রাজা ও রানী – ১ম অঙ্ক

প্রথম অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

জালন্ধর

প্রাসাদের এক কক্ষ

বিক্রমদেব ও দেবদত্ত

দেবদত্ত।              মহারাজ, এ কী উপদ্রব!
বিক্রমদেব।                                        হয়েছে কী!
দেবদত্ত।              আমাকে বরিবে নাকি পুরোহিত-পদে?
কী দোষ করেছি প্রভো? কবে শুনিয়াছ
ত্রিষ্টুভ অনুষ্টুভ এই পাপমুখে?
তোমার সংসর্গে পড়ে ভুলে বসে আছি
যত যাগযজ্ঞবিধি। আমি পুরোহিত?
শ্রুতিস্মৃতি ঢালিয়াছি বিস্মৃতির জলে।
এক বই পিতা নয় তাঁরি নাম ভুলি,
দেবতা তেত্রিশ কোটি গড় করি সবে।
স্কন্ধে ঝুলে পড়ে আছে শুধু পৈতেখানা
তেজোহীন ব্রহ্মণ্যের নির্বিষ খোলশ।
বিক্রমদেব।           তাই তো নির্ভয়ে আমি দিয়েছি তোমারে
পৌরোহিত্য-ভার। শাস্ত্র নাই, মন্ত্র নাই,
নাই কোনো ব্রহ্মণ্য-বালাই।
দেবদত্ত।                                              তুমি চাও
নখদন্তভাঙা এক পোষা পুরোহিত।
বিক্রমদেব।           পুরোহিত, একেকটা ব্রহ্মদৈত্য যেন।
একে তো আহার করে রাজস্কন্ধে চেপে
সুখে বারো মাস, তার পরে দিনরাত
অনুষ্ঠান, উপদ্রব, নিষেধ, বিধান,
অনুযোগ– অনুস্বর-বিসর্গের ঘটা–
দক্ষিণায় পূর্ণ হস্তে শূন্য আশীর্বাদ।
দেবদত্ত।              শাস্ত্রহীন ব্রাহ্মণের প্রয়োজন যদি,
আছেন ত্রিবেদী; অতিশয় সাধুলোক;
সর্বদাই রয়েছেন জপমালা হাতে
ক্রিয়াকর্ম নিয়ে; শুধু মন্ত্র-উচ্চারণে
লেশমাত্র নাই তাঁর ক্রিয়াকর্মজ্ঞান।
বিক্রমদেব।           অতি ভয়ানক। সখা, শাস্ত্র নাই যার
শাস্ত্রের উপদ্রব তার চতুর্গুণ।
নাই যার বেদবিদ্যা, ব্যাকরণ-বিধি,
নাই তার বাধাবিঘ্ন,– শুধু বুলি ছোটে
পশ্চাতে ফেলিয়া রেখে তদ্ধিত প্রত্যয়
অমর পাণিনি। একসঙ্গে নাহি সয়
রাজা আর ব্যাকরণ দোঁহারে পীড়ন।
দেবদত্ত।              আমি পুরোহিত? মহারাজ, এ সংবাদে
ঘন আন্দোলিত হবে কেশলেশহীন
যতেক চিক্কণ মাথা; অমঙ্গল স্মরি
রাজ্যের টিকি যত হবে কণ্টকিত।
বিক্রমদেব।           কেন অমঙ্গলশঙ্কা?
দেবদত্ত।                                    কর্মকাণ্ডহীন
এ দীন বিপ্রের দোষে কুলদেবতার
রোষ-হুতাশন–
বিক্রমদেব।                             রেখে দাও বিভীষিকা।
কুলদেবতার রোষ নতশির পাতি
সহিতে প্রস্তুত আছি;– সহে না কেবল
কুলপুরোহিত-আস্ফালন। জান সখা,
দীপ্ত সূর্য সহ্য হয় তপ্ত বালি চেয়ে।
দূর করো মিছে তর্ক যত। এস করি
কাব্য-আলোচনা। কাল বলেছিলে তুমি
পুরাতন কবি-বাক্য– “নাহিকো বিশ্বাস
রমণীরে”– আর বারবলো শুনি।
দেবদত্ত।                                                    “শাস্ত্রং– “
বিক্রমদেব।           রক্ষা করো– ছেড়ে দাও অনুস্বরগুলো।
দেবদত্ত।              অনুস্বর ধনুঃশর নহে, মহারাজ,
কেবল টংকারমাত্র। হে বীরপুরুষ,
ভয় নাই। ভালো, আমি ভাষায় বলিব।
“যত চিন্তা কর শাস্ত্র, চিন্তা আরো বাড়ে,
যত পূজা কর ভূপে, ভয় নাহি ছাড়ে।
কোলে থাকিলেও নারী রেখো সাবধানে,
শাস্ত্র, নৃপ, নারী কভু বশ নাহি মানে।”
বিক্রমদেব।           বশ নাহি মানে! ধিক স্পর্ধা কবি তব!
চাহে কে করিতে বশ? বিদ্রোহী সে জন।
বশ করিবার নহে নৃপতি, রমণী!
দেবদত্ত।              তা বটে। পুরুষ রবে রমণীর বশে।
বিক্রমদেব।           রমণীর হৃদয়ের রহস্য কে জানে?
বিধির বিধান সব অজ্ঞেয়– তা বলে
অবিশ্বাস জন্মে যদি বিধির বিধানে,
রমণীর প্রেমে– আশ্রয় কোথায় পাবে?
নদী ধায়, বায়ু বহে কেমনে কে জানে।
সেই নদী দেশের কল্যাণ-প্রবাহিণী,
সেই বায়ু জীবের জীবন।
দেবদত্ত।                                          বন্যা আনে
সেই নদী; সেই বায়ু ঝঞ্ঝা নিয়ে আসে।
বিক্রমদেব।           প্রাণ দেয়, মৃত্যু দেয়, লই শিরে তুলি;
তাই বলে কোন্‌ মূর্খ চাহে তাহাদের
বশ করিবারে। বদ্ধ নদী, বদ্ধ বায়ু
রোগ-শোক-মৃত্যুর নিদান। হে ব্রাহ্মণ,
নারীর কী জান তুমি?
দেবদত্ত।                                       কিছু না রাজন্‌।
ছিলাম উজ্জ্বল করে পিতৃমাতৃকুল
ভদ্র  ব্রাহ্মণের ছেলে। তিন সন্ধ্যা ছিল
আহ্নিক তর্পণ;– শেষে তোমারি সংসর্গে
বিসর্জন করিয়াছি সকল দেবতা,
কেবল অনঙ্গদেব রয়েছেন বাকি।
ভুলেছি মহিম্নস্তব– শিখেছি গাহিতে
নারীর মহিমা; সে বিদ্যাও পুঁথিগত,
তার পরে মাঝে মাঝে চক্ষু রাঙাইলে
সে বিদ্যাও ছুটে যায় স্বপ্নের মতন।
বিক্রমদেব।           না না ভয় নাই সখা, মৌন রহিলাম;
তোমার নূতন বিদ্যা বলে যাও তুমি।
দেবদত্ত।              শুন তবে– বলিছেন কবি ভর্তৃ হরি,–
“নারীর বচনে মধু, হৃদয়েতে হলাহল,
অধরে পিয়ায় সুধা, চিত্তে জ্বালে দাবানল।”
বিক্রমদেব।           সেই পুরাতন কথা!
দেবদত্ত।                                     সত্য পুরাতন।
কী করিব মহারাজ, যত পুঁথি খুলি
ওই এক কথা। যত প্রাচীন পণ্ডিত
প্রেয়সীরে ঘরে নিয়ে এক দণ্ড কভু
ছিল না সুস্থির। আমি শুধু ভাবি, যার
ঘরের ব্রাহ্মণী ফিরে পরের সন্ধানে
সে কেমনে কাব্য লেখে ছন্দ গেঁথে গেঁথে
পরম নিশ্চিন্ত মনে?
বিক্রমদেব।                                   মিথ্যা অবিশ্বাস!
ও কেবল ইচ্ছাকৃত আত্মপ্রবঞ্চনা।
ক্ষুদ্র হৃদয়ের প্রেম নিতান্ত বিশ্বাসে
হয়ে আসে মৃত জড়বৎ– তাই তারে
জাগায়ে তুলিতে হয় মিথ্যা অবিশ্বাসে।
হেরো ওই আসিছেন মন্ত্রী, স্তূপাকার
রাজ্যভার স্কন্ধে নিয়ে। পলায়ন করি।
দেবদত্ত।              রানীর রাজত্বে তুমি লও গে আশ্রয়!
ধাও অন্তঃপুরে। অসম্পুর্ণ রাজকার্য
দুয়ার-বাহিরে পড়ে থাক্‌; স্ফীত হোক
যত যায় দিন। তোমার দুয়ার ছাড়ি
ক্রমে উঠিবে সে ঊর্ধ্বদিকে– দেবতার
বিচার-আসন পানে।
বিক্রমদেব।                                  এ কি উপদেশ?
দেবদত্ত।              না রাজন্‌! প্রলাপ-বচন! যাও তুমি,
কাল নষ্ট হয়!
[ বিক্রমদেবের প্রস্থান
মন্ত্রীর প্রবেশ
মন্ত্রী।                                   ছিলেন না মহারাজ?
দেবদত্ত।              করেছেন অন্তর্ধান অন্তঃপুর পানে।
মন্ত্রী।                  (বসিয়া পড়িয়া)
হা বিধাতঃ, এ রাজ্যের কী দশা করিলে?
কোথা রাজা, কোথা দণ্ড, কোথা সিংহাসন!
শ্মশানভূমির মতো বিষণ্ন বিশাল
রাজ্যের বক্ষের ‘পরে সগর্বে দাঁড়ায়ে
বধির পাষাণ রুদ্ধ অন্ধ অন্তঃপুর।
রাজশ্রী দুয়ারে বসি অনাথার বেশে
কাঁদে হাহাকার রবে।
দেবদত্ত।                                       দেখে হাসি আসে।
রাজা করে পলায়ন– রাজ্য ধায় পিছে;
হল ভালো মন্ত্রিবর, অহর্নিশি যেন
রাজ্য ও রাজায় মিলে লুকোচুরি খেলা।
মন্ত্রী।                  এ কি হাসিবার কথা ব্রাহ্মণ ঠাকুর?
দেবদত্ত।              না হাসিয়া করিব কী। অরণ্যে ক্রন্দন
সে তো বালকের কাজ। দিবস-রজনী
বিলাপ না হয় সহ্য তাই মাঝে মাঝে
রোদনের পরিবর্তে শুষ্ক শ্বেত হাসি
জমাট অশ্রুর মতো তুষার-কঠিন।
কী ঘটেছে বলো শুনি।
মন্ত্রী।                                            জান তো সকলি।
রানীর কুটুম্ব যত বিদেশী কাশ্মীরী
দেশ জুড়ে বসিয়াছে। রাজার প্রতাপ
ভাগ করে লইয়াছে খণ্ড খণ্ড করি,
বিষ্ঞুচক্রে ছিন্ন মৃত সতীদেহ সম।
বিদেশীর অত্যাচারে জর্জর কাতর
কাঁদে প্রজা। অরাজক রাজসভামাঝে
মিলায় ক্রন্দন। বিদেশী অমাত্য যত
বসে বসে হাসে। শূন্য সিংহাসন-পার্শ্বে
বিদীর্ণ হৃদয় মন্ত্রী বসি নতশিরে।
দেবদত্ত।              বহে ঝড়, ডোবে তরী, কাঁদে যাত্রী যত,
রিক্তহস্ত কর্ণধার উচ্চে একা বসি
বলে “কর্ণ কোথা গেল।’ মিছে খুঁজে মর,
রমণী নিয়েছে টেনে রাজকর্ণখানা,
বাহিছে প্রেমের তরী লীলা-সরোবরে
বসন্ত-পবনে। রাজ্যের বোঝাই নিয়ে
মন্ত্রীটা মরুক ডুবে অকূল পাথারে।
মন্ত্রী।                  হেসো না ঠাকুর। ছি ছি, শোকের সময়ে
হাসি অকল্যাণ।
দেবদত্ত।                                 আমি বলি মন্ত্রিবর,
রাজারে ডিঙায়ে, একেবারে পড়ো গিয়ে
রানীর চরণে।
মন্ত্রী।                                  আমি পারিব না তাহা।
আপন আত্মীয়-জনে করিবে বিচার
রমণী, এমন কথা শুনি নাই কভু।
দেবদত্ত।              শুধু শাস্ত্র জান মন্ত্রী, চেন না মানুষ।
বরঞ্চ আপন জনে আপনার হাতে
দণ্ড দিতে পারে নারী; পারে না সহিতে
পরের বিচার।
মন্ত্রী।                                  ওই শোনো কোলাহল।
দেবদত্ত।              এ কি প্রজার বিদ্রোহ?
মন্ত্রী।                                          চলো দেখে আসি।

দ্বিতীয় দৃশ্য

রাজপথ

লোকারণ্য

কিনু নাপিত।   ওরে ভাই কান্নার দিন নয়। অনেক কেঁদেছি তাতে কিছু হল কি?
মন্‌সুখ চাষা।   ঠিক বলেছিল রে, সাহসে সব কাজ হয়,– ওই যে কথায় বলে “আছে যার বুকের পাটা, যমরাজকে সে দেখায় ঝাঁটা।”
কুঞ্জরলাল কামার।   ভিক্ষে করে কিছু হবে না, আমরা লুট করব।
কিনু নাপিত।   ভিক্ষেং নৈম নৈমচং। কী বল খুড়ো, তুমি তো স্মার্ত ব্রাহ্মণের ছেলে, লুটপাটে দোষ আছে কি?
নন্দলাল।   কিছু না, খিদের কাছে পাপ নেই রে বাবা। জানিস তো অগ্নিকে বলে পাবক, অগ্নিতে সকল পাপ নষ্ট করে। জঠরাগ্নির বাড়া তো আর অগ্নি নেই।
অনেকে।   আগুন। তা ঠিক বলেছ। বেঁচে থাকো ঠাকুর। তবে তাই হবে। তা আমরা আগুনই লাগিয়ে দেব। ওরে আগুনে পাপ নেই রে। এবার ওঁদের বড়ো বড়ো ভিটেতে ঘুঘু চরাব।
কুঞ্জর।   আমার তিনটে সড়কি আছে।
মন্‌সুখ।   আমার একগাছা লাঙ্গল আছে, এবার তাজপরা মাথাগুলো মাটির ঢেলার মতো চষে ফেলব।
শ্রীহর কলু।   আমার একগাছ বড়ো কুড়ুল আছে, কিন্তু পালাবার সময় সেটা বাড়িতে ফেলে এসেছি।
হরিদীন কুমোর।   ওরে তোরা মরতে বসেছিস না কি? বলিস কী রে। আগে রাজাকে জানা, তার পরে যদি না শোনে, তখন অন্য পরামর্শ হবে।
কিনু নাপিত।   আমিও তো সেই কথা বলি।
কুঞ্জর।   আমিও তো তাই ঠাওরাচ্ছি।
শ্রীহর।   আমি বরাবর বলে আসছি, ঐ কায়স্থর পোকে বলতে দাও। আচ্ছা, দাদা, তুমি রাজাকে ভয় করবে না?
মন্নুরাম কায়স্থ।   ভয় আমি কাউকে করি নে। তোরা লুঠ করতে যাচ্ছিস, আর আমি দুটো কথা বলতে পারি নে?
মন্‌সুখ।   দাঙ্গা করা এক, আর কথা বলা এক। এই তো বরাবর দেখে আসছি, হাত চলে, কিন্তু মুখ চলে না।
কিনু।   মুখের কোনো কাজটাই হয় না– অন্নও জোটে না, কথাও ফোটে না।
কুঞ্জর।   আচ্ছা, তুমি কী বলবে বলো।
মন্নুরাম।   আমি ভয় করে বলব না; আমি প্রথমেই শাস্ত্র বলব।
শ্রীহর।   বল কী? তোমার শাস্তর জানা আছে? আমি তো তাই গোড়াগুড়িই বলছিলুম কায়স্থর পোকে বলতে দাও– ও জানে শোনে।
মন্নুরাম।   আমি প্রথমেই বলব–

অতিদর্পে হতা লঙ্কা, অতিমানে চ কৌরবাঃ
অতিদানে বলির্বদ্ধঃ সর্বমত্যন্তগর্হিতম্‌।

হরিদীন।   হাঁ, এ শাস্ত্র বটে।
কিনু।   ( ব্রাহ্মণের প্রতি ) কেমন খুড়ো, তুমি তো ব্রাহ্মণের ছেলে, এ শাস্ত্র কি না? তুমি তো এ সমস্তই বোঝ।
নন্দ।   হাঁ– তা– ইয়ে– ওর নাম কী– তা বুঝি বই কি। কিন্তু রাজা যদি না বোঝে, তুমি কী করে বুঝিয়ে দেবে, বলো তো শুনি।
মন্নুরাম।
জওহর তাঁতি।
   অর্থাৎ বাড়াবাড়িটে কিছু নয়।

   ওই অতবড়ো কথাটার এইটুকু মানে হল?

শ্রীহর।   তা না হলে আর শাস্তর কিসের।
নন্দ।   চাষাভুষোর মুখে যে-কথাটা ছোট্ট, বড়োলোকের মুখে সেইটেই কত বড়ো শোনায়।
মন্‌সুখ।   কিন্তু কথাটা ভালো, “বাড়াবাড়ি কিছু নয়” শুনে রাজার চোখ ফুটবে।
জওহর।   কিন্তু ওই একটাতে হবে না, আরও শাস্তর চাই।
মন্নুরাম।   তা আমার পুঁজি আছে, আমি বলব–

“লালনে বহবো দোষাস্তাড়নে বহবো গুণাঃ
তস্মাৎ মিত্রঞ্চ পুত্রঞ্চ তাড়য়েৎ ন তু লালয়েৎ।”
তা আমরা কি পুত্র নই? হে মহারাজ, আমাদের তাড়না করবে না– ওইটে ভালো নয়।

হরিদীন।এ ভালো কথা, মস্ত কথা, ওই যে কী বললে, ও কথাগুলো শোনাচ্ছে ভালো।
শ্রীহর।কিন্তু কেবল শাস্তর বললে তো চলবে না– আমার ঘানির কথাটা কখন আসবে? অমনি ওই সঙ্গে জুড়ে দিলে হয় না?
নন্দ।বেটা তুমি ঘানির সঙ্গে শাস্তর জুড়বে? এ কি তোমার গোরু পেয়েছ?
জওহর।কলুর ছেলে, ওর আর কত বুদ্ধি হবে?
কুঞ্জর।দু ঘা না পিঠে পড়লে ওর শিক্ষা হবে না। কিন্তু আমার কথাটা কখন পাড়বে? মনে থাকবে তো? আমার নাম কুঞ্জরলাল। কাঞ্জিলাল নয়– সে আমার ভাইপো, সে বুধকোটে থাকে– সে যখন সবে তিন বছর তখন তাকে–
হরিদীন।সব বুঝলুম, কিন্তু যে-রকম কাল পড়েছে, রাজা যদি শাস্তর না শোনে।
কুঞ্জর।তখন আমরাও শাস্তর ছেড়ে অস্তর ধরব।
কিনু।শাবাশ বলেছ, শাস্তর ছেড়ে অস্তর।
মন্‌সুখ।কে বললে হে? কথাটা কে বললে?
কুঞ্জর।(সগর্বে) আমি বলেছি। আমার নাম কুঞ্জরলাল, কাঞ্জিলাল আমার ভাইপো।
কিনু।তা ঠিক বলেছ ভাই– শাস্তর আর অস্তর– কখনো শাস্তর কখনো অস্তর– আবার কখনো অস্তর কখনো শাস্তর।
জওহর।কিন্তু বড়ো গোলমাল হচ্ছে। কথাটা কী যে স্থির হল বুঝতে পারছি নে। শাস্তর না অস্তর?
শ্রীহর।বেটা তাঁতি কি না, এইটে আর বুঝতে পারলি নে? তবে এতক্ষণ ধরে কথাটা হল কী? স্থির হল যে শাস্তরের মহিমা বুঝতে ঢের দেরি হয়, কিন্তু অন্তরের মহিমা খুব চটপট বোঝা যায়।
অনেকে।(উচ্চস্বরে) তবে শাস্তর চুলোয় যাক– অস্তর ধরো।

দেবদত্তের প্রবেশ

দেবদত্ত।বেশি ব্যস্ত হবার দরকার করে না; চুলোতেই যাবে শিগগির, তার আয়োজন হচ্ছে। বেটা তোরা কী বলছিলি রে?
শ্রীহর।আমরা ওই ভদ্রলোকের ছেলেটির কাছে শাস্তর শুনছিলুম ঠাকুর।
দেবদত্ত।এমনি মন দিয়েই শাস্তর শোনে বটে। চীৎকারের চোটে রাজ্যের কানে তালা ধরিয়ে দিলে। যেন ধোবাপাড়ায় আগুন লেগেছে।
কিনু।তোমার কী ঠাকুর। তুমি তো রাজবাড়ির সিধে খেয়ে খেয়ে ফুলছ– আমাদের পেটে নাড়ীগুলো জ্বলে জ্বলে ম’ল– আমরা কি বড়ো সুখে চেঁচাচ্ছি।
মন্‌সুখ।আজকালের দিনে আস্তে বললে শোনে কে? এখন চেঁচিয়ে কথা কইতে হয়।
কুঞ্জর।কান্নাকাটি ঢের হয়েছে, এখন দেখছি অন্য উপায় আছে কি না।
দেবদত্ত।কী বলিস রে। তোদের বড়ো আস্পর্ধা হয়েছে। তবে শুনবি? তবে বলব?

“ন সমানসমানসমানসমাগমমাপ সমীক্ষ্য বসন্তনভঃ
ভ্রমদভ্রমদভ্রমদভ্রমদভ্রমরচ্ছলতঃ খলু কামিজনঃ॥”

হরিদীন।ও বাবা, শাপ দিচ্ছে নাকি?
দেবদত্ত।(মন্নুর প্রতি) তুমি তো ভদ্রলোকের ছেলে, তুমি তো শাস্তর বোঝ কেমন, এ ঠিক কথা কি না? “নস মানস মানস মানসং।”
মন্নুরাম।আহা ঠিক। শাস্ত্র যদি চাও তো এই বটে। তা আমিও তো ঠিক ওই কথাটাই বোঝাচ্ছিলুম।
দেবদত্ত।(নন্দের প্রতি) নমস্কার। তুমি তো ব্রাহ্মণ দেখছি। কী বল ঠাকুর, পরিণামে এই সব মূর্খরা “ভ্রমদভ্রমদভ্রমদং” হয়ে মরবে না?
নন্দ।বরাবর তাই বলছি, কিন্তু বোঝে কে? ছোটোলোক কিনা।
দেবদত্ত।(মন্‌সুখের প্রতি) তোমাকে এর মধ্যে বুদ্ধিমানের মতো দেখাচ্ছে, আচ্ছা তুমি বলো দেখি, কথাগুলো কি ভালো হচ্ছিল? (কুঞ্জরের প্রতি) আর তোমাকেও তো বেশ ভালোমানুষ দেখছি হে, তোমার নাম কী?
কুঞ্জর।আমার নাম কুঞ্জরলাল– কাঞ্জিলাল আমার ভাইপোর নাম।
দেবদত্ত।ওঃ– তোমারই ভাইপোর নাম কাঞ্জিলাল বটে? তা আমি রাজার কাছে বিশেষ করে তোমাদের নাম করব।
হরিদীন।আর আমাদের কী হবে?
দেবদত্ত।তা আমি বলতে পারি নে বাপু। এখন তো তোরা কান্না ধরেছিস– এই একটু আগে আর-এক সুর বের করেছিলি। সে কথাগুলো কি রাজা শোনে নি? রাজা সব শুনতে পায়?
অনেকে।দোহাই ঠাকুর, আমরা কিছু বলি নি, ওই কাঞ্জুলাল না মাঞ্জুলাল অন্তরের কথা পেড়েছিল।
কুঞ্জর।চুপ কর্‌। আমার নাম খারাপ করিস নে। আমার নাম কুঞ্জরলাল, তা মিছে কথা বলব না– আমি বলছিলুম, “যেমন শাস্তর আছে, তেমনি অস্তরও আছে,– রাজা যদি শাস্তরের দোহাই না মানে, তখন অস্তর আছে।”– কেমন বলেছি ঠাকুর?
দেবদত্ত।ঠিক বলেছ– তোমার উপযুক্ত কথাই বলেছ। অস্ত্র কী? না বল। তা তোমাদের বল কী? না, “দুর্বলস্য বলং রাজা।”– কি না, রাজাই দুর্বলের বল। আবার “বালানাং রোদনং বলং”– রাজার কাছে তোমরা বালক বই নও। অতএব এখানে কান্নাই তোমাদের অস্ত্র। অতএব শাস্তর যদি না খাটে তো তোমাদের অস্ত্র আছে কান্না। বড়ো বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছ– প্রথমে আমাকেই ধাঁধা লেগে গিয়েছিল। তোমার নামটা মনে রাখতে হবে। কী হে তোমার নাম কী।
কুঞ্জর।আমার নাম কুঞ্জরলাল। কাঞ্জিলাল আমার ভাইপো।

অন্য সকলে। ঠাকুর, আমাদের মাপ করো, ঠাকুর মাপ করো–

দেবদত্ত।আমি মাপ করবার কে? তবে দেখো কান্নাকাটি করে দেখো, রাজা যদি মাপ করে।

তৃতীয় দৃশ্য

অন্তঃপুর

প্রমোদ-কানন

বিক্রমদেব ও সুমিত্রা

বিক্রমদেব।           মৌনমুগ্ধ সন্ধ্যা ওই মন্দ মন্দ আসে
কুঞ্জবনমাঝে, প্রিয়তমে, লজ্জানম্র
নববধূসম, সম্মুখে গম্ভীর নিশা
বিস্তার করিয়া অন্তহীন অন্ধকার
এ কনক-কান্তিটুকু চাহে গ্রাসিবারে।
তেমনি দাঁড়ায়ে আছি হৃদয় প্রসারি
ওই হাসি, ওই রূপ, ওই তব জ্যোতি
পান করিবারে; দিবালোক-তট হতে
এস, নেমে এস, কনক-চরণ দিয়ে
এ অগাধ হৃদয়ের নিশীথ-সাগরে।
কোথা ছিলে প্রিয়ে?
সুমিত্রা।                                      নিতান্ত তোমারি আমি
সদা মনে রেখো এ বিশ্বাস। থাকি যবে
গৃহকাজে– জেনো নাথ, তোমারি সে গৃহ,
তোমারি সে কাজ।
বিক্রমদেব।                                থাক্‌ গৃহ, গৃহকাজ।
সংসারের কেহ নহ, অন্তরের তুমি;
অন্তরে তোমার গৃহ– আর গৃহ নাই–
বাহিরে কাঁদুক্‌ পড়ে বাহিরের কাজ।
সুমিত্রা।               কেবল অন্তরে তব? নহে, নাথ, নহে;
রাজন্‌, তোমারি আমি অন্তরে বাহিরে।
অন্তরে প্রেয়সী তব বাহিরে মহিষী।
বিক্রমদেব।           হায়, প্রিয়ে, আজ কেন স্বপ্ন মনে হয়
সে সুখের দিন? সেই প্রথম মিলন–
প্রথম প্রেমের ছটা; দেখিতে দেখিতে
সমস্ত হৃদয়ে দেহে যৌবন-বিকাশ,
সেই নিশি-সমাগমে দুরুদুরু হিয়া;–
নয়ন-পল্লবে লজ্জা, ফুলদলপ্রান্তে
শিশির-বিন্দুর মতো; অধরের হাসি
নিমেষে জাগিয়া ওঠে নিমেষে মিলায়,
সন্ধ্যার বাতাস লেগে কাতর-কম্পিত
দীপশিখাসম; নয়নে নয়নে হয়ে
ফিরে আসে আঁখি; বেধে যায় হৃদয়ের
কথা; হাসে চাঁদ কৌতুকে আকাশে; চাহে
নিশীথের তারা, লুকায়ে জানালা পাশে;
সেই নিশি-অবসানে আঁখি ছলছল,
সেই বিরহের ভয়ে বদ্ধ আলিঙ্গন;
তিলেক বিচ্ছেদ লাগি কাতর হৃদয়।
কোথা ছিল গৃহকাজ। কোথা ছিল, প্রিয়ে,
সংসার-ভাবনা।
সুমিত্রা।                                 তখন ছিলাম শুধু
ছোট দুটি বালক বালিকা; আজি মোরা
রাজা রানী।
বিক্রমদেব।                         রাজা রানী। কে রাজা? কে রানী?
নহি আমি রাজা। শূন্য সিংহাসন কাঁদে।
জীর্ণ রাজকার্যরাশি চূর্ণ হয়ে যায়
তোমার চরণতলে ধূলির মাঝারে।
সুমিত্রা।               শুনিয়া লজ্জায় মরি। ছি ছি মহারাজ,
এ কি ভালোবাসা? এ যে মেঘের মতন
রেখেছে আচ্ছন্ন করে মধ্যাহ্ন-আকাশে
উজ্জ্বল প্রতাপ তব। শোনো প্রিয়তম,
আমার সকলি তুমি, তুমি মহারাজ,
তুমি স্বামী– আমি শুধু অনুগত ছায়া,
তার বেশি নই; আমারে দিয়ো না লাজ,
আমারে বেসো না ভালো রাজশ্রীর চেয়ে।
বিক্রমদেব।           চাহ না আমার প্রেম?
সুমিত্রা।                                        কিছু চাই নাথ;
সব নহে। স্থান দিয়ো হৃদয়ের পাশে,
সমস্ত হৃদয় তুমি দিয়ো না আমারে।
বিক্রমদেব।           আজো রমণীর মন নারিনু বুঝিতে।
সুমিত্রা।               তোমরা পুরুষ, দৃঢ় তরুর মতন
আপনি অটল রবে আপনার ‘পরে
স্বতন্ত্র উন্নত; তবে তো আশ্রয় পাব
আমরা লতার মতো তোমাদের শাখে।
তোমরা সকল মন দিয়ে ফেল যদি
কে রহিবে আমাদের ভালোবাসা নিতে,
কে রহিবে বহিবারে সংসারের ভার?
তোমরা রহিবে কিছু স্নেহময়, কিছু
উদাসীন; কিছু মুক্ত, কিছু বা জড়িত;
সহস্র পাখির গৃহ, পান্থের বিশ্রাম,
তপ্ত ধরণীর ছায়া, মেঘের বান্ধব,
ঝটিকার প্রতিদ্বন্দ্বী, লতার আশ্রয়।
বিক্রমদেব।           কথা দূর করো প্রিয়ে; হেরো সন্ধ্যাবেলা
মৌন-প্রেমসুখে সুপ্ত বিহঙ্গের নীড়,
নীরব কাকলি! তবে মোরা কেন দোঁহে
কথার উপরে কথা করি বরিষন?
অধর অধরে বসি প্রহরীর মতো
চপল কথার দ্বার রাখুক রুধিয়া।
কঞ্চুকীর প্রবেশ
কঞ্চুকী।              এখনি দর্শনপ্রার্থী মন্ত্রী মহাশয়,
গুরুতর রাজকার্য, বিলম্ব সহে না।
বিক্রমদেব।           ধিক্‌ তুমি। ধিক্‌ মন্ত্রী। ধিক্‌ রাজকার্য।
রাজ্য রসাতলে যাক মন্ত্রী লয়ে সাথে।
[ কঞ্চুকীর প্রস্থান
সুমিত্রা।              যাও, নাথ, যাও।
বিক্রমদেব।                               বার বার এক কথা।
নির্মম, নিষ্ঠুর। কাজ, কাজ, যাও যাও।
যেতে কি পারি নে আমি? কে চাহে থাকিতে?
সবিনয় করপুটে কে মাগে তোমার
সযত্নে ওজন-করা বিন্দু বিন্দু কৃপা?
এখনি চলিনু।
                 অয়ি হৃদিলগ্না লতা,
ক্ষমো মোরে, ক্ষমো অপরাধ; মোছো আঁখি,
ম্লান মুখে হাসি আনো, অথবা ভ্রূকুটি;
দাও শাস্তি, করো তিরস্কার।
সুমিত্রা।                                                মহারাজ,
এখন সময় নয়,– আসিয়ো না কাছে;
এই মুছিয়াছি অশ্রু, যাও রাজ-কাজে।
বিক্রমদেব।           হায় নারী, কী কঠিন হৃদয় তোমার।
কোনো কাজ নাই প্রিয়ে, মিছে উপদ্রব।
ধান্যপূর্ণ বসুন্ধরা, প্রজা সুখে আছে,
রাজকার্য চলিছে অবাধে; এ কেবল
সামান্য কী বিঘ্ন নিয়ে তুচ্ছ কথা তুলে
বিজ্ঞ বৃদ্ধ অমাত্যের অতি সাবধান।
সুমিত্রা।              ওই শোনো ক্রন্দনের ধ্বনি– সকাতরে
প্রজার আহ্বান। ওরে বৎস, মাতৃহীন
নস তোরা কেহ, আমি আছি– আমি আছি
আমি এ রাজ্যের রানী, জননী তোদের।

চতুর্থ দৃশ্য

অন্তঃপুরের কক্ষ

সুমিত্রা

সুমিত্রা।                এখনো এল না কেন? কোথায় ব্রাহ্মণ?
ওই ক্রমে বেড়ে ওঠে ক্রন্দনের ধ্বনি।

দেবদত্তের প্রবেশ

দেবদত্ত।              জয় হোক।
সুমিত্রা।                           ঠাকুর, কিসের কোলাহল?
দেবদত্ত।              শোন কেন মাতঃ। শুনিলেই কোলাহল।
সুখে থাকো, রুদ্ধ করো কান। অন্তঃপুরে,
সেথাও কি পশে কোলাহল? শান্তি নেই
সেখানেও? বল তো এখনি সৈন্য লয়ে
তাড়া করে নিয়ে যাই পথ হতে পথে
জীর্ণচীর ক্ষুধিত তৃষিত কোলাহল।
সুমিত্রা।               বলো শীঘ্র কী হয়েছে।
দেবদত্ত।                                        কিছু না, কিছু না।
শুধু ক্ষুধা, হীন ক্ষুধা, দরিদ্রের ক্ষুধা।
অভদ্র অসভ্য যত বর্বরের দল
মরিছে চীৎকার করি ক্ষুধার তাড়নে
কর্কশ ভাষায়। রাজকুঞ্জে ভয়ে মৌন
কোকিল পাপিয়া যত।
সুমিত্রা।                                         আহা কে ক্ষুধিত?
দেবদত্ত।              অভাগ্যের দুরদৃষ্ট। দীন প্রজা যত
চিরদিন কেটে গেছে অর্ধাশনে যার
আজো তার অনশন হল না অভ্যাস,
এমনি আশ্চর্য।
সুমিত্রা।                                 হে ঠাকুর, এ কী শুনি।
ধান্যপূর্ণ বসুন্ধরা, তবু প্রজা কাঁদে
অনাহারে?
দেবদত্ত।                           ধান্য তার বসুন্ধরা যার।
দরিদ্রের নহে বসুন্ধরা। এরা শুধু
যজ্ঞভূমে কুক্কুরের মতো লোলজিহ্ব
একপাশে পড়ে থাকে, পায় ভাগ্যক্রমে
কভু যষ্টি, উচ্ছিষ্ট কখনো। বেঁচে যায়
দয়া হয় যদি, নহে তো কাঁদিয়া ফেরে
পথপ্রান্তে মরিবার তরে।
সুমিত্রা।                                           কী বলিলে,
রাজা কি নির্দয় তবে? দেশ অরাজক?
দেবদত্ত।              অরাজক কে বলিবে। সহস্ররাজক।
সুমিত্রা।               রাজকার্যে অমাত্যের দৃষ্টি নাই বুঝি?
দেবদত্ত।              দৃষ্টি নাই? সে কী কথা। বিলক্ষণ আছে।
গৃহপতি নিদ্রাগত, তা বলিয়া গৃহে
চোরের কি দৃষ্টি নাই? সে যে শনিদৃষ্টি।
তাদের কী দোষ? এসেছে বিদেশ হতে
রিক্ত হস্তে, সে কি শুধু দীন প্রজাদের
আশীর্বাদ করিবারে দুই হাত তুলে?
সুমিত্রা।               বিদেশী? কে তারা? তবে আমার আত্মীয়?
দেবদত্ত।              রানীর আত্মীয় তারা, প্রজার মাতুল,
যেমন মাতুল কংস, মামা কালনেমি।
সুমিত্রা।               জয়সেন?
দেবদত্ত।                         ব্যস্ত তিনি প্রজা-সুশাসনে।
প্রবল শাসনে তাঁর সিংহগড় দেশে
যত উপসর্গ ছিল অন্নবস্ত্র আদি
সব গেছে– আছে শুধু অস্থি আর চর্ম।
সুমিত্রা।               শিলাদিত্য?
দেবদত্ত।                            তাঁর দৃষ্টি বাণিজ্যের প্রতি।
বণিকের ধনভার করিয়া লাঘব
নিজস্কন্ধে করেন বহন।
সুমিত্রা।                                          যুধাজিৎ?
দেবদত্ত।              নিতান্তই ভদ্রলোক, অতি মিষ্টভাষী।
থাকেন বিজয়কোটে মুখে লেগে আছে
বাপু বাছা, আড়চক্ষে চাহেন চৌদিকে,
আদরে বুলান হাত ধরণীর পিঠে;
যাহা কিছু হাতে ঠেকে যত্নে লন তুলি।
সুমিত্রা।               এ কী লজ্জা। এ কী পাপ। আমার আত্মীয়।
পিতৃকুল-অপযশ। ছি ছি এ কলঙ্ক
করিব মোচন। তিলেক বিলম্ব নহে।

[ প্রস্থান

পঞ্চম দৃশ্য

দেবদত্তের গৃহ

নারায়ণী গৃহকার্যে নিযুক্ত

দেবদত্তের প্রবেশ

দেবদত্ত।প্রিয়ে, বলি ঘরে কিছু আছে কি?
নারায়ণী।তোমার থাকার মধ্যে আছি আমি। তাও না থাকলেই আপদ চোকে।
দেবদত্ত।ও আবার কী কথা।
নারায়ণী।তুমি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে কুড়িয়ে যত রাজ্যের ভিক্ষুক জুটিয়ে আন, ঘরে খুদকুঁড়ো আর বাকি রইল না। খেটে খেটে আমার শরীরও আর থাকে না।
দেবদত্ত।আমি সাধে আনি? হাতে কাজ থাকলে তুমি থাক ভালো, সুতরাং আমিও ভালো থাকি। আর কিছু না হোক তোমার ওই মুখখানি বন্ধ থাকে।
নারায়ণী।বটে? তা আমি এই চুপ করলুম। আমার কথা যে তোমার অসহ্য হয়ে উঠেছে তা কে জানত। তা কে বলে আমার কথা শুনতে–
দেবদত্ত।তুমিই বল, আবার কে বলবে? এক কথা না শুনলে দশ কথা শুনিয়ে দাও।
নারায়ণী।বটে। আমি দশ কথা শোনাই? তা আমি এই চুপ করলুম। আমি একেবারে থামলেই তুমি বাঁচ। এখন কি আর সেদিন আছে– সেদিন গেছে। এখন আবার নতুন মুখের নতুন কথা শুনতে সাধ গিয়েছে– এখন আমার কথা পুরোনো হয়ে গেছে।
দেবদত্ত।বাপ রে। আবার নতুন মুখের নতুন কথা। শুনলে আতঙ্ক হয়। তবু পুরোনো কথাগুলো অনেকটা অভ্যেস হয়ে এসেছে।
নারায়ণী।আচ্ছা বেশ। এতই জ্বালাতন হয়ে থাক তো আমি এই চুপ করলুম। আমি আর একটি কথাও কব না। আগে বললেই হত– আমি তো জানতুম না। জানলে কে তোমাকে–
দেবদত্ত।আগে বলি নি? কত বার বলেছি। কই, কিছু হল না তো।
নারায়ণী।বটে। তা বেশ, আজ থেকে তবে এই চুপ করলুম। তুমিও সুখে থাকবে, আমিও সুখে থাকব। আমি সাধে বকি? তোমার রকম দেখে–
দেবদত্ত।এই বুঝি তোমার চুপ করা।
নারায়ণী।আচ্ছা।

[ বিমুখ

দেবদত্ত।প্রিয়ে! প্রেয়সী! মধুরভাষিণী! কোকিলগঞ্জিনী!
নারায়ণী।চুপ করো।
দেবদত্ত।রাগ কোরো না প্রিয়ে– কোকিলের মতো রং বলছি নে, কোকিলের মতো পঞ্চমস্বর।
নারায়ণী।যাও যাও বোকো না। কিন্তু তা বলছি, তুমি যদি আরো ভিখিরি জুটিয়ে আন তাহলে হয় তাদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করব, নয় নিজে বনবাসিনী হয়ে বেরিয়ে যাব।
দেবদত্ত।তাহলে আমিও তোমার পিছনে পিছনে যাব– এবং ভিক্ষুকগুলোও যাবে।
নারায়ণী।মিছে না। ঢেঁকির স্বর্গেও সুখ নেই।

[ নারায়ণীর প্রস্থান

ত্রিবেদীর মালা জপিতে জপিতে প্রবেশ

ত্রিবেদী।শিব শিব শিব। তুমি রাজপুরোহিত হয়েছ?
দেবদত্ত।তা হয়েছি, কিন্তু রাগ কেন ঠাকুর? কোনো দোষ ছিল না। মালাও জপি নে, ভগবানের নামও করি নে। রাজার মরজি।
ত্রিবেদী।পিপীলিকার পক্ষচ্ছেদ হয়েছে। শ্রীহরি।
দেবদত্ত।আমার উপর রাগ করে শব্দশাস্ত্রের প্রতি উপদ্রব কেন? পক্ষচ্ছেদ নয়, পক্ষোদ্ভেদ।
ত্রিবেদী।তা ও একই কথা। ছেদও যা ভেদও তা। কথায় বলে ছেদভেদ। হে ভবকাণ্ডারী। যা হোক তোমার যতদূর বার্ধক্য হবার তা হয়েছে।
দেবদত্ত।ব্রাহ্মণী সাক্ষী এখনো আমার যৌবন পেরোয় নি।
ত্রিবেদী।আমিও তাই বলছি। যৌবনের দর্পেই তোমার এতটা বার্ধক্য হয়েছে। তা তুমি মরবে। হরি হে দীনবন্ধু।
দেবদত্ত।ব্রাহ্মণবাক্য মিথ্যে হবে না– তা আমি মরব। কিন্তু সেজন্যে তোমার বিশেষ আয়োজন করতে হবে না; স্বয়ং যম রয়েছেন। ঠাকুর, তোমার চেয়ে আমার সঙ্গে যে তাঁর বেশি কুটুম্বিতা তা নয়– সকলেরই প্রতি তাঁর সমান নজর।
ত্রিবেদী।তোমার সময় নিতান্ত এগিয়ে এসেছে। দয়াময় হরি।
দেবদত্ত।তা কী করে জানব? দেখেছি বটে আজকাল মরে ঢের লোক– কেউ বা গলায় দড়ি দিয়ে মরে, কেউ বা গলায় কলসী বেঁধে মরে, আবার সর্পাঘাতেও মরে, কিন্তু ব্রহ্মশাপে মরে না। ব্রাহ্মণের লাঠিতে কেউ কেউ মরেছে শুনেছি কিন্তু ব্রাহ্মণের কথায় কেউ মরে না। অতএব যদি শীঘ্র না মরে উঠতে পারি তো রাগ কোরো না ঠাকুর– সে আমার দোষ নয়, সে কালের দোষ।
ত্রিবেদী।প্রণিপাত। শিব শিব শিব।
দেবদত্ত।আর কিছু প্রয়োজন আছে?
ত্রিবেদী।না। কেবল এই খবরটা দিতে এলুম। দয়াময়। তা তোমার চালে যদি দু-একটা বেশি কুমড়ো ফলে থাকে তো দিতে পার– আমার দরকার আছে।
দেবদত্ত।এনে দিচ্ছি।

[ প্রস্থান

ষষ্ঠ দৃশ্য

অন্তঃপুর

পুষ্পোদ্যান

বিক্রমদেব ও রাজমাতুল বৃদ্ধ অমাত্য

বিক্রমদেব।           শুনো না অলীক কথা, মিথ্যা অভিযোগ;
যুধাজিৎ, জয়সেন, উদয়ভাস্কর,
সুযোগ্য সুজন। একমাত্র অপরাধ
বিদেশী তাহারা– তাই এ রাজ্যের মনে
বিদ্বেষ-অনল উদগারিছে কৃষ্ঞ ধূম
নিন্দা রাশি রাশি।
অমাত্য।                                  সহস্র প্রমাণ আছে,
বিচার করিয়া দেখো।
বিক্রমদেব।                                    কী হবে প্রমাণ?
চলিছে বিশাল রাজ্য বিশ্বাসের বলে;
যার ‘পরে রয়েছে সে ভার, সযতনে
তাই সে পালিছে। প্রতিদিন তাহাদের
বিচার করিতে হবে নিন্দাবাক্য শুনে,
নহে ইহা রাজধর্ম। আর্য, যাও ঘরে,
করিয়ো না বিশ্রামে ব্যাঘাত।
অমাত্য।                                               পাঠায়েছে
মন্ত্রী মোরে; সানুনয়ে করিছে প্রার্থনা
দর্শন তোমার, গুরু রাজকার্য-তরে।
বিক্রমদেব।           চিরকাল আছে রাজ্য, আছে রাজকার্য;
সুমধুর অবসর শুধু মাঝে মাঝে
দেখা দেয়, অতি ভীরু, অতি সুকুমার;
ফুটে ওঠে পুষ্পটির মতো, টুটে যায়
বেলা না ফুরাতে; কে তারে ভাঙিতে চাহে
অকালে চিন্তার ভারে? বিশ্রামেরে জেনো
কর্তব্য কাজের অঙ্গ।
অমাত্য।                                      যাই মহারাজ।

[ প্রস্থান

রানীর আত্মীয় অমাত্যের প্রবেশ

অমাত্য।               বিচারের আজ্ঞা হোক।
বিক্রমদেব।                                     কিসের বিচার?
অমাত্য।               শুনি নাকি, মহারাজ, নির্দোষীর নামে
মিথ্যা অভিযোগ–
বিক্রমদেব।                                 সত্য হবে! কিন্তু যতক্ষণ
বিশ্বাস রেখেছি আমি তোমাদের ‘পরে
ততক্ষণ থাকো মৌন হয়ে। এ বিশ্বাস
ভাঙিবে যখন, তখন আপনি আমি
সত্য মিথ্যা করিব বিচার। যাও চলে।
[ অমাত্যের প্রস্থান
বিক্রমদেব।            হায় কষ্ট মানব-জীবন। পদে পদে
নিয়মের বেড়া। আপন রচিত জালে
আপনি জড়িত। অশান্ত আকাঙক্ষা-পাখি
মরিতেছে মাথা খুঁড়ে পিঞ্জরে পিঞ্জরে।
কেন এ জটিল অধীনতা? কেন এত
আত্মপীড়া? কেন এ কর্তব্য-কারাগার?
তুই সুখী অয়ি মাধবিকা, বসন্তের
আনন্দমঞ্জরী। শুধু প্রভাতের আলো,
নিশার শিশির, শুধু গন্ধ, শুধু মধু,
শুধু মধুপের গান, বায়ুর হিল্লোল,
স্নিগ্ধ পল্লব-শয়ন,– প্রস্ফুট শোভায়
সুনীল আকাশ-পানে নীরবে উত্থান,
তার পরে ধীরে ধীরে শ্যাম দূর্বাদলে
নীরবে পতন। নাই তর্ক, নাই বিধি,
নিদ্রিত নিশায় মর্মে সংশয়-দংশন,
নিরাশ্বাস প্রণয়ের নিষ্ফল আবেগ।

সুমিত্রার প্রবেশ

এসেছ পাষাণী! দয়া হয়েছে কি মনে?
হল সারা সংসারের যত কাজ ছিল?
মনে কি পড়িল তবে অধীন এ জনে
সংসারের সব শেষে? জান না কি, প্রিয়ে
সকল কর্তব্য চেয়ে প্রেম গুরুতর।
প্রেম এই হৃদয়ের স্বাধীন কর্তব্য।

সুমিত্রা।               হায়, ধিক মোরে। কেমনে বোঝাব, নাথ,
তোমারে যে ছেড়ে যাই সে তোমারি প্রেমে।
মহারাজ, অধীনার শোনো নিবেদন–
এ রাজ্যের প্রজার জননী আমি। প্রভু,
পারি নে শুনিতে আর কাতর অভাগা
সন্তানের করুণ ক্রন্দন। রক্ষা করো
পীড়িত প্রজারে।
বিক্রমদেব।                              কী করিতে চাহ রানী?
সুমিত্রা।               আমার প্রজারে যারা করিছে পীড়ন
রাজ্য হতে দূর করে দাও তাহাদের।
বিক্রমদেব।           কে তাহারা জান?
সুমিত্রা।                                    জানি।
বিক্রমদেব।                                        তোমার আত্মীয়!
সুমিত্রা।               নহে মহারাজ।  আমার সন্তান চেয়ে
নহে তারা অধিক আত্মীয়। এ রাজ্যের
অনাথ আতুর যত তাড়িত ক্ষুধিত
তারাই আমার আপনার। সিংহাসন-
রাজচ্ছত্রছায়ে ফিরে যারা গুপ্তভাবে
শিকার-সন্ধানে– তারা দস্যু, তারা চোর।
বিক্রমদেব।           যুধাজিৎ, শিলাদিত্য, জয়সেন তারা।
সুমিত্রা।               এই দণ্ডে তাহাদের দাও দূর করে।
বিক্রমদেব।           আরামে রয়েছে তারা, যুদ্ধ ছাড়া কভু
নড়িবে না এক পদ।
সুমিত্রা।                                      তবে যুদ্ধ করো।
বিক্রমদেব।           যুদ্ধ করো! হায় নারী, তুমি কি রমণী?
ভালো, যুদ্ধে যাব আমি। কিন্তু তার আগে
তুমি মানো অধীনতা, তুমি দাও ধরা;
ধর্মাধর্ম, আত্মপর, সংসারের কাজ
সব ছেড়ে হও তুমি আমারি কেবল।
তবেই ফুরাবে কাজ– তৃপ্তমন হয়ে
বাহিরিব বিশ্বরাজ্য জয় করিবারে।
অতৃপ্ত রাখিবে মোরে যতদিন তুমি
তোমার অদৃষ্ট-সম রব তব সাথে।
সুমিত্রা।               আজ্ঞা করো মহারাজ, মহিষী হইয়া
আপনি প্রজারে আমি করিব রক্ষণ।
 
বিক্রমদেব।           এমনি করেই মোরে করেছ বিকল।
আছ তুমি আপনার মহত্ত্বশিখরে
বসি একাকিনী; আমি পাইনে তোমারে।
দিবানিশি চাহি তাই। তুমি যাও কাজে,
আমি ফিরি তোমারে চাহিয়া। হায় হায়,
তোমায় আমায় কভু হবে কি মিলন?

দেবদত্তের প্রবেশ

দেবদত্ত।              জয় হোক মহারানী– কোথা মহারানী,
একা তুমি মহারাজ?
বিক্রমদেব।                                    তুমি কেন হেথা?
ব্রাহ্মণের ষড়যন্ত্র অন্তঃপুরমাঝে?
কে দিয়েছে মহিষীরে রাজ্যের সংবাদ?
দেবদত্ত।              রাজ্যের সংবাদ রাজ্য আপনি দিয়েছে।
ঊর্ধ্বস্বরে কেঁদে মরে রাজ্য উৎপীড়িত
নিতান্ত প্রাণের দায়ে– সে কি ভাবে কভু
পাছে তব বিশ্রামের হয় কোনো ক্ষতি?
ভয় নাই, মহারাজ, এসেছি কিঞ্চিৎ
ভিক্ষা মাগিবার তরে রানীমার কাছে।
ব্রাহ্মণী বড়োই রুক্ষ, গৃহে অন্ন নাই,
অথচ ক্ষুধার কিছু নাই অপ্রতুল।
 
বিক্রমদেব।           সুখী হোক, সুখে থাক্‌ এ রাজ্যের সবে।
কেন দুঃখ, কেন পীড়া, কেন এ ক্রন্দন?
অত্যাচার, উৎপীড়ন, অন্যায় বিচার,
কেন এ-সকল? কেন মানুষের ‘পরে
মানুষের এত উপদ্রব? দুর্বলের
ক্ষুদ্র সুখ, ক্ষুদ্র শান্তিটুকু, তার ‘পরে
সবলের শ্যেনদৃষ্টি কেন? যাই, দেখি,
যদি কিছু খুঁজে পাই শান্তির উপায়।

সপ্তম দৃশ্য

মন্ত্রগৃহ

বিক্রমদেব ও মন্ত্রী

বিক্রমদেব।এই দণ্ডে রাজ্য হতে দাও দূর করে
যত সব বিদেশী দস্যুরে। সদা দুঃখ,
সদা ভয়, রাজ্য জুড়ে কেবল ক্রন্দন।
আর যেন এক দিন না শুনিতে হয়
পীড়িত প্রজার এই নিত্য কোলাহল।
মন্ত্রী।মহারাজ, ধৈর্য চাই। কিছুদিন ধরে
রাজার নিয়ত দৃষ্টি পড়ুক সর্বত্র,
ভয় শোক বিশৃঙ্খলা তবে দূর হবে।
অন্ধকারে বাড়িয়াছে বহুকাল ধরে
অমঙ্গল– একদিনে কী করিবে তার?
বিক্রমদেব।একদিনে চাহি তারে সমূলে নাশিতে।
শত বরষের শাল যেমন সবলে
একদিনে কাঠুরিয়া করে ভূমিসাৎ।
মন্ত্রী।অস্ত্র চাই, লোক চাই–
বিক্রমদেব।সেনাপতি কোথা?
মন্ত্রী।সেনাপতি নিজেই বিদেশী।
বিক্রমদেব।বিড়ম্বনা।
তবে ডেকে নিয়ে এস দীন প্রজাদের,
খাদ্য দিয়ে তাহাদের বন্ধ করো মুখ,
অর্থ দিয়ে করহ বিদায়। রাজ্য ছেড়ে
যাক চলে, যেথা গিয়ে সুখী হয় তারা।
[ প্রস্থান
দেবদত্তের সহিত সুমিত্রার প্রবেশ
সুমিত্রা।আমি এ রাজ্যের রানী– তুমি মন্ত্রী বুঝি?
মন্ত্রী।প্রণাম জননী। দাস আমি। কেন মাতঃ,
অন্তঃপুর ছেড়ে আজ মন্ত্রগৃহে কেন।
সুমিত্রা।প্রজার ক্রন্দন শুনে পারি নে তিষ্ঠিতে
অন্তঃপুরে। এসেছি করিতে প্রতিকার।
মন্ত্রী।কী আদেশ মাতঃ।
সুমিত্রা।বিদেশী নায়ক
এ রাজ্যে যতেক আছে করহ আহ্বান
মোর নামে ত্বরা করি।
মন্ত্রী।সহসা আহ্বানে
সংশয় জন্মিবে মনে, কেহ আসিবে না।
সুমিত্রা।মানিবে না রানীর আদেশ?
দেবদত্ত।রাজা রানী
ভুলে গেছে সবে। কদাচিৎ জনশ্রুতি
শোনা যায়!
সুমিত্রা।কালভৈরবের পূজোৎসবে
করো নিমন্ত্রণ। সেদিন বিচার হবে।
গর্বে অন্ধ দণ্ড যদি না করে স্বীকার
সৈন্যবল কাছাকাছি রাখিয়ো প্রস্তুত।

[ প্রস্থান

দেবদত্ত।কাহারে পাঠাবে দূত?
মন্ত্রী।ত্রিবেদী ঠাকুরে।
নির্বোধ সরলমন ধার্মিক ব্রাহ্মণ,
তার ‘পরে কারো আর সন্দেহ হবে না।
দেবদত্ত।ত্রিবেদী সরল? নির্বুদ্ধিই বুদ্ধি তার,
সরলতা বক্রতার নির্ভরের দণ্ড।

অষ্টম দৃশ্য

ত্রিবেদীর কুটির

মন্ত্রী ও ত্রিবেদী

মন্ত্রী।বুঝেছ ঠাকুর, এ কাজ তোমাকে ছাড়া আর কাউকে দেওয়া যায় না।
ত্রিবেদী।তা বুঝেছি। হরি হে। কিন্তু মন্ত্রী, কাজের সময় আমাকে ডাক, আর পৈরহিত্যের বেলায় দেবদত্তের খোঁজ পড়ে।
মন্ত্রী।তুমি তো জান ঠাকুর, দেবদত্ত বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ, ওঁকে দিয়ে আর তো কোনো কাজ হয় না। উনি কেবল মন্ত্র পড়তে আর ঘণ্টা নাড়তে পারেন।
ত্রিবেদী।কেন, আমার কি বেদের উপর কম ভক্তি? আমি বেদ পুজো করি, তাই বেদ পাঠ করবার সুবিধে হয়ে ওঠে না। চন্দনে আর সিঁদুরে আমার বেদের একটা অক্ষরও দেখবার জো নেই। আজই আমি যাব। হে মধুসূদন।
মন্ত্রী।কী বলবে?
ত্রিবেদী।তা আমি বলব কালভৈরবের পুজো, তাই রাজা তোমাদের নিমন্ত্রণ করেছেন। আমি খুব বড়োরকম সালংকার দিয়েই বলব। সব কথা এখন মনে আসছে না– পথে যেতে যেতে ভেবে নেব। হরি হে তুমিই সত্য।
মন্ত্রী।যাবার আগে একবার দেখা করে যেয়ো ঠাকুর।

[ প্রস্থান

ত্রিবেদী।আমি নির্বোধ, আমি শিশু, আমি সরল, আমি তোমাদের কাজ উদ্ধার করবার গোরু! পিঠে বস্তা, নাকে দড়ি, কিছু বুঝব না, শুধু লেজে মোড়া খেয়ে চলব– আর সন্ধ্যেবেলায় দুটিখানি শুকনো বিচিলি খেতে দেবে। হরি হে, তোমারি ইচ্ছে। দেখা যাবে কে কতখানি বোঝে। ওরে এখনো পুজোর সামগ্রী দিলি নে? বেলা যায় যে। নারায়ণ। নারায়ণ।
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *