তাপস
মনুজকুমারের পড়িবার ঘর। দ্বারের সামনা-সামনি ওদিকে মাঝারি সাইজের একটা টেবিলের প্রান্তে খোলা র্যাক একটা, বইয়ে ঠাসা—ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত এবং দর্শনশাস্ত্রের পাস ও অনার্স মিলাইয়া রাশীকৃত বই। একপাশে একটি চৌকি, হাত দুয়েকও চওড়া হয় কি না হয়। উপরে একটা কালোরঙের কম্বল পাতা, মাথার দিকে একটি পাতলা বালিশের সঙ্গে একখানি চাদর গোটানো—মনুজের বিছানা। টেবিলের সামনে একটি চেয়ার—বাহুহীন, শীর্ণকায়; পিঠটা এত সোজা এবং উঁচু, যেন যে বসিবে তার মেরুদণ্ডটা সিধা রাখিবার জন্য উদ্দণ্ড হইয়া আছে।
কাকা বলেন, “পড়াটা তপস্যা, মনুজের ওটা তপস্যাগার করে দিলাম।”
মনুজ কাকা ভিন্ন আর সবার কাছে বলে, “জেলখানা।”
ঘরের সিলিঙে একটি বিজলী পাখার পয়েন্ট আছে, পাখা নাই। একদিকে দেওয়ালে একটা আলোর ব্র্যাকেট, বাল্বটা না থাকায় পুষ্পহীন বৃত্তের মতো একটা রুক্ষ রিক্ততা লইয়া ঘরটাকে যেন আরও কয়েকগুণ বিরস করিয়া রাখিয়াছে। এই দুইটি কাকা সম্প্রতি সরাইয়া দিয়াছেন। তিনি বলেন, “পুরাণ কিংবা ইতিহাসে কাউকেও বিদ্যুতের আলো কিংবা পাখার নীচে তপস্যা করতে শুনেছ?”
মুখ ফুটিয়া উত্তর দেওয়ার উপায় নাই, অথচ উত্তর খুবই সোজা বলিয়া হালকা আগুনের মতো দাউ দাউ করিয়া তাহার সমস্ত শরীরটাই যেন জ্বালাইয়া দেয়। ঝোঁকটা পড়ে কাকীমার উপর; হয়ত কুটনা কুটিতেছেন, মনুজ শুষ্ক মুখে কাছে গিয়া বসিল; এটা ওটা নাড়িতে নাড়িতে হঠাৎ প্রশ্ন করিয়া বসিল, “আমার কুটনোও কুটছ নাকি?”
“ওঃ, মস্ত বড় খাইয়ে ছেলে আমার, ওঁর জন্যে আবার আলাদা করে কুটনো! কেন?”
“আমার চাল নিও না আজ।”
“কেন শুনি? আজ আবার কি হল?”
“কিচ্ছু না।”
অনেকক্ষণ চুপচাপ। কথাটা বাহির হইয়া পড়িবেই জানিয়া কাকীমা মনে মনে হাসিয়া নীরবে কুটনা কুটিতে লাগিলেন। মনুজ একসময় চোখমুখ অন্ধকার করিয়া বলিয়া উঠিল, “আমার দ্বারা ও-রকম তপস্যা হবে না এই বলে দিচ্ছি। ইস, তপস্যা!”
কাকীমা হাসি চাপিবার জন্য একটা ছুতা করিয়া কাহাকেও কিছু ফরমাশ করিয়া কুটনা কুটিয়া চলিলেন। এদিকে উত্তরের অভাবে রাগটা আত্মনিরুব্ধ হইয়া ক্রমাগতই বাড়িয়া চলিয়াছে। মনুজ আর একটু থামিয়া বলিল, “পুরাণ-ইতিহাসের কথা যে বলছ, সে-সব সময়ে কি ইলেকট্রিসিটি ছিল যে লোকে পাখার হাওয়া খাবে, সুইচ টিপে আলো জ্বেলে পড়বে? যত সব হাঘরে, একরত্তি করে তেল জুটত না যে রাত্তিরে জ্বেলে পড়বে, তারা আবার—! আর ফট করে যে বলে বসলে পুরাণের কথা, তা আমি যদি উত্তর দিই যে, রাবণরাজার ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনীরা নিশ্চয় বিদ্যুতের পাখার হাওয়া খেত, বিদ্যুতের আলোয় পড়াশোনা করত, তখন কি বলবে, বল? আমাদের দেশে যে এক সময় এ সবই ছিল, সে কথা তো ক্রমেই বেরিয়ে পড়ছে। ঠাট্টা করে যে বলে বসলে, গাছে বিদ্যুতের পাখা টাঙিয়ে তপস্যা করত না, তা ইতিহাসের সব চেয়ে আধুনিক থিওরিটা জান? পৃথিবীতে নতুন কিছুই হচ্ছে না, যুগ যুগ পরে সেই একই জিনিসের পুনরাবর্তন হচ্ছে মাত্র। এসব যদি বলি তো বলবে, ভাইপো আমার মুখের ওপর চোপরা করতে শিখেছে। আচ্ছা, সর্বদাই যে বল—”
কাকীমা আর হাসি চাপিতে পারিলেন না; বলিলেন, “হাঁরে, গরগর করে মাথামুণ্ডু কি সব বকে যাচ্ছিস? বল বল যে করছিস, বলেছি কি আমিই, না যে বলেছে সে আমার পরামর্শ নিয়ে বলেছে?”
মনুজ অপ্রতিভ হইয়া একটু থামিল, কিন্তু দারুণ গায়ের জ্বালা আবার তখনই তাহাকে সব ভুলাইয়া দিল। অনমস্কভাবে একটা পটল হাতে লইয়া কচলাইতে কচলাইতে বলিল, “তোমাদের কি? ইজিচেয়ারে শুয়ে ফ্যান খুলে দিব্যি তামাক পোড়াচ্ছ; হুকুম দিলে, মেনো, তুই তপস্যা করগে!”
“আমি তামাক পোড়াচ্ছি! তোর হল কি মনু?”
“তোমায় বললাম? বেশ, এইবার তুমি সুদ্ধু লাগ আমার পেছনে। আমার কিচ্ছু বলে দরকার নেই বাপু, আমায় যদি তপস্যাই করতে হয় তো বনে গিয়ে করব, পৌরাণিক যুগে তাই করত, ঐতিহাসিক যুগে বুদ্ধও তাই করেছিলেন; রেড়ির তেলের আলোও তাহলে যোগাতে হবে না, আর তোমাদের ওই দেড় বিঘতের চৌকি, ওটুকুরও দরকার হবে না। দাও আমার বনে যাবার ব্যবস্থা করে।”
“আচ্ছা, তোর কাকাকে বলে দোব’খন ব্যবস্থা করিয়ে। আপাতত কাল যে একবার বাড়ি যেতে হবে, সে খবর পেয়েছিস? বড়ঠাকুরের চিঠি এসেছে, দেখেছিস?”
“আমার দেখেও কাজ নেই, গিয়েও কাজ নেই, তপস্যা ভঙ্গ হবে।”
হাতের পটলটা কুচি কুচি হইয়া গিয়াছে, একটা আলু তুলিয়া লইয়া কথার ঝোঁকের সঙ্গে সঙ্গে বুড়া আঙুলের নখটা তাহাতে বিঁধিয়া দিতে লাগিল। কাকীমা বলিলেন, “জানি না বাপু, তোরা খুড়ো-ভাইপোতে বুঝগে যা! আর কি যে ছাই তপস্যা, তাও তো বুঝি না। এই কি তপস্যার বয়েস? দিব্যি হেসে খেলে বেড়াবে, তা নয়, বুঝি না বাপু সব কাণ্ড!”
মনুজ আবার একচোট জ্বলিয়া উঠিয়া বলিল, “বুঝবে কোথা থেকে, পরের কষ্টের কথা কি একবারও ভেবে দেখ তোমরা? আচ্ছা, ওদের আরতির যে ঘরের নীচে ম্যাটিং করা, দুটো ভালো ভালো সোফা, বসবার চেয়ারে মখমলের গদি আঁটা, হারমোনিয়াম, ব্যাঞ্জো, ফ্যান, চমৎকার শেড দেওয়া আলো, পড়বার জন্যে একটা টেবিল-ল্যাম্প, দুটো ভাস—যখনই দেখ, টাটকা ফুলে ভরা, বল তপস্যা ভঙ্গ হচ্ছে! এবারে টেস্টে ফার্স্ট হয়েছে, ম্যাট্রিকে স্কলারশিপ বাঁধা। আর মেনো, তুই তপস্যা করে মর—”
কাকীমা একটি দীর্ঘনিশ্বাসের সহিত বলিলেন, “দিব্যি মেয়েটি; সত্যি, ইচ্ছে হয় ঘরে নিয়ে আসি।”
মনুজের একটু হুঁশ হইল যেন; আলোচনাটিতে যে একটু লজ্জার কারণ আছে, অতটা খেয়াল তাহার হয় নাই। কিন্তু রাগটা তবু লাগিয়া আছে, জিহ্বা বশে আসিতেছে না; কথাটা ঘুরাইয়া লইয়া বলিল, “আমিও দেখিয়ে দোব, কি রকম তপস্যা করতে হয়, হ্যাঁ, দেখিয়ে দোব। চুলোয় যাক বই, হাত-পা গুটিয়ে চোখ বুজে বাল্মীকি ঋষি হয়ে…আচ্ছা, তপস্যাই যে বলছ, তা মিনিটে মিনিটে পিদ্দিমের সলতে ওসকাব, না তপস্যা করব, বল তো? বল না, তার বেলা কথা কইছ না যে?”
কাকীমা মাথার কাপড়টা একটু টানিয়া দিয়া বলিলেন, “ওই যাকে জিজ্ঞেস করবার জিজ্ঞেস কর, সত্যিই তো বাপু।–”
পিছন ফিরিয়া ছিল, কাকা আসিয়াছেন সেটা দেখিতে পায় নাই। ঘুরিয়া দেখিয়াই হাতের চটকানো আলুটা ফেলিয়া দিয়া দাঁড়াইয়া উঠিল। কাকা জিজ্ঞাসা করিলেন, “হ্যাঁ, ভালো কথা মনে পড়ে গেল, ফ্যানের অভাবে কোনোরকম কষ্ট কি অসুবিধে হচ্ছে না তো?”
মনুজ কাকীমার পানে সতর্ক দৃষ্টি রাখিয়া বলিল, “আজ্ঞে না।”
দেখলে তো? ওতে আরও মন বসে বরং, নয় কি?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
কাকীমা কি বলিতে যাইতেছিলেন, মনুজ বাধা দিয়া বলিল, “তুমি পিদ্দিমটা ঠিক করে রেখো তো কাকীমা, বড্ড নোংরা হয়ে গেছে।”
কাকীমা ঠোঁটের কোণে একটু হাসি মিলাইয়া লইয়া বলিলেন, “হ্যাঁ, রেখেছি। হাঁগো, ও যে বলছে কাল যাবে না বাড়ি, অথচ—”
মনুজ একটু রাগিয়া বলিল, “তাই বললাম? বলছিলাম, গেলেই পড়ার ক্ষতি তো, তাই—”
কাকা মনুজের কাকীমার দিকে চাহিয়া একটু হাসিয়া বলিলেন, “দেখ, ঝোঁকটি কেমন আপনিই হয়ে আসছে। পড়াটাতো কিছু নয়—একটা সাধনা, তপস্যা; অবস্থাটা তপস্যার অনুকূল করে দাও, দেখবে আপনিই মন কেন্দ্রীভূত হয়ে উঠছে।”
যাইতে যাইতে বলিলেন, “তা যাক, হয়ে আসুক একবার বাড়ি থেকে, কি আর হবে তাতে!”
মনুজ দুই-একবার আড়চোখে কাকার দিকে ফিরিয়া চাহিল; চলিয়া গেলে রাগে ঘাড় বাঁকাইয়া মুঠার উপর মুঠা ঠুকিতে ঠুকিতে বলিল, “আমি কখনও যাব না, দেখি আমায় কে যাওয়ায়!…তুমি যেন তা বলে বলে দিতে যেও না; হ্যাঁ, আর যদি যেতেই হয় তো আমি গরুর গাড়িতে যাব আগেকার তপস্বীদের মতন, দেখি আমায় কে মোটরে করে পাঠাতে পারে! আর আমার যদি আজ চাল নাও তো—”
কাকীমার ক্রুদ্ধ চক্ষু দেখিয়া আর শেষ না করিয়া হনহন করিয়া বাহির হইয়া গেল।
মনুজের বি. এ-তে দর্শনশাস্ত্র লইবার কথা ছিল না। তাহার ঝোঁকটা ছিল ইতিহাসের দিকে। আই. এ. পরীক্ষায় ইউনিভার্সিটি হইতে ‘এইচ’ অক্ষরও পাইয়াছিল। ইতিহাসে অনার্স লইবে ঠিকঠাক, এমন সময় কাকার হাতে তাহার লেখা একটি প্রবন্ধ পড়িয়া গেল—”Femi- nine Beauty in the Making of History” (ইতিহাস সৃষ্টিতে নারী-সৌন্দর্যের স্থান)। সংগ্রহের মধ্যে, তাহার বয়স ও শিক্ষার অনুপাতে, মৌলিকতাই ছিল; কিন্তু কাকা ভ্রাতুষ্পুত্রের মনের গতি লক্ষ্য করিয়া ভড়কাইয়া গেলেন। সাব্যস্ত হইল, তাহাকে দর্শন লইতে হইবে, অনার্স ও দর্শনশাস্ত্রেই। মনুজ আড়ালে একটু গুইগাঁই করিল, কানে উঠিলে কাকা সামনাসামনিই স্পষ্ট স্বরে বলিলেন, “কেন? যারা আসল ইতিহাস গড়ে তুললে—চন্দ্রগুপ্ত, বাবর, শেরশা, ক্রওয়েল, এদের কথাই নেই, খোঁজ পড়ল গিয়ে কুইন মেরীর, নূরজাহানের! এর অর্থটা কি শুনি?… ফেমিনিন বিউটি!”
দর্শনশাস্ত্রটা বাড়িতে নিজেই পড়ানো আরম্ভ করিয়াছেন। দুইটি কারণ আছে; প্রথমত, জিনিসটি তাঁহার প্রিয়; দ্বিতীয়ত, ও শাস্ত্রে আবার মন যদি মিল হার্বার্ট স্পেন্সার প্রভৃতির জড়বাদের দিকে চলে, তাহা হইলে সমূহ বিপদ; এমন কি ইতিহাসের চেয়েও ঢের বেশি, কারণ তাহার পরিণাম এপিকিউ-রিয়ানিজ্ম, অর্থাৎ যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ। সুতরাং সেটিকে আবার আদর্শবাদের খাতে বহাইয়া লইয়া যাওয়া দরকার।
বন্ধুদের বলেন, “সঙ্গে সঙ্গে এথিক্সের কড়া ডিসইনফেকট্যান্টও দিয়ে যাচ্ছি; দেখাই যাক না।”
তাঁহার বিশ্বাস, ফল হইতেছে। তিনি যখন স্পেন্সার প্রভৃতির মতবাদগুলি সূতীক্ষ্ণ তর্কে এবং সুতীব্র মন্তব্যে ছিন্নভিন্ন করিতেন এবং কান্ট হেগেলের আদর্শবাদ লইয়া বেদান্তের কোঠায় গিয়া পড়িতেন, সে-সময় ভাইপোর গভীর তদগত ভাব দেখিয়া নিজের ব্যবস্থায় বেশ আস্থাবান হইয়া উঠিতেছিলেন। মনুজ প্রথমে একটু-আধটু তর্ক করিত, ক্রমে তন্ময়তায় চোটে সেটাও বন্ধ হইয়া গেল, নীরবে তাঁহার যুক্তি-স্রোতবর্ষী মুখের দিকে চাহিয়া থাকে মাত্র। ক্রমে দেখা গেল, শুধু ধীরে ধীরে মাথা দোলাইতেছে; এবং ইহার পরে একদিন দেখা গেল, কাকার উগ্র আলোচনার ঝোঁকে ঝোঁকে চৌকির উপর ছোট্ট করিয়া এক-একটি ঘুষি পর্যন্ত বসাইয়া দিতে লাগিল। কাকা মনে মনে হাসিলেন, ভাইপো একেবারে মাতিয়া গিয়াছে; সুলক্ষণ!
সেদিন পড়ানো শেষ করিয়া বাহিরে আসিতেই কিন্তু হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইয়া গেলেন। কানে গেল, ছোট্ট পার্কটির ওধারে একটি দোতলা বাড়ি হইতে দ্রুত তালে নারীকণ্ঠের সঙ্গীত ভাসিয়া আসিতেছে, পড়ানোয় অতিরিক্ত মনোনিবেশের জন্য এতক্ষণ শুনিতে পান নাই। কাকা কপালে বাঁ হাতের আঙুলের চারিটা ডগা চাপিয়া হেঁটমুখে খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলেন; দুই-একবার উর্ধ্বে-নিম্নে মাথা দোলাইলেন, দুই-একবার ডাইনে বাঁয়ে; যেন কি একটা আকস্মিক সমস্যার ঠিকমতো মীমাংসা হইতেছে না। শেষে নিজের মনেই বলিলেন, নাঃ, স্পষ্ট জিজ্ঞাসা করাই ভালো।…আবার ঘরের দিকে ফিরিলেন।
ঘরে পা দিতে আরও স্তম্ভিত হইয়া তাঁহাকে থমকিয়া দাঁড়াইতে হইল। মনুজ সাইকলজির ভারি বাঁধানো বইটা বুকের কাছে চাপিয়া তড়বড় করিয়া বাঁয়া-তবলা বাজাইয়া যাইতেছে। মিঠা ভঙ্গিমায় মাথাটি ঘুরিয়া ঘুরিয়া দুলিয়া যাইতেছে, চক্ষু গম্ভীর তন্ময়তায় মুদ্রিত, গান তখনও ওদিকে চলিতেছে।
কাকা নির্বাক বিস্ময়ে একটু তাকাইয়া রহিলেন, তাহার পর উৎসাহ ভঙ্গস্বরে ডাক দিলেন, “মনুজ!”
মনুজ যেন আচমকা ঘুম হইতে জাগিয়া উঠিল। বাঁয়া-তবলাখানা আলগা হাত হইতে খসিয়া বিশৃঙ্খলভাবে নীচে গড়াইয়া পড়িল; বাদক কোনো উত্তর না দিয়া ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকাইয়া রহিল। কাকা বলিলেন, “এখন তো বাঁয়া-তবলাই বাজাচ্ছিলে স্পষ্ট দেখলাম, একটু আগের অবস্থা সম্বন্ধে আমার একটু খটকা রয়েছে, ঠিক বলবে তো?”
মনুজ চক্ষু নামাইল।
“আমি যখন ভাবছিলাম, আমার সঙ্গে তুমি বেদান্তের বিচারে বিভোর হয়ে মাথা দোলাচ্ছ, আর মেটিরিয়ালিস্টদের ওপর চটে চৌকিতে মাঝে মাঝে ঘা দিচ্ছ, তখন তুমি আসলে কোনো একটা গানে তাল দিচ্ছিলে কিনা বল তো বাপু? আরে ছ্যাঃ, এই তোমার তপস্যা! আমি কানের কাছে অমন একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস নিয়ে বকে বকে বেদম হচ্ছি, গ্রাহ্যই নেই; আর পার্কের একটেরেয় কে গানকে ভেংচি কাটছে, তাই শুনে শুনে তুমি—ছি ছি!”
ফিরিয়া যাইতে যাইতে আবার মনে হইল, সব সন্দেহ মিটাইয়া লওয়াই ভালো। আবার ঘুরিলেন। ওভাবে কথা বাহির করা যাইবে না, সুর কিঞ্চিৎ বদলাইয়া বলিলেন, “অবশ্য তোমার অতটা অন্যমনস্ক হওয়া ভালো হয় নি; কিন্তু ছেলেটি গাইছে বেশ, তোমায় ততটা দোষও দেওয়া যায় না। তবে কথা হচ্ছে, যতটা পারা যায় মনকে টেনে রাখাই ভালো। চেন নাকি ছেলেটিকে? এই পাড়াতেই থাকে?”
কাকার এমন দরদ-মাখানো কথায় মনুজের মনের কপাট যেন হঠাৎ খুলিয়া গেল। একটু সলজ্জ অথচ উৎসাহদীপ্ত মুখে বলিল, “ছেলে নয়তো কাকা, আমাদের প্রফেসার কার্তিকবাবুর মেয়ে আরতি সান্যাল, এবার মিউজিক-কম্পিটিশনে সেকেন্ড প্রাইজ পেয়েছেন। ওঁর বাবা নিজেও একজন মস্তবড় গুণী লোক।”
কাকা মনে মনে বলিলেন, বটে, বটে! অথচ ছেলেটা এদিকে হাঁ-না’র বেশি জবাব দেয় না কখনও। এ একেবারে আত্মহারা হয়ে গেল যে! মনুজকে বলিলেন, “হ্যাঁ, তাই ভাবছিলাম, ছেলের গলা এত মিষ্টি হয় কোত্থেকে! তা কদ্দিন ওঁরা এসেছেন এ পাড়ায়? ছিলেন না তো!”
“ঠিক একুশ দিন হল আজ নিয়ে, ফার্স্ট জুলাই উঠে এসেছেন কিনা।”
কাকার মনে হইল, প্রায় ওই আন্দাজ সময় হইতেই ভ্রাতুষ্পুত্রও পাঠের সময় মাথা দুলাইতে আরম্ভ করিয়াছে গানের তালে। বলিলেন, ‘বেশ, তেমন আলাপ-পরিচয় থাকলে ওঁদের সঙ্গে, একদিন নেমন্তন্ন করে এলে হত মেয়েটিকে। দেখছি, বেশ শোনবার মতো গান।”
মনুজ একেবারে বর্তাইয়া গেল। বলিল, “খুব জানাশোনা আছে; প্রফেসার সান্যাল আমায় খুব স্নেহ করেন কিনা। তাছাড়া ওঁর ছেলে, আরতি দেবীর ভাই কিরণ সান্যাল, আমার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে, আমার ক্লাস-ফেন্ড। আর মিস সান্যাল যে শুধু গানই গাইতে পারেন তা নয়, ব্যাঞ্জোতেও এমন চমৎকার হাত—”
কাকা মনে মনে একটু হুঁ ধূলিয়া প্রকাশ্যে বলিলেন, “ছোট মেয়ে, যদি একলা না আসতে চায় তো তোমার ক্লাস-ফ্রেন্ড কিরণকেও সঙ্গে সঙ্গে বলে এলে হয়।”
মনুজ বোধ হয় আহ্লাদের চোটে স্থানকালপাত্র সব ভুলিয়া গেল। বলিল, “না, আরতি সান্যাল তত ছেলেমানুষ নন তো; বয়সে পনেরো-ষোল—মানে সেকেন্ড ক্লাসে পড়েন। তা কিরণকে বললে আরও ভালই হয়। বলেন তো পরশুই না হয় বলে আসি—রবিবার আছে।”
সব বুঝা গেল, বয়সটি পর্যন্ত। কাকা যাইতে যাইতে বলিলেন, “দাঁড়াও দেখি, পরশু আমায় বোধ হয় হুগলি যেতে হবে। তুমি কিন্তু বাপু পড়াশুনোর দিকেও একটু মন রেখে যেও, বইগুলোকে তবলা করে করে উচ্ছন্ন দিলে আর কি হবে?”
.
অপর কেহ হইলে তপস্যার নমুনা দেখিয়াই হাল ছাড়িয়া বসিত; কিন্তু মনুজের কাকা অন্য ধাতের মানুষ
রবিবার দিন নিমন্ত্রণের কথা না তুলিয়া বলিলেন, “তোমার দেখছি রাত্তিরটায় গান- বাজনার অত্যাচারে খুবই ব্যাঘাত হয়। পাড়াটাও হয়ে উঠেছে বড্ড খারাপ; দেখছি কিনা, সকালবেলা সতেরো নম্বর বাড়িতে কর্তার সা-রে-গা-মা দশটা পর্যন্ত, যেই সে আঙুল ঘুরিয়ে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে আপিসে বেরুল, ছেলেটা কর্নেট বের করলে। বিকেলবেলা তো সমস্ত পাড়াটা গন্ধর্বপুরী হয়ে দাঁড়ায়। রাত্রে একটু ক্ষান্ত দেয় সব! আবার এই এক নতুন উপদ্রব জুটেছেন, লোকের তাল দিয়েই ফুরসত নেই, তো পড়বে কখন?”
মনুজ কাপড়ের পাড়ের রঙটা ঘষিয়া তুলিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। কাকা মন্তব্যটি মনে ভালো করিয়া বসিবার অবসর দিয়া বলিলেন, “বেশ ব্যাঘাত হচ্ছে। আমি তাই ঠিক করেছি, তুমি সুমুখ-রাত্তিরে পড়া বন্ধ করে মাঝরাত্রে উঠে তোমার সাধনা কর, থাক ওরা গানবাজনা নিয়ে। তুমি এগারোটার সময় না শুয়ে সাড়ে আটটার সময়ই শুয়ে পড়, কেমন?”
মনুজ মাথা কাত করিয়া সম্মতি দিল।
কাকা বলিলেন, “বাকি থাকে ঘুম ভাঙার কথা। একটা অ্যালার্ম-ঘড়ি কিনে আনছি। সে-ধরনের অ্যালার্ম নয় যে, একেবারে আচমকা ঝনঝন করে উঠে হুড়মুড়িয়ে তুলে দেবে; তাতে ব্রেনে ভয়ানক শক লাগে। আমি যার কথা বলছি, এ বেশ একটা নতুন ধরনের জিনিস, বেরিয়েছে জার্মেনি থেকে, আস্তে আস্তে আরম্ভ হয়ে মিষ্টি খানিকটা গতের মতো বেজে প্রথমে ঘুমের ঘোরটা ভেঙে দেবে, তারপর জোরে খানিকটা জলদ, সেটা মিনিট- কয়েক পর্যন্ত চলবে; মানে, ঘড়ি নয়, পেয়াদা, ঘুম না ভাঙিয়ে ছাড়বে না, তবে ওই রকম গায়ে হাত বুলিয়ে। বললে, দু-তিনদিনের মধ্যে জার্মেনি থেকে কনসাইনমেন্ট এসে পড়বে। ততদিন চালাও কোনো রকমে, তবে ওরকম করে তাল দিও না বাপু; বাঁয়া-তবলাই বা তুমি শিখলে কোত্থেকে? কই, আমি তো ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতাম না?”
ফিরিয়া যাইতে যাইতে অকস্মাৎ মুঠায় দাড়ি চাপিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন। নিজের মনেই বলিলেন, নিষুতি রাত, আর মেয়েটার নামই কত রকম ভাবে আওড়ালে সেদিন— আরতি, আরতি দেবী, আরতি সান্যাল, মিস সান্যাল!
ভিতরে গিয়া বলিলেন, “পদ্য-টদ্য লেখার বাই নেই তা? দেখো বাপু, নির্জন রাতের ও আবার একটা বিপদ আছে।”
.
কুটনা কোটা হইতেছিল, মনুজ গিয়া বসিল। মুখ অন্ধকার, জোরে জোরে নিশ্বাস পড়িতেছে। কাকীমার ঠোঁটের কোণটা একবার যেন একটু কুঞ্চিত হইল, কিন্তু কোনো প্রশ্ন করিলেন না। খানিকক্ষণ গেল।
মনুজ একবার আড়চোখে চাহিয়া আবার মুখ ফিরাইয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আমারও তরকারি কুটছ নাকি?”
“হ্যাঁ, অদ্ধেকগুলো তোর, আর বাকি অদ্ধেক আমাদের সব্বার।
এইটুকুই যথেষ্ট ছিল। মনুজ একেবারে দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠল। “ঠাট্টা! কিন্তু দেখো, আমি যদি আজ কিছু খাই তো—”
কাকীমা হঠাৎ কড়া চোখে চাহিয়া উঠিতে বলিল, “বেশ, দিব্যি না করতে দাও তো বয়ে গেল; কিন্তু কে খাওয়াতে পারে আমায় একবার দেখব! রাত জেগে তপস্যা কর! বেশ, নিদ্রা যদি ছাড়তে হয় তো আহার-নিদ্রা আমি দুই-ই ছাড়ব, ঘর ভেঙে ফেললেও দোর খুলব না, দেখি। মস্ত দোষ করেছে সবাই গান গেয়ে, অত গানে ভয় তো চল না সবাই ইজিপ্টে গিয়ে ফ্যারাওদের পিরামিডের ওপর বসে থাকি! আর অমনই খপ করে যে বলে বসলে, তাল দিচ্ছিলাম, মিছে অপবাদ, কানের কাছে ওরকম কচকচ করলে কখনও অমন দ্রুত ঠুংরির তালে—মানে, ইয়ে—আচ্ছা বেশ, তুমি যে বললে, অ্যালার্ম-ঘড়ি কিনে আনবে, আমি যদি সেদিনকার কথা তুলে বলি যে, সেসব যুগে, যেমন ইলেকট্রিক লাইট আর ফ্যানের নীচে বসে তপস্যা করত না, তেমনই যোগনিদ্রা ভাঙবার জন্যে অ্যালার্ম-ঘড়িরও বালাই ছিল না, তখন? তা তাহলেই তো হবে, মেনো হয়ে উঠেছে এক নম্বর বাচাল, তার্কিক! বেশ, আমি কোনো তর্ক করব না, কিন্তু দেখো, এই শপথ—শপথ না করে বলছি—”
কাকীমা চটিয়া উঠিয়াছিলেন, কিন্তু শপথ না করায় ঠাণ্ডা হইয়া বলিলেন, “আবার রাত জাগা, অ্যালার্ম-ঘড়ি, এসবের হাঙ্গামা কেন বাপু? একে তো দুধের দাঁত ভাঙতে না ভাঙতে চোখে চশমা, পড়ে পড়ে চোখের ওপর অত্যাচার করেই তো?”
মনুজ আবার একবার জ্বলিয়া উঠিল, এবার সহানুভূতির বাতাসে। বলিল, “নাঃ, আমার আর ওসবের দরকার কি? চোখ যাক, কানও যাক, কাউকে—মানে কিচ্ছু চোখে না দেখি, কারুর গান—মানে, মানে—তাহলে তোমাদের মনস্কামনা পূর্ণ হয় কিনা; চোখ-কান বুজে বাল্মীকি ঋষি হয়ে তপস্যা করি খালি। বেশ এইবার আমি করবও তাই, এমন শক্ত করে কানে তুলো গুঁজে বসে থাকব যে, কানের কাছে কামান দাগলেও—অ্যালার্ম ঘড়ি কিন্তু তোমার আমি আগে শেষ করব, যতবার সারিয়ে নিয়ে আসবে—”
কাকীমা আর হাসি চাপিয়া রাখিতে পারিলেন না, অনেকক্ষণের বদ্ধ হাসির মুক্তিতে দুলিতে দুলিতে বলিলেন, “হ্যাঁরে, সব তো আমার ঘাড়েই চাপাচ্ছিস, যেন আমিই অপরাধ করেছি। যাক, কিন্তু কামান দাগলেও যখন শুনতে পাবি না, তখন মিছিমিছি ঘড়িটা ভাঙবি কেন, শুনি?”
মনুজ আর এক চোট রাগিয়া কি বলিতে যাইতেছিল, এমন সময় বাহিরের ঘর হইতে কাকাকে এমুখো আসিতে দেখিয়া চুপ করিয়া গেল, এবং মুখের চেহারাটা শোধরাইয়া লইতে ব্যস্ত হইয়া উঠিল।
কাকা আসিয়া বলিলেন, “এই যে, তোমার কাকীমাকে বুঝি সেই আলাম-ঘড়িটার কথা বলছিলে?”
মনুজ চেহারাটাকে অনেকটা প্রকৃতিস্থ করিয়া আনিয়াছে, কেননা এ অনুশীলন তাহাকে প্রায়ই করিতে হয় আজকাল। উত্তর করিল, “আজ্ঞে হ্যাঁ।”
কাকীমা বলিতে যাইতেছিলেন, “হ্যাঁগা, আবার নাকি রাত জেগে—”
মনুজ তাড়াতাড়ি মুখের কথা কাড়িয়া লইয়া বলিল, “বাঃ রে! রাত না জাগলে ওই অতগুলো অনার্সের বই সামলাবে কে?”
কাকা বলিলেন, “ওঁর বুঝি অমত তোমার রাত জাগায়? তোমরা মেয়েমানুষেরা বোঝ না সোঝ না, অথচ সবকথাতেই—”
মনুজ কাকীমার চাপা হাসিতে রাঙা মুখখানার দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে চাহিয়া তাড়াতাড়ি বলিল, “ওঁর অমত হলেও আমি শুনব কেন সেসব কথা, হুঁ!”
কাকা চলিয়া গেলে সিধা দাঁড়াইয়া উঠিয়া রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, “ঘড়ি যদি আমি মুচড়ে না সাবাড় করি তো আমার নামে—বাঃ রে! কুকুর পুষো বলেও দিব্যি করতে পারবে না লোকে, অমনই শাসিয়ে উঠলে? আচ্ছা, দেখো তখন, আসুকই না ঘড়ি
হনহন করিয়া চলিয়া গেল।
.
ঘড়িটা দোকানে আসিয়াছে, কাকা কিনিয়া আনিতে গিয়াছেন। মনুজ পার্কের ওধার হইতে একটু বেড়াইয়া আসিতে গিয়াছিল, কোন্ দিক দিয়া যে দেরি হইয়া গেল, সেটা হুঁশ ছিল না। বাড়ি ঢুকিতে যাইবে, কাকার সামনাসামনি পড়িয়া গেল। প্রশ্ন করিলেন, “কোথায় যাওয়া হয়েছিল বাপু, এই রোদ্দুর মাথায় করে?”
কাকার কাছে এথিক্স অর্থাৎ নীতিশাস্ত্র পড়িতে পড়িতে এমন অবস্থা হইয়া আসিতেছে যে, প্রয়োজনমতো সোজাসুজি মিথ্যা কথাটা আর মুখ দিয়া বাহির হয় না, অথচ খাঁটি সত্য বলিবার শক্তিটাও তেমন আয়ত্ত হয় নাই। মনুজ সত্য মিথ্যা মিশাইয়া বলিয়া ফেলিল, “প্রফেসার সান্যালের বাড়ি; কিরণের সঙ্গে বসে বসে এথিক্সের একটা পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করছিলাম।”
“বেশ ভালো কথা। কতক্ষণ?”
মনুজ একটু উৎসাহের সহিত বলিল, “আজ্ঞে ঘণ্টা-দেড়েক হল গিছলাম। আন্দাজে বলছি, কিছু বেশিও হতে পারে
কাকা বলিলেন, “আজ হঠাৎ ঘণ্টা-দেড়েক আগে তোমাদের প্রফেসার সান্যালের সঙ্গে আলাপ হল; যে দোকানে ঘড়ি কিনছিলাম, সেই দোকানেই তিনি তাঁর ছেলে কিরণের জন্যে একটা রিস্ট-ওয়াচ দেখছিলেন। কিরণই সান্যাল মশাইকে বললে, আমি তোমার কাকা, আলাপ করতে করতে একসঙ্গেই এলাম তিনজনে।”
স্থির শ্লেষপূর্ণ দৃষ্টিতে ভাইপোর পানে চাহিয়া রহিলেন। একটু পরে প্রশ্ন করিলেন, “ওই কিরণের কথাই বলছ তো?”
মনুজ মৃৎপুত্তলীবৎ নির্বাক নিশ্চল থাকিয়া প্রয়োজনীয় উত্তর দিল।
কাকা পকেট ঘড়িটা বাহির করিয়া করতলে রাখিলেন; ডায়ালটার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বলিলেন, “চারটে বিয়াল্লিশ। আরতি—আরতি দেবী নিশ্চয়ই এই খানিকক্ষণ আগে স্কুল থেকে এসে ব্যাঞ্জো নিয়ে বসেছেন, তাই হাঁ করে গেলা হচ্ছিল তো?”
এরকম কোণঠাসা হইয়া মনুজ স্বীকার করিয়াই ফেলিত। কিন্তু নেহাত একেবারে হাঁ করিয়া গেলা’, তাই কোনো উত্তর না দিয়া পূর্ববৎই নিশ্চল হইয়া রহিল। কাকা হ্যাভলক এলিস পড়েন, সব জিনিসে স্পষ্টতার বিশেষ পক্ষপাতী; স্বচ্ছন্দে আরও বে-আবরুভাবে প্রশ্নাদি করিতে পারিতেন, কিন্তু আপাতত আর কিছু না বলিয়া ছোট্ট করিয়া শুধু “হোপ্ লেস” বলিয়া ভিতরে চলিয়া গেলেন।
.
রাত্রে মনুজ নূতন বন্দোবস্তমতো আটার সময় আহার করিয়া লইল। ঠিক সাড়ে আটটায় কম্বলের উপর চাদরটা টানিয়া শয্যারচনা করিতেছে, কাকা আসিয়া টেবিল হইতে নূতন ঘড়িটা তুলিয়া লইলেন। অ্যালার্মের দম দিয়া, কাঁটাটা ঘুরাইয়া বলিলেন, “এই একটা করে রাখলাম। যদি বন্ধ করে না দাও তো ঠিক দশ মিনিট বাজবে। ছোট বিছানাটিতে শুয়ে শুয়ে ক্রমেই বেশ সংযমের একটা ভাব আসছে না কি? এদিকে আধ হাত গেলেও পড়ব, ওদিকে আধ হাত গেলেও পড়ব, মনের অবচেতন অবস্থার মধ্যে এই ধারণাটি মনকে চারিদিক থেকে বেশ নিয়ম আর সংযমের বশীভূত করে আনবে; তপস্যা এই সবকেই বলে। আচ্ছা এখন শুয়ে পড়। আর অ্যালার্মের দমটা বাঁদিকে দিতে হয়, অ্যারো হেড দিয়ে দেখানোই আছে।”
কাকা চলিয়া গেলে মনুজ দাঁতে দাঁত ঘষিয়া চৌকির উপর একটা ঘুষি কষাইয়া অস্ফুট স্বরে বলিল, “কাল যদি আমি নির্ঘাত ডন দিকে চাবি না দিই তো আমার অতি বড় কোটি দিব্যি রইল!”
মুষ্টিবদ্ধ ডান হাতটা মুচড়াইয়া বলিল, “কষে দোব।”
তাহার পর কাল কুটনা কুটিবার সময় কাকীমাকে কি সব স্পষ্ট কথা শুনাইবে মনে মনে তাহারই মহলা দিতে দিতে কখন ঘুমাইয়া পড়িল। মেঘলা রাত, কিন্তু তার সঙ্গে বর্ষার যে একটু সুমিষ্ট প্রত্যাশা জমিয়া উঠিতেছিল, ঠিক ঘুমের মুখে মুখে আপদ ঘড়িটার কথা মনে উঠিয়া সেটুকুকে বিলুপ্ত করিয়া দিতে লাগিল।
মাঝরাত্রে উঠিয়াছে; কিন্তু চোখ যেন চাড়া দিয়াও খোলা যায় না, অভ্যাস তো নাই। প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছে, আলো জ্বালিতে হইবে, কিন্তু চোখের পাতার উপর কে যেন দুইটি আধমুণে পাথর চাপাইয়া গিয়াছে। কাকার উপর চটিয়া দাঁতে দাঁত পিষিয়া বলিল, “হুঁ, তপস্যা! তপস্যা!” কথাটা যেন চিবাইয়া টুকরা টুকরা করিয়া দিতে পারিলে আক্রোশ মিটে।
এমন সময় দোরে খটখট করিয়া দ্রুত করাঘাত হইল, সঙ্গে সঙ্গে ত্রস্ত তাগিদ, “শিগগির দোর খোল।”
“কে, কাকা?”
উত্তর হইল শুধু খিলখিল করিয়া হাসি, যেন একটা সঙ্কীর্ণ অথচ বেগচপল জলস্রোত কুলকুল করিয়া বহিয়া চলিয়াছে। এ যে চেনা হাসি! মনুজের বুক দুরুদুর করিয়া উঠিল; আধভাঙা গলায় প্রশ্ন করিল, “আরতি?”
“আগে দোর খোল, বৃষ্টিতে মলাম ভিজে।”
সংযমের চৌকি হইতে এক রকম অধঃপতিত হইয়াই মনুজ টলিতে টলিতে গিয়া কপাট খুলিয়া দিল। খানিকটা প্রবল ঠাণ্ডা হাওয়ার ও বৃষ্টির ছাটের সঙ্গে আরতি প্রায় ঘাড়ে পড়-পড় হইয়া ঘরটার মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইল; ভিজিয়া চুপসিয়া গিয়াছে একেবারে। প্রশ্ন করিল, “আলো কোথায়?”
মনুজ আরতির প্রশ্নে অতিমাত্র লজ্জিত হইয়া, দরজার কাছে নীরবে সেই অন্ধকারটিতে মাথা নীচু করিল। তাহার পর পকেট হইতে দেশলাই বাহির করিয়া অনেক রকমে প্রদীপটা জ্বালিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু বৃথা। এই কঠোর তপোগৃহের কুণ্ঠিত আলোক এ অকিঞ্চন অভ্যর্থনায় যোগ দিতে যেন নিতান্তই অনিচ্ছুক।
আবার ঘরের সিক্ত অন্ধকারের মধ্যে সেই তরল হাসি যেন ছলছলিয়া উঠিল। আরতি নিজের আর্দ্র বস্ত্রের মধ্য হইতে একটা বিদ্যুতের বাল্ব বাহির করিল, উঠিয়া ব্র্যাকেটটাতে লাগাইতে লাগাইতে বলিল, “আমি জানি যে তোমার দুর্দশার ইতিহাস, কিরণদার কাছে শুনলাম কিনা, তাই তোয়ের হয়েই এসেছি। আলো জ্বাললেই তপস্যার সব সরঞ্জাম অনধিকারীর চোখে ধরা পড়ে যাবে যে, আর বিঘ্নেরও আশঙ্কা!”
আবার হাসি। হাসি না তো, জলের স্রোতে যেন আশেপাশে সমস্ত জায়গাটা ছাইয়া ফেলিয়াছে—কুলকুল কুলকুল।
আরতি নামিয়া নিজেই সুইচটা টিপিয়া দিল। অনেকদিনের নির্বাসিত আলো যেন আচমকা ফিরিয়া আসিয়াছে, ঘরটি ভরিয়া গেল।
সামনেই আরতি দাঁড়াইয়া। দুষ্টামির হাসিতে ভরা ঠোটের একটা কোণ মুঠা দিয়া চাপা। চুল, ভ্রূ, পক্ষ, আর সিক্তবসন হইতে শীকরের মুক্তা ঝরিয়া পড়িতেছে।
এদিকে এত আলো, তবু কিন্তু কিন্তু ঘরটাতে কেমন একটা জড়তা, একটা অস্পষ্টতা। মনুজ ভাবিল, এ কি তাহার চোখের লজ্জার জন্য নাকি? অসম্ভব নয়, আরতি আলট্রা-মডার্ন হইয়া তাহাকে যেন অনেক পেছনে ফেলিয়া দিয়াছে, তাল রাখিয়া উঠা যায় না। লজ্জা ঠেলিয়া নেহাত কিছু একটা বলিবার জন্যই বলিল, “আলোটা বেশ খুলছে না যে, বাদলে জলো হাওয়ার জন্যেই নাকি, বল তো?”
চপল হাসিতে আরতির বৃষ্টিতে-ভেজা মুখখানি ঝিকমিক করিয়া উঠিল। প্রগল্ভার মতো বলিল, “শোন কথা! আরতির সামনে কখনও আলো খোলে নাকি?”
চোখের কোণে কোথায় নিজের অতি বেহায়াপনা, একটু লজ্জা, মুক্তির পাশে পাশে সঙ্কোচ আর সেই হাসির কুলকুল শব্দ, বর্ষার সঙ্গে ওর গলায় যেন ধারা নামিয়াছে।
আরতির আবির্ভাবটা মনুজের যেন অদ্ভুতভাবে কি একরকম মনে হইতেছিল, অত্যন্ত মিষ্ট, প্রায় অসম্ভবের কোঠায়; আশ্চর্য, প্রায় অলৌকিক; তাহারই মধ্যে আবার নিতান্তই অন্তরঙ্গ একটা ঘটনা, তাহার জীবন-সম্পর্কে সবচেয়ে সহজ সত্য, এতই সহজ যে অপার্থিব হইয়া অনায়াসেই সম্ভব হইয়া পড়িয়াছে। এমন একটি সত্যের আলোকে স্পষ্ট যে, তাহার সামনে কাকা, তপস্যা, অ্যালার্ম-ঘড়ি—এ সবই যেন কুয়াশার মতো অস্পষ্ট হইয়া গিয়াছে। মোটের উপর কি রকম একটা অনুভূতি, বাস্তবেও যেন স্বপ্ন, স্বপ্নেও যেন বাস্তব। এত পলকা একটা কিছু যে, সাহস করিয়া একটা প্রশ্ন করিয়াও উঠিতে পারিতেছে না। মনে হইতেছে, আসার কারণ সম্বন্ধে কোনো জবাবদিহি করিতে গেলেই সমস্ত ব্যাপারটা কোন দিক দিয়া যেন মিলাইয়া যাইবে।
মনুজ একটু লজ্জিত হাসি হাসিয়া বলিল, “বস আরু।”
বর্ষার জলের মতোই আরতি যেন হাসির স্রোত বহাইবার পথ খুঁজিতেছে। হাসিয়া হাসিয়া বলিল, “কোথায়? এই একফালি চৌকিতে? মাফ কর, আমার অত তপস্যার জোর নেই, পড়ে মরব, অত সূক্ষ্ম জিনিস সহ্য হবে না। বরং তুমি বস ওটাতে, কিংবা শুয়ে পড়। আমি চেয়ারটাতে বসে যা করতে এসেছি তাই করি।”
ব্যাঞ্জোটা বাহির করিয়া কোলে রাখিল। মনুজ অতিমাত্র আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিল, “ওটা কোথা থেকে বের করলে? ভিজে যায় নি?”
পাতলা কি একটা আস্তরণ, সেটা খুলিতে খুলিতে আরতি উত্তর করিল, “না, ওটা আমার অন্তরের জিনিস, প্রাণের পাশাপাশি লুকানো ছিল, ভিজত তো প্রাণও ভিজে যেতে পারত, নয় কি? বল না? ও, তুমি আবার দর্শনশাস্ত্রের ছাত্র; বলবে—প্রাণ জলে ভেজে না, অনলে পোড়ে না!”
দুষ্টামির হাসি হাসিয়া আবার বলিল, “এক ধরনের অনলে কিন্তু পোড়ে প্ৰাণ, না গা?”
মনুজ হাসিয়া বলিল, “তুমি আজ হঠাৎ বড় বাচাল হয়ে উঠেছ আরু।”
“আজ বিকেল থেকে কেমন যেন হতে ইচ্ছে হয়েছে, তুমি অনেক কথা বাকি থাকতেই তখন উঠে এলে কিনা; তার ওপর আবার এই চমৎকার বর্ষার রাত্তির।
হঠাৎ সামনে একটু ঝুঁকিয়া বলিল, “আচ্ছা, তুমিও হতে না বাচাল, কাকার কাছে যদি অমন দাবড়ানিটা না খেতে? বল না?”
কৌতুকায়ত দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল; চাঁদে জ্যোৎস্নার মতো তাহাতে অফুরন্ত হাসি যেন জমানো আছে।
মনুজ অনুভব করিল, ক্রমশ তাহার জিহ্বাটা ও বেশ সবল হইয়া আসিতেছে, বোধ হয় কাকার দাবড়ানির জেরটা কাটিয়া আসিবার জন্যই। হাসিয়া কি একটা বলিতে যাইতেছিল, এমন সময় একটা দমকা হাওয়া আরতির কোলের ব্যাঞ্জোটার উপর দিয়া বহিয়া তারগুলাকে একসঙ্গে সমস্ত পর্দায় চাপিয়া যেন ঝনঝনাইয়া দিল; একটা তীব্র মিঠা ঝঙ্কারে সমস্ত ঘরটা যেন ভরাট হইয়া গেল। মনুজ বলিল, “তোমার সঙ্গিনীও বাচাল হয়ে উঠেছে আরু; তোমাদের দুজনের প্রাণে প্রাণে একটু বিশ্রাম্ভালাপ হোক, আমি দুষ্যন্তের মতো শুনি চোখ বোজার আড়াল থেকে।
আরতির মুখের ভাবটি নিমেষে নরম হইয়া আসিল, কি একটা যেন সুখের বেদনায়। ব্যাঞ্জোটি কোলে রাখিয়া বুকে চাপিয়া বলিল, “হ্যাঁ, শোন, ওর কথা শোনাতেই ও আমায় আজ এই বর্ষার মাঝরাত্রে ঘরছাড়া করে টেনে নেমেছে।”
সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঞ্জো রনরনিয়া উঠিল। সে কি সঙ্গীত! মনুজের মনে হইল, চাঁপার আধফুটন্ত কলি হইতে গন্ধের মতো আরতির দুইটি হাতের অঙ্গুলিগুচ্ছ হইতে সঙ্গীত ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে। অবিশ্রান্ত বর্ষার ঝরঝর তালের সঙ্গে দ্রিম দ্রিম দ্রিম—কখন মিলিয়া গলিয়া বেদনাতুর হইয়া এই অশ্রুময়ী রজনীর সঙ্গে এক হইয়া গেল; অতল অন্ধকারে, মিলনের সম্ভাবনার বাহিরে কি যেন একটা চিরবিরহের সুর—অন্ধ, নিষ্ফল অনুসন্ধানের ব্যথায় ভরা! অশ্রুতে মনুজের চোখের পাতা ভারি হইয়া আসিল। একটা তন্দ্রায় যেন ক্রমেই আচ্ছন্ন হইয়া আসিতেছে, কেমন একটা ভয় হইতেছে, এই আসন্ন নিদ্রার মধ্য দিয়া সে এমনই একটা অতলে গিয়া পড়িবে যে, সেখান হইতে আর শত্রু চেষ্টাতেও আরতির নাগাল পাওয়া যাইবে না। তবু এই না-পাওয়ার আশঙ্কা, এও যে কত মধুর কি সে অশ্রুতে ভরা সুখ—
সুর বহিয়াই চলিয়াছে—রিম ঝিম, রিম ঝিম; কখনও মৃদু, যেন আর শোনাই যায় না; সহসা কখনও ঝঙ্কৃত, নিজের পূর্ণতায়, নিজের গতির আবেগে আবর্ত সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে।
মনুজ বলিল, “আরু, তুমি আমি যেন হচ্ছি নদীর দুটি কূল; মাঝখান দিয়ে এমনই চিরবিরহের ধারা আমাদের দুজনকে চিরকালের জন্য এক করে চলুক। মন্দ কি আরু?”
হঠাৎ একটা প্রবল ঝনঝনানির পর সঙ্গীত থামিয়া গেল। আরতি চেয়ার ছাড়িয়া ব্যাঞ্জো রাখিয়া আসিয়া চৌকির নীচে মনুজের সামনেটিতে বসিল; দুষ্টামির হাসি হাসিয়া বলিল, “হ্যাঁ, তোমার কাকা চিরকাল নদী হয়ে আমাদের তফাত করে রাখুন, আর তুমি দিব্যি থাকো তোমার তপস্যা নিয়ে। তবে ওই রইল তোমার ব্যাঞ্জো, কী যে সাধ!”
মনুজ মুখটি কাছে আনিয়া গাঢ়স্বরে বলিল, “আমার যে কি তপস্যা, কি সাধ, তুমিও কি তা জান না আরু?”
হাসিতে আরতির কিছু অশ্রু ঝরিয়া পড়িয়াছে, কিছু চোখেই টলটল করিতেছে, সেটুকু আদর করিয়া মুছাইতে গিয়া মনুজের হাতটা খানিকটা শূন্যে গিয়া বাহির হইয়া গেল। পতন হইতে নিজেকে সামলাইয়া লইয়া সে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া পড়িল।
ঘড়ির রেডিয়াম-ডায়ালে দেখিল, রাত্রি একটা বাজিয়া দশ মিনিট হইয়াছে। মনে হইল যে, অ্যালার্মের শেষ ঝঙ্কারের সুর তখনও হাওয়ায় কোথায় একটু ভাসিয়া বেড়াইতেছে। খানিকক্ষণ কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে ঘড়িটার দিকে চাহিয়া রহিল। বাহিরে বর্ষা, মাথার কাছের জানালাটা খুলিয়া গিয়া সজোরে আর্দ্র বাতাস আসিতেছে। চৌকির একধারে আসিয়া পড়িয়াছিল, আর একটু হইলেই হইয়াছিল আর কি!
বই লইয়া সাধনা করিবার আর প্রবৃত্তি হইল না; মনে হইল, যেন এখনও আরতি নীচে বুকের কাছটিতে বসিয়া আছে। আবার এমনই একটি স্বপ্নের মধ্যে একবার ভালো করিয়া তাহাকে যদি পাওয়া যাইত—এই আশায় জড়িমা কাটিবার পূর্বেই মনুজ আবার তাড়াতাড়ি আরতির বিদ্রূপে সরসিত সেই সঙ্কীর্ণ চৌকিটায় শুইয়া পড়িয়া নিদ্রার সাধনায় লাগিয়া গেল। ব্যাঞ্জোর প্রত্যাশায় ঘড়িটাতে এ্যালার্মের জন্য একটু দমও দিয়া দিল, অবশ্য বাঁ-দিকে চাবি দিয়াই।
.
পরের দিন কাকা বলিলেন, “নাঃ, রাত জেগে পড়াটা তোমার পক্ষে এখন ঠিক হবে না, সে সম্বন্ধে মনস্থির করতে পারছি না, ভেবে ভেবে কাল আমারই ঘুম হয় নি, তাইতে শরীরটা এত খারাপ হয়েছে—থাক না হয়, দু-একজন ভালো ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করে দেখি। ঘড়িটা আপাতত আমার ঘরেই রেখে এস।”
কাকীমা কুটনা কুটিতেছিলেন, মুখ অন্ধকার করিয়া মনুজ পাশে গিয়া বসিল। একবার আড়চোখে দেখিয়া বলিল, “অত আলু কি হবে? আজ সাতজনের তো মোটে রান্না।”
“কেন, আজ আবার অষ্টম জনটির কি হল?”
মনুজ ঝঙ্কার দিয়া উঠিল, “নাঃ, কাজ কি কিছু হয়ে, মেনো তো মানুষ নয়! এই এক রকম হুকুম, তক্ষুনি আবার অন্য রকম! কত ইয়ে করে কত রকম কত কি করে যদি আরম্ভই করলাম একটা সাধনা, দুদিন দেখাই যাক; না, ঘড়ি আজ আমার ঘরে দিয়ে আসিস! কেন, সব থাকতে ঘড়িটার ওপরই এত আক্রোশ কেন? ও তো কারুর ব্যাঞ্জোও নয়, এস্রাজ ও নয়, আমি কক্ষনো রেখে আসব না। না হয় বলে বেড়াবে, ভাইপো আমার অবাধ্য হয়েছে। বেশ, হয়েছে তো হয়েছে। আমার তপস্যার-সাধনার ঘড়ি, ও আমি কোনোমতেই ছাড়ব না, একটা মায়া জন্মে যায় না?”