কৈকলার দাদা

কৈকলার দাদা

তারকেশ্বর যাইতেছি। আমি বসিয়া আছি এক কোণে। গাড়িতে কিছু সাধারণ যাত্রী আছে, বাকী বেশির ভাগই ডেলি-প্যাসেঞ্জার। দোরের ওদিকটায় একস্থানে জটলা একটু ঘন, হাঁটুর উপর চাদর পাতিয়া তাস খেলা হইতেছে, মাঝে মাঝে অবান্তর আলোচনার ছিটেফোঁটা। ওরই মধ্যে কয়েকজন একটু বিশিষ্ট,—নাম মুখস্থ হইয়া গেল—হরেন, শিবু, জহর মাইতি, ভজহরি,–এ লোকটি অত্যন্ত নস্য নেওয়ার ফলে ‘ন’য়ের উচ্চারণ হারাইয়াছে।

ট্রেন শ্যাওড়াফুলিতে প্রবেশ করিয়া তারকেশ্বর ব্রাঞ্চের প্লাটফর্মে দাঁড়াইল। হরেন তাসসুদ্ধ যুক্তকর কপালে ঠেকাইয়া চক্ষু বুজিয়া বিড়বিড় করিয়া মন্ত্র পড়িতে লাগিল।

জমাট খেলার মধ্যে ‘সেথো’র এরকম আচরণে জহর মাইতি একটু বিরক্তির সহিত তাহার মুখের পানে চাহিয়া প্রশ্ন করিল, “ওটা কি হচ্ছে?”

হরেন কথা কহিল না; আরও খানিকটা বিড়বিড় করিয়া যুক্তকর কপালে তিনবার ঠেকাইয়া উত্তর করিল, “বাবার সেকশনে এসে ঢুকলাম, একটু ভক্তিটক্তি করতে শেখো, বুড়োকে বুড়ো বলে নেহাত উড়িয়ে দিও না।”

জহর বলিল, “অতি-ভক্তি: কোথায় তারকেশ্বর স্টেশন, কোথায় বাবার মন্দির, ব্রাঞ্চ আরম্ভ হয়েছে আর অমনই—”

শিবু বলিল, “যা বলেছ। এ যেন ‘এই মাটিতে শ্রীখোল হয়েছে’ বলে ভুঁয়ে গড়াগড়ি দেওয়া। নাও, নাও, দান ফেল। অতি-ভক্তিতেই দেশটা গেল, ত্রিপুরী, ওয়েলিংটন স্কোয়ার, দেখছ তো?”

ত্রিপুরী-ওয়েলিংটনের নামেই বোধ হয় একটা কলরব উঠিল, গাড়ি ছাড়িয়া দেওয়ায় কিন্তু সেটা স্পষ্ট বোঝা গেল না।

হরেন বলিল, “তোমরা ঠিক উল্টো বুঝলে। বাবার এখতিয়ারের বাইরে ত্রিভুবনে কোনো জায়গাই নেই, তবে শ্যাওড়াফুলিতে এসে গাড়িটা এই লাইনে এসে দাঁড়ালে বাবার কথাটা একটু বিশেষ করে মনে করিয়ে দেয়। ওঁনাদের কথা এমন করে যত বেশি মনে পড়ে ততই ভালো। শুধুই তো—’আই হ্যাভ দি অনার টু বি সার্’ করে সমস্ত জীবনটা গেল।”

তাহার পর উহাদের আর একটু চটাইবার জন্য একটু বক্রহাস্য করিয়া বলিল, “যখন স্বরাজ হয়ে বাংলা টাইমটেবিল হবে, আমি ধুতি-চাদর পরে গবর্মেন্টের কাছে প্রোপোজ করব, তারকেশ্বরের সব গাড়িগুলোকেই ‘বাবার গাড়ি’ নাম দেওয়া হোক, নম্বর দিয়ে আর ত্রিশূলমার্কা করে; আর শ্যাওড়াফুলি থেকে এই সেক্‌শনটার নাম রাখা হোক—বাবার সেক্‌শন।”

ভজহরি নস্য লইয়া হাতটা ঝাড়িয়া বলিল, ‘বাবার এলাকা বল; স্বরাজে আবার সেক্‌শঁল কেঁল?”

হরেন হাসিয়া বলিল, “থ্যাঙ্ক ইউ, থুড়ি–ধন্যবাদ।”

শিবু বলিল, “সে সময় আমায় একটু মনে করিয়ে দিও হরেন, স্বরাজের খুশিতে যদি নেহাত ভুলে যাই। আমি একটু অ্যামেন্ডমেন্ট জুড়ে দোব—শ্যাওড়াফুলি থেকে ইঞ্জিনগুলো কয়লা নামিয়ে শুধু গাঁজার আগুনে চলবে।”

সকলে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। হরেনও যোগ দিল।

ভজহরি বলিল, ‘শুধু তাই কেঁল? কাশী, বৈদ্যলাথই বা বাদ যায় কেঁল? আমি তো বলি এ সব বাঁচেই গাড়ি ঢোকবার আগে অঁল্য জাতের ড্রাইভার বদল করে গেরুয়া, রুদ্রাক্ষের মালা-পরা পাল্টা ড্রাইভার ভর্তি করে দেওয়া হবে।”

হাসি চলিল।

নিতান্ত ঘরের দেবতা ভোলানাথ, এমন ঠাট্টা অবাধেই চলে। শীঘ্র চটেন না, চটিলেও আশুতোষ, তাছাড়া যতকিছু অশিব গরল লইয়া ভক্তদেরও একটু হাত-পা ছড়াইয়া দুই কথা বলিবার সুযোগ করিয়া দিয়াছেন—কাঁহাতক শুধু হাতজোড় করিয়াই থাকে সব তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীর মাঝে? তাস পড়িয়া রহিল। মাহাত্ম্য-বর্ণনায়, স্বপ্ন-কাহিনীতে, ঠাট্টায়, তর্কে-বিতর্কে কয়েকটা স্টেশন কাটিয়া গেল। তারকেশ্বরের গাড়ির এই একটা বিশেষত্ব।

ওরই মধ্যে কখন সুবিধা পাইয়া শিবের আসরে রাজনীতি আসিয়া পড়িল—হইতে পারে, ব্যাপারটা আজকাল নিতান্ত নন্দীভৃঙ্গীর খাস দখলে রহিয়াছে বলিয়াই। হিন্দুসভা, লীগ, ত্রিপুরী, ওয়েলিংটন স্কোয়ার, সোদপুর, বৃন্দাবন সব আসিয়া জুটিল। গাড়িটা যখন কৈকালায় আসিয়া দাঁড়াইল, ততক্ষণে ব্যাপারটা তাণ্ডবের এতটা কাছাকাছি আসিয়া পৌঁছাইয়াছে যে, অহিংস আস্তিন-গোটানো পর্যন্ত আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। এই অবস্থায় হঠাৎ একটা পরিবর্তন ঘটিয়া গেল এবং আরে, দাদা যে!’ ও দাদা!” ‘এদিকে এদিকে— ‘এ অদিনে’ বা ‘কি সৌভাগ্য?’—ইত্যাকার একটা তুমুল হর্ষকলরব উত্থিত হইল; শুধু আমাদের গাড়ি হইতেই নয়, প্রায় সব গাড়ি হইতেই। একটি লোক বিহ্বল হাস্যের সঙ্গে প্ল্যাটফর্মে একবার এদিক একবার ওদিক করিয়া অনিশ্চিত ভাবে ছুটাছুটি করিতেছিল, “আরে, সে কি হয়?” বলিয়া আমাদের কামরা হইতেই একটি যুবক নামিয়া গেল এবং তাহাকে দখল করিয়া কামরায় আনিয়া তুলিল। বিজয়ের আনন্দে একটা নাটকীয় শব্দ উঠিল। গাড়ি তখন অল্প অল্প চলিতে আরম্ভ করিয়াছে।

লোকটি মাঝবয়সী। শরীরের অভ্যন্তরে চর্বির এবং বাহিরে তৈলের অভাবে চেহারাটা রুক্ষ। মাথায় অবিন্যস্ত বড় বড় চুল, গলায় মোটা রুদ্রাক্ষের মালা, পরনে লালপেড়ে গেরুয়া কাপড় এবং অনুরূপ একটা উড়ানি। শরীরটা বাহ্যত রুক্ষ হইলেও মুখের ভাবটা প্রসন্ন, কৌতুকদীপ্ত।

সকলে ভালো করিয়া মাঝখানে জায়গা করিয়া দিল। ভজহরি নস্যির কৌটার ঢাকনাটা খুলিয়া সামনে ধরিয়া বলিল, “লঁস্যি ইচ্ছে করুল দাদা।” একজন পানের ডিবা হইতে ভিজা ন্যাকড়ায় জড়ানো পান দিল। একজন একটা বিড়ি হাতে দিয়া খচ করিয়া দেশলাই জ্বালাইয়া বাড়াইয়া ধরিয়া বলিল, “আসুন দাদা।”— খাতিরের ছড়াছড়ি পড়িয়া গেল।

তাহার পর প্রশ্ন হইল, “এমন অ-বারে চলেছ যে দাদা, ব্যাপার কি? তোমার তো শুধু মঙ্গলবারটি বাঁধা সমস্ত হপ্তাটির মধ্যে বাবা।”

দাদা পানটা মুখে দিয়া এক খামচা জরদা চালান করিয়া দিল, তাহার পর একটা দীর্ঘ টানে বিড়িটার অর্ধেকটা দগ্ধ করিয়া স্মিতহাস্যের সহিত বলিল, “বাবা টানলে অ-বারে, কি করব?”

তাহার পর গলা উঁচু করিয়া একবার সমস্ত গাড়িটা দেখিয়া লইয়া বলিল, “কোনো মেড়ো ভক্ত-টক্ত যাচ্ছে না? তোমাদের এ বিড়ি কতক্ষণ টানব খুচখুচ করে বাবা? মজুরি পোষায় না।” বলিয়া আর একটা টানে বিড়িটা নিঃশেষ করিয়া বাহিরে ফেলিয়া দিল। পাঁচ- ছয়টা বিড়ি আবার পাশে আসিয়া জড়ো হইল, একটা দেশলাইয়ের বাক্সও।

দাদা একটা তুলিয়া লইয়া অগ্নি-সংযোগ করিতে করিতে বলিল, “ভক্তেরা আর আসবে কোথা থেকে? বাবার লাইনে পাপ ঢুকেছে। আর নির্ভয়ে সেরকম করে কি কেউ যাওয়া আসা করতে পারে? সেদিন নাথুনীমলের সঙ্গে, প্রায় মাস তিনেক পরে, হঠাৎ দেখা।—কি শেঠজী? দেখাই যে আর পাওয়া যায় না তোমার বাবা? লোকটা খাঁটি ছিল, দু’একদিন অন্তর একবার করে আসতই বাবার দর্শনে, সঙ্গে একটি করে কাপড়ের গাঁটরি থাকত। ওই লিলুয়া কি বালি পর্যন্ত একটা টিকিট করত, এদিকটা বাবাই চালিয়ে দিতেন। সব চেনা হয়ে গিয়েছিল, কালেভদ্রে কখনও এক-আধটা অচেনা ক্রু-টু উঠল, সিকিটা দোয়ানিটে ধরিয়ে দিলে হাতে—বাস্। বাবার দৌলতে হপ্তা গেলে গাঁটরিগুলো বেচে কিছু আসত হাতে বেচারীর। আমায় কৈকালায় দেখলেই তুলে নেওয়া চাই, নিজের হাতে এক ছিলিম সেজে আগ বাড়িয়ে দেওয়া—’গোসাঁইজী, পরসাদি করিয়ে দাও।’ যেমন ভক্তি সাধু- সন্ন্যাসীতে, তেমনই মিষ্টি কথাগুলি। আর সে একটি ছিলিম যা সাজত, একেবারে মেওয়া জিনিস! হঠাৎ তিন মাস পরে দেখা—আরে কি শেঠজী, কোথায় ডুব দিয়েছিলে? মেরাজাইয়ের পকেট থেকে একখানি টিকিট বের করে তুলে ধরলে। বলে, ‘বাবাকে লাইনমে আর সে ইজ্জত নেই গোসাঁইজী। লুতন ক্রু, লুতন টিকিস-কালেক্টার, দু-তিনবার দণ্ড দিলুম, তারপর আর কত ঘাটি সইব? বাবা ভাবে, বেটা খালি নিজের মতলবে আসত, তাই তিন মাস পরে এই টিকিট কাটিয়ে চলেছি, পুরানো গাহকরাও সব রয়েছে, এবার বাজার- ভাওটাও দেখে আসব।’…অনেক দুঃখ করতে লাগল বেচারী।”

দাদা ধীরে ধীরে বিড়ি টানিতে লাগিল। চারিদিক হইতে কতকগুলো সহানুভূতিসূচক মন্তব্য হইতে লাগিল।

“দেখ তো সাহস! ভক্তের টিকিট চাওয়া! এ রেল এবারে যাবে দাদা, দেখছ তো কলিশনের ঘটা! আর ওই রকম বনেদী একটা ভক্ত, কতদিন থেকে সে ঐ করে বাবার সেবা করে আসছে—”

একজন দাদাকে উত্তেজিত করিবার জন্য মন্তব্যকারীদের প্রশ্ন করিল, ‘কেন চাইবে না টিকিট, চাঁদ? তুমি বাবার দোহাই দিয়ে নিজেকে তো পার করছই, গাঁটরি কে গাঁটরি পর্যন্ত—”

দাদা উগ্রদৃষ্টিতে যুবকটির পানে চাহিয়া প্রশ্ন করিল, “কেন করবে না পার মশাই? কেন টিকিট নেবে? কার রাজ্যি এটা? কাশী, বৈদ্যনাথ, তারকেশ্বর, বাবার ত্রিশূলের ওপর এসব জায়গার পত্তন, তা জানা আছে? একজোড়া রেললাইন পেতে দিলেই আপনার দখলে এসে গেল, না? রাইট জমিয়ে রাখলেন, দরকার হলে দখল সাব্যস্ত করে বাবার নামে একটা নম্বরী ঠুকে দেবেন, না? একবার জটা নাড়লে রাইট দেখিয়ে ছাড়বে বুড়ো। দেখলেন তো বেহারের দশাটা কি করে ছেড়েছিল। দুটি মিনিটের ওয়াস্তা—একবার শুধু কপালের চোখটা একটু খোলা, কোথায় থাকবে আপনার হাইকোর্ট, কোথায় থাকবে জজসাহেব, আর কোথায় থাকবে—”

গাড়ি বাহিরখণ্ড স্টেশন ছাড়াইয়া আসিয়াছে। দাদা বিড়িটা ফেলিয়া দিতে হরেন সিগারেটের ডিবা বাহির করিয়া একটা সিগারেট দাদার দিকে বাড়াইয়া বলিল, “এইবার একটা কাঁচি চলুক দাদা। এদিকে তোমার সঙ্গে ব্যবহার কি রকম করছে, বেটারা?”

দাদা সিগারেটটা হাতে লইয়া বলিল, “চামারের মতো, এক্কেবারে চামারের মতন। কিন্তু আমি মেড়ো নই, দেখিয়ে দোব বাছাধনকে। হপ্তায় একটিবার করে আসা আমার বাবার কাছে। তোমরা তো জানই, মঙ্গলবার এক ট্রেনে আসা, বাবার দর্শন সেরে কেনাকাটা করে ফিরে যাওয়া। গাঁয়ে দোকান নেই, তা ভিন্ন তারকেশ্বরে জিনিসটা রাখে ভালো, একেবারে বাবার নজরের নিচে, বাবার পেয়ারের জিনিসটা নিয়ে বেইমানি করতে ততটা সাহস করে না। তাই ওই হপ্তায় একটিবার করে এসে হপ্তার রসদটুকু যোগাড় করে নিয়ে যাওয়া। আর কি সম্বন্ধ তোদের লাইনের সঙ্গে বাপু! মরগে যা না তোরা। আজ তেরো বছর থেকে এই করে আসছি, রুটিন বাঁধা। কেউ কখনও টুকতে সাহস করে নি, আর ও- বেটা বেল্লিক আমায় আটকে সেই শ্যাওড়াফুলি থেকে মাশুল গুনে নিলে! নতুন এসেছে। আমায় চেনে না, কিন্তু আজ এমন চেনান চেনাব যে সাতপুরুষেও ভুলতে পারবে না। হাতে এমন পয়সা রইল না যে দুটো দিনেরও রসদ নিয়ে ফিরি। পরশু এসেছিলাম, আবার এই আজ দৌড়তে হয়েছে। বোঝ!”

ভজহরি বলিল, “বেটা যতদিঁল থাকবে এখালে, টিকিটে আপনার কতগুলি করে পয়সা লোকসান করাবে তো দাদা! ঘোর কলি এঁলে ফেললে—লিঁ লস্যি লিঁল।”

টিপ তুলিয়া লইয়া দাদা নিরতিশয় তাচ্ছিল্যের সহিত একবার ভজহরির পানে চাহিয়া বলিল, “রামঃ, নেহাত কায়দায় পেয়েছিল সেদিন, ঘায়েল হয়েছিলাম। আজ? চুপ করে সব তামাশাটা দেখ না। নাও, তোমার দোক্তার কৌটোটা দাও দিকিন এগিয়ে একবার, পান আর আছে নাকি? আর একটু জরদাও দাও। আরে ছ্যাঃ, খালি সিগারেট আর বিড়ি! নাড়ী যেন ঝিমিয়ে আসছে। এতদিন বাবার লাইনে যাতায়াত করে কি করলে গো তোমরা?”

লোকনাথ অনেকক্ষণ পার হইয়া গিয়াছে। দাদা একবার গলা বাড়াইয়া দেখিল। তাহার পর কপালে এবং বুকে যুক্তকর ঠেকাইয়া দেবোদ্দেশে প্রণাম করিয়া বলিল,

“ইস্টিশান এসে গেল, নাও কেউ একটা টিকিট বের কর দিকিন।”

সবাই বিমূঢ় ভাবে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিল একবার; মাইতি বলিল, “আমাদের তো সব মান্থলি। তা ছাড়া তুমি পরের মাথায় কাঁঠাল ভাঙবে নাকি দাদা? যার টিকিট নেবে, নিজে সে কি করবে?”

দাদা একটু বিমূঢ়ভাবে বলিল,—”সবার মান্থলি তোমাদের? তাহলে তো এ-গাড়িতে চড়া ভুল হয়েছে দেখছি।”

ভজহরি বলিল—”সবার মালে আমাদের প্যাসেঞ্জারদের সবার। অঁল্য যাদের আছে, তারা দেবে কেঁল দাদা? প্রালের টান তো লেঁই তোমার সঙ্গে আমাদের মত।”

দাদা বিরক্তির সহিত বলিল, “দেবে কেন? আরে আমি কি খেয়ে ফেলব টিকিট, না সবটাই চাইছি?”

“তবে?”

“আমার একরত্তি দরকার, সুদ্ধু কোণ থেকে একটু কেটে নোব, ও তোমার নম্বর তারিখ সব যেমনকার তেমনই থাকবে। বেমালুম একটু কেটে নোব, ছোট কাঁচি পর্যন্ত এনেছি।”

হরেন বলিল, “একটা কোণ নিয়ে তুমি কি করবে দাদা, তুক-টুক আছে নাকি কিছু?” দাদা বলিল, “আরে, খেলতে জানলে কানাকড়ি নিয়েই খেলা যায়। তোমরা দাও তো একটা যোগাড় করে, এসে পড়ল যে ইস্টিশান।”

দলটি চারিদিকে একবার চাহিল, প্যাসেঞ্জারদের কেহ মুখ ঘুরাইয়া লইল, কেহ স্পষ্টই টিকিট দিতে অসম্মতি জানাইল। আমি এক কোণে বসিয়া তামাসা দেখিতে ছিলাম, শিবু আমার পানে চাহিয়া বলিল, “আপনার মান্থলি নয় বোধ হয়? আপত্তি আছে নাকি টিকিটটা দিতে একবার, অবশ্য ওই শর্তে—শুনলেন তো?”

আমার কৌতূহলটা সত্যই প্রবল হইয়া উঠিতেছিল, টিকিট বাহির করিয়া বাড়াইয়া দিলাম।

দাদা এক কোণ হইতে সামান্য একটু কাটিয়া লইয়া আমার টিকিট ফেরত দিল।

গাড়ি আসিয়া স্টেশনে দাঁড়াইতে দাদা নামিয়া প্ল্যাটফর্মের মেঝেটা চারিটি আঙুল দিয়া স্পর্শ করিয়া আঙুল কয়টা জিবে ঠেকাইল, তাহার পর সিধা হইয়া দাঁড়াইয়া দূরে গেটের কাছে টিকিট কালেক্টারের দিকে কটমট করিয়া চাহিয়া আপনমনেই বলিল, “হুঁ!”

কি একটা পর্ব উপলক্ষে বেশ একটু ভিড় ছিল। চাপের মধ্যে টিকিট দিয়া বাহির হইয়া আসিয়াছি, দেখি, দাদাও কখন বাহির হইয়া সব প্যাসেঞ্জারদের ছাড়াইয়া গিয়াছে। ডাক দিব, এমন সময় আওয়াজ হইল, “ও মশাই! ও মশাই! টিকিট দিয়ে যান!”

সবাই ফিরিয়া চাহিলাম; শুধু দাদা ছাড়া, সে হনহন করিয়া আগাইয়া চলিয়াছে।

টিকিট-কালেক্টার আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল, “ওই ওঁকে বলছি—বাবাজীকে। ও মশাই!”

দাদা ফিরিয়া দাঁড়াইল, বুকের মাঝখানে তর্জনী ঠেকাইয়া বিস্মিতভাবে বলিল, “আমায় ডাকছেন?”

“হ্যাঁ, আপনার টিকিট?”

“টিকিট! সে তো আমি দিয়ে এলাম মশাই এক্ষুনি, ওকি সর্বনেশে কথা!” বলিয়া দাদা আগাইয়া আসিল।

“দিয়ে গেলেন? বটে! কোনো রকমে গলে বেরিয়ে পড়তে পারলেই বুঝি দিয়ে যাওয়া হল? বড় কাঁচাছেলে পেয়েছেন, না? ওসব গেরুয়া-টেরুয়ার খাতির নেই আমার কাছে। পরশুই না আপনি উইদাউট টিকিটে এসে গুণগার দিলেন, আমার কাছেই? আপনিই তো, এ চেহারা তো ভুল হবার জো নেই।

ভিড় জমিয়া উঠিল। দাদা বলিল, “আজ্ঞে হ্যাঁ, দিয়েছি গুণগার। তবে টিকিটও দিয়েছি, গুণগারও দিয়েছি, ভালমানুষের যুগ নেই তো আর—।

“শুনুন আপনারা, পরশু এমনি করে আমায় ফিরিয়ে ডেকে এনে টিকিটের কথা একেবারে উড়িয়ে দিয়ে জংশন থেকে মাশুল আদায় করেছেন উনি। ওঁর কাণ্ডই এই, খুব পাকা টিকিট কালেক্টার কিনা; কিন্তু আমিও অত কাঁচা নই। তা ছাড়া কত দণ্ড সইব মশাই? গরিব সন্ন্যাসী মানুষ; পাঁচজনের কাছ থেকে মেঙে-চেঙে চালাই। এবার সাবধান হয়েছি। নিন, দয়া করে বার করুন তো ০২৮৬ নম্বর টিকিটটা, আজকের তারিখের, দেখুন তো পেয়েছেন কি না?”

টিকিট কালেক্টর প্রায় ভ্যাঙচাইয়াই বলিল, “আজ্ঞে ও ভাঁওতা চলবে না, বের করুন পয়সা। একটা টিকিটের নম্বর জেনে নেওয়া যেন এতই শক্ত।” টিকিটগুলো মুঠার মধ্যে আরও গুছাইয়া লইয়া বলিল, “সাত ঘাটের জল খেয়ে এসে এই তারকেশ্বরেই ঘায়েল হতে হবে দীনো সান্ডেলকে? বটে! টিকিটের নম্বর!”

দাদা সকলের দিকে চাহিয়া বলিল—”আপনারা দেখছেন তো? আচ্ছা, বেশ আমি আরও প্রমাণ দিচ্ছি। আমার টিকিটের কোণটা কাটা, এবার ওইটে আমি চেহ্ন দিয়ে রেখেছিলাম আমার টিকিটে। এই দেখুন, কাঁচিও রয়েছে সঙ্গে। বার বার কতই বা দণ্ড দোব মশাই? সন্ন্যাসী মানুষ। আর কতই বা অপমান সইব? আপনারা পাঁচজন ভদ্রলোক রয়েছেন, বের করতে বলুন ওঁকে, কোণকাটা অত নম্বরের টিকিট যদি না থাকে, যা দণ্ড আপনারা বলেন, দোব।’

টিকিট-কালেক্টরের মুখটা যেন একটু শুকাইল, সামলাইয়া লইয়া অত্যন্ত ক্রুদ্ধভাবে বলিল, “বের কর পয়সা, ওসব ধাপ্পাবাজী চলবে না। না বের কর তো হ্যান্ড-ওভার করে দোব পুলিশে। গেরুয়া পরে কাঁচি নিয়ে এই সব করে বেড়ানো হচ্ছে! কি আমার সন্ন্যাসী রে!”

কয়েকজন ভদ্রলোক বলিল, “উনি বলছেন যখন, দেখুন না টিকিটগুলো মশাই, ওই নম্বরের, ওই ধরনের টিকিট আছে কিনা!”

বিশ্বাস করুক, না করুক, বেশ বোঝা গেল সমস্ত দলটাকে একটা উগ্র কৌতূহলে পাইয়া বসিয়াছে।

এবার দাদার পালা, সিধা হইয়া আহত গর্বের স্বরে বলিল, ‘উনি না বের করেন, এই আমি করছি, দেখুন”—বলিয়া সবার সামনে মুষ্টিটা প্রসারিত করিয়া ধরিল।—করতলের মাঝখানে সেই টিকিটের কোণটি।

সবার জেদের চাপে টিকিট-কালেক্টারকে টিকিটগুলো জমিতে বিছাইতে হইল। দাদা “এই আমায় টিকিট!” বলিয়া ছোঁ মারিয়া কাটা টিকিটটা তুলিয়া লইল এবং সবার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে কাটা অংশটুকু একেবার নিশ্চিহ্নভাবে জোড়া দিয়া বলিল, “এই দেখুন আপনারা! দেখুন সব! সাধু-সন্ন্যাসীর ওপর একবার অত্যাচারটা দেখুন, বাবার নাকের নিচে!”

তাহার পর শুধু নির্বাক রহিল সেই টিকিট-কালেক্টার—মূঢ়, বিস্মিত, অপ্রতিভ। আর কাহারও মুখ বন্ধ রহিল না, দাদার তো নহেই, ধিক্কারে, হুমকিতে, টিটকারিতে জায়গাটা একটুর মধ্যেই মুখর হইয়া উঠিল।

হ্যাঁ, টিকিট-কালেক্টারের মতো আরও একজন নির্বাক ছিল, সেই এই কাহিনীর লেখক। থাকা উচিত ছিল না, বুঝি; কিন্তু কেন যে ছিলাম এখনও পর্যন্ত ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। বিস্ময়ে? না, ভয়ে? তখন কি এই মনে হইয়াছিল যে, যদি বলিই আসল কথাটা তো দাদার গুণগ্রাহীরা আমার বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য দিয়া আমাকেও ওই টিকিট-কালেক্টারের দশায় ফেলিবে? তাও হইতে পারে, অথবা সে সময় বোধ হয় শঙ্কা হইল, আমার সম্বন্ধেও লোকটা পেটে পেটে কি আঁটিয়া রাখিয়াছে, কে জানে! ভয়ঙ্কর পাকা খেলোয়াড়! অথবা— এখন আন্দাজ অনেক কিছুই করিতেছি, কিন্তু তখনকার মনের অবস্থাটা ঠিক ধরিতে পারিতেছি না। মোটের উপর, টিকিটের রহস্য আর উদ্‌ঘাটিত হয় নাই, এবং আমার চোখের উপর দিয়াই দাদা পুরো দলের মধ্যে জেলফেরত সত্যাগ্রহীর মতোই নিঃসঙ্কোচে গটগট করিয়া বাহির হইয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *