রাজা ও রানী – ২য় অঙ্ক

দ্বিতীয় অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

সিংহগড়

জয়সেনের প্রাসাদ

জয়সেন, ত্রিবেদী ও মিহিরগুপ্ত

ত্রিবেদী।

তা বাপু, তুমি যদি চক্ষু অমন রক্তবর্ণ কর তাহলে আমার আপ্তবিশ্রুতি হবে। ভক্তবৎসল হরি। দেবদত্ত আর মন্ত্রী আমাকে অনেক করে শিখিয়ে দিয়েছে– কী বলছিলেম ভালো? আমাদের রাজা কালভৈরবের পুজো নামক একটা উপলক্ষ করে–

জয়সেন।

উপলক্ষ করে?

ত্রিবেদী।

হাঁ, তা নয় উপলক্ষই হল, তাতে দোষ হয়েছে কী? মধুসূদন। যা তোমার চিন্তা হতে পারে বটে। উপলক্ষ শব্দটা কিঞ্চিৎ কাঠিন্যরসাসক্ত হয়ে পড়েছে– ওর যা যথার্থ অর্থ সেটা নিরাকার করতে অনেকেরই গোল ঠেকে দেখেছি।

জয়সেন।

তাই তো ঠাকুর, ওর যথার্থ অর্থটাই ঠাওরাচ্ছি।

ত্রিবেদী।

রাম নাম সত্য। তা না হয় উপলক্ষ না বলে উপসর্গ বলা গেল। শব্দের অভাব কী বাপু? শাস্ত্রে বলে শব্দ ব্রহ্ম। অতএব উপলক্ষই বল আর উপসর্গই বল, অর্থ সমানই রইল।

জয়সেন।

তা বটে। রাজা যে আমাদের আহ্বান করেছেন তার উপলক্ষ এবং উপসর্গ পর্যন্ত বোঝা গেল– কিন্তু তার যথার্থ কারণটা কী খুলে বলো দেখি।

ত্রিবেদী।

ওইটে বলতে পারলুম না বাপু– ওইটে আমায় কেউ বুঝিয়ে বলে নি। হরি হে।

জয়সেন।

ব্রাহ্মণ, তুমি বড়ো কঠিন স্থানে এসেছ, কথা গোপন কর তো বিপদে পড়বে।

ত্রিবেদী।

হে ভগবান! হ্যাঁ দেখো বাপু, তুমি রাগ ক’রো না, তোমার স্বভাবটা নিতান্ত যে মধুমত্ত মধুকরের মতো তা বোধ হচ্ছে না।

জয়সেন।

বেশি ব’কো না ঠাকুর, যথার্থ কারণ যা জান বলে ফেলো।

ত্রিবেদী।

বাসুদেব! সকল জিনিসেরই কি যথার্থ কারণ থাকে। যদি বা থাকে তো সকল লোকে কি টের পায়? যারা গোপনে পরামর্শ করেছে তারাই জানে! মন্ত্রী জানে, দেবদত্ত জানে। তা বাপু, তুমি অধিক ভেবো না, বোধ করি সেখানে যাবামাত্রই যথার্থ কারণ অবিলম্বে টের পাবে।

জয়সেন।

মন্ত্রী তোমাকে আর কিছুই বলে নি?

ত্রিবেদী।

নারায়ণ, নারায়ণ! তোমার দিব্য, কিছু বলে নি। মন্ত্রী বললে, “ঠাকুর, যা বললুম তা ছাড়া একটি কথা ব’লো না। দেখো, তোমাকে যেন একটুও সন্দেহ না করে।” আমি বললুম, “হে রাম। সন্দেহ কেন করবে? তবে বলা যায় না! আমি তো সরলচিত্তে বলে যাব, যিনি সন্দগ্ধ হবেন তিনি হবেন!” হরি হে তুমিই সত্য।

জয়সেন।

পুজো উপলক্ষে নিমন্ত্রণ, এ তো সামান্য কথা,– এতে সন্দেহ হবার কী কারণ থাকতে পারে?

ত্রিবেদী।

তোমরা বড়োলোক, তোমাদের এইরকমই হয়। নইলে “ধর্মস্য সূক্ষ্ণা গতি” বলবে কেন? যদি তোমাদের কেউ এসে বলে, “আয় তো রে পাষণ্ড, তোর মুণ্ডুটা টান মেরে ছিঁড়ে ফেলি” অমনি তোমাদের উপলুব্ধ হয় যে, আর যাই হোক লোকটা প্রবঞ্চনা করছে না, মুণ্ডুটার উপরে বাস্তবিক তার নজর আছে বটে। কিন্তু যদি কেউ বলে, “এস তো বাপধন, আস্তে আস্তে তোমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিই”, অমনি তোমাদের সন্দেহ হয়। যেন আস্ত মুণ্ডুটা ধরে টান মারার চেয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দেওয়া শক্ত কাজ। হে ভগবান, যদি রাজা স্পষ্ট করেই বলত– একবার হাতের কাছে এস তো, তোমাদের একেকটাকে ধরে রাজ্য থেকে নির্বসন করে পাঠাই– তাহলে এটা কখনও সন্দেহ করতে না যে, হয়তো বা রাজকন্যার সঙ্গে পরিণাম-বন্ধন করবার জন্যেই রাজা ডেকে থাকবেন। কিন্তু রাজা বলছেন নাকি, “হে বন্ধুসকল, রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্ঠতি স বান্ধব, অতএব তোমরা পুজো উপলক্ষে এখানে এসে কিঞ্চিৎ ফলাহার করবে”– অমনি তোমাদের সন্দেহ হয়েছে সে ফলাহারটা কী রকমের না জানি। হে মধুসূদন। তা এমনি হয় বটে। বড়োলোকের সামান্য কথায় সন্দেহ হয়, আবার সামান্য লোকের বড়ো কথায় সন্দেহ হয়।

জয়সেন।

ঠাকুর, তুমি অতি সরল প্রকৃতির লোক। আমার যেটুকু বা সন্দেহ ছিল, তোমার কথায় সমস্ত ভেঙে গেছে।

ত্রিবেদী।

তা লেহ্য কথা বলেছ। আমি তোমাদের মতো বুদ্ধিমান নই– সকল কথা তলিয়ে বুঝতে পারি নে– কিন্তু, বাবা, সরল– পুরাণ-সংহিতায় যাকে বলে, অন্যে পরে কা কথা অর্থাৎ অন্যের কথা নিয়ে কখনো থাকি নে।

জয়সেন।

আর কাকে কাকে তুমি নিমন্ত্রণ করতে বেরিয়েছ?

ত্রিবেদী।

তোমাদের পোড়া নাম আমার মনে থাকে না। তোমাদের কাশ্মীরী স্বভাব যেমন তোমাদের নামগুলোও ঠিক তেমনি শ্রুতিপৌরুষ। তা এ-রাজ্যে তোমাদের গুষ্টির যেখানে যে আছে সকলকেই ডাক পড়েছে। শূলপাণি। কেউ বাদ যাবে না।

জয়সেন।

যাও, ঠাকুর, এখন বিশ্রাম করো গে।

ত্রিবেদী।

যা হোক, তোমার মন থেকে যে সমস্ত সন্দেহ দূর হয়েছে, মন্ত্রী এ-কথা শুনলে ভারি খুশি হবে! মুকুন্দ মুরহর মুরারে।

[ প্রস্থান

জয়সেন।

মিহিরগুপ্ত, সমস্ত অবস্থা বুঝলে তো? এখন গৌরসেন যুধাজিৎ উদয়ভাস্কর ওদের কাছে শীঘ্র লোক পাঠাও। বলো, অবিলম্বে সকলে একত্র মিলে একটা পরামর্শ করা আবশ্যক।

মিহিরগুপ্ত।

যে আজ্ঞা।

দ্বিতীয় দৃশ্য

অন্তঃপুর

বিক্রমদেব ও রানীর আত্মীয় সভাসদ

সভাসদ।               ধন্য মহারাজ।
বিক্রমদেব।                            কেন এত ধন্যবাদ।
সভাসদ।               মহত্ত্বের এই তো লক্ষণ, দৃষ্টি তার
সকলের ‘পরে। ক্ষুদ্রপ্রাণ ক্ষুদ্র জনে
পায় না দেখিতে। প্রবাসে পড়িয়া আছে
সেবক যাহারা, জয়সেন, যুধাজিৎ–
মহোৎসবে তাহাদের করেছ স্মরণ।
আনন্দে বিহ্বল তারা। সত্বর আসিছে
দলবল নিয়ে।
বিক্রমদেব।                            যাও, যাও। তুচ্ছ কথা,
তার লাগি এত যশোগান। জানিও নে
আহূত হয়েছে কারা পূজার উৎসবে।
সভাসদ।               রবির উদয়মাত্রে আলোকিত হয়
চরাচর, নাই চেষ্টা, নাহি পরিশ্রম,
নাহি তাহে ক্ষতিবৃদ্ধি তার। জানেও না
কোথা কোন্‌ তৃণতলে কোন্‌ বনফুল
আনন্দে ফুটিছে তার কনক-কিরণে।
কৃপাবৃষ্টি কর অবহেলে, যে পায় সে
ধন্য হয়।
বিক্রমদেব।                       থামো থামো, যথেষ্ট হয়েছে।
আমি যত অবহেলে কৃপাবৃষ্টি করি
তার চেয়ে অবহেলে সভাসদগণ
করে স্তুতিবৃষ্টি। বলা তো হয়েছে শেষ
যত কথা করেছ রচনা। যাও এবে।

[ সভাসদের প্রস্থান

সুমিত্রার প্রবেশ

কোথা যাও, একবার ফিরে চাও রানী।
রাজা আমি পৃথিবীর কাছে, তুমি শুধু
জান মোরে দীন ব’লে। ঐশ্বর্য আমার
বাহিরে বিস্তৃত– শুধু তোমার নিকটে
ক্ষুধার্ত কঙ্কালসার কাঙাল বাসনা।
তাই কি ঘৃণার দর্পে চলে যাও দূরে
মহারানী, রাজরাজেশ্বরী।

সুমিত্রা।                                             মহারাজ,
যে প্রেম করিছে ভিক্ষা সমস্ত বসুধা
একা আমি সে প্রেমের যোগ্য নই কভু
বিক্রমদেব।            অপদার্থ আমি! দীন কাপুরুষ আমি!
কর্তব্যবিমুখ আমি, অন্তঃপুরচারী!
কিন্তু মহারানী, সে কি স্বভাব আমার?
আমি ক্ষুদ্র, তুমি মহীয়সী? তুমি উচ্চে,
আমি ধূলিমাঝে? নহে তাহা। জানি আমি
আপন ক্ষমতা। রয়েছে দুর্জয় শক্তি
এ হৃদয়-মাঝে, প্রেমের আকারে তাহা
দিয়েছি তোমারে। বজ্রাগ্নিরে করিয়াছি
বিদ্যুতের মালা, পরায়েছি কণ্ঠে তব।
সুমিত্রা।                ঘৃণা করো মহারাজ, ঘৃণা করো মোরে
সেও ভালো– একেবারে ভুলে যাও যদি
সেও সহ্য হয়– ক্ষুদ্র এ নারীর ‘পরে
করিয়ো না বিসর্জন সমস্ত পৌরুষ।
বিক্রমদেব।            এত প্রেম, হায় তার এত অনাদর।
চাহ না এ প্রেম? না চাহিয়া দস্যুসম
নিতেছ কাড়িয়া। উপেক্ষার ছুরি দিয়া
কাটিয়া তুলিছ, রক্তসিক্ত তপ্ত প্রেম
মর্ম বিদ্ধ করি। ধূলিতে দিতেছ ফেলি
নির্মম নিষ্ঠুর। পাষাণ-প্রতিমা তুমি,
যত বক্ষে চেপে ধরি অনুরাগভরে,
তত বাজে বুকে।
সুমিত্রা।                                    চরণে পতিত দাসী,
কী করিতে চাও করো। কেন তিরস্কার?
নাথ, কেন আজি এত কঠিন বচন।
কত অপরাধ তুমি করেছ মার্জনা,
কেন রোষ বিনা অপরাধে।
বিক্রমদেব।                                            প্রিয়তমে,
উঠ উঠ, এস, বুকে– স্নিগ্ধ আলিঙ্গনে
এ দীপ্ত হৃদয়জ্বালা করহ নির্বাণ।
কত সুধা, কত ক্ষমা ওই অশ্রুজলে,
অয়ি প্রিয়ে, কত প্রেম, কতই নির্ভর।
কোমল হৃদয়তলে তীক্ষ্ণ কথা বিঁধে
প্রেম-উৎস ছুটে– অর্জুনের শরাঘাতে
মর্মাহত ধরণীর ভোগবতী-সম।
নেপথ্যে।              মহারানী।
সুমিত্রা।                (অশ্রু মুছিয়া) দেবদত্ত। আর্য, কী সংবাদ?

দেবদত্তের প্রবেশ

দেবদত্ত।               রাজ্যের নায়কগণ রাজ-নিমন্ত্রণ
করিয়াছে অবহেলা, বিদ্রোহের তরে
হয়েছে প্রস্তুত।
সুমিত্রা।                                  শুনিতেছ মহারাজ?
বিক্রমদেব।            দেবদত্ত, অন্তঃপুর নহে মন্ত্রগৃহ।
দেবদত্ত।               মহারাজ, মন্ত্রগৃহ অন্তঃপুর নহে
তাই সেথা নৃপতির পাই নে দর্শন।
সুমিত্রা।                স্পর্ধিত কুক্কুর যত বর্ধিত হয়েছে
রাজ্যের উচ্ছিষ্ট অন্নে। রাজার বিরুদ্ধে
বিদ্রোহ করিতে চাহে। এ কী অহংকার।
মহারাজ, মন্ত্রণার আছে কি সময়।
মন্ত্রণার কী আছে বিষয়। সৈন্য লয়ে
যাও অবিলম্বে, রক্তশোষী কীটদের
দলন করিয়া ফেলো চরণের তলে।
বিক্রমদেব।            সেনাপতি শত্রুপক্ষ–
সুমিত্রা।                                       নিজে যাও তুমি।
বিক্রমদেব।            আমি কি তোমার উপদ্রব, অভিশাপ,
দুরদৃষ্ট, দুঃস্বপন, করলগ্ন কাঁটা?
হেথা হতে এক পদ নড়িব না, রানী,
পাঠাইব সন্ধির প্রস্তাব। কে ঘটালে
এই উপদ্রব। ব্রাহ্মণে নারীতে মিলে
বিবরের সুপ্তসর্প জাগাইয়া তুলি
এ কী খেলা। আত্মরক্ষা-অসমর্থ যারা
নিশ্চিন্তে ঘটায় তারা পরের বিপদ।
সুমিত্রা।                ধিক এ অভাগা রাজ্য, হতভাগ্য প্রজা।
ধিক আমি, এ রাজ্যের রানী।
[ প্রস্থান
বিক্রমদেব।                                               দেবদত্ত,
বন্ধুত্বের এই পুরস্কার? বৃথা আশা।
রাজার অদৃষ্টে বিধি লেখে নি প্রণয়;
ছায়াহীন সঙ্গীহীন পর্বতের মতো
এক মহাশূন্যমাঝে দগ্ধ উচ্চ শিরে
প্রেমহীন নীরস মহিমা; ঝঞ্ঝাবায়ু
করে আক্রমণ, বজ্র এসে বিঁধে, সূর্য
রক্তনেত্রে চাহে; ধরণী পড়িয়া থাকে
চরণ ধরিয়া। কিন্তু ভালোবাসা কোথা।
রাজার হৃদয় সেও হৃদয়ের তরে
কাঁদে। হায় বন্ধু, মানবজীবন লয়ে
রাজত্বের ভান করা শুধু বিড়ম্বনা।
দম্ভ-উচ্চ সিংহাসন চূর্ণ হয়ে গিয়ে
ধরা সাথে হোক সমতল, একবার
হৃদয়ের কাছাকাছি পাই তোমাদের।
বাল্যসখা, রাজা বলে ভুলে যাও মোরে,
একবার ভালো করে করো অনুভব
বান্ধব-হৃদয়-ব্যথা বান্ধব-হৃদয়ে।
দেবদত্ত।               সখা, এ হৃদয় মোর জানিয়ো তোমার।
কেবল প্রণয় নয়, অপ্রণয় তব
সেও আমি সব’ অকাতরে, রোষানল
লব বক্ষ পাতি– যেমন অগাধ সিন্ধু
আকাশের বজ্র লয় বুকে।
বিক্রমদেব।                                          দেবদত্ত,
সুখনীড় মাঝে কেন হানিছ বিরহ।
সুখস্বর্গ মাঝে কেন আনিছ বহিয়া
হাহাধ্বনি।
দেবদত্ত।                          সখা, আগুন লেগেছে ঘরে
আমি শুধু এনেছি সংবাদ। সুখনিদ্রা
দিয়েছি ভাঙায়ে।
বিক্রমদেব।                                এর চেয়ে সুখস্বপ্নে
মৃত্যু ছিল ভালো।
দেবদত্ত।                                     ধিক লজ্জা মহারাজ,
রাজ্যের মৃত্যুর চেয়ে তুচ্ছ স্বপ্নসুখ
বেশি হল?
বিক্রমদেব।                         যোগাসনে লীন যোগিবর
তার কাছে কোথা আছে বিশ্বের প্রলয়।
স্বপ্ন এ সংসার। অর্ধশত বর্ষপরে
আজিকার সুখদুঃখ কার মনে রবে?
যাও যাও, দেবদত্ত, যেথা ইচ্ছা তব।
আপন সান্ত্বনা আছে আপনার কাছে।
দেখে আসি ঘৃণাভরে কোথা গেল রানী।

  [ প্রস্থান

তৃতীয় দৃশ্য

মন্দির

পুরুষবেশে রানী সুমিত্রা, বাহিরে অনুচর

সুমিত্রা।                জগৎ-জননী মাতা, দুর্বল-হৃদয়
তনয়ারে করিয়ো মার্জনা। আজ সব
পূজা ব্যর্থ হল– শুধু সে সুন্দর মুখ
পড়ে মনে, সেই প্রেমপূর্ণ চক্ষু দুটি,
সেই শয্যা-‘পরে একা সুপ্ত মহারাজ।
হায় মা, নারীর প্রাণ এত কি কঠিন।
দক্ষযজ্ঞে তুই ঘরে গিয়েছিলি সতী,
প্রতিপদে আপন হৃদয়খানি তোর
আপন চরণ দুটি জড়ায়ে কাতরে
বলে নি কি ফিরে যেতে পতিগৃহপানে।
সেই কৈলাসের পথে আর ফিরিল না
ও রাঙা চরণ। মা গো, সেদিনের কথা
দেখ্‌ মনে করে। জননী, এসেছি আমি
রমণী-হৃদয় বলি দিতে, রমণীর
ভালোবাসা, ছিন্ন শতদল সম, দিতে
পদতলে। নারী তুমি, নারীর হৃদয়
জান তুমি, বল দাও জননী আমারে।
থেকে থেকে ওই শুনি রাজগৃহ হতে
“ফিরে এস, ফিরে এস রানী”, প্রেমপূর্ণ
পুরাতন সেই কণ্ঠস্বর। খড়্‌গ নিয়ে
তুমি এস, দাঁড়াও রুধিয়া পথ, বলো,
“তুমি যাও, রাজধর্ম উঠুক জাগিয়া
ধন্য হোক রাজা, প্রজা হোক সুখী, রাজ্যে
ফিরে আসুক কল্যাণ, দূর হোক যত
অত্যাচার, ভূপতির যশোরশ্মি হতে
ঘুচে যাক কলঙ্ককালিমা। তুমি নারী
ধরাপ্রান্তে যেথা স্থান পাও– একাকিনী
বসে বসে নিজ দুঃখে মরো বুক ফেটে।”
পিতৃসত্য পালনের তরে রামচন্দ্র
গিয়াছেন বনে, পতিসত্য পালনের
লাগি আমি যাব। যে সত্যে আছেন বাঁধা
মহারাজ রাজলক্ষ্ণী কাছে– কভু তাহা
সামান্য নারীর তরে ব্যর্থ হইবে না।
অনুচর।

কে তোরা। দাঁড়া এইখানে।

পুরুষ।

কেন বাবা। এখানেও কি স্থান নেই।

স্ত্রী।

মা গো। এখানেও সেই সিপাই।

সুমিত্রার বাহিরে আগমন

সুমিত্রা।

তোমরা কে গো।

পুরুষ।

মিহিরগুপ্ত আমাদের ছেলেটিকে ধরে রেখে আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের চাল নেই, চুলো নেই, মরবার জায়গাটুকু নেই– তাই আমরা মন্দিরে এসেছি। মার কাছে হত্যা দিয়ে পড়ব– দেখি তিনি আমাদের কী গতি করেন।

স্ত্রী।

তা হাঁ গা, এখেনেও তোমরা সিপাই রেখেছ? রাজার দরজা বন্ধ, আবার মায়ের দরজাও আগলে দাঁড়িয়েছ?

সুমিত্রা।

না বাছা, এস তোমরা। এখানে তোমাদের কোনো ভয় নেই। কে তোমাদের উপর দৌরাত্ম্য করেছে।

পুরুষ।

এই জয়সেন। আমরা রাজার কাছে দুঃখু জানাতে গিয়েছিলেম, রাজদর্শন পেলেম না। ফিরে এসে দেখি আমাদের ঘরদোর জ্বালিয়ে দিয়েছে, আমাদের ছেলেটিকে বেঁধে রেখেছে।

সুমিত্রা।

(স্ত্রীলোকের প্রতি) হাঁ গা, তা তুমি রানীকে গিয়ে জানালে না কেন।

স্ত্রী।

ওগো, রানীই তো রাজাকে জাদু করে রেখেছে। আমাদের রাজা ভালো, রাজার দোষ নেই– ওই বিদেশ থেকে এক রানী এসেছে, সে আপন কুটুম্বদের রাজ্য জুড়ে বসিয়েছে। প্রজার বুকের রক্ত শুষে খাচ্ছে গো।

পুরুষ।

চুপ কর্‌ মাগী। তুই রানীর কী জানিস? যে-কথা জানিস নে, তা মুখে আনিস নে।

স্ত্রী।

জানি গো জানি। ওই রানীই তো বসে বসে রাজার কাছে আমাদের নামে যত কথা লাগায়।

সুমিত্রা।

ঠিক বলেছ বাছা। ওই রানী সর্বনাশীই তো যত নষ্টের মূল। তা সে আর বেশি দিন থাকবে না, তার পাপের ভরা পূর্ণ হয়েছে। এই নাও, আমার সাধ্যমত কিছু দিলাম, সব দুঃখ দূর করতে পারি নে।

পুরুষ।

আহা তুমি কোনো রাজার ছেলে হবে– তোমার জয় হোক।

সুমিত্রা।

আর বিলম্ব নয়, এখনি যাব।

[ প্রস্থান

ত্রিবেদীর প্রবেশ

ত্রিবেদী।

হে হরি কী দেখলুম। পুরুষমূর্তি ধরে রানী সুমিত্রা ঘোড়ায় চড়ে চলেছেন। মন্দিরে দেবপূজোর ছলে এসে রাজ্য ছেড়ে পালিয়েছেন। আমাকে দেখে বড়ো খুশি। মধুসূদন। ভাবলে ব্রাহ্মণ বড়ো সরল-হৃদয়, মাথার তেলোয় যেমন একগাছি চুল দেখা যায় না, তলায় তেমনি বুদ্ধির লেশমাত্র নেই। একে দিয়ে একটা কাজ করিয়ে নেওয়া যাক। এর মুখ দিয়ে রাজাকে দুটো মিষ্টি কথা পাঠিয়ে দেওয়া যাক। বাবা তোমরা বেঁচে থাকো। যখনি তোমাদের কিছু দরকার পড়বে বুড়ো ত্রিবেদীকে ডেকো, আর দান-দক্ষিণের বেলায় দেবদত্ত আছেন। দয়াময়। তা বলব। খুব মিষ্টি মিষ্টি করেই বলব। আমার মুখে মিষ্টি কথা আরো বেশি মিষ্টি হয়ে ওঠে। কমললোচন। রাজা কী খুশিই হবে। কথাগুলো যত বড়ো বড়ো করে বলব রাজার মুখের হাঁ তত বেড়ে যাবে। দেখেছি, আমার মুখে বড়ো কথাগুলো শোনায় ভালো। লোকের বিশেষ আমোদ বোধ হয়। বলে, ব্রাক্ষণ বড়ো সরল। পতিতপাবন। এবারে কতটা আমোদ হবে বলতে পারি নে। কিন্তু শব্দশান্ত্র একেবারে উলটপালট করে দেব। আঃ কী দুর্যোগ। আজ সমস্ত দিন দেবপুজো হয় নি, এইবার একটু পুজো-অর্চনায় মন দেওয়া যাক। দীনবন্ধু ভক্তবৎসল।

চতুর্থ দৃশ্য

প্রাসাদ

বিক্রমদেব, মন্ত্রী ও দেবদত্ত

বিক্রমদেব।            পলায়ন! রাজ্য ছেড়ে পলায়ন! এ রাজ্যেতে
যত সৈন্য, যত দুর্গ, যত কারাগার,
যত লোহার শৃঙ্খল আছে, সব দিয়ে
পারে না কি বাঁধিয়া রাখিতে দৃঢ়বলে
ক্ষুদ্র এক নারীর হৃদয়। এই রাজা
এই কি মহিমা তার। বৃহৎ প্রতাপ,
লোকবল অর্থবল নিয়ে, পড়ে থাকে
শূন্য স্বর্ণ পিঞ্জরের মতো, ক্ষুদ্র পাখি
উড়ে চলে যায়।
মন্ত্রী।                                     হায় হায়, মহারাজ,
লোকনিন্দা, ভগ্নবাঁধ জলস্রোত সম,
ছুটে চারিদিক হতে।
বিক্রমদেব।                                    চুপ করো মন্ত্রী।
লোকনিন্দা, লোকনিন্দা সদা! নিন্দাভারে
রসনা খসিয়া যাক অলস লোকের।
দিবা যদি গেল, উঠুক না চুপি চুপি
ক্ষুদ্র পঙ্ককুণ্ড হতে দুষ্ট বাষ্পরাশি,
অমার আঁধার তাহে বাড়িবে না কিছু।
লোকনিন্দা!
দেবদত্ত।                               মন্ত্রী, পরিপূর্ণ সূর্যপানে
কে পারে তাকাতে। তাই গ্রহণের বেলা
ছুটে আসে যত মর্তলোক, দীননেত্রে
চেয়ে দেখে দুর্দিনের দিনপতি পানে,
আপনার কালিমাখা কাচখণ্ড দিয়ে
কালো দেখে গগনের আলো। মহারানী
মা জননী, এই ছিল অদৃষ্টে তোমার?
তব নাম ধুলায় লুটায়? তব নাম
ফিরে মুখে মুখে? এ কী এ দুর্দিন আজি।
তবু তুমি তেজস্বিনী সতী, এরা সব
পথের কাঙাল।
বিক্রমদেব।                              ত্রিবেদী কোথায় গেল?
মন্ত্রী, ডেকে আনো তারে। শোনা হয় নাই
তার সব কথা, ছিনু অন্যমনে।
মন্ত্রী।                                       যাই
ডেকে আনি তারে।

[ প্রস্থান

বিক্রমদেব।                                    এখনো সময় আছে,
এখনো ফিরাতে পারি পাইলে সন্ধান।
আবার সন্ধান? এমনি কি চিরদিন
কাটিবে জীবন। সে দিবে না ধরা, আমি
ফিরিব পশ্চাতে? প্রেমের শৃঙ্খল হাতে
রাজ্য রাজকর্ম ফেলে শুধু রমণীর
পলাতক হৃদয়ের সন্ধানে ফিরিব?
পলাও, পলাও নারী, চির দিনরাত
করো পলায়ন; গৃহহীন প্রেমহীন
বিশ্রামবিহীন অনাবৃত প্রিথ্বীমাঝে
কেবল পশ্চাতে লয়ে আপনার ছায়া।

ত্রিবেদীর প্রবেশ

চলে যাও, দূর হও, কে ডাকে তোমারে?
বার বার তার কথা কে চাহে শুনিতে
প্রগল্‌ভ ব্রাহ্মণ, মূর্খ।

ত্রিবেদী।                                          হে মধুসূদন।
বিক্রমদেব।            শোনো, শোনো, দুটো কথা শুধাবার আছে।
চোখে অশ্রু ছিল?
ত্রিবেদী।                                     চিন্তা নেই বাপু। অশ্রু
দেখি নাই।
বিক্রমদেব।                         মিথ্যা করে বলো। অতি ক্ষুদ্র
সকরুণ দুটি মিথ্যে কথা। হে ব্রাহ্মণ,
বৃদ্ধ তুমি ক্ষীণদৃষ্টি কী করে জানিলে
চোখে তার অশ্রু ছিল কি না? বেশি নয়,
এক বিন্দু জল! নহে তো নয়ন-প্রান্তে
ছল ছল ভাব, কম্পিত কাতর কণ্ঠে
অশ্রুবদ্ধ বাণী? তাও নয়? সত্য বলো,
মিথ্যা বলো। ব’লো না, ব’লো না, চলে যাও।
ত্রিবেদী।               হরি হে তুমিই সত্য।

[ প্রস্থান

বিক্রমদেব।                                    অন্তর্যামী দেব,
তুমি জান, জীবনের সব অপরাধ
তারে ভালোবাসা; পুণ্য গেল, স্বর্গ গেল,
রাজ্য যায়, অবশেষে সেও চলে গেল।
তবে দাও, ফিরে দাও ক্ষাত্রধর্ম মোর;
রাজধর্ম ফিরে দাও, পুরুষ-হৃদয়
মুক্ত করে দাও এই বিশ্বরঙ্গমাঝে।
কোথা কর্মক্ষেত্র। কোথা জনস্রোত। কোথা
জীবন-মরণ। কোথা সেই মানবের
অবিশ্রাম সুখদুঃখ, বিপদ-সম্পদ,
তরঙ্গ-উচ্ছ্বাস।
মন্ত্রী।                                      মহারাজ, অশ্বারোহী
পাঠায়েছি চারিদিকে রাজ্ঞীর সন্ধানে।
বিক্রমদেব।            ফিরাও ফিরাও মন্ত্রী। স্বপ্ন ছুটে গেছে,
অশ্বারোহী কোথা তারে পাইবে খুঁজিয়া।
সৈন্যদল করহ প্রস্তুত, যুদ্ধে যাব,
নাশিব বিদ্রোহ।
মন্ত্রী।                                    যে আদেশ মহারাজ।  
[ প্রস্থান
বিক্রমদেব।            দেবদত্ত, কেন নত মুখ, ম্লান দৃষ্টি?
ক্ষুদ্র সান্ত্বনার কথা ব’লো না ব্রাহ্মণ।
আমারে পশ্চাতে ফেলে চলে গেছে চোর,
আপনারে পেয়েছি কুড়ায়ে। আজি সখা,
আনন্দের দিন। এস আলিঙ্গনপাশে।
(আলিঙ্গন করিয়া)
বন্ধু, বন্ধু, মিথ্যা কথা, মিথ্যা এই ভান।
থেকে থেকে বজ্রশেল ছুটিছে বিঁধিছে
মর্মে। এস এস, একবার অশ্রুজল
ফেলি বন্ধুর হৃদয়ে। মেঘ যাক কেটে।
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *