রতন আর লক্ষ্মী
॥ ১ ॥
ঠিক কখন থেকে রতনের মনটা খুশিতে ভরে আছে সেটা রতন জানে। দশদিন আগে ছিল চৈত সংক্রান্তি। রতন থাকে শিমুলিতে। সেখান থেকে চার ক্রোশ দূরে উজলপুরে সংক্রান্তির খুব বড় মেলা হয়। রতন গিয়েছিল সেই মেলা দেখতে। শুধু দেখতে নয়, মেলা থেকে বাঁশের বাঁশি কেনার শখও ছিল তার, সেটাও একটা উদ্দেশ্য বটে। রতনের গানের কান খুব ভালো; যে কোনো গান দুবার শুনলে নিজের গলায় তুলে নিতে পারে। সে বাঁশিও বাজায়, কিন্তু ভালো বাঁশি তার নেই। জমজমাট মেলার এক জায়গায় নানারকম বাজনা বিক্রী হচ্ছিল, তার মধ্যে বাঁশিও ছিল অনেক, রতন তারই কয়েকটা হাতে তুলে ফুঁ দিয়ে দেখছিল, এমন সময় চারদিকে একটা সোরগোল পড়ে গেল। উজলপুরের রাজকন্যা লক্ষ্মী এসেছেন ডুলিতে করে মেলা দেখতে। এমনিতে রাজকন্যারা রাজবাড়ির অন্তঃপুরেই বন্দী থাকে, তাকে বাইরের লোকে দেখতে পায় না। কিন্তু লক্ষ্মী তেমন মেয়ে নয়। সে অনেক আগে থেকেই বাপ-মাকে শাসিয়ে রেখেছে—‘সংক্রান্তির মেলা আসছে, আমি কিন্তু তাতে যাব। ওসব পর্দাটর্দা মানতে পারব না। লোকে আমাকে দেখলে ক্ষতি কী? তারাও মানুষ, আমিও মানুষ; আর তারা ত আমায় খেয়ে ফেলবে না। আমি ডুলিতে করে যাব। আমার কেষ্টনগরের মাটির পুতুলের খুব শখ; সেই পুতুল আমি নিজে দেখে কিনতে চাই। তোমরা না করতে পারবে না।’ লক্ষ্মী বাপ-মায়ের একমাত্র সন্তান, তাই তার আবদার না রেখে উপায় নেই।
হবি ত হ, বাজনার দোকান মাটির পুতুলের দোকানের ঠিক পাশেই। রতন সবে একটা বাঁশিতে একটা মন-মাতানো সুর তুলেছে এমন সময় সোরগোল শুনে পাশ ফিরে দেখে রাজকন্যা। শুধু দেখা নয়, একেবারে চোখে চোখে দেখা। রাজকন্যার বয়স ষোলো, রতনের উনিশ। রতনের চেহারাটাও ভালো। সে ব্রাহ্মণ পুরুতের একমাত্র ছেলে। পাঁচ ঘর যজমান নিয়ে পুরুত হরিনারায়ণের মোটামুটি চলে যায়, কিন্তু তার স্ত্রী অন্নপূর্ণা ছেলে রতনকে এই অবস্থার মধ্যেই মানুষ করেছে খুব যত্ন করে। তাই রতনের চেহারায় কোনো দারিদ্র্যের ছাপ পড়েনি।
রাজকন্যা লক্ষ্মীর চোখে চোখ পড়তেই রতনের মন খুশিতে ভরে উঠল। এমন সুন্দর মেয়ে সে দেখেনি কখনো। আহা, একে যদি গান শোনাতে পারত সে তাহলে কেমন ভালো হত!
অবিশ্যি চোখ পড়তেই রাজকন্যা আবার চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু তাতে কী হয়? তাকে দেখে রাজকন্যার খারাপ লাগেনি এটা রতন বুঝেছে। আর কী চাই? সে একটার জায়গায় তিনটে বাঁশি কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরল। সে পুরুতগিরি করবে না, গান-বাজনা নিয়েই থাকবে, এটা সে বাপকে বলে দিয়েছে। তার বিয়ের কথাও বাপ দু-একবার তুলেছেন, তাতে রতন কিছু বলেনি। এবার যদি তোলেন তাহলে রতন বলবে উজলপুরের রাজকন্যার মতো সুন্দরী মেয়ে হলেই সে বিয়ে করবে, নইলে নয়।
আজ ছিল রবিবার। সময়টা দুপুর; রতন সকালে দু’ঘণ্টা বাঁশি বাজানো অভ্যাস করে একবার গিয়েছিল গোপীনাথ মুদির দোকানে। বাড়ি ফিরে এসে দেখে এক জটাজূধারী সন্ন্যাসী তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সন্ন্যাসীর চোখ দুটো লাল, গলায় চারখানা বড় বড় রুদ্রাক্ষের মালা। হাতে চিমটে আর কমণ্ডলু। রতনকে দেখেই বাবাজী হাত তুলে আশীবাদ করে বললেন, ‘সেই চাঁদপুর থেকে আসছি, এখনো যেতে হবে তিন ক্রোশ পথ; তোরা ত ব্রাহ্মণ?
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘আমাকে এক ঘটি খাবার জল এনে দে ত দেখি।’
‘নিশ্চয়ই; আপনি বসুন।’
রতন তাড়াতাড়ি বাবাজীর জন্য দাওয়ায় আসন পেতে দিল। তারপর বাড়ির ভিতরে গেল জল আনতে। মা শুনে বললেন, ‘শুধু জল কেন? অতিথি এসেছেন, পিঠে আছে, দু খানা দিয়ে দে জলের সঙ্গে।’
আসলে বাবাজীর চেহারাটা—বিশেষ করে জবা ফুলের মতো চোখ দুটো—রতনের খুব ভালো লাগেনি। তাই মা-র কথা শুনে সে বলল, ‘আবার পিঠে কেন? চেয়েছেন ত শুধু জল।’
অন্নপূর্ণা ধমকের সুরে বললেন, ‘অতিথিসেবায় যত পুণ্যি তত আর কিছুতে হয় না, জানিস? যা বলছি তাই কর।’
রতন অনিচ্ছা সত্ত্বেও জলের সঙ্গে রেকাবিতে করে পিঠে নিয়ে গিয়ে বাবাজীকে দিল। বাবাজী দুই গ্রাসে দুটো পিঠে খেয়ে ঢক্ ঢক্ করে পুরো ঘটি জলটা খেয়ে ফেলে বললেন, ‘আঃ, বড় তৃপ্তি হল!’
কথাটা বলে আরো আরাম করে বসে পা দুটো সামনের দিকে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘তোর নাম ত রতন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
রতন বুঝল বাবাজী যেমন-তেমন লোক নন; ইনি গুনতে জানেন। কিন্তু তাও তাঁকে রতনের ভালো লাগল না। এমনভাবে পা ছড়িয়ে দিলেন কেন? দুপুরটা এখানেই কাটাবেন নাকি?
‘তা বাবা রতন’, বললেন বাবাজী, ‘একটু পা দুটো ডলে দে ত দেখি। এখনো অনেকটা পথ যেতে হবে।’
রতন এটা আশা করে নি। তার কাছে অনুরোধটা একটু বাড়াবাড়ি বলে মনে হল।
সে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে বাবা আবার বললেন, ‘কই, একটু পদসেবা কর! তোর পুণ্যি হবে। হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলি কেন?’
রতনের মনটা হঠাৎ শক্ত হয়ে উঠল। ইনি যতবড়ই সাধু হন, রতন পরোয়া করে না। এই লোকটার পা টিপে দেবে না। রাজ্যির ধুলোকাদা লেগে আছে পায়ে এতখানি পথ হেঁটে।
সে মাথা নেড়ে বলল, ‘না ঠাকুর, আমায় মাপ করবেন। আমি আমার বাবার পা টিপতে পারি, আর কারুর নয়।’
বাবাজী ছড়ানো পাদুটো টেনে নিলেন। রতন দেখল তাঁর চোখ দুটো যেন আগুনের ভাঁটার মতো জ্বলে উঠল।
‘কী বললি? আবার বল ত!’
রতন আবার বলল। এবার আরো স্পষ্ট করে। তার ভয় কেটে গেছে। যত বড় সাধুই হোক—কী আর করতে পারে? এ ত আর দুর্বাসা মুনি নয় যে অভিশাপ দেবে!
‘আমি কে জানিস?’ এবার বাবাজী জিগ্যেস করলেন।
রতন চুপ।
‘আমি তোর কী করতে পারি জানিস? বাবাজী আবার জিগ্যেস করলেন। তোর ভবিষ্যৎ আমার হাতের মুঠোয়। আমি বিপুলানন্দ তান্ত্রিক। আমি ত্রিকালজ্ঞ। আমার তেজে চরাচর ভস্ম হয়ে যায়। আমাকে অপমান করার সাহস হল তোর?’
রতন এখনও চুপ। সে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে বাবাজীর দিকে। বুকে সামান্য দুরু দুরু ভাব। কী করবে তাকে বাবাজী? কী করতে পারে একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে?
কিন্তু বাবাজী যে মানুষের বাড়া সে কথা রতন জানবে কি করে?
‘আজ অমাবস্যা’, বলে চললেন বাবাজী। ‘আজ সায়াহ্নে তুই আর মানুষ থাকবি না। তুই হয়ে যাবি রাক্ষস। আয়তনে তিন গুণ বেড়ে যাবি তুই। সভ্য সমাজে থাকা আর চলবে না তোর। তোর খাদ্য হবে বন্য পশু। আমার পদসেবা করলে তোর মঙ্গলই হত। তাতে যখন তোর এত আপত্তি তখন তোর একটু শিক্ষা হওয়াই দরকার। আমি আসি।’
বাবাজী চিমটে কমণ্ডলু নিয়ে উঠে পড়লেন। রতন পাথর। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। হ্যাঁ, একটা পন্থা আছে। নরহরি খুড়োর কাছে যাওয়া। সায়াহ্ন মানে কখন? সূর্যি ডোবার আগে ত নয়। তার মানে সময় আছে অন্তত তিন ঘণ্টা।
বাবাজী ‘ব্যোম ভোলানাথ’ বলে চলে গেলেন।
রতন তাঁকে বেশ কিছুদূর যেতে দিয়ে এক ছুটে গিয়ে পৌঁছাল নরহরি জ্যোতিষীর বাড়ি।
‘কী রে রত্না—এই অসময়ে? কী ব্যাপার?’
‘খুব বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি নরহরি খুড়ো!’
‘কী বিপদ?’
‘সেটা আর খুলে বলা যাবে না। আপনি একটু গুনে যদি বলেন আমার সামনের কটা দিন কেমন যাবে!’
রতনের গানের গলা আর মিষ্টি স্বভাবের জন্য গাঁয়ের সকলেই তাকে স্নেহ করে। নরহরি জ্যোতিষী এমনিতে একটু খিটখিটে মানুষ, কিন্তু রতনের দিশাহারা ভাব দেখে তার অনুরোধ ঠেলতে পারলেন না।
‘দাঁড়া দেখি। তোর করকোষ্ঠী আমিই করেছিলাম, তাই না?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘কর্কট রাশি, কৃষ্ণ পক্ষ…হুঁ…’
নরহরি জ্যোতিষী কাগজে কিছুক্ষণ হিজিবিজি কাটলেন, তারপর হঠাৎ ভয়ানক গম্ভীর হয়ে রতনের দিকে চেয়ে বললেন, ‘এ যে মহাসংকট! তোর উপর ত শনির দৃষ্টি পড়েছে দেখছি। সামনের কটা দিন তো ঘোর দুর্বিপাকের সময় রে রতন!’
‘কিন্তু তার পরে? ধরা গলায় জিগ্যেস করল রতন।
নরহরি জ্যোতিষী আবার নকসার দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ ভ্রূকুটি করে রইলেন। তারপর তাঁর ঠোঁটের কোনে হাসি দেখা দিল। তিনি তিনবার পর পর ‘বাঃ!’ বলে বললেন, ‘সব মেঘ কেটে যাবে। শনি সরে গিয়ে বৃহস্পতি উঠবে তুঙ্গে। তার কষ্ট থাকবে না, অভাব থাকবে না, কিছু থাকবে না।’
‘কিন্তু সেটা কদিন পরে নরহরি খুড়ো?’
‘বেশি দিন নয়, বেশি দিন নয়। এক পক্ষকাল। আজ অমাবস্যা। পূর্ণিমায় দেখবি মেঘ কেটে গেছে। বুঝেছিস?’
রতন বুঝল।
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, সূর্য মাথার উপর থেকে পশ্চিমে নামতে শুরু করেছে, তাই রতন আর থাকতে পারল না। নরহরি খুড়োর কাছে ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার করে জেনে নিতে পারলে ভালো হত, কিন্তু তার আর উপায় নেই। মোটামুটি যা জানবার তা রতন জেনে নিয়েছে। কিছুদিনের জন্য তাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। অভিশাপের কথা মা-বাবাকে বলবে না। তারপর আবার কপাল ফিরলে সে বাড়ি ফিরবে।
বাড়ি ফিরে এসে রতন দেখল তার বাপও ফিরেছে। বাপ-মা দুজনকেই একসঙ্গে পেয়ে রতন বলল তাকে দু হপ্তার জন্য নারানপুর যেতে হচ্ছে। সেখানে এক নাম-করা গাইয়ে এসেছেন, তাঁর কাছ থেকে যদি কিছু শেখা যায় তার চেষ্টা দেখবে রতন।
ছেলের যে গানের নেশা এটা তার বাপ-মা দুজনেই জানে। কাজেই তাকে এ ব্যাপারে নিরস্ত করার চেষ্টা বৃথা। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুজনকে মত দিতে হল। রতন লাঠির আগায় একটা পোঁটলা বেঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
গাঁয়ের পশ্চিমপ্রান্তে ঝলসির বন, সেটা পেরোলেই দিগ্নগর। ঝলসির বনে রতন গেছে একবারই, কারণ সেখানে অনেক জানোয়ারের বাস। প্রায় তিনশ বছর আগে ঝলসি ছিল এক সমৃদ্ধ শহর; তখন তার নাম ছিল আজিনগড়। এই আজিনগড়ের ভাঙা কেল্লা দেখতেই রতন গিয়েছিল তার দুই বন্ধু সুবল আর মুকুন্দর সঙ্গে। বিশাল কেল্লা, কিন্তু তার অবস্থা খুবই শোচনীয়। সাপ-বিচ্ছুর বাস বলে আর ভিতরে কেউ যায় না, আর রতন সেখানেই থাকবে বলে মনস্থির করেছে। একটা ডেরা তার চাই; লোকের কাছ থেকে গা ঢাকা দিতে হবে ত!
রতন বনের ধারে গিয়ে একটা ছোট নদী থেকে আঁজলা করে জল নিয়ে খেল। অনেকখানি পথ, বেশ জল পিপাসা পেয়েছিল। এখনও সূর্য ডুবতে এক ঘণ্টা দেরি। বাবাজীর কথা যদি ফলেই যায়, তাহলেই সে কেল্লায় গিয়ে ঢুকবে। না হলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বাড়ি ফিরে যাবে: বলবে, ওস্তাদ ছাত্র নিতে নারাজ তাই সে বাড়ি ফিরে এল।
কিন্তু রতনের মন বলছে বাবাজীর কথা ফলবে; কারণ এর মধ্যেই তার শরীরের ভিতরে কতকগুলো লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করেছে। হাড়ে কেমন যেন টান টান ভাব। সঙ্গে পোঁটলায় চিড়ে বাঁধা ছিল, কিন্তু সেটা আর খেতে ইচ্ছা করছে না; অথচ একটা খিদের ভাব রয়েছে, কিন্তু তার জন্য যেন চাই অন্য খাদ্য।
বনের মধ্যে ক্রমে অন্ধকার হয়ে আসছে। সূর্য এখন দূরের গাছপালার ঠিক মাথার উপর নেমে এসেছে। রতন তার নিজের হাত-পায়ের দিকে চেয়ে দেখল। এত লোম ত তার ছিল না!
আর নখও ত এত ধারালো ছিল না!
সামনে একটা শুয়োর। দাঁতালো বুনো শুয়োর। বন থেকে বেরিয়ে একটা খোলা জায়গায় এসে তার দিকে চেয়ে দেখছে একদৃষ্টে।
রতন একটা আমলকি গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ছিল। গাছের ডাল ছিল তার মাথার চেয়ে প্রায় দশ হাত উপরে। হঠাৎ রতন বুঝল ডালটা যেন ক্রমে কাছে এগিয়ে আসছে।
শুয়োরটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। রতনের দিকে চেয়ে একটা চাপা গর্জনের মতা শব্দ করল। তারপর উল্টো দিকে ঘুরে ছুটে পালাল।
রতন দেখল যে তার মাথা আমলকি গাছের ডাল ছাড়িয়ে উপরে উঠেছে। তার মুখ সে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু গালে হাত দিয়ে বুঝল সেখানেও লোম।
এবার রতন বড় বড় পা ফেলে জঙ্গল ভেদ করে রওনা দিল আজিনগড়ের কেল্লার উদ্দেশে।
॥ ২ ॥
আজিনগড়ের কেল্লায় যে একটা রাক্ষস এসে বাস করছে সে খবর শিমুলির লোকে শুনেছে রামদাস কাঠুরের কাছ থেকে। রামদাস কাঠ কাটতে গিয়েছিল ঝলসির বনে। দিনের আলো থাকতে থাকতেই গিয়েছিল যাতে বাঘের খপ্পরে না পড়তে হয়। কেল্লার কাছাকাছি এসে একটা বারো হাত উঁচু দু-পেয়ে প্রাণী দেখতে পেয়ে সে চম্পট দেয়। প্রাণীটার সর্বাঙ্গে লোম, হাতপায়ের নখ বড় বড়, দু পাশের দাঁতগুলো জানোয়ারের মতো ছুঁচোল আর বড়, চোখ দুটো লাল, আর মাথা ভর্তি জটপাকানো চুল।
রামদাস এই বর্ণনা দেবার পর থেকে ঝলসির বনের ধারেকাছে আর কেউ যায় না। এই দানবের ভয়ে সারা শিমুলি গাঁ কাঁপতে শুরু করেছে, যদিও এটাও ঠিক যে মানুষের কোনো অনিষ্ট এই রাক্ষস এখন অবধি করে নি।
রতনের মনটা এখনো আগের মতোই রয়েছে, এমন কি তার গলার আওয়াজেও কোনো পরিবর্তন হয় নি, কেবল তার চেহারা আর খিদেটা গেছে বদলে। বনে ফলমূলের অভাব নেই, কিন্তু রতনের ক্ষিদে মিটতে লাগে বন্য জানোয়ারের কাঁচা মাংস। তার দেহে শক্তিও হয়েছে অমানুষিক; সে দুই হাতে ধরে যে-কোনো জানোয়ারের ঘাড় মটকে দিতে পারে, তারপর তার ধারালো আর শক্ত দাঁত দিয়ে সেই জানোয়ারের মাংস চিবিয়ে খেতে পারে। তার দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি আর ঘ্রাণশক্তি—তিনটেই অসম্ভব বেড়ে গেছে। বাঘ বন দিয়ে হেঁটে চলে নিঃশব্দে, কিন্তু রতনের কানে তার পায়ের শব্দ ধরা পড়ে। একশো হাত দূর থেকে জানোয়ারের গন্ধ সে পায়, আর পেয়ে নিঃশব্দে তাকে ধাওয়া করে। একবার একটা পুকুরের জলে রতন নিজের চেহারাটা দেখেছিল। দেখে তার নিজেরই ভয় লেগেছিল। জানোয়াররাও তাই তাকে দেখে পালায়, রতনকে ঝড়ের বেগে দৌড়ে গিয়ে তাদের ধরতে হয়।
রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর একা ভাঙা কেল্লায় বসে তার সবচেয়ে যার কথাটা বেশি মনে হয় সে হল উজলপুরের রাজকন্যা লক্ষ্মী। সংক্রান্তির মেলায় দেখা তার মুখের সেই হাসির কথা ভেবেই রতনের গলায় গান এসে পড়ে, আর সে আশ্চর্য হয়ে দেখে যে রাক্ষস হয়েও তার গানের গলা নষ্ট হয় নি। কিন্তু তা হলে কী হবে; সে জানে যে সে আর কোনোদিন রাজকন্যার কাছেও যেতে পারবে না, মানুষ হয়েও না। গরিব ব্রাহ্মণের ছেলে হয়ে রাজকন্যার কথা ভেবে কী লাভ? তার জন্য কত রাজপুত্র রয়েছে, তাদের একটার সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যাবে আর কিছুদিনের মধ্যেই।
তখনই আবার তার নরহরিখুড়োর কথাটা মনে পড়ে। তার কপাল যে ফিরবে সেটা কোনদিকে? হঠাৎ কি সে বড়লোক হয়ে উঠবে যাতে তার আর কোনো অভাব থাকে না? রাজারাজড়া ত সে আর হতে পারবে না, তাহলে নরহরিখুড়োর কথার মানেটা কী? খুড়োর ত বয়স হয়েছে অনেক; তার গণনায় ভুল হয়নি ত?
দশদিনে কাছাকাছির মধ্যে যা জানোয়ার ছিল সব শেষ করে রতন চলল দিগনগরের দিকে। দিগ্নগরের পশ্চিমে, ঝলসির লাগোয়া বন শহরকে তিন দিক দিয়ে ঘিরে রয়েছে। এই বনের নাম কী রতন জানে না, কিন্তু এখানে জানোয়ার আছে অনেক, রাজা মৃগয়ায় আসেন, এ খবর রতন রাখে। অনেক দূর পথ হেঁটে রতনের ক্ষিদে পেয়েছিল খুব, তাই বাঘের গন্ধ পেয়ে সে সন্তর্পণে এগিয়ে গিয়েছিল, আর গাছপালার ফাঁক দিয়ে সে বাঘকে দেখতেও পেল। কিন্তু সেটার দিকে এগোতে গিয়েই হঠাৎ দেখল একটা তীর এসে বাঘের গায়ে লাগাতে সেটা ছট্ফট্ করে মরে গেল। তারপরেই ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শুনতে পেয়ে রতন একটা সেগুন গাছের আড়ালে লুকোবার আগেই তাকে দেখে ফেলল ঘোড়সওয়ার। পোষাক দেখেই বোঝা যায় সে রাজপুত্র। মৃগয়ায় বেরিয়েছে। এদিকে রাজপুত্র এমন বিশাল এক রাক্ষসের সামনে পড়ে থতমত। যদিও রতন দেখে আশ্চর্য হল যে রাজপুত্র ডরায়নি।
‘তুমিই বুঝি ঝলসির বনের রাক্ষস?’ রাজকুমার জিগ্যেস করল।
‘হ্যাঁ, বলল রতন। কিন্তু তুমি কে?’
‘আমি চন্দ্রসেন। দিগ্নগরের রাজকুমার।’ তারপর একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কিন্তু তুমি ত ঠিক মানুষের মতো কথা বল দেখছি।’
‘তার কারণ আমি আসলে মানুষ’ বলল রতন। ‘এক সন্ন্যাসীর অভিশাপে আমি রাক্ষস হয়েছি। তোমার আমাকে দেখে ভয় করছে না?’
‘কই, না ত। তুমি ত আর মানুষ ধরে খাও না; ভয় করবে কেন?’
‘কিন্তু আমি ত জানোয়ার খাই। এই বাঘটাকে আমি খাবো বলে ঠিক করেছিলাম, সেটাকে তুমি মারলে।’
‘আমি মারলাম তাতে কী হল? আমি আজ অনেক শিকার পেয়েছি। এখন সন্ধ্যা হতে চলল, এবার ফিরব। এই বাঘটা তুমিই খাও।’
‘তুমি কি একাই শিকার কর?’ রতন অবাক হয়ে জিগ্যেস করল।
‘হ্যাঁ। আগে লোকজন নিয়ে করতাম, এখন একাই করি। আমার ভয় করে না। ভালো কথা, তোমার একটা নাম আছে ত, না কী?’
‘হ্যাঁ। আমার মানুষ নাম রতন। এখন আমি রাক্ষস, তাই সে নামের আর কোনো দাম নেই।’
‘তুমি কি এখন এই বনেই থাকবে?’
‘যদি খাবার পাই তাহলে থাকব।’
‘তাহলে তোমার সঙ্গে আবার দেখা হতে পারে। কাল আমি থাকব না। কাল যাব উজলপুর।’
উজলপুর শুনেই রতনের চমক লাগল।
‘কেন? উজলপুরে কী?’
‘সেখানে ডম্বরি পাহাড়ের গুহায় একটা দানব এসে রয়েছে। সে মানুষ খায়। তাকে মারবার জন্য উজলপুরের রাজা ঢ্যাঁড়া দিয়েছেন। আমি গিয়ে দেখব সেটাকে যদি মারতে পারি।’
চন্দ্রসেন বিদায় নিয়ে চলে গেল। রতনের খুব ভালো লাগল রাজকুমারকে। কিন্তু উজলপুরে দানবের ব্যাপারটা শুনে রতন যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। মানুষখেকো দানব। চন্দ্রসেন যাবে তাকে মারতে। পারবে ত?
পরদিন সকাল থেকে রতন দেখল তার মন বারবার চলে যাচ্ছে উজলপুরের দিকে। একে ত সেখানেই থাকে লক্ষ্মী রাজকন্যা, তার উপর তার রাজ্যে বিপদ দেখা দিয়েছে, মানুষখেকো দানবের আবির্ভাব হয়েছে। উজলপুরের কেউ নিশ্চয়ই সে দানবকে মারতে পারেনি, নইলে আর ঢ্যাঁড়া দেবে কেন? মারতে পারলে কোনো পুরস্কার দেবে কি রাজা? সে কথা ত চন্দ্রসেন কিছুই বলল না।
রতন আর চিন্তা না করে বনের ভিতর দিয়ে উজলপুর রওনা দিল। এখান থেকে দুক্রোশের বেশি দূর হবে না। সকালে সে একটা বুনো শুয়োর খেয়ে নিয়ে লম্বা পাড়ি দেবার জন্য তৈরি হয়ে নিয়েছে। চন্দ্রসেনের জন্য তার মনে একটা চিন্তা দেখা দিয়েছে। জানোয়ার মারা আর দানব মারা এক জিনিস নয়।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই রতন ডম্বরি পাহাড়ের কাছে পৌঁছে গেল। পাহাড়ের চারিদিকে ঘিরে আছে ঘন বন। সেই বন ধরে এগিয়ে গিয়ে পাহাড়ের গায়ে এক জায়গায় একটা প্রকাণ্ড গুহা দেখতে পেল রতন। এটাই কি দানবের গুহা? হ্যাঁ, এটাই, কারণ তার প্রখর দৃষ্টিশক্তির জোরে সে দেখতে পেয়েছে যে গুহাটার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে আছে অনেক মানুষের হাড়।
রতন একটা বটগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তার কান তাকে বলল যে ঘোড়ার খুরের শব্দ এগিয়ে আসছে।
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছে রতন। একটা ঘোড়া নয়, অনেক ঘোড়া। তবে একটা ছাড়া আর সবগুলোই একটা জায়গাতেই এসে থেমে গেল। তাদের পিঠে রয়েছে বল্লমধারী সৈন্য। আর, যে ঘোড়াটা পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চলল তার পিঠে আছে রাজকুমার চন্দ্রসেন।
রাজকুমার নির্ভয়ে পাহাড়ের গা দিয়ে উঠে গেল দানবের গুহা লক্ষ করে। গুহার মুখে এসে ঘোড়া থামাল সে। এবার সেনারা দামামা বাজিয়ে জানান দিল যে রাজকুমার উপস্থিত। এই শব্দেই দানবের বাইরে বেরোন উচিত; এবার তার রাজকুমারের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।
রতনকে আর অপেক্ষা করতে হল না। দামামা বাজানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা বিকট হুঙ্কার দিয়ে দানব এক লাফে গুহা থেকে বাইরে বেরিয়ে এল—তার পায়ের চাপে কিছু বড় পাথর পাহাড়ের গা বেয়ে নীচের দিকে গড়িয়ে এল সশব্দে।
দানবটা যে কত বড় সেটা ঘোড়ার পিঠে রাজকুমারের পাশে তাকে দেখে বোঝা গেল। রতন প্রমাদ গুণল। চন্দ্রসেন বিদ্যুৎ বেগে তীর ছুঁড়তে আরম্ভ করেছে দানবের দিকে, কিন্তু সে তীর দানবের পুরু চামড়া ভেদ করতে না পেরে চতুর্দিকে ছিটকে পড়ছে।
দানব যেন এটা উপভোগই করছে এমন ভাব করে কিছুক্ষণ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আরেকটা হুঙ্কার দিয়ে সে ঘোড়ার পিঠে চন্দ্রসেনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ঠিক এই মুহূর্তেই রতন বুঝল যে তার আর চুপ করে থাকা চলে না। সে বটগাছের পাশ থেকে বেরিয়ে কয়েকটা বিশাল লাফ দিয়ে পাহাড় বেয়ে পৌঁছে গেল দানবের পাশে। দানব তখন দুহাত দিয়ে ঘোড়া সমেত চন্দ্রসেনকে জাপটে ধরেছে, চন্দ্রসেনও ছটফট করছে এই নাগপাশ থেকে মুক্তি পাবার জন্য। এমন সময় এই নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখতে পেয়ে দানব হঠাৎ হতভম্ব হয়ে ঘোড়াকে ছেড়ে দিল। তারপরেই সে ধেয়ে এল রতনের দিকে।
কিন্তু রতনের খাদ্য বন্য পশু আর দানবের খাদ্য মানুষ; দানব এই রাক্ষসের সঙ্গে পারবে কেন? দানবকে দুহাতে জাপটে নিয়ে তাকে মাথার উপর তুলে রতন প্রথম বুঝল তার নিজের শরীরে কত শক্তি হয়েছে। সেই অবস্থা থেকে সে পাহাড়ের গায়ে একটা প্রকাণ্ড পাথরের উপর দানবকে আছড়ে ফেলল। দানবের জানও কম কড়া নয়; সে সেই অবস্থা থেকে দাঁড়িয়ে উঠে আবার রতনের দিকে ধেয়ে এল। রতন আবার তাকে দুহাতে জড়িয়ে এবার আর ছুঁড়ে না ফেলে শুধু চাপের জোরে তাকে শেষ করার চেষ্টা করল।
সে চাপ যেন সহস্র অজগরের চাপ। দানব হাত পা ছুঁড়তে চেষ্টা করেও পারল না। তার চোখ ঠিক্রে বেরিয়ে আসছে। তার মুখ হাঁ করে জিভ বেরিয়ে গেছে, আর সেই মুখের মধ্যে দিয়ে রতনের চাপের চোটে দানবের শেষ নিশ্বাস বেরিয়ে এল। এবার রতন হাত আলগা দিতেই দানবের নিষ্প্রাণ দেহ পাহাড়ের গা দিয়ে গড়িয়ে একেবারে নীচে গিয়ে পড়ল।
এমন সময় কোলাহল শোনা গেল। সৈন্যদের কোলাহল। উজলপুরেও ঝলসির বনের রাক্ষসের খবর পৌঁছে গেছিল, এখন সেই রাক্ষস এখানে হাজির দেখে একশো সেনা তাদের বল্লম উঁচিয়ে ধেয়ে এল রতনের দিকে।
এইবারে দুটো ব্যাপার ঘটল: রতন কোনোরকম আক্রোশ দেখাল না। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল গুহার সামনে। আর চন্দ্রসেন সৈন্যদের দিকে হাত তুলে বলল, ‘এ রাক্ষসই হোক আর যাই হোক, এ আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে, আর দানবের সংহার এ-ই করেছে; আমার দ্বারা এ কাজ হত না। কাজেই একে তোমরা রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাও; দেখো যেন এর অনিষ্ট হয়।’
রতনকে নিয়ে সৈন্যদের কোনো বেগই পেতে হল না; তারা তাকে নিয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে চলল, আর রতনও সে ব্যাপারে কোনো আপত্তি করল না।
রাজপ্রাসাদের কয়েদখানা রতনের পক্ষে যথেষ্ট বড় নয় বলে তাকে প্রাসাদের পিছনে একটা অশ্বথ গাছের সঙ্গে চারগাছা দড়ি দিয়ে বেঁধে দশ জন সশস্ত্র প্রহরী পাহারা রেখে দেওয়া হল।
এবার রাজা নিজে এলেন রাক্ষসকে দেখতে। বন্য পশু খেয়ে রাক্ষস যে এমন শান্তশিষ্ট হতে পারে এটা রাজা ভাবতেই পারেননি।
আর আরেকজন তাকে দেখল প্রাসাদের দোতলার একটা জানালা থেকে, সে হল রাজকন্যা লক্ষ্মী। এমন কদাকার বিশাল একটা প্রাণী এমন নিরীহ ভাবে বসে থাকতে পারে তাদের দেশের এত বড় একটা শত্রুর প্রাণ সংহার করে, এটা লক্ষ্মীর কেমন যেন অদ্ভুত লাগল। এ কি সত্যিই রাক্ষস, না অন্য কিছু?
ক্রমে দিন ফুরিয়ে রাত এসে পড়ল। রতন এতই নির্জীব হয়ে পড়েছিল যে পেয়াদারা তাদের কাজে একটু একটু ঢিলে দিয়ে কেউ কেউ ঘুমিয়েই পড়েছিল। রতনের তাতে তাপ-উত্তাপ নেই; সে শুধু একজনের মন পাবার আশায় বসে আছে। এমন চেহারা নিয়ে যদিও সে আশা দুরাশা, কিন্তু রতন তবুও হাল ছাড়তে পারে না।
আকাশে চাঁদ দেখে, রাজবাড়ির বাগান থেকে ফুলের গন্ধ পেয়ে রতনের মনে একটা উদাস ভাব এল। চারিদিক নিঝুম হয়ে আছে। তার মধ্যেই রতনের মাথায় একটা গানের কলি এল। তার পরেই সেই গান তার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল। প্রহরীদের মধ্যে যারা জেগে ছিল তারা অবাক হয়ে রাক্ষসের দিকে চাইল। এই রাক্ষস গান গায়? আর এত সুন্দর গলায়?
রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে সে গান ভেসে পৌঁছে গেল রাজবাড়ির দোতলার অন্তঃপুরে। আর সবাই ঘুমে অচেতন, কেবল একজন জেগে আছে তার রেশমের বালিশে মাথা দিয়ে। রাজকুমারী লক্ষ্মী।
গানের কলি তার কানে যেতেই লক্ষ্মী চমকে উঠে মোহিত হয়ে গেল। এই সুরই ত সেই ছেলেটি বাঁশিতে বাজিয়েছিল সংক্রান্তির মেলায়! এটা কী করে হয়?
তারপর রাজকন্যার মনে পড়ল ঘোষণার কথা! উজলপুরের রাজার ঘোষণা দেশে দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এ কদিনের মধ্যে।—‘যে এই দানবকে মারতে পারবে সে পাবে অর্ধেক রাজত্ব, আর সেই সঙ্গে রাজকন্যাকে।’ এই রাক্ষসই ত সেই দানবকে মেরেছে!
একি সত্যিই রাক্ষস?
এদিকে রতন গান গেয়েই চলেছে। রাজকন্যা লক্ষ্মীর চোখে ঘুম নেই। তার মাথায় অদ্ভুত সব চিন্তা এসে জড়ো হয়েছে। কাল সকালে সে বাবার সঙ্গে দেখা করবে। তার মন বলছে—
না, এখনও কিছু বলছে না তার মন, কিন্তু তার মাথার মধ্যে সব গণ্ডগোল হয়ে গেছে। সে এই রহস্যের কোনো কিনারা করতে পারছে না।
শেষ পর্যন্ত লক্ষ্মীর চোখে ঘুম এল, আর ঘুমিয়ে সে স্বপ্ন দেখল সেই রাক্ষস তাকে বলছে, ‘তুমি হ্যাঁ বললেই আমার এ দশার শেষ হবে। তাছাড়া আমার মুক্তি নেই।’
পরদিন সকালে লক্ষ্মী তার বাবাকে ডেকে পাঠাল। রাজা তখন সবে নদীতে স্নান সেরে ফিরছেন। তিনি এসে বললেন, ‘কী বলছ মা?’
লক্ষ্মী সোজা বাপের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমি একবার রাক্ষসের সঙ্গে দেখা করতে চাই।’
‘কেন মা? এমন ইচ্ছা কেন হল তোমার?’
‘তুমি বলেছিলে, যে দানবকে মারবে তাকেই তুমি তোমার মেয়েকে আর অর্ধেক রাজত্ব দেবে। তুমি ত বলনি যে সে যদি রাক্ষস হয় তাহলে দেবে না।’
‘একি পাগলের মতো কথা বলছ তুমি? রাক্ষসের হাতে তুলে দেব তোমাকে আর অর্ধেক রাজত্ব?’
‘কেন দেবে না? সে ত কোনো দোষ করে নি। তার চেহারাটাই যা খারাপ। কাল রাত্রে তার গান শুনেছি আমি। এমন আশ্চর্য সুন্দর গলা খুব কম মানুষের হয়।’
‘তুমি ত মহা সমস্যায় ফেললে দেখছি!’
‘না বাবা। আমি ওকেই বিয়ে করব। একবার আমাকে ওর কাছে নিয়ে চল।’
‘যদি সে কিছু করে?’
‘কিছু করবে না। আমার মন বলছে কিছু করবে না।’
অগত্যা রাজা লক্ষ্মীকে নিয়ে গেলেন রাক্ষসের কাছে। আর সেখানে গিয়ে দেখলেন এক আশ্চর্য দৃশ্য।
এই সবে এক পক্ষকাল শেষ হল; আজ পূর্ণিমা। তাই রাক্ষসের গা থেকে লোম মিলিয়ে যাচ্ছে। তার নখ ছোট হয়ে যাচ্ছে, আর সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছোট হয়ে গিয়ে স্বাভাবিক মানুষের আকার নিচ্ছে, আর এ মানুষকে লক্ষ্মী চেনে।
সংক্রান্তির মেলায় একে দেখেছিল তার দিকে চেয়ে হাসতে।
আর এখন সেই হাসিই লেগে আছে রতনের ঠোঁটের কোণে।
রতন উঠে দাঁড়াল। তারপর মুখ খুলল। বলল, ‘আমার নাম রতন।’
‘আর আমার নাম লক্ষ্মী’, বলল রাজকন্যা।
‘শোন রতন’, বললেন রাজা, ‘আমি কথা দিয়েছি যে, যে দানবকে মারবে তাকে আমার অর্ধেক রাজত্ব, আর আমার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেব।’
‘সে ত ভালো কথা’, বলল রতন।
‘কিন্তু তোমার এমন দশা হল কী করে?’ জিগ্যেস করল রাজকন্যা লক্ষ্মী।
রতন হাসল। তারপর বলল, ‘সব বলব, আগে মণ্ডা মিঠাই আন; বড় খিদে পেয়েছে।’