দোজখের ওম

দোজখের ওম

আজ অনেকদিন পর কামালউদ্দিনের শরীরের প্রায় গোটাটাই শিরশির করে কাঁপে। এর মানে কী? নিজে নিজে পাশ ফিরে শুতে পারে না আজ ৫ বছরের ওপর, তা তো হবেই, আকবরের মা তো মারাই গেছে সাড়ে ৩ বছর, আকবরের মা পুরো ২টি বছর তার গুমত টানলো,–তাহলে এই আধখানা গতর নিয়ে বেঁচে থাকা কি ৫ বছরের বেশি না কম? তা সেই মানুষ কি-না বালিশে বাম হাত ঠেকিয়ে একা একা উঠে বসতে চেষ্টা করছিলো। সুবিধা করতে না পেরে নিজের ডান হাতটিকে আকবরের মায়ের ডান বা বাম যে কোনো হাত ঠাউরে সেটাই আঁকড়ে ধরে। কিন্তু ১. হাতটি প্রকৃতপক্ষে তার নিজের, ২. এই হাতটি তার অচল ডান সাইডের আধ গজ টুকরা এবং ৩. রাত্রিবেলা আকবরের মা এখানে এসে ঘুরঘুর করলেও সে তার স্পর্শের বাইরেই রয়ে যায়—এই ৩টে প্রধান বিষয় তার মনে পড়ায় অন্ধকার মশারির ভেতর ফের ঘুমাবার জন্য কামালউদ্দিন তার এখন পর্যন্ত চালু বাম দিকটা শিথিল করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এখন তার ঘুম আসার কথা নয়, এখন আসবার কথা আকবরের মায়ের। তার কেমন ভয় ভয় করে। না, আকবরের মায়ের জন্য নয়, তার খোঁচা মারা কথা সে শুনে আসছে ৬০/৬৫ বছর থেকে, মরার পরও কথার আদল তার বদলায় নাই এতে অবাক হওয়ার কী হলো? অল্প অল্প বিরতি দিয়ে কামালউদ্দিনের গা ছমছম করে, কারণ একটু আগে কে ১জন এসেছিলো তাকে সে চিনতে পারলো না কেন? মুত্তাকি মুসল্লির ফজরের আজানের জন্য প্রতীক্ষার মতো আকবরের মায়ের আশায় ঠিক সময়েই তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। তারপর রোজকার মতো সে আধা-পঙ্গু ঘাড়খানা ফিরিয়েছিলো শিয়রের কাছে রাখা টেবিলের দিকে।—আকবরের মা যখনি আসে তার ছায়া-ছায়া হাত দিয়ে ওষুধপত্র, পানির জগ, গ্লাস, ইসবগুলোর ভুষিভেজানো বাটি, তসবি, টুপি এবং ‘মকসুদুল মোমেনিন’ বইটা গুছিয়ে রাখে, গোছানো থাকলেও ফের গোছায়। তায়াম্মুম করার মাটির ঢেলাটি রেখে দেবে কামালউদ্দিনের বালিশের পাশে, তাহলে আজান শুনে পাশের তক্তপোষে শুয়েথাকা আবুবকরকে না ডাকলেও চলে। অতো ভোরে ১৪ বছরের নাতিটিকে ঘুম থেকে ছিঁড়ে আনাটা আকবরের মায়ের পছন্দ নয়। — তা চোখ মেলে কামালউদ্দিন আজও ঘরের শূন্যতায় হালকা গোলাপি আভা দেখতে পায়। এটা হলো বেহেস্তের স্বাভাবিক রঙ। যাদের কবর আল্লা বেহেস্তের টুকরা করে সাজিয়ে রাখে তারা যেখানেই যাক, এই রোশনি তাদের সঙ্গে ঝালরের মতো লাগানো থাকে। কিন্তু হলে কী হবে, এ তো আকবরের মা নয়। এর বয়স অনেক কম একটু হাবা হারা চেহারার অল্প বয়সের মেয়েমানুষ। মেয়েটির কোলে কাঁথা-জড়ানো ১টি শিশু। বাচ্চার মুখে গোলাপি আলো ঘন হয়ে পড়ায় তার রঙ কি চেহারা বোঝা মুশকিল। কাঁথার ওপর আলো পড়েছিলো ছড়িয়ে, কাঁথাটা দ্যাখার মতো! এমনি মোটা দাগের সেলাই, কিন্তু লাল-নীল ম্যাজেঞ্জি মার্কা সুতা ব্যবহারের ফলে পুরনো কাপড়েও ঢেউ চিকচিক করে। ভালো বাহারি সেলাইয়ের দিকে কামালউদ্দিনের টান একটু বেশি, কিন্তু ইসলামপুরের ছাতা ও খেলার সরঞ্জামের দোকানের বারান্দায় সিঙ্গার মেশিনে লুঙি, বালিশের অড় ও মশারি সেলাই করে তার জীবন কাটলো, মনের আশ মিটিয়ে সেলাই করার সময় পেলো কোথায়? কাঁথা সেলাইয়ের হাত আকবরের মায়ের একেবারে মন্দ ছিলো না, কিন্তু সেলাই-ফোঁড়াইয়ের দিকে তার ঝোঁক বরাবরই কম। কাঁথার ঢেউখেলানো কাজ দেখে মনে হয় এই কাজ তার মামাতো বোন কামরুন বিবির হতে পারে। তবে কি কামরুন বিবি এসেছিলো? নাঃ! বেঁচে থাকতে গায়ের ফর্সা রঙের দাপটে কামরুন্নেসা মাটিতে পা ফেলতো না। মারার পর সে আসবে বিমারি ফুফাতো ভায়ের খবর নিতে? মেয়েটি কিছুক্ষণের জন্য তার চোখে সরাসরি তাকিয়েছিলো। চোখের চরম বিরক্তি তার ভুরুজোড়ার মাঝখানে এমন কারুকাজ তৈরি করে যে হাতের শিশু জড়ানো কাঁথার সেলাই থেকে তাকে আলাদা করা মুশকিল। তখন তাকে খুব চেনা চেনা ঠেকছিলো, কে? ফ্যাসফ্যাসে গলায় কামালউদ্দিন জিগ্যেস করে, ‘ক্যাঠা?’ গ্রাম্য চেহারার তরুণীর ভুরুর ভাঁজ ভেঙে যায়, সে ফের ঘোরতর অপরিচিত হয়ে পড়ে, তাকে চিনতে পারার যে আয়োজন প্রায় সম্পন্ন হয়ে এসেছিলো তা গিয়ে ঠেকে একেবারে তলানিতে। কামালউদ্দিনের হয়রান গলা ও জড়ানো স্বর তখন কাঠকাঠ, ‘ক্যাঠায়? কথা কও না?’ জবাবে ‘পোলায় কান্দে দ্যাহো না? বুইড়া মরদটা খাতির জমাইয়া নিন্দ পাড়ো?’ বলতে বলতে মেয়েটি পা ঝাপটায়। গোলাপি আলো তখন নিভে যায়, ঘরে ঘনঘোট অন্ধকার। মেয়েটি কি দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো? দরজার বাইরে আবছা আলো, দরজা একটু ফাঁক করা। ইস! এই পোলাপানগুলি মানুষ হইলো না! চোরে আইয়া ঘরের মাল-সামান ব্যাকটি গায়ের কইরা দিবো, তয় ভি এ্যাগো হুঁশ হইবো না? জড়ানো জিহ্বায় সে নাতিকে ডাকে, ‘আবুবতল, আবুবতল!’ সাড়া না পেয়ে চুপ করে, দূর! ছ্যামরাটারে অহন ত্যক্ত করার দরকার কী? এখানে তার আর কতোদিন? এই বাড়িঘর মাল-সামান এসবে তার কী এসে যায়? তার এই বৈরাগ্য আকবরের মা কিন্তু বিশ্বাস করে না। মরার পরও আকবরের মায়ের রাগ একটুও কমে নাই। দ্যাখো না, আজ আকবরের মা এলো না, মনে হয় তার রাগ আরো বেড়ে গেছে। কিন্তু কামালউদ্দিনের কী দোষ? আকবরের মা যখুনি আসবে তার কেবল ১ কথা, ১ সওয়াল, ‘যাইবা না? খালি দুইটা খাওন আর নিন্দের লাইগা তোমার এমুন লালচ ক্যালায়? বুইড়া জইফ মরদ একখান, হাগামাতা ভি ঠিকমতোন করবার পারো না, তয় কিয়ের টানে পইড়া থাকো, এ্যাঁ?’ কিন্তু কামালউদ্দিন কি ইচ্ছা করলেই বৌয়ের ডাকে সাড়া দিতে পারে?

মরার পর প্রথমদিকে এসে আকবরের মা জানলার বাইরের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করতো, ‘লও যাই।’

‘কৈ?’

‘ঐহানে!’

কিন্তু বাইরে চাপা গলি। রহিমুল্লা সর্দারের ছেলে পুরনো দালান ভেঙে নতুন করে বাড়ি করতে গিয়ে কামালউদ্দিনের না হোক আড়াই হাত জায়গা গায়ের করে দিয়েছে। কামালউদ্দিন উসখুস করে, ‘ঐদিক যাইবার দিবো? সর্দারের পোলায় না কবজা করছে

‘আরে ভালো কইরা চাইয়া দ্যাহো। কানা হইলা?’

ভালো করে দেখলেও রহিমুল্লা সর্দারের নতুন বাড়ির প্রসারিত বারান্দাই চোখের ভেতর দিয়ে মাথায় ঢুকতে চায়। আকবরের মা রাগ করে চলে যায়। পরদিন ফের আসে, ‘যাইবা না?’ এমনি করে কয়েকদিন দেখতে দেখতে আঙুল দিয়ে চোখ ঘষলে রহিমুল্লা সর্দারের বাড়ি মুছে গেলো। একদিন সেখানে ফুটে উঠলো ১টি কালচে খয়েরি রঙের গম্বুজ। দিন যায়। আকবরের মায়ের তর্জনীর মাথায় ২টি ৩টি করতে করতে গড়ে ওঠে মোহাম্মদপুরের সাতগম্বুজ মসজিদ। পেছনে মসজিদের গা ঘেঁষে নদী, আকবরের মা মনে হয় ৩টে গম্বুজ ও ৪টে মিনার টেনে তুললো পানির ভেতর থেকে। তাদের শরীরে পুরনো মাছের গায়ের মতো নানারকম শ্যাওলার দাগ। নদীতে কতো নৌকা, কিন্তু সেগুলো চলে কি-না সেদিকে কামালউদ্দিনের লক্ষ নাই; তাদের গায়ে সব বুক-চিতানো পাল, কামালউদ্দিন তাই দেখে মুগ্ধ। কী সুন্দর সেলাই! একটা কাপড়ের সঙ্গে আরেকটার জোড়া এমনভাবে মিলে গেছে যে মনে হয় প্রত্যেকটি পাল নানা রঙ দিয়ে আঁকা। আকবরের মায়ের তাগাদায় কিংবা ঐসব বাহারে পাল দ্যাখার তাগিদে বৌয়ের পেছনে পেছনে গিয়ে একদিন একটা নৌকায় কামালউদ্দিন তার সচল বাম পা তুলে দিয়েছিলো, অচল ডান পা তোলবার আগেই নৌকা চলতে শুরু করে, নৌকার গতিতে কামালউদ্দিনের রগে ও মাংসে টান পড়ে, সে ডাঙায় পড়ে যায়। রগে খিচ ধরলে তার গোটা বাম দিক ব্যথায় টনটন করে ওঠে, কামালউদ্দিন বেশ জোরে জোরে গোঙাতে শুরু করে। আবুবকরের ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো, তার নানা, অ নানা’ ডাকে সাড়া না পেয়ে আবুবকর চিৎকার করে মাকে ডাকে। মাকে দেখেও আবুবকরের ভয় কাটে না, ‘নানায় যানি কেমন করে। নানার মনে লয় দম যায় গিয়া! বাপের কপালে হাত দিয়ে খোদেজা নিজেও ভয় পায়, ইস, ঘাইমা এক্কেরে নাহাইয়া উঠছেন। আব্বা, কি খোয়াব দেখছেন?’ খোলা দরজা দিয়ে একটু একটু হাওয়া আসছিলো, কপালে ও মাথায় মেয়ের হাতের স্পর্শে কামালউদ্দিন ঘুমিয়ে পড়ে।

পরদিন দুপুরবেলা বাপকে ভাত খাওয়াবার সময় কথায় কথায় খোদেজা সব জেনে নেয়। স্ত্রীর দৈনিক যাতায়াতের খবরটি গোপন রাখাই ভালো। আকবরের মায়ের ডাকে সাড়া দিতে না পারায় এমনি সে কুঁকড়ে আছে, এইসব ফাঁস করে সকলের সামনে জড়সড় হওয়ার দরকারটা কী? তবে কি-না সেদিন কৈমাছের ঝোল ছিলো, আলু ঝিঙা দিয়ে মাখামাখা করে রাঁধা, এক চিমটি মাছে আঠালো জিভে স্বাদটিকে আরো চটচটে করে নেওয়ার লোভে সে বলে, ‘তর মায়ে আইছিলো।’

‘আম্মা?’ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মাখানো স্থগিত রেখে এই দুপুরবেলাতেও খোদেজা এদিক ওদিক তাকায়, স্বর তার আপনাআপনি নেমে আসে, ‘কী কয়?’ মাছভাত, লালা ও পক্ষাঘাতে জড়ানো জিভে কামালউদ্দিন বলে, ‘আমারে ডাক পাড়ে। সাতগম্বুজ মসজিদ দ্যাহাইয়া কয়, লও যাই গিয়া! খোজেদা, তর মায়ে ঐ মসজিদ চিনলো ক্যামনে?’ এটা একটা সমস্যা বটে। কিন্তু খোদেজা বেশ ভয় পেয়েছে অন্য কারণে, ‘আব্বা, খোয়াবের মইদ্যে মরা মানুষ ডাকলে পরে যাইবা না, কিছুতেই যাইবা না।’

এইসব শুনে কৈ মাছে কামালউদ্দিনের অরুচি ধরে : কটা বছর যেতে না যেতে খোদেজার কাছে তার মা মরা মানুষের বেশি আর কিছু নয়? মেয়েকে সে কী করে বোঝায় যে এসব কোনো স্বপন-খোয়াবের ব্যাপার নয়, আকবরের মা আজকাল প্রায় প্রতি রাত্রেই তার ঘরে আসে, নইলে তার ঘরে রোজ রোজ জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখে কে? অজু করার মাটির ঢেলা তো আপনাআপনি তার শিয়রের কাছে এসে হাজির হতে পারে না। শীতশীত করলে পাতলা কাঁথাটা তার গায়ে বিছিয়ে দেয় কে? –তা মেয়েকে এসব কথা কি বোঝানো যাবে? বাপকে তার এতো আদর, ‘এটা খাও ওটা খাও’, কিংবা ‘না আব্বা এইটা তোমার খাওয়া হারাম, ডাক্তারের মানা আছে’, কিংবা বালিশ ঠেকা দেই, তুমি উইঠা বসো’—কামালউদ্দিনের দুনিয়ার মেয়াদ বাড়াবার জন্য এইসব ষড়যন্ত্র সে কি মিছেমিছি করে? বাপ হয়ে কামালউদ্দিন মেয়েকে চেনে না?–বাপটি চোখ বুজলেই ভাই দুজন একাট্টা হয়ে এই বাড়ি থেকে তাকে নির্ঘাত উচ্ছেদ করবে। ৭ বছর হলো খোদেজার স্বামী নাই, ভাসুর দেওর জায়ের মুখ ঝামটা সহ্য করতে না পেরে মায়ের কাছে এসে প্যানপ্যান করতো, অতিষ্ঠ হয়ে কামালউদ্দিন নিজেই গিয়ে পাকাপাকিভাবে মেয়েকে নিয়ে এসেছে। বাপ মরলে ভাইরা তাকে জায়গা দেবে? আমজাদ যদি বোনকে দ্যাখেও তো তার ম্যাট্রিকফেল বৌটা? অতো সোজা। এইসব লেখাপড়া-জানা মেয়েদের কামালউদ্দিন কি কম চেনে? খোদেজাই কি হাড়ে হাড়ে চিনতে পাচ্ছে না? তাই তো বাপকে দীর্ঘায়ু করার জন্য তার এতো যত্ন, এতো তদবির! নইলে আধখানা অচল শরীরের ভার ও বাকি আধখানা সচল শরীরের যন্ত্রণা নিয়ে এবং বৌছেলেমেয়েনাতি — একেকজনকে চোখের সামনে পটপট করে মরে যেতে দেখেও বয়সের নিয়মকানুন অস্বীকার করে বেঁচে থাকাটা যে কতো মজার-বাপের জন্য একটু মায়ামোহাব্বত থাকলে মেয়ে সেটা ঠিকই বুঝতো। যাই কও, ছেলেমেয়ে বড়ো হলে কেউ কারো নয়। দ্যাখো, বড়ো ছেলের চেয়ে বড়ো ধন আর কী? সেই আকবরের ব্যবহারটা দ্যাখো না! সে-ই বুড়ো হতে চললো, যুদ্ধের সময়, সেই ব্রিটিশ আমলের যুদ্ধ, ব্রিটিশ জার্মানে বড়ো লড়াই, সেই সময় আকবর ১০/১২ বছরের পোলা, মানে এখন তার ৫৫/৬০ হবো হবো করছে, সে তো বাড়িতে উঁকি দিতেও আসে না। কামালউদ্দিনের পেশাটা নিলো সে-ই, তাকে নিয়ে কামালউদ্দিনের কতো আশা ছিলো, বশিরউদ্দিন মাস্টার টেলারের সাক্ষাৎ সাগরেদ হাসান মিয়ার দোকানে ঢোকাতে কামালউদ্দিনকে কম ঝামেলা পোয়াতে হয় নাই। নিজে সারাজীবন কাজ করলো বশিরউদ্দিন মাস্টার টেলারের কাছাকাছি। — হলে কী হবে? ছাতা ও খেলার সরঞ্জামের দোকানের বারান্দায় মানুষের লুঙি আর বালিশের অড় আর মশারি সেলাইয়ের বেশি তাকে দিয়ে আর কিছুই হলো না। ছেলে সেখানে সরাসরি ঢুকলো অতো বড়ো দোকানে, তাও বশিরউদ্দিনের সাক্ষাৎ সাগরেদের কাছে কাজ শেখার সুযোগ পেয়ে। তা লাভ কী হলো? কপাল! কপাল! সেই ছেলে কি-না নিজের ওস্তাদের বৌয়ের পাল্লায় পড়ে নিজের বাপ-মা ছাড়লো। ২/৩ টা ছেলের মা সেই বাড়ি মাগীটাকে বিয়ে করার পর বছরখানেক তার কোনো পাত্তাই ছিলো না, তারপর আবার এই বাড়িতে একটু ঘেঁষবার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু তার মায়ের সাফ কথা, আইলে একলা আইবো! খানকি উনকি লইয়া ঘর নাপাক করবার দিমু না!’ বড়ো কঠিন মেয়েমানুষ, নইলে আকবরের বিয়ে করা বৌ, সে খানকি হবে কেন? আকবরও তো ঐ মায়েরই পোলা, বৌ সম্বন্ধে মায়ের বচন শুনে সেই যে ঘর ছাড়লো, আবার এলো মা যখন তার একেবারে মৃত্যুশয্যায়। আকবরের মা মরলো সপ্তাহখানেকের জ্বরে, কিন্তু ঐ ৭/৮ দিন জ্বরের ঘোরে তার মুখে আকবর ছাড়া আর কথা শোনা যায় নাই।— ‘আকবর, বাবা, ও আব্বা, দুধ খাইবি না?’ ‘ও আকবরের বাপ, দেইখা যাও, তোমার পোলায় তোমার টুপি পইরা কেমুন হাসতাছে!’ ‘আকবর, আব্বা, আমার সোনাটা, আয়, নাহাইয়া দেই ভাত খাইয়া খেলবি, অহন আয় বাবা!’ ‘হায় হায়! আকবরে আউজকা নারিন্দার মোচড়ে গেছিলো গিয়া, পোলায় কেমুন বিচ্ছু হইছে, কুনদিন গাড়ির নিচে পড়বো!’ মায়ের এইসব বিলাপ শুনে আমজাদ গিয়ে আকবরকে কোত্থেকে ধরে নিয়ে আসে। তার মা অবশ্য আকবরকে চিনতেও পারে নাই, ছেলেকে দেখেও তার বিলাপ অব্যাহত ছিলো। শেষপর্যন্ত তার সবটা দখল করে ছিলো শৈশবকালের আকবর।— কামালউদ্দিনের মাথায় হঠাৎ করে একটি সুই বেঁধে, আজকাল এ একটা নতুন ব‍্যারাম ধরেছে, একটু তন্দ্রার মধ্যে গেলেই মনে হয় যে সেলাই করতে করতে একটু ঝিমুনি এসেছে আর মেশিনের সুই বিধে গেছে তার তর্জনীতে। এখনকার সুইটি অবশ্য বিধলো কপালের মাঝামাঝি। একটি কথা মাথায় ফিনকি দিয়ে ওঠে: যে তরুণী আজ এসেছিলো তার কাঁথায় জড়ানো শিশুটির মুখ কি অনেকটা আকবরের মতো? কী জানি? ৫৫/৬০ বছর আগেকার শিশুটির চেহারা মনে করা কি তার আধখানা মগজের কম? আকবরের এখনকার চেহারাই মাঝে মাঝে ভুলে যায়। সে কি বাপকে দেখতে আসে যে মুখটা সবসময় মনে থাকবে? মায়ের মৃত্যুর পর বৌছেলেমেয়ে নিয়ে বেশ ঘন ঘন আসতে শুরু করেছিলো, একবার মনে হলো এই বাড়িতেই বসবাস করবে। একটু ভয়ও হতো, বাড়িতে এতো সব লোকের জায়গা হবে? এর মধ্যে আমজাদের সঙ্গে কি কথা কাটাকাটি হলো, না, দুই বৌ কী নিয়ে মন কষাকষি করলো, ব্যস, আবার সব যোগাযোগ বন্ধ। আকবরের ছোটো মেয়েটা, বৌয়ের আগের পক্ষের একটিকেও কামালউদ্দিন দ্যাখে নাই আল্লার কাছে হাজার শুকুর, আর আকবরের বড়ো মেয়েটা কোন বিহারির সঙ্গে পাকিস্তান চলে গেছে,– ঐ মায়েরই তো মেয়ে! তো ছোটো মেয়েটা কামালউদ্দিনের আশেপাশেই ঘুরঘুর করতো। আকবরের মা মারা যাওয়ার পর ওরা যতোদিন এ বাড়িতে এসেছে ঐ মেয়েটা প্রায় সব সময় কামালউদ্দিনের ঘরেই থাকতো। কৈ সে-ও তো আসে না। ছুঁড়ির নাম যেন কী?—কী নাম? কী নাম? নাঃ মনে নাই। মেয়েটা এলেই তো পারে। আকবর কি ওর ভালো একটা বিয়েও দিতে পারবে? আকবরের যে টানাটানি, খাওয়াও ঠিকমতো জোটে কি-না সন্দেহ। এতো বড়ো দোকানে কামালউদ্দিন ঢুকিয়ে দিলো, কেলেঙ্কারি করে সেই দোকান ছাড়লো। এরপর কতো দর্জির ঘরে ঘরে যে ঘুরলো, কোথাও ১ বছর, ২ বছরের বেশি টিকতে পারে না। কাজ কিন্তু ভালো জানে, হাজার হলেও বশিরউদ্দিন মাস্টারটেলারের সাগরেদের হাতে শেখা; মা মারা যাবার কিছুদিন পর কামালউদ্দিনকে একটা পাঞ্জাবি রিপু করে দিয়েছিলো, দেখে বোঝা যায় না কোনটা আসল জমি কোনটা রিপু। হলে কী হবে, কোনো দোকানের প্রতি দরদ নাই, মহাজনকে ইজ্জত করে না, কাজের বরকত হয় কী করে? বুড়ো হতে চললো এখনো সন্ধ্যা হতে না হতে বাঙলা মদ টানার জন্য তার হাঁইফাই। এসব লোক সংসার করতে পারে? বড়ো ছেলেটাকে কোন ইলেকট্রিসিটির দোকানে দিয়েছিলো, হাতখরচটা পাবে, কাজও শেখা চলবে। দোকানের মালপত্র গাপ করে সে নাকি কোথায় কেটে পড়েছে, তার আর কোনো পাত্তা নাই। আসলে পুরুষ মানুষ বৌয়ের ভাউরা হলে সংসার ছারেখার যায়। এসব নিয়ে কামালউদ্দিন কথাবার্তা বলে কার সঙ্গে? আকবর আর তার বৌছেলেমেয়ের নতুন নতুন কীর্তির কথা রোজরোজ শুনতেও ভালো লাগে না। খোদেজা আগে দিনরাত এসব কাহিনীই বয়ান করতো, আজকাল আকবরের বৌয়ের গিবত করায় খ্যান্ত দিয়েছে। কামালউদ্দিন সবই বোঝে, গতর আধখানা বিকল হলে কী হয়, দুনিয়া বোঝার জন্য তার সচল আধখানা মগজই যথেষ্ট। আসলে আমজাদের রোজগারে থাকতে হয় তো, ছোটো ভায়ের বৌয়ের কাছে মাথাটা নিচু হতে হতে খোদেজার হাল এখন এমন যে বড়ো ভাবীর ওপর রাগটা দিনদিন নেতিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া প্যাঁচাল পাড়ার মতো সময়ও খোদেজার এখন কম। তার বলে শতেক ঝামেলা।—তার আবুবকর এখন এই মহল্লার উঠতি মস্তান, তাকে সামলাতে হয়। তার মেয়েটা বড়ো হচ্ছে, মস্তানদের হাত থেকে তাকে সামলাবার জন্য খোদেজার চোখকান অষ্টপ্রহর খাড়া। তার যে ছেলেটি গতবারের আগের বার সংক্রান্তির দিন রহিমুল্লা সর্দারের বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে মরে গেলো তার শোক মাঝে মাঝে উথলে ওঠে, খোদেজা তাও সামলায়। কামালউদ্দিনের চোখজোড়া বুজে এসেছিলো এই সুযোগে কে যেন ওর আঙুলপোষ খুলে নিয়ে গেছে, ওর আঙুলে আর একটি সুই বেঁধে; একটু আগে আসা তরুণীর কাঁথা জড়ানো শিশুটির মুখে কি খোদেজার ঐ মৃত ছেলেটির আদল আসে? সবাই কিন্তু আকবরের সঙ্গে তার ভাগ্নের চেহারার খুব মিল দেখতো। আকবর ঐ ভাগ্নেকে ভালো করে দ্যাখেও নাই কোনোদিন। তার জন্মের অনেক আগেই ঐ বাড়ি মাগীর পাল্লায় পড়ে সে ঘরছাড়া হয়েছে। ছ্যামরার স্বভাবটি ছিলো বড়োমামার মতো। ছেলেবেলায় আকবরও কি কম শয়তান ছিলো? মহল্লার সব পাকা বাড়ির ছাদই ছিলো তার ঘুড়ি ওড়াবার জায়গা। কি সংক্রান্তি, কি শনিবার, কি মহরম, কি বৃহস্পতিবার–সুযোগ পেলেই ঘুড়ি-লাটাই নিয়ে এর ছাদে ওর ছাদে উঠে পড়েছে। কামালউদ্দিন দিব্যি দেখতে পায়, হাসমত ওস্তাগরের ছেলে ছাদের ওপর তার দাপাদাপিতে অতিষ্ঠ হয়ে আকবরের কান ধরে টেনে এনেছে কামালউদ্দিনের কাছে। তা তার ছেলের কান ধরার অধিকার হাসমত ওস্তাগারের ছেলের ছিলো বৈকি। সে তো কামালউদ্দিনের ছেলেবেলার দোস্ত, কী নাম যেন? —আরে, ওরা একসঙ্গে মুনীর হোসেন লেন, শাহ সাহেব লেন, শরৎ গুপ্ত রোড ধরে গোল্লাছুট খেলে বেড়িয়েছে না? একসঙ্গে ঋষিপাড়া গিয়ে মুচিদের ছেলেদের নিয়ে মার্বেল খেলতো না? ইস! কামালউদ্দিন ছটফট করে, আরে নারিন্দায় বিবির মসজিদের মক্তবে মকবুল মুন্সির কাছে আমপারা সেপারা পড়তো একসঙ্গে। ইস! তার নামটা মনে করতে পাচ্ছে না! একসঙ্গে, একসঙ্গে আর কী, আর কী?—ইসমাইল সাহেবের বাড়ির ছাদে ওঠার সিঁড়িতে তার লুঙি খুলে ফেলেছিলো তো ঐ ছেলেই, তারপর সে কী জড়াজড়ি, কী তুমুল জড়িয়ে ধরা—তওবা তওবা, এসব তার কী মনে হচ্ছে? জীবনের প্রথম যৌন অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ায় কামালউদ্দিন বারবার তওবা পড়ে। এগুলো হলো ইবলিসের উস্কানি। এসব আসলে মেয়াদের ওপর দুনিয়ায় বসবাস করার শাস্তি আকবরের মা কি আর সাধ করে বকে, ‘অহন তরি দুনিয়ার লালচ তোমার গেলো না। দোজখের কীড়া, দোজখের লাহান ঘরের মইদ্যে থাকো, তয় কি গতরখান উঠাইবা না!’ কিন্তু কামালউদ্দিন কী করতে পারে? আল্লার ইচ্ছার ওপর একটি ফোঁড় বসাবার ক্ষমতাও কি তার কি আছে? নিজের ইচ্ছামতো মরা কি তার মতো নালায়েক বান্দার নসিবে থাকে? সেসব পারে বড়ো বড়ো পির সায়েব, কামেল শাহসায়েবরা। তার বাপের যে পিরসায়েব ছিলো তার এরকম ইচ্ছামৃত্যু ঘটেছিলো। ছি! ছি! কার সঙ্গে কার তুলনা! কামালউদ্দিন ফের তওবা পড়ে, এরকম তুলনা যেন ভুলেও কোনোদিন করে না। পিরসায়েবের মতো কামেল মানুষ দুনিয়ায় কজন আসে? বড়োপির সায়েবের সাক্ষাৎ বংশধর, বাগাদাদ না মক্কা না মদিনা শরিফ না আজমির শরিফ থেকে এসেছিলো। জীবনে হজই করেছে ২৫/২৬ বার। আহা কামালউদ্দিনের বাপের হজ করার নিয়ত ছিলো, পয়সার টানাটানিতে মীরপুর মাজারেই যাওয়া হয়ে উঠতো না, হজে যাবে কোত্থেকে। হাজী সাহেব দেখলেই বয়সের বাছবিচার না করে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে কদমবুসি করতো। শেষদিকে বাপজান পিরসায়েবের দরগাশরিফে আস্তানা গড়ে। হুজুরের খানকা শরীফ ছিলো কোথায়? কোথায় যেন?–কলতাবাজার? না-কি একরামপুর? –না-কি রোকনপুর?—কী জানি? মনে নাই। তবে হুজুরের মাজারের পাশে বাপজানের দিনরাত বসে থাকার নকশাটি তার চোখে বেশ স্পষ্ট। হুজুরের ওফাতের পর কামালউদ্দিনের বাপ ওখানেই পড়ে থাকতো। বাপজানের বড়ো খায়েশ ছিলো তার কবরটা যেন হুজুরের পায়ের কাছেই হয়। না, হয় নাই। তাই কি হয়? কতো বড়ো বড়ো খাদেম ছিলো তার। — নবাববাড়ির লোক ছিলো; ইসমলামপুরের ব্যবসায়ীদের চাঁদায় তার ওরস শুরু হলো। সেখানে কোথাকার কোন দর্জির গোর হবে এতো বড়ো কামেল দরবেশের কাছাকাছি? এখন কামালউদ্দিনের মনে হচ্ছে যে হুজুর বেঁচে থাকলে তার পায়ের কাছে বাপজানের ৩ হাত জায়গা ঠিকই জুটে যেতো। সে কি যে সে পির? তেমন মুরিদ হলে সে যতো গরিবই হোক তার জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করেছে। নিজের ইচ্ছায় যে মউত বরণ করতে পারে সে কি মুরিদের ভক্তির খবর রাখে না? প্রতিবছর রমজানের চাঁদ দেখে মুরিদদের নিয়ে তারাবি পড়েছে সকলের সঙ্গে সেহরি খেয়ে ভোররাত্রির দিকে হুজুরপাক ঢুকে পড়তো কবরের সাইজে কাটা মাটির কুঠরিতে। ঢুকেই একেবারে সোজা সটান চিত। এরপর মুরিদরা সব এক এক করে কবরের ওপর মাটি রাখতো। কাঠের নল ছিলো একটা, হুজুর সঙ্গে করে এনেছিলো মদিনা শরিফ না মক্কা শরিফ না আজমির শরিফ থেকে, সেটা লাগানো থাকতো তার মুখের সঙ্গে, তার এক প্রান্ত মাটির ওপর। প্রত্যেকদিন মাগরেবের আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খাদেমরা ঐ নল দিয়ে পানি আর এক পেয়ালা দুধ ঢেলে দিতো। ওটাই তার এফতার, ওটাই তার সেহরি। পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত ফের তার একটানা উপবাস। মাসের শেষ শাবানের চাঁদ ওঠার পর কবর একটু একটু করে কাঁপতো, মানে হুজুর এখন ফের মুরিদদের মধ্যে তশরিফ আনবে। মাটি খুঁড়ে ওপরে তুললে বরাবরই দ্যাখা গেছে তার রোগা শরীর থেকে গোলাপি রোশনি বার হচ্ছে। এইভাবে বছর গড়ায়, মহল্লার লোকজনের কাছে ব্যাপারটি রমজানের চাঁদ শাবানের চাঁদের মতোই খুব স্বাভাবিক ও নিয়মিত হয়ে পড়ে। একবার নিচে যাবার আগে হুজুর সাদা কাপড়ে নিজেকে জড়িয়ে নিলো। সেদিন গন্ধ। চোখে সুরমা। কাউকে কিছু বলে নাই। এরপর নলে করে রোজ এফতার করা—তাও অব্যাহত রইলো। ২৭শে রোজার দিনও দিবাগত রাত্রে এক পেয়ালা দুধ দিয়ে এফতার ও সেহরি খাওয়ানো হলো। কিন্তু পরদিন কয়েকটি বুদবুদ তুলে মুরিদের দুধ ফিরে আসে। সবার জান ঘাবড়ে গিয়েছিলো, তাদের কি কোনো অপরাধ হলো? কতো বড়ো বড়ো মানুষ এসে দুধ ঢালে, এমন কি নবাবসাহেব নিজে এসে সোনার না চাঁদির পেয়ালায় বাদাম-পেস্তা মেশানো দুধ ঢাললো। না, সবই ফেরত আসে। দুরুদুরু বুকে সবাই অপেক্ষা করে। শাবানের চাঁদ দ্যাখা গেলে এবার কবর আর কাঁপলো না। ভয়ে মুরিদদের জান ঠাণ্ডা। নবাব বাহাদুরকে ফের তশরিফ নিতে হলো। কোদালের প্রথম কোপ ফেলা হলো তার হাত দিয়েই। পির হুজুরের সারা গায়ে কাফন জড়ানো, মেশক অম্বর আতরের গন্ধে ভুরভুর করে সারা মহল্লা। হুজুরের মুখ পশ্চিম দিকে ফেরানো, সবাই বুঝতে পারে মরণের এরাদা নিয়েই হুজুরপাক এবার কবরে নেমে ছিলো। তারা গুনাগার, নাদান আদমি, তার কার্যক্রমের মানে বুঝাতে পারে নাই। তার লাশ তোলা হয় নাই। এবার সবার মনে পড়ে যে রোজার চাঁদ দেখেই হুজুর মুরিদদের দিয়ে ভালো করে গোসল করিয়ে নিয়েছিলো।–বাপজান এই গল্প করতো আর কাঁদতো। পিরসায়েবের এন্তেকালের পর বাপজান ঘরে আসতোই না, ৩ দিন ৪ দিন পর এসে ২/১ দিন থাকতো, এই ২/১ দিন তার মুখে কেবল পিরসায়েবের কাহিনী। তা যে যাই বলুক, পিরহুজুরের খেদমত করে তার বাবার ফায়দাটা কী হলো? মরার পর তার পাশে মাটিটাও তো জুটলো না। অথচ হুজুরের ক্ষমতা কি কম ছিলো? বাপজানের মুখেই শোনা, হুজুরের দোয়ায় এই ঢাকায় একবার বৃষ্টি পর্যন্ত হয়েছিলো। কবে? কতো সালে? কামালউদ্দিনের তখন জন্ম হয়েছিলো? না, সে বোধহয় বহু আগে। কিন্তু কামালউদ্দিন তো দৃশ্যটি প্রায় স্পষ্ট দেখতে পারে। মেঘ নাই, বৃষ্টি নাই, পানি নাই; নারিন্দা, টিকাটুলি, একরামপুর, রোকনপুর, কলতাবাজার, বাঙলাবাজার, তাঁতিবাজার, সদরঘাট, গ্যাণ্ডারিয়া থেকে শুরু করে ওদিকে ইমামগঞ্জ, সোয়ারিঘাট, চকবাজার বেগমবাজার, মাহুতটুলি, মোগলটুলি — সব, সব—এতোগুলো মহল্লার নাম মনে করতে পারায় কামালউদ্দিন বেশ চাঙা হয়ে ওঠে, এতে হলো কি ঐ তেজে পির সায়েবের কামেলির দৃশ্য বেশ স্পষ্ট হয়। খরায় সারাটা শহর জরজর, বস্তিগুলো সব বসন্তে উজাড় হতে লাগলো। কতো বড়ো বড়ো মওলানা কতো দোয়া পড়ে, খোলা রাস্তায়, মাঠে দুপুরবেলা এস্তেকার নামাজ যে কতো পড়া হলো তার আর লেখাজোখা নাই। কোনো ফল হয় না। শেষপর্যন্ত সবাই গিয়ে ধরে পিরহুজুরকে। তো তার এক কথা, এসব কেয়ামতের লক্ষণ, মানুষ আল্লার কথা ভুলে গুণাগারিতে লিপ্ত। তার কী করার আছে? কোন মুরিদ নবাব বাহাদুরের কাছে হুজুরের কথা বলে। নবাব বাহাদুর — নবাব সলিমুল্লা না আহসানউল্লা—কী জানি নাম তো মনে নাই, নবাব সিরাজদৌল্লা না তো?―না কি নবাব শায়েস্তা খাঁ–কী জানি নাম মনে করাটা এখন তুচ্ছ কাজ, নবাব বাহাদুর গিয়ে হুজুরের হুজরাখানায় ধরনা দেয়, ‘হুজুর, তামাম শহরমে আগ জ্বল রাহা, বারিশ নেহি হোগা তো তামাম আদমি একদম মর যায়েগা’ ১০/১২ দিন আগে পিরসায়ের মাটির তলার একমাসের বসবাস থেকে উঠে এসেছে, তার শরীর তখনো রোগা; কামেল পির, তাই সম্মানী মানুষের কথা কি ফেলতে পারে? হুজুর এস্তেকার নামাজ পড়াতে রাজি হয়, শর্ত ছিলো এই যে মুসল্লিদের সবাইকে খালি পায়ে হেঁটে যেতে হবে পল্টনের মাঠ পর্যন্ত। সেই আগুন-ঝরা রোদে খোয়া-বিছানো ও পিচ ঢালা পথে সবাইকে খালি পায়েই যেতে হয়েছিলো। নবাব সলিমুল্লা না আহসানউল্লা, না-কি সিরাজদ্দৌলা?– আহা, নবাববাড়ি থেকে পল্টন ময়দান পর্যন্ত তার খালি পায়ে হাঁটবার বর্ণনা যতোবার দেয় ততোবার কামালউদ্দিনের বাপের চোখ থেকে বারবার করে পানি পড়ে, তখন মাতৃভাষা কুলাতো না, মিয়া, কেয়া বলে, নবাব বাহাদুরকা দোনো পাঁত্তমে এতনা বড়া বড়া ফোসকা গিরা থা।’ তো ফলও হয়েছিলো। ২ রাকাত নামাজ শেষ হতে না হতে আকাশ জুড়ে মেঘ করে আসে। নামাজের পর মাটিতে লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে হুজুর যখন খোতবা পড়ছে তখন টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়। তারপর সবাই বাড়ি ফেরে ঝমঝম বর্ষণের ভেতর। সেই বহুকাল আগেকার বৃষ্টির ঝাপটায় কামালউদ্দিনের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কামালউদ্দিন কি সেই নামাজে সামিল হয়েছিলো? বাপজানকে জিগ্যেস করলে হতো। তার বাবা তো আসেই না! আকবরের মা এতোবার আসতে পারে, কৈ বাপজান তো আসে না! মৃত্যুর পরও কি বাপজান তার পিরসায়েবের কদমমোবারকের খোদমতই করে চলছে? বাবার ওপর একটু রাগ হয়, মরণের পর কি ছেলেকে দেখতে একবারও আসতে পারে না? পিরসায়ের কি এখনও তাকে কবজা করে রেখেছে?–না, বাপজানের আর দোষ কী? একদিন ঠিকই এসেছিলো, হ্যাঁ, তাকে নিতেই আসে, তো কামালউদ্দিন যেতে পারলো না। সেও তো অনেকদিন হতে চললো। সেদিন কামালউদ্দিনের এই অসুখের শুরু। তার ভাড়াটের সঙ্গে সেদিন তার একচোট ঝগড়া হয়েছিলো। ভাড়াটে লোকটা এমনিতে ভালোই ছিলো, দ্যাখা হলেই ‘খালুজান খালুজান’ করতো, ‘খালুজান কেমন আছেন’, ‘ব্লাড প্রেসার দেখিয়েছিলেন? এখন ব্লাড প্রেসার কতো?’–কতো মিষ্টি মিষ্টি কথা, এদিকে মাস ভাড়া বাকি।—মিনসিপ্যালটি তোমার দোকান উঠাইয়া দিছে তো আমি তার কী করুম? একটা খালি জায়গা পাইলেই তোমার দোকান বানাইবা, মিনসিপ্যালটি তোমাগো উচ্ছেদ করবো না তো জমি কবলা কইরা দিবো? ঐগুলি কোনো কথা না. আমার ভাড়া বুঝাইয়া দাও নাইলে তুমি ঘর দ্যাহো। তুমি উঠলেই আমি ভাড়া বাড়াইতে পারি। তার গলা বড়ো চড়ে গিয়েছিলো, চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতেই তার মনে হয় যে মাথার ভেতরকার রগগুলো তার সিঙার মেশিনের রবিনের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে, এই জট বোধহয় জিন্দেগিতে খোলা সম্ভব হবে না। নিশ্বাস তার ছোটো হয়ে আসে এবং দেখতে দেখতে বাতাস ঢোকার পথ বন্ধ হয়ে যায়। তারপর সব অন্ধকার। কেবল মনে আছে তার বাপজান একবার এসেছিলো, মাথায় হাত বুলিয়ে বলছিলো, ‘আমার লগে চল। এহানে বহুত তকলিফ, চল যাই গিয়া সে চলেই যেতো, কিন্তু ঐ সময় চুতমারানি ডাক্তার কী ইঞ্জেকশন দিয়ে তার চোখ খুলিয়ে দেয়। চোখ মেলে কামালউদ্দিন দ্যাখে যে তার পাশে হাউমাউ করে কান্নাকাটি করছে আকবরের মা, পায়ের কাছে আমজাদের বৌ, আমজাদ, খোদেজা। এমন কি আকবরও এসেছিলো। সেই সময় বাপজানের সঙ্গে যেতে পারলে তার কি এই দশা ঘটে? বাপজান তার কামেল পিরের খেদমত করে জীবন কাটালো, সে ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো বেঁচে থেকে ছেলে কেবল দোজখের আগুনে পুড়বে। বাপজান আর একবার আসে তো কামালউদ্দিন আর ভুল করবে না। তার আঙুল ধরে সোজা উঠে চলে যাবে। কিন্তু হাঁটতে পারবে তো? বাপজান এতোবড়ো কামেল পিরের সঙ্গে ছিলো, এখনো হয়তো আছে, ছেলের হাঁটার ব্যবস্থা করতে পারবে না? কিন্তু কৈ, বাপজান তো আসে না! তাকে আর কী দোষ দেবে? কামালউদ্দিনের নিজের ছেলে সোবহান–সবচেয়ে ছোটো ছেলে, সে কি খোয়ারের মধ্যেও একবার এসে দ্যাখা দিতে পারে না? এই একটা ছেলেকে কামালউদ্দিন যত্ন করে লেখাপড়া করাতে চেয়েছিলো। মাথা ছিলো ভালো, পোগোজ স্কুল থেকে এক চান্সে ম্যাট্রিক পাস করে জগন্নাথে ভর্তি হয়, তার কলেজে পড়ার ব্যাপারে আমজাদের খুব উৎসাহ ছিলো। এদিক ওদিক ফ্যান বাল্ব সুইচ সাপ্লায়ের ব্যবসা তার তখন একটু জমে উঠেছে, কলেজে ভর্তি হওয়ার টাকা, বইপত্র কেনা। সব ব্যবস্থা করে আমজাদই। মিলিটারির জুলুম শুরু হলো যখন, এই মহল্লার আরো কয়েকটা ছেলের সঙ্গে সে বেরিয়ে গেলো। যুদ্ধের পর বন্দুক ফোটাতে ফোটাতে কতো ছেলে ঘরে ফিরলো, পথের দিকে দেখতে দেখতে কামালউদ্দিনের চোখ কানা হবার দশা, তার ব্লাড প্রেসারের শুরু বলতে গেলে তখন থেকেই, কিন্তু না, সোবহান আর ঘরে ফেরে নাই। মহল্লার কোন ছেলে নাকি বলেছে, কোথায় কোন গ্রামে মাথায় মিলিটারির গুলি লেগে সে মারা গেছে। কোথায়? মরলেও তো মানুষ স্বপ্নে খোয়াবে দ্যাখা দেয়, তার মায়ের স্বপ্নেও সোবহান নাকি প্রায়ই দ্যাখা দিতো, কৈ তার কাছে তো আসে নাই। একদিন, সেও অনেক দিন হয়ে গেলো, আকবরের মায়ের পেছনে ঝাঁকড়া চুলওয়ালা একটি মাথা দ্যাখা গিয়েছিলো, চুল থেকে তার অঝোরে পানি ঝরছিলো। পরে কামালউদ্দিন বুঝতে পারে যে আসলে তার স্বপ্নের কালো-সাদা ছবিতে চুল থেকে ঝরা তরল জিনিসটি ছিলো রক্ত। সোবহান ছাড়া আর কার মাথা থেকে রক্ত ঝরতে পারে? আকবরের মায়ের গলার ঝাঁঝ সেই রাতে খুব বেড়ে গিয়েছিলো, ‘পোলাপান ব্যাকটিরে খেদাইয়া দিয়া তুমি খাতির জমাইয়া খাইতে চাও, না? তোমার শরম করে না?’ সকালবেলা সোবহানের কথা মনে হলে তার চোখ দিয়ে বেশ অনেকক্ষণ ধরে পানি গড়িয়ে পড়ে। ২/৩ বছর আগেকার কথা, আবুবকর তখনো এতোটা লায়েক হয় নাই, নানার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে সে তাকে ভোলাতে চায়, নানা, কান্দো ক্যান? খাড়াও আমি তোমারে কেক আইনা দেই, মাইজা মামু আজ পূর্বাণী থাইকা কী সুন্দর কেক লইয়া আইছে।’ খোদেজার এই ছেলেটির এখন পর্যন্ত ১৫ পুরো হয় নাই। তবু তার জন্য পিচ্চিটাকে কী কষ্টটাই না করতে হয়। রাত্রে তার পাশেই শুয়ে ঘুমায়, ডাকলে উঠে প্রস্রাব করার চোঙাওলা পাত্রটি লুঙির মধ্যে ধরে, থুথু ফেলতে গেলে কামালউদ্দিনের দাড়ি টাড়ি সব লেপ্টে যায়, সেগুলো মুছে দেয়। এমন কি রাত্রে পায়খানা করলে তার ছোচার কাজটিও করতে হয় এই পিচ্চিটাকেই। কামালউদ্দিনের জন্য প্রত্যেকের এতো কষ্ট! সবার কাছে আর কতোকাল তাকে ছোটো হয়ে থাকতে হবে? আকবরের মায়ের কাছে তাকে আর কতোকাল মাথা নিচু করে থাকতে হবে? কিন্তু হায়াত মউত কি তার নিজের হাতে? একি মার্কিন কাপড়ের বালিশের অড় যে সুইয়ের দুটো ফোঁড় দিয়ে সে একটা কিছু করে ফেলতে পারে?—এই আধখান গতর লইয়া তার কিয়ের খাওন, কিয়ের নিন্দ আর কিয়ের হাগামোতা?–সোবহানের রক্ত-ঝরা মাথা দ্যাখার পরদিন মগরেবের পর সে অনেকক্ষণ ধরে মোনাজাত করেছিলো, ‘আল্লা তুমি আমারে দুনিয়ার মইদ্যে দোজখ দ্যাহাও ক্যালায়? আমি তোমার কী করছি? আমারে উঠাইয়া লও। আমারে তুমি যতো খুশি গোরআজাব করো, মগর এই দুনিয়ার দোজখ থাইকা আমারে নাজাত দাও।’ কিন্তু আল্লার কেরামতি বোঝে কে? কেয়ামত পর্যন্ত কি তাকে বেঁচে থাকতে হবে? কামালউদ্দিন তার মরণের আশ্বাস পায় কেবল রুমার কাছে, নানার মৃত্যুর অনিবার্যতা সম্বন্ধে আস্থা আছে কেবল এই মেয়েটির মনেই। খোদেজার এই মেয়েটি তার ঘরে এলেই একবার বলবে, নানা তুমি মরলে এই ঘরে থাকুম আমি আর আপা। আমাগো ঘরে এমুন গরম! এক মিনিটেই সে তার নাতনীর নাম ভুলে যায়, কী নাম যেন? –এর সঙ্গে নুরুন্নাহারের কোথায় যেন মিল আছে। নুরুন্নাহারটা ছিলো সোবহানের পিঠেপিঠি। ভাইবোনে মারামারি করে, জড়াজড়ি করে মানুষ হয়েছে, ওরা এখনো বোধহয় একসঙ্গেই থাকে। বড়ো হতে হতে নুরুন্নাহারের মুখটা একটু লম্বাটে হয়ে যায়, রঙ একটু চাপা হয়। এই মেয়েটিকে কামালউদ্দিন একটু সমীহই করতো। নুরুন্নাহার তার শেষের দিককার সন্তান; তার জন্ম দেশে তখন খুব দুর্ভিক্ষ। আকবরের মা বাচ্চা বিয়াবার আর টাইম পায় নাই! কামালউদ্দিনের তখন খুব টানাটানি। জগদীশবাবুর সুদের হার নিয়ে লোকে যতো নিন্দাই করুক, ঐ সময় টাকাটা না পেলে আকবরের মাকে বাঁচানো যায় কি-না সন্দেহ। আকবরের মায়ের গাহাতপা খিঁচে খিঁচে আসছিলো। হানিফের মা ভাবী রীতিমতো ঘাবড়ে যায়, আকবরের বাপ, রেনুবালা দাইরে তুমি খবর দাও, আমার কেমুন ডর করতাছে।’ এই ভাবীর হাতে আকবর, খোদেজা, আমজাদ সবাই হলো, আর আজ এ কী মুসিবত? রেনুবালা দাই অবশ্য পয়সা তেমন নেয় নাই, তবে তার স্বামী জিতেন কম্পাউন্ডার হালায় ওষুদের দামে ব্যাকটি উঠাইয়া লইছে। — আচ্ছা, ঐ টাকাটা কি জগদীশবাবু দেয়? না-কি মুড়াপাড়ার বাবুদের গোমস্তা রামেশ্বরবাবু? এই নিয়ে কামালউদ্দিন খটকায় পড়ে। তবে এটা মনে আছে যে, জগদীশবাবু দিক আর রামেশ্বর বাবু দিক, সদ্যোজাত মেয়েকে দেখে সুদের কথা, এমন কি ছেলে না হয়ে মেয়ে হবার দুঃখ ঘুচে গিয়েছিলো। কী সুন্দর মেয়ে হয়েছিলো তার। কিন্তু এখন মেয়ের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হানিফের মা ভাবীর শ্যামলা মুখ। বিধবা এই ভাবীর স্বামী এদের খুব দূর সম্পর্কের ভাই। সে সম্পর্ক ধরলেও কিছু এসে যায় না। কিন্তু মহল্লার যে কারো উৎসবে, বালা মুসিবতে হানিফের মা ভাবী ঠিক পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। নুরুন্নাহারের জন্মের রাত্রিটা কামালউদ্দিনের বড়ো বিপদে কাটে। ঘরের বারান্দায় একা একা ছটফট করছিলো, ভাবী বারবার এসে সান্ত্বনা দিয়ে গেছে। একবার ভাবী এসে বসেছিলো তার পাশেই একই বেঞ্চের এমাথা ওমাথা। পান সাজিয়ে সামনে ধরেছিলো ‘ছোটোমিয়া, পান খাও, তাইলে জাগনা থাকবার পারবা। এই কিমামটা লও, লালবাগের কিমাম, মুখে দিয়া দ্যাহো, পান কেমুন মাখনের লাহান মিলাইয়া যাইবো।’ হানিফের মা ভাবী এরকম নরম করে কথা বলতো, আর কারো কাছে সে এরকম কথা শোনে নাই। হানিফের মা না থাকলে সেই রাত্রিতে সে যে কী করতো! মনে আছে, একবার এসে বলেছিলো, ‘এই হইয়া আইলো! রেনুবালা দাই ঠিক কইরা দিছে। আহারে তোমার চক্ষু দুইখান এক্কেরে মুইঞ্জা আহে যাও না, ঘরের মইদ্যে গিয়া নিন্দ পাড়ো, আমি তো আছিই।’ সেই সময় একবার, না খুব অল্পক্ষণের জন্য তার মনে হয় আকবরের মা মারা গেলে এই হানিফের মা ভাবীকে নিয়ে সে ফের নতুন করে ঘর বাঁধতে পারে। না, না, ঠিক এরকম ভাবে নাই। তাই কি হয়, হওয়া উচিত? তবে সেই রাত্রির পর ভাবীকে দেখলে তার মাথার ভেতরকার সাজগোজ ঠিক থাকতো না, সব সিজিল ভেঙে যেতো। বেচারা ভয়ে ভয়ে থাকতো, ভাবীর সামনে পড়ে গেলে অতিরিক্ত আদব দ্যাখতো, হাজার হলেও বড় ভাইয়ের বিবি, মুরুব্বি মানুষ। একটু বড়ো হয়ে হানিফ তেজগাঁয়ে কোন কারখানায় কী কাজ নিয়ে ওদিকেই চলে গেলো, কিছুদিন পর মাকেও নিয়ে যায়। এরপর আর যোগাযোগ নাই। হানিফের মা ভাবীর সঙ্গে তার শেষ দ্যাখা কবে? করে যেন?–নুরুন্নাহারের সঙ্গে হানিফের বিয়ে দিলে যোগাযোগটা থাকতো। এই মেয়েটিকে হানিফের মা ভারী বড়ো পছন্দ করতো, পিয়দা হওনের টাইমে ছেমরি তুই বহুত জ্বালাইছস। তরে আমি বৌ বানাইয়া খাটাইয়া লমু।’ নুরুন্নাহারকে ভাবী ঠাট্টা করে বৌ বলেই ডাকতো। হানিফের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা কিন্তু কামালউদ্দিনের একটু একটু ছিলো। ছিলো কি? মনে হয় ছিলো। এ নিয়ে সে বেশ ধান্দায় পড়ে। হানিফের মুখে ওর মায়ের চেহারা বেশ স্পষ্ট। ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে কামালউদ্দিনের বড়ো ভালো লাগতো। দামাদ করতে পারলে বেশ হতো, না? নুরুন্নাহারের বিয়ের কথাবার্তা যখন চলছে, হানিফের কথা তার বারবার মনে হয়েছে। কিন্তু একবারও আকবরের মায়ের সামনে মুখ ফুটে বলতে পারলো না। কেন যে পারলো না সে সম্বন্ধেও কামালউদ্দিনের ভাবনা পরিষ্কার নয়। ইস, এই বিয়েটা দিতে পারলে মেয়েটা এভাবে মরে? কী সুন্দর মেয়ে তার, যেমন দেখতে, তেমনি পয়মন্ত। দুর্ভিক্ষের সময় জন্ম, অথচ তার জন্মের পরপরই কামালউদ্দিনের কপাল গেলো খুলে। ন্যাশনাল হাসপাতালে বালিশের বড় সাপ্লায়ের অর্ডার পায় জগদীশবাবু, এর আট আনি মাল কামালউদ্দিনের হাতের। বাড়ির লাগোয়া ৩ কাঠা জমি বেচে বাপের তৈরি অসম্পূর্ণ ভিতের ওপর পাকা বাড়ি তৈরি করলো, তার দোতলার ভাড়া আসছে বলেই আমজাদের বৌ এখন পর্যন্ত একটু চুপচাপ থাকে। তো মেয়ের চেহারার মতো মেজাজটাও ছিলো বড়োলোকি। আকবরের মা থেকে শুরু করে আকবর বলো, আমজাদ বলো, খোদেজা বলো–এদের সকলের কাপড়চোপড় সেলাই করেছে কামালউদ্দিন নিজে। কিন্তু বাপের কাটা কাপড় নুরুন্নাহারের পছন্দ হয় নাই। ‘আব্বায় খালি বাদামতলী আর সোয়ারি ঘাটের ব্যাপারিগো লুঙি সেলাই করে, আমার ব্লাউজ কাটছে মনে লয় বালিশের খোল বানাইয়া রাখছে।’ নুরুন্নাহারের জন্য কাপড় বানাতে হতো বড়ো দোকান থেকে, খরচটা বেশি পড়তো, কিন্তু তা কামালউদ্দিনের গায়ে লাগে নাই। মেয়েটা তাকে বড়ো মায়া করতো। ইসলামপুরের সেই দোকানে মেশিন টেশিন গুছিয়ে রেখে বাড়ি ফিরতে তার যতো রাত হোক, কামালউদ্দিন বাড়ি ফিরে দেখেছে নুরুন্নাহার তার ভাত আগলে বসে রয়েছে। আকবরের মা রাত জাগতে পারতো না, সন্ধ্যার পরপরই বিছানায় না গেলে তার চলে না। কামালউদ্দিন ঘরে ফিরলে একেকটি ঝাঁঝালো কথা, যেমন, ‘বাদামতলীর ব্যাকটি ব্যাপারি আর কুলিগো লুঙি সিলাইয়া আইলেন? রাইত হইছে কতো, সেই হিসাব রাখেন?’ বলতে বলতে তাওয়ার ওপর হাঁড়ি রেখে নুরুন্নাহার ভাত গরম করেছে। না, বাপকে নুরুন্নাহার কোনোদিন ঠাণ্ডা ভাত খেতে দেয় নাই। সেই মেয়ে — কামালউদ্দিন পঙ্গু গলায় ঢোঁক গেলে, ঐ ঢোঁক বেঁধে সুইয়ের মতো—সেই মেয়ে কি-না দম বন্ধ হয়ে মরে রক্তের মধ্যে। সবই কপাল। চেহারা সুরত দেখে নবাবপুরের এক হার্ডওয়ারের দোকানের কর্মচারীর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলো, তার স্বভাব যে এরকম কে জানতো? বিয়ের আগে জগদীশবাবু একটু সাবধান করে দিয়েছিলো, ‘ছ্যামরা শুনি প্রত্যেক দিন লায়ন সিনেমা না গেলে ভাত হজম করবার পারে না। একটু খবর লইস তো!’ তা নুরুন্নাহারের জন্য একটু সৌখিন ছেলেই ভালো। সবসময় ফর্সা লুঙি জামা পরা ছেলেটির কথাবার্তাও কামালউদ্দিনের খুব পছন্দ হয়েছিলো। কপাল! কপালে না থাকলে মানুষ কী করতে পারে?

বিয়ের পর আস্তে আস্তে শোনা গেলো যে লায়ন সিনেমাই শেষ নয়। সিনেমার চেয়েও বড়ো আকর্ষণ তার কুমারটুলির খানকিপট্টি। নুরুন্নাহার বাপমাকে কোনোদিন কিছু বলে নাই। তবে বলবার লোকের কি অভাব হয়? মেয়ে তার নিজের কষ্টে নিজেই পুড়লো, কথার ঝাঁঝ পর্যন্ত তার একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আজ এতোদিন পর কামালউদ্দিনের সচল ও অচল কানদুটো খাঁ খাঁ করে, সেখানে নুরুন্নাহারের ঝাপটা মারা কথা পড়ে না কতোকাল! ৭ কি ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা, তখন তার গর্ভপাত ঘটে, টাকের হাট লেনের অন্ধকার ঘরে মেয়ে তার একা একা মরে গেলো, দামাদ হালা তখন কোথায় কোন খানকি মাগীর সঙ্গে রঙ করছে কে জানে? কার মুখে খবর পেয়ে আকবরের মাকে নিয়ে কামালউদ্দিন যখন সেখানে পৌঁছলো তখন সব শেষ। কুমারটুলির মস্তান আসে তাদের অনেক পরে। খানকির বাচ্চার হাউমাউ কান্না কামালউদ্দিনের অসহ্য ঠেকে, তার ইচ্ছা করছিলো চুতমারানির পাছায় লাখি দিয়ে কুমারটুলি পাঠিয়ে দেয়। ছোকরা কিন্তু পরে আর বিয়েশাদি করে নাই। কেন করলো না সে-ই জানে। একদিন তন্দ্রার ভেতর কামালউদ্দিন দ্যাখে কি ঐ ছোকরা দাঁড়িয়ে সিগ্রেট ফুঁকছে। পাশে একটি মেয়ে। দেখে তার মেজাজ চড়ে যায়, বেয়াদব ছ্যামরা, শ্বশুরবাড়ি আহে খানকি লইয়া! কিন্তু এখন মনে হচ্ছে মেয়েটি যেন তাকে কষে ধমক দিয়েছিলো, গতরের উপরে একখানা তাম্বু খাটাইয়া ভ্যাটকাইয়া পইড়া থাকো, শরম করে না? আম্মায় ডাক পাড়ে, কানের মইদ্যে লুঙি দিয়া রাখো?’ মেয়েটি কি নুরুন্নাহারই ছিলো?—মৃত্যুর পরও কি ভ্যাদাইমা ছ্যামরার কবজা থাইকা মাইয়া বারাইবার পারে নাই? –না কি সে তার কবজায় থেকেই সুখ পায়? সে কি সত্যি নুরুন্নাহার? ঐ মেয়ে ছাড়া তার সেলাই করা পাঞ্জাবির সঙ্গে তাঁবুর তুলনা করতে পারে আর কে?—তার মাথার ভেতর কে যেন একটি সুই বিধে দিলে কামালউদ্দিন হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, মা রে, আমি কী করুম? আল্লায় আমারে উঠাইয়া না লইলে আমি কী করবার পারি?’ প্রচণ্ডরকম একটি কাশির দমক আসে, কাশতে কাশতে দম বন্ধ হবার দশা হলে বাম হাত দিয়ে নিজের মাথা চেপে ধরে। বুকের কষ্টটা দমাবে কোন হাত দিয়ে? সেখানে চিনচিন করে, আহারে, আল্লারে, এই দমটাই আমার শেষ দম কইরা দাও। কিন্তু প্রায় একসঙ্গে লুঙির ভেতর একটি গরম কেঁচোর তরল গতি টের পায়, দেখতে দেখতে ভিজে লুঙি ঠাণ্ডা হলে কামালউদ্দিন বড়ো বিচলিত হয়। ঠাণ্ডা প্রবাহটি নেতিয়ে পড়া নুনু ও ঊরু গড়িয়ে পাছায় ছড়িয়ে পড়লে তার ভয় হয়, পেচ্ছাবের সঙ্গে পায়খানা হলো না তো? তার সারা গায়ের সচল এমন কি অচল ভাগটিও ঘিনঘিন করে। পবিত্র হবার জন্য কামালউদ্দিন তখন শিয়রের কাছে মাটির ঢেলা হাতড়ায়। সেটা হাতে ঠেকলে কামালউদ্দিন টের পায় যে আকবরের মা তবে ঠিকই এসেছিলো। কিন্তু কৈ, তাকে তো দ্যাখা দিলো না! তবে কি সেই তরুণীটিই? তাহলে তার কোলের শিশুটি কে?—এই ঝামেলার সমাধান না হতেই আজান শোনা গেলো। আল্লার নাম তার কানে ঠিক মধু পেচ্ছাব অথবা পেচ্ছাব-পায়খানায় মাখামাখি গতর আরো ঘিনঘিন করে। এখন দরকার আবুবকরকে। প্রথমে তার গলা একটু মিনমিনে শোনায়, এর কারণ এই হতে পারে যে বেঁচে থাকার জন্য এবং বেঁচে থেকে লুঙিতে হাগাযোতা করার জন্য দোষী দোষী ভাবটা তার বেড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এইসময় তার গোটা মাথা ও শরীরে খোদেজার হামলানো কান্না আছড়ে পড়লো। তখন ফের নতুন করে চোখে পড়ে যে দরজাটা খোলা, পাশের তক্তপোশের মশারি ভোরবেলার হাওয়ায় একটু একটু কাঁপে। ঐ বিছানা শূন্য! কামালউদ্দিন আঁতকে উঠলো, তবে কি আবুবকর মারা গেলো? তাহলে এখন তার গুমুত ধোবে কে? এই উদ্বেগ তার চিরে যায় খোদেজার আর এক চিৎকারে। এবার সে একবারে নেতিয়ে পড়ে : আল্লা তুমি আমারে দোজখের মইদ্যে আর কতোদিন রাখবা? খোদেজারে অহন আমি মুখ দ্যাহাই ক্যামনে?

‘নানা, জাগনা পাইছেন?’ ঘরে আবুবকর ঢুকলে কামালউদ্দিন তার ওপর ভয়ানক বিরক্ত হয়। ভোর হতে না হতে ছ্যামরা কোথায় মরতে গিয়ে ছিলো? কিন্তু কামালউদ্দিন তার অভিযোগ যা প্রকাশ করে তা অন্যরকম, ‘আজানের আগেই আমি জাগনা পাই না?’ আবুবকর হঠাৎ করে বলে, ‘বড়োমামুর খবর ভালো না।’

‘এ্যাঁ? কী কইলি?’

দারুণরকম চমকে ওঠায় তার উচ্চারণ খুব স্পষ্ট। এমন কি তার মাথার অচল দিকটাও কতোকাল আগে বয়ে যাওয়া হাওয়ায় একটু কাঁপলো। আবুবকর ফোঁপাতে আরম্ভ করে বড়োমামু বেহুঁশ হইয়া রইছে। রাইতে হাসপাতালে গেছিলাম, মাইজা মামু অহন তরি হাসপাতালে বইসা রইছে।’

কামালউদ্দিন কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকায়। সে যেন আগেই এই খবর পেয়ে গেছে, কিংবা এই নিয়ে সে অনেকক্ষণ ধরে কারো কাছে মেলা তদবির করে ফিরলো। তাই ‘আল্লা! আল্লা গো!’ বলে চ্যাঁচালে তার গলায় শোকের বদলে ফোটে অভিযোগ। এখন সব কিছু তার কাছে স্পষ্ট : ৫৫/৬০ বছর আগে ফিরে গিয়ে আকবরের মা আজ রাত্রে এসেছিলো, কোলে ছিলো তার ৮/৯ মাস বয়সের আকবর। প্রথম সন্তানকে সে কাঁথায় জড়িয়ে নিয়ে চলে গেলো, কামালউদ্দিন কোনো বাধাই দিতে পারলো না।

কামালউদ্দিনের জিভের সচল সাইডের ‘আল্লা গো’ শুনে এই ঘরে ছুটে এসেছে খোদেজা। আব্বারে কইছস?’ কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে সে ধমকাবার চেষ্টা করে, কিন্তু এই উদ্যোগ নিতে গিয়ে তার নিজের কান্না আরো উথলে ওঠে। ঐ অবস্থাতেই খোদেজা আকবরের শারীরিক অবস্থার একটি দীর্ঘ বিবরণ ছাড়ে।

রাত্রি দেড়টার দিকে ঘরে ফিরে আকবর অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। ঘণ্টাখানেক পর আকবরের ছোটো ছেলে এই বাড়িতে এসে খবর দিলে আমজাদ ও আবুবকর চলে যায় মালীবাগ চৌধুরীপাড়া। আকবর তখনো বেহুঁশ। অতো রাতে কোথায় এ্যাম্বুলেন্স, কোথায় কী? ফজরের আজানের আগে আগে একটা স্কুটার পাওয়া যায়। মেডিক্যাল কলেজে কোনো ভরসা দিতে পারে নাই। –কামালউদ্দিনের কাছে এসব কথা বলা অর্থহীন। রাত দেড়টায় আকবর যদি বেহুঁশ হয়ে থাকে তো তার বাঁচার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, আকবরের মা ঐ সময়েই শিশু কোলে তার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

বেলা ১২টার দিকে তাকে বারান্দায় বসিয়ে দিলে ৫৫/৬০ বছরের ছেলের মৃতদেহের মুখে রায়ের বাজারের মাটির হাঁড়িপাতিল বানানো কুমারের মতো করে হাত ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে কামালউদ্দিন সেখানে ৮ মাসের একটি শিশুর আদল নিয়ে আসে। তার সচল আধখানা জিভ ও ঠোঁটের একপাশ থেকে কীসব আওয়াজ বেরোয় কেউ বোঝে না, বোঝবার চেষ্টাও করে না। তাতে কামালউদ্দিনের কী এসে যায়? সে জানে আকবরের মা আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে, এবার আকবরকেও হাত করে ফেললো। আকবরের মা কি এক এক করে সবাইকে টেনে নিয়ে যাবে?

হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে আসা, লাশ গোসল করানো থেকে শুরু করে দাফন করা পর্যন্ত যাবতীয় কাজে নানাভাবে জড়িত থেকে এবং এরই মধ্যে কখনো একা কখনো কোরোসে, কখনো ভেউ ভেউ করে ও কখনো উঁ উঁ করে কেঁদে ক্লান্ত আবুবকর রাত্রে বেঘোরে ঘুমোয়। আকবরের ১৩ বছরের ছেলেটিও আজ তার পাশে। ছেলেটির বোধহয় সর্দি, কিংবা সারাদিন কান্নাকাটির ফলেও হতে পারে,–চাপা নিশ্বাসের সঙ্গে নাক দিয়ে তার কোঁকোঁ আওয়াজ আসছে। ভেতরের একটি ঘর থেকে খোদেজার সবিরাম কান্না মাঝে মাঝে পাড়া তোলপাড় করে তোলে। বারান্দার জলচৌকিতে জোড়াহাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে আকবরের বৌ, খোদেজা ও আমজাদের বৌ হাজার চেষ্টা করেও তাকে ঘরে নিয়ে শোয়াতে পারে নাই। বৌটা বড়ো জেদি, এখন এতো জেদ কি ভালো? তো এ নিয়ে কামালউদ্দিনের মাথা ঘামাবার দরকারটা কী? তার ঘুম আসে না। ভয়ে ভয়ে সে আকবরের মায়ের জন্য অপেক্ষা করে। আজ তাকে সে মুখ দ্যাখাবে কী করে? আকবরের মা আজ একা আসবে না। আকবর তো এখানেই আছে। এই যে বারান্দার ঠিক নিচে চাদর দিয়ে আড়া করে নিয়ে যেখানে আজ তাকে গোসল করানো হলো ঐ জায়গা তার ৪০ দিনের ঠিকানা। মাকে দেখলেই ৫৫/৬০ বছর উজিয়ে ৮ মাসের শিশু হয়ে সে দিব্যি হাজির হবে। তারপর নুরুন্নাহার। রক্তাক্ত মাথায় দাঁড়িয়ে থাকবে সোবহান। খোদেজার ছাদ থেকে পড়ে-মরা ছেলেটা, এখন নাম মনে পড়লো, ফিরোজ, হ্যাঁ, ফিরোজই তো, সে-ও আসবে তার ব্যান্ডেজ বাধা পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এই ঘরে এতোসব লোকের জায়গা হবে? না, তারা কোনো জায়গা নেয় না। তাদের গতরে কি সের সের রক্ত-মাংস থিকথিক করে যে তারা এলে ঘর-দোর সব গিজগিজ করবে? জায়গা লাগে কামাল উদ্দিনের। আর কতোকাল সে দখল করে থাকবে? সচল বাম হাত ও অচল ডান হাত বুকে রেখে কামালউদ্দিন শুয়ে শুয়েই রাকাতের পর রাকাত নামাজ পড়ে, নামাজের নিয়ম পালনের জন্য এখন সে পরোয়া করছে না, তার মোনাজাতও এসে ঠেকছে কেবল একটিতে–আল্লা তাকে এক্ষুনি দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নিক, আগামীকাল ফজর যেন দেখতে না হয়। যদি সে নেকদার বান্দা হয় তো আল্লা তার কথায় সাড়া দেবে না কেন? সুরা, দোয়া তার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, ব্যাকুলভাবে সে অনুসন্ধান চালাচ্ছে, কবে, কীভাবে সে কী গুনা করলো যে আল্লা তাকে এভাবে দোজখ খাটায়। কবে সে কী অপরাধ করলো? আচ্ছা, ঐ ব্যাপারটিকে কি আল্লা গুনা বলে সনাক্ত করবে? ঐ যে বহুদিন আগে রায়সাহেবের বাজারে এক জেলের কাছ থেকে গলদা চিংড়ি নিয়ে দাম না দিয়ে চলে এসেছিলো, তারপর একবছর ওদিকে পা মাড়ায় নাই। কিন্তু আল্লা জানে তার দোষ নাই। ঐ সময় তার শাশুড়ি বেড়াতে এসেছিলো, আকবরের মা তাকে গলদা চিংড়ি খাওয়াবার জন্য একেবারে পাগলা হয়ে উঠলো। রোজ রোজ গলদা চিংড়ি গলদা চিংড়ি করে তার জানটা নাস্তানাবুদ করে ফেলে। তখন অতো দাম দিয়ে মাছ কেনার সামর্থ কোথায়? আল্লা কি এটুকু বুঝবে না? তবে জগদীশবাবুর বাজারের ঝুড়ি থেকে কয়েকদিন মাছটা তরকারিটা সরিয়েছে, এটাই কি তার অপরাধ? রায়টের সময় জগদীশবাবুর বাজারটা করে দিতো কামালউদ্দিন। জগদীশবাবু দাঁড়িয়ে থাকতো লোহার পুলের ঠিক ওপারে, কামালউদ্দিনের হাতে ঝুড়ি দিয়ে বলতো, ‘মাছটা দেইখা কিনিস। মাছ নরম হইলে ধীরেনের মায়ে চেতবো।’ তা কামালউদ্দিন নিজের ঝুড়িতে মাছ কিছুটা সরাতো বৈকি! জগদীশবাবু কোনোদিন কিছু বলে নাই, কিন্তু তার শালাটা, ভ্যাদাইমা ছ্যামরাটা, রায়টের পর এই নিয়ে হাউকাউ করতো, ‘কী বে কামাইল্যা, আষ্ট আনার পাবদা মাছ হইলো ঐ কয়টা? মানুষের বিপদের সুযোগ লস, না?’–তা তুমি মালাউন, তুমি হইলা কী কও তোমরা, ধোয়া তুলাসি পাতাটা? ঐ যে তাঁতিবাজারের বরজের দাস, বছর বছর রায়টের টাইমে একটা দুইটা মোসলমান না মারলে যার বলে প্যাটের ভাত হজম হয় না, তার লগে তোমার কিয়ের এতো গুজুরগাজুর, কিয়ের ফুসুরফাসুর?–কিন্তু এসব কথা বলা কামালউদ্দিনের পক্ষে সম্ভব হয় নাই। জগদীশবাবুর ওপর তাকে অনেক নির্ভর করতে হতো, টাকা হাওলাত দিয়ে চড়া সুদ নিলে কী হবে, তার হাত দিয়ে কাজও এসেছে মেলা। আল্লা জানে, তার হাতে জগদীশবাবুর কোনো লোকসান হয় নাই। পার্টিশনের পর তাদের বাড়ির বড়ো বড়ো সব ট্রাঙ্ক, তামার কাঁসার বড়ো বড়ো বাসনকোসন, দুটো পালঙ, চেয়ার টেবিল—সব বেচে দিয়েছিলো এই কামালউদ্দিনই। জগদীশবাবুর মতো লোক কি-না খুশি হয়ে তার সুদের ২৪টা টাকা মাফ করে দিয়েছিলো, সে কি এমনি এমনি? — তাহলে আল্লা তাকে শাস্তি দেয় কেন? তাহলে কি হানিফের মা ভাবী? না না এটা ঠিক নয়। তাড়াতাড়ি করে কামালউদ্দিন অন্য কোনো পাপের খোঁজ করে। সোবহানের দুজন বন্ধুর কথা মনে পড়লে সে একটু হাঁফ ছাড়ে। তাদের রুহ কি আল্লার কাছে তার বিরুদ্ধে ফরিয়াদ করলো? মিলিটারির সঙ্গে যুদ্ধের সময় এক কারফ্যু-রাতে টিকাটুলির ইলেকট্রিক টেরান্সফর্মার না কী বলে, তাই উড়িয়ে দিয়ে সোবহানের দুই বন্ধু তার ঘরে আশ্রয় নেয়। সোবহানের সঙ্গে পড়ে, এদিকেই কোথায় বাড়ি। খুব বিপদের কাজ সেরে তাদেরই একজন সহযোদ্ধার বাপের কাছে আশ্রয় চাইবে না তো কোথায় যাবে? কিন্তু আমজাদের কথা শুনে কামালউদ্দিন তাদের বেশিক্ষণ ঘরে রাখতে পারে নাই। হাত জোড় করে বলেছিলো, ‘বাবারা, আমার পোলায় তোমাগো লগে গেছে, মহল্লার ব্যাকটি মানুষ সন্দ করে। কেউ বুঝবার পারলে তোমাগো বিপদ, আমাগো ভি জেতা রাখবো না।’ কারফ্যুর রাতে ছেলে দুটো বেরিয়ে গেলো, তাদের আর খবর পাওয়া যায় নাই। হয়তো শহর ছেড়ে ওরা ঠিকই বেরিয়ে গিয়েছিলো হয়তো আর কেউ জায়গা দিয়েছিলো। কিংবা পাঞ্জাবিদের হাতে ধরা পড়ে গেছে। তাহলে তো বাঁচার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু তার কী দোষ? আমজাদ যেভাবে ভয় দেখিয়েছিলো, তাতে তার মতো মানুষ কী করে তাদের ঘরে রাখে? আর দোষ যদি হয়েও থাকে, তো যুদ্ধ করতে করতে মরে গিয়ে সোবহান কি বাপের গুনা মাফ করিয়ে নেয় নাই? তাহলে? চিত হয়ে শুয়ে অন্ধকারে কামালউদ্দিন তার গুনা খুঁজে মরে। মশারির ওপার হালকা ঘি রঙের পাখার ব্লেড অন্ধকারে আলগোছে ঝোলে। এই পাখা নেওয়া কি পাপ হয়েছে? স্বাধীনতার পর মহল্লার দিল্লিওয়ালা জুতার দোকানদারের বাড়ি লুট হলে আমজাদ দুটো ফ্যান নিয়ে এসেছিলো। তার একটি সে ফিট করে বাপের ঘরে। আকবরের মা তখন বেঁচে। বলতে কি, তার কথাতেই আমজাদ এই পিতৃসেবার উদ্যোগ নেয়। ছেলেকে কি ছেলের মাকে বাধা দেওয়ার সাহস কামালউদ্দিনের ছিলো না। কিছুদিনের মধ্যে এমন হলো যে ফ্যান ছাড়া সে ঘুমোতেই পারে না। — ছেলে ফ্যান এনে দিয়েছে, তো তার কী দোষ? আবার এও বলি, দিল্লিওয়ালা জুতাওয়ালা না হয় লোক ভালোই ছিলো, কিন্তু তার জাতভাইরা? আরে, রহিমুল্লা সর্দারের ছেলে, যে কি-না ছিলো মিলিটারিদের শান্তি কমিটির পাণ্ডা, ঐ ৯টা মাস খাজা খয়েরুদ্দিনের হোগার পিছে ঘুরলো, প্রধানত যার ভয়ে ঘরে সোবহানের বন্ধুদের জায়গা দেওয়া গেলো না, সেই লোকের বাড়িতে ভাড়া ছিলো এক শালা মাউড়া, মিলিটারি নামার পর থেকে সর্দারের পোলারে ১টা পয়সা ভাড়া দেয় নাই। তাহলে? তাহলে ওদের মাল লুট করতে দোষ কী? না, আল্লা মালুম, এই ব্যাপারে তার কিছু করার ছিলো না। আল্লা তার কোন গুনার জন্য তাকে এই দোজখবাস করায়? তাহলে কি হানিফের মা ভাবী? ভাবীকে তার ভালো লাগতো, কিন্তু তাতে দোষ কী? হিন্দু মেয়েদের সঙ্গে ভাবীর মেলামেশা ছিলো, তাদের মতো সুন্দর করে কথা বলতে পারতো, সেই সময় ভাবী চা বানাতে পারতো, লুচি ভাজতো। প্রথম প্রথম চা খেতে কামালউদ্দিনের জিভে ছ্যাকছ্যাক করতো। এই হানিফের মা ভাবীর হাতে চা খেতে খেতে তার চায়ের নেশা ধরে। এছাড়া? না, আর কিছু থাকলে কি আকবরের মায়ের চোখ এড়াতো? তবে এমন হয়েছে যে ভাবীর কথা মনে করতে করতে মেশিনের সুইয়ের নিচ থেকে কাপড় বেরিয়ে গেছে, সে বুঝতেই পারে নাই। আর একদিন, সেবার খুব শীত পড়েছিলো, কাজ করতে করতে হানিফের মা ভাবীর মুখ তার মুণ্ডুর ভেতরে ঢুকে এমন ঝাঁকাঝাঁকি আরম্ভ করে যে, মগরেবের আজান পড়ার আগেই মেশিন তুলে রেখে কামালউদ্দিন বেরিয়ে পড়ে। তারপর কী করে যে কান্দুপট্টির ভেতর ঢুকে পড়েছিলো সে নিজেও ভালো করে জানে না। কিন্তু আল্লা জানে সেখানে সে নিজে থেকে কোনো একটি প্রাণীকে এমন কি স্পর্শ পর্যন্ত করে নাই। তার ভ্যাবাচ্যাকা ভাব দেখে কিংবা তার রোগা পটকা শরীরে একটি চাল্লির বিভিন্ন লক্ষণ আবিষ্কার করে খানকিরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে। সে রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। মুখ নিচু করে সে পালিয়ে আসছে, এমন সময় এক খানকি মাগী তার গায়ের সুতির র‍্যাপার টেনে নেয়। প্রায় দৌড়ে রাস্তায় নামে কামালউদ্দিন। পেছন থেকে ‘এ মানু, এই কাউঠ্যা, তর ত্যানাখান লইয়া যা, আমাগো পাতিল ধরনের কাপড়ে অভাব নাই’ এইসব বচন এক একটি থাপ্পড়ের মতো তার পাছায় পড়তে থাকে এবং তার গতি বৃদ্ধি করে। শীতের ভেতর পাতলা জামা গায়ে তাকে সেদিন অনেকটা পথ হাঁটতে হয়েছিলো, কিন্তু তার ঠাণ্ডা লাগে নাই। এমন কি জিনভূতের ভয় থাকা সত্ত্বেও ভিক্টোরিয়া পার্কে সে অনেকটা সময় বসে বসে কাটায়। রাত্রে কিন্তু ভাবীর ওপর সাঙ্ঘাতিক রকম রাগ হয়েছিলো, এই মেয়েমানুষ সকলের সঙ্গে এতো ঢলাঢলি করে কেন? সব কথায় হাসির কী থাকতে পারে? নিজের এই রাগের মাথামুণ্ডু সে আজও বুঝতে পারে না। তো এখানে সে কোন গুনাটার কাম করলো? তাহলে? কামালউদ্দিন কাঁদতে শুরু করে। আকবরের মৃত্যু বা নিজের অবাঞ্ছিত নরক বাস অথবা এই দুইটাই তার কান্নার কারণ হতে পারে। প্রথমে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো, ফোঁপানোতে বেশিক্ষণ আটকে থাকা সম্ভব হয় না, একটু পরই গোঙাতে শুরু করে, বলতে গেলে সে প্রায় হামলে ওঠে, ‘আল্লা! তুমি আমারে উঠাইয়া লও।’ তার মুখ দিয়ে লালা গড়ায়। ভাঙা ও পঙ্গু গলা এবং জড়ানো ও পঙ্গু জিভে লালা বলকানো স্বরে আল্লার প্রতি তার এই ব্যাকুল আকুতিতে পাশের বিছানায় ঘুমিয়ে-থাকা আকবরের ছোটো ছেলের ঘুম ভাঙে এবং সে ‘আম্মা আম্মা’ বলে চিৎকার করে। কান্না এখন কামালউদ্দিনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কাঁদতে কাঁদতে বার কয়েক নাতিকেও ডাকে। কিন্তু আল্লা কি তার উদ্দেশ্যে বলা কথা আকবরের ছেলের চিৎকারকে এতেটুকু দমাতে পারে না! কামালউদ্দিন কী করবে? একটু পর দরজায় করাঘাত শুনে তার আশা হয় যে খোদেজা এসে পড়েছে, এবার একটা ব্যবস্থা হবেই। আবুবকর উঠে ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলে দিলে বারান্দা থেকে আকবরের বৌ ক্লান্ত ও কঠিন গলায় ছেলেকে বকে, ‘কইলাম, আমার লগে থাক। না, কথা হুনবো না। আয় কুত্তার বাচ্চা আয়, বারাইয়া আয়।’ সদ্যস্বামীহারা মেয়েটি সদ্যপুত্রহারা রুগ্ন শ্বশুরের দিকে কিছুমাত্র না তাকিয়ে ছেলের হাত ধরে তাকে প্রায় ছ্যাচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে নিয়ে যায়। বৌয়ের শোকগ্রস্ত গলার অসন্তুষ্ট বিড়বিড় ধ্বনি অস্পষ্ট হলেও কামালউদ্দিন জানে যে সমস্ত দোষ বৌ ঠিক তার ঘাড়েই অর্পণ করে গেলো। ছেলে মরার পরও সে বেঁচে থাকে কেন? তার লজ্জা করে না?

তার কোঁচকানো শরীর আরো কাঁপে। সচল ও অচল অঙ্গগুলোকে একটিমাত্র অবিভাজ্য কাঠামোতে রূপ দেওয়ার জন্য সে কুণ্ডলী পাকিয়ে শোয়। ঘন নিশ্বাসে কামালউদ্দিন নিঃশব্দে মোনাজাত করে, ‘আল্লা, তুমি তোমার বান্দার দিলের খবর রাখো। এই রাইত যানি আমার শ্যাষ রাইত হয়। আমারে এই দোজখ থাইকা উঠাইয়া তুমি যা খুশি করো। কেয়ামত তক আমারে গোর আজাব দাও, মুনকির নকুর আইয়া কেয়ামত তক আমারে আগুনের দোররা মারুক, তাও ভি ভালা, মগর এই হাবিয়া থাইকা আমারে উঠাইয়া লও। এই দোজখের ফজর যানি আমারে চোক্ষে দেখতে না হয়।’ জীবনে যতো সৎ কাজ সে করেছে সব সওয়াব সে প্রত্যাহার করে নিতে প্রস্তুত, বিনিময়ে তার কাম্য কেবল তার মৃত্যু। কী সওয়াব আছে তার?—কামালউদ্দিন নতুন ঝামেলায় পড়ে। বাপের পিরহুজুরের দরগায় বছর বছর ওরসে চাঁদা দেওয়ার কথা তার হিসাবে আছে বটে, কিন্তু দেওয়ার ক্ষমতা তার কতোটা? নবাববাড়ির মুরিদ, বলিয়াদির জমিদারবাড়ির মুরিদ, ইসলামপুরের বড়ো বড়ো কাপড়ের দোকানদার মুরিদ,–ওরসের টাকা যোগায় তো এরা, তার ঐ ৫ টাকা ১০ টাকা ওরসের কী কাজে লাগে? পিরসায়েবের ভাগ্নে কি ভাগ্নের ছেলে এখন গদ্দিনশীন, আমজাদ তার মুরিদ, আমজাদ নাকি মেলা পয়সাকড়ি ঢালে; তা ছেলের সওয়াবে কি বাপের হিস্যা থাকে? বাপ কি ছেলের ওয়ারিশ?—নাঃ! হুজুরের ওখানে তার সওয়াব কিছু নাই বললেই চলে। নামাজটা কিন্তু কামালউদ্দিন প্রায় নিয়মিতই পড়তো। ইসলামপুরের ছাতা ও খেলার সরঞ্জামের দোকানের বারান্দায় কাজ করার সময় অনেকদিন আসর বাদ পড়েছে, কিন্তু যতোটা সম্ভব পরে সে কাজা আদায় করে নিয়েছে। জগদীশবাবু হাসপাতালের বালিশের অড় সাপ্লায়ের অর্ডার নিলে তার কাজের চাপ এতো বেড়ে গিয়েছিলো যে একদিন রোজা মুখে কামালউদ্দিন বেহুঁশ হয়ে পড়ে। এরপর ৭/৮ টা রোজা তার বাদ পড়ে। তবে পরে কিন্তু অনেকগুলো রোজা করে কামালউদ্দিন পুষিয়ে নিয়েছিলো। এছাড়া সাওয়াবের কাজ সে আর কী করেছে? কী করেছে? সওয়াবের কাজ আর কী করেছে?–নিজের সৎ কাজ খুঁজতে খুঁজতে তার তন্দ্রা আসে এবং তন্দ্রা থেকে ঘুমের মধ্যে গড়ালে আকবরের মা এবং আকবরের বৌকে রান্নাঘরে পাশাপাশি বাঁটতে বসে আলু বেগুন কুটতে দ্যাখে। তাদের এই সহ-অবস্থান ভালো করে দেখতে না দেখতে আজান শোনা গেলো।

আল্লা তার সওয়াব ফিরিয়ে নেওয়ার মোনাজাত কবুল করে না কিংবা কবুল হওয়ার মতো সওয়াব তার জীবনে হয় নাই। সকালবেলা কামালউদ্দিন বেঁচেই থাকে এবং ফজরের নামাজ পড়ে। শুয়ে শুয়ে সে জোহর পড়ে, আসর মাগরে, কোনোটাই বাদ যায় না। আকবরের বৌয়ের কীরকম এক বোন এসে তারস্বরে কাঁদে এবং তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাঁদে আকবরের বৌ। এইসব কান্নায় দেওয়ালের নোনা বাড়ে এবং খসে পড়া চুনের ধকে কামালউদ্দিনের চোখ খচখচ করে। তার মাথায় হাত দিয়ে কখনো ফুঁপিয়ে কখনো চুপচাপ কাঁদছে আকবরের ছোটো মেয়ে। মেয়েটা খালার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলো, খবর পেয়ে আজ খালার সঙ্গেই চলে এসেছে। শোক এখনো তার টাটকা বলে মেয়েটা ঠিক নেতিয়ে পড়ে নাই। পরশু রাতে এর নাম মনে ভুলে গিয়েছিলো বলে কামালউদ্দিন প্রথম প্রথম তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলো। কেউ বলার আগেই নাম মনে পড়লো তার, পারভীন। এই নাম মনে পড়াতেই কামালউদ্দিন খানিকটা চাঙা হয়ে উঠলো, নিজে নিজে বিড়বিড় করলো, এই ধরনের নাম তাদের পরিবারে কোনোদিন ছিলো নাকি যে সবসময় মনে রাখতে পারবে? তার কী দোষ? এ্যা, তার কী দোষ? নাতনী এখনো তার ন্যাওটাই রয়ে গেছে, এসেই কাঁদতে কাঁদতে ঠিক দাদার ঘরেই ঢুকেছে। না, এসব মায়া ভালো নয়। এগুলো শয়তানের খেলা, মানুষের দোজখের মেয়াদ বাড়ানোই হলো ইবলিসের এক নম্বরের চাকরি। তবে এখন শয়তানের চেয়ে তার বেশি রাগ হচ্ছে আকবরের ওপর। এতো বড়ো মেয়েটাকে সে বিয়ে দেয় নাই কেন? এই মেয়ে যে কার হাতে পড়ে। আমজাদকে ভালো করে বলতে হবে, আল্লা দিনদিন তার অবস্থা ভালো করছে, তার আরো ভালো হবে, আমজাদ যেন আকবরের ছেলেমেয়েদের নিজের মনে করে মানুষ করে। আকবরের বৌয়ের তেজটা একটু বেশি। আমজাদের বৌ এখন জাকে বেশিদিন সহ্য করলে হয়। তা ওরা যা ইচ্ছা করুক। দোজখের ভেতরকার ঝামেলা যতোই বাড় ক, তার কী? অবিরাম সে তসবি টিপে চলেছে, আল্লা আজরাইলকে যতোদিন না তার কাছে পাঠাচ্ছে ততোদিন তার নামাজ পড়া আর দোয়া পড়ার বিরতি নাই। আল্লা তাকে কতোদিন অচ্ছুৎ করে রাখতে পারে সেও দেখবে!

তবে কি-না প্রাণ যখন একটা আছেই, কিছু করতে পারুক আর না-ই পারুক, তার প্রতি আজরাইলের অরুচির কারণেই কামালউদ্দিন হলো এই বাড়ির মুরুব্বি। আকবরের কুলখানির দিন আধখানা সচল গা ঝেড়ে বাকি অচল আধখানা বোরখা পরা খোদেজা ও কপালে ওড়না-ঢাকা পারভীনের ওপর রেখে বারান্দায় এসে তাকে বসতে হয়। সকালবেলা আমজাদ এসে তাকে রেডিমেড পাজামা-পাঞ্জাবি দিয়ে গেলো, পিরহুজুরে আইবো, সাফসুরুত হইয়া থাইকেন। হুজুরের লগে কয়জন ভিআইপি–বহুত খানদানি মানুষ ভি আইবার পারে। আব্বা, আপনে রেডি হইয়া থাইকেন।’ নওশা সাজতে কামালউদ্দিন মন থেকে সায় পায় না, বিশেষ করে পাজামা পরার অভ্যাসও তার নাই। এর ওপর শৌচকার্যের ব্যাপারটি নিখুঁভাবে সম্পন্ন হয় না বলে পাছার সচল সাইডটা তার প্রায় সব সময় চড়চড় করে। নতুন পাজামা নষ্ট করে লাভ কী? কিন্তু আমজাদ ধমক দেয়, ঐগুলি নখরা ছাড়ান দ্যান। হুজুরে নাপাক মানুষ দ্যাখবার পারে না।’

পিরসায়েবের চেহারা সুরত দেখে চোখ ফেরানো দায়। গায়ের রঙ লালচে ফর্সা। কালো কুচকুচে দাড়ির মাঝে মাঝে সাদা কয়েকটি রেখা, আহা কালো মখমলের কাপড়ে জরির মিহি কাজ। সাদা সার্জস্কিনের শেরোয়ানির ভেতর পিরসায়েবকে দ্যাখায় নবাববাড়ির নওশার মতো। এক বশিরউদ্দিন ছাড়া আর কারো হাতে এ শেরোয়ানি কাটা হতে পারে না। এখন একজন পাঙ্খাবরদারের খুব দরকার। এরা আজকালকার পোলাপান কিছুই জানে না। এতোই খরচ করতে পারে তো একটা পাঙ্খাবরদারের জন্য আর কটা পয়সাই না হয় যেতো। হুজুরের পেছনে পেছনে আরো খানদানি মানুষের সারি। আমজাদ এদের সম্বন্ধে কী একটা ইংরাজি কথা যেন বললো, কথাটা মনে নাই বলে কামালউদ্দিন হায় হায় করে না। কাপড়ের কাট দেখলেই বোঝা যায় কে কী দরের মানুষ।

আমজাদের সঙ্গে বারান্দায় উঠে এসে পিরসায়ের তার সঙ্গে মোসাবা করার জন্য লালচে ফর্সা হাতজোড়া এগিয়ে দিলে কামালউদ্দিনের প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবার দশা ঘটে। আমজাদ তাড়াতাড়ি তাকে ধরে ফেলে এবং বাপের হয়ে কৈফিয়ত দেয়, ‘হুজুর, আব্বা বিমারি মানুষ। আব্বার লাইগা দোয়া কইরেন।’

মিলাদের পর নাজাতের দোয়া পড়ে একটুখানি ফিরনি মুখে দিয়ে হুজুর চলে গেলো। হুজুরের পেছনে আমজাদের এক পিরভায়ের গাড়িতে গেলো বিরিয়ানির ডেগচি, রেজালার হাঁড়ি, টিফিন ক্যারিয়ারের মস্ত মস্ত বাটিতে টিকিয়া, জর্দা। বড়ো বড়ো মুরিদদের প্রায় কেউই রইলো না, এদেরই কার যেন কাপড়ের মিল চালু হবে আজ, হুজুর সেখানে যাচ্ছে খাস দোয়া পড়তে। এদের কার কীরকম মর্যাদা সেটা ঠিকমতো বুঝতে না পারলেও বিরিয়ানি, রেজালা, জর্দা ও আগরবাতির মিলিত খসবু ধোঁয়ায় কামালউদ্দিনের সচল ও নিমচল চোখজোড়া ছলছল করে : হায়রে, আকবর বেঁচে থাকলে কী তৃপ্তিটাই না পেতো! বেচারার তামাম জিন্দেগি বড়ো কষ্টে কেটেছে। তাকে দোয়া করার জন্য আজ এখানে কতো বড়ো বড়ো খানদানি মানুষ। ঐ যে রহিমুল্লা সর্দারের নাতি খেয়ে উঠে ড্রামের পানিতে হাত ধুচ্ছে। ২ জন পুলিস দেখে ইজি চেয়ার থেকে উঠে বসার জন্য কামালউদ্দিন উসখুস করে। না, ভয়ের কিছু নাই, গলিতে গাড়ি কন্ট্রোল করার জন্য আমজাদ এদের পয়সা দিয়ে নিয়ে এসেছে, এরা এখন খাবে বলে সামিয়ানার নিচে পাতা লম্বা টেবিলের দিকে যাচ্ছে। আহা, আকবর যদি এসব দেখতে পেতো! আমজাদ যে বলে, ঠিকই, ‘হুজুরপাকের দোয়ার বরকতে দেইখেন এই বাড়ি ভাইঙা আমি কেমুন বিল্ডিং বানাই।’ আমজাদ বলে তার যাবতীয় উন্নতি পিরহুজুরের দোয়ার বরকতে। আবার দ্যাখো তার পিরের প্রতি ভক্তিতেই বাপজান ঘর সংসার ছেড়ে রাতদিন মাজার শরিফেই পড়ে থাকতো। আল্লার খেয়াল কে বুঝতে পারে? তার বাপজানের মোনাজাতে সাড়া দিয়ে আল্লা তাকে দুনিয়া থেকে তাড়াতাড়ি উঠিয়ে নেয়, ওপারে গিয়ে বাপজান তার হুজুরপাকের সঙ্গে নিশ্চয়ই মিলিত হয়েছে। আল্লার করুণার প্রতি কামালউদ্দিনের আস্থা হয়, আল্লাপাক এবার তার কান্নায় নিশ্চয়ই কান দেবে।

‘দাদা, একলা বইয়া কান্দেন?’ আকবরের মেয়েটা কাঁদো কাঁদো গলায় কথা বলতে বলতে তার পাশে দাঁড়ায়। কামালউদ্দিন ঠিক কাঁদছিলো না। নতুন পাঞ্জাবির ভেতর তার পিঠ ও ঘাড়ে খুব চুলকাচ্ছিলো। ফলে তার পক্ষাঘাতগ্রস্ত চোয়ালে নতুন ধরনের বিকৃতি ঘটায় তার চেহারা অমন কাঁদো কাঁদো দেখাচ্ছে। তার একটিমাত্র সচল হাতে ঘাড় চুলকাতে গিয়ে তার মুখের এই দশা। কেঁদে কেঁদে লাল চোখ খচিত মেয়েটির কালো ও মিষ্টি মুখের দিকে তাকিয়ে কামালউদ্দিনের বুক খাঁ খাঁ করে ওঠে। পিঠের অস্বস্তিটা তেমন টের পাওয়া যায় না। তার কথার কী জবাব দেবে ভাবতে না পেরে সে জিগ্যেস করে, ‘খাইচস? তর মায়ে খাইছে?’ কামালউদ্দিন আপন মনে বলেই চলে, ‘বহুত মানুষ খাইলো, না রে? তর বাপের লাইগা এতোগুলি মানুষে দোয়া করলো, আল্লায় শুনবো।’ কামালউদ্দিন তার মৃত পুত্রের প্রতি ঈর্ষা বোধ করে কি-না তার ভাঙাচোরা গলা থেকে তা ঠাহর করা কঠিন। তার আরো কিছু কথা শুনলে হয়তো অনুমান করা যেতো, কিন্তু তার আগেই পারভীন বলে, ‘দাদা, আম্মায় না কিছু খায় নাই।’

‘মানা আছে? হুজুরের মানা?’

‘না।’

‘তয় খায় নাই? কী হইছে?’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটু তেতো ও একটু ভীতু গলায় পারভীন বিড়বিড় করে, ‘চাচায় না আইজ আম্মারে বহুত শাসাইছে।’

কামালউদ্দিনের সচল, এমন কি নিমচল মুণ্ডু খাড়া হলো, ‘কী হইছে?’

‘চাচায় কয়, আম্মায় ফন্দি কইরা আব্বারে এই বাড়ি থন বাইর কইরা লইছে।’ বলতে বলতে পারভীনের গলা ধরে আসে, ‘চাচায় কয়, ‘তুমি আবার আমাগো কিয়ের ভাবী? ভাই তোমারে বিয়া করছে আমরা জানি নাকি?’ এই বাড়ির মইদ্যে নাকি আমাগো হিস্যা নাই।’

বুঝতে কামালউদ্দিনের ১ সেকেন্ড সময়ও লাগে না। এই নিয়ে বহুকাল ধরে বাড়িতে মেলা কথা চলে আসছে। আমজাদের এই কথাগুলো আসলে কামালউদ্দিনের নিজের উক্তি। আকবরকে তার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবার সংকল্প সে বহুবার ঘোষণা করেছে। কিন্তু আকবরের মৃত্যুর ৩ দিনের মধ্যেই তার সংকল্পটি আমজাদের মুখ থেকে প্রচারিত হওয়ায় সে ধান্দায় পড়ে। এই মুহূর্তে কিছু বলা তার সাধ্যে কুলায় না। কারণ পিঠ ও কাঁধের অস্বস্তি বাড়ছে খুব তাড়াতাড়ি।–রেডিমেড পাঞ্জাবি মানষে ক্যামনে পড়ে? তলার সাইডটা ঢিলা করছে তো পিঠটা এমুন টাইট কি মনে লয় গর্দানের লগে আঁকশি একখান ফিট কইরা টান মারতাছে। —চুলকাবার জন্য কামালউদ্দিন তার সচল বাম হাতটা ঘাড় ডিঙিয়ে পিঠে ঢোকাবার চেষ্টা করছে, বেশ কঠিন কাজ, এমন সময় আকবরের মেয়ের নরম আঙুলের মসৃণ গতি অনুভব করে, সঙ্গে সঙ্গে ফের মনে হয়, হায়রে মেয়েটা যে কার হাতে পড়ে! পারভীন এবার জিগ্যেস করে, ‘দাদা, চাচায় আমাগো থাকবার দিবো না?’ কামালউদ্দিন তার কী জানে? আমজাদ তার সাবালক ছেলে, তার ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা কামালউদ্দিন কী করে বলবে? ‘দাদা, মায়ে খালি কান্দে আর কয়, এতিম পোলাপান লইয়া আমি অহন কই যাই? দাদা, চাচার খালি এক কথা, ‘তুমি ভাইজানরে ফুসলইয়া বিয়া করছো, তারে এই বাড়িতে আগে পাঠাইয়া দিবার পারো নাই?’ আমজাদকে কামালউদ্দিন কী করে দোষ দেয়? এসব তো তারই কথা, তার কথা দিয়ে আমজাদ তার আকবরের বৌছেলেমেয়েদের পথে বসাবার আয়োজন করছে। আমজাদকে সে ঠেকায় কী করে? আমজাদ এখন মস্ত বড়ো মানুষ, এতো বড়ো পিরের মুরিদ, নামীদামি সব খানদানি মানুষ তার পিরভাই। এর সঙ্গে পেরে ওঠা কী আকবরের এতিম ছেলেমেয়ের পক্ষে অতো সোজা? আকবরের রুহের মাগফেরাতের জন্য আমজাদ কী বিরাট আয়োজন করেছে, তার ছেলেমেয়েদের সে যদি এখন বাড়ি থেকে বার করে দেয় তো কেউ কিছু বলতে পারবে না। —দুত্তোরি, এই দোজখের আগুন নতুন নতুন শিখায় জ্বলে উঠছে! কামালউদ্দিন বিরক্ত হয়, দূর, তার কী? আল্লা তার কথা শুনলে এই দোজখে তার আর কদ্দিনই বা মেয়াদ? তার কী? তার গোটা মাথা ঝিমঝিম করে, মাথাটাকে ভালো করে ঝাড়বার জন্য উঠানের দিকে তাকায়, দ্যাখে, উঠান থেকে সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে আসছে আকবরের মা। এইবার আকবরের মা তাকে আর কিছুতেই ছাড়বে না। তার শক্তির কোনো শেষ নাই। শরীরটা দুনিয়ায় ফেলে গেলে কী হয়, বেহেশতের আলোতে তার রুহের তেজ এখন শরীরের তুলনায় শতগুণ। অতো বড়ো ৫৫/৬০ বছরের বুড়ো ছেলেকে ৮ মাসের শিশুতে গড়িয়ে নিয়ে যে কি-না হাওয়া হয়ে যেতে পারে, কামালউদ্দিন তো তার কাছে এক ববিন সুতার সমান নয়। এতো সব লোকজনের ভেতর আকবরের মা তাকে আজ কী হেনস্তাটাই না করবে। এই তো এসে পড়লো বলে সিঁড়ির সবগুলো বাপ ডিঙানো শেষ করে আকবরের মা বারান্দায় উঠে পড়েছে, একটু কুঁজো হয়ে ধীরেসুস্থে এগিয়ে আসছে তার দিকে।

‘দাদা তোমার কাছে ক্যাঠায় জানি আছে। পারভীনের কথায় কামালউদ্দিন বুঝতে পারে যে আকবরের মা আজ সবাইকে জানান দিয়ে আসছে। তাহলে?–আঙুলে আর একটি সুই বিধলে কামালউদ্দিন তার জিভটিকে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, ঠিক আছে, কামালউদ্দিনও আজ পাল্টা নালিশ করবে। পারভীন তো সামনেই আছে। এই ছেলেমেয়েদের এতিম করে আকবরকে উঠিয়ে নিয়ে আকবরের মা খুব বাহাদুরির কাজ করলো, না? মরে গেলেই কি মানুষের মায়া মমতা বিবেচনাবোধ সব রসাতলে যায়? নিচের দিকে তাকিয়ে কামালউদ্দিন এইভাবে তৈরি হচ্ছে, এমন সময় শুনলো, ‘এইটা আকবরের মাইয়া, না?’ তার গলা একেবারে চেনা যাচ্ছে না, বুড়ি তবে কে?

হায়রে ছেমরি, তর দাদারে পছন্দ করছস?’ ঠাট্টার ধরন শুনেই কামালউদ্দিন ঠিক বুঝতে পারে।— হানিফের মা ভাবীর দিকে ভালো করে তাকিয়ে তার বুক মুচড়ে ওঠে, ভাবীর সঙ্গে কতোকাল পর দ্যাখা! হাজার কথায় তার গলা কানায় কানায় ভরে ওঠে, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোয় না। ভাবী, ভাবী, বলার জন্য সে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলো, কিন্তু তার জড়ানো জিভ একেবারে টাইট, কোনো কথাই বলতে পারে না, তার জবান কি চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেলো?

হানিফের মায়ের কথা বলার ভঙ্গি ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে, ‘তোমরা অহন বড়লোক হইয়া গেছো, কুনো খবর উপর কিছু দ্যাও না। আউজকা মিল থাইকা গিয়া হানিফে কয়, ‘অ মা, আকবর ভাই মইরা গেছে। আউজকা কুল পড়বো, আমজাদে যাইতে কইছে।’ তোমার কথা জিগাই তো কইতে পারলো না। আমি কই আকবরের বাপ কি আর আছে? কতোদিনের মানুষ, অহন কি আর বাঁইচা আছে?’ একটু ধরে আসা গলা সামলে নিয়ে হানিফের মা ফের ঠাট্টা করে, আইয়া দেহি, বারিন্দার মইদ্যে বইয়া নাতনীর লগে দিললাগি করো।’

কামালউদ্দিন ফের ইজি চেয়ারের ক্যানভাসে নাচার গতরটা এলিয়ে দেয়, তার বেঁচে থাকার খবরটা এরা হানিফের মা ভাবীকে জানায়নি পর্যন্ত। আকবর মারা গেছে, তাকে নিয়ে আজ আমজাদের মহফিল, বাপ মরলে আমজাদ না জানি কী বিরাট ওয়াজ মাহফিলের এন্তেজাম করবে।

আকবরের মেয়ে একটা মোড়া এনে দিলে হানিফের মা বেশ জাঁকিয়ে বসলো। কামালউদ্দিনের পাতলা চুলে পারভীন এখন আস্তে আস্তে বিলি কেটে দিচ্ছে। একনাগাড়ে অনেকগুলো বাক্য বলার পর হানিফের মা ভাবী এখন হঠাৎ চুপচাপ! কামালউদ্দিনের শীতল নীরবতায় ভাবী উসখুস করছে। একটু পর সে বলে, যাই, আমজাদে কারে যানি রিকশা ডাকতে কইলো, তোমারে দেইখা আমি আইলাম। তুমি অহন তরি বাঁইচাই আছো?’ কামালউদ্দিন তবু কথা বলতে পারে না। কী বলবে? আকবরের মা ছেলেমেয়ে দুজনকে তো আগেই খেদিয়ে খুব তারিয়ে তারিয়ে কিছুদিন পতিসেবা করলো, তারপর একদিন নিজেই বেশ সুড় ৎ করে কেটে পড়লো, কারো দিকে একবার তাকালো না পর্যন্ত। এটা তার কী ধরনের কাজ? আবার দ্যাখো, এক লোকমায় গিলে ফেললো বড়ো ছেলেটাকে। তার এতিমগুলো কি এখন পথে পথে ভিক্ষা করে বেড়াবে? এদের এখন দ্যাখাশোনা করে কে? এদিকে কামালউদ্দিনের দিকে দেখতে দেখতে হানিফের মায়ের বিস্ময় ক্রমাগত বাড়ে, উঠতে উঠতে সে ফের বলে, ‘তুমি অহন তরি বাঁইচাই আছো?’ তার সচল হাত দিয়ে তার মাথার ওপর বিলি কাটতে থাকা পারভীনের হাত ছোঁয়ার জন্য কামালউদ্দিন একটি ক্ষীণ প্রচেষ্টা চালায়! পারে না। পারভীন সামনে এগিয়ে এসে একটু ঝুঁকে জিগ্যেস করে, করে, ‘কী দাদা?’

পারভীনের একটি হাত তার সচল হাতের ভেতর নিয়ে কামালউদ্দিন বলে, ‘সিধা হইয়া খাড়া। নাতনীকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেবার জন্য তার হাতে সে একটু ঠেলাও দিলো। যাবার জন্য পা বাড়িয়ে হানিফের মা বলে, ‘খবর দিও। বাঁইচা আছে। একটা খবর ভি পাই না।’

‘বাঁচুম না ক্যালায়?’ কামালউদ্দিনের এই বিড়বিড় ধ্বনি ভালো করে শোনবার জন্য হানিফের মা ভাবী মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো। দ্যাখে ডান হাতে ধরা লাঠিতে ভর দিয়ে কামালউদ্দিন উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। পারভীন চট করে এগিয়ে না ধরলে সে ঠিক পড়েই যেতো। লাঠি এবং নাতনীর ওপর ভাঙাচোরা শরীরের ভার রেখে ডান দিকের গতর ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে সে রওয়ানা হলো নিজের ঘরের দিকে। ঠোঁট, জিভ ও গলার সচল, অচল ও নিমচল টুকরাগুলো জোড়াতালি দিয়ে কামালউদ্দিন একটি লালা-বলকানো হঙ্কার ছাড়ে, তর চাচারে কইস, দাদায় অহন তরি বাঁইচা আছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *