অপঘাত

অপঘাত

ডুকরে ওঠা কান্নার একেকটি ধাক্কায় মোবারক আলির বন্ধ চোখের মণি কাঁপে, চোখের পাতা আলগা হয়ে আসে, তার বাঁ পায়ের পাতা শিরশির করে। দুই হাঁটুর ভেতর হাতজোড়া ভাঁজ করে ডান কাত করে শুলে বাঁ পায়ের পাতার ওপর একজিমা চুলকাবার জন্য উঠে বসার উৎসাহ পায় না। এদিকে দেখতে দেখতে কান্নার ফাঁকগুলো সব ভরে যায় এবং কান্না একটানা বিলাপে পরিণত হয়ে তার ঝুনা করোটির ভেতরকার ঠকঠক দেওয়ালে ঘনতালে বাজতে থাকে। বাজনাটা একবার বৃষ্টি বলে মনে হয়েছিলো; কিন্তু বৃষ্টিপাতের ফলে ঘরের কান্নাকাটির খবর বাইরে যাবে না—এই আশা করে একটু নিশ্চিন্ত হবার আগেই বৃষ্টির বিভ্রম কাটে। বিলাপের আওয়াজ তার আঁশের মতো চুলের গোড়ায় গোড়ায় হ্যাঁচকা টান মারে। টানাটানির ফলে চোখের ঢাকনি সম্পূর্ণ উদাম হলে মোবারক কিছুই দেখতে পায় না, ঘরে ঘনঘোট অন্ধকার। ভালো করে তাকাবার বলও তার নাই, ঘুম-ভাঙা শরীরে স্ত্রীর বিলাপ অবিরাম ঠেলা দেওয়ায় সে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তবে কি-না মুঙুর প্রতিক্রিয়ায় নিস্তেজ শরীরেও মোবারক আলি বিরক্ত হওয়ার বলটুকু পায়; এটা কি বিলাপ করার টাইম হলো? এই বয়সেও বুলুর মায়ের কাণ্ডজ্ঞান হলো না তো হবেটা কবে? ২৫০/৩০০ গজ দূরে হাইস্কুলের দালানে মিলিটারির ক্যাম্প, স্কুলের চওড়া বারান্দায় গাদা গাদা বালুর বস্তার আড়ালে থাবার মতো সব হাতে ধরা রয়েছে কতো কিসিমের অস্ত্র, মোবারক ওসবের নামও জানে না, শুনলেও তার মনে থাকে না। সপ্তাহখানেক হলো ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসটাও মিলিটারি দখল করে নিয়েছে, সে তো ১৫০ গজও হবে না। বুলুর মায়ের বুকের পাঁটা কতো বড়ো যে এইভাবে বিলাপ করে কাঁদে? মেয়েমানুষের এতো সাহস ভালো না, সব ছারখার করে ফেলবে। এই বিলাপ শুনে ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিস থেকে দুজন সেপাই এসে পড়লে মোবারক আলির ক্ষমতা হবে যে তাদের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়ায়? তারপর সেপাই, মানে সেপাই সায়েব যদি জিগ্যেস করে তোমার বৌ কাঁদে কেন?—তো সে কী জবাব দেবে? যদি বলে তোমার ছেলেমেয়ে কটা? –তখন না হয় বলা যাবে, জি দুই ছেলে, দুই মেয়ে। সঙ্গে সঙ্গে জানাতে হবে যে মেয়ে দুটোর বিয়ে হয়ে গেছে, তারা সব স্বামীদের সঙ্গে থাকে। তবে ছোটো মেয়েটা দুমাস হলো এখানে এসেছে, তিনদিন আগে সে গেছে তার মামাবাড়ি। তার মামা আলেম মানুষ, ঠনঠনিয়া মোস্তাফাবিয়া মাদ্রাসার হেড-মোদাররেস, সারা শীতকালটা ওয়াজ করে বেড়ায়, জেলা জুড়ে তার নাম। — সেপাই ধমক দিতে পারে, আরে, এতে তার বিবির কান্নাকাটির কী হলো? ঠিকভাবে কথার জবাব দাও।—তখন বাধা হয়ে বলতে হবে যে তার বড়োছেলের মৃত্যুই হলো তার স্ত্রীর কান্নাকাটির কারণ। —বড়ো ছেলে?–জি. আমার দুই ছেলে, ছোটোটা ঘরেই আছে, ক্লাস ফোরে পড়ে— সেপাই চটে যাবে, রাখোয়াজি রাখো। বড়োটা মারা গেছে? কী করতো?—জি, কলেজে পড়তো।— কলেজে পড়তো? মুক্তি ছিলো? কীভাবে মরলো? — হুজুর, অপঘাতে মারা গেছে। — অপঘাত? অপঘাত কেয়া হ্যায়?-না, মানে এ্যাক্সিডেন্ট হ্যায় না? হেঁ হেঁ। —ক্যায়সা এ্যাক্সিডেন্ট? সাচ বলো!—এরপর মোবারক আলি আর বলতে পারবে না। —জি না স্যার, জি না হুজুর, জি না মেজর সাহেব, জি না ক্যাপ্টেন বাহাদুর, আমি কিছু জানি না! — শালা তোমার ছেলে মিসক্রিয়ান্ট ছিলো? তোমার ঘরে তুমি মিসক্রিয়ান্টদের শেলাটারও দাও?—না হুজুর! — মিসক্রিয়ান্টদের কথা সে জানে না। ইউনিয়ন কাউন্সিলের কেরানি মোবারক আলি হাজার হলেও পাকিস্তান গভমেন্টের চাকরি করে, জি. তার বেতন আসে বগুড়া ট্রেজারি থেকে, মিসক্রিয়ান্টদের খবর সে রাখবে কোত্থেকে?–না, তার শুকনা এবং কাঠ-কাঠ গলা থেকে এইসব বাণী হাঁকা অতো সহজ নয়। মিলিটারির সঙ্গে কাল্পনিক বাক্যবিনিময়ের সংকল্পে তার বল তাই বাড়ে না। তার পাশে শুয়ে থাকা ছোটো ছেলে টুলু ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে কী বলে, তাতে মোবারক আলির তন্দ্রা একেবারে ছিঁড়ে যায় এবং সে উঠে বসে। এখন আর শিরশির না করলেও একজিমার খানিকটা চুলকে নেয় এবং পাশের ঘরে দেড় বছরের নাতিটা হঠাৎ কেঁদে ওঠে। তখন তার মগজের ময়লা কাটে, মোবারক আলি বোঝে যে এই একটানা বিলাপের উৎস তার নিজের বাড়ি নয়। আওয়াজ আসছে দক্ষিণ থেকে। নাতি তার ফের কাঁদে এবং মোবারকের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায় : চেয়ারম্যানের ছেলেটা তা হলে মারা গেলো!

বিকালেও সে চেয়ারম্যানের বাড়ি গিয়েছিলো। ইউনিয়ন কাউন্সিলে মিলিটারি ক্যাম্প হবার পর থেকে অফিসের টুকটাক কাজ সারতে হয় চেয়ারম্যানের বাড়িতে। বিকালবেলা চেয়ারম্যানের চোখমুখ একটু হাল্কা মনে হচ্ছিলো, শাজাহান মনে হয় একটু ভালো। না, ভালো আর কোথায়? জ্বরটা রেমিশন হচ্ছে না, তবে একটু আগে লেবু দিয়ে প্রায় এক গ্লাস বার্লি খেয়েছে। চেয়ারম্যান একটু আলাপও করলো, এখানে চিকিৎসা একেবারেই হচ্ছে না, অবস্থা একটু ভালো হলে বগুড়া পাঠাবে। চার গাঁয়ের এক ডাক্তার চেয়ারম্যানেরই কীরকম চাচাতো ভাই, একই বাড়ি, মার্চের প্রথমদিকে দিনাজপুরে শ্বশুরবাড়ি গেলো মরণাপন্ন সম্বন্ধীকে দেখতে, গোলমাল শুরু হতেই ওপারে ভাগলবা। আর সেরপুরের বীরু সান্যাল, পুরনো আমলের ন্যাশনাল পাস,–১০/১২ বছর আগেও এই গ্রামের সবাই তার কাছেই যেতো, তা শোনা যাচ্ছে বর্ডার পার হবার সময় বেয়নেটের খোঁচায় বুড়ো সাফ হয়ে গেছে।— ছেলেকে নিয়ে চেয়ারম্যান এখন যায় কোথায়? গোরুর গাড়ি করে সেরপুর পর্যন্ত না হয় গেলো, সেরপুরে জনমনিষ্যি কেউ নাই, বড়ো রাস্তায় খালি মিলিটারি, খালি মিলিটারি। তা এখানে হাইস্কুল ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে চেয়ারম্যানের একটু আলাপ হয়েছে, তবে ওদের সাহায্য চাইতে ভয় হয়, ঘরে সোমত্ত বয়সের মেয়েরা আছে, কিসের বিনিময়ে আবার কী চেয়ে বসে! তা দ্যাখা যাক, আজ তো বার্লি খেলো, অবস্থা একটু ভালো হোক, এর মধ্যে কি অনেকটা নর্মাল হবে না? দেশের অবস্থা নর্মাল হওয়ার আগেই ছেলেটা মারা গেলো? তাহলে সন্ধ্যার পর থেকে কি খারাপ হচ্ছিলো? মনসুর সরকার কয়েক বছর থেকে হোমিওপ্যাথিক প্র্যাকটিস করে, কাউকে না পেয়ে তাকে দ্যাখানো হলো, তার ডায়াগনোসিস হলো টাইফয়েড। দূর, টাইফয়েড কি দুটো সপ্তাহ সময় দেবে না? ১০/১২ দিনেই সব শেষ হয়ে গেলো? আহা! ছেলেটার মায়ের স্বর স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তার সঙ্গে ছলকে ছলকে ওঠে চেয়ারম্যানের মায়ের কান্না। এদের কান্নাকে মোবারক বুলুর মায়ের বিলাপ বলে ভুল করলো কী করে? স্ত্রীর জন্য তার মায়া হয়, শোকে বুলুর মা একেবারে কাঠ হয়ে গেলো! বৌয়ের ওপর সে মিছেমিছি রাগ করছিলো।

বিছানা থেকে নেমে মোবারক আলি ঘরের উল্টো প্রান্তে বৌয়ের বিছানার দিকে পা বাড়ায়। তক্তপোষের কাছাকাছি যেতে পা লেগে নেভানো হ্যারিকেনটা গড়িয়ে পড়ে। কেরোসিনের ঝাঁঝালো গন্ধে মাথা আরেকটু পরিষ্কার হয়। মনে পড়ে যে নাতিকে নিয়ে বুলুর মা শুয়ে রয়েছে পাশের কামরায়। এই ঘরটায় থাকতো বুলু। মোবারক আলি একটু দমে যায়, তবু অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে বারান্দা দিয়ে সে পাশের কামরায় ঢোকে। বুলুর মা বলে ওঠে, ‘আস্তে হাঁটো, টেবিলের উপরে দুধের বোতল, কাচের গিলাস!’ মোবারকের মুখস্থ। আজ ২ রাত হলো বুলুর মা এখানে শোয়, কিন্তু বুলুর খবর শোনার পর থেকে মোবারক অনেক রাত্রে পেচ্ছাব করতে বেরিয়ে একবার করে এই ঘরে বসে। অল্পক্ষণ বসে, কাঠের চেয়ারে পাছা ঠেকাতে না ঠেকাতেই উঠে নিজের ঘরে যায়। কিন্তু তার জানা আছে কোথায় বুলুর তক্তপোষ, কোথায় তার কেরোসিন কাঠের টেবিল। টেবিলে পুরনো ক্যালন্ডারের মলাট লাগানো বই, খাতা, দোয়াত, কলম কীভাবে সাজানো সব তার জানা। বিছানার দিকে এগোবার বদলে মোবারক টেবিলের বইপত্র হাতড়াতে শুরু করে। বুলুর মায়ের সাড়া পেয়ে সে বিড়বিড় করে, ‘দিয়াশলাই পাই না, দুর!’

‘বাতি জ্বালায়ো না।’ স্ত্রীর ভিজে ভিজে গলায় এই সতর্ক নিষেধ শুনে মোবারক এসে দাঁড়ায় তক্তপোষের মাথায়। মাস দেড়েক হলো প্রতিরাতে পেচ্ছাব সেরে এ ঘরে এসে ঠিক এখানেই দাঁড়িয়ে মোবারক বিছানাটা ভালো করে ঠাহর করার চেষ্টা করে। আজ তার মাথায় তন্দ্রার রেশ নাই, সুতরাং বুলুর ঢ্যাঙা শরীরটাকে এখানে শুইয়ে অন্ধকারে নয়ন ভরে আর দ্যাখা হয়ে ওঠে না। চোখজোড়া তাই ফাঁকা ফাঁকা ঠেকে এবং বিছানার ওপরকার শূন্যতা চোখের মধ্যে নুন হয়ে জমতে শুরু করলে নিজেকে সামলাবার জন্য তাকে অনাবশ্যক স্বাভাবিক গলায় বলতে হয়, ‘চেয়ারম্যানের ব্যাটা বুঝি মারা গেলো। শাজাহানের মৃত্যু-সংবাদ সম্পূর্ণ প্রকাশিত হওয়ার আগেই বুলুর মা ফোঁপাতে শুরু করে। এই ফোঁপানো হলো কোনো দীর্ঘকান্নার রেশ। বুলুর মা তাহলে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদছে। ঘুম ও তন্দ্রার ভেতর দক্ষিণপাড়ার আখন্দবাড়ির বিলাপকে যখন সে স্ত্রীর কান্না বলে ভুল করে, বুলুর মা তখনো কাঁদছিলোই। তবে বাইরের বিলাপের তোড়ে রোগা গলার কান্না চাপা পড়েছিলো। স্ত্রী বিলাপ করছিলো বলে একটু আগে তার ওপরে রাগ করায় মোবারকের যে অস্বস্তির মতো হচ্ছিলো তা এখন কেটে যায়। স্ত্রীর ওপর বিরক্ত হবার সুযোগটি সে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করে, ‘আস্তে! আস্তে কান্দো। বিপদ বোঝো না?’

চুপ করার চেষ্টায় বুলুর মায়ের কান্না আরো উথলে ওঠে। কান্নায় সম্পূর্ণ মগ্ন থাকায় এবং অন্ধকারের জন্যেও বটে, বুলুর মা স্বামীকে দেখতে পাচ্ছে না। ভয় ও রাগে মোবারক আলির চোখমুখনাকঠোঁটের ওলটপালট হবার দশাঃ বুলুর মা সারাটা জীবন কি অবুঝ মেয়েমানুষই থেকে যাবে? তার কান্না শুনে মিলিটারির ১ জন সেপাই যদি এসেই পড়ে তখন এই পুত্রশোকের ব্যাখ্যা করা যাবে কী করে? তখন কি খুঁড়তে খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়বে না? তারপর? তার পরে? তারপরের ঘটনা মোবারকের জানা আছে। তাকে ধরে নিয়ে যাবে স্কুলের দালানে, হেডমাস্টারের কামরায় এখন টর্চার সেল। মোবারক আলির মেরুদণ্ড শিরশির করে। সুতরাং টর্চার সেলের ছবি তাড়াতাড়ি মুছে ফেলার জন্য সে কাতর হয়। তার বাড়িতে ওরা নির্ঘাত আগুন ধরিয়ে দেবে। এই পুরনো মাটির বাড়ি, টিনের চাল, বাঁশের সিলিঙ—সব দাউদাউ করে জ্বলবে। আগুনের আঁচ সে এখনি অনুভব করতে পারে। তলপেটে আগুনের আঁচ লাগে। তার ভয় হয় যে লুঙিতে প্রস্রাবের ফোঁটা পড়েছে। একটু বাইরে গেলে হতো। কিন্তু এও তার জানা আছে যে বাড়ির পেছনে ভেরেণ্ডা ঝোপে বসলে গুণে গুণে ৮ ফোঁটাও পড়বে কি-না সন্দেহ। সে প্রায় চিৎকার করে ধমক দেয়, ‘চুপ করো, বুলুর মা চুপ করো। সোয়াগ দ্যাখাবার টাইম পাও না, না?’ ধমকে কাজ হয়। বুলুর মা চুপ করে। এই সুযোগে মাথা তোলে দক্ষিণপাড়ার বিলাপ। মোবারক আলি হঠাৎ খুব জোরে নিশ্বাস ফেলে তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া পাছাটিকে ধপাস করে তক্তপোষের একধারে ফেলে দিলে বুলুর মা বলে, ‘আস্তে!’ এই একটিমাত্র শব্দে স্বামীর প্রতি তার অনাস্থা বা সাময়িক অনাস্থা প্রকাশ পায়। প্রায় মিনিট দুয়েক সময় পার হলে মোবারক আলির শিরদাঁড়ায় স্পন্দন থিতিয়ে আসে এবং আপোশ-আপোশ গলা করে সে বলে, ‘চেয়ারম্যানের একটাই ব্যাটা গো।’

শাজাহানের জন্যে মোবারক আলির খারাপ লাগে। এই শাজাহান স্কুলে সাত বছর বুলুর ক্লাসমেট ছিলো, আহারে! না, স্কুলজীবনে দুজনের তেমন খাতির হয়নি। শাজাহান ছাত্র খুব ভালো, রাতদিন লেখাপড়া নিয়ে থাকে। বুলু গড়পড়তা ছাত্র, সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করেই খুশি। ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েও শাজাহানের তৃপ্তি হয়নি, আর ক’টা নম্বর পেলেই সে অনেক ভালো করতো। এই নিয়ে তাঁর আক্ষেপের আর শেষ নাই। শাজাহান বছরের ১টা মাস কোনো না কোনো রোগে ভোগে, নইলে চেয়ারম্যান কি তাকে গ্রামের স্কুলে ফেলে রাখে? শহরে তাদের কতো আত্মীয়স্বজন, জেলা স্কুলে পড়লে কেবল রোল নম্বর নয়, খবরের কাগজে তার নামও ছাপা হতো। এসএসসি’র পর শাজাহান শুনলো না, জেদ করে ভর্তি হলো ঢাকায়। বুলু গেলো বগুড়া কলেজে। অথচ, তখন থেকে দুজনের ভারী ভাব, ছুটিতে বাড়ি এলে প্রায় সারাদিন এক সঙ্গে কাটায়। শাজাহান ছেলেটি ভারী ভদ্র, বাপ-চাচাদের মতো কথায় কথায় খোচা মারা কথা বলে না। বুলুর কথা ভোলার জন্য মোবারক আলি শাজাহানের কণ্ঠস্বর মনে করার চেষ্টা করে, আহা কী অমায়িক ছেলে, দ্যাখা হলেই ‘স্লামালেকুম চাচা, বুলু বাড়ি নাই?’—আহা, সেই ছেলে কয়েক দিনের জ্বরে এভাবে। শাজাহানের জন্য শোকটা তারিয়ে তারিয়ে দেখবে, তা বুলুর মা তার দিকে পিঠ ফিরিয়ে আস্তে আস্তে ফোঁপাতে লাগলো। ছেলের শোক বহন করার চেষ্টা সে এখন করছে একা একা! মেয়েমানুষের দৌড় মোবারক আলির জানা আছে। একটু পরেই তার হাত জড়িয়ে হাউমাউ করতে শুরু করবে। কেন, ছেলেকে আগলে রাখতে পারোনি, এখন হায় হায় করে লাভ কী? বুলুটা বড্ডো বেশি বেড়ে গিয়েছিলো। মুক্তিবাহিনী করে তোরা করলিটা কী? মিলিটারি এসে গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে দিচ্ছে, মরা ছাড়া তোরা আর কী বালটা ছিঁড়তে পারিস?—রাগে মোবারক আলি মনে মনে মুখ খারাপ করে। করবে না? মিলিটারি কলেরার মতো আসে, ম্যালিরিয়ার মতো আসে। যে গ্রামে একবার হাত দেয় তার আর কোনো চিহ্ন রাখে না। গতকাল বৃহস্পতিবার গেলো, তার আগের বৃহস্পতিবার মাইল ছয়েক উত্তরে মালিয়ানডাঙায় মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা এক রাত্রির জন্য আশ্রয় নিয়েছিলো। একদিন পরে, শনিবার দিনগত রাত্রে সিঙড়া ক্যাম্প থেকে মিলিটারি এসে গোটা গোটা গ্রাম জ্বালিয়ে দিলো। প্রাইমারি স্কুলটাও বাদ দেয়নি,–তা মুক্তিবাহিনী, তোরা কী করতে পারলি? সরকার বাড়ির ল্যাংড়া জমির আলির মেয়ে আর ভাইঝিকে নিয়ে গেলো। কী ব্যাপার? না, তাদের নামে কমপ্লেন আছে।—মেয়েমানুষের নামে কমপ্লেন? –হ্যাঁ, তারা সব ইনফর্মার, মুক্তিবাহিনীকে খোঁজখবর পাঠায়। তাদের একজন ফিরে এলো দিন দশেক পর। সেই মেয়েকে নিয়ে ল্যাংড়া জমির আলি যে মুসিবতে পড়েছে, কপালে তার আরো কতো যে ভোগান্তি আছে!— গজব! গজব! গজব ছাড়া এসব কী?–চেয়ারম্যান যে চেয়ারম্যান, যে সরকারই আসুক, লোকটা ঠিকঠাক সামালাতে পারে, সবাইকে খুশি করার মতো ক্ষমতা তার আল্লার রহমতে ভালোই আছে, তো সেই চেয়ারম্যান পর্যন্ত পরশুদিন সকালবেলা মোবারক আলিকে বলে, ‘মোবারক মিয়া, ডাঙর বেটিছেলেকে বাড়িতে না রাখাই ভালো গো!’—’কেন?’— মোবারকের অজ্ঞতায় চেয়ারম্যান বিরক্ত হয়, ‘বোঝেন না? ইউনিয়ন কাউন্সিলের মধ্যে মিলিটারি ক্যাম্প করিছে, একরকম ঘরের মধ্যেই ঢুকলো, না কী কন? মিলিটারির সব মানুষ তো একরকম নয়। হাতের পাঁচ আঙুল কি এক সমান হয়? আবার এটাও কই, দুই চারটা মাথা-গরম মানুষ না থাকলে মিলিটারি চলে না।’

চেয়ারম্যানের পরামর্শে মোবারক আলি তার ছোটো মেয়েকে পাঠিয়ে দিলো সম্বন্ধীর সঙ্গে। চেয়ারম্যানও তার মেজো মেয়েটিকে সঙ্গে দিলো। মেয়েটি বেশ ফর্সা, নাকমুখ চোখে পড়ার মতো, তাই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। মোবারক আলির সম্বন্ধী নামকরা মওলানা, জেলার নামকরা মাদ্রাসার হেড মোদাররেস, গোলমালের জন্য মাদ্রাসা বন্ধ থাকায় বাড়িতেই থাকে, আল্লা আল্লা করে, মানুষকে হেদায়েত করে, সেটাই চেয়ারম্যানের ভরসা। কুদ্দুস মওলানা লোকও খুব ভালো। কোত্থেকে ভাগ্নের খবর পেয়ে বোন-ভগ্নীপতির সঙ্গে দ্যাখা করতে এসেছিলো। আহা, উপযুক্ত ভাগ্নে তার, তার ওপর কি-না খোদার গজব পড়লো, নইলে এভারে গুলি খেয়ে মরে? মোবারক আলি ফিসফিস করে জানায় যে এখানে এসব নিয়ে কথাবার্তা না বলাই ভালো। মিলিটারি খবর পেলে নির্বংশ করে ছাড়বে। তা মওলানা সাহেব জবাব দিয়ে গেছে, বাড়ি গিয়ে বুলুর নামে কোরান খতম করাবে, আরো যা যা করার সব করবে। তারপর মোবারক আলির এক কথায় ভাগ্নীকেও সঙ্গে নিলো, এমন কি জোহরার দেড় বছরের ছেলেটিকেও নিতে চেয়েছিলো। কিন্তু মেয়ের শরীরের কথা ভেবে বুলুর মা নাতিকে রেখে দিলো। পোয়াতি মেয়ে, জমির আল দিয়ে, বাঁশঝাড়ের মধ্যে দিয়ে লুকিয়ে ছাপিয়ে যাবে, কোলে বাচ্চা থাকলে বিপদ আপদে সামলাতে পারবে? জামাই ঢাকায় ব্যাঙ্কের কেরানি, বৌ বাচ্চা পাঠিয়ে দিলো, না, ঢাকায় ফুটফাট লেগেই আছে, আর এ সময়টা মেয়েরা তো মায়ের কাছেই ভালো থাকে। মায়ের কাছে আর রাখা গেলো কোথায়? আল্লা না করুক জোহরার যদি কিছু হয়! জোহারার সম্ভাব্য বিপদের কথা মনে হলে মোবারক আলির নিয়ন্ত্রণহীন শরীর আরো এলিয়ে পড়তে চায়। শরীর সামলাবার উহ্য বাসনাতেই সে বলে, ‘যাই! চেয়ারম্যানের বাড়িতে যাই। একটাই ব্যাটা! কয়টা দিন খুব ভুগলো গো! চেয়ারম্যানের বৌ এই কয়টা দিন একটা মিনিটও ব্যাটার কাছ ছাড়া হয় নাই। ব্যাটা ব্যাটা করা মনে হয় জান দিবি!’

এবার ডুকরে কেঁদে ওঠে বুলুর মা। বলকানো কান্নার জন্য প্রথমদিকে তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিলো, কিছুক্ষণের মধ্যে কান্নার স্বর নিচে নামে এবং কথা স্পষ্ট হয়, ‘সেই কথাই তো কই গো, হামি সেই কথাই কই! কোন কথা তা শোনার জন্য মোবারক আলিকে আরো কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করতে হয়, ‘দ্যাখো তো, চেয়ারম্যানের ব্যাটা, এ্যাঁ, তাই মরলো মায়ের সামনে, বাপের সামনে! মাও তো তার ব্যাটাক জান ভরা দেখ্যা লিবার পারলো! আর হারাম বুলু কোটে কার গুলি খায়া মুখ থুবড়্যা পড়া মলো গো, ব্যাটার মুখকোনা হামি একবার দেখবারও পারলাম না গো! হামার বুলুর উপরে গজব পড়ে কিসক গো? বুলু অপঘাতত মরে কিসক গো?’—এর জবাব দেওয়া মোবারক আলির সাধ্যের বাইরে। বুলুর মায়ের এই বিলাপময় প্রশ্নের খাঁড়া থেকে ঘাড় বাঁচাবার জন্য এক্ষুনি তার বাইরে পালানো দরকার। কিন্তু দরজার ফাঁক দিয়ে বোঝা যায়, ফর্সা হতে এখনো বাকি। অন্ধকারে বাইরে বেরুলেই গুলি করে দেবে। ১০/১২ দিন আগে সরকারবাড়ির এক বর্গাদার চাষা পিঠে গুলি খেয়ে মরলো পানধোয়া বিলের ধারে। বিলের কাছে তহসিন সরকারের নাবা জমিতে লোকটা ঘর করে থাকে, তহসিন সরকারের জমিতেই বর্গা চাষ করে। রাত্রে বিলের ধারে পায়খানা করতে বসেছিলো, হাইস্কুলের ক্যাম্প থেকে গুলি করা হয়। পেটে গুলি লেগে লোকটা সঙ্গে সঙ্গে শেষ। তারপর হাইস্কুলের দপ্তরি নজীবুল্লার পিঠে গুলি লাগলো, সেও রাত্রেই। নজীবুল্লা গিয়েছিলো বেলুকুচি হাটে। মিলিটারি ক্যাম্প হওয়ায় এদিককার হাটবাজার সব লাটে ওঠার অবস্থা, —গত বছরের সের পাঁচেক মরিচ ছিলো, তাই বিক্রি করতে নজীবুল্লার বেলকুচি যাওয়া। ফিরতে একটু রাত হয়েছিলো, রাত আর কতো, এই এশার আজান দিয়েছে কি দেয়নি, স্কুলের সামনে দিয়ে সে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে তো মিলিটারি তাকে হুঙ্কার দিয়ে থামতে বলে। নজীবুল্লা থামবে কি, পড়িমরি করে দৌড় দেয় সামনের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে গুলি এসে লাগে তার পিঠে। মনে হয় গুলি লাগার পরেও লোকটা দৌড়েছিলো, তার লাশ পাওয়া যায় আমিনুদ্দিন সরকারের বাঁশঝাড়ের ভেতর। আমিনুদ্দিন সরকারের ভাইপো তবারক, লাঠিডাঙার আয়নুল, পদুমশহরের হাশেম মণ্ডল, হাইস্কুলের অঙ্ক স্যার নূর মোহাম্মদ—এদের মারা হয়েছে লাইনে দাঁড় করিয়ে, স্কুল দালানের পেছনে, ছোটো ক্লাসের ছেলেরা যেখানে দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, হাডুডু খেলতো সেখানে এদের পুঁতে রাখা হয়েছে। বিলের ধারে লাশ, বাঁশঝাড়ে লাশ, স্কুলের পেছনে লাশ,–তাইতো একটা মাস যতোগুলো মানুষ পড়লো সব কটা গুলি খেয়ে মরেছে। — সব্বাই! তাই তো! সকলের অপঘাতে মৃত্যু! এমন কি পুর অঞ্চলে বিয়ে হয়েছে তার খালাতো বোন আমেনাবুবুর, সে মেলা দূর, যমুনার তীরে কেষটিয়া গ্রাম, প্রত্যেক বছর বর্ষাকাল আসে তারা নদীভাঙার ভয়ে তটস্থ হয়ে ওঠে; এবার এসেছে নদীর বাপ মিলিটারি। আমেনাবুবুর দেওরের ছেলে আলি আকবর, চন্দনবাইসা কলেজে আই কম পড়ে, তাকে গুলি করে ফেলে দিয়েছে যমুনায়। চন্দনবাইসা তহশিলদার অফিসে মিলিটারি ক্যাম্পের সামনে ছেলেটা ধরা পড়ে, তার কাছে অস্ত্র পাওয়া গিয়েছিলো। আহা, বেচারা বংশের একমাত্র ছেলে, ঐ বাড়িতে আর সবকটা মেয়ে, ছেলেটাকে খুব কষ্ট দিয়ে মেরেছে। না, না, বুলুকে কিন্তু কষ্ট দেওয়ার সুযোগ পায়নি। ধরা পড়ার আগেই ও গুলি খায়। — সেই অজ্ঞাত জায়গায় অশ্রুত গুলির শব্দে মাথাটা দুলে ওঠে, হঠাৎ মনে হয়, তাইতো, কয়েক মাস এই এলাকায়, এমন কি কোন পুব অঞ্চলে কেষটিয়া গ্রাম সেখানে পর্যন্ত — সবাই মারা গেছে গুলি খেয়ে। সব অপঘাতে মৃত্যু, স্বাভাবিকভাবে লোকে মরে না, গজব, আল্লার গজব, গজব না পড়লে মানুষের এরকম মৃত্যু হয়? চেয়ারম্যানের ভাগ্য! — তার ছেলেরই এমন স্বাভাবিক মরণ। এসব ভাগ্যের ব্যাপার! চেয়ারম্যান লোকটার সবদিকেই ভাগ্য ভালো, তার জমিতে ফসল হয় সবচেয়ে ভালো, যেবার যা বোনে সেবার তাতেই লাভ থাকে। ধান বলো, মরিচ বলো, পেঁয়াজ বলো, আলু বলো–চেয়ারম্যানের জমিতে যার ফলন ভালো সেই ফসলের সেবার দাম উঠবে। আবার দ্যাখো তিন তিনবার ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হলো, ইলেকশনে লোকটা কখনো হারে না। একমাত্র ছেলে, ছাত্র কতো ভালো, গত কয়েক বৎসর এই-স্কুল থেকে তার মতো রেজাল্ট কেউ করতে পারেনি। আবার দ্যাখো সবাই যখন এদিক ওদিকে মরছে, চেয়ারম্যানের ছেলে তখন মায়ের কোলে দোল খেতে খেতে চোখ বোজে। এটা ভাগ্য ছাড়া কী? — দীর্ঘনিশ্বাস চাপার জন্য মোবারক আলি একটু কাশে। আর বুলু — কী সুন্দর ছেলে তার, কী রকম ঢ্যাঙা হয়ে উঠছিলো, তাই না?—মাথায় মোবারক আলিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো, ও ঠিক ওর দাদার মতো হতো–সেই ছেলে, দিব্যি ভালো ছেলে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো, ৪ মাস পর খবর এলো যে সে গুলি খেয়ে মারা গেছে। কোথায়? না, সে এখান থেকে মেলা দূর! একই জেলা, তবে সে হলো পুবের পলি এলাকা। হ্যাঁ, আমেনাবুর শ্বশুর বাড়ির কাছেই হবে। গ্রামের নাম তার জানা নাই।

দেড় মাস আগে বুলুর মরার খবর পেয়ে মোবারক ভেবেছিলো যে বৌয়ের কাছে খবরটা একেবারে চেপে যাবে। তো শোনার পর কয়েকটা ঘণ্টা সে চুপ করেই ছিলো, তাও যে ছেলেটি খবর নিয়ে এসেছিলো তার বিশেষ অনুরোধে। অনুরোধ না বলে আদেশ বলাই ঠিক, যাদের হাতে অস্ত্র থাকে তারা কি অনুরোধ বাড়ির করতে পারে? ছেলেটার নাম যেন কী?–না, নামটা মনে না করাই ভালো, কাছে মিলিটারি ক্যাম্প, কখন কে এসে ধমক দিলেই মোবারক আলি তার নাম ফাঁস করে দেবে। নাম মনে না থাকলে কী হয়, তার চেহারা প্রায় ২৪ ঘণ্টাই মোবারকের সামনে দোলে। ঘন কালো মেঘের সামনে শ্যামবর্ণ একখানা মুখ। ও যখন আসে তখন বিকালবেলা। খুব মেঘ করায় অন্ধকার হয়ে এসেছিলো। মোবারক হাট থেকে ফিরছিলো পা চালিয়ে। এদিকে, এই ৫/৬/৭ মাইলের মধ্যে মিলিটারি ক্যাম্প তখনো হয়নি, তাই আকাশে জমাট মেঘ ছাড়া জোরে হাঁটার অন্য কোনো কারণ ছিলো না। ছেলেটিকে সে প্রথম দ্যাখে, বড়োমিয়ার আউশের জমির পাশে সাইকেল ঠেলে ঠেলে নালা পার হচ্ছিলো। তারপর সাইকেলে উঠে ছেলেটি তাদের গ্রামের দিকে চলে যায়। পাকুড় গাছের তলায় এসে রাস্তা হঠাৎ বাঁক নিয়েছে, ছেলেটি সেখান থেকে আড়াল হয়ে পড়লো। তার দিকে মোবারক আলি ভালো করে লক্ষও করেনি। হাটে শুনে এসেছে যে সেরপুর শহরে মিলিটারি ঢুকে বাড়িঘর তছনছ করে ফেলছে। তারপর বগুড়ায় নাকি মিলিটারির বিরাট আড্ডা। মানুষের লাশের গন্ধে নাকি টাউনে ঢোকা যায় না। আবার এরই মধ্যে কোন এক বড়ো মিলিটারি অফিসারকে মেরে ফেলেছে কারা। বর্ডারে জোর যুদ্ধ চলছে। এবার পাটের দর বাড়তে পারে। হাঁটের ভেতরেই লোকজন ফিসফিস করে এইসব আলোচনা করে। মোবারক আলি ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসের সামনে এসে পড়ে, না সাইকেলের তখন চিহ্নমাত্র দ্যাখা যায়নি। অফিসের পাকা বারান্দায় উঠে মোবারক অফিস ঘরের তালা দুটো একবার করে টেনে দ্যাখে। না, ঠিক আছে। এ পর্যন্ত ভুল তো কোনোদিন হলো না, তবু যতবার এদিক দিয়ে যাবে—তা সে জমি দেখতে হোক কি হাটে বাজারে হোক বা বিলে মাছ ধরতে হোক—বারান্দায় উঠে তালা দুটো তার পরীক্ষা করা চাই। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে একবার আকাশের দিকে মেঘের ভারটা ঠাহর করার চেষ্টা করলো। না, তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়া দরকার। বারান্দা থেকে নিচে নামছে এমন সময় অফিসের পেছন থেকে এসে ওর মুখোমুখি দাঁড়ালো শুকলু পরামানিক। শুকলুকে দেখে মোবারক ভ্রূ কোঁচকায় : এইসব চাষাভুষাদের মানুষ করা তার বাপের সাধ্যের বাইরে। এতোবার বারণ করা হয় তবু শালাদের হাগামোতা সব এই অফিসের পেছনে। চেয়ারম্যান সাহেব এতো সখ কর শেফালির চারা লাগিয়েছে, তা এদের গুয়ের গন্ধে ওদিকে উঁকি দেওয়া যায় না। কিন্তু তাকে ধমক দেওয়ার আগেই শুক বলে, ‘চাচামিয়া, একটা চ্যাংড়া আপনের ঠিকানা পুস করিচ্ছিলো। সাইকেল লিয়া

‘কেটা?’

আছে,

‘কে জানে বাপু? হামি পুস করনু তো ক’লো বুলুর সাথে কলেজত পড়ে। হামাগোরে ইঠানকার মানুষ লয় গো চাচামিয়া। হামি এক লজর দেখ্যাই বুঝিছি টাউনের মানুষ।

‘নাম পুস করিছিস?’

‘ক্যাঙ্কা কর্যা করি? এ্যানা কথা কতে না কতে সাইকোলোত উঠ্যা তাঁই হাঁটা দিলো।’

বুলুর ক্লাসমেট? মোবারক আলি যতো তাড়াতাড়ি পারে ছুটতে লাগলো। আজ ৪ মাস বুলুর দ্যাখা নাই। মার্চের মাঝামাঝি বাড়ি এলো। এখানেও তখন খুব তোড়জোড়। রাস্তায়, হাটে, বাজারে, পুকুরে ধারে খালি মিছিল। গাও-গেরামে এতো মানুষ কোনোদিন দ্যাখা যায় নাই। মানুষ যেন ফুলে ফেঁপে উঠছিলো। মানুষ হয়তো ২০টা কি ৩০টা, কিন্তু ওদের চিতানো বুক দেখে মনে হয় একেকজনের গায়ে ১০ মানুষের বল। বুলুর খাওয়া নাই, গোসল নাই, খালি এ গ্রাম ও গ্রাম করে, জোয়ান জোয়ান ছেলেদের নিয়ে প্যারেড করে, এইসব কালোকিষ্টি চাষাভুষা রাখালদের নিয়ে সে যেন জগৎ জয় করবে। ছেলেটা হঠাৎ ঢ্যাঙা হয়ে গেছে। শহরে দূর সম্পর্কের মামাবাড়িতে থাকে, কী খায়, কী পরে–অথচ দেখতে দেখতে তাগড়া জোয়ান হয়ে গেলো। মার্চের শেষে ঢাকায় মিলিটারিরা মানুষ মারতে শুরু করলো, আর বগুড়া থেকে শুরু হলো মানুষ আসা। বগুড়ায় মিলটারিকে ঢুকতে দিচ্ছে না, শহরের উত্তরদিকে ব্যাংকের দালানের ওপর পজিশন নিয়ে ছেলেরা ফাইট করে যাচ্ছে। চেয়ারম্যান একদিন এসে অভিযোগ করে, ‘মোবারক মিয়া, বুলু এই গোলমালের মধ্যে যাচ্ছে, আপনে শাসন করিচ্ছেন না? আবার শাজাহানকে খালি খালি চেতাচ্ছে, শাজাহান স্কলার ছাত্র, অর কি ইগলান করা মানায়, কন?’ তারপর আস্তে আস্তে বলে, ‘কী পাগলামি শুরু করিছে, কন তো! চং্যাংড়াপ্যাংড়ার মাথার মধ্যে পোকা ঢুকিছে! গাদাবন্দুক আর দাও কুড়াল খন্তা লিয়া মিলিটারির সাথে যুদ্ধ করবি, এ্যা?’ মোবারক আলিও এসব বোঝে। কিন্তু বুলুকে বোঝাবার আগেই সে একদিন উধাও হয়ে গেলো। ৪ দিন যায় ৫ দিন যায় তার পাত্তা নাই। খবর আসে যে বগুড়ায় মিলিটারি ঢুকে বাড়িঘর সব পুড়িয়ে দিচ্ছে। সেখান থেকে মানুষের ঢল আসে, এই গ্রামের ভেতর দিয়ে মানুষ যায়, বেশিরভাগই ভদ্দরলোক। তাদের কী সুন্দর সুন্দর মেয়ে! চশমা চোখে জুতা পায়ে হাঁটে। জীবনে গ্রামে আসেনি, তারা হাঁটতে হাঁটতে টলে, টলতে টলতে পড়ে যায়। সেরপুর থেকে মানুষ পালালো। এমন কি ব্যাংক ভেঙে টাকা নিয়ে নেতারা পর্যন্ত এই পথ দিয়ে বর্ডারের দিকে চলে গেলো। সেই টাকা দিয়ে তারা দেশ স্বাধীন করবে। কিন্তু বুলুর দ্যাখা নাই।—বাড়ির দিকে যেতে যেতে মোবারকের বুক ঢিপঢিপ করে। বয়স তো হলো, এখন কি অমনি করে ছোটা যায়? সাইকেলওয়ালা ছেলেটি হয়তো বুলুও হতে পারে। ছদ্মবেশ ধরে এসেছে। শুকলু হয়তো চিনতে পারেনি। এরকম হতে পারে না? না। —এরকম যে হয়নি সেই ক্ষোভ মোবারকের আজও কাটেনি। ছদ্মবেশী বুলুকে দ্যাখার আশাভঙ্গের দৃশ্যটি সে তাই মুছে ফেলতে চায়। শুকল পরামাণিকের কথাবার্তা বরং আরেকবার শোনা যায় না? না, তাও যায় না। এর সপ্তাহ দুয়েক পর গ্রামে যখন মিলিটারি ঢোকে, শুকলু তখন বড়োমিয়ার জমিতে কাদামাটিতে উপুড় হয়ে বীজতলা থেকে ধানের চারা তুলছে। জিপের আওয়াজে সে চমকে উঠে দাড়ায়। তার হাতে ১ আঁটি কলাপাতাসবুজ ধানগাছের চারা এবং চোখে বোকাবোকা ভয়। মিলিটারি সোজা গুলি করে তার পেটে। মিলিটারি কি বুলুরও পেটেই গুলি চালিয়েছিলো?–অন্ধকার ঘরে নাতিকে নিয়ে শুয়ে-থাকা স্ত্রীর পাশে বসে মোবারক আলি নিজের পেটে আস্তে আস্তে হাত বুলায়। পেটের বা কোণে তার বহুদিনের একটা চিনচিন ব্যথা ছিলো, আজ মাস তিনেক হলো সেটা বোঝা যায় না। নিজের পেটে গুলিবারুদ পেতে নিয়ে বুলু কি তার পেটের ব্যথা চিরকালের জন্য শুষে নিয়ে গেছে? মোবারকের মনেই থাকে না যে সাইকেলওয়ালা ছেলেটি বুলুর মৃত্যুর যে বিবরণ দিয়েছে তাতে পেটে গুলি লাগার কোনো কথা নাই। হয়তো একটু পরেই সেটা তার মনে পড়তো, কিন্তু ফের প্যানপ্যান করতে শুরু করে বুলুর মা, একবার চোখের দ্যাখাটাও দেখবার পার না গো! কোটে কোন পাথারের মধ্যে একলা একলা দাপাদাপি করা মরলো, মুখোত এ্যানা পানিও পালো না গো! হামার ব্যাটার উপরে ইঙ্কা গজব কিসক পড়লো গো? আল্লার বিচার ক্যাঙ্কা কও তো? তার মাটিও হয় না, কোটে কোন কাদোর মধ্যে পড়া থাকে, কও তো!’

‘থামো!’ মোবারক আলি ভয় পায় যে বুলুর মা এবার চ্যাঁচাতে শুরু করবে, ‘থামো! মাটি হয় নাই তোমাকে ক’ছে?’

‘তুমি একবার দেখবার গেলা না কিসক?’ বুলুর মা রাগ করে, তুমি যায়া তার কবর জিয়ারত করা আসলা না কিসক! আপাঘাতত মরছে, তো তাঁই কি তোমার ব্যাটা লয়? পাষাণ বাপ হচ্ছো, ব্যাটা তোমার লিজের পয়দা লয়?’—রাগ করতে চাইলেও বুলুর মা রাগ টিকিয়ে রাখতে পারে না। রাগ তার মুখ থুবড়ে পড়ে শোকে, শোকে এবং ভয়ে, নাতির ঘুম ভাঙার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও মোবারকের উরুর ওপর ১টি রোগা কালো হাত রেখে সে ফোঁপায়, ‘হামরা কী গুনা করছিলাম গো, হামাগোর উপরে গজব পড়ে কিসক? হামাগোর ব্যাটা অপঘাতত মরে কিসক গো?’ মোবারক আলি ভয় পায়। ছাদের ফুটো দিয়ে বাঁশের সিলিং ফুঁড়ে ঘরে আলো ঢুকছে। মোবারক জানলা খুলে দেয়, ভোরবেলার লালচে সাদা আলোয় আকাশ, গাছপালা ও মাটি যেন স্বপ্নের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসছে। ঝিরঝিরে বাতাস ঢুকে মশারি কাঁপায়। জোহরার ছেলেটা হাত পা ছড়িয়ে ঘুমায়, বাতাসের ঝাপ্টায় ঘুম গাঢ় হয়।

মোবারকের একটু ভয় হলো, তার বোধ হয় দেরি হয়ে গেলো। চেয়ারম্যানের বাড়িতে এর মধ্যেই মেলা লোক এসে পড়েছে। বাইরে আমতলায় হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসেছিলো কাবেজউদ্দিন। এদের বাড়ির পুরনো কাজের লোক, বুড়ো হয়ে গেছে, দুটো চোখেই ছানি পড়তে শুরু করছে, একটু কাছে না এলে লোক চিনতে তার কষ্ট হয়। মোবারক তার পাশে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করে, ‘কাবেজ, চেয়ারম্যান সাহেব কৈ?’ ‘তাঁই না আপনাক উটকাচ্ছিলো! চেয়ারম্যান তাকে খুঁজছিলো শুনে মোবারক আলি ঘাবড়ে যায়, তার আরো আগে আসা উচিত ছিলো। শুকনা গলা করে ফের জিগ্যেস করে, ‘সমাচার কী?’ ‘ফজরের আগে, আন্ধার থাকতে মিলিটারি খবর দিয়া চিয়ারম্যানোক লিয়া গেছিলো। তাই কলো, মোবারক মিয়া থাকলে একসাথে গেলামনি।’

দ্যাখ্যা হলে চেয়ারম্যান কিন্তু এসব কিছুই বলে না। মোবারক আলিকে জড়িয়ে ধরে লোকটা হঠাৎ বেগে কাঁদতে শুরু করে। তাকে নিয়ে মোবারক ভেতরের বারান্দার কোণে জলচৌকিতে বসায়, নিজেও পাশে বসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চেয়ারম্যান চোখ মোছে, সে আবার স্বভাবে ফেরার চেষ্টা করে। আস্তে আস্তে বলে, ‘মোবারক মিয়া, সাজু তামাম রাত খালি বুলুর কথাই ক’ছে। রাত আটটা সাড়ে আটটার সময় প্রলাপ শুরু হলো যতোক্ষণ প্রাণ ছিলো খালি বুলুর কথা কয়! যে জলচৌকিতে তারা বসেছিলো তার সঙ্গেই চেয়ারম্যানের শোবার ঘরের দরজা। সেই ঘর থেকে চেয়ারম্যানের স্ত্রীর কান্নার শব্দ আসছিলো। স্বামীর কথা কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বিলাপে সে ছেলের শেষ কথাগুলো যোগ করে, ‘খালি বুলু, খালি বুলু! তামাম রাত খালি বুলুকই ডাকে, খালি বুলুকই ডাকে। বুলুর সাথে চল্যা যামু, বুলুক কও আমাক না লিয়া যেন যায় না। ও মা, বুলুক আটকাও, আমাক ছাড়া উই গেলো।’

মোবারকের মাথা দুলে ওঠে। এই দুলুনি সারা শরীরে চালান হয়ে গেলে সে বেশ চাঙা হয়; এতোটাই চাঙা যে শাজাহান বুলুর সঙ্গে কোথায় যেতে চেয়েছিলো জানার জন্য প্রবল আগ্রহ বোধ করে। চেয়ারম্যানের বৌ এবং এই বাড়ির এক পুরনো দাসী মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত শাজাহান যা কিছু প্রলাপ বকেছে তার সবই অত্যন্ত এলোমেলোভাবে উদ্ধৃত করে চলে। শাজাহান তার বাবা মা, ভাই, বোন কারো সঙ্গে কথা বলতে চায়নি। এক ঢোঁক পানি খাবার জন্য এদিকে ওদিক তাকায়নি। একবারও বলেনি, মা, আমার মাথাটা টিপে দাও না। মউত এলে মানুষ আজরাইলকে দেখে ভয়ে চোখ বড়ো করে ফেলে, কিন্তু শাজাহানের চোখ খালি অস্থির হয়ে এদিক ওদিক ঘুরছিলো বুলুর খোঁজে; তার শুধু এক কথা, বুলুকে ডাকো, আমি বুলুর সঙ্গে যাবো। চেয়ারম্যানের বৌ জানায় যে এইসব শুনেই বুকের মধ্যে সে সঙ্কেত পেয়েছে, তার শাজাহান বাঁচবে না। -স্ত্রীর এইসব বিলাপে চেয়ারম্যান উসখুস করে, পুত্রবিয়োগ তার বিবেচনাবোধ বিনাশ করতে পারেনি। সে এখনো ভালোভাবে জানে যে, বৌডোবা খালের ব্রিজে মিলিটারি জিপ উড়িয়ে দেওয়ার পর পরই বুলুর নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে মোবারক তো মোবারক, এই গ্রামের ১টি মানুষকেও আস্ত রাখা হবে না। চেয়ারম্যান এ পর্যন্ত খবরটা গোপন রেখেছে, কিন্তু বৌকে কোন কথাটা না বলে থাকা যায়? এখন বৌকে চেয়ারম্যান থামায় কী করে? বাড়ির পাশে মিলিটারি, তাদের কানে খবরটা গেলে গ্রামে কেয়ামত ঠেকাবে কে?—কিন্তু মোবারক আলির রক্তমাংসহাড্ডিমজ্জা সব তোলপাড় করে ওঠে, বুলুর সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে শাজাহান তাহলে অস্থির হয়ে উঠেছিলো! শাজাহান আর কী বলেছিলো?–কিন্তু সে সব বিস্তারিত জানার উপায় নাই। কারণ চেয়ারম্যানের বৌয়ের বিলাপ এখন চাপা পড়েছে বুলুর মায়ের হামলানো কান্নায়। এই বারান্দারই অন্যপ্রান্তে শাজাহানের লাশ। লাশের মুখ থেকে কাপড় সরাতেই বুলুর মা চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। তার কান্না বাজে সমস্ত আওয়াজ ছাপিয়ে। এর ফলে মেয়েদের মধ্যে যাদের কান্না নিস্তেজ হয়ে এসেছিলো তারা ফের নতুন করে কাঁদতে থাকে। মোবারক আলি উঠে লাশের দিকে চলে যায়। না, বৌকে থামাবার কোনোরকম ইচ্ছা তার নাই। কাঁদবার এরকম সুযোগ বুলুর মায়ের কতোদিন জোটেনি, আবার কবে জোটে কে জানে। যতো খুশি সে কেঁদে নিক, মোবারক তাকে একটুও বাধা দেবে না। তার নিজের চোখ একেবারে খটখটে, সেই পরিষ্কার শুকনা চোখে সে শুধু শাজাহানকে একবার ভালো করে দেখবে।

মরার পরও শাজাহানের ভ্রূর মাঝখানে ছোট্টো একটা ভাঁজ। সামনের দুটি দাঁত দিয়ে চেপে ধরেছে নিচের পাতলা ঠোঁট। বুলুর সঙ্গে বৌডোবা খালের ব্রিজে গ্রেনেড মারার সুযোগ না পাওয়ার ক্ষোভ কি এখনো ভ্রুতে, গালে, দাঁতে ও ঠোঁটে বিধে রয়েছে? বুলুর সঙ্গে এর চেহারার কোনো মিল নাই–বুলু শ্যামবর্ণের, এর গায়ের রঙ ফর্সা; বুলুর গাল ভাঙা, কয়েক দিনের জ্বরে মলিন হলেও শাজাহানের গালের ফোলা ফোলা ভাবটা রয়েই গেছে। মিলিটারি জিপ উল্টিয়ে দেওয়ায় বুলু হয়তো এরকম অসন্তুষ্ট মুখ করে মরেনি। কে জানে, শাজাহানের বুকে হয়তো গুলির দাগ ২/১ টা লেগে থাকতে পারে। গুলিটা তো বুলুর বুকেই বিধেছিলো সাইকেলওয়ালা ছেলেটি তো তাই বলে গেছে। — সন্ধ্যার পর পরই সেদিন খুব চেপে বৃষ্টি আসে। এমনি অন্ধকার, তার ওপর দেওয়ালের মতো বৃষ্টি। ছেলেটির বাইরে যাওয়ার উপায় ছিলো না। সেই রাত্রেই তার চলে যাওয়ার কথা, বৃষ্টিতে আটকে না পড়লে হয়তো এতো কথা বলতো না। ওরা সব কাজের ছেলে, নিহত বন্ধুর বাপের সঙ্গে এতো কথা বলার সময় কোথায়? ছেলেটি এদিকে এসেছিলো ভবানীহাট গ্রামে, এখান থেকে মাইল দুয়েক পথ। কী কাজে আসে তা একবারো বললো না, খালি বলে ওদিকে ওদের লোক আছে। ফেরার সময় তার মনে হয় যে সুলতানদের গ্রাম তো এদিকেই, একবার ওর বাবার সঙ্গে দ্যাখা করে যাবে। সুলতান হলো বুলুর ভালো নাম, ওর কলেজে এই নামেই বুলু পরিচিত। সাইকেলওয়ালা ছেলেটি ওর এক ক্লাস ওপরে পড়ে, বগুড়া শহর মিলিটারিদের কজায় চলে গেলে ওরা একসঙ্গে পূর্বদিকের গ্রামে পালায়। ছেলেটি অনেকক্ষণ পর পর কথা বলছিলো, প্রথমদিকে খুব রেখেঢেকে, খুব সাবধানে। পরে আস্তে আস্তে সব বলে ফেলে। বুলুর মৃত্যুর সময় ওদের আরেক বন্ধুর সঙ্গে এই ছেলেটিও ছিলো। জায়গাটার নাম?–এখান থেকে সেরপুর গিয়ে সেরপুর হাটের ওখানে করতোয়া পার হয়ে যেতে হয়। ওসব জায়গা মোবারক আলি চেনে। তারপর? তারপর চওড়া কাঁচা রাস্তা চলে গেছে একেবারে যমুনার পশ্চিম তীর পর্যন্ত। যমুনার কাছাকাছি, যমুনা থেকে সোয়া মাইল কি দেড় মাইল হবে, সেখানে বৌড়োবা খাল। তারপর? ধুনট বাজারে মিলিটারির ক্যাম্প বসেছে। ধূনট থেকে আরো অনেকটা পূর্বে দেবডাঙা গ্রাম। দেবডাঙায় মুক্তিবাহিনী তখন কেবল এসে জমা হচ্ছে। ঐ গ্রামের এক দালাল শালা ধূনটে গিয়ে খবরটা পৌঁছে দেয় মিলিটারি ক্যাম্পে। তা ওরাও খবর পেয়ে যায় যে মিলিটারি এদিকে আসছে। ধুনট দেবডাঙা রাস্তায়, দেবডাঙার একেবারে কাছে বৌডোবা খাল। রাস্তা আড়াআড়ি চলে গেছে। এই খালের ওপর ছোট্টো পাকা ব্রিজ। ওরা ৩ জন মাইন পুঁততে যায় ব্রিজের নিচে। মাইন পোঁতার কাজ শুরু করবে এমন সময় জিপের আওয়াজ। জিপ যে এতো তাড়াতাড়ি আসবে ওরা ভাবেনি। সঙ্গে সঙ্গে ৩ জনেই নেমে পড়ে রাস্তার ধারে। নিচু জমি, ঘন পাটখেতে মানুষ সমান পাট। পাটখেতে ঢুকে নিশ্বাস বন্ধ করে ৩ জনেই জিপের অপেক্ষা করে। এই ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তা খারাপ, ব্রিজ কোনোমতে পার হলেই কয়েক মিনিটের মধ্যে দেবডাঙা। মুক্তিবাহিনীর ছেলেগুলো একটু তৈরি হবার সময় পাবে না। উঁচুনিচু রাস্তায় টলোমলো চাকায় জিপ যখন ব্রিজের ওপর উঠেছে, বুলু করলো কি, পাটখেত থেকে হঠাৎ করে বেরিয়ে গ্রেনেড ছুড়ে দিলো জিপ লক্ষ করে। অব্যর্থ লক্ষ। ড্রাইভারের পাশে বসা অফিসার একেবারে সঙ্গে সঙ্গে ব্রিজ ডিঙিয়ে নিচে পড়ে যায়। নিচে বৌডোবার খালে তখন ৫ হাত পানি। ডাইভার সামলাতে না পারায় গাড়ি গড়িয়ে পড়ে বিজ্রের একটু আগে রাস্তার ঢালুতে, সেখান থেকে গড়াতে গড়াতে ফের খালের মুখে আটকে গেলো। বুলু এবং সেই ছেলেটি তখন দৌড়ে যায় জিপের দিকে, রাস্তার অন্য ঢালে জিপ, সুতরাং রাস্তা ক্রস করা দরকার। ওদের এখন অস্ত্র চাই। স্টেনগান মেশিনাগান তখনো ওরা চোখে দ্যাখেনি, এই থানা টানা থেকে ছিনিয়ে নেওয়া থ্রি নট থ্রি, গাদাবন্দুক এবং দুদিন আগে পাওয়া কয়েকটা গ্রেনেড ওদের সম্বল। কিন্তু জিপ থেকে এক সেপাই যে আগেই লাফিয়ে পড়েছে তা বোঝা যায়নি। ওদের দুজনকে রাস্তায় উঠতে দেখে লোকটা গুলি ছোড়ে রাস্তার ঢাল থেকে। দুটো গুলিই লাগে বুলুর বুকে। লোকটা তারপর সোজা ছুটতে থাকে ধূনটের দিকে। কিন্তু বুলুর সঙ্গীদের রাইফেলের গুলি সে এড়াতে পারেনি। তার পায়ে গুলি লাগে, কিন্তু সে তখন অনেকটা এগিয়ে গেছে। আহত সেপাইকে ওরা ধরতে যাবে কি-না ঠিক বুঝতে পারছে না, এমন সময় ফের মিলিটারি গাড়ির শব্দ আসে। ওদের দুজনকে ফের ঢুকতে হয় পাটখেতের ভেতর। আহত সেপাইটিকে হয়তো একটি গাড়ি ঠিক তুলে নিয়েছে। তবে গাড়িগুলো ব্রিজের এখানে এসে এক পলকের জন্যেও গতি কমায়নি। কিছুক্ষণ পর দেবডাঙার দিক থেকে পাল্টাপাল্টি গুলিবর্ষণের শব্দ আসে, প্রায় মিনিট ১৫ ধরে ক্রসফায়ারিং চলে। এরপর দারুণ নীরবতা। আরো কয়েক মিনিট পর সেদিকে আগুনের মস্ত শিখা চোখে পড়ে। এর সঙ্গে সাংঘাতিক কোলাহল ও আর্তস্বর। গ্রামের লোকজনকে পালাতে হয় যমুনার দিকে, নয়তো মাঠ পার হয়ে তারা এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তাটি কেউ ব্যবহার করতে পারেনি, রাস্তার মুখে কড়া মিলিটারি। বুলুর সঙ্গী দুজন সারারাত এবং পরদিন বিকাল পর্যন্ত পাটখেতেই ছিলো। এর মধ্যে মিলিটারি জিপ বেশ কয়েকবার রাস্তা দিয়ে ধূনট-দেবডাঙা করে।

‘বুলুর লাশ?’

ছেলেটি মাথা নিচু করে ছিলো! না, না, তাকে বিব্রত করতে চায়নি মোবারক, এমনি জিগ্যেস করেছিলো। বুকে গুলি লেগেছিলো? –হ্যাঁ, দুটো গুলি। বুলু তখনো রাস্তায় সম্পূর্ণ ওঠেনি, রাস্তার অন্য ঢাল থেকে গুলি ছোড়া হয় বলে তারা কেউ সাবধান হতে পারেনি। বিপরীত ঢালে সে পড়ে যায়! — চিৎ হয়ে?–হ্যাঁ, চিৎ হয়ে। তার মাথা ছিলো নিচের দিকে, শরীরটা ওপরের দিকে।—খালের পানিতে মাথা ডুবে যায়নি? — চুলগুলো পানি ছুঁয়েছিলো।—তারপর ছেলেটা এ সম্পর্কে আর তেমন কিছু বলেনি। গুলি দুটো ঠিক কোথায় ঢোকে?–না, সে কিছুই না বলে উঠে পড়ে। বৃষ্টি তখন ধরে এসেছে, অন্ধকার ও টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে সে সাইকেলের প্যাডেলে পা রাখে। এখন শাজাহানের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে তার বুকটা এক নজর দ্যাখার জন্য মোবারক আলির চোখজোড়া নিসপিস করে।

সে নিজেও ঠিক জানে না কেন, হয়তো এই উদ্দেশ্যে কিংবা এমনি প্রতিবেশীসুলভ সৌজন্যের খাতিরে বা ওপরওয়ালা চেয়ারম্যানের মন যোগাবার জন্য বা ছেলের সহপাঠীর প্রতি ভালোবাসা — যে কোনো কারণে মোবারক আলি এগিয়ে যায় উঠানে চাদরঘেরা জায়গায়। সেখানে তখন শাজাহানের লাশ ধোয়ানো হচ্ছে। কারেজ খুব যত্ন করে সাবান মাখায় আর বিড়বিড় করে, ‘ছোটো থাকতে বড়ো দিঘিত নিয়া কতো গোসল করা দিছি, কী দাপাদাপি করিছে। এখন তাঁই একটা কথাও কচ্ছে না গো!’

নাঃ! শাজাহানের মৃতদেহে কোথাও গুলির একটি চিহ্ন পর্যন্ত নাই। ব্যাপারটা মোবারক আলির এতো স্পষ্ট করে মনে হয়নি! কিন্তু তার নিজের চোখ জোড়া বড্ডো পরিষ্কার ঠেকে। বুলুকেও ভালোভাবে দ্যাখা যায়, শাজাহানকেও দ্যাখা যায়। বুলু এবং শাজাহান সম্পূর্ণ আলাদা ২ জন যুবক। চোখের মাধ্যমে সে মাথার জট খুলতে থাকে এবং শাজাহানের শেষকৃত্যের দায়িত্ব এসে পড়ে প্রধানত তার ওপরই। চেয়ারম্যান তাকেই বলে যে একটু তাড়াতাড়ি করা দরকার, ভোর হবার আগেই স্কুল দালান থেকে ক্যাপ্টেন সাহেব তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলো। এতো চ্যাঁচামেচি কিসের? মিসক্রিয়েন্টরা কি তার বাড়ি এ্যাটাক করলো? না, তার ছেলে মারা গেছে। — তাহলে যতো তাড়াতাড়ি পারে, এই ২/৩ ঘণ্টার মধ্যেই যেন তার দাফন করা হয়। দরকার হলে তার ট্রুপ তাকে সাহায্য করবে। — সাহায্য-প্রস্তাব অনেক কষ্টে এড়ানো গেছে, এখন দেরি হলে আবার ট্রুপ যদি চলে আসে! বাড়িতে বৌ-ঝিরা আছে। জুম্মাঘরে জানাজা হয়ে গেলো বেলা সাড়ে ১০টার মধ্যে। এদের পারিবারিক গোরস্থানটা বাড়ি থেকে একটু দূরে, ৪০০/৪৫০ গজ পথ পার হয়ে যেতে হয়।

কিন্তু ইউনিয়ন কাউন্সিলের সামনে কয়েকজন সেপাই পথ রোধ করে দাঁড়ালো। এতো লোক একসঙ্গে কোথায় যাচ্ছে?–চেয়ারম্যান ছিলো মোবারকের পাশে, মোবারকের ডান কাঁধে খাটিয়ার একটা কোণ। মোবারক গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, ‘লাশ হ্যায়, খান সাব। চেয়ারম্যান সাহেবের লড়কা।’

তাদের ক্যাম্পের সামনে দিয়ে এতোগুলো মানুষের একসঙ্গে যাওয়া নিষেধ। জুম্মাঘরের ইমাম-কাম- মোয়াজ্জেন মিনমিন করে, ‘মুসলমান কা লাশ খান সাব! দাফন কা লিয়ে লে রহা। মেহেরবানি করকে।’ না, সৈন্যরা কোনো ঝুঁকি নেবে না। মানুষ যদি মরে থাকে তো তাকে দাফন করতেই হবে। যেখানে ইচ্ছা দাফন করুক, এদিক দিয়ে শবযাত্রা যেতে দেওয়া যায় না। কানুন নাই। চেয়ারম্যান এবার নিজেই এগিয়ে আসে। ভয়, দ্বিধা ও সঙ্কোচে তার শোক প্রায় মুছে যায় যায়। বাঙলা উর্দু এবং ইংরেজি মিশিয়ে সে জানায় যে রাত্রি পৌনে চারটায় তার ছেলের মৃত্যু হয়েছে। তাদের বাড়িতে কান্নাকাটির আওয়াজ পেয়ে স্কুলদালান থেকে ক্যাপ্টেন সাহেব তাকে তলব করেছিলো। সব শুনে ক্যাপ্টেন সাহেব আদেশ দিয়েছে যে যতো তাড়াতাড়ি পারে লাশ যেন দাফন করা হয়। তারই হুকুমে এরা এতো তাড়াতাড়ি এসেছে। এমন কি তাদের আত্মীয় স্বজন অনেকে এখনো এসে পৌঁছেনি। মোবারক আলি তাড়াতাড়ি যোগ করে, উনার বেটিও আসতে পারেনি। কিন্তু মেয়ের ব্যাপারটা জানাতে চেয়ারম্যানের সায় নাই। সে শুধু মিনতি করে যে তারা যদি মেহেরবানি করে। না অনুমতি দেওয়া যায় না। সৈন্যরা তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে নিজেদের মধ্যে পা মেলাতে মেলাতে ইউনিয়ন কাউন্সিলের বারান্দায় গিয়ে উঠলো। শবযাত্রীরা কী করবে বুঝতে পারে না। ওদিকে সৈন্যদের ২ জন বন্দুক তাগ করে রেখেছে এদের দিকে, এক পা সামনে বাড়ালেই সাংঘাতিক বিপদ হতে পারে। প্রায় ১০/১৫ মিনিট পর ২ জন সেপাই ফের এগিয়ে আসে, জিগ্যেস করে, ‘লড়কা? জওয়ান লড়কা? উমর কেতনা?’ ইমাম-কাম-মোয়াজ্জেন বলে, ‘জ্বি হাঁ হুজুর! আঠারো বয়স কা নওজোয়ান!’ ২ জন সৈন্যের ১ জন হাসে, অপরজন গম্ভীর মুখে যুবকের মৃত্যুর কারণ জানতে চায়। মোবারক শাজাহানের জ্বরের কথা বলে শেষ করতে না করতে সৈন্য ফের বলে, ‘সালা মুক্তি থা? গোলি খাকে খতম হুয়া?’ পেছন থেকে কারেজউদ্দিন কি বোঝে সে-ই জানে, কেবল বিড়বিড় করে, ‘তাহলে তো কামই হলোনি!

চেয়ারম্যানের ছোটোভাই আস্তে করে তাকে ধমক দেয়, ‘চুপ কর!’ এবং একই সঙ্গে ইমাম-কাম-মোয়াজ্জেন সৈন্যের সন্দেহের প্রতিবাদে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে, ‘নেহি হুজুর! বহুত আচ্ছা লড়কা থা।’ সৈন্য ২জন তেতো হাসি ছোড়ে। চেয়ারম্যান একটু এগিয়ে ফের জানায় যে সকালবেলা ক্যাপ্টেন সাহেব নিজে তাকে অনুমতি দিয়েছে, এখন তারা যদি মেহেরবানি করে তাকে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দেখাটুকু করিয়ে দেয় তো বড়ো উপকার হতো। এবার ২জন সেপাই একসঙ্গে রাগ করে এবং ২জনের রাগ ১জনের গলায় প্রকাশিত হয় দ্বিগুণ ঝাঁঝের সঙ্গে। ব্যাপ্টেন কি তাদের মতো জানোয়ার যে ইচ্ছা করলো আর তার সঙ্গে দ্যাখা হয়ে গেলো? ক্যাপ্টেন কি তার বাবার চাকর যে এত্তেলো দিলেই চলে আসবে?

এদিকে লাশ কাঁধে করে কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়। কিছুক্ষণ পর পর শবযাত্রীরা খাটিয়ার নিচে ঘাড় বদল করে। হঠাৎ খুব গুমোট শুরু হওয়ায় সবাই ঘামতে শুরু করেছে, কেউ কেউ ভাবছে এর চেয়ে রোদ ভালো। পাশের নিচু জমি থেকে পানি সরে যাচ্ছে, কিন্তু পচা ঘাসপাতা ও কাদার জমাটবাঁধা গন্ধ বাতাসের একেকটি ঝাপটায় ভালোরকম জানান দিয়ে যায়। এর মধ্যে ১জন সেপাই চেয়ারম্যানকে ডেকে নরম গলায় বলে যে এভাবে অপেক্ষা করে তাদের ফায়দা হবে না। যেখানে পারে তারা লাশ পুঁতে ফেলুক। চেয়ারম্যান রাজি হয় না। লোকটি তখন বিরক্ত হয়ে বলে, ঠিক আছে, তা হলে তার কিছু করার নাই। তবে এখানকার লোকদের তো হিন্দুদের সঙ্গেই আঁতাতটা বেশি এবং তারা একরকম হিন্দুই বলা চলে তখন ছেলের লাশ সে পুড়িয়ে ফেললেই পারে। সেনাবাহিনী দেশলাই সরবরাহ করতে প্রস্তুত।

চেয়ারম্যান কাঁদো কাঁদো মুখে শবযাত্রীদের কাছে আসে। কী করা যায়? শর কালের ফাজিল মেঘ থেকে এমন সময় পেচ্ছাবের মতো ছর ছর করে বৃষ্টি শুরু হয়। চেয়ারম্যান বলে, ‘চলো চলো, বাড়ি চলো।’ কিন্তু লাশ নিয়ে একবার বাড়ি থেকে বেরুলে আর ফেরা যায় না। সুতরাং মুশকিল হলো। ডানদিকে নিচু জমিতে কোনো বড়ো গাছ নাই। বাঁদিকের জমিও নিচু, তবে রাস্তার ঢালে ১টা শ্যাওড়া গাছ। শ্যাওড়াগাছের নিচে তেমন আড়াল হবে না, তার ওপর ঐ গাছে ভূতপেত্নীর আড্ডা, তারা আবার সব হিন্দু। কিন্তু আর কোনো উপায় না থাকায় খাটিয়া নামাতে হলো ওখানেই। চেয়ারম্যানের চাচাতো ভাই কোত্থেকে বাঁশের চাটাই এনে লাশের ওপর বিছিয়ে দেয়, কিন্তু তার আগেই শবযাত্রীদের কারো হাতের ছাতা নিয়ে লাশের শিওরে তাই ধরে বসে পড়ছে কাবেজউদ্দিন। বৃষ্টি থেমে যায় এবং দেখতে দেখতে মেঘ ও গুমোট কেটে রোদ উঠলো। রোদও ভয়ানক চড়া। মোবারকের কানের কাছে মুখ দিয়ে কাবেজউদ্দিন বলে, ‘শালার ওদের তেজ কী! ওদপানি সবই গেলো চ্যাংড়ার শরীলের উপর দিয়া! কন তো, কী গজব পড়িছে, কন তো বাপু!’

জ্যান্ত মানুষের শরীরের রোদপানির তেজ কম লাগে না। মোবারক আলির পায়ের একজিমা টাটায়, সেখানে একটু চুলকে নিলে হতো। ইমাম-কাম-মোয়াজ্জেন সায়েব তাকে একটু তফাতে নিয়ে ফিসফিস করে নতুন প্রস্তাব দেয়। লাশ নিয়ে পেছনে হটে চেয়ারম্যানদের বাড়ির দক্ষিণে বড়ো দিঘির উঁচু পাড় দিয়ে কিছুদূর হেঁটে তারপর নিচে জমির আল দিয়ে গোরস্থানে যাওয়া যায়। — মোবারক একটু ভাবে।- -হ্যাঁ, তা যাওয়া যায় বটে, কিন্তু নিচু জমি থেকে পানি এখনো সম্পূর্ণ সরে যায়নি। লাশ নিয়ে ঐ জমিতে কি যাওয়া যাবে?—কষ্ট একটু হবে, তবে জমিতে পা দেওয়া দরকার কী? আল দিয়েই তো দিব্যি হাঁটা চলে। কিন্তু সদর রাস্তা ছেড়ে পেছন দিক দিয়ে লাশ নিয়ে যাওয়ার কথা চেয়ারম্যানকে বলা যায় কী করে?

মাথার উপর রোদ গজায়। এবার আর ভ্যাপসা নয়, রোদের একেকটা শিখা শিকের মতো খুলিতে বেঁধে। ইমাম-কাম মোয়াজ্জেন সায়েব আরেকজন শবযাত্রীকে ডেকে তার প্রস্তাব বুঝিয়ে বলে। মোবারক আলির মুখে প্রস্তাবটা শুনে চেয়ারম্যানের চাচাতো ভাই মন্তব্য করে না। তবে তার সায় বোঝা যায়।

জুম্মার নামাজের সময় হলে ইমাম সাহেব জুম্মার ঘরে চলে যায়। যাবার সময় চেয়ারম্যানের হাত ধরে ডাকলো। এই ইমাম-কাম- মোয়াজ্জেন সায়েবকে চেয়ারম্যান তেমন পাত্তা দেয় না। কিন্তু আজ কী করতে হবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বলে চেয়ারম্যান সুড়সুড় করে তার সঙ্গে চললো। এমন কি শবযাত্রীদের প্রতি প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে সে ভুলে যায়। চেয়ারম্যানকে অনুসরণ করা মোবারক আলির কর্তব্য।

জুম্মার ঘর একেবারে ভরে বারান্দায় পর্যন্ত মুসল্লিদের ভিড়। গোলমাল শুরু হবার পর থেকে মানুষের নামাজপড়া খুব বেড়ে গেছে। তার ওপর আজ জুম্মার নামাজ। জুম্মার নামাজের পর এখানে কতো কথাবার্তা হয়, কিন্তু আজ সবাই খুব চুপচাপ। মোবারক আলি নামাজে উপযুক্ত মনোনিবেশ করতে পারে না। নিরাকার আল্লার জায়গায় তার চোখ জুড়ে ঝাঁঝরা-বুকে বুলুর চিৎ হয়ে থাকা লাশ। বুলুর চুল ধুয়ে যাচ্ছে খালের পানি। তার শরীর বড়ো ক্লান্ত, দেখে মনে হয় দিনমান খেটে এসে ছেলেটা না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে ডিস্টার্ব না করাই ভালো। ঘুমাক। নামাজের পরও ছেলেটা ওর চোখ ছাড়া হয় না। তা থাক না! ওর জন্য মোবারক আলির কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।

শ্যাওড়াতলায় ফিরে গিয়ে দ্যাখা যায় চেয়ারম্যানের ভাই আলিম আখন্দ মিলিটারির সঙ্গে কথা বলছে। এই সেপাই নতুন, দুপুরের পর ওদের ডিউটি বদল হয়। শবযাত্রীদের সংখ্যা খানিকটা কমে গেছে। যারা নামাজ পড়তে গিয়েছিলো তাদের অনেকেই বাড়ি গেছে খাওয়া-দাওয়া সারতে। আবার তারা নামাজ পড়তে গেলে এখান থেকে কেউ কেউ কেটে পড়েছে। নাকি প্রথম থেকেই একটু একটু করে সরছে, মোবারক আলি হয়তো খেয়াল করেনি।

না যাবার দিবার লয়!’ লাশের মাথায় ছাতা ধরে বসে কারেজ এখনো বিড়বিড় করেই চলেছে। এবার সবাই তার দিকে তাকায়। মানুষজন কমে যাওয়ায় কাবেজকে এমনিতেই চোখে পড়ছে। আপন মনে বিড়বিড় করা তার এক মুহূর্তের জন্য থামেনি। চাষাভুষা না হলে তার ঠোঁট নাড়ানোকে কলেমা পাঠ বলে মনে হতো। একটু স্বর বাড়ায় কারেজ, ‘যি মিলিটারি হুকুম দিবি, তাই বলে কড়িতলাত গেছে। চ্যাংড়াপ্যাংড়া কড়িতলার থানা বলে খাম করিচ্ছে।’

‘আস্তে। চেয়ারম্যান তাকে ধমক দেয়, ‘শালা বলদের বাচ্চা বলদ। চুপ কর!’ আলিম আখন্দ বলে যে ক্যাপ্টেন এখানে নাই। সকালবেলাতেই তাকে যেতে হয়েছে কড়িতলা। সেখানে যে কী হয়েছে আলিম আখন্দ ঠিক বলতে পারে না, তবে সাঙ্ঘাতিক একটা কিছু ঘটেছে।— চেয়্যারম্যানের ধমক খেয়ে কারেজউদ্দিনের বিড়বিড় ধ্বনি ফের খাদে নেমে এসেছে। কারেজ কী বলছে?–না, চেয়ারম্যান তখন যদি বুলুর সঙ্গে শাজাহানকে যেতে দেয় তো শাজাহানের এই পরিণতি হয় না। আজ সে ব্যস্ত থাকতো কড়িতলা থানা বিজয়-অভিযানে। শাজাহান তখন সঙ্গে গেলে বুলু কি তাকে না নিয়ে কড়িতলায় আসে!—বুলুর খবর তাহলে কাবেজ জানে না। মোবারক আলির মাথা থেকে পা পর্যন্ত ছটফট করে। মিলিটারির জিপ উল্টিয়ে ২/৪/১০ টাকে খতম করে বুলু কীভাবে মরলো—এর বিস্তারিত চলচ্চিত্র তার করোটির ছাদের ভেতর দিয়ে গলিয়ে টাকরা গড়িয়ে পড়ে শুকনা জিভের খসখসে জমিতে, জিভ সুড়সুড় করে। দাঁত দিয়ে মোবারক আলি নিজের জিভ চুলকায়

আবার ওঠো, খাটিয়া তোলো, ঘুরে দাঁড়াও, আখন্দ-বাড়ির পেছন দিয়ে ঘুরে চলো গোরস্থানে। চেয়ারম্যানের বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড় পেরোবার সময় বাড়ির মেয়েদের কান্না নতুন করে চড়ে। তাদের শোককে পরিচর্যা করার সময় শবযাত্রীদের নাই। দেরি হয়ে গেছে, অনেক দেরি হয়েছে, তাড়াতাড়ি দাফন করা দরকার। মেয়েদের দিকে দেখতে দেখতে কাবেজউদ্দিন বিড়বিড় করা অব্যাহত রাখে, ‘আম্মারা সব এখন কান্দিচ্ছেন? বুলুর সাথে তখন যাবার দিলেন না? তখন বার হয়া গেলে চ্যাংড়াটাক এতো জুলুম সওয়া লাগে?’ বলতে বলতে শবযাত্রার সঙ্গে পা চালিয়ে কাজে বাঁশঝাড় পেরিয়ে উঠে পড়ে জোড়-পুকুরের উঁচু পাড়ের ওপর।

পুকুরের পাড় আসলে একটা রাস্তার অংশ, এই রাস্তায় হাঁটতে শবযাত্রীদের কোনো অসুবিধা হয় না। এমন কি সরু ও কাঁচা পথটি থেকে নিচে নামাটাও স্বচ্ছন্দে সম্পন্ন হয়। জমিতে নামবার ঢালে পানি সরে গেছে। নিচের জমিতে আমন ধান। ভালো করে দেখলে মনে হয় ধানের সবুজ শীর্ষ বাতাসে একবার ফুলে ওঠে, একবার বসে যায়। জমিতে এখনো ইঞ্চি দেড়েক পানি। ৮/১০ দিন আগে পানি ছিলো ০.৫ হাত, বর্ষা শেষ হয়ে গেলে কমতে কমতে ১.৫ পানি সরতে সপ্তাহের পুরোটাই লাগবে।

লাশের খাটিয়া যাদের ঘাড়ে তাদের একটি সারি যাচ্ছে জমির আলের ওপর দিয়ে, আরেকটি সারিকে হাঁটতে হয় ধানজমির ওপর। মোবারক আলির কাঁধে খাটিয়ার ডান দিকের প্রথম কোণ। তার আগে আগে ইমাম-কাম-মোয়াজ্জেন সায়েব। ঐ সারির শেষ কোণ আলিম আখন্দের ঘাড়ে। তার পেছনে চেয়ারম্যান। তারপর চেয়ারম্যানের চাচাতো ভাই। এদের পেছনে লম্বা সারিতে অন্য সবাই। আর ওদিকে পাশের পঙক্তিতে খাটিয়ার প্রথম কোণ বহন করছে কাবেজউদ্দিন। তার আগে আগে চলছে চেয়ারম্যানের সবচেয়ে বড়ো বর্গাচাষী বিটলুর বাপ ও তার ছেলে বিটলু, বিটলুর কোলে তার আড়াই বছর বয়সের ন্যাংটা শিশু। ঐ সারিতে খাটিয়ার পেছনের কোণ কাঁধে নিয়েছে গুণাহারের আরজ আলি সাকিদার, লোকটি চেয়ারম্যানের ধানকলের কর্মচারী, তার সামনে খাটিয়ার নিচে হেঁটে যায় আরজ আলির ভাইপো, এই সারির সর্বশেষ ব্যক্তি হলো নিহত শুকলু পরামাণিকের ছেলে ওবায়েদ। এই সারিতে আর কেউ নাই। ধানজমিতে হাঁটা এখন রীতিমতো কঠিন কাজ। ধানগাছের ফাঁকে ফাঁকে খালি জায়গায় পা পড়লে ডুবে যায় কাদার মধ্যে। লালমাটির কাদা, এমনভাবে খামচে ধরে যে পা তুলতে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু এই সারির এরা মাঠে মাঠে কাজ করে বলে মাঠ ওদের বেশ পোষা, মাঠের নাড়িনক্ষত্র এদের মুখস্থ। ধান গাছের গোড়ার একটু ওপর এমন করে পা ফেলবে যে একটুখানি হেলে ধানগাছ অনেকটা পাপোষের কাজ করবে। কাদার কামড় থেকে এইভাবে বাঁচতে হয়। আবার দেখতে হয় ধানগাছ যেন একেবারে চিরকালের মতো শুয়ে না পড়ে। অতো দ্যাখাদেখির দরকার পড়ে না, তাদের পায়ের সঙ্গে মাঠ ও কাদার বোঝাপড়া ভালো, সহজে কেউ কাউকে ঘাঁটায় না।

সতর্ক পা ফেলতে হয় জমির আলের উপর দিয়ে যারা চলছে তাদের। জমির আল মাত্রেই দিন দিন রোগা হয়ে আসছে, এর ওপর এতোদিন বর্ষার পানির নিচে থাকায় কোথাও কোথাও ক্ষয় হয়েছে। আলের ওপর তাই হাঁটতে হয় পা টিপে টিপে। আলিম আখন্দ মাঝে মাঝে উপদেশ দিচ্ছে, ‘সাবোধান, খুব সারোধান! দেখাশুনা কদম ফালাও। কাদার মধ্যে পড়লে বিপদ হবি।’ সবাইকে সাবধান করার দায়িত্ব পালনে মগ্ন হয়ে লোকটা নিজের বাত-চুম্বিত চরণযুগলের প্রতি অবহেলা করে। কয়েক গজ মাত্র চলার পর ৭ম কি ৮ম সাবধানবাণী সম্পূর্ণ নিঃসৃত হবার আগেই তার মোটাসোটা ডান পা আল থেকে পড়ে যায় নিচে। খাটিয়ার ওপর শাজাহানের লাশ অনেকটা ডানদিকে গড়ায়। মোবারক আলির বুকে ধড়াস করে আওয়াজ ওঠে; লাশ কাদার মধ্যে পড়ে গেলো! তবে আলিম আখন্দের পায়ের পতনের সঙ্গে সঙ্গে অন্য সবার মতো সেও খাটিয়ার কোণ এবং খাটিয়ার পা দুই হাত দিয়ে ধরে ফেলে। এইভাবে শাজাহানকে পতন থেকে উদ্ধার করা হয়। আলিম আখন্দের পা পড়েছিলো একটি ধান গাছের গোড়ায়, তাই রক্ষা। তবু বেচারার পায়ের পাতায় শামুকের খোলা লেগেছে, একটু রক্তও বোধহয় বেরিয়েছে। কিন্তু খাটিয়া বহনের কাজ থেকে তাকে রেহাই দেওয়া বড়ো সহজ কাজ নয়। কারণ জমির আলের সারির কারো পক্ষে কাউকে পেরিয়ে সামনে যাওয়া কঠিন, এরকম যেতে হলে তাকে আল থেকে নেমে কাদার ওপর দিয়ে যেতে হবে। যাক, আলিম আখন্দ সামলে নিয়েছে, অন্যদের সাবধান করার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে সে এখন সতর্ক পায়ে হাঁটছে। জমিতে খসখস শব্দ। মাঝে মাঝে পানির ওপর পা পড়লে পানি ও ধানগাছের মিলিত আওয়াজ। আর আলের ওপর দিয়ে যারা চলছে তাদের পায়ের নিচে শব্দ একঘেয়ে। তবে এই সারির পুরোভাগে ইমাম-কাম-মোয়াজ্জেন সায়ের অবিরাম কলেমা পড়ে চলেছে, ফলে আলের ওপরেও বৈচিত্র্য আছে বৈ কি! মোবারক আলির ভয় হয় যে কলেমা পাঠে ইমাম সাহেবের অখণ্ড মনোযোগ নিজের কদমের প্রতি তাকে অসতর্ক না করে। এই ভয় ভালো করে দানা বাঁধতে না বাঁধতে ঘাড়ের ওপর খাটিয়া কেঁপে ওঠে, মোবারক আলির কাঁধ থেকে খাটিয়ার কোণ বলতে গেলে একটু সরেও যায় এবং সে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার বন্ধ চোখের ভেতরটা পর্দার মতো কাঁপে এবং মোবারক আলি দ্যাখে যে শাজাহানের লাশ ধান খেতের কাদায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে গড়াতে থাকে বুলুর মুখ। কোথায় কোন বৌডোবা খালের ধারে বুলুর লাশ পানিতে ভেজে। না, বুলু ছিলো চিৎ হয়ে। তার বন্ধ চোখের মণি তাগ করা ছিলো আকাশের দিকে। মিলিটারি জিপ উল্টিয়ে দিয়ে, ২/৪/১০টা মিলিটারিকে খতম করে বুলুর তখন যা তেজ তাতে চোখের পাতা টাতা ভেদ্ করে সে সব দেখতে পাচ্ছিলো।—এ দৃশ্যটি মোবারক আলি আগেই দ্যাখে এবং এটা দেখতে দেখতে তার বাম পা হড়কে পড়ে যায় জমির কাদায়। আবার এও হতে পারে যে তার পা নিচে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শাজাহানের লাশের কথা ভেবে বিচলিত হয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে এবং এই দৃশ্যটি দেখতে থাকে।

কাদা থেকে পা তুলতে মোবারক আলিকে একটু বেগ পেতে হয়। তার একজিমায় কাদাপানি লাগায় জায়গাটা বড়ো চুলকাচ্ছে। এখন সেখানে আর হাত লাগায় কী করে? কিন্তু চোখের বন্ধ পাতা ভেদ করে তাকানো বুলুর তেজি চোখজোড়া ঝেড়ে ফেলা দরকার, নইলে ফের পা হড়কাবার সম্ভাবনা। আবার ওদিকে একজিমার যন্ত্রণা। সেটাও ভোলা দরকার। অস্থির হয়ে মোবারক একটু জোরে পা চালাবার চেষ্টা করতেই কাবেজ ও আলিম আখন্দ এক সঙ্গে চিৎকার করে, ‘আস্তে। আস্তে।’ এবার মোবারকের পদস্খলন ঘটে না বটে, কিন্তু সে ধাক্কা খায় ইমাম-কাম মোয়াজ্জেন সায়েবের পিঠে। সামনে জমির আল হঠাৎ খুব সরু হয়ে গেছে, ইমাম সায়েব সেজন্য প্রস্তুত ছিলো, কিন্তু মোবারকের ধাক্কায় তার সমস্ত প্রস্তুতি ভণ্ডুল হয়ে গেলো, আলের দুই পাশে কাদায় তার দুই পা গেঁথে যাওয়ায় লোকটার গতি একেবারে রুদ্ধ হয়। মনে হয় সাদা কাপড়ে জড়ানো ১জোড়া খুঁটি পুঁতে তাকে স্থাপন করা হয়েছে। এখন কেবল তার মুণ্ডুতে চাঁদ-তারা-খচিত নিশান কোনোভাবে একটা ফিট করে দিলেই ইমাম-কাম- মোয়াজ্জেন সায়ের পত পত আওয়াজে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে শুরু ইমাম-কাম-মোয়াজ্জেন করবে। কিন্তু তার মুখ দিয়ে বমির মতো তোড়ে বেরিয়ে আসে, শালা জালেমের বাচ্চারা!’

বিটলুর বাপ এদিকে এসে আলের ওপর বসে ইমাম সায়েবের চরণ উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করে। এই জায়গায় কাদা বড়ো থকথকে। এক পা তুলতে গেলে শরীরের ভার পড়ে অন্য পায়ে এবং দ্বিতীয় পাটি কাদায় অনেক বেশি করে গেঁথে যায়। তার পেছনে লাশ ঘাড়ে নিয়ে এতোগুলো মানুষ অধীর আগ্রহের সঙ্গে বিটলুর বাপের প্রচেষ্টার অগ্রগতি লক্ষ করে। ইমাম-কাম- মোয়াজ্জেন সকলের লক্ষ্যবস্তু হয়ে বিব্রত হয়। দিনে ৫ বার অবশ্য অনেক লোকের সামনে তাকে দাঁড়াতে হয়। তবে সেটা হলো মেলা দিনের অভ্যাসের ব্যাপার। আর সেখানে তার নিজের কিছুই করার নাই। মুসল্লিরা কাতার বেঁধে দাঁড়ালেই সে ইঞ্জিনের ঠেলায় চলতে থাকা রেলগাড়ির মতো চাপ অনুভব করে এবং ১টির পর ১টি সুরা আবৃত্তি করে চলে। কিন্তু এখানে দৃশ্য বা অদৃশ্য কোনো চাপ নাই যে তার ওপর ভরসা করে পেছনের লোকদের উৎকণ্ঠাকে সে অগ্রাহ্য করে। সারির সামনে ইমাম সায়েব অচল বলে সবার গতি রুদ্ধ, দায়টা কি তবে তার ওপরেই বর্তায় না? ইমাম-কাম-মোয়াজ্জেন প্রায় আজান দেওয়ার মতো আওয়াজ তুলে আল্লার কাছে নালিশ করে, ‘আল্লা পরওয়ারদিগার, তুমি দ্যাখো মুসলমানের মুর্দার সাথে এরা কীরকম নাফরমানি করে, মুসলমানের মুর্দার দাফন দিতেও এরা বাধা দেয়, আল্লা, এরা কাফেরেরও অধম, জানোয়ার, সব হায়ওয়ান!’ আল্লার উদ্দেশ্যে বললেও তার প্রকৃত লক্ষ্য শবযাত্রীরা এই আপাতঅভিযোগকে কৈফিয়ত বলে সনাক্ত করতে পারে এবং মেনেও নেয়। তবে এরকম না করলেও তার চলতো, কাদার ভেতর তার পা গেঁথে যাওয়ায় তার ওপর কেউ বিরক্ত হয়নি। এমন কি বিটলুর বাপ, যে কি-না গতবারের আগের বার চাষের সময় সার কেনার অর্ধেক টাকা যোগাড় করতে ইমাম সায়েবের কাছ থেকে ৪ মাসের কড়ারে ৫০ টাকা হাওলাত নিয়ে ৭ মাস পার করিয়ে দেওয়ায় ঐ শেষ কটা মাসের জন্য দ্বিগুণ হারে সুদ দিয়েও কেবল একবেলা খোরাকিতে তার পাতকুয়া সাফ করে রক্ষা পেয়েছিলো, সে পর্যন্ত তার পদসেবায় এতোটুকু ফাঁকি দিলো না।

‘কন তো ইমাম সায়েব, আমার ব্যাটার সাথে অরা ইটা কী করিচ্ছে, কন তো। চেয়ারম্যানের এই বিলাপে সবাই চুপচাপ মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রায় ফোঁপাতে ফোঁপাতে চেয়ারম্যান জানতে চায় তার নিরীহ নিষ্পাপ মাসুম বাচ্চাটির ওপর আল্লার গজব নামে কেন? লেখাপড়ার বাইরে সে তো কিছুই জানে না, কোথাও কোনো ঝগড়াঝাটির আভাস পেলেও সে ওখান থেকে শতহাত দূরে থাকে। তো তার ওপর এরকম জুলুম কেন? — কেউ এর জবাব না দিলে গুনাহারের আরজ আলি সাকিদার জোর গলায় মনিবকে সমর্থন জানায়, ‘কিসের ক্যাম্প খাড়া করছে, তার সামনে দিয়া যাবার দিবি না।–ক্যান?—মুর্দা কি কাফনের মধ্যে বন্দুক লিয়া যাচ্ছে? মুর্দার হাতে হাতিয়ার আছে?’

‘তালে তো কামই হতো।’ জমির ওপর থেকে খাটিয়া কাঁধে জবাব দেয় কাবেজ, তার বিড়বিড় এতোক্ষণে বাক্যের আকার পায়, ‘বন্দুক কি কচ্চেন গো, মানষের হাতে পান্টি দেখলে শালারা বলে গোয়ার কাপড় তুল্যা কোটে দৌড় মারবি তার দিশা পায় না, কড়িতলাত গেলে দ্যাখা গেলোনি, সেটি বলে দুধের ছোলেরা এই জাউরাগুলাক খাম করা দিলো–

‘প্যাচাল পাড়িস না কাবেজ! শালার চাষার মুখ বন্ধ হয় না।’ আলিম আখন্দের ধমকে কাবেজ থামে, কিন্তু ইমাম-কাম-মোয়াজ্জেনের চরণ-উদ্ধারের পর তার বিড়বিড় ফের শুরু হয়। শবযাত্রীরা কলেমা শাহাদত পড়ে, আর কারেজ হলো জাহেল মানুষ, খোদার কালাম জানে না কলেমা জানে না, সে কেবল জপে যে, বুলুর সঙ্গে তখন শাজাহান যদি চলে যায় তো আজ কি তার এতো কষ্ট হয়?—কাবেজের জপপাঠ শোনে আর মোবারক আলির ঠোঁটজোড়া নিসপিস করে, বুলুর কথাটা কাবেজকে জানানো খুব দরকার।—বুকে গুলি লেগে বুলু মারা গেছে। না, এমনি মার খেয়ে মরেনি, মরার আগে হাত দিয়ে বোমা ছুঁড়ে মটোর ভর্তি মিলিটারি নিশ্চিহ্ন করে তাদের গাড়িগুলি সব উল্টিয়ে তারপর—। তারপর বুকে, নাকি পেটে? না, বুকেই গুলি লাগলে বুলু গড়িয়ে পড়ে বৌডোবা খালে, বৌডোবা খাল কোথায়?—আরে পুবে, যমুনা থেকে একটু পশ্চিমে। তা এতোদিনে বৌডোবা খালে সে কি আর আছে? সে কি বসে থাকার ছেলে? বর্ষার ঢলে বুলুর লাশ ঠিক পৌঁছে গেছে যমুনার স্রোতে। যমুনার স্রোতের কথা খিয়ার অঞ্চলের মানুষ কাবেজ জানবে কোত্থেকে?— যমুনার একেকটা ছোবলে ঘরবাড়ি, ফসলের জমি, হাটবাজার গ্রামকে গ্রাম, এমন কি গুণাহারের প্রদ্যোত্নারায়ণ হাইস্কুলের মতো দালানও টুপ করে ধসে পড়ে, কোনো চিহ্ন থাকে না। তো সেই স্রোতের ওপর সওয়ার হয়ে তার বুলু রওয়ানা দিয়েছে কোন দিকে? কোথায়? যমুনা গিয়ে মেশে কোথায়? পদ্মায়? না-কি মেঘনায়? তারপর আত্রাই পেরোতে হবে না? তারপর গুনাহারে কাপড়ের দোকানদারের বাড়ির পাশের নদী ধলেশ্বরী, সেটা কোথায়? মোবারক আলি সুরমা নদীর নাম জানে, কর্ণফুলির নাম জানে, করতোয়া তো তার তাদের ইতিহাসের মাস্টার ছিলো, বাড়ি তিতাস নদীর তীরে, কোথায় যেন ভৈরব, কোথায় শীতলক্ষ্যা—এতোসব নদীর নাম মনে করতে করতে মোবারক হাবুডুবু খায়, থই পায় না। নদী উপনদীর বিপুল স্রোতোধারা তার কানে এমন বেগে আছাড় খায় যে এমন কি বুলুর মায়ের কান্নাও চাপা পড়ে। এই বিশাল জলধারায় তার রোগা ঢ্যাঙা কালো ছেলেটার গুলিতে ঝাঁঝরা বুক কানায় কানায় ভরে গিয়েছে। এই গুমোট গরমে সিন্দুকের মতো গর্তে মাটিচাপা হয়ে থাকতে হচ্ছে না বলে বুলু তার ইচ্ছামতো হাতপা ছড়াতে পারে। সে কি চিৎ হয়ে শোয়? না-কি উপুড় হয়ে? বুলু কি ভেসে ভেসে চলে? না-কি রুই কাৎলা চিতল বোয়াল খলসে পুঁটির ঝাঁকের সঙ্গে পানির নিচে এগিয়ে যায়? কিন্তু এতোসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে বার করা মোবারকের পক্ষে বেশ কঠিন। সময়ও হয় না। গোরস্থানে পৌঁছে খাটিয়া নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই চোখে পড়ে খেজুরতলার ধসে পড়া এক কবরের ভেতর থেকে মোটাসোটা ১টা শেয়াল সরাসরি তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। মাটির ঢিল হাতে নিয়ে তাকে তাগ করে মোবারক খুব জোরে ছুড়ে মারে!

ফেরার সময় কয়েকজনের সঙ্গে মোবারক আলিও চেয়ারম্যানের বাড়িতে কিছুক্ষণ বসলো। মাইল তিনেক তফাৎ কড়িতলায় আজ খুব একচোট হয়ে গেছে, মিলিটারিও নাকি বেশ কয়েকটা সাফ। — খবর শুনে চেয়ারম্যানের পুত্রশোক মাথায় ওঠার দশা, এই ক্যাম্পে মিলিটারির ক্যাপ্টেনকে না হলেও ১০ বার সে বলেছে যে তার ইউনিয়ন সম্পূর্ণ পবিত্র, ঐসব মুক্তি ফুক্তির ছোঁড়ারা অন্তত রেললাইন পেরোতে পারবে না—এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। যে মুকুন্দহাটের গ্রামভর্তি হিন্দুরা গোলমালের শুরুতেই বর্ডার পার হয়েছে, এখন গোটা এলাকায় সাচ্চা মুসলমান ছাড়া আর মানুষ নাই। এখন মিলিটারি এসে তার হাল কী করবে তা জানে কেবল আল্লা পরওয়ারাদিগার আর মিলিটারি আর খানিকটা অনুমান করতে পারে সে নিজে। বাড়ির লোকজনও জান ভরে কাঁদতে পাচ্ছে না, কেবল শাজাহানের মায়ের ক্লান্ত ও বসা গলার কান্না মধ্যরাত্রির কুকুরের ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নার মতো টানা আওয়াজ তুলে অশুভ ইঙ্গিত দিয়ে চলেছে। কড়িতলার শোধ নিতে মিলিটারি এই গ্রামে কতোরকম কায়দায় মানুষ খুনের কেরামতি দ্যাখাবে তাই নিয়ে মানুষ নিজেদের মধ্যে আতঙ্ক বিনিময় করে। পশ্চিমপাড়া মক্তবের কয়েকটি তালেব-এলেম শাজাহানের ঘরে, ঐ ঘরের বারান্দায় এবং উঠানে যে যে জায়গায় শাজাহানের লাশ ছিলো,–বসে কোরান শরিফ পড়ছে। আগরবাতির ধোঁয়ার পাতলা পর্দার আড়ালে এদের মিনমিনে ঝাপসা আওয়াজ শুনে কে বলবে এরা আল্লাপাকের কালাম পড়ছে, না আগে আগে নিজেরাই নিজেদের জানাজা পড়ে নিচ্ছে,–মিলিটারির হাতে মরলে জানাজা হয় কি-না কে জানে? এদের সঙ্গে মোবারক আলি কথা বলে কী করে?

চেয়ারম্যানের বাড়ির বাইরের উঠানে কেবল কাবেজউদ্দিন। চেয়ারম্যানের গোরুবাছুর নিয়ে সে যাচ্ছে গোয়ালঘরের দিকে। বুলুর কথা শোনাবার জন্য তাকে দাঁড়াতে বলে মোবারক ফ্যাসাদে পড়ে, কথাটা শুরু করে কীভাবে? তা কারেজউদ্দিনই তাকে উদ্ধার করে, ‘দ্যাখেন তো চাচামিয়া, অল্যেখ্য কথাটা হামি কী কনু, কন তো? তখন বুলুর সাথে গেলে শাজাহানের আজ বলে এতো দুক্ষু পোয়ান লাগে? শালারা অর সাথে এতো জুলুম করব্যার পারে?’ হঠাৎ গলা নামিয়ে সে জিগ্যেস করে, ‘কড়িতলাত কি বুলু আসিছিলো, সোম্বাদ পাছেন?’ আজ বুলু বেঁচে থাকলে কড়িতলার আক্রমণ হয়তো তারই পরিচালনায় সম্পন্ন হতো, কে জানে? কিন্তু বুলু মরার আগে যে কাণ্ডটা করে গেছে,–সেটা? কাবেজের নিচু স্বরকে পরোয়া না করে মোবারক স্বাভাবিক গলায় বলে, ‘কাবেজ, বুলুর খবর তুমি কি জানো? অর লাশ লিয়া শয়তানি করবি এই ইবলিশের পয়দা মিলিটারি? বুলুর লাশ বলে বৌডোবা খাল থেক্যো বার হয়া-।’

‘লাশ? বুলুর লাশ? কী কচ্ছেন চাচামিয়া?

মোবারক আলি তখন বৌডোবা খালের ধারে পাটখেতের ভেতর থেকে বুলুর গ্রেনেড ছুড়ে মিলিটারি মারার গল্প বলে। মস্ত বড়ো গাড়ি ভর্তি মিলিটারি খতম করার পর ওদের এক গুলিতে বুলু গড়িয়ে পড়েছে খালে। বুলুর লাশের দীর্ঘ জলযাত্রা পর্যন্ত পৌছবার আগেই গোরুর পালের পাটকিলে বাছুরটা দৌড় দেয় সামনের খড়ের গাদার দিকে, কাবেজ ছোটে তার পেছনে। একটুখানি দাঁড়িয়ে মোবারক রাস্তায় নামলো।

রাস্তা খাঁ খাঁ করছে। কেবল খুব জোরে পা চালিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে বিটলুর বাপ। তার ধ্যাবড়া পায়ের একেকটি কদমে রাস্তার নির্জনতা অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়। মোবারক হঠাৎ করে তার সামনে এসে দাঁড়ালে সে চমকে ওঠে 1 মোবারক বলে, ‘এখনি বাড়িত যাস?’

‘কড়িতলার সোম্বাদ শুনছেন? যাই। আত হয়। যাবি। ঘাটাত যদি ধরে তো—।‘

‘কেটা ধরবি?’

‘বেলা ডুবলে অরা ধরবি না?’ এই বারবেলায় মিলিটারির নাম মুখে আনতে বিটলুর বাপের বুক টিপটিপ করে, ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসে ক্যাম্প হওয়ার পর থেকে সন্ধ্যা থেকে এখানে অঘোষিত কার্ফু জারি হয়।

‘আরে থো’, মোবারক প্রায় ধমক দেয়, ‘হামার বুলু বলে একো বন্দুকের গুলিত মটোর ভরা মিলিটারিক শ্যাষ করিছে সেই বিত্তান্ত জানিস?’

‘কী কন?’ বুলু ইন্ডিয়া গেছে এই নিয়ে সে কানাঘুসা শুনেছে, তা বোকাসোকা কারেজের কথায় আমল দেয় কে? ‘তাই তো, বুলুক অনেকদিন দেখি না। হামি কই তার কলেজ আছে, তাঁই বগুড়া থিকা আসবার পারিচ্ছে না।’ বিটলুর বাপ স্থির হয়ে দাঁড়ালে মোবারক বুলুর কথা বলে। তবে বলতে বলতে সে একটু আনমনা হয়ে যাচ্ছিলো, অনেক দূর থেকে ভেসে আসা চাপা আওয়াজে তার বুক হু হু করে, আহারে, বুলুর মা আজ চোখ ভরে, গলা ভরে, বুক ভরে কাঁদে! এই সুযোগটা দেওয়ায় শাজাহানের জন্যে একটু বেশিরকম মায়া হয়, কিন্তু বুলুর গল্প বলার সুযোগ নষ্ট হয়ে গেলো; গাছপালা, ঘরবাড়ি, ফসলের জমি এবং বাতাসের ওপর দিয়ে ভেসে আসা সেই আওয়াজে হাওয়া লাগে, খুব বেগে তা এগিয়ে এলে দুজনই দক্ষিণে তাকিয়ে তার উৎস খুঁজতে থাকে। দেখতে দেখতে কড়িতলার মাইলখানেক দক্ষিণে রেললাইনের ওপরের অনেকটা জায়গা আগুনে, ধোঁয়ায়, চিৎকারে আর্তনাদে সামনে এগিয়ে আসে। বিটলুর বাপ ফিসফিস করে, মনে হয় আইলগর। অরা গেছে!’ ‘হু, মিলিটারি পড়িছে। রায়নগর মোকামতলা ঘোড়াঘাটের একটা পোকাও অরা রাখবি না, দেখিস। কুত্তার বাচ্চারা মানুষ সহ্য করবার পারে না।’ মোবারক আলির গলা কাঁপে।

বাড়িতে যাই ভাইজান, অনেকক্ষণ বেলা ডুবিছে, যাই।’ পা বাড়িয়ে বিটলুর বাপ এগোয় না, বলে, ‘তা ভাইজান, বুলু যখন বোমা না বন্দুক মারলো ঐ মটোরের মধ্যে অরা কয়জন আছিলো? ব্যামাক কয়টাই মরিছে?’

‘তো তোমাক কলাম কি?’

বিটলুর বাপ হন হন করে হাঁটা দিলে ঝপ করে রাত নামলো, কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ থেকে আলোর সঙ্গে অন্ধকার চোঁয়ায় প্রায় সমান সমান। আসমত সরকারের আমবাগানের পশ্চিম মাথায় ভাঙাচোরা, কেবল ১০/১২টি ইটসর্বস্ব শাহবাবার মাজার শরিফের শিয়রে মস্ত শিমুল গাছের নিচে বিড়ি টানতে টানতে রাতভোর বসে থাকে ভিখুপাগলা, ঐ গাছের পুরনো বাসিন্দা শাহবাবার পোষা জিনের কাছে সে গুপ্তবিদ্যার পাঠ নিচ্ছে আজ কম করে হলেও ৭ বছর তো হবেই। ভিখুপাগলাটাও আজ নাই, মনে হয় কড়িতলা রায়নগরের খবর তারও কানে গেছে। মোবারক একটু দমে গেলো, ভিখুপাগলাকে বুলুর গল্প বললে তার থ্রতে আসমানি জীবের এলাকায় বুলুর গলাটা ঠিক পৌঁছে যেতো। তবে একটু এগোলে এই ক্ষোভ মুছে যায়, জুম্মাঘরের অন্ধকার বারান্দায় বসে ইমাম-কাম- মোয়াজ্জেন বদনা থেকে পানি ঢেলে অজু করছে। ইমাম সায়েবের কুলকুচো করার আওয়াজ আজ এতোটাই খাদে নেমেছে যে মনে হতে পারে লোকটা সবাইকে লুকিয়ে চুপচাপ কোনো নিষিদ্ধ পানীয়তে চুমুক দিচ্ছে এবং সঙ্গে সঙ্গে তওবা করে তাই আবার নীরবে বমি করে ফেলছে। মোবারকের অবশ্য তা মনে হয় না। বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে সে আজকের কড়িতলা সংঘর্ষের বিবরণ ছাড়ে। তার বর্ণনা থেকে খুঁটিনাটি জিনিসও বাদ পড়ে না, কড়িতলায় আশেপাশে কোনো খাল না থাকায় মিলিটারির গাড়ি চুরমার হয়ে পড়ে যায় প্রাইমারি স্কুলের মাঠে। এখানে পাটখেত নাই, তাই রোগা ঢ্যাঙা কালো ছেলেরা বোমা ছুড়েছিলো স্কুলের উত্তরের বাঁশঝাড় থেকে। মিলিটারি যতোগুলো গিয়েছিলো প্রাণ নিয়ে কেউ ফেরেনি। ছেলেদের মধ্যে মারা গেছে একজন, হ্যাঁ প্রথম বোমাটি সেই ছুড়েছিলো। তারপর ফ্ল্যাশ ব্যাক করে মোবারক বুলুর গল্প করে। সবই বলে, এমন কি তার যমুনায় পৌঁছে যাওয়ার খবরটিও বাদ পড়ে না। মিলিটারি সম্বন্ধে সে বাঞ্চোৎ, বেজন্মা, বেশ্যার পয়দা, জাউরা, হারামির বাচ্চা ও হারামখোর এইসব বিশেষণ প্রয়োগ করলে অজু নষ্ট হতে পারে জেনেও ইমাম সায়েব লালচে কালো ধানখেতের দিকে তাকিয়ে শেষপর্যন্ত তার কথা শোনে।

ওদিকে বুলুর মা দাঁড়িয়ে ছিলো দরজার কপাট ধরে। গ্রামে মিলিটারি ক্যাম্প পড়ার পর থেকে বুলুর বাপ বেলা থাকতে থাকতে ঘরে ফেরে, মগরেবের নামাজ সে আজকাল ঘরেই পড়ে। আর আজ কি-না এশার আজান পর্যন্ত পড়ে গেলো, তার দ্যাখাই নাই।

ভেতরের বারান্দায় জলচৌকির ওপর গামছা ও বদনা ভরা পানি দিয়ে বুলুর মা রাগ করে, ‘দেরি হলে খবর পাঠাবার পারো না? একটা মানুষ পাই না যে তোমার কথা পুস করি।’

তার জন্য স্ত্রীর এই দুশ্চিন্তা দেখে মোবারক আলি বিরক্ত হয়। যার ছেলে মারা গেছে মাস দুয়েকও হয়নি, সেই মা অন্য কারণে উতলা হয় কীভাবে? সন্ধ্যার পর ছেলের জন্য হামলে কেঁদে মা যদি সারা গ্রাম মাথায় না তুললো তো বুলু এরকম মরা মরতে গেছে কোন দুঃখে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *