যুগলবন্দি

যুগলবন্দি

‘আসগর।’

কার্পেটে বসে আসগর হোসেন তখন খালি সব বোতল থেকে ফোঁটা ফোঁটা তলানি ঢালছিলো নিজের জিভে। মস্ত ড্রয়িংরুমের আরেক মাথায় সরোয়ার বি কবিরের হুইস্কিশোষা গলা গমগম করে উঠলে প্রথমে সাড়া দেয় বারান্দায় বসে থাকা এ্যালসেশিয়ানটি। তারপর চমকে ওঠে আসগর। অতিথিদের বিদায় দিয়ে সরোয়ার কবির এইতো ভেতরে গেলো, ১৫ মিনিটের মধ্যে তার ফিরে আসার সম্ভাবনা আঁচ করতে পারলে এখন বোতল ঠোঁটে ধরার সাহস আসগরের হয়? মিনিট দশেক আগেও বারান্দায় বসে সে আসগরের পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো, সরোয়ার কবির ফিরে আসবে জানলে তাই অব্যাহত রাখা যেতো। আসগরের লোকটাই এরকম, সায়েবের ফেভারিট কাজগুলো যখন করে সায়েব তখন লক্ষই করে না। সরোয়ার কবিরের গলা পর্যন্ত এখন ডিম্পলে শিভাজ রিগ্যালে টইটম্বুর, সাহিত্য কি কোষ্ঠকাঠিন্য কি নিজের ব্রিলিয়ান্ট এ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার নিয়ে কথাবার্তা শুরু করে তো রাতটা বসে বসেই কাবার।

টাল সামলাতে সামলাতে আসগর উঠে দাঁড়ায়, ‘জি?’

তার গোপনে বোতল চোষার দিকে সরোয়ার কবির ফিরেও তাকায় না। ‘বোসো’ বলে নিজে লম্বা ১টা সোফায় বসে আধশোয়া হয়ে। এখন সহজে উঠবে না। আসগর আড়চোখে সার্ভে করে; না, চেহারা দেখে তার মুড বোঝবার জো নাই। তবে মিসেস জেসমিন বি কবিরের মেজাজ বোধ হয় ফর্মে নাই, বেডরুমে লোকটা সুবিধা করতে পারেনি। আহা, এতোবড়ো জাঁদরেল অফিসার—যার হাত দিয়ে লক্ষপতি কোটিপতিদের রোজগারের খানিকটা চালান হয়ে আসে রাষ্ট্রীয় তহবিলে–দ্যাখো বৌয়ের মেজাজের জন্য মাসে কম করে হলেও ৪/৫ দিন তাকে কাটাতে হয় ড্রয়িংরুমে, স্রেফ সোফায় কি ডিভানে আধশোয়া অবস্থায়। লোকটার এই ভোগান্তির কথা ভেবে আসগর এতোটা দুঃখিত হয় যে তার দুঃখ নিজেই বরণ করে নেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এ ধরনের দুঃখকষ্ট ভোগ করার কপাল যে তার কবে হবে!

‘আসগর, তোমাকে তো একটু কষ্ট করতে হয়। পারবে?’

কুশনঢাকা মোড়ায় বসে বসেই আসগর এ্যাটেনশন হয়। একই সঙ্গে অভিভূত চোখে তাকায়, সায়ের কীরকম পোলাইট, কী তার এটিকেট! আসগর হোসেন কি? –না, তার বোনের চাচাতো না মামাতো দেওরের বন্ধু।—এটা কোনো সম্পর্ক হলো? আসলে তো চাকরির উমেদার। তাকে সোজাসুজি হুকুম করলেও পারে। তা না, ভারী গলায় কী বিনয়। কিন্তু এ ধরনের জবাবে কী করতে হয় না জানায় আসগর কথা বলে না। সরোয়ার কবির জিগ্যেস করে, ‘রাত অনেক হয়েছে, না?’

‘জি পৌনে একটা, বারোটা তেতাল্লিশ।’

‘মোটে?’

সরোয়ার কবির হাসলে আসগরও অগত্যা হাসে, ‘না, রাত তেমন হয়নি, শীতের রাত, এখনো সারাটা রাত্রি পড়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে, হুইস্কির বোতল আনতে তাকে এখন যেতে হবে মাইল পাঁচেক দূরে। অসময়ে এসব কাজ সরোয়ার কবির তার অফিসের লোক দিয়ে করায় না, অফিসে সে দয়ালু ও বিবেচক বস। বছরখানেক এসব কাজ করেছে তার বোনের চাচাতো না মামাতো দেওর। ১০/১২ মাসের একনিষ্ঠতার পুরস্কারও তার জুটেছে, সরোয়ার কবিরই বলে কয়ে তাকে ঢুকিয়ে দিয়েছে এ্যামেরিকান এক জাহাজ কোম্পানিতে। ঐ সিকানদারের থ্রতেই আসগর এই বাড়িতে ঢোকে, লেগে থাকতে পারলে তারও হবে। এখন বোতল নিয়ে এলে ১টা অন্তত সরিয়ে রাখতে হবে, কোথায় কীভাবে রাখবে এই নিয়ে আসগর একটু পরিকল্পনা করে।

শীত কোথায়? দেখছো না পাঞ্জাবি পরে কেমন ঘামাছি।’ তা পেগের পর পেগ শিভাজ রিগ্যাল চালালে আসগর ন্যাংটা হয়ে এতোক্ষণে রাস্তায় নামতে পারে। সরোয়ার কবির বলে, ‘বসন্তের হাওয়া ফিল করছো না?’

‘জি, আর মাস খানেকের মধ্যেই ফাল্গুন মাস এসেছে।

‘রাইট। ফাল্গুন আসছে, না?’

‘জি, নেকস্ট মাহু। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি।’

‘দ্যাটস রাইট। এনিওয়ে, তোমাকে একটু বদার করবো।’

না, স্যার, না স্যার। আগ্রাবাদ যেতে হবে?’

তাকে কবির ভাই বলে ডাকলেও তার কোনো অর্ডার ক্যারি আউট করার

সময় আসগর স্যার বলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে।

‘আগ্রা দিল্লি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারো। কয়েকটা কমলালেবু জোগাড় করতে হয়। এক্ষুনি দরকার।

‘কমলালেবু? এখন?’

‘হ্যা। পিঙ্কির, আই মিন তোমার ভাবীর হঠাৎ কী হয়েছে কমলালেবু খেতে ইচ্ছে করছে। নর্মালি ও রাতে কিছু খায় না, নট ইভন এ গ্লাস অফ ওয়াটার, পানিতেও নাকি ফ্যাট বাড়ে। আমি বারবার করে বললাম এতো ড্রিঙ্ক করার পর খালি পেটে থেকো না, অন্তত ফলটল কিছু খাও। তো ফ্রিজ খুলে দেখি আপেল আছে, কলা আছে, বাট নো অরেঞ্জ।’

আপেল খেলে হয় না?’ জিগ্যেস করেই আসগরের ভয় হয় যে এই কথায় সরোয়ার কবির তাকে কর্মবিমুখ অলস ও অপদার্থ যুবক হিসাবে চিহ্নিত না করে। সঙ্গে সঙ্গে তাই একটু মেরামত করতে হয়, ‘রাত্রে কমলালেবু খেলে অনেক সময় এ্যাসিড হতে পারে।

আপেল থেকেই বরং এ্যাসিড হওয়ার চান্স বেশি।

এরপর কলা সম্বন্ধে পরামর্শ দেওয়াটা রিস্কি। আর এদের সোসাইটিতে কলার পজিশনও ওর কাছে স্পষ্ট নয়।

সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে সরোয়ার কবির বলে, ‘শি ওয়ান্টস অরেঞ্জ। ইট হেল্পস হার টু রিডিউস হার ওয়েট। টক তো চর্বিনাশক।

‘জি, টক সব সময় চর্বিনাশক।’ সরোয়ার কবিরের ইংরেজির মতো তার কঠিন কঠিন বাঙলা কথাও রপ্ত করার জন্য আসগর সদা সচেতন।

‘গাড়িটা বের করো’, আসগরের হাতে ১০০ টাকার নোট গুজে দিতে দিতে সরোয়ার কবির বলে, ‘ড্রাইভার বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। বেচারা সারাটা দিন ডিউটি করেছে, ড্যাম টায়ার্ড। দ্যাখো তো ওঠে কি-না।’

‘আমি নিজেই বরং চালিয়ে নিয়ে যাই।

‘গুড।’ টেবিলের শেলফ থেকে ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ টেনে নিতে নিতে সরোয়ার কবির ছোট্টো করে হাসে, ‘ভেরি গুড। যাও।’

গাড়ি বার করার সময় এ্যালসেশিয়ানটা গর্র্ গর্র্ করলে আসগর ডাকে, ‘আরগস। দুর! ডাকটা হার্শ হয়ে গেলো। সরোয়ার কবির শুনে ফেললো সঙ্গেসঙ্গে মোলায়েম ও আদুরে করে বলে, ‘আরগস। এবার গলাটা বেশি নিচু হয়ে গিয়েছিলো। সরোয়ার কবির শুনলো তো?

না, চকবাজারে ফলের দোকান একটিও খোলা নাই। এতো রাতে তার জন্যে কমলালেবু নিয়ে বসে থাকবে কোন শালা? সুতরাং ডানদিকে মোড় নিয়ে চাকা গড়িয়ে দিলো দক্ষিণ-পূর্বে। ডাইভটা ভারী চমৎকার। রাস্তা-ঘাট সব ফাঁকা। সারমন রোড দিয়ে এতোবার গেছে, জামান ইন্টারন্যাশনালের পুরনো জিপ নিয়ে সিকানদারের সঙ্গে যখন ড্রাইভিং শেখে তখনও এই রাস্তায় মেলা গাড়ি চালিয়েছে। কিন্তু এরকম অদ্ভুত লাগেনি কোনোদিন। কোথাও পাতলা কোথাও ঘন কুয়াশার আড়ালে পাহাড়গুলো ভারী রহস্যময়। জয় পাহাড়ের এখানে ওখানে আলো জ্বলে, কুয়াশায় সেই সব আলো এখন ঝাপসা। কখনো কখনো ১টি আলো ২টি ৩টি আলোয় ভাগ হয়ে লুকোচুরি খেলে। গাড়ির হেডলাইটের আলো কুয়াশা ছিঁড়তে ছিঁড়তে নিজেই গলে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে, ফ্যাকাসে অন্ধকার বড়ো অপরিচিত মনে হয়। গাড়ির জানলা খোলা, সেদিক দিয়ে পাহাড়ের ঠাণ্ডা নিশ্বাস এসে মুখে লাগে। জানলাটি উঠিয়ে দিতে বাধো বাধো ঠেকে, মনে হয় কেউ অসন্তুষ্ট হতে পারে। পাহাড়ের গায়ে গাছগুলো সরে সরে যাচ্ছিলো, হঠাৎ করে চোখে পড়ে একটু দূরে পাহাড়ের মাথায় ন্যাড়া ঢ্যাঙা গাছের পাতাঝরা ডালে ডিমে তা দেওয়ার ভঙ্গিতে বসে রয়েছে কৃষ্ণপক্ষের কালচে রক্তের রঙের চাঁদ। ডাল ভেঙে শালার চাঁদ পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়লে মহা কেলেঙ্কারি! জোর করে সেদিক থেকে চোখ ফেরাতে ফেরাতে আসগর গাড়ির স্পিড বাড়ায়। দুত্তোরি! ভূতের ভয় কি শালা ফের চাগিয়ে উঠলো নাকি? বছর চারেক আগে পর্যন্ত তাকে কাটাতে হয়েছে মফস্বলে, প্রায় এঁদো মফস্বল, পোস্ট অফিসের সঙ্গে লাগোয়া পোস্ট মাস্টার বাপের টিনের বাড়িতে। শোবার ঘর থেকে কলপাড়ে যেতে সেখানে উঠান পেরোতে হয়। এখন অনেক উঁচুতে ন্যাড়া গাছের রোগা ডালে কালচে লাল চাঁদের ডিম পাড়া দেখে উঠানের কলাগাছের ঝাড় শিরশির করে কাঁপতে লাগলো। দুর! এখন আবার এসব আদিখ্যেতা কেন? এসব ভয় কি এখন পোষায়? তবু কমলালেবু জোগাড় করার অভিযানের চেয়ে এই বুক-ছমছম অনেক ভালো।

রিয়াজউদ্দিন বাজারের কুকুরগুলো পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়েছিলো। গাড়ির নরম আওয়াজেও তাদের কাচা ঘুম ভাঙে এবং আসগরের দিকে টার্গেট করে মহা ঘেউঘেউ শুরু করে। কুত্তার বাচ্চা! একেকটার চেহারা সুরৎ কী! একবার চোখে পড়লে আর তাকাবার রুচি হয় না। ইচ্ছা করে সবকটাকে লাথি মেরে স্টেশন রোড, স্ট্রান্ড রোড ডিঙিয়ে কর্ণফুলীতে নামিয়ে দেয়। কিন্তু ওদের ওপর আসগরের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, কারণ কোরাস ঘেউঘেউতে কাজ হলো, একজন লোক দোকান খুলে বাইরে এলো। দোকানের কর্মচারী গোছের লোক। প্রথমে পাত্তাই দেয় না। আসগর তখন ইব্রাহিম সওদাগরের নাম বলে। পোর্ট থেকে কয়েকবার গোপনে টু-ইন-ওয়ান এনে আসগর তার কাছে বিক্রি করেছে। তার নাম বলায় কাজ হয়।

তারপর গাড়ি নিয়ে সোজা মাদারবাড়ি। সরোয়ার কবিরের হাতে কমলালেবু একটু দেরিতেই পৌঁছানো ভালো। রাত দেড়টায় কমলালেবু জোগাড় করা চাট্টিখানি কথা নয়। সায়েরা, আরামে থাকো, বোঝো না কতো ধানে কতো চাল! কিন্তু মাদারবাড়িতে আসগরদের বাসায় সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন। বাবা যখন থানা বা রেলওয়ে স্টেশনের কাছে পোস্ট অফিসে কাজ করতো তখন যতো রাতই হোক তাদের ২ কামরার বাসায় টিনের চালে টিকটিকি হাঁটলেও ‘কে? কে?’ বলে লাফিয়ে উঠতো। আর সারাজীবন কিপটেমি করে জমানো পয়সায় দালান তুলে লোকটার ঘুম কীরকম গাঢ় হয়েছে। রিটায়ার করার পর কাজ নাই কম্ম নাই খালি ঘুমাও, না? দাঁড়াও তোমার ঘুমের ঘোর ঘোচাচ্ছি, দাঁড়াও। আসগর দরজায় ধাঁই ধাঁই করে ঘুষি মারে আর চ্যাঁচায়, দরজা খোলো, দরজা খোলো না!’

ঘুমঘুম চোখে দরজা খোলে আসগরের মা, ছেলের বিরক্তির শিকারও হতে হয় তাকেই, ‘ঘুমালে তোমরা কি সব মরে যাও নাকি? কড়া নাড়ি, দরজায় ঘুষি মারি, তবু কারো ঘুম ভাঙে না কেন? কলিং বেল বাজে না কেন? বাল্‌ব খুলে রেখেছো নাকি?’ কলিং বেলের বাল্‌ব খুলে রান্নাঘরে লাগানো হয়েছে, আজকাল বাল্‌ব বড্ডো ফিউজড হয়, বালব কেনার কথা বললেই আসগরের বাপ খ্যাকখ্যাক করে। কিন্তু এতো বকাবকিতে ঘাবড়ে যাওয়ায় মা জবাব দিতে পারে না, হাই তুলতে গিয়ে তার মাড়ির হাড় আটকে যায়। আবার সেটাকে সামলাতেও হয় ভয়েই, লালাজড়ানো জিভে মা বলে, ‘রান্নাঘরের বাল্বটা হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেলো।’

‘ওটাও কি আমাকেই আনতে হবে? বাড়িতে আর লোক নেই?’

বাবা ছাড়া বাড়িতে পুরুষমানুষ বলতে আর কে আছে? আসগরের ছোটোভাই আজহারটা একেবারেই ছোটো, ক্লাস ফোরে পড়ে। একমাত্র বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, সে থাকে ঢাকায়। সুতরাং বাল্‌ব না কেনার দায়িত্ব পড়ে বাবার ঘাড়েই। ওদিকে স্ত্রী-পুত্রের মধ্যরাত্রির কথপোকথনে অংশ নেওয়ার জন্য গোলাম হোসেন বিছানা ছেড়ে এখানেই আসছিলো, আসগরের সঙ্গে তার একটু দরকারও আছে। কিন্তু ছেলে এবার তাকেই সরাসরি ধমক দিয়ে বসবে অনুমান করে বেচারা করিডোরের সঙ্গে খাবার ঘরে চেয়ারে বসে পড়ে।

মাকে পাশ কাটিয়ে খাবার ঘরে ঢুকে আসগর রেফ্রিজারেটরের দরজা খোলে। মা বলে, ‘ভাত খা, একটু বোস, তরকারি গরম করে দিই।’

আর খাওয়া! রেফ্রিজারেটরের ভেতরটা দেখে আসগরের মেজাজ খিচড়ে গেছে। রাজ্যের হাঁড়িকুড়ি আর লাউয়ের ফালি আর বেগুন আর পুঁইশাকে তাকগুলো ঠাসা। এইসব ছোটোলোকি জিনিসপত্র রাখার জন্য কি এতো রিস্ক নিয়ে পোর্ট থেকে আসগর ফ্রিজটা সরিয়েছিলো? সেই এ্যামেরিকান জাহাজের এক সেলারকে পটাতে কাঠখড় কম পোড়াতে হয়নি, তারপর কাস্টমসের লোক, তারপর পুলিস– ঝামেলা কম হয়নি। আর সেই ফ্রিজে কি-না রাখা হয় এইসব অখাদ্য? ফ্রিজের তাক থেকে হাত দিয়ে লাউয়ের ফালি, পুঁইশাক ও বেগুন গড়িয়ে নিচে মেঝেতে ফেলে আসগর সেখানে সাজিয়ে রাখে ডজনখানেক কমলালেবু। আজ ২ ডজন দিয়েই সরোয়ার কবিরকে সামলানো যাবে। মা উপুড় হয়ে তরকারিগুলো তুলে টেবিলে রেখে দেয়। রেফ্রিজারেটর বন্ধ করে আসগর ফিরে তাকালে মা বলে, ‘খাবি না বাবা?’

‘ঐসব?’

‘পাগলা!’ ঘুম-ভাঙা ঘরঘরে গলায় মা বলে, ট্যাংরা মাছের তরকারি আছে, বেগুন দিয়ে রাঁধা, পুঁইশাকের চচ্চড়ি আছে, ভাত খা।’ এসব আসগরের প্রিয় খাদ্যের অন্তর্গত। কিন্তু মেনু শুনে রাগে দুঃখে তার গা জ্বলে যায়। মায়ের দিকে তাকায় না পর্যন্ত।

গোলাম হোসেন ভয়ে ভয়ে ছেলের তড়পানি দ্যাখে। তার রোগা কালো শরীরে ভয়টা বড়ো স্পষ্ট। বাপের এই ভয় আসগর অনুমোদন করতে পারে না। ছেলেকে বাপ এতো ভয় পাবে কেন? মাসখানেক আগে সরোয়ার কবিরের বাপকে দেখলো। সে একেবারে আলাদা ধরনের বাপ। কী জাঁদরেল চেহারা, বৃটিশ আমলের পাকিস্তানি আমলের হাই গভর্নমেন্ট অফিশর। ঢাকা থেকে সেকেন্ড ফ্লাইটে এলো, এয়ারপোর্টে গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলো আসগর। গাড়িতে উঠতে উঠতে জিগ্যেস করলো, ‘টুকু নিশ্চয়ই খুব ব্যস্ত? ফাইনান্স সেক্রেটারি তো এখন চিটাগাঙেই আছে?’—দ্যাখো তো কতো বড়ো ছেলে, তো তার সম্বন্ধে স্রেফ টুকু ছাড়া আর কিছুই বললো না। আর গোলাম হোসেন ঘাড় নিচু করে কেমন মিনমিন করে, ‘বাবা সিমেন্ট তো পাওয়া যাচ্ছে না, আজ সারাদিন ঘুরলাম।’

‘পাওনি?’

‘না। নতুন ঘরের ফ্লোরের কাজ বন্ধ, মিস্ত্রীকে বসিয়ে রেখে খালি খালি পয়সা দেওয়া হলো।

আসগর জানে বাপের দুটো কথাই ডাহা মিথ্যা। সিমেন্টের খোঁজই সে করেনি, সিমেন্ট পেলে তো পয়সা যেতো নিজের গাঁট থেকে আর মিস্ত্রী সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করলেও মজুরি দিতে তার বুকটা ছিঁড়ে যায়, আর সে কি-না বসিয়ে রেখে মিস্ত্রীকে পয়সা দেবে? অতো সোজা? তবে বাপের এই মিছে কথা বলার জন্য তার ওপর রাগ করার সুযোগ পেয়ে আসগর খ্যাক করে উঠেলো, ‘খালি খালি দণ্ড দাও কেন? সকালে না করে দিতে পারলে না?’

গোলাম হোসেন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলে তৃপ্ত আসগর স্বর নামায়, ‘তুমি সিমেন্ট পাবে কোথায়? সোমবার এগারোটার দিকে কালীবাড়িতে ইয়াজউদ্দিনের দোকানে যেও। বলা থাকবে। আমার নাম বললে পঁচিশ বস্তা সিমেন্ট ছাড়বে।

‘দাম?’ গোলাম হোসেন অন্যদিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করে। ইস! লোকটার ছোটোলোকামির কোনো সীমা নাই! ‘আগেই দেওয়া থাকবে।’

‘ঠেলাগাড়ি করে আনবো তো?’ গোলাম হোসেনের এই উদ্বেগের জবাবে হিপ-পকেট থেকে ১০ টাকার ৩টে নোট টেবিলে ছুড়ে রাখে আসগর। সকালবেলা সরোয়ার কবির ১০০ টাকার হিসাব চাইলে একটু মুশকিল হবে। টাকা দিয়ে হিসাব চাইবার লোক অবশ্য সরোয়ার কবির নয়। কিন্তু করবে কী এরপর ২/৩ দিন এটা আনতে বলবে, ওটা আনতে বলবে, তবে টাকা দেবে না। মানে, মনে মনে শালাদেরহিসাবপত্তর সব ঠিকই থাকে। এই টাকাটা কীভাবে ম্যানেজ করা যায় ভাবতে ভাবতে চেয়ারে ডান পা রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আসগর কমলালেবুর খোসা ছাড়ায়।

‘ভাত খা। এখন লেবু খেলে ভাত খেতে পারবি না।’ মার এইসব বাঙাল মার্কা কথাবার্তা সে আর কতো সহ্য করবে? এদের ধারণা গাদা গাদা ভাত না গিললে খিদে মেটে না। সরোয়ার কবিরের বৌ কেমন দিনের পর দিন ভাত না খেয়ে কাটায়, তাতে কি তার শরীর ভেঙে পড়েছে, না আরো সুন্দর হয়ে উঠছে? সরোয়ার কবির যে বলে, ঠিকই বলে, ডেফিনিট এইম না থাকলে লাইফে কিচ্ছু করা যায় না। স্লিম হওয়া হলো জেসমিন কবিরের জীবনের আকাঙ্ক্ষা, তার চিন্তাভাবনা, তার সুখ-দুঃখ; বলা যায় তার দর্শন—সবই একটি অভিন্ন কেন্দ্রের দিকে ধাবমান—ক্লাবে পার্টিতে সোসাইটিতে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলা। এজন্য তাকে কিছু খেসারত তো দিতেই হবে। খাওয়া কন্ট্রোল করা তো আছেই, যখন তখন ঘুম পেলেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলে চলবে না, ঘুম পেলেও নয়, সেক্‌স ফিল করলেও নয়। ক্ষুধা নিদ্রা কাম — সবরকম স্পৃহা জয় করার জন্য ওদের ঐ সাধনা এই রিটায়ার্ড পোস্ট মাস্টার আর তার বৌ কি কল্পনাও করতে পারে? না। এরা সব সংশোধনের অতীত। আসগর ১টি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, না, এদের সঙ্গে বকবক করে লাভ নাই। বাইরে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে চোখ কুঁচকে বাবার ময়লা বেনিয়ানটা দ্যাখে এবং চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘এসব যে কী পরে থাকো? এতো সব দামি স্লিপিং স্যুট এনে দিই, সেসব কবরে নিয়ে যাবে?’

সরোয়ার কবিরের ড্রয়িংরুমে তখন কেউ নাই। দারোয়ান গেট খুলে দেওয়ার সময় আরগস একটু ঘেউঘেউ করলেও আসগরকে চিনতে পেরে ফের শুয়ে পড়ে। এখন কমলালেবু ভেতরে পাঠায় কী বলে? আসগর কয়েকবার গলা খাঁকারি দিলো, আবদুলের নাম ধরে কয়েকবার ডাকলো, কোনো সাড়া নাই। বেশি জোরে ডাকতেও ভয় হয়, কী জানি কারো ঘুম ভেঙে যায়। সায়ের কি রাগ করলো? মাদারবাড়িতে না গেলেই হতো। মেমসায়েব না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে তার প্রতিক্রিয়া কতোরকম হতে পারে। যেমন খালি পেটে ভালো ঘুম হওয়া অসম্ভব। ভালো ঘুম না হওয়া মানে হ্যাংওভার। হ্যাংওভার মানে বদমেজাজ। বদমেজাজ হলে হাজব্যান্ডের ওপর একচোট ঝাড়া। তার মানে সরোয়ার কবিরেরও মেজাজ খারাপ। তাহলে আসগরের অবস্থাটা কী দাঁড়ায়? ম্যাকডোনাল্ড এ্যান্ড রবিনসনের কাজটা সম্বন্ধে কাল একবার মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলো, তা সায়েবের মেজাজ শরিফ ঠিক না থাকলে আর কথা বলবে কী করে? ঐ কোম্পানির কাজটা বাগানো এমন কিছু নয়, সরোয়ার কবির ১ বার কি বড়োজোর ২ বার টেলিফোন করলেই হয়ে যায়। এরা টাকা পয়সা মেলা এদিক ওদিক করছে, চুরি করার যাবতীয় সীমা পার হয়ে গেছে, সরোয়ার কবির এদের ওপর দারুণ চটা। ওদের ১জন ডিরেক্টর নানাভাবে তোয়াজ করার চেষ্টা করছে, সরোয়ার কবিরের পেছনে খুব ঘুরছে, সরোয়ার কবিরও বেশ ঘোরাচ্ছে। যতোই ঘোরাবে কমিশন ততোই বাড়বে। মোক্ষম সময় যাচ্ছে এখন, ইচ্ছা করলে আসগরকে এখনই কাজটা পাইয়ে দিতে পারে। সরোয়ার কবির আসগরকেই বা এভাবে নাচাচ্ছে কেন? আসগর তো তার জন্য কম করে না। মধ্যরাতে কমলালেবু জোগাড় করে আনা তো কোনো ব্যাপারই নয়, কতো রিস্কি কাজ করে দিচ্ছে তার হিসাব দেবে কে? বড়ো বড়ো ফার্ম সরোয়ার কবিরকে যে কমিশন দেয় তার মধ্যে ইন-কাইন্ড যা আসে তার শতকরা ২৫ ভাগ আজকাল ট্যাকল করে আসগর। কোনো কোনো জিনিস আনতে হয় সোজা পোর্ট থেকে। এসবে খাটনি কী কম? খাটতে আসগরের আপত্তি নাই, ঝুঁকি নিতেও সে পেছপা হয় না। তা একটা ভালো চাকরি ম্যানেজ করে না দিলে কি পোষায়? কয়েকদিন খুব ঝোলালো, মস্ত কোম্পানি, আড্রিয়াটিক-বেঙ্গল বে লাইনে কনটেনার সার্ভিস, বেতন মেলা, তার ওপর আন্ডারওয়ার্লড বিজনেসের হেভি কমিশন + কুলশিতে ফার্নিশড ফ্ল্যাট। ফার্নিশড মানে খালি খাট পালং আর চেয়ার টেবিল নয়, এর ওপর রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন, ইউটেনলিসলস, কিচেন গ্যাজেটস, এমন কি প্রতিবছর কয়েক সেট করে বিছানার চাদর, বেড কভার, পর্দা—সব, সব। চাইলে এ্যালসেশিয়ান জোগাড় করে দেবে। কাজটায় ঝুঁকি আছে; শতকরা ৭৫ ভাগ কারবার স্মাগলড গুডস নিয়ে, ধরা পড়লে কোম্পানি সম্পূর্ণ প্রোটেকশন নাও দিতে পারে। তা অতো সুযোগ দেবে আর সে এটুকু করতে পারবে না? কিন্তু কাজটা জুটলো কোন মিনিস্টারের শালা না ভাইপোর। অথচ মন্ত্রীর আত্মীয় কি আর সরোয়ার কবিরকে এরকম সার্ভিস দেবে? একেকবার আসগরের মনে হয়, দুত্তোরি! সব ছেড়েছুড়ে চলে যাবে। কোনো ফার্মে ছোটোখাটো চাকরি সে নিজেও কি জোগাড় করে নিতে পারে না? পারে। কিন্তু তাহলে কি পাঁচলাইশ কি কুলশিতে ফার্নিশড বাড়িতে থাকা যাবে? ইহজীবনে নয়। কখনো কখনো ভাবে, পোর্টের অন্ধিসন্ধি তার যা রপ্ত হয়েছে তাতে নিজেও বেশ করে খাওয়া যায়। কিন্তু তখন আবার ফেঁসে যাওয়ার চান্স থাকে। রিস্ক সে নিতে পারে বটে, কিন্তু মাথার ওপর কেউ না থাকলে চলে না। তাছাড়া এরকম ভাবাটাও তার অন্যায়। কবির ভাই না থাকলে এতো লোকজন, এতো ট্রিকস, এতো পথঘাট না, কিছুই তার জানা হতো না। কবির ভাইকে শেষপর্যন্ত ধরে রাখতেই হবে। লেগে থাকলে কী না হয়? কাল খুব ভোরে উঠেই এ্যালসেশিয়ানটা নিয়ে আসগর খেলবে। সরোয়ার কবির সেই সময় লনে কিছুক্ষণ ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইস করে। তখন কি ম্যাকডোনাল্ড এ্যান্ড রবিনসনের কথাটা পাড়বে? না না তা হয় না। আরগসকে আদর করে তখন সরোয়ার কবিরের ইমপ্রেশনটা জাস্ট ভালো করা। ব্যস, দিস মাচ। সায়েবকে তখন শুধু খুশি করা। কথাটা বলবে সরোয়ার কবির যখন অফিস যাবে তার আগে আগে। সবচেয়ে ভালো হতো ড্রাইভার ব্যাটাকে ২০টা টাকা গছিয়ে দিয়ে মেয়ের অসুখের নাম করে সকালবেলা ছুটি নেওয়াতে পারলে। তাহলে সরোয়ার কবিরকে গাড়ি ড্রাইভ করে অফিসে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায় আসগর, ঐ সময় ভালো করে পটানো যায়। ড্রাইভারের কাছে একটু ছোটো হতে হয় বটে, তবে ঐ চাকরি পেলে এরকম কতো ড্রাইভার তার পায়ের নিচে গড়াগড়ি যাবে। পরিকল্পনাটি পরিষ্কার হলে আসগরের ছটফটানি কমে, ফলে ঘুমটা নামে একেবারে ঝেপে।

‘আরগস! আরগস! নটি বয়।’ ডাক শুনে আসগর লাফিয়ে উঠে দ্যাখে, পৌনে সাতটা বেজে গেছে। জগিং শেষ করে, ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইস সেরে লনে আরগসের সঙ্গে বল নিয়ে লোফালুফি করছে সরোয়ার কবির। ইস! আসগরের সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেলো। কী আর করে, হাত কচলাতে কচলাতে সে লনে এসে দাঁড়ায়। হাতের কাজ অব্যাহত রেখে সে বলে, ‘কাল বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিলো, চকবাজার গেলাম, তো দেখি একটা দোকানও খোলা নেই, রিয়াজউদ্দিন বাজারে কেউ দোকান খুলতে চায় না। মহাবিপদ! কমলালেবু কোথায় পাই? ওদিকে নিউ মার্কেটে—’ ‘কমলালেবু?’ এই প্রশ্নবোধক শব্দটি উচ্চারণ করে সরোয়ার কবির ফের মনোযোগ দেয় আরগসের দিকে। কিন্তু আসগরকে দ্যাখার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আরগস চঞ্চল হয়ে ওঠে এবং ল্যাজ নাড়তে নাড়তে বারবার কেবল তার দিকেই তাকায়। ‘আরগস মনে হয় তোমাকেই লাইক করে। সরোয়ার কবির এই কথা বললে আসগরের ভালো লাগে। খুব ভালো খবর, কিন্তু কমলালেবুর ব্যাপারটা তো স্পষ্ট করা যাচ্ছে না। তার এতো কষ্ট, এতো পরিশ্রম, এতো সাহস—সরোয়ার কবির কি কিছুই জানবে না? কমলালেবু না পেলে মিসেস জেসমিন বি কবির — বুড়োধাড়ি মাগীটা অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে— সেই ক্ষোভটিও তো সরোয়ার কবির প্রকাশ করতে পারে! কিংবা কমলালেবু না পেয়ে শেষপর্যন্ত ফিগারের ব্যালান্স নষ্ট হওয়ার মস্ত ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তাকে আপেল খেতে হয়েছে—এটা জানতে পারলেও আসগরের টেনশন একটা আকার পায়। এই সব সম্ভ্রান্ত, মহামার্জিত ও ক্ষমতাবান লোকদের নিয়ে আসগরের হয়েছে শতেক জ্বালা। এখন চাকরির কথাটা তোলে কী করে?

সরোয়ার কবির বলে, আরগসের মিলটা বাড়াতে হবে, কেমন ডাল হয়ে যাচ্ছে, দেখছো? খুব উইক।’

‘জি। আবদুলকে বলে দেবো, দুধটা বরং বাড়িয়ে দিক।’ আসগর জিভ নাড়ে বটে, কিন্তু আরগসের খাবার বাড়িয়ে দেওয়া অতো সোজা নয়। পরশু এই নিয়ে জেসমিনের সঙ্গে সরোয়ার কবিরের একটু তর্কমতোনও হয়ে গেলো। আরগসের খাবার বাড়িয়ে দেওয়া দরকার সরোয়ার কবির এই কথা বলতেই জেসমিন প্রতিবাদ করে, বডি স্লিম না হলে এ্যালসেশিয়ানের সঙ্গে দেশি কুকুরের আর পার্থক্য কী? বেশি খেলেই খালি বসে বসে হাই তুলবে।

‘দিস ইজ আ সিলি আইডিয়া। শোনো, খাবার কষ্ট দিলে কোনো প্রাণীরই শক্তি বাড়ে না।’

‘না, তোমাকে বললো কে? মডার্ন মেডিক্যাল সায়েন্স বলে, কক্ষনো পেট ভরে খাওয়া উচিত না, পেট ভরে খাওয়া মানেই হাঁসফাঁস করা, কোনো কাজে মন দিতে না পারা।’

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্বন্ধে স্ত্রীর ব্যুৎপত্তি নস্যাৎ করার জন্য সরোয়ার কবির হাসে, বাজে কথা। ব্যালান্সড ডায়েট মানে কি কম খাওয়া? যা দরকার তা তো খেতেই হবে। তবে বাউয়েলস ক্লিয়ার হওয়া চাই। লোডিং আর আনলোডিং সমান গুরুত্ব পাবে।

‘রাস্টিক। কথায় কথায় কোষ্ট নিয়ে কথা তোলা জেসমিন কবিরের রুচিতে বাধে। কিন্তু সরোয়ার কবিরের প্রধান বিবেচনা আবার এটাই। সকালবেলা কোষ্ট পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত সে অবিরাম সিগ্রেট টানে, এমন কি তার ভোরবেলার জগিং ও ব্যায়ামের অন্যতম উদ্দেশ্য তার পাকস্থলি পরিষ্কার করা। একদিন লনে বসে এক বন্ধুর সঙ্গে সরোয়ার কবির এই নিয়ে আলাপ করছিলো, আসগর শুনে ফেলেছে। সরোয়ার কবির বলছিলো, ‘সকালবেলা জগিং করতে না পারলে পেটের মধ্যে ট্র্যাফিক জাম, সারাটা দিন মাটি। এ্যাট এনি কষ্ট আই মাস্ট গেট মাই স্টমাক ক্লিয়ার বাই সেভন থার্টি ইন দ্য মর্নিং।

‘বৃষ্টি টিষ্টি হলে জগিং করো কী করে? প্রবলেম হয় না? বন্ধুর এই উদ্বেগে সরোয়ার কবির কৃতজ্ঞতার হাসি ছাড়ে, তাকে নিশ্চিন্ত করার জন্য বলে, ‘সে এ্যারেঞ্জমেন্টও আছে।

‘কী রকম?’ বন্ধুর কৌতূহলকে জিইয়ে রেখে সরোয়ার কবির ধীরেসুস্থে সিগ্রেট ধরায়। কৌতূহল মেটাবার জন্য আসগরকেও গেটের কপাট অকারণে বন্ধ করতে হয়, ওখানে থাকার জন্যে তার ছুতা তো চাই।

ঘুম ভাঙলে বিছানায় শুয়ে শর্ট একটা ইন্টারকোর্স সলভস ইওর প্রবলেম। কয়েকটা স্ট্রোক দিলেই তলপেটে চাপ পড়বে, এরপর রেগুলার ডোজ অফ থ্রি সিগারেটেস এ্যান্ড ইউ গেট ইওর বাউয়েলস ক্লিয়ার।’

‘তা সাত সকালে তোমার ওয়াইফ এ্যালাউ করবে কেন?’ বন্ধু হেসেই অস্থির, ‘তুমি না বলো শি ইজ আ লেট রাইজার।’

‘শি ইজ।’ সরোয়ার কবির ঠোঁট টিপে হাসে, এই হাসিও এরকম ডাঁটেফাটে না থাকলে ঠিক রপ্ত করা যায় না। ঐ হাসিই প্রসারিত করে বলে, ‘একটু ট্রিক খাটাতে হয়। ভোরবেলা ঘুম থেকে না উঠেও যে এক্সারসাইস করতে পাচ্ছো এতেও তোমার ফিগার স্লিম থাকবে। এক নম্বর সাঁতার আর দুই নম্বর সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স ইন দি আর্লি মর্নিং— আইদার অফ দিজ টু কিপস্ ইওর ফিগার স্লিম।–ব্যস, এই থিওরিতে কাজ হয়।’

এই পশ ধরনের হিউমার আসগর যে কবে করতে পারবে এই ভেবে এখন সে একটু উতলা হলো। তো সেদিন তো ‘রাস্টিক বলে জেসমিন কবির ভেতরে চলে গিয়েছিলো, আজ স্বামী-স্ত্রীর মতানৈক্যের কথা মনে করে আসগর বললো, ‘বেশি খাওয়ালে আপা আবার রাগ করতে পারে।’

‘তোমার আপার কথা বাদ দাও। ওর মিল বাড়াতেই হবে। একটু ছোটাছুটি করলেই খাবারটা হজম হবে, এজিলিটি বাড়বে। এ্যালসেশিয়ানস আর অলওয়েজ নিম্বল-ফুটেড। মাই আরগস ইজ রাদার স্লো। ওর প্রপার নিউট্রিশন হচ্ছে না।’

আসগর বলে, ‘আজ ওর খাবার সময় আমি দেখবো।’

‘একটু দেখো তো। কুকুরের যত্ন নিলে মানুষ ছোটো হয়ে যায় না।’

‘না না তা কেন?’

‘কুকুরের মতো বন্ধু কি হয়? আমি কয়েকদিন বাইরে কাটিয়ে এলে আরগন কীভাবে রি-এ্যাক্‌ট করে দ্যাখো না? যতোবার বাইরে থেকে এসে ওর জুভিল্যান্ট মুড দেখি ততোবার আমার মনে হয় ওর নাম রাখাটা খুব এ্যাপ্রোপ্রিয়েট হয়েছে।

সরোয়ার কবির লনে চেয়ারে বসে একটু পা দোলায়, আরগস শুয়ে শুয়ে সামনের ডান পা দিয়ে মাছি ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করে। রোদ ছড়িয়ে পড়ছে লনে, রোদের সীমানা মিনিটে মিনিটে বাড়ে। কচি রোদের আলোয় শিশির-ভেজা সবুজ ঘাসে মোড়ানো টিলাগুলো ঝকঝক করে। আসগর এই পরিবেশের সুযোগ নিতে চায়, ‘এহসানুল হক সায়েবকে আমার কথা বলেছিলেন?’

‘ম্যাকডোনাল্ড রবিনসনের হক? ওদের থাকতে দিই কি-না দ্যাখো! ব্যাটারা কোটি কোটি টাকার বিজনেস করবে আর গভমেন্টকে ট্যাক্স দেওয়ার কথা তুললেই ধানাই পানাই। কী করে বিজনেস করে আমি দেখবো। সে ফের আরগসের প্রসঙ্গে ফিরে আসে, এরকম হয়েছিলো অডিসিতে। অডিসিউস যখন ইথাকায় ফিরে আসে—’ একটু থেমে বলে, ‘অডিসির নাম শোনো নি?’

নামটা আসগরের চেনা চেনা ঠেকে, কোন জাহাজের বিজ্ঞাপনে দেখেছে, সাহস করে বলে, ‘কোনো শিপের নাম বোধ হয়, না? এ্যামেরিকান লাইনার?’

‘শিপ! শিপ! শিপ! তুমি একটা আস্ত শিপ, বুঝলে? এন এইচ ডবল ই পি। অডিসির নাম শোনোনি, বি এ পাস করেছো কীভাবে? বিরক্ত হয়ে সারোয়ার কবির চুপ করে। আসগর কী আর বলবে, বি এ যে কীভাবে পাস করেছে সে বিবরণ না দেওয়াই ভালো।

‘এই যে সকালবেলা উঠেই মাস্টারি শুরু করেছো?’–বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলে জেসমিন কবির, সুযোগ পেলেই মাস্টারি।’

‘আরে তোমার ঘুম ভেঙে গেছে? সো আর্লি?’

‘যে লেকচার শুরু করেছো, এর মধ্যে ঘুমুই কী করে? ইস! এতো মাস্টারি করতে পারো!’

মাস্টারির কথায় কাজ হয়। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে সরোয়ার কবির সেই প্রথম যৌবনে বছরখানেক কোনো কলেজে ইংরেজি পড়িয়েছিলো, তারপর সি এস এস পরীক্ষা দিয়ে চাকরি নিলো, তারও বছর দুয়েক পর বিয়ে করলো। কোনো বইয়ের রেফারেন্স দিয়ে কথা বললেই সেই কবেকার মাস্টারির কথা তুলে জেসমিন এমন তীক্ষ্ণ গলায় ঠাট্টা করে যে সরোয়ার কবিরকে সঙ্গে সঙ্গে ক্ষান্ত দিতে হয়। মহিলা আসায় আসগর হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কৃতজ্ঞতায় সে জিভ নাড়ে, আপা, কাল আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, কমলালেবু আনতে আমার একটু দেরি হয়ে গিয়েছিলো। তো অতো রাত্রে দোকানপাট তো সব—’

‘ও মা, কমলালেবু এনেছিলো?’ জেসমিন কবির কলকল করে ওঠে, স্বামীর দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ‘আর তুমি আমাকে একগাদা আপেল খাইয়ে দিলে, এ্যা?

‘তোমার ঘুম পাচ্ছিলো, তাই এক স্লাইস আপেল খেতে বললাম।’

‘তা একটু ওয়েট করলেই তো পাওয়া যেতো। তুমি কখন এসেছো আসগর।’ সুযোগটির সদ্ব্যবহার করতে আসগর ব্যস্ত হয়ে পড়ে, দুটো আড়াইটে বেজে গিয়েছিলো। অতো রাত্রে কোথাও দোকান খোলা নেই, চকবাজারে সব বন্ধ, চকবাজার থেকে রিয়াজউদ্দিন মার্কেট –সব বন্ধ। আগ্রাবাদে কর্ণফুলী মার্কেটেও দোকান খোলা নেই। কী আর করি, শেষপর্যন্ত ফের রিয়াজউদ্দিন মার্কেটে—’।

কিন্তু তার এই কর্মতৎপরতায় জেসমিন কবিরের কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। তার টার্গেট এখন সরোয়ার কবির, ‘টেল মি সরোয়ার, আমার ওয়েট বাড়লে কি ফিগারটা বেঢপ হলে হাউ ডাজ ইট হেল্প ইউ?’ স্ত্রীর এই মারাত্মক অভিযোগে সরোয়ার কবির বিচলিত না হয়ে খাদ্য, পরিপাক ও কোষ্ট পরিষ্কার সম্বন্ধে তার বক্তব্য ঝড়ে, আমি বলি যদি ডাইজেস্ট করতে পারো তো যতোই খাও না বড়ি ঠিক থাকে। নিয়মিত এক্সারসাইস করো, জাস্ট ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ, আর বাউয়েলেস ক্লিয়ার হলে।’

‘ননসেন্স!’

জেসমিন কবির উঠে ভেতরে চলে গেলে সরোয়ার কবির বেশ জড়সড় হয়ে পড়ে। এখন উঠে বৌয়ের পিছে পিছে গেলে এক ধরনের আত্মসমর্পণ হয়, আসগরের সামনে ব্যাপারটা ঠিক হবে না। অথচ এখন যাওয়াটা তার খুবই জরুরি। এতোক্ষণ ২টো সিগ্রেট শেষ করেছে, ৩ নম্বরটি ব্যবহার করবে টয়লেটে ঢুকে। ঠিক সময়মতো ঢুকতে না পারলে স্টমাক ক্লিয়ার হবে না। তাহলে দিনটা মাটি। সরোয়ার কবিরের মুড অফ হলে আসগরের কথাটা পাড়বে কী করে? সরোয়ার কবিরকে সহজ করে তোলার জন্য আসগর উদ্যোগ নেয়, ‘আমার মনে হয় আরগসের বাউয়েলস ক্লিয়ার হচ্ছে না।’

‘একটু দেখলেই তো পারো।’ তেতো গলায় বলে সরোয়ার কবির ভেতরে চলে যায়। তার দামি সিগ্রেটের প্যাকেট পরে থাকে টিপয়ের ওপর। প্যাকেটটা প্যান্টের পকেটে রাখতে গেলে আসগরের পকেট থেকে তা বেরিয়ে থাকে। এই সিগ্রেট আজকাল সুযোগ পেলেই আসগর প্যাকেট থেকে ২/১ টা করে সরায়। এখন প্রায় ভরা প্যাকেট সরাতে গিয়ে তার দারুণ উত্তেজনা হয়। এর মানে কী? পোর্ট থেকে একবার গাড়িতে মস্ত টেপ রেকর্ডার নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় কাস্টমসের সেপাই তার গাড়ি দাঁড় করিয়েছিলো একেবারে ল্যাম্পোস্টের নিচে, তখনো বুক এভাবে কাঁপেনি। আস্তে করে গাড়ি দাঁড় করিয়েছিলো এমন কায়দায় যাতে আলো পড়ে তার মুখে, পেছনের সিটে ছায়া পড়ায় মালটা দ্যাখা যাচ্ছিলো না। আর ঐ সেপাই ব্যাটার চোখের মণিতে এমনভাবে তাকিয়েছিলো যে লোকটা বাঁকাচোরা হয়ে এ্যাটেনশন হয়ে তাকে স্যালুট দিয়ে ফেলেছিলো। মাথা বেশ ঠাণ্ডা রাখা সেই সময় চাট্টিখানি কথা নয়। তাহলে এখন এরকম হচ্ছে কেন?

অফিসে যাওয়ার সময় সায়েবের মুড অনেক ভালো, বেশ ভালো। গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আসগর, ম্যাকডোনালডের এহসানুল হক টেলিফোন করেছিলো, বিকালে আসবে, তুমি থেকো।’ নরম আওয়াজে তার গাড়ি চলে যায় আগ্রাবাদের দিকে। একটা লিফট পেলে আসগরের ভালো হতো। বাসায় মিস্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলে সে নিজেই চলে যেতো সিমেন্টের খোঁজে। দোকানদারদের সঙ্গে বাবা দামটাম নিয়ে বিশ্রীরকম খ্যাচাখেচি করে। লাভ কিছুই হয় না, ব্যাগ প্রতি ২/১ টাকা কম দিয়ে ভেজাল মেশানো মাল গছিয়ে দেয়। আসগরের খিদেও পেয়েছে অসম্ভব রকম। এদের ব্যাপার বোঝা দায়, যেদিন মুড ভালো তো গাদা খাওয়ায়। আবার দ্যাখো কাল বিকাল থেকে এ পর্যন্ত কয়েক ফোঁটা হুইস্কি আর কমলালেবুর গোটা চারেক কোয়া ছাড়া পেটে কিছুই পড়েনি। রাত্রে মা এতো করে মাছ দিয়ে ভাত খেতে বললো। মা দিনদিন রোগা হয়ে যাচ্ছে, ভেতরে ভেতরে কী রোগ হচ্ছে কে জানে? ম্যাকডোনালড এ্যান্ড রবিনসনের কাজটা পেলে খেয়ে না খেয়ে দিনরাত এখানে পড়ে থাকতে হবে না! কোম্পানির ভালো বাড়ি আছে কুলশিতে। ফার্নিশড বাড়ি, যা যা দরকার সব পাওয়া যাবে। এমন কি ফর্সা, বয়-কাট চুল, ডায়াটিং-করা, স্লিম, ন্যাকা ন্যাকা করে কথা-কওয়া ১টা বৌ পর্যন্ত প্রবলেম বাবা মাকে নিয়ে, ঐ ২ জনকে নিয়ে মুশকিল। বাবাকে এতোবার বলে, জামাকাপড়গুলো একটু ভালো দেখে পরো, তোমাকে তো আর পয়সা দিয়ে কিনতে হচ্ছে না, আমি রেগুলার সাপ্লাই দিয়েই যাচ্ছি। না, তার কেরানি মেন্টালিটি ঘোচাবে কে? আর মায়ের খাওয়ার রুচি ইম্প্রুভ করা তার সাধ্যের বাইরে। এরা সব ইনকরিজেবল। কিন্তু আসগরকে তো থাকতে হবে তার নিজের মতো করে। ঠিক আছে তোমরা নিজেদের নিয়মে থাকো, টাকা পয়সা যখন যা লাগে দেবো। টাকাপয়সা কি জিনিসপত্র নেওয়ার বেলায় তো বাছাধনদের কিছুমাত্র আপত্তি নাই, আসগর যেখান থেকে যা-ই নিয়ে আসে চুপচাপ ঘরে ঢোকায়, জিগ্যেসও করে না, এটা কোথায় পেলি বাবা? তাহলে তার মতো করে চলবে না কেন? হঠাৎ করে এতোটা রাগ হয় তার যে আরগসকে চড় মারার জন্য বাম হাতটা ওপরে উঠে যায়। পাগল! সে কি পাগল হয়ে গেলো? বুদ্ধিমানের মতো চট করে ডান হাত দিয়ে নিজের বাম হাতটা নামিয়ে নেয়। ডান হাতের চাপে বাম হাতের কব্জি লাল হয়ে গেলো।

বিকালে আসগর একটু ফিটফাট হয়ে আসে, এহসানুল হককে ইম্প্রেস করা চাই। তবে সব নির্ভর করে সরোয়ার কবিরের ওপর। আসগর যখন ঢোকে আরগসকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে আবদুল। এটা হলো আরগসের বেড়াবার সময়। ১ ঘণ্টার বেশি তাকে বাইরে রাখা যাবে না, সায়ের ফিরে এসে বরান্দায় তাকে ল্যাজ-নাড়া অবস্থায় দেখতে ভালোবাসে।

আসগর বলে, ‘আবদুল, আমার কাছে দাও।’

‘ক্যান?’

‘দাও না, একটা নতুন খেলা শেখাবো।’

‘এখন তো অর বেড়াইবার টাইম। সায়েবে অর লগে খেলে অফিস থিকা আইসা।’

‘সায়েব ফেরার আগেই আমি নিয়ে আসবো।‘

আবদুল ইতস্তত করে, ‘এই সময় ঐ যে ঐ বাড়িগুলির ঐদিকে ইটের পাঁজা, তার পারে ঝোপের মধ্যে বাহ্যি করবো। আপনে না হয় সকালবেলা খেলা শিখাইয়েন।‘

‘যা বলছি শোনো। সবই করবো।’

কিছুক্ষণের জন্য ডিউটি থেকে রেহাই পাবার ইচ্ছাও আবদুলের কম নয়। শিকলটা আসগরের হাতে সমর্পণ করে সে বলে, ‘এট্টু টাইট কইরা ধইরেন। কুত্তাটা খালি ছুইটা যাইতে চায়।’

বাইরে পা দিতে না দিতে আরগস সত্যিই ছুটে যেতে চাইছে। ইঁটের পাঁজার কাছে পৌঁছতেই ওর স্পিড দ্বিগুণ হয়ে গেলো। শিকলে কেবলি টান পড়ে। তা আসগর ধরেছেও টাইট করে, বাপধন যাবে কোথায়? এই শিকল ছেঁড়া তোমার বাপেরও সাধ্যি নয়। ওর বাপটা ছিলো কে? সরোয়ার কবিরকে জিগ্যেস করতে হবে। লোকটা জানে না হেন বস্তু নাই। এঞ্জিনিয়রদের সে সিমেন্ট-বালির অনুপাত সম্বন্ধে উপদেশ দেয়, এ্যান্টি-বায়োটিক কোথায় প্রয়োগ করা উচিত তা শিখিয়ে দেয় ডাক্তারদের, কলেজের বুড়ো প্রফেসর দ্যাখা করতে এলে তাকে প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে ক্লাসে রোলকল করার সঠিক ও আধুনিক পদ্ধতি বুঝিয়ে দিয়েছিলো। ঝাড় দারকে ঝাড় ধরার কায়দা দেখিয়ে দেয়, আইন গাইনের যথাযথ উচ্চারণ সম্বন্ধে তার এলেম জবরদস্ত আলেমদের স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। মেয়েদের পটাবার বিদ্যায় সুপ্রতিষ্ঠিত লম্পটদের সে হার মানাতে পারে, কুকুর কখন কী খেতে ভালোবাসে সংশ্লিষ্ট কুকুরদের চেয়ে সে ভালো জানে। আরগস কি এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানে যে সে হলো নেকড়ের বংশধর? কিন্তু সারোয়ার কবির জানে। এ নিয়ে আসগরের কাছে সে কতোদিন কতো পাঠ দিয়েছে। লোকটা এতো শিখলো কোত্থেকে? লাহোর সিভিল সার্ভিস এ্যাকাডেমিতে কতো ট্রেনিং দেয়, সেখানে? — নাকি প্রশাসনে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে? —এই প্রশ্নের মীমাংসা হওয়ার আগেই শিকলে হ্যাঁচকা টান পড়লে আসগর প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো, কোনোমতে সামলে নিলো। এখন বুঝতে পাচ্ছে, আরগসের বাউয়েলস আসলে ক্লিয়ার হচ্ছে না। সরোয়ার কবির ঠিকই বলে যে পাকস্থলি পরিষ্কার না হলে জীব শান্তি পায় না। আসলে ক্লিয়ার করার বন্দোবস্ত করাটা খুব দরকার। সায়েবসুবোর বাড়িতে থাকে, ওদের নিয়ম মানলেই কাজ হবে।— পকেট থেকে সকালবেলা সরোয়ার কবিরের টেবিল থেকে হাতানো সিগ্রেটের প্যাকেট বার করে ১টা ধরালো। সিগ্রেট শেষ করার পরও আসগরের হাতের মুঠিতে শিকলের কম্পন বোঝা যায়! এই সময় আরগসের উত্তেজনা হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে এই ভয় করতেই শিকলে বেশ জোরে টান পড়ে। এবার ঠিক হাঁচকা টান নয়। বেশ লম্বা ধরনের শক্ত টান। না, অতো ঝুঁকি নেওয়া যায় না। আসগর তার ডান হাতের কব্জিতে শিকলের এদিকের প্রান্ত বেশ টাইট করে জড়িয়ে নিলো। একরকম বাঁধাই হয়ে গেলো আর কি! এবার সম্পূর্ণ নিরাপদ, এখন শালা কুত্তার বাচ্চা যদি ছোটে তো তাকে না নিয়ে যেতে পারবে না। নিশ্চিন্ত হয়ে ২য় সিগ্রেটটি ধরিয়ে গোটা তিনেক লম্বা টান দেওয়ার পর আসগরের হাতের শিকল শান্ত ও শিথিল হয়ে আসে। আসগর সিগ্রেটে বেশ কয়েকটা সুখটান দেয় আর অনুভব করে যে আরগস খুব আরাম ও তৃপ্তির সঙ্গে বাউয়েলস ক্লিয়ার করছে। শিকলের ধাতব বিনুনি বেয়ে সেই তৃপ্তি আসগরের শরীরে চমৎকার মৌতাত ছড়িয়ে দিচ্ছে। অফিস থেকে ফিরে সরোয়ার বি কবির দেখবে তার প্রিয় প্রাণীটি কতো সপ্রতিভ হয়েছে, নিম্বল-ফুটেড এ্যালসেশিয়ানের স্পিন লক্ষ করে সে মুগ্ধ না হয়ে পারে না। এ ব্যাপারে তার নিজের প্রচেষ্টা ও উদ্যোগের কথা আসগর কীভাবে প্রকাশ করবে এ নিয়ে আগেই কিছু ডায়ালগ ঠিক করে রাখা দরকার। এটা পরে করলেও চলবে। এখন রেগুলার ডোজ হিসাবে ৩টে সিগ্রেট খাওয়া উচিত, ৩ নম্বর সিগ্রেটটি ধরাতেই আসগরের হাতে শিকল শিরশির করে ওঠে এবং সে রিনিঝিনি আওয়াজ শুনতে পায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চমৎকার, আশাতিরিক্ত ক্ষিপ্রতায় আরগস তার সামনে এসে মৃদু মৃদু ল্যাজ নাড়ে। কোনো সন্দেহ নাই যে তার পাকস্থলিতে এখন শেষ-শীতের নির্মল হাওয়া বইছে। হাওয়ার তোড়ে সে এতোটা বেগে বাড়ির দিকে ছুটতে শুরু করে যে আসগরকে রীতিমতো দৌড়াতে হয়। তাড়াতাড়ি যেতে হবে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সরোয়ার কবির ঘরে ফিরবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *