গন্ধ

গন্ধ

চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছিল কৌশিক৷ সত্যিই কোনও তুলনা নেই৷ ওর নিজের বাড়ি থেকে সাইকেলে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে যে এমন একটা বাড়ি যে এই দক্ষিণপাড়ায় থাকতে পারে তা ওর স্বপ্নের অতীত ছিল৷ দক্ষিণপাড়া হল হাওড়া মেন লাইনের একটি রেলস্টশনের নাম৷ হাওড়া স্টেশন থেকে মেনলাইনগামী লোকালে ঠিক আটটা স্টেশন পরেই দক্ষিণপাড়া৷ দক্ষিণপাড়ার পুবদিকে তিন কিলোমিটার দূরে জিটি রোড, গঙ্গা আর পশ্চিমদিকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে দিল্লিরোড৷ এই আট কিলোমিটার ব্যাস নিয়ে গোলাকার দক্ষিণপাড়া৷ বেশ পুরনো জায়গা, বিশেষ করে পুবদিকটায় এখনও বেশ কিছু প্রায় দুশো বছরের পুরনো বাড়ির সন্ধান মেলে৷ পশ্চিমদিক অবশ্য সেই তুলনায় নতুন৷ ষাট সত্তর বছর আগেও এইদিকটা ঘন জঙ্গলে ভরা ছিল৷ শিয়াল, বনবিড়াল, বিষাক্ত সাপ ইত্যাদির আখড়া৷ পরে ধীরে ধীরে জঙ্গল সাফ করে বসতি গড়ে ওঠে৷ কৌশিকের ঠাকুর্দা আজ থেকে প্রায় ষাঠট বছর আগে এখানে বাড়ি বানিয়েছিলেন তারপর থেকে পাকাপাকি এখানেই৷ কৌশিকের স্কুল জীবন এই দক্ষিণপাড়া বয়েজস্কুল তারপর কলকাতার কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন৷ এখন কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করছে এবং সঙ্গে সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা৷ তেইশ বছরের কৌশিকের শখ বলতে একটিই তা হ’ল গিটার৷ গানবাজনার প্রতি শখ ওর ছোটবেলা থেকেই ছিল, মাধ্যমিক পাশ করার পর খুব ইচ্ছে হল গিটার শেখার৷ ভর্তিও হল শিখতে৷ বছর দিয়েকের মধ্যে দিব্বি চলনসই শিখে নেওয়ার পর নিজের মনেই গান আর গিটার নিয়ে থাকে কৌশিক৷ লাজুক অন্তর্মুখী কৌশিক বরাবরই নিজের জগতে থাকতে ভালবাসে৷ ওদের বাড়ির পিছনে বেশ খানিকটা সাইকেল চালিয়ে গেলেই এখনও ধানক্ষেত, বাঁশবাগান, ঘন জঙ্গল পাওয়া যায়৷ যেদিন ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস থাকে না সেদিন বেলার দিকে অথবা দুপুর-বিকেলে কৌশিক সাইকেল চালিয়ে চলে যায় ওইসব জায়গায়৷ অনেকক্ষণ একা একা ঘোরে, বাঁশবনের ভিজে মাটি, ঠান্ডা পরিবেশ অথবা ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে বয়ে আসা মিষ্টি হাওয়া ওর বড় ভাল লাগে৷ মন ভাল হয়ে যায়৷

কৌশিকের আজ পর্যন্ত কোনও বান্ধবী হয়নি৷ দুই একজনকে কলেজে মনে ধরেছিল ঠিকই কিন্তু ওই পর্যন্তই৷ মনের বাইরে তার আর প্রকাশ ঘটেনি৷ এমনকি যাকে ওর পছন্দ হয় তাকে ওর ধারে কাছে আসতে দেখলেই ভয় পেয়ে যায় কৌশিক৷ সঙ্গে সঙ্গে দূরে, আড়ালে সরে যায়৷ এমন স্বভাব যার, তার প্রেমিকা জুটবে না সেটাই স্বাভাবিক৷

তা নিয়ে যে কৌশিকের খুব আফসোস রয়েছে তাও নয়৷ বরং এই একা একা থাকার যে একটা মজা সেটা ওর দিব্বি লাগে৷ কৌশিকের বাড়িটা যেখানে সেই জায়গাটা দিন পনেরো আগে পর্যন্তও খুব চুপচাপ ছিল৷ কিন্তু হপ্তা দুয়েক আগে থেকে সেই শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে৷ বাড়িতে কৌশিকের ঘরের বড় জানলা যেদিকে মুখ করে তার থেকে ঠিক কুড়ি ফুট দুরেই ধীরেনকাকাদের বাড়ি৷ ওদেরও অনেক পুরনো বাড়ি৷ সেই বাড়ি কিছুদিন আগে থেকে আগাপাশতলা সারাইয়ের কাজ চলছে৷ ধীরেনকাকুর ছেলে মলয়দা ভাল চাকরি করে৷ সেই বাড়ি রেনোভেনশনের কাজ শুরু করেছে ফলে রাজমিস্ত্রি, পাথর কাটার মিস্ত্রি, ঢালাই মেশিন, লেবারদের হৈ হৈ সবমিলিয়ে এক ভয়ংকর দুর্যোগ৷ এত হট্টগোলে জাস্ট পাগল পাগল লাগছিল কৌশিকের৷ কতদিনে এর থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে জানা নেই৷ যে আয়োজনে কাজ শুরু হয়েছে তাতে স্পষ্ট কম করে মাস দেড়েকের ধাক্কা৷ এমন হলে জীবন আর বেশিদিন নেই৷ কী করা যায় তাই ভাবতে ভাবতেই আজ সকালে কৌশিকের বন্ধু বুদ্ধদেব এসে হাজির৷ স্কুল বেলার বন্ধু৷ কয়েক কথার পরেই কৌশিক বলেছিল আর পারছি না ভাই, মনে হচ্ছে খুব শিগগিরিই পাগল হয়ে যাব৷ সারাক্ষণ মাথার ভেতরে যেন কেউ হাতুড়ি পিটছে৷

বুদ্ধদেব ওর বন্ধুকে চেনে৷ বলল কোথাও ঘুরতে চলে যা৷

কতদিন? সাতদিন দশ দিন পনেরো দিন? তারপর? এ তো মাস দুয়েকের আগে থামবে না৷

বুদ্ধ ঠোঁট কামড়ে বলেছিল একটা জায়গায় তোর থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারি, পুরো ফ্রিতে৷ যদি রাজি থাকিস তো কথা বলে দেখতে পারি৷

কোথায়?

এই দক্ষিণপাড়াতেই৷ বিউটিফুল জায়গাটা৷ আমি শিওর দেখলে তোর ভাল লাগবে৷ আরামে যতদিন খুশি থাকতে পারবি৷ কেউ ডিস্টার্ব করার নেই৷

কী বলছিস রে!

ঠিকই বলছি৷ যাবি দেখতে?

এখনই চল৷

দুই বন্ধু মিলে তখনই রওনা দিয়েছিল সাইকেল চেপে৷

কৌশিকের বাড়ি থেকে সাইকেলে বেশ কিছুটা পথ, চার কিলোমিটার মতো৷ দক্ষিণপাড়ার পূর্বদিকে৷ গঙ্গার কাছাকাছি জিটি রোড থেকে একটু ভেতরের রাস্তার ওপরে একটা পুরনো ফটকের সামনে এসে দাঁড়াল বুদ্ধ৷ কৌশিককে বলল এই যে এসে গেছি৷ বিবর্ণ পলেস্তারা চটা দুটো প্রায় দশফুট উঁচু থামের মাঝে ব্ল্যাক জাপান রঙ করা লোহার পাতের গেট৷ বাইরে থেকে ভেতর দেখা যায় না৷ একটা থামের গায়ে পাথরের ফলকে লেখা রয়েছে মিত্র ভিলা৷ লেখাটাও কিছুটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছে বয়সের ভারে৷

কৌশিক জিজ্ঞাসা করল, কী করে ঢুকব রে?

আয় আমি জানি কী করে ঢুকতে হবে৷ বলে উবু হয়ে বসে ওই গেটের নিচের ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে কী একটা টানল তারপর উঠে দাঁড়াল৷ চল গেট খুলে গেছে৷ নিচে একটা দড়ি রয়েছে ভেতরের শিকলের সঙ্গে সেট করা৷ দড়িটা টানলে ভেতরের শিকল খুলে যায়৷ এটা এই বাড়ির কেয়ারটেকার বাবলুদার টেকনিক, বলে বুদ্ধ বলল, চলে আয় ভেতরে৷ লোহার দরজাটা ঠেলে সরিয়ে দিল৷ দরজা সরা মাত্র কৌশিক দেখল বাড়ির ভেতরটা যেন ওর জন্যই অপেক্ষা করছে৷ গেট থেকে সোজা চলে গিয়েছে ইট বিছনো লন৷ লনের দুই ধার ঘন সবুজ লম্বা ঘাসে ঢাকা৷ বুদ্ধ আর কৌশিক ভেতরে ঢুকল৷ দরজাটা ভেতর থেকে শিকল টেনে দিল বুদ্ধ৷ বলল চল এবার৷ সাইকেল এখানেই থাক৷

.

প্রায় আধঘন্টা ধরে পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখল কৌশিক৷ দক্ষিণপাড়াতে যে এমন বাড়ি থাকতে পারে তা ওর কল্পনার বাইরে ছিল৷ প্রায় কুড়ি কাঠা জমির ওপর বাড়ি৷ একতলা৷ আর বাকিটা জঙ্গল৷ জঙ্গলের গন্ধ যেন ছেয়ে রয়েছে বাড়িটাকে৷ কী অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ! পুরো বাড়িটাই উঁচু পাঁচিলে ঘেরা৷ বাড়ির চৌহদ্দিতে একটা শানবাঁধানো পুকুরও রয়েছে৷ যদিও পুকুরের জল দেখেই বোঝা যায় সেটা দীর্ঘদিন অব্যবহূত৷

এই বাড়ির কেয়ারটেকার বছর পয়তাল্লিশের বাবলুদা তার স্ত্রী পুত্র নিয়ে অনেক বছরই রয়েছেন৷ তবে ওর ঘরটা পুকুরের অপর ঘাটের দিকে৷ মেন বিল্ডিংটা একতলা হলেও বেশ বড় এবং মেনটেইন্ড৷ পুকুরের গা দিয়ে সরু রস্তা রয়েছে বাবলুদার টিনে ছাওয়া ঘরের দিকে যাওয়ার জন্য৷ অনেক গাছ এই বাড়িতে৷ নারকেল, সুপুরি, আম, জাম, কাঠাল, আতা, জামরুল, কামরাঙা তো রয়েছেই ফুলের গাছও অনেক৷ জবা, টগর, কল্কের পাশাপাশি কামিনী, গুলঞ্চও রয়েছে৷ আর বাকিটা লম্বালম্বা ঘাস এবং আগাছার জঙ্গল৷

কেমন বুঝছিস? জিজ্ঞাসা করল বুদ্ধ৷

আমি ভাবতেই পারছি না৷ মনে হচ্ছে অনেক দূরে কোথাও এসেছি৷ সেখানে এমন জায়গা, এই হাভেলি…

এখানে থাকবি? তাহলে বল ব্যবস্থা করে দেব৷ ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করল বুদ্ধ৷

সত্যি থাকতে দেবে আমাকে?

বুদ্ধ বলল, একটা দিন সময় দে৷

৷৷ ২ ৷৷

.

বিকেল, সন্ধে দিব্যি কেটে গেল৷ কী যে ভাল লাগছে এই পরিবেশটা৷ এই বাড়িটা৷ এ যেন কৌশিকের কাছে আশীর্বাদ! বুদ্ধ ঠিক একদিনের মধ্যেই ব্যবস্থা করে ফেলেছিল৷ আসলে এই বাড়ির যে বর্তমান মালিক শুভাশিস মিত্র তার ছেলে অরিন্দম হল বুদ্ধর দাদা সারথির কলেজের বন্ধু৷ বেশ কিছুবছর আগে অরিন্দম চাকরি পেয়ে ব্যাঙ্গালোরে চলে যায়৷ শুভাশিস এবং তার স্ত্রীও ছেলের সংগে চলে যান৷ সেই থেকে এই বাড়িটা একাই পড়ে রয়েছে৷ বনেদি বড়লোক পরিবার৷ কেয়ারটেকার বাবলুদা থাকে পরিবার নিয়ে৷ মাস মাইনের বদলে এই বাড়ির দেখভাল ওই করে৷

.

বুদ্ধর সংগে বাবলুদার বেশ ভালই পরিচিতি রয়েছে৷ ও বন্ধুদের নিয়ে মাঝেমাঝেই এখানে এসে আড্ডা মেরে যায়৷ বাবলুদার থেকে শুভাশিসবাবুর নামবারটা নিয়ে ওর দাদা সারথিকে দিয়ে ফোন করিয়েছিল বুদ্ধ, যদি কৌশিককে মাসখানেক থাকার জন্য একটা ঘর একটু দেওয়া যায়৷ যদিও ফোনটা অরিন্দম ধরেনি, তবে শুভাশিসবাবু বুদ্ধর সারথিকে চিনতে পেরেছিলেন এবং কৌশিক সম্পর্কে কিছুটা জানার পর বলেছিলেন, তোর ভাইয়ের বন্ধু যখন আমার কোনও আপত্তি নেই৷ আমি বাবলুকে বলে দেব৷ তবে ওই বাড়িতে থাকতে…মানে এমনি কোনও সমস্যা নেই, তবে অনেক ঝোপ জঙ্গল রয়েছে তো, রাতে দরজা জানলা ভালভাবে বন্ধ করে শুতে বলিস, আর এমনি কোনও সমস্যা নেই৷

.

শুভাশিসবাবু যে কিছু একটা বলার ইঙ্গিত দিয়েও চুপ করে যাচ্ছিলেন সেটা খানিক আন্দাজ করেছিল সারথি৷ খুব গুরুত্ব দেয়নি৷ ভেবেছিল হয়তো কোনও পারিবারিক সমস্যা৷ যাইহোক শুভাশিস মিত্র রাজি হওয়ার পর সেই খবর যখন কৌশিকের কাছে পৌঁছল আর বিন্দুমাত্র দেরি করেনি ও৷ সঙ্গে সঙ্গে নিজের ব্যাগ গিটার ইত্যাদি গুছিয়ে চলে এসেছিল এই বাড়িতে৷ কৌশিক প্রথমে ভেবেছিল সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত থাকবে, রাতে নিজের বাড়িতেই ফিরে আসবে৷ কিন্তু এমন সুন্দর একটা বাড়িতে রাতের পরিবেশটা ও মিস করতে চায়নি৷ তাই বাড়িতে বাবা-মাকে অনেক চেষ্টায় রাজি করিয়ে চলে এসেছে গতকাল৷ বাবলুদা নেহাতই ভাল মানুষ৷ বাড়ির তালা খুলে দিয়ে বলেছে চারটে বেডরুম রয়েছে৷ তোমার যেটা খুশি ব্যবহার করতে পার৷ বলে একে একে সবকটা ঘরই খুলে দেখিয়েছিল বাবলু৷ কয়েকটা ঘরে তালা দেওয়া৷ ওগুলো বন্ধ কেন জিজ্ঞাসা করায় বাবলু বলেছিল কোনওটা স্টোররুম, কোনওটা কিচেন, তাই ওগুলো খোলার দরকার পড়ে না৷ আর একটা ঘর দেখিয়ে কৌশিক জিজ্ঞাসা করেছিল, আর এটা?

এটা আমিও জানি না, এমনিই বন্ধ৷

অ৷

তা বলছি কি ভাই, তুমি তো সারাদিন থেকে রাতে ফিরে যাবে?

তেমনই ইচ্ছে৷ কিন্তু থাকলে কি কোনও অসুবিধা হবে আপনার?

না না তা কেন? আসলে বুদ্ধ তেমনই বলেছিল৷

হুঁ আমিও তেমনই ভেবেছিলাম৷ কিন্তু বাড়িটা এতই সুন্দর যে আমার সবসময়েই থেকে যেতে ইচ্ছে করছে৷

আজ চব্বিশ তারিখ না? হঠাৎই অপ্রাসঙ্গিক একটা প্রশ্ন করেছিল বাবলু৷

হ্যাঁ, কেন বলুন তো?

না না মানে…আপনি তাহলে মাসটা শেষ করে সামনের মাস থেকে রাতে থাকতে পার৷ এমনি এই কয়েকদিন সারাদিন থাকলে৷

বুঝলাম না আপনার কথা৷ সামনের মাস থেকে রাতে…মানে কেন? এই মাসে কী অসুবিধা?

না অসুবিধা আর কি…আসলে…বাবলু কিছুটা একটা যেন লুকোতে চেষ্টা করছে দেখে কৌশিক স্পষ্ট জিজ্ঞাসা করেছিল কোনও রকম সমস্যা থাকলে আমাকে নিশ্চিন্তে বলতে পারেন৷

না না দাদা সমস্যা বলতে মানে…আসলে রাতে শোবার মতো ব্যবস্থা কিছু করা হয়নি…আচ্ছা দেখছি৷ তুমি থাক৷ শুধু রাতের দিকে জানলা দরজা বন্ধ করে রাখবে৷ আর রাতে ওঠার দরকার হলে লাইট জ্বালিয়ে যাবে৷ আর ভেতরের বাথরুমটা ব্যবহার করবে৷ বারান্দার ওইপ্রান্তে যেটা রয়েছে সেটা নয় কিন্তু৷

বাবলুদা, এত সাবধাবাণী কিসের? কী সমস্যা বলুন না৷

না না আসলে দেখছই তো অনেক পুরনো বাড়ি তার ওপর ঝোপ-জঙ্গল তাই সাপখোপ তো রয়েছেই ভামও রয়েছে বেশ কিছু সেইজন্যই…

ওহ তাই বলো৷ সে ঠিক আছে৷ আমি ব্যবস্থা করে নেব৷ নিশ্চিন্ত হয়ে বলেছিল কৌশিক৷

তারপর সারাদিন গেল বাড়িটা এক্সপ্লোর করতে৷ চারিদিক অদ্ভুত এক প্রশান্তি, নৈঃশব্দ যেন সারাদিন জড়িয়ে রয়েছে অলস বাড়িটাকে৷ যেন সময়ের সঙ্গে না দৌড়ে নিজের মতো থেমে রয়েছে মিত্র ভিলা৷ কিংবা সময়ই যেন থমকে গিয়েছে এখানে৷ সময়ের কোনও ব্যস্ততা নেই এই বাড়ির হাওয়ায়, দেওয়ালে, ঘাসে, গাছে, জঙ্গলে৷

নিজের মতো গান গেয়ে গিটার বাজানো, বই পড়া, ল্যাপটপে সিনেমা দেখার মধ্যে দিব্বি কেটে গেল দিনটা৷ বিকেলে বুদ্ধ এসেছিল৷ ওর সঙ্গে বাড়ির ছাদেও গিয়েছিল কৌশিক৷ বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব৷ সন্ধের পর ফিরে গেল বুদ্ধ৷ কৌশিক ততক্ষণে ঠিক করে ফেলেছে রাত্রিবাসটাও ও এখানেই করবে৷ অন্তত আজকের রাতটা থাকবেই৷ কাল থেকে না হয় বাড়িতে৷

রাতের খাবার বাড়ি থেকে খেয়ে দশটা নাগাদ চলে এল কৌশিক৷ পুকুরের দিকে জানলা রয়েছে যে ঘরটা সেদিকের বেডরুমটাই নিয়েছে ও৷ বেশ বড় ঘর৷ পুরনো দিনের একটা কালচে কাঠের খাট, টেবিল চেয়ার আর একটা আলমারি৷ আর কিছু নেই৷ বাবলুদা খাটে সুন্দর করে বিছানা পেতে রেখেছে৷ মশারি, চাদর, মশা তাড়ানোর ধূপ, দেশলাই, মোমবাতি সবই রেখে গেছে৷ রাতে এই বাড়ির চারদিক যেন ঘন জঙ্গলের ভেতর যেমন হয় অবিকল তেমনই৷ নিঝুম, শুধু ঝিঁঝিঁ পোকা আর জোনাকির অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে৷ বারান্দার লাইটটাও নিভিয়ে দিয়েছে কৌশিক৷ জানলা দিয়ে পুকুরের ওই পাড়ে বাবলুদার ঘরের আলো দেখা যাচ্ছে৷ অনেকটা দূর মনে হচ্ছে ওদের ঘরটা যেন পাশের গ্রাম থেকে ভেসে আসা টিমটিমে আলো ভেসে আসছে৷ এগারোটা পর্যন্ত জেগে ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল কৌশিক৷ কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়েও পড়েছিল আচমকাই ঘুম ভেঙে গেল৷ কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে৷ মনে হচ্ছে বাইরে লম্বা বারান্দাটায় কেউ যেন ছোটাছুটি করছে৷ প্রথমে ভাবল মনের ভুল৷ ঘুমোতে চেষ্টা করল কিন্তু ঘুম এল না৷ নাকের মধ্যে কীসের যেন একটা গন্ধ লাগছে৷ অচেনা মিষ্টিগন্ধ৷ বাইরে পায়ের শব্দটা যেন বেশ প্রকট৷ গন্ধগোকুল নয়তো? খানিকটা বেজির মতো দেখতে এই প্রাণীটি সদলবলে যখন আসে তখন চারপাশে একটা গন্ধ ছড়ায়৷ খানিকটা পায়েসের চালের মতো গন্ধ৷ কিন্তু এ তো সেই গন্ধ নয়৷ হঠাৎই বারান্দার ওইপারে কোনও দরজায় শিকল খোলা ঝনাৎ করে শব্দ হল৷ শিকল কোন ঘরে রয়েছে মনে করার চেষ্টা করল কৌশিক৷ বারান্দার পাশে সার সার মোট চারটে ঘর প্রতিটাতেই তালা দেওয়া৷ একমাত্র শেষপ্রান্তে একটা বাথরুম রয়েছে যেটায় শিকল তোলা ছিল শুধু৷ কোনও তালা দেওয়া ছিল না৷ ওই বাথরুমটা বাবলুদা ব্যবহার করতে বারণ করেছিল৷ কৌশিক যে ঘরে রয়েছে সেই ঘর লাগোয়া একটি বাথরুম রয়েছে৷

শিকলের শব্দটা স্পষ্ট৷ তারপর আবার কী যেন বারান্দার ওই প্রান্ত থেকে লঘু পায়ে হেঁটে এল এইদিকে৷ এ তো চতুষ্পদ কোনও প্রাণীর পায়ের শব্দ নয়৷ গা ছমছম করে উঠল কৌশিকের৷ উঠে বসল৷ ভেতরে খুব টেনশন হচ্ছে৷ হঠাৎই মনে হল পায়ের শব্দটা যেন খুব দ্রুত ছাদের সিড়ি দিয়ে উঠে গেল ওপরে৷ ছাদে যাওয়ার সিঁড়িটা কৌশিক যে ঘরে শুয়েছে তার লাগোয়া৷ ওর নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত৷ হ্যাঁ ওই তো ছাদে কেউ দৌড়চ্ছে৷ ধুপ ধুপ শব্দ হচ্ছে৷ নাহ এভাবে বসে থাকার কোনও মানে হয় না৷ কৌশিক কোনওকালেই ভিতু নয়৷ এমন সব শব্দ হওয়ার পর তার রহস্য ভেদ না করলে ওর ঘুমের দফারফা হয়ে যাবে তাই রহস্য ভেদ করাটা আগে প্রয়োজন৷ বালিশের পাশে রাখা মোবাইলের টর্চটা জ্বালিয়ে খাট থেকে নেমে ও লাইট জ্বালল৷ তারপর দরজা খুলে দরজার ইয়া মোটা খিলটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে বারান্দায় আসতেই প্রথমে ওর নাকে ঝাপটা দিল অদ্ভূত মিষ্টি একটা গন্ধ৷ কেমন যেন মন আনচান করে দেওয়া গন্ধ৷ কিছুটা কামিনী ফুলের মতো কিন্তু পুরোটা নয়, কিছুটা ছাতিম একেবারে অচেনা গন্ধটা৷ এ কোন ফুলের গন্ধ? সারাদিনে পাওয়া যায়নি তো! কাল সকালে বাবলুদার কাছে জানতে হবে৷ কৌশিক একহাতে টর্চ আর অন্যহাতে মোবাইল বাগিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকল ছাদের দিকে৷ যত ওপরে উঠতে থাকল ততই সেই গন্ধটা যেন তীব্র…গা সিরসির করতে থাকল কৌশিকের৷ এই গন্ধ নেহাত ফুলের নয়…কেমন যেন কেমন যেন…ছাদে উঠে টর্চ জালানো মোবাইলটা তুলে ধরে দেখল অন্ধকার মস্ত ছাদে কিছুই নেই৷ কিন্তু সেই অচেনা গন্ধটা ম ম করছে৷ বার বার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে কৌশিকের৷ এ গন্ধ ফুলের নয়…কিছুতেই ফুলের হতে পারে না…এ তীব্র শরীরী গন্ধ৷ কোনও যুবতী মেয়ের কাঁধে নাক ঠেকালে কি এমন গন্ধ পাওয়া যায়? জানা নেই কৌশিকের কিন্তু আচমকা এমনই ভাবনা ওর মনে এল৷ গন্ধটা ওকে শিহরিত করছে৷ ওর পৌরুষকে কেমন উত্তেজিত করে তুলছে অজানা হর্ষে৷ গায়ে কাঁটা দিল কৌশিকের৷ সামান্য কেঁপে উঠল৷ তাড়াতাড়ি ছাদ থেকে নেমে যাওয়ার জন্য পিছন ফিরল, আর তখনই মনে হল পিছনে কেউ যেন দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে৷ এক ঝটকায় ঘাড় ঘুরিয়ে আবার পিছন দিকে তাকাল কৌশিক৷ নাহ কিছু নেই…৷ কিন্তু আছে কিছু একটা আছে…

.

পর পর দুটো দিন৷ কী যে হয়ে গেল কৌশিকের ও নিজেও জানে না৷ সারাক্ষণ যেন একটা ঘোর, ক্ষিদে তৃষ্ণা কিছুই নেই, শুধু এক অদ্ভূত অনুভূতি৷ একটি পুরুষের শরীরে নারীর স্পর্শে যেমন অনুভূতি হয় ঠিক তেমন৷ আর সেই অনুভূতির কারণ ওই গন্ধটা…সারাদিন ধরে গন্ধটা রয়েছে আর দিনের আলো নিভে গিয়ে রাত যত বাড়তে থাকে গন্ধটা যেন ততই তীব্রতর হয়ে উঠতে থাকে৷ তখন কেমন যেন পাগল পাগল লাগে কৌশিকের৷ বালিশটাকে আঁচড়ে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে৷ অথচ কৌশিকের যৌনচেতনা এত তীব্র কখনই নয়৷ এমনি সুস্থ সাধারণ একটি তরুণের যতটা আগ্রহ এবং অনুভূতি থাকে ওর ততটাই রয়েছে, তার বেশি কিছু নয়, কিন্তু এই দুটো দিন যেন ওকে পুরো বদলে দিল৷ ড্রাগস নেওয়ার মতো মাথার মধ্যে সারাক্ষণ ঝিম ধরে থাকছে৷ ওই গন্ধটা ওই অদ্ভূত মিষ্টি অথচ তীব্র গন্ধটা যতবার ওর শ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করছে কৌশিক প্রতিবার অনুভব করছে তীব্র শরীরী সুখ৷ বুঁদ হয়ে যাচ্ছে৷ মন অস্থির হয়ে যাচ্ছে৷ কেমন যেন পাগল পাগল৷ গান, গিটার কিচ্ছু ভাল লাগছে না, কিচ্ছু না৷ শুধু ইচ্ছে করছে একটি নারীকে আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে তার মধ্যে মিশে থাকতে৷ গতকাল রাতেও ঠিক একই ঘটনা৷ প্রথমে বাথরুমে শব্দ, তারপর বারান্দায় কার হেঁটে যাওয়ার শব্দ তারপর সিঁড়িতে ওঠা আর শেষে ছাদের মধ্যে কখনও হাঁটা, কখনও দৌড়নো৷ অল্প বয়েসি ছেলে মেয়েরা চলাফেরা করলে যেমন একটা অস্থিরতা থাকে ঠিক তেমনই৷

আজ অনেক বেলা পর্যন্ত শুয়েছিল কৌশিক৷ চোখে ঘুম এলেই সুন্দর সুন্দর সব স্বপ্ন আসছে, সবই কেমন নেশায় মাতাল করে দেওয়া স্বপ্ন৷ প্রায় দশটা নাগাদ উঠল বিছানা ছেড়ে৷ আড়মোড়া ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখল বাবলুদা আসছে এইদিকে৷ এসে আগেই জিজ্ঞাসা করল তোমার শরীর টরির ঠিক আছে তো?

হ্যাঁ ঠিকই আছে৷ শান্তস্বরে বলল কৌশিক৷

বাবলু যেন ওকে পরখ করছিল৷ রাতে কি বাইরে বেরিয়েছিলে কাল পরশু?

কেন বলুন তো?

না এমনিই জিজ্ঞাসা করছি৷

কৌশিক কিছু গোপন করল না৷ সরাসরি জিজ্ঞাসা করল হ্যাঁ দুই রাতেই বেরোতে হয়েছিল৷

সেকি! আমি বলেছিলাম না রাতে না বেরোতে৷

হ্যাঁ, কিন্তু এই বাড়িতে কিছু একটা রয়েছে বাবলু দা৷ আপনি হয়তো জানেন আমাকে বলছেন না৷

না না কিছু নেই…কী আবার থাকবে? তবে ওসব শব্দটব্দ কিছু পেলে বেরোবে না৷ কয়েকদিন পর ঠিক হয়ে যাবে৷

আমি যে শব্দ পেয়েছি সেটা আপনি কী করে জানলেন? আর সেই শব্দ কয়েকদিন পর ঠিক হয়ে যাবে সেটাই বা বললেন কী ভাবে?

এই রে…আমি তো আমি তো…বাবলু কী বলবে ভেবে পেল না৷

আচ্ছা বাবলুদা গতপরশু রাত থেকে একটা খুব মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছি, মানে কোনও অচেনা ফুলের গন্ধ আমার মনে হয়, বুনো কিন্তু মিষ্টি৷ কী ফুল বলো তো?

গন্ধ…ও কিছু নয়, এখানে অনেক গাছ রয়েছে হবে কিছু…ও কিছু নয়৷ বলতে বলতেই হাঁটা দিল বাবলু দা৷

ও বাবলুদা৷ শুনুন৷

কী হয়েছে? আমার কথা শুনুন নতুন জায়গা৷ সুট করতে কদিন সময় লাগবে৷ মাসের শেষ দুটো দিন নিজের বাড়িতে কাটিয়ে এসো আমার কথা শুনলে ভালই হবে৷ বলতে বলতে চলে গেল বাবলু৷

এই লোকটা কিছু জানে যা গোপন করতে চাইছে প্রথম থেকেই৷ বার বার ওই মাসের শেষ মাসের শেষ কয়েকদিন এর মানে কী? নাহ বাবলু না বললেও ওকে একাই জানতে হবে৷

৷৷ ৩ ৷৷

আজ সারাদিন বাড়ির চারপাশ ঘুরে বেড়াল কৌশিক৷ নাহ এমন কোনও ফুল নেই যার গন্ধ ওই ওইরকম৷ তন্নতন্ন করে চারদিক খুঁজতে খুঁজতে শেষে ওই পানায় ভরা পুকুরটার সামনে যখন এল টের পেল পুকুরের কাছে সেই গন্ধটা অনেক বেশি৷ পুকুরের পানায় এমন গন্ধ হতে পারে না৷ তাহলে পুকুরের তলায় কিছু…কিছু তো একটা রহস্য রয়েছে, কী সেটা? পুকুরপাড়েই বসে পড়ল৷ গন্ধটা ওকে মাতাল করে দিচ্ছে৷ আহ! আবার জেগে উঠছে শরীর৷ বার বার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে কৌশিকের৷ জলের দিকে তাকিয়ে ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল ও৷ ইচ্ছে করছিল ওই জলে নেমে স্নান করতে৷ এই জল মোটেও স্নানের উপযুক্ত নয়, তবু ওই গন্ধের মধ্যে ডুবতে চাইছিল কৌশিক৷ হঠাৎই ও মুখ তুলে তাকাতে দেখতে পেল পুকুরের উল্টোদিকে বাবলুদার ঘরের জানলায় একটি মুখ, ওর দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে৷ ও তাকাতেই মুখটা চট করে সরে গেল৷ কৌশিক ততক্ষণে মুখটা চিনে ফেলেছে৷ বাবলুদার স্ত্রী৷ এমন লুকিয়ে ওকে দেখছে কেন? আশ্চর্য তো! কৌশিক এই দু’দিনে অনেকবারই খেয়াল করেছে ওকে বাবলুদা এবং ওর স্ত্রী যেন আড়াল থেকে নজরে রাখে৷ কী দেখে? ভাবনাটা এগোতে গিয়েও পারল না৷ হাওয়া দিল একটা৷ আর সেই হাওয়াতে ওই মন মাতানো গন্ধটা যেন গোটা শরীর দিয়ে বয়ে গেল কৌশিকের৷ উঠে দাঁড়াল ও৷ পুকুরের জলটা একবার খুব ছুঁতে ইচ্ছে করছে৷ চারধাপ সিঁড়ি নেমে উবু হয়ে বসে সব যখন জলে হাত ডোবাতে যাচ্ছে তখনই পিছন থেকে ডাক, ভাই করছ কী?

কৌশিক পিছনে তাকিয়ে দেখল বাবলু এসে দাঁড়িয়েছে৷

কিছু না জলটা একটু…

ছোঁবে না৷ উঠে এস৷

কেন? ছোঁবো নাই বা কেন? বিরক্ত হয়ে উঠল এবার কৌশিক৷ কী অসুবিধা আছে?

না অসুবিধা নয়…আসলে বহুদিনের অব্যবহূত জল, তার ওপরে সাপখোপ থাকতে পারে ওইজন্যই বলছিলাম আর কি৷ উঠে এসো৷

শেষ লাইনটায় যেন প্রচ্ছন্ন হুকুম ছিল বাবলুর গলায়৷ কৌশিক সেটা অমান্য করতে পারল না৷ আফটার অল ওই এই বাড়ির দায়িত্বে৷

ঘরে যাও তুমি৷ এই পুকুরের দিকে এসো না৷

যে গন্ধটার কথা বলছিলাম সেটা কিন্তু এই পুকুরের থেকেই বেরোচ্ছে বাবলুদা৷

ওসব তোমার মনের ভুল৷ আমি এতদিন এখানে রয়েছি কই কোনও গন্ধ পাইনি তো৷ আমার মনে হচ্ছে তোমার এই বাড়ির পরিবেশ সুট করছে না, তুমি বাড়ি ফিরে যাও, তুমি দাদাবাবুর বন্ধু৷ মিত্রভিলার গেস্ট৷ তোমাকে চলে যাওয়ার জন্য জোর তো করতে পারি না, কিন্তু অনুরোধ করতে পারি৷ আর যদি একান্তই থাকতে চাও তাহলে অনুরোধ করছি দুটো দিন রাতবিরেতে ঘর ছেড়ে বেরোবে না৷ এতে তোমারই মঙ্গল৷

হ্যাঁ এই কথাটা আপনি বারবার কেন বলছেন জানতে পারি? কী রহস্যটা কী?

বাবলু ঠান্ডা গলাতেই বলল, রহস্য কিছুই নেই৷ পুরনো বাড়ি, তাও আবার এমন পরিবেশ৷ মানিয়ে নিতে সকলেরই কয়েকটা দিন সময় লাগে৷ আমি যখন চাকরিতে ঢুকি, আমারও শুরুর দিকে এমন সব হত৷ এখন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে৷

কৌশিক বাবলুর কথাগুলো শুনছিল আর একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছিল বাবলুর চোখের মণিদুটো চঞ্চল৷

.

রাত সাড়ে এগারোটা বাজল৷ মোবাইলে নেট সার্ফ করতে করতে সময়টা খেয়াল করল কৌশিক৷ আজ ও মনে মনে ঠিক করে রেখেছে রহস্যটা কী তা জেনেই ছাড়বে৷ কারণ মনের ভেতর একটা অন্যরকম সন্দেহ দানা বাঁধছে ওর৷ এমন নয়তো বাবলুদা আর ওর স্ত্রী মিলেই কৌশিককে ভয় দেখিয়ে এই বাড়ি ছাড়া করতে চাইছে৷ হয়তো ফাঁকা বাড়ির সুযোগ নিয়ে বাবলু এখানে এমন কিছু কারবার ফেঁদে বসেছে যা কৌশিকের উপস্থিতিতে চালাতে অসুবিধা হচ্ছে বলেই এইসব রহস্যের অবতারণা৷ হতেই পারে৷ আজকাল সবই হয়৷ আজ মনে মনে প্রস্তুত হয়েই রয়েছে কৌশিক, এসপার ওসপার করতেই হবে৷ কিন্তু সমস্যা একটাই বেশি রাত পর্যন্ত কোনওকালেই জেগে থাকতে পারে না৷ মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতেই একসময় বিছানায় ঘুমিয়ে ঢলে পড়ল৷ আজও ঘুম ভাঙল সেই তীব্র গন্ধে৷ ঘুমটা ভাঙতেই ধড়মড় করে উঠে বসল কৌশিক৷ ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা৷ না, আজ বারান্দা থেকে নয় ও দিব্বি বুঝতে পারছে গন্ধের উৎস এই ঘরের ভেতরেই৷ কে যেন ঘোরাফেরা করছে ঘরের ভেতর৷ তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু দেখা যাচ্ছে না৷ গায়ের প্রতিটা লোম খাড়া হয়ে উঠল কৌশিকের৷ কিন্তু সেই ভয়ের অনুভূতি মিনিট খানেকও স্থায়ী হল না৷ তার আগেই ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলল সেই ডুবিয়ে দেওয়া গন্ধটা৷ কৌশিক চেষ্টা করছিল নিজেকে শক্ত রাখতে, আজ কিছুতেই ওই গন্ধের মোহে না ডুবতে কিন্তু পারল না হার মানল৷ ঘরটায় কৌশিক নিজে ছাড়াও অন্য একজনের উপস্থিতি রয়েছে, নিশ্চয়ই রয়েছে সেটা অনুভব করা যাচ্ছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে না৷ কানের ভেতর খুব মিহি কন্ঠস্বর পৌঁছচ্ছে ওর৷ যেন বহু দূর থেকে কেউ কথা বলছে৷ গলাটা…গলাটা কোনও মেয়ের…নাকি ছেলের? কিন্তু কোনও অল্পবয়েসির…সব মিলিয়ে কেমন বিবশ হয়ে গেল কৌশিক৷ ওই গন্ধের উৎসকে ভীষণভাবে কাছে পেতে ইচ্ছে হল…ও আর নিজেকে সামলাতে পারল না দুই হাত বাড়িয়ে বলে উঠল কে কে তুমি কে? আমার কাছে এস…প্লিজ আমার কাছে এসো আমি আর পারছি না…

.

তখনই খিলখিল করে একটা হাসি৷ কী মোহময়ী হাসি! খাট থেকে নামল কৌশিক৷ ওর মন আর ওর নিজের নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই৷ কে যেন ওকে বাইরের দিকে ডাকছে৷ গন্ধটা এখন কেমন যেন জমাট বেঁধে গিয়ে ওর আশেপাশেই ঘুরছে, ওকে ছুঁচ্ছে, আবেগে থিরথির করে উঠছে কৌশিক…প্রায় টলতে টলতেই ওই গন্ধের পিছু পিছু এগোতে থাকল ও৷ বারান্দা পেরিয়ে বাড়ির পিছনের দিকে সেই পুকুরের দিকে এগোতে থাকল, বার বার শুনেতে পাচ্ছে কে যেন ওর কানের সামনে বলছে, এসো, আমার সঙ্গে এসো…এসো…৷ মোহগ্রস্ত অবস্থায় এগোতে এগোতে একসময় ওই পুকুরঘাটের সামনে পৌঁছল কৌশিক৷ রাতের ঘসা আবছা আলোতে দেখল হ্যাঁ ওই তো পুকুরের ঘাটের একেবারে নিচের ধাপে সাদা ধোঁয়ার মতো কী যেন একটা…কে যেন একটা…সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গিয়েছে সেই অপূর্ব সুবাস আহ! পেতেই হবে ওই গন্ধটা নিজের গায়ে মাখতেই হবে নইলে জীবন বৃথা…এমন একটা ভাবনা ওর বোধকে গ্রাস করে ফেলল, তারপর ঘোরের মধ্যে ঘাটের সিড়ি দিয়ে নামতে থাকল ওই পুরনো, পানা, ঝাঁঝিতে ভরা পুকুর যেখানে একবার নামলে আর উঠে আসার উপায় নেই৷ ঝাঁঝিতে জড়িয়ে মৃত্যু অনিবার্য, সেদিকেই এগোতে থাকল কৌশিক৷ ওই যে সাদা ধোয়াটে অবয়বটা এখন অনেক স্পষ্ট নিটোল৷ একটি কিশোরীর শরীর, যেন মেঘ দিয়ে দিয়ে গড়া৷ জলে নেমে যাচ্ছে ওই শরীর এখনই ধরতে হবে তাকে এখনই, শেষ ধাপে নেমে পুকুরের জলে সবে পা দিতে যাবে কৌশিক তখনই ওকে পিছন থেকে কে যেন সপাটে জাপটে ধরল আর ধরামাত্রই জ্ঞান হারাল ও৷

.

চোখ মেলল যখন চারদিকে দিনের আলো৷ শুয়ে রয়েছে অচেনা একটা ঘরে৷ ছোট ঘর৷ মাথা ভার, দুই চোখ মেলতেও কষ্ট হচ্ছে৷

ঠিক লাগছে তো তোমার?

গলাটা চেনা লাগল কৌশিকের৷ অতি কষ্টে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল বাবলুদা বসে রয়েছে৷ প্রশ্নটা ওই করেছে৷ হ্যাঁ এবার ঘরটা চিনেছে বাবলুদার ঘর৷ এই মিত্রভিলায় আসার পর একবারই মাত্র এই ঘরে ঢুকেছিল কৌশিক৷ শোওয়া থেকে দুই হাতের কুনুইতে ভর দিয়ে উঠে বসল ও৷ গোটা শরীরে এত ব্যথা যেন বহুদিন ধরে অতিপরিশ্রম গিয়েছে৷

আমি এখানে!

বাবলুদার স্ত্রী এক কাপ চা এগিয়ে দিল কৌশিকের দিকে৷ চা নাও৷ কাল ও না থাকলে তুমি আর বাঁচতে না৷ ওই পুকুরে ডুবে মরতে৷

সঙ্গে সঙ্গে গতকাল রাতের কথা মনে পড়ল ওর৷ পুরো ঘটনাটা পর পর মনে পড়ল৷ নাহ আজ সকালে গত কয়েকদিন ধরে ওকে পাগল করে দেওয়া গন্ধটা বেমালুম উধাও…

এসব কী বাবলুদা? আমাকে বলুন৷

ছেড়ে দাও৷ কী হবে সবকিছু জেনে৷ আমার কথা শোনো, যদিও আজ থেকে আবার আগামী দিন পঁচিশেক তুমি মোটামুটি নিশ্চিন্ত থাকতে পার তবে সবটা নয়, ছেলেমানুষের খেয়াল কখন যে কী…

ছেলেমানুষ? কে ছেলেমানুষ? আপনি দয়া করে বলুন দাদা৷

কৌশিকের এমন কাতর অনুরোধে বাবলু একবার তাকাল ওর স্ত্রীর দিকে৷ স্ত্রীর নীরব সম্মতি পেয়ে বাবলু বলল, চা খাও, বলছি৷ কিন্তু এই কথা যেন তুমি ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ না জানে৷ মিত্রবাড়ির সম্মান জড়িয়ে রয়েছে এর সঙ্গে৷

কৌশিক চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে খেয়াল করল কাপের হ্যান্ডেল ধরা হাতটা থির থির করে কাঁপছে৷ আপনি বলুন৷

আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা৷ তা প্রায় পনেরো বছর তো হবেই, অরিন্দম দাদাবাবুর একটি বোন হয়েছিল৷ বাচ্চাটি কী বলব, সদ্যোজাত অবস্থাতেই এত সুন্দর ছিল যে একবার দেখলে তাকে কোলে নিতে ইচ্ছে করবেই৷ একেবারে রাজকন্যা৷ শুভাশিসবাবু তার মেয়ের নাম রেখেছিলেন রচনা৷ রচনা দিদি বড় হতে লাগল৷ যত দিন যায় আমার দিদিমণির রূপ যেন চাঁদের মতো ছড়িয়ে পড়ে আহা এমন সুন্দর মুখ দাদা আমি কেউ ভূভারতে কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না৷ যেমন সুন্দর দেখতে তেমনই মিষ্টি তার স্বভাব৷ সকলকে সে সমানভাবে ভালবাসত৷ ওই একরত্তি রচনা যেন এই মিত্রভিলায় নতুন করে আনন্দ ছড়িয়ে দিয়েছিল৷ আমরা বুঝতে পারতাম ও এই বাড়িতে আসার পর থেকে পরিবারের সকলেই কেমন আনন্দে থাকে৷ সবসময়েই যেন একটা খুশির পরিবেশ৷ আমাদের মনের ভেতরের সব দুঃখ, কষ্ট যেন দূর করে দিয়েছিল ওই মেয়ে৷ আমরা সকলেই ভাবতাম ও মানুষ নয় সাক্ষাৎ কোনও দেবী এসেছেন মর্তে৷ আর আমাদের এই ভাবনাটাই যে আর কিছুদিন পরে অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে তা আর কেই বা জানত৷ আমার সেই দিনটা এখনও মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়৷ সেদিন দুপুরবেলা ছিল৷ সম্ভবত রবিবার৷ কারণ বাড়ির সকলেই সেদিন তখন ঘরে৷ হঠাৎ রচনাদিদি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল৷ সবাই ছুটে গিয়ে দেখে বারান্দায় থোকাথোকা রক্ত, রচনাদিদির পা গড়িয়েও রক্ত নামছে আর দিদি ভীষণ ভয়ে ওই রক্ত দেখে চিৎকার করছে৷ আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে দিদি ওইদিন প্রথম ঋতুমতী হয়েছিল, বয়স তখন ওর বারো কি তেরো হবে, কিন্তু বয়সের তুলনায় ও ছিল অনেকটাই ছোট৷ মানে শরীরের বাড় সাধারণ মেয়েদের তুলনায় অনেকটাই বাড়ন্ত হলেও বুদ্ধি বিবেচনাবোধ তখনও ছোটদের মতোই৷ মানে নির্বোধ নয় কিন্তু সরল, একেবারে জলের মতো স্বচ্ছ৷ সারাক্ষণ হাসছে হৈ-হুল্লোড় করছে, ওর কাছে যে আসবে তার ওকে ভাল না বেসে উপায় নেই৷ আর দিদিমণিও আমার সকলকে আপন করে নিতে পারত৷ চেনা অচেনা যে কাউকে৷ তো রচনা মা’র যেদিন প্রথম অমন হল সেদিনই ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা৷ গোটা বাড়িটায় এক অপুর্বসুবাসে ভরে গেল৷ আমরা সকলেই যেন মোহিত হয়ে গেলাম সেই অপুর্ব গন্ধে৷ এ কোন ফুল? কিসের গন্ধ৷ প্রায় নিজেদের কাজকর্ম ফেলে রেখে সেই গন্ধের উৎস খুঁজতে লেগে পড়লাম আমরা বাড়ির প্রতিটা গাছ প্রায় খুঁটিয়ে দেখেও কেউ বুঝতে পারলাম না গন্ধটা কিসের৷ দিন কয়েক গন্ধটা থাকল আমাদের সকলকে যেন ডুবিয়ে রাখল সেই গন্ধ তারপর উধাও৷ আমরাও ভুলে গেলাম৷ পরের মাসে আবার যখন গন্ধটা পাওয়া গেল তখন প্রথমেই আমরা জানতে পারিনি উৎসটা কোথায়? পরদিন সকালে জানা গেল রচনা মায়ের আবার ওই ইয়ে মাসিক হয়েছে৷ আমি তো সেই খবর সরাসরি জানতে পারি না, আমার স্ত্রীর মাধ্যমে জেনেছিলাম আর কী৷ তবে আমি কর্মচারী হলেও মাত্র পনেরো বছর বয়েসে ওই বাড়িতে কাজে লেগেছিলাম৷ ফলে থাকতে থাকতে ওই মিত্র বাড়ির একজন সদস্য হয়ে উঠেছিলাম৷ বাড়ির সবরকম সমস্যা, আলোচনাতে আমাকেও ডাকা হত৷ আমার স্ত্রীও হয়ে উঠেছিল মিত্র পরিবারের একজন সদস্য৷ সেইবারে আর তারপর থেকেই অমন…বিশ্বাস করবে না দাদা…ওই গন্ধে আমরা যেন আবার পাগল পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম৷ রচনা কাছাকাছি এলেই সেই গন্ধটা এত তীব্রভাবে এসে নাকে ঝাপটা দিত যে নিজেকে স্থির রাখা দায় হত, মাথা খারাপ হয়ে যেত৷ আমি দৌড়ে পালাতাম৷ নিজের মেয়ের মতো যাকে দেখি তাকে ওই গন্ধটার জন্য এক এক সময় খারাপ চিন্তা চলে আসত…ঠিক কেমন…তুমিও তো টের পেয়েছ বলো তাই না? আর এইভাবেই চলতে থাকল প্রতিমাসের কয়েকটা দিন৷ এই আমার বউয়ের সামনে আমি আজও স্বীকার করছি হ্যাঁ গোটা মাস আমি অপেক্ষা করতাম কবে রচনা মায়ের ওইদিনকটা আসবে৷ মহুয়ার গন্ধে যেমন নেশা হয় তেমনই নেশা ধরে গিয়েছিল আমার৷ হয়তো বাড়ির সকলেরই৷ কিন্তু বাড়ির মেয়ে বলে কথা…কেই বা এমন গোপন সত্যিকে নিজের মুখে স্বীকার করবে বলো? বেশ কয়েকজন ডাক্তার দেখানো হল, তারা ইয়ে পরীক্ষা- টরিক্ষা করে জানালেন তেমন অস্বাভাবিক কিছুই নেই ওতে, অথচ গন্ধটা রয়েছে আর তা কীভাবে তৈরি হচ্ছে তার ব্যাখ্যা তাদের কাছে নেই৷ তখন মা, মানে রচনাদিদির মা বাড়িতে এক সিদ্ধ সন্ন্যাসীকে ডাকলেন৷ তিনি অনেক দেখেশুনে বললেন রচনা আসলে মানুষের রূপ নিয়ে পৃথিবীতে এলেও এ আসলে কোনও শাপভ্রষ্ট দেবী৷ তবে ক্ষতিকারক নয়, ওকে ওর মতোই বড় হতে দিন৷ মিত্র পরিবারের সৌভাগ্য যে দেবীকে গৃহে পেয়েছে৷ এইসব কিছু বলার পর তিনি শুধু একটাই কথা বললেন৷ তবে সাবধান…খুব সাবধান৷ এ কিন্তু পরিবারের কাছে এক কঠিন পরীক্ষা৷ একটু পদস্খলন হলেই ঘোর বিপদ৷ ভয়ংকর বিপদ৷ অনর্থ হয়ে যাবে৷ সাবধান!

আর কিছুই না বলে সেই সন্ন্যাসী চলে গেলেন৷ তারপর বছরও ঘুরল না…ওহ…সে কী ভয়ংকর ঘটনা! একদিন রাতে সকলে যখন ঘুমোচ্ছে রচনা এই পুকুরে এসে জলে ডুবে আত্মঘাতী হল৷ পরের দিন ভেসে উঠেছিল ফুলের মতো সুন্দর শরীরটা৷ ওহ সেই দৃশ্য যে কী ভয়ংকর৷ আর তার থেকেও আরও ভয়ঙ্কর খবর হল…বলে একটু থামল বাবলু৷ ওর ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ছে…

কৌশিক প্রায় দম বন্ধ করে অপলক তাকিয়ে শুনে যাচ্ছে বাবলুর কথা৷ চা ঠান্ডা হয়ে কাপেই পড়ে রয়েছে৷ কী খবর হল বলুন৷

পুলিশে খবর দেওয়া ছাড়া আর উপায় ছিল না আর পুলিশ বডি মর্গে নিয়ে গেল৷ পোস্টমর্টেমে জানা গেল…বলে আবার একটু থেমে নিচু গলায় বাবলু বলল রচনা অন্তঃসত্ত্বা ছিল৷

হোয়াট! মুখ বিকৃত করে প্রায় চিৎকার করে উঠল কৌশিক৷ ওইটুকু মেয়েকে…!

হ্যাঁ অমন ফুলের মতো একরত্তিমেয়েটাকেও…সব থেকে বড় কথা হল, মাসের ওই কয়েকদিন রচনাকে স্কুলে যেতে যেওয়া হত না, বাইরেও ছাড়া হত না, ওই রকম মন মাতাল করে দেওয়া গন্ধটা ওই দিনকটায় ওর শরীর থেকে বেরোত বলেই সাবধানতার কারণে ওকে বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া হত না৷ ও যখন সুইসাইড করে তখন ওর মাসিক চলছিল৷ সাধারণত ওই সময়ে মেয়েরা অন্তঃসত্ত্বা হয় না, কিন্তু একেবারেই হয় না তাও নয়৷ রচনা হয়ে গিয়েছিল৷

কে করল এমন?…তাহলে কে?

পুলিশকে এই খবর দেওয়ার পর সন্দেহ এসে পড়ল আমার ওপর যেহেতু আমিই পরিবারের বাইরের লোক৷ আমার জেরা, পরীক্ষা ইত্যাদি সব হল৷ এবং আমি নির্দোষ প্রমাণিত হলাম৷ তারপর পরিবারকে চূড়ান্ত লজ্জা থেকে বাঁচানোর জন্যই হয়তো শুভাশিসবাবু কিছু বড় জায়গার প্রভাব খাটিয়েছিলেন কারণ তারপরেই পুলিশ সেই কেস পুরো চাপা দিয়ে দিল৷ মিডিয়া ইত্যদি কিছুই জানল না৷ আর তার কিছুদিন পরেই মিত্র পরিবার থেকে যেন আনন্দ শব্দটাকেই কেউ মুছে দিল৷ অরিন্দমদাদার সাঙ্ঘাতিক অ্যাক্সিডেন্ট হল, মানে বাড়ির ছাদ থেকে একদিন রাতে পড়ে গেলেন৷ যদিও আমার মনে হয় না উনি পড়ে গিয়েছিলেন, কারণ রেলিং দেওয়া ছাদে যদি কেউ ইচ্ছে করে না ঝাঁপ দেয়…যাই হোক প্রাণে বেঁচে গেলেন তিনি৷ আর তারপর থেকে দাদা প্রতিমুহূর্তে সবকিছুকে ভয় পেতেন, একেবারে ছিটিয়ালটাইপ হয়ে যাচ্ছিলেন৷ মাঝেমাঝে এমনিই চিৎকার করতেন, বিড়বিড় করতেন৷ অনেক ডাক্তার দেখানো হল৷ ডাক্তার বললেন, এই বাড়িতে থাকলে উনি কোনওদিন সুস্থ হবেন না, ওর ভেতরে একটা শক রয়েছে৷ এখান ছেড়ে আপনারা চলে যান৷ তাই করলেন শুভাশিসবাবু৷ এই বাড়ি ছেড়ে সপরিবার চলে গেলেন৷ বাড়ি দেখাশোনার ভার দিয়ে গেলেন আমাকে৷ সবাইকে জানানো হল অরিন্দমদাদাবাবু বাইরে চাকরি পেয়েছে বলে যাওয়া হয়েছে৷ আসলে তা নয়, বরং দাদাবাবুর মনের রোগ আজও সারেনি৷ বরং শুনেছি আরও বেড়েছে৷ বাড়িতেই থাকেন৷ আর বড়কর্তা মানে শুভাশিসবাবুই এখনও সংসার চালান৷ যদিও টাকার অভাব নেই, কিন্তু তবু সংসারটা ছাড়খাড় হয়ে গেল দাদা, অমন ফুলের মতো মেয়েটাও শেষ হয়ে গেল, আর অরিন্দম দাদাও অল্পবয়স থেকে খুব বিলিয়ান্ট ছিল৷ পড়াশোনায় দারুন৷ সকলের আশা ছিল বড় হয়ে মস্ত কিছু একটা হবে৷ কিন্তু…এমনই কপাল…কী যে হল…কে যে…অন্যায়টা করেছিল তা আর জানা গেল না…তবে যেই করুক শাস্তি নিশ্চয়ই তার হবেই৷

দীর্ঘ কথা শেষ করে থামল বাবলু৷ তারপর আবার বলল এই মিত্রভিলা অভিশপ্ত হয়ে গিয়েছে দাদা, রচনা দিদিমনি আজও এখানে ঘোরে, আমি টের পাই, প্রতি মাসের ওই কয়েকটা দিন ঠিক তেমনই গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে৷ আমি এতবছর ধরে সেই গন্ধ পেয়ে অভ্যস্ত তবু যেন এখনও এই বুড়ো বয়েসেও সেই গন্ধে ভেতরটা তাজা জোয়ান হয়ে ওঠে…নিজেকে শক্ত রাখি৷ জানি কয়েকদিন পরেই গন্ধ মিলিয়ে যাবে৷

সেই কয়েকটা দিন বুঝি আমি যেদিন এই বাড়িতে এলাম তারপরের দিন থেকে শুরু হয়েছিল? জিজ্ঞাসা করল কৌশিক৷

হ্যাঁ ঠিকই বলেছ৷ আমার ভয় হচ্ছিল তোমাকে নিয়ে৷ যদি কিছু অঘটন বাঁধিয়ে বস৷ রচনা দিদিমনির আত্মা শান্তি পায়নি৷ প্রথম দিকে আমিও একবার ওই গন্ধে মেতে পুকুরে ডুবে মরতে গিয়েছিলাম আমার স্ত্রী ঠিকসময় এসে বাঁচিয়েছিল৷ আর কাল আমার মন বলছিল তুমি নিশ্চয়ই কিছু একটা করবে তাই আমরা কাল রাতে দুজনেই ঘরের জানলা দিয়ে তাকিয়ে বসেছিলাম এই পুকুরের দিকে৷ আর ছাদে যাওয়ার দরজাতেও তালা দিয়ে এসেছিলাম যাতে তুমি ছাদে না যেতে পার৷ দেখলাম তুমি পুকুরের দিকে আসছ তখনই আর দেরি করিনি৷ হয়তো কথাগুলো তোমাকে আগে বলে দিকেই ভাল হত, কিন্তু সংকোচ লাগে, বোঝোই তো এতবছর এই বাড়ির নুন খেয়েছি, এই বাড়ির কলঙ্ক আমার গায়েও লাগে৷

ঘরের মধ্যে সকলেই চুপ৷ কৌশিকের চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠলছিল একটা আবছা একটা তেরো চোদ্দ বছরের নিষ্পাপ শরীর, আর একটা গন্ধ…যে গন্ধে গোটা পৃথিবী ডুবে মরতে পারে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *