যুগান্তর

যুগান্তর

দুপুর পার হইয়া গিয়াছে, তবে ঠিক বিকাল এখনও হয় নাই।

কাল অনেক রাত্রে বর-বধূ আসিয়াছে। বরণ প্রভৃতি প্রাথমিক আচারে হাঁকডাক- গল্পগুজবে এবং তাহার পর খাওয়া-দাওয়ায় অনেক বিলম্ব হইয়া গিয়াছিল। বাড়িটা তাই এখনও পর্যন্ত দিবাসুপ্ত। নেহাৎ যদি এক-আধজন জাগিয়া থাকে।

বাড়িটার গায়ে হেমন্তের হলদেটে রোদ, এখানে-ওখানে গোটাকতক নারিকেলগাছের আর একটা ঘনপল্লবিত জামরুলগাছের ছায়া। মনে হয়, কয়দিন আগে বাড়িটাতে গায়ে- হলুদের যে ধুম পড়িয়াছিল তাহারই ছোপছাপ এখনও যেখানে-সেখানে লাগিয়া রহিয়াছে। এই গায়ে-হলুদ সেদিনকার হাসি হল্লা হট্টগোলের মধ্যে ছিল অন্য রকম; আজ কয়েকদিন দূরে পড়িয়া ইহারই মধ্যে তাহাতে স্মৃতির যাদু রঙ ধরিয়াছে।

বিয়ের জের এখনও শেষ হয় নাই। আজ সকালে দিন ছিল, বউভাতের অনুষ্ঠানটা সারিয়া রাখা হইয়াছে। রাত্রে ফুলশয্যা। পরশু বউভাতের খাওয়ানোর হাঙ্গামা। সদরে রোশন-চৌকি বসিয়াছে। বাজনাদারেরা দুপুরের ঝোঁকে একটু জিরাইয়া লইতেছিল, আবার নিজেদের বাজনা ধরিল। প্রথমে ঢোল খঞ্জনি; তাহার পর একজন সানাইয়ে একটানা ফুঁ দিয়া সুরের একটা স্রোত বহাইয়া দিয়া গেল, তাহার উপর ওস্তাদ মূল সানাইয়ে রাগিণীর বিচিত্র লহরী সৃষ্টি করিয়া চলিল।

যেন বীচি-চপল স্রোতই বটে। এক এক সময়, যেমন হেমন্তের এই রকম একটা উৎসবক্লান্ত ম্লান দিনে, মনে হয়, এ কবেকার একেবারে ভুলিয়া যাওয়া সময়ের মধ্য হইতে কত হাসি কান্নার টুকরা ভাসাইয়া আনিয়া, অল্প একটু সময়ের জন্য চোখের সামনে দুলাইয়া নাচাইয়া আবার নিজের প্রবাহের বেগে মিলাইয়া গেল।

আজিকার স্রোতে এমনই ভাবে হঠাৎ পঞ্চাশ বৎসর আগেকার এমনই উৎসব-দিনের গোটাকতক বিচ্ছিন্ন কাহিনী ভাসিয়া আসিল। দেখিতে দেখিতে কেমন করিয়া এই কঠিন বাড়িটার কিছু কিছু অংশ গলিয়া মিলাইয়া পরিবর্তিত হইয়া গেল। আজিকার দিনে যাহারা সুখে-দুঃখে বাড়িটা মুখরিত করিয়া আছে, তাহারা নিদ্রিত রহিল; কিন্তু একটুর মধ্যেই সেই পরিবর্তিত মায়াগৃহে কবেকার বিস্মৃত একটা আনন্দ-চপলতা সাড়া দিয়া উঠিল। কত মুখের কত রকম ভাষা, কত সব ভঙ্গী; কত-রকম চোখ, তাহাতে কত কৌতুকের কি সব বিচিত্র চাহনি; কত রকম পায়ের কত ভঙ্গিমায় চলা!

তাহাদের অনেকেরই চলা শেষ হইয়া গিয়াছে। যাহারা আছে, তাহারাও তাহাদের কণ্ঠস্বরের সে সুর, চাহনির সে অমৃত, গতির সে ছন্দ হারাইয়া বসিয়া আছে। কিন্তু আজ যেই সেদিনকার মতো সানাইয়ে করুণ সুরে বাড়িটার সর্বাঙ্গ পূর্ণ হইয়া উঠিল, অমনই প্রত্যক্ষের সমস্ত কঠিনতা, সত্যের সমস্ত গ্লানি বিলুপ্ত হইয়া গেল, মৃত্যুর ব্যবধানও অন্তর্হিত হইয়া গেল, যাহারা জীবিত আর যাহারা গত, সবাই তাহাদের পঞ্চাশবৎসর পূর্বেকার সেই কয়টি দিনের উৎসবদীপ্ত চাঞ্চল্য লইয়া স্বপ্নাবিষ্ট চোখের সামনে জাগিয়া উঠিল।

আজ বধু আসিয়াছে—মীরা; নূতন যুগের নূতন নাম, নূতনবিধ সজ্জা। পায়ে জরির কাজ-করা মখমলের লক্ষ্মৌয়ী নাগরা; নীচের হাতে হালকা স্বর্ণাভরণ; কানে দুইটি হীরার টপ ছাড়া মুখমণ্ডল মুক্ত; আর ভরা বয়সের সেই পূর্ণ মুখখানিতে একটা সপ্রতিভ ভাব, যাহা নিতান্তই যেন এই স্বাধীনতাযুগের বিজয়কেতন। বধূ আই. এ. পাস।

সেটা ছিল লাবণ্যপ্রভার দিন। আজ যেখানে রোশনচৌকি বসিয়াছে, সেদিন সেইখানে সাঁচ্চার ঝালর দেওয়া পাল্কি নামিল। কচি, সবে খেলাঘর হইতে বাহির হইয়া আসা, আলতা-পরা দুইখানি পা একথালা দুধে ধোওয়াইয়া দুধে-আলতা করা হইল। তাহার পর শাশুড়ির সেই কোল, নথ-পরা ঘোরালো মুখের সেই প্রসন্ন আহ্বান, “এস মা লক্ষ্মী আমার!”

তাহার পর বরণের পালা। সেটা বেশ স্পষ্ট মনে পড়ে, যেন কালিকার কথা, যেন কাল মীরার বরণের পাশে পাশে পঞ্চাশ বছর আগেকার এই বাড়ির সেই আর একটি বরণও হইয়া গিয়াছে। ওইখানে একটা কাঞ্চন-ফুলের গাছ ছিল, সেটা নাকি অনেক বরণের সাক্ষী, তাহার তলায় বর-বধূ দাঁড়াইল। চারিপাশে উচ্ছল আনন্দের একটা মিশ্র কোলাহল; বাজনার শব্দে, হাসির হিল্লোলে, বড়দের হুকুমের পুরু আওয়াজে, ছেলেমেয়েদের আবদারের স্বরে যেন মাখা-মাখি পড়িয়া গিয়াছে। ওরই মধ্যে একটা কথা স্নেহের গভীরতায় খুব স্পষ্ট, কালের গায়ে দাগিয়া বসিয়া আছে।—”

“ওগো, তোমাদের একশো বার বলছি, ওই বাজে মেয়ে-আচারগুলা শিগগির সেরে নাও, মা আমরা রোদে-ধুলোয় সারা হয়ে এসেছেন, আর দাঁড়াতে পারেন না।”

সে-শ্বশুর আর সে-শাশুড়ি কেহ কি পায়? মনে হইলেই হাত দুইখানি কপালে গিয়া ঠেকে, চোখে জল ভরিয়া আসে।

পিসশাশুড়ির সেই ঝঙ্কার, “নে বাপু, তোর নতুন শ্বশুরগিরি ফলাতে হবে না; আমাদের আচার সবই বাজে!”

পাশে একজনের বোকার মতো কথা, “বাজেই তো; আমারও ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ধরে আসছে।”

সঙ্গে সঙ্গে, “ও ঠাকুরপো! র’স, এখনও ঘরে ঢোকে নি, এরই মধ্যে…!”

সেই এক হাসি। ছোট বড় কেউ আর বাদ রহিল না।

একটা দীর্ঘনিশ্বাসের সঙ্গে মনটা এ যুগে ফিরিয়া আসে, সুরস্নাত ঘুমন্ত পুরীতে সানাইয়ের সুর হঠাৎ স্পষ্ট হইয়া উঠে, তাহার পর অতীতের সেই সেদিনের সানাইয়ের সঙ্গে এক হইয়া যায়।

বরণশেষে দেখার ভিড় পড়ে, মুখ দেখা, গড়ন দেখা, ভূষণ দেখা।

“না রাঙাগিন্নি, বউয়ের সেরা বউ এনেচ বাছা; আহা, কি আঙুল গা, যেন আগুনের শিখে!” কেহ বলে, “যেন চাঁপার কুঁড়ি!” একজন কচি গলায় বলে, “নখগুলো কত রাঙা দেখেছ মা—টকটকে নটকানের মতন!”

এর সঙ্গে খুব ভাব হইয়াছিল, অনেক কথা মনে পড়ে, কত শপথ করিয়া আতর পাতানো! কিন্তু—”

শাশুড়ি বলেন, “আশীর্বাদ কর, সিঁথির সিঁদুর নিয়ে বেঁচে থাক—এই। রূপ আর কি!”—সুখের ভারে আওয়াজ ভারি হইয়া পড়ে। হাতখানি তুলিয়া ধরিয়া বলেন, “এই রতনচুড় দিয়েছে, এই তাবিজ আর এই কণ্ঠী। মুখটা তোল তো মা।”

“দিব্যি দিয়েছে, দেবেই তো, এমন প্রতিমের মতো মেয়ে, সাজিয়ে দেবে না গা?” আতরের কথাও মনে পড়ে, “আর নোলকটাও চমৎকার দিয়েছে মা, সত্যি!”

সবাইয়ের আবার সেই হাসি, “চুপ কর পাগলি, এত গয়নার মধ্যে ওর চোখে ঠেকল কিনা নোলক!”

আর একজন কে বলিয়াছিল, “নোলকে মুখখানি খুব খুলেছে কিনা, যেন সকালের পদ্মফুলটি। নাম কি হল গা?”

শাশুড়ি বলিলেন, “লাবণ্যপ্রভা।”

শ্বশুরবাড়ির লোকে নামে যেন একটা সুর বসাইয়া দেয়। আঙুর মুখে দিয়া লোকে যেমন ধীরে ধীরে চাপিয়া রসটা চারাইয়া লইতে থাকে, প্রশ্নকর্ত্রী সেইরকম ভাবে নামটা লইয়া একটু নাড়াচাড়া করিল, “লাবণ্যপ্রভা, লা–ব–ণ্য–প্র—ভা, লাবণ্য, বাঃ, চমৎকার নামটি, দিব্যি!”

সেদিনকার আদরের বধূ আজিকার বধূর দিদিশাশুড়ি; কোথায় সেই লাবণ্য, কোথায়ই বা সে প্রভা?

যা কোনো কালেই চিরস্থায়ী নয়, তাহার জন্য দুঃখ নাই; দুঃখ হয়, সে সব ধরনের প্রশংসাও আর নই। আজ সকালে মীরাকে দেখিবার সময় একজন বলিল, “একেবারে হালফ্যাশানের ব্লাউজটি, সবচেয়ে নতুন ছাঁট, দিব্যি!”

অমন নিটোল গড়ন, অমন পটের ছবির মতো মুখ, কাহারও একটা মিষ্টি তুলনা দিবার মুরদ হইল না? কত তো ঠাকুর-দেবতা রহিয়াছেন—দুর্গা প্রতিমা, লক্ষ্মীঠাকরুন, রাইগ্রামের রাধারাণী; কত ফুল, কত কি!…হালফ্যাশানের ব্লাউজ! শুনিলেও গা জ্বালা করে।

যাক, নূতন যুগের রীতি; অমন হয়ই। সে যুগে যাহারা দিদিশাশুড়ি ছিল, তাহারও নাতি-নাতনীর বিয়েতে সব জিনিস নিজের মনের মতন করিয়া পায় নাই। নাতবউয়েরা মাথায় তোলা-খোঁপা, সিঁথির নীচে অর্ধেক কপাল জুড়িয়া তেলে-গোলা সিঁদুর আর চোখে টানা কাজল পরিয়া আসিত না বলিয়া তাহারা দুঃখ করিত। সময়টা যেন হাওয়া, বহিতে বহিতে নিজের গন্ধ হারাইয়া ফেলে, আবার নূতন গন্ধ সঞ্চয় করিয়া চলে। মানুষ ঠিক থাকিলেই হইল।

পায়ে জুতা দিয়া আসুক, মীরা মেয়েটি কিন্তু বড় ভালো। জুতা কি চিরকালই পরিবে? কোলে একটি হইলেই কোথায় যাইবে জুতা, কোথায় যাইবে ব্লাউজ, যে কয়টা দিন কোল খালি থাকে—

আজ সকালের মধ্যেই কতজনের সঙ্গে ভাব করিয়া লইয়াছে। দিদিশাশুড়ি তো যেন কতদিনের খেলার সাথীটি। নাতি যেমন হাসিখুশি ভালোবাসে, ঠিক তেমনটি হইয়াছে। আর হাসিটিও চমৎকার, কেমন ঘাড়টি বাঁকাইয়া লয় সঙ্গে সঙ্গে, কেমন মুক্তার সারির মতো দাঁতগুলি! হ্যাঁ, ওই আবার এক একেলে রোগ, পান খাইবে না। ধরুক গিয়া দাঁতে ছোপ, তাই বলিয়া বউ-মানুষ পান খাইবে না? এ আবার কোন্ দেশী কথা? আজ ফুলশয্যা, এই ব্রতটি ভাঙা চাই, নাতিকে টিপিয়া দিতে হইবে।

একটু কানাঘুষা চলিয়াছে, কনে যেন একটু বেহায়া। এত খোলাখুলি ভাব, ঘোমটায় চোখের অর্ধেকটাও ঢাকা পড়ে না, কথা পড়িবার আগেই হাসি!

নেত্য-ঠাকুরঝির ঠোটে ক্ষুর, অতক্ষণ দেখিয়া শুনিয়া উঠিবার সময় বলিয়া গেল, “কই গো রাঙাগিন্নি, এতক্ষণ বসলাম, কনে-বউ দেখালে না তো? লোকে বলে, যেন কতকালের পুরনো বউ ঘরে এল, বয়েস হয়েছে কিনা!”

দিদিশাশুড়ির গায়ে লাগে, ভাবে, বলুক গিয়া লোকে। শ্বশুরবাড়ির কি আবার নূতন পুরানো আছে? এ কি এক জন্মের সম্বন্ধ? জন্মাইবার আগে হইতেই স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, দেওর, জা সব ঠিক হইয়া আছে। বাপ-ভাইয়ের বাড়ি, সে তো পরের বাড়ি; সেখান হইতে অসিয়া ঘরকন্না বুঝিয়া লওয়া; অবস্থাগতিকে কেহ দুই দিন আগে আসিল, কেহ দুই দিন পরে। আসিয়াই যে নিজের ধন, নিজের জন চিনিয়া লইল, সেই তো সেয়ানা মেয়ে। মেয়ে মানুষের শাস্ত্রই তো এই।

.

বাঁশী অব্যাহত প্রবাহে বাজিয়া চলিয়াছে, সুরের মধ্যে কেমন একটা মালাবদলের ভাব। শুধু যে মানুষেরই মালাবদল তাহা নয়, যেন এযুগ-সেযুগের মধ্যেও মালাবদল, গলাগলি, মেশামেশি আজ।

আজ ফুলশয্যা না? ইহারা যে দিব্য নিশ্চিন্ত হইয়া ঘুমাইতেছে! কেমন ননদ-জা সব? মীরাকে দিয়া মালা গাঁথাইবে না? এদের সব ভালো, ওইটেই কেমন এক বদ প্রথা দাঁড়াইয়া গিয়াছে। বলিলেই বলে, সেকালে দুধের বাছা কচি মেয়ে সব ঘরে আসত, অতশত বুঝত না, তাদের দিয়ে সব করানো যেত। আজকাল ডাগরটি হয়ে সব শ্বশুরবাড়ি পা দিচ্ছে, ওসব করতে চায় না।

কী যে কথা!

না, মেয়েরা সব গলাবন্ধ বুনুক, পায়ের জুতার জন্য কার্পেট বুনুক, গলার মালা গাঁথিয়া কাজ নাই। কোথাকার এক মালিনী বেদেনী মালা গাঁথিয়া দিবে, লগ্নক্ষণে সেই মালা গলায় দেওয়া,—এই করিয়াই আজকাল যত অনাসৃষ্টির ছড়াছড়ি, প্রায়ই পুরুষদের সব নোঙর-ছেঁড়া ভাব। এ একটা অলক্ষণ যে! কে মনে কি ভাব লইয়া মালা গাঁথিয়া দেয়, কে বলিতে পারে! ওইজন্য বিয়ের মালাতেও সেকালে বর-কনেকে একটি করিয়া ফুল লাগাইয়া দিতে হইত; উদ্দেশ্য, দোষ খণ্ডানো। সেকালে তো কাহারও আর বুদ্ধিসুদ্ধি ছিল না!

না, সেই দুধের বাছা কচি মেয়েদের লজ্জাশরমও কিছু ছিল না। তাহারা উঠানের মাঝখানে শ্বশুর-শাশুড়ি-ভাশুর সব একত্র করিয়া ঢঙ করিয়া মালা গাঁথায় লাগিয়া যাইত আর কি!

না বাপু, একালের তোমরা যতই বুদ্ধিমান ভাব নিজেদের, কোনো ব্যাপার তলাইয়া বুঝিবার মতো বুদ্ধিসুদ্ধি তোমাদের নাই; আর যদি হক কথা বলিতে হয় তো তোমাদের একালের ছেলেমেয়েই সব বিয়ে করিতে আসে যেন দুধের বাছা, এসব দিকের কিছু জ্ঞান নাই, কলেজ-স্কুল ঘাঁটিয়াই সব হাক্লান্ত। এই অশুই তো একটা নমুনা; কে বলিবে— ছেলেটার কাল পারাইয়া পরশু বিবাহ হইয়াছে?

সেকালের ছবি ফুটিয়া উঠে, ফুলশয্যার মালা-গাঁথা।

জামরুলতলার ওই ঘরটা তখন অত বড় ছিল না, ওর জায়গায় দুইটা ছোট ছোট ঘর ছিল; তাহার মধ্যে ওদিকেরটা একটেরেয় ছিল বলিয়া সেটাতে কাহারও বড় নজর পড়িত না, নিরিবিলি থাকিত।

এখন কি আর সব কথা মনে পড়ে! দুপুরবেলা, বড়দের মধ্যে বসিয়া ছিল শাশুড়ি, দিদিশাশুড়ি, আরও কে কে সব। একজন আসিয়া তাহাকে তাহাদের নিকট হইতে চাহিয়া লইয়া গেল—মলের ঝমর ঝমর শব্দ, শাশুড়ির ঘাড় বাঁকাইয়া হাসিমুখে চাহিয়া থাকা, এখন বুঝা যায়, সেটা গুমরের দৃষ্টি। তাহার পর মনে পড়ে, জামরুলতলার সেই ঘরের মধ্যে ফুলের মেলা—শিউলি, গোলাপ, দোপাটির রাশি, আরও কত ফুল, কলকের মধু-মধু গন্ধটা এখনও নাকে লাগিয়া আছে। ঘরে ঢুকিতেই টগর-ঠাকুরঝির গম্ভীর হইয়া কথা, “ডিম ফুটতেই তেড়ে-ফুড়ে যে আমার দাদাকে বিয়ে করতে এলি, ফুলের মালা গাঁথতে শিখেছিস?” ঘাবড়াইয়া গিয়া তাহার কাঁদ কাঁদ হইয়া উত্তর, “আমি বে করব বলি নি তো।” ঘরসুদ্ধ সকলের হাসি, ছাত যেন ভাঙিয়া পড়িবে।

দশ বছরের ছোট মেয়ে, ছলছলে তাহার চোখ, ঘরের মধ্যে দুষ্টামিতে ভরা কতকগুলি মুখ, সবগুলো হাসিতে এলাইয়া পড়িল, এখনও চোখের সামনে ভাসিতেছে।

গোড়ে গাঁথায় সেই প্রথম হাতেখড়ি।

ফুলশয্যার কোনো কথাই মেয়েরা সারাজীবন ভোলে না। কিন্তু তাহারই মধ্যে একটা ব্যাপার মনে হয় যেন এই কাল কি পরশুর কথা। সেই এক রকম জবরদস্তি করিয়াই মুখ ফিরাইয়া ঘোমটা খুলিয়া প্রশ্ন, “আমার মালা কই? পরাতে হবে না?”

কে উত্তর দেয়? সেই জোর করিয়া চোখ বুজিয়া শুইয়া থাকা।

কত খোশামোদ, প্রবঞ্চনা, অভিমান! “বেশ, বোঝা গেল আমায় পছন্দ হয় নি।” উত্তর দিতে বহিয়া গিয়াছে।

“আচ্ছা, আর তিনবার বলব, মাত্র তিনটি বার। পরাও মালা, পরাও মালা, পরাও— আচ্ছা, আর দুবার। দুবার হয়ে গেল বলে দিচ্ছি। আচ্ছা, আর একবার বলব, এই শেষ, না শোন তো আমার অকল্যাণ হবে। বেশ তো।”

“কোনটা পরবে?”—জীবনে সেই প্রথম কথা

রেকাবিতে তাহার নিজের হাতের গাঁথা মালা ছিল। আসিবার সময় কাপড়ের মধ্যে চুরি করিয়া ননদের নিপুণ হাতে তৈয়ারি একটা মোটা গোলাপ-ফুলের ধুকধুকি দেওয়া গোড়ে আনিয়া সঙ্গে রাখিয়া দিয়াছিল। সেইটার উপর লোভ না হইয়া যায় না।

“আহাহা, এতই বোকা আমি? এইটে, আর কোনটা!”—সেই বোনের গাঁথা মালাটি স্বামী তুলিয়া ধরিল।

তাড়াতাড়ি মালাটা গলায় পরাইয়া দিয়াই পাশ-বালিশে মুখ গুঁজিয়া সে কি হাসি! ফুল-ছড়ানো বিছানায় হতভম্ব বরের চোখের নীচে হাসিতে কম্পমানা কিশোরীকে স্পষ্ট যেন দেখা যাইতেছে। হঠাৎ অমন দুষ্টামির বুদ্ধি যে কোথা হইতে জুটিল!

ছোটবেলায় যখন কেহ বলিত, মেয়েটা হাঁদা হবে, ঠাকুরমা বলিতেন, “রসো, মেয়েমানুষ, কপালে সিঁদুরের বাতি জ্বললেই মাথায় বুদ্ধির ঘর আলো হয়ে যাবে।”

তাই ওইরকম ভাবে আলো হইয়াছিল আর কি! এর সাজাও হইয়াছিল, এর পর আর বাহির হইতে আনা মালা গলায় দিতে চাহিত না। দেরাজে ফুল আনিয়া লুকাইয়া রাখিতে হইত; রাত্রে বিছানায় বসিয়া সদ্য সদ্য মালা গাঁথিয়া দিতে হইত। ইশারা ছিল, যেদিন ফুল যোগাড় হইত না আগেই জানাইয়া দিতে হইত। জামার পকেট ভরিয়া রাশীকৃত ফুল আসিয়া হাজির হইত।

.

এক এক সময় মনটা কেমন উদাস হইয়া যায়; হঠাৎ যেন এত নিবিড়ভাবে পাওয়া অতীতটা ঝাপসা হইয়া যায়; বর্তমানটাও থাকে না, সব লুপ্ত করিয়া আসিয়া পড়ে কেমন একটা অবসাদ। একটা জীবনের বসন্ত হইতে শরৎ পর্যন্ত সবই শেষ হইয়া গিয়াছে; সামনে মরণের শীতের হাওয়া, এই কথাটাই যেন হেমন্তের পাণ্ডুর লিপির মধ্যে কোথায় লেখা রহিয়াছে।

বাঁশীতে আবার ফুঁ পড়ে। তরতরে স্রোত, তাহাতে কোন শতদলের পাপড়ি যেন ভাসিয়া আসে, শ্বশুরবাড়ির সেই প্রথম কয়টা দিন, একবাড়ি লোকের মধ্যে মিলনের সেই হাজার রকম ফন্দি, একটু চকিত দেখা, একটু স্পর্শ, যা লাভ—”

কই, আজকালকার বর-কনেদের মধ্যে সেরকম যেন আঠাই হয় না, তা একালের ছেলেমেয়েরা যতই না কেন গুমর করুক। বিয়ে করিতে হয় করে, ওই পর্যন্ত। বাপ-মা বিবাহ দিয়া খালাস, বর মন্ত্র আওড়াইয়া খালাস, ভাজেরা, শালী-শালাজ-ননদেরা প্রীতি- উপহার লিখিয়া খালাস। এখন কোথায় নূতন কনের নেশায় মন মাতিয়া থাকিবে, কিন্তু অশুর কথাবার্তায় চলাফেরায়, তাহার একটু আঁচ পাওয়া যায় কি? মীরারও ওই রোগ, বেশ হাসিখুশি, আমোদ-আহ্লাদ, শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে যেন মিশিয়া এক হইয়া গিয়াছে; কিন্তু মনের কোথাও যে আসল লোকটির ভাবনার রঙ ধরিয়াছে, এমন তো মনে হয় না; সে হইলে আর দিদিশাশুড়ির পাকা চোখকে এড়ানো যাইত না। যেন হচ্ছে হবে, ও তো হাতের পাঁচ—এই ভাব। এই তো জোড়া-গাঁথার সময়, এ সময়টা অমন ঢিলাঢালা ভাবটা ভালো নয় তো! এই জন্যই সেকালে হাতের তৈয়ারি মালা, হাতের সাজা পান, এই সব করিয়া প্রথম ঝোঁকেই ভালো করিয়া মিলাইয়া দিত।

না, সে নিজে যখন বাঁচিয়া, তখন প্রথম নাতির বিয়েতে একটা পুরনো রেওয়াজ নষ্ট হইতে দিবে না। মীরা উঠুক, ঢের ঘুম হইয়াছে। ননদ-জায়েরা ফুল আনিয়া দিক, মীরা, মালা গাঁথুক। লজ্জা চলিবে না, গাঁথিতে হইবে।

এ কি ঘুম অনাসৃষ্টি!

একালের দরদী দিদিশাশুড়ির আর বসিয়া থাকা চলিল না। আহা, একালের আপনভোলা দম্পতি, কত দিক দিয়াই যে এরা বঞ্চিত!

.

উঠিতেই একটা অস্পষ্ট শব্দ কানে গেল, যেন ওপাশের কোণের ঘরটায় সন্তর্পণে দুয়ার খোলার আওয়াজ হইতেছে। এত লুকোচুরি করিয়া কে দুয়ার খোলে! চাকর-দাসী কেউ ঘরে ঢোকে নাই তো! কাজের বাড়ির ভিড়, গহনাপত্র কাপড়-চোপড় যেখানে-সেখানে ছড়ানো গোঁজড়ানো রহিয়াছে। নাঃ, এই অলক্ষণে ঘুমে একটা কাণ্ড ঘটাইবে।

ঘরটা একেবারে আড়ালে পড়ে। আর দুই পা যাইলেই ওদিক দিয়া নীচের দিকে একটা কাঠের সিঁড়ি নামিয়া গিয়াছে, একেবারে খিড়কির পানে। কে মানুষটি দেখিতে হয় তো! আর একটু আড়াল হইয়া বসিতে হইল।

সিঁড়িতেও যেন পায়ের খসখস শব্দ, থামিয়া থামিয়া খুব সতর্ক উঠিবার আওয়াজ। সর্বনাশ! এ যে চাকর-দাসীর সঙ্গে একজোট করিয়া চুরির ব্যবস্থা! ডাকাতিও হইতে পারে। এই ভাবেই তো সেবারে বোসেদের বাড়িতে ডাকাতি হইয়া গেল। আর ওদিকে ঘরের মধ্যে নিশ্চিন্ত ভাবে নাক ডাকার ধুম!

বাহিরের ঘরে পাশা পড়িয়াছে; কিন্তু কে গিয়া খবর দেয়? ঝিটা পর্যন্ত কাছে নাই। কিন্তু এ রকম করিয়া চুপচাপ থাকাও তো চলে না, এদিকে চেঁচাইতে গেলেই যে আসিয়া টুটি টিপিয়া ধরিবে। তা হোক, এতগুলা লোকের প্রাণ, গহনাগাঁটি—”

দুয়ার আরও একটু খুলিল, কব্জার একটা টানা মিহি আওয়াজ হইল। আবার সিঁড়িতে পায়ের শব্দ, একেবারে তাড়াতাড়ি তিন-চারটা ধাপ। না, আর দেরি করা নয়, বুঝি সব যায়!

সমস্ত শক্তি একত্র করিয়া চিৎকার করিয়া উঠিবার পূর্বেই আধ-ভেজানো দুয়ার গলিয়া লঘু পদক্ষেপে মীরা আসিয়া বারান্দায় দাঁড়াইল, এবং একবার এদিক ওদিক চাহিয়া জামরুলের ঝোপে রেলিঙে ভর দিয়া মাথা নীচু করিয়া দাঁড়াইল।

সিঁড়ির শব্দটা আবার জাগিয়া উঠিল—জুতার খসখসানি। মীরা চকিতে চাহিয়া ঘোমটাটা আর একটু টানিয়া দিল, গালের আধখানা পর্যন্ত ঢাকা রহিল।

এদিকে ভয়ের জায়গায় কৌতূহল আসিয়া মনটা দখল করিয়া বসিয়াছে। কাণ্ডটা কি? একটা সমস্যা যে!

সমস্যার মূর্তিমান সমাধানের মতো নাতির শরীরের উপরের ভাগটা হঠাৎ বারান্দার শেষে সিঁড়ির উপর আবির্ভূত হইল।

অবাক করিল! আর ওই অশোক, সাত চড়ে কথা কয় না, সে কিনা খিড়কির বনবাদাড় এঁটো-সকড়ি ছাইগাদা ঠেলিয়া—, আর এই নিষুতি দুপুরে কখনই বা ওদের মতলব ঠিক হইল? এখন এরা করিতেই বা চায় কি? দেখ দেখি কাণ্ডখানা!

খানিকটা দূরে যে মূকাভিনয় হইতে লাগিল, তাহাতেই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল। নাতি সিঁড়ি বাহিয়া বারান্দায় আসিল, ঘরের অর্ধমুক্ত দুয়ারটি ভেজাইয়া শিকল চড়াইয়া দিল, তাহার পর চোরের মতো চারিদিক দেখিয়া লইয়া বধুর পাশ ঘেঁষিয়া পিঠের কাছটিতে আসিয়া দাঁড়াইল। একবার রেলিঙের উপর গলা বাড়াইয়া নীচের দিকটা দেখিয়া লইল।

কি সব কথা হইতেছে; খানিকটা দূরেও, আর চাপা গলায়, শোনা যায় না; তবে কথা যে বেশ হইতেছে, তাহাতে আর সন্দেহই নাই।

ঠাকুরমা এদের ব্যাপার দেখিয়া কৌটা হইতে মুখে পান গুল পুরিয়া দিয়া হাসিতেছিল। উপরে উপরে সব গোবেচারী, আর ভিতরে ভিতরে একালের এঁদের এই কীর্তি! সেকালের বড়াই আর রহিল কোথায়? তিনটে রাতও হয় নাই চার চোখ এক হইয়াছে, ইহারই মধ্যে এত মতলব, এত লুকোচুরি, এত গলাগলি!

নাতির বামহাতটা নাতবউয়ের কাঁধের উপর উঠিল। ঠাকুরমা এদিকে সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িল। ইচ্ছা হয়, বলে, ওরে করিস কি? এখনও ফুলশয্যা হয় নি; ফুলশয্যার আগে যে গায়ে গা ঠেকতে নেই; মনুর আমল থেকে পদ্ধতি চলে আসছে, তোরা কি কিছু মানবি নি? শাস্ত্র-টাস্ত্র সব রসাতলে দিবি?

ততক্ষণে বাম হস্তটি ঘোমটায় উঠিয়াছে।

ঠাকুরমা ওদিকে পান আর গুল-দোক্তার রসে মুখ বোঝাই করিয়া একলাই চাপা-হাসি হাসিয়া লুটাপুটি খাইতেছিল। হাসির চোটে চোখে অশ্রু ঠেলিয়া উঠিয়াছে, দৃষ্টি হইয়া পড়িয়াছে ঝাপসা। হাসির বেগের মধ্যেই আঁচল তুলিয়া চোখ মুছিয়া যখন চাহিল, অশোক তখন শিকলটা খুলিয়া দিয়া আস্তে আস্তে নামিয়া যাইতেছে। চোর, ডাকাত, যা বলা যায়।

আবার এক ঝলক হাসিতে উচ্ছ্বসিত অশ্রুর ধারা মুছিয়া ঠাকুরমা বলিল, “বাবা বাবা, হার মানলাম; তোদের যুগের ক্ষুরে ক্ষুরে নমস্কার, কটা ঘণ্টার আর তর সইল না? সে যুগের গুমর আমার দুটো দণ্ডও টিকতে দিলি না, বলিহারি!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *