ম্যাকেঞ্জি ফ্রুট

ম্যাকেঞ্জি ফ্রুট

॥ ১ ॥

ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বাগানে আশ্চর্য গাছটা আবিষ্কার করলেন নিশিকান্তবাবু। সাহেব যে গাছপালা ভালবাসতেন সেটা করিমগঞ্জে এসেই শুনেছিলেন নিশিকান্তবাবু। ভারত স্বাধীন হবার বছর সাতেকের মধ্যেই সাহেব অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর দেশে ফিরে যান। তারপর থেকে এই বাংলোবাড়িটা খালিই পড়ে আছে। লোকে বলে সাহেবের গিন্নী নাকি এই বাড়িতে বজ্রাঘাতে মারা যান। সাদা গাউন পরা তাঁর ভূতকে নাকি বাগানে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় পূর্ণিমার রাতে। তাই এ বাড়ির দিকে আর বিশেষ কেউ ঘেঁষে না।

নিশিকান্তবাবু বহরমপুরের সরকারী ইস্কুলে মাস্টারী থেকে রিটায়ার করে করিমগঞ্জে আসেন মাধব কবিরাজকে দিয়ে তাঁর বাতের চিকিৎসা করানোর জন্য। মাধব ডাক্তারের খ্যাতি দেশজোড়া না হলেও, প্রদেশজোড়া ত বটেই। বন্ধু তারক বাগচীর বাড়িতে এ-কদিন থেকে চিকিৎসা করিয়ে ফিরে যাবেন এই ছিল কথা। কিন্তু সে আর হল না। প্রথমত, এসে শুনলেন মাধব কবিরাজ মারা গেছেন দেড় মাস হল। তারপর তারক বাগচী বললেন, ‘তুমি একা মানুষ বিয়ে থা করনি, কার জন্য ফিরবে বহরমপুরে? এখানেই থেকে যাও, কবিরাজ অর নো কবিরাজ। করিমগঞ্জের জলহাওয়াতেই তোমার বাত ভালো হয়ে যাবে।’

অনুরোধ এড়াতে পারেননি নিশিকান্তবাবু। একবার যেতে হয়েছিল বহরমপুর তল্পিতল্পা গুটিয়ে আনার জন্য। সেই থেকে পেইং গেস্ট হয়ে আছেন বন্ধুর বাড়িতে। বেশ ছিমছাম বাড়ি, মুনসেফীর আয় থেকে তারক বাগচী তৈরি করেছেন সিক্সটি ফোরে।

বৌ মারা গেছেন বছর তিনেক হল, একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, একমাত্র ছেলে চাকরি করে দেরাদুনে।

জায়গাটা যে মনোরম তাতে সন্দেহ নেই। এককালে রেশমের কুঠি ছিল করিমগঞ্জে। সেই সূত্রেই ম্যাকেঞ্জি সাহেবের পূর্বপুরুষ এখানে বাসা বেঁধেছিল। কুঠি উঠে গেছে একশো বছর আগে। কিন্তু ম্যাকেঞ্জিরা করিমগঞ্জের মায়া কাটাতে পারেননি। শেষ সাহেব জন ম্যাকেঞ্জিও হয়ত থেকেই যেতেন, কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁর মন ভেঙে গিয়েছিল। ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় পশমের ব্যবসা করে, সে-ই বাপকে চিঠি লিখে দেশে আনিয়ে নেয়।

বন্ধুর সঙ্গে নিশিকান্তবাবুর একটা ব্যাপারে বেমিল। তারক বাগচী ঘরকুনো মানুষ, কাজের পর বাড়িতে এসে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দেন, আর নিশিকান্তবাবুর হেঁটে বেড়ানোর অভ্যাস, বাত সত্ত্বেও সকালে সন্ধে মাইল দু’এক না হাঁটলে তাঁর ভাত হজম হয় না। করিমগঞ্জে আসার দিন তিনেকের মধ্যেই বেড়ানোর পথে ম্যাকেঞ্জি সাহেবের পরিত্যক্ত বাংলোটা চোখে পড়ল তাঁর। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা আড়াই বিঘে জমির মাঝখানে ছবির মতো একতলা বাংলো, খাপরা দেওয়া ঢালু ছাত, সামনে পিছনে বারান্দা, চারদিক ঘিরে গাছপালা। নিশিকান্তবাবু গাছপালা ভালবাসেন, বটানি তাঁর প্রিয় সাবজেক্ট ছিল কলেজে, বহরমপুরের বাড়িতে তাঁর নিজেরও একটি ছোট্ট বাগান ছিল। তার উপর অনুসন্ধিৎসা তাঁর চরিত্রের একটা বিশেষ অঙ্গ। এত বিচিত্র রকমের গাছ দেখে তিনি আর লোভ সামলাতে পারেন-নি। ১০ই কার্তিক ১৩৮৭—তারিখটা জরুরী—তিনি বন্ধুর নিষেধ অমান্য করে কাপড় হাঁটুর উপর তুলে পাঁচিলের একটি ভাঙা অংশ টপকে ঢুকে পড়লেন ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বাগানে।’

আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, নারকেল ইত্যাদি যাবতীয় দেশী গাছ ছাড়াও, ছবিতে এবং শিবপুরের বোট্যানিক্যাল গার্ডেনে দেখা কিছু বিদেশী গাছও চোখে পড়ল নিশিকান্তবাবুর। ফুলগাছ যা ছিল তার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আগাছায় ভরে আছে চতুর্দিক। তারই মধ্যে দিয়ে এক অদম্য কৌতূহলে গাছপালা দেখতে দেখতে এগিয়ে চললেন নিশিকান্তবাবু।

বাগানের মধ্যে দিয়ে পাথরে বাঁধানো পথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে। আশেপাশে ছড়ানো রয়েছে শ্বেতপাথরের স্ট্যাচু, লোহার বেঞ্চি, জল শুকিয়ে যাওয়া ফোয়ারা। শৌখিন লোক ছিলেন ম্যাকেঞ্জিরা তাতে সন্দেহ নেই।

বাংলোর পিছন দিকটায় পৌঁছে গন্ধটা পেলেন নিশিকান্তবাবু। কোনো ফুল কিম্বা ফলের গন্ধ। তবে চেনা নয়। স্নিগ্ধ মিষ্টি গন্ধ।

নিশিকান্তবাবু এগিয়ে গেলেন অনুসন্ধান করতে। শরৎকালের দিন ছোট হয়ে এসেছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে পড়বে। গন্ধের কারণটা কী সেটা তার আগেই জানা দরকার।

একটা সিংহের মূর্তি পেরিয়ে তিন পা যেতেই নিশিকান্তবাবুকে থেমে যেতে হল। সামনে বাঁয়ে একটা করবী গাছ, তার ঠিক পিছনে একটা অপেক্ষাকৃত খোলা জায়গায় একটা অচেনা গাছের গায়ে পশ্চিম দিক থেকে ঢলে পড়া সূর্যের রশ্মি এসে পড়ে তার একটা দিককে যেন সোনার পাতে মুড়ে দিয়েছে।

নিশিকান্তবাবু এগিয়ে গেলেন গাছটার দিকে। গন্ধ যে এই গাছটা থেকেই আসছে তাতে সন্দেহ নেই। গাছের ফল থেকে। সাদা রঙের ফল। ওপর দিকটা গোল। তলাটা ঈষৎ ছুঁচোল। গোল অংশটার ব্যাস একটা মাঝারি সাইজের কমলালেবুর মতো। গাছের পাতাগুলোও লক্ষ করলেন নিশিকান্তবাবু। আর সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসে শেখা বটানির কিছু নামও মনে পড়ে গেল। পাতার রঙ গাঢ় সবুজ, কম্পাউণ্ড লীফ, অবলং, সেরেট। গাছটা দেড় মানুষ উঁচু। ফলের সংখ্যা কম করে পঞ্চাশ। তাদের গা থেকে সোনালি রোদ ক্রমে সরে যাচ্ছে, কিন্তু ফলের রঙটার যেন একটা নিজস্ব ঔজ্জ্বল্য আছে, যাতে মনে হয় অন্ধকার হবার পরও সেগুলো চোখ টানবে।

প্রায় মিনিট দশেক ধরে গাছটার এদিক ওদিক ঘুরে অবশেষে নিশিকান্তবাবুর মায়া কাটাতে হল। পোকামাকড় সরীসৃপের অভাব নেই এই পরিত্যক্ত বাগানে। এইবেলা বেরিয়ে পড়া দরকার। খালি হাতে ফিরবেন কি? না। এই অভিনব গাছের একটি ফল সঙ্গে নেওয়া দরকার।

নিশিকান্তবাবু হাত বাড়িয়ে একটি ফল ছিঁড়ে নিয়ে বাড়িমুখো হলেন।

ম্যাকেঞ্জি ফ্রুট

তারকবাবু ফলটা দেখে নিশিকান্তবাবুর মতো না হলেও, খানিকটা বিস্মিত হলেন বৈকি।

‘এ আবার কী আনলে সঙ্গে করে?

নিশিকান্তবাবু বললেন। তারকবাবু ফলটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, ‘এ জিনিস ত কস্মিনকালে দেখিনি হে। অস্ট্রেলিয়ার ফলই হবে বলে মনে হচ্ছে।’

‘কিন্তু সেটা সঠিক জানা যায় কি করে বল ত?’

ফলের নাম না জানা অবধি নিশিকান্তবাবুর শান্তি নেই।

‘তুমি জ্ঞানবাবুকে দেখাও গিয়ে’, বললেন তারক বাগচী। ‘ওঁর দেশ-বিদেশে অনেক ঘোরা আছে। দেখ উনি যদি চিনতে পারেন।’

জ্ঞানবাবু অর্থাৎ জ্ঞানপ্রকাশ চৌধুরী। চৌধুরীরা করিমগঞ্জের জমিদার ছিলেন। জ্ঞানপ্রকাশের ছিল ভ্রমণের নেশা। এখন তাঁর বয়স পঁয়ষট্টি। তবে যুবা বয়সে যখন জমিদারী উচ্ছেদ হয়নি তখন বাপের পয়সায় অনেক ঘুরেছেন। অনেক দেশের অনেক কিছু জিনিস সংগ্রহ করে এনে বাড়ি ভরিয়ে ফেলেছেন।

নিশিকান্তবাবু তাঁর বন্ধুর কথামতো ফলটি থলিতে ভরে নিয়ে গেলেন জ্ঞান চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে। ভদ্রলোক তখন তাঁর বৈঠকখানায় বসে কলের গান শুনছেন। আজকাল ভদ্রলোকের নেশা পুরোন বাংলা গানের রেকর্ড আর ডাকটিকিটে এসে দাঁড়িয়েছে। চৌধুরীমশাই হালফ্যাশানের রেকর্ডপ্লেয়ারে বিশ্বাস করেন না। তাঁর গ্রামোফোনের চোঙা আছে, এবং সেটি হাতে ঘুরিয়ে দম দিয়ে চালাতে হয়। কাজেই কলের গান বলাটাই ঠিক।

তিন মিনিটের রেকর্ড—জোহরা বাঈ-য়ের গান—শেষ হতে চাবি টিপে মেশিন বন্ধ করে ভদ্রলোক নিশিকান্তবাবুকে বসতে বললেন। হাতের ফলটা থলি থেকে বার করে শ্বেতপাথরের টেবিলের উপর রেখে পাশের সোফায় আসন গ্রহণ করলেন নিশিকান্তবাবু।

‘ওটা আবার কী?’

জ্ঞানবাবুর দৃষ্টি ফলের দিকে।

নিশিকান্তবাবু নম্রভাবে বললেন, আজ্ঞে ওটার জন্যই আপনার কাছে আসা। এই ফলটা পেয়েছি ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বাগানে, কিন্তু কী ফল সেটা বুঝতে পারছি না। আপনি ত অনেক ঘুরেছেন-টুরেছেন, তাই…

‘দেখি।’

নিশিকান্তবাবু ফলটা দিলেন চৌধুরীমশাইয়ের হাতে। সেটাকে নেড়েচেড়ে শুঁকেটুকে দেখে মাথা নাড়লেন জ্ঞান চৌধুরী।

‘উঁহু। এ ফল ত দেখছি আমার অজানা। আপনি বরং কোনো বটানিস্টকে জিগ্যেস করুন। প্রেসিডেন্সির বটানির অধ্যাপক এখন বোধ করি বিনয় সোম। সেদিন কাগজে যেন দেখলাম নামটা। সে যদি বলতে পারে।’

নিশিকান্তবাবু চিন্তায় পড়লেন। তাঁকে কি তাহলে কলকাতায় যেতে হবে এই ফল নিয়ে?

‘আপনি এক কাজ করুন’,—তাঁর চিন্তাটা আঁচ করেই যেন বললেন জ্ঞান চৌধুরী—‘আমার মেজো ছেলের পোলারয়েড ক্যামেরা আছে। সে আপনাকে ফল-সমেত গাছের রঙীন ছবি তুলে দেবে। তারই এক কপি আপনি সোমকে পাঠিয়ে দিন। তারপর দেখুন কী বলে?’

মেজো ছেলে জ্যোতিপ্রকাশ চৌধুরী ক্যানাডায় প্রোফেসারি করেন, সম্প্রতি বিয়ে করতে এসেছেন করিমগঞ্জে। তিনি খুশি হয়েই তাঁর ক্যামেরায় এই অজানা গাছের ছবি তুলে দিলেন। নিশিকান্তবাবু অবাক হয়ে দেখলেন ক্যামেরার শাটার টেপার সঙ্গে সঙ্গে একটি সাদা কাগজ সড়াৎ করে ক্যামেরার গায়ে একটি খাঁজের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। তারপর চোখের সামনে এক মিনিটের মধ্যে ভেল্‌কির মতো সেই কাগজে গাছের রঙীন ছবি ফুটে বেরোল। জ্যোতিপ্রকাশ ছবিটা ছিঁড়ে নিশিকান্তবাবুকে দিয়ে দিলেন।

ছবিটা হাতে নিয়ে একটু ইতস্তত করে নিশিকান্তবাবু বললেন, ‘একটা ছবি, যদি হারিয়ে টারিয়ে যায়…

জ্যোতিপ্রকাশ বিনা বাক্যব্যয়ে আরো দুখানা ছবি তুলে দিলেন নিশিকাতবাবুকে।

ছবির সঙ্গে তাঁর কলেজলব্ধ জ্ঞানের উপর নির্ভর করে নিশিকান্তবাবু গাছের একটি বর্ণনা দিয়ে প্রেসিডেন্সির অধ্যাপক বিনয় সোমের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

সাত দিনের মধ্যে উত্তর এসে গেল।

বিনয় সোম জানালেন এমন গাছ তিনি কখনো দেখেননি।

কিন্তু নিশিকান্তবাবু সহজে ছাড়বার পাত্র নয়। বর্ণনা সমেত আরেকটি ছবি তিনি পাঠালেন ইংল্যাণ্ডের রয়েল বোটানিক্যাল সোসাইটিতে। জ্ঞানবাবুর বাড়িতেই ‘হুইটেকারস অ্যালম্যান্যাক’ ছিল, তাতেই পাওয়া গেল সোসাইটির ঠিকানা। উত্তর আসতে লাগল তিন সপ্তাহ।

সোসাইটির পক্ষ থেকে মর্টিমার সাহেব জানিয়েছেন যে ফল সমেত গাছের যে ছবি পাঠানো হয়েছে তাতে যদি কোনো কারচুপি না থাকে তাহলে বলতেই হবে যে গাছটির জাত অজ্ঞাত।

এরপর যেটা ঘটল তাতে নিশিকান্তবাবুর চরিত্রের আরেকটি দিকের পরিচয় পাওয়া যায়। সেটা হল তাঁর ভাবুক দিক। একদিন রাত্রে বিছানায় শুয়ে নিশিকান্তবাবু ভাবলেন—এই যে মানুষ এতরকম শাকসব্জি ফলমূল শস্যকে খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করছে, এর শুরু হল কবে? আম জাম কলা কমলা পেঁপে পেয়ারা এসব কে বা কারা প্রথম খেলো, এ কথা ত ইতিহাসে লেখে না। অমুক ফল সুস্বাদু, অমুক খাদ্য পুষ্টিকর—এসব কে কবে আবিষ্কার করল? এর মধ্যে এমনও ত অনেক কিছু আছে যা মানুষের খাদ্য নয়, যা খেলে মানুষের অনিষ্ট হতে পারে। কয়েক শ্রেণীর ব্যাঙের ছাতা আছে যা মানুষের পক্ষে মারাত্মক। সেটা যে খাওয়া চলে না সেটাও ত একদিন মানুষকে খেয়েই বুঝতে হয়েছিল!

শাস্ত্রে যাবতীয় খাদ্যের গুণাগুণ লেখা আছে, কিন্তু শাস্ত্র লেখা হয়েছে এই ত সেদিন—মানুষ সভ্য হবার অনেক পরে। তার লক্ষ লক্ষ বছর আগেই ত সে সব খাদ্য মানুষ খেতে শুরু করে দিয়েছে। ইতিহাসে এমন একটিও নজির আছে কি যেখানে বলা হয়েছে অমুক ফল অমুক শস্য আজ প্রথম অমুক ব্যক্তি খেয়ে সেটাকে খাদ্য বলে প্রমাণ করল?

এইসব চিন্তা থেকেই নিশিকান্তবাবু একদিন স্থির করলেন যে এই নতুন ফল—যার নাম তিনি দিয়েছেন ম্যাকেঞ্জি ফ্রুট—তাঁকে খেয়ে দেখতে হবে। তাঁর এই সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তিনি বন্ধুকে কিছু বললেন না। কারণ বললে তিনি হয় ঔদাসীন্য প্রকাশ করবেন, না হয় হাঁ হাঁ করে উঠবেন। দুটোর কোনোটাই নিশিকান্তবাবু চান না।

এই সিদ্ধান্ত নেবার পরদিনই নিশিকান্তবাবু প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে সোজা চলে গেলেন ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বাগানে।

মনে একটা সংশয় ছিল যে দেখবেন গাছে ফল নেই, সব ঝরে পড়েছে, কিন্তু গিয়ে দেখলেন ফলের সংখ্যা আগের দিনের চেয়েও বেশি। নিশিকান্তবাবু ঝোলা নিয়ে গিয়েছিলেন, টস্‌টসে দেখে তিনটি ফল পেড়ে তাতে পুরে বাড়িমুখো হলেন। তিনি বেশ বুঝতে পারছিলেন তাঁর হৃৎস্পন্দনের মাত্রা সাধারণ অবস্থার চেয়ে বেশ খানিকটা দ্রুত। আজ তিনি যা করতে চলেছেন সেটা পৃথিবীতে আর কেউ কোনোদিন করেনি।

কিন্তু তাই কি?

গাছটা ত ছিল ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বাগানে। তিনি নিজে কি এ ফল কোনোদিন খেয়ে দেখেননি?

এই নতুন প্রশ্নটা সাময়িকভাবে নিশিকান্তবাবুর সমস্ত উৎসাহকে ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিল। কে দিতে পারে এই প্রশ্নের উত্তর? ম্যাকেঞ্জি সাহেবের সঙ্গে করিমগঞ্জের কারুর ঘনিষ্ঠতা ছিল কিনা সেটা আগে জানা দরকার, তারপর ফল ভক্ষণ!

উত্তর মিলল তারকবাবুর কাছে।

‘ম্যাকেঞ্জি বিশেষ মিশতেন টিশতেন না কারুর সঙ্গে’, বললেন তারকবাবু। ‘তবে শিবশরণ উকীলের সঙ্গে সাহেবকে ঘুরতে দেখেছি বার কয়েক। বোধ হয় সাহেবের কোনো মামলার সূত্রে দুজনের আলাপ হয়।’

শিবশরণ মিত্র ব্যাপারটাকে অনেক সহজ করে দিলেন। বললেন, ‘মামলা নয়। তাঁরও বাগানের শখ, আমারও বাগানের শখ, আর এই সূত্রেই আমাদের আলাপ। তেতাল্লিশ রকম গোলাপ ছিল আমার বাগানে। সাহেব দেখে খুব তারিফ করেছিলেন।’

নিশিকান্তবাবু ভরসা পেয়ে ঝোলা থেকে ফল বার করলেন।

‘এই ফল কি ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বাগানে দেখেছেন কখনো?’

শিবশরণবাবুর ভুরু কুঁচকে গেল।

‘সাহেবের বাগানে ছিল এই ফল?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘কোনখানটায়?’

নিশিকান্তবাবু বর্ণনা দিলেন।

‘কাছাকাছি একটা বাজে-ঝলসানো আমলকী গাছ আছে কি?’ প্রশ্ন করলেন শিবশরণবাবু।

তা আছে। মনে পড়েছে নিশিকান্তবাবুর। এই অজানা গাছটার পুব দিকে হাত দশেক দূরে।

‘তার মানে মেমসাহেব যেখানে মারা গিয়েছিলেন ঠিক সেইখানেই এই গাছ,’ বললেন শিবশরণ উকীল। ‘তবে সাহেব থাকাকালীন এ গাছ ছিল না। থাকলে আমার চোখে পড়ত। ও বাগানে সাহেবের সঙ্গে অনেক ঘুরিচি আমি।’

হাঁফ ছাড়লেন নিশিকান্তবাবু। পায়োনীয়ার হবার পথে তাঁর আর কোনো বাধা নেই। তিনিই হবেন ম্যাকেঞ্জি ফ্রুটের প্রথম ভক্ষক।

সেই রাত্তিরে নিতাই ঠাকুরের রান্না চচ্চড়ি, মুসুরির ডাল, লাউঘণ্ট আর ট্যাংরা মাছের ঝোল খেয়ে বন্ধুর সঙ্গে উত্তরের বারান্দায় বসে আধ ঘণ্টা খানেক গল্প করে নিশিকান্তবাবু চলে এলেন নিজের ঘরে। বিকেল থেকেই মেঘ করেছিল, দশটা নাগাদ বজ্রবিদ্যুৎ সহ বেশ জাঁকিয়ে বৃষ্টি নামল। নিশিকান্তবাবু ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে কুঁজো থেকে এক গেলাস জল ঢেলে নিয়ে খাটের পাশে টেবিলের উপর রাখলেন। তারপর একটি ম্যাকেঞ্জি ফ্রুট হাতে নিয়ে দেয়ালে টাঙানো পরমহংসদেবের ছবিটা উদ্দেশ করে একটা নমস্কার ঠুকে শরীরটাকে টান করে হাতের ফলে কামড় দিলেন।

বার তিনেক চিবোবার পর ফলের রস খাদ্যনালীতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুঝলেন এ একেবারে দেবভোগ্য ফল। এর সঙ্গে অন্য কোনো ফলের সাদৃশ্য নেই। তুলনাও নেই।

একটি আস্ত ফল শেষ করতে পাঁচ মিনিট লাগল নিশিকান্তবাবুর। তখন রাত পৌনে এগারটা। ঘুমোনর কোনো প্রশ্ন ওঠে না। একে ত আবিষ্কারের উত্তেজনা, তার উপর একটা সংশয় আছে—ফলে যদি কোনো অনিষ্ট হয় সেটা হয়ত রাতারাতিই জানা যাবে।

নিশিকান্তবাবু ঘন ঘন নিজের নাড়ী টিপে দেখতে লাগলেন। চেহারায় কোনো অনিষ্টের ছাপ পড়ছে কিনা জানার জন্য আধ ঘণ্টা অন্তর অন্তর দেয়ালে টাঙানো আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। শেষটায় মাঝরাতেই ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পায়চারি করে শরীরের মাংসপেশীগুলো সব ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা পরীক্ষা করে দেখলেন।

পাঁচটার ঠিক পরে যখন ভোরের প্রথম পাখি ডাকতে শুরু করেছে, তখন নিশিকান্তবাবু উপলব্ধি করলেন যে তাঁর কোমরের বাত সম্পূর্ণ সেরে গেছে, এবং এমন সুস্থ তিনি গত ত্রিশ বছরের মধ্যে কখনো বোধ করেননি।

॥ ২ ॥

ম্যাকেঞ্জি ফলের এই আশ্চর্য স্বাদ তিনি একাই ভোগ করবেন এটা নিশিকান্তবাবুর কাছে ন্যায্য বলে মনে হল না। সেই সঙ্গে তিনিই যে ফলের সন্ধান পেয়েছেন এবং তিনিই যে প্রথম এই ফল খেয়ে দেখেছেন সেটাও ত জানানো দরকার। বন্ধুর এ ব্যাপারে কোনো উৎসাহ নেই সেটা নিশিকান্তবাবু ভালোভাবেই জানেন। ব্যাপারটা কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তির গোচরে আনা উচিত এটা মনে করে জ্ঞান চৌধুরীর নামটাই সবচেয়ে আগে মনে পড়ল। মানুষে মানুষে রুচিভেদ হয় এটা নিশিকান্তবাবু জানেন, কিন্তু এমন সুস্বাদু ফল কারুর খারাপ লাগতে পারে এটা যেন তাঁর বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাই একটি ফল সঙ্গে নিয়ে তিনি গেলেন চৌধুরী নিবাসে।

বৈঠকখানায় জ্ঞানবাবুর সঙ্গে একটি অবাঙালী ভদ্রলোককে দেখে কিছুটা দমে গেলেও, নিশিকান্তবাবু ভণিতা না করে তাঁর আসার কারণটা জানিয়ে দিয়ে থলি থেকে ফলটা বার করে চৌধুরী মশায়ের সামনে টেবিলের উপর রাখলেন।

‘নাম জানলেন এ ফলের?’ জ্ঞান চৌধুরী প্রশ্ন করলেন। নিশিকান্তবাবু জানালেন রয়্যাল বোট্যানিক্যাল সোসাইটি পর্যন্ত ছবি দেখে ফলটাকে চিনতে পারেনি।—‘আপনি খেয়ে দেখুন, অতি সুস্বাদু ফল।’

জ্ঞানবাবু আপত্তি করলেন না, তবে কামড় দিয়ে না খেয়ে চাকরকে ডেকে ছুরি আর দুটো প্লেট আনিয়ে নিজে এক টুকরো নিয়ে এক টুকরো দিলেন অন্য ভদ্রলোকটিকে। খাওয়ার পর দুজনের মুখের ভাব দেখে নিশিকান্তবাবুর মন খুশিতে ভরে গেল।

‘এ যে অতি সুস্বাদু মশাই!’ বললেন জ্ঞানবাবু।

‘ওয়ান্ডারফুল!’ বললেন অন্য ভদ্রলোকটি। ‘ডিলিশাস! ইয়ে ফল কোথায় মিলল?’

নিশিকান্তবাবু সরল মনে সব কিছুই বলে দিলেন। এমনকি তাঁর বাত সেরে যাওয়ার ব্যাপারটা পর্যন্ত।

‘ম্যাকেঞ্জি ফ্রুট? একি আপনি দিলেন নাম?’ অবাঙালী ভদ্রলোকটি জিজ্ঞেস করলেন।

‘নাম ত একটা দেওয়া দরকার’, বললেন নিশিকান্তবাবু। ‘এ ছাড়া আর কিছু মনে পড়ল না।’

ম্যাকেঞ্জি ফ্রুট

নামটা যে বেশ জবরদস্ত হয়েছে সেটা দুই ভদ্রলোকই স্বীকার করলেন। আর বেশি কথা না বাড়িয়ে দুজনকেই নমস্কার জানিয়ে নিশিকান্তবাবু বিদায় নিলেন।

চৌধুরী নিবাস থেকে রাস্তায় বেরিয়ে নিশিকান্তবাবু ভারী প্রসন্ন বোধ করলেন। একটা কীর্তি রেখে যেতে চলেছেন তিনি। এমন যে হবে সেটা তাঁর এই বাষট্টি বছরের জীবনের ঘটনা থেকে কারুর বোঝার সাধ্যি ছিল কি? না, ছিল না। মাঝারি মানুষের মাঝারি জীবন তাঁর। আর লক্ষ লক্ষ মাঝারি জীবনের সঙ্গে কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু আজ তিনি অনন্য। শুধু বাঙালীদের মধ্যে নয়, নিজ-দেশবাসীদের মধ্যে নয়, সারা পৃথিবীর মধ্যে।

কিন্তু কীর্তির শেষ ত এখানেই না। এই ফল যদি দশজনের হাতে তুলে দেওয়া যায় তবেই না কীর্তি। ফলের ব্যাপক চাষ হলে দেশের লোকের যে কত উপকার হবে সেটা ভাবতেই নিশিকান্তবাবুর বুক দশহাত হয়ে গেল। ফলের বীজ ত আছে তাঁর কাছে! হালকা বেগুনী শাঁসের ভিতর কালো রঙের বীজ। সেটা পুঁতলে গাছ হবে না কি? তাঁর বাড়ির পিছনদিকে লাউ মাচার পাশে ত খানিকটা জমি রয়েছে। সেখানে পরীক্ষা করে দেখতে ক্ষতি কী?

কিন্তু সে-গুড়ে বালি। বীচি পুঁতে জলটল দিয়ে কোন ফল হল না। সাতদিন অপেক্ষা করেও অঙ্কুরের কোনো চিহ্ন দেখতে পেলেন না নিশিকান্তবাবু।

ইতিমধ্যে ফলের আশ্চর্য গুণের আরো পরিচয় পেয়েছেন তিনি। পড়শী অবনী ঘোষের আট বছরের ছেলে ভূতো তাঁর কাছে মাঝে মাঝে অঙ্ক দেখাতে আসে। তার ফ্যারিনজাইটিস সেরে গেছে ফল খেয়ে। পাড়ার একটা ঘেয়ো কুকুর তারকবাবুর বাড়ির রাস্তার দিকের বারান্দার সামনে এসে রোজ ঘুর ঘুর করে। নিশিকান্তবাবু তাকে ফলের একটা টুকরো খেতে দেওয়ায় দুদিন পরে দেখলেন তার ঘা শুকিয়ে গেছে। এমনকি বন্ধুকে না বলে তার চায়ে এক চামচ ম্যাকেঞ্জির রস মিশিয়ে দেওয়ার ফলে ভদ্রলোকের দশদিনের বসা সর্দি একদিনে হাওয়া।

কিন্তু শুধু করিমগঞ্জের লোকেরাই ফলের কথা জানবে, বাইরের আর কেউ জানবে না, এটা কি হয়? জ্যোতিপ্রকাশবাবুর তোলা একটা ছবি এখনো আছে নিশিকান্তবাবুর কাছে। ইংরিজিতে ফুলস্ক্যাপের চার পাতা একটি প্রবন্ধ লিখে ছবি সমেত স্টেটস্‌ম্যান পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলেন তিনি। প্রবন্ধের নাম ‘এ ওয়ান্ডারফুল নিউ ফ্রুট’। বলা বাহুল্য, তিনি নিজেই ফলের আবিষ্কর্তা সেটা বেশ পরিষ্কার ভাবে লিখে দিলেন নিশিকান্তবাবু। এ অবস্থায় আত্মপ্রচারের লোভটা সামলানো কি সহজ কথা?

সাতদিন বাদে একটি বছর পঁচিশেকের যুবক তাঁর বাড়িতে এল দেখা করতে। ইনি অঞ্জন সেনগুপ্ত, স্টেটসম্যানের রিপোর্টার। স্মার্ট চেহারা, চোখে পুরু চশমা, সঙ্গে ক্যামেরা ও টেপরেকর্ডার। নিশিকান্তবাবু যে ফলটার কথা লিখেছেন সেটা সম্বন্ধে আরো তথ্য সংগ্রহ করতে পাঠানো হয়েছে তাকে।

নিশিকান্তবাবু খুশি হলেন। এই ত চাই। এটাই ত আশা করছিলেন তিনি।

‘আমার লেখাটা যাচ্ছে ত?’ নিশিকান্তবাবু প্রশ্ন করলেন।

‘লেখার চেয়ে, মানে, সাক্ষাৎকারটা আজকাল লোকে পছন্দ করে বেশি,’ বললেন অঞ্জন সেনগুপ্ত। ‘ইয়ে, আমি কি গাছটা একবার দেখতে পারি?’

‘নিশ্চয়ই পারেন,’ বললেন নিশিকান্তবাবু, ‘তবে মাইল খানেক হাঁটতে হবে।’

দুজনে মিলে বেরিয়ে পড়লেন ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বাগানের উদ্দেশ্যে। দিন দশেক যাওয়া হয়নি বাগানে। শেষ যেদিন গেছেন সেদিনও নিশিকান্তবাবু দেখেছেন গাছ ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে। এ ফলের কি তাহলে ‘সীজন’ নেই? সারা বছরই কি গাছে ফল ফলে? যাবার পথে এইসব প্রশ্ন নিশিকান্তবাবুর মনে ঘুরছিল।

কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার। যে বাগানে তিনি ছাড়া আর কেউ প্রবেশ করেনি গত কয়েক মাস—এক ক্যামেরা নিয়ে জ্যোতিপ্রকাশ চৌধুরী ছাড়া—সেখানে আজ এত লোক কেন?

দুজন লোককে চিনতে পারলেন নিশিকান্তবাবু—জ্ঞানপ্রকাশ চৌধুরী ও তাঁর ঘরে সেদিন যে অবাঙালী ভদ্রলোকটি ছিলেন তিনি। আজ তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন জ্ঞানবাবু।

‘এঁকে সেদিন দেখেছেন আপনি। ইনি হচ্ছেন চুনিলাল মানসুখানি। আপনার দেওয়া সেই ফলটি খেয়ে অবধি এনার মাথায় নানান ফন্দি খেলছে।’

‘তাই বুঝি?’

নিশিকান্তবাবুর বুকের মধ্যে কেন জানি দুরু দুরু আরম্ভ হয়ে গেছে। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে সেটা তিনি বেশ বুঝতে পারছেন।

‘ওই ফলের চাষ করার ইচ্ছে মিঃ মানসুখানির। ব্যবসাদার মানুষ ত, নতুন ব্যবসার সুযোগ পেলে ওঁকে সামলানো দায়।’

নিশিকান্তবাবু কথাটা না বলে পারলেন না।

‘কিন্তু আমি বীজ পুঁতে দেখেছি। চারার কোনো লক্ষণ দেখিনি।’

মানসুখানি হেসে উঠলেন। ‘গাছ শুধু এই বাগানের মাটিতেই জন্মায়। ওই দেখুন—সাতদিন আগে পোঁতা বীজে কেমন চারা গজিয়েছে।’

নিশিকান্তবাবু অবাক হয়ে দেখলেন আগের গাছটা থেকে হাত দশেক ডাইনে একটি সতেজ গাছের চারা, পাতা দেখে তাকে চিনতে কোনো অসুবিধা হয় না।

সাংবাদিক অঞ্জন সেনগুপ্ত জোর খবরের গন্ধ পেয়ে নিশিকান্তবাবুকে ছেড়ে মানসুখানিকে ধরেই ইন্টারভিউ করে নিয়ে গেলেন। নিশিকান্তবাবুর প্রবন্ধের বদলে সেই ইন্টারভিউটাই বেরোল কাগজে।

ছ’মাসের মধ্যে ম্যাকেঞ্জি ফলের গাছে ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বাগান ভরে গেল। এক মাসের মধ্যে জ্ঞান চৌধুরীর সঙ্গে পার্টনারশিপে মানসুখানির ব্যবসা চালু হয়ে গেল। মাত্র একশো বাষট্টিটা গাছ। কিন্তু তা থেকে ফল পাওয়া যায় সারা বছর ধরে। ইতিমধ্যে গবেষণাগারে পরীক্ষা করে জানা গেছে ফলে সাত রকম ভিটামিন আছে, এবং সেই সঙ্গে আরো এমন কিছু আছে যার সঙ্গে রাসায়নিকদের এখনো পরিচয় হয়নি।

স্বাদ গন্ধ উপকারিতা ও দুষ্প্রাপ্যতার জন্য ফলের দাম হল আকাশ-ছোঁয়া। এক একটি টিনে দু’টুকরো করে কাটা সংরক্ষক-রসে ভাসমান চারটি করে খোসা ছাড়ানো বীজবিহীন ফল। প্রতি টিনের দাম ভারতীয় টাকার হিসেবে সাড়ে তিনশো। দেশের লোক সে ফলের শুধু নামই শুনেছে, তাদের ঘরে সে ফল পৌঁছায় না, কারণ সব ফল চলে যায় জাপান, ইউরোপ ও আমেরিকায়। ফলের খ্যাতি সারা বিশ্বে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু বহু চেষ্টা সত্ত্বেও ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বাগানের বাইরে সে ফল গজানো সম্ভব হয়নি।

যেমন বাগানে, তেমনি করিমগঞ্জের লাগোয়া বীরসিংহপুরে, ফল যেখানে টিনে ভরা হয় সেই কারখানায় পুলিশের কড়া বন্দোবস্ত করা হয়েছে। বাগানের চারিপাশ ঘিরে নতুন পাঁচিল উঠেছে, দেখে মনে হয় জেলখানার পাঁচিল। বাংলো ভেঙে মানসুখানির ম্যাকেঞ্জি ফ্রুট কোম্পানির আধুনিক অফিস তৈরি হয়েছে। রোজ সকাল ন’টায় জার্মান মার্সেডিজ গাড়িতে ভদ্রলোককে সেই অফিসে আসতে দেখা যায়। তাঁর কয়েকজন খুব কাছের লোকও মাঝে মাঝে সেখানে আসেন, আর যাবার সময় সঙ্গে একটি করে ফলের টিন নিয়ে যান কনসেশন রেটে। এ ছাড়া অফিসের কর্মীর বাইরে আর কারুর প্রবেশাধিকার নেই।

আজ দেড় বছর হল এই ব্যবসা চালু হয়েছে। কিন্তু নিশিকান্তবাবুর হতভম্ব ভাবটা এখনো কাটেনি। অফিস খোলার দুদিন বাদে তিনি গিয়েছিলেন ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বাগান দেখতে। কিন্তু পুলিশ তাঁকে ঢুকতে দেয়নি। তিনি ভারী অবাক হয়ে বলেন, ‘হাম্‌ নিশিকান্ত বোস হ্যায়—ইয়ে ফল হমারি আবিষ্কার হ্যায়—তুমহারা বাবুকো যাকে বোলো।’ কিন্তু সশস্ত্র দ্বাররক্ষক তাঁর কথায় কান দেয়নি। জ্ঞান চৌধুরীর বাড়িতে গিয়েও কোনো লাভ হয়নি। তিনি এখন আর যার তার সঙ্গে দেখা করেন না।

তারক বাগচী অবশ্য এতদিনে সবই জেনেছেন। তিনি ভর্ৎসনার সুরে বন্ধুকে বলেন, ‘তোমার বন্ধু উকীল, তুমি তাঁর সঙ্গে পরামর্শ না করে ফস্‌ করে কতগুলো ব্যাপার করে বসলে—ধুরন্ধর লোকের মতিগতি তুমি বুঝবে কি করে? তোমাকে বোকা পেয়ে তারা যে লেঙ্গি মারবে এতে করে আশ্চর্য কী?’

তবে একটি ফল নিশিকান্তবাবুর কাছে রয়ে গিয়েছিল। বীরসিংহপুরে গিয়ে একটি খালি টিন তিনি সংগ্রহ করে এনেছিলেন অনেক কষ্টে। সেই ফল তার মধ্যে তিনি রেখে দিয়েছেন। তাঁরই আবিষ্কার এই ফল, তিনিই প্রথম খেয়েছিলেন, তিনিই নামকরণ করেছিলেন ম্যাকেঞ্জি ফ্রুট।

সেই আশ্চর্য ফল এই দেড় বছর পরে আজও টাট্‌কা রয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *