ভাষা প্রসঙ্গে : বিতর্কের অন্তরালে

ভাষা প্রসঙ্গে : বিতর্কের অন্তরালে

০১.

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই ভাষার প্রশ্নটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। শিক্ষায় ও সম্পদে অগ্রসর সাবেক যুক্তপ্রদেশের নেতারা ও পদস্থ কর্মচারীরা এবং পাঞ্জাবের মুসলমান জমিদাররা ও পদস্থ চাকুরাই পাকিস্তানে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব লাভ করে। এদের ভাষা ছিল উর্দু। পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো আঞ্চলিক বুলিই তখনো লেখ্য ভাষা হিসেবে প্রয়োজনানুরূপ বিকাশ পায়নি। তার উপর পাকিস্তানভুক্ত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনসমাজে তখনো অশিক্ষার অন্ধকার বিদ্যমান।

উর্দুভাষী শাসক-প্রশাসকেরা যখন কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের সুযোগে তাদের মাতৃভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে জনগণের উপর চাপিয়ে দিতে কৃতসংকল্প, তখন প্রায়-বুলি-নির্ভর পশ্চিম পাকিস্তানীদের আপত্তির কোনো কারণ ঘটেনি। তাছাড়া নতুন রাষ্ট্রপ্রাপ্তির উল্লাস এবং বিজাতি বিদ্বেষজাত ইসলামী বেরাদরী ভাবটাও ছিল তখন জনমনে প্রবল। পূর্ব-বাঙলার একশ্রেণীর শিক্ষিত লোকেরও ছিল এই বেরাদরী উদারতা ও হিন্দুভীতি। তারাও হিন্দুস্তানী ও পাঞ্জাবী বেরাদরের প্রতি সর্বব্যাপারে ছিল শ্রদ্ধাবান ও নির্ভরশীল। তার উপর, জিন্নাহর কায়েদে আযম নামের ফাঁকে একটা personality cult বা ব্যক্তিপূজার প্রবণতা জনসমাজে গভীর ও ব্যাপক রূপ নিয়েছিল। উর্দুভাষী অনুচরদের প্রভাবে গুজরাটী-ভাষী জিন্নাহও উর্দুর পক্ষে রায় দিলেন। কাজেই অনুগ্রহজীবী বাঙালি নেতারাও এদের কেউ কেউ ছিলেন উর্দুভাষী] জুটে গেলেন উর্দুর দলে। বাকি রইল বাঙলার ছাত্র, সাহিত্যিক ও তরুণ বুদ্ধিজীবীরা। ছাত্রদের সক্রিয় সংগ্রামে অবশেষে বাঙলা মৌখিক স্বীকৃতি পেল, কিন্তু অকপট অন্তরে গৃহীত হল না অবাঙালি সমাজে। তার গূঢ় কারণ ছিল।

.

০২.

মাতৃভাষার প্রতি নিছক প্রীতিবশেই তারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চায়নি, চেয়েছিল সাম্রাজ্যিক স্বার্থলোভে। কেননা তারা জানত স্বাধর্মের নামে বিধর্মী-বিদ্বেষ জাগিয়ে সাময়িক সাফল্য অর্জন সম্ভব হলেও বৈষয়িক ব্যাপারে এ কখনো স্থায়ী প্রেরণার আকর হতে পারে না। কাজেই বিধর্মী বিদ্বেষপুষ্ট ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধের উত্তেজনা দুই বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে সাময়িক সংহতি দান করলেও তা নিতান্ত নশ্বর। অতএব পরিণাম ভেবেই তারা সাম্রাজ্যবাদীর সাম্রাজ্যিক নীতি গ্রহণ করে শোষণের স্থায়ী ব্যবস্থা রাখার উদ্দেশ্যেই। ইতিহাস বলে এবং সবাই জানে, কেবল বাহুবলে শাসন শোষণ কায়েম রাখা চলে না। শাসিত জনকে অনুরক্ত করেই আনুগত্য আদায় করতে হয়। এর পরীক্ষিত ও অমোঘ ফলপ্রসূ উত্তম উপায় হচ্ছে, নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে শাসিত জনের মনে-মেজাজে একপ্রকার মুগ্ধতার কুয়াশা রচনা করা। শাসকজাতির ভাষার মাধ্যমে তাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, দর্শন ও ইতিহাস শাসিত জনের মনে মাকড়সার জাল তৈরি করে, তার ফলে শাসকগোষ্ঠীর প্রতি শাসিতজন শ্রদ্ধাবান ও সহিষ্ণু হয়ে উঠে। ধনের, মানের ও মর্যাদার ক্ষেত্রে শাসিতজনের হীনমন্যতা এবং শাসকগোষ্ঠীর উত্তমন্যতাও এ ক্ষেত্রে আনুকূল্য করে। চিরকাল এমনি উদ্দেশ্যে বিদেশী শাসকরা শাসিতজনের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে বা তার বিকাশ রুদ্ধ করে নিজেদের ভাষা ও বর্ণমালা চালু করেছে। এর ফলে শাসিতজনের বুদ্ধি হয় আড়ষ্ট, চিন্তাশক্তি পায় হ্রাস, দৃষ্টি হয় আচ্ছন্ন, মন থাকে অনুরক্ত। এমনি অবস্থায় আনুগত্যের স্বস্তিই হয় প্রজার কাম্য। প্রতীচ্যবিদ্যার ও সংস্কৃতির প্রভাবে এদেশের শিক্ষিত সাধারণেও ব্রিটিশ-প্রীতি এমনি গাঢ় হয়ে উঠেছিল বলেই সিপাহী-বিপ্লব কালে তা যে শুধু নিষ্ক্রিয় ছিল তা নয়, ইংরেজদের বিপর্যয়ে উদ্বিগ্নও হয়েছিল এবং ব্রিটিশ-বিজয়ে তাদের উল্লাসের সীমা ছিল না। অতএব শাসিত-মনে জরা ও জীর্ণতা দানের মোক্ষম উপায় হচ্ছে তাদের ভাষা কেড়ে নেয়া এবং শাসকগোষ্ঠীর ভাষা চালু করা।

.

০৩.

গোড়া থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা অবচেতনভাবেই উপলব্ধি করেছিল পূর্ব বাঙলা হবে তাদের খাজনা উসুলের জমিদারী এবং শুল্ক আদায়ের বন্দর–একটি অনায়াসলব্ধ উপনিবেশ। ভেততা ও ভীতু বাঙালি নেতাদের প্রাণী বিশেষের মতো আনুগত্য তাদের লোভ ও ঔদ্ধত্য বাড়িয়ে দিয়েছিল। তারা লক্ষ্য করেছিল, বাঙালিরা তখন বেরাদরীভাবে বিগলিত। সামরিক ও বেসামরিক চাকরির ব্যাপারে, ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিংবা আঞ্চলিক উন্নয়ন প্রকল্পে তাদের ন্যায্য দাবি উত্থাপনে তারা পরম উদারতায় উদাসীন। এই ঔদাসীন্য যেন চিরস্থায়ী হয়, তার জন্যে তারা নানা ছলাকলা উদ্ভাবনে সদাতৎপর। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ইসলাম। দেশে অমুসলমান প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, তবু বাঙালির স্থায়ী আনুগত্য লাভের দুরাশা বশে তারা বাঙালির মনে ইসলামী উত্তেজনা জাগিয়ে রেখে, তাদের মনে বিধর্মী-বিদ্বেষকে তথা হিন্দু-ফোবিয়ায় স্থায়িত্ব দানে প্রয়াসী, তার আনুষঙ্গিক উপসর্গ হচ্ছে মুসলিম তমদুনের ধুয়া। আর তমদুন রক্ষার জন্যে প্রয়োজন ইসলামী সাহিত্য এবং তা মিলবে উর্দুভাষায় ও সাহিত্যে এবং আরবি ফরাসি শব্দে। আবার এই উর্দুভাষা ও আরবি-ফরাসি শব্দ অনায়াস আয়ত্তে পেতে হলে উর্দু হরফে (বিকল্পে রোমান হরফে) বাঙলা লেখা প্রয়োজন।

এ সহজ সদ্বুদ্ধি যদি কুফরী মন না-ই গ্রহণ করে, তবে অন্তত কিছু হরফ বর্জন করে, বানান সরল করে বাঙলা ভাষাকে বিকৃত কর, যাতে তা পৃথক রূপ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গীয় কাফের-প্রভাব থেকে মুক্ত হয়। অতএব, উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার অভিপ্রায়, এবং সে-প্রয়াসে ব্যর্থ হয়ে হরফ বদলানো, বানান পাল্টানো, আরবি-ফারসি শব্দ বসানো প্রভৃতির অভিসন্ধি মূলত এই ষড়যন্ত্রে সিদ্ধি-লক্ষ্যে প্রযুক্ত। পোষা হাতি দিয়ে বুনো হাতি বাধার মতো এসব অপকর্মে যারা নিয়োজিত, তারা আমাদেরই পরিজন। এজন্যে ষড়যন্ত্রের স্বরূপ সরল সাধারণ বাঙালির কাছে স্পষ্ট নয়। তাই তারা বিভ্রান্ত ও প্রতারিত।

.

০৪.

বাঙালি-মনে জড়তা ও জীর্ণতা দানের গোপন উদ্দেশ্যে তারা যেসব পন্থা উদ্ভাবন করেছে এবং জাতীয় জীবন বিকাশে সেসবের উপযোগ ও ফলপ্রসূতা প্রমাণের জন্যে তারা সাধারণত যেসব যুক্তি উপস্থাপিত করে, আমাদের মন্তব্য-সমেত সেগুলো এখানে তুলে ধরছি :

১. তারা বলে বাঙলা আরবি-ফারসি শব্দ-বহুল ছিল। উনিশ শতকে পাদরী ও পণ্ডিতের ষড়যন্ত্রে বাঙলা সংস্কৃতি-ঘেঁষা হয়ে উঠেছে। এর মূলে কোনো সত্য নেই। পনেরো শতকের শাহ মুহম্মদ সগীর থেকে উনিশ শতকের প্রথমার্ধের কবি চুহর অবধি কবির লিখিত রচনায় এবং গোপীচাঁদ-ময়নামতীর গান, পূর্ববঙ্গ-ময়মনসিংহগীতিকা, বাউলগান থেকে অল্পশিক্ষিত আজকের কবির মৌখিক রচনা অবধি কোথাও আরবি-ফরাসি শব্দবহুল বাঙলার নমুনা মেলে না।

হাওড়া-হুগলী-কোলকাতা-মুর্শিদাবাদ অঞ্চল ছিল আন্তর্জাতিক ও আন্তরাঞ্চলিক বাণিজ্যকেন্দ্র। য়ুরোপীয়রা ছাড়াও ভারতের, ইরানের ও মধ্য-এশিয়ার লোক এখানে বাস করত। ফারসি ও হিন্দি ছিল Lingua Franca ভাব বিনিময়ের ভাষা। স্থানীয় বাঙলার সঙ্গে ফারসি-হিন্দির মিশ্রণে গড়ে উঠে খিচুড়ি বাঙলা। এর উদ্ভব ও প্রকৃতি অবিকল দাখিনী উর্দু ও উত্তর ভারতীয় উর্দুর মতোই। এটি ছিল বন্দর এলাকার সঙ্কর বাঙালির বুলি। উক্ত অঞ্চলের বাইরে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। সত্যপীর পাঁচালী প্রণেতা এই অঞ্চলের হিন্দু কবিরা সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দীন হোসেন শাহর বংশোদ্ভব বলে কথিত সত্যপীরের মুখে বিকৃত হিন্দুস্থানী বুলি প্রয়োগ শুরু করেন সতেরো শতক থেকেই। এঁদের অনুকরণে ১৭৬০ সনের পরেরকার কবি হুগলী বন্দরের শায়ের ফকির গরীবুল্লাহ বাঙলা ও হিন্দুস্থানী বাক্রীতির মিশ্রণে কাব্যরচনা করেন। তাকে অনুসরণ করেন হাওড়াবাসী কবি সৈয়দ হামজা। উনিশ ও বিশ শতকে এ অঞ্চলের মালে মুহম্মদ, জনাব আলী, রেজাউল্লাহ, মুহম্মদ খাতের, মুহম্মদ দানিশ, আবদুল মজিদ প্রভৃতি প্রায় শত পেশাদার শায়ের উক্ত মিশ্ররীতি প্রয়োগে অনুবাদমূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন।

উনিশ শতকের শেষার্ধে মীর মশাররফ হোসেন, রিয়াজ আল দীন, মাশহাদী প্রমুখ মুসলিম লিখিয়েরা এর নাম দেন দোভাষী রীতি। বিশ শতকে হিন্দুরা এর নাম রাখেন মুসলমানী বাঙলা। আর ১৯৪০ সনের পরে মুসলমানরা এ সাহিত্যের নাম দেন পুথি-সাহিত্য। কোলকাতার ছাপাখানার বদৌলতে এগুলো সারা বাঙলা দেশে প্রচার লাভ করে। বিকল্প পাঠ্যগ্রন্থের অভাবে গ্রাম-বাঙলার স্বল্পশিক্ষিত ও অশিক্ষিত মুসলমান শোধ্ব বছর ধরে এগুলো পড়েছে–শুনেছে বটে, কিন্তু এর বাীতি বা ভাষার দ্বারা কোথাও কেউ কখনো প্রভাবিত হয়নি। প্রমাণ পুথিসাহিত্য পড়য়া গ্রাম্য বাঙালির রচিত গান-গাথা, কবিতা এবং কথাবার্তা।

 পূর্বোক্ত অঞ্চলে ছাড়া অন্যত্র বাঙলা ভাষায় যে আরবি-ফারসি শব্দ বিরল ছিল, তা কেবল হালহেড় বা ফরস্টারের উক্তি থেকেই নয়, কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ কিংবা ব্রাহ্মণ রোমান ক্যাথলিক সম্বাদ-এর ভাষা থেকেও প্রমাণিত। উক্ত বন্দর ও শাসন-কেন্দ্রের সঙ্কর বাঙালিরা ছাড়াও দরবারীভাষা ফারসি শিক্ষিত অসাহিত্যিক বাঙালিরা কথাবার্তায় ও বৈষয়িক চিঠিপত্রে, দলিল দস্তাবেজে দেদার ফারসি শব্দ ব্যবহার করত, এখনকার অসাহিত্যিক রচনায় কিংবা কথাবাতায় ইংরেজি শিক্ষিত লোকেরা যেমন অজস্র ইংরেজি শব্দ প্রয়োগ করে। তাই বলে গ্রাম-বাঙলার অশিক্ষিত মানুষকে পূর্বে ফারসি এবং এ যুগে ইংরেজি ভাষা প্রভাবিত করেছে বললে সত্যের অপলাপই হয়। প্রমাণস্বরূপ বলা চলে বাঙলার পল্লী অঞ্চলের মুসলমান নারী-পুরুষদের যারা পুরুষানুক্রমে চিরকাল নিরক্ষর, তাদের উপর নিশ্চয়ই উনিশ শতকের পাদরী ও পণ্ডিতের কিংবা এ যুগের পুস্তকী ভাষার প্রভাব পড়ার উপায় ছিল না বা নেই। তবে তাদের আঞ্চলিক বুলিতে শাস্ত্রীয় কিংবা সরকার সম্বন্ধীয় পরিভাষা ব্যতীত অন্য আরবি-ফারসি-হিন্দির প্রভাব নেই কেন!

২. তারা আরবি-ফারসি শব্দের মধ্যেই ইসলাম ও তমদুনের স্থিতি প্রত্যক্ষ করে। অথচ এ দুটোই ইসলাম-পূর্ব যুগের পৌত্তলিক-বেদীনের ভাষা। তবু আল্লাহ ও ইলাহী শব্দদুটোকে নতুন তাৎপর্যে গ্রহণ করতে অসুবিধে হয়নি। সাকার সকন্যা দেবতা মুহূর্তে নিরবয়ব স্রষ্টার ভাবরূপ লাভ করেছেন মুসলিম মনে, এমনকি ইসলামী অঙ্গীকারের মৌল শব্দগুলো–আল্লাহ, রসুল, মক, জান্নাত, জাহান্নাম, সালাত, সিয়াম প্রভৃতি ইরানে খোদা, পয়গম্বর, ফেরেস্তা, বেহেস্ত, দোজখ, নামায, রোযা রূপে অনূদিত ও গৃহীত হয়েছে। পাক-ভারতে ইরানী পরিভাষাই গৃহীত হয়েছে, তৎসঙ্গে খোদার দেশী পরিভাষাও যুক্ত হয়েছিল : নিরঞ্জন, নাথ, ধর্ম, করতার এবং বেহেস্ত দোজখও হয়েছিল স্বর্গ ও নরক।

উল্লেখ্য যে একটি আরবি শব্দও সরাসরি পাক-ভারতের ভাষায় গৃহীত হয়নি। সব কয়টিই এসেছে ফারসির মাধ্যমে। আর উর্দু বলে কোনো ভাষা ছিল না বা নেই। বৈদিক ভাষার উত্তরভারতীয় আঞ্চলিক বুলিতে ফারসি শব্দের আধিক্যে ও ফারসি হরফ প্রযুক্ত হয়ে গড়ে উঠেছে আধুনিক উর্দু। উর্দু নামটাই অর্বাচীন। এটি একটি মঙ্গোলীয় শব্দ, অর্থ সৈন্য-শিবির। সামরিক বাহিনীর তথা সৈন্য-শিবিরের Lingua Franca অর্থে চালু হল এটি।

বিদেশাগত শাসক-প্রশাসক ও তাদের অনুচরেরা প্রয়োজনানুরূপ দেশী শব্দ আয়ত্ত করার অসামর্থবশে উত্তরভারতীয় ভাষায় তুর্কী-ফারসি শব্দের বহুল প্রয়োগে ভাব প্রকাশ করত এবং দেশী হরফ শিক্ষার ঝামেলা এড়িয়ে ফারসি হরফে পরবর্তীকালে লেখাও শুরু করল। এভাবে ফারসি শব্দবহুল এবং ফারসি হরফে লিখিত একটি ভাষা দাঁড়িয়ে গেল। তবু জাতি বিচারে উর্দু একটি আধুনিক ভারতীয় আর্য ভাষা। কেননা শব্দ দিয়ে ভাষার জাতি নির্মিত হয় না, হয় বাক্য-গঠন রীতি বা ব্যাকরণ দিয়ে। তাছাড়া শব্দের দিক দিয়ে পৃথিবীর যাবতীয় ভাষাই–সভ্যজাতির ভাষা মাত্রই মিশ্র। অবশ্য ফারসিও যে বৈদিকি ভাষার জ্ঞাতি-পহ্লবী ভাষার আধুনিক রূপ, তাও এ সূত্রে স্মর্তব্য। প্রমাণস্বরূপ বলা চলে ষোলো শতকের উত্তরভারতীয় কবি কুতবন, মালিক মুহম্মদ জায়সী, মিয়া সাধন, এয়ারী, কবীর, দাদু, রজব, দরিয়া প্রমুখ সবাই আঞ্চলিক হিন্দিতে নাগরী হরফেই কাব্য রচনা করেছেন, তখনো ঐ রিখতার ভাষা ছিল হিন্দবী (আমীর খুসরু) দাখানী (দাক্ষিণাত্যে) দেহলবী (আবুল ফজল), হিন্দি বা গুজারী বা গুজরাটী (গুজরাটে)। শিবিরের ভাষা হিসেবে উর্দু নাম সতেরো শতকের শেষের দিকে সৈন্য-সমাজে হয়তো চালু হয়েছিল।

আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে উর্দু নাম সাধারণ্যে চালু হতে থাকলেও উনিশ শতকের আগে এ নাম সর্বজনগ্রাহ্য বা তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। আঠারো শতকেও উর্দু গদ্য হিন্দি নামে এবং উর্দু কবিতা রিখতা নামে পরিচিত ছিল। স্যার সৈয়দ আহমদের পত্ৰসূত্রে জানতে পাই উনিশ শতকের শেষার্ধেও দিল্লী থেকে বিহার অবধি অঞ্চলের ভাষার নাম ও হরফ নিয়ে হিন্দু-মুসলমানে দ্বন্দ্ব-বিরোধ ছিল। হিন্দুরা ছিল হিন্দি-নামের ও নাগরী হরফের পক্ষপাতী আর মুসলমানেরা ছিল উর্দু নামের ও ফারসি হরফের অনুরক্ত। আরো দুটো তথ্য স্মর্তব্য : ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের জন গিলাইস্টের প্রবর্তনাতেই উর্দুভাষা স্বাতন্ত্র্য লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেছে এবং এ ভাষা মুসলিম রাজশক্তির ও সংস্কৃতির পতন যুগেই বিকাশ লাভ করে। অতএব, এটি উজ্জীবিতের নয়, নির্জিতের ভাষা ও সাহিত্য। এ কারণেই সম্ভবত প্রখ্যাত মুসলিম কবিদের শ্রেষ্ঠ রচনার বাহন হয়েছে ফারসি-উর্দু নয়।

৩. এদের আর একটি যুক্তি : উর্দুভাষা ইসলামী শাস্ত্র, সাহিত্য ও তমদুনের আকর।

ভাষার গুণেই কী ধর্মীয় শাস্ত্র, সাহিত্য ও তমদুন গড়ে উঠে? ধর্মভাব থাকে মনে, তা-ই প্রকাশিত হয় ভাষায় ও আচরণে। মুসলমানের অভিপ্রায় ও প্রচেষ্টাতেই আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় ইসলামী শাস্ত্রগ্রন্থ রচিত হয়েছে। অমুসলমানের আগ্রহে যেমন ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান ভাষায় রচিত হয়েছে ইসলাম ও মুসলিম সাহিত্য, দর্শন ও ইতিহাস সম্পর্কিত নানা গ্রন্থ। বাঙলায় যে শাস্ত্রগ্রন্থ নেই–এ-তথ্যই বা তারা সংগ্রহ করল কিরূপে? আর যদি না-ই থাকে, তাহলে প্রয়োজনবোধে বাঙলায় ইসলামী শাস্ত্র, সাহিত্য, ইতিহাস ও দর্শন গ্রন্থ রচনা করতে ভাষাগত কিংবা স্থানগত বাধা আছে কি?

মানুষের মনের যে ভাব-ভাবনা জেগে উঠে, তা-ই তার ভাষায় লিখিত বা রচিত রূপে প্রকাশ পায়। বাঙালি যদি ইসলাম চর্চায় মনোযোগী হয়, সে প্রয়োজন অনুভব করে, তাহলে অন্যান্য বিষয়ে যেমন সে গ্রন্থ রচনায় সমর্থ, এ বিষয়েও সে কাজ করবে, বই লিখবে, বাইরের লোকের এ ব্যাপারে মুরুব্বিয়ানা অহেতুক। কেননা বাঙালি মুসলমানরা হাজার বছরের পুরোনো মুসলমানের বংশধর। ইসলামের কী তার অজানা রয়েছে যে, সে রাজনৈতিক কারণে নতুন পীরের মুরিদ হবে? তাছাড়া নিছক ধর্মীয় কোনো তমদুন থাকতে পারে না। তাই যদি হত, তাহলে ভূগোল ও কাল নিরপেক্ষ একটি নিবর্ণ ও চিরন্তন বিশ্বমুসলিম সংস্কৃতি থাকত। দেশান্তরে ও কালান্তরে তা রূপান্তর লাভ করত না। বস্তুত দেশ-কাল-ব্যক্তি নিরপেক্ষ এবং শৈক্ষিক, আর্থিক, সামাজিক ও নৈতিক প্রতিবেশবিরহী কোনো সংস্কৃতি কল্পানাতীত। সংস্কৃতি তাই স্বরূপত ব্যক্তিক ও অবস্থানিক বা পারিবেশিক। ইসলামে অনুরাগই যদি উর্দুপ্রীতির কারণ হয়ে থাকে, তাহলে আরবিকেই আমাদের রাষ্ট্রভাষা করা উচিত। স্মর্তব্য যে আরবি-ফারসি কিংবা উর্দুর সবটা শাস্ত্রীয়ও নয়, সু-মুসলমানের রচনাও নয়। আজো উক্ত তিন ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখকেরা সব মুসলিম নন। আজো আরবিভাষী লোকের শতকরা পনেরো জন খ্রীস্টান ও ইহুদী। উর্দুও কেবল মুসলমানের দানে ঋদ্ধ হয়নি। কাজেই আরবি-ফারসি শব্দ ও সাহিত্য মাত্রই ইসলামী নয়, একাধারে অমুসলিমেরও। অতএব বাঙলা ভাষার নিন্দা-কলঙ্ক রটানোর মূলে অভিসন্ধিই ক্রিয়াশীল। ন্যায়ত সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাঙলাই হওয়া উচিত ছিল পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। বেরাদরীভাবে বিগলিত আত্ম-প্রত্যয়হীন হীনমন্য ও প্রভুগত প্রাণ বাঙালিরা সে-কথা ভাবতেও সাহস পায়নি। ফলে উত্তরভারতের ভাষা আপাতত আসন জুড়ে বসেছে পাকিস্তানে। এ অন্যায়েরও জবর-দখলের পক্ষে নৈতিক সমর্থন সঞ্চয়ের জন্যেই এত ছল-চাতুরীর আশ্রয় ও প্রশ্রয় জরুরি হয়েছে।

বলেছি, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালে উর্দুকে অস্বীকার করবার মতো ভাষার ঐশ্বর্য ছিল না পশ্চিম পাকিস্তানীদের। আজ তারাও মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে তাদের অনলস সাধনায় তারা স্ব স্ব ভাষাকে অনেকখানি উন্নত করেছে। কাজেই আত্মপ্রত্যয় নিয়ে কথা বলবার মতো নৈতিক ভিত্তিও রচিত হয়েছে তাদের। এর মধ্যেই সিন্ধি, সারাইকী, পশতু ও বেলুচ ভাষীরা ভাষার ক্ষেত্রে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে তারা আত্মসম্মানবোধে ও পরিণাম চিন্তায় বিচলিত। তাই তারা আজ প্রবুদ্ধ ও উচ্চকণ্ঠ। আজ যখন পাকিস্তান প্রাপ্তির উচ্ছ্বাস ও উল্লাস অপগত, আর স্ব-ভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে সবাই সচেতন এবং উর্দুও যখন রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আজো স্বপ্রতিষ্ঠিত নয়, তখন পাকিস্তানে উর্দুর ভবিষ্যৎ নতুন করে যাচাই করার সময় এসেছে। রাষ্ট্রভাষা হিন্দির বিরুদ্ধে দাক্ষিণাত্যে যেমন, উর্দুর বিরুদ্ধেও তেমনি প্রতিবাদী দল অচিরেই পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে উঠবে–সে আশঙ্কা অমূলক নয়। ইতিমধ্যেই তার আভাস সুপ্রকট। পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্বতন প্রদেশগুলোর পুনঃপ্রতিষ্ঠা এ আশঙ্কাকে প্রবল করছে। কেননা, প্রদেশগুলোর সংস্থিতি ভাষা-ভিত্তিক।

.

০৫.

বাঙলা ভাষার সংস্কার-প্ৰয়াস সরকারি-উদ্যোগেই শুরু হয়েছিল। শিশুরাষ্ট্র পাকিস্তানে তখন অনেক সমস্যা ছিল। বাঙলা ভাষার হরফ ও বানান কোনো সমস্যা ছিল না, তবু অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বাঙলা ভাষা সম্পর্কিত একটি কাল্পনিক সমস্যার সমাধান সরকারি অফিসে অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছিল। তারই ফলে ভাষা-সংস্কার কমিটিগুলো পর পর গড়ে উঠে–সরকারি কমিটি, বাঙলা একাডেমী কমিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি ও ব্যক্তিগত প্রয়াস চারদিক মাতিয়ে তোলে। ঐদিকে আরবি হরফে বাঙলা লেখানোর অভিযানও সরকারি অর্থে চলতে থাকে। প্রয়াসটা যে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রমূলক তা বুঝতে কারো বাকি থাকল না। উক্ত সব কমিটির সদস্যদের সবাই ভাষাবিদও ছিলেন না। সবচেয়ে বেদনাদায়ক ও ক্ষোভজনক আনাড়ির অনধিকার চর্চার আগ্রহ। অতএব কলকাঠি ঘুরাচ্ছিল যারা, তারা ছিল নেপথ্যে; পুতুল ও যন্ত্ররূপে যাদের সুমুখে দেখেছি, তাঁরা আমাদের ঘরের লোক–অনেকেই শ্রদ্ধেয়। তাই জনমনে প্রভাব পড়েছিল তাদের। এই কপট হিতৈষীরা তাই আজো নির্বিঘ্নে ভাষা সংস্কার রূপ মহাসমস্যা নিয়ে উদ্ব্যস্ত ও উদ্বিগ্ন। মাঝে মাঝে তারা দুঃস্বপ্নের মতো জেগে উঠেন। আতঙ্কিত করেন আমাদের। এর পশ্চাতে মূল উদ্দেশ্য বাঙলা ভাষাকে বাঙালির মতানৈক্যের সুযোগে রাষ্ট্রভাষার অধিকারচ্যুত করা। আর আনুষঙ্গিক উদ্দেশ্য রোমান হরফ বা আরবি হরফ চালু করে এর বিকৃতি সাধন করে বিকাশ-পথ রুদ্ধ করা এবং তৎসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বাঙলা ভাষার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া।

১. তাঁরা বলেন, শব্দের বানান উচ্চারণ অনুযায়ী হওয়া উচিত। প্রশ্ন জাগে, পূর্ব বাঙলার কোনো দুটো অঞ্চলের উচ্চারণ এরকরম নয়। ভাষাবিজ্ঞান বলে–কোনো দুটো মানুষই অবিকল একরকম উচ্চারণ করতে পারে না। এমনকি কোনো মানুষের পক্ষেই কোনো শব্দ একই রূপে দুবার উচ্চারণ করাও সম্ভব নয়। তাহলে তারা কোন অঞ্চলের কোন্ ব্যক্তির উচ্চারণ অনুযায়ী বানান-পদ্ধতি নির্মাণ করবেন? তাছাড়া, যেহেতু উচ্চারণ জনে-জনে, স্থানে স্থানে ও কালে কালে বদলায়, সেহেতু উচ্চারণের অনুগত করে বানান সংস্কার করতে হলে প্রায় প্রতিজনের জন্যে ও প্রতিস্থানে এবং প্রতি পঞ্চাশ বছরে বর্ণ ও বানান বদলাতে হবে। তাহলেই কেবল বিজ্ঞান সম্মত সংস্কার সম্ভব। দুনিয়ার কোথাও কখনো শব্দের বানান উচ্চারণ-অনুগ হয় না।

উপরোক্ত কারণে হতে পারে না বলেই হয় না। লেখ্য ভাষার মাধ্যমেই এক দেশের মানুষ পরস্পরের সঙ্গে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক ও ঐতিহ্যিক জ্ঞাতিত্ব রক্ষা করে। কেননা আঞ্চলিক বুলি প্রতিমুহূর্তে রূপান্তর লাভ করছে ও দেশের মানুষকে পারস্পরিক আত্মীয়তা ঘুচিয়ে স্বাতন্ত্র্য দান করছে। সেই লেখ্য ভাষার জোর নিহিত থাকে তার দীর্ঘকালীন অপরিবর্তনীয়তায়। অতএব, লেখ্য ভাষা মাত্রেই কৃত্রিম। কাজেই সাধারণ অর্থে মাতৃভাষা বলতে যা বুঝায়, আসলে এ তা নয়। বুলির মতো এ শৈশবে লভ্য নয়। একজন বিদ্বান বলেছেন, মাতৃভূমি মানে যেমন মামার বাড়ি নয়, মাতৃভাষাও তেমনি মায়ের মুখের বুলি নয়। অন্যান্য বিদ্যার মতো লেখ্য ভাষাও একটি বিদ্যা এবং তা অনায়াসলভ্য নয়। অন্যান্য শাস্ত্রের মতো ভাষাও পরিশ্রম করে আয়ত্ত করতে হয়।

২. তাঁদের আর একটি যুক্তি–কিছু বর্ণ বর্জন করে বানান সংস্কার করলে, শিক্ষার্থীর পক্ষে ভাষা শেখা সহজ হবে। কিন্তু তাতেই কী বানান ভুলের খপ্পর থেকে বাঁচা যাবে? বাধাকে-বাঁধা, চোরকে–চুর, বিধাতাকে–বিদাতা, বাড়িকে–বারি, ঘনিষ্ঠকে–ঘনিষ্ট, সম্বন্ধকে সম্মন্দ লেখার বিড়ম্বনা থেকে শিক্ষার্থীরা উদ্ধার পাবে কী করে? আসল কথা: শিখবার, জানবার, বুঝবার যোগ্যতা ও আগ্রহ যাদের থাকে তারাই কেবল ভাষা সমেত যে-কোনো বিদ্যা আয়ত্ত করতে পারে।

কেউ কেউ বলেন Type, Telegraph ও stenography-র জন্য বর্ণসংখ্যা কমানো দরকার। যন্ত্র তো আমাদের প্রয়োজনেই তৈরি। যন্ত্রকে আমরা আমাদের অনুগত করে নেব, আমরা কেন যন্ত্রের অনুগত হব? আরবি-উর্দু হরফের রয়েছে শব্দের আদ্যে-মধ্যে-অন্ত্যে তিনটি ভিন্ন রূপ। ইংরেজিরও Capital ও small letter যেমন রয়েছে, তেমনি হস্তাক্ষর পায় একেবারে ভিন্ন। অবয়ব। তাছাড়া ইংরেজির কয়েকটি বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি বিভিন্ন উচ্চারণে ব্যবহৃত হয়। যেমন, C ক, চ, Th—ত,দ, ghফ,উহ্য,ch–চ, ক, ou-আ, E–আ, এ, ই, a–এ্যা, আ, ই, আই, ইত্যাদি। এছাড়াও বর্ণের উচ্চারণ উহ্য তো থাকেই। কোনো ইংরেজি শব্দের উচ্চারণ বানান অনুগ নয়। তবু আমরাই এ বিদেশী ভাষার প্রত্যেকটি বানান নির্ভুলভাবে আয়ত্ত করেছি! বাঙলা বর্ণমালা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সাজানো, প্রত্যেকটা বর্ণ উচ্চারণসাধ্য। কেবল জ+ঞ=জ্ঞ ব্যতীত আর কোথাও বানানে ও উচ্চারণে অসঙ্গতি নেই। আধুনিক মুদ্রণালয়ে যুক্তবর্ণের অবয়ব সংস্কারের ফলে ব্যঞ্জন বর্ণগুলো প্রায় সর্বত্রই অবিকৃত ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কেবল স্বরবর্ণের কার ও কয়েকটি ব্যঞ্জনবর্ণের ফলা-ই যা ব্যতিক্রম।

৩. তাঁদের কাছে, ত-২, ই-ঈ, উ-ঊ, ঋ-র, ন-ণ, জ-য, খ-ক্ষ, ঙ-ং, ব-ভ মহাসমস্যার বিষয়। অথচ সব ভাষাতেই এমনি আপাত ঐক্যের পৃথক বর্ণ রয়েছে। ইংরেজিতে g-j-z, c-k, a-u-e, j-s, F-gh, x-ks, ct, cz ইত্যাদি এবং আরবিতে রয়েছে জিম-জাল-ডাল-জে-জোয়াই, কাফ কোয়াফ, হে-হামজা, আলিফ-আইন ইত্যাদি। তাছাড়া কৃত্রিম স্বর-চিহ্ন যুক্ত না হলে যে-কোনো স্বর যোগে আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দের শুদ্ধ-প্রতিম বিকৃত উচ্চারণ সম্ভব।

৪. পাকিস্তানে সম্প্রতি চারটি ভাষা শিক্ষা আবশ্যিক। শাস্ত্রীয় ভাষা আরবি, সরকারি ভাষা ইংরেজি এবং রাষ্ট্রভাষা উর্দু ও বাঙলা। কেবল বাঙলা বানান সংস্কার করে কোনো লাভ হবে না, করতে হলে উক্ত চারটি ভাষারই উচ্চারণ-অনুগ বানান সংস্কার করতে হবে। তাহলেই আমাদের মহৎ জাতীয় উদ্দেশ্য সফল ও সার্থক হবে। অর্থাৎ উক্ত চার ভাষারই একটি করে পাকিস্তানীরূপ রচনা করতে হবে। তা কেবল পাকিস্তানীর হিতার্থে পাকিস্তানেই চলবে। যদি বিদেশী ভাষা বলে ইংরেজি, আরবি, উর্দু ভাষা সংস্কারে আমাদের অধিকার না থাকে, তাহলে বাঙলাতেও কী সে অধিকার থাকে? কেননা, পাকিস্তানের বাইরেও বাঙলা ভাষার মালিক আছে। অতএব, অপর তিনটে ভাষাই যখন যথাপূর্ব সকল জটিলতা ও অসঙ্গতি নিয়ে আমাদের শিক্ষার অঙ্গীভূত রয়েছে, তখন বেচারা বাঙলাকেও দয়া করতে বাধা কি?

৫. তাছাড়া, লেখ্য ভাষার প্রয়োজন কেবল শিক্ষার্থী ও শিক্ষিত লোকেরই। শিক্ষার্থীর শিক্ষা কেবল ভাষার উপর নির্ভর করে না। জটিলতর বিষয় ও বিদ্যা তাকে অর্জন করতে হয়। ভাষা বুঝলেই অঙ্ক কষা যায় না; কিংবা ইতিহাসে দর্শনে জ্ঞান অর্জিত হয় না। কিংবা দ্বিতীয় পাঠের . সুবোধ বালকের গল্পের ঋজু ভাষা দিয়ে দর্শন বা মনোবিজ্ঞান শেখা চলে না। অতএব ভাষার সারল্য ও জটিলতা বিষয়ানুসারী। যে বয়সে শিশু বর্ণশিক্ষা করে সে-বয়সে তার ধীশক্তি বিকশিত থাকে না। কাজেই তার শিক্ষা অনেকটা চোখ-কান নির্ভর ও স্মৃতিভিত্তিক। এজন্যে তার কাছে সরল জটিলের পার্থক্য সামান্য। তাই তাই তাই মামার বাড়ি যাই যেমন যুক্তাক্ষর বর্জিত, যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই-ও তেমনি। তাই বলে কী যে-কোনো অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন লোকই কী শেষোক্ত চরণের তাৎপর্য বুঝবে? তার জন্যে বয়স ও বিদ্যার প্রয়োজন হয় না কি?

অতএব, অশিক্ষিত লোকের লেখ্য ভাষা নিয়ে কোনো সমস্যাই নেই। এবং সব শিক্ষিত লোকেরও ভাষার শুদ্ধাশুদ্ধ নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। তাদের বৈষয়িক জীবনে প্রযুক্ত ভাষায় বর্ণাশুদ্ধি কিংবা বাক্যাশুদ্ধি চিন্তায় বা কর্মে কোনো বিপর্যয় ঘটায় না। আর বানান শুদ্ধ হলেই যে ভাষাও বিশুদ্ধ এবং অর্থগ্রাহ্য হবে–তার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। ব্যাকরণ তথা শব্দের অভিধা, আসত্তি ও বাক-রীতি (syntax) আয়ত্তে না থাকলে ভাষা শুদ্ধরূপে বলা বা লেখা চলে না; আর ভাষা শুদ্ধ হলেই যে সুন্দর ও অভিপ্রেতভাব প্রকাশক হয় না, তার জন্যে যে বক্তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা, রুচি, ভাব ও প্রকাশ-সামর্থ্য প্রয়োজন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

অতএব, বিশুদ্ধ ভাষার প্রয়োজন শিক্ষকের, সাহিত্যিকের, চিন্তাবিদের ও পণ্ডিতের। তারাই নতুন ভাব-চিন্তা প্রকাশের জন্যে বিদেশী ভাব ও বস্তুর পরিভাষা সৃষ্টির জন্যে ভাষার অনুশীলন করেন। ভাষা তাদের পেশার ও নেশার অবলম্বন। তাই ভাষা তাদের সর্বক্ষণের সাথী এবং অস্ত্র ও শাস্ত্র। এঁদের জন্যেই ভাষার অবিকৃত রূপ রক্ষা করা প্রয়োজন। যাতে ধাতু ও শব্দমূলের সঙ্গে

তাদের পরিচয় ও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ থাকে। কেননা প্রকাশের প্রয়োজনে তারা সর্বক্ষণ শব্দ খুঁজে বেড়ান। এবং প্রয়োজনবোধে তারা শব্দ সৃষ্টি করেন। এই সৃষ্টির উপকরণ হচ্ছে ধাতুমূল বা শব্দমূল। ওগুলো জানা না থাকলে নতুন শব্দ সৃষ্টি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, পূর্ব বাঙলার সরকার, বাঙলা একাডেমী ও বাঙলা উন্নয়ন বোর্ড ইংরেজি শব্দের বাঙলা পরিভাষা তৈরির জন্যে তামদুনিক প্রবণতাবশে আরবি ও ফারসির সাহায্য নিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে বহুনিন্দিত সংস্কৃত ধাতু ও শব্দমূলকেই সম্বল করেছেন। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক : ক্ষা, ও সা–এ দুটোই ইচ্ছা বাঞ্ছব্যঞ্জক প্রকৃতি। এগুলো দিয়ে আকাঙ্ক্ষা, বুভুক্ষা, মুমুক্ষা, তিতিক্ষা কিংবা বুভুক্ষু, তিতিক্ষু প্রভৃতি বিভিন্ন অর্থজ্ঞাপক শব্দ তৈরি হয়েছে; তেমনি পিপাসা, জিজ্ঞাসা, জিঘাংসা, উপচিকীর্ষা, অপচিকীর্ষা, লিঙ্গ, বিবমিষা প্রভৃতি শব্দ নির্মাণ সম্ভব হয়ছে। এমনি করে উপসর্গ ও প্রত্যয় যোগে প্রয়োজনমতো অসংখ্য শব্দ রচিত হয়ে ভাষাকে ঋদ্ধ ও সর্বপ্রকার ভাব-চিন্তা-অনুভূতি প্রকাশের যোগ্য করেছে। এভাবেই শব্দগুলো বিভিন্ন তাৎপর্যে সূক্ষ্ম ভাব-প্রতিম ও প্রমূর্ত-অনুভব হয়ে উঠে। মানব-মনীষার বিমূর্ত জগৎ এমনি করে সমূর্ত হয়ে ধরা দেয় সাধারণের কাছে।

জীবন যেহেতু গভীরতর অর্থে অনুভবের সমষ্টিমাত্র এবং যেহেতু সে-অনুভূতি অনুভবযোগ্য হয়ে রূপ পায় ভাষায়, সেহেতু ভাষা জীবানুভূতির নামান্তর মাত্র। মানুষের মানসার্জিত যা-কিছু সম্পদ তা বলতে গেলে এই ভাষারই দান। কাজেই সে-ভাষা নিয়ে আনাড়ির আস্ফালন শুধু-যে ঔদ্ধত্য, তা নয়, মারাত্মকও বটে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *