রাজা ও রানী – ৩য় অঙ্ক

তৃতীয় অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

কাশ্মীর

প্রাসাদ-সম্মুখে রাজপথ

দ্বারে শংকর

শংকর। এতটুকু ছিল, আমার কোলে খেলা করত। যখন কেবল চারটি দাঁত উঠেছে তখন সে আমাকে সংকল দাদা বলত। এখন বড়ো হয়ে উঠেছে, এখন সংকল দাদার কোলে আর ধরে না, এখন সিংহাসন চাই। স্বর্গীয় মহারাজ মরবার সময় তোদের দুটি ভাইবোনকে আমার কোলে দিয়ে গিয়েছিল। বোনটি তো দুদিন বাদে স্বামীর কোলে গেল। মনে করেছিলুম কুমারসেনকে আমার কোল থেকে একেবারে সিংহাসনে উঠিয়ে দেব। কিন্তু খুড়ো-মহারাজ আর সিংহাসন থেকে নাবেন না। শুভলগ্ন কতবার হল, কিন্তু আজ কাল করে আর সময় হল না। কত ওজর কত আপত্তি। আরে ভাই সংকলের কোল এক, আর সিংহাসন এক। বুড়ো হয়ে গেলুম– তোকে কি আর রাজাসনে দেখে যেতে পারব।

দুইজন সৈনিকের প্রবেশ

প্রথম সৈনিক। আমাদের যুবরাজ কবে রাজা হবে রে ভাই? সেদিন আমি তোদের সকলকে মহুয়া খাওয়াব।
দ্বিতীয় সৈনিক। আরে, তুই তো মহুয়া খাওয়াবি– আমি জান্‌ দেব, আমি লড়াই করে করে বেড়াব, আমি পাঁচটা গাঁ লুট করে আনব। আমি আমার মহাজন বেটার মাথা ভেঙে দেব। বলিস তো, আমি খুশি হয়ে যুবরাজের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অম্‌নি মরে পড়ে যাব।
প্রথম সৈনিক। তা কি আমি পারি নে। মরবার কথা কী বলিস। আমার যদি সওয়া-শ বরষ পরমায়ু থাকে আমি যুবরাজের জন্যে রোজ নিয়মিত দু-সন্ধ্যে দু-বার করে মরতে পারি। তা ছাড়া উপরি আছে।
দ্বিতীয় সৈনিক। ওরে যুবরাজ তো আমাদেরই। স্বর্গীয় মহারাজ তাকে আমাদেরই হাতে দিয়ে গেছেন। আমরা তাকে কাঁধে করে ঢাক বাজিয়ে রাজা করে দেব। তা কাউকে ভয় করব না–
প্রথম সৈনিক। খুড়ো-মহারাজকে গিয়ে বলব, তুমি নেমে এস; আমরা রাজপুত্তুরকে সিংহাসনে চড়িয়ে আনন্দ করতে চাই।
দ্বিতীয় সৈনিক। শুনেছিস, পূর্ণিমা তিথিতে যুবরাজের বিয়ে।
প্রথম সৈনিক। সে তো পাঁচ বৎসর ধরে শুনে এসেছি।
দ্বিতীয় সৈনিক। এইবার পাঁচ বৎসর পূর্ণ হয়ে গেছে। ত্রিচূড়ের রাজবংশে নিয়ম চলে আসছে যে, পাঁচ বৎসর রাজকন্যার অধীন হয়ে থাকতে হবে। তার পর তার হুকুম হলে বিয়ে হবে।
প্রথম সৈনিক। বাবা, এ আবার কী নিয়ম। আমরা ক্ষত্রিয়, আমাদের চিরকাল চলে আসছে শ্বশুরের গালে চড় মেরে মেয়েটার ঝুঁটি ধরে টেনে নিয়ে আসি– ঘণ্টা দুয়ের মধ্যে সমস্ত পরিষ্কার হয়ে যায়। তার পরে দশটা বিয়ে করবার ফুরসৎ পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় সৈনিক। যোধমল, সেদিন কী করবি বল্‌ দেখি?
প্রথম সৈনিক। সেদিন আমিও আরেকটা বিয়ে করে ফেলব।
দ্বিতীয় সৈনিক। শাবাশ বলেছিস রে ভাই।
প্রথম সৈনিক। মহিচাঁদের মেয়ে! খাসা দেখতে ভাই। কী চোখ রে। সে দিন বিতস্তায় জল আনতে যাচ্ছিল, দুটো কথা বলতে গেলুম, কঙ্কণ তুলে মারতে এল। দেখলুম চোখের চেয়ে তার কঙ্কণ ভয়ানক। চটপট সরে পড়তে হল।

গান

ঐ আঁখি রে।
ফিরে ফিরে চেয়ো না চেয়ো না, ফিরে যাও
কী আর রেখেছ বাকি রে।
মরমে কেটেছ সিঁধ, নয়নের কেড়েছ নিদ
কী সুখে পরান আর রাখি রে।

দ্বিতীয় সৈনিক। শাবাশ ভাই।
প্রথম সৈনিক। ওই দেখ্‌ শংকরদাদা। যুবরাজ এখানে নেই– তবু বুড়ো সাজসজ্জা করে সেই দুয়োরে বসে আছে। পৃথিবী যদি উলটপালট হয়ে যায় তবু বুড়োর নিয়মের ত্রুটি হবে না।
দ্বিতীয় সৈনিক। আয় ভাই ওকে যুবরাজের দুটো কথা জিজ্ঞাসা করা যাক।
প্রথম সৈনিক। জিজ্ঞাসা করলে ও কি উত্তর দেবে? ও তেমন বুড়ো নয়। যেন ভরতের রাজত্বে রামচন্দ্রের জুতোজোড়াটার মতো পড়ে আছে, মুখে কথাটি নেই।
দ্বিতীয় সৈনিক। (শংকরের নিকটে গিয়া) হাঁ দাদা, বলো না দাদা, যুবরাজ রাজা হবে কবে?
শংকর। তোদের সে খবরে কাজ কী।
প্রথম সৈনিক। না না, বলছি আমাদের যুবরাজের বয়স হয়েছে, এখন খুড়ো-রাজা নাবছে না কেন?
শংকর। তাতে দোষ হয়েছে কী। হাজার হোক, খুড়ো তো বটে।
দ্বিতীয় সৈনিক। তা তো বটেই। কিন্তু যে-দেশের যেমন নিয়ম– আমাদের নিয়ম আছে যে–
শংকর। নিয়ম তোরা মানবি, আমরা মানব, বড়োলোকের আবার নিয়ম কী। সবাই যদি নিয়ম মানবে তবে নিয়ম গড়বে কে।
প্রথম সৈনিক। আচ্ছা, দাদা, তা যেন হল– কিন্তু এই পাঁচ বছর ধরে বিয়ে করা এ কেমন নিয়ম দাদা। আমি তো বলি, বিয়ে করা বাণ খাওয়ার মতো– চট করে লাগল তীর, তার পরে ইহজন্মের মতো বিঁধে রইল। আর ভাবনা রইল না। কিন্তু দাদা, পাঁচ বৎসর ধরে এ কী রকম কারখানা।
শংকর। তোদের আশ্চর্য ঠেকবে বলে কি যে-দেশের যা নিয়ম তা উলটে যাবে? নিয়ম তো কারো ছাড়বার জো নেই। এ সংসার নিয়মেই চলছে। যা যা আর বকিস নে যা। এ সকল কথা তোদের মুখে ভালো শোনায় না।
প্রথম সৈনিক। তা চললুম। আজকাল আমাদের দাদার মেজাজ ভালো নেই। একেবারে শুকিয়ে যেন খড়খড় করছে।

[ সৈনিকদ্বয়ের প্রস্থান

পুরুষবেশী সুমিত্রার প্রবেশ

সুমিত্রা।                তুমি কি শংকরদাদা।
শংকর।                                        কে তুমি ডাকিলে
পুরাতন পরিচিত স্নেহভরা সুরে।
কে তুমি পথিক।
সুমিত্রা।                                     এসেছি বিদেশ হতে।
শংকর।                এ কি স্বপ্ন দেখি আমি? কী মন্ত্র-কুহকে
কুমার আবার এল বালক হইয়া
শংকরের কাছে। যেন সেই সন্ধ্যাবেলা
খেলাশ্রান্ত সুকুমার বাল্যতনুখানি
চরণকমল ক্লিষ্ট, বিবর্ণ কপোল,
ক্লান্ত শিশু হিয়া, বৃদ্ধ শংকরের বুকে
বিশ্রাম মাগিছে।
সুমিত্রা।                                   জালন্ধর হতে আমি
এসেছি সংবাদ লয়ে কুমারের কাছে।
শংকর।                কুমারের বাল্যকাল এসেছে আপনি
কুমারের কাছে। শৈশবের খেলাধুলা
মনে করে দিতে, ছোটো বোন পাঠায়েছে
তারে। দূত তুমি এ মূর্তি কোথায় পেলে।
মিছে বকিতেছি কত। ক্ষমা করো মোরে।
বলো বলো কী সংবাদ। রানী দিদি মোর
ভালো আছে, সুখে আছে, পতির সোহাগে,
মহিষী-গৌরবে? সুখে প্রজাগণ তারে
মা বলিয়া করে আশীর্বাদ? রাজলক্ষ্ণী
অন্নপূর্ণা বিতরিছে রাজ্যের কল্যাণ?
ধিক মোরে, শ্রান্ত তুমি পথশ্রমে, চলো
গৃহে চলো। বিশ্রামের পরে একে একে
ব’লো তুমি সকল সংবাদ। গৃহে চলো।
সুমিত্রা।                শংকর, মনে কি আছে এখনো রানীরে।
শংকর।                সেই কণ্ঠস্বর। সেই গভীর গম্ভীর
দৃষ্টি স্নেহভারনত। এ কি মরীচিকা?
এনেছ কি চুরি করে মোর সুমিত্রার
ছায়াখানি? মনে নাই তারে? তুমি বুঝি
তাহারি অতীত স্মৃতি বাহিরিয়া এলে
আমারি হৃদয় হতে আমারে ছলিতে?
বার্ধক্যের মুখরতা ক্ষমা করো যুবা।
বহুদিন মৌন ছিনু– আজ কত কথা
আসে মুখে, চোখে আসে জল। নাহি জানি
কেন এত স্নেহ আসে মনে, তোমা ‘পরে।
যেন তুমি চিরপরিচিত। যেন তুমি
চিরজীবনের মোর আদরের ধন।

[ প্রস্থান

দ্বিতীয় দৃশ্য

ত্রিচূড়

ক্রীড়াকানন

কুমারসেন, ইলা ও সখীগণ

ইলা।                   যেতে হবে? কেন যেতে হবে যুবরাজ।
ইলারে লাগে না ভালো দু-দণ্ডের বেশি,
ছি ছি চঞ্চল হৃদয়!
কুমারসেন।                                 প্রজাগণ সবে–
ইলা।                   তারা কি আমার চেয়ে হয় ম্রিয়মাণ
তব অদর্শনে। রাজ্যে তুমি চলে গেলে
মনে হয়, আর আমি নেই। যতক্ষণ
তুমি মোরে মনে কর ততক্ষণ আছি,
একাকিনী কেহ নই আমি। রাজ্যে তব
কত লোক, কত চিন্তা, কত কার্যভার,
কত রাজ-আড়ম্বর; আর সব আছে,
শুধু সেথা ক্ষুদ্র ইলা নাই।
কুমারসেন।                                          সব আছে
তবু কিছু নাই, তুমি না থেকেও আছ
প্রাণতমে।
ইলা।                               মিছে কথা ব’লো না কুমার।
তুমি রাজা আপন রাজত্বে, এ অরণ্যে
আমি রানী, তুমি প্রজা মোর। কোথা যাবে
যেতে আমি দিব না তোমারে। সখী, তোরা
আয়। এরে বাঁধ্‌ ফুলপাশে, কর্‌ গান,
কেড়ে নে সকলে মিলি রাজ্যের ভাবনা।
সখীদের গান
যদি আসে তবে কেন যেতে চায়।
দেখা দিয়ে তবে কেন গো লুকায়।
চেয়ে থাকে ফুল হৃদয় আকুল বায়ু বলে এসে ভেসে যাই।
ধরে রাখো, ধরে রাখো, সুখপাখি ফাঁকি দিয়ে উড়ে যায়।
পথিকের বেশে সুখনিশি এসে বলে হেসে হেসে, মিশে যাই।
জেগে থাকো, জেগে থাকো, বয়সের সাধ নিমেষে মিলায়।
কুমারসেন।            আমারে কী করেছিস, অয়ি কুহকিনী।
নির্বাপিত আমি। সমস্ত জীবন মন
নয়ন বচন ধাইছে তোমার পানে
কেবল বাসনাময় হয়ে। যেন আমি
আমারে ভাঙিয়ে দিয়ে ব্যাপ্ত হয়ে যাব
তোমার মাঝারে প্রিয়ে। যেন মিশে রব
সুখস্বপ্ন হয়ে ওই নয়নপল্লবে।
হাসি হয়ে ভাসিব অধরে। বাহু দুটি
ললিত লাবণ্যসম রহিব বেড়িয়া,
মিলন-সুখের মতো কোমল হৃদয়ে
রহিব মিলায়ে।
ইলা।                                   তার পরে অবশেষে
সহসা টুটিবে স্বপ্নজাল, আপনারে
পড়িবে স্মরণে। গীতহীনা বীণাসম
আমি পড়ে রব ভূমে, তুমি চলে যাবে
গুনগুন গাহি অন্যমনে। না না সখা,
স্বপ্ন নয়, মোহ নয়, এ মিলন-পাশ
কখন বাঁধিয়া যাবে বাহুতে বাহুতে,
চোখে চোখে, মর্মে মর্মে, জীবনে জীবনে।
কুমারসেন।           সে তো আর দেখি নাই– আজি সপ্তমীর
অর্ধ চাঁদ ক্রমে ক্রমে পূর্ণ শশী হয়ে
দেখিবেক আমাদের পূর্ণ সে মিলন।
ক্ষীণ বিচ্ছেদের বাধা মাঝখানে রেখে
কম্পিত আগ্রহবেগে মিলনের সুখ–
আজি তার শেষ। দূরে থেকে কাছাকাছি,
কাছে থেকে তবু দূর, আজি তার শেষ।
সহসা সাক্ষাৎ, সহসা বিস্ময়রাশি,
সহসা মিলন, সহসা বিরহব্যথা–
বনপথ দিয়ে ধীরে ধীরে ফিরে যাওয়া
শূন্য গৃহপানে সুখস্মৃতি সঙ্গে নিয়ে,
প্রতি কথা, প্রতি হাসিটুকু শতবার
উলটি পালটি মনে, আজি তার শেষ।
মৌন লজ্জা প্রতিবার প্রথম মিলনে,
অশ্রুজল প্রতিবারে বিদায়ের বেলা–
আজি তার শেষ।
ইলা।                                       আহা তাই যেন হয়।
সুখের ছায়ার চেয়ে সুখ ভালো, দুঃখ
সেও ভালো। তৃষ্ঞা ভালো মরীচিকা চেয়ে।
কখন তোমারে পাব, কখন পাব না,
তাই সদা মনে হয়– কখন হারাব।
একা বসে বসে ভাবি, কোথা আছ তুমি,
কী করিছ। কল্পনা কাঁদিয়া ফিরে আসে
অরণ্যের প্রান্ত হতে। বনের বাহিরে
তোমারে জানি নে আর, পাই নে সন্ধান।
সমস্ত ভুবনে তব রহিব সর্বদা,
কিছুই রবে না আর অচেনা, অজানা,
অন্ধকার। ধরা দিতে চাহ না কি নাথ?
কুমারসেন।           ধরা তো দিয়েছি আমি আপন ইচ্ছায়,
তবু কেন বন্ধনের পাশ। বলো দেখি।
কী তুমি পাও নি, কোথা রয়েছে অভাব।
ইলা।                   যখন তোমার কাছে সুমিত্রার কথা
শুনি বসে, মনে মনে ব্যথা যেন বাজে।
মনে হয় সে যেন আমায় ফাঁকি দিয়ে
চুরি করে রাখিয়াছে শৈশব তোমার
গোপনে আপন কাছে। কভু মনে হয়
যদি সে ফিরিয়া আসে, বাল্য-সহচরী
ডেকে নিয়ে যায় সেই সুখশৈশবের
খেলাঘরে, সেথা তারি তুমি। সেথা মোর
নাই অধিকার। মাঝে মাঝে সাধ যায়,
তোমার সে সুমিত্রারে দেখি একবার।
কুমারসেন।           সে যদি আসিত, আহা, কত সুখ হত।
উৎসবের আনন্দ-কিরণখানি হয়ে
দীপ্তি পেত পিতৃগৃহে শৈশব-ভবনে।
অলংকারে সাজাত তোমারে, বাহুপাশে
বাঁধিত সাদরে, চুরি করে হাসিমুখে
দেখিত মিলন। আর কি সে মনে করে
আমাদের। পরগৃহে পর হয়ে আছে।
                ইলার গান
এরা, পরকে আপন করে, আপনারে পর,
বাহিরে বাঁশির রবে ছেড়ে যায় ঘর।
          ভালোবাসে সুখে দুখে,
          ব্যথা সহে হাসিমুখে,
মরণেরে করে চির জীবন-নির্ভর॥
কুমারসেন।           কেন এ করুণ সুর। কেন দুঃখগান।
বিষণ্ন নয়ন কেন।
ইলা।                                       এ কি দুঃখগান।
শোনায় গভীর সুখ দুঃখের মতন
উদার উদাস। সুখদুঃখ ছেড়ে দিয়ে
আত্মবিসর্জন করি রমণীর সুখ।
কুমারসেন।           পৃথিবী করিব বশ তোমার এ প্রেমে।
আনন্দে জীবন মোর উঠে উচ্ছ্বসিয়া
বিশ্বমাঝে। শ্রান্তিহীন কর্মসুখতরে
ধায় হিয়া। চিরকীর্তি করিয়া অর্জন
তোমারে করিব তার অধিষ্ঠাত্রী দেবী।
বিরলে বিলাসে বসে এ অগাধ প্রেম
পারি নে করিতে ভোগ অলসের মতো।
ইলা।                  ওই দেখো রাশি রাশি মেঘ উঠে আসে
উপত্যকা হতে, ঘিরিতে পর্বতশৃঙ্গ,–
সৃষ্টির বিচিত্র লেখা মুছিয়া ফেলিতে।
কুমারসেন।           দক্ষিণে চাহিয়া দেখো– অস্তরবিকরে
সুবর্ণ-সমুদ্র সম সমতলভূমি
গেছে চলে নিরুদ্দেশ কোন্‌ বিশ্বপানে।
শস্যক্ষেত্র, বনরাজি, নদী, লোকালয়
অস্পষ্ট সকলি– যেন স্বর্ণ-চিত্রপটে
শুধু নানা বর্ণসমাবেশ, চিত্ররেখা
এখনো ফোটে নি। যেন আকাঙক্ষা আমারি
শৈল-অন্তরাল ছেড়ে ধরণীর পানে
চলেছে বিস্তৃত হয়ে হৃদয়ে বহিয়া
কল্পনার স্বর্ণলেখা ছায়াস্ফুট ছবি।
আহা হোথা কত দেশ, নব দৃশ্য কত,
কত নব কীর্তি, কত নব রঙ্গভূমি।
ইলা।                   অনন্তের মূর্তি ধরে ওই মেঘ আসে
মোদের করিতে গ্রাস। নাথ কাছে এস।
আহা যদি চিরকাল এই মেঘমাঝে
লুপ্ত বিশ্বে থাকিতাম তোমাতে আমাতে,
দুটি পাখি একমাত্র মহামেখনীড়ে।
পারিতে থাকিতে তুমি? মেঘ-আবরণ
ভেদ করে কোথা হতে পশিত শ্রবণে
ধরার আহ্বান; তুমি ছুটে চলে যেতে
আমারে ফেলিয়া রেখে প্রলয়ের মাঝে।
পরিচারিকার প্রবেশ
পরিচারিকা।         কাশ্মীরে এসেছে দূত জালন্ধর হতে
গোপন সংবাদ লয়ে।
কুমারসেন।                                   তবে যাই, প্রিয়ে,
আবার আসিব ফিরে পূর্ণিমার রাতে
নিয়ে যাব হৃদয়ের চিরপূর্ণিমারে–
হৃদয়দেবতা আছ, গৃহলক্ষ্ণী হবে।

[ প্রস্থান

ইলা।                   যাও তুমি, আমি একা কেমনে পারিব
তোমারে রাখিতে ধরে। হায়, কত ক্ষুদ্র,
কত ক্ষুদ্র আমি। কী বৃহৎ এ সংসার,
কী উদ্দাম তোমার হৃদয়। কে জানিবে
আমার বিরহ। কে গনিবে অশ্রু মোর।
কে মানিবে এ নিভৃত বনপ্রান্তভাগে
শূন্যহিয়া বালিকার মর্মকাতরতা।

তৃতীয় দৃশ্য

কাশ্মীর

যুবরাজের প্রাসাদ

কুমারসেন ও ছদ্মবেশী সুমিত্রা

কুমারসেন।           কত যে আগ্রহ মোর কেমনে দেখাব
তোমারে ভগিনী। আমারে ব্যথিছে যেন
প্রত্যেক নিমেষ পল,– যেতে চাই আমি
এখনি লইয়া সৈন্য– দুর্বিনীত সেই
দস্যুদের করিতে দমন, কাশ্মীরের
কলঙ্ক করিতে দূর। কিন্তু পিতৃব্যের
পাই নে আদেশ। ছদ্মবেশ দূর করো
বোন। চলো মোরা যাই দোঁহে,– পড়ি গিয়ে
রাজার চরণে।
সুমিত্রা।                                 সে কী কথা, ভাই। আমি
এসেছি তোমার কাছে, জানাতে তোমারে
ভগিনীর মনোব্যথা। আমি কি এসেছি
জালন্ধর রাজ্য হতে ভিখারিনী রানী
ভিক্ষা মাগিবার তরে কাশ্মীরের কাছে?
ছদ্মবেশ দহিছে হৃদয়। আপনার
পিতৃগৃহে আসিলাম এতদিন পরে
আপনারে করিয়া গোপন! কতবার
বৃদ্ধ শংকরের কাছে কণ্ঠ রুদ্ধ হল
অশ্রুভরে,– কতবার মনে করেছিনু
কাঁদিয়া তাহারে বলি– “শংকর, শংকর,
তোদের সুমিত্রা সেই ফিরিয়া এসেছে
দেখিতে তোদের।” হায় বৃদ্ধ, কত অশ্রু
ফেলে গিয়েছিনু সেই বিদায়ের দিনে,
মিলনের অশ্রুজল নারিলাম দিতে।
শুধু আমি নহি আর কন্যা কাশ্মীরের
আজ আমি জালন্ধর-রানী।
কুমারসেন।                                           বুঝিয়াছি
বোন।  যাই দেখি, অন্য কী উপায় আছে।

চতুর্থ দৃশ্য

কাশ্মীর-প্রাসাদ

অন্তঃপুর

রেবতী ও চন্দ্রসেন

রেবতী।               যেতে দাও মহারাজ। কী ভাবিছ বসি?
ভাবিছ কী লাগি? যাক যুদ্ধে,– তার পরে
দেবতা-কৃপায় আর যেন নাহি আসে
ফিরে।
চন্দ্রসেন।                      ধীরে রানী, ধীরে।
রেবতী।                                            ক্ষুধিত মার্জার
বসে ছিলে এতদিন সময় চাহিয়া,
আজ তো সময় এল– তবু আজো কেন
সেই বসে আছ।
চন্দ্রসেন।                                  কে বসিয়া ছিল, রানী,
কিসের লাগিয়া।
রেবতী।                                  ছি ছি, আবার ছলনা।
লুকাবে আমার কাছে? কোন্‌ অভিপ্রায়ে
এতদিন কুমারের দাও নি বিবাহ।
কেন বা সম্মতি দিলে ত্রিচূড়-রাজ্যের
এই অনার্য প্রথায়। পঞ্চবর্ষ ধরে
কন্যার সাধনা।
চন্দ্রসেন।                                ধিক্‌। চুপ করো রানী–
কে বোঝে কাহার অভিপ্রায়?
রেবতী।                                                 তবে, বুঝে
দেখো ভালো করে। যে কাজ করিতে চাও
জেনে শুনে করো। আপনার কাছ হতে
রেখো না গোপন করে উদ্দেশ্য আপন।
দেবতা তোমার হয়ে অলক্ষ্য-সন্ধানে
করিবে না তব লক্ষ্যভেদ। নিজহাতে
উপায় রচনা করো অবসর বুঝে।
বাসনার পাপ সেই হতেছে সঞ্চয়,
তার পরে কেন থাকে অসিদ্ধির ক্লেশ।
কুমারে পাঠাও যুদ্ধে।
চন্দ্রসেন।                                        বাহিরে রয়েছে
কাশ্মীরের যত উপদ্রব। পর-রাজ্যে
আপনার বিষদন্ত করিতেছে ক্ষয়।
ফিরায়ে আনিতে চাও তাদের আবার?
রেবতী।               অনেক সময় আছে সে-কথা ভাবিতে।
আপাতত পাঠাও কুমারে। প্রজাগণ
ব্যগ্র অতি যৌবরাজ্য-অভিষেক তরে,
তাদের থামাও কিছুদিন। ইতিমধ্যে
কত কী ঘটিতে পারে পরে ভেবে দেখো।
কুমারের প্রবেশ
রেবতী।               (কুমারের প্রতি) যাও যুদ্ধে, পিতৃব্যের হয়েছে আদেশ।
বিলম্ব ক’রো না আর, বিবাহ-উৎসব
পরে হবে। দীপ্ত যৌবনের তেজ ক্ষয়
করিয়ো না গৃহে বসে আলস্য-উৎসবে।
কুমারসেন।           জয় হোক, জয় হোক জননী তোমার।
এ কী আনন্দ-সংবাদ। নিজমুখে তাত,
করহ আদেশ।
চন্দ্রসেন।                               যাও তবে। দেখো বৎস,
থেকো সাবধানে। দর্পমদে ইচ্ছা ক’রে
বিপদে দিয়ো না ঝাঁপ। আশীর্বাদ করি
ফিরে এসো জয়গর্বে অক্ষত শরীরে
পিতৃসিংহাসন ‘পরে।
কুমারসেন।                                    মাগি জননীর
আশীর্বাদ।
রেবতী।                            কী হইবে মিথ্যা আশীর্বাদে।
আপনারে রক্ষা করে আপনার বাহু।

পঞ্চম দৃশ্য

ত্রিচূড়

ক্রীড়া-কানন

ইলার সখীগণ

প্রথম সখী।           আলো কোথায় কোথায় দেবে ভাই?
দ্বিতীয় সখী।         আলোর জন্যে ভাবি নে। আলো তো কেবল এক রাত্রি জ্বলবে। কিন্তু বাঁশি এখনো এল না কেন? বাঁশি না বাজলে আমোদ নেই ভাই।
তৃতীয় সখী।         বাঁশি কাশ্মীর থেকে আনতে গেছে, এতক্ষণ এল বোধ হয়। কখন বাজবে ভাই?
প্রথম সখী।           বাজবে লো বাজবে। তোর অদৃষ্টেও একদিন বাজবে।
তৃতীয় সখী।         পোড়াকপাল আর কি! আমি সেইজন্যেই ভেবে মরছি।
প্রথম সখীর গান
বাজিবে, সখী, বাঁশি বাজিবে।
হৃদয়রাজ হৃদে রাজিবে।
বচন রাশি রাশি, কোথা যে যাবে ভাসি,
অধরে লাজ-হাসি সাজিবে।
নয়নে আঁখিজল করিবে ছল ছল,
সুখবেদনা মনে বাজিবে।
মরমে মুরছিয়া মিলাতে চাবে হিয়া
সেই চরণযুগ-রাজীবে।
দ্বিতীয় সখী।         তোর গান রেখে দে। এক এক বার মন কেমন হু হু করে উঠেছে। মনে পড়ছে কেবল একটি রাত আলো হাসি বাঁশি আর গান। তার পরদিন থেকে সমস্ত অন্ধকার।
প্রথম সখী।           কাঁদবার সময় ঢের আছে বোন। এই দুটো দিন একটু হেসে আমোদ করে নে। ফুল যদি না শুকোত তাহলে আমি আজ থেকেই মালা গাঁথতে বসতুম।
দ্বিতীয় সখী।         আমি বাসরঘর সাজাব।
প্রথম সখী।           আমি সখীকে সাজিয়ে দেব।
তৃতীয় সখী।         আর আমি কী করব?
প্রথম সখী।           ওলো, তুই আপনি সাজিস। দেখিস যদি যুবরাজের মন ভোলাতে পারিস।
তৃতীয় সখী। তুই তো ভাই চেষ্টা করতে ছাড়িস নি। তা তুই যখন পারলি নে তখন কি আর আমি পারব। ওলো, আমাদের সখীকে যে একবার দেখেছে তার মন কি আর অমনি পথেঘাটে চুরি যায়। ওই বাঁশি এসেছে। ওই শোন্‌ বেজে উঠেছে।

প্রথম সখীর গান

ঐ বুঝি বাঁশি বাজে।
বনমাঝে, কি মনমাঝে?
বসন্ত-বায় বহিছে কোথায়, কোথায় ফুটেছে ফুল!
বল গো সজনী, এ সুখরজনী কোন্‌খানে উদিয়াছে,
বনমাঝে, কি মনমাঝে?
যাব কি যাব না মিছে এ ভাবনা মিছে মরি লোকলাজে।
কে জানে কোথা সে বিরহ-হুতাশে ফিরে অভিসার-সাজে,
বনমাঝে, কি মনমাঝে?
দ্বিতীয় সখী।         ওলো থাম্‌– ওই দেখ্‌ যুবরাজ কুমারসেন এসেছেন।
তৃতীয় সখী।         চল্‌ চল্‌ ভাই, আমরা একটু আড়ালে দাঁড়াই গে। তোরা পারিস, কিন্তু কে জানে ভাই, যুবরাজের সামনে যেতে আমার কেমন করে।
দ্বিতীয় সখী।         কিন্তু কুমার আজ হঠাৎ অসময়ে এলেন কেন।
প্রথম সখী।           ওলো এর কি আর সময়-অসময় আছে। রাজার ছেলে বলে কি পঞ্চশর ওকে ছেড়ে কথা কয়। থাকতে পারবে কেন।
তৃতীয় সখী।         চল্‌ ভাই আড়ালে চল্‌।

[ অন্তরালে গমন

কুমারসেন ও ইলার প্রবেশ

ইলা।                  থাক্‌ নাথ, আর বেশি ব’লো না আমারে।
কাজ আছে, যেতে হবে রাজ্য ছেড়ে, তাই
বিবাহ স্থগিত রবে কিছুকাল, এর
বেশি কী আর শুনিব।
কুমারসেন।                                     এমনি বিশ্বাস
মোর ‘পরে রেখো চিরদিন। মন দিয়ে
মন বোঝা যায়; গভীর বিশ্বাস শুধু
নীরব প্রাণের কথা টেনে নিয়ে আসে।
প্রবাসীরে মনে ক’রো এই উপবনে,
এই নির্ঝরিণী-তীরে, এই লতাগৃহে,
এই সন্ধ্যালোকে, পশ্চিম-গগন-প্রান্তে
ওই সন্ধ্যাতারা-পানে চেয়ে। মনে ক’রো,
আমিও প্রদোষে, প্রবাসে তরুর তলে
একেলা বসিয়া ওই তারকার ‘পরে
তোমারি আঁখির তারা পেতেছি দেখিতে।
মনে ক’রো মিশিতেছে এই নীলাকাশে
পুষ্পের সৌরভ-সম তোমার আমার
প্রেম। এক চন্দ্র উঠিয়াছে উভয়ের
বিরহরজনী ‘পরে।
ইলা।                                        জানি, জানি, নাথ,
জানি আমি তোমার হৃদয়।
কুমারসেন।                                           যাই তবে,
অয়ি তুমি অন্তরের ধন, জীবনের
মর্মস্বরূপিণী, অয়ি সবার অধিক।

[ প্রস্থান

সখীগণের প্রবেশ

দ্বিতীয় সখী।          হায় এ কী শুনি।
তৃতীয় সখী।                              সখী, কেন যেতে দিলে।
প্রথম সখী।            ভালোই করেছ। স্বেচ্ছায় না দিলে ছাড়ি
বাঁধন ছিঁড়িয়া যায় চিরদিন-তরে!
হায় সখী, হায় শেষে নিবাতে হল কি
উৎসবের দীপ?
ইলা।                                    সখী, তোরা চুপ কর্‌,
টুটিছে হৃদয়। ভেঙে দে ভেঙে দে ওই
দীপমালা। বল্‌ সখী, কে দিবে নিবায়ে
লজ্জাহীনা পূর্ণিমার আলো? কেন আজ
মনে হয়, আমার এ জীবনের সুখ
আজি দিবসের সাথে ডুবিল পশ্চিমে।
অমনি ইলারে কেন অস্তপথ-পানে
সঙ্গে নাহি নিয়ে গেল ছায়ার মতন।
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *