বডি

বডি

ইয়াসিনের পাঁজর বার করা শুকনো নির্লোম বুকে আঙুল দিয়ে খোঁচা দিয়ে পিউ বলল, শুধু শায়েরি করলে হবে? পেটে একটু নুনপান্তাও তো দিতে হবে নাকি? যা চেহারা হয়েছে আর খুব বেশিদিন বাঁচবি বলে মনে হয় না৷

ইয়াসিন পিউয়ের কথায় হাসল৷ কথাটা মিথ্যে নয়৷ চব্বিশ বছরের ইয়াসিন আনোয়ারের চেহারাটা আগুনে ঝলসে যাওয়া গাছের মতো৷ পোড়া, খটখটে শুকনো৷ একবার তাকালে যে কেউ বুঝবে ছেলেটার জীবনের সব রস শুকিয়ে গিয়েছে৷ নেহাৎ টিঁকে রয়েছে এই যা৷ অতিরিক্ত রোগা বলে ছয়ফুট উচ্চতার ইয়াসিন অল্প বয়েসেই কোলকুঁজো৷ ইয়াসিন সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত খাটে৷ এই সন্ধ্যানগর জুটমিলের ইয়াসিন হল গোডাউন সুপারভাইজর৷ যদিও এই কাজ করতে ওর অসহ্য লাগে৷ সেই নাইনিটিন সিক্সটি ফোরে মজফফরপুর থেকে ইয়াসিনের বাবা ফারুক হোসেন কাজের খোঁজে কলকাতায় চলে এসেছিল সপরিবার৷ পরিবার বলতে চার বছরের ইয়াসিন আর স্ত্রী জাহেদা৷ কলকাতায় বেশ কিছুদিন কাজের সন্ধান করে তেমন কিছু সুবিধার জুটল না৷ শেষে কলকাতা থেকে বেশ খানিকটা দূরে গঙ্গার ধারে বহু পুরনো সন্ধ্যানগর জুটমিলে ঠাঁই মিলল৷ লেবার হয়ে ঢুকে সুপারভাইজর পদ পর্যন্ত উঠেছিল ফারুক৷ মিলের কোয়ার্টারেই থাকার জায়গা৷ একটা সময় ছিল যখন এই রাজ্যে জুটমিলের রমরমা বাজার৷ গঙ্গার ধার ঘেঁসে অজস্র মিল গড়ে উঠেছিল৷ কম বেশি প্রতিটা চলত ভাল৷ এই সন্ধ্যানগর জুটমিলও প্রতিবছর বেশ ভাল লাভের মুখ দেখত৷ শ্রমিক কর্মচারীদের মাইনে বোনাস, ওভারটাইম ছিল ভাল৷ সন্ধ্যানগর রেলস্টেশন ছিল একটা জংশন৷ কর্ড আর মেনলাইন এখান থেকে দুইভাগ৷ ফলে এই জংশন এবং জুটমিলকে ঘিরে সন্ধ্যানগরে গড়ে উঠেছিল সন্ধ্যাবাজার নামে এক বিশাল পাইকারি বাজার৷ সেখানে কাঁচা আনাজ থেকে মুদি সবকিছুই পাওয়া যায়৷ পাইকারি বাজার হওয়ার ফলে সেখানে প্রতিদিন উদয় অস্ত নানা ধরণের মানুষের আনাগোনা শুরু ৷ বাজারে আসা মুটেমজুর ব্যাপারীদের একটু বিশ্রাম আর আমোদ আহ্লাদ দিতে স্টেশন আর সন্ধ্যাবাজারের মাঝামাঝি জায়গায় ধীরে ধিরে গড়ে উঠল একটি পতিতাপল্লী৷ সেই পল্লীর বেশ্যারাও গরিব আর তাদের কাস্টমারও কেউ উচ্চবিত্ত নয়৷ সবমিলিয়ে ছাপোষা ব্যাপার৷ এখানে বেলফুলের মালা বিক্রি না হলেও, একটা দিশি এবং দুটো বিলিতি মদের দোকান চপ, ঘুগনির দোকান দিব্বি চলতে থাকল৷ কোনও রসিকমানুষ কোনওকালে এই পতিতাপল্লির নাম দিয়েছিলেন সন্ধ্যারতি৷ সেই নামই মুখে মুখে ছড়িয়ে ওটাই থেকে গেল৷ কলকাতার সোনাগাছির বাচ্চা সাইজ-এর এই সন্ধ্যারতি দিব্বি রমরমিয়ে চলতে থাকল৷ ছোটছোট গুমটি ঘর, টিনের ছাউনি৷ প্রতিটি ঘরে একজন করে গরিব ঘরের আলগা রঙমাখা প্রজাপতি অপেক্ষা করত, জুটত খদ্দের৷ অল্প পয়সায় কিছুটা সুখ৷ কোনও ব্যাপারী আবার রাতেও থেকে যেত সামান্য বেশি পয়সা দিয়ে, পরের দিন ভোরের ট্রেনটা ধরে ফিরবে বলে৷

তো ফারুকের কোনও মেয়েছেলের দোষ ছিল না, কিন্তু সন্ধে হলেই পুরো বোতল দিশি না হলে তার চলত না৷ এইটুকুও সহ্য করে নেওয়া যাচ্ছিল কিন্তু জুটমিলের বাজার যখন পড়তির দিকে, বোনাস, ওভারতাইম তো দূর কি বাত মাইনেও অনিয়মিত হতে শুরু করেছে তখন মদের পিছনে টাকা ঢালা আর বরদাস্ত করল না জাহেদা৷ লাগল অশান্তি৷ রোজের ঝগড়াঝাঁটি দেখতে দেখতে কিশোর আনোয়ার হাঁফিয়ে উঠত৷ বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করত না৷ ধুঁকতে ধুঁকতে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়াশোনা করে আর ইস্কুলমুখো হ’ল না৷ আসলে জগতের কোনও হইচই ই ভাল লাগত না আনোয়ারের৷ বরাবর চুপচাপ, অন্তর্মুখী৷ শুধু তাই নয় কল্পনাবিলাসী এবং জেদি৷ ক্লাস নাইনে পড়ার সময় স্কুলের এক বন্ধু ক্লাসে নিয়ে এসেছিল হিন্দী প্রেমের শায়রি নামে একটি চটি বই৷ বইয়ের মলাটে হিন্দী নায়ক নায়িকার ছবি ছিল৷ বইটা সবাই কাড়াকাড়ি করছিল বটে কিন্তু দুই একটা পাতা ওল্টানোর পরই তেমন রগরগে কিছু না থাকায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিল৷ কিন্তু ইয়াসিন দুই একটা পৃষ্ঠা পড়ার পর কেমন যেন মনের ভেতরটা করে উঠেছিল ওর৷ কী সুন্দর শব্দগুলো! কী সুন্দর কথা! অনেক শব্দেরই মানে বুঝতে পারেনি আনোয়ার, কিন্তু শব্দের ভেতরে যে একটা সুর থাকে সেটা ওকে নাড়া দিয়েছিল৷ বইটা নিয়ে এসেছিল বন্ধুর কাছ থেকে৷ সারারাত ধরে পরেছিল৷ কী অদ্ভুত এক ভালোলাগার অনুভূতি৷ নেশা ধরে গেল৷ বইয়ের স্টল থেকে ওই ধরনের সস্তার শেরশায়রির বই খুঁজে খুঁজে বার করে তাতে মুখ ডুবিয়ে পড়া৷ উর্দুটু হিন্দি পকেট ডিকশনারি কিনে শব্দের মানে বুঝে নেওয়া চলতে থাকল বেশি কিছুদিন৷ পড়তে পড়তে একদিন ইয়াসিন নিজেই লিখে ফেলেছিল—

ঔর উসকো দিলায়গা চ্যায়ন ক্যায়সে

দেখেঙ্গে উয়ো হমসে মিলায়গা নয়ন ক্যায়সে

হম উনসে হর কর ভি রখতে হ্যায় খুশ বহোত

দেখনা উয়ো জিত কর ভি রহেঙ্গা বেচয়ন ক্যায়সে৷

এই চারটে লাইন লেখার পর ঠিক কী যে হয়েছিল ইয়াসিন আনোয়ারের ও নিজেও জানে না৷ শুধু এইটুকু বুঝতে পেরেছিল খোদাতাল্লা ইনসানকে যখন এই দুনিয়ায় পাঠান তার সঙ্গে একটি খেলও পাঠান তা হল তার আনন্দ৷ দুজনকে একসঙ্গে তিনি কখনই পাঠান না৷ ইনসানের কাজ হল তার আনন্দকে খুঁজে নেওয়া৷ নসীবওয়ালা হলে চট করে খঁজে পাওয়া যায় আর বদনসীব হলে আজীবন ঘুরেও ইনসান তার আনন্দকে খুঁজে পায় না৷ ইয়াসিন পেয়ে গিয়েছিল৷ ওই ষোল সতেরো বছর বয়েসেই ও পেয়ে গিয়েছিল সেই আলাদিনের চেরাগ৷ সকলকে লুকিয়ে লিখতে শুরু করল ইয়াসিন৷

কিন্তু কথায় বলে প্রতিভা ঢেকে রাখা যায় না৷ সে কখনও না কখনও উপচে পড়বেই৷ তাই হল৷ ক্লাসের খাতার পিছনে একদিন ক্লাসটিচার নিজামুদ্দিন স্যর দেখলেন লেখা রয়েছে—

হর জনিব কোই তুমকো আপনা মিলেগা

কোই ভি নেহি তুমকো মগর হামসা মিলেগা৷

জখম এ মুহব্বত কভি ভরতা হি নেহি হ্যায়

যব ভি মিলোগে তুমকো ইয়ে তাজা মিলেগা

বদলতে ওয়ক্ত কে হমরহ হাম নেহি বদলে

ইয়াসিন উনহি দিনোসা তুমকো তনহা মিলেগা৷

শুধু এটা নয়, আরও এবং আরও লেখা৷ নিজামুদ্দিন ওর সবকটা খাতা জমা নিয়ে নিলেন তারপর সব পড়ে স্কুল ছুটির পর ওকে ডেকে বললেন স্কুলের খাতায় এইসব লিখিস না৷ এই নে, তোকে এটা দিলাম এতে লিখবি৷ প্রতিদিন লিখবি, তোর লেখার হাত রয়েছে৷ আল্লাহর ফেরেস্তা হল শায়র৷ তুই লেখ বাবা৷ অনেক লেখ৷ বলে ছাত্রটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন৷ আর এই খবরটা দাবানলের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল কালসের বন্ধুমহল থেকে গোটা স্কুল থেকে ইয়াসিনের মহল্লায়৷ ইয়াসিন আনোয়ার একজন শায়র৷ ব্যাপারটা প্রথমদিকে ভাল লাগত ইয়াসিনের৷ লিখে বন্ধুদের শোনাত, বন্ধুরা বাহ বাহ করত৷ নিজামুদ্দিন স্যরও শুনতেন৷ প্রশংসা করতেন৷ তারপর একদিন ইয়াসিনের আর স্কুল যেতে ভাল লাগল না৷ ছেড়ে দিল৷ ফারুক বললেন স্কুল ছেড়েছিস যখন কাজে লেগে পড়৷ বলে ওকে ঢুকিয়ে দিলেন পরিচিত একটা লেদ মেশিন কারখানায়৷ সারাদিন ধাতব চ্যাঁ চোঁওওও শব্দ শুনতে শুনতে পাগল হয়ে যাচ্ছিল ইয়াসিন৷ বাড়ি ছেড়ে পালাবে ভাবছিল৷ তখন এক বন্ধুর সহায়তায় পেয়ে গেল বেশ ছিমছাম একটা কাজ৷ সন্ধ্যাবাজারের মধ্যে একটা চালের পাইকারির দোকানে খাতা লেখা৷ ছাদ ছোয়া চালের বস্তার আড়ালে সারাদিন বসে আনোয়ার জমা খরচের হিসাব আর শায়েরি লেখে৷ মানুষের দেখা মেলে কম৷ ওই বয়েসেই হাতে টাকা৷ ফলে সেই টাকার সদব্যবহারের থেকে বদব্যবহারের ঝোঁকই বেশি থাকে৷ আর ইয়াসিনের মতো কবির পক্ষে জীবনে সাবধানে চলা খুব কঠিন৷ তাই শায়রিতে আরও মাদকতা আরও রস মেশাতে উনিশ বছর বয়সেই হাতে গেলাস তুলে নিয়ে বলল—

দস্ত এ সাকি সে আগর সরাব মিলে

শ হজো কা মুঝে শবাব মিলে

খুম পেখুম ভরকে ম্যায় পিউ জাহিদ

অচ্ছি হো ইয়া খরাব মিলে

দস্ত এ সাকি সে অগর সরাব মিলে৷

অবশ্য সন্ধ্যাবাজারের মধ্যে একমাত্র দিশি মদের ঠেকটায় ইয়াসিনকে সরাব এগিয়ে দেওয়ার জন্য তেমন কোনও সাকি ছিল না৷ ওখানে কাউন্টারে টাকা গলিয়ে নিজের বোতল নিজেকেই নিতে হত৷ তারপর ছোলাসেদ্ধ বা ঘুগনি দিয়ে বোতল শেষ করা৷ শের আর জাম দুটো নেশা চলতে চলতে ওই দিশি বারেরই এক জুটে যাওয়া বন্ধু একদিন ইয়াসিনকে নিয়ে গেল সন্ধ্যাবাজারের সেইখানে যেখানে সারে সারে সাকিরা সপেক্ষা করে বসে থাকে গেলাসে জাম ঢেলে দেওয়ার জন্য৷ ওইখানেই কয়েকদিন যাতায়াত করতে করতে একদিন পরিচয় হয়ে গেল পিউএর সঙ্গে৷

.

ইয়াসিনের হাসি দেখে গা চিরবির করে উঠল পিউএর৷ আবার দাঁত ক্যালাচ্ছিস! তুই মিলিয়েছিস যে রেটে মাল খাস, আর পাঁচ বছরও বাঁচবি বলে মনে হয় না৷

পিউয়ের কথায় আবারও হেসে উঠল ইয়াসিন৷ ডান হাতটা সামান্য শূন্যের দিকে তুলে বলল—

লায়ি হায়াৎ, আয়ে

কজা লে চলি, চলে

ন অপনে খুশিসে আয়ে হ্যাঁ

ন অপনে খুশি চলে৷

জীবন নিয়ে এসেছিল৷ মৃতু নিয়ে যাবে, নিজের ইচ্ছেয় আসিওনি, নিজের ইচ্ছেতে ফিরেও যেতে পারব না৷

উফ সবসময় ছড়া বলিস না তো৷ বলে ইয়াসিনের লম্বা চুলগুলোকে খামচে টেনে দিল পিউ৷ মুখে বিরক্তি দেখালেও মনে মনে ইয়াসিনকে বেশ কিছুটা ভালবেসে ফেলেছে ও, বেশ্যারা খদ্দেরদের টাকা ছাড়া আর কিছু ভালবাসে না, ভালবাসতে নেইও৷ খদ্দেররাও বেশ্যাদের ওই শরীরটা ভোগ করার সময়টুকু ছাড়া আর কোনও মায়ায় জড়ায় না৷ এটাই রীতি, কিন্তু তবু মাঝেমাঝে পৃথিবীতে নানা রকমের দুর্ঘটনা ঘটে৷ অনেক হিসেব ওলোটপালট হয়ে যায়৷ এই যেমন ইয়াসিন আর পিউএর মোলাকাত৷ ঘটেছিল আচমকাই, ইয়াসিন সেই রাতে তার সেই রাতের সঙ্গীনির ঘর থেকে প্রায় গলাধাক্কা খেয়েই বেরিয়ে আর খুব বেশি পা এগোতে পারেনি, উলটে পড়ে গিয়েছিল পিউয়ের ঘরের সামনে৷ পিয়ের সেদিন খদ্দের হয়নি, মেজাজ খারাপ ছিল৷ তার ওপরে আবার এমন উটকো এসে দোরের সামনে উলটে পড়ে গেলে কার মাথার ঠিক থাকে৷ হতভাগাটাকে হাত ধরে টেনে সরাতে গিয়ে মুখটা দেখে কেমন একটু মায়া লেগেছিল পিউ-এর৷ সরিয়ে দেওয়ার বদলে পট্টির দালাল শিবুর সাহায্য নিয়ে ছেলেটাকে নিজের ঘরে ঢুকিয়ে নিয়েছিল৷ নইলে সারারাত ওইভাবে বাইরেই পড়ে থাকবে৷ পরদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর ইয়াসিনের পরিচয় হয়েছিল পিউয়ের সঙ্গে৷ তারপর থেকে ইয়াসিন পিয়ের কাছেই আসে৷ দেখতে দেখতে পায় দেড় বছর…পিউ মাঝেমাঝে ভাবে ও ইয়াসিনকে বেশী ভালবাসে নাকি বলা ওই ছড়াগুলো৷ কী সুন্দর যে লাগে শুনতে৷ ইয়াসিন অনেকবার বলেছে, এগুলোকে ছড়া বলে না, শের বলে৷ পিউ খিলখিল করে হেসে বলে ধেত শের মানে তো বাঘ! হাল ছেড়ে দিয়েছে ইয়াসিন৷

ইয়াসিন বলল আআহ চুল ছাড় লাগছে৷

না ছাড়ব না, বলে আরও জোরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলল, মহা শয়তান তুই! খুব যে বড় বড় কথা বলছিস, মরে গেলে তোকে কবর দেওয়ার লোকও তো পাবি না রে৷ বাপ মা তো লাথ মেরে ঘর থেকে দূর করেই দিয়েছে৷ তোর বোতলের বন্ধুরা কেউ ছুঁতেও আসবে না৷

শুনে ইয়াসিন হাসল৷ বলল, আমি মরে গেলেও আমার বডির ডিমান্ড থাকবে বুঝেছিস৷ সেই ব্যবস্থা করে ফেলেছি৷ রাত আটটার সময় পিউ-এর ঘরে এই কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে পিউ চমকে উঠে বলল, মানে?

মানে? বলে রহস্যময় হাসল ইয়াসিন৷ ব্যাপার কী হয়েছে জানিস, আমি বেশ অনেকদিন ধরেই ভাবি এই যে আমি শের লিখছি, মদ খাচ্ছি, রোজ তোর কাছে আসছি, কাজ করছি, একদিন মরে যাব, কেউ কিছুই জানবে না৷ দুদিনও কেউ আলোচনা করবে না আমাকে নিয়ে, তাহলে কী করতে এলাম? এই দুনিয়ায় থেকে এতদিন তার থেকে এতকিছু নিয়ে তাকে কী দিলাম আর মনে রাখার মতই বা কী করলাম৷ পোকা মাকড়ও তো জনাম্য মরে যায়, তাহলে আমার আর পোকার মধ্যে পার্থক্য কী? কিছুদিন আগে আমার প্রিয় সায়র ফিরাখ গোরখপুরীর একটা শের পড়ছিলাম, ফিরাখ লিখেছেন—

আনেওয়ালি নসলেঁ তুম পর রশক করেঙ্গি হামস্রু

যব ইয়ে উনকো ধেয়ান আয়গা তুম নে ফিরাক কো দেখা হ্যায়৷

কিন্তু আমি তো ফিরাক নয়, তার নখের ধুলো হওয়ার যোগ্যতাও নেই আমার, তাহলে আমি কী করব? কী করলে আমি মরে গেলে কেউ না হলেও অন্তত তুই মনে রাখবি হাঁ ম্যায়নে ইয়াসিন কো দেখা হ্যায়৷ আমি ভাবছিলাম বুঝলি, ভাবতে ভাবতে একসিন সুযোগ জুটে গেল৷ বলে ইয়াসিন উঠে বসল৷ চৌকির পায়ার কাছে রাখা রামের বোতলটা হাতে নিয়ে র একঢোঁক খেয়ে আবার ওটা রেখে দিয়ে বলল, আমাদের মহল্লায় কয়েকদিন আগে রক্তদান শিবির ছিল৷ পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, থেমে গেলাম৷ ইচ্ছে হল রক্ত দিই৷ ওজন মেশিনে আমার ওজন দেখে ডাক্তার বলল ওজন খুব কম, ব্লাড দেওয়া যাবে না৷ মন খারাপ করে ফিরে আসছিলাম৷ একটা ছেলে ডাকল৷ আমাকে জিজ্ঞাসা করল মরনোত্তর দেহদান করবেন? জিজ্ঞাসা করলাম সেটা কী?

ছেলেটা বলল, আপনি মারা যাওয়ার পর আপনার বডি জ্বালিয়ে দেওয়া হয় কিংবা দফন করে দেওয়া হয়, মানুষের কোনও কাজেই আসে না৷ কিত্নু যদি আপনি আপনার বডি দান করে যান তাহলে মানুষের অনেক উপকার হবে৷ আমি জিজ্ঞাসা করলাম কী উপকার হবে ভাই? ও বলল আমার বডি নাকি মেডিকেল কলেজে যে ডাক্তাররা পড়াশোনা করে তাদের অনেক কাজে লাগবে৷ আমার বডির যেসব আইটেমগুলো ভাল রয়েছে যেমন চোখ, কিডনি তারপর…লিভার…না না আমার লিভার নেওয়ার মতো নয়, বাকি অন্য যা সব রয়েছে সেগুলো খুলে জীবিত যাদের এগুলো দরকার ডাক্তাররা তাদের শরীরে এগুলো সেটিং করে দিতে পারবে তারা বেঁচে যাবে৷ তারপর অনেক রিসার্চ করতে পারবে৷ তো আমি দেখলাম বেঁচে থেকে তো কারও হেল্প করতে পারলাম না, আর কদিনই বা বাঁচব তো মরে গিয়ে যদি দুটো মানুষের হেল্পে লাগি তো খারাপ কী? আর এমনিতেও আমি মরলে দফন করার জন্যও কেউ থাকবে না, তোর এখানে যদি মরি, তুইও বিপদে পড়বি৷ তো তার থেকে বডি দান করে দিলে ব্যাস, কেউ একজন ওখানে ফোন করে দিলেই ওরা এসে নিয়ে যাবে৷

ইয়াসিন এমন শজভাবে কথাগুলো বলছিল যেন মরাটা ওর কাছে কোনও ব্যাপারই না, বেঁচে রয়েছি সেটাই আশ্চর্যের৷ পিউ এতদিনে ইয়াসিনকে অনেকটাই বুঝেছে৷ ও যে সবসময় শরীরের লোভ নিয়ে এখানে আসে তাও নয়, কোনওদিন এসে অনর্গল শুধু কথা বলতে থাকে, কোনওদিন আবার এসেই বলে আজ তোর গল্প শুনব, আবার একএক দিন এসেই বলে আজ খুব ক্লান্ত একটু ঘুমোতে এসেছি৷ পিউ হাসে, মজা পায়, এমন খদ্দেরও হয়! আর এই জন্যই হয়তো ভাললাগে ইয়াসিনকে৷ পিউ বোঝে ছেলেটার ভেতরে একটা অন্যরকমের ক্ষিদে রয়েছে৷ কিন্তু সেই ক্ষিদে কেমন তা ও নিজেও বোঝে না৷

এসব কী বলছিস তুই? এত মরা শখ যখন যা না গিয়ে গলায় দড়ি দে, কিংবা ট্রেন লাইনে গলা দে, আমার কাছে এসে দিন রাত পরে থাকিস কেন?

ইয়াসিন রাজেশখান্নার গলা নকল করে পুস্পা মুঝে নেহি মালুম কিউঁ ইয়াহা আতা হুঁ৷ সায়দ তুমহে নেহি দেখকর চয়ন নেহি আতে ইসি লিয়ে আতা হুঁ৷

হুঁহ আর ঢং করিস না! একদিকে অবশ্য ভালই করেছিস৷ কোনদিন রাস্তাঘাটে মরে পড়ে থাকবি শেয়াল কুকুরে খাবে তার থেকে ওই ক্যাচড়া বডি দান করে দেওয়াই ভাল বলতে বলতেই পিউ দেখল ওর এই কথাগুলো বলতে ভাল লাগছে না৷ মন খারাপ হয়ে উঠছে৷

ইয়াসিন হা হা করে হেসে উঠল৷ আরেক চুমুক মদ খেয়ে বলল দাঁড়া একটা জিনিস দেখাই তোকে৷ প্যান্টের হিপপকেট থেকে মানিব্যাগটা বার করে সেখান থেকে একটা কার্ড বার করল ইয়াসিন৷ পিউএর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল এই দেখ, এটা হল বডি ডোনেশনের কার্ড৷ বেঁচে থাকতে তো কারও উপকারে লাগলাম না, মরার পর যদি কয়েকজনের কাজে লাগি… এটার দাম আমার কাছে আধার, ভোটার, এটিএম কার্ডের থেকে অনেক বেশি, বুঝলি৷

পিউ ইয়াসিনের কাছ থেকে কার্ডটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল৷ ওর ছবি দেওয়া কার্ডটায় নাম ধাম ইত্যাদি লেখা৷ আর কার্ডের অপর পিঠে সংস্থার নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার ইত্যাদি৷ ভারি অদ্ভূত লাগছিল পিউএর৷ বসিরহাটের মেয়ে পিউ ক্লাস সিক্স পাশ করার পর আর স্কুল যেতে পারেনি৷ ভ্যানওলা বাবার চারটে ছেলে মেয়ের মুখে দুইবেলা জোটে কি জোটে না৷ বয়সের সঙ্গে লাফিয়ে বাড়ছিল খিদে৷ পেটের টানেই চোদ্দবছর বয়েসে প্রথম নিজের শরীর ছুঁতে দিয়েছিল পাড়ার শিবুদাকে৷ কুড়ি টাকা পেয়েছিল৷ সেই শুরু৷ সহজে রোজগারের পথটা খুব দ্রুত ধরে নিয়েছিল পিউ৷ ছোটবেলায় পাড়ার মল্লিকাপিসিকে দেখে জীবনে খুব স্বপ্ন ছিল নার্স হওয়ার৷ রুগীদের সেবা করত বলে পাড়ায় মল্লিকাপিসিকে সকলে খুব শ্রদ্ধা করত৷ সেইজন্য বড় লোভ ছিল অমন হওয়ার৷ সেই স্বপ্ন মেটেনি৷ পিউ তার এই স্বপ্নের কথা শুধু একজনকেই বলেছে, ইয়াসিন৷ ইয়াসিন উত্তর দিয়েছে নার্সের বদলে তওয়াইফ হয়েছিস বলে মন খারাপ করিস না পিউ৷ নার্স যেমন রুগীর সেবা করে, তুইও আমাদের মতো ঘায়েল দিল মরিজদের সেবা করিস৷

কথাটা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠতে গিয়ে সেদিন ইয়াসনকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলেছিল পিউ৷

আজ এতকাল পরে ইয়াসিনের কার্ডটা দেখে ওর মনে কী হল কে জানে দুম করে বলে বসল, আমিও বডিদান করতে পারি?

পারি মানে? তাহলে এতদিন কী করছিস তুই? বলে হো হো করে হেসে উঠেছিল ইয়াসিন৷

৷৷ ২ ৷৷

অনেক রাত৷ একা চুপ করে শুয়েছিল পিউ৷ ঘরে এখনও লাইট নেভায়নি৷ খায়ওনি কিছু৷ খিদে নেই৷ আজ সন্ধেবেলা থেকে একটা মাছের ব্যবসায়ী ছিল ঘরে৷ গায়ে যেমন ঘামের গন্ধ তেমনই মাছের আঁশতে গন্ধে ভরপুর৷ প্রথম প্রথম এমন বদ গন্ধে বমি পেত, কান্না পেত, শরীরের ওপর চেপে বসা কুৎসিত সব শরীরগুলোকে এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ছুটে পালাতে ইচ্ছে করত এই পৃথিবী ছেড়ে৷ তীব্র অভিমান ঝরে পড়ত তার জন্ম দেওয়া বাবা-মা পরিবার এই দুনিয়ার সবকিছুর প্রতি৷ ঘেন্না আছড়ে পড়ত প্রত্যেকের গায়ে৷ মরে যেতে ইচ্ছে করত পিউয়ের৷ বেঁচে থাকার কোনও সঙ্গত কারণ খুঁজে পেত না ও৷ বসিরহাটে নিজের বাড়ি চিরকালের মত ছেড়ে দিয়ে যেদিন দালালের মারফত চলে এসেছিল কলকাতায় ধান্দার জন্য তারপর অনকগুলো বছর নানা ঘাটের জল খেতে হয়েছে ওকে৷ ভয়ঙ্কর সেসব অভিজ্ঞতা৷ ভাবলে এখনও গা শিউরে ওঠে৷ কত ঝড়ঝাপটা যে এই শরীর এই মনের ওপর দিয়ে গিয়েছে৷ এক এক দিন এমনও হয়েছে আর যন্ত্রণা সইতে না পেরে সারাদিন বসে থেকেছে রেললাইনের ধারে৷ চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়বে ভেবেও শেষপর্যন্ত পারেনি, শাড়ি পাকিয়ে সিলিং ফ্যানে ছুড়ে দেওয়ার পর মনে হয়েছে আর কিছুদিন দেখা যাক৷ নাহ কিছুই বদলায়নি আরও কিছুদিন পরে বরং আহত হতে হতে একতা সময় জীবন বলে যে একতা পদার্থ রয়েছে, ও যে একটা জ্যান্ত মানুষ সেটাই ভুলে গেল৷ ভালবাসাহীন ভাতডালের মতই প্রেমহীন যৌনতায় একসময় স্রেফ অভ্যাসে থেকে যেতে থাকল ও৷ অনুভূতিহীন একটা জীবন৷ একদিন পরিচয় হল ইয়াসিনের সঙ্গে৷ খদ্দের আর বেশ্যার সম্পর্ক যেমন হয় তেমনই সম্পর্ক দিয়ে শুরু হয়ে তার থেকে সামান্য কিছুটা বেশি৷ কিন্তু ওই পর্যন্তই পিউ বা ইয়াসিন কখনই কেউ কাউকে বলেনি ‘ভালবাসি’, কখনই ভাবেনি একে অপরের সঙ্গে আজীবন থেকে যাওয়ার কথা৷ কারণ দুজনেই উদাসীন জীবনের ব্যাপারে, ভবিষ্যতের ব্যাপারে৷ তবু কখনও কোনও আন্তরিক অসতর্ক মুহূর্তে এই ঔদাসিন্যের গভীর আড়ালে না মরে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছেরা আচমকাই উঁকি দিত, উঁকি দেয়৷ যেমন ইয়াসিনের ওই মরনত্তর দেহদানের কার্ড আর ওর মুখ থেকে সেইকথাগুলো শোনার পর পিউএর হঠাৎই মনে হয়েছিল ওর জীবনে এই শরীরটাই সব৷ বেঁচে থেকে শরীর শুধু বিক্রিই করেছি, বাকি যতদিন বাঁচব হয়তো তাইই করে যেতে হবে, তাই জীবনের শেষে অন্তত শরীরটা বিক্রি না করে যদি স্রেফ দান করে দেওয়া যেত অন্তত কিছুটা সত্যিকারের ভাললাগা, কিছুটা আরাম, একটু শান্তি মিলত৷ ইয়াসিনকে চমকে দেবে সেই ইচ্ছে নিয়ে কাল সকালে পিউ একাই গিয়েছিল দেহদান করার অফিসে৷ ইয়াসিনের কার্ডের পছনে যে ঠিকানাটা দেওয়া ছিল সেটাতেই৷ অফিসটা সন্ধ্যাবাজার থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে৷ অটো করে যেতে হয়৷ এনজিও র একটা ছোট্ট অফিসঘর৷ একটা ছেলে ফর্ম দিয়েছিল৷ সেটা নিয়ে ফিরেছিল পিউ৷ সন্ধেয় ইয়াসিন ওর ঘরে আসার পর ইংরেজিতে লেখা তিন পৃষ্ঠার ফর্মটা ইয়াসিনের সামনে মেলে ধরে পিউ বলেছিল এটা ভরে দে তো৷

ইয়াসিন বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ফর্মটার দিকে৷ তারপর পিয়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিল তুই সত্যিই চলে গিয়েছিলি! তুই শালা সত্যিই…সত্যিই অন্যরকম! বলে জড়িয়ে ধরেছিল ওকে৷

পিউ ফিক করে হেসে বলেছিল হুঁ যেমন তুই৷ নে ভর এটা৷

আচ্ছা শোন আমি তো তোর আগে মরব, এটা গ্যারান্টেড৷ তুই কিন্তু আমার হয়ে ওদের ফোন করে জানাবি বডি নিয়ে যাওয়ার জন্য৷

হুঁ, আর যদি আমি আগে ফুটে যাই তাহলে তুই৷

তারপর দুজনেই হেসে উঠেছিল জীবনকে কাঁচকলা দেখিয়ে৷

পিউকে কিছু করতে হয়নি, ইয়াসিনই ওর হয়ে ফর্মটা ফিলআপ করে দিয়েছিল৷ তারপর ওর হাতে দিয়ে বলেছিল, তোর জন্য সত্যিই আমার অহংকার হচ্ছে রে৷

পরদিন ওই ফিলয়াপ করা ফর্মটা নিয়ে পিউ আবার ছুটেছিল ওই অফিসে৷ বুকের ভেওত্রে মুঠো মুঠো আনন্দ৷ সেই ছেলেটার হাতে ফর্মটা জমা দিয়ে খেয়াল করেছিল একটা মাঝবয়েসি টেকো লোক একটু দূরের চেয়ারে বসে ওকে একদৃষ্টিতে দেখছে৷ একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল পিউ৷ চেনা নাকি! ফর্ম দেওয়া ছেলেটাকে হাঁক পেড়ে ডেকেছিল লোকটা৷ ছেলেটাকে নিচু গলায় কিসব যেন বলছিল আর বার বার ওদের দিকে তাকাচ্ছিল, মনে কু ডাকছিল পিউর৷ ছেলেটা আবার ফিরে এসে ফর্মটায় চোখ বুলিয়ে বলেছিল আপনি পেশার জায়গাটা ফাঁকা রেখেছেন কেন? কিছু করেন না?

পিউ উত্তর দিয়েছিল, না আমি কিছু করি না৷

আপনি তো বিবাহিতা তো নন দেখছি তাহলে কি বাবা মায়ের সঙ্গে থাকেন?

না আমি একা থাকি৷

একা? তাহলে আপনার ইনকামের সোর্স কী?

এবার পিউ একটু বিরক্তি নিয়েই বলে উঠেছিল সেটা জানাতেই হবে নাকি?

নিশ্চয়ই জানাতে হবে৷ নইলে আর ফর্মে লেখা রয়েছে কেন? ফর্ম ঠিকঠাক ফিলআপ না হলে আমরা এটা এ্যাকসেপ্ট করতে পারব না৷

কেন পারবেন না? রেগে উঠেছিল পিউ৷ আবার তাকিয়েছিল সেই টেকো লোকটার দিকে৷ ওর জীবন ওকে অনেককিছু শিখিয়েদিয়েছে৷ বিশেষ করে মানুষ চেনা৷ হাত তুলে লোকটা আচমকাই ডেকে উঠেছিল পিউ৷ ও দাদা এদিকে একবার শুনবেন?

এমন আহ্বানে লোকটা কেমন ঘাবড়ে গিয়ে সত্যিই উঠে এসেছিল ওদের সামনে৷ কী হয়েছে?

আচ্ছা দাদা আপনি তো আমাকে চেনেন, আমিও আপনার সবটা চিনি, বলুন তো এখানে আমি কী কাজ করি সেটা লেখার কি দরকার রয়েছে? বেমালুম আন্দাজে ঢিলটা ছুড়ে দিয়েছিল পিউ৷ আর লোকটা মুহূর্তের মধ্যে কাঠের মতো শক্ত হয়ে গিয়ে একটু আমতা আমতা করে পরক্ষণেই বলে উঠল কে বলেছে? কে বলেছে আমি আপনাকে চিনি? মোটেই চিনি না৷ কে আপনি?

তাই সত্যি চেনেন না?

নাহ…চিনি না৷ বলে আর দাঁড়ায়নি লোকটা৷ একেবারে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল৷

ফর্ম দেওয়ার অল্পবয়েসি ছেলেটা তখন গলা নামিয়ে বলেছিল, দিদি আপনি দত্ত বাবুকেই চটিয়ে দিলেন? উনিই সব ফর্ম এখান থেকে হেড অফিসে স্যাংশন করে পাঠান৷ এখানে আর আপনার কাজটা হবে না৷ আপনি বরং অন্য কোথাও দেখুন৷

অন্য কোথাও? কোথায়?

কলকাতায় আমাদের মতো এমন এমন বেশ কিছু অফিস রয়েছে, হসপিটালও রয়েছে৷ গিয়ে খোঁজ নেবেন৷

কলকাতায়! আমি কী করে চিনব? প্লিজ একটু ওই দাদাকে বলুন না৷

ছেলেটা ঠোঁট ওল্টাল৷

আচ্ছা আমি অন্যায় করেছি, ওর কাছে ক্ষমা চাইছি বলুন৷

একটা কথা জিজ্ঞাসা করব আপনাকে?

কী?

দেহ দান করার জন্য আপনার এত আর্জ মানে এত ইচ্ছে কেন?

প্রশ্নটার মুখে থমকে গিয়েছিল পিউ৷ কী বলবে ছেলেটাকে৷ বলে ফেলেছিল৷ জানি না৷

ছেলেটা কী বুঝেছিল কে জানে, বলেছিল আপনি একটু বসুন, আমি দেখছি৷ উঠে গিয়েছিল চেয়ার ছেড়ে বাইরে৷ বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে চেয়ারে বসে বেশ আমতা আমতা করে বলেছিল উনি মানে রাজি হয়েছেন কিন্তু৷৷

কী চাই বলুন?

ওনার পান সিগারেটের নেশা খুব৷

কত লাগবে?

পাঁচশ দিন আমি ম্যানেজ করে নেব৷

শুনে হেসে ফেলেছিল পিউ৷ মানুষ আসলে যে একটি আদ্যন্ত ব্যাবসায়ী প্রাণী সেটা ওর থেকে ভাল আর কে জানে? যে যেখানে বিজনেস করার সুযোগ পায়, করে৷ পিউও কি করেনি কখনও এমন বিজনেস? হয়তো ওই লোকতার সঙ্গেই করেছে কখনও৷ আজ পিউ এর অসহায়তা আন্দাজ করে সুযোগ বুঝে পালটা হিসেব বুঝে নিচ্ছে৷

অত টাকা তো আনিনি ভাই৷

ঠিক আছে, ফর্মটা নিয়ে যান৷ আর এইখানে সেলফ এমপ্লয়েড লিখে টাকাটা নিয়ে কাল আসবেন৷

ফর্মটা হাতে নিয়ে ব্যাগে ভরে উঠে দাঁড়িয়েছিল পিউ৷

আজ বিকেল থেকে দুটো খেপে রোজগার হয়েছে মাত্র দুশো৷ ইয়াসিন এসেছিল, ঘরে লোক রয়েছে দেখে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরে গিয়েছে৷ হারামি মাছওলাটা একেবারে বুনো মোষ ছুটিয়েছে পিউয়ের ওপর৷ গতর টনটন করছে, জ্বালা করছে যোনীদ্বার৷ ক্লান্ত হয়ে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠল পিউ৷ খাটের নীচের বাক্সতা তেনে বার করল, ওর ভেতরে একটা টিনের কৌটো৷ সেখানে কিছু পাকানো নোট৷ কয়েকটা নোটসেখান থেকে বার করল৷ মোট পাঁচটা একশোর নোট ভাল করে যত্নে হাত বুলিয়ে টান করে খাটের বিছানার তলা থেকে সেই ফর্মটা বার করল৷ নোটগুলো ওর ভেতরে গুঁজে আবার সেটা রাখল নিজের পাশে৷ সিলিং ফ্যানের হাওয়ায় ফর্মের প্রথম পৃষ্ঠাটা প্রজাপতির মতো উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে৷ ফর্মটাকে নিজের মাথার বালিশের তলায় রাখল পিউ৷ মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটা ঘুরছে৷ সিলিং ফ্যান থেকে মেঝের দূরত্ব কতটা সেটা ভাবতে ভাবতে আজ রাতের মতো ঘুমিয়ে পড়ল৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *