অসমঞ্জবাবুর কুকুর
হাসিমারায় বন্ধুর বাড়িতে ছুটি কাটাতে এসে অসমঞ্জবাবুর একটা অনেকদিনের শখ মিটল।
ভবানীপুরের মোহিনীমোহন রোডে দেড়খানা ঘর নিয়ে থাকেন অসমঞ্জবাবু। লাজপত রায় পোস্টঅফিসের রেজিস্ট্রি বিভাগে কাজ করেন তিনি; কাজের জায়গা তাঁর বাড়ি থেকে সাত মিনিটের হাঁটা পথ, তাই ট্রাম-বাসের ঝক্কি পোয়াতে হয় না। এমনিতে দিব্যি চলে যায়, কারণ যেসব মানুষ জীবনে কী হল না কী পেল না এই ভেবেই মুখ বেজার করে বসে থাকে, অসমঞ্জবাবু তাদের দলে পড়েন না। তিনি অল্পেই সন্তুষ্ট। মাসে দুটো হিন্দী ছবি, একটা বাঙলা যাত্রা বা থিয়েটার, হপ্তায় দুদিন মাছ আর চার প্যাকেট উইলস সিগারেট হলেই তাঁর চলে যায়। তবে তিনি একা মানুষ, বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনও বিশেষ নেই, তাই অনেক সময় মনে হয়েছে একটা কুকুর থাকলে বেশ হত। তাঁর বাড়ির দুটো বাড়ি পশ্চিমে তালুকদারদের যে বিশাল অ্যালসেশিয়ানটা আছে, সে রকম কুকুর না হলেও চলে; এমনি একটা সাধারণ কুকুর, যেটা তাঁকে সকাল সন্ধে সঙ্গ দেবে, তাঁর তক্তপোষের পাশে মেঝেতে গা এলিয়ে পড়ে থাকবে, তিনি আপিস থেকে ফিরলে পরে লেজ নেড়ে আহ্লাদ প্রকাশ করবে, তাঁর আদেশ মেনে তার বুদ্ধি আর আনুগত্যের পরিচয় দেবে। কুকুরকে তিনি ইংরিজিতে আদেশ করবেন এটাও অসমঞ্জবাবুর একটা শখ। ‘স্ট্যান্ড-আপ’ ‘সিট ডাউন’ ‘শেক হ্যান্ড’, এসব বললে যদি কুকুর মানে তা হলে বেশ হবে। কুকুর জাতটাকে সাহেবের জাত বলে ভাবতে অসমঞ্জবাবুর বেশ ভাল লাগে, আর উনি হবেন সেই সাহেবের মালিক-মানে হিজ মাস্টার আর কী।
মেঘলা দিন, সকাল থেকে টিপ্ টিপ্ বৃষ্টি পড়ছে, অসমঞ্জবাবু ছাতা ছাড়াই হাসিমারার বাজারে গিয়েছিলেন কমলালেবু কিনতে। বাজারের এক প্রান্তে একটা বেঁটে কুলগাছের পাশে বেতের টোকা মাথায় ভুটানি লোকটাকে দেখতে পেলেন তিনি। তিন আঙুলে একটা জ্বলন্ত চুটা ধরে পা ছাড়িয়ে মাটিতে বসে তাঁরই দিকে চেয়ে কেন যে মিটিমিটি হাসছে লোকটা সেটা বুঝতে না পারলেও, কৌতুহলবশে তিনি লোকটার দিকে এগিয়ে গেলেন। ভিখিরি কি? পোশাক দেখে সেটা মনে হওয়া আশ্চর্য নয়; প্যান্ট আর গায়ের জামাটার অন্তত পাঁচ জায়গায় তাপ্পি লক্ষ করলেন অসমঞ্জবাবু। কিন্তু ভিক্ষের পাত্র বা ঝুলি বলে কিছু নেই; তার বদলে আছে একটা জুতোর বাক্স, সেই বাক্স থেকে উঁকি মারছে। একটা বাদামি রঙের কুকুরছানা।
‘গুড মর্নিং!’—চোখ বন্ধ করা হাসি হেসে বলল ভুটানি। উত্তরে অসমঞ্জবাবুও ‘গুড মর্নিং’ না বলে পারলেন না।
‘বাই ডগ? ডগ বাই? ভেরি গুড ডগ।’
কুকুরছানাটাকে বাক্স থেকে বার করে মাটিতে রেখেছে ভুটানি। ‘ভেরি চীপ। ভেরি গুড। হ্যাপি ডগ।’
কুকুরছানাটা গা ঝাড়া দিল, বোধ হয় পিঠে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার দরুন। তারপর অসমঞ্জবাবুর দিকে চেয়ে তার দেড় ইঞ্চি লম্বা ল্যাজটা বার কয়েক নেড়ে দিল। বেশ কুকুর তো!
অসমঞ্জবাবু এগিয়ে গিয়ে কুকুরটার সামনে বসে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন তার দিকে। কুকুরটা দু’ পা এগিয়ে এসে তার ছোট্ট জিভটা বার করে, অসমঞ্জবাবুর বুড়ো আঙুলের ডগাটায় একটা মৃদু চাটা দিয়ে দিল। বেশ কুকুর। যাকে বলে ফ্রেন্ডলি।
‘কেতনা দাম? হাউ মাচ?’
‘টেন রুপিজ।’
সাড়ে সাতে রফা হল। অসমঞ্জবাবু জুতোর বাক্স সমেত কুকুরছানাটাকে নিয়ে বগলদাবা করে বাড়িমুখো হলেন। কমলালেবুর কথাটা তিনি বেমালুম ভুলে গেলেন।
হাসিমারা স্টেট ব্যাঙ্কের কর্মচারী বিজয় রাহা তাঁর বন্ধুর এই শখটার কথা জানতেন না। তাই তাঁর হাতে জুতোর বাক্স এবং বাক্সের মধ্যে কুকুরছানা দেখে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন বইকী; কিন্তু দামটা শুনে খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বললেন, ‘নেড়ি কুত্তাই যদি কেনার ছিল তা সে এখান থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার কী ভাই? এ জিনিস তোমার ভবানীপুরে পেতে না?
না, ভবানীপুরে পেতেন না। অসমঞ্জবাবু সেটা জানেন। তাঁর বাড়ির সামনে রাস্তায় অনেক সময় অনেক কুকুরছানা দেখেছেন তিনি। তারা কখনও তাঁকে দেখে লেজ নাড়েনি বা প্রথম আলাপেই তাঁর বুড়ো আঙুল চেটে দেয়নি। বিজয় যাই বলুক—এ কুকুরের একটা বিশেষত্ব আছে। তবে নেড়ি কুত্তা জেনে অসমঞ্জবাবু খানিকটা আক্ষেপ প্রকাশ করাতে বিজয়বাবু তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন যে জাত কুকুরের ঝক্কি পোয়ানো অসমঞ্জবাবুর পক্ষে সম্ভব হত না। —‘তোর কোনও আইডিয়া আছে একটা জাত কুকুরের কত ঝামেলা? মাসে মাসে ডাক্তারের খরচায় তোর অর্ধেক মাইনে বেরিয়ে যেত। এ কুকুরকে নিয়ে তোর কোনও চিন্তা নেই। আর এর জন্য কোনও স্পশাল ডায়েটেরও দরকার নেই। তুই যা খাস তাই খাবে। তবে মাছটা দিসনি, ওটা বেড়ালের খাদ্য। কুকুর মাছের কাঁটা ম্যানেজ করতে পারে না।’
কলকাতায় ফিরে এসে অসমঞ্জবাবুর খেয়াল হল যে কুকুরটার একটা নাম দেওয়া হয়নি। সাহেবি নাম ভাবতে গিয়ে প্রথমে টম ছাড়া আর কিছুই মনে পড়ছিল না, তারপর ছানাটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মাথায় এল যে রংটা যখন ব্রাউন, তখন ব্রাউনি নামটা হয়তো বেমানান হবে না। ব্রাউনি নামে একটা বিলিতি ক্যামেরা তাঁর এক খুড়তুতো ভাইয়ের ছিল। কাজেই নামটা সাহেবি তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আশ্চর্য নামটা মনে পড়া মাত্র ব্রাউনি বলে ডাকতেই ছানাটা ঘরের কোণে রাখা বেঁটে মোড়াটার উপর থেকে একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে মেঝেতে নেমে তাঁর দিকে লেজ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে এল। অসমঞ্জবাবু বললেন, ‘সিট ডাউন’, আর অমনি ব্রাউনি তার পিছনের পা দুটো ভাঁজ করে থপ্ করে বসে পড়ে তাঁর দিকে চেয়ে একটা ছোট্ট হাই তুলল। অসমঞ্জবাবু এক মুহূর্তের জন্য যেন চোখের সামনে দেখতে পেলেন যে ব্রাউনি ডগ-শোতে বুদ্ধিমান কুকুর হিসেবে প্রথম পুরস্কার পাচ্ছে।
সুবিধে এই যে চাকর বিপিনেরও কুকুরটাকে পছন্দ হয়ে গেছে, ফলে দিনের বেলায় যে সময়টুকু তিনি বাইরে থাকেন, সে সময়ে ব্রাউনির দিকে নজর রাখার কাজটা বিপিন খুশি হয়েই করে। অসমঞ্জবাবু তাকে সাবধান করে দিয়েছেন যেন ব্রাউনিকে আজেবাজে কিছু খেতে না দেয়। —‘আর দেখিস রাস্তায়-টাস্তায় না বেরোয়। আজকালকার ড্রাইভারগুলো চোখে ঠুলি দিয়ে গাড়ি চালায়।’ অবিশ্যি বিপিনকে ফরমাশ দিয়েও অসমঞ্জবাবুর সোয়াস্তি নেই; রোজ সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে এসে ব্রাউনির লাঙ্গুলসঞ্চালন না দেখা পর্যন্ত তাঁর উৎকণ্ঠা যায় না।
ঘটনাটা ঘটল হাসিমারা থেকে ফেরার তিনমাস পরে। বারটা ছিল শনি, তারিখ বাইশে নভেম্বর। অসমঞ্জবাবু আপিস থেকে ফিরে তাঁর ঘরে ঢুকে সার্টটা খুলে আলনায় টাঙিয়ে তক্তপোষ ছাড়া তাঁর একমাত্র আসবাব একটা পুরোনো কাঠের চেয়ারে বসতেই সেটার একটা পঙ্গু পায়া তাঁর সামান্য ভারও সইতে না পেরে কাজে ইস্তফা দিল, আর তার ফলে চোখের পলকে অসমঞ্জবাবু চেয়ার সমেত সশব্দে মেঝের সংস্পর্শে এসে গেলেন। এতে তাঁর চোট লাগল ঠিকই, এমনকী চেয়ারের পায়ার মতো তাঁর ডানহাতের কনুইটাও বাতিল হয়ে যাবে কি না সে চিন্তাটাও তাঁর মনে উদয় হয়েছিল, কিন্তু একটা অপ্রত্যাশিত শব্দ তাঁকে তাঁর যন্ত্রণার কথা ভুলিয়ে দিল।
শব্দটা এসেছে তক্তপোষের উপর থেকে। হাসির শব্দ, বোধহয় যাকে বলে খিলখিল হাসি, আর সেটার উৎস হচ্ছে নিঃসন্দেহে তাঁর কুকুর ব্রাউনি, কারণ ব্রাউনিই বসে আছে। তক্তপোষের উপর, আর ব্রাউনিরই ঠোঁটের কোণে এখনও লেগে আছে হাসির রেশ।
অসমঞ্জবাবুর সাধারণ জ্ঞানের মাত্রাটা যদি আর সামান্যও বেশি হত তা হলে তিনি জানতেন যে কুকুর কখনও হাসে না। আর এই জ্ঞানের সঙ্গে যদি তাঁর কল্পনাশক্তিও খানিকটা বেশি হত, তা হলে আজকের এই ঘটনা তাঁর নাওয়া-খাওয়া, রাতের ঘুম সব বন্ধ করে দিত। এই দুটোরই অভাবে অসমঞ্জবাবু যেটা করলেন সেটা হল, তিন দিন আগে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের একটা পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে আড়াই টাকা দিয়ে কেনা ‘অল অ্যাবাউট ডগ্স্’ বইটা হাতে নিয়ে বসলেন। তারপর প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে সেটা উল্টেপাল্টে দেখলেন যে তাতে কুকুরের হাসির কোনও উল্লেখ নেই।
অথচ ব্রাউনি যে হেসেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। শুধু হাসেনি, হাসির কারণে হেসেছে। অসমঞ্জবাবুর স্পষ্ট মনে আছে, তাঁর যখন বছর পাঁচেক বয়স তখন নরেন ডাক্তার একবার তাঁদের চন্দননগরের বাড়িতে রুগি দেখতে এসে চেয়ার ভেঙে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছিলেন, আর তাই দেখে অসমঞ্জবাবু হাসিতে ফেটে পড়ায় বাবার কাছে। কানমলা খেয়েছিলেন।
অসমঞ্জবাবু হাতের বইটা বন্ধ করে ব্রাউনির দিকে চাইলেন। চোখাচোখি হতেই বালিশের উপর সামনের পা দুটো ভর করে দাঁড়িয়ে ব্রাউনি তার তিন মাসে দেড় ইঞ্চি বেড়ে যাওয়া লেজটা নেড়ে দিল। তার মুখে এখন হাসির কোনও চিহ্ন নেই। অকারণে হাসাটা পাগলের লক্ষণ; অসমঞ্জবাবু ভেবে আশ্বস্ত হলেন যে ব্রাউনি ম্যাড ডগ নয়।
* * *
এর পর সাতদিনের মধ্যে ব্রাউনি আরো দুবার হাসার কারণে হাসল। প্রথমবারের ব্যাপারটা ঘটল রাত্রে। তখন রাত সাড়ে নটা। ব্রাউনির শোবার জন্য অসমঞ্জবাবু সবে তার তক্তপোষের পাশে মেঝেতে একটা চাদর পেতে দিয়েছেন, এমন সময় ফর ফর শব্দ করে দেওয়ালে একটা আরশোলা উড়ে এসে বসল। অসমঞ্জবাবু তাঁর এক পাটি চটি নিয়ে সেটাকে তাগ করে মারতে গিয়ে বেমক্কা এক চাপড় মেরে বসলেন দেওয়ালে টাঙানো আয়নাটায়, আর তার ফলে সেটা পেরেক থেকে খসে মাটিতে পড়ে ভেঙে চৌচির। এবারে ব্রাউনির খিলখিলে হাসি তাঁকে ভাঙা আয়নার জন্য আপসোস করতে দিল না।
দ্বিতীয়বারের হাসিটা অবশ্য খিলখিল নয়; সেটা যাকে বলে ফিক্ করে হাসা। অসমঞ্জবাবু এবারে বেশ ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলেন, কারণ ঘটনা বলতে কিছুই ঘটেনি। তবু ব্রাউনি হাসল কেন? উত্তর জোগাল বিপিন। চা এনে ঘরে ঢুকে মনিবের দিকে চেয়ে সেও ফিক্ করে হেসে বলল, ‘আপনার কানের পাশে সাবান লেগে রয়েছে বাবু।’ আসলে আয়নার অভাবে জানলার আর্শিতে দাড়ি কামিয়েছেন অসমঞ্জবাবু; চাকরের কথায় দু’দিকের জুলফিতেই হাত বুলিয়ে দেখলেন বেশ খানিকটা করে শেভিং সোপ লেগে রয়েছে।
এই সামান্য কারণেও যে ব্রাউনি হেসেছে তাতে অসমঞ্জবাবুর বেশ অবাক লাগল। তিনি দেখলেন যে পোস্টাপিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে বার বার ব্রাউনির কৌতুকভরা দৃষ্টি আর হাসির ফিক্ শব্দটা মনে পড়েছে। অল অ্যাবাউট ডগ্স্-এ কুকুরের হাসির কথা না থাকলেও, কুকুরের এনসাইক্লোপিডিয়া গোছের একটা বই জোগাড় করতে পারলে তিনি নিশ্চয়ই এ বিষয় কিছু জানতে পারতেন।
ভবানীপুরের চারটে বইয়ের দোকান, আর তারপর নিউ মার্কেটের সবক’টা বইয়ের দোকান খুঁজেও যখন তিনি ওই জাতীয় কোনও এনসাইক্লোপিডিয়া পেলেন না, তখন মনে হল—রজনী চাটুজ্যের কাছে গেলে কেমন হয়? তাঁর পাড়াতেই থাকেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক রজনী চাটুজ্যে। কী বিষয়ে অধ্যাপনা করতেন ভদ্রলোক সেটা অসমঞ্জবাবু জানেন না, কিন্তু তাঁর বৈঠকখানাটি যে ভারী ভারী বইয়ে ঠাসা সেটা তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেই দেখা যায়।
এক রবিবার সকালে দুগ্গা বলে রজনী চাটুজ্যের বাড়ি গিয়ে হাজির হলেন অসমঞ্জবাবু। দূর থেকে ভদ্রলোককে দেখেছেন অনেকবার, কিন্তু তাঁর গলার স্বর যে এত ভারী, আর ভুরু যে এত ঘন সেটা জানা ছিল না। রাগি মানুষ হলেও দরজা থেকে ফিরিয়ে দেননি, তাই খানিকটা ভরসা পেয়ে অসমঞ্জবাবু অধ্যাপকের মুখোমুখি সোফাটায় বসে একবার ছোট্ট করে কেশে গলাটা ঝেড়ে নিলেন। রজনীবাবু হাতের ইংরিজি পত্রিকাটি চোখের সামনে থেকে সরিয়ে তাঁর দিকে দৃষ্টি দিলেন।
‘আপনাকে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে?’
‘আজ্ঞে আমি এ পাড়াতেই থাকি।’
‘অ।… কী ব্যাপার?’
‘আপনার বাড়িতে একটা কুকুর দেখেছি, তাই…’
‘তাই কী? আছে তো কুকুর। একটা কেন, দুটো আছে।’
‘ও। আমারও আছে।’
‘আপনারও আছে?’
‘আজ্ঞে হ্যা। একটা।’
‘বুঝলাম। —তা আপনি কি কুকুর-পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে আসছেন?’
অসমঞ্জবাবু সরল মানুষ, তাই শ্লেষটা ধরতে পারলেন না। বললেন, ‘আজ্ঞে না। একটা জিনিসের খোঁজ করতে আপনার কাছে এসেছি।’
‘কী জিনিস?’
‘আপনার কাছে কি কুকুরের এনসাইক্লোপিডিয়া আছে?’
‘না, নেই।…ও জিনিসটার দরকার হচ্ছে কেন?’
‘না, মানে—আমার কুকুর হাসে। তাই জানতে চাইছিলাম কুকুরের হাসিটা স্বাভাবিক কিনা। আপনার কুকুরও হাসে কি?’
রজনীবাবুর দেয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে আটটা বাজতে যতটা সময় লাগল, ততক্ষণ একটানা তিনি অসমঞ্জবাবুর দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘কখন হাসে আপনার কুকুর? রাত্তিরে কি?’
‘হ্যাঁ, তা রাত্তিরেও…’
‘রাত্তিরে আপনি ক’রকম নেশা করেন? শুধু গাঁজায় তো হয় না এ জিনিস। তার সঙ্গে ভাঙ, চরস, আফিং—এসবও চলে কি?’
অসমঞ্জবাবু বিনীতভাবে জানালেন যে একমাত্র ধূমপান ছাড়া তাঁর আর কোনও নেশা নেই, আর সেটাও তিনি কুকুর আসার পর থেকে হপ্তায় চার প্যাকেট থেকে তিন প্যাকেটে নামিয়েছেন, কারণ খরচে কুলোয় না।
‘তাও বলছেন আপনার কুকুর হাসে?’
‘আমি দেখেছি হাসতে। শুনেছি। আওয়াজ করে হাসে।’
‘শুনুন—।’
রজনী চাটুজ্যে হাতের পত্রিকাটা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসে অসমঞ্জবাবুর দিকে তাকিয়ে একেবারে ষোলো আনা অধ্যাপকের মেজাজে বলেন, আপনার একটি তথ্য বোধহয় জানা নেই; সেটা জেনে রাখুন। ঈশ্বরের সৃষ্ট যত প্রাণী আছে জগতে, তার মধ্যে মানুষ ছাড়া আর কেউ হাসে না, হাসতে জানে না, হাসতে পারে না। এটাই হচ্ছে মানুষ আর অন্য প্রাণীর মধ্যে প্রধান পার্থক্য। কেন এমন হল সেটা জিগ্যেস করবেন না, কারণ সেটা জানি না। শুনেছি ডলফিন নামে শুশুক জাতীয় একরকম প্রাণীর নাকি রসবোধ আছে, তারা হাসলেও হাসতে পারে, কিন্তু এ ছাড়া আর কোনও প্রাণী হাসে না। মানুষ যে কেন হাসে সেটার কোনও স্পষ্ট কারণ জানা নেই। বাঘা বাঘা দার্শনিকরা অনেক ভেবে এর কারণ নির্দেশ করতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাঁদের মতের মিল হয়নি। —বুঝেছেন?’
অসমঞ্জবাবু বুঝলেন, আর এও বুঝলেন যে এবার তাঁকে উঠতে হবে, কারণ রজনী চাটুজ্যের দৃষ্টি কথা শেষ করেই চলে গেছে তাঁর হাতের পত্রিকার দিকে।
ডাঃ সুখময় ভৌমিক—যাঁকে কেউ কেউ ভৌ-ডাক্তার বলেন—কলকাতার একজন নামকরা কুকুরের ডাক্তার। সাধারণ লোকে তাঁর কথা হেসে উড়িয়ে দিলেও একজন কুকুরের ডাক্তার সেটা করবে না এই বিশ্বাসে অসমঞ্জবাবু খোঁজ খবর নিয়ে টেলিফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে গোখেল রোডে ভৌমিকের বাড়ি গিয়ে হাজির হলেন। গত চার মাসে সতেরো বার হেসেছে ব্রাউনি। এটা অসমঞ্জবাবু লক্ষ করেছেন যে মজার কথা শুনলে ব্রাউনি হাসে না, কেবল মজার ঘটনা দেখলেই হাসে। যেমন বোম্বাগড়ের রাজা শুনে ব্রাউনির মুখে কোনও পরিবর্তন হয়নি, কিন্তু আধসেদ্ধ আলুর দমের আলু যখন অসমঞ্জবাবুর আঙুলের চাপে পিছলে ছিটকে দইয়ের মধ্যে পড়ল, আর সেই দইয়ের ছিটে যখন অসমঞ্জবাবুর নাকের ডগায় লাগল, তখন ব্রাউনির প্রায় বিষম লাগার জোগাড়। রজনী চাটুজ্যে ঈশ্বরসৃষ্ট প্রাণী-টানি বলে তো তাঁকে বিস্তর জ্ঞান দিলেন, কিন্তু অসমঞ্জবাবুর চোখের সামনে যে অধ্যাপকের কথা মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে তার কী হবে?
এই সব ভেবে-টেবে বিশ টাকা ফি জেনেও অসমঞ্জবাবু গেলেন ভৌ-ডাক্তারের কাছে। কুকুরের হাসির কথা শোনার আগেই তার চেহারা দেখে ডাক্তারের চোখ কপালে উঠল।
‘অনেক মংগ্রেল দেখিচি মশাই, কিন্তু এমনটি তো দেখিনি।’
ডাক্তার দুহাতে ব্রাউনিকে তুলে তাঁর টেবিলের উপর দাঁড় করালেন। ব্রাউনি তার পায়ের সামনে পিতলের পেপারওয়েটটাকে একবার শুঁকে নিল।
‘কী খাওয়াচ্ছেন একে?’
‘আজ্ঞে আমি যা খাই তাই খায়। জাত কুকুর তো নয়, কাজেই অতটা…’
ভৌমিক ভুরু কুঁচকোলেন। ভারী মনোযোগ আর কৌতুহলের সঙ্গে দেখছেন তিনি ব্রাউনিকে।
‘জাত কুকুর দেখলে অবিশ্যি আমরা বুঝি’, বললেন ভৌমিক, ‘তবে সারা বিশ্বের সব জাত কুকুর যে আমাদের চেনা সেকথা জোর দিয়ে বলি কী করে বলুন। এটার চেহারা দেখে ফস করে দোআঁশলা বলতে আমার দ্বিধা হচ্ছে। আপনি একে ডাল ভাত খাওয়াবেন না, আমি একটা খাবারের তালিকা করে দিচ্ছি।’
অসমঞ্জবাবু এবার আসল কথায় যাবার একটা চেষ্টা দিলেন।
‘ইয়ে, আমার কুকুরের একটা বিশেষত্ব আছে, যার জন্য আপনার কাছে আসা।’
‘কী বলুন তো?’
‘কুকুরটা হাসে।’
‘হাসে?’
‘হ্যাঁ—মানে, মানুষের মতো করে হাসে।’
‘বলেন কী! কই দেখি হাসান তো দেখি।’
এইখানেই মুশকিলে পড়ে গেলেন অসমঞ্জবাবু। এমনিতেই তিনি বেশ লাজুক মানুষ, কাজেই সার্কাসের ক্লাউনের মতো হাস্যকর অঙ্গভঙ্গি করে তিনি ব্রাউনিকে হাসাবেন এমন ক্ষমতা তাঁর নেই। আর ঠিক এই মুহূর্তে এই ডাক্তারের ঘরে কোনও হাস্যকর ঘটনা ঘটবে এটাও আশা করা যায় না। তাঁকে তাই বাধ্য হয়ে বলতে হল অত সহজে ফরমাইশি হাসি হাসে না তাঁর কুকুর, কেবল কোনও হাসির ঘটনা দেখলেই হাসে।
এর পরে ডাঃ ভৌমিক আর বেশি সময় দিলেন না অসমঞ্জবাবুকে। বললেন, ‘আপনার কুকুরের চেহারাতেই যথেষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে; তার সঙ্গে আবার হাসিটাসি জুড়ে দিয়ে আরো বেশি অসাধারণ করে তুলবেন না। তেইশ বছর কুকুরের ডাক্তারির অভিজ্ঞতা থেকে বলছি আপনাকে—কুকুর কাঁদে, কুকুর ভয় পায়, কুকুর রাগ ঘৃণা বিরক্তি হিংসে এ সবই প্রকাশ করে, এমন কী কুকুর স্বপ্নও দেখে; কিন্তু কুকুর হাসে না।’
এই ঘটনার পর অসমঞ্জবাবু ঠিক করলেন যে আর কোনওদিন কাউকে কুকুরের হাসির কথা বলবেন না। প্রমাণ দেবার উপায় যখন নেই, তখন বলে কেবল নিজেই অপ্রস্তুত হওয়া। কেউ নাই বা জানুক, তিনি তো জানেন। ব্রাউনি তাঁরই কুকুর, তাঁরই সম্পত্তি। তাঁদের দুজনের এই জগতের বাইরের লোককে টেনে আনার কী দরকার?
কিন্তু মানুষে যা ভাবে সব সময় তো তা হয় না। ব্রাউনির হাসিও একদিন বাইরের লোকের কাছে প্রকাশ পেয়ে গেল।
বেশ কিছুদিন থেকেই অসমঞ্জবাবু অভ্যাস করে নিয়েছিলেন কাজ থেকে ফিরে এসে ব্রাউনিকে নিয়ে ভিকটোরিয়া মেমোরিয়ালের দিকটায় একটা চক্কর মেরে আসা। একদিন এপ্রিল মাসের একটা বিকেলে বেড়ানোর সময় হঠাৎ আচমকা এল তুমুল ঝড়! আকাশের দিকে চেয়ে অসমঞ্জবাবু বুঝলেন এখন বাড়ি ফেরা মুশকিল, কারণ বৃষ্টিরও আর বেশি দেরি নেই। তিনি ব্রাউনিকে নিয়ে মেমোরিয়ালের দক্ষিণ দিকে কালো ঘোড়সওয়ার মাথায় করা শ্বেতপাথরের তোরণটার নীচে আশ্রয় নিলেন।
বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে, চারদিকে লোকজন পরিত্রাহি ছুটছে ছাউনি লক্ষ্য করে, এমন সময় সাদা প্যান্ট আর বুশ শার্ট পরা একটি মাঝবয়সী ফরসা মোটা বেঁটে ভদ্রলোক তাঁদের হাত থেকে হাত পনেরো দূরে দাঁড়িয়ে দু’হাত দিয়ে তার হাতের ছাতাটা খুলে মাথায় দিতেই ঝড়ের দাপটে সেটা হড়াৎ শব্দ করে উলটে গিয়ে অকেজো হয়ে গেল। সত্যি বলতে কী, এই দৃশ্য দেখে অসমঞ্জবাবুরই হাসি পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তিনি হাসবার আগেই ব্রাউনির অট্টহাস্য ঝড়ের শব্দকে ছাপিয়ে পৌঁছে গেল সেই অপ্রস্তুত ভদ্রলোকের কানে। ভদ্রলোক ছাতাটা আবার সোজা করার ব্যর্থ চেষ্টা বন্ধ করে অবাক বিস্ময়ে ব্রাউনির দিকে চাইলেন। এদিকে ব্রাউনির এখন কুটিপাটি অবস্থা, অসমঞ্জবাবু তার মুখের উপর হাত চেপে হাসি থামানোর চেষ্টায় বিফল হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
হতভম্ব ভদ্রলোক ভূত দেখার ভাব করে এগিয়ে এলেন অসমঞ্জবাবুর দিকে। ব্রাউনির হাসির তেজ খানিকটা কমেছে, কিন্তু তাও একজন লোকের মুণ্ডু ঘুরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট।
‘লাফিং ডগ।’
ভদ্রলোকের মুখে রা নেই দেখে অসমঞ্জবাবুই বললেন কথাটা।
‘লা-ফিং ড-গ!’ বহুদূরের পাহাড় থেকে প্রতিধ্বনির মতো ফিরে এল কথাটা ভদ্রলোকের মুখ থেকে। ‘হাউ এক্সট্রর্ডিনারি!’
অসমঞ্জবাবু দেখেই বুঝেছিলেন যে ভদ্রলোক বাঙালি নন; হয়তো গুজরাটি বা পারসি হবে। কোনও প্রশ্ন যদি করেন ভদ্রলোক তা হলে ইংরিজিতে করবেন, আর অসমঞ্জবাবুকেও জবাব দিতে হবে ইংরিজিতেই।
বৃষ্টিটা বেড়েছে। ভদ্রলোক অসমঞ্জবাবুর পাশেই আশ্রয় নিলেন ঘোড়সওয়ারের নীচে, এবং যে দশ মিনিট ধরে বৃষ্টিটা চলল তার মধ্যে ব্রাউনি সম্বন্ধে যা কিছু সব তথ্য জেনে নিলেন। সেই সঙ্গে অসমঞ্জবাবুর নিজের ঠিকানাটাও দিতে হল। ভদ্রলোক বললেন তাঁর নাম পিলু পোচকানওয়ালা। তিনি কুকুর সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল, তাঁর এক ড্যালমেশিয়ান নাকি দুবার ডগ-শোতে প্রাইজ পেয়েছে, এমন কী তিনি কুকুর সম্বন্ধে কাগজে লিখেটিখেও থাকেন। বলা বাহুল্য, তাঁর জীবনে আজকের মতো তাক লাগানো ঘটনা আর ঘটেনি, ভবিষ্যতে আর ঘটবে না। তিনি মনে করেন এ বিষয়ে একটা কিছু করা দরকার, কারণ অসমঞ্জবাবু নিজে নাকি বুঝতে পারছেন না তিনি কী আশ্চর্য সম্পদের অধিকারী।
বৃষ্টি থামার পরে চৌরঙ্গির এডওয়ার্ড কোর্টে তাঁর বাসস্থানে ফেরার পথে পোচকানওয়ালা যে মিনিবাসের ধাক্কা খেয়ে কোমর ভাঙলেন, তার জন্য ব্রাউনিকে খানিকটা দায়ী করা চলে, কারণ লাফিং ডগের চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকার ফলে ভদ্রলোক রাস্তা পেরোবার সময় যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেননি। আড়াই মাস হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে পোচকানওয়ালা হাওয়া বদলের জন্য যান নৈনিতাল। সেখানে একমাস থেকে কলকাতায় ফিরে এসে সেইদিনই সন্ধ্যায় বেঙ্গল ক্লাবে গিয়ে তিনি তাঁর বন্ধু মিঃ বালাপুরিয়া ও মিঃ বিসোয়াসকে লাফিং ডগের ঘটনাটা বললেন। আধ ঘণ্টার মধ্যে ঘটনাটা পৌঁছে গেল ক্লাবের সাতাশজন সদস্য ও তিনটি বেয়ারার কানে, এবং পরদিন দুপুরের মধ্যে এই ত্রিশজন মারফত ঘটনাটা জেনে গেল কমপক্ষে হাজার কলকাতাবাসী।
এই সাড়ে তিন মাসে ব্রাউনি আর হাসেনি। তার একটা কারণ হয়তো এই যে, হাসির ঘটনা কোনও ঘটেনি। তাতে অবিশ্যি অসমঞ্জবাবু কোনও উদ্বেগ বোধ করেননি। কুকুরের হাসি ভাঙিয়ে খাবার কোনও অভিপ্রায় তাঁর কোনওদিন ছিল না। এই সাড়ে তিন মাসে তিনি বেশ ভালভাবেই বুঝেছেন যে ব্রাউনি এসে তাঁর নিঃসঙ্গতা সম্পূর্ণ দূর করে দিয়েছে। সত্যি বলতে কী, কোনও মানুষের প্রতি অসমঞ্জবাবু কোনওদিন এতটা মমতা বোধ করেননি।
পোচকানওয়ালার দৌলতে যারা লাফিং ডগের খবরটা পেলেন তাদের মধ্যে ছিলেন স্টেটসম্যান পত্রিকার একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী। তিনি সেই কাগজের এক সাংবাদিক রজত চৌধুরীকে ডেকে অসমঞ্জবাবুর সঙ্গে একটা সাক্ষাৎকারের প্রস্তাব করলেন। অসমঞ্জবাবু যে লাজপত রায় পোস্টাপিসের কেরানি সে খবরটা পোচকানওয়ালার জবানিতেই রটে গিয়েছিল।
অসমঞ্জবাবু অবিশ্যি তাঁর বাড়িতে সাংবাদিকদের আগমনের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁর বিস্ময় খানিকটা কাটল যখন রজত চৌধুরী পোচকানওয়ালার উল্লেখ করলেন। অসমঞ্জবাবু ভদ্রলোককে ঘরে এনে নতুন পায়া-লাগানো চেয়ারটায় বসিয়ে নিজে খাটে বসলেন। সেই সাতান্ন সালে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ-এর পর এই তাঁর প্রথম ইন্টারভিউ। ব্রাউনি ঘরের এক কোণে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে দেওয়ালের গায়ে একটা পিঁপড়ের সারির গতিবিধি লক্ষ করছিল, তার মনিবকে খাটে বসতে দেখে সে এক লাফে তাঁর পাশে গিয়ে হাজির হল।
রজত চৌধুরীকে টেপ রেকর্ডারের চাবি টিপতে দেখে অসমঞ্জবাবুর হঠাৎ খেয়াল হল সাংবাদিককে একটা কথা জানানো দরকার। তিনি বললেন, ‘ইয়ে আমার কুকুর আগে হাসত ঠিকই, কিন্তু ইদানীং বেশ কয়েকমাস আর হাসেনি; কাজেই আপনি ওর হাসি চাক্ষুষ দেখতে চাইলে আপনাকে হতাশ হতে হবে।’
আজকালকার অনেক সাংবাদিকদের মতোই রজত চৌধুরী একটা বেশ চনমনে দাঁওমারা ভাব বোধ করেছিলেন এই সাক্ষাৎকারের শুরুতে। কথাটা শুনে তিনি খানিকটা হতাশ হলেও মনের ভাবটা যথাসম্ভব আড়াল করে বললেন, ‘ঠিক, আছে। তবু কতকগুলো ডিটেলস্ আমি জেনে নিই। যেমন প্রথম হচ্ছে, আপনার কুকুরের নাম কী?’
এগোনো মাইকটার দিকে গলা বাড়িয়ে অসমঞ্জবাবু বললেন, ‘ব্রাউনি।’
‘ব্রাউনি…’। এটা রজত চৌধুরীর দৃষ্টি এড়াল না যে নামটা উচ্চারণ হতেই কুকুরের লেজটা দুলে উঠেছে।
‘ওর বয়স কত?’ দ্বিতীয় প্রশ্ন করলেন রজত চৌধুরী।
‘এক বছর এক মাস।’
‘আচ্ছা—আপনি এটাকে পে-প্পে-প্পেলেন কোথায়?’
এটা আগেও হয়েছে। অনেক হোমরা-চোমরার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েও রজত চৌধুরীর জিভের এই দোষটি তাকে আচমকা অপ্রস্তুত করে ফেলেছে। এখানেও তাই হতে পারত, কিন্তু ফল হল উল্টো। এই তোতলামো ব্রাউনির বৈশিষ্ট্যপ্রকাশে আশ্চর্যভাবে সাহায্য করল। পোচকানওয়ালার পরে রজত চৌধুরী হলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি নিজের কানে শুনলেন কুকুরের মুখে মানুষের হাসি।
পরের রবিবার সকালে গ্র্যান্ড হোটেলের শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত দু’শো সাতষট্টি নম্বর কামরায় বসে আমেরিকায় সিনসিনাটি শহরের অধিবাসী উইলিয়াম পি. মূডি কফি খেতে খেতে স্টেটসম্যান পত্রিকায় লাফিং ডগ-এর বিবরণ পড়ে হোটেলের অপারেটরকে ফোন করে বললেন টুরিস্ট ডিপার্টমেন্টের মিস্টার ন্যানডির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে। এই ন্যানডি ছোকরাটি যে কলকাতার রাস্তাঘাট ভালই চেনে তার প্রমাণ মূড়ি সাহেব গত দু’দিনে পেয়েছেন। স্টেটসম্যানে লাফিং ডগ-এর মালিকের নাম ঠিকানা বেরিয়েছে। মূডি সাহেবের তাঁর সঙ্গে দেখা করা একান্ত দরকার।
অসমঞ্জবাবু স্টেটসম্যান পড়েন না। তা ছাড়া তাঁর সাক্ষাৎকারটি যে কবে বেরোবে সেটা রজত চৌধুরী বলে যাননি; দিনটা জানা থাকলে হয়তো তিনি কাগজের খোঁজ করতেন। তাঁকে খবরটা বলল জগুবাবুর বাজারে তাঁর পাড়ার জয়দেব দত্ত।
‘আপনি তো মশাই আচ্ছা লোক’, বললেন জয়দেববাবু, ‘এমন একটা তাজ্জব জিনিস ঘরে নিয়ে বসে আছেন এক বচ্ছর যাবৎ, আর কথাটা ঘুণাক্ষরেও জানাননি। আজ বেলা করে যাব একবারটি আপনার ওখানে। দেখে আসব আপনার কুকুর।’
অসমঞ্জবাবু প্রমাদ গুনলেন। উৎপাতের সমূহ সম্ভাবনা। সত্যি বলতে কী, আপিসের বাইরে মানুষের সঙ্গ তাঁর মোটেই ভাল লাগে না। কোনওদিনই লাগত না—ব্রাউনি আসার পরে তো নয়ই। অথচ কলকাতার লোকেরা যা হুজুগে; এমন একটা খবর পড়ে কি আর তারা এই আশ্চর্য কুকুরটি দেখার লোভ সামলাতে পারবে?
অসমঞ্জবাবু দ্বিধা না করে বাড়ি ফিরে দশ মিনিটের মধ্যে ব্রাউনিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর জীবনে প্রথম একটি ট্যাক্সি ডেকে তাতে চেপে সোজা চলে গেলেন বালিগঞ্জ রেলের স্টেশনে। সেখান থেকে চাপলেন ক্যানিং-এর ট্রেনে। পথে তালিত বলে একটা স্টেশনে গাড়ি থামলে পর জায়গাটাকে বেশ নিরিবিলি মনে হওয়ায় ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন। সারা দুপুর বাঁশবন আমবনের ছায়া-শীতল পরিবেশে ঘুরে ভারী আরাম বোধ হল। ব্রাউনিকে দেখে মনে হল তারও ভাল লাগছে। তার ঠোঁটের কোণে যে হাসিটা আজ দেখলেন অসমঞ্জবাবু, সেটা একেবারে নতুন হাসি। এটা হল প্রসন্নতার হাসি, আরামের হাসি, মেজাজখুশ হাসি। অল অ্যাবাউট ডগ্স্ বইতে অসমঞ্জবাবু পড়েছিলেন যে কুকুরের এক বছর নাকি মানুষের সাত বছরের সামিল। কিন্তু এক বছরের ব্রাউনির হাবভাব দেখে তাঁর মনে হচ্ছে এই কুকুরটির মনের বয়স সাতের চেয়ে অনেক অনেক বেশি।
বাড়ি ফিরতে হল প্রায় সাতটা। বিপিন দরজা খুলতে অসমঞ্জবাবু জিগ্যেস করলেন, ‘হ্যাঁরে, কেউ এসেছিল?’ বিপিন জানাল সারাদিনে অন্তত চল্লিশবার তাকে কড়া নাড়ার শব্দে দরজা খুলতে হয়েছে। অসমঞ্জবাবু মনে মনে নিজের বুদ্ধির তারিফ করলেন।
বিপিনকে চা করতে বলে গায়ের জামাটা খুলে আলনায় রাখতেই কড়া নাড়ার শব্দ হল। ‘ধুত্তেরি’ বলে দরজা খুলে সামনে সাহেব দেখেই অসমঞ্জবাবু বলে ফেললেন, ‘রং নাম্বার।’ তারপর সাহেবের পাশে চশমা পরা এক বাঙালি যুবককে দেখে খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে বললেন, ‘কাকে চাই?’
‘বোধহয় আপনাকে’, বললেন ট্যুরিস্ট ডিপার্টমেন্টের শ্যামল নন্দী। ‘আপনার পিছনে যে কুকুরটাকে দেখছি সেটার সঙ্গে আজকের কাগজের বর্ণনা মিলে যাচ্ছে। ভেতরে আসতে পারি?’
অসমঞ্জবাবু অগত্যা দুজনকে তাঁর ঘরে এনে বসালেন। সাহেব বসলেন চেয়ারে, নন্দী মোড়াতে আর অসমঞ্জবাবু নিজে বসলেন খাটে। ব্রাউনির যেন কেমন একটা ইতস্তত ভাব; সে ঘরে না ঢুকে চৌকাঠের ঠিক বাইরে রয়ে গেল। তার কারণ বোধহয় এই যে, এর আগে সে এই ঘরে কখনও একসঙ্গে তিনজন পুরুষকে দেখেনি।
‘ব্রাউনি! ব্রাউনি! ব্রাউনি!’
ঘাড় নিচু, চোখ সঙ্কুচিত এবং ঠোঁট ছুঁচলো করে সাহেব হাসি হাসি মুখে ব্রাউনির দিকে চেয়ে মিহি গলায় তার নাম ধরে ডাকছে। ব্রাউনিও একদৃষ্টে সাহেবকে পর্যবেক্ষণ করছে।
স্বভাবতই অসমঞ্জবাবুর মনে প্রশ্ন জেগেছিল—এঁরা কারা? সে প্রশ্নের উত্তর দিলেন। শ্যামল নন্দী। সাহেব মার্কিন মুলুকের একজন বিশিষ্ট ধনী ব্যক্তি, ভারতবর্ষে এসেছেন পুরোনো রোলস রয়েস গাড়ির সন্ধানে। সকালে ব্রাউনির বিষয়ে খবরের কাগজে পড়ে তাকে একবার দেখার লোভ সামলাতে পারেননি। সাহেব ঠিকানা খুঁজে বার করতে পারবেন না বলে শ্যামল নন্দী তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন।
অসমঞ্জবাবু লক্ষ করলেন সাহেব এবার নাম ধরে ডাকা ছেড়ে চেয়ার থেকে নেমে এসে নানারকম মুখভঙ্গি ও অঙ্গভঙ্গি করতে আরম্ভ করেছেন। অর্থাৎ কুকুরকে হাসানোর চেষ্টা চলেছে।
মিনিট তিনেক এইভাবে সংবাজি চালাবার পর সাহেব হাল ছেড়ে অসমঞ্জবাবুর দিকে ফিরে বললেন, ‘ইজ হি সিঁক্?’
অসমঞ্জবাবু জানালেন তাঁর কুকুরের কোনও ব্যারাম হয়েছে বলে তিনি জানেন না।
‘ডাঁজ হিঁ রিঁয়েলি ল্যাঁফ?’
মার্কিনি ইংরিজি পাছে অসমঞ্জবাবু না বোঝেন তাই শ্যামল নন্দী অনুবাদ করে বুঝিয়ে দিলেন সাহেব জানতে চাইছেন কুকুরটা সত্যিই হাসে কি না।
অসমঞ্জবাবুর অন্তরের ভিতর থেকে একটা বিরক্তির ভাব বাইরে ঠেলে বেরোতে চেষ্টা করছিল। সেটাকে মনের জোরে দাবিয়ে রেখে বললেন, ‘সব সময় হাসে না। যেমন সব মানুষও হাসতে বললেই হাসে না।’
এবার দোভাষীর অনুবাদ শুনে সাহেবের মুখে লালের ছোপ পড়ল। তারপর তিনি জানালেন যে প্রমাণ না পেলে তিনি কুকুরের পিছনে খরচ করতে রাজি নন, কারণ দেশে ফিরে অপ্রস্তুতে পড়তে চান না তিনি। তিনি আরো জানালেন তাঁর বাড়িতে তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে চীন থেকে পেরু পর্যন্ত পৃথিবীর এমন কোনও দেশ নেই যেখানকার কোনও না কোনও আশ্চর্য জিনিস নেই। একটি প্যারট আছে তাঁর কাছে, যেটা ল্যাটিন ভাষা ছাড়া কথা বলে না। —‘এই লাফিং ডগটি কেনার জন্য আমি সঙ্গে চেক বই নিয়ে এসেছিলাম।’
কথাটা বলে সাহেব তাঁর বুক পকেট থেকে সড়াৎ করে একটি নীল বই করে দেখালেন। অসমঞ্জবাবু আড় চোখে দেখলেন, তার মলাটে লেখা সিটি ব্যাঙ্ক অব নিউ ইয়র্ক।
‘আপনার ভোল পালটে যেত মশাই’, বললেন শ্যামল নন্দী, ‘আপনার কুকুরকে হাসাবার যদি কোনও উপায় জানা থাকে তা হলে সেইটি এবার ছাড়ন। ইনি বিশ হাজার ডলার পর্যন্ত দিতে রাজি আছেন ওই কুকুরের জন্য। মানে টাকার হিসেবে দেড় লাখ।’
বাইবেলে লিখেছে ঈশ্বর সাতদিনে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছিলেন। মানুষ কিন্তু কল্পনার সাহায্যে সাত সেকেন্ডেই এ কাজটা করতে পারে। শ্যামল নন্দীর কথা শোনামাত্র অসমঞ্জবাবু যে জগৎটা চোখের সামনে দেখতে পেলেন, সেখানে তিনি একটি পেল্লায় ছিমছাম ঘরে বার্ড কোম্পানির বড় সাহেবের মতো পায়ের উপর পা তুলে আরাম কেদারায় বসে আছেন, আর বাইরের বাগান থেকে ভেসে আসছে হাসনাহানা ফুলের গন্ধ। দুঃখের বিষয় তাঁর এই ছবি বুদ্বুদের মতো ফুড়ৎ হয়ে গেল একটা শব্দে।
ব্রাউনি হাসছে।
এ হাসি আগের কোনও হাসির মতো নয়; এ একেবারে নতুন হাসি।
‘বাঁট হিঁ ইঁজ ল্যাফিং!’
মূডি সাহেব কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়েছেন, আর দুই চোখ দিয়ে গিলছেন এই দৃশ্য। জানোয়ার হলে তাঁর কানটাও যে খাড়া হয়ে উঠত সে বিষয়ে সন্দেহ নেই অসমঞ্জবাবুর।
এবার কম্পিত হস্তে মূডি সাহেব তাঁর পকেট থেকে আবার বার করলেন তাঁর চেক বই। আর সেই সঙ্গে একটি সোনার পার্কার কলম।
ব্রাউনি কিন্তু হেসে চলেছে। অসমঞ্জবাবুর মনে খট্কা, কারণ তিনি এ হাসির মানে বুঝতে পারছেন না। কেউ তোতলায়নি, কেউ হোঁচট খায়নি, কারুর ছাতা উল্টে যায়নি, চটির আঘাতে কোনও আয়না দেয়াল থেকে খসে পড়েনি—তা হলে কেন হাসছে ব্রাউনি?
‘আপনার কপাল ভাল’, বললেন শ্যামল নন্দী। ‘তবে আমার কিন্তু একটা কমিশন পাওয়া উচিত, কী বলেন—হেঃ হেঃ।’
মূডি সাহেব মেঝে থেকে উঠে চেয়ারে বসে চেক বই খুললেন। ‘আঁস্ক হিঁম হাঁউ হিঁ স্পেঁল্স্ হিঁজ নেম।’
‘সাহেব আপনার নামের বানান জিগ্যেস করছেন’, বললেন দোভাষী শ্যামল নন্দী।
অসমঞ্জবাবু কথাটার উত্তর দিলেন না, কারণ তিনি হঠাৎ আলো দেখতে পেয়েছেন। আর সেই আলো তাঁর মনে গভীর বিস্ময় জাগিয়েছে। নামের বানানের বদলে তিনি বললেন, ‘সাহেবকে বলুন কুকুর কেন হাসছে সেটা জানলে তিনি আর টাকার কথা তুলতেন না।’
‘আপনি আমাকেই বলুন না,’ শুকনো গলায় কড়া সুরে বললেন শ্যামল নন্দী। ঘটনার গতি তাঁর মোটেই মনঃপূত হচ্ছে না। মিশন ফেল করলে সাহেবের ধাতানি আছে তাঁর কপালে এটা তিনি জানেন।
ব্রাউনির হাসি থেমেছে। অসমঞ্জবাবু তাকে কোলে তুলে নিয়ে চোখের জল মুছিয়ে বললেন, ‘সাহেব ভাবছেন টাকা দিলে দুনিয়ার সব কিছু কেনা যায়, তাই শুনে কুকুর হাসছে।’
‘বটে? আপনার কুকুর বুঝি দার্শনিক?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘তার মানে আপনি কুকুর বেচবেন না?’
‘আজ্ঞে না।’
শ্যামল নন্দী অবিশ্যি তাঁর অনুবাদে কুকুরের মনের ভাবের কথা কিছুই বললেন না, শুধু জানিয়ে দিলেন যে কুকুরের মালিক কুকুর বেচবেন না। কথাটা শুনে কলম, চেক বই পকেটে পুরে প্যান্টের হাঁটু থেকে অসমঞ্জবাবুর মেঝের ধুলো হাত দিয়ে ঝেড়ে ঘর থেকে বেরোনোর সময় সাহেব শুধু মাথা নেড়ে বলে গেলেন, ‘হিঁ মাস্ট বিঁ ক্রেঁজি!’
বাইরে মার্কিন গাড়িটার আওয়াজ যখন মিলিয়ে এল তখন অসমঞ্জবাবু ব্রাউনিকে তাঁর কোল থেকে নামিয়ে খাটের উপর রেখে তার দিকে চেয়ে বললেন, ‘তোর হাসির কারণটা ঠিক বলিনি রে, ব্রাউনি?’
ব্রাউনি ছোট্ট করে হেসে দিল—ফিক্।
অথাৎ ঠিক।