রায় রাজীবলোচন রায় বাহাদুর
গুরুত্বে দ্বিতীয় হলেও রাজীবলোচন তাঁর নিয়োগকর্ত্রী মহারাণী স্বর্ণময়ীর মতই সুখ্যাত ও সুপরিচিত। তাঁর বাস্তব পরামর্শ, মহারাণীর পরোপকারবৃত্তির প্রতি তাঁর আন্তরিক সহানুভূতি ও সমর্থন, এবং মানুষ ও সংসার সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞানের সহায়তা না পেলে, দরিদ্র ও আর্তদের দুঃখমোচনে মহারাণীর ব্যাপক পরিকল্পনা অত চমৎকারভাবে ও সাফল্যের সঙ্গে কার্যকর হতে পারত না। দেওয়ান রাজীবলোচন জন্মগ্রহণ করেন ঢাকার এক সম্ভ্রান্ত বনেদী পরিবারে।
মুসলমান শাসনকালে বাঙলার নবাব নাজিমের সরকারে চাকরি করার সময়ি পীতাম্বর দত্ত ‘রায়’ পদবীতে ভূষিত হন। পদবীটি বংশানুক্রমিকভাবে ব্যবহারের অধিকার তিনি লাভ করেছিলেন। পীতাম্বর দত্ত ঢাকার তিল্লিতে অনেক সম্পত্তি করেন; তাঁর বংশধরগণের শাখাপ্রশাখায় সে সম্পত্তি ভাগ বাঁটোয়ারা হয়ে যায়। এই সকল পরিবার এখনও তিল্লিতে বসবাস করছেন।
মহারাণীর অধীনে চাকরি নেবার পর রাজীবলোচন ঢাকা ছেড়ে মুর্শিদাবাদ চলে আসেন। মুর্শিদাবাদের সৈদাবাদে তিনি বাস করছেন। তিল্লির পৈতৃক সম্পত্তির অংশ তো আছেই, তাছাড়া তিনি স্বোপার্জিত অর্থে, মুর্শিদাবাদ ও ২৪ পরগণা জেলায় ভূসম্পত্তির অধিকারী হয়েছেন।
বাংলা সন ১২১৩ তে ঢাকার তিল্লিতে রাজীবলোচন রায় বাহাদুরের জন্ম হয়। প্রথমত তিনি কাশিমবাজার রাজ এস্টেটের রঙ্গপুর জেলার মোক্তার নিযুক্ত হন, স্বামীর সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য সরকারের বিরুদ্ধে মহারাণীর মামলা চলাকালে, তিনি যে দক্ষতা, ঐকান্তিকতা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে এই মোকদ্দমায় মহারাণীকে সাহায্য করেন, যার ফলে মহারাণী স্বামীর সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে সাফল্যলাভ করেন, সেজন্য মহারাণী স্বয়ং তাঁকে স্বীয় দেওয়ানপদে নিযুক্ত করেন। গত বত্রিশ বছর তিনি মহারাণীর অধীনে এই পদে নিযুক্ত আছেন; এই দীর্ঘ সময় তিনি বিশেষ দক্ষতা ও সুবিবেচনার সঙ্গে তাঁর কর্তব্য পালন করেছেন, তার জন্য মহারাণীর স্বার্থ ও মর্যাদা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি তাঁর অগণিত প্রজাসাধারণও সন্তুষ্ট হয়েছে; প্রশংসা অর্জন করেছে বাঙলার জনগনের কাছ থেকেও। তাঁর কর্তব্যবোধ ও কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার তাঁকে ১৮৭১-এর ১০ আগস্ট “রায় বাহাদুর” পদবীতে ভূষিত করেন। (দ্রষ্টব্য, ক্যালকাটা গেজেট)। মাননীয়া স্বর্ণময়ীকে “দি অর্ডার অব দি ক্রাউন অব ইন্ডিয়া’ সম্মানে ভূষিত করবার জন্য অনুষ্ঠিত দরবারে কমিশনার মিঃ পীককও রায় রাজীবলোচন রায় বাহাদুরের সপ্রশংস উল্লেখ করেন।
দেওয়ান রাজীবলোচনের চাকরিসূত্রে প্রভূত অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকলেও, তিনি আজীবন থেকেছেন নিঃস্বার্থ সেবা ও আপনভোলা কর্তব্যপালনের উজ্জল দৃষ্টান্ত হয়ে। স্বার্থসিদ্ধিতে অনিচ্ছুক এই মানুষটি আপন সম্মানজনক দারিদ্র্যে সন্তুষ্ট, এটা তাঁর চরিত্রের নিষ্ক্রিয় দিক। কিন্তু যে পরোপকারবৃত্তি ও মানবহিতৈষণা মহারাণীর অস্তিত্বের মূলকথা, সেক্ষেত্রে কিন্তু রাজীবলোচন অত্যন্ত সক্রিয়, সৎ কাজে সহায়তা দানে তিনি সদা প্রস্তুত। মহারাণীর সীমাহীন দান খয়রাৎ হয় তাঁরই মাধ্যমে কিন্তু এ জন্য তিনি বিন্দুমাত্র প্রশংসা বা কৃতিত্ব দাবী করেন না, এমন কি মহারাণীর দানশীলতায় নিম্নতম কর্মচারীদের দুর্নীতি ও লোভ নিবারণের জন্য তাঁকে যে অত্যন্ত পরিশ্রম করতে হয়, তার জন্য তাঁর প্রাপ্য প্রশংসাটুকুও গ্রহণে তিনি অনিচ্ছুক। জমিদারী পরিচালনার ক্ষেত্রেও তিনি যে কত দক্ষ, তার জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হল কাশিমবাজার রাজ এস্টেটের বর্তমান সমুন্নত আর্থিক অবস্থা। তাঁর উচ্চাশাহীন চরিত্র না হলে এবং একান্ত বিনীত না হলে তিনি এদেশীয় জনগণের মধ্যে ধনী-মানী ব্যক্তিরূপে অক্লেশেই গণ্য হতে পারতেন।
বাংলা ও ফার্সী ভাষা ও সাহিত্যে তিনি সুপন্ডিত হলেও, রাজীবলোচন কখনও অন্যান্য অনেকের মতো ইংরেজি ভাষা সাহিত্য এবং বিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে চান নি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাঁর বিচারবুদ্ধি ও সুবিবেচনা প্রায় অভ্রান্ত, আর জমিদারী পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর দক্ষতা ও জ্ঞান অসাধারণ। নিষ্ঠাবান হিন্দু রাজীবলোচন জীবনযাপন করেন অত্যন্ত সাদাসিধা ভাবে; অন্যান্যদের তুলনায় তাঁর আপন অভাববোধ সামান্যই। নিজস্ব সংসার না থাকায়, সে দিকে তাঁকে আদৌ মনোনিবেশ করতে হয় না, তাঁর সমগ্র মন ও চিন্তা অধিকার করে আছে মহারাণীর স্বার্থ আর প্রজা-সাধারণের মঙ্গল। আবার তাঁর ব্যক্তিগত উপার্জনেরও বড় একটা অংশ তিনি ব্যয় করেন মহারাণীর দান বহির্ভূত ক্ষেত্রে দান খয়রাতে। বিষয়কর্ম ও মানব-চরিত্র সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অধিকারী হওয়ায়, তিনি জনগণের মঙ্গলজনক কাজ ও দানের যোগ্য ব্যক্তি সম্পর্কে মহারাণীকে সঠিক পরামর্শ দেন। দান খয়রাতে মহারাণীর ব্যয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলেও রাজীবলোচনের সুপরিচালনায়, এস্টেটের আয়ও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ৷ এ জন্য তিনি আদৌ প্রজাপীড়ন করেন না। এই সকল কারণেই এবং অত্যন্ত যুক্তিযুক্তভাবেই তিনি দেশবাসীর অকুণ্ঠ প্রশংসা ও স্বীকৃতি লাভ করেছেন। তবে, যে কোন বিচার বিভাগীয় বা প্রশাসনের যে কোনো উপ বা নিম্নপদস্থ আধিকারিককে যে রায় বাহাদুর খেতাব দেওয়া হয় সেই একই সাধারণ খেতাব রাজীবলোচনের ক্ষেত্রেও দেওয়া না হলে, এবং উচ্চতর কোন খেতাবে তাঁকে ভূষিত করলে তাঁর যোগ্যতা ও নিঃস্বার্থপরতার প্রতি অধিকতর সম্মান প্রদর্শন করা হয়।