বাঙলায় সূফী প্রভাব
০১.
মুসলিম বিজয়ের পূর্বে বাঙলাদেশে সূফী-দরবেশ এসেছিলেন কী না, ইতিহাস তা বলতে পারে না। তবু পাহাড়পুরে ও ময়নামতীতে আব্বাসীয় খলীফাদের মুদ্ৰাপ্রাপ্তি ও সোলেমান, খুরদাদবেহ, আলইদ্রিসী, আলমাসুদী প্রমুখ লেখকদের এবং দুদুল আলম গ্রন্থের বিবরণের প্রমাণে স্বীকার করতে হয় যে, অন্তত আটশতক থেকে আরবদের সঙ্গে বাঙলার বাণিজ্যিক সম্পর্ক শুরু হয়। অবশ্য Periplus in the Erythrean Sea-র আলোকে যাচাই করলে এ সম্পর্ক খ্রীস্টীয় প্রথম শতক অবধি পিছিয়ে দেয়া সম্ভব।
চট্টগ্রাম বন্দরে আরব বেনেরা বছরের কয়েক মাস থেকে যেত। সে-সূত্রে বন্দর এলাকায় তারা বৈবাহিক সম্পর্ক পাতিয়েছিল কি-না জানা নেই। তবে পরবর্তীকালের পর্তুগীজ প্রভৃতি য়ুরোপীয় বেনেদের জীবনযাপন রীতির কথা স্মরণ রাখলে, এ সম্পর্কও অনুমান করা চলে। ইংরেজ আমলে দেখেছি, বাঙালি মুসলমানেরা বার্মায় বর্মী স্ত্রী গ্রহণ করত আর তাদের সন্তানেরা জোরবাদী নামে পরিচিত হত। এমনি সঙ্কর মুসলমান হয়তো কিছুটা ছিল চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায়। মুসলমান ব্যবসায়ীদের পাহাড়পুরে, ময়নামতীতে, কিংবা কামরূপে যাতায়াতও ছিল কি-না বলা যাবে না। কেননা, তাদের মুদ্রা ওসব অঞ্চলে অন্যভাবেও নীত হওয়া সম্ভব। কিন্তু ইসলামের প্রচার ও প্রসার যুগে মুসলিম বেনে বা তাদের সঙ্গী কেউ ইসলামপ্রচারে আগ্রহী হয়নি এমন কথা ভাবব কেন? আমাদের মনে হয়, তখনো মুসলিম সমাজে সূফীমতবাদ প্রসার লাভ করেনি বলে এবং দণ্ডশক্তি বিধর্মীর হাতে ছিল বলে এদেশে যারা ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন বা অন্যসূত্রে এসে ইসলাম প্রচারের চেষ্টায় ছিলেন, তারা বিশেষ শ্রদ্ধা কিংবা সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। দরবেশ না হলে তথা কেরামতির আভাস না পেলে অজ্ঞলোকেরা ভক্তি করবার কারণ খুঁজে পায় না। কাজেই তেমন লোকের স্মৃতি রক্ষার গরজও বোধ করে না। আর যদি মুসলিম বিজয়ের পূর্বে জালালউদ্দীন তাবরেজীর (?) মতো সূফীরা এসেও থাকেন তাহলেও মুসলিম-বিরল কিংবা বিহীন বিধর্মীর রাজ্যে তার স্মৃতিরক্ষার আয়োজন করবার লোকই ছিল না।
সূফীমত প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে দলে দলে সূফীরা বিজিত ভারতেও আসতে শুরু করেন। তখন থেকেই খানকা ও দরগাকেন্দ্রী ইতিহাসেরও আরম্ভ।
কিন্তু চৌদ্দ শতকের এক সূফীর সাক্ষ্যে প্রমাণিত বাঙলাদেশে তার আগেই বহু সূফীর আগমন ঘটেছে। তারা বিভিন্ন মত-সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। শেখ আলাউল হক পাণ্ডুবীর সাগরেদ সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী কর্তৃক জৌনপুর সুলতান ইব্রাহীম শর্কীর নিকট লিখিত পত্রে আছে :
God be praised! What a good land is that Bengal where numerous saints and asceties came from many directions and made it their habitation and home. For example at Devgaon, followers of Hazrat Shaikh Shahabuddin Suhrwardi are taking their eternal rest. Several saints of the Suhrwardi order are lying burried in Mahisun and this is the case with saints of Jalalia order in Deotala. In Narkoti some of the best companions of the Shaikh Ahmed Damishqi are found. Hazrat Shaikh Sharfuddin Tawwama, one of the twelve of the Qadar Khani order whose chief pupil was Hazrat Shaikh Sharfuddin Maneri is lying burried at Sonargaon. And then there was Hazrat Badr Alam and Badr Alam Zahidi. In short, in the country of Bengal what to speak of the cities there is no town and no village where holy saints did not come and settle down. Many of the saints of the Suhrwardi order are dead and gone under earth but those still alive are also in fairly large number.
এতে বোঝা যায়, যে চৌদ্দ শতকের মধ্যেই বাঙলা দেশে সূফীপ্রভাব গভীরতা ও বিস্তৃতি লাভ করে।
কিন্তু যে কয়জন প্রাচীন সূফীর কাহিনী এবং খানকা ও দরগাহর খবর আমরা জানি, তাঁদের আগমন ও অবস্থিতি কাল সম্বন্ধে বিদ্বানেরা একমত নন। যেমন বাবা আদম শহীদ। বিক্রমপুরস্থিত রামপালের এই আদম শহীদ বিক্রমপুরের এক সেন রাজা বল্লালের সমসাময়িক। অনন্দভট্ট রচিত বল্লাল চরিতম সম্ভবত এঁরই জীবন চরিত লক্ষণসেনের পিতা প্রখ্যাত বল্লালসেনের নয়। বল্লাল চরিতোক্ত বায়াদুমবা সম্ভবত বাবা আদমেরই নামবিকৃতি। নগেন্দ্রনাথ বসুর মতে বল্লাল সেন চৌদ্দ শতকের শেষার্ধের লোক। কাজেই বাবা আদমও ঐ সময়ের।
চট্টগ্রামের পীর বদরুদ্দীন বদর-ই-আলম, বর্ধমানের কালনার বদর সাহিব, দিনাজপুরের হেমতাবাদের বদরুদ্দীন এবং বদর-মোকান খ্যাত বদর শাহ্ বা বদর আউলিয়া আর মাঝিমাল্লার পাঁচপীরের অন্যতম পীর বদর সম্ভবত অভিন্ন ব্যক্তি। চট্টগ্রামে এর অবস্থিতিকাল কারো মতে ১৩৪০ আর কারো ধারণায় ১৪৪০ খ্রীস্টাব্দ।
শেখ জালালউদ্দীন তাবরেজীর নাম শেকশুভোদয়ার সঙ্গে জড়িত। কেউ কেউ একে জাল গ্রন্থ বলে বিবেচনা করেন। এই গ্রন্থের লেখক হলায়ুধ মিশ্র রাজা লক্ষ্মণ সেনের সচিব ছিলেন। তিনি যদি ১২১০-১২ খ্রীস্টাব্দের পর বেঁচে থাকেন, তাহলে শেখ শুভোদয়া তাঁর রচনা হওয়া সম্ভব। তবে স্বীকার করতে হবে যে ভাষার বিকৃতি ও প্রক্ষিপ্ত তথ্যে গ্রন্থটি বিদ্বানদের বিভ্রান্তির কারণ হয়েছে। ইতিহাস-বিরল সে-যুগে গ্রন্থকার হিসেবে হলায়ুধ মিশ্রের ও শাসকরূপে লক্ষ্মণ সেনের নাম জড়িয়ে, আর্যা প্রভৃতির প্রাচীনরূপ রক্ষা করে মোলো-সতেরো শতকে জালগ্রন্থ রচিত হয়েছে, অনুমান করতে অনেকখানি কল্পনার প্রয়োজন। শেখ শুভোদয়া সূত্রে কারো কারো বিশ্বাস, শেখ জালালউদ্দীন তাবরেজী লক্ষ্মণ সেনের আমলে লখনোতিতে তথা বাঙলায় বাস করতেন। অমৃতকুণ্ড তাঁরই আগ্রহে অনূদিত হয়। তাঁরাই মাহাত্ম্য-মুগ্ধ হলায়ুধ মিশ্র তাঁর কৃতিকথা বর্ণনা করেছেন শেখ শুভোদয়ায় (শেখের শুভ উদয়)। আবদুর রহমান চিশতির মতে জালালউদ্দীন তাবরেজীর পুরো নাম ছিল আবুল কাশেম মখদুম শেখ জালাল তাবরেজী। তিনি শেখ শিহাবুদ্দীন সোহরওয়ার্দীর সাগরেদ ছিলেন। তিনি কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী, বাহাউদ্দীন জাকারিয়া, নিযামুদ্দীন মুগরা ও দিল্লীর সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিসের (১২১০-৩৬) সমসাময়িক। জন্মস্থান তাব্রিজ থেকে দিল্লী এলে তাকে সুলতান ইলতুৎমিস অভ্যর্থনা করেন। এ তথ্যে আস্থা রাখলে স্বীকার করতে হবে জালালউদ্দীন তাবরেজী লক্ষ্মণ সেনের আমলে বাংলায় আসেননি। কেউ কেউ আবার শেখ জালালউদ্দীন তাবরেজী ও সিলেটের জালালউদ্দীন কুনিয়াঈকে অভিন্ন মনে করেন। শেখ জালালউদ্দীন বহুল আলোচিত সূফী।১৫ ময়মনসিংহ জেলার মদনপুরে শাহ সুলতান রুমী নামে এক সূফীর দরগাহ্ আছে। ইনি ৪৪৫ হিজরি বা ১০৫৩-৫৪ সনে ওখানে বিদ্যমান ছিলেন বলে পরবর্তীকালে দলিলসূত্রে দাবী করা হয়। এক কোচ রাজা তার হাতে ইসলামে দীক্ষিত হয়ে তাকে মদনপুর গ্রাম দান করেন বলে ময়মনসিংহ Gazetter-এ উল্লেখ আছে। কিন্তু আরো প্রায় সাড়ে তিনশ বছর পরে উক্ত জেলায় কোচ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। অতএব, উক্ত কোচ রাজা কোনো কোচ জমিদার হবেন, কিংবা সুলতান রুমী চৌদ্দ শতকের লোক।
পাবনা জেলার শাহজাদপুরে রয়েছে মুখদুম শাহ্ দৌলা শহীদের দরগাহ্। ইনি জালালউদ্দীন বোখারীর সমসাময়িক ছিলেন। অতএব ইনি বারো-তেরো শতকের লোক।
বর্ধমানের মঙ্গলকোট গায়ে মখদুম শাহ মাহমুদ গজনবী ওর্ষে শাহরাহী পীরের দরগাহ রয়েছে। ইনি স্থানীয় রাজা বিক্রম কেশরীর সাথে লড়েছিলেন বলে কিংবদন্তি আছে।
বগুড়ার মহাস্থানগড়ের শাহ্ সুলতান মাহি-আসোয়ারের স্বীকৃতি আওরঙজীবের সনদসূত্রেও (১০৯৬ হি. ১৬৮৫-৮৬) মিলে। তার সম্বন্ধে লোকশ্রুতি এই যে তিনি মুসলিম-বিদ্বেষী রাজা বলরাম ও পরশুরামকে হত্যা করেন। পরশুরামের ভগ্নী শিলাদেবী করতোয়া নদীর যেখানে ডুবে মরেছিল, তা এখনো শিলাদেবীর ঘাট নামে পরিচিত। ইনি সম্ভবত চৌদ্দশতকের লোক। মনে হয় মাহি-আসোয়ার (মৎস্যাকৃতি নৌকার আরোহী) খ্যাতির লোকেরা চৌদ্দশতকের পরের লোক নন। কেননা পনেরো শতকে আরব-ভারতের স্থলপথ জনপ্রিয় হয়। আর ষোলো শতকে পর্তুগীজেরা জলপথ নিয়ন্ত্রণ করত।
সিলেটের শাহ্ জালাউদ্দীন কুনিয়াঈ চৌদ্দশতকের দ্বিতীয় পাদে বাঙলাদেশে আসেন। ইবন বতুতা (১৩৩৮ সনে) সিলেটে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ইনি রাজা গৌরগোবিন্দকে পরাজিত করে সিলেট অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন।
মখদুম-উল-মুলক শেখ শরফুদ্দীন ইয়াহীয়া ও তাঁর উস্তাদ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামাহ সোনারগাঁয়ে (১২১০-৩৬, বা ১২৭০-৭১, কিংবা ১২৮২-৮৭ খ্রীস্টাব্দে) এসেছিলেন। ইনি এবং মকুল হোসেনে মুহম্মদ খান-বর্ণিত শেখ শরফুদ্দীন অভিন্ন ব্যক্তি কী না বলবার উপায় নেই।
শেখ বদিউদ্দীন শাহ মাদার সিরিয়া থেকে এসেছিলেন। এঁর পিতার নাম আবু ইসহাক শামী। ইনি মুসা নবীর ভাই হারুনের বংশধর। ইনিই সম্ভবত শূন্য পুরাণোক্ত নিরঞ্জনের রুম্মার দম মাদার। এবং মাদারীপুরও সম্ভবত তাঁর নাম বহন করছে। চট্টগ্রামের মাদারবাড়ী, মাদার শাহ্ এবং দরগাহ সংলগ্ন পুকুরের মাছের মাদারী নাম, শাহ্ মাদারের স্মরণার্থ বাঁশ তোলার বার্ষিক উৎসব প্রভৃতি মাদারিয়া সম্প্রদায়ের সূফীর বহুল প্রভাবের পরিচায়ক বলে ডক্টর এনামুল হক মনে করেন।
মখদুম জাহানিয়া জাহানগত ওফে জালালউদ্দীন সুপুশ (Surkpush) নামে এক দরবেশ বাঙলায় এসেছিলেন। জাহানসতের মৃত্যু হয় ১৩৮৩ খ্রীস্টাব্দে এবং উছে (Uchh) তার সমাধি আছে।
শেখ আখি সিরাজউদ্দীন উসমান নিযামুদ্দীন আউলিয়ার খলিফা ছিলেন। ইনি পাণ্ডুয়ার শেখ আলাউল হকের পীর। ইনি চৌদ্দ-পনেরো শতকের দরবেশ। তাঁর প্রভাবেই মুখ্যত বাঙলাদেশে চিশতিয়া তরিকার প্রসার হয়। পীরের নামানুসারে বিভিন্ন চিশতিয়া পীরের শিষ্যরা বিভিন্ন নামে পরিচিত হতেন। আলাউল হকের শিষ্যরা আলাহ, তাঁর পুত্র নূর কুতুব-ই-আলমের সাগরেদরা নূরী২৮ এবং আলাউলের খলিফা শেখ হোসেন ধুক্কারপোশ (Dhukkarposh)-এর সম্প্রদায়ের সূফীরা হোসেনী নামে পরিচিত ছিল। শেখ আলাউল হক ইসলামের উন্মেষযুগের মুসলিম সেনাপতি খালিদ-বিন-ওলীদের বংশধর। সেজন্যে তাঁর শিষ্যরা খালিদিয়া নামেও অভিহিত হতেন। আলাউল হকেরই পুত্র ছিলেন নূর কুতুব-ই-আলম। গণেশ-যদুর আমলে গৌড়ের রাজনীতিতে আলাউল হকের পরিবার স্মরণীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। নূর কুতুব-ই-আলমের পুত্র শেখ আনোয়ার রাজা গণেশ কর্তৃক সোনারগাঁয়ে নির্বাসিত ও পরে নিহত হন। নূর কুতুব-ই আলমের ভ্রাতুস্পুত্র শেখ জাহিদও সোনারগাঁয়ে নির্বাসিত হয়েছিলেন। জালালুদ্দীন মোহাম্মদ শাহ ওফেঁ যদু শেখ জাহিদের প্রতি শ্রদ্ধাবান ছিলেন।
মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাগীর সিমনানী শেখ আলাউল হকের শিষ্য ছিলেন। এঁর চিঠিগুলো সেকালের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের মূল্যবান উপকরণ ও নির্ভরযোগ্য দলিল। সৈয়দ আশরাফ সিমনানী জৌনপুর সুলতান ইব্রাহীম সৰ্কীর সমসাময়িক ছিলেন। সিমনানী ইব্রাহীম সকীকে লিখিত এক পত্রে বদর আলম ও বদর আলম জাহিদী নামে দুইজন সূফীর উল্লেখ করেছেন। শেখ হোসেন ধুক্কারপোশ (Dhukkarposh)-এর ছেলে রাজা গণেশ কর্তৃক নিহত হলে সিমনানী তাঁকে প্রবোধ দিয়ে যে পত্র লেখেন, তা থেকে আভাস মিলে যে, গণেশ কিছু সোহরাওয়ার্দীয়া ও রুহানিয়া সূফীকে হত্যা করেন। Those who Traverse the path of God, have many calamities to suffer from. It is hoped through the spiritual grace of the souls of Suhrawardia and Ruhania saints of the part, of that in near future that kingdom of Islam will be free from the hands of the luckless nonbelievers.us
শেখ বদরুল ইসলাম নূর কুতুব-ই-আলমের সমসাময়িক। রিয়াজুস-সালতিন৩২-এ বর্ণিত ঘটনায় প্রকাশ : রাজা গণেশের দরবারে ইনি রাজাকে অভিবাদন না করেই আসন গ্রহণ করেন। রুষ্ট রাজা তাঁকে হত্যা করে তার ঔদ্ধত্যের শাস্তি দেন।
এঁরা ছাড়া শাহ্ সফিউদ্দীন, জাফর খান গাজী৩৩ খাঁ জাহান আলী, শাহু আনোয়ার কুলি হালবী, ইসমাইল গাজী, মোল্লা আ, শাহ জালাল দাখিনী (মৃত্যু ১৪৭৬ খ্র.), শাহ মোয়াজ্জম দানেশমন্দ ওর্কে মৌলানা শাহ্ দৌলা (রাজশাহী : বাঘা), শাহ আলী বাগদাদী (মীরপুর, ঢাকা), শেখ ফরিদউদ্দীন শাহ্, লঙ্গর শাহ নিয়ামতুল্লাহ, শাহ লঙ্কাপতি প্রভৃতি দরবেশের নাম উল্লেখ্য।
জালালুদ্দীন তাবরেজী (মৃত্যু ১২২৫ খ্রী.), মখদুম জাহানিয়া (১৩০৭-৮৩) ও শাহজালাল কুনিয়াঈ (মৃত্যু ১৩৪৬) সোহরাওয়ার্দীয়া মতবাদী ছিলেন।
শেখ ফরিদউদ্দিন শখরগঞ্জ (১১৭৬-১২৬৯), আখি সিরাজুদ্দীন (মৃ. ১৩৫৭), আলাউল হক (মৃ. ১৩৯৮), শেখ নাসিরুদ্দীন মানিকপুরী, মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাগীর সিমনানী, শেখ নুর কুতুব-ই-আলম (মৃ. ১৪১৬), শেখ জাহিদ প্রমুখ চিশতিয়া সম্প্রদায়ের সূফী ছিলেন।
শাহ সফীউদ্দিন (মৃত্যু ১২৯০-৯৫?) কলন্দরিয়া সূফী ছিলেন।
শাহ্ আল্লাহ্ মদারিয়া এবং শেখ হামিদ দানিশমন্দ নকশবন্দিয়া সূফী ছিলেন।৪০ ষোলো শতক অবধি চট্টগ্রামের সূফী শাহ্ সুলতান বল্খী (বায়জিদ?), শেখ ফরিদ, পীর বদর আলাম, কাতাল পীর, শাহ মসন্দর বা মোহসেন আউলিয়া, শাহপীর, শাহাদ প্রমুখ এবং কবি মুহম্মদ খানের মাতৃকূলের পীর শরফউদ্দীন থেকে সদরজাহা আবদুল ওহাব ওর্ষে শাহ ভিখারী অবধি অনেক পীর প্রখ্যাত।
গৌড়ের সুলতানদের মধ্যে ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ্, সিকান্দর শাহ্, গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ্, জলালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ্ (যদু), রুকনুদ্দীন বারবক শাহ্ প্রমুখের দরবেশ ভক্তি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
আবার শাহ্ জালালউদ্দীন কুনিয়াঈ, আলাউল হক, নুর কুতুব-ই-আলম, আশরাফ জাহাগীর সিমনানী, ইসমাইল গাজী, জাফর আলী খা, খান জাহান খান প্রমুখ সূফীরা রাজনীতি ও সরকারি কর্মে নিযুক্ত ছিলেন।
আর্তের সেবা, কাঙাল ভোজন, রোগীর চিকিৎসা ও কেরামতি প্রভৃতি দ্বারাই সূফীরা গণমন জয় করেন।
.
০২.
মুসলমানদের বিশ্বাস : হযরত মুহম্মদ হজরত আলীকে তত্ত্ব বা গুপ্ত জ্ঞান দিয়ে যান। হাসান, হোসেন, খাজা কামীল বিন জয়ীদ ও হাসান বসরী সে-জ্ঞান আলী থেকে প্রাপ্ত হন। এই কিংবদন্তির কথা বাদ দিলে হাসান বসোরী (মৃ. ৭২৮ খ্র.), রাবিয়া (মৃ. ৭৫৩), ইব্রাহীম আদহম (মৃ. ৭৭৭), আবু হাশিম (মৃ. ৭৭৭), দাউদ তায়ী (মৃ ৭৮১), মারুফ করখী (মৃ ৮৫) প্রমুখই সূফী মতের আদি প্রবক্তা।
পরবর্তী সূফী জুননুন মিশরী (মৃ. ৮৬০), শিবলী খোরাসানী (মৃ. ৯৪৬), জুনাইদ বাগদাদী (মৃ. ৯১০) প্রমুখ সাধকরা সূফীমতকে লিপিবদ্ধ, সুশৃঙ্খলিত ও জনপ্রিয় করে তোলেন। আল্লাহ আকাশ ও মর্ত্যের আলো স্বরূপ। আমরা তার (মানুষেরা) ঘাড়ের শিরা থেকেও কাছে (রয়েছি)। –এই প্রকার ইঙ্গিত থেকেই সূফীমত বিশ্বব্রহ্ম বা সর্বেশ্বরবাদের তথা অদ্বৈতবাদের দিকে এগিয়ে যায়। জিকর বা জপ করার নির্দেশ মিলেছে কোরানের অপর এক আয়াতে অতএব (আল্লাহকে) স্মরণ কর। কেননা তুমি একজন স্মারক মাত্র।
সৃষ্টি ও স্রষ্টার অদৃশ্য লীলা ও অস্তিত্ব বুঝবার জন্যে বোধি তথা ইরফান কিংবা গুহ্যজ্ঞান লাভ করা প্রয়োজন। এ প্রয়োজনবোধ ও রহস্যচিন্তাই সূফীদের বিশ্বব্রহ্মবাদী বা সর্বেশ্বরবাদী করেছে। এই চিন্তা বা কল্পনার পরিণতিই হচ্ছে হমহউস্ত (সবই আল্লাহ্) বিশ্বব্রহ্মতত্ত্ব তথা সর্বং খন্বিদং ব্রহ্মতত্ত্ব। এই হল তৌহিদ-ই-ওজুদী তথা আল্লাহ্ সর্ব ভূতে বিরাজমান–এই অঙ্গীকারে আস্থা স্থাপন।
বায়জিদ, জুনাইদ বাগদাদী, আবুল হোসেন ইবনে মনসুর হল্লাজ এবং আবু সৈয়দ বিন আবুল খয়ের খোরাসানী (মৃত্যু ১০৪৯ খ্র.) প্রমুখ প্রথম যুগের অদ্বৈতবাদী সূফী। শরীয়তপন্থ বিরোধী এসব সূফীদের অনেককেই নতুন মত পোষণ ও প্রচারের জন্যে প্রাণ হারাতে হয়। মনসুর হল্লাজ, শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল্লাহ প্রমুখ এভাবেই শহীদ হন।
ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক বলেন–ভারতে সূফী প্রভাব পড়িবার পূর্ব হইতে, সূফীমতবাদ ভারতীয় চিন্তাধারায় পরিপুষ্ট হইতে থাকে। খ্রীস্টীয় একাদশ শতাব্দীতেই ভারতে সূফীমত প্রবেশ করে। তৎপর্বের সূফীমতেও ভারতীয় দর্শন ও চিন্তাধারার স্পষ্ট চাপ দেখিতে পাই। তার মতে এ প্রভাব পড়ে ভারতীয় পুস্তকের আরবি-ফারসি অনুবাদের মাধ্যমে ও ভ্রাম্যমাণ বৌদ্ধভিক্ষুর সান্নিধ্যে। এবং আলবিরুনীর অনুবাদ, পাতঞ্জল যোগ এবং কপিল সাংখ্য তত্ত্বের সঙ্গে পরিচয়ই এ প্রভাবের মুখ্য কারণ। বায়জিদ বোস্তামীর ভারতীয় (সিন্ধু দেশীয়) গুরু বুআলীর প্রভাবও এক্ষেত্রে স্মরণীয়। তিনি আরও বলেন, (বাঙলা) দেশে সূফীমত প্রচার ও বহুল বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সহজিয়া ও যোগ সাধন প্রভৃতি পন্থা, বঙ্গের সূফীমতকে অভিভূত করিয়া ফেলিতে থাকে। কালক্রমে বাঙলার সূফী মতবাদের সহিত এদেশীয় সংস্কার, বিশ্বাস প্রভৃতিও সম্মিলিত হইতে থাকে। এবং সূফীমতবাদ ও সাধনপদ্ধতি ক্রমে ক্রমে যোগসাধন প্রভৃতি হিন্দুপদ্ধতির সঙ্গে একটা আপোষ করিয়া লইতে থাকে।
…… চিশতীয় ও সুহরদীয়হ সম্প্রদায়দ্বয়ের সাধনা, ভারতে আগমন করার পূর্ব হইতেই অনেকখানি ভারতীয় ভাবাপন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। ভারতে আগমনের পর, এদেশীয় সাধনার সহিত তাহাদের সাক্ষাৎ যোগসূত্রের সৃষ্টি হইল; ভারতের প্রাণের সহিত আরব ও পারস্যের প্রাণের ত্রিবেণী সঙ্গম ঘটিয়া গেল। ভারতবিখ্যাত সাধক কবীর (১৩৯৮-১৪৪০ খ্র.) উক্ত প্রাণত্রয়ের পুণ্যতীর্থ প্রয়োগক্ষেত্রে পরিণত হইলেন। তাঁহার মধ্যে ভারতীয় যোগ সাধনা ও সূফীদের তস্ববফ বা ব্রহ্মবাদ সম্মিলিত হইল। সূফীরা সাক্ষাত্তাবে তাহার ভিতর দিয়া ভারতীয়দের আর ভারতীয়েরা সূফীদের প্রাণের সন্ধান লাভ করিলেন।
আইন-ই-আকবরীতে চৌদ্দটি সূফী খান্দান বা মণ্ডলীর উল্লেখ আছে। আবুল ফজল হয়তো প্রধান সম্প্রদায়গুলোরই নাম করেছেন। আমাদের অনুমানে তখন এক এক পীর-কেন্দ্রী এক এক সম্প্রদায় ছিল। পরে তাত্ত্বিক ও আচারিক বিধিবদ্ধ শাস্ত্র গড়ে উঠার ফলে সম্প্রদায়-সংখ্যা কমেছে এবং চারটি প্রধান মতবাদী খান্দান প্রসার লাভ করে। আর অপ্রধানগুলো কালে লোপ পায়, অথবা স্থানিক সীমা অতিক্রমণের যোগ্যতা হারায়। এ কারণেই আবুল ফজল কথিত চৌদ্দটি খান্দানের অনেকগুলোই লোপ পেয়েছে।
চিশতিয়া ও সুহরওয়ার্দিয়া মতই প্রথমে ভারতে তথা বাঙলায় প্রসার লাভ করে।৪৪ এরপরে নক্শবন্দিয়া এবং আরও পরে কাদিরিয়া সম্প্রদায় জনপ্রিয় হয়। মনে হয় ষোলো শতক অবধি চিশতিয়া, মদারিয়া ও কলন্দরিয়া সম্প্রদায়ের প্রভাবই বেশি ছিল। মদারিয়া ও কলন্দরিয়া মত একসময় জনপ্রিয়তা হারিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
চৌদ্দ-পনেরো শতকের মধ্যেই সূফীর সর্বেশ্বরবাদ আর বৈদান্তিক অদ্বৈতবাদ অভিন্নরূপ নিল। আচার ও চর্যার ক্ষেত্রেও যোগপদ্ধতির মাধ্যমে ঐক্য স্থাপিত হল.। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে এ অভিন্নতা প্রথম আমরা কবীরের (১৩৯৮-১৪৪৮) মধ্যেই প্রত্যক্ষ করি। এই মিলন-বিরোধী আন্দোলনও শতোকঁ বছর পর মুজদ্দদ-ই-আলফ-ই-সানী আহমদ সরহিন্দীর (১৫৬৩-১৬২৪) নেতৃত্বে গড়ে উঠে। কিন্তু সে-সংস্কার আন্দোলন সর্বব্যাপী হতে পারেনি। নকশবন্দিয়া এবং কিছুটা কাদিরিয়া। সম্প্রদায়েই এ সংস্কার আন্দোলন প্রধানত সীমাবদ্ধ ছিল। আলফসানী স্বয়ং একজন নকশবন্দিয়া।
বাঙলায় এ আন্দোলন দেশী তত্ত্ব চিন্তা ও চর্যার সঙ্গে ইসলামের বহির্বয়বের মিলন ঘটানোর চেষ্টায় পরিণতি লাভ করে। সৈয়দ সুলতান ও তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে এই প্রচেষ্টাই লক্ষ্য করি।
ভারতীয় যোগ-চর্যা ভিত্তিক তান্ত্রিক সাধনার যা-কিছু মুসলিম সূফীরা গ্রহণ করলেন, তাকে একটা মুসলিম আবরণ দেবার চেষ্টা হল, তা অবশ্য কার্যত নয় নামত। কেননা আরবি-ফারসি পরিভাষা গ্রহণের মধ্যেই এর ইসলামী রূপায়ণ সীমিত রইল। যেমন : নির্বাণ হল ফানা, কুণ্ডলিনীশক্তি হল নকশাবন্দিয়াদের লতিফা। হিন্দুতন্ত্রের ষড় পদ্ম হল এদের ষড় লতিফা বা আলোক-কেন্দ্র। এদেরও অবলম্বন হল দেহ চর্যা ও দেহস্থ আলোর উধ্বায়ন। পরম আলো বা মৌল আলোর দ্বারা সাধকের সর্বশরীর আলোময় হয়ে উঠে। এ হচ্ছে এক আনন্দময় অদ্বয়সত্তা-এর সঙ্গে সামরস্য জাত সহজাবস্থার, সচ্চিদানন্দ বা বোধিচিত্তাবস্থার মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
সূফীর জিকির ভারতিক প্রভাবে যোগীর ন্যাস, প্রাণায়াম ও জপের রূপ নিল। বর্হিভারতিক বৌদ্ধ-প্রভাবে (ইরানে, সমরখন্দে, বোখারায়-বলখে) এবং ভারতিক বৌদ্ধ-হিন্দু প্রভাবে বৌদ্ধ গুরুবাদও যোগতান্ত্রিক সাধকদের অনুসৃতি বশে সূফী সাধনায় অপরিহার্য হয়ে উঠল। সূফী মাত্রই তাই পীর-মুর্শিদ-নির্ভর তথা গুরুবাদী। গুরুর আনুগত্যই সাধনায় সিদ্ধির একমাত্র পথ। এটিই পরিণামে কবর পূজারও (দরগাহ্ বৌদ্ধ ভিক্ষুর স্তূপ পূজারই মতো হয়ে উঠল) রূপ পেল। সূফীরা আল্লাহর ধ্যানের প্রাথমিক অনুশীলন হিসেবে পীরের চেহারা ধ্যান করা শুরু করেন। শুরুতে বিলীন হওয়ায় অবস্থার উন্নীত হলেই শিষ্য আল্লাহতে বিলীন হওয়ার সাধনার যোগ্য হয়। প্রথম অবস্থার নাম ফানা-ফিশ-শেখ, দ্বিতীয় স্তরের নাম ফানা ফিল্লাহ। প্রথমটি রাবিতা (গুরুসংযোগ), দ্বিতীয়টি মুরাকিবাহু (আল্লাহর ধ্যান)। এই মুরাকিবায় যৌগিক পদ্ধতি গৃহীত হয়েছে। আসন, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি–এই চতুরঙ্গ যোগ পদ্ধতি থেকেই পাওয়া। পীরের খানকা বা আখড়ায়। সামা (গান), হালকা (ভাবাবেগে নর্তন), দারা (আল্লার নাম কীর্তনের আসর), হাল (অভিভূতি), সাকী, ইশক প্রভৃতি খাজা মঈনউদ্দীন চিশতীর আমল থেকেই চিশতিয়া খান্দানের সূফীদের সাধনায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। পরবর্তীকালে নিজামিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়েও এ রীতি গৃহীত হয়। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাধনায় এরই অনুসৃতি রয়েছে।
সূফীদের দ্বারা দীক্ষিত অজ্ঞ জনসাধারণ শরীয়তী ইসলামের সঙ্গে ভাষার ব্যবধ্বন বশত অনেককাল পরিচিত হতে পারেনি। ফলে, তাহারা ক্রিয়াকলাপে আচার ব্যবহারে, ভাষায় ও লিখায়, সর্বোপরি সংস্কার ও চিন্তায় প্রায় পুরোপুরি বাঙালিই রহিয়া গেল। এমনকি হিন্দুত্বকে পুরোপুরি বর্জন করিতে পারিল না।
দরবেশদের প্রশ্রয়ও ছিল–তাহারা (দরবেশরা) কখনও বাহ্যিক আচার বিচারের প্রতি বিশেষ মনোযোগও দেনই নাই, এমনকি আভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও অসাধারণ মহৎ ও উদার ছিলেন। …. এখনও পশ্চিম ও উত্তরবঙ্গীয় শয়খ শ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে অনেক হিন্দু ভাব, চিন্তা ও ব্যবহারের বহুল প্রচলন রয়েছে)। সাধারণ বঙ্গীয় মুসলমানদের মধ্যে এখনও তাহাদের ভারতীয় পিতৃপুরুষ হইতে লব্ধ বা পরবর্তীকালে গৃহীত যত হিন্দু ও বৌদ্ধ আচার ব্যবহার প্রচলিত আছে এবং চিন্তা ও বিশ্বাস ক্রিয়া করিতেছে।