মহারাণী স্বর্ণময়ী সি আই
মহারাণী স্বর্ণময়ী সি আই, ১২৩৪ বঙ্গাব্দের (১৮২৭ খ্রিস্টাব্দ) অগ্রহায়ণ মাসে বর্ধমান জেলার ভাটাকূলে জন্মগ্রহণ করেন; তাঁর বিবাহ হয় ১২৪৫ বঙ্গাব্দের (১৮৩৮ খ্রীস্টাব্দে) বৈশাখ মাসে। তাঁর এস্টেটের মহালসমূহ ছড়িয়ে আছে বাংলার মুর্শিদাবাদ, রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুর, মালদহ, রংপুর, বগুড়া, ফরিদপুর, যশোর, নদীয়া, বর্ধমান, হাওড়া ও ২৪ পরগণা জেলাসমূহে আর উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের গাজিয়াবাদ ও আজমগড় জেলা দুটিতে। কলকাতা ও তার উপকণ্ঠেও তাঁর বহু ভূসম্পত্তি আছে। রংপুর জেলার পরগণাবাহার বন্দর তাঁর এস্টেটের বৃহত্তম মহাল। যা থেকে ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্য স্থাপনের ইতিহাস শুরু হয় সেই পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রটি তাঁর নদীয়া জেলার জমিদারীর মধ্যেই অবস্থিত।
রাজশক্তির প্রতি তাঁর সশ্রদ্ধ আনুগত্য, জনগণের মঙ্গলের জন্য তাঁর গঠনমূলক কাজ ও প্রায় সীমাহীন দানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৮৭১ এর ১০ আগস্ট তাঁকে ‘মহারাণী’ খেতাবে ভূষিত করা হয় (দ্রষ্টব্য, ঐ তারিখের কলকাতা গেজেট)। তাঁকে সনদদানের উদ্দেশ্যে ঐ বছর ১৩ অক্টোবর কাসিম বাজার রাজবাড়ীতে আহূত বিশেষ দরবারে সভাপতিত্ব করেন কমিশনার মিঃ মোলোনি।
তাঁর জনকল্যাণমূলক কার্যসমূহ, তাঁর দান ও মানবপ্রেম এতই প্রত্যক্ষ ও উল্লেখযোগ্য যে কলকাতার ইংলিশম্যান পত্রিকাটি তাঁকে ইংল্যান্ডের বর্তমান ব্যারোনেস বার্ডেট কুটের সঙ্গে তুলনা করেন।
১৮৭৪ এর দুর্ভিক্ষের সময় তিনি যেভাবে আর্ত জনগণের সেবা করেছিলেন তার স্বীকৃতিস্বরূপ এবং পূর্বাপর তাঁর অন্যান্য গুণের মূল্যায়ন করে ১৮৭৫ এর ১২ মার্চ একটি ঘোষণা দ্বারা সরকারের এযাবৎকাল অনুসৃত প্রথানুগ রীতি শিথিল করে তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে, তাঁর ইচ্ছামত যে-কাউকে তিনি পোষ্য নেবেন তাঁকেই সরকার মহারাজ খেতাব দেবেন যাতে মানবসেবায় যে অক্লান্ত ধারা তিনি অনুসরণ করে চলেছেন, সেটি তাঁর অবর্তমানেও তাঁর উত্তরাধিকারীগণ যথোচিত মর্যাদার সঙ্গে পালন করতে পারেন। (দ্রষ্টব্য, কলিকাতা গেজেট)।
রাজকীয় সম্মানলাভের এটি সূচনামাত্র। ১৮৭৮এর জানুয়ারিতে (দ্রষ্টব্য, ইন্ডিয়া গেজেট) ব্রিটিশ অভিজাতশ্রেণির কয়েকজন মহিলার সঙ্গে তাঁকেও ‘মেম্বার অব দি ইমপিরিয়াল ক্রাউন অব ইন্ডিয়া’ করার জন্য মনোনয়নের প্রথম তালিকায় তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়; উল্লেখ্য যে খেতাবটিও ছিল নবসৃষ্ট। ঐ বছরই কাসিমবাজার রাজবাড়িতে ১৪ আগস্ট অনুষ্ঠিত দরবারে প্রেসিডেন্সি কমিশনার মিঃ পীকক্ তাঁর হাতে রাজকীয় সম্মাননা পত্রটি তুলে দেন। বাংলায় তিনিই একমাত্র মহিলা যাঁকে এই দুর্লভ সম্মান দ্বারা সম্মানিত করা হয়।
১৮৭৮ এর ২২ আগস্ট কলকাতার ইংলিশম্যান পত্রিকায় মিঃ পীককের এই অবসরে প্রদত্ত ভাষণের পূর্ণ বয়ান এবং উত্তরে মহারাণী স্বর্ণময়ীর প্রদত্ত ভাষণের সারাংশ প্রকাশিত হয়। এই ভাষণটি এখানে উদ্ধৃত হল :
মহামান্য মহারাণীর রাজকীয় অনুগ্রহ ও শ্রদ্ধার প্রতীকস্বরূপ ‘ইমপিরিয়াল অর্ডার অব দি ক্রাউন অব ইন্ডিয়া’ সম্মাননাটি মহারাণীর নামে আপনাকে ব্যক্তিগভাবে উপস্থিত থেকে প্রদান করতে না পারার জন্য বাংলার মাননীয় লেফটেন্যান্ট গভর্নর দুঃখ প্রকাশ করে আমাকে উক্ত কাজের জন্য প্রতিনিধি হিসাবে পাঠিয়েছেন।
আপনি যে সকল সময় ও বিবিধ প্রকারে মুক্ত হস্তে দান করে চলেছেন তার এবং আপনার জনহিতৈষণামূলক কার্যাবলীর স্বীকৃতি স্বরূপই এটি দেওয়া হচ্ছে। এই সভায় নিশ্চয়ই এমন অনেক ব্যক্তি উপস্থিত আছেন, যাঁরা আপনার সৎকার্যসমূহ ও সুবিস্তৃত এস্টেটের সুপরিচালনা সম্পর্কে আমার চেয়ে অনেক বেশি ওয়াকিবহাল, কিন্তু এমন অনেক ব্যক্তি আছেন, যাঁরা আপনার দানশীলতার কথা শুনে থাকলেও তার ব্যাপ্তি ও পদ্ধতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল নন। এই জন্য আমার মনে হয় আপনার যে দানশীলতা ও ঔদার্যের জন্য মহারাণীর এই স্বীকৃতিমূলক সম্মাননা, তার কয়েকটির উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। পূর্বে আপনি বহুক্ষেত্রে যেভাবে দান করেছেন, এবং বর্তমানে দানশীলতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তার কয়েকটির উল্লেখ করা আমার পক্ষে কঠিন হবে না। বস্তুতপক্ষে দীর্ঘ দানশীলতাই আপনার জীবন। বিগত কয়েক বছরের দৃষ্টান্তের মধ্যে আমি আমার বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখব, কারণ আপনার দানের ক্ষেত্র ও পাত্র এত ব্যাপক এবং সংখ্যায় এত বেশি যে, সবগুলির উল্লেখ না করে নিদর্শনমূলক কয়েকটি মাত্র আমি এখানে উল্লেখ করছি।
১৮৭১-৭২-এ আপনি চট্টগ্রামের নাবিক-আবাসের জন্য দিয়েছেন ৩,০০০ টাকা, কলকাতার চাঁদনী হাসপাতালের জন্য ১,০০০ টাকা, যশোহরে ভৈরব নদের উন্নয়ন বাবদ ১,০০০ টাকা, মুর্শিদাবাদে ত্রাণকার্যের জন্য ১,০০০ টাকা ৷
১৮৭২-৭৩ এ আপনি দিয়েছেন বেথুন ফিমেল স্কুলকে ১,৫০০ টাকা, বগুড়া ইনসটিটিউশনকে ৫০০ টাকা; নেটিভ হাসপাতালকে ৮,০০০ টাকা, সংক্রামক জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ত্রাণের জন্য ১,৫০০ টাকা এবং বহরমগঞ্জ রাস্তা নির্মাণের জন্য ১,০০০ টাকা।
১৮৭৪-৭৫ এ অন্যান্য দান ছাড়াও, মুর্শিদাবাদ, ছাড়াও, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা, ২৪ পরগণা, নদীয়া ও বর্ধমানে দুঃস্থদের ত্রাণের জন্য আপনি এক লক্ষ দশ হাজার টাকা দান করেছেন।
পরবর্তী বছর আপনি দিয়েছেন, বহরমপুর কলেজকে ১০,০০০ টাকা, রাজশাহী মাদ্রাসাকে ৫,০০০ টাকা, কটক কলেজকে ৫,০০০ টাকা আর গারো পাহাড় ডিসপেনসারিকে ৫,০০০ টাকা কটক কলেজকে ৫,০০০ টাকা আর গারো পাহাড় ডিসপেনসারিকে ৫,০০০ টাকা।
১৮৭৬-৭৭-এ আপনি দিয়েছেন মিস মিলম্যান কর্তৃক স্থাপিত ক্যালকাটা ফিমেল স্কুলকে ১,০০০ টাকা; রংপুর হাই স্কুলকে ৪,০০০ টাকা; আলিগড় কলেজকে ১,০০০ টাকা; ক্যালকাটা জুওলজিক্যাল গার্ডেনকে ১৪,০০০ টাকা; কলকাতার অ্যাসোসিয়েশন অব ফেমিনকে ৮,০০০ টাকা; বাখরগঞ্জে সাইক্লোনে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণের জন্য ৩,০০০ টাকা; গত বছর আপনি দিয়েছেন গরীবদের গরম কাপড় কেনার জন্য ১১,১২১ টাকা; জঙ্গিপুর ডিসপেনসারিকে ৫০০ টাকা, মাদ্রাজ দুর্ভিক্ষ ত্রাণনিধিতে ১০,০০০ টাকা; টেম্পল নেটিভ অ্যাসাইলামকে ১,০০০ টাকা, হাওড়া ডিসেপনসারিকে ৫০০ টাকা; ক্যালকাটা ওরিয়েন্টাল সেমিনারিকে ৩,০০০ টাকা; নদীয়া ও বাঁকুড়ায় গৃহদাহে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণের জন্য ১,০০০ টাকা; ক্যালকাটা ডিসট্রিক্ট্-চ্যারিটেবল সোসাইটিকে ৫০০ টাকা; ম্যাকডোনাল্ড ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনকে ১,০০০ টাকা, পতিতাদের জন্য মিস ফিউড্যালের ইনসটিটিউশনকে ১,০০০ টাকা।
এ তালিকা হয়ত কিঞ্চিৎ দীর্ঘ তবু একে আপনার দানের পূর্ণ বিবরণ বলা যায় না। আমার বক্তব্য হল এ তালিকা আদৌ পুর্ণাঙ্গ নয়, কারণ, বিভিন্ন ব্যক্তির স্মৃতিরক্ষা প্রভৃতি উদ্দেশ্যে আপনার কাছ থেকে যে অজস্র চাঁদা নেওয়া হয়েছে, ইচ্ছাকৃত ভাবেই আমি এখানে সেগুলির উল্লেখ করলাম না।
উপরের তালিকাটি দীর্ঘ, তালিকাভুক্ত দানের পরিমাণ ২,০০,০০০ টাকা কিন্তু স্কুল, গ্রন্থাগার, ডিসপেন্সারি, দরিদ্র ও দুঃস্থদের ত্রাণবাবদ ঐ সময় আপনার দানের পরিমাণ তিন লক্ষ টাকারও অধিক; তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ঐ সময়কালে আপনি দান করেছেন সওয়া পাঁচ লাখ টাকারও অধিক। এই অর্থ আপনার মোট আয়ের এক ষষ্ঠাংশের থেকে কম নয়। পরিমাণটি এমনিতেই পর্যাপ্ত; কিন্তু যে-ভাবে এই সকল দান দেওয়া হয়েছে সেটিই সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ হঠাৎ দান হিসাবে দিতে আমরা দেখেছি; সে সব দান যে সৎ ও প্রয়োজনীয় উদ্দেশ্যেই দেওয়া হয়ে থাকে, এতেও কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু সে-সব দানের উদ্দেশ্য থাকে জনগণের মধ্যে দাতার নাম যশ হবে বা তিনি অন্য কোন ভাবে পুরস্কৃত হবেন। আপনায় ক্ষেত্রে কিন্তু সে কথা বলা যায় না। প্রার্থী হয়ে কেউ আপনার কাছে এসে দাঁড়ালে, তবে আপনি দান করবেন, তা না করে আপনি চান, সাহায্যদানের উপযুক্ত ক্ষেত্র ও পাত্রের কথা আপনাকে জানান হোক; জানামাত্রই আপনি উদারভাবে দান করেন, বিনিময়ে কোন পুরস্কারই আপনি আশা করেন না। এককথায় জনগণের মঙ্গলসাধনের মহৎ ইচ্ছা থেকেই আপনার দান উৎসারিত হয়, আপনি ডান হাত দিয়ে দান করলে আপনার বাঁ হাত সে কথা জানতে পারে না। এ ধরনের দান অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা এমন দান অসাধারণও। বাংলা ও উত্তরপশ্চিম প্রদেশের কমপক্ষে দশটি জেলায় ছড়িয়ে থাকা আপনার বিস্তৃত জমিদারী আপনি যে কত সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেন, সে সম্পর্কে আমার বলার কিছু নেই। তবু বলতেই হয় যে জমিদারী সংক্রান্ত ব্যাপারে আপনি যেমন সক্রিয় অংশ নেন এবং এর পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ বিষয়ে যে গভীর জ্ঞানের পরিচয় দেন, এদেশে মহিলাদের মধ্যে তেমন সক্রিয়তা ও দক্ষতা তুলনাহীন না হলেও বিরল। আপনার সুদক্ষ পরামর্শদাতা বাবু রাজীবলোচন রায়ের সহায়তায় প্রজাদের বিন্দুমাত্রও হয়রান না করে আপনার ন্যায্য খাজনা আপনি সুচারুরূপে আদায় করতে পারায়, ইদানিংকালে অন্যান্য বহু জমিদার যেভাবে নানা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছেন, আপনাকে সেরকম কোন ঝঞ্ঝাটের সম্মুখীন হতে হয় না। আমার দিক থেকে একথা বলা বাহুল্য, আমার ওপর আজ যে কর্তব্য সম্পাদনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেটি আমার পক্ষে অত্যন্ত আনন্দদায়ক। ২৪ পরগণার ম্যাটিস্ট্রেট হিসাবে এবং ঢাকার কমিশনার হিসাবে আমার প্রতিটি পরিকল্পনায় আপনার উদার ও অবাধ সহযোগিতার জন্য বহুবার আপনাকে ধন্যবাদ জানাবার অবকাশ আমার হয়েছে। ১৮৭৬-এর ১ অক্টোবর বাখরগঞ্জ জেলার দক্ষিণাংশে মৃত্যু আর ধ্বংসের তান্ডব ঘটিয়ে যে দুর্যোগ বয়ে যায়, তার ফলে ঐ সমগ্র এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল আর্ত অভাবগ্রস্ত মানুষের হাহাকার, মানুষের সে দুঃসময়ে আপনি উদারভাবে সেবায় এগিয়ে এসেছিলেন, তার জন্য এই অবকাশে আপনাকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারছি না। মহামান্যা সম্রাজ্ঞী কৃপাবশত যে সম্মানিত সাম্মানিক পদে আপনাকে নিয়োগ করলেন, তৎসংক্রান্ত অভিজ্ঞানপত্র এবং মাননীয় ভাইসরয় ও মান্যবর লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অভিনন্দনপত্র আপনাকে অর্পণ করে এবং যোগ্যতাবশে যে সম্মাননা আপনি অর্জন করলেন, দীর্ঘজীবী হয়ে সে সম্মান আপনি ভোগ করুন এই কামনা জানিয়ে, আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।’
উত্তরে মহারাণী অভিজাত মহিলার যোগ্য ভাষণ দেণ। এই সম্মাননার জন্য তিনি মহামান্যা সম্রাজ্ঞীকে তাঁর রাজভক্তিমিশ্রিত কৃতজ্ঞতা বিনীতভাবে নিবেদন করেন; আশা প্রকাশ করেন, তাঁর প্রতি যে অনুগ্রহ মহামান্যা সম্রাজ্ঞী, মাননীয় ভাইসরয়, মান্যবর লেফটেন্যান্ট গভর্নর এবং কমিশনার সাহেব থেকে সকল শ্রেণির আধিকারিক এতদিন দেখিয়ে এসেছেন সে অনুগ্রহ ভবিষ্যতেও তাঁরা অক্ষুণ্ণ রাখবেন। পরিশেষে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, তিনি আদৌ ইংরেজি ভাষা না জানার জন্য, আর যে সকল ইউরোপীয় মহিলা কৃপাপরবশ হয়ে এই অনুষ্ঠানে যোগদান করেছেন, তাঁরা ভাল বাংলা না জানায়, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁদের সঙ্গে খোলামেলা ভাবে মেলামেশা করতে পারলেন না।
দেখা যাচ্ছে, মিঃ পীকক্ ১৮৭৬-৭৭ পর্যন্ত মহারাণীর দানের যে হিসাব দিয়েছেন তার মোট পরিমাণ দাঁড়ায় এগার লক্ষ টাকা; কাজেই, এখন (১৮৮১) পর্যন্ত তাঁর দানের হিসাব ধরতে হলে নির্ভয়ে আরও কয়েক লক্ষ টাকা এর সঙ্গে যোগ করা যায়।
তাঁর ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান
প্রতি বছর মকর সংক্রান্তিতে তিনি অন্নমেরু উৎসব পালন করেন। এতে হাজার হাজার মণ চালের অন্ন, তার সঙ্গে উপযুক্ত পরিমাণ তরিতরকারী, ঘি, ডাল, চিনি, বিভিন্ন প্রকারের মিষ্টান্ন এবং তার পাশে বিপুল পরিমাণ বস্ত্র সাজিয়ে পূজা অনুষ্ঠানের পর ব্রাহ্মণ, ফকির এবং সকল সমাজ, সম্প্রদায় ও শ্রেণির জনগণের, বিশেষত দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। অন্ন বিতরণের পর তিনি বাংলার সকল জেলার ব্রাহ্মণ ও পন্ডিতগণকে শাল ও চাদর আর নাগা ফকিরগণকে শীত থেকে রক্ষা করতে কম্বল দান করেন।
মহাবিষুব সংক্রান্তিতে তিনি পিতলের ঘড়া এবং অন্ন ও বস্ত্র ব্রাহ্মণগণকে দান করেন। তাছাড়া, এই উপলক্ষে তিনি বহুসংখ্যক কাঙালী ভোজন করান।
দুর্গাপূজা উপলক্ষেও তিনি বাংলার সমস্ত ব্রাহ্মণ পন্ডিতবর্গকে মূল্যবান দান ও দক্ষিণা দেন; তার সঙ্গে থাকে ব্রাহ্মণ ও কাঙালী ভোজন। স্বগৃহের দুর্গাপুজা অনুষ্ঠানের জন্য যে-সকল ব্রাহ্মণ এই ধর্মপ্রাণা মহিলার অর্থসাহায্য প্রার্থনা করেন, তিনি তাঁদের ও যথোপযুক্ত অর্থসাহায্য দান করেন।
শ্যামা পূজা, দোল, ঝুলন, জন্মাষ্টমী, রথ প্রভৃতি অন্যান্য হিন্দু পুজাপার্বণ উপলক্ষে তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। সারা রাজবাড়ি আলোকমালায় সাজিয়ে মহা ধুমধামের সঙ্গে তিনি শ্যামাপূজার অনুষ্ঠান করেন।
হিন্দু সমাজের প্রায় সকলেই জানেন, যাঁরা অর্থাভাবের কারণে কন্যার বিবাহ দিতে পারছেন না, স্বর্গত মাতাপিতার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করতে পারছেন না, বা পুত্রের উপনয়ন দিতে পারছেন না, মহারাণী স্বর্ণময়ীর কাছে প্রার্থনা জানালেই তাঁরা উপযুক্ত দান লাভ করেন। এমন দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই, যখন দেওয়ানী আদালতের রায়ে কোন ঋণগ্রস্তের ভদ্রাসন বা সম্পত্তি নিলাম হয়ে যাচ্ছে, সে ব্যক্তি তাঁর সাহায্যপ্রার্থী হলে তিনি অকৃপণভাবে তাকে ঋণমুক্ত করেন।
একথা বললে আদৌ অত্যুক্তি করা হবে না যে, প্রতিদিন তিনি যে-সব ভিখারীকে রান্না করা অন্নব্যঞ্জন বা চাল-ডাল দান করেন, সংখ্যায় তারা প্রায় অগণিত।
শিক্ষাবিস্তারের জন্য তাঁর ব্যয়
শিক্ষা বিস্তারে তিনি বিশেষ উৎসাহী; এজন্য তিনি বেশ কয়েকজন অনাথ বালকের থাকা-খাওয়া, বই-খাতাসহ সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাঁরই কৃপায় বেশ কিছু ছাত্র বহরমপুর কলেজে পড়ছে। সংস্কৃত শিক্ষার উন্নয়নের জন্য তিনি বাংলার বিভিন্ন অংশে বহু টোলের সর্বপ্রকার ব্যয় বহন করেন। নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের মতো তিনিও সংস্কৃতে গভীর পান্ডিত্যসম্পন্ন মনীষীদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন। স্বদেশবাসীর মধ্যে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের প্রসার যাতে ভালভাবে হয়, এই উদ্দেশ্যে তিনি সংস্কৃত পন্ডিতগণকে উদারভাবে উৎসাহ দেন, তাঁদের পরিচালিত টোলগুলিকেও সর্বপ্রকারের সাহায্য করেন। সংস্কৃত উপাধি পরীক্ষায় চারটি বৃত্তিদানের উদ্দেশ্যে তিনি ৮,০৫০ টাকার একটি কমিশন স্থাপন করেছেন। মহারাণী নিজে বাঙলা ভাষায় পান্ডিত্যের অধিকারীণী হওয়ায় এই ভাষায় উপযুক্ত সাহিত্যিকদের তিনি উদারভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বিভিন্ন বিষয়ে বাঙলায় ছোট ছোট পুস্তিকা রচয়িতাগণও তাঁর কাছ থেকে প্রচুর পারিতোষিক লাভ করেন। আর, ইংরেজি বা অন্য ভাষায়ও যাঁরা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন, তাঁদেরও তিনি উপেক্ষা করেননি। শিক্ষাপ্রসারে উৎসাহ দানের জন্য তিনি বাঙলার প্রায় সকল বিদ্যালয়কে বার্ষিক ভাল পরিমাণ আর্থিক অনুদান ছাড়াও পুস্তক, পুরস্কার ও পদক দিয়ে সাহায্য করেন।
বহু সংখ্যক পুস্করিণী ও কূপ তিনি খনন করিয়েছেন, কোথাও সংক্রামক ব্যাধি দেখা দিলে আর্তদের ত্রাণকার্যে তাঁর দান অবশ্যম্ভাবী; তাছাড়া, পথ বা পুল নির্মাণের জন্য বা ডিসপেন্সারি, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে তিনি অকৃপণভাবে সাহায্য করেন।
জীবজন্তুর প্রতিও তাঁর মমতার শেষ নেই। কলকাতার চিড়িয়াখানাকে তিনি প্রচুর অর্থ দান হিসাবে দিয়েছেন; সরকারও তাঁর সম্মানে এখানকার একটি গৃহের নামকরণ করেছেন “মহারাণী স্বর্ণময়ী হাউস”।
দুঃখী, অভাবী, আর্ত মানুষের সেবায় তিনি যেভাবে অকাতরে দান করে চলেছেন এবং ধনী ও অভিজাত শ্রেণির মানুষদের কাছে তিনি উচ্চ আদর্শ ও সৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সে কথা স্মরণ করলে আপনা থেকেই মনে প্রার্থনা উৎসারিত হয় যে, ঈশ্বর তাঁকে দীর্ঘজীবী করুন যাতে তিনি আরও বহু বহু বছর মানুষের মঙ্গল সাধন করতে পারেন, স্বার্থপর, সহানুভূতিহীনদের যাতে তাঁর আদর্শ পরোপকারে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। মনে হয় তাঁর গভীর উপলব্ধি, স্বাভাবিক সৎ প্রকৃতি, ন্যায়-অন্যায় বোধ এবং আন্তরিক দানশীলতা তাঁকে আজকের অন্যান্য মানুষ অপেক্ষা অনেক ঊর্ধ্বে স্থাপন করেছে; তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই, বিশেষত এই দানশীল জাতির মধ্যেও তাঁর সদা প্রবাহিত দানশীলতা তুলনাবিহীন।
মহারাণী স্বর্ণময়ীর প্রকৃতি এতই স্বার্থলেশশূন্য ও সহানুভূতিপূর্ণ যে আর্তের আর্তিমোচনকেই তিনি তাঁর দানশীলতার সর্বোচ্চ পুরস্কারহিসাবে গণ্য করেন অন্য কোন পুরস্কারের প্রত্যাশা তিনি করেন না, উপকৃত তাঁর জয়ধ্বনি করুক, এও তাঁর কাম্য নয়। কিন্তু তাঁর মহৎ কর্মসমূহই তাঁকে জনসমক্ষে এনে দেয়; তাই ভয়ভীতিশূন্য, ক্লান্তিহীন বদান্যতা জনগণকে তাঁর কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছে; আগামী বহু যুগ, উপকৃতের সংখ্যার মতই সীমাহীনকাল লোকে তাঁকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবেন।
নিম্নোদ্ধৃত সংস্কৃত শ্লোকটি তাঁর সম্পর্কে যথা অর্থেই প্রযোজ্য :
দয়ালবশ্য দাতারৌ রূপবন্তৌ জিতেন্দ্রিয়াঃ।
পরোপকারিণশ্চৈব তেৎপূর্বা মানবাঃ স্মৃতাঃ।।
[দয়ালু, দাতা, রূপবান, জিতেন্দ্রিয় এবং পরোপকারী মানবদেব অপূর্ব মানবরূপে স্মরণ করা হয়। ]
এই ভারতের বহু বিশিষ্টা মহিলা দেবতার উদ্দেশ্যে বহু ব্যয়ে বিরাট বিরাট দেবমন্দির নির্মাণ করেছেন, কিন্তু মহারাণী আরও বাস্তব ও মঙ্গলময় পন্থায় ঈশ্বর-সৃষ্ট আর্ত, পীড়িত ও অভাবগ্রস্তদের সেবায় বিরামবিরতিহীনভাবে দান করে চলেছেন।
পূর্বেই বলা হয়েছে, মহারাণী তাঁর সম্পত্তিতে অধিকার পাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রায় রাজীবলোচন রায় বাহাদুর তাঁর দেওয়ান নিযুক্ত হন। ঢাকা জেলার তিল্লির এই মানুষটি দেশবাসীর মঙ্গলসাধনের জন্য মহারাণীর মহাব্রতের প্রকৃত সহায়ক হবার জন্যই যেন সৃষ্ট হয়েছেন।
রাজীবলোচন রায়ের জীবন সম্পর্কে কিছু না লিখলে, মহারাণীর জীবনকথা অপূর্ণ থেকে যাবে। তাই আমরা তাঁর সম্পর্কেও একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেব।