রাজা ও রানী – ৫ম অঙ্ক (শেষ)

পঞ্চম অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

কাশ্মীর।  প্রাসাদ

রেবতী ও চন্দ্রসেন

 

রেবতী।               যুদ্ধসজ্জা? কেন যুদ্ধসজ্জা। শত্রু কোথা।
মিত্র আসিতেছে। সমাদরে ডেকে আনো
তারে। করুক সে অধিকার কাশ্মীরের
সিংহাসন। রাজ্যরক্ষা-তরে তুমি এত
ব্যস্ত কেন। এ কি তব আপনার ধন।
আগে তারে নিতে দাও, তার পরে ফিরে
নিয়ো বন্ধুভাবে। তখন এ পররাজ্য
হবে আপনার।
 
চন্দ্রসেন।                                চুপ করো, চুপ করো,
ব’লো না অমন করে। কর্তব্য আমার
করিব পালন; তার পরে দেখা যাবে
অদৃষ্ট কী করে।
 
রেবতী।                                  তুমি কী করিতে চাও
আমি জানি তাহা। যুদ্ধের ছলনা করে
পরাজয় মানিবারে চাও। তার পর
চারিদিক রক্ষা করে সুবিধা বুঝিয়া
কৌশলে করিতে চাও উদ্দেশ্য সাধন।
 
চন্দ্রসেন।              ছি ছি রানী, এ-সকল কথা শুনি যবে
তব মুখে, ঘৃণা হয় আপনার ‘পরে।
মনে হয় সত্য বুঝি এমনি পাষণ্ড
আমি; আপনারে ছদ্মবেশী চোর বলে
সন্দেহ জনমে। কর্তব্যের পথ হতে
ফিরায়ো না মোরে।
 
রেবতী।                                      আমিও পালিব তবে
কর্তব্য আপন। নিশ্বাস করিয়া রোধ
বধিব আপন হস্তে সন্তান আপন।
রাজা যদি না করিবে তারে, কেন তবে
রোপিলে সংসারে পরাধীন ভিক্ষুকের
বংশ। অরণ্যে গমন ভালো, মৃত্যু ভালো,
রিক্তহস্তে পরের সম্পদছায়ে ফেরা
ধিক্‌ বিড়ম্বনা। জেনো তুমি, রাজভ্রাতা,
আমার গর্ভের ছেলে সহিবে না কভু
পরের শাসনপাশ; সমস্ত জীবন
পরদত্ত সাজ পরে রহিবে না বসে,
রাজসভা-পুত্তলিকা হয়ে। আমি তারে
দিয়েছি জনম, আমি তারে সিংহাসন
দিব,–  নহে আমি নিজ হস্তে মৃত্যু দিব
তারে। নতুবা সে কুমাতা বলিয়া মোরে
দিবে অভিশাপ।
 

কঞ্চুকীর প্রবেশ

 

কঞ্চুকী।                                    যুবরাজ এসেছেন
রাজধানীমাঝে। আসিছেন অবিলম্বে
রাজসাক্ষাতের তরে।
 
রেবতী।                                          অন্তরালে রব
আমি। তুমি তারে ব’লো, অস্ত্রশস্ত্র ছাড়ি
জালন্ধর-রাজপদে অপরাধিভাবে
করিতে হইবে তারে আত্মসমর্পণ।
 
চন্দ্রসেন।              যেয়ো না চলিয়া।
 
রেবতী।                                   পারি নে লুকাতে আমি
হৃদয়ের ভাব। স্নেহের ছলনা করা
অসাধ্য আমার। তার চেয়ে অন্তরালে
গুপ্ত থেকে শুনি বসে তোমাদের কথা।
 

[ প্রস্থান

 

কুমারসেন ও সুমিত্রার প্রবেশ

 

কুমারসেন।           প্রণাম।
 
সুমিত্রা।                       প্রণাম তাত।
 
চন্দ্রসেন।                                     দীর্ঘজীবী হও।
 
কুমারসেন।            বহু পূর্বে পাঠায়েছি সংবাদ, রাজন্‌,
শত্রুসৈন্য আসিছে পশ্চাতে, আক্রমণ
করিতে কাশ্মীর। কই রণসজ্জা কই।
কোথা সৈন্যবল।
 
চন্দ্রসেন।                                 শত্রুপক্ষ কারে বল’।
বিক্রম কি শত্রু হল? জননী সুমিত্রা,
বিক্রম কি নহে বৎসে কাশ্মীর-জামাতা?
সে যদি আসিল গৃহে এতকাল পরে,
অসি দিয়ে তারে কি করিব সম্ভাষণ?
 
সুমিত্রা।                হায় তাত, মোরে কিছু ক’রো না জিজ্ঞাসা।
আমি দুর্ভাগিনী নারী কেন আসিলাম
অন্তঃপুর ছাড়ি। কোথা লুকাইয়া ছিল
এত অকল্যাণ। অবলা নারীর ক্ষীণ
ক্ষুদ্র পদক্ষেপে সহসা উঠিল রুষি
সর্প শতফণা। মোরে কিছু শুধায়ো না।
বুদ্ধিহীনা আমি। তুমি সব জান ভাই।
তুমি জ্ঞানী, তুমি বীর, আমি পদপ্রান্তে
মৌন ছায়া। তুমি জান সংসারের গতি,
আমি শুধু তোমারেই জানি।
 
কুমারসেন।                                            মহারাজ,
আমাদের শত্রু নহে জালন্ধরপতি,
নিতান্তই আপনার জন। কাশ্মীরের
শত্রু তিনি, আসিছেন শত্রুভাব ধরি।
অকাতরে সহিয়াছি নিজ অপমান,
কেমনে উপেক্ষা করি রাজ্যের বিপদ।
 
চন্দ্রসেন।               সেজন্য ভেবো না বৎস, যথেষ্ট রয়েছে
বল। কাশ্মীরের তরে আশঙ্কা কিছুই
নাই।
 
কুমারসেন।                 মোর হাতে দাও সৈন্যভার।
 
চন্দ্রসেন।                                                   দেখা
যাবে পরে। আগে হতে প্রস্তুত হইলে
অকারণে জেগে ওঠে যুদ্ধের কারণ।
আবশ্যক কালে তুমি পাবে সৈন্যভার।
 

রেবতীর প্রবেশ

 

রেবতী।               কে চাহিছে সৈন্যভার?
 
সুমিত্রা ও কুমারসেন।                         প্রণাম জননী।
 
রেবতী।               যুদ্ধে ভঙ্গ দিয়ে তুমি এসেছ পলায়ে,
নিতে চাও অবশেষে ঘরে ফিরে এসে
সৈন্যভার? তুমি রাজপুত্র? তুমি চাও
কাশ্মীরের সিংহাসন? ছি ছি লজ্জাহীন।
বনে গিয়ে থাকো লুকাইয়া। সিংহাসনে
বসো যদি, বিশ্বসুদ্ধ সকলে দেখিবে
কনককিরীটচূড়া কলঙ্কে অঙ্কিত।
 
কুমারসেন।            জননী, কী অপরাধ করেছি চরণে?
কী কঠিন বচন তোমার। এ কি মাতা
স্নেহের ভর্ৎসনা। বহুদিন হতে তুমি
অপ্রসন্ন অভাগার ‘পরে। রোষদীপ্ত
দৃষ্টি তব বিঁধে মোর মর্মস্থলে সদা;
কাছে গেলে চলে যাও কথা না কহিয়া
অন্য ঘরে; অকারণে কহ তীব্র বাণী
বলো মাতা, কী করিলে আমারে তোমার
আপন সন্তান বলে হইবে বিশ্বাস।
 
রেবতী।                বলি তবে?
 
চন্দ্রসেন।                            ছি ছি, চুপ করো রাণী।
 
কুমারসেন।                                                     মাতঃ,
অধিক কহিতে কথা নাহিক সময়।
দ্বারে এল শত্রুদল আমারে করিতে
আক্রমণ। তাই আমি সৈন্য ভিক্ষা মাগি।
 
রেবতী।               তোমারে করিয়া বন্দী অপরাধিভাবে
জালন্ধর-রাজকরে করিব অর্পণ।
মার্জনা করেন ভালো, নতুবা যেমন
বিধান করেন শাস্তি নিয়ো নতশিরে।
 
সুমিত্রা।                ধিক পাপ। চুপ করো মাতা। নারী হয়ে
রাজকার্যে দিয়ো না দিয়ো না হাত। ঘোর
অমঙ্গলপাশে সবারে আনিবে টানি,
আপনি পড়িবে। হেথা হতে চলো ফিরে
দয়ামায়াহীন ওই সদা ঘূর্ণমান
কর্মচক্র ছাড়ি। তুমি শুধু ভালোবাসো,
শুধু স্নেহ করো, দয়া করো, সেবা করো,–
জননী হইয়া থাকো প্রাসাদ-মাঝারে।
যুদ্ধ দ্বন্দ্ব রাজ্যরক্ষা আমাদের কার্য
নহে।
 
কুমারসেন।                  কাল যায়, মহারাজ, কী আদেশ।
 
চন্দ্রসেন।               বৎস তুমি অনভিজ্ঞ, মনে কর তাই
শুধু ইচ্ছামাত্রে সব কার্য সিদ্ধ হয়
চক্ষের নিমেষে। রাজকার্য মনে রেখো
সুকঠিন অতি। সহস্রের শুভাশুভ
কেমনে করিব স্থির মুহূর্তের মাঝে।
 
কুমারসেন।           নির্দয় বিলম্ব তব পিতঃ। বিপদের
মুখে মোরে ফেলি অনায়াসে, স্থিরভাবে
বিচার-মন্ত্রণা? প্রণাম, বিদায় হই।
 

[ সুমিত্রাকে লইয়া প্রস্থান

 

চন্দ্রসেন।              তোমার নিষ্ঠুর বাক্য শুনে দয়া হয়
কুমারের ‘পরে; প্রাণে বাজে, ইচ্ছা করে
ডেকে নিয়ে বেঁধে তারে রাখি বক্ষ-মাঝে,
স্নেহ দিয়ে দূর করি আঘাত-বেদনা।
 
রেবতী।               শিশু তুমি! মনে কর আঘাত না করে
আপনি ভাঙিবে বাধা? পুরুষের মতো
যদি তুমি কার্যে দিতে হাত, আমি তবে
দয়ামায়া করিতাম ঘরে বসে বসে
অবসর বুঝে। এখন সময় নাই।
 

[ প্রস্থান

 

চন্দ্রসেন।               অতি-ইচ্ছা চলে অতি-বেগে। দেখিতে না
পায় পথ, আপনারে করে সে নিষ্ফল।
বায়ুবেগে ছুটে গিয়ে মত্ত অশ্ব যথা
চূর্ণ করে ফেলে রথ পাষাণ-প্রাচীরে।
 

দ্বিতীয় দৃশ্য

কাশ্মীর। হাট

 

লোকসমাগম

 

প্রথম।

কেমন হে খুড়ো, গোলা ভরে ভরে যে গম জমিয়ে রেখেছিলে, আজ বেচবার জন্যে এত তাড়াতাড়ি কেন।
 

দ্বিতীয়।

না বেচলে কি আর রক্ষে আছে। এদিকে জালন্ধরের সৈন্য এল বলে। সমস্ত লুটে নেবে। আমাদের এই মহাজনদের বড়ো বড়ো গোলা আর মোটা মোটা পেট বেবাক ফাঁসিয়ে দেবে। গম আর রুটি দুয়েরই জায়গা থাকবে না।
 

মহাজন।

আচ্ছা ভাই, আমোদ করে নে। কিন্তু শিগগির তোদের ওই দাঁতের পাটি ঢাকতে হবে। গুঁতো সকলেরই উপর পড়বে।
 

প্রথম।

সেই সুখেই তো হাসছি বাবা। এবারে তোমায় আমায় একসঙ্গে মরব। তুমি রাখতে গম জমিয়ে, আর আমি মরতুম পেটের জ্বালায়। সেইটে হবে না। এবার তোমাকেও জ্বালা ধরবে। সেই শুকনো মুখখানি দেখে যেন মরতে পারি।
 

দ্বিতীয়।

আমাদের ভাবনা কী ভাই। আমাদের আছে কী। প্রাণখানা এমনেও বেশিদিন টিকবে না, অমনেও বেশিদিন টিকবে না। এ কটা দিন কষে মজা করে নে ভাই।
 

প্রথম।

ও জনার্দন, এতগুলি থলে এনেছ কেন। কিছু কিনবে নাকি।
 

জনার্দন।

একেবারে বছরখানেকের মতো গম কিনে রাখব।
 

দ্বিতীয়।

কিনলে যেন, রাখবে কোথায়।
 

জনার্দন।

আজ রাত্তিরেই মামার বাড়ি পালাচ্ছি।
 

প্রথম।

মামার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছলে তো! পথে অনেক মামা বসে আছে, আদর করে ডেকে নেবে।
 

কোলাহল করিতে করিতে এক দল লোকের প্রবেশ

 

পঞ্চম।

ওরে, কে তোরা লড়াই করতে চাস, আয়।
 

প্রথম।

রাজি আছি; কার সঙ্গে লড়তে হবে বলে দে।
 

পঞ্চম।

খুড়ো-রাজা জালন্ধরের সঙ্গে ষড় করে যুবরাজকে ধরিয়ে দিতে চায়।
 

দ্বিতীয়।

বটে। খুড়ো-রাজার দাড়িতে আমরা মশাল ধরিয়ে দেব!
 

অনেকে।

আমাদের যুবরাজকে আমরা রক্ষা করব।
 

পঞ্চম।

খুড়ো-রাজা গোপনে যুবরাজকে বন্দী করতে চেষ্টা করেছিল, তাই আমরা যুবরাজকে লুকিয়ে রেখেছি।
 

প্রথম।

চল্‌ ভাই, খুড়ো-রাজাকে গুঁড়ো করে দিয়ে আসি গে।
 

দ্বিতীয়।

চল্‌ ভাই, তার মুণ্ডুখানা খসিয়ে তাকে মুড়ো করে দিই গে।
 

পঞ্চম।

সে-সব পরে হবে রে। আপাতত লড়তে হবে।
 

প্রথম।

তা লড়ব। এই হাট থেকেই লড়াই শুরু করে দেওয়া যাক না। প্রথমে ওই মহাজনদের গমের বস্তাগুলো লুটে নেওয়া যাক। তার পরে ঘি আছে, চামড়া আছে, কাপড় আছে।
 

ষষ্ঠের প্রবেশ

 

ষষ্ঠ।

শুনেছিস, যুবরাজ লুকিয়েছেন শুনে জালন্ধরের রাজা রটিয়েছে, যে তার সন্ধান বলে দেবে তাকে পুরস্কার দেবে।
 

পঞ্চম।

তোর এ-সব খবরে কাজ কী?
 

দ্বিতীয়।

তুই পুরস্কার নিবি নাকি?
 

প্রথম।

আয় না ভাই, ওকে সবাই মিলে পুরস্কার দিই। যা হয় একটা কাজ আরম্ভ করে দেওয়া যাক। চুপ করে বসে থাকতে পারি নে।
 

ষষ্ঠ।

আমাকে মারিস নে ভাই, দোহাই বাপসকল। আমি তোদের সাবধান করে দিতে এসেছি।
 

দ্বিতীয়।

বেটা তুই আপনি সাবধান হ।
 

পঞ্চম।

এ খবর যদি তুই রটাবি তাহলে তোর জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব।
 

দূরে কোলাহল

 

অনেকে মিলিয়া।

এসেছে– এসেছে।
 

সকলে।

ওরে এসেছে রে, জালন্ধরের সৈন্য এসে পৌঁচেছে।
 

প্রথম।

তবে আর কী। এবারে লুঠ করতে চললুম। ওই জনার্দন থলে ভরে গোরুর পিঠে বোঝাই করছে। এই বেলা চল্‌। ওই জনার্দনটাকে বাদ দিয়ে বাকি কটা গোরু বোঝাই-সুদ্ধ তাড়া করা যাক।
 

দ্বিতীয়।

তোরা যা ভাই। আমি তামাশা দেখে আসি। সার বেঁধে খোলা তলোয়ার হাতে যখন সৈন্য আসে আমার দেখতে বড়ো মজা লাগে।
 

গান

 

যমের দুয়োর খোলা পেয়ে
             ছুটেছে সব ছেলেমেয়ে।
                       হরিবোল হরিবোল।
রাজ্য জুড়ে মস্ত খেলা
             মরণ-বাঁচন অবহেলা,ও ভাই, সবাই মিলে প্রাণটা দিলে
               সুখ আছে কি মরার চেয়ে।
                            হরিবোল হরিবোল।
বেজেছে ঢোল, বেজেছে ঢাক,
    ঘরে ঘরে পড়েছে ডাক,
এখন     কাজকর্ম চুলোতে যাক–
               কেজো লোক সব আয় রে ধেয়ে।
                                     হরিবোল হরিবোল।
      রাজা প্রজা হবে জড়ো,
                      থাকবে না আর ছোটো বড়ো,
একই     স্রোতের মুখে ভাসবে সুখে
              বৈতরণীর নদী বেয়ে।
                                   হরিবোল হরিবোল।
 

তৃতীয় দৃশ্য

ত্রিচূড়। প্রাসাদ

 

অমরুরাজ ও কুমারসেন

 

অমরুরাজ।            পালাও, পালাও। এসো না আমার রাজ্যে।
আপনি মজিবে তুমি আমারে মজাবে।
তোমারে আশ্রয় দিয়ে চাহি নে হইতে
অপরাধী জালন্ধর-রাজ-কাছে। হেথা
তব নাহি স্থান।
 
কুমারসেন।                               আশ্রয় চাহি নে আমি।
অনিশ্চিত অদৃষ্টের পারাবার-মাঝে
ভাসাইব জীবন-তরণী,– তার আগে
ইলারে দেখিয়া যাব একবার শুধু
এই ভিক্ষা মাগি।
 
অমরুরাজ।                                ইলারে দেখিয়া যাবে?
কী হইবে দেখে তারে। কী হইবে দেখা
দিয়ে। স্বার্থপর। রয়েছ মৃত্যুর মুখে
অপমান বহি–  গৃহহীন, আশাহীন,
কেন আসিয়াছ ইলার হৃদয়-মাঝে
জাগাতে প্রেমের স্মৃতি।
 
কুমারসেন।                                        কেন আসিয়াছি?
হায় আর্য, কেমনে তা বোঝাব তোমায়।
 
অমরুরাজ।            বিপদের খরস্রোতে ভেসে চলিয়াছ,
তুমি কেন চাহিছ ধরিতে ক্ষীণপ্রাণ
কুসুমিত তীর-লতা? যাও, ভেসে যাও।
 
কুমারসেন।           আমার বিপদ আজ দোঁহার বিপদ,
মোর দুঃখ দু-জনার দুঃখ। প্রেম শুধু
সম্পদের নহে। মহারাজ, একবার
বিদায় লইতে দাও দু দণ্ডের তরে।
 
অমরুরাজ।            চিরকাল-তরে তুমি লয়েছ বিদায়।
আর নহে। যাও চলে। ভুলে যেতে দাও
তারে অবসর। হাসিমুখখানি তার
দিয়ো না আঁধার করি এ-জন্মের মতো।
 
কুমারসেন।           ভুলিতে পারিত যদি দিতাম ভুলিতে।
ফিরে এসে দেখা দিব বলে গিয়েছিনু;
জানি সে রয়েছে বসি আমার লাগিয়া
পথপানে চাহি, আমারে বিশ্বাস করি।
সে সরল সে অগাধ বিশ্বাস তাহার
কেমনে ভাঙিতে দিব।
 
অমরুরাজ।                                     সে বিশ্বাস ভেঙে
যাক একেবারে। নতুবা নূতন পথে
জীবন তাহার ফিরাতে সে পারিবে না।
চিরকাল দুঃখতাপ চেয়ে কিছুকাল
এ যন্ত্রণা ভালো।
 
কুমারসেন।                                 তার সুখদুঃখ তুমি
দিয়েছ আমার হাতে, কিছুতে ফিরায়ে
নিতে পারিবে না আর।  তারে তুমি আর
নাহি জান।  তারে আর নারিবে বুঝিতে।
তুমি যারে সুখদুঃখ বলে মনে কর
তার  সুখদুঃখ তাহা নহে।  একবার
দেখে যাই তারে।
 
অমরুরাজ।                                আমি তারে জানায়েছি,
কাশ্মীরে রয়েছ তুমি রাজমর্যাদায়
ক্ষুদ্র বলে আমাদের অবহেলা করে;
বিদেশে সংগ্রাম-যাত্রা মিছে ছল শুধু
বিবাহ ভাঙিতে।
 
কুমারসেন।                              ধিক, ধিক প্রতারণা।
সরল বালিকা সে কি তোমার দুহিতা?
এ নিষ্ঠুর মিথ্যা তারে কহিলে যখন
বিধাতা কি ঘুমাইতেছিল? শিরে তব
বজ্র পড়িল না ভেঙে? এখনো সে বেঁচে
রয়েছে কি? যেতে দাও, যেতে দাও মোরে–
দিবে না কি যেতে? হানো তবে তরবারি–
ব’লো তারে মরে গেছি আমি। প্রতারণা
ক’রো না তাহারে।
 

শংকরের প্রবেশ

 

শংকর।                                      আসিছে সন্ধানে তব
শত্রুচর, পেয়েছি সংবাদ। এইবেলা
চলো যাই।
 
কুমারসেন।                         কোথা যাব।  কী হবে লুকায়ে।
এ জীবন পারি নে বহিতে।
 
শংকর।                                               বনপ্রান্তে
তোমার অপেক্ষা করি আছেন সুমিত্রা।
 
কুমারসেন।            চলো, যাই চলো।  ইলা, কোথা আছ ইলা?
ফিরে গেনু দুয়ারে আসিয়া। দুর্ভাগ্যের
দিনে জগতের চারিদিকে রুদ্ধ হয়
আনন্দের দ্বার। প্রিয়ে, হতভাগ্য আমি,
তাই বলে নহি অবিশ্বাসী। চলো, যাই।
 

চতুর্থ দৃশ্য

ত্রিচূড়।  অন্তঃপুর

 

ইলা ও সখীগণ

 

ইলা।                   মিছে কথা, মিছে কথা। তোরা চুপ কর্‌।
আমি তার মন জানি। সখী, ভালো করে
বেঁধে দে কবরী মোর ফুলমালা দিয়ে।
নিয়ে আয় সেই নীলাম্বর। স্বর্ণথালে
আন্‌ তুলে শুভ্র ফুল্ল মালতীর ফুল।
নির্ঝরিণীতীরে ওই বকুলের তলা
ভালো সে বাসিত, ওইখানে শিলাতলে
পেতে দে আসনখানি। এমনি যতনে
প্রতিদিন করি সাজ, এমনি করিয়া
প্রতিদিন থাকি বসে, কে জানে কখন
সহসা আসিবে ফিরে প্রিয়তম মোর।
এসেছিল আমাদের মিলন দেখিতে
পরে পরে দুটি পূর্ণিমার রাত, অস্ত
গেছে নিরাশ হইয়া। মনে স্থির জানি
এবার পূর্ণিমা-নিশি হবে না নিষ্ফল।
আসিবে সে দেখা দিতে। না’ই যদি আসে
তোদের কী!  আমারে সে ভুলে যায় যদি
আমিই সে বুঝিব অন্তরে।  কেনই বা
না ভুলিবে, কী আছে আমার।  ভুলে যদি
সুখী হয় সেই ভালো–  ভালোবেসে যদি
সুখী হয় সেও ভালো।  তোরা সখী, মিছে
বকিস নে আর।  একটুকু চুপ কর্‌।
 

গান

 

পঞ্চম দৃশ্য

কাশ্মীর।   শিবির

 

বিক্রমদেব, জয়সেন ও যুধাজিৎ

 

জয়সেন।               কোথায় সে পালাবে রাজন্‌! ধরে এনে
দিব তারে রাজপদে। বিবর-দুয়ারে
অগ্নি দিলে বাহিরিয়া আসে ভুজঙ্গম
উত্তাপকাতর। সমস্ত কাশ্মীর ঘিরি
লাগাব আগুন; আপনি সে ধরা দিবে।
 
বিক্রমদেব।            এতদূর এনু পিছে পিছে,–  কত বন,
কত নদী, কত তুঙ্গ গিরিশৃঙ্গ ভাঙি;
আজ সে পালাবে হাত ছেড়ে? চাহি তারে,
চাহি তারে আমি। সে না হলে সুখ নাই,
নিদ্রা নাই মোর। শীঘ্র না পাইলে তারে,
সমস্ত কাশ্মীর আমি খণ্ড দীর্ণ করি
দেখিব কোথা সে আছে।
 
যুধাজিৎ।                                           ধরিবারে তারে
পুরস্কার করেছি ঘোষণা।
 
বিক্রমদেব।                                         তারে পেলে
অন্য কার্যে দিতে পারি হাত। রাজ্য মোর
রয়েছে পড়িয়া; শূন্যপ্রায় রাজকোষ;
দুর্ভিক্ষ হয়েছে রাজা অরাজক দেশে;
ফিরিতে পারি নে তবু। এ কী দৃঢ়পাশে
আমারে করেছে বন্দী শত্রু পলাতক।
সচকিতে সদা মনে হয়, এই এল,
এই এল, ওই দেখা যায়, ওই বুঝি
উড়ে ধুলা, আর দেরি নাই, এইবার
বুঝি পাব তারে ধাবমান ঘনশ্বাস
ত্রস্ত-আঁখি মৃগ-সম। শীঘ্র আনো তারে
জীবিত কি মৃত। ছিন্নভিন্ন হয়ে যাক
মায়াপাশ। নতুবা যা কিছু আছে মোর
সব যাবে অধঃপাতে।
 

প্রহরীর প্রবেশ

 

প্রহরী।                                           রাজা চন্দ্রসেন,
মহিষী রেবতী, এসেছেন ভেটিবার
তরে।
 
বিক্রমদেব।                    তোমরা সরিয়া যাও।
( প্রহরীকে )                  নিয়ে এস
তাঁহাদের প্রণাম জানায়ে।

[ অন্য সকলের প্রস্থান

 
                              কী বিপদ।
আসিছেন শাশুড়ী আমার। কী বলিব
শুধাইলে কুমারের কথা। কী বলিব
মার্জনা চাহেন যদি যুবরাজ-তরে,
সহিতে পারি নে আমি অশ্রু রমণীর।

চন্দ্রসেন ও রেবতীর প্রবেশ

 
প্রণাম। প্রণাম আর্যা।
 

চন্দ্রসেন।                                        চিরজীবী হও।
 
রেবতী।               জয়ী হও, পূর্ণ হোক মনস্কাম তব।
 
চন্দ্রসেন।              শুনেছি তোমার কাছে কুমার হয়েছে
অপরাধী।
 
বিক্রমদেব।                        অপমান করেছে আমারে।
 
চন্দ্রসেন।               বিচারে কী শাস্তি তার করেছ বিধান।
 
বিক্রমদেব।            বন্দিভাবে অপমান করিলে স্বীকার,
করিব মার্জনা।
 
রেবতী।                                এই শুধু?   আর কিছু
নয়? অবশেষে মার্জনা করিবে যদি
তবে কেন এত ক্লেশে এত সৈন্য লয়ে
এত দূরে আসা।
 
বিক্রমদেব।                               ভর্ৎসনা ক’রো না মোরে।
রাজার প্রধান কাজ আপনার মান
রক্ষা করা। যে মস্তক মুকুট বহিছে
অপমান পারে না বহিতে। মিছে কাজে
আসি নি হেথায়।
 
চন্দ্রসেন।                                   ক্ষমা তারে করো, বৎস,
বালক সে অল্পবুদ্ধি। ইচ্ছা কর যদি
রাজ্য হতে করিয়ো বঞ্চিত–  কেড়ে নিয়ো
সিংহাসন-অধিকার। নির্বাসন সেও
ভালো, প্রাণে বধিয়ো না।
 
বিক্রমদেব।                                           চাহি না বধিতে।
 
রেবতী।                তবে কেন এত অস্ত্র এনেছ বহিয়া।
এত অসি শর? নির্দোষী সৈনিকদের
বধ করে যাবে, যথার্থ যে জন দোষী
ক্ষমিবে তাহারে?
 
বিক্রমদেব।                                বুঝিতে পারি নে দেবী,
কী বলিছ তুমি।
 
চন্দ্রসেন।                                 কিছু নয়, কিছু নয়।
আমি তবে বলি বুঝাইয়া। সৈন্য যবে
মোর কাছে মাগিল কুমার আমি তারে
কহিলাম, বিক্রম স্নেহের পাত্র মোর,
তার সনে যুদ্ধ নাহি সাজে। সেই ক্ষোভে
ক্রুদ্ধ যুবা প্রজাদের ঘরে ঘরে গিয়া
বিদ্রোহে করিল উত্তেজিত। অসন্তুষ্ট
মহারানী তাই; রাজবিদ্রোহীর শাস্তি
করিছে প্রার্থনা তোমা-কাছে। গুরুদণ্ড
দিয়ো না তাহারে, সে যে অবোধ বালক।
 
বিক্রমদেব।            আগে তারে বন্দী করে আনি।  তার পরে
যথাযোগ্য করিব বিচার।
 
রেবতী।                                            প্রজাগণ
লুকায়ে রেখেছে তারে। আগুন জ্বালাও
ঘরে ঘরে তাহাদের। শস্যক্ষেত্র করো
ছারখার। ক্ষুধা-রাক্ষসীর হাতে সঁপি
দাও দেশ, তবে তারে করিবে বাহির।
 
চন্দ্রসেন।              চুপ করো চুপ করো রানী। চলো বৎস,
শিবির ছাড়িয়া চলো কাশ্মীর-প্রাসাদে।
 
বিক্রমদেব।            পরে যাব, অগ্রসর হও মহারাজ।

[ চন্দ্রসেন ও রেবতীর প্রস্থান

 
ওরে হিংস্র নারী! ওরে নরকাগ্নিশিখা!
বন্ধুত্ব আমার সনে! এতদিন পরে
আপনার হৃদয়ের প্রতিমূর্তিখানা
দেখিতে পেলেম ওই রমণীর মুখে।
অমনি শাণিত ক্রুর বক্র জ্বালারেখা
আছে কি ললাটে মোর। রুদ্ধ হিংসাভারে
অধরের দুই প্রান্ত পড়েছে কি নুয়ে।
অমনি কি তীক্ষ্ণ মোর উষ্ঞ তিক্ত বাণী
খুনীর ছুরির মতো বাঁকা বিষমাখা।
নহে নহে কভু নহে। এ হিংসা আমার
চোর নহে, ক্রুর নহে, নহে ছদ্মবেশী।
প্রচণ্ড প্রেমের মতো প্রবল এ জ্বালা
অভ্রভেদী সর্বগ্রাসী উদ্দাম উন্মাদ
দুর্নিবার।  নহি আমি তোদের আত্মীয়।
হে বিক্রম, ক্ষান্ত করো এ সংহার-খেলা।
এ শ্মশান-নৃত্য তব থামাও থামাও,
নিবাও এ চিতা। পিশাচ-পিশাচী যত
অতৃপ্ত হৃদয়ে লয়ে দীপ্ত হিংসাতৃষা
ফিরে যাক রুদ্ধ রোষে, লালায়িত লোভে।
এক দিন দিব বুঝাইয়া, নহি আমি
তোমাদের কেহ।  নিরাশ করিব এই
গুপ্ত লোভ, বক্র রোষ, দীপ্ত হিংসাতৃষা।
দেখিব কেমন করে আপনার বিষে
আপনি জ্বলিয়া মরে নর-বিষধর।
রমণীর হিংস্র মুখ সূচিময় যেন–
কী ভীষণ, কী নিষ্ঠুর, একান্ত কুৎসিত।
 

চরের প্রবেশ

 

চর।                    ত্রিচূড়ের অভিমুখে গেছেন কুমার।
 
বিক্রমদেব।            এ সংবাদ রাখিয়ো গোপনে। একা আমি
যাব সেথা মৃগয়ার ছলে।
 
চর।                                                যে আদেশ।
 

ষষ্ঠ দৃশ্য

অরণ্য

 

শুষ্ক পর্ণশয্যায় কুমারসেন শয়ান, সুমিত্রা আসীন

 

কুমারসেন।           কত রাত্রি?
 
সুমিত্রা।                             রাত্রি আর নাই ভাই। রাঙা
হয়ে উঠেছে আকাশ।  শুধু বনচ্ছায়া
অন্ধকার রাখিয়াছে বেঁধে।
 
কুমারসেন।                                          সারা রাত্রি
জেগে বসে আছ, বোন, ঘুম নেই চোখে?
 
সুমিত্রা।                জাগিয়াছি দুঃস্বপন দেখে।  সারা রাত
মনে হয় শুনি যেন পদশব্দ কার
শুষ্ক পল্লবের ‘পরে।  তরু-অন্তরালে
শুনি যেন কাহাদের চুপি চুপি কথা,
বিজন মন্ত্রণা।  শ্রান্ত আঁখি যদি কভু
মুদে আসে, দারুণ দুঃস্বপ্ন দেখে কেঁদে
জেগে উঠি।  সুখসুপ্ত মুখখানি তব
দেখে পুন প্রাণ পাই প্রাণে।
 
কুমারসেন।                                           দুর্ভাবনা
দুঃস্বপ্ন-জননী।  ভেবো না আমার তরে
বোন।  সুখে আছি।  মগ্ন হয়ে জীবনের
মাঝখানে, কে জেনেছে জীবনের সুখ?
মরণের তটপ্রান্তে বসে, এ যেন গো
প্রাণপণে জীবনের একান্ত সম্ভোগ।
এ সংসারে যত সুখ, যত শোভা, যত
প্রেম আছে, সকলি প্রগাঢ় হয়ে যেন
আমারে করিছে আলিঙ্গন।  জীবনের
প্রতি বিন্দুটিতে যত মিষ্ট আছে, সব
আমি পেতেছি আস্বাদ। ঘন বন,
তুঙ্গ শৃঙ্গ, উদার আকাশ, উচ্ছ্বসিত
নির্ঝরিণী, আশ্চর্য এ শোভা।  অযাচিত
ভালোবাসা অরণ্যের পুষ্পবৃষ্টি-সম
অবিশ্রাম হতেছে বর্ষণ।  চারিদিকে
ভক্ত প্রজাগণ।  তুমি আছ প্রীতিময়ী
শিয়রে বসিয়া।  উড়িবার আগে বুঝি
জীবন-বিহঙ্গ বিচিত্র-বরন পাখা
করিছে বিস্তার।  ওই শোনো কাঠুরিয়া
গান গায়;  শোনা যাবে রাজ্যের সংবাদ।
 
বঁধু, তোমায় করব রাজা তরুতলে।
বনফুলের বিনোদ-মালা দেব গলে।
        সিংহাসনে বসাইতে
        হৃদয়খানি দেব পেতে,
অভিষেক করব তোমায় আঁখিজলে।
 
কুমারসেন।           (অগ্রসর হইয়া) বন্ধু, আজি কী সংবাদ?
 
কাঠুরিয়া।                                                          ভালো নয় প্রভু।
জয়সেন কাল রাত্রে জ্বালায়ে দিয়েছে
নন্দীগ্রাম; আজ আসে পাণ্ডুপুর-পানে।
 
কুমারসেন।            হায়, ভক্ত প্রজা মোর, কেমনে তোদের
রক্ষা করি?  ভগবান, নির্দয় কেন গো
নির্দোষ দীনের ‘পরে?
 
কাঠুরিয়া।             ( সুমিত্রার প্রতি )       জননী, এনেছি
কাষ্ঠভার, রাখি শ্রীচরণে।
 
সুমিত্রা।                                              বেঁচে থাক।
 

[ কাঠুরিয়ার প্রস্থান

 

মধুজীবীর প্রবেশ

 

কুমারসেন।           কী সংবাদ?
 
মধুজীবী।                           সাবধানে থেকো যুবরাজ।
তোমারে যে ধরে দেবে জীবিত কি মৃত
পুরস্কার পাইবে সে, ঘোষণা করেছে
 
যুধাজিৎ।   বিশ্বাস ক’রো না কারে প্রভু।
 
কুমারসেন।            বিশ্বাস করিয়া মরা ভালো; অবিশ্বাস
কাহারে করিব? তোরা সব অনুরক্ত
বন্ধু মোর সরল-হৃদয়।
 
মধুজীবী।                                         মা-জননী,
এনেছি সঞ্চয় করে কিছু বনমধু
দয়া করে করো মা গ্রহণ।
 
সুমিত্রা।                                              ভগবান
মঙ্গল করুন তোর।
 

[ মধুজীবীর প্রস্থান

 

শিকারীর প্রবেশ

 

শিকারী।                                         জয় হোক প্রভু।
ছাগ-শিকারের তরে যেতে হবে দূর
গিরিদেশে, দুর্গম সে পথ।  তব পদে
প্রণাম করিয়া যাব।  জয়সেন গৃহ
মোর দিয়াছে জ্বালায়ে।
 
কুমারসেন।                                      ধিক সে পিশাচ।
 
শিকারী।               আমরা শিকারী।  যতদিন বন আছে
আমাদের কে পারে করিতে গৃহহীন?
কিছু খাদ্য এনেছি জননী, দরিদ্রের
তুচ্ছ উপহার।  আশীর্বাদ করো যেন
ফিরে এসে আমাদের যুবরাজে দেখি
সিংহাসনে।
 
কুমারসেন।          ( বাহু বাড়াইয়া ) এস তুমি, এস আলিঙ্গনে।
 

[ শিকারীর প্রস্থান

 

সপ্তম দৃশ্য

ত্রিচূড়।  প্রমোদভবন

 

বিক্রমদেব ও অমরুরাজ

 

অমরুরাজ।            তোমারে করিনু সমর্পণ যাহা আছে
মোর।  তুমি বীর, তুমি রাজ-অধিরাজ।
তব যোগ্য কন্যা মোর, তারে লহো তুমি।
সহকার মাধবিকা-লতার আশ্রয়।
ক্ষণেক বিলম্ব করো, মহারাজ, তারে
দিই পাঠাইয়া।
 

[ প্রস্থান

 

বিক্রমদেব।                             কী মধুর শান্তি হেথা।
চিরন্তন অরণ্য-আবাস, সুখসুপ্ত
ঘনচ্ছায়া, নির্ঝরিণী নিরন্তর-ধ্বনি।
শান্তি যে শীতল এত, এমন গম্ভীর,
এমন নিস্তব্ধ তবু এমন প্রবল
উদার সমুদ্র-সম, বহুদিন ভুলে
ছিনু যেন।  মনে হয়, আমার প্রাণের
অনন্ত অনল-দাহ সেও যেন হেথা
হারাইয়া ডুবে যায়, না থাকে নির্দেশ–
এত ছায়া, এত স্থান, এত গভীরতা।
এমনি নিভৃত সুখ ছিল আমাদের,
গেল কার অপরাধে?  আমার, কি তার?
যারি হোক– এ জনমে আর কি পাব না?
যাও তবে  একেবারে চলে যাও দুরে।
জীবনে থেকো না জেগে অনুতাপ-রূপে,
দেখা যাক যদি এইখানে– সংসারের
নির্জন নেপথ্যদেশে পাই নব প্রেম,
তেমনি অতলস্পর্শ, তেমনি মধুর।

সখীর সহিত ইলার প্রবেশ

 
এ কী অপরূপ মূর্তি!  চরিতার্থ আমি।
আসন গ্রহণ করো দেবী।  কেন মৌন,
নতশির, কেন ম্লানমুখ, দেহলতা
কম্পিত কাতর?  কিসের বেদনা তব?
 

ইলা।                  (নতজানু) শুনিয়াছি মহারাজ-অধিরাজ তুমি
সসাগরা ধরণীর পতি।  ভিক্ষা আছে
তোমার চরণে।
 
বিক্রমদেব।                              উঠ উঠ হে সুন্দরী।
তব পদস্পর্শযোগ্য নহে এ ধরণী,
তুমি কেন ধুলায় পতিত?  চরাচরে
কিবা আছে অদেয় তোমারে?
 
ইলা।                                                     মহারাজ,
পিতা মোরে দিয়াছেন শঁপি তব হাতে;
আপনারে ভিক্ষা চাহি আমি।  ফিরাইয়া
দাও মোরে।  কত ধন রত্ন রাজ্য দেশ
আছে তব, ফেলে রেখে যাও মোরে এই
ভূমিতলে।  তোমার অভাব কিছু নাই।
 
বিক্রমদেব।            আমার অভাব নাই|  কেমনে দেখাব
গোপন হৃদয়? কোথা সেথা ধনরত্ন?
কোথা সসাগরা ধরা?  সব শূন্যময়।
রাজ্যধন না থাকিত যদি,– শুধু তুমি
থাকিতে আমার —
 
ইলা।                   (উঠিয়া)           লহো তবে এ জীবন।
তোমরা যেমন ক’রে বনের হরিণী
নিয়ে যাও, বুকে তার তীক্ষ্ণ তীর বিঁধে,
তেমনি হৃদয় মোর বিদীর্ণ করিয়া
জীবন কাড়িয়া আগে, তার পরে মোরে
নিয়ে যাও।
 
বিক্রমদেব।                         কেন দেবী, মোর ‘পরে এত
অবহেলা?  আমি কি নিতান্ত তব যোগ্য
নহি? এত রাজ্য দেশ    করিলাম জয়,
প্রার্থনা করেও আমি পাব না কি তবু
হৃদয় তোমার?
 
ইলা।                                    সে কি আর আছে মোর?
সমস্ত সঁপেছি যারে, বিদায়ের কালে,
হৃদয় সে নিয়ে চলে গেছে, বলে গেছে–
ফিরে এসে দেখা দেবে এই উপবনে।
কতদিন হল; বনপ্রান্তে দিন আর
কাটে নাকো।  পথ চেয়ে সদা পড়ে আছি;
যদি এসে দেখিতে না পায়, ফিরে যায়,
আর যদি ফিরিয়া না আসে! মহারাজ,
কোথা নিয়ে যাবে?  রেখে যাও তার তরে
যে আমারে ফেলে রেখে গেছে।
 
বিক্রমদেব।                                                না জানি সে
কোন্‌ ভাগ্যবান!  সাবধান, অতিপ্রেম
সহে না বিধির। শুন তবে মোর কথা।
এক কালে চরাচর তুচ্ছ করি আমি
শুধু ভালোবাসিতাম; সে প্রেমের ‘পরে
পড়িল বিধির হিংসা, জেগে দেখিলাম
চরাচর পড়ে আছে, প্রেম গেছে ভেঙে।
বসে আছ যার তরে কী নাম তাহার?
 
ইলা।                   কাশ্মীরের যুবরাজ– কুমার তাহার
নাম।
 
বিক্রমদেব।                  কুমার?
 
ইলা।                                 তারে জান তুমি!  কেই বা
না জানে।  সমস্ত কাশ্মীর তারে দিয়েছে
হৃদয়।
 
বিক্রমদেব।                    কুমার?  কাশ্মীরের যুবরাজ?
 
ইলা।                   সেই বটে মহারাজ।  তার নাম সদা
ধ্বনিছে চৌদিকে।  তোমারি সে বন্ধু বুঝি!
মহৎ সে, ধরণীর যোগ্য অধিপতি।
 
বিক্রমদেব।            তাহার সৌভাগ্য-রবি গেছে অস্তাচলে,
ছাড়ো তার আশা।  শিকারের মৃগ-সম
সে আজ তাড়িত, ভীত, আশ্রয়বিহীন,
গোপন অরণ্যছায়ে রয়েছে লুকায়ে।
কাশ্মীরের দীনতম ভিক্ষাজীবী আজ
সুখী তার চেয়ে।
 
ইলা।                                       কী বলিলে মহারাজ?
 
বিক্রমদেব।            তোমরা বসিয়া থাক ধরাপ্রান্ত-ভাগে,
শুধু ভালোবাস।  জান না বাহিরে বিশ্বে
গরজে সংসার, কর্মস্রোতে কে কোথায়
ভেসে যায়, ছল ছল বিশাল নয়নে
তোমরা চাহিয়া থাক।  বৃথা তার আশা।
 
ইলা।                  সত্য বলো মহারাজ, ছলনা ক’রো না।
জেনো এই অতি ক্ষুদ্র রমণীর প্রাণ
শুধু আছে তারি তরে, তারি পথ চেয়ে।
কোন্‌ গৃহহীন পথে কোন্‌ বনমাঝে
কোথা ফিরে কুমার আমার? আমি যাব
বলে দাও– গৃহ ছেড়ে কখনো যাই নি,
কোথা যেতে হবে?  কোন্‌ দিকে, কোন্‌ পাথে?
 
বিক্রমদেব।            বিদ্রোহী সে, রাজসৈন্য ফিরিতেছে সদা
সন্ধানে তাহার।
 
ইলা।                                     তোমরা কি বন্ধু নহ
তার?  তোমরা কি রক্ষা করিবে না তারে?
রাজপুত্র ফিরিতেছে বনে, তোমরা কি
রাজা হয়ে দেখিবে চাহিয়া? এতটুকু
দয়া নেই কারো? প্রিয়তম, প্রিয়তম,
আমি তো জানি নে, নাথ, সংকটে পড়েছ–
আমি হেথা বসে আছি তোমার লাগিয়া।
অনেক বিলম্ব দেখে মাঝে মাঝে মনে
চকিত বিদ্যুৎ-সম বেজেছে সংশয়।
শুনেছিনু এত লোক ভালোবাসে তারে
কোথা তারা বিপদের দিনে?  তুমি নাকি
পৃথিবীর রাজা।  বিপন্নের কেহ নহ?
এত সৈন্য, এত যশ, এত বল নিয়ে
দূরে বসে রবে?  তবে পথ বলে দাও।
জীবন সঁপিব একা অবলা রমণী।
 
বিক্রমদেব।            কী প্রবল প্রেম! ভালোবাসো ভালোবাসো
এমনি সবেগে চিরদিন।  যে তোমার
হৃদয়ের রাজা, শুধু তারে ভালোবাসো।
প্রেমস্বর্গচ্যুত আমি, তোমাদের দেখে
ধন্য হই।  দেবী, চাহি নে তোমার প্রেম।
শুষ্ক শাখে ঝরে ফুল, অন্য তরু হতে
ফুল ছিঁড়ে নিয়ে তারে কেমনে সাজাব?
আমারে বিশ্বাস করো– আমি বন্ধু তব।
চলো মোর সাথে, আমি তারে এনে দেব।
সিংহাসনে বসায়ে কুমারে, তার হাতে
সঁপি দিব তোমারে কুমারী।
 
ইলা।                                                   মহারাজ,
প্রাণ দিলে মোরে।  যেথা যেতে বল, যাব।
 
বিক্রমদেব।            এস তবে প্রস্তুত হইয়া।  যেতে হবে
কাশ্মীরের রাজধানী-মাঝে।

[ ইলা ও সখীর প্রস্থান

 
                                 যুদ্ধ নাহি
ভালো লাগে।  শান্তি আরো অসহ্য দ্বিগুণ।
গৃহহীন পলাতক, তুমি সুখী মোর
চেয়ে।  এ সংসারে যেথা যাও, সাথে থাকে
রমণীর অনিমেষ প্রেম, দেবতার
ধ্রুবদৃষ্টি-সম; পবিত্র কিরণে তারি
দীপ্তি পায় বিপদের মেঘ, স্বর্ণময়
সম্পদের মতো।  আমি কোন্‌ সুখে ফিরি
দেশ-দেশান্তরে, স্কন্ধে বহে জয়ধ্বজা,
অন্তরেতে অভিশপ্ত হিংসাতপ্ত প্রাণ।
কোথা আছে কোন্‌ স্নিগ্ধ হৃদয়ের মাঝে
প্রস্ফুটিত শুভ্র প্রেম শিশিরশীতল।
ধুয়ে দাও, প্রেমময়ী, পুণ্য অশ্রুজলে
এ মলিন হস্ত মোর রক্তকলুষিত।
 

প্রহরীর প্রবেশ

 

প্রহরী।                 ব্রাহ্মণ এসেছে মহারাজ, তব সাথে
সাক্ষাতের তরে।
 
বিক্রমদেব।                                 নিয়ে এস; দেখা যাক।
 

দেবদত্তের প্রবেশ

 

দেবদত্ত।               রাজার দোহাই, ব্রাহ্মণেরে রক্ষা করো।
 
বিক্রমদেব।            এ কী!  তুমি কোথা হতে এলে?  অনুকূল
দৈব মোর ‘পরে।  তুমি বন্ধুরত্ন মোর।
 
দেবদত্ত।               তাই বটে মহারাজ, রত্ন বটে আমি।
অতি যত্নে বন্ধ করে রেখেছিলে তাই।
ভাগ্যবলে পলায়েছি খোলা পেয়ে দ্বার।
আবার দিয়ো না সঁপি প্রহরীর হাতে
রত্নভ্রমে।  আমি শুধু বন্ধুরত্ন নহি,
ব্রাহ্মণীর স্বামীরত্ন আমি।  সে কি হায়
এতদিন বেঁচে আছে আর?
 
বিক্রমদেব।                                            এ কী কথা!
আমি তো জানি নে কিছু, এতদিন রুদ্ধ
আছ তুমি!
 
দেবদত্ত।                             তুমি কী জানিবে মহারাজ।
তোমার প্রহরী দুটো জানে।  কত শাস্ত্র
বলি তাহাদের, কত কাব্যকথা, শুনে
মূর্খ দুটো হাসে।  একদিন বর্ষা দেখে
বিরহ-ব্যথায় মেঘদূত কাব্যখানা
শুনালেম দোঁহে ডেকে; গ্রাম্য মূর্খ দুটো
পড়িল কাতর হয়ে নিদ্রার আবেশে।
তখনি ধিক্‌কার-ভরে কারাগার ছাড়ি
আসিনু চলিয়া।  বেছে বেছে ভালো লোক
দিয়েছিলে বিরহী এ ব্রাহ্মণের ‘পরে!
এত লোক আছে সখা অধীনে তোমার
শাস্ত্র বোঝে এমন কি ছিল না দু-জন?
 
বিক্রমদেব।            বন্ধুবর, বড়ো কষ্ট দিয়েছে তোমারে।
সমুচিত শাস্তি দিব তারে, যে পাষণ্ড
রেখেছিল রুধিয়া তোমায়।  নিশ্চয় সে
ক্রুরমতি জয়সেন।
 
দেবদত্ত।                                    শাস্তি পরে হবে।
আপাতত যুদ্ধ রেখে অবিলম্বে দেশে
ফিরে চলো।  সত্য কথা বলি মহারাজ,
বিরহ সামান্য ব্যথা নয়, এবার তা
পেরেছি বুঝিতে।  আগে আমি ভাবিতাম
শুধু বড়ো বড়ো লোক বিরহেতে মরে।
এবার দেখেছি, সামান্য এ ব্রাহ্মণের
ছেলে, এরেও ছাড়ে না পঞ্চবাণ; ছোটো
বড়ো করে না বিচার।
 
বিক্রমদেব।                                     যম আর প্রেম
উভয়েরি সমদৃষ্টি সর্বভূতে।  বন্ধু,
ফিরে চলো দেশে।  কেবল যাবার আগে
এক কাজ বাকি আছে।  তুমি লহো ভার।
অরণ্যে কুমারসেন আছে লুকাইয়া,
ত্রিচূড়রাজের কাছে সন্ধান পাইবে
সখে, তার কাছে যেতে হবে।  ব’লো তারে,
আর আমি শত্রু নহি।  অস্ত্র ফেলে দিয়ে
বসে আছি প্রেমে বন্দী করিবারে তারে।
আর সখা– আর কেহ যদি থাকে সেথা–
যদি দেখা পাও আর কারো–
 
দেবদত্ত।                                                 জানি, জানি–
তাঁর কথা জাগিতেছে হৃদয়ে সতত।
এতক্ষণ বলি নাই কিছু।  মুখে যেন
সরে না বচন।  এখন তাঁহার কথা
বচনের অতীত হয়েছে।  সাধ্বী তিনি,
তাই এত দুঃখ তাঁর।  তাঁরে মনে ক’রে
মনে পড়ে পুণ্যবতী জানকীর কথা।
চলিলাম তবে।
 
বিক্রমদেব।                              বসন্ত না আসিতেই
আগে আসে দক্ষিণপবন,  তার পরে
পল্লবে কুসুমে বনশ্রী প্রফুল্ল হয়ে
ওঠে।  তোমারে হেরিয়া আশা হয় মনে,
আবার আসিবে ফিরে সেই পুরাতন
দিন মোর, নিয়ে তার সব সুখ-ভার।
 

অষ্টম দৃশ্য

অরণ্য

 

কুমারের দুই জন অনুচর

 

প্রথম।

হ্যা, দেখ মাধু, কাল যে স্বপ্নটা দেখলুম তার কোনো মানে ভেবে পাচ্ছি নে। শহরে গিয়ে দৈবিজ্ঞি ঠাকুরের কাছে গুনিয়ে নিয়ে আসতে হবে।
 

দ্বিতীয়।

কী স্বপ্নটা বল্‌ তো শুনি।
 

প্রথম।

যেন এক জন মহাপুরুষ ওই জল থেকে উঠে আমাকে তিনটে বড়ো বড়ো বেল দিতে এল। আমি দুটো দু-হাতে নিলুম, আর একটা কোথায় নেব ভাবনা পড়ে গেল।
 

দ্বিতীয়।

দূর মূর্খ, তিনটেই চাদরে বেঁধে নিতে হয়।
 

প্রথম।

আরে জেগে থাকলে তো সকলেরই বুদ্ধি জোগায় — সে-সময়ে তুই কোথায় ছিলি? তার পর শোন্‌ না; সেই বাকি বেলটা মাটিতে পড়েই গড়াতে আরম্ভ করলে, আমি তার পিছন পিছন ছুটলুম। হঠাৎ দেখি যুবরাজ অশথতলায় বসে আহ্নিক করছেন। বেলটা ধপ্‌ করে তাঁর কোলের উপর গিয়ে লাফিয়ে উঠল। আমার ঘুম ভেঙে গেল।
 

দ্বিতীয়।

এটা আর বুঝতে পারলি নে। যুবরাজ শিগ্‌গির রাজা হবে।
 

প্রথম।

আমিও তাই ঠাউরেছিলুম। কিন্তু আমি যে দুটো বেল পেলুম, আমার কী হবে?
 

দ্বিতীয়।

তোর আবার হবে কী? তোর খেতে বেগুন বেশি করে ফলবে।
 

প্রথম।

না ভাই, আমি ঠাউরে রেখেছি আমার দুই পুত্তুর-সন্তান হবে।
 

দ্বিতীয়।

হ্যা দেখ্‌ ভাই, বললে পিত্তয় যাবি নে, কাল ভারি আশ্চর্য কাণ্ড হয়ে গেছে। ওই জলের ধারে বসে রামচরণে আমাতে চিঁড়ে ভিজিয়ে খাচ্ছিলুম, তা আমি কথায় কথায় বললুম আমাদের দোবেজী গুনে বলেছে যুবরাজের ফাঁড়া প্রায় কেটে এসেছে। আর দেরি নেই। এবার শিগ্‌গির রাজা হবে। হঠাৎ মাথার উপর কে তিন বার বলে উঠল “ঠিক ঠিক ঠিক”,– উপরে চেয়ে দেখি ডুমুরের ডালে এতবড়ো একটা টিকটিকি!
 

রামচরণের প্রবেশ

 

প্রথম।

কী খবর রামচরণ?
 

রামচরণ।

ওরে ভাই, আজ একটা ব্রাহ্মণ এই বনের আশেপাশে যুবরাজের সন্ধান নিয়ে ফিরছিল। আমাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কত কথাই জিজ্ঞেসা করলে। আমি তেমনি বোকা আর কি! আমিও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জবাব দিতে লাগলুম। অনেক খোঁজ করে শেষকালে চলে গেল। তাকে আমি চিত্তলের রাস্তা দেখিয়ে দিলুম। ব্রাহ্মণ না হলে তাকে আজ আর আমি আস্ত রাখতুম না।
 

দ্বিতীয়।

কিন্তু তাহলে তো এ বন ছাড়তে হচ্ছে। বেটারা সন্ধান পেয়েছে দেখছি।
 

প্রথম।

এইখানে বসে পড়ো না ভাই রামচরণ — দুটো গল্প করা যাক।
 

রামচরণ।

যুবরাজের সঙ্গে আমাদের মা-ঠাকরুণ এই দিকে আসছেন। চল্‌ ভাই তফাতে গিয়ে বসি গে।
 

[ প্রস্থান

 

কুমারসেন ও সুমিত্রার প্রবেশ

 

কুমারসেন।           শংকর পড়েছে ধরা।  রাজ্যের সংবাদ
নিতে গিয়েছিল বৃদ্ধ, গোপনে ধরিয়া
ছদ্মবেশ।  শত্রুচর ধরেছে তাহারে।
নিয়ে গেছে জয়সেন-কাছে।  শুনিয়াছি
চলিতেছে নিষ্ঠুর পীড়ন তার ‘পরে–
তবু সে অটল।  একটি কথাও তারা
পারে নাই মুখ হতে করিতে বাহির।
 
সুমিত্রা।                হায় বৃদ্ধ প্রভুবৎসল!  প্রাণাধিক
ভালোবাস যারে সেই কুমারের কাজে
সঁপি দিলে তোমার কুমারগত প্রাণ।
 
কুমারসেন।           এ সংসারে সব চেয়ে বন্ধু সে আামার,
আজন্মের সখা।  আপনার প্রাণ দিয়ে
আড়াল করিয়া চাহে সে রাখিতে মোরে
নিরাপদে।  অতি বৃদ্ধ ক্ষীণ জীর্ণ দেহ,
কেমনে সে সহিছে যন্ত্রণা?  আমি হেথা
সুখে আছি লুকায়ে বসিয়া।
 
সুমিত্রা।                                               আমি যাই,
ভাই!  ভিখারিনীবেশে সিংহাসনতলে
গিয়া শংকরের প্রাণভিক্ষা মেগে আসি।
 
কুমারসেন।           বাহির হইতে তারা আবার তোমারে
দিবে ফিরাইয়া।  তোমার পিতার রাজ্য
হবে নতশির।  বজ্রসম বাজিবে সে
মর্মে গিয়ে মোর।
 

চরের প্রবেশ

 

চর।                                         গত রাত্রে গিধ্‌কূট
জ্বালায়ে দিয়েছে জয়সেন।  গৃহহীন
গ্রামবাসিগণ আশ্রয় নিয়েছে গিয়ে
মন্দুর অরণ্য-মাঝে।
 

[ প্রস্থান

 

কুমারসেন।                                   আর তো সহে না।
ঘৃণা হয় এ জীবন করিতে বহন
সহস্রের জীবন করিয়া ক্ষয়।
 
সুমিত্রা।                                                চলো
মোরা দুই জনে যাই রাজসভা-মাঝে
দেখিব কেমনে, কোন্‌ ছলে, জালন্ধর
স্পর্শ করে কেশ তব।
 
কুমারসেন।                                      শংকর বলিত,
“প্রাণ যায় সেও ভালো, তবু বন্দিভাবে
কখনো দিয়ো না ধরা।” পিতৃসিংহাসনে
বসি বিদেশের রাজা দণ্ড দিবে মোরে
বিচারের ছল করি, এ কি সহ্য হবে?
অনেক সহেছি বোন, পিতৃপুরুষের
অপমান সহিব কেমনে।
 
সুমিত্রা।                                            তার চেয়ে
মৃত্যু ভালো।
 
কুমারসেন।                           বলো বোন, বলো, “তার চেয়ে
মৃত্যু ভালো।”  এই তো তোমার যোগ্য কথা।
তার চেয়ে মৃত্যু ভালো। ভালো করে ভেবে
দেখো। বেঁচে থাকা ভীরুতা কেবল। বলো,
এ কি সত্য নয়? থেকো না নীরব হয়ে,
বিষাদ-আনত নেত্রে চেয়ো না ভূতলে।
মুখ তোলো, স্পষ্ট করে বলো এক বার,
ঘৃণিত এ প্রাণ লয়ে লুকায়ে লুকায়ে
নিশিদিন মরে থাকো, এক দণ্ড এ কি
উচিত আমার?
 
সুমিত্রা।                                   ভাই–
 
কুমারসেন।                                    আমি রাজপুত্র–
ছারখার হয়ে যায় সোনার কাশ্মীর,
পথে পথে বনে বনে ফিরে গৃহহীন
প্রজা, কেঁদে মরে পতিপুত্রহীনা নারী,–
তবু আমি কোনোমতে বাঁচিব গোপনে?
 
সুমিত্রা।                তার চেয়ে মৃত্যু ভালো।
 
কুমারসেন।                                        বলো, তাই বলো।
ভক্ত যারা অনুরক্ত মোর– প্রতিদিন
সঁপিছে আপন প্রাণ নির্যাতন সহি।
তবু আমি তাহাদের পশ্চাতে লুকায়ে
জীবন করিব ভোগ!  এ কি বেঁচে থাকা!
 
সুমিত্রা।               এর চেয়ে মৃত্যু ভালো।
 
কুমারসেন।                                       বাঁচিলাম শুনে।
কোনোমতে রেখেছিনু তোমারি লাগিয়া
এ হীন জীবন, প্রত্যেক নিশ্বাসে মোর
নির্দোষের প্রাণবায়ু করিয়া শোষণ।
আমার চরণ ছুঁয়ে করহ শপথ
যে-কথা বলিব তাহা করিবে পালন
যতই কঠিন হোক।
 
সুমিত্রা।                                      করিনু শপথ।
 
কুমারসেন।           এ জীবন দিব বিসর্জন।  তার পরে
তুমি মোর ছিন্নমুণ্ড নিয়ে, নিজ হস্তে
জালন্ধর-রাজ-করে দিবে উপহার।
বলিয়ো তাহারে– “কাশ্মীরে অতিথি তুমি;
ব্যাকুল হয়েছ এত যে-দ্রব্যের তরে
কাশ্মীরের যুবরাজ দিতেছেন তাহা
আতিথ্যের অর্ঘ্যরূপে তোমারে পাঠায়ে।”
মৌন কেন বোন? সঘনে কাঁপিছে কেন
চরণ তোমার? ব’সো এই তরুতলে।
পারিবে না তুমি?  একান্ত অসাধ্য এ কি?
তবে কি ভৃত্যের হস্তে পাঠাইতে হবে
তুচ্ছ উপহার-সম এ রাজমস্তক?
সমস্ত কাশ্মীর তারে ফেলিবে যে রোষে
ছিন্নভিন্ন করি।

[ সুমিত্রার মূর্ছা

 
                 ছি ছি বোন।  উঠ, উঠ।
পাষাণে হৃদয় বাঁধো।  হ’য়ো না বিহ্বল।
দুঃসহ এ কাজ–  তাই তো তোমার ‘পরে
দিতেছি দুরূহ ভার।  অয়ি প্রাণাধিকে,
মহৎহৃদয় ছাড়া কাহারা সহিবে
জগতের মহাক্লেশ যত।  বলো বোন,
পারিবে করিতে?
 

সুমিত্রা।                                    পারিব।
 
কুমারসেন।                                         দাঁড়াও তবে।
ধরো বল, তোলো শির।  উঠাও জাগায়ে
সমস্ত হৃদয়-মন।  ক্ষুদ্র নারী-সম
আপন বেদনাভারে প’ড়ো না ভাঙিয়া।
 
সুমিত্রা।                অভাগিনী ইলা!
 
কুমারসেন।                              তারে কি জানি নে আমি?
হেন অপমান লয়ে সে কি মোরে কভু
বাঁচিতে বলিত?  সে আমার ধ্রুবতারা
মহৎ মৃত্যুর দিকে দেখাইছে পথ।
কাল পূর্ণিমার তিথি মিলনের রাত।
জীবনের গ্লানি হতে মুক্ত ধৌত হয়ে
চিরমিলনের বেশ করিব ধারণ।
চলো বোন।  আগে হতে সংবাদ পাঠাই
দূতমুখে রাজসভামাঝে, কাল আমি
যাব ধরা দিতে।  তাহা হলে অবিলম্বে
শংকর পাইবে ছাড়া– বান্ধব আমার।
 

নবম দৃশ্য

কাশ্মীর।  রাজসভা

 

বিক্রমদেব ও চন্দ্রসেন

 

বিক্রমদেব।            আর্য, তুমি কেন আজ নীরব এমন?
মার্জনা তো করেছি কুমারে।
 
চন্দ্রসেন।                                                তুমি তারে
মার্জনা করেছ।  আমি তো এখনো তার
বিচার করি নি।  বিদ্রোহী সে মোর কাছে।
এবার তাহার শাস্তি দিব।
 
বিক্রমদেব।                                        কোন্‌ শাস্তি
করিয়াছ স্থির?
 
চন্দ্রসেন।                                 সিংহাসন হতে তারে
করিব বঞ্চিত।
 
বিক্রমদেব।                             অতি অসম্ভব কথা।
সিংহাসন দিব তারে নিজ হস্তে আমি।
 
চন্দ্রসেন।              কাশ্মীরের সিংহাসনে তোমার কী আছে
অধিকার?
 
বিক্রমদেব।                        বিজয়ীর অধিকার।
 
চন্দ্রসেন।                                                তুমি
হেথা আছ বন্ধুভাবে অতিথির মতো।
কাশ্মীরের সিংহাসন কর নাই জয়।
 
বিক্রমদেব।            বিনা যুদ্ধে করিয়াছে কাশ্মীর আমারে
আত্মসমর্পণ।  যুদ্ধ চাও যুদ্ধ করো,
রয়েছি প্রস্তুত।  আমার এ সিংহাসন।
যারে ইচ্ছা দিব।
 
চন্দ্রসেন।                                 তুমি দিবে!  জানি আমি
গর্বিত কুমারসেন জন্মকাল হতে।
সে কি লবে আপনার পিতৃসিংহাসন
ভিক্ষার স্বরূপে? প্রেম দাও প্রেম লবে,
হিংসা দাও প্রতিহিংসা লবে, ভিক্ষা দাও
ঘৃণাভরে পদাঘাত করিবে তাহাতে।
 
বিক্রমদেব।            এত গর্ব যদি তার তবে সে কি কভু
ধরা দিতে মোর কাছে আপনি আসিত?
 
চন্দ্রসেন।               তাই ভাবিতেছি, মহারাজ, নহে ইহা
কুমারসেনের মতো কাজ।  দৃপ্ত যুবা
সিংহসম।  সে কি আজ স্বেচ্ছায় আসিবে
শৃঙ্খল পরিতে গলে?  জীবনের মায়া
এতই কি বলবান।
 

প্রহরীর প্রবেশ

 

প্রহরী।                                        শিবিকার দ্বার
রুদ্ধ করি প্রাসাদে আসিছে যুবরাজ।
 
বিক্রমদেব।            শিবিকার দ্বার রুদ্ধ?
 
চন্দ্রসেন।                                      সে কি আর কভু
দেখাইবে মুখ?  আপনার পিতৃরাজ্যে
আসিছে সে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে; রাজপথে
লোকারণ্য চারিদিকে, সহস্রের আঁখি
রয়েছে তাকায়ে।  কাশ্মীরললনা যত
গবাক্ষে দাঁড়ায়ে।  উৎসবের পূর্ণচন্দ্র
চেয়ে আছে আকাশের মাঝখান হতে।
সেই চিরপরিচিত গৃহ পথ হাট
সরোবর মন্দির কানন, পরিচিত
প্রত্যেক প্রজার মুখ।  কোন্‌ লাজে আজি
দেখা দিবে সবারে সে?  মহারাজ, শোনো
নিবেদন।  গীতবাদ্য বন্ধ করে দাও।
এ উৎসব উপহাস মনে হবে তার।
আজ রাত্রে দীপালোক দেখে ভাবিবে সে,
নিশীথ-তিমিরে পাছে লজ্জা ঢাকা পড়ে
তাই এত আলো।  এ আলোক শুধু বুঝি
অপমান-পিশাচের পরিহাস-হাসি।
 

দেবদত্তের প্রবেশ

 

দেবদত্ত।               জয়োস্তু রাজন্‌।  কুমারের অন্বেষণে
বনে বনে ফিরিয়াছি, পাই নাই দেখা।
আজ শুনিলাম নাকি আসিছেন তিনি
স্বেচ্ছায় নগরে ফিরি। তাই চলে এনু।
 
বিক্রমদেব।            করিব রাজার মতো অভ্যর্থনা তারে।
তুমি হবে পুরোহিত অভিষেক-কালে।
পূর্ণিমা-নিশীথে আজ কুমারের সনে
ইলার বিবাহ হবে, করেছি তাহার
আয়োজন।      
 

নগরের ব্রাহ্মণগণের প্রবেশ

 

সকলে।                               মহারাজ, জয় হোক।
 
প্রথম।                                                          করি
আশীর্বাদ,ধরণীর অধীশ্বর হও।
লক্ষ্ণী হোন অচলা তোমার গৃহে সদা।
আজ যে আনন্দ তুমি দিয়েছ সবারে
বলিতে শকতি নাই– লহো মহারাজ,
কৃতজ্ঞ এ কাশ্মীরের কল্যাণ-আশিস।
 

[ রাজার মস্তকে ধান্যদূর্বা দিয়া আশীর্বাদ

 

বিক্রমদেব।            ধন্য আমি কৃতার্থ জীবন।
 

[ ব্রাহ্মণগণের প্রস্থান

 

যষ্টিহস্তে কষ্টে শংকরের প্রবেশ

 

শংকর।                (চন্দ্রসেনের প্রতি)         মহারাজ!
এ কি সত্য? যুবরাজ আসিছেন নিজে
শক্রকরে করিবারে আত্মসমর্পণ?
বলো, এ কি সত্য কথা?
 
চন্দ্রসেন।                                           সত্য বটে।
 
শংকর।                                                        ধিক,
সহস্র মিথ্যার চেয়ে এই সত্যে ধিক
হায় যুবরাজ, বৃদ্ধ ভৃত্য আমি তব,
সহিলাম এত যে যন্ত্রণা, জীর্ণ অন্থি
চূর্ণ হয়ে গেল মূক-সম রহিলাম
তবু, সে কি এরি তবে? অবশেষে তুমি
আপনি ধরিলে বন্দিবেশ, কাশ্মীরের
রাজপথ দিয়ে চলে এলে নতশিরে
বন্দিশালা-মাঝে? এই কি সে রাজসভা
পিতামহদের?  যেথা বসি পিতা তব
উঠিতেন ধরণীর সর্ব্বোচ্চ শিখরে
সে আজ তোমার কাছে ধরার ধুলার
চেয়ে নিচে!  তার চেয়ে নিরাশ্রয় পথ
গৃহতুল্য, অরণ্যের ছায়া সমুজ্জ্বল,
কঠিন পর্বতশৃঙ্গ অনুর্বর মরু
রাজার সম্পদে পূর্ণ।  চিরভৃত্য তব
আজি দুর্দিনের আগে মরিল না কেন?
 
বিক্রমদেব।            ভালো হতে মন্দটুকু নিয়ে, বৃদ্ধ, মিছে
এ তব ক্রন্দন।
 
শংকর।                                 রাজন্‌, তোমার কাছে
আসি নি কাঁদিতে।  স্বর্গীয় রাজেন্দ্রগণ
রয়েছেন জাগি ওই সিংহাসন-কাছে,
আজি তাঁরা ম্লানমুখ,  লজ্জানতশির,
তাঁরা বুঝিবেন মোর হৃদয়-বেদনা।
 
বিক্রমদেব।            কেন মোরে শত্রু বলে করিতেছ ভ্রম?
মিত্র আমি আজি।
 
শংকর।                                    অতিশয় দয়া তব
জালন্ধরপতি;  মার্জনা করেছ তুমি।
দণ্ড ভালো মার্জনার চেয়ে।
 
বিক্রমদেব।                                           এর মতো
হেন ভক্ত বন্ধু হায় কে আমার আছে?
 
দেবদত্ত।               আছে বন্ধু, আছে মহারাজ।
 

বাহিরে হুলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, কোলাহল

 

শংকরের দুই হস্তে মুখ আচ্ছাদন

 

প্রহরীর প্রবেশ

 

প্রহরী।                                                 আসিয়াছে
দুয়ারে শিবিকা।
 
বিক্রমদেব।                               বাদ্য কোথা, বাজাইতে
বলো।  চলো সখা, অগ্রসর হয়ে তারে
অভ্যর্থনা করি।
 

বাদ্যোদ্যম।  সভামধ্যে শিবিকার প্রবেশ

 

বিক্রমদেব।            ( অগ্রসর হইয়া ) এস, এস, বন্ধু এস।
                স্বর্ণথালে ছিন্নমুণ্ড লইয়া সুমিত্রার শিবিকাবাহিরে আগমন
                                     সহসা সমস্ত বাদ্য নীরব
 
বিক্রমদেব।            সুমিত্রা! সুমিত্রা!
 
চন্দ্রসেন।                                  এ কী, জননী সুমিত্রা!
 
সুমিত্রা।                ফিরেছ সন্ধানে যার রাত্রিদিন ধরে
কাননে কান্তারে শৈলে–  রাজ্য ধর্ম দয়া
রাজলক্ষ্ণী সব বিসর্জিয়া, যার লাগি
দিগ্বিদিকে হাহাকার করেছ প্রচার,
মূল্য দিয়ে চেয়েছিলে কিনিবারে যারে,
লহ মহারাজ, ধরণীর রাজবংশে
শ্রেষ্ঠ সেই শির।  আতিথ্যের উপহার
আপনি ভেটিলা যুবরাজ।  পূর্ণ তব
মনস্কাম, এবে শান্তি হোক, শান্তি হোক
এ জগতে, নিবে যাক নরকাগ্নিরাশি,
সুখী হও তুমি।  ( ঊর্ধ্বস্বরে ) মাগো জগৎজননী,
দয়াময়ী, স্থান দাও কোলে।
 

[ পতন ও মৃত্যু

 

ছুটিয়া ইলার প্রবেশ

 

ইলা।                                               এ কী, এ কী,
মহারাজ, কুমার আমার–
 
শংকর।               ( অগ্রসর হইয়া )          প্রভু, স্বামী,
বৎস, প্রাণাধিক, বৃদ্ধের জীবনধন,
এই ভালো, এই ভালো। মুকুট পরেছ
তুমি, এসেছ রাজার মতো আপনার
সিংহাসনে।  মৃত্যুর অমর রশ্মিরেখা
উজ্জ্বল করেছে তব ভাল।  এতদিন
এ বৃদ্ধেরে রেখেছিল বিধি, আজি তব
এ মহিমা দেখাবার তরে।  গেছ তুমি
পুণ্যধামে– ভৃত্য আমি চিরজনমের
আমিও যাইব সাথে।
 
চন্দ্রসেন।               ( মাথা হইতে মুকুট ভূমে ফেলিয়া )
                        ধিক এ মুকুট।
ধিক এই সিংহাসন।

[ সিংহাসনে পদাঘাত

রেবতীর প্রবেশ

 
                         রাক্ষসী পিশাচী
দূর হ দূর হ– আমারে দিস নে দেখা
পাপীয়সী।
 

রেবতী।                           এ রোষ রবে না চিরদিন।
 

[ প্রস্থান

 

বিক্রমদেব।            ( নতজানু ) দেবী, যোগ্য নহি আমি তোমার প্রেমের,
তাই বলে মার্জনাও করিলে না? রেখে
গেলে চির অপরাধী করে? ইহজন্ম
নিত্য-অশ্রুজলে লইতাম ভিক্ষা মাগি
ক্ষমা তব; তাহারো দিলে না অবকাশ?
দেবতার মতো তুমি নিশ্চল নিষ্ঠুর,
অমোঘ তোমার দণ্ড, কঠিন বিধান।
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *