রাজনীতি ও গণমানব

রাজনীতি ও গণমানব

০১.

প্রাচীন ও মধ্যযুগে জাতীয়তার স্থান ছিল না, তখন ছিল প্রবল ও পরাক্রান্ত ব্যক্তির রাজ্য ও সাম্রাজ্য। তখন জোর যার, মুলুক ছিল তার। বসুন্ধরা ছিল বীরভোগ্যা। সে-বীরের জাত-জন্ম ও বর্ণ-ধর্ম বিচারের অধিকার ছিল না কারো।

আদিকালের গোত্র-ভিত্তিক সর্দারতন্ত্রই সংস্কৃতি-সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় ক্ষুদ্র ও খণ্ড অঞ্চলভিত্তিক রাজতন্ত্রে এবং আরো পরে সামন্ত সমর্থিত সাম্রাজ্যের বিকাশ লাভ করে। আমাদের পাক-ভারতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ঐতিহাসিক স্মৃতির যুগে আমরা দক্ষিণ ভারতে যেমন দ্রাবিড় গোষ্ঠীর পল্লব, চালুক্য, রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের সন্ধান পাই উত্তর ভারতেও তেমনি ইরানী-আর্য ও মধ্য এশিয়ার শক, হুন, কুশান, তুর্কী, মুঘল সাম্রাজ্যের সংস্থিতি লক্ষ্য করি। সবাই বাহুবলেই ভোগ দখল করেছে দেশের ঐশ্বর্য। জনগণের সঙ্গে রাজার সম্পর্ক ছিল শাসকের ও শাসিতের, শোষকের ও শোষিতের। এক্ষেত্রে স্বাজাত্য স্বাধৰ্ম ব স্বাদেশিকতা ছিল অনুপস্থিত।

গোত্ৰ-চেতনা অবশ্যই ছিল, ছিল স্বধর্মী প্রীতিও, আরো ছিল স্ব-ভাষীর প্রতি মমতা। কিন্তু সামাজিক স্তর অতিক্রম করে এসব কখনো রাষ্ট্রিক ঐক্য-বোধের কিংবা আর্থিক স্বার্থবোধের উদ্ভব ঘটায়নি। তাই দত্তশক্তি বিদেশী বিজাতি কিংবা বিধর্মী বলেই তারা কখনো বিক্ষুব্ধ হয়নি। যদিও ধর্মমতের ক্ষেত্রে ও সামাজিক স্তরে বিধর্মী ও বিজাতির প্রতি ছিল অসীম ঘৃণা ও অপরিমেয় বিদ্বেষ। কিন্তু স্বার্থ ও অর্থের ক্ষেত্রে কিংবা শাসন ও শোষণের ব্যপারে তারা দেশ-জাত বা বর্ণ-ধর্ম বিচার করেনি। তাই শক-হূন- কৃশানদেরকে এদেশবাসীরা বিদেশী, বিজাতি কিংবা বিধর্মী বলে প্রতিরোধ করতে এগোয়নি। এমনকি হাজারোর্ধ্ব বছর পরেও তুর্কী, মুঘল বা বৃটিশকেও বিদেশী-বিধর্মী বলে কেউ ঠেকানোর বা তাড়ানোর চেষ্টা করেনি। রাজা বদল ছিল প্রজাদের চোখে অনেকটা এ-যুগের জমিদার বদলের মতোই। কোনো অবস্থাতেই তার অধিক কিছু ছিল না। হাত-বদলের সময়ে খাজনাদির ব্যাপারে জনগণের জীবনে আর্থিক বিপর্যয় ও দুর্ভোগ অবশ্যই ঘটত। কিন্তু তা ছিল সাময়িক। রাজা ছিল শাসক–সেবক নয়। মানুষের উপর তার সর্বাত্মক অধিকার ছিল, তাদের প্রতি দায়িত্ব ছিল না কিছুই। বলতে গেলে একপ্রকারের দায়িত্ব অবশ্যই ছিল, সেটা গৃহস্থের অর্থকর পোষা মেষপাল কিংবা গোধন রক্ষণের ও লালনের দায়িত্বের মতোই। অর্থাৎ রাজস্বের নিশ্চয়তার জন্যে রাজ্যসীমা সুরক্ষিত রাখা ও প্রজাদের শাসনে রাখাই ছিল রাজার দায়িত্ব।

আমাদের এই ধারণার সমর্থনে প্রমাণ অবশ্যই মিলবে। দূর-অতীতের অন্ধকারে না হাতড়িয়ে মধ্যযুগের ভারত থেকেই দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। পর্তুগীজ প্রভৃতি বিদেশী বেনে জাতেরা গোয়া, দামন, দিউ, কারিকল, মাহে দখল করেছিল। এগুলি কোননা-কোনো দেশীয় রাজ্যের এলাকা ছিল। কিন্তু স্বদেশ-চেতনা কিংবা স্বাজাত্য বশে ভারতের কোনো রাজা-বাদশাই তাদের উচ্ছেদ করবার চেষ্টা করেনি। পর্তুগীজ, দিনেমার, ওলন্দাজ, আর্মেনীয়, ইংরেজ ও ফরাসি বেনেদের সহায়তায় প্রতিবেশীকে জব্দ ও পরাজিত করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল ষোলো শতকের গোড়া থেকেই। কারো মনে এ প্রশ্ন কখনো জাগেনি যে তারা নিজেদের কোন্দলে কোনো বিদেশীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। চোরা কারবারে কিংবা চুরিতে যেমন জাতভেদ নেই, রাজ্য কাড়াকাড়িতেও তেমন জাতধর্মের পার্থক্য চেতনা ছিল না।

কর্ণট দরবারের ঘরোয়া বিবাদে ইংরেজ ফরাসির সাহায্য কামনা; পর্তুগীজ, আর্মেনীয়, ওলন্দাজ ও ফরাসি কর্মচারীর হাতে দেশীয় রাজন্য কর্তৃক রাজ্যরক্ষার ভারার্পণ; টিপু সুলতানকে ইংরেজের বিরুদ্ধে সাহায্যদানে নিযাম-মারাঠার অস্বীকৃতি; পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী ইংরেজকে দিল্লীর সুলতানের দেওয়ানী দান, স্বাধর্মবোধে ভারতের মুসলমান কর্তৃক নাদিরশাহ-আহমদশাহকে মারাঠা দমনার্থে ভারত বিজয়ে প্ররোচনা দান আর নাদিরশাহ-আহমদশাহ কর্তৃক দিল্লী বিজয়, গৃহদ্বারের বিদেশী-বিধর্মী শত্রু ইংরেজকে ছেড়ে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর বালাকোটে শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, মীর কাসিম আলির পতনকালে দিল্লীর সম্রাটের ব্রিটিশ পক্ষাবলম্বন, ইংরেজ প্রতিরোধে মারাঠাদের সঙ্শক্তি প্রয়োগে অনীহা, সিপাহীবিপ্লব কালেও দেশী রাজন্যের উচ্ছন্ন-প্রায় ব্রিটিশের প্রতি আনুগত্য প্রভৃতিই সাক্ষ্য দেয় যে রাজা-বাদশাহর দেশ-জাত প্রীতি ছিল না, ছিল কেবল স্বার্থ চেতনা।

তাই সে-যুগের জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে রাজা ও প্রজার সমস্বার্থের কোনো মিলন-ময়দান ছিল না। কাজেই রাজার সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের, এবং উত্থান ও পতনের লাভক্ষতি ছিল একান্তই রাজার ও রাজ-পরিজনের ব্যক্তিগত দুর্যোগ-দুর্ভোগের বিষয়। এতে প্রজার কোনো ভূমিকা বা হাত ছিল না। রাজ্য ভাগাভাগির জন্যে দ্বন্দ্ব-মিলনে রাজাদের দেশ-জাত ও বর্ণ-ধর্মের বিচার ছিল না; কেবল সম বা বিষম স্বার্থের গুরুত্ব ছিল। তাই দেশী-বিদেশী বা স্বধর্মী-বিধর্মীর পার্থক্য-চেতনা তাদের চিন্তায় ও কর্মে প্রশ্রয় পায়নি। রাজকীয় ব্যাপারে প্রজাদের অধিকার ছিল না বলেই, এক্ষেত্রে তাদের কোনো দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল না। আর তাই তাদের আনুকূল্য কিংবা প্রতিকূল্যের গুরুত্বও ছিল সামান্য।

পরিণামের পরিপ্রেক্ষিতে পলাশীর যুদ্ধে যে-গুরুত্ব আমরা একালে দিয়েছি, সমকালে এই যুদ্ধের এমনি গুরুত্ব ছিল অভাবিত। ইংরেজ আমলে প্রতীচ্য প্রভাবে লব্ধ জাতীয়তাবাবোধ ও স্বদেশপ্রীতিপ্রসূত এই বোধ আমাদের দেশে অজাতপূর্ব। তাছাড়া স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রে আধুনিক সংজ্ঞানুগত দেশ-জাত চেতনার উদ্ভব ছিল অসম্ভব। এ বোধ জাগে অধিকার ও দায়িত্ব-চেতনা থেকে। রাজকীয় ব্যাপারে প্রজার কোনো অধিকার ছিল না, তাই দেশরক্ষার ও দেশবাসী মানুষের হিতচিন্তার দায়িত্ব ছিল না প্রজার। দায়িত্ব-চেতনাই কৰ্তব বুদ্ধি জাগ্রত করে আর কর্তব্যেবোধই উপায় উদ্ভাবনে প্রবর্তনা দেয়। এতেই ঘটে বোধের বিকাশ, এমনি বিকাশের অন্যতম প্রসূন হচ্ছে স্বাজাত্য ও স্বাদেশিকতা। সেদিনকার রাজন্য ও জনগণের চোখে পলাশীর যুদ্ধ ছিল রাজ্য কাড়াকাড়ির আর দশটা যুদ্ধেরই একটি। তাই ইংরেজের সাফল্যে ভারতীয় রাজন্য- সমাজে কোনো চাঞ্চল্য দেখা যায়নি। দিল্লীর দুর্বল রাজা বরং অর্থলোভে অভিনন্দিত করেছেন ইংরেজদের। শুধু কী তাই! পলাশীর পরেও একশ, বছর সময় পেয়েছিলেন ভারতের রাজারা; কিন্তু ক্রমবধিষ্ণু ইংরেজশক্তিকে ঠেকানোর জন্যে তৈরি হননি কেউ। ভারতের পূর্ব প্রত্যন্ত অঞ্চলের পলাশীর যুদ্ধকে এক বছর পরে ইংরেজ কর্তৃক পশ্চিম প্রান্তের পেশোয়ার বিজয়ের জন্যে দায়ী করা চলে না। এ হচ্ছে ছলনার আশ্রয়ে বিবেককে প্রতারিত করে অক্ষমের আত্মপ্রবোধ লাভের অপচেষ্টা মাত্র।

.

০২.

রাজ্য যে রাজার রাজস্ব উসুলের জমিদারী নয়, জনহিত সাধনের জন্যে সমবায় সংস্থামাত্র–এ সত্যের তত্ত্বগত স্বীকৃতির ভিত্তিতে মধ্যযুগের অবসানে গড়ে উঠেছিল য়ুরোপীয় রাজ্য ও রাষ্ট্রগুলো। এমনি রাষ্ট্রচেতনা সহজে আসেনি। উপলব্ধির এই স্তরে উত্তরণের জন্যে সুদীর্ঘকাল ধরে সংগ্রাম করতে হয়েছে। শোষণ, নির্যাতন ও মৃত্যুর শিকার হয়ে অর্জন করতে হয়েছে এ অধিকার। তাজা প্রাণের, নিউঁকি বুকের পলাশ-লাল রক্তের গঙ্গা বয়ে গেছে য়ুরোপে। এ সাফল্য অর্জন-লক্ষ্যে প্রায় চারশ বছর ধরে ধনে-প্রাণে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে অসংখ্য মানুষকে। মনুষ্য জগতে আধুনিকতা রক্তস্নাত য়ুরোপের দান। চারশ বছরের অনলস অবিরাম সাধনায় লব্ধ এই য়ুরোপীয় জীবন-চেতনা ও জগৎ-ভাবনা তাদের বহির্বিশ্বস্থ উপনিবেশে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ে য়ুরোপীয় ভাষার মাধ্যমে।

তেরো শতকের অন্তিমে দান্তের আবির্ভাব থেকেই মধ্যযুগীয় তমসা তরল হতে থাকে। পেত্রার্ক ছিলেন প্রভাতী পূর্বাশা। এমনি করে য়ুরোপ শাস্ত্রের খাঁচা ডিঙিয়ে সাহিত্য-শিল্পের উদার অঙ্গনে মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করতে শুরু করে। এভাবে তারা মেরীর চাইতে সত্যকে, যিশুর চাইতে জীবনকে বেশি ভালবাসতে শিখে। এ অঙ্গন যদিও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না, তবু ইটালীয় শিল্পী-ভাঙ্কর বিজ্ঞানী লিউনার্দো দ্য ভিনসি, রাফেল, মাইকেল এ্যাঞ্জেলো ও টাইটিয়ানের নতুন জীবন ও রূপচেতনা; পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে (১৪৫৩ খ্রী.) মুসলিমদের কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের ফলে বাজেন্টাইন গ্রীক বিদ্বানদের য়ুরোপে প্রত্যাবর্তন এবং মুদ্রণযন্ত্রের ব্যবহার এ সাধনাকে অপ্রতিরোধ্য ও বেগবান করে তুলল। তারপর নতুন দেশ আবিষ্কারের প্রভাব প্রসূত reformation ও revolution-এর মাধ্যমে শাস্ত্রীয় Indulgence-এর ফাঁকি ও Inquisition-এর পীড়ন-মুক্ত হয় বহু শতাব্দীব্যাপী নির্যাতিত মানুষ। চারশ বছরব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই মানববাদ, এই শাস্ত্রদ্রোহিতা, এই সৌন্দর্য-অন্বেষা, এই আত্মবিস্তার, এই বিজ্ঞান বুদ্ধি, এই সম্পদ-স্বাচ্ছন্দ্য ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় প্রভৃতির সামগ্রিক নাম রেনেসাস। ভাষিক, দৈশিক, রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য-চেতনা তথা জাতীয়তাবোধ এই নবযুগের প্রসূন।

.

০৩.

য়ুরোপীয়দের অন্যান্য উপনিবেশের মতো ব্রিটিশ ভারতেও প্রতীচ্য ভাষা ও বিদ্যার প্রভাবে জাতীয়তাবোধ দানা বাঁধতে থাকে। তবে য়ুরোপে যা ছিল সাধনা ও সংগ্রামলব্ধ, বহির্বিশ্বে তা ছিল অকালে আকস্মিকভাবে অনায়াসপ্রাপ্তি। হঠাৎ করে মধ্যযুগীয় অমানিশা শীত-সকালের কুয়াশার মতো মিলিয়ে গেল। এজন্যে কারো মানসিক, সামাজিক, বৈষয়িক, আর্থিক কিংবা শৈক্ষিক প্রস্তুতি ছিল না। তাই গোড়াতে এই প্রভাব বিচিত্র ও বিকৃত হয়ে দৃশ্যমান হল। পণ্যবিনিময়-ভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতি আকস্মিকভাবে মৌদ্রিক অর্থনীতির রূপ নিল, প্রতীচ্য বিদ্যায় শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের বিশ্বাস সংস্কারে দেখা দিল দ্বন্দ্ব, শাস্ত্রে ও সাহিত্যে-দর্শনে বিরোধ হল প্রকট, সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদের দ্বান্দ্বিক স্থিতি ঘটাল নতুন বিপর্যয়; যন্ত্রচালিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অভাব, পণ্যের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিদেশী শাসকের শোষণ আনল আয়-ব্যয়ে অসমতা। এক কথায়, মানস কিংবা বৈষয়িক জীবনে কোথাও আর আনুপাতিক ভারসাম্য রক্ষা করা গেল না।

এমনি প্রতিবেশে প্রতীচ্যশিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত মনে জাতীয়তাবোধ এবং তজ্জাত জাতিবৈর অঙ্কুরিত হয়। এ জাতি-চেতনা সুষ্ঠু ছিল না। কখনো ভাষিক, কখনো ধার্মিক, কখনো আঞ্চলিক, কখনো প্রাদেশিক এবং কখনোবা ভারতীয় জাতীয়তারূপে তা আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। এগুলোর মধ্যে স্বধর্ম-ভিত্তিক জাতীয়তাই প্রবল ও প্রকট হয়ে উঠে। রামমোহনে-বিদ্যাসাগরে-বঙ্কিমে এবং হিন্দু-মেলায় এই স্বধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধের উন্মেষ যেমন লক্ষণীয়, তেমনি সৈয়দ আহমদ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন হালী, সৈয়দ আমীর আলী প্রমুখও ছিলেন মুসলিম জাতীয়তাবাদী।

হিন্দুমনে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করার অবলম্বন হয়েছিল আর্য, রাজপুত ও মারাঠা ঐতিহ্য আর মুসলমানেরা প্রেরণার উৎস করেছিল আরব-ইরানী পুরাণ ও ঐতিহ্যকে। দেশ-কাল-পরিবেশ চেতনা কারো ছিল না। এভাবে তারা কেবল হিন্দু ও নিছক মুসলমান বনেছিল, অর্থাৎ প্যান হিন্দুইজম ও প্যান ইসলামই ছিল তাদের আদর্শিক জাতীয়তার লক্ষ্য। এমনিভাবে দেশকালের প্রয়োজন অস্বীকার করে তারা অতীতে, বিদেশমুখিতায় ও স্বাতন্ত্রে খুঁজেছে স্বস্তি ও শ্রেয়সকে। কল্যাণের পথ তাদের জানা ছিল না, জানতে চায়নি তারা; তাই কল্যাণ আসেনি, সুখ দেয়ওনি, পায়ওনি, কেবল লাভের ও সুখের মরীচিকায় আত্মক্ষয় করেছে।

তারপর এই শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে ব্রিটিশ বিতাড়ন-বাঞ্ছায় কংগ্রেসের ধ্বজা ধরে তারা ময়দানী-মিলনে প্রয়াস পায়। ময়দানী-মিলন বলছি এজন্যে যে তারা আসলে হিন্দু কিংবা মুসলমানই রয়ে গেল, কেবল সমলক্ষ্যে কারখানা শ্রমিকের মতোই সাময়িক স্বার্থে রাজনৈতিক সংগ্রামার্থ মিলন কামনা করেছিল–এ ছিল অনেকটা নীলনদের ধারার মতো। কেননা তারা দেশের সন্তান হিসেবে অভিন্ন সত্তায় ও পরিচয়ে আস্থাবান ছিল না। মুসলিম লীগে ও হিন্দুমহাসভাতেই তাদের চেতনার ও লক্ষ্যের স্বরূপ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। অতএব, কংগ্রেসী নিবর্ণ জাতীয়তা ছিল অনেকটা ছদ্মরূপ। এবং বিপন্ন খিলাফৎ-প্রীতিই মুসলমানদেরকে কংগ্রেসের সাহায্য প্রত্যাশী করে তোলে। সেই প্রয়োজনের অবসানে: ইংরেজি-শিক্ষিত মুসলমান কংগ্রেস ত্যাগ করে। আর স্বাধীনতাকামী মোল্লা-মৌলভীরা তখনো কংগ্রেসে থেকে যায় হিন্দু প্রীতিবশে নয় অবশ্যই, স্বাধীনতা অর্জনে হিন্দুর শক্তির প্রতি আস্থাবশে। ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমান চাকুরির ক্ষেত্রে ছিল হিন্দুর প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই মুসলিম লীগই ছিল তাদের প্রিয়।

ইংরেজি অজ্ঞ মোল্লা-মৌলভীরা চাকুরির প্রত্যাশী ছিল না, তাই স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দুর সঙ্গে হাত মিলাতে পেরেছিল সহজেই। আবার সেকালের পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু ও সীমান্ত প্রদেশে হিন্দুর সংখ্যা ছিল নগণ্য, তেমনি দাক্ষিণাত্যে ও মধ্য প্রদেশে মুসলমান ছিল বিরল; রাজনীতি ক্ষেত্রে তাই ওদের বিধর্মী-সমস্যা ছিল না, বিধর্মী-বিদ্বেষও ছিল না। শেষাবধি ওসব অঞ্চলে কংগ্রেস প্রভাবও ছিল প্রবল। এদিকে তকালীন যুক্ত প্রদেশে চাকুরি ও জমিদারীর অর্থ-সম্পদের অধিকাংশ ছিল। সংখ্যালঘু মুসলমানদের করতলগত, যেমনটি সংখ্যালঘু হিন্দুর ছিল বাঙলা দেশে।

যুক্ত প্রদেশের মুসলমান এই স্বার্থ ও সুবিধা দীর্ঘস্থায়ী করবার জন্যে সচেষ্ট ছিল। তাদের নেতৃত্বে ও বাঙালির সংগ্রামে পাকিস্তান অর্জিত হয়েছিল। মোটামুটিভাবে ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ওহাবী সংগ্রামের অবাসনে স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে উত্তর-পূর্ব ভারতে ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে হিন্দু-দ্বেষণা ও ব্রিটিশ-প্রীতি প্রবল হতে থাকে। হিন্দু-বিদ্বেষের মূল ছিল সরকারি অনুগ্রহের প্রত্যাশা। অতএব, ১৮৬০ সন থেকে ১৯৪৭ সন অবধি ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানেরা স্বাধীনতা-সংগ্রামী ছিল না, সরকারি সহযোগিতায় হিন্দুর কবল থেকে নিজেদের প্রাপ্য ধন-সম্পদ উদ্ধারেই ছিল ব্রতী। সে ধন-সম্পদ অবশেষে পাকিস্তান রাষ্ট্ররূপে আয়ত্তে এল।

যে ভাগ-বাটোয়ারার দাবী উনিশ শতকের শেষ পাদ থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের মুসলিম-মনে গুঞ্জরিত হচ্ছিল, তা-ই মুসলিম লীগের মাধ্যমে প্রবল ও ফলপ্রসূ হল। মূলত হিন্দুর জন্যে হলেও কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতা চেয়েছিল। ব্রিটিশ বিতাড়নে সাফল্য আসে কংগ্রেসের মাধ্যমেই। তার আনুষঙ্গিক ফল পাকিস্তান।

.

০৪.

ব্রিটিশ যুগে কিছুসংখ্যক বর্ণহিন্দু চাকুরে-মহাজন-জমিদার বাঙলার অর্থ-সম্পদ করায়ত্ত করে। বর্ণ ধর্ম অবিশেষে আর সব বাঙালিই ছিল নির্জিত, শোষিত ও নির্যাতিত। ইংরেজি শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত বর্ধিষ্ণু মুসলিম সমাজ দেশের ধন-সম্পদে, বাণিজ্যে ও চাকুরিতে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংকল্প নিয়ে ওদের প্রতিপক্ষতা শুরু করে। এ ছিল স্বস্বার্থে সমশ্রেণীর প্রবল শোষকের বিরুদ্ধে দুর্বল বঞ্চিত শোষকের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এর মধ্যে গণ-কল্যাণের কোনো অভিপ্রায় ছিল না। চাকুরি-সদাগরী জমিদারীতে শিক্ষিত মুসলমানের আনুপাতিক হার প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলিম জনগোষ্ঠী শোষণ ও দারিদ্র্যমুক্ত হত না। যেহেতু চাকুরে-মহাজন-জমিদার ছিল হিন্দু, সেহেতু এইসব উচ্চাভিলাষী মুসলমান স্বধর্মীর অজ্ঞতা ও দারিদ্র্যের সুযোগে স্বস্বার্থে মুসলিম মনে জাতিবৈর জাগাতে সমর্থ হল সহজেই। ফলে শোষক-শোষিত নির্বিশেষ হিন্দুর প্রতি মুসলিম-মনে জাগল ক্ষোভ ও বিদ্বেষ। গণ কল্যাণে যে-সংগ্রাম শুরু হওয়া উচিত ছিল ব্রিটিশ শাসক ও দেশী শোষকের বিরুদ্ধে, তা এভাবে বিধর্মী-বিদ্বেষের রূপ নিল। গণমানবের অজ্ঞতা ও সরলতার সুযোগে মুসলিম লীগ গণ-সমর্থনে অর্জন করল পাকিস্তান। যারা পূর্বে ধন-সম্পদ দখলে ছিল হিন্দুর পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বী, পাকিস্তানে তারাই হল পরিত্যক্ত ধন-সম্পদ চাকুরির নির্ঘ ও নির্বিঘ্ন মালিক। জনগণের দুর্ভাগ্য-দুর্ভোগ রইল পূর্ববৎ।

.

০৫.

এদিকে কালক্রমে পাকিস্তান প্রাপ্তির প্রাথমিক উচ্ছ্বাসে ও উল্লাসে যখন ভাটা পড়েছে, তখন ক্রমবর্ধিষ্ণু শিক্ষিত বাঙালিরা দেখছে তারা অর্থ-সম্পদের সর্বক্ষেত্রে ঠকছে। তাদেরই স্বস্বার্থে তারা আবার পূর্বতন নীতিরই অনুবর্তন কামনা করছে রাজনীতিক্ষেত্রে। তারা দেখছে চাকুরি ও ব্যবসা ধনাগম, ও মর্যাদার এই দু-ক্ষেত্র তাদের হাতছাড়া, সেখানে প্রবেশাধিকার বর্তমান অবস্থায় একরকম অসম্ভব। পাকিস্তান যখন হল তখন সামরিক বিভাগে বাঙালি ছিলই না, প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও পদস্থ বাঙালি মুসলিমান ছিল নেহাত নগণ্য। আর ব্যবসা-বাণিজ্যে তাদের ছিল অনীহা ও আর্থিক অসামর্থ্য। বিশেষ করে হিন্দু-বিদ্বেষজাত বেরাদরী উদারতা বশে তখন বাঙালিরা ন্যায্য প্রাপ্য দাবি করেনি। না-পেয়েও তারা পাওয়ার আনন্দে ছিল অভিভূত। আগে জাতি- দ্বেষণাবশে তারা ছিল বেরাদরী-ভাবে বিভোর। ইদানীং দারিদ্র্য, শোষণ ও হতবাঞ্ছার আঘাতে শিক্ষিত বাঙালি আবার স্বাধিকার সংগ্রামে অবতীর্ণ। আগে গণসমর্থন লাভের জন্যে তাদের অবলম্বন হয়েছিল হিন্দু দ্বেষণা, এখন তারা উত্তেজনা দানের ইন্ধন করছে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ও.ভাষিক স্বাতন্ত্র্যকে। পূর্বে মুসলিম মনে হিন্দু-বিদ্বেষ যেমন করে প্রবল হয়েছিল, অবিকল তেমনি ধারায় ও তেমনি যুক্তিতে দানা বাঁধছে উর্দুভাষী-বিদ্বেষ। কেবল প্রতিপক্ষ বদল হয়েছে, উপায় ও উদ্দেশ্য রয়েছে অবিচল। এর মধ্যেও পূর্বেকার ফাঁক ও ফাঁকি উভয়েই বর্তমান।

পাকিস্তানের শিল্প-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে বোম্বাই থেকে আগত মেমন ও ইসমাইলী সম্প্রদায়, সামরিক ও বেসামরিক বড় চাকুরিগুলো রয়েছে পাঞ্জাবী ও উত্তর ভারত থেকে আগত মোহাজেরদের হাতে। মেমন ও ইসমাইলী ধনপতি-পুঁজিপতিদের পরিচয়ও জানে না বাঙালিরা, তারা চোখের সামনে দেখে পাঞ্জাবী বড় সাহেবদের। পশ্চিম পাকিস্তানী বলতে এরা সিন্ধি, বেলুচ, পাঠান, মোহাজের-ভেদ মানে না, তাদের চোখে সবাই উর্দুওয়ালা ও পাঞ্জাবী। এমনকি বাঙলার বিহারী মোহাজেরেরাও উর্দুওয়ালা বলে বিহারী-পাঞ্জাবী তাদের কাছে সমার্থক।

এখানকার বিহারীদেরও দোষ আছে। ভাষিক ঐক্যের দরুন তারা পাঞ্জাবীদের মনে করে জ্ঞাতি এবং পাঞ্জাবী শাসনকে তারা ভাবে নিজেদেরই শাসন, ফলে ইংরেজ আমলের দেশী খ্রীস্টান। ও এ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মতো তারাও নিজেদের মনে করে শাসকজাত। আর পশ্চিম পাকিস্তানীর স্বার্থ, লাভ ও গৌরবের তারাও যেন অংশীদার। সেজন্যে বাঙলার বিহারী মোহাজেরেরা। রাজনীতিক্ষেত্রে এ অংশের স্বার্থে কিছু তো করেই না, বরং তাদের আনুগত্য থাকে করাচি-লাহোর রাওয়ালপিণ্ডির প্রতি। এভাবে তারা নিজেদেরকে নিজেরাই বিপন্ন করছে। আর মধ্যবিত্ত নামে পরিচিত উঠতি বাঙালি বুর্জোয়া এবং চাকুরেরাও তাদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা মানসে পূর্বের মতো এ. সুযোগ গ্রহণ করে উর্দুওয়ালা নামে অভিহিত অবাঙালি মাত্রেরই বিরুদ্ধে অজ্ঞ-দরিদ্র জনগণকে লেলিয়ে দিতে উৎসুক। স্ব-স্বার্থেই এই বিকাশমান বাঙালি সমাজ প্রতিদ্বন্দ্বী অবাঙালি পুঁজিপতি ও চাকুরেদের সম্পদে ও সম্মানে ভাগ বসাতে চাচ্ছে–বাঙালি জনগণের স্বার্থে নয়।

আযাদী-উত্তর যুগে হিন্দু চাকুরে-মহাজন-জমিদার ও ব্যবসায়ীর স্থলে শিক্ষিত মুসলমান শ্রেণী বসে মজা লুটছে, জনগণের তকদির রয়েছে অপরিবর্তিত। এও তেমনি এক চাল, এখন যেমন বিশ-বাইশটি অবাঙালি পরিবার পাকিস্তানের ধন-সম্পদের মালিক, তখন ছিল তেমনি কয়েকজন হিন্দু-জৈন আগরওয়ালারা। আগে যেমন হিন্দু শোষক শ্রেণীর সঙ্গে লড়তে গিয়ে আপামর হিন্দুর। বিরুদ্ধে বিদ্বেষ-বিষ ছড়িয়েছে তারা, এখন আবার তেমনি পুঁজিপতি ও চাকুরে পশ্চিমাদের থেকে সম্পদ-সম্মানের ভাগ আদায় করবার জন্যে আপামর অবাঙালি-দ্বেষণা জাগানোর চেষ্টা চলছে। এর নাম বাঙালির স্বাতন্ত্র্য-চেতনা, নামান্তরে বাঙালির জাগরণ। উঠতি মধ্যবিত্তের স্বার্থে এ আন্দোলন গড়ে উঠছে বলেই এতে আমাদের আপত্তি।

.

০৬.

নইলে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা অনেকেরই মনঃপূত নয়। সমস্বার্থে মিলন অসম্ভব নয়। বটে, তবে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা যে আর্থিক, ভাষিক, সাংস্কৃতিক ও জীবনধারণ পদ্ধতির পার্থক্য ঘটায়, তাতে আধুনিক রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাও নিতান্ত কৃত্রিম ও অকেজো হয়ে পড়ে। এ কারণে,  একক রাষ্ট্র-গঠনে কিছুসংখ্যক লোকের আপত্তি গোড়াতেই শোনা গিয়েছিল। কিন্তু তখন সাফল্য ও প্রাপ্তির উল্লাস বশে কেউ স্বস্থ ছিল না, তাই এ সদ্বুদ্ধি তখন পাত্তা পায়নি।

বাঙালির সর্বাত্মক স্বাতন্ত্র্য ও স্বার্থ রক্ষিত হোক, তা আমাদেরও কাম্য। কিন্তু তা জনস্বার্থে ও জনকল্যাণের জন্যেই হওয়া চাই,অবাঙালি বুর্জোয়াকে তাড়িয়ে বাঙালি বুর্জোয়ার সুবিধে করে দেবার জন্যে নয়। আগে একবার বেরাদরানে ইসলাম-এর মোহে পড়ে ঠকেছি, আবার বাঙালি ভাইয়ের মমতায় পড়ে প্রতারিত হতে চাইনে। স্বার্থের জন্যে আমরা বাপ-ভাইয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব করতে দ্বিধা করিনে। বাঙালি ভাইকে পুঁজিপতি ও ধনপতি করবার জন্যে নিজের প্রাণ দেবার মতো নির্বোধ থাকা এ-যুগে নৈতিক অপরাধ ও শোচনীয়রূপে বেদনাকর। জনগণের এমনি অজ্ঞতা ও ঔদাসীন্যের সুযোগে চিয়াঙকাইশেকরা চীনে রাজত্ব করেছিল; স্বদেশী স্বজাতি বেরাদরের শোষণ থেকে গণমানব মুক্তি খুঁজেছিল অন্য পন্থায়। চিয়াঙকাইশেকরাও সেদিন গণস্বার্থ রক্ষার ভাওতা দিয়ে বিদেশী বিতাড়নে জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনে হয়েছিল গণনেতা। তারপর ক্ষমতা হাতে পেয়ে তারা স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে।

আর গণমানবেরা দেখল তারা প্রতারিত, শোষিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত এবং স্বদেশী ও বিদেশী শাসনে পার্থক্য নগণ্য। স্বদেশী বা বিদেশী শাসন এ-যুগে বড় সম্পদ বা সমস্যা নয়, এ-যুগে বঞ্চক বঞ্চিত সম্পর্ক সব সমস্যার মূলে। বঞ্চিত জনের কল্যাণ চিন্তাই, তার শোষণ ও দারিদ্র মুক্তিই এ যুগের রাষ্ট্র-ভাবনার একমাত্র বিষয়। বুর্যোয় স্বার্থের সংগ্রামকে গণ-সংগ্রাম বলে চালিয়ে দেয়ার দিন অপগত-প্রায়–এই প্রত্যয় নিয়ে মানুষের রাষ্ট্র-সাধনা ও রাজনৈতিক সংগ্রাম গণ-মুক্তি ও গণ কল্যাণে নিয়োজিত হবে–এই আশ্বাসে ও অঙ্গীকারে আমরা সুদিনের প্রতীক্ষারত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *