আয়না
দুপুর দুটো নাগাদ অফিসে লাঞ্চ সারার পর রাস্তায় বেরিয়ে উল্টোদিকের ফুটেই একটা বাসস্ট্যান্ডে কয়েকজন কলিগের সঙ্গে মিনিট পনেরো কুড়ি আড্ডা দেয় সুব্রত৷ নয় ঘন্টার ডিউটি আওয়ারে এই আধঘন্টাই একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার সময়৷ তারপর আবার নিজের ডেস্কে বসে রুদ্ধশ্বাসে এক নাগাড়ে কাজ করে যাওয়া৷ ওর অফিসটা বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ত্রিভোলি কোর্টে৷ ফিফথ ফ্লোরে অফিস৷ অটোমোবাইল স্পেয়ার পার্টস ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি৷ সুব্রত এ্যাকুন্টস এক্সিকিউটিভ৷ এইমাসে ছয় মাসের প্রোবেশন পিরিওড শেষ হয়েছে৷ এখন ও কোম্পানির পারমানেন্ট স্টাফ৷ ভাল স্যালারি৷ এই কারণে সুব্রতর খুব খুশি থাকার কথা৷ কিন্তু গত তিনবছর ধরে সুব্রত কোনও কিছুতেই খুশি হয় না৷ আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব-পরিচিত সকলেই ব্যাপারটা খেয়াল করেছে, ওকে বারবার জিজ্ঞাসাও করেছে কিন্তু উত্তরে যা সব বলেছে সুব্রত তা একটা বাচ্চা শুনেও বলে দেবে ডাঁহা মিহ্যে৷ চৌত্রিশ বছরের সুব্রত মজুমদারের এই খুশিহীন জীবনের মূল কারণ ওর স্ত্রী নন্দিনী৷ আজ থেকে প্রায় তিনবছর আগে খবরের কাগজে পাত্র-পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনসূত্রে শিবপুরের সুব্রতর সঙ্গে বেহালার নন্দিনীর বিয়ে হয়েছিল৷ ফুলশ্যার পরের দিন রাতে সুবরত তার নতুন বউ এর একটু ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করতেই তীক্ষ্ণ চিৎকার করে এক ধাক্কায় সুব্রতকে সরিয়ে দিয়েছিল নন্দিনী৷ প্রথমে বেজায় ঘাবড়ে গিয়েছিল সুব্রত৷ তারপর ভেবেছিল হয়তো প্রথমবারের ভয়৷ প্রথম প্রথম অনেক মেয়েরই এমনটা হয়ে থাকে শুনেছে৷ পরে ঠিক হয়ে যায়৷ কিন্তু এইক্ষেত্রে হল না৷ সপ্তাহ-মাস পেরিয়ে গেল, কিন্তু তবু হল না৷ একটু ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করলেই প্রবলভাবে বাধা দিতে থাকে নন্দিনী৷ সুব্রত জোরাজুরি করলে হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়৷ সুব্রতর মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ে৷ এসবের কারণ কী? কেন এমন করছে নন্দিনী? সুব্রত বহুবার জিজ্ঞাসা করেছিল ওকে৷ বুঝিয়েছিল, অভিমান দেখিয়েছিল, রাগ করেছিল, নন্দিনীর একই উত্তর ওইসব খারাপ লোকেরা করে৷
যাববাবা তাহলে তোমার বাবা-মাও খারাপ মানুষ?
এর উত্তরে নন্দিনী বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল সাতদিনের জন্য৷
আরেকবার অনেক ভুজুং ভাজাং দিয়ে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে কাউন্সেলিঙ্গের জন্য নিয়ে গিয়েছিল সুব্রত৷ ফার্সট সিটিং এর পরেই বাড়ি ফিরে নন্দিনীর প্রথম প্রশ্ন ছিল তুমি কি আমাকে পাগল ভাব?
এ বাবা তা কেন ভাবব?
তাহলে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে কেন নিয়ে গেছিলে?
সে তো…মানে দেখো মনে হয় তোমার কিছু একটা প্রবলেম হচ্ছে৷ সেই জন্যই৷
তা বলে একটা বাইরের লোক আমাদের পারসোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করবে? আর বিয়ে করা মানে তোমার কাছে শুধুই ওইসব?
শুধু ওইসব হবে কেন? কিন্তু ম্যারিটাল লাইফে ওটা তো একটা পার্ট৷
ওসব নোংরামোতে যদি এতই সখ থাকে তাহলে বিজ্ঞাপনেও সেটা লিখে দিতে পারতে৷
এর উত্তর কী দেওয়া উচিত মাথায় আসেনি সুব্রতর৷ কিন্তু ভেতরে ভেতরে একেবারে গুড়োগুড়ো হয়ে গিয়েছিল৷ ডিভোর্সের কথাও ভেবেছিল কয়েকবার কিন্তু তার কারণ হিসেবে সবাইকে যেটা বলতে হবে তা ভেবেই লজ্জায় গুটিয়ে গিয়েছিল৷ দুই একবার পরকিয়ার চেষ্টা করে দেখেছে ওই জিনিসের ধক ওর নেই৷ এগোতে আর সাহস পায়নি৷ অগত্যা গাছেদের মতো পুরোপুরি অযৌনজীবন৷ যৌনতা বলতে শুধু ইন্টারনেট আর টয়লেট৷ জীবনে অন্যান্য শখ বলতে তেমন কিছু নেই সুব্রত৷ বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিশতে ইচ্ছে করে না আর৷ গল্প করতে গেলেই অনেক এমন প্রসঙ্গ এসে পড়ে যা ওর পক্ষে খুব অস্বস্তিকর৷ তাই অফিস থেকে অনেকটা দেরি করেই বেরোয়৷ কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রেখে শান্তি খোঁজে৷ এই তিনবছরে সুব্রত নন্দিনীর সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যায়নি৷ নন্দিনীও আবদার করেনি৷ দুইজনে স্রেফ সামাজিকতা রক্ষার দায়ে একসঙ্গে থাকে৷ রাতে বিছানায় শোবার পর সুব্রতর মনে হয়, ও কোনো খাটে নয়, শ্মশানে শুয়ে রয়েছে৷
.
আজও দুপুরে লাঞ্চ সেরে বাসট্যান্ডে এসে বসল সুব্রত৷ বাসস্ট্যান্ডটা ফাঁকাই থাকে৷ এই রাস্তায় বাসচলাচল খুবই কম৷ তাই লোহার ছটা চেয়ারও ফাঁকা৷ আজ সুব্রতর সঙ্গে কৌশিক আর রাজদীপ ছিল৷ পাশাপাশি চেয়ারে বসে বেশ আয়েস করে সিগারেট ধরাল তিনজনে৷ মিনিট কয়েক গল্পগুজবের পরে কৌশিক বলল, দেখেছিস মালটাকে?
বাকি দুইজন ভাবল কোনও সুন্দরী মেয়েকে দেখার কথা বলছে বোধহয়৷
কৌশিক ফিক করে হেসে বলল তোরা যা ভাবছিস তা নয়, ওই দেখ বলে ও আঙুল তুলল বাসস্ট্যান্ডের ঠিক অপোজিট ফুটপাতে৷ ওখানে একটা পুরনো ফার্নিচারের দোকান রয়েছে৷ সাইনবোর্ডে ইংরেজিতে লেখা হুসেনস ফার্নিচার৷ বায়ার এন্ড সেলার অফ ওল্ড ফার্নিচারস৷ ছোট দোকানটাকে রোজই আলোগোছে দেখে ওরা৷ অত খেয়াল করে না৷ দোকানটায় সব কর্মচারীই মুসলিম৷ ফুটপাতের ওপরেই ওধিকাংশ ফার্নিচার রেখে ওরা রিপেয়ার, পালিশ ইত্যাদির কাজ করে৷ ওই ফুটপাতের ওপরেই দোকানের দেওয়ালে আজ হেলান দিয়ে রাখা রয়েছে বিশাল আকারের একটা আয়না৷
রাজদীপ বলল ধুস শালা আয়না!
হুঁ খানদানি আয়না৷ আহ এমন একটা জিনিস ঘরে থাকলে সারাদিন আয়নার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করবে৷ বলল কৌশিক৷
সুব্রত বেশ মনোযোগ দিয়ে আয়নাটাকে দেখছিল৷ প্রায় পাঁচফুট লম্বা হবে৷ আর দুই হাত চওড়া৷ আয়নাটা ওকে বেশ আকৃষ্ট করল৷
কৌশিক বলল, হেব্বি দেখতে কিন্তু মনে হয় কোনও রইস আদমীর ছিল৷
.
তাহলে বেচে দিল কেন? জিজ্ঞাসা করল রাজদীপ৷
এটা কে রে? বেচে দিল কেন আমি কী করে বলব? চল ওঠ আড়াইটা বাজল৷ বলে উঠে দাঁড়াল কৌশিক৷ ওদের লাঞ্চ আওয়ার শেষ৷ রাজিদীপও উঠে দাঁড়াল৷ কৌশিক বলল কী রে সুব্রত ওঠ৷
সুব্রত বলল তোরা যা, আমি একটা কাজ সেরে আসছি৷
ওক্কে বস৷ ওরা দু’জন চলে গেল৷ সুবরত সিগারেট ফেলে উঠে দাঁরাল৷ রাস্তা ক্রস করে দোকানের সামনে এল৷ আয়নাটার সামনে এসে দাঁড়াল৷ এত সুন্দর দেখতে সত্যিই চোখ ধাঁধিয়ে যায়৷ দেখলেই বোঝা যায় অনেক পুরনো, কিন্তু এত এখনও এত ঝকঝকে যে পুরনো বলে দেগে দেওয়া যায় না৷ কাচ এখনও চকচকে৷ আয়নাটা এতই বড় সুব্রত নিজেকে আপাদমস্তক দেখতে পাচ্ছিল৷ কাঠের ফ্রেম পালিশ করা৷ ফ্রেমে অপূর্ব কাঠের কারুকাজ৷ সবথেকে নজর কাড়ে যেটা ফ্রেমের মাথায় এক স্বল্পবসনা নারীর রিলিফ, তার চোখের মনিদুটি লাল কাচের৷ এতই নিখুঁত যে একবার তাকালে চোখ সরানো যায় না৷ দেহের প্রতিটি খাঁজ যেন শিল্পী পরম যত্নে কুঁদে তৈরি করেছেন৷ মেয়েটির শরীরের কোমলতা যেন অনুভব করা যায়৷ সুব্রত নিজেকে আটকে রাখতে পারল না৷ হাত বাড়িয়ে কিছুটা বেখেয়ালেই ছুঁয়ে ফেলল আয়নাটাকে৷ ফ্রেমে হাত বোলাল তারপর ধীরে ধীরে নিজের আঙুল সরিয়ে নিয়ে যেতে থাকল ওই কাঠের নারী শরীরটির দিকে৷ সুব্রতর অস্বস্তি হচ্ছিল কিন্তু কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিল না৷
লে লিজিয়ে বাবু বড়িয়া চিজ৷
চমকে উঠে নিজের হাত সরিয়ে নিল সুব্রত৷ কথাটা দোকানের ভেতর থেকে এসেছে৷ সুব্রত তাকিয়ে দেখল দোকানের ভেতর বসে রয়েছে এক বয়স্ক সাদা দাড়িওলা মুসলমান৷ উনিই দোকানের মালিক৷
সুব্রত কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল লোকটার দিকে৷
লে না হ্যায় তো লে লিজিয়ে৷ এ্যায়সা চিজ বার বার নেহি মিলেগা৷
না না এমনিই দেখছি৷ আময়া আমতা করে বলল সুব্রত৷
আরে বাবু দেখতা তো সবহি হ্যায়৷ লেকিন মিলতা হ্যায় নসিববালোকো৷ হ্যায় না?
হুঁ তা ঠিক৷
লে না হ্যায় তো সোচিয়ে মত৷ ফট সে লে লিজিয়ে, কমতি করকে ছোড় দেঙ্গে৷
তা ভাল জিনিস কম দামে ছাড়বেন কেন? প্রশ্ন করল সুব্রত৷
দুকান ছোটা হ্যায় হামারা৷ আপ তো দেখহি রহে হো৷ কিতনা সামান রাখে গা৷ ঔর ইয়ে সিসাকা চিজ থোরি সি ভি আগর খরোচ লগ যায়ে তো কোই নেহি খড়িদে গা বাবু৷ ইসলিয়ে…
হুম…তা দাম কত বলছেন৷ হঠাৎই প্রশ্নটা করে ফেলল সুব্রত৷
আজ লে না হ্যায়?
আগে দাম তো শুনি৷
এক কিমত পাঁচ হাজার৷
পাঁ—চ! হাহাহা করে হেসে উঠল সুব্রত৷ তারপর ঘড়ি দেখে হাঁটা লাগাতে গেল৷
আরে রুকিয়ে বাবু৷ কেয়া হুয়া?
আরে দাদা এত দাম! এত টাকা আমার স্যালারিও নয়৷ এসব বড়লোকেদের জিনিস৷
নেহি নেহি বড়লোক নেহি দিল বড়া হোনা চাহিয়ে বাস৷ আপ কিতনা দে সকতে হো বতাও?
আরে আপনি এত দাম বললেন আমি এরপর আর কী বলব?
ফির ভি কুছ তো বতাকে যাইয়ে বাবু৷
সুব্রত ভেবে পেল না কী বলবে? আর সবথেকে বড় কথা এতবড় আয়না নিয়ে ও করবে টা কী? ঘরে রাখবে কোথায়? এসব আয়না রাখার জন্য তেমন বাড়ি হওয়া দরকার৷ তবু দড় করে ফেলেছে যখন কিছু একটা বলা দরকার৷ সুব্রত বলল, আমি মিডলক্লাস লোক৷ খুব বেশি হলে হাজারখানেক পারব৷
নেহি বাবু কুছ সোচকে তো বতাইয়ে৷ চিজ দেখিয়ে আপ? মার্কিটমে কম সে কম আট দশ হাজার তো মিল হি যায় গা৷ লেকিন ফুরসত কাঁহা৷
না চাচা আমি এর বেশি পারব না৷ বললাম তো আপনাকে৷ চললাম আমি৷ অফিসে ঢুকতে হবে৷
আরে রুকিয়ে জনাব৷
এগোতে গিয়েও আবার থামল সুব্রত৷
আভি লেনা হ্যায়?
নাহ আজ কী করে নেব? অত টাকা নেই সঙ্গে৷ আর আমি ঢুকব অফিসে৷ সুব্রত মনে মনে প্রমাদ গুনল৷ জিনিসটা কেনার মোটেও ইচ্ছে নেই, দড় করাটাই ভুল হয়েছে৷
ঘর কাঁহা হ্যায় আপকা?
বহোত দূর, শ্যামবাজার৷
উয়ো দূর কাঁহা৷ চলিয়ে আপকে লিয়ে দো হাজার মে ছোড় দেঙ্গে৷
সুব্রত কিছুটা একটা বলতে গেল সেই সুযোগ দিল না দোকানদার, তার আগেই বলে উঠল৷ অব ঔর কুছ মত বলিয়ে৷ হাথ জোড়তা হু৷ ইসসে কমমে নেহি দে সকতা৷ পুরা লস মে দে রহা হুঁ৷ খড়িদকে পুরা ফঁস গয়া ম্যায়নে৷
সুব্রত কী বলবে বুঝে পেল না৷ এ তো আচ্ছা ফাঁসা গেল৷
মাল হাম ঘরমে ভেজ দেঙ্গে৷ পেমেন্ট ঘর মে করেঙ্গে না ইঁহা?
না না দুই হাজার টাকা সঙ্গে নেই৷
ঠিক হ্যায় কোই বাত নেহি কুছ এ্যাডভান্স দে দিজিয়ে৷
এই রে আমার কাছে আজ বলত বলতে মানিব্যাগ খুলে সুব্রত দেখল মাত্র চারতে একশোটাকার নোট রয়েছে৷ ও বলল আমি তিনশ টাকা এখন দিতে পারি৷
কোই বাত নেই৷ আপ তো জান পেহচানওয়ালা হো৷ এহি বগলকা অফিস মে কাম করতে হো হম জানতে হ্যায়৷ তিনশই দে দিজিয়ে৷
সুব্রত বুঝল দোকানদার মরিয়া৷ আর রেহাই নেই৷ এরপরে না নিলে কাল থেকে উলটো ফুটে বসে আর আড্ডা দেওয়া যাবে না৷ ব্যাগ থেকে তিনটে একশোর নোট বার করে লোকটির হাতে দিল ও৷ বাড়ির ঠিকানা জেনে নোট করে বিল বানিয়ে দিল লোকটা৷ বিল পকেটে নিয়ে অফিসে চলে এল সুব্রত৷ অনেক বেশি দেরি হয়ে গেল আজ৷
অফিসে ঢুকে নিজের ডেস্কে বসে কাজ মন বসছিল না সুব্রতর৷ বারবার মনে পড়ছিল আয়নাটার কথা৷ আয়নার ফ্রেমে ওই অদ্ভুত সুন্দর কারুকাজ, নারী মুর্তিটির কথা৷ এত বড় একটা ধুমসো আয়না কিনে বাড়িতে ঢোকালে বাবা-মা নন্দিনীর কাছে অনেক কৈফিয়ত দিতে হবে ঠিকই কিন্তু এ্যান্টিক জিনিস বাড়িতে একটা থাকলে মন্দ হয় না৷ আর সুব্রত এবং নন্দিনীর বেডরুমটা একেবারে ছোট নয়, ঘরে মোটামুটি মানিয়েই যাবে৷ যদি নন্দিনী আপত্তি না তোলে তাহলে শোবার ঘরেই রাখা যাবে ওটাকে৷
.
বাবা-মা , নন্দিনী যথারীতি তিনজনেই বেশ অবাক হল এত ঢ্যাপ্পোস একটা আয়না আচমকা বাড়িতে নিয়ে আসার কারণে৷ নন্দিনী বলল তোমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে, মা জিজ্ঞাসা করল রাখবি কোথায়? বাবা বলল দেখতে মন্দ নয়, কিন্তু এসব এ্যান্টিকের জন্য ফ্ল্যাটবাড়ি মামানসই নয়৷
সুব্রত জানত এইসব প্রশ্নের উত্তর ওকে ফেস করতে হবে৷ তাই চুপ করে শুনে যাচ্ছিল কথাগুলো৷ শুধু হুঁ হাঁ করে সামান্য উত্তর৷ আজ সকালেই টেম্পো করে জিনিসটা হাজির হয়ে গিয়েছিল বাড়িতে৷ অফিসের জন্য যখন তৈরি হচ্ছিল তখনই জিনিসটা এসে হাজির হল৷ খালাসির সঙ্গে হাত লাগিয়ে আয়নাটা নিজের ঘরে এনে দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখল সুব্রত৷ বাকি টাকা মিটিয়ে দিয়ে ওর মন খুঁতখুত করতে থাকল এইভাবে দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখাটা কি ঠিক হবে? যদি হড়কে মেঝেতে পড়ে যায় তাহলে সব গেল৷ এই কাচ এখানে পাওয়া যাবে না৷ নাহ আজ আর অফিস যাবে না ঠিক করল৷ অফিস যাওয়ার থেকে ঢের বেশি ইমপরট্যান্ট আয়নাটার ব্যবস্থা করা৷ সুব্রত বেরিয়ে পড়ল কাঠের মিস্তিরির খোঁজে৷ কাছেই একটি দোকান, সেখান থেকে একজন কাঠ মিস্তিরিকে ধরে বেঁধে নিয়ে এল৷ দেওয়ালে হুক লাগিয়ে আয়না ফিটিংপর্ব চলল বেশ কিছুক্ষণ৷ একটা দেওয়ালের অনেকটা জায়গা জুড়ে গেল আয়নার জন্য৷ কিন্তু বেশ লাগছে দেখতে৷ নন্দিনী প্রথম দিকে খুব আপত্তি জানিয়েছিল শোবার ঘরের মধ্যে এত বড় একটা আয়না ঢোকানোর জন্য৷ কিন্তু ওই আয়নাতেই বারবার নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল৷ মানুষের সহজাত স্বভাব সুযোগ পেলে নিজেকে একবার দেখে নেওয়া৷ এই স্বভাব মেয়েদের আরও অনেক বেশি৷ সুব্রত খেয়াল করল সকালে আয়নাটা ঘরে ঢোকানোর সময় নন্দিনী যতটা আপত্তি তুলেছিল বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ওর আপত্তিটা নরম হতে শুরু করল শুধু তাই নয় সুব্রতর অনুপস্থিতিতে আয়নাটার গায় বেশ কয়েকবা হাতও বুলিয়ে দেখল৷ নন্দিনী টের পাচ্ছিল ওটার সামনে ও যতবার যাচ্ছে শরীরের ভেতরে একটা অদ্ভূত অনুভূতি হচ্ছে, যেটা ওর আগে কখনই হয়নি৷ একেবারে অচেনা একটা অনুভূতি, গা সিরসিরে, গায়ে কাঁটা দেওয়া৷ সারাদিনে নন্দিনীর সঙ্গে সুব্রতর খুব বেশি কথা হয় না৷ দুইজনেই দুজনকে আসলে কিছুটা অ্যাভয়েড করে৷ দুজনের সেই অন্তরঙ্গ সম্পর্কটাই গড়ে ওঠেনি বলে কেউই খুব একটা কারও কাছে ঘেসে না৷ আজ ছুটি নেওয়ার কারনে সুব্রত সারাদিন অলসভাবেই ঘরে কাটাল৷ দুপুরে খেয়ে দেয়ে মোবাইলে নেটফ্লিক্সে সিনেমা দেখল৷ আর একটা বিষয় আরচোখে খেয়াল করছিল নন্দিনী বা বার কোনো অছিলায় ওই আয়নাটার সামনে যাচ্ছে আর নিজেকে দেখছে৷ বেশ মজা লাগছিল সুব্রতর৷ অবশ্য এতবড় খানদানি আয়নার সামনে নিজেকে দেখার লোভ ত্যাগ করা খুব কঠিন৷ কিন্তু ও জানত না আজ রাতে ওর জন্য কী অপেক্ষা করছে৷
.
রোজের মত রাতে খেয়ে খুব বেশিক্ষণ জাগে না সুব্রত৷ ও খেয়ে দেয়েই শুয়ে পড়ে৷ নন্দিনীর শুতে একটু দেরি হয়৷ সারা বছর ও শোবার আগে স্নান করে তারপর বেশ কিছুক্ষণ ধরে নানা রকমের লোশন গায়ে মুখে মাখে৷ চুল আঁচড়ায় তারপর যখন শুতে আসে ততক্ষণে সুব্রত ঘুমিয়ে পড়ে৷ আজ সুব্রত বিছানায় এলিয়ে কিছুক্ষণ মোবাইলখুটখাট করতেই ঘুম দুইচোখে জড়িয়ে এল ওর৷ চোখ বুজতে ঘুমও চলে এল৷ ঘুম ভাঙল তখন ঘরে ড্রিমলাইট জ্বলছে৷ ওর কেমন যেন মনে হল ওর ওপরে কেউ চেপে বসেছে৷ প্রথমে মনে হল স্বপ্ন, তারপর মনে হল নাহ স্বপ্ন নয়, ভয় পেয়ে চোখ মেলতেই যা দেখল চমকে উঠ সুব্রত৷ নন্দিনী ওর গা ঘেসে শুয়ে ওর খোলা বুকে হাত বোলাচ্ছে৷ প্রথমে বিশ্বাস হল না সুব্রতর৷ ভাবল চোখের ভুল৷ কিন্তু তারপরে বুঝল নাহ এ সত্যি৷ স্লিভলেস সাদা নাইটি, মাখন ত্বক ছিপছিপে শরীর ড্রিমলাইটে কেমন অন্যরকম লাগছে নন্দিনীকে৷ সুব্রত বেশ সন্তর্পনেই প্রথমে হাত রাখল নন্দিনীর বাহুতে৷ উষ্ণ শরীর৷ নন্দিনী আরও ঘেঁসে এল কাছে৷ মুখ ঘসতে থাকল সুব্রতর বুকে৷ সুব্রত অবাক হয়ে তাকাল নন্দিনীর দিকে৷ এ যেন এক অচেনা নন্দিনী৷ ওর চোখদুটোর দিকে তাকাতেই গা ছমছম করে উঠল সুব্রতর৷ সরে আসতে চাইল৷ কিন্তু নন্দিনী আর সেই সুযোগ দিল না সুব্রতকে, নিপূনভাবে আদর করতে করতে জাগিয়ে তুলল ওকে৷ সুব্রতও মেতে উঠল খেলায়৷ আদিম লাগামছাড়া উদ্দাম খেলতে একটা সময়ের পর অনিবার্য ক্লান্ত ও তৃপ্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল দু’জনেই৷
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গার পরেই গতরাতের কথা মনে পড়ে আনন্দ যেন চুঁইয়ে পড়ল সুব্রতর গোটা শরীর থেকে৷ এত খুশি এত ভাল লাগছে সবকিছু! আজও অফিস যেতে ইচ্ছে করছে না৷ এতদিন পর তাহলে অবশেষে…বিছানায় নন্দিনী নেই৷ আজও অফিস যেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু কাল কামাই গিয়েছে আজ আর উপায় নেই৷ উঠল সুব্রত৷ ঘরে আয়নাটার দিকে দেখল৷ ওটার দিকে তাকালে কেমন যেন মনে হয় আয়নাটাই ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে৷
ঘর ছেড়ে টয়লেটের দিকে যেতে যাবে তখনই নন্দিনী ঘরে ঢুকল৷ ওকে জড়িয়ে ধরল সুব্রত৷
কী হল কী? ছাড়? সেই পুরনো স্টাইলেই বলল নন্দিনী৷
সে না হয় ছাড়ছি, কিন্তু কাল রাতে কী হয়েছিল তোমার? এতদিন পরে অবশেষে…বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলল সুব্রত৷
কী আবার হবে? বিরক্ত হয়ে জবাব দিল নন্দিনী৷
তাই নাকি? তাহলে এগুলো কী? বলে পিঠের, গলার পাশে নন্দিনীর আদরের দাগগুলো দেখাল সুব্রত৷
দেখে প্রথমেই ইস করে উঠল নন্দিনী৷ তারপর বলল এগুলো কী?
কী মানে তোমারই তো করা৷ হেসে বলল সুব্রত৷
বাজে কথা বলবে না৷ কে না কে করেছে ছি ছি…বলতে বলতে অন্য ঘরে চলে গেল নন্দিনী৷
মানে! থম মেরে ঘরে দাঁড়িয়ে রইল সুব্রত৷
.
পরপর দুইরাত তিন রাত একই ঘটনা৷ রাতের নন্দিনী আর দিনের নন্দিনী কেউ কাউকে চেনে না৷ দিনের আলোর নন্দিনী বড় চেনা, একঘেয়ে, খিটখিটে৷ রাতে বিছানায় সেই আবার অপূর্ব শিল্পী৷ সুব্রতর ভয় লাগে তখন কারণ আদরের সময় নন্দিনী যতই বন্য হয়ে ওঠে ওর চোখদুটোও ওই আয়নার কাঠখোদাই নারী মুর্তির চোখের লাল মনিদুটোর মত জ্বলজ্বল করতে থাকে৷ কয়েকদিনের মধ্যে খুব অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল সুব্রত৷ কোনও কাজেই মন বসে না৷ সবসময়ে মনে কেমন যেন একটা অশান্তি৷ ইদানিং ওই আয়নাটার সামনে দাঁড়াতেও কেমন যেন গা ছমছম করে৷ আর নন্দিনী যেন পারলে সারাদিন আয়নার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে৷ নড়তেই চায় না৷ নড়তে পারেও না৷ কী এক অমোঘ আকর্ষণ ওকে সারাদিন চুম্বকের মতো আটকে রাখে আয়নার ওই কাচের সামনে৷ নন্দিনী তাকিয়ে থাকে বিভোরভাবে৷
আজ অফিসে কাজ করতে বসে সুব্রত ঠিক করে ফেলল এইভাবে আর চলছে না৷ কিছু একটা রহস্য রয়েছে৷ আয়নাটা বাড়িতে আনার পরেই এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে৷ নন্দিনীর এমন আচরণ আগের থেকেও বেশি অস্বস্তিকর লাগে সুব্রতর৷ প্রতিদিন রাতে একই উদ্দামতা আর সকাল হলেই অন্যরকম৷ লাঞ্চ আওয়ারের একটু আগেই ও অফিস থেকে বেরিয়ে এল আজ৷ সোজা গেল ওই ফার্নিচারটার দোকানে৷ রহস্যের কিনারা করতে গেলে ওখানেই যেতে হবে৷
চাচা—
হাঁ বোলিয়ে
কিছুদিন আগে আপনার দোকান থেকে একটা আয়না কিনেছিলাম মনে রয়েছে?
হাঁ ইয়াদ হ্যায়৷ কেয়া হুয়া?
ওই আয়না আপনি যেখান থেকে কিনেছিলেন সেখানকার ঠিকানাটা দিতে পারবেন?
শুনে বুড়ো মালিক ভুরু কুঁচকে তাকাল কিঁউ?
খুব দরকার ঠিকানাটা৷
কেয়া জরুরত হামকো বোলিয়ে না? কুছ ডিফেক্ট নিকলা মালমে?
না না সেসব কিছু না অন্য কারণে এ্যাড্রেসটা দরকার ছিল৷
নেহি মালুম৷ বলে লোকটা নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে গেল৷ সুব্রত বুঝল লোকটা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যাচ্ছে৷ পকেট থেকে একটা একশোটাকার নোট বার করে লোকটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এই নিন চাচা একটু চা মিষ্টি খাবেন৷
বুড়ো নোটটার দিকে তাকাল, তারপর নেহাত অনিচ্ছায় নোটটা হাতে নিয়ে পকেট ভরে বলল আপভি কেয়া জিদ করতে হ্যায় বাবু৷ ঠেহরিয়ে দেখতে হ্যায়৷ বলে টেবিলের সামনে রাখা ডায়রি খুলে পৃষ্ঠা ওল্টাতে থাকল৷ মিনিট পাঁচেক পৃষ্ঠা ওল্টানোর পর বলল হাঁ মিলা হ্যায়৷ নোট কর লিজিয়ে, বি কে মালহোত্রা, থারটি থ্রি বাই টু রিচি রোড৷
ঠিকানাটা মনে মনে একবার আওড়ে নিয়ে পিছন ফিরল সুব্রত৷ একটা ফাঁকা ট্যাক্সি যাচ্ছে৷ ট্যাক্সিইই…
.
ড্রয়িংরুমে বসে রয়েছে সুব্রত৷ বি কে মালহোত্রার বাড়ি৷ বাড়িটা দেখলেই বোঝা যায় পুরনো দিনের৷ এই এলাকায় সব অভিজাতদের বাস৷ মেন গেট দিয়ে ঢুকে ফার্সট ফ্লোরে ওঠার সিড়িটা কাঠের৷ চকচকে পালিশ৷ ঘরের ফার্নিচার, ডেকরেশন দেখলে বোঝা যায় অনেক দিনের বাসিন্দাই শুধু নয় যথেষ্ট ধনী৷ চাকর দরজা খুলে ওকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে রেখে গিয়েছে মিনিট দশেক হয়ে গিয়েছে৷ এবার ভেতরের ঘর থেকে একজন মহিলা এলেন ধীর পদক্ষেপে৷ সুব্রত দেখল মহিলার চেহারা স্থুল৷ পরনে নীল রঙের হাউজকোট, ধপধপে সাদা চুল কাঁধ পর্যন্ত সুন্দর করে কাটা৷ মহিলা সুব্রতর মুখোমুখি চেয়ারে বসে বললেন আমি মিসেস মালহোত্রা৷ কী ব্যাপার বলুন?
আপনার সঙ্গে খুব জরুরি কিছু কথা ছিল৷ অনুগ্রহ করে যদি একটু শোনেন৷
বলুন কী বলতে চান৷
আসলে মানে ব্যাপার হল আমি কিছুদিন আগে…পুরো ঘটনাটাই বলল সুব্রত৷ শুধু লজ্জার খাতিরে নন্দিনীর পরিবর্তনতা ডিটেলে বলতে পারল না, বলল আমার স্ত্রীর আচরণে কিছু অদ্ভুত পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি যেটা আসলে স্বাভাবিক নয়৷ সামথিং আনন্যাচারাল৷ আয়নার গল্পটা বলতে বলতে সুব্রত খেয়াল করছিল মিসেস মালহোত্রার চোখ মুখের অভিব্যক্তি বদলে যাচ্ছে৷ বেশ আতঙ্কিত৷ উনি পুরো গল্পটা স্থির হয়ে শুনলেন, তারপর টেবিলের ওপর রাখা জলের জাগ থেকে কিছুটা জল খেয়ে বললেন, আপনি ওই আয়না বাড়িতে রাখবেন না৷ ফেলে দিন, নষ্ট করে দিন, কাউকে দিয়ে দিন কিন্তু ঘরে রাখবেন না৷
কিন্তু কেন?
সে আমি বলতে পারব না কিন্তু রাখবেন না৷ আমার মন বলছে ওই আয়না ঠিক নয়৷
কিন্তু ওই আয়না তো আপনারই ছিল তাই না? তাহলে বলতে কেন পারবেন না? কি কারণে বিক্রি করে দিয়েছিলেন আয়নাটা? প্লিজ ম্যাডাম আমার কাছে গোপন করবেন না দয়া করে বলুন৷
মহিলা একটু চুপ থাকলেন তারপর যা কাহিনি শোনালেন শুনে গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল সুব্রত৷ এই বাড়িরই গ্রাউন্ড ফ্লোরে ভাড়া থাকত একটি এ্যাংলো মেয়ে৷ রোজালিন্ড গর্ডন৷ একটা প্রাইভেট কোম্পনাইতে রিসেপশনে কাজ করত৷ নামেই চাকরি আসলে ওটা লোক দেখানো মেয়েটির আসল পেশা ছিল প্রসটিটিউশন৷ সেট মিসেস মালহোত্রা জানতে পেরেছিলেন অনেক পরে৷ কিন্তু মেয়েটিকে বাড়ি থেকে তোলা সহজ ছিল না৷ কারণ ওর অনেক প্রভাবশালী কাস্টমার ছিল৷ প্রতি রাতেই চলত নতুন নতুন পুরুষের সঙ্গে লীলাখেলা৷ মাস তিনেক আগে মেয়েটিকে হঠাৎই তার বিছানায় মৃত পাওয়া যায়৷ খুন৷ কিন্তু কে খুন করল তার কিনারা এখনও পুলিশ করে উঠতে পারেনি৷ নিচের ঘরটা পুলিশ সিল করে রেখেছিল বেশ কিছুকাল৷ এই কিছুদিন আগে সিল খুলে দেওয়ার পরেই মিসেস মালহোত্রা মেয়েটির ঘরে ঢোকেন এবং দেখেন ঘরে অনেক পুরনো আসবাব৷ মানে মেয়েটির শখ ছিল পুরনো ফার্নিচারের৷ ওর শোবার ঘরে একটি পুরনো দিনের পালঙ্ক আর পালংকের মুখোমুখি এই বিশাল আয়নাটি দেওয়ালে সেট করা ছিল৷ মেয়েটির রিলেটিভ বলতে কেউ ছিল না বলে কাউকে খবরও দেওয়া যায়নি৷ মিসেস মালহোত্রা তাই সব ফার্নিচার কম দামে বিক্রি করে দেন৷ হ্যাঁ ওই হুসেনস ফার্নিচারেই৷
উঠে দাঁড়াল সুব্রত৷ মাথা টলছে৷ কোনওমতে বাইরে বেরিয়ে এল৷
.
অফিস থেকে আজ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়েছিল ও শরীর খারাপ করছে এই অজুহাতে৷ তারপর আগে সোজা পাড়ার সেই ফারনিচারের দোকানে গিয়ে মিস্তিরি নিয়ে এসে আগে আয়নাটাকে খোলাল৷ বাড়ির সকলে অবাক৷ নন্দিনীর তীব্র আপত্তিও শুনল না ও৷ আয়না খুলিয়ে একেবারে দোকানদারকে দিয়ে তাদের দোকানে পাঠিয়ে দিল৷ বলল যা দাম দেবে দিও৷ না দিলে রেখে দিও৷ দোকানদারও বেশ অবাক৷ এই দুদিন আগে লাগিয়ে এখন আবার খোলানোর তাড়া!
আয়না বিদায় নেওয়ার পর নিশ্চিন্ত হল সুব্রত৷ আয়েস করে বিছানায় বসল৷ বিকেলে মিসেস মালহোত্রা ম্যাডামের কথাগুলো যতবার মনে পড়ছে, গা ছমছম করে উঠছে৷ নন্দিনী ঘরে ঢুকে আবার বেশ বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞাসা করল আয়নাটা সরিয়ে দিলে কেন?
ওটা ভাল না৷
কেন শুনি৷
আমাদের অফিসে একজন বাস্তু বিশেষজ্ঞ রয়েছেন৷ উনি বললেন ঘরে এতবড় আয়না রাখতে নেই, অকল্যান হয়৷ বেমালুম মিথ্যে বলে দিল সুব্রত৷
বাব্বা তুমি আবার কবে এই সবে বিশ্বাস করতে শুরু করলে? কাল আমার বলে আর কথা বাড়াল না নন্দিনী৷ নিজের ক্রিম লোশন ইত্যাদি মাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল৷
আয়নাটা সরিয়ে ফেলায় যেমন নিশ্চিন্তি লাগছে তেমন মনটা একটু খারাপও লাগছে সুব্রতর৷ শখ করে কেনা এমন রাজকীয় আয়না…জিনিসটাও গেল টাকাও গেল আর তার থেকেও বেশি যা গেল তা নন্দিনীর আদর, শরীরের স্পর্শ৷ হ্যাঁ হয়ত সেই স্পর্শ মনের থেকে নয়, ঘোর লাগা…তবু… আজ থেকে আবার সেই নিরুত্তাপ জীবন…নানা কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়ল সুব্রত৷ আর আজও ঘুম ভাঙল বুকের ওপর চাপ অনুভব করায়৷ ভারি কিছু একটা চেপে বসেছে বুকের ওপর৷ অস্বস্তি হতে চোখ মেলতেই কেঁপে উঠল ও৷ নীল রঙের ড্রিমলাইটে দেখল নন্দিনী! হ্যাঁ নন্দিনী আজও আবার সেই দুইদিকে পা ছড়িয়ে সুব্রতর বুকের ওপর চেপে বসেছে৷ নিরাবরণ,
খোলা চুল…আর চোখের মনিদুটো…সেই আয়নার নারীমুর্তিটির মতোই টকটকে লাল, জ্বলছে৷ আজ সেই চোখদুটোয় যেন তীব্র আগুন…সুব্রত ভয়ে চিৎকার করে উঠতে গেল, পারল না, নন্দিনীর মুখ এগিয়ে গেল সুব্রতর গলার কাছে৷
সমাপ্ত