাটা নীচের ঠোঁটের ফাঁকে ভরে নিয়ে বিলু বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা বাবাকে ধমকে বলেছিল, এখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে কী শুনছ? যাও, সাইকেলটা রাস্তায় বার করো৷

দাদা…

বল…৷ আরে ধুর, ভয় পাচ্ছিস কেন? চন্দনদা খুব ভালো লোক৷ প্রচুর টাকা৷ একটু সেবাযত্ন করবি, একটু গল্প-টল্প করতে আসবে আর কি৷ কোনও ভয় নেই৷ বড় হয়ে গেছিস, এত ভয় কিসের? বলে বোনের শরীরের দিকে ভালো করে চোখ বুলিয়েছিল বিলু৷

রূপসার ওই মুহূর্তে ঠিক কী হচ্ছিল ঠিক নিজেও বুঝতে পারছিল না, একবার মনে হচ্ছিল বাড়ি ছেড়ে ছুটে পালিয়ে যেতে, একবার মনে হচ্ছিল দাদার গায়ে কেরোসিনের বোতলটা ঢেলে দিয়ে দেশলাই কাঠি ছুঁড়ে ফেলতে৷ বাবার দিকে একবারের জন্যই তাকিয়েছিল রূপসা, বাবা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল৷ রূপসার দিকে একবারের জন্যও তাকায়নি৷

এসব ছেঁড়া-খোঁড়া ফ্রক না পরে বরং…কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকেছিল তারপর একটু গলা নামিয়েই বলেছিল, আলমারিতে দেখিস কোনও শাড়ি-টাড়ি থাকলে…

মায়ের শাড়ি? বেশ স্পষ্ট উচ্চরণেই প্রশ্নটা করেছিল রূপসা৷

দেখ কিছু আছে কি না৷ বলে আর দাঁড়ায়নি বিলু৷ বাবাকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল৷

বিকেলে চন্দনদা এসেছিল৷ রূপসার থেকে পনেরো বছরের বড় চন্দনদা৷ অনেক কিছু নিয়ে এসেছিল রূপসার জন্য৷ ফল, সন্দেশ, কেক, চুড়ি, হার, সালোয়ার কামিজ, সেন্ট, পাউডার৷

সেদিন দুপুরে একা ভাত খেতে বসে গা গুলোচ্ছিল রূপসার৷ খেতে পারেনি৷ দুই গ্রাস ভাত মুখে দিতেই ভেতর থেকে ঠেলা আসছিল৷ কাঁঠালবাগানের চন্দনদার বিশ্রী চেহারাটা বারবার মনে পড়ছিল৷ কী করতে হবে, চন্দন বিশ্বাস কেন আসছে বুঝতে আর সময় লাগেনি রূপসার৷ একবার মনে হয়েছিল বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবে কোথাও৷ নিজের বিজনেসের তিনশোটা টাকা আলাদা লুকিয়ে রেখেছিল৷ কিন্তু তারপরেই একটা অদ্ভুত জেদ চেপে বসেছিল মনের ওপর৷ অকারণ একটা আক্রোশ, জগতের সবকিছুর প্রতি৷ ইচ্ছে করছিল সব ব্যাটাছেলেকে আগুনে পুড়িয়ে দিতে, বাবাকেও৷ তারপরেই মনে হয়েছিল ওইভাবে নয়, যে শরীর ওর সব থেকে বড় শত্রু তাকে দিয়েই প্রতিশোধ নিতে হবে৷

তাই সেদিনের পর আরও বারকয়েক চন্দন আসার পর যখন রূপসা বুঝতে পেরেছিল চন্দনের বত্রিশ বছরের বেঢপ শরীরটা ওকে আর ঘেন্না দিচ্ছে না, স্পর্শই করতে পারছে না, তখন রূপসা ঠিক করে নিয়েছিল ওকে কী কী করতে হবে৷ চোদ্দ-পনেরো বছরের একটি মেয়ে ঝড়ের বেগে দ্রুত ম্যাচিয়োর হয়ে উঠছিল৷ পোষা ভেড়ার মতো হয়ে উঠেছিল চন্দন৷ যতবার বাড়িতে আসত মুঠোভর্তি টাকা নিয়ে আসত৷ কেরোসিন তেলের ডিলার চন্দন বিশ্বাসের বউটা ছিল দজ্জাল, চার বছরের ছেলেটা হাবা৷ আর চন্দন কেরোসিন এবং রসের সন্ধানী৷ প্রথম দিকে বাবাকে বিলু নিয়ে যেত, তারপর বাবা নিজেই চন্দনকে আসতে দেখে, ‘ভালো আছ তো বাবা?’ শরীরের কুশল জেনে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেত৷ সংসারের শ্রী ফিরছিল৷ বছর দুয়েকের মধ্যেই রূপসার নামডাক ছড়িয়ে পড়েছিল পাড়ায়-বেপাড়ায়৷ স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল৷ পাড়ার বন্ধুরা আর কেউ কথা বলত না ওর সঙ্গে৷ বিলু প্রথমদিকে যাকে পারত নিয়ে আসত ধরে, তারপর একসময় রূপসা বুঝল এবার ওর টার্ন এসেছে৷ ততদিনে লোকাল এম এল এ কিংবা এলাকার নামী দাদা পর্যন্ত রূপসা বলতে অজ্ঞান৷ কার কেমন দম, কোন দেবতা কীভাবে খুশি শিখে নিয়েছিল রূপসা৷ বাড়ি পাকা করে ফেলেছিল৷ নতুন চওড়া খাট, সোফা কাম বেড, গ্যাসের লাইন—অনেক কিছু এসে গিয়েছিল ঘরে৷ কিন্তু বিলুর অত্যাচার বাড়ছিল৷ যখন-তখন এসে পয়সা চাওয়া, হুড়তাল ফুর্তি করা, মাঝে মাঝে রূপসাকে শাসানো৷ রূপসা অপেক্ষা করছিল৷ তারপর একদিন সময় এসেও গেল৷ এলাকার খতরনাক প্রমোটার সুশান্ত মল্লিক তখন রূপসার রসে হাবুডুবু খাচ্ছে৷ প্রায় দুই বেলার খদ্দের৷ যখন খুশি বাড়িতে চলে আসে৷ এক এক রাতে থেকেও যায়৷ রূপসার তখন আলাদা ঘর৷ এক রাতে রূপসার সঙ্গে বিছানায় তুমুল দাপাদাপির সময় সুশান্ত আবিষ্কার করল সেদিন রূপসার মন ভালো নেই৷ খুনখুন করে কাঁদছে৷

এ কী রে? কী হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন?

দাদার জ্বালায় আমি আর পারছি না, সুশান্তদা৷ রোজ মারধোর করে৷ আমি এবার কোনদিন গায়ে আগুন দিয়ে মরব দেখো৷

সুশান্ত তখন মালের ঘোরে৷ দাঁত ঘষে বলে উঠেছিল, তুই মরবি কেন? ওই শুয়োরটার বহুত বাড় বেড়েছে, স্রেফ তোর দাদা বলে এতদিন ছেড়ে দিয়েছি৷ দেখছি এবার৷

খুব বেশি দিন দেখতে হয়নি রূপসাকে, দুই দিন পরেই রেললাইনের ধার থেকে মর্গে পাঠানো বিলুর ক্ষতবিক্ষত বডিটা একবার শনাক্ত করতে মর্গে যেতে হয়েছিল রূপসাকে৷ ব্যস!

তারপর থেকে বাবার কী যেন হল৷ ভীষণ ভয় পেতে শুরু করল রূপসাকে৷ কোনও কথা বলত না, শুধু ভয়ে ভয়ে তাকাত৷ রূপসার মাঝে মাঝে কষ্ট হত আবার এক এক সময় ভালো লাগত বাবার এই ভয়৷ বাবার মাথাটা বিগড়োতে শুরু করেছিল৷ মাঝে মাঝেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ত৷ ফিরত না৷ খেতে-নাইতে ভুলে যেত৷ তারপর একদিন আর ফিরল না৷ সত্যি বলতে আর কেউ না জানুক, বাবা, শুধু বাবার জন্যই ওই পাড়ায় তখনও আটকে ছিল রূপসা৷ দিন পনেরো পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন বাবা ফিরল না, রূপসা তারপর আর দেরি করেনি৷ এক বিকেলে বাড়িতে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল কলকাতার পথে৷

সেখান থেকে কখনও মুম্বই, কখনও দিল্লি, এলাহাবাদ, গোয়া আবার কলকাতা৷ এক অদ্ভুত জীবন৷ যত দিন গিয়েছে নিজেকে আরও শাণিত করেছে রূপসা৷ নিজের শরীরকে করে তুলেছে আরও ঐশ্বর্যময়ী৷ এসকর্ট সার্ভিস, প্লেজার ট্রিপে রোজগার বেশি৷ সেগুলোই প্রেফার করত রূপসা৷ দুই-তিনটে সল্প পর্নোতে কাজ করে বুঝেছিল অতি অখাদ্য৷ ইউরোপ-আমেরিকান পর্নোর ধারে-কাছ দিয়েও যায় না ইন্ডিয়ান পর্নো অ্যাক্টররা৷ সস্তায় বাজিমাত করার চেষ্টা৷ কয়েকটা এজেন্সিতে নাম লেখানো ছিল রূপসার৷ তাদের কলে যতবার শহর ছেড়ে ক্লায়েন্টের সঙ্গে শহরের বাইরে যেতে হয়েছে, বেশ ভয়ই করত৷ দুই-একবার প্রাণে মরতে মরতে বেঁচেছিল৷ তবে শেষবার যখন এক ক্লায়েন্ট ব্যাঙ্গালোরের এক হোটেলের রুমে রূপসার ওপরে অনেক নির্যাতন করার পরে ওর ভেতরে বোতল ঢোকানোর চেষ্টা করছিল তখন ওই বোতল কেড়ে নিয়ে ক্লায়েন্টের মাথায় বাড়ি দিয়ে তাকে আহত করে ওই রাতেই হোটেল ছেড়ে পালিয়েছিল৷ ঠিক করে নিয়েছিল আর শহরের বাইরে নয়৷ অন্য কিছু ভাবতে হবে৷ তখন যোগাযোগ হয়ে গিয়েছিল এই রূপমঞ্জরীর সঙ্গে৷ প্রায় দশ বছরের অভিজ্ঞতায় রূপসা একটা জিনিস বুঝেছে এই প্রফেশনে সেই মেয়েদের চাহিদা বেশি যারা অত্যাচারী পুরুষদের নানারকম অত্যাচার সহ্য করতে পারে৷ ধর্ষকাম পুরুষের সংখ্যাই যেন পৃথিবীতে বেশি৷ নারীশরীরে যন্ত্রণা দিয়ে, তাকে ক্ষতবিক্ষত করাই যেন একমাত্র সুখ৷ আর সেই সুখের যে কতরকমের বিকৃতি! এক একটা রাত যেন সাক্ষাৎ নরকের মতো বিভীষিকা হয়ে উঠেছে রূপসার কাছে৷ কত গোপন অশ্রু, হতাশা, যন্ত্রণার সাক্ষী হয়েছে তার একা বালিশ, স্নানঘর৷ কিন্তু কাঁদতে রূপসার লজ্জা হয়৷ নিজের প্রতি ঘৃণা আসে৷ প্রতিটি অশ্রুকেই আগুনের কণা বানিয়ে আরও জ্বলে উঠতে চায় ও৷ পুড়ে যেতে চায়৷ এ যেন নিজের প্রতিই এক প্রতিশোধ, কিসের প্রতিশোধ? জানা নেই৷

স্বপ্নের মধ্যে আজ বহুকাল পর দাদার মৃত মুখটা একঝলক মনে এল৷ বিকৃত মুখ, গলার নলি কাটা সেই মুখটা৷ ঘুমের রেশটা কেটে গেল রূপসার৷ উঠে বসল৷ গোটা শরীরে অসহ্য ব্যথা৷ আজ আবার ওষুধ নিতে হবে৷

রূপমঞ্জরীতে যত রকমের রূপচর্চা এবং ওষুধ ব্যবহার করা হয় সবই প্রাচীন এবং ভেষজ৷ তিনজন কবিরাজ রয়েছেন এখানে চিকিৎসার জন্য৷ এবং যাবতীয় ভেষজের চাষও এই রূপমঞ্জরীর জমিতেই হয়৷

ফিলিপেরও ঘুম ভাঙল৷ উঠে বসে রূপসাকে বলল, সময় হয়ে গিয়েছে কি?

বোধহয় হয়নি৷ এখনও বার্তাবাহী আসেনি…৷

আমি আবার আসব এখানে৷ তোমার আকর্ষণেই আমাকে ভারতে আসতে হবে৷ সামনের মাসে আমার এক বন্ধু ভারতে আসবে৷ এখানে ওকে অবশ্যই আসতে বলব৷

বিছানার পাশে থালায় কিছু ফল রাখা ছিল৷ সেখান থেকে একটা আপেল তুলে কামড় বসাল ফিলিপ৷ নিজে দুটো কামড় দিয়ে রূপসার মুখের সামনে ধরল৷ রূপসাও কামড় দিল একটা৷

ঘরের ভেতরে হঠাৎই সেতারের শব্দ৷ কলিং বেল বেজে উঠেছে৷ মানে দূত এসে গেছে৷ ফিলিপকে মনে করাতে যে তার বেরোনোর সময় হয়ে গিয়েছে৷

রূপসা সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থাতেই উঠে গিয়ে দরজা খুলল৷ সামনে পরিচারিকা দাঁড়িয়ে৷

প্রণাম করে বলল, ফিলিপ মহাশয়ের বেরোনোর সময় হয়ে গিয়েছে৷

হ্যাঁ, ঠিক আছে৷ ধন্যবাদ৷

আবার নমস্কার করে চলে গেল পরিচারিকা৷

এখানে সকল পরিচারক-পরিচারিকার অন্যতম কাজ হল কোন গণিকা কোথায় রয়েছে তার সম্পর্কে প্রতিমুহূর্তে খবর রাখা৷ সকল পরিচারক-পরিচারিকার কানের ফুটোয় একটি মাইক্রোফোন গোঁজা থাকে৷ অফিস রুম থেকে তাদের যাবতীয় নির্দেশ ওই চিপের মাধ্যমে দেওয়া হয়ে থাকে৷

রূপসা পিছন ফিরে দেখল ফিলিপ উঠে পড়েছে৷ রূপসা মনে মনে ভাবল, উফফ! এবার মুক্তি৷ এবার পুরো একটা দিন বিশ্রাম নিতে হবে৷ এই বিশ্রাম ম্যানেজমেন্ট অ্যালাউ করে৷

বিশ্রাম পাবে এই ভাবনার আনন্দেই ফিলিপকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল রূপসা৷ ফিলিপও ওকে চেপে ধরে চুমু খেল৷ দুই স্তনে কঠোরভাবে মর্দন করে নিজের শিশ্নটি ঠেসে ধরল রূপসার পেটে৷

এই রে, আবার শিশ্ন শক্ত হয়ে উঠছে! কিন্তু ভয় বা বিরক্তি দেখালে চলবে না৷ রূপসা ফিলিপের দৃঢ় ও দীর্ঘ লিঙ্গটি ধরে ঝুঁকে একটি চুমু খেল৷ তারপর খিলখিল করে হেসে ফিলিপকে পরিয়ে দিল সাদা সিল্কের ধুতি৷ গায়ে খানিকটা কস্তুরী তেল মাখিয়ে জড়িয়ে দিল উত্তরীয়৷ বাইরে রথ অপেক্ষা করছে৷ ফিলিপ রূপসাকে বিদায় জানিয়ে উঠে পড়ল রথে৷ প্রেমকুঞ্জ ছাড়িয়ে বাইরের অংশে একটি মস্ত বিল্ডিং রয়েছে, সেখানে ক্লায়েন্টদের নিজেদের লাগেজ, জামাকাপড় রাখার এবং তাদের কেয়ারটেকার, বা পি এ ইত্যাদিদের থাকার ব্যবস্থা৷ ফিলিপকে আগে ওখানে নিয়ে যাওয়া হবে৷ তারপর সেখানে এই পোশাক ছেড়ে নিজের পোশাক পরে কাউন্টারে পেমেন্ট মিটিয়ে রূপমঞ্জরীর গাড়িতে সোজা এয়ারপোর্ট৷

রূপসা আবার শুয়ে পড়ল বিছানায়৷ আরও ঘুম দরকার৷ শরীর জুড়ে ব্যথা, ভীষণ ব্যথা৷

.

বেশ রাত হয়েছে৷ চিত্রলেখার ঘরে বসেছিল রূপসা৷ রিপোর্ট নিচ্ছিল৷ এটাও প্রেমকুঞ্জের নিয়ম৷ কোনও নির্দিষ্ট গণিকার কাছে যদি কোনো ক্লায়েন্ট চব্বিশ ঘণ্টার অধিক সময় থাকে, তাহলে শেষে ক্লায়েন্ট এবং সেই গণিকা উভয়ের কাছ থেকেই ফিডব্যাক নেওয়া হয়৷ সেই অনুসারে রিপোর্ট তৈরি হয়৷ ভবিষ্যতের প্ল্যানিং হয়৷

চিত্রলেখা খুব মন দিয়ে শুনছিলেন রূপসার কথা৷

রূপসা বলে যাচ্ছিল৷ আমি এইভাবে আর পারছি না মা, বড় যন্ত্রণা৷ ছেলেগুলো এত যন্ত্রণা দিয়ে কী সুখ পায় জানি না৷ রূপসার বিবিধ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ফিলিপের রেখে যাওয়া আঘাতের চিহ্নগুলো পরম মমতায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখছিলেন চিত্রলেখা৷ কোথাও কালশিটে, কোথাও আঁচড়ে রক্ত জমে রয়েছে৷ গত রাতে সঙ্গমের সময়ে ফিলিপ রূপসার ডানহাতটা এমনভাবে মুচড়ে দিয়েছিল যে তখনই যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠেছিল রূপসা৷ তারপর থেকে ডানহাতটা নাড়াতেও কষ্ট হচ্ছে৷ কিন্তু ফিলিপের কাছে এই ব্যথা প্রকাশ করার উপায় ছিল না৷ তাহলে ওর মনে খারাপ প্রভাব পড়তে পারত৷ আসলে ইন্ডিয়ান ক্লায়েন্টদের নিয়ে রূপসার খুব বেশি সমস্যা হয় না, কিন্তু ভয় লাগে ইওরোপিয়ান দৈত্যগুলোকে৷ শালাদের গায়ে যেন অসুরের শক্তি৷ আর রূপসার এমন কপাল এরা বেশিরভাগই রূপসাকে পছন্দ করে নায়িকা হিসেবে৷ আসলে রূপসার চেহারার মধ্যে এমন একটি ভারতীয় লালিত্য রয়েছে যা এক দর্শনেই যে কেউ মুগ্ধ হয়৷ আর হরিণের মাংসই তার শত্রু৷

আমি কোনোদিন এবার মরেই যাব৷ আর বেঁচে থেকেই বা কী লাভ, মা? অনেকদিন হয়ে গেল পৃথিবীতে৷ আমার কোনও পিছুটান নেই, কাউকে কোনও কৈফিয়ত দেওয়ার নেই৷ অনেক বছর হয়ে গেল পৃথিবীতে বেঁচে রয়েছি, আর ভালো লাগছে না৷

চিত্রলেখা তাঁর অত্যন্ত গুণী ছাত্রীটির দিকে তাকিয়ে শুনছিলেন৷ জীবনে বহু গণিকা তিনি তৈরি করেছেন৷ তাদের অনেকেই আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে৷ আবার কেউ অন্ধকারে তলিয়েও গিয়েছে৷ কিন্তু আজ পর্যন্ত যাদের তৈরি করেছেন তাদের মধ্যে নিজের মনের মতো ছাত্রী পেয়েছেন মাত্র গুটিকয়েক৷ রূপসা সেই গুটিকয়েকের মধ্যে একজন৷ মেয়েটির মধ্যে শেখার আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে৷ আত্মবিশ্বাস, শেখার আগ্রহ এবং সেই শিক্ষাকে কাজে লাগানোর নিপুণ ক্ষমতা তো রয়েছেই, তার সঙ্গে রয়েছে অদম্য জেদ, পরিশ্রম করার ক্ষমতা৷ চিত্রলেখা টের পান মেয়েটির অনেক গভীরে একটি গনগনে আগুন রয়েছে, তার জ্বলনেই ওর এই শক্তির প্রকাশ৷ বেশ্যা অনেক প্রকারই হয়, কুলটা, রূপজীবী, স্বৈরিণী, কিন্তু একজন আদর্শ গণিকার মধ্যে শুধু শরীরের রূপ নয়, শিল্প-শাস্ত্র সম্পর্কেও জ্ঞান থাকা আবশ্যিক৷ আর রূপসা এই কয়েক মাসে নিজেকে এইসব বিষয়ে যে পরিমাণে উন্নত করেছে তা অসাধারণ৷ এবং আগামীদিনে রূপসা যে চিত্রলেখার জায়গাটিও নিতে পারে, সেই ভাবনাও ম্যানেজমেন্টের কানে চিত্রলেখাই দিয়েছে৷ একজন গণিকার অন্যতম গুণ হল তার অন্তরে পুরুষের প্রতি কোনও আসক্তি, কোনও প্রেম থাকবে না অথচ প্রেমের অভিনয়ে অনন্যা সে হবে শ্রেষ্ঠতমা৷ নায়কের কাছ থেকে ছলাকলায় যত বেশি সম্ভব ধনসম্পদ আদায় করতে জানতে হবে৷ সঙ্গীত, নৃত্য, কাম, অঙ্গরাগে সে হবে অসামান্যা৷ এইসব গুণই রূপসার মধ্যে রয়েছে৷ মেয়েটি বাধ্য৷ তাই ওকে বেশ নিজের মতো করে তৈরি করছেন চিত্রলেখা৷ কোনও গভীর যন্ত্রণা ওর রয়েছে অন্তরে যা ও কখনোই স্বীকার করে না, কিন্তু এই যন্ত্রণার তুষের আগুনেই সারাক্ষণ জ্বালিয়ে রাখে নিজেকে৷ চিত্রলেখা তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় জানেন অধিকাংশ মেয়েই বিশেষ করে ভারতবর্ষের মতো দেশগুলিতে মেয়েরা শরীরকে বিক্রয়যোগ্য করে বা বেশ্যাবৃত্তিতে আসে নেহাত দায়ে পড়ে৷ তাই এই বৃত্তিটির প্রতি তাদের না রয়েছে কোনও সম্মানবোধ, না রয়েছে ভালোবাসা, সেই কারণে পেশাদারিত্বও নেই৷ কিন্তু পৃথিবীর আদিমতম এই পেশায় কোনও অসম্মানের ব্যাপার নেই, বাকি আর পাঁচটি পেশার মতো এটিও যথেষ্ট সম্মানজনক এবং রীতিমতো পরিশ্রম করেই নিজেকে এই পেশার যোগ্য করে তুলতে হয়, তা নিয়ে কেউ ভাবে না৷ এই কাজটিই চিত্রলেখা করে আসছেন৷

রূপসার চিবুক ধরে নিজের মুখের সামনে ধরলেন তিনি৷ ওর কপালে একটা চুমু খেলেন৷ তারপর মায়ের মতোই মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, খুব কষ্ট, তাই না?

চিত্রলেখার এমন স্পর্শে বুকের ভেতরটা এক মুহূর্তে কেমন যেন করে উঠল রূপসার৷ চোখ ঝাপসা হয়ে উঠতে চাইল৷ খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিতে চাইল রূপসা, সেটা চিত্রলেখার নজর এড়াল না৷ বললেন, তুমি খুব অল্প বয়সেই অনেককিছু সহ্য করে ফেলেছ৷ বুঝি কিছুটা৷ দেখো রূপসা, গণিকা যখন অল্পবয়স তখন সে বালা, তারপর যুবতী এবং প্রৌঢ়া আর সব শেষে বৃদ্ধা৷ যুবতী পর্যন্ত একজন গণিকার মূল্য৷ এই পেশায় পেনশন, গ্র্যাচুইটি, পি এফ কিছুই নেই৷ নিজেরটুকু এই কয়েক বছরের মধ্যেই গুছিয়ে নিতে হয়৷ এবং খেয়াল রাখতে হয় যেন অসুস্থ না হয়ে পড়ে৷ তুমি একজন সচেতন, বুদ্ধিমতী মেয়ে আমি জানি, কিন্তু তোমার আবেগকে তুমি লুকিয়ে রেখেছ যা কাউকে দেখাতে দাও না৷ কী, ঠিক বলছি তো?

রূপসার চোখ এবার সত্যিই ঝাপসা হয়ে গেল৷ দুই হাতে চিত্রলেখাকে জড়িয়ে ধরল৷ বহু যুগ রূপসার চোখে জল আসে না, অশ্রু শুকিয়ে গেছে কতকাল আগে৷ আজও এল না, শুধু ঝাপসা৷ চোখ বন্ধ করে ফেলল রূপসা৷

চিত্রলেখা রূপসাকে আলিঙ্গনরত অবস্থাতেই গভীর কিছু একটা ভাবছিলেন৷ বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তিনি ভাবছিলেন কথাটা কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না৷ একটি ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত৷ যে সিদ্ধান্ত সঠিক না হলে তার পরিণতি ভয়ংকর৷ একবার সেই ভুল তিনি করেছেন যার খেসারত দিতে হচ্ছে একজনকে এই রূপমঞ্জরীর বাইরে৷ তারপরে তিনি ঠিক করে নিয়েছিলেন আর নয়, কিন্তু অনেকদিন পর আজ আবার কী করা উচিত ভাবতে ভাবতে শেষে ভেবে নিলেন তাঁর এই প্রিয় ছাত্রীটির জন্য সত্যিই এই ঝুঁকি আরও একবার তাঁকে নিতে হবে৷

রূপসাকে নিজের শরীর থেকে সরিয়ে তার দুই কাঁধে হাত রেখে চিত্রলেখা বললেন, শোনো, তোমার সঙ্গে আজ আমার অত্যন্ত গোপন এবং গুরুত্বপূর্ণ কথা রয়েছে৷

.

অনেক রাত৷ রূপসা বসে রয়েছে চিত্রলেখার ঘরে৷ ঘরে শুধু একটি হলদে বাতি জ্বলছে৷ দরজা বন্ধ৷ দুজনেই ঘরের মেঝেতে মুখোমুখি বসে৷ এক আশ্চর্য কাহিনি রূপসাকে শোনাচ্ছেন চিত্রলেখা৷ পলিনের কাহিনি৷

নেপোলিয়ন বোনাপার্টের অত্যন্ত আদরের বোন পলিন ছিলেন অপরূপ সুন্দরী৷ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সৌন্দর্যও চাঁদের আলোর মতো ছড়িয়ে গেল চারদিকে৷ নিজের সৌন্দর্যের প্রতিও পলিন ছিলেন খুব অল্পবয়স থেকে সচেতন৷ সুন্দরী এবং কামুকতা এই দুইয়ের মেলবন্ধন কিশোরী বয়স থেকেই পলিনকে করে তুলেছিল স্বেচ্ছাচারী৷ মাত্র তেরো বছর বয়স থেকেই নানা বয়সের পুরুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে৷ ব্যভিচারের চূড়ান্ত নিদর্শন হয়ে ওঠেন পলিন৷ নেপোলিয়নও নাজেহাল হয়ে ওঠেন তাঁর বোনের এমন আচরণে৷ কিন্তু কখনোই তিনি তাঁর বোনের প্রতি নির্দয়, কঠোর হয়ে উঠতে পারেননি৷ ফলে পলিনও যখন যা খুশি তাই করে গিয়েছেন৷ বোনের আচরণকে সংযত করার জন্য নেপোলিয়ন খুব অল্প বয়েসে প্রিন্স কামিলোর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন৷ কিন্তু পলিনের উদ্দামতা, স্বেচ্ছাচারিতা তাতে একটুও কমল না৷ ১৮০৪ সালের ১৮ মে নেপোলিয়ন নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেছিলেন৷ তারপর থেকে পলিনের উদ্দামতা আরও বেড়ে যায়৷ দুই হাতে উজাড় করে ঢালতে থাকেন ধনসম্পদ, যৌনতার প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি৷ বলে একটু থামলেন চিত্রলেখা৷ তারপর আবার বললেন, এতটাই কামুক প্রকৃতির এবং নিজের শরীরী ঐশ্বর্য দেখানোর জন্য লালায়িত ছিলেন পলিন যে প্রাসাদে তাঁর অতিথিদের সঙ্গে দেখা করতেন স্নানরতা অবস্থায়৷ প্রতিদিন কুড়ি লিটার দুধে স্নান করতেন তিনি৷ এবং সেই অতিথিদের সামনেই স্নান সেরে গা মুছে পোশাক পরতেন৷ যে পুরুষ অতিথিকে তাঁর মনে ধরত তার সঙ্গে সঙ্গম করতেন৷ এইভাবেই চলতে চলতে পলিন একদিন নিজেকে আয়নার সামনে আবিষ্কার করলেন তাঁর গলার চামড়ায় বয়সের ভাঁজ দেখা যাচ্ছে৷ হাহাকার করে উঠলেন তিনি৷ দেশের তাবড় বৈদ্যদের ডেকে বললেন, নিজের যৌবনকে অটুট রাখা যায় এমন কোনও ওষধি যদি কেউ দিতে পারে তাকে তিনি ধনসম্পদে ভরিয়ে দেবেন৷

শুধু তাই নয়, পলিন যৌনতার সময়ে পুরুষের শারীরিক অত্যাচারকে উপভোগ করতেন, ধর্ষকামী পুরুষ ছিল তাঁর প্রিয়, কিন্তু তার ফলে শরীরে যে নানাবিধ ক্ষত তৈরি হত সেটা আবার তাঁর না-পসন্দ৷ তাই দিকে দিকে পলিনের বার্তা ছড়িয়ে গেল এমন কোনও ঔষধ প্রয়োজন যা পলিনের যৌবনকে যেমন অনন্তকাল ধরে রাখবে তেমনই সঙ্গমকালীন কোনওপ্রকার ক্ষতচিহ্ন তাঁর শরীরে সঙ্গমশেষে স্থায়ী হবে না৷ কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্রে এমন কোনও ওষধি ছিল না, ফলে বৈদ্যরা ব্যর্থ হলেন, পলিন মনমরা হয়ে পড়লেন৷ নাওয়া-খাওয়া প্রায় বন্ধ৷ তখন তাঁর এক বিশ্বস্ত দাসী খোঁজ আনল এক পিশাচসিদ্ধের৷ সে জানে এই ওষধির সন্ধান৷ পলিন পালকি চেপে গেলেন তার কাছে৷ গভীর অরণ্যের মধ্যে সেই পিশাচসিদ্ধের বাস৷ পলিনের কথা শুনে তিনি তাঁকে আহ্বান করলেন সঙ্গমে৷ সেই বিকটদর্শন পুরুষকে দেখেই বিবমিষা হচ্ছিল পলিনের, কিন্তু তিনি তখন নিজের রূপ-লাবণ্য এবং নিজেকে অক্ষত রাখার চেষ্টায় মরিয়া৷ কাজেই তাঁর সঙ্গেও সঙ্গমে লিপ্ত হলেন পলিন৷ দীর্ঘক্ষণ সেই সঙ্গম চলার পর তৃপ্ত হলেন সেই পিশাচসিদ্ধ৷ পলিনকে বললেন, তোমাকে এমন এক জিনিস দেব আমি তাতে তুমি অনন্তকাল নিজের রূপ-যৌবনকে ধরে রাখতে পারবে৷ এবং তোমার শরীরে পুরুষের তৈরি কোনও ক্ষত সঙ্গম শেষে আর স্থায়ী হবে না, মিলিয়ে যাবে৷ বলে তিনি ছোট একটি শিশি পলিনের হাতে দিয়ে বললেন, এই ওষধিতে স্বয়ং পিশাচ অবস্থান করে৷ ঊষাকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে এই শিশি থেকে মাত্র একফোঁটা হাতে নিয়ে নিজের গোটা শরীরের সর্বত্র ভালো করে মালিশ করবে৷ পায়ু, যোনি, নাক-কানের ফুটোর ভেতরেও আঙুলের সাহায্যে এই ওষধি স্পর্শ করাবে৷ জীবনে আর কখনও সঙ্গমকালীন কোনও আঘাত তোমাকে আহত করবে না, রূপ এবং যৌবন অটুট থাকবে৷ কিন্তু তুমি হয়ে উঠবে পিশাচিনী৷

পলিন শিশিটি পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন৷ ফিরে আসতে যাবেন তখন পিশাচসিদ্ধ বললেন, কিন্তু সাবধান, জীবনে যদি কখনও কোনও পুরুষের স্পর্শ অনুভব করো তাহলে কিন্তু ভয়ংকর বিপদ নেমে আসবে তোমার জীবনে৷

মানে? এ আপনি কী বললেন? আমি সম্ভোগ করতে পারব না?

সে কথা বলিনি৷ ইচ্ছেমতো সম্ভোগ করো কিন্তু পুরুষ যেন তোমাকে না ছোঁয়৷ তাহলেই সর্বনাশ৷

আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না৷ পুরুষ না ছুঁলে মিলন কী করে হবে? জিজ্ঞাসা করলেন পলিন৷

তার উত্তর দিলেন না পিশাচসিদ্ধ৷ বললেন, এর উত্তর ব্যবহারকারীকে নিজেকেই বুঝতে হবে৷

পলিন আবার জিজ্ঞাসা করলেন, পুরুষকে সম্ভোগে কোনও সমস্যা নেই তো?

না৷ উত্তর দিলেন পিশাচসিদ্ধ৷

ব্যস, আর কিছু আমার জানার দরকার নেই৷

দরকার আছে৷ এই জিনিস তুমি যদি সহ্য করতে না পারো তাহলে নিজে হাতে ফেলে দিতে পারবে না, তাহলে তোমার কাছে আবার ফিরে আসবে৷ তোমাকে এটা তুলে দিতে হবে যোগ্য কোনও নারীর হাতে যা সে সবকিছু তোমার মুখ থেকে শুনে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করতে রাজি হবে৷ মনে থাকবে?

পলিন ঘাড় নেড়ে খুশি হয়ে ফিরে এলেন৷ আর এই পুরো ঘটনার সাক্ষী থাকল পলিনের বিশ্বস্ত পরিচারিকা রুসভেলা৷ সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী রুসভেলাই খবর এনেছিল এই পিশাচসিদ্ধের৷ তারপর যা হওয়ার তাই হল, ওই ওষধি হাতে পেয়ে পলিন যেন স্বর্গলাভ করলেন৷ একের পর এক পুরুষ সঙ্গী৷ উদ্দাম যৌনাচার৷ নেপোলিয়ন খুবই বিব্রত হতেন তাঁর বোনের এমন আচরণে, কিন্তু অতিরিক্ত স্নেহের কারণে বোনকে কড়াভাবে কিছু বলতে পারতেন না৷ পলিন নিজে একটি প্রমোদশালাও খুলে ফেলেছিলেন, সেখানে তিনি অবাধে চালাতেন নিজের স্বেচ্ছাচার৷ পুরুষের দল পতঙ্গের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ত তাঁর শরীর-আগুনের আকর্ষণে৷ কিন্তু ওষধির গুণে পলিন ক্লান্তিহীন, অক্ষত, বয়ঃবৃদ্ধি থেমে গেল তাঁর৷ এমনই চলতে থাকল দিন-মাস-বছর৷ তারপর একদিন পলিনের শখ হল তিনি গান শিখবেন৷ সঙ্গীত শিক্ষক নিযুক্ত হলেন ফেলিস ব্লানজিনি৷ কিন্তু সঙ্গীতের পাঠ নেওয়ার থেকে প্রেমের পাঠেই আগ্রহ তাঁর বেশি৷ ফলে ফেলিসের সঙ্গেও শুরু হল শরীরী সম্পর্ক৷ আর ফেলিসের সূত্রেই একদিন পরিচয় হল ওই সময়ের প্রখ্যাত সুরকার অতীব সুদর্শন পুরুষ জিওভোননি পাকিনির সঙ্গে৷ পরিচয় ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করল, পলিন পাকিনিকে আদর করে ডাকতেন নিনো নামে৷ কিন্তু নিনোকে কিছুতেই কাছে টানতে পারেন না৷ কেমন যেন পিছলে চলে যায়৷ এ যেন সকলের মতো নয়৷ জীবনে এমন কখনও হয়নি যে পলিন যাকে কামনা করেছেন তাকে কাছে পাননি, বরং পুরুষের দল তাঁকে একবার স্পর্শ করার জন্য পাগল৷ আর সেখানে পাকিনি যেন…নিজের সুরের জগতেই বিভোর৷ পলিন মরিয়া হয়ে উঠলেন, জেদ ধরলেন যেভাবেই হোক নিনোকে পেতেই হবে৷ নিনোও কিছুতেই ধরা দেবেন না৷ অদ্ভুত নির্লিপ্ত৷ পলিনের রূপ যেন তাঁর চোখে কোনও আগুনই তৈরি করে না৷ এই পরাজয়, হীনম্মন্যতায় শেষে অসুস্থ হয়ে পড়লেন পলিন৷ শয্যাশায়ী৷ একদিন গভীর রাতে, পলিন নিজের শয্যায় আধোঘুমে৷ পালঙ্কের নীচে বসে রয়েছে দাসি রুসাভেলা৷ এমন সময় পাকিনি এলেন পলিনের কাছে৷ শুধু একটিবারের জন্য পলিনের জ্বরতপ্ত কপালে নিজের করতল স্পর্শ করে আবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন৷

আর সেই ঘটনার কিছুদিন পর থেকেই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন পলিন৷ গোটা শরীর জর্জরিত৷ বহু চিকিৎসা হল, কিন্তু পলিন বাঁচলেন না৷ শেষ দিকে মাথাটাও বিগড়ে গিয়েছিল৷ আবোল-তাবোল বকতেন৷ মরে যাওয়ার আগে ওই শিশিটা রুসাভেলাকে দিয়েছিলেন৷ রুসাভেলা ওই শিশি রেখে দিয়েছিল৷ সে নিজে কখনও এই ওষধি ব্যবহার করেনি, কিন্তু তার হাত থেকে এই শিশি ঘুরতে ঘুরতে একসময় পৌঁছল আমার হাতে৷ আমি তখন এথেন্সে৷ নিজের কাজের কারণেই ওখানে ট্যুর করছি৷ একটি অতি প্রাচীন পানশালায় আলাপ হয়েছিল এক বৃদ্ধা গণিকার সঙ্গে৷ দেখেই মনে হয়েছিল তিনি বেশ অসুস্থ৷ তাঁর জীবনের অনেক কাহিনি শুনতে শুনতে আমি নোট নিচ্ছিলাম৷ কামকলায় তাঁর নিজস্ব কিছু বিশেষ ভাবনা ছিল সেগুলো খুব আগ্রহব্যঞ্জক৷ মহিলা আমার প্রতি কেন জানি না বেশ সদয় হয়ে ওঠেন, আমাকে ওঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ করেন৷ বেশ অনেক কথার পর আমাকে বললেন, তাঁর মৃত্যুর আর খুব বেশি দেরি নেই৷ মারণরোগে আক্রান্ত তিনি৷ পোশাকের ভেতরে তাঁর শরীরের অনেকটাই নাকি দূষিত ঘায়ে ভরা৷ অনেক চিকিৎসায় তা সারেনি৷ আর বেশিদিন তাঁর আয়ু নেই৷ আরও দুই-চার কথার পর তিনি আমাকে একটি শিশি দেন৷ খুব ছোট স্ফটিকের শিশি৷ তার মধ্যে টলটল করছে সামান্য কয়েক ফোঁটা তরল৷ আমার হাতে ওইটি দিয়ে বললেন, এইটি রাখো তুমি৷ তারপর এর ইতিহাসটুকু এবং তিনি কীভাবে এটা পেয়েছিলেন ইত্যাদি জানিয়ে বললেন যদি এর সঠিক ব্যবহার করা যায় তবে এটা আলাদিনের চিরাগ, নইলে এর থেকে ভয়ঙ্কর জিনিস আর নেই৷ আর সব থেকে বড় কথা এ জিনিস কারও হাত থেকে নিলে তা নিজে ফেলে দেওয়া যায় না৷ অন্য কারও হাতে তাকে সবকিছু জানিয়ে তুলে দিতে হয়, এটাই নিয়ম৷

আমি নিয়ে এলাম৷ তাঁর কাহিনি সত্যি বলতে খুব যে বিশ্বাস করেছিলাম তা নয়, তবে জগতে কতকিছুই তো ঘটে যা আমাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বাইরে৷ আমি শিশিটা রেখে দিয়েছিলাম নিজের কাছে৷ কোনওদিন নিজে ব্যবহার তো করার কথা তো ভাবিইনি, কাউকে দিইওনি৷ কিন্তু একবার মাত্র…থেমে গেলেন চিত্রলেখা৷

রূপসা পিঠ সোজা করে চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে এই আশ্চর্য কাহিনি শুনছিল৷

চিত্রলেখা এক চুমুক জল খেয়ে বললেন, রূপসা, তুমি যদি চাও তোমাকে এই ওষধি আমি দিতে পারি, কিন্তু এর ফলাফল যেমন ভালো দেখেছি, ভয়ঙ্করও আমার নিজের চোখে দেখা৷ তাই তুমি ভেবে দেখো৷ সিদ্ধান্ত তোমার ওপর৷ আসলে আমি তোমাকে বিশেষ স্নেহ করি, তোমার আগে আরেকজন এমনই এক প্রিয় ছাত্রী ছিল আমার৷ অম্বালিকা নাম ছিল তার৷ সেও ছিল তোমার মতোই প্রতিভাময়ী৷ আমার অত্যন্ত স্নেহের পাত্রী ছিল সে৷ এই তোমার মতোই চেহারার গড়ন এবং অন্তরে পুরুষ-বিদ্বেষী৷ অত্যন্ত কোমল শরীর৷ সামান্য আঘাতও তার ত্বক সইত না৷ ফুটে উঠত৷ একবার এক নায়কের রেখে যাওয়া ক্ষত অন্য নায়ক সহ্য করে না তুমিও জানো৷ এতে সবদিকেই সমস্যা তৈরি হচ্ছিল৷ তাই আমি বাধ্য হয়ে একদিন ওকে এই ওষধির শিশি দিলাম৷ সেই প্রথম৷ সে নিয়ে এটা ব্যবহারের পরের দিন থেকে সত্যিই আশ্চর্য ঘটনা ঘটতে শুরু করল৷ অম্বার শরীরে আর কোনও ক্ষত তৈরি হত না; শুধু তাই নয়, কোনও যন্ত্রণাবোধও আর ছিল না অম্বার৷

বাকি কথা আর শুনল না রূপসা৷ হাতজোড় করে বলল, মা, এটা আমি নেব৷

তোমাকে দেব বলেই আজ ডেকেছি, কিন্তু ভাবছি কোনও ক্ষতি না হয়, আমার এক প্রিয় ছাত্রীকে এই জিনিসটির জন্য হারিয়েছি৷

অম্বাই কি আপনাকে এটা ফেরত দিয়ে গেছে?

হ্যাঁ৷ ওই দিয়ে গেছিল যাওয়ার আগে৷ তুমি শুনবে না ওর কি হয়েছিল?

থাক মা, আমি আর কিছু জানতে চাই না৷ শুনলে হয়তো মনে ধন্দ আসবে৷ ভয় আসবে৷ আমি তার জীবনের পরিণতি জানতে চাই না, শুধু এই যন্ত্রণা থেকে একটু রেহাই চাই৷ একটা সময় ভাবতাম মরে গেলেই বুঝি মুক্তি৷ কিন্তু ওপরওলা আমাকে কঠিন জীবনসংগ্রামে ফেলবে বলেই হয়তো আমার মনকে খুব কঠিন বানিয়ে পাঠিয়েছে, তাই নিজের দাদাকে খুন করাতে আমার কষ্ট হয়নি৷ বাবা নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ায় আমার কোনও বেদনাবোধ ছিল না, কোনওদিন কারো ভালোবাসা পাইনি বলে অভাববোধ হয়নি, বরং আমার প্রেমহীনতা আমার জেদ বাড়িয়েছে৷ লড়াইয়ের জেদ, জেতার জেদ৷ আপনি আমায় ভরসা করুন, মা৷

বেশ৷ চিত্রলেখা উঠে অন্য ঘরে গেলেন৷ তারপর ফিরে এলেন হাতে খুব ছোট একটি শিশি৷ খাঁজকাটা কাচের শিশি, আতরের শিশি যেমন হয়৷ ভেতরে খুব সামান্য কয়েক ফোঁটা গাঢ় লাল রঙের তরল৷

কাল ভোরে সরোবরে স্নান সেরে ঠিক এক ফোঁটা পরিমাণ ডানহাতের তালুতে নেবে, তারপর দুই হাতের তালুতে সেটা ঘষে গোটা শরীরের সর্বত্র মাখবে৷

কিন্তু ওই এক ফোঁটা পরিমাণে কি সর্বত্র মাখানো সম্ভব?

হ্যাঁ, শুধু কড়ে আঙুলে তরলটি স্পর্শ করবে তারপর দুই হাতে সেটা মেখে নেবে৷ ওতেই হবে৷ কিন্তু শিশিটা খুব সাবধানে রাখতে হবে৷ কারো নজরে না পড়ে৷

তাই হবে, মা৷ আমি এলাম তবে৷

হ্যাঁ, এসো৷

চিত্রলেখাকে প্রণাম করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল রূপসা৷ বাইরে ঘন অন্ধকার৷ মিহি হাওয়া দিচ্ছে৷ অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে রূপসার মনে হল আজ যদি মুক্তিরই রাত হবে তাহলে এমন চারদিক অন্ধকার কেন?

.

শুধু রূপসা আর রূপসা৷ দেশ-বিদেশ থেকে ক্লায়েন্টরা যেন অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকল রূপমঞ্জরীতে৷ ত্বরিৎগতিতে চারদিকে ছড়িয়ে গেল রূপনগরের কথা৷ রূপমঞ্জরীতে এমন এক গণিকা রয়েছে যার নাম রূপসা, পুরুষের শত অত্যাচার, সে সহাস্যে গ্রহণে সক্ষম৷ ধর্ষকাম, মর্ষকাম, যৌনতায় আরও যতরকমের যন্ত্রণাদায়ক বিকৃতি রয়েছে পুরুষের তাই নিয়ে তারা ছুটে আসতে থাকল রূপসার কাছে৷ দিনরাত শুধু পুরুষের নানাবিধ লালসাকে চরিতার্থ করতে রূপসা তৎপর৷ তার ক্লান্তি নেই, ঘুম নেই, প্রতি মুহূর্তে সে উচ্ছ্বাসময়ী, উত্তরোত্তর বাড়তে থাকল তার লাস্যময়তা৷ সকল নায়কই প্রশংসায় পঞ্চমুখ৷ শুধু একক নায়ক নয়, একাধিক নায়কের সঙ্গে সঙ্গমেও রূপসা একইরকম সাবলীল, সকলকে সুখ দিতে সক্ষম৷ রূপমঞ্জরীর ম্যানেজমেন্ট আবার নজর করল অম্বালিকার পর আবার এই রূপসার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণে ইনসেনটিভ জমা পড়ছে৷ রূপমঞ্জরীর নামও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে৷ সকলেই রূপসাকে বুক করতে চায়৷ একদিনের জন্যও ফুরসত নেই রূপসার৷ সকলেই খুশি৷ শুধু চিত্রলেখা মাঝে মাঝে ভাবেন আবারও তিনি ভুল করলেন না তো? পুরুষ মানুষের ছোঁয়া—এই শব্দের মানে কী তিনি নিজেও জানেন না, একমাত্র যে টের পেয়েছে সে জানে…গণিকার শরীরকে শত শত পুরুষ ছোঁয়, তার মধ্যে আবার পুরুষের ছোঁয়া মানে কী তা বোঝা বড় কঠিন!

রূপসা কোনওদিনই নিজের জীবনকে নিয়ে খুব বেশি কিছু ভাবেনি৷ যখন যে মুহূর্তে যা মনে হয়েছে তাই করে গিয়েছে৷ শিশিটা হাতে পাওয়ার পর রূপসার জীবনটা যেন মুহূর্তের মধ্যে বদলে গিয়েছিল৷ তারপর পেরিয়ে গিয়েছে তিনটে বছর৷ রূপমঞ্জরীর অন্যতম প্রধান গণিকা রূপসা, তার সামান্য সঙ্গ কামনা করে দেশ-বিদেশের ধনকুবেররা লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে৷ রূপমঞ্জরীর বাইরে যে একটা পৃথিবী রয়েছে তা অনেকদিন আগেই ভুলে গিয়েছে রূপসা৷ অপালা, বিশাখারাও ভুলে গিয়েছে, আরও অনেক নতুন গণিকা এসেছে এখানে৷

এইভাবে দিন চলতে চলতে একদিন এক শরৎকালের দুপুরে রূপমঞ্জরীর প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকল একটি বিশাল বিলাসবহুল গাড়ি৷ রূপমঞ্জরীর রিসেপশন অফিসে থামল সেই গাড়ি৷ দারোয়ান দ্রুতপায়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিল৷ নেমে এলেন এক সত্তর বছর বয়েসি বৃদ্ধ৷ বয়সের কারণে সামান্য ন্যুব্জ হলেও, পদক্ষেপের রাজকীয়তাটি চোখে পড়ার মতো৷ পরনে হালকা গোলাপি রঙের গরদের পাঞ্জাবি এবং চোস্ত৷ পায়ে জরির কাজ করা নাগরা৷ গলায় সোনার মোটা চেন৷ মাথার টুপিটি কাশ্মীরি৷ গালের দাড়িতে হেনা করা৷ চুলেও তাই৷ চোখে সুর্মা৷ সোনার ফ্রেমের গোল চশমা৷ কালো সিল্কের পাঞ্জাবির ওপর সাদা সুতোর অসামান্য কাজ করা হাতকাটা জ্যাকেটটি চাপানো৷ তার বুকপকেট থেকে ঝুলে রয়েছে সোনার ঘড়ির চেন৷ বৃদ্ধের হাতে ধরা একটি কারুকাজমণ্ডিত ছড়ি যার হাতলটি হাতির দাঁতের তৈরি৷

বৃদ্ধের সঙ্গে নামলেন মোট চারজন৷ প্রত্যেকের হাতে বেশ কয়েকটি ব্যাগ৷ বেশ ভারী ভারী ব্যাগই রয়েছে৷ বছর তিরিশের এক যুবক বৃদ্ধের ঠিক পাশেই হেঁটে উঠল রিসেপশনে৷ তার পিঠে একটি লম্বামতো ব্যাগ, আর হাতে আরেকটি৷ যুবক ছয় ফুটের অধিক লম্বা, ছিপছিপে চেহারা৷ লম্বাটে মুখের গড়ন, চোখ দুটি তার অপূর্ব সুন্দর৷ যেন এই জগতে থেকেও সে ডুবে রয়েছে তার নিজস্ব অন্যমনস্কতায়৷ সরু গোঁফ আর থুতনিতে অল্প দাড়ি৷ তার পরনে সাদা শেরোয়ানি৷ মাথায় তারও ওই একইরকম কাশ্মীরি টুপি৷ বৃদ্ধ খুব নিচু গলায় যুবকের সঙ্গে কথা বলছিলেন৷ রূপমঞ্জরীর কর্মচারীরা যথারীতি ব্যস্ত তাদের নবাগত নায়ককে নিয়ে৷ না যুবক নয়, ওই সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধটি রূপমঞ্জরীর প্রেমকুঞ্জে ‘নায়ক’ হতে এসেছেন৷

খুব দ্রুত সব ব্যবস্থা হয়ে গেল৷ বৃদ্ধের সঙ্গে আগত তিনজন ব্যক্তির স্থান হল গেস্ট হাউজে আর সেই সুপুরুষ যুবক তার কাঁধে লম্বা ঝোলাটি নিয়ে বৃদ্ধের সঙ্গে রথে চড়ে রওনা দিল প্রেমকুঞ্জের দিকে৷

কারা এই দুজন? বৃদ্ধ হলেন লখনৌ-এর বিখ্যাত কুতুব আবু হায়দরের একমাত্র এবং শেষ বংশধর আলী হায়দর৷ আবু হায়দরের বিলাসিতার কথা এখনও পুরোনো লখনৌ-বাসীদের মুখে মুখে ঘোরে৷ শৌখিনতার জন্য টাকা কীভাবে ওড়ানো যায় তার নিদর্শন ছিলেন হায়দর সাহেব৷ শোনা যায় পারস্যের এক রক্ষিতার জন্য তিনি দর হেঁকেছিলেন তিন লক্ষ টাকা৷ সেই বংশেরই আলীসাহেব৷ আগের মতো আর সেই পুঁজি না থাকলেও রক্তে সেই ঠাটবাঁট ধরে রেখেছেন যথাসাধ্য৷ লখনৌতে তাঁর নিজের হাভেলিতে তিনজন স্ত্রী, চারজন রক্ষিতা তো রয়েছেই, এ ছাড়াও ভারতের নানা প্রান্তে আলীসাহেবের মাসোহারা প্রাপ্ত গণিকার সংখ্যা নেহাত কম নয়৷ দেশ-বিদেশের দামি মদ এবং নানা রূপের গণিকার স্বাদ নেওয়াই আলীসাহেবের শখ৷ সঙ্গে আসল অম্বুরী তামাক৷ আলীসাহেবের জন্য সেইকালে পারস্য থেকে আসত বিশেষ তামাক৷ এক জাতের তিমির পেটে জমা হওয়া প্রাকৃতিক সুগন্ধী থেকে তৈরি হত সেই তামাকের সুগন্ধী৷ তারপর দিন গিয়েছে, সেই তামাক আর মেলে না৷ তবে আলীসাহেবের তামাকেও আসল কস্তুরী থাকে৷ রুপোর আলবোলায় টান দেওয়া মাত্র গুরুক গুরুক শব্দের সঙ্গে যে ধোঁয়া নির্গত হয় তার খুশবুতে মানুষ তো কোন ছার কীট-পতঙ্গরাও মাতোয়ারা হয়ে পড়ে৷

রথ এসে থামল প্রেমকুঞ্জের দরজার সামনে৷ সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছে দুইজন গণিকা৷ আলীসাহেবকে তোয়াজ করে রথ থেকে নামাল তারা৷ আলীসাহেবের সঙ্গে সেই পিঠে লম্বা ঝোলা যুবকটিও নামল কিন্তু তাকে খাতির করার জন্য কেউ নেই৷ কে ক্লায়েন্ট, কেমন দেখতে ইতিমধ্যেই প্রেমকুঞ্জের অফিসরুমে ছবি সহ ডিটেল পৌঁছে গিয়েছে৷ আলীসাহেব নিজের ছড়িটি যুবকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দুই হাত প্রসারিত করলেন, এবং দুই গণিকার কাঁধে হাত দিয়ে প্রবেশ করলেন প্রেমকুঞ্জে৷ ভেতরে অপেক্ষা করছে রূপসা৷ রূপসাকে পছন্দ করেছে আলীসাহেব৷ আগামী কয়েকদিন রূপসা আলীসাহেবের৷

.

জীবনে বহু বিচিত্র রকমের পুরুষ দেখেছে রূপসা৷ আলী হায়দরের মতো এমন ভয়ঙ্কর পুরুষ দেখেনি৷ এত বিপরীত বৈচিত্র্য যে কোনও মানুষের মধ্যে থাকতে পারে তা স্বপ্নেরও অতীত ছিল রূপসার৷ গত কয়েকদিনে আলীসাহেবকে যত দেখছে ততই বিস্মিত হচ্ছে৷ সত্তর বছরের বৃদ্ধের কাঁধ পর্যন্ত সাদা চুল কিন্তু এখনও দুজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের শক্তি ধরেন৷ সঙ্গমেও তাঁর ক্ষমতা অসামান্য৷ শিশ্নের দৃঢ়তা এবং সঙ্গমের সময়কাল যে কোনও যুবকের কাছে ঈর্ষার কারণ হতে পারে৷ আলীসাহেব একেবারেই আপন মর্জির মালিক, অত্যন্ত খামখেয়ালি, কখন কোন মুডে থাকেন কোনও ঠিক নেই, এইমাত্র খুব প্রেমে গদগদ হয়ে রূপসার প্রশংসা করছেন তো পরক্ষণেই তাঁর মেজাজ তিরিক্ষে৷ গড়গড়ার টিকেয় আগুন কেন ভালো করে ধরেনি তাই নিয়ে প্রবল ধমকাচ্ছেন কোনও পরিচারিকাকে৷ রূপসা গড়গড়ায় আগুন ধরাতে জানে, এখানে শেখানো হয়েছে৷ কিন্তু আলীসাহেব রূপসাকে দিয়ে টিকের আগুন ধরাবেন না, কারণ রূপসার আঙুলে ফোস্কা পড়তে পারে৷ এই কথা শুনলে যে কেউ মনে করবেন না জানি আলীসাহেবের মন কী কোমল! কিন্তু এই মানুষটাই রমণের সময়ে যে কী ভয়ংকর পাশবিক হয়ে ওঠেন তা নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না৷ গতকাল রাতেও রমণের সময়ে উনি তামাকের জ্বলন্ত টিকে চিমটে করে তুলে রূপসার দুই স্তনে, নাভিতে, জঙ্ঘায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফোস্কা ফেলছিলেন আর রূপসা উহ! আহ! করে কাতর শব্দ করছিল তাতে তাঁর শিশ্ন আরও প্রহর্ষিত হচ্ছিল৷ দুই হাতের লম্বা ধারালো নখ দিয়ে রূপসার পিঠে, পেটে, কাঁধে আঁচড়ে রক্ত বার করে পিশাচের মতো সেই রক্ত নিজের জিভে ঠেকাচ্ছিলেন আলীসাহেব৷ রূপসা দেখছিল বৃদ্ধের জিভ তার রক্তে লাল হয়ে উঠছে৷ সঙ্গমের সময়েও রূপসাকে নানাভাবে যতটা শারীরিক নিগ্রহ করা দরকার কোনওটারই কসুর করছিলেন না তিনি৷ রূপসার যন্ত্রণাবোধ সেই ওষধির কারণে না হলেও সে জানে এই ধরনের ধর্ষকামী পুরুষেরা চায় তাদের দেওয়া যন্ত্রণায় নারী কাতর হোক, বেদনায় জর্জরিত হয়ে আর্তনাদ করুক, এতেই তাদের সুখ৷ রূপসা নিখুঁত অভিনয়ে সেই সকল প্রকার যন্ত্রণার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে আলীসাহেবের মনকে তৃপ্ত করেছে৷ এই পর্যন্ত ঠিক রয়েছে, কারণ এই ধরনের পুরুষ রূপসা আগেও কম-বেশি দেখেছে কিন্তু আলীসাহেবের বিশেষত্ব হচ্ছে সাহিল৷ আলীসাহেবের সঙ্গে যে দীর্ঘদেহী রোগা ফর্সা যুবকটি এসেছে তার নাম সাহিল আখতার৷ গত চার পুরুষ ধরে সাহিলরা এই আলীসাহেবদের ফ্যামিলি মিউজিশিয়ান৷ আবু হায়দরের শখ ছিল সঙ্গীতের৷ নিজে যেমন ভালো গাইতে পারতেন তেমনই দুই-তিন রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজানোর অসামান্য হাত ছিল তাঁর৷ তাঁর পুত্র সোহারাব আলীর ছিল সেতার বাজানোর অসামান্য দক্ষতা, সোহারাব আলীর পুত্র রশিদ আলীও তাঁর আববার কাছে সেতারের তালিম নিয়েছিলেন কিন্তু আবু হায়দরের একমাত্র সন্তান আলী হায়দর সঙ্গীত শিক্ষা না করলেও রক্তে সেই নেশাটা থেকেই গিয়েছিল তাই তাঁর পূর্বপুরুষ যে মাস মাইনে দিয়ে গাইয়ে-বাজিয়ে রাখতেন সেই ঐতিহ্য তিনি রেখে দিয়েছেন৷ সঙ্গীতের বোদ্ধা তিনি৷ সাহিলের আববা রহমত সারেঙ্গি এবং এস্রাজ বাজাতেন৷ সাহিল আববার কাছ থেকে দুটোই শিক্ষা করলেও আলীসাহেবের বেশি পছন্দ হল সারেঙ্গি৷ এমন কোনও দিন যায় না যেদিন আলীসাহেব সাহিলের হাতের বাজনা শোনেন না৷ রহমত মধ্য বয়সেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁর ছেলেটিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আলীসাহেবের সঙ্গীত সেবার জন্য৷ তাও কম করে পনেরো বছর হয়ে গেল৷ আলী সাহেবের মনে হয় বাপের থেকে ছেলের হাতে বেদনার সুর অনেক বেশি আন্তরিক-ভাবে ঝরে পড়ে৷ আলীসাহেব বেদনার অনুভব ভালোবাসেন৷ সারেঙ্গি তাঁর হূদয়ের অন্তঃস্থলকে এমনভাবে মোচড় দেয় যে সেই বেদনায় তিনি অপূর্ব এক তৃপ্তি পান৷ যন্ত্রণাতেই আলীসাহেব আনন্দ পান৷ নারীর সঙ্গে সঙ্গমের সময় তিনি সাহিলকে ঘরের এককোণে বসিয়ে সারেঙ্গি বাজাতে বলেন৷ সুর যত বেশি বেদনায় ঝরে পড়ে ততই তিনি সঙ্গমের সঙ্গিনীকে নিপীড়ন করে পরম তৃপ্তি পান৷ এই অভ্যাস তাঁর আজকের নয়৷ সাহিলের আববাকেও একসময়ে করতে হয়েছিল তারপর সাহিলকে৷ কিশোর বয়স থেকে সাহিল তাঁর প্রভুর এমন অদ্ভুত স্বভাব দেখে প্রথমে শিহরিত হত, ভয় লাগত, বিবমিষা আসত, কিশোর চোখে নগ্ন নারী অথবা সঙ্গম দেখলে তার শরীরে যে উত্থান হওয়ার কথা সেই স্বাভাবিকতার বদলে সাহিল দেখতে থাকল রাতের পর রাত ধর্ষণ, নির্যাতন, গণিকা, রূপজীবী অথবা মনিবের স্ত্রীদের যন্ত্রণার আর্তনাদ৷ কখনও চাবুক, কখনও ছোরা, কখনও হাতের ছড়িটি দিয়েও গণিকাদের আঘাত করে আনন্দ পান আলীসাহেব৷ আজ পর্যন্ত তিনজন গণিকা আলীসাহেবের অত্যাচারে সঙ্গমকালে নিহত হয়েছে, শুধু অঢেল অর্থের বিনিময়ে রেহাই পেয়েছেন তিনি৷ এই সব বীভৎস মুহূর্তের নীরব সাক্ষী সাহিল৷ নারীদের এমন যন্ত্রণা দেখতে দেখতে, তাদের আর্তনাদ শুনতে শুনতে তার হাতের সারেঙ্গিটিও যেন ছড় ছোঁয়ানোমাত্র বেদনায় ককিয়ে ওঠে৷ বুকের তন্তু যেন ছিঁড়ে যায় সেই কারুণ্যে৷ সাহিলের নিজের সুন্দরী নগ্নিকার প্রতি কোনও বয়সোচিত যৌন ইচ্ছে তৈরি হয় না, যেটা হয় তা নেহাতই সমবেদনা, সহমর্মিতা৷ মালিক আলীসাহেবের সঙ্গে ভারতবর্ষের বহু জায়গায় ঘুরেছে সাহিল, বহু নামী-দামি তওয়াইফ, বেশ্যা, বাঈজির শরীর দেখেছে, তাদের কোঠা দেখেছে৷ দেখতে দেখতে একসময়ে তার মনে হয়েছে জগতের সব নারীর শরীরই আসলে একইরকম৷ বছরের পর বছর আলীসাহেবের বিকৃতি দেখতে দেখতে একজন পুরুষ হিসেবে নারী শরীর ভোগ করার যে স্বাভাবিক বাসনা সেটাই সমূলে বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে সাহিলের৷ কিন্তু জীবনে এই প্রথম রূপমঞ্জরীতে এসে ও পুরো হতভম্ব হয়ে গিয়েছে৷ এমনও হয়! এ যেন প্রাচীন ভারতবর্ষের এক নগরী৷ জলজ্যান্ত এক ইতিহাসের মধ্যে ঢুকে পড়েছে ও৷

মালিক ওকে যখন ছুটি দিয়েছেন তখন আপন মনে এই প্রেমকুঞ্জের আনাচে- কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছে সাহিল৷ ভারী অদ্ভুত! সত্যিই অদ্ভুত৷ কার মাথা থেকে এমন অভিনব ভাবনা এসেছিল কে জানে! এখানের হাওয়াতেও যেন প্রাচীনত্বের গন্ধ৷ হরিণের দল, পাখির ঝাঁক, সরোবরের সাঁতাররত রংবেরঙের মাছ সকলেই নির্ভয়, স্বাধীন৷ আর মালিক এবার যাকে সঙ্গিনী করেছেন সেই রূপসা নামের মেয়েটিকে দেখেও জীবনে হয়তো প্রথমবারের জন্য অবাক হয়ে তাকিয়েছে সাহিল৷ সে যেন পাথর কুঁদে তৈরি করা এক ভাস্কর্য, সহসা প্রাণ পেয়ে জেগে উঠেছে৷ ত্বক শ্বেতশুভ্র নয়, বরং শ্যামলবরণ৷ কিন্তু কী তার দীপ্তি! আলো যেন পিছলে যায়! আর তার থেকেও যা দেখে রীতিমতো চমকে গিয়েছে সাহিল তা হল রূপসার সঙ্গমকালীন শীৎকার, মালিকের দেওয়া প্রতিটি আঘাতের যে করুণ আর্তনাদ রূপসা প্রতিবার ফিরিয়ে দিয়েছে তা যেন হূদয়ের উৎস থেকে উৎসারিত৷ কী নিদারুণ সেই আর্তনাদ অথচ…অথচ কী সুরেলা! যেন আরেকটি সারেঙ্গি থেকে অচেনা একটি সুর বেজে উঠছে৷ এমনটা প্রথমদিনই খেয়াল করেছিল সাহিল৷ মালিক এবং রূপসা যখন সঙ্গমে উত্তাল তখন সাহিল চোখ বুজে সারেঙ্গির তারে মারু বেহাগের আরোহী-অবরোহীতে বিভোর৷ নিজের শরীরে ঠেস দেওয়া সারেঙ্গির তিলক থেকে সওয়ারি পর্যন্ত যে তারগুলি বিস্তৃত তারা সকলে সাহিলের প্রথম বন্ধু, প্রতিটি স্পর্শকে তারা মেনে চলে৷ তখনও চলছিল, আচমকাই অন্যমনস্ক হয়ে উঠেছিল সাহিল, এই গণিকার যন্ত্রণার শব্দে অবিকল যেন সারেঙ্গির বেদনার সুর! হাত কেঁপে উঠেছিল সাহিলের৷ প্রথমে মনে হয়েছিল ভুল ভাবনা৷ কিন্তু না, আবার…আবারও তাই৷ সেই রাতে নিজের আঙুল যেন নিজের কথা শুনছিল না, বারবার অন্যমনস্ক হয়ে সুর কেটে যাচ্ছিল৷ কখনও আঙুল থেমে যাচ্ছিল, কখনও ছড়৷ আশ্চর্য, এমন তো হয় না কখনও! মালিক চিরকাল সারেঙ্গির সুরের সঙ্গে নারী সম্ভোগ করেন, এটা অনেককাল আগেই অভ্যাস হয়ে গিয়েছে সাহিলের…তাহলে আজ…ওই সময়টায় চোখ মেলতে চায় না সাহিল৷ মালিকের সঙ্গমকালীন বীভৎসতা, নিষ্ঠুরতা ও নিতে পারে না৷ সেই কারণেই মূলত চোখ বন্ধ রেখে নিজের সঙ্গীতে ডুবে যেতে চায়, যায়ও৷ কিন্তু সেদিন রাতে সেই যে অন্যমনস্কতা ধরল সাহিলকে তা আর কিছুতেই কাটল না৷ আলীসাহেবের পাকা কান, সুর সামান্য বিচ্যুত হলে তিনি ওই অবস্থাতেও ঠিক ধরে ফেলেন, সাহিলকে পরে জিজ্ঞাসাও করেছেন, কী হয়েছে বেটা? তোমার হাত কেঁপে যাচ্ছিল কেন? তবিয়ত ঠিক আছে তো?

জি মালিক, আমি ঠিক আছি৷ বলে মালিকের প্রশ্ন এড়াতে চেয়েছিল সাহিল৷ কিন্তু তারপরের দিন সকালে রূপসাকে দেখে আরও চমকিত হয়েছিল৷ আগের রাতে মালিকের করা অত্যাচারের বিন্দুমাত্র চিহ্ন এই গণিকার শরীরে নেই, সামান্য ক্লান্তিও নেই! বরং সদ্য ফোটা ফুলের মতো তরতাজা৷ এমনও হয়! এইরকম আগে কখনও দেখেনি সাহিল৷ আজ পর্যন্ত আলীসাহেব যত মেয়েকে ভোগ করেছেন তাদের শরীরকে প্রায় ছিঁড়ে খেয়েছেন, কেউ অর্থের জন্য মুখ বুজে শত অত্যাচার সহ্য করে প্রায় আধমরা হয়েছে, কেউ মাঝপথেই প্রাণভিক্ষা করে পালিয়েছে, কারও গোটা শরীরে কালশিটে, আঁচড়, কামড় অথবা ফোস্কার দাগ, চোখে ক্ষত, ঠোঁট খোবলানো, রক্তাক্ত যোনি, পায়ু৷ এমন দেখেই অভ্যস্ত সাহিল কিন্তু এই মেয়েটি যেন মানবী নয়, অন্য কিছু৷ তা না হলে আলীসাহেবের দেওয়া এত আঘাতের কোনও চিহ্নমাত্রই তার শরীরে পরদিন নেই! দংশন, আঁচড়, প্রহারের সামান্য ক্ষতও নেই শরীরে বরং একইরকম৷ আলীসাহেব নিজেও বেশ অবাক হয়েছিলেন৷ সাহিলকে আলীসাহেব পুরুষ তো দূরের কথা মানুষ বলেও মনে করেন না, আসলে মনিবরা তাঁদের চাকর-বাকরকে কোনওকালেই মানুষ বলে ভাবেন না, কীটপতঙ্গ ধরনের কিছু একটা ভাবেন, আর তাই এদের কাছে মনিবদের কোনও গোপনীয়তা থাকে না৷ ভৃত্যদেরও মন হয়ে ওঠে পাথরের মতো৷

গতকাল দুপুরে রূপসার স্নানঘরে যখন দুইজনে স্নান করছিল তখন পাশের ঘরে বসে সারেঙ্গি বাজাচ্ছিল সাহিল৷ গোটা স্নানঘর জুড়ে সত্যি বৃষ্টির মতোই ঝরঝর করে ঝরে পড়ছিল সুগন্ধী জলের ফোঁটা৷ সাহিল তখন একটা ঠুংরির গৎ বাজাচ্ছিল৷ হঠাৎই কানে এসেছিল আলীসাহেব রূপসাকে বলছেন, মাশাল্লাহ তোমার সম্পর্কে যা শুনেছিলাম তা সত্যিই৷ আমি আজ পর্যন্ত বহু নারী দেখেছি, তোমার মতো কাউকে দেখিনি৷ এর রহস্য কী? কীভাবে নিজেকে এমন অক্ষত অটুট রাখো?

মনিব যতবার প্রশ্নটা করছিলেন ততবারই রূপসা খিল খিল করে হেসে এড়িয়ে যাচ্ছিল নিজস্ব পটুতায়৷

কিন্তু এই অক্ষত থাকার মধ্যে যে একটা বিশেষ রহস্য রয়েছে তা বুঝতে আলীসাহেব এবং সাহিল কারও বাকি ছিল না এবং আলীসাহেব যে রূপসার এই অলৌকিক ক্ষমতার কথা আগে জেনেই ওকে সঙ্গিনী হিসেবে পছন্দ করেছেন সেটাও বুঝতে পেয়েছে আলীসাহেবের ওই কথাতেই৷

এই সাহিলকেও দেখে অবাক হয়েছে রূপসা৷ এমন রূপবান পুরুষ ও জীবনে খুব কম দেখেছে৷ কাঁধ পর্যন্ত ঘন কোঁকড়া চুল, চোখ দুটিতে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা মাখানো ঔদাসীন্য৷ জীবনে যত পুরুষ দেখেছে রূপসা তাদের চোখে লালসা, কামনা ছাড়া আর কিছু দেখেনি, কিন্তু এই ছেলেটি যেন রূপসাকে দেখেই না, বা দেখলেও কেমন অবাক মানি চোখ, এই চোখে শরীরের বেশি অতিরিক্ত যেন কিছু খোঁজা, কী খোঁজে ছেলেটা? আর…আর সঙ্গীত! এই রূপমঞ্জরীতে বহু সঙ্গীত শুনেছে রূপসা, আজও নিয়মিত শোনে৷ এখানে গান, বাদ্যযন্ত্র, নৃত্যের মধ্যে যে কোনও একটি কলা শিখতেই হবে সেটা নিজের পছন্দ৷ রূপসা নৃত্যকে বেছেছিল৷ নাচের কারণে ওর প্রায় প্রতিদিনই সেতার, পাখোয়াজ, তবলা ইত্যাদির সঙ্গে ওঠাবসা৷ রূপমঞ্জরীর গাইয়ে-বাজিয়েরা যথেষ্ট দক্ষ, পেশাদার, কিন্তু এই সাহিল নামের ছেলেটির আঙুলে যে কী রয়েছে বুঝে পায় না রূপসা৷ যতবার তারের ওপর ছড় টানে, বুকের ভেতরে কী যেন একটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়, কী রয়েছে ওই সুরে? কেন এমন মন কেঁদে কেঁদে ওঠে? নারী শরীরের প্রতি ছেলেটির এই ঔদাসীন্যে রূপসার মাঝে মাঝে যেমন বিরক্তি লাগে তেমনও বিস্ময়ও জাগে৷ এ এমন কেন? সারেঙ্গি যখন বাজায় তখন যেমন নিজের সঙ্গীতে ডুবে যায় ছেলেটি, যখন বাজায় না তখনও যেন নিজের ভাবজগতে বিভোর৷ অন্যমনস্ক৷ কত পুরুষ তো দেখেছে রূপসা কিন্তু এমনটি…তবে এটাও ভেবে আশ্চর্য লাগে যার আঙুলে এমন জাদু রয়েছে সে কেন এই আলীসাহেবের খিদমতগিরি করে কে জানে! কিসের বাধকতা?

.

আগামীকাল ফিরে যাবেন আলীসাহেব৷ এই কয়েকদিন যেন একটা ঝড় বয়ে গেল৷ আলীসাহেব আসলে একটি ত্রাস৷ মানুষের যৌনবিকৃতি যে কত ভয়ংকর হতে পারে তার সাক্ষাৎ নিদর্শন হলেন এই আলী হায়দর৷ রূপসার ওপরে এই ক’দিনে উনি অতরকমের অত্যাচার চালিয়েছেন, অন্য কেউ হলে এক বেলার মধ্যে আধমরা কিংবা পুরোই মরে যেত৷ শুধুমাত্র রূপসার অলৌকিক শক্তির জোরে টিকে রয়েছে৷ এই ক’দিনের মধ্যে আলীসাহেব রূপসার সঙ্গেই অধিকাংশ সময়টা ব্যয় করলেও অন্যান্য গণিকার সঙ্গেও মিলিত হয়েছেন৷ তবে বারবার রূপসাকে বলেছেন তোমার মতো কেউ নেই৷ এই কথা অবশ্য রূপসা প্রথমবার শোনেনি৷ দীর্ঘকাল ধরে শুনে আসছে৷ এখন যে খুব আনন্দ লাগে তা নয়৷ আনন্দ, দুঃখ কোনও অনুভূতিই আর হয় না৷ শুধু মনের খুব ভেতরে একটা ক্লান্তি, সারাক্ষণের ক্লান্তি অপেক্ষা করে থাকে খুব লম্বা একটি ঘুমের৷

আজ সন্ধেবেলায় মজলিশ বসেছে প্রেমকুঞ্জে৷ নাচ-গান অনেককিছু চলছে৷ নায়কেরা দেদার টাকা ওড়াচ্ছেন, নামী-দামি সুরা, সুখাদ্যের বন্যা বইছে৷ মুজরার হলঘরে যেখানে আলীসাহেব আয়েশ করে বসেছিলেন তারই পিছনে চুপ করে বসেছিল সাহিল৷ চুপ করে গান শুনছিল, নাচ দেখছিল৷ একটু আগে হিন্দুস্থানি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালে তালে রূপসা যখন হলের মধ্যে নাচছিল তখন বার বার ওই অত চোখের ভিড়ে ওর চোখ পড়ে যাচ্ছিল সাহিলের সমুদ্রের মতো গভীর আর নীলচে তারার চোখ দুটির দিকে৷ কী অপরিসীম মুগ্ধতা সেই চোখে! কী যে ভালো লাগছিল রূপসার! ইচ্ছে করছিল নেচেই যায়৷ আর সাহিলও পুরো ডুবে গিয়ে দেখছিল সাক্ষাত সঙ্গীতই যেন মানবীর রূপ পেয়ে নৃত্যে বিভোর৷ দেখতে দেখতে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল সাহিল৷ তার এই জীবনটিতে শুধু সঙ্গীত ছাড়া আর কোনও বাঁচার পথ নেই৷ অনেকবার ইচ্ছে করেছে এই বন্দি জীবন, ভৃত্যের জীবন থেকে কোথাও একটা পালাতে৷ কিন্তু সুযোগ পেয়েও চলে যেতে পারেনি শেষ পর্যন্ত৷ বাঁধা পড়ে গিয়েছে নিজের আদর্শ এবং বিবেকের কাছে৷ সাহিলের বয়স তখন মাত্র নয়৷ কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিল সে৷ বাঁচার কোনও আশাই ছিল না৷ চিকিৎসার ব্যয়ও ছিল প্রচুর৷ বংশের একমাত্র সন্তান সাহিলের জন্য মনে-প্রাণে ভেঙে পড়েছিলেন সাহিলের বাবা রহমত৷ ঘরে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আর নেই৷ একদিন আলীসাহেবের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি৷ হাতজোড় করে প্রার্থনা করলেন আলীসাহেব যেন তাঁর পুত্রের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন, যদি সাহিল সুস্থ হয়ে ওঠে তবে আজীবন আলীসাহেবের সেবা করবে এই জবান দিয়ে ফেলেন তিনি৷ আলী হায়দর চিরকাল মর্জির রাজা৷ এবং রহমতের সঙ্গীতের সমঝদার৷ তিনি বলে দিলেন, রহমত, তুমি মন খারাপ কোরো না, অর্থের কারণে তোমার ছেলের চিকিৎসা বন্ধ হবে না, যদি ওর পরমায়ু থাকে তাহলে আমার শেষ টাকাটাও ওর চিকিৎসার জন্যই ব্যয় করব আমি কথা দিলাম৷

আর সত্যিই তিনি সেই কথা রাখলেন৷ দেশের সব থেকে নামী চিকিৎসকদের দিয়ে সাহিলের চিকিৎসা শুরু করালেন আলীসাহেব৷ তারপর যখন এই দেশের ডাক্তাররা জানালেন এই রোগের চিকিৎসা এই দেশে সম্ভব নয়, তখন তিনি সাহিলকে লোক সমেত পাঠালেন আমেরিকায়৷ প্রায় একমাস সেখানে বহু অর্থব্যয়ে চিকিৎসা হল সাহিলের৷ এবং সে সুস্থ হয়ে ফিরে এল৷

এই ঘটনার পরই রহমত তাঁর নিজের দেওয়া জবান রক্ষার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন৷ ছেলে সাহিল পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার পর ছেলেকে বললেন, বাবা সাহিল, মনে রাখবে আলীসাহেব তোমাকে জীবন দান করেছেন৷ তাই তুমি আজীবন ওঁর সঙ্গ ছাড়বে না৷ মনে রেখো, তোমার জীবনের ওপর তাঁর পূর্ণ অধিকার রয়েছে৷ ওঁকে সঙ্গ দান করা, আনন্দ দান করাই তোমার জীবনের একমাত্র কাজ৷ আমি তোমাকে আলীসাহেবের কাছে সমর্পণ করেছি৷

বাবার কথা রেখেছে সাহিল৷ রহমত অসুস্থ হয়ে পড়ার পর আলীসাহেবের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল কারণ উনি সঙ্গীত ছাড়া থাকতে পারতেন না৷ সাহিলও ততদিনে বাবার কাছে সারেঙ্গির শিক্ষা অনেকটাই নিয়ে ফেলেছে, ফলে একদিন নিজে বাবার সারেঙ্গিটি কোলে নিয়ে আলীসাহেবের বাড়িতে এসে বলেছিল, আববু আর আসতে পারবেন না, আজ থেকে আমি আপনার খিদমত দেব৷

তুমি পারবে?

হ্যাঁ পারব৷ গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠেছিল সাহিল৷

মুখের কথা মানব না, বাজিয়ে শোনাও দেখি৷

সাহিল বাজিয়েছিল শিবরঞ্জনী৷

সাবাশ বেটা! ও তোমার হাতে সত্যিই জাদু রয়েছে, তোমাকে সুস্থ করে তোলার জন্য আল্লাহকে শতকোটি সালাম৷ আজ থেকে তুমি আমার হলে৷

সেই থেকে রয়ে গেল সাহিল৷ কিছুদিন পরেই জানতে বুঝতে শুরু করেছিল সঙ্গীতঅন্ত প্রাণ, দরাজ দিল মানুষটার ভেতরে আরও একটা সত্তা রয়েছে যে ধর্ষণকারী, যৌননিপীড়নে সুখ পায়৷ কপাল তবু ভালো লোকটা সমলিঙ্গে আকর্ষণ বোধ করে না, তা না হলে সাহিলের যা রূপ তাতে ওর কপালেও অশেষ দুঃখ ছিল৷ মনিবের নারী সঙ্গমের সময়ে সামনে বসে সারেঙ্গি বাজানোর সময়ে প্রথম দিকে যে কী ভয় লাগত সাহিলের, হাত কেঁপে উঠত অমন অত্যাচার দেখে, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামত মেয়েটির প্রতি অত্যাচার দেখে, বমি পেত, দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করত, কিন্তু উপায় ছিল না কোথাও যাওয়ার৷ বাবার দেওয়া বচন এবং নিজের ফেরত পাওয়া জীবনের কৃতজ্ঞতার জন্য শেষ পর্যন্ত সঙ্গ ছাড়তে পারেনি সাহিল৷ নিজেকে বোঝাতে শুরু করেছিল তোমার নিজের কোনও আলাদা জীবন নেই, আলীসাহেব যতদিন থাকবেন ততদিন তাঁর জন্যই তোমার বেঁচে থাকা৷ সেই মতো নিজের মনকে স্থির করে নিয়েছিল৷ প্রেমহীন, বান্ধবহীন, সামাজিকতাহীন একটি জীবন৷ বন্ধু বলতে শুধু নিজের সারেঙ্গিটি, ওখানেই তার সবকিছু সমর্পিত, নিজের মনে কোনও কথা জমলে সারেঙ্গিকেই সেই কথা ফিসফিস করে বলে সাহিল৷ সারেঙ্গি নিশ্চুপ হয়ে শোনে সেই কথা৷

নাচঘরে রূপসার নাচ দেখতে দেখতে জীবনে এই প্রথম মনের ভেতর কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল৷ এমন কেন হচ্ছে? এখানে এসে রূপসাকে দেখার পর থেকেই তার মনের ভেতর কেমন যেন হচ্ছে৷ আলীসাহেবের অনুমতি নিয়ে নিঃশব্দে উঠে পড়েছিল সাহিল৷ বাইরে বেরিয়ে খোলা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছিল৷ আজ পূর্ণিমা৷ তখন সবে রাত আটটা, গোল থালার মতো চাঁদ আকাশের মাঝে৷ চারদিকে আলো ছড়িয়ে পড়েছে৷ লম্বা শ্বাস নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল সাহিল৷ মনে মনে গুনগুন করছিল একটি সুর৷ আঠাশ বছর বয়স পেরিয়ে গেল, আরও কতদিন বেঁচে থাকতে হবে কে জানে….

আপনি উঠে এলেন যে? কণ্ঠ শুনে চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকাল সাহিল৷ রূপসা এসে দাঁড়িয়েছে৷

প্রথমে কিছু বলতে পারল না ও, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল রূপসার দিকে৷

অমন তাকিয়ে থাকা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল রূপসা৷

আপনি অমন বোকার মতো শুধু তাকিয়ে থাকেন কেন বলুন তো? বোবা নাকি? কথা বলতে পারেন না?

আচমকা এমন কথা শুনে থতমত খেয়ে গেল স্বভাবলাজুক সাহিল৷ কোনওক্রমে বলল, না না মানে…একটু বাইরে এলাম৷

চাঁদ দেখতে?

ওই আর কি…

আজ পূর্ণিমা তাই না?

হ্যাঁ৷ চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল সাহিল৷ তারপর ওর মনে হল রূপসাকে কিছু বলা উচিত৷ জিজ্ঞাসা করল, আপনি চলে এলেন?

হ্যাঁ৷ এখন দুই ঘণ্টা আমার বিশ্রামের সময়৷ বলে একটু থামল রূপসা৷ তারপর নিচু গলায় বলল, জানেন, আমি জীবনে অনেক মানুষ দেখেছি৷ আপনার মতো এমন অদ্ভুত লোক দেখিনি৷ বলে আর দাঁড়াল না৷ পায়ে বাঁধা নূপুরের ছম ছম শব্দ করতে করতে হেঁটে গেল৷ সাহিল একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল সেই চলে যাওয়ার দিকে৷

.

অনেক রাত৷ আজ চাঁদের আলোয় রূপসা নিজের কুটিরের ছাদে শুয়েছিল৷ আলীসাহেবের নির্দেশে আজ রাতে চাঁদের আলোতেই শয্যা পাতা হয়েছিল৷ ফুরফুরে হাওয়া ছিল আজ বিকেল থেকেই৷ বেশ অনেক রাত পর্যন্ত হুল্লোড় করে আলীসাহেব ফিরেছিলেন মজলিশ থেকে৷ পানাহার ওখানেই সেরে নিয়েছিলেন৷ তারপর রূপসার কুটিরে ফিরে শুরু হল শেষপ্রস্থ রমণ৷ চূড়ান্ত উদ্দামতা৷ সাহিল আজ বাজাচ্ছিল রাগ বাহার৷ আজ বাজানোর সময় রূপসার সঙ্গমকালীন কাতর শব্দ সাহিলকে অন্তরে আঘাত দিচ্ছিল তীব্রভাবে৷ মন বসছিল না বাজনায়৷ ইচ্ছে হচ্ছিল আলীসাহেবের পা দুটি জড়িয়ে ধরে বলে, ওকে ছেড়ে দিন, দয়া করে ছেড়ে দিন, কিন্তু এসবই অলীক ভাবনা৷ আজ রাতের সারেঙ্গির তারে জগতের সকল বেদনা যেন আছড়ে পড়ছিল…রূপসার পাথর হয়ে যাওয়া মনও যেন সেই উত্তাপে গলে যাচ্ছিল, কান্না পাচ্ছিল৷ হূদয়ের অতল গভীর থেকে একটা হাহাকার, আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল৷ আলীসাহেবের সঙ্গে শেষবার মিলনের সময়েই তাঁর অলক্ষে চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে নেমেছিল রূপসার৷ নিজেই চমকে উঠেছিল রূপসা৷ এমন তো তার হয় না, অন্তত বহুযুগ তার চোখ থেকে জল পড়েনি৷ অশ্রু কী সেটাই মনে নেই তার অথচ এই সারেঙ্গি যেন তার শরীরের প্রতিটি রোমকূপে এক অনির্বচনীয় বেদনা জাগিয়ে তুলছিল৷

সবকিছু মিটে যাওয়ার পর আলীসাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন৷ গভীর ঘুম৷ সাহিল উঠে চলে গেল৷ তার শয্যা আজ রূপসার কুটিরের দালানে৷ রূপসার ঘুম আসছিল না৷ চাঁদের দিকে তাকিয়ে চিত হয়ে শুয়ে আনমনা হয়ে ভাবছিল নানা কথা৷ সম্পূর্ণ নগ্ন শরীরে চাঁদের আলো পড়ে অপরূপ দেখাচ্ছিল ওকে৷ নিজের পুরোনো জীবনের নানা মুহূর্ত টুকরো টুকরো মনে পড়ছিল, মনে পড়ল যেদিন এই রূপমঞ্জরীতে প্রথম পা দেওয়ার দিনটি৷ সেই কথা মনে পড়তেই স্মরণে এল এখানে প্রবেশের ঠিক আগের মুহূর্তে ঘায়ে গলিত শরীর পূতিগন্ধময় ছিন্ন বস্ত্র সেই পাগলিনীর কথা, যে ছুটে এসে বলেছিল, যাস না, যাস না, মরবি৷ সেই উন্মাদিনী এখন কেমন রয়েছে কে জানে৷ রূপসা জানে না মাস কয়েক আগে সেই পাগলি রূপমঞ্জরীর ম্যানেজমেন্টের নির্দেশে এই পৃথিবী থেকে বহুদূরে চলে গিয়েছে কারণ এখানে প্রবেশকারীকে সে বাধা দিত, সাক্ষাৎ এক দৃষ্টিদূষণ ছিল সে অথচ কোনও এক সময়ে চিত্রলেখার অন্যতম প্রিয় ছাত্রী ছিল সেই পাগলিনী, রূপমঞ্জরীতে তার নাম ছিল অম্বালিকা যাকে ভরসা করে প্রথমবার সেই বিশেষ ওষধি প্রয়োগের জন্য দিয়েছিলেন তিনি৷ কিন্তু….এমনই দুর্ভাগ্য শেষ পর্যন্ত অম্বালিকা সেই ওষধির নিয়ম বজায় রাখতে পারেনি৷ কীভাবে সেইসব যে ঘটেছিল কেউ জানে না৷ অম্বালিকাকে বের করে দেওয়া হল রূপমঞ্জরী থেকে, কিন্তু এর মায়া সে কাটাতে পারল না, ওই প্রধান ফটকের পাশ দিয়ে যে মেন রাস্তা তারই উলটোদিকের ফুটপাতে একটি গাছের নীচে আস্তানা গেড়েছিল সে৷ ওখানেই সারাদিন থাকত আর কোনও মেয়ে এখানে প্রবেশ করতে গেলে ছুটে এসে তাকে প্রবেশে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করত৷

এসব কিছুই জানে না রূপসা৷ চিত্রলেখাও কিছুই বলেননি তাকে৷

অনেক অনেক কথা মনে করতে করতে চোখে ঘুম জড়িয়ে এল৷ ঠিক ঘুম নয় আধো অচেতন, ওইভাবে কতক্ষণ কেটে গেল কে জানে৷ রাত আরও গভীর হতে আকাশের চাঁদ যখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে, আকাশে পৃথিবীর প্রতি কোনা জ্যোৎস্নার অকৃপণ আলোয় ভেসে যাচ্ছে, তখন রূপসা যেন ঘুমের মধ্যেই অনুভব করল ওর সামনে কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে৷ রূপসা চোখ মেলে দেখতে গেল কিন্তু কেন জানা নেই পারল না, কিছুতেই পারল না চোখ মেলে তাকাতে, অথচ স্পষ্ট বুঝতে পারছে কে এসেছে…সাহিল…সাহিল এসেছে ওর কাছে, ঝুঁকে দেখছে রূপসাকে৷ রূপসার আপ্রাণ ইচ্ছে হল দুই হাত বাড়িয়ে সাহিলকে নিজের বুকে টেনে নেয়, তারপর দীর্ঘক্ষণ ওকে জড়িয়ে কাঁদে, তীব্র কান্নায় ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে জগতের সবকিছুকে কিন্তু কিছুতেই পারে না, ওই তো সাহিল, হ্যাঁ, চাঁদের আলোতে গন্ধর্বের মতো অপরূপ দেখতে লাগছে সাহিলকে৷ চন্দনের গন্ধ বের হচ্ছে ওর শরীর থেকে৷ সাহিলের শরীরের ছায়া পড়েছে রূপসার ওপর, যেন জুঁইফুলের তৈরি কোনও চাদর বিছিয়ে দিয়েছে রূপসার শরীরে এমনই নরম স্পর্শ সেই ছায়ার৷ গায়ে কাঁটা দিল রূপসার৷ প্রাণপণে একবারের জন্য চোখ মেলতে গেল আর ঠিক তখনই শরীরের প্রতিটি রোমকূপ দিয়ে অনুভব করল সাহিল ওর কপালে আলতোভাবে হাত রেখেছে৷ আহ! আঙুলগুলি রূপসার কপালে বেয়ে দুই চোখে আর ঠোঁটের ওপর এমনভাবে বুলিয়ে গেল যেন নিজেকে সারেঙ্গি মনে হল রূপসার, সাহিল সেই সারেঙ্গির তারে হাত বোলাচ্ছে, আর জগতের সব থেকে মধুর সঙ্গীতটি বেজে উঠছে, ছড়িয়ে পড়ছে এই খোলা পৃথিবীর প্রতিটি কোণে৷ আহ!

হাত সরিয়ে নিল সাহিল৷ কী এক আবেশে আচ্ছন্ন তার মন৷ কী তীব্র ইচ্ছে হচ্ছিল এই নারীমূর্তির কপালে আর ঠোঁটে একবার স্পর্শ করতে, সেই ইচ্ছেকে অবদমন করতে করতে শেষে হার মেনে ঘোরের মধ্যেই ফের উঠে এসেছিল ছাদে৷ চাঁদের আলোয় রূপসার খোলা শরীরটিকে অবিকল একটি দীর্ঘ সারেঙ্গি মনে হচ্ছিল তার, যেন স্পর্শমাত্র বেজে উঠবে মালকোষ কিংবা দরবারি৷ আর সত্যিই তাই হল, রূপসার কপালে নিজের আঙুল ছোঁয়ানোমাত্র সাহিল স্পষ্ট শুনতে পেল চরাচর জুড়ে অপূর্ব এক সঙ্গীত ছড়িয়ে পড়ছে৷ সে সুর বড় বেদনার, বড় অশ্রুমাখানো৷

জীবনে এই দ্বিতীয়বার শরীরী স্পর্শে শিহরিত হল রূপসা, প্রথমবার হয়েছিল বহুকাল আগে দীপুর কাছে৷ প্রতিটি রোমকূপ জেগে উঠল তার সাহিলের জাদুস্পর্শে, এ কেমন ছোঁয়া! কেন এমন…ভাবতে ভাবতে চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল রূপসার আর দেখতে পেল সাহিল তার সামনে থেকে সরে যাচ্ছে৷ চলে যাচ্ছে আজীবনের মতো৷ সাহিল বলে ডাকতে চেষ্টা করল রূপসা, পারল না৷ রাত শেষ হয়ে গেল৷

.

মাস ছয়েক পরের ঘটনা৷ শরতের শেষ দুপুরে রূপমঞ্জরীর সামনে এসে দাঁড়াল একটি ট্যাক্সি৷ সেখান থেকে বেরিয়ে এল বছর কুড়ি-বাইশের এক তন্বী সুন্দরী৷ গায়ের রঙ সূর্যের আলোয় যেন ঝলসে উঠছে৷ চোখে রোদ চশমা, পরনে হলুদ স্লিভলেস টি-শার্ট আর ডেনিমব্লু জিন্স৷ ঠোঁটে চড়া লিপস্টিক৷ হাতে একটি ট্রলি ব্যাগ৷ মেয়েটির নাম পিঙ্কি শর্মা, উত্তরপ্রদেশ থেকে এসেছে সে৷ রূপমঞ্জরীর মেন গেটের এককোণে সিকিউরিটি অফিসে কথা বলার জন্য এগোতে যাবে অমনই রাস্তার ওপর থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এল এক উন্মাদিনী৷ তেলহীন উস্কোখুস্কো চুল৷ পরনের শাড়িটি কোনও একসময় মূল্যবান ছিল কিন্তু এখন শতচ্ছিন্ন, মলিন, গোটা শরীরে গলিত ঘা৷ দুর্গন্ধে বমি চলে আসবে যে কারও৷ বয়স বোঝা দায়৷ দুই চোখ অস্থির আর রক্তবর্ণ৷

যাস না৷ যাস না৷ মরবি, মরবি৷ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে সেই পাগলি৷

‘এই ভাগ’ বলে এক প্রহরী বল্লম উঁচিয়ে দূরে সরাতে যায়৷

মেয়েটি রুমাল বার করে নাক চাপা দিয়ে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে সেই উন্মাদিনীকে৷

প্রহরীর ধমক আর বল্লমের খোঁচার ভয়ে পাগলি আবার দূরে সরে যায় কিন্তু ক্রমাগত বলে যেতে থাকে, মরবি, মরবি, যাস না…৷

পিঙ্কি নিজের নাম, আইডি ইত্যাদি জানিয়ে ঢুকে পড়ে ভেতরে৷ আজ ওর জয়েনিং৷ চলে যাওয়ার পর সিকিউরিটি অফিসে সদ্য জয়েন করা এক তরুণ ওই পাগলিকে উদ্দেশ করে তার সিনিয়রকে জিজ্ঞাসা করে, এই পাগলিটা কে, স্যার?

সিনিয়র কাজ করতে করতে আলগোছে উত্তর দেন, ওর নাম রূপসা৷ প্রেমকুঞ্জে একসময় সব থেকে নামী গণিকা ছিল, একদিন কী যে হল…

গল্প এগোতে থাকে আর বিকেল নামতে থাকে রূপনগরীতে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *