অপদার্থ

অপদার্থ

অপদার্থ কথাটা অনেক লোক সম্বন্ধে অনেক সময়ই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন আমাদের চাকর নবকেষ্ট। ‘নব, তুই একটা অপদার্থ’—এই কথাটা ছেলেবেলায় মার মুখে অনেকবার শুনেছি। নব কিন্তু কাজ ভালোই করত; দোষের মধ্যে সে ছিল বেজায় ঘুমকাতুরে। দিনের বেলা প্রায়ই একট টেনে ঘুম দেওয়ার ফলে বিকেলে চায়ের জলটা চড়াতে চারটের জায়গায় হয়ে যেত সাড়ে চারটে। কাজেই মা যে তাকে অপবাদটা দিতেন সেটা ছিল রাগের কথা।

কিন্তু সেজোকাকার বেলায় অপদার্থ কথাটা যেরকম লাগসই ছিল সেরকম আর কারুর বেলায় হয়েছে বলে আমার জানা নেই। সেজোকাকা মানে যাঁর ভালো নাম ক্ষেত্রমোহন সেন, ডাক নাম ক্ষেতু। বাবারা ছিলেন পাঁচ ভাই। বাবাই বড়, তারপর মেজো সেজো সোনা আর ছোট। পাঁচের মধ্যে সেজো বাদে আর সকলেই জীবনে প্রতিষ্ঠালাভ করেছিলেন। বাবা ছিলেন নামকরা উকীল। মেজো সম্মানিত অধ্যাপক, সংস্কৃত আর ইতিহাসে ডবল এম, এ। সোনা ব্যবসা করে কলকাতায় তিনখানা বাড়ি তুলেছিলেন, আর ছোট কালোয়াতি গানে বড় বড় মুসলমান ওস্তাদের বাহবা আর ছত্রিশটা সোনা-রুপোর মেডেল পেয়েছিলেন ধনী সমঝদারদের কাছ থেকে।

আর সেজোকাকা?

তাঁকে নিয়েই এই গল্প, তাই তাঁর কথাটা এককথায় বলা যাবে না।

সেজোকাকার জন্মের মুহূর্তে নাকি ভূমিকম্প হয়েছিল। অনেকের মতে সেই কারণে নাকি তাঁর ঘিলুতে জট পাকিয়ে যায়, আর তাই তাঁর এই দশা। হাম আর চিকেন পক্স একবার না একবার প্রায় সব শিশুদেরই হয়। সেজোকাকার এই দুটো ত হয়েই ছিল, সেই সঙ্গে কোনো-না-কোনো সময় হয়েছিল হুপিং কাশি, ডিপথিরিয়া, ডেঙ্গু, একজিমা, আসল বসন্ত। শিশু বয়সে সাতবার কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে নীল হয়ে সেজোকাকা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। সাত বছরে সেজোকাকার তোৎলামো দেখা দেয়; সাড়ে ন’য়ে পেয়ারা গাছ থেকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে তোৎলামো সেরে যায়। এই পতনের ফলে সেজোকাকার গোড়ালি ভেঙে যায়। ডাক্তার বিশ্বাস সেটাকে ঠিকমতো জোড়া দিতে না পারায় সেজোকাকাকে সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটতে হত। এই খোঁড়ানোর জন্য তাঁর আর খেলাধুলা করা সম্ভব হয়নি। হাতের টিপের অভাবে ক্যারম, আর মাথা খেলে না বলে তাসপাশাও হয়নি।

সেজোকাকা ইস্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পর পর তিনবার এফ, এ পরীক্ষায় ফেল হবার পর ওঁর বাবা, মানে আমার ঠাকুরদাদা, নিজেই ওঁর পড়াশুনা বন্ধ করে দেন। বলেন, ‘ক্ষেতু, তুই যখন একেবারেই অপদার্থ, তখন তোর এডুকেশনের পেছনে খরচ করা মানে টাকা জলে দেওয়া। তবে গলগ্রহ হয়ে থাকতে দেওয়াও ত চলে না! তুই আজ থেকে ভোম্বলের সঙ্গে বাজারে যাবি। শাক সব্জি মাছ মাংস চিনে নিবি। তারপর থেকে সংসারের বাজারটা তুই-ই করবি।’ ভোম্বলকাকা হলেন বাবার এক দূরসম্পর্কের ভাই; আমাদের বাড়িতে থেকেই পড়াশুনা করেছেন, মানুষ হয়েছেন।

সেজোকাকা বেশ কিছুদিন বাজারে গেলেন ভোম্বলকাকার সঙ্গে। তারপর একদিন—সেদিন বাড়িতে লোক খাবে—ঠাকুরদা সেজোকাকার পকেটে দুটো দশ-টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘দেখি তুই কেমন জিনিসপত্তর চিনেছিস। আজ বাজারের ভার তোর ওপর।’

সেজোকাকাকে দিয়ে বাজার আর হল না, কারণ কাকার পাঞ্জাবীর পকেটে ফুটো, নোট দুখানা বাজারে পৌঁছানর আগেই পথে কোথায় গলে পড়েছে। এর পর থেকে কে আর কাকাকে ট্রাস্ট করবে?

আমার প্রথম স্মৃতিতে সেজোকাকার বয়স তেত্রিশ আর আমার তিন। কালীপুজোর দিন সন্ধ্যাবেলা। ঘটনাটা মনে আছে কেন সেটা আরেকটু বললেই বোঝা যাবে। সেজোকাকা বারান্দার মেঝেতে হামাগুড়ি দিচ্ছেন, আর আমি তাঁর পিঠে চড়ে ঘোড়া-ঘোড়া খেলছি। পাশের বাড়ি থেকে হঠাৎ একটা জ্বলন্ত উড়নতুবড়ি এসে বারান্দার তক্তপোষের উপর পড়তেই ‘সর্বনাশ’ বলে সেজোকাকা সটান উঠে দাঁড়ালেন। তার ফলে আমি পিঠ থেকে ছিট্‌কে পড়লাম শান বাঁধানো মেঝেতে, আর সঙ্গে সঙ্গে মাথা ফেটে রক্তারক্তি কাণ্ড। সেদিন অবিশ্যি সেজোকাকাকে ভয়ংকর সব কথা শুনতে হয়েছিল বাড়ির প্রায় সকলের কাছ থেকেই। আমার কিন্তু একটু দঃখ হয়েছিল কাকার জন্য। কেউ তাঁকে গ্রাহ্য করে না, এমনকি মানুষের মধ্যেই ধরে না, তাই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমার কাকার উপর একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল। মাঝারি হাইট, মাঝারি রং, মুখে সব সময়ই একটা খুশি আর দুঃখ মেশানো ভাব—মনে হত সব মানুষেরই বুদ্ধি হবে, সব মানুষই করিৎকর্মা হবে, তার কী মানে? শহরভর্তি এত লোকের মধ্যে একটা লোক যদি সেজোকাকার মতো হয় তাতে দোষ কি?

আমি তাই ফাঁক পেলেই তাঁর একতলার কোণের ঘরটায় গিয়ে সেজোকাকার সঙ্গে বসে গল্প করতাম। কদিন গিয়েই এটা বুঝেছিলাম যে সেজোকাকাকে গল্প বলতে বলে কোনো লাভ নেই, কারণ তাঁর কোনো গল্পই শেষ পর্যন্ত মনে থাকে না।

‘তারপর কী হল সেজোকাকা?’

‘তারপর? হুঁ…তারপর…দাঁড়া, তারপর…তারপর…তারপর…’

গলার স্বর ‘তারপর’ ‘তারপর’ বলতে বলতে ক্রমে দম ফুরোনো হারমোনিয়ামের মতো ক্ষীণ হয়ে আসে। সেজোকাকা গল্প থেকে গুন্‌গুন্ বেসুরো গানে চলে যান, শেষটায় গানও ফুরিয়ে গিয়ে কাকার মাথাটা ঘুমে ঢুলতে থাকে। বুঝতে পারি গল্পের বাকি অংশ মনে করার মেহনৎ কাকার পোষাচ্ছে না। তাঁকে সেই অবস্থায় রেখেই আমি পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি, সেজোকাকা আর ডাকেনও না।

আমার যখন বছর বারো বয়স তখন একদিন তাঁর ঘরে গিয়ে দেখি তিনি একটা মোটা বই খুলে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। জিগ্যেস করাতে বললেন আয়ুর্বেদের বই।

বললাম, ‘ও বই পড়ে কী হবে সেজোকাকা?’

কাকা একটু ভেবে গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘এটাও ত একটা ব্যারাম, তাই না?’

‘কোনটা?’

‘এই যে আমার দ্বারা কিচ্ছু হচ্ছে না, কিচ্ছু মনে থাকে না, কিচ্ছু মাথায় ঢোকে না—এটা নিশ্চয়ই একটা রোগ?’

কী আর বলব? বললাম, ‘তা ত হতেই পারে, সেজোকাকা।’

‘তাহলে এর চিকিৎসা হবে না কেন?’

বললাম, ‘তুমি নিজেই চিকিৎসা করবে নাকি?’

আমি জানতাম যে সেজোকাকার এই অপদার্থতার জন্য তাঁকে ডাক্তার দেখানোর কথা কেউ কোনোদিন ভাবেনি। সত্যি বলতে কি, ওঁর ছেলেবেলার সেই একগাদা ব্যারামের পর ওঁর আর বিশেষ কোনো অসুখটসুখ করেনি। স্বাস্থ্যটা ওঁর মোটামুটি ভালোই ছিল।

সেজোকাকা বলে চললেন, ‘চক বাজারে ফুটপাথে বইটা পড়ে ছিল, দশ আনা দিয়ে কিনে এনেছি। বোধ হয় কাজে দেবে। মনে হচ্ছে আমার ব্যারামের জন্যেও আয়ুর্বেদী চিকিৎসা আছে।’

দুদিন বাদে—তখন বর্ষাকাল—বিকেলে সেজোকাকার ঘরে গিয়ে দেখি উনি বেরোবার তোড়জোড় করছেন। পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো, মালকোঁচা মেরে পরা ধুতি, গলায় জড়ানো সুতির চাদর আর হাতে ছাতা। বললেন, ‘ভটচাষ পাড়ায় ভাঙা শিব মন্দিরটার পেছনে একটা গাছ আছে খবর পেয়েছি। তার শেকড় আমার চাই। ওইটে পেলেই—ব্যস্ নিশ্চিন্তি।’

সেজোকাকা বেরিয়ে পড়লেন। আকাশ ঘোলাটে হয়ে আসছে, তেমন তেমন বৃষ্টি নামলে কাকার প্ল্যান ভেস্তে যাবে।

আমি ঘণ্টাখানেক নিচে ঘুর ঘুর করে দোতলায় নিজের ঘরে চলে গেলাম। দক্ষিণের জানালা দিয়ে সামনের রাস্তা দেখা যায়। বৃষ্টি নামল না। সন্ধে যখন হব হব, তখন দেখি সেজোকাকা ফিরছেন। দুড়দাড় করে নিচে নেমে সদর দরজার মুখে কাকার সঙ্গে দেখা।

‘পেলে শেকড়?’

‘না রে। ভুল হয়ে গেল। একটা টর্চ নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। জায়গাটা জংলা আর বেজায় অন্ধকার।’

‘কিন্তু ওটা কী?’

কাকার কথার মধ্যেই চোখ পড়েছে আমার। খদ্দরের পাঞ্জাবীর বুকে লাল রঙের ছোপ।

‘তাই ত, এটা ত খেয়াল করিনি এতক্ষণ!’

পাঞ্জাবী খুলতেই বেরোল একটা জোঁক। ভীম যেমন দুর্যোধনের বুকের রক্ত খেয়েছিল, তেমনি ইনি সেজোকাকার বুকের রক্ত খেয়ে ফুলে ঢোল, টোকা দিতেই টপ করে মাটিতে পড়ে গেল।

কিন্তু একটা জোঁকে আর সেজোকাকার কী হবে? কাঁধ, কনুই, কোমর, পায়ের গুল, হাঁটু, গোড়ালি—সব জায়গা মিলিয়ে চোদ্দটা জোঁক বেরোল কাকার গা থেকে। পাঁচ-ছ আউন্স রক্ত যে তাঁর আজ খোয়া গেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বলা বাহুল্য, তাঁর আয়ুর্বেদ চর্চাও এই একটি ঘটনাই দিল বন্ধ করে।

পড়াশুনায় আমি ছিলাম রীতিমত ভালো। আমাদের সময় এফ, এ, এনট্রান্সের যুগ শেষ হয়ে ম্যাট্রিক চলছে। পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে থার্ড হয়ে বিজ্ঞান পড়ব বলে চলে এলাম কলকাতায়। হোস্টেলে থেকেই এম. এস. সি পর্যন্ত পড়ে পদার্থ বিজ্ঞানে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে চলে যাই আমেরিকায়। শেষ পর্যন্ত গবেষক হিসাবে আমার বেশ খ্যাতি হয়। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ও গবেষণার কাজ আমি একসঙ্গে চালাতে থাকি।

অপদার্থ

বাইরে থাকার ফলে সেজোকাকার সঙ্গে যোগসূত্র ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। একবার—তখন আমি সবে অধ্যাপনা শুরু করেছি—মা-র চিঠিতে এক অদ্ভুত খবর পেলাম। সেজোকাকা নাকি ফিল্মে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন। এখানে বলি যে সেজোকাকার সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের চেহারার একটা সাদৃশ্য ছিল। দেহের গঠন মোটেই এক নয়—সেজোকাকা ছিলেন পাঁচ ফুট ছ’ ইঞ্চি—তবে নাক চোখ মুখের সাদৃশ্য সকলের চোখেই ধরা পড়ত। পরমহংসদেব সম্বন্ধে একটা ফিল্ম তোলা হবে এবং তাতে বিবেকানন্দের ভূমিকা আছে খবর পেয়ে সেজোকাকা নাকি সরাসরি প্রযোজকের সঙ্গে দেখা করে অভিনয় করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। চেহারায় মিলের জন্য পার্টটা পেতে নাকি তাঁর কোনোই অসুবিধা হয়নি।

কিন্তু হপ্তাখানেক বাদেই আরেকটা চিঠিতে জানলাম কাকা নাকি ছবি থেকে বাদ হয়ে গেছেন। হবেন নাই বা কেন? ঘর বন্ধ করে প্রাণপণে পার্ট মুখস্থ করা সত্ত্বেও, এক নম্বর দৃশ্যে রামকৃষ্ণের কথার উত্তরে বিবেকানন্দের মুখ থেকে যদি তিন নম্বর দৃশ্যের উত্তর বেরিয়ে পড়ে, তাহলে আর তাঁকে দিয়ে কীভাবে কাজ চলে? অর্থাৎ ফিল্ম অভিনেতা হিসেবেও তিনি যে অপদার্থ সেটা সেজোকাকা প্রমাণ করে দিয়েছেন।

আমার যখন আটচল্লিশ বছর বয়স তখন শিকাগোতেই আমার ছোট ভাইয়ের একটা চিঠিতে জানি যে সেজোকাকা এক সাধুবাবার শিষ্য হয়ে কোয়েম্বেটর চলে গেছেন।

গত বছর ডিসেম্বরের গোড়ায় আমার ছোটকাকার মেয়ে কাকলির বিয়েতে আমাকে কলকাতায় আসতে হয়। সঙ্গে আমার স্ত্রী আর আমার দুই মেয়ে—তারা দুজনেই পুরোপুরি আমেরিকায় মানুষ। ইতিমধ্যে সেজোকাকার আর কোনো খবর পাইনি। তাই কলকাতায় এসে যখন শুনলাম উনি শহরেই আছেন এবং বহাল তবিয়তে আছেন, তখন স্বভাবতই তাঁকে একবার দেখার জন্য মনটা উৎসুক হয়ে উঠল। আমার বয়স তখন ষাট। তাই সোজা হিসেবে সেজোকাকার নব্বুই। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে ইতিমধ্যে প্রবাসেই কাকার দেহান্ত ঘটেছে।

শুনলাম ফার্ন রোডে তাঁর ভাগ্নে, অর্থাৎ আমার ছোট পিসিমার ছেলে ডাক্তার রণেশ গুপ্তর বাড়িতে এসে তিনি উঠেছেন মাস তিনেক হল। আরো শুনলাম যে ধর্মকর্ম ব্যাপারটা মোটেই তাঁর ধাতে সয়নি। দশ বছরেও ইডলি-দোসায় অভ্যাস হয়নি। রোজ আধপেটা খেয়ে ওজন নাকি প্রায় ত্রিশ কিলো কমে গেছে। আমি এসেছি শুনে তিনি তাঁর ডাক্তার ভাগ্নেকে বলেছেন, ‘ঝণ্টুকে বলিস একবার যেন এসে আমার সঙ্গে দেখা করে যায়।’

এক রবিবার সন্ধ্যায় গিয়ে হাজির হলাম ফার্ন রোডে। লোড শেডিং চলছে, দোতলার একটি ঘরে টিমটিমে মোমবাতি জ্বালিয়ে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে খাটের উপর বসে আছেন সেজোকাকা। একটা মটকার চাদরের উপর গলায় প্যাঁচ দিয়ে জড়ানো সবুজ মাফলার।

কাকাকে দেখলে চেনা যায় বটেই, এবং বলতেই হবে বয়সের পক্ষে রীতিমতো মজবুত চেহারা। মাথার চুল সব পাকা ঠিকই, কিন্তু এখনো যে চুল আছে সেটাই বড় কথা। আমায় দেখে হাসিতে মুখ ফাঁক হওয়াতে অরিজিন্যাল দাঁতও চোখে পড়ল ডজন খানেক, আর যখন কথা বেরোল তখন দেখলাম গলার স্বর ক্ষীণ হলেও কথায় বেশ তেজ আছে। এ তেজ কাকার মধ্যে আগে দেখিনি কখনো। তিনি যে সকলের বয়োজ্যেষ্ঠ, তাঁকে আর কারুর কাছে মাথা নোয়াতে হয় না, এই বোধই হয়ত তাঁর মেজাজে একটা ভারিক্কি ভাব এনে দিয়েছে।

‘কি রে ঝণ্টু’, বললেন সেজোকাকা, ‘মার্কিন মুলুকে গিয়ে কী করা হচ্ছে শুনি?’

আমার কাজের কথাটা যথাসম্ভব বিনয়ের সঙ্গে বললাম।

‘পদার্থ বিজ্ঞান? গবেষণা?’ বললেন সেজোকাকা। ‘লোকে মান্যি করে?’

আমার সাতাত্তর বছরের পিসিমা গলা সপ্তমে চড়িয়ে আমার বিনয়কে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে জানিয়ে দিলেন আমার খ্যাতির কথা।

‘বটে?’ বললেন সেজোকাকা। ‘নোবেল প্রাইজ পেয়েছিস কি না সেটা বল আগে।’

হাল্‌কা হেসে মাথা নাড়লাম।

‘তবে আর কিসের বড়াই? ছ্যা ছ্যা ছ্যা—একেবারে অপদার্থ!’

আমি এই গুঁতোর ঠেলা সামলাতে না সামলাতে সেজোকাকার বাক্যস্রোত আমাকে নাকানি-চোবানি খাইয়ে দিল।

‘তুই ত যাহক ভিন মুলুকে পালিয়ে বাঁচলি, আমি ভাবলুম কলকাতায় গিয়ে একটু সোয়াস্তি মিলবে। জীবনের শেষ কটা দিন তবু আপনজনের সান্নিধ্যে কাটবে—তা এসব কি হচ্ছে বল ত? শকুনির ঠোকরে ত হাড় পাঁজরা বার করে দিয়েছে শহরটার। দিনে দশ ঘণ্টা বিজ্‌লি নেই। শ্বাস টানলে ধোঁয়া-ধুলোয় প্রাণ অতিষ্ঠ। জিনিসপত্তরের যা দর, উদরের সাধ মিটিয়ে ভালোমন্দ যে একটু খাব তারও জো নেই।—দুর দুর দুর—অপদার্থ, অপদার্থ।’

সেদিন বুঝলাম যে সেজোকাকার উপর থেকে আমার পুরোন টানটা এখনো যায়নি, কারণ তাঁর কথাগুলো শুনে আমার মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠল। মনে হল আমরা বোধহয় অ্যাদ্দিন ভুল করে এসেছি, উল্টো ভেবে এসেছি; আসলে কাকা দিব্যি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ, আমরা শুদ্ধ দুনিয়াটাই অপদার্থ।

কিন্তু কথাটা যে ঠিক নয় সেটা সেজোকাকাই প্রমাণ করে দিলেন কয়েক দিনের মধ্যে।

এক সকালে ছোট পিসিমার বাড়ি থেকে ফোন এল যে সেজোকাকা ভোর রাত্রে ইহলোক ত্যাগ করে চলে গেছেন। আর বাবার দিনটাও মোক্ষম বেছেছেন কাকা, কারণ সেদিনই সন্ধ্যায় গোধূলি লগ্নে আমার ভাগ্নীর বিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অপদার্থ
1 of 2

অপদার্থ

অপদার্থ

অপদার্থ কথাটা অনেক লোক সম্বন্ধে অনেক সময়ই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন আমাদের চাকর নবকেষ্ট। নব, তুই একটা অপদার্থ–এই কথাটা ছেলেবেলায় মার মুখে অনেকবার শুনেছি। নব কিন্তু কাজ ভালই করত; দোষের মধ্যে সে ছিল বেজায় ঘুমকাতুরে। দিনের বেলা প্রায়ই একটু টেনে ঘুম। দেওয়ার ফলে বিকেলে চায়ের জলটা চড়াতে চারটের জায়গায় হয়ে যেত সাড়ে চারটে। কাজেই মা যে। তাকে অপবাদটা দিতেন সেটা ছিল রাগের কথা।

কিন্তু সেজোকাকার বেলায় অপদার্থ কথাটা যেরকম লাগসই ছিল সেরকম আর কারুর বেলায় হয়েছে। বলে আমার জানা নেই। সেজোকাকা মানে যাঁর ভালনাম ক্ষেত্রমোহন সেন, ডাকনাম ক্ষেতু। বাবারা ছিলেন পাঁচ ভাই। বাবাই বড়, তারপর মেজো সেজো সোনা আর ছোট। পাঁচের মধ্যে সেজো বাদে আর সকলেই জীবনে প্রতিষ্ঠালাভ করেছিলেন। বাবা ছিলেন নামকরা উকিল। মেজো সম্মানিত অধ্যাপক, সংস্কৃত আর ইতিহাসে ডবল এম. এ। সোনা ব্যবসা করে কলকাতায় তিনখানা বাড়ি তুলেছিলেন, আর ছোট কালোয়াতি গানে বড়বড় মুসলমান ওস্তাদের বাহবা আর ছত্রিশটা সোনা-রুপোর মেডেল পেয়েছিলেন ধনী সমঝদারদের কাছ থেকে।

আর সেজোকাকা?

তাঁকে নিয়েই এই গল্প, তাই তাঁর কথাটা এককথায় বলা যাবে না।

সেজোকাকার জন্মের মুহূর্তে নাকি ভূমিকম্প হয়েছিল। অনেকের মতে সেই কারণে নাকি তাঁর ঘিলুতে জট পাকিয়ে যায়, আর তাই তাঁর এই দশা। হাম আর চিকেন পক্স একবার না একবার প্রায় সব শিশুদেরই হয়। সেজোকাকার এই দুটো তো হয়েই ছিল, সেইসঙ্গে কোনও-না-কোনও সময় হয়েছিল। হুপিং কাশি, ডিপথিরিয়া, ডেঙ্গু, একজিমা, আসল বসন্ত। শিশু বয়সে সাতবার কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে নীল হয়ে সেজোকাকা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। সাত বছরে সেজোকাকার তোতলামো দেখা দেয়; সাড়ে নয়ে পেয়ারা গাছ থেকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে তোতলামো সেরে যায়। এই পতনের ফলে সেজোকাকার গোঁড়ালি ভেঙে যায়। ডাক্তার বিশ্বাস সেটাকে ঠিকমতো জোড়া দিতে না পারায় সেজোকাকাকে সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটতে হত। এই খোঁড়ানোর জন্য তাঁর আর খেলাধুলা করা সম্ভব হয়নি। হাতের টিপের অভাবে ক্যারম, আর মাথা খেলে না বলে তাসপাশাও হয়নি।

সেজোকাকা ইস্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পর পর তিনবার এফ. এ. পরীক্ষায় ফেল হবার পর ওঁর বাবা, মানে আমার ঠাকুরদাদা, নিজেই ওঁর পড়াশুনো বন্ধ করে দেন। বলেন, ক্ষেতু, তুই যখন একেবারেই অপদার্থ, তখন তোর এডুকেশনের পেছনে খরচ করা মানে টাক জলে দেওয়া। তবে গলগ্রহ হয়ে থাকতে দেওয়াও তো চলে না! তুই আজ থেকে ভোম্বলের সঙ্গে বাজারে যাবি। শাকসজি মাছ মাংস চিনে নিবি। তারপর থেকে সংসারের বাজারটা তুই-ই করবি। ডোম্বল কাকা হলেন বাবার এক দূরসম্পর্কের ভাই; আমাদের বাড়িতে থেকেই পড়াশুনা করেছেন, মানুষ হয়েছেন।

সেজোকাকা বেশ কিছুদিন বাজারে গেলেন ভোম্বলকাকার সঙ্গে। তারপর একদিন–সেদিন বাড়িতে লোক খাবে–ঠাকুরদা সেজোকাকার পকেটে দুটো দশ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বললেন, দেখি তুই কেমন জিনিসপত্তর চিনেছিস। আজ বাজারের ভার তোর ওপর।

সেজোকাকাকে দিয়ে বাজার আর হল না, কারণ কাকার পাঞ্জাবির পকেটে ফুটো, নোট দুখানা বাজারে পৌঁছনোর আগেই পথে কোথায় গলে পড়েছে। এর পর থেকে কে আর কাকাকে ট্রাস্ট করবে?

আমার প্রথম স্মৃতিতে সেজোকাকার বয়স তেত্রিশ আর আমার তিন। কালীপুজোর দিন সন্ধ্যাবেলা। ঘটনাটা মনে আছে কেন, সেটা আরেকটু বললেই বোঝা যাবে। সেজোকাকা বারান্দার মেঝেতে হামাগুড়ি দিচ্ছেন, আর আমি তাঁর পিঠে চড়ে ঘোড়া-ঘোড়া খেলছি। পাশের বাড়ি থেকে হঠাৎ একটা জ্বলন্ত উড়নতুবড়ি এসে বারান্দার তক্তপোশের উপর পড়তেই সর্বনাশ বলে সেজোকাকা সটান উঠে দাঁড়ালেন। তার ফলে আমি পিঠ থেকে ছিটকে পড়লাম শান বাঁধানো মেঝেতে, আর সঙ্গে সঙ্গে মাথা ফেটে রক্তারক্তি কাণ্ড। সেদিন অবিশ্যি সেজোকাকাকে ভয়ংকর সব কথা শুনতে হয়েছিল বাড়ির প্রায় সকলের কাছ থেকেই। আমার কিন্তু একটু দুঃখ হয়েছিল কাকার জন্য। কেউ তাঁকে গ্রাহ্য করে না, এমনকী মানুষের মধ্যেই ধরে না, তাই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমার কাকার উপর একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল। মাঝারি হাইট, মাঝারি রঙ, মুখে সবসময়ই একটা খুশি আর দুঃখ মেশানো ভাব–মনে হত সব মানুষেরই বুদ্ধি হবে, সব মানুষই করিৎকর্মা হবে, তার কী মানে? শহরভর্তি এত লোকের মধ্যে একটা লোক যদি সেজোকাকার মতো হয় তাতে দোষ কী?

আমি তাই ফাঁক পেলেই তাঁর একতলার কোণের ঘরটায় গিয়ে সেজোকাকার সঙ্গে বসে গল্প করতাম। কদিন গিয়েই এটা বুঝেছিলাম যে সেজোকাকাকে গল্প বলতে বলে কোনও লাভ নেই, কারণ তাঁর কোনও গল্পই শেষ পর্যন্ত মনে থাকে না।

তারপর কী হল সেজোকাকা?

তারপর? হুঁ…তারপর… দাঁড়া, তারপর…তারপর…তারপর…

গলার স্বর তারপর তারপর বলতে বলতে ক্রমে দম ফুরানো হারমোনিয়ামের মতো ক্ষীণ হয়ে আসে। সেজোকাকা গল্প থেকে গুনগুন বেসুরো গানে চলে যান, শেষটায় গানও ফুরিয়ে গিয়ে কাকার মাথাটা ঘুমে ঢুলতে থাকে। বুঝতে পারি গল্পের বাকি অংশ মনে করার মেহনত কাকার পোষাচ্ছে না। তাঁকে সেই অবস্থায় রেখেই আমি পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি, সেজোকাকা আর ডাকেনও না।

আমার যখন বছর বারো বয়স তখন একদিন তাঁর ঘরে গিয়ে দেখি তিনি একটা মোটা বই খুলে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। জিজ্ঞেস করাতে বললেন আয়ুর্বেদের বই।

বললাম, ও বই পড়ে কী হবে সেজোকাকা?

কাকা একটু ভেবে গম্ভীর ভাবে বললেন, এটাও তো একটা ব্যারাম, তাই না?

কোনটা?

এই যে আমার দ্বারা কিচ্ছু হচ্ছে না, কিচ্ছু মনে থাকে না, কিচ্ছু মাথায় ঢোকে না–এটা নিশ্চয়ই একটা রোগ?

কী আর বলব? বললাম, তা তো হতেই পারে, সেজোকাকা।

তা হলে এর চিকিৎসা হবে না কেন?

বললাম, তুমি নিজেই চিকিৎসা করবে নাকি?

আমি জানতাম যে সেজোকাকার এই অপদার্থতার জন্য তাঁকে ডাক্তার দেখানোর কথা কেউ কোনওদিন ভাবেনি। সত্যি বলতে কি, ওঁর ছেলেবেলার সেই একগাদা ব্যারামের পর ওঁর আর বিশেষ কোনও অসুখটসুখ করেনি। স্বাস্থ্যটা ওঁর মোটামুটি ভালই ছিল।

সেজোকাকা বলে চললেন, চকবাজারে ফুটপাথে বইটা পড়ে ছিল, দশ আনা দিয়ে কিনে এনেছি।  বোধহয় কাজে দেবে। মনে হচ্ছে আমার ব্যারামের জন্যও আয়ুর্বেদী চিকিৎসা আছে।

দুদিন বাদে তখন বর্ষাকাল বিকেলে সেজোকাকার ঘরে গিয়ে দেখি উনি বেরোবার তোড়জোড় করছেন। পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো, মালকোঁচা মেরে পরা ধুতি, গলায় জড়ানো সুতির চাদর আর হাতে ছাতা। বললেন, ভটচাপাড়ায় ভাঙা শিবমন্দিরটার পিছনে একটা গাছ আছে খবর পেয়েছি। তার শিকড় আমার চাই। ওইটে পেলেই ব্যস্ নিশ্চিন্তি।

সেজোকাকা বেরিয়ে পড়লেন। আকাশ ঘোলাটে হয়ে আসছে, তেমন তেমন বৃষ্টি নামলে কাকার প্ল্যান ভেস্তে যাবে।

আমি ঘণ্টাখানেক নীচে ঘুরঘুর করে দোতলায় নিজের ঘরে চলে গেলাম। দক্ষিণের জানলা দিয়ে সামনের রাস্তা দেখা যায়। বৃষ্টি নামল না। সন্ধে যখন হব হব, তখন দেখি সেজোকাকা ফিরছেন। দুড়দাড় করে নীচে নেমে সদর দরজার মুখে কাকার সঙ্গে দেখা।

পেলে শিকড়?

না রে! ভুল হয়ে গেল। একটা টর্চ নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। জায়গাটা জংলা আর বেজায় অন্ধকার।

কিন্তু ওটা কী?

কাকার কথার মধ্যেই চোখ পড়েছে আমার। খদ্দরের পাঞ্জাবির বুকে লাল রঙের ছোপ।

তাই তো, এটা তো খেয়াল করিনি এতক্ষণ!

পাঞ্জাবি খুলতেই বেরোল একটা জোঁক। ভীম যেমন দুর্যোধনের বুকের রক্ত খেয়েছিল, তেমনই ইনি সেজোকাকার বুকের রক্ত খেয়ে ফুলে ঢোল, টোকা দিতেই টপ করে মাটিতে পড়ে গেল।

কিন্তু একটা জোঁকে আর সেজোকাকার কী হবে? কাঁধ, কনুই, কোমর, পায়ের গুল। হাঁটু, গোঁড়ালি–সব জায়গা মিলিয়ে চোদ্দটা জোঁক বেরোল কাকার গা থেকে। পাঁচ-ছ আউন্স রক্ত যে তাঁর আজ খোয়া গেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বলা বাহুল্য, তার আয়ুর্বেদ চর্চাও এই একটি ঘটনাই দিল বন্ধ করে।

.

পড়াশুনায় আমি ছিলাম রীতিমতো ভাল। আমাদের এফ, এ, এনট্রান্সের যুগ শেষ হয়ে ম্যাট্রিক চলছে। পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে থার্ড হয়ে বিজ্ঞান পড়ব বলে চলে এলাম কলকাতায়। হোস্টেলে থেকেই এম. এসসি পর্যন্ত পড়ে পদার্থবিজ্ঞানে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে চলে যাই আমেরিকায়। শেষ পর্যন্ত গবেষক হিসেবে আমার বেশ খ্যাতি হয়। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ও গবেষণার কাজ আমি একসঙ্গে চালাতে থাকি।

বাইরে থাকার ফলে সেজোকাকার সঙ্গে যোগসূত্র ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। একবার–তখন আমি সবে অধ্যাপনা শুরু করেছি–মার চিঠিতে এক অদ্ভুত খবর পেলাম। সেজোকাকা নাকি ফিল্মে অভিনয়ের। সুযোগ পেয়েছেন। এখানে বলি যে সেজোকাকার সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের চেহারার একটা সাদৃশ্য ছিল। দেহের গঠন মোটেই এক নয়–সেজোকাকা ছিলেন পাঁচ ফুট ছ ইঞ্চি–তবে নাক চোখ মুখের সাদৃশ্য সকলের চোখেই ধড়া পড়ত। পরমহংসদেব সম্বন্ধে একটা ফিল্ম তোলা হবে এবং তাতে বিবেকানন্দের ভূমিকা আছে খবর পেয়ে সেজোকাকা নাকি সরাসরি প্রযোজকের সঙ্গে দেখা করে অভিনয় করার ইচ্ছে। প্রকাশ করেন। চেহারায় মিলের জন্য পার্টটা পেতে নাকি তাঁর কোনও অসুবিধা হয়নি।

কিন্তু হপ্তাখানেক বাদেই আর একটা চিঠিতে জানলাম কাকা নাকি ছবি থেকে বাদ হয়ে গেছেন। হবেন নাই বা কেন? ঘর বন্ধ করে প্রাণপণে পার্ট মুখস্থ করা সত্ত্বেও, এক নম্বর দৃশ্যে রামকৃষ্ণের কথার উত্তরে। বিবেকানন্দের মুখ থেকে যদি তিন নম্বর দৃশ্যের উত্তর বেরিয়ে পড়ে, তা হলে আর তাঁকে দিয়ে কীভাবে কাজ চলে? অর্থাৎ ফিল্ম অভিনেতা হিসেবেও তিনি যে অপদার্থ, সেটা সেজোকাকা প্রমাণ করে দিয়েছেন।

আমার যখন আটচল্লিশ বছর বয়স তখন শিকাগোতেই আমার ছোট ভাইয়ের একটা চিঠিতে জানি যে, সেজোকাকা এক সাধুবাবার শিষ্য হয়ে কোয়েটের চলে গেছেন।

গত বছর ডিসেম্বরের গোড়ায় আমার ছোটকাকার মেয়ে কাকলির বিয়েতে আমাকে কলকাতায় আসতে হয়। সঙ্গে আমার স্ত্রী আর আমার দুই মেয়ে তারা দুজনেই পুরোপুরি আমেরিকায় মানুষ। ইতিমধ্যে সেজোকাকার কোনও খবর পাইনি। তাই কলকাতায় এসে যখন শুনলাম উনি শহরেই আছেন এবং বহাল তবিয়তে আছেন, তখন স্বভাবতই তাঁকে একবার দেখার জন্য মনটা উৎসুক হয়ে উঠল। আমার বয়স তখন ষাট। তাই সোজা হিসেবে সেজোকাকার নব্বই। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে, ইতিমধ্যেই প্রবাসেই কাকার দেহান্ত ঘটেছে।

শুনলাম ফার্ন রোডে তাঁর ভাগ্নে, অর্থাৎ আমার ছোট পিসিমার ছেলে ডাক্তার রণেশ গুপ্তর বাড়িতে এসে তিনি উঠেছে মাস তিনেক হল। আরও শুনলাম যে, ধর্মকর্ম ব্যাপারটা মোটেই তাঁর ধাতে সয়নি। দশ বছরেও ইডলিদোসায় অভ্যাস হয়নি। রোজ আধপেটা খেয়ে ওজন নাকি প্রায় ত্রিশ কিলো কমে গেছে। আমি এসেছি শুনে তিনি তাঁর ডাক্তার ভাগ্নেকে বলেছেন, ঝন্টুকে বলিস একবার যেন এসে আমার সঙ্গে দেখা করে যায়।

এক রবিবার সন্ধ্যায় গিয়ে হাজির হলাম ফার্ন রোডে। লোডশেডিং চলছে, দোতলার একটি ঘরে টিমটিমে মোমবাতি জ্বালিয়ে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে খাটের উপর বসে আছেন সেজোকাকা। একটা মটকার চাদরের উপর গলায় প্যাঁচ দিয়ে জড়ানো সবুজ মাফলার।

কাকাকে দেখলে চেনা যায় বটেই, এবং বলতেই হবে বয়সের পক্ষে রীতিমতো মজবুত চেহারা। মাথার চুল সব পাকা ঠিকই, কিন্তু এখনও যে চুল আছে সেটাই বড় কথা। আমায় দেখে হাসিতে মুখ ফাঁক হওয়াতে অরিজিন্যাল দাঁতও চোখে পড়ল ডজনখানেক, আর যখন কথা বেরোল তখন দেখলাম গলার স্বর ক্ষীণ হলেও কথায় বেশ তেজ আছে। এ তেজ কাকার মধ্যে আগে দেখিনি কখনও। তিনি যে সকলের বয়োজ্যেষ্ঠ, তাঁকে আর কারুর কাছে মাথা নোয়াতে হয় না, এই বোধ হয়তো তাঁর মেজাজে একটা ভারিক্কি ভাব এনে দিয়েছে।

কী রে ঝন্টু, বললেন সেজোকাকা, মার্কিন মুলুকে গিয়ে কী করা হচ্ছে শুনি?

আমার কাজের কথাটা যথাসম্ভব বিনয়ের সঙ্গে বললাম।

পদার্থবিজ্ঞান? গবেষণা? বললেন সেজোকাকা। লোকে মান্যি করে?

আমার সাতাত্তর বছরের পিসিমা গলা সপ্তমে চড়িয়ে আমার বিনয়কে ফুঙ্কারে উড়িয়ে দিয়ে জানিয়ে দিলেন আমার খ্যাতির কথা।

বটে? বললেন সেজোকাকা। নোবেল প্রাইজ পেয়েছিস কিনা সেটা বল আগে।

হালকা হেসে মাথা নাড়লাম।

তবে আর কীসের বড়াই? ছ্যা ছ্যা ছ্যা–একেবারে অপদার্থ!

আমি এই গুঁতোর ঠেলা সামলাতে না সামলাতে সেজোকাকার বাক্যস্রোত আমাকে নাকানিচোবানি খাইয়ে দিল।

তুই তো যাহোক ভিন মুলুকে পালিয়ে বাঁচলি, আমি ভাবলুম কলকাতায় গিয়ে একটু সোয়াস্তি মিলবে। জীবনের শেষ কটা দিন তবু আপনজনের সান্নিধ্যে কাটবে–তা এসব কী হচ্ছে বল তো? শকুনির ঠোকরে তো হাড় পাঁজরা বার করে দিয়েছে শহরটার। দিনে দশ ঘণ্টা বিজলি নেই। শ্বাস টানলে ধোঁয়া-ধুলোয় প্রাণ অতিষ্ঠ। জিনিসপত্তরের যা দর, উদরের সাধ মিটিয়ে ভালমন্দ যে একটু খাব তারও জো নেই।দূর দূর দূর–অপদার্থ, অপদার্থ।

সেদিন বুঝলাম যে, সেজোকাকার উপর থেকে আমার পুরনো টানটা এখনও যায়নি, কারণ তাঁর কথাগুলো শুনে আমার মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠল। মনে হল আমরা বোধহয় অ্যাদ্দিন ভুল করে এসেছি, উলটো ভেবে এসেছি; আসলে কাকা দিব্যি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ, আমরা সুদ্ধ দুনিয়াটাই অপদার্থ।

কিন্তু কথাটা যে ঠিক নয় সেটা সেজোকাকাই প্রমাণ করে দিলেন কয়েক দিনের মধ্যে।

এক সকালে ছোট পিসিমার বাড়ি থেকে ফোন এল যে, সেজোকাকা ভোর রাত্রে ইহলোক ত্যাগ করে চলে গেছেন। আর যাওয়ার দিনটাও মোক্ষম বেছেছেন কাকা, কারণ সেদিনই সন্ধ্যায় গোধূলি লগ্নে আমার ভাগ্নির বিয়ে।

চক্‌মকি, ১৩৯০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *